Sunday 20 February 2022

কোথা থেকে আসে জীব, কোথা চলে যায় ? ছান্দোগ্য উপনিষদ - ষষ্ঠ অধ্যায় (CHANDOGYA UPANISHAD 6TH CHAPTER)


ছান্দোগ্য উপনিষদ - ষষ্ঠ অধ্যায়  (CHANDOGYA UPANISHAD 6TH CHAPTER)

কোথা থেকে আসে জীব, কোথা চলে যায় ?  জীবাত্মা  বারবার, বহুবার জন্ম গ্রহণ করে, বারবার দেহে থেকে দেহান্তরে পরিভ্রমন  করে।  

ছান্দোগ্য উপনিষদে ঋষি উদ্দালক বলছেন " সর্বাঃ প্রজা সত আগম্য ন বিদুঃ সত আগচ্ছামহে ইতি" .  সমস্ত প্রজা অর্থাৎ জীবসকল, জানে না যে সে  সৎ অর্থাৎ ব্রহ্ম থেকে  এসেছে।"   

জীবকুল দুটো আশ্চার্য্য জিনিস নিয়ে দৌড়োচ্ছে। একটাকে সে ধরে রাখতে চাইছে, আর  একটাকে সে ছেড়ে দিতে চাইছে। কিন্তু ফল হচ্ছে উল্টো।  যাকে সে ধরে রাখতে চাইছে, তাকে ধরে রাখতে পারছে না। আর যাকে সে ছেড়ে দিতে চাইছে, তাকে সে ছাড়তে পারছে না। মানুষ জীবনকে ধরে রাখতে চাইছে, আর মৃত্যুকে কে ছেড়ে দিতে চাইছে। মানুষ সুখকে ধরে রাখতে চাইছে আর দুঃখকে ছেড়ে দিতে চাইছে। কিন্তু ফল হচ্ছে উল্টো, মানুষ মৃত্যুর কাছে হার স্বীকার করছে একদিন।  মানুষ দুঃখকে নিয়েই চলতে বাধ্য হচ্ছে। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার, যাকে  আমি চাইছি না, সে আমাকে ছাড়ছে  না, যাকে  আমি চাইছি সে আমার সাথে থাকছে না।     

 জীবন একটা যজ্ঞ। আমরা জানি মানুষের বেঁচে থাকবার প্রাথমিক শর্তই র হচ্ছে প্রাণের প্রবাহ, প্রাণশক্তি । কিন্তু আমাদের বাকশক্তি, শ্রবনশক্তি, এমনকি মনঃশক্তি সবাই গুরুত্ত্বপূর্ন।  আমাদের পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়। এছাড়া আছে মন যাকে  বলা হয় অন্তরিন্দ্রিয়। কেউ যদি জীবনে সাফল্য পেতে চান, মনুষ্য জীবনকে সার্থক করতে চান, অর্থাৎ  আধ্যাত্মিক উন্নতি করতে চান তবে তাকে  যজ্ঞ করতে হবে। আর এই যজ্ঞে, বাক হচ্ছে সমিধকাষ্ঠ। এইবাক্শক্তিকে প্রথমে প্রজ্জ্বলিত করতে হবে। বাকই পুরুষের শক্তি। এর পরে,  প্রাণ হচ্ছে এই যজ্ঞের ধুম।  অর্থাৎ অগ্নি থেকে যেমন ধুম নির্গত হয়, তেমনি মুখ দিয়ে (মৃত্যুকালে) প্রাণবায়ু নির্গত হয়। এরপরে, জিহ্বা হচ্ছে যজ্ঞের শিখা।  জিহ্বার রঙ লাল অগ্নিশিখার রঙও লাল। চক্ষু হচ্ছে অঙ্গার। কর্ন হচ্ছে স্ফুলিঙ্গ। আর অগ্নি হচ্ছে স্বয়ং নারী-মাতা । দেবগন এই অগ্নিরূপ নারীতে শুক্রের আহুতি দেন। সেই আহুতি থেকেই গর্ভ সঞ্চার হয়ে থাকে। জরায়ু দ্বারা আবৃত এই গর্ভ নয় মাস দশ দিন বা যতদিন আবশ্যক ততদিন মাতৃজঠরে বাস করার পরে জন্ম গ্রহণ করে থাকে। সন্তান জন্ম গ্রহণ ক'রে যতদিন আয়ু থাকে ততদিন সে জীবিত থাকে তারপর নির্দিষ্ট সময়ে কর্ম্মফল অনুযায়ী নির্দিষ্ট লোক লাভের  জন্য দেহ ত্যাগ করে থাকে। এর পরে দেহের অন্তেষ্টির জন্য, তাকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করা হয়, যে অগ্নি থেকে সে এসেছে। সেখানেই সতার  নির্বাণ প্রাপ্তি হয় । 

সৃষ্টির পূর্বে : একটা দিন ছিল, যেদিন আমি আপনি ছিলাম না। আবার এমন একদিন আসবে যেদিন আমি আপনি থাকবো না। এমনকি একটা দিন ছিল, যেদিন এই পৃথিবীতে কোনো প্রাণের সঞ্চার হয়নি। এমনকি পৃথিবীর আজকের যে আকার, সেই আকারেও পৃথিবী ছিলো না। এমনও হতে পারে, এমন একদিন ছিল, যেদিন পৃথিবীটাই ছিল না। তো যদি কিছু নাই থেকে থাকে তবে কোথা থেকে এলো এই সব ? এইসব কথা শুধু আমাদের কল্পনা নয়, এগুলো বৈজ্ঞানিক সত্য, যে একসময় প্রাণিকুল ছিল না, একসময় পৃবীটাই ছিল না। কিন্তু তাহলে তো প্রশ্ন জাগে এল  কোথা থেকে।  কিভাবেই বা এলো ? 

মহাত্মাগণ বলছেন, শূন্য থেকে কিছু সৃষ্টি হতে পারে না। এটা আমাদের অভিজ্ঞতা লব্ধ বাস্তব  জ্ঞানও বটে যে শূন্য থেকে কিছু সৃষ্টি হতে পারে না  । বেদান্ত বলছে, এই জগৎ আগেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে, কিন্তু এই আকারে ছিল না, আবার ভবিষ্যতে এই আকারে থাকবেও  না। বেদান্তের এই কথাটাও আমাদের বিশ্বাস করতেই  হয়, কেননা আজ যে জগতের আকার আমার চোখের সামনে ভাসছে, কাল সেই আকারে জগৎ ছিল না।  প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে জগতের আকার পাল্টাচ্ছে। আর আমরা সবাই এই ধারাবাহিক পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে পরিবর্তিত আকারে নিয়ে চলেছি। 

ছান্দোগ্য উপনিষদ বলছে, সেই সৎ-পুরুষ  সংকল্প করলেন, আমি বহু হবো। এর পরে তিনি তেজ সৃষ্টি করলেন, তেজ থেকে জল উৎপন্ন হলো। এখন কথা হচ্ছে এই সৎ-পুরুষ  কে ?  শাস্ত্র বলছে, এই সৎ-পুরুষ  হচ্ছেন  একটা অপরিবর্তনীয় অবিনাশী সত্ত্বা যার নাম দেওয়া হয়েছে ব্রহ্ম। তো ব্রহ্ম চিন্তা করলেন, সংকল্প করলেন, আমি বহু হবো। এর পর তেজ বা অগ্নির সৃষ্টি হলো। অগ্নি থেকে আবার জলের সৃষ্টি হলো। কিন্তু কথা হচ্ছে, ব্রহ্ম চিন্তা করলেন।  তো কে চিন্তা করতে পারে, যার মধ্যে চেতনা আছে। তাহলে কি ব্রহ্ম মানে একটা চেতন সত্ত্বা।  আবার  এই চেতন সত্ত্বা থেকে যা সৃষ্টি হলো অর্থাৎ তেজ বা জল এরা  তো চেতন সত্ত্বা নয়। উপনিষদ বলছে, ব্রহ্ম শুধু চেতন নয়, শুদ্ধ চৈতন্য। আর শুদ্ধ চৈতন্য থেকে যাকিছু এসেছে, সবই চেতনা সম্পন্ন। তাই অগ্নি, জল, অন্ন বা পৃথিবী সবই চেতনা সম্পন্ন। এই কথাটা আমাদের বোধগম্য নয়। অগ্নির মধ্যে, বা বায়ুর মধ্যে, পৃথিবীর মধ্যে চেতনা শক্তি আছে, এটা  আমাদের বোধের বাইরে। এই ব্যাপারে আমরা ধীরে ধীরে বুঝবার চেষ্টা করবো। 

যাইহোক,  প্রাণীর জন্মের  মধ্যে তিনটি প্রকার দেখতে পাওয়া যায় অর্থাৎ তিন ভাবে প্রাণীর জন্ম হয়ে থাকে। এক হচ্ছে বীজ থেকে অর্থাৎ উদ্ভিদ, দ্বিতীয়  হচ্ছে ডিম্ থেকে  অর্থাৎ অন্ডজ, আর একটা হচ্ছে  জীবজ অর্থাৎ মাতার জরায়ু থেকে। উপনিষদ একটা অদ্ভুত কথা বলছে।  বলছে, রূপ হচ্ছে তিন রঙের খেলা। লাল, সাদা, ও কালো। সাদা হচ্ছে জল, লাল হচ্ছে অগ্নি, আর কালো হচ্ছে প্রথিবী। এই তিন দেবতাকে বলা হয় মহাভূত। এখন ভূত বলতে  আমরা জানি, পাঁচটি। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। বাকি দুটো  আসলে মরুৎ হচ্ছে গতিশক্তি , আর ব্যোম হচ্ছে আশ্রয় স্থল । 

আমারা জানি, খাদ্যই আমাদের দেহ ও মনকে পুষ্টি যোগাচ্ছে। বেদান্ত এই দুটোকেই (দেহ-মন) জড়পদার্থ বলে থাকে। আমরা যে খাবার খাই, তা আমাদের শরীরে গিয়ে নানাভাবে শরীরকে পুষ্ট  করে থাকে। এরমধ্যে যে স্থূল অংশ আছে, তা আমাদের মল আকারে বাইরে বেরিয়ে যায়। সুক্ষ অংশ থেকে মাংস ইত্যাদি তৈরী হয়, আর সূক্ষ্মতম অংশ থেকে মন তৈরী হয়। মন কাজ করে হিতা নামক স্নায়ুতন্ত্রের ভেতর দিয়ে। তাই অন্ন বা খাদ্য ছাড়া আমরা কেউই  বাঁচতে পারি না। 

আবার জল যা আমরা গ্রহণ করছি,  তার স্থূলতম অংশ শরীরের বর্জ্য পদার্থকে বহন করে মূত্রের আকারে বেরিয়ে যাচ্ছে।  আর সূক্ষতম অংশ রক্তে পরিণত হচ্ছে। আর জলের সূক্ষ্মতর অংশ প্রাণ বা প্রাণবায়ুতে রূপান্তরিত হয়। তাই  জল ছাড়াও  আমরা বাঁচতে পারি না। 

আবার আমরা যখন তেজস্কর খাদ্য যেমন ঘি, মাখন ইত্যাদি খাবার খাই তা আমাদের শরীরে গিয়ে তিন ভাবে ভাগ হয়ে যায়।  স্থূল অংশ দিয়ে তৈরী হয় হাড়, মধ্যম অংশ  দিয়ে তৈরী হয় মজ্জা আর সূক্ষ্মতম অংশ দিয়ে তৈরী হয় আমাদের বাক। তো শরীর ও মন আমাদের খাদ্য দ্বারা পুষ্টি লাভ করে, প্রাণ বায়ুর দ্বারা পুষ্ট বা গতিশীল  হয়, এবং বাক পুষ্টি লাভ করে তেজের দ্বারা। 

উপনিষদে এই কথাগুলো একটা একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো হয়েছে। 

 আমরা জানি দধিকে যদি মন্থন করা হয়, তবে তার সূক্ষ্ম অংশ উপরে উঠে আসে যাকে  আমরা বলি মাখন।  ঠিক তেমনি খাদ্যের সূক্ষ্মতম অংশ যখন উপরে উঠে আসে, তখন তাকে বলা হয় মন। আবার আমরা যে জল পান করি, তার সূক্ষ্মতম অংশ উপরে উঠে আসে, তাকে বলা হয় প্রাণ। আবার আমরা যখন তেজস্কর পদার্থ খাই, তার সূক্ষতম অংশ উপরে উঠে আসে, তাকে বলা হয় বাক। 

 আমরা জানি মানুষের শরীরে ষোলোটি কলা আছে। খাবার না খেলে শরীরের ১৫টি  কলাই  স্তিমিত হয়ে যায়।   কেউ যদি আহার না করে, অথচ শুধু জল পান করে তবে তার সহজে প্রাণবিয়োগ হয় না ঠিকই  কিন্তু এইসময় শরীর ও মন স্তিমিত হয়ে যায়। এইসময় আমাদের কোনো কাজ করবার শক্তি এমনকি জ্ঞান সংগ্রহ করবার শক্তি থাকে না।  এইসময় যদি কাউকে বেদ অধ্যায়ন   করতে বলা হয়, তবে সে বলবে, আমার কিছুই মনে থাকছে না। কোনো কাজ করতে বললে, বলবে আমার শরীর কাজ করতে পারছে না। 

 দেখো, বিশাল প্রজ্বলিত অগ্নি থেকে  একখন্ড স্ফুলিঙ্গ নিয়ে তার দ্বারা কোনো বস্তু দাহ করা যায় না। কিন্তু যদি সেই অগ্নিতে আবার কিছু জ্বালানি দেওয়া হয়, তবে আবার সেই আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে। পনের দিন না খেয়ে থাকলে, অর্থাৎ শরীরে যদি ইন্ধন না দেওয়া হয়, তবে শরীর -মন কাজ করতে পারে না। কিন্তু যদি তুমি আবার আহার করো, তবে তোমার শরীর-মন আবার ক্রিয়াশক্তি ফিরে পাবে। এমনকি যে সামান্য অগ্নির স্ফুলিঙ্গ নিয়ে যে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করা হয়েছে, তা কিন্তু জ্বালানির প্রভাবে আগের থেকে বেশি শক্তিশালীও হয়ে উঠতে পারে। এবং আগের  থেকে আরো বেশি কাজও  করা যেতে পায়ে। 

তো ইন্ধন না জোগালে যেমন অগ্নি নিভে যায়, তেমনি শরীর-মনকে খাদ্য না দিলে শরীর মন কাজ করতে পারে না। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। 

এখন কথা হচ্ছে, সারা জীবন ধরেই আমরা খেয়েই চলেছি । কিন্তু পেটের  ক্ষিদে আমাদের মেটে  না। এমনকি শরীরও একটা বয়সের পড়ে যতই খাই না কেন, শরীর  আর  বাড়ছে না।  হয়তো সারা জীবনে আমরা  কয়েক হাজার কিলোগ্রাম খাদ্য খেয়েছি। কিন্তু আমার শরীর সেই ৬০/৬৫ কিলোর বেশি আর হলো কৈ ? আবার তৃষ্ণাও আমাদের মেটে না সারা জীবনে যে কত পরিমান জল খেয়েছি, তার হিসেবে কে রাখে ?  কিন্তু তথাপি ক্ষুধা তৃষ্ণার ফিরে ফিরে আসে। এর কারন কি ? এর কারন হচ্ছে, এই খাবার যেখান থেকে এসেছিলো, সেখানেই চলে গেছে। আগে যা খেয়েছি, জল সেসব বহন করে যথা স্থানে নিয়ে গেছে। আমরা যাকিছু খাবার খেয়েছি, তা মধ্যে থেকে সামান্যই এই শরীরে থাকছে, বাকিটা জল বহন করে নিয়ে যথা স্থানে রেখে দিচ্ছে। ফলে মানুষের আবার ক্ষুধা  পাচ্ছে। তো এই দেহ অন্ন-জল দ্বারা তৈরী। এর যে কোনো  এটিকে বাদ  দিলে আমাদের দেহ বিনষ্ট হয়ে যাবে। তো খাদ্য-জল হচ্ছে দেহের প্রধান  উৎস। আবার খাদ্যকে জল বহন করে যথাস্থানে নিয়ে বলেই আমাদের ক্ষুধা পায়। 

এখন কথা হচ্ছে, আমরা জানি মানুষের তৃষ্ণা পায়। অর্থাৎ আমাদের জল পান করতে হয়।   তো তৃষ্ণা কখন পায় ? মানুষের শরীরে যে জল ছিল তা যদি অগ্নি বা তেজ বহন  করে নিয়ে যায়, তবেই আমাদের তৃষ্ণা পায় । অর্থাৎ সে যে জল পান করেছিলো, তা যখন তেজ বহন করে যথা স্থানে নিয়ে যায়, তখন তার তৃষ্ণা পায় । 

তো খাদ্যকে  নিয়ে যাচ্ছে জল, আবার জলকে নিয়ে যাচ্ছে তেজ। তো এই তেজের উৎসে আমরা যদি যেতে পারি, তবে একটা সৎ বস্তুর সন্ধান পেতে পারি, আর সেই সৎ বস্তুকে আশ্রয় করেই স্থিত হচ্ছে  এই দেহ।

দেখুন, আমাদের যখন মৃত্যু হয়, তখন প্রথমে আমাদের খাদ্য গ্রহণের স্পৃহা কমে যায় আর ধীরে ধীরে আমাদের বাক শক্তি লোপ পায়, অর্থাৎ বাকশক্তি মনঃশক্তিতে লয় হয়ে হয়। বাকশক্তি মনের মধ্যে মিশে গেলেও, আমরা কথা বলতে না পারলেও, আমরা কিন্তু তখন চিন্তা অর্থাৎ মনের যা কাজ তা চলতে থাকে।  অর্থাৎ আমাদের তখনও চিন্তা শক্তির লোপ পায়  না। এইসময় মনে হয়, তিনি কিছু বলতে চাইছেন, কিন্তু বাকশক্তির স্বল্পতে হেতু, কিছুই বলতে পারছেন না। আবার, ধীরে ধীরে এই মনের ক্রিয়াও  একসময় থেমে  যায়। কিন্তু মন কার সঙ্গে লয় হয় ? মন প্রাণের সঙ্গে লয় হয়। অর্থাৎ বাকশক্তি ও মনঃশক্তির নাশ হলেও, মানুষের শ্বাস প্রশ্বাস চলতে থাকে। একসময় এই শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এই শ্বাসপ্রশ্বাস অর্থাৎ যার শক্তিতে আমাদের শরীরের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার দেখা যাচ্ছিলো, সেই প্রাণশক্তি কোথায় যায় ? সেই প্রাণশক্তি তখন তেজঃশক্তির সঙ্গে মিলিয়ে যায়। এই তেজশক্তি হচ্ছে আমাদের শরীরের উত্তাপ। আমরা জানি শরীর  যতক্ষন গরম থাকে ততক্ষন তাকে মৃত বলা যায় না। এইজন্য দেখবেন, মৃত্যু আসন্ন দেখলে, ডাক্তারবাবু এই তেজঃশক্তিকে ধরে রাখবার জন্য, কোরামিন ইনজেকশন দিয়ে থাকেন।, যাতে শরীরের উত্তাপশক্তি মিলিয়ে না যায়। শরীর ঠান্ডা হয়ে গেলে সব শেষ। অর্থাৎ তখন জীবাত্মা সেই সৎস্বরূপে অর্থাৎ নিজের সঙ্গেই   মিলিত হয়ে গেছেন। 

এখন কথা হচ্ছে, আমাদের মধ্যে ভিন্নতা কেন দেখা যায় ?  মৌমাছিরা গাছে গাছে ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ করছে। আমের মুকুল,  সর্ষের ফুল, গোলাপফুল, রজনীগন্ধা, শিউলি ফুল, সবার কাছ থেকে মধু সংগ্রহ করছে।    এই যে গাছ থেকে মধু বা রস যখন মৌমাছির চাকে সঞ্চয় হচ্ছে, তখন আর মধুর মধ্যে গাছের ভিন্নতা লক্ষিত হয় না। মধুর মধ্যে কোনো  পার্থক্য থাকে না।  অর্থাৎ একফোটা মধুর মধ্যে কোন্ কোন্ গাছের রস মিশ্রিত হয়ে আছে, তাকে আর আলাদা করা যায় না। মধুর মধ্যেও  পৃথক অস্তিত্ত্ব বোধ, আমি অমুক গাছের বা ফুলের রস, তুমি অমুক গাছের বা ফুলের রস, সেই বোধ  আর থাকে না। 

আমরা যখন নিদ্রামগ্ন থাকি, আমরা যখন স্বপ্নের জগতে থাকি, তখন আমরা না জানি কতকিছু দেখি, কতকিছু খাই, কতকিছু সংগ্রহ করি, কিন্তু নিদ্রা ভেঙে গেলেই আবার যে ভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সেই ভাবেই ফিরে আসি। একদিক  থেকে দেখতে গেলে, আমাদের মৃত্যু যেন গভীর  নিদ্রা, আমরা বার বার গভীর নিদ্রাতে মগ্ন থাকি, অর্থাৎ বারবার মারা যাই, আবার ফিরে ফিরে আসি, অর্থাৎ আবার জন্ম গ্রহণ করে থাকি। যদিও আত্মজ্ঞান লাভ হলে আমাদের আর পৃথিবীতে অর্থাৎ এই মৃত্যুপুরীতে আর ফিরে আসতে  হয় না। তবে কতজনেরই বা সেই সৌভাগ্য হয়ে থাকে। 

ঋষি উদ্দালক তার পুত্র/শিষ্য শ্বেতকেতুকে বলছেন, তুমিই সেই।  "তৎ ত্বম্ অসি".  উপনিষদের এই বাণী আমরা বহুবার শুনেছি। কিন্তু এই মহাবাক্যের উপলব্ধি আসে কৈ ? আসলে বহু দিনের সাধনার ফলে, বহু বছরের কঠোর সাধনার ফলে,  আমাদের  যখন চিত্ত শুদ্ধি হয়, যেদিন আমাদের মধ্যে থেকে অহংবুদ্ধি মুছে যায়, সেদিন আমাদের মনটা স্বচ্ছ হয়। তখন এই পরিষ্কার আয়নায় আমরা নিজেকে দেখতে পারি, আমরা বুঝতে পারি আমি কে। তখন এই ঋষিবাক্য "তৎ ত্বম্ অসি".কথার অর্থ ধরতে পারি। 

পাহাড় থেকে কত নদীর জন্ম হয়। সবাই একদিন সমুদ্রে মিশে যায়।  তার আর আলাদা   নাম বা রূপ বলে কিছুই থাকে না। সমুদ্রে লিন হয়ে যায়।  কিন্তু যতদিন না সে সমুদ্রে মিলিত না হচ্ছে, ততদিন তার নাম বা রূপ আলাদা আলাদাই  থাকে। কখনো গঙ্গা, কখনো যমুনা, কখনো সরস্বতী, নর্মদা, মহানন্দা ইত্যাদি ইত্যাদি। জীবাত্মা দেহ ছেড়ে চলে গেলে দেহের নাশ হয়, কিন্তু জীবাত্মার মৃত্যু হয় না। 

 ধরো তুমি কোনো একটা কাজ অসমাপ্ত  রেখে ঘুমিয়ে পড়েছো।  ঘুমের সময় তোমার সেই কাজটির কথা মনেই  ছিল না। কিন্তু ঘুম ভাঙার পরেই তোমার সেই কাজটির কথা আবার মনে পরবে । আর যেখানে কাজটি শেষ করেছিলে, তোমাকে সেখান থেকেই শুরু করতে হবে। তাই জীব সকল বারবার জন্মায়। তার কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য জন্মায়, বা অসমাপ্ত কাজ শেষ করবার জন্য ।  আবার সে নতুন কর্ম্মফল  সঞ্চয় করে দেহত্যাগ করে।  কিন্তু আত্মার কোনো পরিবর্তন হয় না। 

দেখো বীজের মধ্যেই আছে সেই বিশাল বৃক্ষ ।  কিন্তু সেই বীজের মধ্যে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সেই গাছ তুমি খুঁজে পাবে না। ঋষি উদ্দালক পুত্র শ্বেতকেতুকে বলছেন, আমার কথায় তুমি শ্রদ্ধাবান হও আর বিশ্বাস করো যে তোমার মধ্যেই আছে ঈশ্বররূপ বীজ অর্থাৎ জীবাত্মা। শরীরের মধ্যে তন্ন তন্ন করে খুঁজে কিন্তু আমরা এই জীবাত্মাকে খুঁজে পাবো না। তথাপি জানবে তোমার মধ্যেই সেই জীবাত্মা অবস্থান করছেন। এখন কথা হচ্ছে, তাহলে আমরা কিভাবে সেই জীবাত্মাকে খুঁজে পাবো ? মহাত্মাগণ বলছেন, আত্মাই একমাত্র সত্য। এই ধ্রুববাক্যকে আগে দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করো। মনের মধ্যে গেঁথে নাও, যে আত্মাই একমাত্র সত্য। এবার মনকে এই ভাবনার মধ্যে সংযম করো। সংযত মনে তখন সত্য নিজেকে প্রকাশ করবে।  শাস্ত্রের সূক্ষ্মতত্ত্ব তখন তোমার কাছে ধরা পড়বে। আমরা যখন আন্তরিকভাবে কোনো বিষয়ে আগ্রহী হই , যখন আন্তরিকভাবে কোনো কিছুতে জানতে চাই, তখন মনটা বিভিন্ন দিকে ছোটাছুটি না করে, সেই বিষয়ের দিকে ধাবিত হয়। 

সমস্ত কিছুর মধ্যে যে সূক্ষ্ম তত্ত্ব তাকেই বলে আত্মতত্ত্ব। আবার এই সূক্ষ্ম তত্ত্ব-ই আত্মা। 

উদ্দালক বলছেন, একখন্ড লবন জলে রেখে দাও। এবার অপেক্ষা করো। এবার জল থেকে লবণকে তুলে নিয়ে এসো।  শ্বেতকেতু জলের মধ্যে লবণকে খুঁজে পেলেন না।  উদ্দালক বললেন, জল  পান করো।  কেমন লাগছে ? শ্বেতকেতু বললেন, লবনাক্ত। তো দেখো, জলের মধ্যে লবনের অস্তিত্ত্ব খুঁজে না পেলেও, তুমি জানো  যে জলের মধ্যে লবন আছে।  তেমনি শরীরের মধ্যে আত্মাকে খুঁজে না পেলেও জানবে আত্মা আছে। এখন কথা হচ্ছে, জলের লবনাক্ত ভাব আমাদের জিভ  টের পায়। তাই তুমি এটাকে সহজে বিশ্বাস করতে পারছো, যে জলের মধ্যে লবন আছে। কিন্তু আত্মা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, তাই ইন্দ্রিয়শক্তি দিয়ে, একে  উপলব্ধি করতে পারবে না। আমাদের ইন্দ্রিয়শক্তির একটা সিমাবদ্ধতা আছে। ইন্দ্রিয়ক্ষমতা আত্মার অস্তিত্ত্ব সম্পর্কে কোনো উপলব্ধি দিতে পারে না।  

এই আত্মাকে জানতে গেলে আমাদের আপেক্ষিক জগতের উর্দ্ধে উঠতে হবে। আমরা অজ্ঞ আমরা অন্ধ এই আপেক্ষিক জগৎ সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা  নেই। এইজন্য দরকার এমন একজন ঋষিপুরুষ যাঁর  এই আপেক্ষিক জগতের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, সেই ঋষিপুরুষ আমরা পাবো কি করে ? কোথায় পাবো তার সন্ধান ? আর এই মহাপুরুষ কেমন করে আমাদের সেই জগতের সন্ধান দেবেন ? 

উপনিষদ বলছে, কর্ম্মফল, আমাদের প্রারব্ধ কর্ম্মফল এই সুযোগ এনে দিতে পারে। আমাদের প্রারব্ধ কর্ম্মই আমাদের তাঁর কাছে টেনে নিতে পারে। এই ঈশ্বরপুরুষগন সর্বদা অপরের কল্যাণের জন্য বা লোক-হিতার্থে কর্ম্মে লিপ্ত থাকেন।  ঠাকুর রামকৃষ্ণের কাছে সে-যুগের সবাই যেতে পারেনি।  যারা গিয়েছিলেন, তারাও  সবাই যে তাঁকে চিনতে পেরেছিলেন, এমন কথা বলা যায় না। শ্রীকৃষ্ণকে সেযুগের সবাই চিনতে পারেন নি। গুটিকয় মানুষই তাঁকে চিনতে পেরেছিলেন। আজও শোনা  যায়, নর্মদার তীরে, পাহাড়ের জঙ্গলে, অনেক মহাপুরুষ আছেন, যাদের কাজই হচ্ছে লোক কল্যাণ। 

যাইহোক, আমরা আগেই শুনেছি, আত্মা থেকে তেজ, তেজ থেকে প্রাণ, প্রাণ থেকে মন, আর মন থেকে বাকের উৎপন্ন হয়েছে। আবার এগুলো বিপরীত মুখী হয়ে অর্থাৎ বাকশক্তি মনের মধ্যে, মনঃশক্তি প্রাণে, প্রাণশক্তি তেজে, তেজঃশক্তি আত্মাতে ফিরে যায়। এই হচ্ছে জন্ম মৃত্যুর চক্র। 

আমরা একজন মরণাপন্ন মানুষের গতি দেখলেই বুঝতে পারবো, যখন  সে রোগগ্রস্থ হয়, তখন সে শরীরের যে ইন্ধন অর্থাৎ অন্ন গ্রহণ করতে অনীহা প্রকাশ করে, অথবা অন্ন গ্রহণে অপারগ হয়ে যায়। পাশে কোনো আত্মীয়স্বজন থাকলে তাকে চিনতে পারে না, কথা বলতে পারে না, শেষে শরীর ঠান্ডা হতে শুরু করে। একসময় আত্মা দেহ ছেড়ে অনন্তের পথে যাত্রা  করে। বাসনা পূরণের জন্য, সংকল্প পূরণের জন্য, আমাদের দেহের দরকার পড়ে।  কিন্তু প্রকৃতির নিয়মে যখন শরীর অকেজো হয়ে যায়, বাসনা পূরণের অযোগ্য হয়ে যায়, অথবা আমাদের বাসনার পূরণ হয়ে যায়, তখন আমরা দেহ ছেড়ে নিজভূমিতে চলে যাই। 

সবশেষে একটা কথা বলি, বুঝুন আর না বুঝুন, উপলব্ধি করতে পারেন আর না পারেন, ভারতের মুনি-ঋষিদের এই কথাটা শুধু বিশ্বাস করুন যে আমরা সবাই মূলতঃ এক সেই আত্মা, আমরা কেউ আত্মা থেকে ভিন্ন নোই।  আমাদের সবার মধ্যেই সেই একই আত্মা বিরাজ করছেন।  শুধু এই চিন্তাই করতে থাকুন, এই কথাটার মনন করতে থাকুন, দেখবেন একসময় আপনার জীবনে একটা আমূল পরিবর্তন হয়ে যাবে। তখন সবার প্রতি একটা গভীর ভালোবাসা জাগ্রত হবে, সবাইকে ক্ষমা করতে কোনো দ্বিধা আসবে না, কারুর প্রতি কোনো রাগ, দ্বেষ হিংসা থাকবে না। দুদিনের এই জীবন - এতো স্বপ্ন বই কিঁছু নয়। এই  স্বপ্নের ঘোর কেটে গেলে আমরা সেই পরমাত্মাতেই ফিরে যাবো। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।          

 মানুষের আসা যাওয়া  

 


  

      


  












No comments:

Post a Comment