Wednesday 2 February 2022

যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - তৃতীয় অধ্যায় - কর্ম্মযোগঃ

 

যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - তৃতীয় অধ্যায়  - কর্ম্মযোগঃ      
১৩.০১.২০২২

ওঁং নারায়নং নমস্কৃত্য  নরঞ্চৈব নরোত্তমম
দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততো জয়মুদীরয়েৎ ওঁং
   
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - তৃতীয় অধ্যায়  - কর্ম্মযোগঃ      
শ্লোক নং ৩/১-৩/২

অর্জ্জুন উবাচ : 
জ্য়ায়সী চেৎ কর্ম্মণস্তে মতা বুদ্ধিঃ জনার্দ্দন 
তৎ কিং কর্ম্মণি ঘোরে মাং নিয়োজয়সি কেশব। (৩/১) 

অর্জ্জুন বললেন, হে জনার্দ্দন, যদি তোমার মতে কর্ম্ম হতে বুদ্ধি শ্রেষ্ট, তবে হে কেশব, তুমি আমাকে হিংসাত্মক কর্ম্মে কেন নিযুক্ত করছো ? 

ব্যামিশ্রেণ-ইব বাক্যেন বুদ্ধিং মোহয়সীব  মে  
তদেকং বদ নিশ্চিত্য যেন শ্রেয়-অহম-আপ্নুয়াম।  (৩/২)

(হে কেশব,)  বিমিশ্র বাক্যের দ্বারা আমাকে কেন বিভ্রান্ত করছো ?  যার দ্বারা আমার নিশ্চিত শ্রেয়লাভ হয়, সেই পথটি আমাকে নিশ্চিত করে বলো। 

উপরোক্ত দুটো শ্লোকের অর্থ বুঝতে গেলে, আমাদের একটু পিছনের দিকে তাকাতে হবে। এক যোগীপুরুষের পুত্র  অল্পবয়সী জিজ্ঞাসু,  পিতার বন্ধু আর এক যোগীপুরুষের কাছে গেছেন। সে যোগের ভালো-মন্দ জানতে চায়, যোগ কিভাবে করে, কেনই বা করে, ইত্যাদি নানান প্রশ্ন। তো যোগগুরু, যোগের ভালো-মন্দ সম্পর্কে অনেক কথা বললেন, যোগের ঐশ্বর্যের কথা বললেন। কিন্তু যোগের ক্রিয়াপদ্ধতির গুহ্যকথা বললেন না। বললেন, দেখো বাবা যোগের ক্রিয়া-পদ্ধতির কথা মুখে বলে তো তোমাকে বোঝানো যাবে না।  তুমি আশ্রমে কিছুদিন থাকো, ব্রহ্মচারীদের যোগক্রিয়া প্রথমে দেখো, তাহলে হয়তো তোমার একটা ধারণা  হতে পারে। আর একটা কথা শোনো ভরাপেটে যোগ করা যায় না। তুমি যা খেয়েছো, সেগুলো আগে যতক্ষন তোমার পেট থেকে বের না হচ্ছে, ততক্ষন তোমার যোগাভ্যাস করা হবে না। অর্থাৎ , তোমার পূর্বার্জিত যে সাংসারিক জ্ঞান আছে, সেগুলোকে আগে ত্যাগ করতে হবে।  তুমি কিছুদিন এখানে থেকে ব্রহ্মচারীদের জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেকে মেলানোর চেষ্টা করো। তো জিজ্ঞাসু কিছুদিন সেখানে থেকে ব্রহ্মচারীদের দেখতে লাগলো। এঁরা  খুব ভোর ঘুম থেকে উঠে আসন-প্রাণায়াম, নেতি, ধৌতি, বস্তিক্রিয়া ইত্যাদি অভ্যাস করে। দিনের বেলা মাধুকরীতে বেরুনো, ইত্যাদি ইত্যাদি করে, গভীর রাতে ধ্যানস্থ হয়ে বসে থাকেন । তো শীতকালের ভোরবেলা ওঠা,  ঘুম থেকে উঠে আসন-প্রাণায়াম, নেতি, ধৌতি, বস্তিক্রিয়া ইত্যাদি অভ্যাস করা, আবার মাধুকরী করা, ইত্যাদি ব্যাপারটা তার খুব একটা ভালো লাগলো না। বিশেষ করে মাধুকরী করা তার পক্ষে একদমই সম্ভব নয়। ও বললো, আমার কাছে অনেক টাকা-পয়সা আছে, মাধুকরী করে জীবনধারণ করার দরকার কি ? আর আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ভগবানকে লাভ তো রাতের দিকে সরাসরি  ঈশ্বরের ধ্যান করলেই তো হবে। আমি তাই করবো। এইসব শারীরিক ক্রিয়া করে কি হবে ? এতে আরো শারীরিক ক্ষতি হবার সম্ভব আছে।  

এবার আমরা অর্জ্জুনের কথায় আসি। অর্জ্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে আসবার আগে একরকম ছিলো। তখন যুদ্ধ সম্পর্কে তার আগ্রহের কোনো ঘাটতি দেখা যায়নি।   কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে এসে, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব, গুরুদেব, গুরুজন ইত্যাদিদের দেখে, তার মধ্যে স্নেহ-মমতা ইত্যাদি কমনীয় গুনে উদয়  হলো। এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো, এদের সাথে যুদ্ধ সে কিছুতেই করতে পারে না, এই যুদ্ধ একটা নিধনযজ্ঞ।  এতে করে কারুর লাভ হতে পরে না। না পান্ডব পক্ষের, না কৌরব পক্ষের। এমনকি তার নিজের জীবনের ঝুঁকিও আছে।  এই অবস্থায়, কাছে সখা শ্রীকৃষ্ণকে পেয়ে, তাকেই বোঝাতে লাগলো, 

যুদ্ধে স্বজনদের নিহত করবার মধ্যে আমি কোনো মঙ্গল দেখতে পাচ্ছি না (১/৩৫) 
বলছেন, হায়, এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে আমরা বুদ্ধিমান হয়েও, যুদ্ধের মতো ভয়ানক পাপ করতে চলেছি (১/৪৪) । 
আবার বলছেন, যুদ্ধ করার চেয়ে ভিক্ষান্ন ভোজন করাকেও আমি শ্রেয় বলে মনে করি (২/৫) ।
এবং সবশেষে বললেন, আমি যুদ্ধ করবো না (২/৯) . 
এই বলে ধনুর্বান ছেড়ে দিয়ে রথের উপরে বসে পড়লেন। 

সাধন-সমরে এসে যখন আমরা বুঝতে পারি, যে আমাদের হাজার বছরের পুরাতন প্রবৃত্তির সঙ্গে লড়াই করতে হবে, যখন আমরা দেখি, যারা আমাকে রস-আস্বাদন করিয়েছে, যারা আমাদের দৃষ্টি নন্দনের কারন, যারা আমার শ্রুতির মধুরতা এনে দিয়েছে, মাদকতার স্পর্শ দিয়েছে, সেই ইন্দ্রিয়সকলের  সঙ্গে যুদ্ধে করতে  হতে হবে, তখন মন বেঁকে বসে।  মন কিছুতেই এই জন্ম-জন্মান্তরের সাথীদের (প্রবৃত্তি)  হারাতে চায় না। এই আশঙ্কায়, সাধক প্রবৃত্তির  সাথে একাত্ম বোধ করে। এবং সাধন-সমর  থেকে সরে আসতে  চায়।    

কিন্তু সৎগুরু, যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ  বোঝাতে চেষ্টা করলেন, 
কর্ম্ম করাতেই তোমার অধিকার, ফলে নয় ( ২/৪৭)
যোগস্থ হয়ে কর্ম্ম করো (২/৪৮)
সকাম কর্ম্ম বুদ্ধিযোগের থেকে অনেক তুচ্ছ (২/৪৯)
তুমি সমবুদ্ধির আশ্রয় গ্রহণ করো, কর্ম্মের কুশলই যোগ  (২/৫০) ইত্যাদি-ইত্যাদি 

দেখুন, একবার যদি আপনি ভাগ্যক্রমে যোগগুরুর কাছে এসে পড়েন, আর আপনাকে যদি যোগগুরু যোগ্যপাত্র মনে  করেন, যোগ্য অধিকারী মনে করেন,  তবে কিন্তু  আপনার কপালে দুঃখ আছে, আপনার পুরাতন মানুষটার মৃত্যু হবে, আর নতুন মানুষের জন্ম হবে।   অর্থাৎ গুরুদেব আপনাকে কিছুতেই ছাড়তে চাইবেন না, আপনাকে মেরে ফেলবে । বিজয় গোস্বামী না চাইলেও, ত্রৈলঙ্গ স্বামী তাকে দীক্ষিত করেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দকে পওহারীবাবা দীক্ষার পথে প্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তো অর্জুন এখন যোগেশ্বরের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের হাতে পড়েছে, তার  এখন  যোগাশ্রম থেকে বেরুনো কঠিন থেকে কঠিনতর।  অর্জুন এখন সাধন সমরে দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে অর্জুন বিভ্রান্ত হয়ে বেরিয়ে যেতে চাইলেও,  গুরুদেব  ছাড়বেন না। তো কিভাবে তিনি অর্জ্জুনকে আশ্রয় দেন।  আমরা সেইসব কথা শুনব।
অর্জুনের মনে নানান প্রশ্ন : 
বলছেন, হে জনার্দ্দন (অর্থাৎ যিনি সবার মনস্কামনা পূরণ করেন) যদি কর্ম্ম থেকে জ্ঞান শ্রেষ্ট তবে হে কেশব  (যিনি অনন্ত শয়নে শবাকারে ভাসমান ছিলেন।  ব্রহ্মা-বিষ্ণু-রুদ্রদেব যার অধীন।)  আমাকে কেন, এই হিংসাত্মক কর্ম্মে নিযুক্ত করছো ?

যদি ক্রিয়ার উচ্চ অবস্থায় থাকা ভালো, তবে এই যম-নিয়ম ইত্যাদি পালনের দরকার  কি ? ক্রিয়ার পরাবস্থা লাভই সাধনের উদ্দেশ্য।  এই অবস্থাতেই মন শান্ত ও নিশ্চিন্ত হয়ে যায়।  সাধকের মধ্যে প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হয়।  তাই এটাই যদি কাম্য, বা প্রার্থনীয় তবে নিশ্চিন্তে কূটস্থে স্থির হয়ে চুপচাপ বসে থাকি না কেন ? তবে আর এসব প্রাথমিক ক্রিয়া অর্থাৎ যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, এগুলো অনেকবেশি কষ্টসাধ্য,  তো এই ব্যাপারে মধ্যে নিযুক্ত হওয়া কেন ?   ইন্দ্রিয় সংযম করো, মূলাধার থেকে আজ্ঞাচক্র পর্যন্ত প্রাণকে ওঠাও, আবার নামাও, ইত্যাদি কাজ তো সহজ সাধ্য নয়, আর এই সব কর্ম্ম অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গুলোকে নিষ্ক্রিয় করা, মনকে নিষ্ক্রিয় করা, সমস্ত প্রবৃত্তিকে নিষ্ক্রিয় করা, এসব করতে গিয়ে আখেরে কি লাভ হবে?  এতে করে মনে হয়, মনের বিক্ষিপ্ততা চঞ্চল্যতা আরো বৃদ্ধি পাবে। এমনকি শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে।  তার  চেয়ে সোজা ধ্যানে  বসে থাকি, কাজ-কর্ম্ম কিছুই করতে হলো না। আর ভগবানের শরণ নিয়েছি বলে, ভগবান আমাকে রক্ষা করবেন। আমাদের মধ্যে অনেকেই ধ্যানের আশ্চর্য্য  উপকারিতার কথা   শুনে, সরাসরি ধ্যানে অভ্যস্ত হতে চায়। কিন্তু ধ্যান হচ্ছে নিষ্ক্রিয় অবস্থা। ধ্যানের আগে প্রস্তুতি দরকার।  সেসব না করলে  ধ্যান হয় না। 

একবার অষ্টাঙ্গ যোগের উচ্চাবস্থার প্রশংসা, একবার ক্রিয়ার প্রাথমিক অবস্থার গুরুত্ত্ব - এতে করে,  বিভ্রান্ত হয়ে যায় সাধক। একবার ক্রিয়ার প্রসংশা, একবার স্থীতপ্রজ্ঞের প্রসংশা ভগবানের এইসব কথায় বিভ্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক। আসলে ক্রিয়া করা আর ক্রিয়ার উচ্চবস্থায় নিষ্ক্রিয় হয়ে অবস্থান করা,এদুটোর মধ্যে নিজের ইচ্ছেমতো একটা বেছে নেওয়া সাধকের উপরে নির্ভর করে না। এগুলো এক-একটা সোপান যা এক-একটি করেই পার হতে হয়। কিন্তু মন ছোটে নির্ঝঞ্ঝাট হয়ে নিশ্চুপ সমাধিররূপ বিশ্রামের দিকে। সাধনক্রিয়ার অভ্যাস করার চেয়ে স্থির হয়ে ধ্যানের নামে বসে থাকাটাই সাধকের কাছে শ্রেয় ও সহজ বলে মনে হয়। এখন গুরুদেবের অনুমতি পেলে সমস্ত ক্রিয়াকর্ম্ম  ছেড়ে চুপচাপ বসে থাকার আয়োজন করতে পারলে ভালো হয়। এই হচ্ছে সাধকের মনের কথা। আসলে সবাই আমরা সাফল্যটা দেখি।  সফল মানুষের জীবন যাত্রায় নিজে অভ্যস্ত করতে ইচ্ছে হয়, ভালো লাগে।  কিন্তু সফল মানুষ একদিনে সফল হন নি।  তার অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার ইতিহাস আছে, সেই কথা আমরা জানতে চাই না। সেই কাজও আমরা করতে চাই না। 

একটু বিচারশীল ও তৎপর সাধকের এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক, যে দুটো আলাদা পথ, যেকোনো একটা ধরলেই লক্ষে পৌঁছনো যায়। আসলে জ্ঞান বিহীন কর্ম্ম নিষ্ফলা।  আবার কর্ম্মহীন জ্ঞান কোনো কাজে লাগে না। কর্ম্ম ও জ্ঞান আমাদের দুটো পা, দুটো হাত ।  চলার পথে এই দুটোকেই কাজে লাগাতে হয়। মোক্ষমার্গে যেতে গেলেও আমাদের জ্ঞান ও কর্ম্ম দুটোরই প্রয়োজন।  সুতরাং দুটো আলাদা পথ নয়, একই গাড়ির দুটো চাকা। আর এই কারণেই যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উভয়েরই প্রসংসা করছেন। অর্জুনকে দ্বন্দ্বের মধ্যে বা মোহের মধ্যে ফেলবার জন্য বলেননি। আসলে আমাদের বুদ্ধির স্বল্পতা হেতু, এবং আমাদের সহজে সবকিছু পাবার প্রবৃত্তি থেকে আমাদের মধ্যে মোহ-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। আর এইগুলো আমাদের পূর্বপূর্ব জীবনের সংস্কার থেকেই এসে থাকে। আমাদের আত্মবিস্মৃতির জন্য এই মোহের জালে আমরা আবদ্ধ হই ।  কিন্তু গুরুদেবের কৃপাদৃষ্টি যার দিকে আছে, তাকে-তো বিভ্রান্ত হলে চলবে না।
---------------------                                                                                                                                                                              ১৪.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - তৃতীয় অধ্যায়  - কর্ম্মযোগঃ      
শ্লোক নং ৩/৩-৩/৫
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                      
শ্রী ভগবান উবাচ : 
লোকে অস্মিন দ্বিবিধা নিষ্ঠা পুরা প্রোক্তা ময়ানঘ
জ্ঞানযোগেন সাংখ্যানাং  কর্ম্মযোগেন যোগিনাম  (৩/৩)

শ্রী ভগবান বললেন, হে অনঘ দুই প্রকার নিষ্ঠা আছে, একথা আগেই বলেছি। যোগীর   জন্য কর্ম্মযোগ, আর সাংখ্যদর্শীর   জন্য জ্ঞানযোগ। 
এখানে অর্জুনকে অনঘ বলে সম্ভাষণ করা হচ্ছে।  অনঘ কথাটার অর্থ হচ্ছে নিষ্পাপ। শিশু যেমন নিজের ভালো বোঝে না, কিন্তু মনের মধ্যে কোনো পাপবোধ নেই, আর তার প্রশ্নেরও শেষ নেই। শিশু বোঝে কম কিন্তু বুঝতে চায়।  তাই অর্জুনরূপ নিষ্পাপ শিশু  বারবার প্রশ্ন করে সে গুরুরুপী  শ্রীকৃষ্ণকে  বিব্রত করে তোলে।   

দুই রকমের স্থিতি একটা দেখে শুনে নিজবোধে স্থিতি আর একটা ক্রিয়া করে আপনাতে আপনার স্থিতি। এই যে স্থিতি তা দুইরকম সাধনের  দ্বারা লাভ করা যায়। একটা হচ্ছে প্রাণায়াম ইত্যাদি ক্রিয়ার  দ্বারা সম্পন্ন হতে পারে।  আর একটা হচ্ছে প্রণব বা ধ্বনির  দ্বারা যে সাধনা হয়ে থাকে। একটা হচ্ছে প্রাণের সাধনা আর একটা হচ্ছে শব্দের সাধনা। প্রাণের সাধনাকে বলা হয় ক্রিয়া যোগ। আর শব্দের সাধনাকে বলা হয় জ্ঞানযোগ। উভয় সাধনাতেই ব্রাহ্মীস্থিত লাভ হতে পারে । 

প্রথম সাধনাটি কর্ম্ম-যোগ : প্রাণের সঙ্গে মনকে রেখে কাজ করা। সদ্গুরুর দ্বারা উপাদিষ্ট হয়ে, সুষুম্নামার্গের ছয় চক্রের মধ্যে প্রাণকে নিয়ে গিয়ে তাতে মন রেখে এই কাজ করতে হয়।  এতে করে প্রাণ স্থির হয়ে মনকে নিয়ে ব্রহ্মাকাশে ব্রহ্মের সাথে এক হয়ে যায় । সুষুম্না নাড়ী নির্মল  না হলে, বায়ুকে উদ্দীপ্ত না করতে পারলে, এই সাধনায় সিদ্ধি আসে না। প্রাণায়াম ইত্যাদির দ্বারা সুষুম্নামার্গের মধ্যে প্রাণ প্রবিষ্ট হলে এই কাজে সাফল্য আসে। তখন বাহ্য বিষয়ের জ্ঞান লোপ পায়।  জগৎ এমনকি নিজেকে ভুলে যাওয়া যায়। একসময় এই প্রাণ মাথায় অর্থাৎ সহস্রারে চেপে বসে এবং সেখানে এই প্রাণবায়ু আটকে যায়, তখন নিবৃত্তিরূপ শান্তির উদয় হয়। সাধকের সংসারদুঃখ চিরদিনের তরে দূর হয়ে যায়। 

দ্বিতীয় সাধন-প্রক্রিয়াতেও এই সুষুম্নাকেই অবলম্বন করে এগুতে হয়। সাধক যখন নাদের মধ্যে ডুবে যায়, তখন অপূর্ব আলোকজ্যোতির প্রকাশ ঘটে।  এবং এই জ্যোতির্বিন্দুর মধ্যে নাদ-কলার প্রতক্ষ্য অনুভব হয়। সেই নাদবিন্দু ভেদ করে অদৃষ্টপূর্ব দর্শন হতে থাকে। সাধকের অনেক অভূতপূর্ব বিষয়, জ্ঞানের গোচর হয়।  চিদাকাশে অবস্থান করে মহাসিদ্ধি লাভ করে সাধক। এইসময় বহু প্রকার দর্শন-শ্রবণ সাধককে পরমানন্দে মগ্ন করে দেয়। 

ব্রহ্মাকাশে মিলিত হবার এই দুই পথ। প্রথমমার্গ  থেকে দ্বিতীয়মার্গে আসতে  গেলে কর্ম্মযোগের আবশ্যক।  অর্থাৎ প্রাণায়াম দ্বারা প্রাণবায়ুকে স্থির করতে হবে।  প্রাণবায়ু স্থির না হলে, মন স্থির হতে পারে না।  মন স্থির না হলে মন বাইরের বিষয়ের দিকে ছুটবে। এবং সেখানেই অবস্থান করতে চাইবে।  যদিও দুটো পথই সেইএক  ব্রহ্মে মিলিত হবার পথ কিন্তু যাদের বিষয় কামনা আছে, অর্থাৎ মন-প্রাণ স্থির হয়নি, তাদের মন-প্রাণের গতি স্থির করে তারপরে দ্বিতীয় পথের অবলম্বন করতে হয়। প্রাণায়ামের দ্বারা নাড়ীশুদ্ধি হয়,  অন্তঃশুদ্ধি হয়, আর দ্বিতীয় পথে আত্মদর্শন বা আত্মজ্ঞান হয়। মনের এই নিশ্চল অবস্থা না আসলে, কোনো সিদ্ধিলাভই  সম্ভব নয়। বাইরের শ্বেতবস্ত্র বা গেরুয়াবস্ত্র, এমকি ক্ষনিকের বৈরাগ্য, বাইরের জ্ঞান, ইত্যাদি কোনো কাজেই  আসে না।  

ন কর্ম্মনাম-অনারম্ভাৎ-নৈষ্কর্ন্ম্যং পুরুষঃ-অশ্নুতে 
ন চ সংন্যসনাৎ-এব চ সিদ্ধিং সমধি গচ্ছতি। (৩/৪) 

কর্ম্ম না করে কেউ নৈষ্কর্ন্ম্যের অবস্থা লাভ করতে পারে না।  আবার কর্ম্ম ত্যাগ করলেই সিদ্ধিলাভ করা যায় না।

প্রথমে ক্রিয়া তারপরে সৎ-পুরুষে স্থিতি, অর্থাৎ প্রথমে ক্রিয়া তারপরে ক্রিয়ারহিত হয়ে ব্রহ্মে স্থিতি। সমস্ত বিষয়-রহিত বা ইছা-রহিত অবস্থা না হলে সিদ্ধিলাভ  সম্ভব নয়। ইচ্ছারহিত হলেই সিদ্ধি। সিদ্ধি  হলে মনের সামগ্রিক তৃপ্তি, আর তৃপ্ত-মনই  ইচ্ছা -রহিত হতে পরে। নতুবা সবই লোকদেখানো ব্যাপার। 

শাস্ত্র বলছে, ব্রহ্মজ্ঞানের জন্য সন্ন্যাস গ্রহণ করতে হয়।  কিন্তু চিত্ত শুদ্ধি না হলে বিষয়-বৈরাগ্য আসে না। আর বিষয়-বৈরাগ্য না হলে সন্ন্যাস গ্রহণ বৃথা। তুলসির মালা পড়লে, রুদ্রাক্ষের মালা ধারণ করলে, বা দণ্ডধারণ  করলে মানুষ নরশ্রেষ্ঠ নারায়ণ হয়ে যাবে, এমন কথা শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু সত্য হচ্ছে,  অন্তর থেকে শরীর-মন-বাক্যের শাসন চাই। শরীর মন ও বাক্যকে যিনি সংযত করতে পেরেছেন, তার বাইরের পরিচ্ছদের প্রয়োজন নেই। তবে একথাও সত্য এগুলো অর্থাৎ মালা, দণ্ড, পোশাক আমাদের একটা মানসিক পরিবর্তন এনে দিতে পারে, এনে দিতে পারে সামাজিক শাসন। পুলিশের ড্রেস পড়লে, নিজের মধ্যে একটা পুলিশ-পুলিশ ভাব হয়, তেমনি গেরুয়া পড়লে, নিজের মধ্যে একটা সংযম আসতে পারে।  তা যদি না আসে তবে এগুলো ভেক ছাড়া আর কিছু নয়। সবচেয়ে বড়ো  কথা সাধন দ্বারা প্রাণ ও মনকে শুদ্ধ না করতে পারলে, নৈষ্ক্রম্ম্য বা সন্ন্যাস গ্রহণ সম্ভব নয়। এইজন্য আগে প্রাণায়াম ইত্যাদি যোগক্রিয়া দ্বারা নাড়ীশুদ্ধি দেহশুদ্ধি করে, প্রাণ-মনকে স্থির করতে হবে। কর্ম্ম ছেড়ে দিলেই এই স্থিরতা আসতে  পারে না।  বরং সঠিক নিষ্কাম কর্ম্মের মধ্যেই লুকিয়ে আছে জ্ঞান। চিত্তের স্থিরতা থেকে এই জ্ঞানের উদয় হতে পারে। চঞ্চল  মন বিশ্বব্রহ্মান্ড ঘুরে মরছে। এই মনকে চিন্মাত্রে স্থাপন না করতে পারলে,  সমস্ত ক্রিয়াই  বৃথা। কারুর  মুখ থেকে শুনে, বা পুঁথিগত বিদ্যায় কারুর মন চিন্মাত্রে স্থিতি লাভ করতে পারে না। এই স্থিতি পেতে গেলে প্রথমে প্রানপনে ক্রিয়ায় মনোযোগ দিতে হবে। একটা দৃঢ় মোনোভাব নিয়ে ক্রিয়াকর্ম্মে লেগে থাকতে হবে। 

আসলে বাইরের দিকে দেখতে গেলে, মনে হয়, কর্ম্মে আছে চঞ্চলতা, আর নৈষ্ক্রম্ম্যে আছে স্থিরতা।  তাই এদুটোকে আলাদা বলে মনে হয়।  কিন্তু কর্ম্মের পরেই আসে স্থিরতা। কর্ম্মের আগে যে স্থিরতা প্রদর্শন হয়, তা বাহ্যিক।  মন তখন ভীষণই অস্থির।  একটা কি-করি কি-করি ভাব। ক্রিয়া না করলে, অন্তঃকরণের বৃত্তিগুলো কিছুতেই থামতে চায় না । তাই ক্রিয়া করবার প্রথম অবস্থায় মনের মধ্যে লড়াই চলে। মনের মধ্যে তরঙ্গের পর তরঙ্গ উঠছে, ক্ষনিকের জন্যও তার বিশ্রাম নেই। তাই নিজের ভালো চাইলে,  কিছুদিন সাধনের মধ্যে নিযুক্ত করো তখন দেখবে মন বৃত্তিশূন্য অবস্থায় এসে যাবে। এই অবস্থা ক্রিয়া না করলে কিছুতেই আসতে  পারে না। দুটো শাস্ত্র গ্রন্থ পাঠ  করলাম, সৎসঙ্গ করলাম, ভালোমন্দ দুটো সাধুকথা শুনলাম,  এতে যে জ্ঞানের উদয় হবে, তা শুষ্ক জ্ঞান। ডিম্ থেকে কিভাবে বাচ্চা হয়, সেই জ্ঞানের কোনো মূল্য নেই যতক্ষন তুমি ডিম্ থেকে বাচ্চা করবার কাজে নিজেকে সামিল করতে না পারছো। বই পড়ে পণ্ডিত হওয়া যায়, মুখে অনেক বড় বড়  কথা বলাও  যায়। কিন্তু যখন সত্যি সত্যি বিপদের সম্মুখে এসে দাড়াও, তখন বিজ্ঞানের বইতে পড়া বিদ্যা কোনো কাজে লাগে না। আকাশে কেন চাঁদের উদয় হয়, সমুদ্রে কেন ঝড় ওঠে, নদীতে কেন তুফান বয়, - এসব জ্ঞান কোনো কাজে লাগবে না যখন গভীর রাতে কালবৈশাখীর ঝড় উঠবে নদীতে, আর  তুমি একলা ডুবু-ডুবু নৌকার যাত্রী হয়ে আতঙ্কের সঙ্গে  ঈশ্বর অভিমুখী হয়ে আছো।  যদি সাঁতার না জানো, তবে তখন সাঁতার না জানার জন্য নিজেকে ধিক্কার  দেবে।  আর সাঁতার জানতে গেলে বই পড়ে  হয় না। জলে নামতে হয়। তো নদীর জল যখন স্থির তখন নদীতে নেমে সাঁতার শিখে নাও। নতুবা আখেরে কেতাবী বিদ্যা কোনো কাজে লাগবে না। 

আসল সিদ্ধি হলো মনের সমস্ত প্রবৃত্তিকে নিবৃত্ত করা। এই সিদ্ধি না হলে মনের শান্তি আসে না।  একমাত্র সাধন ক্রিয়া দ্বারাই মনের সমস্ত সংকল্প-বিকল্পের নাশ হতে পারে।  আর চিত্তে যখন কোনো সংকল্প-বিকল্পের উদয় হবে না, তখনই যথার্থ জ্ঞানের উদয় হতে পারে, মনের শান্তি আসতে  পারে। সুতরাং ক্রিয়াই  জ্ঞান লাভের  একমাত্র উপায়। আত্ম জ্ঞানের সাধনাই  সাধনক্রিয়া।  এই সাধন-কর্ম্ম করতে করতে একসময় কর্ম্মের ফলস্বরূপ আমাদের সত্ত্বশুদ্ধি হয়।  আর সত্ত্বশুদ্ধি হলেই শুদ্ধজ্ঞানের উদয় হয়।  বিনা পরিশ্রমে, বিনা আয়াসে, কেবল গুরুকৃপায়, সব হয়ে যাবে, এমনটা ভাবা মূর্খামি ছাড়া  কিছু নয়। বিষয় বাসনাকে বলে পাপ। এই পাপ আমাদের শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে আছে। আর এই পাপক্ষয় করতে হলে আগে শরীরকে শুদ্ধ করতে হবে। এই শরীর শুদ্ধ  করবার প্রক্রিয়াই  যোগক্রিয়া অর্থাৎ প্রাণায়াম ইত্যাদি। প্রাণায়ামের দ্বারা পাপের ক্ষয় হলে,  শুদ্ধ জ্ঞানের উদয় হবে। শুদ্ধ জ্ঞানীই ব্রহ্মে স্থিত হতে পারেন।        

ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠতি-অকর্ম্মকৃৎ 
কার্য্যতে হ্যবসঃ কর্ম্ম সর্ব্বঃ প্রকৃতিজৈঃ-গুণৈঃ। (৩/৫) 

কেহ কখনো ক্ষণকালের জন্যও কর্ম্ম না করে থাকতে পারে না।  কেননা, প্রকৃতির প্রভাবে অবশ হয়ে সবাইকেই  কর্ম্ম করতে হয়। 
আত্মা শরীর ধারণ করে কর্ম্ম করবার জন্য।  শরীরবিনা কোনো কর্ম্ম সমাধান করা যায়  না। আর শরীর এমনি একটা যন্ত্র যা কর্ম্ম না করলে বাঁচতেও  পারে  না। বিদেহ  অবস্থায় কেউ কর্ম্ম করতে পারে না। শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তার ইড়া -পিঙ্গলাতে শ্বাসক্রিয়া প্রবাহিত হতে শুরু করে। আর জীবকুল অর্থাৎ পঞ্চতত্বের এই শরীর, মন-বুদ্ধি-অহঙ্কার-এর বশীভূত হয়ে কর্ম্ম করে থাকে। শিশুর জন্মের আগে সুষুম্নাতে প্রাণের প্রবাহ চলে। তখন তার কোনো কর্ম্ম থাকে না। এই সুষুম্নার  অন্তর্গত সমস্ত বিশ্বসংসার। এর কর্তা  সেই আদিপুরুষ যিনি সর্ব্বব্যাপক। সুষুম্না থেকে প্রাণপ্রবাহ যখন ইড়া-পিঙ্গলাতে নেমে আসে তখন আমরা সংসারের মধ্যে নিমজ্জিত হই। . এইসময় থেকেই জীব জাগতিক ব্যাপারের  সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। যদিও এই প্রাণপ্রবাহের আসল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সুষুম্না আর  এই সুষুম্নাই আদিশক্তি প্রাণকে নিয়ে বিরাজ করছে, আর তার মধ্যে আছে এই বিশ্বসংসার। সুষুম্না কথাটার অর্থ হচ্ছে, সুষু = অব্যক্ত শব্দ, ম্না=অনুশীলন করা, এটি সূর্য্যরশ্মি বিশেষ।  ব্রহ্মান্ডের সমস্ত ক্রিয়া বা খেলা সেই সূর্য্যরশ্মির,  বিশ্বশক্তির, বিশ্বপুরুষের। প্রাণ হচ্ছে বিশ্বের ধারক। সুষুম্না (সূর্য্যরশ্মি) না থাকলে  জীবের জন্মই  হতো না। এই পঞ্চতত্ত্ব মন, বুদ্ধি অহংকার সবই জগন্মাতা প্রকৃতির   বশে। সত্ত্ব,রজ,তম - এই তিন গুনের খেলা, সব এই ইড়া  পিঙ্গলা ও সুষুম্নার মধ্যে যে প্রাণবায়ুর আছে, তারই খেলা। আবার এদের জড়শক্তি নিহিত আছে ব্রহ্মরন্ধ্রে। এই ব্রহ্মনাড়ীতেই  সব কিছু বাঁধা। তাই প্রাণক্রিয়া অর্থাৎ প্রাণায়াম করতে করতে প্রাণের গতিকে উর্দ্ধগতি সম্পন্ন করে যখন ব্রহ্মরন্ধ্ৰমূলে স্থাপিত হয়, তখন সাধকযোগী গুনত্রয়ের অতীত হয়ে যান ।  আর তা না হলে এই গুনত্রয়ের প্রভাব চলতে থাকে। এই অবস্থায় জ্ঞানী-অজ্ঞানী কেউই গুন-ত্রয়ের  প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেন  না। 
------------------------           

১৫.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - তৃতীয় অধ্যায়  - কর্ম্মযোগঃ      
শ্লোক নং ৩/৬-৩/৮

কর্ম্মেন্দ্রিয়ানি সংযম্য য আস্তে মনসা স্মরন্
ইন্দ্রিয়ার্থান্ বিমুঢ়াত্মা মিথ্যাচারঃ স উচ্যতে। (৩/৬)

যে বিমূঢ় আত্মা হস্ত-পদ ইত্যাদি কর্ম্মেন্দ্রিয়গুলোকে সংযত করে শান্ত ভাবে অবস্থান করে, অথচ মনে মনে বিষয়ের কথা স্মরণ করে, সে মিথ্যাচারী। 

দেহধারীর পক্ষে কর্ম্মত্যাগ করা সম্ভব নয়। কিন্তু একদল অলস ব্যক্তি বা ভন্ডব্যাক্তি মনেমনে ইন্দ্রিয়সুখের কামনা সত্ত্বেও কর্ম্মে লিপ্ত হয় না। এদের ভোগের মানসিক প্রবৃত্তি প্রবল ও সক্রিয়।  মনে মনে নিরন্তর ভোগ্যবিষয়ের চিন্তায় করে থাকে।  কিন্তু কর্ম্মে এদের অনীহা। ধ্যানে বসেছে, কিন্তু রান্নাঘরে বিড়াল ঢুকেছে কিনা, আজ অফিসে বসকে কিভাবে দিলাম - বেশ করেছি। ইত্যাদি ইত্যাদি চিন্তা মনের মধ্যে ঘুরছে। সাধক ধ্যানে বসে, অনিত্য বস্তু থেকে নিত্য বস্তুতে মনকে  স্থির করবার জন্য। আমাদের শ্বাসের ক্রিয়া বা প্রাণায়াম-ক্রিয়া  করতে হবে ফলাকাঙ্খ্যা রোহিত হয়ে। প্রথম দিকে বিষয়চিন্তা আসবেই। কিন্তু  সাধনক্রিয়া করতে করতে বিষয়ের দিকে মন চলে গেলে, আমাদের প্রত্যাহার করতে হয়। কিন্তু অনেকসময় বিষয় চিন্তায় মগ্ন থেকে যন্ত্রের মতো প্রাণায়াম করতে থাকলাম, এতে আসলে কোনো উপকার হতে পারে না। প্রাণায়াম করবার সময় প্রাণের মধ্যে মনকে নিবিষ্ট করতে হবে। কিছু লোক আছে বৈরাগ্যের উপরে বিশাল বক্তৃতা দিতে পারে, জাগতিক দুঃখ নিবারনের জন্য পন্ডিতের মতো অনেক শাস্ত্রবাক্য আওড়াতে পারে।  কিন্তু নিজের জীবনে যখন দুঃখ আসে,  বা নিজের পাওনাগণ্ডায় যখন কম পড়ে তখন অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে। এদের মুখে শাস্ত্রকথা শোনাও পাপ। এদের কথায় ও  কাজে কোনো মিল নেই। এরা  মুখে এক মনে আর-এক। মুখে মিষ্টি, মনে বিষ। এরা  উপরে ত্যাগী, ভিতরে ভোগী। এরা  যেমন অন্যের সঙ্গে প্রবঞ্চনা করছে,  তেমনি নিজের সঙ্গেও আত্মপ্রবঞ্চনা করছে। তাই আমাদের কর্ম্ম-ইন্দ্রিয় সংযত হোক বা না হোক, আমাদের মনের সংযম সর্বাগ্রে প্রয়োজন। চোখ বুজে ধ্যান-ধারণার ভান করবার চেয়ে, গুরুদেবের মূর্তির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা অনেক ভালো। এতে করে মন শান্ত হতে পারে।      

যঃ তু ইন্দ্রিয়ানি মনসা নিয়ম্য-আরভতে অর্জ্জুন 
কর্ম্মেন্দ্রিয়ৈঃ কর্ম্মযোগম অসক্তঃ স বিশিষ্যতে।  (৩/৭)

যিনি মনের দ্বারা জ্ঞান ইন্দ্রিয়গুলোকে সংযত করে অনাসক্ত হয়ে কর্ম্ম ইন্দ্রিয়গুলোকে কর্ম্মযোগে নিবদ্ধ করেন, তিনি শ্রেষ্ঠ।
কর্ম্ম-ইন্দ্রিয়গুলো  মনের নির্দেশে কর্ম্ম করে থাকে। কিন্তু যার মন  ইন্দ্রিয়সংযম করে ব্রহ্মেস্থিত হয়েছে, তাঁর কর্ম্ম হয়ে থাকে অনাসক্ত। যিনি সাধনক্রিয়ার উচ্চ-অবস্থায় অবস্থান করছেন, সেই মনের কোনো ইন্দ্রিয়জনিত কর্ম্ম থাকে না।
আমরা যখন নিদ্রা অবস্থায় থাকি বা ঘুমের ঘোরে  থাকি, এমনকি আমরা যখন আনমনা থাকি, তখনও আমরা অনেক কাজ করে থাকি, যেমন গা চুলকানো, মশা  মারা, পাশফিরে শোয়া, এই কাজগুলো আমাদের হয়ে থাকে  অভ্যাস বশতঃ। অভ্যাসবশতঃ এই কাজে আমাদের কোনো আসক্তি থাকে না। তো অভ্যাস বশতঃ আমরা অনেক কাজ করি, কিন্তু তখন মন থাকে অন্য বিষয়ে বা ব্রহ্মে। এইসব কর্ম্মের কর্ম্মফল নেই না নয়, কিন্তু এই কর্ম্মফলের ভোগে মনের বিকার ঘটবে না। শুদ্ধচিত্ত যোগীর মন  ব্রহ্মে স্থিত থাকে। এই অবস্থাতেও কর্ম্ম-ইন্দ্রিয়ের কর্ম্ম করা চলে, কিন্তু মন থাকে ঈশ্বরের চরণে। তাই ঈশ্বরের চরণে মন নিবদ্ধ অবস্থায় যাকিছু কর্ম্ম হোক না কেন, তার মধ্যে আসক্তি থাকে না।  আবার এর বিপরিত অবস্থা হচ্ছে অশুদ্ধ  চিত্তের লক্ষণ। অর্থাৎ বাইরের  কাজও   সে মনোযোগ দিয়ে  করে না। হয়তো সে বসে বসে জপের মালা টিপছে, বা ধ্যানের ভঙ্গিমায় আসনকুটে  বসে আছে, বা হয়তো প্রাণায়ামের ক্রিয়া করছে, অথচ ঠিক  একই সময়ে মন বিষয়চিন্তা করছে। আর  এই কাজগুলো করছে সে অভ্যাসবশতঃ, যন্ত্রের মতো। তাই বলা হয়,  অশুদ্ধ চিত্তে বিষয় চিন্তা, আর শুদ্ধ চিত্তে ভগবত চিন্তা। মন ও ইন্দ্রিয়সকল যখন একত্রে ধাবিত হবে, তখন সে যে বিষয়ে ধাবিত হবে, সেই বিষয়কর্ম্ম অধিক ফলপ্রসূ হবে। আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়কর্ম্ম যখন ভগবৎ চরণে নিবেদিত হবে, তখন সমস্ত কর্ম্ম যজ্ঞে পরিণত হবে। আর এই যজ্ঞে  মন-প্রাণ-এর  আহুতি হবে। তখন প্রাণ-মন ব্রহ্মে স্থিত হবে। এই অবস্থাই যোগীর কাম্য, যা শ্রেষ্ঠ।   
  
নিয়তং কুরু কর্ম্ম ত্বং কর্ম্ম জ্যায়ো হ্য় কর্ম্মণঃ
শরীর-যাত্রাপি চ তে ন প্রসিধ্যেৎ-কর্ম্মণঃ।  (৩/৮)

তুমি নিয়ত কর্ম্ম করো।  কর্ম্ম না করা থেকে কর্ম্ম করা শ্রেষ্ঠ। কর্ম্ম না করলে তোমার শরীরযাত্রাও নির্বাহ হতে পারে না। 

আমরা বার বার শুনেছি, এই সংসার কর্ম্মক্ষেত্র। এখানে জীবনের আগমন হয়ে থাকে একমাত্র কর্ম্ম করবার জন্য। জীবাত্মার অবয়ব ধারনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে কর্ম্মসাধন।  আবার কর্ম্মই সমস্ত বন্ধনের  কারন। জীবের জন্ম-মৃত্যুর যে চক্র চলছে তা এই কর্ম্মের মাধ্যমেই সম্পাদিত হচ্ছে। কর্ম্ম থেকে কর্ম্মফল আবার কর্ম্মফল থেকে পুনর্জন্ম। কর্ম্মের কুশলতা অর্জন করাই যোগশিক্ষা। যোগেরক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা কর্ম্মের সুফলতা  পেতে পারি। 

সাধনক্রিয়া না করলে, সাধনার পরাবস্থায় পৌঁছনো সম্ভব নয়। তাই সবকিছু ত্যাগ করে, অকর্ম্মা হয়ে বসে থাকলেই মন স্থির হতে পারে না। যদি বলো, আমি সমস্ত শাস্ত্র গ্রন্থ পাঠ  করে, বেদ-বেদান্ত পাঠ  করে, আমার পূর্ব-পূর্ব সংস্কারগুলোকে নষ্ট করে দেবো।সেক্ষেত্রে বলি,   এই জ্ঞানের আলোচনা, বা মনন অবশ্য়ই উপকারে আসবে, কিন্তু এর জন্য অনেক সময় যেমন লাগবে, তেমনি মনের মধ্যে প্রশ্নের পর প্রশ্ন উদয় হতে থাকবে। আর এই  প্রশ্নের কখনো শেষ হতে পারে না। আবার নতুন শুভ সংস্কারের জন্ম হতেও  পারবে  না। 
আরো একটা কথা হচ্ছে, শরীরকে সুস্থ রাখবার জন্য, যেমন আমাদের খাদ্যসামগ্রী গ্রহণ করতে  হয়, তেমনি এই খাদ্যসামগ্রী হজম করবার জন্য, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঠিক ক্রিয়া সম্পাদন জরুরি।  আপনি সারাদিন শাস্ত্র আলোচনায়, বা শাস্ত্র অধ্যায়নে সময় কাটাতে গেলে, আপনার শরীরের যে স্বাভাবিক কর্ম্ম তার যে  ভারসাম্য তা বিঘ্নিত হবে।  ফলত আপনার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়বে, আর অসুস্থ শরীরে মনের ধীশক্তি স্তিমিত হয়ে আসবে।  তখন শাস্ত্রগ্রন্থের যে মর্মার্থ তা আপনার বোধগম্য হবে না। আপনার শরীরের মধ্যে যে স্মৃতি আছে, তার স্বল্পতা  দেখা দেবে। এমনকি আপনার শরীরের নাশক্রিয়া দ্রুত সংগঠিত হতে শুরু করবে। । তো যার শরীর সুস্থ নয়, তার দ্বারা ভগবৎ উপাসনা, সাধনভজন করা সম্ভব নয়। তাই শরীরকে ক্রিয়াশীল রাখতে প্রাণায়ামের প্রয়োজনীয়তা ভাষায় বলে শেষ করা যাবে না। আবার এলোমেলো ভাবে বা অনিয়মিত ভাবে যোগেরক্রিয়া করেও আপনার শরীর ঠিক থাকবে না। আমাদের আহার, বিহার, শয়ন, প্রাণায়াম বা সাধন ক্রিয়া সবই পরিমিতভাবে সম্পন্ন করতে হবে। শারীরিক কষ্ট সহ্য করে, শারীরিক ক্রিয়া করেই শরীরকে সুস্থ সবল রাখা যায়। অর্থাৎ আমাদের (জীবাত্মার) যে অনন্ত যাত্রা, এই যাত্রার রসদ সংগ্রহ করাই আমাদের দেহধারনের উদ্দেশ্য। মনে রাখবেন, এই জীবনই আমাদের অন্তিম জীবন তা নাও হতে পারে। আবার পরবর্তী জীবনের জন্য শরীরের সংগ্রহ এখনকার সাধন ক্রিয়া থেকেই হতে পারে।  আমাদের সূক্ষ্ম শরীরের পুষ্টি যেমন মানসিক চিন্তা ও জ্ঞান সংগ্রহ থেকে হতে পারে, তেমনি আমাদের পরবর্তী স্থুল দেহের প্রাপ্তি কিন্তু এইজীবনের ক্রিয়া থেকেই ঠিক হয়ে যাবে। তো সমস্ত জীবের ক্রিয়াকর্ম্ম শুধু প্রয়োজনীয় নয়, আবশ্যিক। 

এইযে স্থুল  শরীর, এর একদিন প্রকৃতির নিয়মে নাশ হবে।  আবার প্রকৃতির নিয়ম উলঙ্ঘন করলে, আমাদের শরীরে ব্যাধি ইত্যাদির জন্ম হবে। শরীর  ধারনের উদ্দেশ্য ভগবতলীলায় নিজেকে উৎসর্গ করা। আমরা সবাই ভগবানের হাতের পুতুল, যেমন নাচায়, তেমনি নাচি। কিন্তু ভগবান আমাদের কিছু ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন, ভগবৎ  প্রেম দিয়েছেন, আমাদের কিছু শারীরিক-মানসিক শক্তি দিয়েছেন, এই শক্তিত্রয় অর্থাৎ সত্ত্ব, রজ, তম গুন্ দিয়েছেন, এর অনুশীলন করতে হবে । তা না হলে জগতে যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা প্রকট হয়েছি, সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। তো কর্ম্মের অধিকারী হয়েও যে শুধু শুষ্ক জ্ঞানের কথা মুখে আওড়ায়, তাদের না আছে ইহকাল, না আছে পরকাল। প্রাণক্রিয়া করতে করতে একদিন নিশ্চই দেহাভিমান চলে যাবে। আর দেহাভিমান-শূন্য পুরুষের সর্বত্রই আত্মদর্শন হয়ে থাকে।  তখন সমস্ত অহংকারের বিলোপ সাধন হয়। তখন যাকিছু কাজ করছি বা হচ্ছে সবই সেই ঈশ্বরের কাজ বলেই উপলব্ধ হবে।  তখন আমি করছি, আমার কাজ, আমার ফল, এমন ভাবনা দূর হয়ে যাবে। এইযে চরম জ্ঞান এই জ্ঞানের উদয় একমাত্র তখনই হতে পারে, যখন আমরা আকাঙ্খ্যাহীন হয়ে প্রাণের মধ্যে মনকে নিবদ্ধ করে, প্রাণক্রিয়া করে যাবো। 
-----------------------      

১৬.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - তৃতীয় অধ্যায়  - কর্ম্মযোগঃ      
শ্লোক নং ৩/৯-৩/১১

যজ্ঞার্থাৎ কর্ম্মণঃ অন্যত্র লোকঃ অয়ং কর্ম্ম-বন্ধনঃ
তদর্থ কর্ম্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর। (৩/৯)

যজ্ঞের জন্যই কর্ম্ম করা উচিত। তা না হলে কর্ম্মবন্ধন সৃষ্ট হয়। অতএব হে কৌন্তেয় তুমি অনাসক্ত হয়ে যজ্ঞের উদ্দেশ্যে কর্ম্মের অনুষ্ঠান করো। 
যজ্ঞ কথাটার অর্থ হচ্ছে, যজ+ঞ,  যজ কথাটার অর্থ পূজা করা। ন =ঞ অর্থ সকর্ন্মক ক্রিয়ার কর্তৃবাচক। জগতের হিতের  জন্য যে পুজার আয়োজন করা হয়, তাকে বলা হয় যজ্ঞ। আপন ইছারহিত হয়ে, ভগবানের ইচ্ছেয় সমস্ত কর্ম্ম করো। আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়সুখের জন্য কর্ম্মে প্রবৃত্ত হই। আর এতে করে যে আমাদের আনন্দ বা সুখ হয় না তা নয়, তবে সে আরাম ক্ষণস্থায়ী। আর এই আরাম ক্ষণস্থায়ী হবার  ফলে, আমাদের সেই কর্ম্মে একটা আসক্তি জন্মায়। রসোগল্লা খেলে আমাদের রসনার  তৃপ্তি হয়। যেহেতু এই তৃপ্তি ক্ষণস্থায়ী, তাই আমরা রসোগল্লা খাবার জন্য, বারবার উদগ্রীব হই। আর এইভাবে আমরা আমাদের কর্ম্মের বোঝা চাপাই । আর এই ক্ষনিকের তৃপ্তির জন্য যে কর্ম্ম তা আমাদের সারাজীবন করেই যেতে হয়, কিন্তু চিরস্থায়ী তৃপ্তি হয় না। অন্যদিকে বারবার এই কর্ম্ম আমাদের শরীরে চিরস্থায়ী সুগারের বৃদ্ধি করে।  ফলত কর্ম্ম জনিত যে ভোগ তা আমাদের ভুগতে হয়। আর এই কর্ম্মফলের  বোঝা আমাদের সারাজীবন তাড়িয়ে বেড়ায়। জন্ম থেকে জন্মান্তরে এই একইভাবে আমরা কর্ম্মজনিত ভোগের জন্য দেহ ধারণ করে থাকি। 
কিন্তু এই কর্ম্ম যদি আমাদের সার্বিক মঙ্গলের জন্য হয়, যদি আমাদের কর্ম্ম হয় উপাসনা, তবে তাতে যেমন আমাদের নিজস্ব  মানসিক তৃপ্তি হতে পারে, তেমনি অন্যের সার্বিক মঙ্গল হতে পারে। কিন্তু কথা হচ্ছে, রসগোল্লার মধ্যে কি আছে, যা পাবার জন্য আমরা বারবার সেই রসোগল্লার দিকেই  ধাবিত হই ? আসলে রসোগল্লার মধ্যে কিছু নেই, তৃপ্তি আছে আমাদের ইন্দ্রিয়ের মধ্যে, তৃপ্তি আছে আমার মনের মধ্যে। আবার  ইন্দ্রিয় ততক্ষনই সক্রিয় থাকে যতক্ষন  ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে মন । আবার মন ততক্ষন ক্রিয়াশীল থাকে যতক্ষন আমাদের শরীরে প্রাণের প্রবাহ আছে।  শরীর থেকে প্রাণ বেরিয়ে গেলে, আমাদের ইন্দ্রিয়সকল নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এই প্রাণই সমস্ত বস্তুর মধ্যে সমস্ত প্রাণীর মধ্যে বিরাজ করছে। যার ফলে আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয় ক্রিয়াশীল থাকছে। 
অতয়েব দেখা যাচ্ছে, প্রাণই সর্ব্বময় কর্তা।  প্রাণই ব্রহ্মরূপে সমস্ত কিছু হচ্ছেন, আবার রুদ্ররূপে  ধংশ করছেন। আবার এই প্রাণবায়ু নাভি-স্থলে বিষ্ণু  সমান হয়ে জগৎকে ধারণ করে আছেন । এই ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব শক্তি অর্থাৎ প্রাণ-অপান-সমান বায়ু বিশ্বব্যাপী জগৎ সৃষ্টি করছে, রক্ষা করছে এবং সংহার করছে। বিশ্বে এই তিন মহাপ্রাণ না থাকলে, কোনো বস্তুর অস্তিত্ত্বই  থাকতো না। 
তো আমাদের মহাপ্রাণের তৃপ্তির জন্য যজ্ঞ করতে হবে।  অর্থাৎ প্রাণের সাধন ক্রিয়া করতে হবে। আত্মজ্ঞান লাভের  জন্য এই প্রাণেরকর্ম্ম করতে হবে। আর তাহলে যজ্ঞেশ্বর বিষ্ণু তৃপ্ত হবেন। তিনি সন্তুষ্ট হলে অর্থাৎ প্রাণবায়ু সন্তুষ্ট হলে, তিনি বিক্ষেপমুক্ত হবেন। আর বিক্ষেপহীন বায়ু আমাদের সুস্বাস্থের অধিকারী করে দেবে, মনের মধ্যে শুভ চিন্তার উদয় হবে, এমনকি আমাদের স্থুল  শরীরের আয়ু বৃদ্ধি পাবে। একেই বলে ধর্ম্মকর্ম্ম।  একেই বলে যজ্ঞকর্ম্ম। যজ্ঞেশ্বর বিষ্ণুর প্রসন্নতা এই প্রাণকর্ম্ম  দ্বারাই হতে পারে। যোগী-সাধকের শরীরের মধ্যে, সমস্ত নাড়ীর মধ্যে এই বায়ুকে প্রবাহিত করতে হবে। এতে করে আমাদের যেমন শারীরিক রোগব্যাধি থেকে মুক্ত থাকতে পারবো, আমাদের পরমায়ু বৃদ্ধি পাবে।  তেমনি বাড়বে আমাদের মেধাশক্তি, স্মৃতিশক্তি ও সর্বোপরি শুদ্ধজ্ঞানের অধিকারী হবো আমরা । অর্থাৎ  শরীরের সমস্ত নাড়ীগুলোর মধ্যে যখন শুদ্ধ-স্থির বায়ুর অবস্থান হবে, তখন সাধক এক অদ্ভুত শক্তিসম্পন্ন, অনুভূতিপ্রবল  হয়ে উঠবে।  একটা নতুন  মানুষের জন্ম হবে। আর নতুন মানুষ হবে দেহাত্ববোধের অতীত। আর দেহাত্ববোধের অতীতে যে মানুষটার জন্ম হবে, সে হবে স্থির চিত্ত, ব্রহ্মে স্থিত। দেহ থেকে পৃথক করে চিত্ত যখন ব্রহ্মে স্থিত হবে তখন সমস্ত বন্ধন  থেকে মুক্তি ঘটবে, আমরা হবো সুখী-শান্ত। 

আমাদের মনের মধ্যে চলছে, অসংখ্য চিন্তারাশি।  এই চিন্তার প্রবাহ তখনই শান্ত হতে পারে, যখন আমাদের শুদ্ধ নাড়ীতে প্রাণশক্তি প্রবেশ করে, সহস্রারে স্থির হয়ে বসে। এই সময় দেহ আত্মা থেকে পৃথক হয়ে যায়। গঙ্গার প্রবাহ খালবিলে প্রবেশ করছিলো, এখন খাল-বিল বন্ধ হবার ফলে সমস্ত জল গঙ্গাতেই এসে জড়ো হচ্ছে। সাধক যখন সমস্ত প্রাণশক্তিকে সহস্রারে স্থির করতে পারেন, তখন সাধকের দেহবোধ ক্ষীণ হয়ে আসে। আর সমস্ত চিন্তার প্রবাহ থেমে  যায়। প্রাণ তখন বিশ্রামের মধ্যে পরমানন্দ লাভ করে সাধককে মুক্তপুরুষ করে দেয়। এই হচ্ছে যজ্ঞ। যা প্রাণের মধ্যে অপানের  আহুতি। আর ফল হচ্ছে তেজঃশক্তি। 
       
সহযজ্ঞাঃ প্রজাঃ সৃষ্ট্বা পুরোবাচ প্রজাপতিঃ
অনেন প্রসবিষ্যধ্বম-এষ বঃ-অস্তু-ইষ্ট-কামধুক।  (৩/১০)

সৃষ্টির আদিতে প্রজাপতি যজ্ঞের সাথে জীবসমূহ সৃষ্টি  করে বলেছিলেন, এই যজ্ঞ দ্বারা উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হও, এই যজ্ঞ তোমাদিগের অভীষ্ট ফলপ্রদ হোক। 
প্রজাপতি কথাটা অর্থ স্রষ্টা। যিনি প্রজার সৃষ্টি করেছেন। সমস্ত জীবজগতের পিতা।   আসলে সমস্ত সৃষ্টির বীজ যেখানে সুরক্ষিত থাকে, তাকে বলা হয় প্রজাপতি। ব্রহ্মা যখন জীব সৃষ্টি করলেন, তখন এই শ্বাস-প্রশ্বাসরূপ যজ্ঞকর্ম্মকে আমাদের সাথে যুক্ত করে দিলেন। এবং বলে দিলেন, এই শ্বাস-প্রশ্বাসরূপ যজ্ঞকর্ম্ম দ্বারা তোমরা  উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হও। এই যজ্ঞই তোমাদের অভীষ্ট ফল প্রদান করবে। আমাদের শরীরে যতক্ষন এই প্রাণের আগমন-নির্গমন হচ্ছে, ততক্ষনই জীবের সমস্ত ক্রিয়া-কর্ম্ম চলতে পারে। একেই বলে জীবন।  এই জীবন না থাকলে, আমাদের সাধের  সমস্ত সংসার, সুখ-দুঃখ, আরাম-আনন্দ সব শেষ হয়ে যায়। সংসার সমুদ্রে সাঁতার কাটতে গেলে যেমন আমাদের শ্বাসক্রিয়া প্রয়োজন তেমনি এই সংসার সমুদ্র পার হতে গেলেও,  এই শ্বাসক্রিয়া সাহায্য নিতে হয়। জীবের শ্বাস-প্রশ্বাসই হচ্ছে মন্ত্র, যাঁকে যোগীপুরুষগণ বলে থাকেন "হংস বা সোঽহং" । এই মন্ত্রই আমরা সারাক্ষন জ্ঞাতসারে হোক বা অজ্ঞাতসারে জপ করে চলেছি। ভবনদী পার হবার এই হচ্ছে আমাদের নৌকা। এই প্রাণ-যজ্ঞ দ্বারাই সাধকের উন্নতি সম্ভব। এতে শুধু শারীরিক উন্নতি হয় তা নয়, আমাদের সাংসারিক উন্নতি এমনকি আধ্যাত্মিক উন্নতি কেবলমাত্র এই প্রাণযজ্ঞ দ্বারাই সম্পন্ন হয়ে থাকে। এমন কোনো মহাপুরুষ নেই, এমন কোনো মহাত্মা নেই, যিনি এই প্রাণ-যজ্ঞকর্ম্ম করেন নি। তো মহাপুরুষগন যে পথে গেছেন, আমাদের উচিত সেই পথ অবলম্বন করে মুক্তির সন্ধান করা। এই যজ্ঞের দ্বারা আমাদের ত্রাণ হতে পারে। এই যজ্ঞের ঈশ্বর হচ্ছেন, বিষ্ণু। প্রাণবায়ুর প্রভু এই ঈশ্বর হলেন, স্থিরতা, বা লয় প্রাপ্ত হওয়া। 

তো যোগ-অভ্যাসের দ্বারা আমাদের শরীর সুস্থ  থাকতে পারে, শরীর ব্যাধিমুক্ত থাকতে পারে, শরীরের আয়ু বৃদ্ধি হতে পারে। আবার এই যোগ-অভ্যাসের দ্বারাই আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি হতে পারে, আমাদের ধীশক্তি বৃদ্ধি  হতে পারে, আমাদের স্মৃতি শক্তি বাড়তে পায়ে। আত্মার সঙ্গে চিত্তের একটা ঐক্যতান  হতে পারে। তাই ভগবান যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ  প্রজাপতিকে উদ্ধৃত করে বলছেন,  যজ্ঞদ্বারা উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হও।       

দেবান ভাবয় তানেন তে দেবা ভাবয়ন্তু বঃ
পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরম-অবাপস্যথ . (৩/১১)

এই  যজ্ঞ দ্বারা দেবগণকে সেবা করো সেইসব দেবগন তোমাদের সংম্বর্ধিত করুন। পরস্পরের সম্বর্ধনা দ্বারা পরম কল্যাণ প্রাপ্ত হবে। 

আমাদের চিন্তার মধ্যে একটা শক্তি নিহিত আছে, আর তা হচ্ছে, আপনি যার কথা চিন্তা করবেন, সেও আপনার কথা অবশ্য়ই চিন্তা করবেন। আপনি কারুর ভালো চাইলে, সেও আপনার ভালোই চাইবেন। এইজন্য বলা হয়ে থাকে কারুর অশুভ চিন্তা করতে নেই। কারন আপনি কারুর  অশুভ চিন্তা করা মানে, যার সম্পর্কে এই সব কুভাবনা ভাবছেন, তার মধ্যেও এই একই ধরনের ভাবনার উদয় হবে।  ফলত আখেরে তার ক্ষতি হোক না হোক, আপনার ক্ষতি হবে। এইজন্য বলা হয়ে থাকে সমস্ত যজ্ঞের  মধ্যে জপ্ সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কেননা, এখানে ঈশ্বরের চিন্তন বাক্যই  উচ্চারিত হয়ে থাকে।  আবার এই জপের মধ্যে অজপা জপ সর্বোৎকৃষ্ট। কারন অজপা জপ হচ্ছে প্রাণের সঙ্গে মনকে স্মরণ করা। এই অজপা জপ দ্বারা আর শ্বাস-প্রশ্বাস দ্বারা হোমক্রিয়া করতে হয়। আর  এই হোমক্রিয়া করতে করতে আমাদের প্রাণের গতি উর্দ্ধমুখী হয়ে ওঠে। একসময় প্রাণ স্থির হয়ে ব্রহ্মরন্ধ্রে স্থিতি লাভ করে। তখন আর দেহাত্মবুদ্ধি থাকে না। এই প্রাণকর্ম্মের দ্বারা সমস্ত দেবতাগণ অর্থাৎ বিশেষ বিশেষ গুনের অধিকারীগণ পুষ্টি লাভ করে থাকেন। আমাদের দেহের সমস্ত ইন্দ্রিয়গণ এক-একজন দেবতা। এরা  সবাই বিশেষ-বিশেষ গুনের অধিকারী। 
তো প্রাণের ক্রিয়া-সাধনের ফলে আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয় এবং এর মধ্যে যে সূক্ষ্ম শক্তি আছে, তা জাগ্রত হয়ে ওঠে। মূলাধারে যে চৈতন্য শক্তি সুপ্ত অবস্থায় বিরাজ করছে, প্রানের ক্রীয়ার ফলে সেই  শক্তির উন্মীলন ঘটে। এর পরে সেই শক্তি এক-এক করে সমস্ত চক্র  ভেদ করতে উদ্দত হয়।  মূলাধারের পরে, স্বাধিষ্ঠান, স্বাধিষ্ঠান থেকে মনিপুর, মনিপুর থেকে অনাহত, বিশুদ্ধি, আজ্ঞাচক্রে অর্থাৎ তপোলকে স্থির হন।  সেখান থেকে সহস্রারে উত্তম পুরুষের সাথে সাক্ষাৎ করে জীব ধন্য হয়ে যায়। 

এই চক্র  সাধনাকে বলা হচ্ছে দেবতাদের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ। প্রথমে শ্রীশ্রী গনেশ (মূলাধারে), তারপরে বিষ্ণু (স্বাধিষ্ঠান), তারপরে রুদ্রদেব (মনিপুরে),  অনাহতে শিব, বিশুদ্ধে সদাশিব, আজ্ঞাচক্রে অক্ষরপুরুষ,  সহস্রারে উত্তমপুরুষ। এইসব দেবতাদের উপাসনা বা যজ্ঞ করতে করতে জীবন ধন্য হয়। আসলে ভূতশুদ্ধিই এই যজ্ঞকর্ম্মের উদ্দেশ্য। আমরা ধীরে ধীরে এইসব গুহ্য কথা শুনবো। 

যোগীপুরুষ যোগের সাহায্যে বিশেষকরে "মহাবন্ধ" ও  "মূলবন্ধ" ক্রিয়ার দ্বারা অপান  বায়ু যা স্বাভাবিক সময়ে নিম্নগামি থাকে, তাকে রোধ ও উর্দ্ধগামী করে কুম্ভক অবলম্বন করলে, এই নিরুদ্ধ বায়ু স্বাধিষ্ঠানের  অগ্নিকে আঘাত করে জাগিয়ে তোলে। তখন এই উদ্দীপিত বহ্নি ও বেগবান বায়ু কুন্ডলিনীকে প্রবুদ্ধ করে।  অধোগামী অপানবায়ু উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হয়ে, নাভির অধোদেশে যে মনিপুর চক্র আছে, তার বহ্নিমন্ডলে প্রবেশ ক'রে তাকে আঘাত করতে থাকে। এইভাবে আঘাতের ফলে, অগ্নি প্রজ্বলিত হয়ে শিখার  রূপ ধারণ করে দীর্ঘ হতে থাকে। তখন এই অগ্নিশিখা ও অপানবায়ু প্রাণবায়ুকে স্পর্শ করে।  তখন সাধকের শরীর -ব্যাপী অগ্নি প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে।  এই অগ্নিতাপে  তপ্ত হয়ে  প্রসুপ্তা কুণ্ডলিনী জাগ্রত হয়ে সুষুম্নার মধ্যে প্রবেশ করে।  একেই বলে কুণ্ডলিনী  জাগরণ। 

একবার  এই কুণ্ডলিনী শক্তি উর্দ্ধমুখী হতে আরম্ভ করলে, মূলাধারে অবস্থিত ব্রহ্মা ডাকিনীশক্তি ও অন্যান্য দেবতা, চতুর্দলের চারটি বর্ণ এবং গন্ধ-তত্ত্ব অর্থাৎ পৃত্থি তত্ত্ব ধরা-বীজ "লং" -এর সাথে মিলিত হয়ে কুণ্ডলিনীর দেহে লয়প্রাপ্ত হয়। 

মূলাধার চক্র থেকে জীবাত্মাকে সঙ্গে নিয়ে কুণ্ডলিনী স্বাধিষ্ঠান চক্রে  প্রবেশ করে. তখন স্বাধিষ্ঠান চক্রের পদ্মের পাপড়িগুলো খুলে যায়। এই চক্রে  অবস্থান করছেন মহাবিষ্ণু, রাকিনীশক্তি ও অন্যান্য দেবতা। এই পদ্মদলের চারটি  বর্ণ ও গন্ধতত্ত্ব তখন রসতত্ত্ব বা অপতত্ত্বে মিশে যায়।  অর্থাৎ এইসময় মাটি জলে মিশে যায়। কুণ্ডলিনী দেহে যে পৃত্থি-বীজ "লং" যা একসময় কারন শরীরে অবস্থান করছিলো, তা বরুণ-বীজ "বং" এর সঙ্গে মিশে কুণ্ডলিনীর দেহে বিলীন হয়।
 
এবার রস-তন্মাত্র ও জীবাত্মার সঙ্গে কুন্ডলিনীর মনিপুর চক্রে  প্রবেশ করে।  এই চক্রে  অবস্থিত রুদ্রদেব, লাকিনি শক্তি ও অন্যান্য দেবতা, পদ্মের দশদলের দশটি বর্ণ  ও রস-তন্মাত্র রূপ-তন্মাত্রে (তেজঃ-তত্ত্ব) মিশে যায়। কুণ্ডলিনীর দেহে সূক্ষ্ম ভাবে অবস্থিত বরুন বীজ "বং" তেজবীজ "রং" এর সঙ্গে মিশে যায়।  অর্থাৎ এবার জল অগ্নিতে পরিণত হলো।  এবং শেষে কুণ্ডলিনীর দেহে বিলীন হয়। 

এই মনিপুর চক্র থেকে অনাহত চক্রে উঠতে গেলে সাধককে ব্রহ্ম-গ্রন্থি ভেদ করতে হয়। মনিপুর চক্র পর্যন্ত ছিল জড়শক্তি প্রাকৃত শক্তির (পৃথিবী, জল, তেজ) বিস্তারস্থান।  তো এই ব্রহ্মগ্রন্থি ভেদ দুঃসাধ্য নয়, তবে ভীষণই  কঠিন সাধনা। নাড়ীশুদ্ধি ও প্রাণশক্তিকে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর না করতে পারলে, এই কাজ সম্ভব নয়।  আমাদের মধ্যে আছে পশুভাব।  অর্থাৎ খাওয়া  ঘুম আর মৈথুন - এগুলো আমাদের পশুভাবের লক্ষণ। এখান থেকে বেরুতে না পারলে, এই ব্রহ্মগ্রন্থি ভেদ সম্ভব নয়। 

যাই হোক, আমরা শুনছিলাম, ভগবানের শ্রীমুখ নিঃসৃত বাণী। বলছেন, যজ্ঞ দ্বারা দেবতাদের সন্তুষ্ট করতে পারলে, আখেরে তোমার নিজের মঙ্গল হবে। এই যজ্ঞ হচ্ছে আসলে প্রাণের আহুতি। আর দেবতা হচ্ছেন, বিভিন্ন চক্রের মধ্যে স্থিত শক্তিবিশেষ।  

 
---------------------------  

১৭.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - তৃতীয় অধ্যায়  - কর্ম্মযোগঃ      
শ্লোক নং ৩/১২-১৩

ইষ্টান ভোগান হি বো দেবা দাস্যন্তে  যজ্ঞভাবিতাঃ 
তৈঃ-দত্তান-অপ্রদায়-এভ্যঃ যো ভুঙক্তে স্তেন এব সঃ। (৩/১২)

যজ্ঞের দ্বারা সন্তুষ্ট দেবতাগণ বাঞ্চিত ভোগ তোমাদের দান করবেন। তাঁদেরই প্রদত্ত ভোগ তাঁদের দান না করে যে স্বয়ং ভোগ করে, সে চোর। 
পিতৃমাতৃ প্রদত্ত এই শরীর, শিক্ষক বা আচার্য্য  প্রদত্ত বিদ্যা, আর গুরুপ্রদত্ত জ্ঞান। তো আমরা যা কিছু পেয়েছি, তা অন্য কেউ না কেউ দান করেছেন। আর এটি হচ্ছে পরম্পরা।  এই পরম্পরা থেকে কেউ বিচ্ছিন্ন হয়ে বাঁচতে পারে না। যদিও বা বাঁচতে পারে, কিন্তু উন্নতি হতে পারে না। অভাব থেকে ভাবে যাওয়াই সাধনা। তো আহুতি দেবার মাধ্যমেই সাধনক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে। নিজের জন্য কিছু সংগ্রহ করলে, তাতেই পুরুষ আবদ্ধ হয়ে পড়ে।  কিন্তু অন্যের জন্য সংগ্রহ কর্ম্ম করলে, তাতে সে আবদ্ধ হতে পারে না। 

প্রাণায়াম ইত্যাদি যজ্ঞ দ্বারা স্থুল শরীরের পুষ্টি,  তেজ, শক্তি, আয়ু, ধী, স্মৃতি বুদ্ধি - এই যে দেবশক্তি তার বৃদ্ধি  হতে পরে। আর এই শক্তি যিনি আহরণ করতে পেরেছেন, তিনি যেমন এই শক্তিকে নিজের কল্যানে লাগাতে পারেন, তেমনি জগতের কল্যাণেও  লাগাতে পারেন । সত্যি কথা বলতে কি, এই যে শরীর তার সমস্ত কিছু, পৃত্থিতত্ত্ব, অগ্নিতত্ত্ব, জলতত্ত্ব, আকাশ তত্ত্ব  ও বায়ুতত্ত্ব দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। আমাদের নিজস্ব কিছুই নেই, তাই আমাদের অহংকার করবারও কিছু নেই। সাধন-ক্রিয়া দ্বারা অর্জিত সিদ্ধি জগতের কল্যাণের উদ্দেশ্যেই হয়ে থাকে, কিন্তু অহংকারে উন্মত্ত মানুষ যদি এই অধিতবিদ্যা শক্তির  ফলসমূহকে ইন্দ্রিয়ভোগের নিমিত্ত প্রয়োগ করে, তবে তা হবে, অন্যের সম্পদে বলীয়ান হয়ে, নিজের ভোগবৃত্তিকে সন্তুষ্ট করা। আর এই কারণেই আমরা দেখতে পাই, অনেক যোগীপুরুষ সাধনকৃত ঐশ্বরিক শক্তি ধরে রাখতে পারেন না। বিভূতি লাভের  জন্য যেমন লালায়িত হওয়া উচিত হয়, তেমনি বিভূতিশক্তির অপব্যবহার করাও উচিত নয়। যোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে, বৃত্তিসমূহকে ত্যাগ। যোগসাধন কেবল বিভূতিলাভের জন্য নয়, কিন্তু সাধন পথে বিভূতির দর্শন মেলে, একে  উপেক্ষা করাই যোগীর ধর্ম্ম।        

যজ্ঞশিষ্টাশিনঃ সন্তো মুচ্যন্তে  সর্ব্ব কিল্বিষৈঃ
ভুঞ্জতে তে ত্বঘং পাপা যে পচন্তি-আত্মকারনাৎ। (৩/১৩)

যে সন্ত যজ্ঞাবশেষ ভোজন করেন তিনি সর্বপ্রকার পাপতাপ থেকে মুক্ত হন।  আর যে পাপাত্মা কেবল নিজেদের উদর পূরণের জন্য অন্ন প্রস্তুত করেন, তিনি পাপ ভক্ষণ করেন।

আমরা যে অন্নাদি গ্রহণ ক্রিয়া, এটি একপ্রকার যজ্ঞ। আমরা যে যজ্ঞের কথা শুনে থাকি বা  দেখে থাকি, তা হচ্ছে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে ঘৃত ইত্যাদি মন্ত্রপূত করে আহুতি দেওয়া।  আমরা যে অন্নাদি গ্রহণ করি, তাও জঠরাগ্নিতেই   নিক্ষেপ করা হয়। আরো একপ্রকার যজ্ঞ আছে যাকে  বলা হয় প্রাণযজ্ঞ বা প্রাণায়াম যজ্ঞ। আমরা শুনেছি, প্রাণের সাধন করতে করতে প্রাণক্রিয়ার উচ্চ-অবস্থা প্রাপ্ত হয় - অর্থাৎ যজ্ঞের শেষ অবস্থা। যজ্ঞের  শেষভাগ যিনি গ্রহণ করেন, তিনিই আসলে যজ্ঞাবশেষ ভোজনকারী। এই সময় তিনি ব্রহ্মে স্থিত হন। আর ব্রহ্মে স্থিত হলে, মন বিষয় ভ্রমন থেকে বিরত থেকে নিষ্পাপ হয়। প্রাণে অপান, আর অপানে  প্রাণের হবন - এই হচ্ছে প্রাণায়াম যজ্ঞ। এই প্রাণায়ামের দ্বারাই ইন্দ্রিয় বহির্মুখ থেকে অন্তর্মুখী হয়। প্রাণায়ামের দ্বারা নিরন্তর অগ্নি উদ্গারিত হচ্ছে। এই অগ্নি আমাদের শরীরকে শীতলতা থেকে রক্ষা করছে। তা না হলে শরীর  নিস্তেজ হয়ে যেত। এই যে অগ্নিকুন্ড প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে, এখানে বিষয় বাসনার হোমযজ্ঞ সম্পাদন করতে হয়। এখানেই ইন্ধন দেওয়া হচ্ছে অন্ন-পানাদি দ্বারা। এইভাবে যা বল বা পুষ্টি হবে, তার দ্বারাই সাধনক্রিয়ার শক্তি অর্জন করতে হবে। যদি সমস্ত ভোগবৃত্তি ইন্ধন হিসেবে আহুতি দিয়ে প্রাণকে প্রজ্জ্বলিত রাখা যায়, তবে সাধনক্রিয়ার  সাহায্যে আমাদের দৈবশক্তি জাগ্রত হতে পারে। তা না হলে, আমাদের ভোগ-বাসনার ইন্ধন আমাদের শরীর-মনকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। এতে আত্মদর্শন তো হবেই না, বরং দেহ-মন-বুদ্ধি অগ্নিদগ্ধ হবে, শেষে প্রানাগ্নি নির্বাপিত হবে। এই ভোগ-বাসনার ইন্ধনে যে অগ্নি প্রজ্জলিত হয়, একেই বলে পাপ।  এই পাপের  ফল হচ্ছে মৃত্যু।  

-------------------        
১৮.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - তৃতীয় অধ্যায়  - কর্ম্মযোগঃ      
শ্লোক নং ৩/১৪-৩/১৫

অন্নাদ ভবন্তি ভূতানি  পর্জ্জন্যঃ-অন্নসম্ভবঃ
যজ্ঞাদ ভবতি  পর্জ্জন্যো যজ্ঞঃ কর্ম্ম-সমুদ্ভবঃ।  (৩/১৪) 

সমস্ত ভূত (জীবগন) অন্ন থেকে উৎপন্ন হয়।  অন্ন উৎপন্ন হয় জল (মেঘ) থেকে।  মেঘ জন্মায় যজ্ঞ থেকে। যজ্ঞ নিস্পন্ন হয় কর্ম্ম থেকে। 
এখানে যেন আমরা উপনিষদের ধ্বনি  শুনে পাই, সেখানেও বলা হয়েছে, যজ্ঞ থেকে ধূম্রের উৎপন্ন হয়, ধুম্র  অর্থাৎ মেঘ থেকে বৃষ্টি বা জল, আর জল থেকে অন্নের সৃষ্টি  হয়, আবার এই অন্ন থেকেই প্রাণের সৃষ্টি হয়ে থাকে।  

কর্ম্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি ব্রহ্মাক্ষরসমুদ্ভবম 
তস্মাৎ সর্ব্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম। (৩/১৫)

কর্ম্ম উৎপন্ন হয় জ্ঞান থেকে । জ্ঞান উৎপন্ন হয় একাক্ষর ব্রহ্ম থেকে। এই ব্রহ্ম সর্ব্বব্যাপী। ব্রহ্ম সদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত। 

সমস্ত কিছুর  মধ্যেই ব্রহ্ম। আবার ব্রহ্মের মধ্যেই সমস্ত কিছু স্থিত।   এই ব্রহ্ম থেকেই সমস্ত জগতের উৎপত্তি। যজ্ঞ দ্বারা মেঘ, মেঘ থেকে জল, জল থেকে অন্ন,  অন্ন থেকে জীবের উৎপত্তি।

এখন কথা হচ্ছে ব্রহ্ম থেকে সমস্ত কিছুর উৎপত্তি, তো এই ব্রহ্মকে জানবো কি করে ?  দেখুন জগতের অনেক বস্তু সম্পর্কে অনেক কিছু জানি, কিন্তু এমন বস্তুও আছে, যার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। সেই জ্ঞান হচ্ছে ব্রহ্মজ্ঞান। এই ব্রহ্মজ্ঞানের সাথে অন্য কোনো জ্ঞানের  তুলনা হয় না। তিনি জ্ঞান-অজ্ঞানের পারে অবস্থান করেন। যত  জ্ঞাত বস্তু আছে, এমনকি যত  অজ্ঞাত বস্তু আছে, এই দুই প্রকার বস্তুরও উর্দ্ধে এনার  অবস্থান। এই ব্রহ্মজ্ঞান হচ্ছে আত্মজ্ঞান। অর্থাৎ নিজের স্বরূপকে জানা। বিবিধ শাস্ত্র গ্রন্থ পাঠ করে, এমনকি শিক্ষকের মুখে শুনে এই জ্ঞানের স্ফূরণ হতে পারে না।  এই জ্ঞান আসলে পরম্পরাগতভাবে গুরু থেকে শিষ্যের মধ্যে স্ফূরিত হয়।  প্রদীপ থেকে সহজেই  প্রদীপ জ্বালানো যায়। অথচ অগ্নি সর্বত্র আছে, কিন্তু সেই অগ্নি আমাদের কোনো কাজে আসে না, বা আমাদের অনুভূতিতেও আসে না। কিন্তু প্রজ্বলিত প্রদীপ থেকে হাজার প্রদীপ জ্বালানো যেতে পারে। তেমনি  গুরুসান্নিধ্যে এলে, এই জ্ঞান একদিন হঠাৎ করে, সাধকের অন্তরে দপ  করে জ্বলে ওঠে। এটি যে কেমন করে হয়,  তা কাউকে বাক্য দ্বারা প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। আপনি যত শাস্ত্রজ্ঞ হন, বা যত  বড়ো পণ্ডিত হন না কেন, আপনি ব্রহ্মকে জেনে যাবেন, এমনটা হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এখন কথা হচ্ছে, তাহলে কি সেই ব্রহ্মজ্ঞ-গুরুদেবই একমাত্র ভরসা ? গুরুদেব ভরসা একথা যেমন ঠিক তেমনি নিজেকে তৈরী না করতে পারলে এই জ্ঞানাগ্নি প্রজ্বলিত হতে পারে না। ইন্ধন সমূহকে ঘর্ষনের দ্বারা, অর্থাৎ কাঠে কাঠে ঘর্ষনের দ্বারা শূন্যের এই অগ্নি প্রকাশিত হতে পারে। স্থুল  বায়ুর মধ্যে যেমন আছে প্রাণশক্তি, তেমনি এই প্রাণের মধ্যে আছে চৈতন্যশক্তি। তাই  প্রাণায়াম ক্রিয়ার দ্বারাই একমাত্র এই জ্ঞানাগ্নি আমাদের হৃদয়ে স্ফূরিত হয়ে উঠতে পারে। একেই বলে প্রাণ-যজ্ঞ। এই প্রাণ-যজ্ঞ দ্বারা শরীরের মধ্যে অগ্নির স্ফুলিঙ্গ  হতে পারে। এই অগ্নিশিখার মধ্যে আহুতি দিতে হয়, আমাদের কামনা-বাসনা-সংকল্পকে।   এই অগ্নি দ্বারা উদ্দীপ্ত হয়ে প্রাণবায়ু যখন সুষুম্নার অর্থাৎ সূর্য্যরশ্মির সাহায্যে বিন্দু অর্থাৎ সূক্ষ্ম ও স্থুল  জগতের মিলনস্থলে স্থির হয়ে অবস্থান করে, তখন বহির্জগৎ ও অন্তর্জগৎ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান হয়। অর্থাৎ তখন তার একদিকে স্থুল জগৎ দৃশ্যমান হয়, আবার অন্যদিকে সূক্ষ্ম জগৎ প্রতীয়মান হয়। 

ব্রহ্ম থেকে ব্রহ্মান্ডের উৎপত্তি। তাঁর শক্তিতেই সমস্ত কিছু প্রকাশিত, আবার তাঁর মধ্যেই সমস্ত কিছুর লয় হচ্ছে। কথায় বলে, সবই কালের অধীন। এই কালের উৎপত্তি হচ্ছে ওঙ্কার বা শব্দব্রহ্ম থেকে। কাল যার উৎপত্তির কারন, তার লয় হয় কালেরই  মধ্যে।  আবার এই কালের কাল হচ্ছে মহাকাল - পরব্রহ্ম। এই পরব্রহ্ম হচ্ছে মহাকাশ। সাধকের চিদাকাশ। এই চিদাকাশে অবস্থান  করাকেই বলে সাধকের সাধনার পরাবস্থা। এই চিদাকাশ হচ্ছে নিরঞ্জন, (অর্থাৎ কাজল-বিহীন) শুদ্ধ, নির্মল। এই শুদ্ধ অবস্থা বিরাজ করছে আমাদের সুষুম্নার মধ্যে। আর সুষুম্না হচ্ছে সূর্য্যরশ্মি মাত্র । 

অব্যক্ত সেই কূটস্থ হচ্ছেন অক্ষর। এই কূটস্থের স্থান হচ্ছে আজ্ঞাচক্র। আবার এই আত্মজ্যোতি হচ্ছে ধ্বনির অন্তর্গত।  অর্থাৎ ধ্বনিকে অবলম্বন করেই এখানে, এই জ্যোতির্মণ্ডলীতে  পৌঁছানো যায়। এই ধ্বনিকেই বলে শব্দব্রহ্ম, মহাকাশ, বিশুদ্ধচক্রে যার অবস্থান। এই শব্দব্রহ্ম থেকেই এসেছে প্রাণ বা বায়ুতত্ত্ব।  এই বায়ুতত্ত্ব আবার প্রাণকে ধারণ করে আছে। এই বায়ুতত্ত্বের স্থান আমাদের হৃদয় বা অনাহত চক্র। আবার এই প্রাণবায়ু জীবকুলের শ্বাসপ্রশ্বাস রূপে অবস্থান করছে বলেই, ইন্দ্রিয়সকল কর্ম্মে সক্ষম। সুতরাং প্রাণকর্ম্ম থেকে প্রাণের সাথে একাত্ম হওয়া যায়, প্রাণ আবার সাধককে শব্দব্রহ্মের কাছে নিয়ে যায়, শব্দব্রহ্ম আবার মহাকাশে নিয়ে যায়।  আর এই মহাকাশে মন রাখলে সাধক সর্বজ্ঞ হতে পারেন। 

তো প্রাণকর্ম্ম থেকে তেজের বিকাশ।  এই তেজতত্ত্ব আছে আমাদের মনিপুর চক্রে। এই তেজতত্ত্ব না থাকলে, জীবকুল জড়বৎ হয়ে যায়। তো প্রাণক্রিয়া থেকে তেজের বৃদ্ধি।  তার প্রাণক্রিয়াকে বলা হয় যজ্ঞ। এই ক্রিয়াশক্তি সঞ্চালনের ফলে রস বা আনন্দ উৎপন্ন হচ্ছে।  এই রস-তত্ত্বের  অবস্থান হচ্ছে আমাদের স্বাধিষ্ঠান চক্রে। এই রসতত্ত্ব হচ্ছে কারণবারি।  ভবিষ্যতের ফল-উৎপাদক এই কারন-বারি।  এই কারন-বারির মধ্যে নারায়ণের শয়ন  শয্যা। আবার শুক্ৰমধ্যে আছে শক্তিবীজ। এই রস-তত্ত্ব-এর মধ্যে নিহিত আছে জগতের বীজ।  একেই ক্ষিতিতত্ত্ব বা মূলাধার বলা হয়ে থাকে এখান থেকেই জীবের অনন্ময় কোষের অর্থাৎ স্থুল শরীরের জন্ম। সমস্ত কর্ম্ম  এই স্থুল বা পিন্ড দেহে নিস্পন্ন হয়ে থাকে।  আর কর্ম্ম অনুযায়ী ভোগায়তন বা কর্ম্মশরীর উৎপন্ন হয়।  এই মূলাধারকেই বলা হয় মায়া চক্র।  এখন এই  যোগমায়া যোগনিদ্রায় বিরাজ করছেন। এঁকে আমাদের জাগাতে হবে।  এঁকে জাগানোই যজ্ঞ। এই মূলাধার চক্রের জয় না করতে পারলে, আমাদের দেহাভিমান যাবে না। আমাদের স্থূল দেহের যে অভিমান, আমাদের যে অজ্ঞান অর্থাৎ দেহাভিমান, সংসার চিন্তা ইত্যাদির উৎপত্তি এখান থেকেই হয়ে থাকে। 

আমরা যখন অনুলোম-বিলোম রূপ যজ্ঞ ক্রিয়া একাগ্রতার সাথে  শুরু করবো,  যখন যজ্ঞেশ্বর বিষ্ণুতে মন নিবিষ্ট হবে, তখন অনুভব করবো, সমস্ত কিছুর মধ্যে এই যজ্ঞেশ্বর বিষ্ণুই অবস্থান করছেন। এই প্রাণযজ্ঞের দুটো ভাব, প্রথম হচ্ছে বাহ্যভাব - যা আমাদের স্থুল  শরীরের পুষ্টি সাধন করতে পারে, আমাদের সুস্বাস্থের জন্য, আমাদের জ্ঞান অর্জনের ক্ষমতার জন্য, আমাদের ধীশক্তি অর্জনের জন্য সম্পন্ন হতে পারে। আর একটি হচ্ছে আন্তরভাব।  প্রাণ যখন উর্দ্ধমুখী হয়, তখন সংসার অসার হয়ে যায়। মনের চঞ্চলতা দূর হয়ে যায়, মন ব্রহ্মে স্থিত হয়। তখন জন্ম-মৃত্যু বলে কিছু থাকে না।  কেবল কৈবল্যভাবের উদয় হয়। এই ভাবই মনুষ্যকে দেহের উর্দ্ধে স্থাপন করে। একেই বলে জীবনমুক্ত অবস্থা। সবই এই প্রাণ যজ্ঞের ফল স্বরূপ সাধকের কাছে এসে উপস্থিত হয়।  

-------------------                     

 ১৯.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - তৃতীয় অধ্যায়  - কর্ম্মযোগঃ      
শ্লোক নং ৩/১৬-৩/১৮

এবং প্রবর্ত্তিতং চক্ৰং ন অনুবর্ত্তয়তীহ যঃ
অঘায়ুঃ-ইন্দ্রিয়ারামো মোঘং পার্থ স জীবতি।  (৩/১৬)

হে পার্থ, যিনি এই প্রবর্ত্তিত  কর্ম্ম চক্রের অনুবর্ত্তন না করেন তিনি পাপযুক্ত ইন্দ্রিয়াশক্ত পুরুষ। বৃথাই তার জীবন ধারন। 

এই যে ছয়টি কর্ম্ম চক্র অর্থাৎ আজ্ঞা চক্র  থেকে মূলাধার পর্যন্ত (আজ্ঞা, বিশুদ্ধি, অনাহত, মনিপুর, স্বাধিষ্ঠান, মূলাধার) অর্থাৎ সূক্ষ্ম থেকে স্থূল পর্যন্ত একদম শেষে ওঙ্কারের আকার, এগুলো সবই স্থুল থেকে সূক্ষ্ম শরীরের কার্যকলাপের্ ক্ষেত্র। সাধনার পথ বা ক্ষেত্র এখানেই। অনুলোম ক্রিয়া করতে করতে একবার নিচ থেকে উপরে আবার উপর থেকে নিচে প্রত্যাবর্তন করতে হয়। অর্থাৎ জাগ্রত থেকে সুষুপ্তি, সুষুপ্তি থেকে জাগ্রত, গুহ্যদ্বার থেকে ব্রহ্মরন্ধ্র, আবার ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে গুহ্যদ্বার, এক ত্রিবেণী থেকে আর এক ত্রিবেণী এই যাতায়াতের যখন সাধক সড়গড়  হয়ে ওঠে, তখন মূলাধার স্থিত চৈতন্য শক্তি তার সঙ্গে যুক্ত হয়। এই ক্রিয়াই প্রাণের চাঞ্চল্য দূর করে দেবে, মনের অস্থিরতা দূর করে দেবে, আর মন-প্রাণ যখন সমত্ত্বভাব সম্পন্ন হবে তখন যে অবস্থা সাধকের হয়, তাকেই  বলে সমাধি।
আবার  ইড়া-পিঙ্গলায়, বা সূর্য নাড়ী ও চন্দ্র নাড়ীর মধ্যে যে শ্বাসক্রিয়া এর সঙ্গে মনকে জুড়ে নিয়ে বিচরণশীল হলে, প্রাণ ও মন বিলীন হয়ে সংকল্প-বিকল্পহীন হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় মূলাধারে স্থিত শক্তি সহস্রারে উঠে আসে।
এছাড়া গায়ত্রী, মহামৃত্যুঞ্জয়, অথবা প্রণবপুত যেকোনো মন্ত্র মুহুর্মুহু জপের  ফলেও সংকল্প-বিকল্পের বিনাশ হয়। 
এগুলো সবই মনকে স্থির রাখার কৌশল। একেই বলে প্রবর্তিত কর্ম্মচক্র। এই কৌশলে যে সচেষ্ট নয়, সে ইন্দ্রিয়পরায়ণ হয়ে থাকে। আর ইন্দ্রিয়ভোগ করতে করতেই জীবনের প্রান্তে  এসে পরে। বিষয়ভোগেই জীবন শেষ হয়ে যায়।

পুনশ্চ : ক্রিয়া সম্পর্কে আরো  একটু গভীরে যাবো। ক্রিয়া যখন স্থির হয় তখন হয় ধ্যান। এই ধ্যানের  একটা পরম্পরা আছে। 
দেখুন একদিকে মা আর একদিকে বাবা মাঝে সন্তান। প্রজননে তাঁরা মিলিত হলে ফল হয় সন্তান। এই হচ্ছে বংশধারার ধ্যান। 
শরীরের ধ্যানে প্রথম হলো নিম্ন চোয়াল, ও শেষ হলো উর্দ্ধ চোয়াল, এর মধ্যে আমাদের বাগেন্দ্রিয়।  জিভের দ্বারা এরা পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। এই হচ্ছে দেহমনের ধ্যান। 
একদিকে আচার্য্য আর একদিকে শিষ্য, এর মধ্যে আছে শিক্ষাগ্রহণ।  এই হচ্ছে শিক্ষাবিষয়ক ধ্যান। 
একদিকে আছে অগ্নি আর একদিকে আছে জ্যোতির্ময় বস্তু আদিত্য, এদের মধ্যে আছে জল, বিদ্যুৎ এদের মিলন করে থাকে। এইভাবে জ্যোতির্ময় বস্তুর ধ্যান হয়ে থাকে।
 একদিকে আছে পৃথিবী আর দিকে আছে স্বর্গ এই দুয়ের মাঝে আছে অন্তরীক্ষ বা আকাশ।  বায়ু এদের যুক্ত করছে। এই যে ধ্যানের  পরম্পরা বা কর্ম্মচক্র একে অবশ্য়ই মেনে চলতে হয়।     

যঃ তু আত্মরতিরেব স্যাৎ আত্মতৃপ্তশ্চ মানবঃ 
আত্মন্যেব চ সন্তুষ্টস্তস্য কার্য্যং না বিদ্যতে। (৩/১৭)

যিনি আত্মাতেই প্রীত, আত্মাতেই তৃপ্ত ও আত্মাতেই সন্তুষ্ট থাকেন, তার কোনো কর্তব্য থাকে না। 

সাধকের এই ক্রিয়ার পরাবস্থাতে না যাওয়া পর্যন্ত অর্থাৎ ব্রাহ্মে স্থিত না হওয়া পর্য্যন্ত, এই ক্রিয়ার মধ্যে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে হয়। একবার আত্মসাক্ষাৎকার লাভ হলে, এই কর্ম্ম তোমার স্বভাবজাত হয়ে যাবে। তখন এই ক্রিয়া স্বাভাবিকভাবে সম্পাদিত হতে থাকবে।  আর যখন প্রাণের গতি সুষুম্নামুখী হয়ে আত্মারাম হয়ে গেছে, তখন আর বিষয়ে দৃষ্টি নেই। বিষয়বিমুখ এই সাধকের তখন আর কোনো বাহ্যিক কর্তব্য থাকে না। যার  দৃষ্টি জড় বিষয়ের দিকে নেই, তার আবার বিষয়কর্ম্ম কিসের ? আত্মাতেই তার সমস্ত ক্রিয়া, আত্মাতেই যার স্থিতি, আত্মাতেই যার রতি, তিনি স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই সাধনক্রিয়ার রত থাকেন, আর সাধনফল স্বরূপ পরা শান্তির মধ্যে বিরাজ করেন।   

নৈব তস্য কৃতেনার্থো ন অকৃতেনেহ কশ্চন 
ন চাস্য সর্ব্বভূতেষু কশ্চিদ-অর্থব্যপাশ্রয়ঃ। (৩/১৮)

তাঁর কর্ন্মানুষ্ঠানের কোনো প্রয়োজন না, আবার কর্ম্ম না করারও কোনো কারন নেই। সর্ব্বভূতের মধ্যে কারুর আশ্রয়ের তাঁর প্রয়োজন নেই। 

যিনি আত্মাতে স্থিত, যিনি আত্মারাম তার  না জাগতিক না আধ্যাত্মিক কোনো কর্ম্মই  তার অবশিষ্ট থাকে না। পরমাত্মা যেমন সমস্ত ভূতে  অবস্থিত, তেমনি তিনিও সর্বভূতেই অবস্থান করছেন। তখন  তার মধ্যে অহঙ্কারের লেশ মাত্র থাকে না। আর যার অহঙ্কার নেই, তার আবার কর্ম্মফল কিসের ? আর কর্ম্মফল না থাকলে কর্ম্মবন্ধনও থাকে না। তিনি অদ্বৈত ব্রহ্মে স্থিত।  এই অবস্থায়, তার কর্ম্ম আমিত্ববিহীন হয়ে সম্পাদিত হয়ে থাকে। জ্ঞানের উচ্চস্তরে ইনি অবস্থান করছেন। এখন না আছে হারাবার ভয়, না আছে কোনোকিছু পাবার আকাংখ্যা। একেই ক্রিয়ার পরাবস্থা বলা হয়ে থাকে। এনার বিঘ্ন হবার কিছু নেই, আবার বিঘ্ন করবারও  কেউ নেই। এইসময় তিনি স্ব-রূপে স্থিত। পরমাত্মা যেমন সর্বভূতে স্থিত, এই ব্রহ্মজ্ঞ স্থিতপ্রজ্ঞ পুরুষ সর্বভূতে অবস্থান করেন।  তাই আলাদা করে কোনো আশ্রয়ের প্রয়োজন থাকে না। 
---------------------------   

 ২০.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - তৃতীয় অধ্যায়  - কর্ম্মযোগঃ      
শ্লোক নং ৩/১৯-৩/২১

তস্মাৎ অসক্তঃ সততং কার্য্যং কর্ম্ম সমাচার 
অসক্তো হ্যাচরণ কর্ম্ম পরমাপ্নোতি  পুরুষঃ।  (৩/১৯)

অতএব তুমি আসক্তিশূন্য হয়ে অবিরত কর্ম্ম করো। কারন, এইভাবে কর্ম্ম করলে পুরুষ পরম-পদ প্রাপ্ত হয়।
আসক্তি  ত্যাগ করে কর্ম্ম করলে সেই পরম-পদ  পাওয়া যায়। কিন্তু কথা হচ্ছে, আসক্তি কেন হয় আমাদের ? ফলাকাঙ্খ্যা ও কর্ম্ম  ফলপ্রাপ্তির মধ্যে যখন একটা সাযুজ্য থাকে তখন সেই কর্ম্মের মধ্যে আমাদের আগ্রহ  জন্মায়। আর যদি ফলাকাঙ্খ্যা ও কর্ম্ম ফল প্রাপ্তির মধ্যে সাযুজ্যের অভাব হয়, তখন সেই কর্ম্মে আমাদের অনাগ্রহ  জন্মায়। এই আগ্রহ ও অনাগ্রহ  ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে কর্ম্মের আসক্তি বা অনাসক্তি জন্মায়।  কিন্তু ফলাকাঙ্খ্যা কেন করি আমরা ? তার কারন হচ্ছে, আমাদের দেহ-বোধ। এই দেহবোধ যখনই জাগ্রত হয়, তখন থেকেই আমাদের এই দেহকে রক্ষা করবার একটা প্রবৃত্তি আমাদের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই আসে। শিশুর দেহে যখন ক্ষুধার উদ্রেগ হয়, তখন সে খাবারের আকাংখ্যা করে থাকে। খাবার পেলে একটা তৃপ্তি অনুভব হয়।  আর বার-বার এই ক্ষুধার উদ্রেগ হবার ফলে, বার বার সেই ক্ষুধার নিবৃত্তির জন্য সে  খাবারের প্রত্যাশী হয়। তো দেহাভিমান যতক্ষন থাকবে, ততক্ষন আমাদের কর্ম্মের প্রতি আসক্তি থাকবে। ঠিক তেমনি মানসিক শরীরের জন্যও আমাদের খাবারের প্রয়োজন হয়, এই মানসিক শরীরের পুষ্টির জন্য, বা মানসিক শান্তির জন্যও আমাদের মানসিক কর্ম্মের প্রতি আসক্তি জন্মায়। এমনকি আমরা যখন সাধন-ক্রিয়া করি, তখনও আমাদের এই শারীরিক ও মানসিক শরীরের উন্নতির জন্য এই সাধনক্রিয়াতে প্রলুব্ধ  হই। প্রাণায়াম করলে, আমাদের শরীর ভালো থাকবে, এমনকি সাধনক্রিয়ার ফলে অনেক ঐশ্বরিক শক্তি অধিকারী হতে পারবো। এই সব ভাবনা সাধকের মধ্যেও এসে থাকে। 

তো আকাঙ্খ্যা, কর্ম্মফলের প্রত্যাশা আমাদের শরীরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।  আর এই শরীরই  একমাত্র কর্ম্মক্ষেত্র ।  এই শরীরে থেকেই আমাদের কর্ম্মক্ষমতা ভোগ করে থাকি। বিদেহির কোনো কর্ম্ম থাকে না। তাই আমরা কর্ম্মহীন হয়ে যেমন বাঁচতে পারি না, তেমনি কর্ম্মফলের প্রত্যাশী হয়েই আমরা কর্ম্মে নিযুক্ত হয়ে থাকি। যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ  বলছেন, এইজায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে  হবে।  কর্ম্ম আমাদের থাকবে, কিন্তু সেই কর্ম্ম হবে অনাসক্ত,  আসক্তিহীন। 

দেখুন, শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধের লোভে, আমাদের বহু জন্ম ব্যতীত হয়েছে। এই বিষয় সেবাতেই আমাদের হাজার হাজার বছর দেহ থেকে দেহান্তরে কেটে গেছে। এখন যোগেশ্বরের  সান্নিধ্যে এসে আমরা সাধনক্রিয়ার কথা শুনছি। এখনো জানিনা, এই করে আমাদের গভীর গর্ভযন্ত্রণার অবসান ঘটবে কি না। বস্তুর মায়া  কাটিয়ে উঠতে পারবো  কি না। শিশুর মতো মল-মূত্র নিয়ে  ঘাটাঘাটি করবো কি না। 
নিষ্কাম ভাবে সাধনায় লিপ্ত হতে পারলে, ক্রিয়ার পরাবস্থা লাভ হতে পারে। নিষ্কাম পুরুষের চিত্ত স্থির  থাকে। তাই এই নিষ্কাম পুরুষই মায়ার বাঁধন  কেটে, দুঃখের সংসার নদী অতিক্রম করে, পরম-আত্মাতে স্থিত হতে পারে। পরম-পুরুষের মধ্যে প্রবিষ্ট হওয়াই জীবের দেহধারনের উদ্দেশ্য।  আমরা আজ এই যোগেশ্বরের সান্নিধ্যে এসে সেই স্মৃতি যদি জাগিয়ে তুলতে পারি , তবেই গীতাপাঠের সার্থকতা। নতুবা বৃথাই সব  ভষ্মে ঘি ঢালা।     

কর্ম্মণৈব হি সংসিদ্ধিম-আস্থিতা জনকাদয়ঃ
লোকসংগ্রহম এবং অপি সংপশ্যন কর্ত্তুম  অর্হসি।  (৩/২০)

যেহেতু জনকাদি জ্ঞানীগণ কর্ম্মের দ্বারাই সম্যক সিদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছেন।  লোক সংগ্রহের দিকে দৃষ্টি  রেখে কর্ম্ম করা তোমার কর্ত্তব্য।

রাজা জনক থেকে বহু ঋষিমুনি, অনেকেই সংসার করতেন। এঁরা সবাই, লোকহিতকর কর্ম্মে নিয়োজিত থাকতেন। তাদের সংসারযাত্রা, যাবতীয় কর্ম্ম  সংসারের হিতের জন্য করে থাকতেন। স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি ক্রিয়া-কর্ম্ম না করলেও তাদের জীবন প্রবাহে কোনো ক্ষতি হয় না। আপনি আজ যার জন্য নিষ্কামকর্ম্ম করছেন, আপনি জানবেন, আপনার সেই কর্ম্মের ফল, আপনাকে অবশ্যই ঈশ্বর ফিরিয়ে দেবেন।  এইজন্য বলা হয়ে থাকে জ্ঞানী পুরুষের কাজ অন্য সবাই সম্মিলিতভাবে  করে দেয়।  ফলত তার সমস্ত কর্ম্ম এমনকি দেহ ধারনের জন্য যে কর্ম্ম সবই কেউ না কেউ করে দেবেন। তাই বলে আত্মারাম পুরুষ কখনোই কর্ম্ম থেকে বিশ্রাম নেন না। আত্মারাম পুরুষ কর্ম্ম করে থাকেন, নিজের জন্য নয়, জগতের কল্যাণের জন্য। কিছু কিছু অজ্ঞানী পুরুষ এইসব জ্ঞানী মহাপুরুষের নিষ্কাম অবস্থা দেখে, ভাবেন কর্ম্মই বন্ধনের কারন, আর তারাও কাজকর্ম্ম ছেড়ে দিয়ে জ্ঞানী-পুরুষ সেজে  বসেন। অথচ মনের মধ্যে কামনার জন্ম দিতে থাকেন।  ক্রিয়া ত্যাগ করলে, জ্ঞানীর কিছু এসে-যায় না, কিন্তু অজ্ঞানীর অধঃপতন হয়। যিনি পর্ব্বতের শিখরে পৌঁছেছেন, তার সামনে দুর্গম পথের ইতি, কিন্তু যিনি পাদদেশে আছেন,  তার সামনে বিস্তর পথ। চিত্তশুদ্ধি করতে হলে, অবশ্যই  ক্রিয়া করতে হবে।  আর ক্রিয়ার ফলে চিত্তশুদ্ধি হলে মনের ময়লারূপ  বিষয়াসক্তি জমে না। মসৃন  পালিশের উপরে ময়লা জমতে পারে না, কিন্তু  কিন্তু যতক্ষন পালিশ না হচ্ছে, ততক্ষন ময়লা পরিষ্কার প্রক্রিয়ায় নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে হয়। 

যতক্ষন তুমি ব্রহ্মজ্ঞ না হতে পারছো, ততক্ষন তোমার মধ্যে যে পুরুষকার আছে, যে ক্ষত্রিয় শক্তি আছে, তার দ্বারা কাম-ক্রোধ-হিংসা-দ্বেষ ইত্যাদি যাবতীয় রিপুগুলোকে বশে আনাই তোমার স্ব-ধর্ম্ম জেনো। রাজা জনক ছিলেন বিদেহরাজ, অর্থাৎ দেহাত্মবুদ্ধির উর্দ্ধে শুদ্ধবুদ্ধ স্বরূপ। শুভ্রজ্যোতিকে তিনি লাভ করেছিলেন। এখন এই শুভ্রজ্যোতি তিনি কোথা থেকে পেলেন ? এই দেহভুমিতেই সাধন ক্রিয়া ক'রে, তিনি দেহাতীত বা বিদেহ অবস্থা লাভ করেছিলেন। তোমাকেও এমন কার্য করতে হবে, যা দেখে সাধারণ লোকর লোকশিক্ষা হয়। আর লোকশিক্ষা দিতে গেলে, নিজেকে তৈরী করতে হয়।  নিজে কাজ না করে, অন্যকে কাজের কথা বললে, তা হবে শুষ্ক জ্ঞানের কথা।  এতে লোকশিক্ষা হবে না।  নিজে ফাঁকি দেবে, আর অন্যকে বলবে ফাঁকি না দিতে, এতে করে আর যাই হোক, কারুরই কল্যাণ হতে পারে না।
যোগীপুরুষ হতে গেলে, অনেক বেশি খাটতে হবে।  অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হবে। মূলাধার থেকে অর্থাৎ পৃত্থি থেকে সহস্রার অর্থাৎ ব্যোমতত্ত্ব অবধি বার বার যাতায়াত করতে হবে। সমস্ত ভূমিকেই নিজের আয়ত্ত্বে আনতে হবে। সমস্ত গতিপথে নিজের অবাধগতি সম্পন্ন করতে হবে। প্রত্যেকটি লোকেই নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হবে। স্বচ্ছন্দ হতে হবে। শেষে সহস্রারে এসে দেহাভিমান সহ অংহকারকে আহুতি দিতে হবে। এই আহুতি দিতে পারলেই বিদেহরাজ হওয়া যায়। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সমস্ত ক্রিয়াযোগীকে ক্রিয়া করে যেতে হবে। একেই ঋষি পতঞ্জলি বলছেন  নিদিধ্যাসন।     

যদ্ যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ 
স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকঃ তৎ অনুবর্ত্ততে। (২/২১) 

শ্রেষ্ট ব্যক্তিগন যা তারা আচরণ করেন, অন্য সাধারণ সেই সেই কার্য্য করে।  সেই শ্রেষ্ট ব্যক্তি যা প্রমান বলে মনে করেন আর সাধারণ লোকসকল অনুসরণ করে। 

আপনি যেমন আচরণ করবেন, আপনার সন্তানগন তেমনই আচরণ করতে শিখবে। আপনি হয়তো বললেবন, আমাকে যা মানায়, আমার যা সহ্য হয়, তা তো অন্যের সহ্য নাও হতে পারে। কিন্তু মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হচ্ছে অন্যকে অনুসরণ করা। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, মানুষ ভালোর  থেকে খারাপটার দিকে বেশি করে আকৃষ্ট হয়ে থাকে। তাই আপনি যদি আদর্শ পুরুষ হতে চান, তবে নিজের কর্ম্মের মুখে লাগাম লাগান। আবার নিষ্কর্মা হয়ে থাকলে, সেই আদর্শও অন্যের কাছে গ্রহণীয় হবে।  তাই আপনাকে সর্বদা সতর্ক হতে হবে। 
সমস্ত সফল ব্যক্তিকে আমরা আদর্শপুরুষ হিসেবে দেখি। আর সাধারণ লোক এই সফল ব্যক্তিকে শ্রেষ্ট ব্যক্তি বলে মনে করে, ও  নির্ব্বিচারে অনুসরণ করে থাকে। তাই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে সবসময় সাবধানতার সঙ্গে চলতে হয়। 

দেহাদির মধ্যে আমাদের মন হচ্ছে শ্রেষ্ট। সমস্ত ইন্দ্রিয়গনের মধ্যে মন হচ্ছে রাজা। এই মনের কর্ম্ম অর্থাৎ চিন্তারাজিই একজন মানুষের সম্বল - পরিচায়ক। এই মন যা চিন্তা করে, ইন্দ্রিয়সকল সেই দিকেই  ধাবিত হয়। মন যদি বিষয়ের দিকে না ছুটে ভগবানের দিকে ছোটে তবে আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয় ভগবানের দিকে ছুটতে বাধ্য হবে। আর  ইন্দ্রিয় সকল ভগবানের কাজেই লিপ্ত হবে। এইজন্য সাধনক্রিয়াতে মন একবার বসে গেলে, মন আর অন্যদিকে ছুটতে চাইবে না। ইন্দ্রিয়গণও আর কোনো দৌরাত্ম করতে পারবে না। রাষ্ট্রের রাজা (শাসক-গোষ্ঠী) যদি বাসনাশূন্য হয়, লোককল্যান যদি রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হয়, রাজা যদি নিজে কর্মঠ হয়, তবে প্রজাসকল তাকেই অনুসরণ করবে। আমাদের মন যদি ব্রহ্মে স্থিত থেকে অর্থাৎ ক্রিয়ার পরাবস্থায়  স্থির হয়ে যায়, তবে ইন্দ্রিয়সকল মনের সঙ্গে স্থির হয়ে যাবে। রানী মৌমাছি যেখানে বসবে, শ্রমিক মৌমাছি সেখানেই মধু সংগ্রহ করে নিয়ে আসবে। তো প্রাণবায়ুকে শুদ্ধ  করে,মনকে স্থির করে, কূটস্থে অবস্থান করতে হবে । 
-------------------    

২১.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - তৃতীয় অধ্যায়  - কর্ম্মযোগঃ      
শ্লোক নং ৩/২২-৩/২৪

ন মে পার্থ অস্তি কর্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন 
ন অনব্যাপ্তম-অব্যাপ্তম বর্ত্ত এব চ কর্ম্মণি। (৩/২২)

হে পার্থ, তিন লোকের মধ্যে, আমার কিছুই কর্তব্য নেই, আমার অপ্রাপ্ত ও অপ্রাপ্য বলে কিছুই নেই, তথাপি আমি নিরন্তর কর্ম্ম-অনুষ্ঠানে ব্যাপৃত আছি। 
সাধনক্রিয়ার উচ্চ অবস্থায় সাধকের আর কিছুই করবার থাকে না। যেখানে সমস্ত কর্ম্মের লয় হয়, সেখানে আবার কর্ত্তব্য কর্ম্ম বলে কিছু থাকে নাকি ? যিনি জ্ঞানস্বরূপ, আত্মাতে স্থিত, আত্মারাম, তাঁর কোনো কর্ম্ম নেই। তিনি সমস্ত কর্তব্য কর্ম্মের উর্দ্ধে। আমরা অজ্ঞান, বদ্ধ জীব।  তাই বন্ধন কাটাবার জন্য, আত্মজ্ঞানের প্রয়োজন। এই আত্মজ্ঞান আমাদের ত্রিতাপজ্বালার নিবৃত্তি করতে পারে। যিনি সাধনক্রিয়ার ফলে আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন, যিনি নিজেকে জেনেছেন, যিনি নিজের স্বরূপে স্থিত হতে পেরেছেন, তিনি ইছারহিত অবস্থায়, অবস্থান করেন। তাই তাঁর সমস্ত প্রাপ্তির যে ইচ্ছে তার বিলোপ সাধন হয়। তখন তার কাছে মুক্তি পাবার ইচ্ছেও জাগতে পারে না। আসলে অহংকারের বিলোপ হয়। তো আমি-আমার বোধ যদি না থাকে তবে কে চাইব ?  দ্রষ্টা ও দৃশ্য যখন এক হয়ে যায়, তখন কার দেখবার ইচ্ছে থাকবে  ? ব্রহ্মকে যিনি জেনেছেন, তিনি নিজেই ব্রহ্ম হয়ে যান। তখন সমস্ত জগৎ একই স্বরূপতঃ ব্রহ্ম। যে তোমাকে জানে সে তখন তুমি হয়ে যায়। তো আমি-তুমি তখন আলাদা বলে কিছু থাকে না । 

তথাপি আমাদের কর্ম্ম করতে হয়। কারন যতক্ষন দেহে স্থিত আছি, ততক্ষন দেহের ধর্ম্ম পালন করতেই  হয়। আর দেহের ধর্ম্ম হচ্ছে কর্ম্ম। কর্ম্মহীন দেহ বলে কিছু হয় না। স্থুলদেহ  যতক্ষন থাকে, দেহের স্বাভাবিক কর্ম্ম স্বাভাবিক ভাবেই সম্পাদিত হতে থাকে। শরীর যতক্ষন থাকবে ততক্ষন প্রাণের ক্রিয়া চলতে থাকবে, শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রবাহ চলতে থাকবে। এমনি শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ  ক্রিয়াশীল থাকবে। তাঁর সমস্ত ইন্দ্রিয় ক্রিয়াশীল থাকবে। কর্ম্ম ইন্দ্রিয় তার কাজ করবে। কিন্তু সমস্ত  কাজ হবে লোকহিতকর - ব্যক্তিগত  ইছারহিত। আসলে তিনি তখন বিশ্বশক্তির ইচ্ছেতেই কর্ম্মরত  থাকেন। 

যতক্ষন  দেহাভিমান থাকে, ততক্ষন আমাদের কর্ম্মের বিরাম নেই। আবার সাধন ক্রিয়া করতে করতে আমরা যখন বায়ুকে স্থির করতে পারি, তখন আমাদের বাইরের ক্রিয়া থাকে না, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হয়ে যায়। কিন্তু শ্বাসের গতি রুদ্ধ হয় না। তখন বায়ুর গতিমুখ হয়, সুষুম্নার অন্তর্গত। দেহ-অভিমান চলে গেলেও অর্থাৎ দেহাতীত  অবস্থা প্রাপ্ত হলেও, দেহের কাজ একেবারে শেষ হয়ে যায় না। অর্থাৎ প্রাণক্রিয়া থাকে, তবে অনিত্য জগৎ-বোধের বিলোপ ঘটে। কারন শরীরের মধ্যে সুষুম্নার স্থিতি আছে, সূর্য্যরশ্মি এখনো সুষুম্নার মধ্যে বিচরণ করছে। এই সুসুম্নার মধ্যে জ্যোতিঃশক্তি প্রবাহিত থাকে বলেই এঁকে জীবনমুক্ত অবস্থা বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ  জীবনের ক্রিয়া আছে, কিন্তু আর সমস্ত ক্রিয়া স্থির হয়ে গেছে। আমাদের সুসুপ্তির অবস্থায় যেমন স্থুল শরীর থাকে, শরীরের ক্রিয়াও থাকে,  কিন্তু  মন, বুদ্ধি, স্থুল  ও সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয় সকল তখন নিষ্ক্রিয় হয়ে অবস্থান করে। প্রাণ--ক্রিয়ার অবসান হয় না। আর এই প্রাণক্রিয়ার অবসান হয় না বলেই, আমরা আবার সুষুপ্তি থেকে জাগ্রত অবস্থায় ফিরে আসতে পারি। প্রাণবায়ু তখন সূক্ষ্মতম অবস্থায় নিজের কার্য্য করতেই থাকে। প্রাণকে বলা হয় পরমাত্মার ক্রিয়াশক্তি।  এই ক্রিয়াশক্তির নিজস্ব কোনো প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি থাকে না, তবুও সে ক্রিয়া করে থাকে। সুসুপ্তির অবস্থায়  মনের ক্রিয়াও বন্ধ হয়ে যায়। তাই তখন  মনন বা অভিনিবেশ থাকে না। প্রাণক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে জীবন লীলার  অবসান হয়। ভূত-সকল আলাদা হতে শুরু করে।    
 
যদি হ্যহং ন বর্ত্তেয়ং জাতু কর্ম্মণ্য-অতন্দ্রিতঃ
মম বর্ত্মানুবর্ত্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্ব্বশঃ। (৩/২৩)

হে পার্থ, যদি আমি কদাপি  অনলসভাবে কর্ম্ম না করি,  তাহলে মনুষ্যসকল আমার পথ সর্বদা অনুবর্ত্তন করবে।

যিনি যাই করুন না কেন, সবাই আমরা প্রাণকেই  অনুসরণ করি। প্রাণের পিছুপিছু সমস্ত কর্ম্ম ও কর্ম্মফল  ধাবিত হয়। প্রাণ নিঃসরণের সঙ্গে সঙ্গে  জীব-আত্মা  তার মন, বুদ্ধি, অহংকার, ইন্দ্রিয়শক্তি, সংস্কার রূপে সঙ্গে নিয়ে  প্রাণের অনুগামী হয়।
আমাদের ইড়া নাড়ীতে যতক্ষন শ্বাসবায়ু প্রবাহিত হয়, ততক্ষন মানুষ  কর্ম্মে উদ্দমী হয়ে থাকে, আবার যখন আমাদের পিঙ্গলা নাড়ীতে শ্বাসবায়ু প্রবাহিত হয়, তখন আমরা আলস্যে অভিভূত হয়ে কর্ম্মহীন থাকতে ভালোবাসি। আবার  আমাদের শ্বাস যখন সুষুম্না নাড়ীতে প্রবাহিত হতে শুরু করে, তখন আমাদের মধ্যে জ্ঞান ইত্যাদি সাত্ত্বিক ভাবের উদয় হয়। তো সেই একই শ্বাসবায়ু তার গতিপথের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মধ্যে ভাবের পরিবর্তন হয়ে থাকে। আর জীবসকল সেই অনুযায়ী কর্ম্ম করে থাকে। তাই প্রাণশক্তি খেলা চলছে, এই শরীর থেকে শুরু করে সমস্ত জগৎব্যাপী। ভালো, মন্দ, সুখ, দুঃখ, উদ্দমী, অনুদ্দমী সবই এই প্রাণশক্তির খেলা। ঈশ্বরের এই প্রাণশক্তির ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে, প্রাণের প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে, প্রাণবায়ু স্থির হয়ে গেলে, তখন সমস্ত জগৎ ক্রিয়াশূন্য হয়ে যাবে।  আর কার্য্যশক্তির খেলা বন্ধ গেলে, জগতের অস্তিত্ত্ব থাকবে না। তাই ভগবান যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন,  ঈশ্বরের প্রাণশক্তি কর্ম্মের ছেদ টানলে, সমস্ত জগৎ লীলার অবসান  হবে।    

উৎসীদেয়ুঃ-ইমে লোকা ন কুর্য্যাং কর্ম্ম চেদহম্
সঙ্করস্য চ কর্তা স্যাম-উপহন্য়াম-ইমাঃ প্রজাঃ। (৩/২৪)

আমি যদি কর্ম্ম না করি তবে এ লোকসকল উৎসন্নে যাবে। এমন হলে আমিই বর্ণশঙ্করের  কর্তা হবো। এইসকল প্রজাকে বিনাশের কারন হবো।

শঙ্কর অর্থাৎ দেবাদিদেব মহাদেব, যিনি সংহারের কর্তা। কূটস্থ ব্রহ্মকেই বলা হয় মহাদেব। ছিলেন এক হয়েছেন বহু। এই শ্বাস বা বায়ু সমস্ত  কিছুকে ব্যাপক করেছে। ব্রহ্মার শ্বাস-ক্রিয়ার ফলেই জগৎ ব্যাপ্তি লাভ করেছে। অর্থাৎ যাকিছু ছিল ব্রহ্মার অন্তরীণ, এই শ্বাসের ফলেই তার বিস্তার হয়েছে, বিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে। এই শ্বাস সব শরীরে ব্যাপক। এই কারণেই বলা হয়ে থাকে দেবাদিদেব মহাদেবই সমস্ত শরীরে মায় সমস্ত জগতে ব্যাপক হয়ে রয়েছেন। সাধন ক্রিয়া আসলে শ্বাসক্রিয়ার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করা। শ্বাস  স্থির  হলে আমরা ব্রহ্মপুরীতে প্রবেশ করবো, আর তা না হলে যমপুরীতে। এই শ্বাসরূপী দেবাদিদেব মহাদেব স্তূপীকৃত হয়ে কালস্বরূপ হয়েছেন। যদি সাধনক্রিয়া দ্বারা এঁর প্রতি মনোযোগ দেওয়া না হয়, তবে কাল বহু ব্যর্থকর্ম্মে নিযুক্ত হবে। দীর্ঘ-শ্বাসক্রিয়া শরীরের আয়ু ফুরিয়ে দেবে। এই দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে প্রজাসকলকে অর্থাৎ মন, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয় সমস্তকেই কুপথে পরিচালিত করবে। ফল হবে অজ্ঞান অবস্থায় অকালমৃত্যু। তাই শ্বাসক্রিয়াকে সাধনক্রিয়া দ্বারা স্থির করাই  সাধনজীবনের উদেশ্য হওয়া উচিত। 

----------------------------         

২২.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - তৃতীয় অধ্যায়  - কর্ম্মযোগঃ      
শ্লোক নং ৩/২৫-৩/২৭

সক্তাঃ কর্ম্মণ্য-অবিদ্বাংসো যথা কুর্ব্বন্তি ভারত 
কুর্যাৎ-বিদ্বান-তথা-অসক্তঃ-চিকীর্ষুঃ-লোকসংগ্রহম। ( ৩/২৫)

হে ভারত, অজ্ঞ ব্যাক্তিগন আসক্তির বশে যেমন কর্ম্ম করে, জ্ঞানী ব্যাক্তিগন অনাসক্ত চিত্তে লোকসংগ্রহের জন্য তেমনি কর্ম্ম করে থাকেন। 
পণ্ডিত বলুন বা মূর্খ বলুন, ভালো বলুন বা মন্দ বলুন, সবাইকেই কর্ম্ম করতে হয়। বিদ্বানের কাজের প্রয়োজন থাকুন না থাকুক। বিদ্বানকেও কাজ করতে হবে এবং সেই কাজ হবে আসক্তিবিহীন। বিদ্বান ব্যক্তি যদি কর্ম্ম না করে, তবে মূর্খ ব্যক্তি বিদ্বানকে অনুসরণ করে কর্ম্মহীন হয়ে জীবনটাকে নষ্ট করবে। বিদ্বান বলুন, বা মূর্খ বলুন, সবারই শরীর রক্ষা করবার জন্য আবশ্যিক  কর্ম্ম করতে হবে। যতদিন খেতে-পড়তে হবে, ততদিন সেই খাবারের সন্ধানে , তো বের হতে হবে, তা সে হোক না মাধুকরী। এমনকি সমাধিবান পুরুষ যিনি সমস্ত ক্রিয়া-কর্ম্মের  উর্দ্ধে, তথাপি সাধারনের সামনে শিক্ষামূলক  দৃষ্টান্ত তুলে ধরবার জন্য, তাঁকেও কর্ম্মে লিপ্ত হতে হবে। দেখুন, সাধন ক্রিয়ায় যার প্রথম  অবস্থা, সে যদি সমাধির  ভান করে বসে থাকে, তবে তার সাধনায় উন্নতি তো দূর অস্ত, দিনে দিনে তার অধঃপতন হবে।  তখন সে না পারবে সাংসারিক  কার্যক্রম করতে না পারবে সে সাধন-ক্রিয়াতে  মন বসাতে। দেখুন বিষয় ভোগে যেমন আনন্দ আছে, তেমনি বিষয় ত্যাগেও আনন্দ আছে। এখন যে বিষ্য়্ত্যাগের আনন্দ আয়ত্ত্ব  করতে পারে নি, সে যদি বিষয় ত্যাগ  করে, তবে তার জীবন হবে নিরানন্দে ভরা। এখন সমাজের স্বাভাবিক ধারাই হচ্ছে মহাজনকে অনুসরণ করা। আর মহাজনের উচিত এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা, যাতে সাধারণ মানুষ তাকে অনুসরণ করে জীবনে সাফল্য পেতে পারে। এইজন্য আমি বহু আশ্রমের মহারাজদের  দেখেছি, ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সমস্ত আশ্রমবাসী বিদ্যার্থীদের ডেকে সাধনক্রিয়াতে নিযুক্ত করেন । এমনকি তিনিও বিদ্যার্থীদের সাথে ক্রিয়াকর্ম্মে লেগে পড়তেন।      

ন বুদ্ধিভেদং জনয়েৎ-অজ্ঞানং কর্ম্ম-সঙ্গিনাম 
যোজয়েৎ সর্ব্ব-কর্ম্মাণি বিদ্বান্ যুক্তঃ সমাচরন্। (৩/২৬)

জ্ঞানীরা, কর্ম্মে আসক্ত অজ্ঞানব্যক্তিদের বুদ্ধিভেদ জন্মাবেন না।  বরং অবহিত চিত্তে সমস্ত কর্ম্মের অনুষ্ঠান করে তাদেরকে কর্ম্মে নিযুক্ত রাখবেন। 

ক্রিয়ার উচ্চ অবস্থায় থেকেও নিজের পরাবুদ্ধি প্রদর্শন না করা উচিত। পরাবুদ্ধি অর্থাৎ যে বুদ্ধি দ্বারা একত্ত্বের অনুভূতি হয়।   ক্রিয়ার পরাবস্থায় থেকেও সাধারণ কাজকর্ম্মে  কখনো অনীহা প্রদর্শন করতে নেই। প্রকৃত জিজ্ঞাসু  এবং যোগ্য অধিকারী না হলে ব্রহ্মজ্ঞানের কথা বলতে নেই। জ্ঞানীগণ অজ্ঞানীর মতো আচরণে অর্থাৎ সাধারণ জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত হলেও  ক্ষতি নেই।  কিন্তু অজ্ঞানী যখন জ্ঞানীর মতো মিথ্যা বা নকল আচরণ করে, তখন অজ্ঞানীর জ্ঞান হওয়া তো দূরে থাকুক, সে আরো অন্ধকূপে পতিত হয়। একটা জিনিস জানবেন, সাধনার শেষ করতে নেই।  ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলতেন ঈশ্বরের শেষ করতে নেই। সাধন ক্রিয়া করতে করতে  কোন অবস্থায় সাধক পৌঁছেছেন , সাধারনের পক্ষে তা বোঝা সম্ভবও  নয়। তাই কোনো সাধককে বাহ্যিক দিক থেকে দেখতে গেলে, ভুল হবার সম্ভাবনাই বেশী। এমনকি অনর্থ পর্যন্ত ঘটতে পারে। এইজন্য জ্ঞানীগণ কখনোই সাধন বৃত্তান্ত অজ্ঞ অর্থাৎ সাধনক্রিয়াহীন ব্যক্তিকে বলেন না। এমনকি যারা সাধনার যে পর্য্যায়ে আছেন, তাদের সেইমতো শিক্ষা দেওয়া উচিত। নিগুড় তত্ত্বকথা বললে, তা সে যেমন বুঝবে না, আবার ভুল বুঝে নিজের অমঙ্গল ডেকে নিয়ে আসতে পারে। তাই যে যে-ভাষা বোঝে তাকে সেই ভাষাতেই শিক্ষা দান করতে হয়। যে যেমন বোঝে সেইমতো তাকে কর্ম্মশিক্ষা দিতে হয়। শিশুশিক্ষার নিয়মই হচ্ছে, শিক্ষককে শিশুর  মনের কথা বুঝে সেই মতো আচরণ করতে হবে। লোকে বলে গরু পুষতে গেলে গরু হতে হয়। না হলে গরুর পালন-পোষণ সম্ভব নয়। তবে একটা কথা হচ্ছে, একটা  সাধন স্তর  আছে, যে অবধি এই নিয়ম প্রজোয্য - এর পরে অর্থাৎ ষষ্ঠ ভূমি থেকে এই কোনো নিয়ম প্রযোজ্য নয়। এখানে কোনো নিয়মের বালাই থাকে না। এই অবস্থায় যোগেশ্বর সাধারনের মতো আচরণ করবার কথাও  বিস্মৃত হয়ে যান। তখন তিনি আপনাতে  আপনি স্থিত হয়ে সর্বত্র আত্মাকেই দর্শন করে থাকেন।  তখন তিনি কুকুরের সঙ্গেও  একসাথে খাবার ভাগ করে খেতে পারেন। এই দুর্লভ অবস্থার ব্যাখ্যা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।     


প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্ম্মাণি সর্ব্বশঃ 
অহঙ্কার-বিমূঢ়াত্মা কর্ত্তা-অহং-ইতি মন্যতে। (৩/২৭) 

প্রকৃতির গুনের দ্বারাই সমস্ত কর্ম্ম সম্পন্ন হয়।  যে ব্যক্তি অহংকার বসে বিমূঢ়, সে মনে করে আমিই কর্ত্তা।

যা সত্য নয়, তাকে সত্য বলে মনে করা মূর্খামি  ছাড়া কিছু নয়। পুতুল পুতুলই হয়।  পুতুল কখনো কথা বলতে পারে না। মাটির পুতুলে প্রাণের সঞ্চার হতে পারে না। পঞ্চতত্ত্বের শরীর কখনো আত্মা হতে পারে না। এই যে নাম ও রূপের খেলা আমরা দেখতে পাই, তা সকলই অনিত্য, অসত্য। আত্মার অস্তিত্ত্ব আছে বলেই ত্রিগুণের অস্তিত্ত্ব। সাধন ক্রিয়ায় মন-বুদ্ধি-অহংকার যখন আত্মার মধ্যে গুটিয়ে যায়, তখন আর তাদের পৃথক সত্তা থাকে না। এসবের সাময়িক একটা স্ফূরণ হলেও, আখেরে সবই  আত্মাতে বিলীন হয়ে যাবে। চেতন একমাত্র আত্মা।  মন-বুদ্ধি সবই জড়। মায়ার প্রভাবে এগুলোকে চৈতন্যযুক্ত বলে মনে হয়। আর তাই মনের মননশক্তি, অহংকারের কর্তৃত্ত্ব ভাব নিঃসঙ্গ-নিরাকার-নাম-রূপহীন আত্মাতে আরোপিত হয়। আর এই জড় ও চেতন তখন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সাধক যখন সাধনক্রিয়ার উচ্চ অবস্থাতে অবস্থান করেন, তখন তার মন-বুদ্ধি-অহঙ্কার বলে কিছু থাকে না। তখন নির্মল আত্মা তার নিজস্ব রূপে উদ্ভাসিত হয়। ক্রিয়াহীন মুঢ়ব্যক্তি আত্মা সম্পর্কে শুধু শুনে থাকে, কিন্তু আত্মার স্বরূপ অর্থাৎ নির্মলতা, অসঙ্গতা সম্পর্কে কিছুই জানে না। যোগীপুরুষ যখন আত্মস্থ হন, তখন আত্মার যে কোনো চেষ্টিত ক্রিয়া নেই, তা তিনি উপলব্ধি করেন। মনের বিলোপ হওয়ায় মনের মধ্যে কোনো চিন্তার উদয় হয় না। অখন্ড আকাশ আর হৃদয়স্থিত আকাশের মধ্যে  কোনো পার্থক্য নেই।  আসলে দেহাদি দ্বারা  আবিষ্ট হয়ে, আত্মা মন বুদ্ধি ও অহঙ্কার দ্বারা  নিজেকে দেহ-ইত্যাদিকেই আমি আমার বলে মনে করে। দেহাদির সুখ-দুঃখ আত্মাতে আরোপ করা হয়। ক্রিয়ার উচ্চ অবস্থায় এই ভ্রম দূর হয়ে যায়। আসলে বুত্থিত  যোগীপুরুষ প্রকৃতির কোনো কার্য্যকেই আমার বলে স্বীকার করেন না। তাই প্রকৃতির কোনো কাজেই তার সুখ বা দুঃখ অনুভব হয় না। কিন্তু সাধনক্রিয়াহীন ব্যক্তির এই বোধ জন্মাতে পারে না। জ্ঞানী জল মিশ্রিত দুধের মধ্য থেকে দুধকে আলাদা করতে পারেন। মূর্খের সেই সাধ্য নেই। তাই জ্ঞানী কর্তৃত্বাভিমান শূন্য, আর মুঢ় অজ্ঞানী কর্তৃত্বাভিমান পূর্ন। 
-------------------        

২৩.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - তৃতীয় অধ্যায়  - কর্ম্মযোগঃ      
শ্লোক নং ৩/২৮-৩/২৯

তত্ত্ববিত্তু মহাবাহো গুনকর্ম্ম-বিভাগয়োঃ
গুনা গুনেষু বর্ত্তন্ত ইতি  মত্বা না সজ্জতে। (২/২৮)

হে মহাবাহো, গুন্ ও কর্ম্মের যথার্থ তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তি মনে করেন, গুন্ গুনের মধ্যেই আছে, তাই তিনি তাতে আসক্ত হন না। 
আমি যখন যার মধ্যে প্রবেশ করি, তখন আমি তাই হয়ে যাই।  আমি যখন দেহের মধ্যে প্রবেশ করি, তখন আমি দেহি হয়ে যাই, আমি যখন জ্ঞানের মধ্যে প্রবেশ করি, তখন আমি জ্ঞানী হয়ে যাই। আমি যখন পাপের মধ্যে প্রবেশ করি তখন আমি পাপী হয়ে যাই। আমি যখন গুনের মধ্যে প্রবেশ করি, তখন আমি গুণী হয়ে যাই। আমি যখন কর্ম্মের মধ্যে প্রবেশ করি, তখন আমি কৰ্ম্মী হয়ে যাই।  কিন্তু আমি আসলে এক শুদ্ধ আত্মা। আমার কোনো পরিবর্তন নেই। আমি অসঙ্গ। গুনের প্রকাশ আছে, দেহের প্রকাশ আছে, জ্ঞানের প্রকাশ আছে, পাপের  প্রকাশ আছে, আবার এসবের নাশও  আছে। যার প্রকাশ আছে, তার অপ্রকাশ আছে, যার জন্ম আছে, তার মৃত্যু আছে। আমি অজন্মা, আমি জন্ম মৃত্যুর উর্দ্ধে।  আমি গুন্ ও কর্ম্মের উর্দ্ধে। 
 সাধনের উচ্চ অবস্থায়, এই জ্ঞানের প্রকাশ ঘটে, তখন সে বুঝতে পারে, দেহ আছে দেহের মধ্যে, জ্ঞান আছে জ্ঞানের মধ্যে, গুন্ আছে গুনের মধ্যে, পাপ আছে পাপের  মধ্যে।  আর আমি আমাতেই স্থিত। কূটস্থে স্থিত হবার অভ্যাস যাঁর আয়ত্ত্ব  হয়েছে, তিনি গুন্ ও কর্ম্মের পার্থক্য বেশ বুঝতে পারেন। আমি যখন স্থির থাকি তখন কে কি করছে, তা আমি বেশ বুঝতে পারি। আর আমি যদি অস্থির হই, তবে কে কোথায় কি করছে, তা আমার নজরে আসে না। আমি সাক্ষী স্বরূপ - কূটস্থে স্থিত আত্মা। তিন গুনের (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ) পরিনাম হচ্ছে দেহাদির ( ইন্দ্রিয়সকল) পৃথক পৃথক কার্য্য।  যার সাক্ষী হচ্ছেন আত্মা যা আমার স্বরূপ। সাক্ষী  ঘটনার নিরপেক্ষ দর্শক মাত্র। কর্ম্ম, গুন্, ইত্যাদি তাকে প্রভাবিত করে না। যাদের  সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই, তাদের সুখ-দুঃখ-হর্ষ-বিষাদ আমাকে  স্পর্শ করে না। তাদের হ্রাস-বৃদ্ধি-ক্ষয়ে আমার কিছু যায়-আসে না। কূটস্থে স্থির হয়ে থাকতে থাকতে এই সত্যে আমি প্রতিষ্টিত। দেহের ইন্দ্রিয়াদি সকল তাদের প্রথক পৃথক কার্য্যে লিপ্ত আছে। কখনো গুণবান হচ্ছে, কখনো জ্ঞানবান হচ্ছে, কখনো সে অজ্ঞান।  কিন্তু আমি যা তাই আছি।  আমার কোনো পরিবর্তন নেই। কূটস্থে কোনো তরঙ্গ  নেই, তাই সেখানে না আছে ঢেউ, না আছে বুঁদবুঁদ। না আছে ক্রিয়া না আছে কর্ম্মফল। এখানে কোনো চিন্তার তরঙ্গ ওঠে না। তাই সদা সাম্যভাব  বজায় থাকে। এখানে কোনো বিচারের প্রয়োজন নেই তাই বুদ্ধির এখানে কোনো প্রয়োজন নেই। 

সাধকের এই অবস্থায় "আমি"  জ্ঞান রুদ্ধ হয়।  যখন আমি থাকে না তখন আমার বলেও কিছু থাকে। তুমি বলেও কিছু থাকে না।  এখানে কোনো ইচ্ছা থাকে না তাই এখানে কোনো বিষয় থাকে না। এখানে কোনো মন থাকে না, তাই মমত্ত্ব বলে কিছু থাকে না। মন এখানে নিরোধের অবস্থায়। সমভাবে স্থিতি তাই সমাধি।    

প্রকৃতেঃ-গুনসংমূঢাঃ সজ্জন্তে গুনকর্ম্মসু
তান-অকৃৎস্নবিদো মন্দান কৃৎস্নবিন্ন বিচালয়েৎ। (২/২৯)

প্রকৃতির গুনে মোহগ্রস্থ ব্যক্তি গুন ও কর্ম্মে আসক্ত হয়।  এই অল্পবুদ্ধি সম্পন্ন  সেই সব অজ্ঞ অসমদর্শী মন্দমতিগণকে সর্বজ্ঞব্যক্তিগন  কর্ম্ম থেকে  বিচলিত করবে না।

গুরুকৃপায়, বোকা-মুর্খ সবার উদ্ধার হতে পারে।  কিন্তু অলস ব্যক্তির উন্নতির কোনো সম্ভাবনা নেই। আচার্য্য শংকরের আনন্দগিরি নামে একজন শিষ্য ছিলেন, যার বুদ্ধি অন্য শিষ্যদের তুলনায় প্রখর ছিল না। কিন্তু তার ছিল গুরুর প্রতি নিষ্ঠা, শ্রদ্ধা, গুরুবাক্যে ছিল অগাধ বিশ্বাস, এবং কর্ম্মঠ।  তো একে  আশ্রমের বিভিন্ন কাজে নিয়োগ করা হতো, কিন্তু বিদ্যা  অর্জনের সময় তার অনুপস্থিতি অন্য শিষ্যদের কাছে ছিল গুরুত্ত্বহীন। আর যদি উপস্থিত থাকতোও সে শুধু গুরুমুখী হয়ে বসে থাকতো  - বুঝুক আর না বুঝুক - গুরুদেবের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতো। কখনো তার ব্যতিক্রম হতো না। এই কর্ম্মঠ ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন, তোটকাচার্য্য - যাঁর  খ্যাতি যার পান্ডিত্য বিশ্বব্যাপি। 

অলস ব্যক্তি ভালো পথ, ভালই গুরু পেয়েও সে পরিশ্রম বিমুখ বলে, নিজের  উন্নতি করতে  পারে না। যে নিজেকে উদ্ধার করবার মানসে উদয়-অস্ত  পারিশশ্রম করে, তার ভার স্বয়ং ভগবান নিয়ে নেন। আর যারা অলস-বিলাসপ্রিয় তাদের গুরু কেন স্বয়ং ভগবানও  উদ্ধার করতে পারেন না। তো মহাত্মাগণ বলছেন, অলস-অজ্ঞানীর কাছে জ্ঞানের কথা আলোচনা না করা শ্রেয়। সাধনক্রিয়াহীন ব্যক্তির চিত্ত অশুদ্ধ থাকে , আর ক্রিয়া  না করলে, চিত্ত শুদ্ধ হবার সম্ভাবনাও থাকে না। অশুদ্ধ  চিত্তের জ্ঞানের প্রকৃত ভাবের প্রকাশ ঘটে না, বরং বিকৃতভাবের প্রকাশ দেখা যায়।তাই  অজ্ঞানীর সঙ্গে জ্ঞানের আলোচনা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। 
--------------------------        
২৪.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - তৃতীয় অধ্যায়  - কর্ম্মযোগঃ      
শ্লোক নং ৩/৩০-৩/৩১

ময়ি সর্ব্বাণি কর্ম্মাণি সংনস্য-অধ্যাত্মচেতসা 
নিরাশীঃ-নির্ম্মমো ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ। (২/৩০)

বিবেক বুদ্ধিসহকারে সমস্ত  কর্ম্ম তুমি আমাতে সমর্পন করে বাসনা ও মমতাশূন্য হয়ে শোক ত্যাগ করে তুমি যুদ্ধরূপ কর্তব্য কর্ম্ম করো।

"আমি নিজের জন্য কাজ করছি", এই কথা না ভেবে, যদি আমি ভাবি "আমার কাজের জন্য অন্যের উপকার হচ্ছে," অর্থাৎ অন্যের উপকারের   উদ্দেশ্য নিয়ে যদি কাজ করি, তবে দেখা যাবে, কাজের পরিশ্রম লাঘব হয়ে যাবে। এমনকি কাজে উৎসাহ বাড়বে। আরো একটু উচ্চভাব, অর্থাৎ "আমার কাজ হচ্ছে আত্মার সন্তুষ্টির জন্য," তবে দেখবেন, আপনার কাজের মান উন্নত হবে, নিজের কাজের মধ্যে একটা প্রফুল্লতা   অনুভব করবেন। 

চিত্ত যখন আত্মাতে সংস্থাপিত হবে, তখন সেই অবস্থাকে বলে অধ্যাত্মচিত্ত। আমাদের মনের মধ্যে অসংখ্য বাসনা, ব্যাথা বেদনা, সুখের স্মৃতি, দুঃখের স্মৃতি জমে আছে।  মনের দরজা খুললেই এইসব দৃশ্য ভেসে আসবে। এই সব দৃশ্য যখন চোখের সামনে ভাসে, তখন তার একটা আকার আমাদের চোখের সামনে ভাসে। এই ভাবের বা চিন্তার দৃশ্য বেশিক্ষন থাকে না। চিত্তের স্পন্দনের সঙ্গে চিত্রের আকারের পরিবর্তন হয়। কিন্তু মন যখন বিষয়বিমুখ হয়ে আত্মাতে স্থিত হয়, তখন এই চিত্তের চঞ্চলতা থাকে না। আর চিত্ত যখন অচঞ্চল তখন এইসব চিত্রের আগমন-নির্গমন বন্ধ  হয়ে যায়। একেই বলে চিত্তের একাগ্রতা। এই একাগ্রতা সাধনার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হতে হতে বিষয়-স্মৃতি লোপ পায়।  একেই চিত্তের নিরুদ্ধ অবস্থা বলা হয়ে থাকে। এই নিরুদ্ধ ভাব যখন স্থায়ী হয়, তখন তাকে সমাধি বলে।  সমাধি অবস্থায় চিত্ত কেবলমাত্র আত্মস্থিত হয়ে থাকে। এই অবস্থা পাবার জন্য, যার  চিত্ত সচেষ্ট, তিনিই আধ্যাত্মিক পুরুষ। এই অবস্থায় সমস্ত কর্ম্ম ব্রহ্মে সমর্পিত হয়। সাধন ক্রিয়া করতে করতে  সাধনার উচ্চ থেকে উচ্চতর অবস্থায় সাধন উন্নীত হন। সেই উন্নততর অবস্থায় আর আসক্তযুক্ত কর্ম্ম করতে পারেন  না। যেটুকু কর্ম্ম তার দ্বারা সম্পাদিত হয়, তা যেন স্বতঃস্ফূর্ত এবং ফল লোককল্যান। কর্ম্মে যতক্ষন কর্ত্তা ভাব থাকে ততক্ষন কর্ম্মের উত্তাপ তাকেই সহ্য করতে হয়, কিন্তু একটা সময় আসে, যখন কর্ম্মের ফলে যে উত্তাপের উদ্ভব হয়, তা লাগে সন্নিহিত লোকজনের গায়ে। আর সেই কর্ম্ম কেবলমাত্র শুভ ফল প্রদান করে থাকে। 

এখন কথা হচ্ছে, এই অবস্থা কিভাবে প্রাপ্ত হওয়া যায় ? দুধ স্থির হয়ে থাকলে  যেমন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দই হয়ে যায়, দুধ জাল  দিলে যেমন ক্ষীর  হয়ে ওঠে,  আবার দই মন্থন করতে করতে যেমন মাখন উঠে আসে, তেমনি এই সাধন ক্রিয়া।  প্রথম কথা হচ্ছে, নিজেকে অর্থাৎ শরীরকে প্রথমে স্থির করতে হবে।অর্থাৎ আসনে অভ্যস্থ হতে হবে।  এই অভ্যাস গড়ে উঠলে, ধীরে ধীরে শরীরের মধ্যে একটা পরিবর্তন আসবে। একটা স্থিরতা আসবে। মনের মধ্যে পূর্ব-পূর্ব সংস্কার স্মৃতির আকারে উঠে আসবে।   অথাৎ দুধ দইয়ে পরিণত হবে। এর পরে শুরু করতে হবে মন্থন। অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রক্রিয়া  হচ্ছে প্রাণায়ামের ক্রিয়া করতে হবে।  অনুলোম বিলোপ ক্রিয়া করতে হবে। অর্থাৎ সংস্কারের শোধন করতে হবে। নতুন সংস্কার ওঠাতে হবে।  তৃতীয় প্রক্রিয়া হচ্ছে, শরীরের উত্তাপ বৃদ্ধি করতে হবে আর তা হবে কুম্ভকের সাহায্যে। বাহ্য কুম্ভক - অন্তর কুম্ভক। অর্থাৎ দুধ জাল দিয়ে ক্ষীরে পরিণত করতে হবে। 

দেহ-মন-বুদ্ধিকে যিনি সর্বদা জাগ্রত রেখে সাধন-ক্রিয়া করছেন, তার মধ্যে ভর্গ অর্থাৎ জ্যোতির আবির্ভাব হবে। এই জ্যোতি বা প্রকাশশক্তিই আসলে শরীর মন এর নির্মাতা। তাহলে এই যে কৃত-কর্ম্ম  তা আসলে শরীর  বা মনের নয়, এই শক্তি আসলে প্রাণের শক্তি। তো প্রাণের কর্ম্মকে নিজের বলে মনে হলেই কর্ত্তাভাবের উৎপত্তি হয়। কিন্তু কার দ্বারা কর্ম্ম প্রেরিত হচ্ছে তা বুঝতে পারলেই, কর্ত্তাভাবের নিস্পত্তি হয়ে যাবে। এই অবস্থাই  অহঙ্কারশূন্য অবস্থা।তখন অধ্যাত্মচিত্ত হওয়া অর্থাৎ নিরাশী ও নির্ম্মম হওয়া সম্ভব হবে। ইন্দ্রিয়-সকল তখন নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে তা নয়, কিন্তু ইন্দ্রিয়ের যে স্বাভাবিক গতিমুখ, অর্থাৎ বিষমুখী গতি তখন অন্তর্মুখী হয়ে যাবে। প্রাণ আত্মস্থ ও স্থির  হলে মন শরীরকে পরিচালনা করবে না। তখন আত্মার অনুগত হয়ে শরীর-মন আত্মহারা হয়ে যাবে। তো শরীর -মন-বুদ্ধি সবই যখন আত্মস্থ তখন সব কর্ম্মও সেই আত্মা দ্বারা পরিচালিত হওয়ায়, অহংবোধের লোপ পাবে। অহংবোধ একসময়  ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে শূন্যে মিলিয়ে যাবে। এই অবস্থায় সাধককে যেতে গেলে, সাধককে অবশ্য়ই সমস্ত আলস্য ত্যাগ পরে, সাধনক্রিয়া অর্থাৎ যুদ্ধে নেমে পড়তে হবে। একেই যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ  বলছেন, "যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ" ।

 বিঃদ্রঃ ক্রিয়া ও কর্ম্মের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। কর্তাভাবের সঙ্গে কোনো কিছু করাকে বলে কর্ম্ম। অর্থাৎ এখানে দুইয়ের অবস্থান কর্তা  ও কার্য্য।  আর যখন কার্য্যের সঙ্গে কর্তৃত্ত্বভাব থাকে না তখন তা হয় ক্রিয়া। এখানে কার্য্য স্বয়ংসিদ্ধ।  এখানে কর্তার আবির্ভাব নেই। এখন কথা হচ্ছে, কোনো কর্ম্ম সাধিত হলে স্বাভাবিক ভাবেই মনে হতে পারে, এর পিছনে একজন কর্তা  আছেন। আসলে সমস্ত কর্ম্মের পিছনেই এক ও অদ্বিতীয় শক্তি কাজ করে থাকে।  কিন্তু যখন এর মধ্যে একজন মধ্যসত্ত্বা এসে যায়, তখন তাকে কর্তা বলা হয়ে থাকে।    

  
যে মে মতমিদং নিত্যম-অনুতিষ্ঠন্তি মানবাঃ 
শ্রদ্ধাবন্তঃ-অনসুয়ন্তঃমুচ্যন্তে তে-অপি কর্ম্মভিঃ।  (৩/৩১)

যারা শ্রদ্ধাবান ও অসুয়াবর্জিত (দোষ-দর্শন-বর্জিত) হয়ে আমার এই মতের নিত্য অনুষ্ঠান করে তারা কর্ম্মফল হতে মুক্তি লাভ করে থাকে। 

এখানে দুটো শব্দ "শ্রদ্ধাবন্ত" ও "অনুসূয়ন্ত" কথাদুটোর উপরে গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে। আর একটা হচ্ছে "মতমিদং" অর্থাৎ আমার মত মতো। 
এখন কথা হচ্ছে আমার মত অর্থাৎ যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের মত কি ? শরীর, ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি, পদার্থ, এমনকি কর্ম্মশক্তি  এগুলো কারুর নিজস্ব সম্পত্তি নয়। এগুলো ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছে, আবার এগুলো ব্যবহারের অযোগ্য  হয়ে গেলে, বা এগুলোর কাজ শেষ হয়ে গেলে, এরা  সবাই তার নিজস্ব জায়গায় ফিরে যাবে। বা ব্যবহারের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে একে মালিকের কাছে  ফিরিয়ে দিতে হবে। এই হচ্ছে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের অভিমত। 
 এবার শ্রদ্ধাবন্ত -  প্রতক্ষ্য অভিজ্ঞতার সম্মুখীন না হয়েও, প্রতক্ষ্যের মতো নিঃসন্দেহ হয়ে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন, এবং একটা পূজার্হ ভাব যার  মধ্যে আছে, তাকেই বলা হচ্ছে শ্রদ্ধাবন্ত। 
 অনুসূয়ন্ত - অর্থাৎ এখানে ভগবান যে মতের কথা বলেছেন, তার মধ্যে দোষ না দেখবার কথা বলছেন।  অসূয়া কথাটার অর্থ হচ্ছে দোষদৃষ্টি। অর্থাৎ ভালো মন্দ সবকিছুর  মধ্যে যে দোষ  খুঁজে বেড়ায়।
এখন কথা হচ্ছে আলস্য ত্যাগ করে অনাসক্ত হয়ে কর্ম্ম করাই যোগেশ্বরের অভিমত। এর ফলে কি  হয় ? এরফলে সাধক ব্রহ্মতে স্থিত হন। সাধক যখন ব্রহ্মতে স্থিত হয়ে সমস্ত কর্ম্মফল আত্মাকে অর্পণ করেন তখন ভগবানের ইচ্ছে মতো কাজ হতে পারে। এখন এই কাজ করতে গেলে তার শারীরিক কষ্ট  হতে পরে। এই কষ্টকে যে স্বীকার করতে চায় না, সে আলস্যে সময় কাটাতে চায়। অর্থাৎ ভগবানের ইচ্ছেকে সে উপেক্ষা করে।  সে এটা বোঝে না যে এই কষ্টের মাধ্যমেই সে কেষ্টকে পেতে পারে।  মঙ্গল ও অমঙ্গল সবই প্রকৃতির বসে হয়ে থাকে। আমরা আমাদের বিচার বুদ্ধি দিয়ে, সুখ-দুঃখের পরিমাপ করে থাকি। কিন্তু এই প্রকৃতির যিনি অধীশ্বর তার প্রেয় ও শ্রেয় ভেদে কর্ম্মের বিভাগ করে থাকেন। যিনি দেহ-মনের সঙ্গে থেকে কর্ম্ম করতে থাকেন, তার কাজ প্রেয়।  আর যিনি ঈশ্বরের শরণাগত হতে ক্রিয়া করেন, প্রকৃতির দিকে দৃষ্টিপাত করেন না, সেই জ্ঞানী পুরুষ এ ভারেই মুক্তির  পথের সন্ধান পান। 
এখন কথা হচ্ছে, ঈশ্বরের ইচ্ছে বা অভিমত বোঝা আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য ব্যাপার।  তাই আমাদের উচিত গুরুর নির্দেশে, ভালো-মন্দ বিচার না করে, গুরুবাক্যে শ্রদ্ধাশীল হয়ে যোগাদি ক্রিয়ার মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত করা। তো শ্রদ্ধালু সাধক গুরুর উপদেশ মতো সাধনায় যথাসাধ্য পরিশ্রম করে থাকে। আবার এমনকিছু সাধক আছেন, তারাও গুরুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কিন্তু পারিশ্রমবিমুখ তারা সহজে সবকিছু পেতে চায়। তারা ভাবে গুরুকৃপায় সব কিছু হয়ে যাবে। অবশ্য যারা গুরুবাক্যেও  শ্রদ্ধাশীল নয়, আবার বিধিমত সাধনাও করতে চায় না, আবার কুতর্কে নিযুক্ত হন এদের জ্ঞানলাভ দূরের কথা, ধীরে ধীরে নিজেকে অধঃগতি সম্পন্ন করে থাকেন। গুরুবাক্যে শ্রদ্ধাশীল, ও পরিশ্রমী সাধকের সত্তর উন্নতি হয়ে থাকে। 
-----------------------------
 ২৫.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - তৃতীয় অধ্যায়  - কর্ম্মযোগঃ      
শ্লোক নং ৩/৩২-৩/৩৩

 যে ত্বেতদ-অভ্য়সুয়ন্তো ন-অনুতিষ্ঠন্তি মে মতম 
সর্বজ্ঞান-বিমূঢ়াংস্তান্ বিদ্ধি নষ্টান-চেতসঃ।  (৩/৩২)

যারা অসূয়া-পরবশ হয়ে (অন্যের দোষ দেখার প্রবৃত্তি-বশতঃ ) আমার এই মতের অনুসরণ করে না - তারা দুর্বুদ্ধিযুক্ত, সর্বজ্ঞান-বর্জিত ও বিনাশপ্রাপ্ত জানবে। 

পরের দোষ অর্থাৎ বিষয়ে মনোযোগ আর ব্রহ্মে অমনোযোগ । আমাদের মন চঞ্চল। পঞ্চভূতের এই শরীরে অবস্থিত ইন্দ্রিয়সকল এই চঞ্চল মনের নির্দেশেই কাজ করে থাকে। জন্মের পর থেকে আমাদেরকে বহির্মুখী হতে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। তাই স্বভাবতই আমরা সবাই বহির্মুখী।  এই স্বভাব আমাদের আদতে পরিণত হয়ে গেছে। মন যার অস্থির, সে ব্রহ্মে স্থিত হতেই পারলো না। ফুলের শুধু সুগন্ধ নয়, ফুলে আছে মধু। ফুলে যে স্থির হয়ে বসতে পারেনি, সে মধুর সন্ধান পাবে কি করে ? তাই  জোর করে ইন্দ্রিয়নিগ্রহ কোনো সুফল দিতে পারে  না। যারা ভগবানের কথায় অশ্রদ্ধায়যুক্ত হয়ে সাধনক্রিয়া থেকে দূরে থাকে, তারা আত্মার স্থিরতা ব্যাপারটাই বুঝতেই  পারে না। আর শান্তিও পায় না। মনুষ্য জীবন ধারনের যে উদ্দেশ্য তা ব্যর্থ হয়। সাধনক্রিয়া ব্যাতিত চিত্ত শুদ্ধ হতে পরে না। আর চিত্ত শুদ্ধ না হলে, সেই অশুদ্ধ চিত্তে কখনো শাস্ত্রের গূঢ় রহস্যঃ তার বোধগম্য হয় না। শাস্ত্রপাঠের পরে তা তার স্মৃতিতেও ধরে রাখতে পারে না। তো যে পঞ্চতত্ত্বের মধ্যে সে সারা জীবন কাটিয়ে গেলো, সেই পঞ্চতত্ত্ব-এর গুনাগুনের রহস্য ভেদও  সে করতে পারলো না।  অর্থাৎ শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধের মধ্যে যে রহস্যঃ লুকিয়ে আছে, সে সম্পর্কে অনভিজ্ঞ রয়ে গেলো। মনুষ্য দেহ ধারনের ফলে যে বিরল সম্ভাবনার দেখা মিলেছিল, তার সদব্যবহার  হলো না। জন্মের কারন সে জানতেই পারলো না। ধিক এই মনুষ্য জীবনের।

বিঃদ্রঃ : চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক এই পাঁচ জ্ঞানসাধন শরীরের বাহির-ইন্দ্রিয়। এর দ্বারা আমরা যথাক্রমে, রূপ, শব্দ,গন্ধ, রস, স্পর্শ অনুভব করতে পারি । এগুলো শরীর মাত্রেই বর্তমান। কিন্তু আমি যা শুনছি, আপনি হয়তো তা শুনছেন না, অথবা আপনি যা শুনছেন, আমি তা শুনছি না - অথবা অন্যরকম শুনছি। সুতরাং  আপনার শোনা আর আমার শোনার  মধ্যে একটা পার্থক্য হতে পারে। আপনি যা দেখছেন, আমি হয়তো তা দেখছি না - বা আমি হয়তো অন্যরকম দেখছি, অথবা কিছুই দেখতে পাচ্ছি না ।  এই অবস্থায় আমাদের মধ্যে দেখার বা শোনার পার্থক্য ও বিভ্রান্তি হতে পারে। কিন্তু আপনার আমার মধ্যে একজন দ্রষ্টা বা শ্রোতা অবশ্য়ই আছেন । তো ইন্দ্রিয়ের বিষয়-জ্ঞানের একজন গ্রাহক অবশ্য়ই  আছে।  কে তিনি ? 

বলা হয়ে থাকে, শরীর ও মস্তিষ্কের সমস্ত উপাদান ৭ বছরের মধ্যে, কেউ বলেন ১৪ বছরের মধ্যে পরিবর্ত্তন হয়। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতায় বুঝেছি,  স্মৃতি, যা আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে সংরক্ষিত আছে  বলে ভাবি, তার কোনো পরিবর্তন হয় না। জীবনের শেষভাগে এসেও এই স্মৃতি বজায় থাকে।  তো মস্তিষ্কের সমস্ত কোষের পরিবর্তন হয়ে গেলো, কিন্তু স্মৃতি থেকে গেলো, এটা কিভাবে সম্ভব ? তার মানে একটা শক্তি আমাদের মধ্যে বিরাজ করছে, যে আমাদের এই স্মৃতিকে ধরে রাখছে। আসলে শরীর  বা ইন্দ্রিয়গণ হচ্ছে করন, আর সেই মূল শক্তি  হচ্ছে কর্তা।

 আবার প্রাণশক্তি না থাকলে, শরীর অকেজো হয় যায়। কিন্তু প্রাণশক্তি থাকলেও কি আমরা সব সময় চৈতন্যবান থাকতে পারি।  আমরা অনেক সময় আকস্মিক আঘাতে মূর্ছা যাই, তখন আমাদের জ্ঞান থাকে না।  কিন্তু আমাদের শরীর  বেঁচে থাকে । তো জ্ঞানহীন অবস্থায় বেঁচে থাকা যায়। কিন্তু  শুধুই  শ্বাসের প্রবাহ আমাদের শরীরকে জ্ঞানবান রাখতে পারে না। অর্থাৎ শরীরে প্রাণের প্রবাহ থাকলেও, আমি আছি কি নেই, সেই বোধ আমাদের লোপ পেয়ে যায়।

অতএব এটা আমাদের স্বীকার করতেই  হয়  যে , আমাদের সতেজ জ্ঞান-ইন্দ্রিয়, আমাদের প্রাণশক্তি ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও, আমি যে আছি এই বোধ আমাদের নাও থাকতে পারে। তার মানে আমাদের এই দেহে এমন কোনো পদার্থ আছে, তার দ্বারা আমরা জ্ঞান, সূখ, দুঃখ, রাগ, দ্বেষ, ইচ্ছে, অনিচ্ছা ইত্যাদির অনুভব হয়। এই অনুভবশক্তি যার মধ্যে আছে, তাঁকেই  বলে জীবাত্মা। 

এই জীবাত্মাই সমস্ত জ্ঞানের কর্তা, সমস্ত কর্ম্মের কর্তা, এমনকি সমস্ত ভোগের কর্তা। অর্থাৎ জ্ঞাতা, ভোক্তা ও কর্তা হচ্ছে জীবাত্মা। শরীর জড়, কিন্তু শরীর চৈতন্যবান হয় আত্মার সংস্পর্শে এসে। উভয়ের কিভাবে যোগ সম্পন্ন হতে পারে, সে সম্পর্কে ধীরে ধীরে শুনবো।         

সদৃশং চেষ্টতে স্বস্যাঃ প্রকৃতেঃ জ্ঞানবান-অপি 
প্রকৃতিং যান্তি ভুতানি নিগ্রহঃ কিং করিষ্যতি। (৩/৩৩)

জ্ঞানবান ব্যক্তিও নিজের প্রকৃতির অনুরূপ চেষ্টা অর্থাৎ কার্য্য করেন।  সমস্ত প্রাণীগণ প্রকৃতির অনুসরণ করে ইন্দ্রিয়-নিগ্রহ করে আর কি করবে ?

বিষয় বাসনাও থাকবে, আবার কূটস্থে মন থাকবে, এই দুটো একসঙ্গে সম্ভব নয়।  বিষয়ে মন থাকলে সাধনক্রিয়া সম্ভব নয়। মন যতক্ষন পঞ্চতত্ত্বে থাকবে, ততক্ষন যতই আপনি মনকে বোঝাতে চেষ্টা করুন না কেন, ইন্দ্রিয়গুলোকে নিষ্ক্রিয় রেখেই, আপনার মনের মধ্যে বিষয়চিন্তায় মগ্ন থাকবে।অর্থাৎ আপনার চোখ দেখছে না, কান শুনছে না, মুখে কথা বলছেন না, তথাপি, মনের মধ্যে চিন্তার শেষ নেই।  কিন্তু এর থেকে বেরুবার উপায় কি ? দেখুন সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই তিন গুনের সাম্যাবস্থা হচ্ছে প্রকৃতি। প্রকৃতি যখন সত্ত্ব ভাবাপন্ন হন, তখন মন থাকে  ঈশ্বরমুখী। এইসময় সংসারের কাজে মন বসে না। এইসময় আমাদের সূর্য নাড়ী  ও চন্দ্র নাড়ী উভয় নাড়ী দিয়ে বায়ু প্রবাহিত হয়। তখন প্রকৃতির মধ্যে একটা হিল্লোল চলতে থাকে। সমস্ত কিছু তখন চৈতন্যময়ী বলে মনে হয়। আর এই চৈতন্যময়ীর মধ্যে তখন প্রাণবায়ু স্থির হয়ে যায়। আর শরীর, মন, প্রাণ, ইন্দ্রিয় তখন প্রকৃতিকে অনুসরণ করে শুদ্ধসত্ত্ব অর্থাৎ সাম্য ভাবাপন্ন হয়। সমস্ত বহির্মুখী বৃত্তি তখন নিজে থেকে গুটিয়ে আত্মাতে স্থির হয়ে বসে।একটা  শান্তির বাতাবরণ, একটা শীতল বাতাস বইতে থাকে প্রাণে-মনে-শরীরে। প্রকৃতির এই সাম্যাবস্থা থেকেই একদিন তরঙ্গ উদ্ভূত হয়েছিল - শুরু হয়েছিল এই সংসার রচনার কাজ। আবার এই সংসারের ওপারে যেতে হলে, পঞ্চতত্ত্বকে অতিক্রমন করে পরম পুরুষের কাছে যেতে হবে। তখন সমস্ত ইন্দ্রিয় নিজে থেকেই শান্ত হয়ে যাবে। তাই ইন্দ্রিয়কে জোর করে নিষ্ক্রিয় করা প্রকৃতি বিরুদ্ধ। কিন্তু যখন মন ইন্দ্রিয় থেকে কূটস্থে স্থির হবে, তখন ইন্দ্রিয় শান্ত হবে। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়কে শান্ত করবার জন্য ইন্দ্রিয়-নিগ্রহের দরকার  নাই।  শুধু মনকে ইন্দ্রিয় থেকে উঠিয়ে আনতে পারলেই হলো। 

এখন কথা প্রকৃতির স্বভাবকে বাধা দেওয়া চলবে না। তাহলে আমরা আত্মমুখী হবো কিভাবে ? মহাত্মাগণ বলছেন, এটি শুধু অভ্যাসের দ্বারাই সম্ভব হতে পারে। দেখুন আমরা কেউ দুই মিনিট চিন্তাহীন অবস্থায় বসে থাকতে পারি না।  এমনকি শরীরকে স্থির অবস্থায় বেশিক্ষন রাখতে পারি না। হয় শরীরের কোথাও চুলকানি শুরু হবে, নয়, মন বিষয় চিন্তায় মগ্ন হবে। এখান থেকে বেরুতে গেলে, নিরন্তর একটা অভ্যাসে মধ্যে আমাদের ঢুকতে হবে। প্রতিদিন নিয়ম করে নির্দিষ্ট আসনে বসে থাকতে থাকতে একটা অভ্যাস তৈরী হয়ে যাবে।  আবার মনের চিন্তাকে প্রথমে ঘুরে বেড়াতে দিন। কিন্তু খেয়াল রাখুন কোথায় কোথায় সে ঘুরতে বেড়াতে ভালো বাসছে। আপনি যদি চেতন থাকেন, তবে,  মনকে ধরে একটা নির্দিষ্ট বস্তুর মধ্যে,  তা হতে পারে, কারুর মূর্তি, বা প্রদীপের আলোকরশ্মি, নতুবা কোনো কাল্পনিক আলোকবিন্দু , নিবদ্ধ করুন। বারবার এই অভ্যাস করতে করতে একদিন  দিন দেখবেন, মন আপনার ইষ্টে স্থির হয়েছে। আর আপনি নির্দিষ্ট আসনে, নির্দিষ্ট সময়ে বসলেই, আপনার মন তার নিদিষ্ট ইষ্টে স্থির হয়েছে। একমাত্র  নিরন্তর অভ্যাস এই অলৌকিক কাজটি করে দিতে পারে। 
আমাদের জন্ম জন্মান্তরের সংস্কার।  স্বাভাবিক ভাবেই এই সংস্কারের প্রাবল্য থাকবে। কিন্তু অভ্যাস আপনার এই পুরোনো সংস্কারকে  বদলে দেবে। অস্থির মন শান্ত হবে। চেষ্টার অসাধ্য কিছু নেই। চেষ্টা করলেই কিছু দিনের মধ্যেই মন স্থির হয়ে আসবে। এই কাজে সাহায্য করতে পারে, প্রাণায়াম। এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাসের গতির দিকে খেয়াল রেখে বসে থাকলেও, অর্থাৎ নাসিকাগ্রে মনকে বা দৃষ্টিকে স্থির রেখে বসে থাকলেও, মন শান্ত হয়ে যাবে। মনে রাখবেন, পুরুষার্থের প্রয়োগে, আর ভগবৎ-শক্তির কৃপায় সমস্ত অসম্ভব সম্ভব হতে পারে। 

----------------------------------------          
২৬.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - তৃতীয় অধ্যায়  - কর্ম্মযোগঃ      
শ্লোক নং ৩/৩৪  

ইন্দ্রিয়স্য -ইন্দ্রিয়স্য-অর্থে রাগদ্বেষৌ ব্যবস্থিতৌ 
তয়োর্ন বশমাগচ্ছেৎ তৌ হ্যস্য পরিপন্থিনৌ।  (৩/৩৪)

ইন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়ত্ত্ব অর্থাৎ চক্ষু কর্ন নাসিকা জিহ্বা ত্বক এর যে বিষয়কার্য্য অর্থাৎ শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ ইত্যাদির প্রতি অনুরাগ নিশ্চয়ই  আছে অর্থাৎ স্বাভাবিক যে গুন্ - এদের বশবর্তী হওয়া উচিত নয়। যেহেতু তারা মুমুক্ষু-জীবের ঘোর বিরোধী।

পুরুষ যদি প্রকৃতির অধীন হয় তবে ধর্ম্ম প্রতিষ্ঠিত হতে পরে না। সমস্ত শাস্ত্র তাহলে মিথ্যা হয়ে যায় । ইন্দ্রিয়সকল তাদের নিজ নিজ বিষয়ের প্রতি ধাবিত হবে। পছন্দের বিষয়ে অনুরাগ হবে, আবার অপছন্দের বিষয়ে বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হবে। এইভাবেই প্রকৃতি জীবকুলের প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির উৎপাদন ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।  এটাই প্রকৃতির বৈশিষ্ঠ। এখন শাস্ত্র বলছে, এদের বশবর্তী না হতে। তাহলে প্রকৃতির বন্ধনে থাকবে। মুক্তি হবে না। বিষয়ের স্মরণ, বিষয়ের প্রতি অনুরাগ বা বিরাগের উৎপন্ন করে থাকে। কিন্তু ভগবত স্মরণ তাকে ভগবানের প্রতি অনুরাগ বৃদ্ধি করে। 

ভগবানের স্মরণ মুমুক্ষ পথের  দিশারী। আর ইন্দ্রিয়ের  কাছ থেকে আমাদের দূরে সরে থাকতে হবে, তাকে কেবল উপেক্ষা করলেই হবে না, তার ক্রিয়া-পদ্ধতি সম্পর্কেও সাধককে অবহিত হতে হবে। ইন্দ্রিয়ের বশ্যতা স্বীকার করো না - এই  কথা বলা যত  সহজ, কার্যত একে  রূপায়ণ করা তত সহজ নয়। চোখ থাকলে দেখবে, কান থাকলে সে শুনবে, নাকের মধ্যে সুগন্ধ দুর্গন্ধ আসবে, ত্বকে শীত-গ্রীষ্ম অনুভব হবে, মুখ কথা বলবে। এগুলোকে বাহ্যিক দিক থেকে বন্ধ করলেই এদের থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে না। আবার এদেরকে অবহেলা করেও জীবনধারন সম্ভব নয়। কেননা এগুলো জীবধারনের জন্য অপরিহার্য অঙ্গ। এমনকি এই যে মন, একেও তুমি সহজে ভালো করতে পারবে না। কেননা ইন্দ্রিয় যেমন বহির্মুখী হয়ে বিষয়ে লিপ্ত হবে, তেমনি মন এই বিষয় থেকে ভালো মন্দ আস্বাদ গ্রহণ করবে। ভালো জিনিস খেলে, ভালো কথা শুনলে, তোমার ভালো লাগবে না এটা হতে পারে না।  আবার খারাপ কথা শুনলে, খারাপ জিনিস খেলে, তোমার খারাপ লাগবে না এটাও  হতে পারে না।

এখন কথা হচ্ছে তাহলে আমরা কি করবো ? আমরা প্রকৃতি থেকে দূরে তো যেতে পারবো না। আবার প্রকৃতি স্বভাবতই মুমুক্ষ বিরোধী।   ভগবান বলছেন, প্রকৃতির কাজ প্রকৃতি করুক, তুমি তাতে অসহিষ্ণু হয়ো না। প্রকৃতির কাজ প্রকৃতি করুক আর তোমার কাজ তুমি করো। তোমার মন যতক্ষন ইন্দ্রিয়-কর্ম্মে লিপ্ত  থাকবে, ততক্ষন তোমার মধ্যে ইন্দ্রিয়-কর্ম্মের প্রভাব পড়বে। এর থেকে বেরুতে গেলে, মনকে আত্মক্রিয়ায় নিয়োগ করতে হবে। মন যখন আত্মমগ্ন হবে, তখন বিষয় থেকে দূরে থাকবে। 

এই অভ্যাস নিরন্তর চালিয়ে যেতে হবে। চোখ সুন্দর অসুন্দর অবশ্যই  দুই-ই দেখবে। আর আমাদের মতো সাধারনের মানুষ  অসুন্দর থেকে মন অবশ্য়ই ফিরিয়ে নেবে, আর সুন্দরের দিকে ধাবিত হবে। রূপ মনকে আকৃষ্ট করবে, এটাই স্বাভাবিক।  কিন্তু আমাদের পুরুষার্থের কাজ হচ্ছে, সাধকের কাজ হচ্ছে, এই রূপে প্রলুব্ধ না হওয়া। 

 রূপের পরিণতি জ্ঞান থাকলে বা পূর্বাপর জ্ঞান থাকলে, আমরা বুঝতে পারবো, যা কিছু দেখছি সবই মায়া। এই আছে এই নাই। আজ যে রপবতী বা রূপবন্ত, কালের পরিণতিতে সে একদিন শুকিয়ে ঝরে পড়বে। সুন্দরী বৃদ্ধা হবে - সৌন্দর্য্য ম্লান হতে হতে একদিন কদর্য হয়ে যাবে। আত্মার অবর্তমানে সেখানে পচন শুরু হবে, দুর্গন্ধ বেরুবে। বারবার মনের মধ্যে এই চিন্তার পুনরাবৃত্তি হতে থাকলে, অর্থাৎ বস্তুর পরিণতি জ্ঞান হলে, বস্তুর প্রতি মনের আকর্ষণ ধীরে ধীরে লোপ পাবে। 

নিবৃত্তির আরো একটা উপায় হচ্ছে, যে বিষয়ে তোমার মন আকৃষ্ট হচ্ছে, মনকে সেই বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে নিয়ে যাওয়া। ৪/৫ বার দীর্ঘ অর্থাৎ জোরে জোরে শ্বাসে-প্রশ্বাসের ক্রিয়া অর্থাৎ প্রণায়াম করলেও  নাড়ীর উত্তেজনা প্রশমিত হবে। সাধন ক্রিয়ার সাহায্যে ইন্দ্রিয়ের রাগ-দ্বেষ প্রশমিত হলে মন শুভপথের সন্ধান করবে।  তখন শাস্ত্রবাক্য, গুরুবাক্য ইত্যাদিতে মন আকৃষ্ট হবে।  পুরুষার্থ মানে অহংকার নয়, পুরুষের বিষয়কেই বলে পুরুষার্থ। পরম পুরুষ হচ্ছেন, নির্গুণ,  নির্লিপ্ত, আপনাতেই  আপনি স্থিত।  এই পুরুষের প্রয়াসকে বা পুরুষের স্বভাবকে যার দ্বারা আয়ত্ত্ব  করা যায়, তাকেই বলে পুরুষার্থ। প্রকৃতির বশীভূত যারা তারা পুরুষার্থের প্রয়োগে ব্যর্থ। তারা বৃথা আলস্যে, আমোদে দিন অতিবাহিত করে। আর সুখ-দুঃখের তাপে দগ্ধ হয়। ইন্দ্রিয়ের যে বিষয়ে আসক্তি, যার দ্বারা রাগ দ্বেষের উৎপত্তি তা যে শুধু নিজের বিচার বুদ্ধি দিয়ে শেষ করা যাবেই, তা না-ও হতে পারে। সেজন্য দরকার,  নিরন্তর সৎসঙ্গ, সৎগ্রন্থ পাঠ। গুরুবানী শ্রবণ। আর এর থেকে ধীরে ধীরে বিষয়ের জ্ঞান জন্মে। নিত্য ও অনিত্যের জ্ঞান আসে। সৎ-আলোচনা শুনতে শুনতে, সদগ্রন্থের বিষয়কে মনন করতে করতে একসময় নিজের মধ্যে জিজ্ঞাসা জেগে ওঠে।  মুমুক্ষের জন্য প্রাণ আঁকুপাঁকু করতে থাকে। ভগবত স্মরণ করতে করতে ভিতরে একটা ভগবত-আনন্দের অনুভূতি হতে শুরু করে। এই নির্মল-আনন্দ আমাদের মধ্যে নতুন সংস্কারের জন্ম দেবে। আর এই নতুন সংস্কার আমাদের প্রকৃতির উপরে জয় লাভ করতে  সাহায্য করবে। তখন প্রকৃতির উপরে নির্ভরতা ছাড়িয়ে আত্মনির্ভর হবে মন। ধ্যান-জপ-আসন-প্রাণায়াম ইত্যাদিতে মন আকৃষ্ট হবে। আর এই সাধনক্রিয়ার  স্বল্প বিচ্যুতিও তখন মন মেনে নিতে পারবে না। জগতের সমস্ত কিছুই অনিত্য, এখান থেকে সংগ্রহ করে রাখবার মতো কিছু নেই। এই বোধ যখন জন্মাবে, তখন জাগতিক দ্রব্যের প্রতি লোভ করবার মতো আর কিছু থাকবে না। বিষয়ের  সংস্পর্শে এলেও, বিষয়কে বিষবৎ মনে হবে। নিজেকে ভুলেও আর কর্ত্তা মনে হবে না। মন-প্রাণ ভগবৎ চরণে নিবেদিত হবে। প্রতিনিয়ত ভগবৎ স্মরণ করতে করতে,  মনকে ভগবানের সঙ্গে একত্মবোধ করতে শুরু করবে। প্রকৃতি মুমুক্ষুতার বিরোধী শক্তি। এই প্রকৃতির শক্তিকে  তখন মন অবজ্ঞা করবে। নিরন্তর ব্রহ্মকথা শুনতে শুনতে, সাধনক্রিয়া করতে করতে,  শরীরের রাসায়নিক মিশ্রনের মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখা দেবে। একটা সময় মনে হবে "আমি ব্রহ্মই"। অবিদ্যার বিক্ষেপ জনিত দুঃখের অবসান  হবে। 
-----------------------              
২৭.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - তৃতীয় অধ্যায়  - কর্ম্মযোগঃ      
শ্লোক নং ৩/৩৫ 

শ্রেয়ান স্বধর্ম্মো বিগুনঃ পরধর্ম্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ
স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্ম্মো ভয়াবহঃ (৩/৩৫) 

 ঠিকঠিক অনুষ্ঠিত পর-ধর্ম্ম থেকে, অঙ্গহীন স্বধর্ম্ম শ্রেষ্ঠ। স্বধর্ম্মে থেকে নিধনও কল্যাণকর, পর-ধর্ম্ম ভয়াবহ।

ইন্দ্রিয় তার নিজের স্বভাবজাত-কর্ম্ম করছে, তাকে বশ করা কঠিন। কেননা কারুরই স্বভাব সহজে পাল্টানো যায় না। আর ইন্দ্রিয় আত্মাতে স্থিত নয়, ইন্দ্রিয়ের পরিচালক হচ্ছে আমাদের মন।  মন আবার বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। তাই  আমাদের যেটা কর্তব্য তা হচ্ছে, ইন্দ্রিয়ের কর্ম্মগুলোকে ভালোভাবে বিচার বিশ্লেষণ করা। এই বিচার বিশ্লেষণ থেকেই আমরা ইন্দ্রিয়ের কর্ম্ম সম্পর্কে সাবধানতা  অবলম্বন করতে পারি। ইন্দ্রিয়কে আমরা জয় না করতে পারি, ইন্দ্রিয়ের বশ্যতা যেন আমরা স্বীকার না করি। 

অনেকের ধারণা  হচ্ছে, আমরা যদি সাধনক্রিয়া করি, আমরা যদি ভগবৎ স্মরণে থাকি তবে হয়তো আমাদের ইন্দ্রিয় মাথাচারা  দেবে না, ইন্দ্রিয় তার কর্ম্ম থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকবে। ব্যাপারটা এমন নয়।  প্রকৃতিকে বশে আনা দুঃসাধ্য। যতই দৃঢ় সংকল্প করুন না কেন, চোখ সামনের দৃশ্যের প্রতি আকৃষ্ট হবেই।  কান বাহ্যিক শব্দের অনুভব করবেই। আমি প্রকৃতি থেকে দূরে থাকতে চাই বললেই, আমি প্রকৃতি থেকে দূরে যেতে পারবো না।  স্থুল দেহে বাস করবো, আর প্রকৃতির বিরুদ্ধাচারন করবো, এটা হতে পারে না। তাহলে স্থুলদেহের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। 

আর এই মৃত্যুই আমাদের কাছে সবচেয়ে অনভিপ্রেত। আবার আসক্তিবশতঃ মনের মধ্যে যদি নিরন্তর চঞ্চলতা থাকে, তাহলেও আমাদের অমৃতের পথে যাওয়া হলো না, অর্থাৎ উভয় সংকট। প্রকৃতিকে প্রশ্রয় দিলে, অমৃতত্ব লাভ হবে না, আবার প্রকৃতির আশ্রয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। তাই আমাদের কাজ হচ্ছে মন-প্রাণের স্থির অবস্থা। আর এই মন ও প্রাণের স্থিরতা আনার কাজই স্বধর্ম্ম পালন। শরীর যেমন কর্ম্মক্ষেত্ৰ, তেমনি এই শরীর হচ্ছে আমাদের সাধন-ক্রিয়ার ক্ষেত্র। একদিকে যুদ্ধক্ষেত্র, অন্য দিকে ধর্ম্মক্ষেত্ৰ। এই দেহ হচ্ছে, পঞ্চতত্ত্ব, জ্ঞান ও কর্ম্মের আধার। তো এই ভূতগুলোর প্রতি দয়াও আমাদের ধর্ম্ম। 

মেরুদন্ডকে আশ্রয় করে, যে সুষুম্না নাড়ী সহস্রার  পর্যন্ত বিস্তারলাভ করে বিরাজ করে আছে, গুরুকৃপায়, তাকে চৈতন্যময় করতে পারলেই, জীবন সার্থক হয়। তখন জন্ম, জরা, মৃত্যুর অধীন এই দেহবন্ধন থেকে আমি অর্থাৎ আত্মার নিষ্কৃতি হয়। একেই বলে নিজের প্রতি নিজের দয়া। সাধনক্রিয়া ব্যাতিত এই দয়া-কর্ম্ম সম্পাদিত হতে  পারে না। শুভ বা অশুভ উভয় কর্ম্মই একই মনুষ্য দেহে ক্রিয়াশীল হয়। শুভ-অশুভ উভয় কর্ম্মের আধার এই দেহ। দেহকে বাদ  দিয়ে, কোনো কর্ম্মই হতে পারে না। যতক্ষন দেহের সংযাগে আমাদের সম্পর্ক থাকে ততক্ষন আমাদের কর্ম্মক্ষয় হয় না।  আর কর্ম্মক্ষয় না হলে আমাদের এই ভববন্ধন কাটে না। সুতরাং সাধন ক্রিয়া করবার জন্য আমাদের এই দেহের অবশ্য়ই প্রয়োজন। প্রাণায়ামের কৌশল জেনে প্রাণায়ামের সাহায্যে শ্বাসকে চৈতন্য যুক্ত করে সুষুম্না রন্ধ্রে প্রবাহিত করতে হবে। এতে মনের চাঞ্চল্য চলে যায়।  মন হয় স্থির। যোগীপুরুষের আদর্শে  প্রাণায়ামের দ্বারা ও বিভিন্ন মুদ্রার দ্বারা তেজের প্রকাশ অনুভব হয়। এই তেজই প্রসবিতার বরণীয় শক্তি। তেজের মধ্যে কৃষ্ণবর্ণের বিন্দু বা গোলক দৃষ্ট হয়। এই  গোলকস্থিত পুরুষকে জানতে পারলেই জীবের জীবন সার্থক হয়। 

স্ব-ধর্ম্মে স্থিতি কথাটার অর্থ হচ্ছে,  আত্মস্থে অবস্থান করা। নিজের মধ্যে স্থিত হওয়া।  এই ধর্ম্ম পালন করতে গেলে, ভুল-ত্রুটি হবে। সাধন-ক্রিয়া ঠিক ঠিক মতো অনুষ্ঠিত না করতে পারলেও, এই স্ব-ধর্ম্মেই স্থিত থাকা ভালো।  বিষয়-কর্ম্ম হচ্ছে, পর-ধর্ম্ম। এই বিষয়কর্ম্ম যতই নিপুন ভাবে করা হোক না কেন, আখেরে এতে কোনো লাভ নেই। কেননা এই বিষয়-কর্ম্ম যতই সঠিক ভাবে করা হোক না কেন, তা দেহাদিভাব অতিক্রম করতে পরে না। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়াদির যে ভোগাদি কর্ম্ম যা যতই প্রসংশার যোগ্য হোক না কেন, জীবের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে অর্থাৎ জীবের পরিত্রাণে এই বিষয়-ধর্ম্ম যাকে যোগেশ্বর বলছেন পরধর্ম্ম, কোনো কাজে আসে না। ইন্দ্রিয়ভোগে আসক্ত  জীব একসময় ত্রাহিমাম ত্রাহিমাম বলে চিৎকার শুরু করে। তাই ভগবান বলছেন, এই পর-ধর্ম্ম  ভয়াবহ।  

মহাত্মাগণ বলছেন, গুণাতীত অবস্থায়, জীবের পরিত্রান হতে পারে। এই গুণাতীত অবস্থায় যেতে গেলে, নিরন্তর তপস্যার ক্লেশ সহ্য করতে হবে। ইন্দ্রিয়সংযম হচ্ছে সর্ব্বপ্রধান ধর্ম্ম। ধর্ম্ম হচ্ছে জীবের পরিত্রানের পথ, স্ব-ধর্ম্ম হচ্ছে নিজের পরিত্রানের ক্রিয়া, সাধনক্রিয়া। বাহ্যিক ধর্ম্মানুষ্ঠান পুজো-পাঠ সাময়িক ভাবে, মানুষকে শান্তির সন্ধান দিতে পারে। কিন্তু এই পথ কেবল প্রাথমিক সাধকের পক্ষে ভালো। উচ্চতর সাধনায় অর্থাৎ প্রাণায়ামের ক্রিয়া দ্বারা ব্রহ্মে স্থিত হওয়া  ভিন্ন স্ব-ধর্ম্ম পালন হতে পারে না। কঠ উপনিষদে (শ্লোক :২/১/৯/১১) যমরাজ বলছেন,  কেবলমাত্র শুদ্ধ মনের দ্বারাই ব্রহ্মের উপলব্ধি সম্ভব। ব্রহ্ম থেকে পৃথক কিছু নেই.. ব্রহ্ম থেকে পৃথক কিছুতে  যে বিশ্বাস করে সে মৃত্যু থেকে মৃত্যুতে যাত্রা করে। অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যুর চক্রে ঘুরতে থাকে। শ্লোক নং ২/১/১১/১২-১৩ তে আবার বলছেন, বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ পরিমান পুরুষব্রহ্ম আমাদের দেহের অভ্যন্তরেই বাস করেন। তিনি অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। সাধক যখন ব্রহ্মকে জানেন, তখন তিনি নিজেকে আর গোপন করেন না।  বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ পরিমান পুরুষকে যোগীরা নিজ হৃদয়ে ধুম্রহীন অগ্নিশিখার মতো দেখেন। 

অনু থেকেও সূক্ষ্মতর আকাশ থেকেও বৃহৎ, দেশ কালের অতীত এই ব্রহ্ম। বুদ্ধির অতীত, এই জীবাত্মা হৃদয়গুহায় বাস করেন। যোগী যখন কামনাশূন্য হয়ে, শোকাদি রোহিত হয়ে, ইন্দ্রিয়বর্গকে স্থির ক'রে, শুদ্ধ মনের অধিকারী হন, আত্মমুখী হন, তখন তিনি এঁর সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হন। 

------------
২৮.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - তৃতীয় অধ্যায়  - কর্ম্মযোগঃ      
শ্লোক নং ৩/৩৬-৩৭
 
অর্জ্জুন উবাচ : 
অথ কেন প্রযুক্তঃ-অয়ং পাপং চরতি পুরুষঃ
অনিচ্ছন্-অপি বার্ষ্ণেয় বলাদিব নিয়োজিতঃ।  (৩/৩৬) 

অর্জ্জুন বললেন, হে বার্ষ্ণেয়, মানুষ কার দ্বারা প্রযুক্ত  হয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলপূর্বক পাপাচরনে নিয়োজিত হয় ? 

যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে অর্জ্জুন এবার  বার্ষ্ণেয় বলে সম্মোধন করছেন। যদুকুলে বৃষ্ণি নামক বংশে শ্রীকৃষ্ণের  জন্ম হওয়াতে তাঁকে বার্ষ্ণেয় নাম ডাকা হয়েছে। আসলে "বৃষ্" কথাটার অর্থ হচ্ছে, বর্ষণ করা "নি" অর্থাৎ ত্ত্ব - যিনি বর্ষণ করেন।  বৃষ্ণি কথার দ্বারা জ্যোতি, মেঘ, বায়ু,অগ্নি ইত্যাদিকেও বোঝানো নয়। 

শরীরের তেজ দ্বারা আমাদে সমস্ত অনুভূতি হয়ে থাকে। অর্জ্জুনের প্রশ্ন হচ্ছে, পাপ আচরণে মানুষ কেন লিপ্ত  হয় ?  অনেক সময় অনিচ্ছাসত্ত্বেও  মানুষ পাপাচারন করে ফেলেন।  কিন্তু কেন।  অর্জ্জুন এই প্রশ্নের জবাব চাইছেন - কার কাছে না  বার্ষ্ণেয়র কাছে। আসলে আমাদের শরীরে সারাক্ষন বিভিন্ন ধরনের রস নিঃসৃত হচ্ছে, অর্থাৎ বর্ষিত হচ্ছে। আর এই রসের মধ্যেই উঠছে স্পন্দন। এই স্পন্দন আমাদের মনের চিন্তাশক্তির উৎস। এই রসের বিভিন্নতায় মানুষে মানুষে পার্থক্য হয়ে থাকে। একেই বলে স্নায়ুর ক্রিয়া।  তো যিনি এই রসের উদ্গাতা অর্থাৎ বৃষ্ণি বংশজাতক-কে এই প্রশ্নের সম্মুখে ফেলে দিলেন, অর্জ্জুন। 

শ্রীভগবান উবাচ : 
কাম এষ ক্রোধ এষ রজোগুণ-সমুদ্ভবঃ
মহাশনো মহাপাপ্না বিদ্ধ্যেনমিহ  বৈরিনম্। (৩/৩৭)

শ্রীভগবান বললেন, কাম ও ক্রোধ রজোগুণ হতে উৎপন্ন।  মহাশনঃ অর্থাৎ অঢেল ভোগের পরেও এর নিবৃত্তি হয় না। এটি অতি উগ্র। মোক্ষমার্গে একে শত্রু বলে জেনো। 

আমাদের এই দেহভান্ড সাতটি  স্তরে বিভক্ত। দেহের এক একটা স্থান এক এক তত্ত্বের কর্ম্ম কেন্দ্র। এই কর্ম্ম কেন্দ্রগুলোর নাম গ্রন্থিচক্র বা গ্রন্থিস্থান। স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী এই গ্রন্থিগুলোর নাম রেখেছেন, মহৎগ্রন্থি, অহংগ্রন্থি, ব্যোমগ্রন্থি, বায়ুগ্রন্থি,  অগ্নিগ্রন্থি, বায়ুগ্রন্থি, বরুনগ্রন্থি ও পৃত্থিগ্রন্থি। হঠযোগের ভাষায়, মূলাধার (পৃত্থি) স্বাধিষ্ঠান (বরুন) মনিপুর (বায়ু) অনাহত (ব্যোম) বিশুদ্ধ (অহং)ও আজ্ঞা ( মহৎ) ।  সমস্ত সাধনার ভিত্তিভূমি হচ্ছে এই শরীর। এই দেহ শুদ্ধ হলেই, আমাদের মন শুদ্ধ হতে পারে। তো সাধনার ভিত্তি ভূমি সুদৃঢ় হলে আমরা গগনচুম্বী জীবনসৌধ নির্মাণ করতে পারবো। দেহ, মন, বুদ্ধি, অহংকার ইত্যাদি সবই সেই আত্মারই বিভূতি বা শক্তি। এই শক্তির খেলা চলছে, আমাদের দেহযন্ত্রের  মধ্যে। দেহের স্নায়ু, পেশীকোষ, ও গ্রন্থিসকল যদি স্বাভাবিক থাকে, অর্থাৎ দোষমুক্ত থাকে তখন দেহযন্ত্রের মধ্যে আত্মার দেবভাব, ভাগবতভাবে স্ফূরিত হতে থাকবে। আর তা যদি না হয়, দেহ-মন যদি  অশুদ্ধ  হয়, তবে দেহমনে পাশবিক বৃত্তির তাণ্ডব শুরু হবে। একই শক্তির দ্বিবিধ আচরণ, খেলা।  

তাই বলা হয়, আমাদের বরুণগ্রন্থি  অর্থাৎ যকৃতের ক্রিয়া যদি ঠিক ঠিক মতো না হয়, তবে আমাদের মধ্যে কামপ্রবৃত্তির জাগরণ হয়, মানুষ হয়ে ওঠে খিটখিটে, ব্যবহার হয় রুক্ষ-কর্কশ। অর্থাৎ কাম ও ক্রোধ হচ্ছে, এই বরুণগ্রন্থির ক্রিয়া। 

আবার ইচ্ছেশক্তিই রজগুনের ক্রিয়া করে থাকে। ক্ৰোধ রজঃগুন্ থেকে উৎপন্ন হয়ে থাকে। প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তিতে, গ্রহণ ও বর্জনের যে ইচ্ছাশক্তি তা যখন বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখন আমাদের ক্রোধের জন্ম হয়। যতক্ষন মন বিষয়ের প্রতি আসক্ত থাকবে, ততক্ষন এই মনের মধ্যে আবাহন-বিসর্জনের, গ্রহন-বর্জনের  ক্রিয়া থাকবে। কাউকে সে গ্রহন  করতে চাইবে, কাউকে সে বর্জন করতে চাইবে। আর এই কাজে যদি বাধা আসে, বা এই কাজ যদি অপূর্ন থাকে তখন নিজের মধ্যে রাগের উৎপত্তি হবে। আসলে এসবই বায়ুর ক্রিয়া। বায়ু যতক্ষন না স্থির হয়ে ব্রহ্মে স্থিত  হচ্ছে, ততক্ষন এই কাম-ক্রোধের খেলা চলতে থাকবে। সংসারক্ষেত্রে এই কাম-ক্রোধ যেমন বর্জনীয়, তেমনি সাধন জগতেও কাম-ক্রোধ সাংঘাতিক শত্রু। প্রাণায়াম করতে করতে যখন প্রাণবায়ু ব্রহ্মনাড়ীতে স্থিত হয়, তখন প্রাণ-মন একত্রে স্থির হয়ে অবস্থান করে। তাই শ্বাসের  দিকে সদা দৃষ্টি রেখে, শ্বাসের গমন-নির্গমন ক্রিয়া করতে হয়। দৃঢ়তার সাথে যোগাভ্যাসে নিজেকে নিয়োগ করতে হবে। তবেই কাম-ক্রোধের উপরে জয় লাভ সম্ভব হবে।  

আত্মা ভিন্ন অন্যকিছু বোধ করাই অজ্ঞান। আর এই অজ্ঞান থেকে কাম-ক্রোধ, সংকল্প-বাসনার উৎপত্তি। আমাদের বহির্দৃষ্টি যত  প্রসারিত হয়, তত আমাদের অন্তর্দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসে। আর বহির্বিশ্বের আকর্ষনে অজ্ঞানের আবরণ দিনের পর দিন বাড়তে থাকে। প্রাণ থেকেই সমস্ত  ভূতগণের উৎপত্তি। আবার এই প্রাণের সঙ্গেই রয়েছেন স্বয়ং ব্রহ্ম, বা চেতন শক্তি। তাই প্রাণের উপাসনা দ্বারাই মায়া শক্তিকে সংকুচিত করা সম্ভব। প্রাণের উপাসনার সঙ্গে সঙ্গে ভাগবৎশক্তির বিকাশ হয় । এই ভাগবৎশক্তির বিকাশ হলে, তত্ত্বজ্ঞান লাভ হয়। তত্ত্বজ্ঞান লাভ হলে মায়ার আবরণ কেটে যায়। সাধক তখন  আত্মাতে স্থিত হয়। আত্মতে স্থিত হলে স্ব-রূপের জ্ঞান হয়।  তখন আর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি বলে কিছু থাকে না।  গ্রহণ-বর্জন বলে কিছু থাকে না। রাগ দ্বেষ ঘৃণা ভয় সব দূর হয়ে যায়।  

----------
২৯.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - তৃতীয় অধ্যায়  - কর্ম্মযোগঃ      
শ্লোক নং ৩/৩৮
 
ধূমেন-আব্রিয়তে বহ্নির্যথা-আদর্শো মলেন চ 
যথোল্বেনাবৃতো গর্ভস্তথা তেন-ইদম-আবৃতম্। (৩/৩৮)

ধূমের দ্বারা যেমন অগ্নি, ও মলের দ্বারা যেমন দর্পন আচ্ছাদিত থাকে এবং জরায়ু-চর্ম্ম দ্বারা গর্ভ আবৃত থাকে তেমনি জ্ঞান কাম  দ্বারা আবৃত থাকে।

কথায় বলে বাতাস পেলেই আমরা স্ব-মূর্তি  ধারণ করি। অর্থাৎ ইন্ধন পেলেই অগ্নি জেগে ওঠে, আয়না পরিষ্কার হয়ে যায়।  তখন আমাদের বীভৎস রূপ বেরিয়ে পড়ে। সাধাণরত যোগীর প্রাথমিক অবস্থায়, মাঝে মধ্যে মনে হয়, তার মধ্যে থেকে সমস্ত কাম-রিপু দূরীভূত হয়ে গেছে। কেননা সে সাধনক্রিয়া করছে। আসলে এই কামরিপু কিন্তু সহজে নির্মূল হয় না।  অগ্নির স্ফুলিঙ্গের ন্যায় ম্রিয়মান হয়ে থাকে আবার সময় সুযোগ পেলে, অর্থাৎ বাসনার বাতাস পেলেই অগ্নি আবার জ্বলে ওঠে। তখন জীবের বিবেকজ্ঞান নষ্ট করে দেয়। মাঝে মধ্যে মনে হয়, মানুষের মধ্যে যদি এই কাম-ক্রোধ রিপুর সমাগম না হতো, তাহলে কত সহজেই না আমাদের আত্মজ্ঞান লাভ হতে পারতো। সমস্ত জীবের মধ্যেই  আছেন, সেই প্রজ্ঞানঘন রূপ। শুধু আচ্ছাদনে ঢাকা। বাসনার ধুম দ্বারা সেই জ্ঞানাগ্নি ঢাকা। আবার বাসনা হচ্ছে মনের ক্রিয়া। তাই বাসনাশূন্য মনেই একমাত্র আত্মার  প্রকাশ ঘটতে পারে।  

সূর্যকে মেঘ ঢেকে রাখলেও সূর্য সূর্যই থাকে। সূর্য্যের রশ্মি এতে এতটুকু নষ্ট হয় না। মেঘ কেটে গেলে, আবার সূর্য্যের প্রকাশ ঘটে। আত্মার মধ্যে আনন্দঘন ভাব, সর্বদা বিরাজ করছে। এই আনন্দময় সত্ত্বার সাথে একাত্ম হতে গেলে,  মন থেকে কামনা রূপ আবরণ সরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু কিভাবে এই কামনার বিনাশ হবে ? 

আমরা জানি, আমাদের তিনটি শরীর।  স্থুল সূক্ষ্ম ও কারন। এই কারন শরীরের সহজে নাশ হয় না। জীবকুল এই স্থুল  শরীর ধারণ করবার আগে, জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কার অনুযায়ী সূক্ষ্ম শরীর রচনা করে থাকে। প্রতি জন্মে জীবের সূক্ষ্ম  শরীর সৃষ্টির  সাথে এই কামভাব বা সংকল্প  কারন হয়ে থাকে। কাম হচ্ছে অজ্ঞানের আধার। কাম নষ্ট হয়ে গেলে অজ্ঞানের নাশ হয়। কিন্তু এই কামনার জন্যই সে সূক্ষ্ম শরীর রচনায় প্রবৃত্ত হয়।  এর পরে, জীব পিতৃ-মাতৃ সহযোগে সে তার পিন্ডদেহকে রচনা করে। আর কারন শরীর  তো আগে থেকেই ছিল। তো স্থুলদেহের পুষ্টি সাধনের সঙ্গে সঙ্গে তার সূক্ষ্ম শরীরও পুষ্টি লাভ করে থাকে। অর্থাৎ মনোময়, বিজ্ঞানময় শরীরের পুষ্টি সাধন হয়ে থাকে।  এবং এই সূক্ষ্ম শরীরের মধ্যে যে কামনার বীজ সংগ্রহীত ছিল, তার বিকাশ হতে থাকে স্থুল  শরীরে । 
যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের কথায় আমাদের মনে হয়েছে, তিনি উদাহরণ দিচ্ছেন আবরণ ব্যাপারটাকে বোঝাবার জন্য।  কিন্তু তিনি এর মধ্যে সত্যের উদ্ঘাটন করেছেন।  অর্থাৎ জীব প্রথমে ধূম্রের আকারে থাকে। তারপরে, এই ধূম্রের মধ্যে অগ্নির সন্ধান মেলে।  অর্থাৎ তখন কারন শরীর ও তন্মাত্রের (পঞ্চভূতের) মিলন ঘটে। আর এর মধ্যে আত্মার স্থিতি লাভ হয়, বা আত্মার আবির্ভাব ঘটে । তখন সূক্ষ্ম শরীর ও তার মধ্যে জীবাত্মা বাসনা দ্বারা আবৃত হয় বলে, এঁকে অধিক আচ্ছাদিত করে ফেলে। একেই যোগেশ্বর বলছেন, মলদীপ্ত দর্পন অর্থাৎ গর্ভস্থ জীব। তখন আর আত্মা নিরাভরণ থাকে না। আত্মা তখন প্রথম পোশাক ধারণ করলো। বাসনা লিপ্ত সূক্ষ্ম শরীর যতটা আচ্ছাদিত ছিল, তার চেয়ে স্থূল শরীরে এসে সে আরো বেশী অন্ধকার আছন্ন হয়ে পড়লো। অজ্ঞান অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো। 

এই দর্পন মাজা ঘষা  করলে, যেমন প্রতিবিম্ব স্পষ্ট আকারে দেখা দিতে পারে, তেমনি এই শরীরনামক আবরণকে শুদ্ধ নির্মল  করতে পারলে, আত্মার প্রতিচ্ছবি উপলব্ধ হতে পারে। জ্ঞান দিয়ে, বিচার বিশ্লেষণ করে, ও সাধনক্রিয়ার সঙ্গে নিজেকে নিয়োগ করলে, এই উপলব্ধি হতে পারে। পিন্ড শরীরে বা স্থুল  শরীরেরই কামের বিষয়ভোগ হয়ে থাকে। এইসময় আত্মা লুপ্তবৎ হয়ে থাকে। একেই জরায়ু মধ্যস্থ প্রাণের অবস্থা বলা যেতে পারে। জরায়ুর মধ্যে যেমন ভ্রূণ অজ্ঞান-অন্ধকারে আছন্ন হয়ে থাকে,  অর্থাৎ জ্ঞানশক্তির বিকাশ সেখানে দেখা যায় না ঠিক তেমনি কাম বাসনায় লিপ্ত মন-বুদ্ধি এতো  স্থুল ও বিষয়দর্শী হয়, যে সেখানে আত্মজ্ঞানের প্রকাশ সেখানে দেখা যায় না। 

তো আত্মার অজ্ঞান-আবরণ যেমন তিন প্রকার, তেমনি সাধনার ক্ষেত্রে এই তিন অবস্থা দেখতে পাওয়া যায়। প্রথমটি মায়ের পেটে জরায়ুর মধ্যে অবস্থানের মতো.অর্থাৎ ঘোর অজ্ঞান অন্ধকার। এদের আত্মা সম্পর্কে কোনো বোধ থাকে না। ঈশ্বর সাধনা সন্মন্ধে তারা উদাসীন। এখানেও ভগবান আছেন, কিন্তু ভগবান তখন জীব-বুদ্ধির বাইরে অবস্থান করেন। এরা জাগতিক বিষয়ভোগে মত্ত। এরা সাধন  করতে চায়ও না, সাধন করবার যোগ্যতাও এদের মধ্যে জাগ্রত হয় নি।  মেরে-ধরে বা প্রভাবশালী আচার্য্যের কাছে এলেও, এরা  সেখান থেকে পালাতে চেষ্টা করে থাকে। এরা সবেমাত্র মনুষ্য শরীর পেয়েছে, কিন্তু এতদিন নিকৃষ্ট  ভোগ-শরীরে অবস্থানের ফলে, তার পূর্ব-পূর্ব জীবনের সংস্কার ছেড়ে বেরিয়ে আসবার ক্ষমতা অর্জন হয় নি।   আসলে এই স্তর অতিক্রম করতে পারলে,  তবেই মানুষ সাধনা সম্পর্কে আগ্রহ দেখাতে পারে। 
এর পরের স্তরের  মানুষের মধ্যে  সাধনা সম্পর্কে একটা আগ্রহ দেখা যায়। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে, সে সাধন  ক্রিয়ার মধ্যে প্রবেশ করে। কিন্তু বিষয়বিমুখ না হবার জন্য, এরা বিষয়  ছাড়তে পারে  না। এরা লোক কল্যাণের জন্য, বিভিন্ন কর্ম্মে লিপ্ত হয়। এইযে মন্দির মসজিদ  দেখছেন, এগুলো এইসব মানুষের সহযোগিতায় হয়ে থাকে। এদের মধ্যে কিছু শাস্ত্রজ্ঞানের উন্মেষ দেখা যায়।  ফলত এরা মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু এরা নিজেদেরকে আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে নিয়ে যেতে পারে না। 

অতঃপর মানুষ যখন মুক্তির আকাঙ্খায় সত্যকে জানবার জন্য উদগ্রীব হয়, এবং এর জন্য তারা সমস্ত কিছুকে বিসর্জন দিতে পারে, তখন মানুষ অসীম কষ্ট  সহ্য করে সাধনক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। এরাই সাধন জগতের স্তরভেদ করতে পারে।  দুর্লভ ঐশ্বরিক শক্তি, অর্থাৎ যোগৈশ্বর্য্য এঁরা  লাভ করতে পারে। এদের অনাহত চক্রে মধুর ধ্বনি উঠতে থাকে। আত্মজ্যোতির প্রকাশ অনুভব করে এঁরা। ওঙ্কারের সাধনার ফলে, এদের মধ্যে কারুর কারুর ভূতশুদ্ধি আরম্ভ হয়। এই ভূতশুদ্ধি হলেই, আত্মার আবরণ উন্মোচন হতে থাকে। কিন্তু অনাদি-অজ্ঞান বীজ তখনও বিনাশপ্রাপ্ত হয় না। এর জন্য আরো কঠিন সাধনার প্রয়োজন। আর এই কঠিন সাধনা, একমাত্র ভাগবৎকৃপা ধন্য সাধকের মধ্যেই দেখা যায়। মহাত্মাগণ বলছেন, এই অবস্থায় যেতে সাধকের  বহু জন্ম লাগতে পারে। কেননা এই শেষ আবরণ হচ্ছে কারন শরীরের। এই কারন শরীরেই সঞ্চিত আছে, আমাদের বহু জন্মের সংস্কার, স্মৃতি।  একে  নির্মূল করতে পারলে, সাধক স্বয়ং ব্রহ্ম হয়ে যান। এঁদের সবিকল্প সমাধি দীর্ঘস্থায়ী হয়। এই অবস্থায় স্থুল ও সূক্ষ্ম উভয়  শরীরের নাশ, হয়। তখন জ্ঞান-অজ্ঞান উভয়ের বিলোপ সাধন হয়। একেই বলে শিব-ভাব। এর পরে কারন শরীরের নাশ হয় আর সাধক ব্রহ্মে লীন হয়ে যান। একে  বলে ব্রহ্মাতীত অবস্থা। ওঁং শুভম।    

-------------------------               
৩০.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - তৃতীয় অধ্যায়  - কর্ম্মযোগঃ      
শ্লোক নং ৩/৩৯-৪০

আবৃতং জ্ঞানমেতেন জ্ঞানিনো নিত্যবৈরিণা
কাম রূপেণ কৌন্তেয় দুষ্পূরেণ-অনলেন  চ। (৩/৩৯)

হে কৌন্তেয়, জ্ঞানীর নিত্যশত্রু এই কামরূপ দুষ্পূরণীয় অগ্নি  দ্বারা জ্ঞান আবৃত। 

কৌন্তেয় অর্থাৎ কুন্তীপুত্র। কুন্তিভোজের পালিত কন্যা কুন্তী। যা শরীরকে রক্ষা করে তাকে বলা হয় কুন্ত।  "ক"-অর্থাৎ শরীর "অন্ত"  অর্থাৎ বন্ধনে। কন্ত  অথাৎ তেজঃশক্তি। সমস্ত ক্রিয়াশীল ব্যক্তির অন্তরে আছে অনলাবৃত্ত অর্থাৎ অগ্নি দ্বারা আচ্ছাদিত ইচ্ছা। এই ইচ্ছারূপ অগ্নি প্রজ্বলিত হলেই আমাদের সাধারণ বুদ্ধি রাগান্বিত হয়ে ওঠে। প্রত্যেকের অন্তরে আছে বাসনার অনল। বিষয় সংযোগরূপ বাতাসের আঁচ পেলেই, দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। সঙ্গে যদি অহংকারের যোগ হয়, তবে, তা ষোলকলা পূর্ণ হয়।  এই কামরূপ অগ্নিতে যত  বিষয় সংযোগ হবে, কামাগ্নি তত শক্তিশালী হয়ে উঠবে। জ্ঞানী ব্যক্তি কামবাসনা মুক্ত নন. কিন্তু জ্ঞানযোগীর মধ্যে কামনার লেশ  মাত্র থাকে না। তাই জ্ঞানী ব্যক্তিকে  কামের পীড়ন সহ্য করতে হয়। জ্ঞানী ব্যক্তি যে ভোগাসক্ত তা নয়, কিন্তু জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কার সহজে তাদের ছেড়ে যেতে চায় না। তাই জ্ঞানীকে সদা সতর্ক থাকতে হয়।  সদা সচেতন থেকে আত্মস্মৃতি জাগ্রত রেখে সাধনার সাহায্যে কামকে পরাজিত করতে হয়। ভগবত প্রাপ্তির  প্রবল ইচ্ছাই কামকে দূরে সরিয়ে রাখে। আসলে বস্তুর স্বরূপবোধ, ও বস্তুর পরিণতি জ্ঞান সাধককে কামসঙ্কল্প থেকে নিবৃত্ত করতে পারে। 

ইন্দ্রিয়াণি মনো বুদ্ধিঃ-অস্য-অধিষ্ঠানম উচ্চতে 
এতৈঃ-বিমোহয়তি-এষ জ্ঞানমাবৃত দেহিনম্। (৩/৪০)

ইন্দ্রিয়সকল মন-বুদ্ধি এই কামের আশ্রয় বলে কথিত হয়।  এই কামাদির দ্বারা বিবেকজ্ঞানকে আচ্ছাদিত করে দেহাভিমানী জীবকে বিমুগ্ধ করে। 

আত্মায় অবস্থিত মনে সঙ্কল্পের  উদয় হয় না। কিন্তু এই অবস্থায় পৌঁছানো কঠিন থেকে কঠিনতর, আবার এই অবস্থায় স্থিতিলাভ করা আরো বেশি কঠিন ।  এমনকি অনেক উচ্চতর সাধকের মনও ক্ষনিকের তরে আত্মা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে । তার কারন হচ্ছে, জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কার।  বাসনার বীজ প্রভাবে মন আবার আত্মা থেকে স্থানচ্যূত হয়ে বিষয়-বাসনার দিকে ধাবিত হয়। একে রোধ করা সহজে যায় না। কিন্তু মন-বুদ্ধি যখন এই পঞ্চতত্ত্বের শরীর-ক্ষেত্র ছেড়ে আজ্ঞাচক্রে বা সহস্রারে  স্থিতি লাভ করতে পারে, তখন  কাম আর তার ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না। 

মন যখন স্বক্ষেত্রে স্থিতি লাভ করে, তখন মনের শক্তি বিপুলভাবে  বৃদ্ধিপ্রাপ্ত   হয়। এই অবস্থায় মনকে আর টেনে আত্মা থেকে  কিছুতেই আলাদা করা  সম্ভব হয় না। আসলে এই অবস্থায় বিষয়-দর্শন-শ্রবণ ইত্যাদি বলে কিছু  থাকে না, তাই তখন আর মনের মধ্যে কোনো  সংকল্পের উদয়ও  হতে পারে না। বিষয় দর্শন-শ্রবনের  দ্বারা মন যখন আকৃষ্ট হয়, তখন মনের মধ্যে কামনারুপ সংকল্পের উদয় হয়। ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধি এগুলোই কামনার আধার। এর দ্বারাই অর্থাৎ ইন্দ্রিয়াদির দ্বারাই মানুষ বিষয়তৃষ্ণা  বিষয়ভোগ ইত্যাদি করে  থাকে। শব্দ-স্পর্শ-রুপ-রস-গন্ধ এর আশ্রয়স্থল হচ্ছে, বাক-পানি-পাদ-পায়ু-উপস্থ এই  পাঁচটি  কর্ম্মেন্দ্রিয়। মনে মধ্যে যত  কাম-সংকল্প জাগে তা মন বুদ্ধির সহযোগে উপভোগ করে  থাকে। আর নিরন্তর এই বিষয়ভোগের ফলে অন্তরের  জ্ঞানজ্যোতি আবৃত হয়ে পড়ে। তখন মোহরূপ অন্ধকার  জীবকে ঘিরে ফেলে। জীব তখন ভালো-মন্দ জ্ঞান রোহিত যায়। আসলে জ্ঞানজ্যোতিঃ তো থাকে, মেঘেঢাকা সূর্য্যের মতো। মেঘ কেটে গেলেই আবার  সূর্য্যের  প্রকাশ হয়। আবার  সূর্য্যের রশ্মি সমস্ত কিছুকে প্রকাশিত করে। তেমনি জ্ঞানজ্যোতি আমাদের বিবেকসুর্য্যকে বিষয়তৃষ্ণা দিয়ে, বা বিষয়ভোগ দিয়ে ঢেকে রাখে। তখন বিবেকজ্ঞান  আবৃত হয় ঠিকই, কিন্তু বিলুপ্ত হয় না। কামের প্রবলতাই বিবেকজ্ঞানকে ঢেকে রাখে। আর এই সময় তার স্বরূপের জ্ঞান থাকে না। সে যে আত্মা, সেকথা সে ভুলে যায়। 

এখন কথা হচ্ছে এর থেকে জীবকুলের নিস্তারের উপায়  কি ? দেখুন, আপনি আপনার মনকে যে দিকে ধাবিত করাবেন, বা আপনার মন যে দিকে ধাবিত হবে, সেখানে সে আনন্দের খোঁজ করবে। আসলে মন যে বিষয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে, সেটিও আসলে সেই আনন্দেরই  খোঁজে। কেননা আনন্দই আমাদের খাদ্য, আনন্দই আমাদের মূলসত্ত্বা।  এখন বিষয়-আনন্দরূপ খাদ্য খেয়ে আমরা আখেরে অসুস্থ হয়ে পড়ি। মদে আসক্ত ব্যক্তি মদ্য পান করে  বিভোর হয়ে থাকে। এতে যে আখেরে তার ক্ষতি হচ্ছে, সেটি সে তখন বোঝে না। কিন্তু যখন তার নেশা কেটে যায়, তখন সে কিছুক্ষনের জন্য হলেও বোঝে, যে মদের প্রতি আসক্তি তার ক্ষতি করছে। কিন্তু অন্য কোনো বিষয়ে সে এমন নিবিড় আনন্দ অনুভব করে না।  তাই সে আবার একসময় সেই একই মদের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে।  এখন কথা হচ্ছে, আপনি যদি মদাসক্ত ব্যক্তিকে অন্য কোনো আনন্দের উপাদান এনে দিতে পারেন, তবে সে মদ ছেড়ে দিয়ে  অন্য বস্তুর দিকে ধাবিত হতে পারে। অল্প বয়সী বেকার মেধাবী ছেলের মধ্যে একসময় আড্ডা মেরে বেড়ানোর একটি কু-প্রবৃত্তি জাগ্রত হয়।  কিন্তু সেই ছেলে যখন একটা চাকুরী পায়, মাস গেলে হাতে মাস-মাইনের টাকা  পায়,  তখন সে আড্ডায় সময় অতিবাহিত করে না।  এর পরে যখন সে বিয়ে-থা করে তখন তার সেই আড্ডার বন্ধুদের সঙ্গেও সম্পর্ক কমতে থাকে।  তো মূল ব্যাপারটা হচ্ছে আনন্দ। এই আনন্দের খোঁজ করছে সবাই। মন বিষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে শুধু মাত্র আনন্দের খোঁজেই। এখন কোনো আনন্দ নির্মল শুদ্ধ আর কোনো আনন্দ অশুদ্ধ।  অর্থাৎ কোনোটি আমাদের পক্ষে প্রেয় আর কোনোটি আমাদের পক্ষে শ্রেয় - এই দুইয়ের পার্থক্য বুঝতে গেলে, দুটোকেই আমাদের চেখে দেখতে হবে। বিষয়ের আনন্দ সম্পর্কে আমাদের সবার সম্যক ধারণা  আছে, বিষয় সংগ্রহের পরিণতি সম্পর্কেও জ্ঞান আছে।  কিন্তু এর বিপরীত অবস্থানেও যে আনন্দ আছে।  আত্মাতে স্থিত হলে একটা নির্ম্মল আনন্দের  অনুভব হতে পারে, যা বিষয় আনন্দ থেকে সহস্রগুণ বেশী সেই ধারণা  আমাদের নেই। এই বিদ্যাই হচ্ছে যোগবিদ্যা। যা যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ আর অন্তরঙ্গ সখাকে শেখাতে চাইছেন। 

দেখুন, আমরা সবাই, চারিদিক দেখে শুনে, একটা সিদ্ধান্তে এসেছি, যে লেখাপড়া করে একটা ভালো চাকরি জোগাড় করতে পারলে, আমরা বাকি জীবনটা সুখে স্বাচ্ছন্দে কাটাতে পারবো।  আর এই উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা সবাই আমাদের ছেলেমেয়েদের তার জীবনের অন্তত ১৫/২০ বছর এই তথাকথিত শিক্ষার জন্য ব্যয় করতে উৎসাহিত করে থাকি। কিন্তু এই বিষয়জ্ঞানের সঙ্গে যদি আমরা আমাদের সন্তানকে একটু আত্মমুখী হবার শিক্ষা দিতে পারতাম, তবে কিন্তু তারা বিষয় ছেড়ে দিয়েও একটা নির্ম্মল আনন্দের অধিকারী হতে পারতো। কিন্তু আমরা মাতা-পিতাগন যেহেতু সেই আনন্দের সন্ধান নিজেরাই পাই নি, সেই বিষয়-বহির্ভূত আনন্দের সন্ধান জানি না, তাই আমরা সেই পথের সন্ধান কাউকে দিতেও  পারি না। রস গ্রহণের ইচ্ছে মনের স্বভাব। ভগবৎ রসে যে বঞ্চিত সে সহজলভ্য বিষয় রসেই ডুবে থাকতে চাইবে। এটাই স্বাভাবিক। আত্মরস একমাত্র আত্মাতেই বর্তমান। আর এই রসের ভান্ডার  সে নিজেই। এর রসকে বের করে উপভোগ করাই যথার্থ সাধনক্রিয়া। আর প্রাথমিকভাবে এই রসের আস্বাদন করবার জন্য, জীবনের ১৫/২০ বছরও লাগে না। যদিও আধার অনুযায়ী এই সময়ের তারতম্য হতে পারে। কিন্তু উপযুক্ত গুরুর সান্নিধ্যে এসে, নিরন্তর মাত্র কয়েক-বছরের সাধনাতেই এই উপলব্ধি হতে পারে। আর এর জন্য দরকার  দৃঢ় সংকল্প। শাস্ত্রের নির্দেশ অনুযায়ী,  প্রাণায়াম ও মুদ্রাদির অভ্যাস। এই সাধনা ক্লেশসাধ্য সন্দেহ নেই, কিন্তু যার মধ্যে একটা দৃঢ়চেতা মন আছে, যার মন লক্ষে স্থির হয়েছে, তার কাছে এই সাধনা মোটেই দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়। 

নিরন্তর প্রাণায়ামে যখন শরীরের বায়ু স্থির হয়,  তখন বিষয়-সংকল্প থাকে না। প্রাণ-অপান-এর গতি সমভাবাপন্ন হলে, শরীরের মধ্যে বায়ুর সাম্যাবস্থা অবস্থান করে।  তখন সুস্থ শরীরে, ব্যাধিমুক্ত শরীরে  একটা অহেতুক আনন্দের হিল্লোল বইতে থাকে। বিষয় স্পৃহা বিলুপ্ত হয়ে যায়, আর ব্রহ্মানন্দ রসে মন বিগলিত হয়ে পরমান্দ ভোগ হয়ে থাকে। আসুন আমরাও যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশিত পথে আনন্দের সন্ধান করি।  
-----------------------------------                     
৩১.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - তৃতীয় অধ্যায়  - কর্ম্মযোগঃ      
শ্লোক নং ৩/৪১

তস্মাৎ ত্মম-ইন্দ্রিয়াণি-আদৌ নিয়ম্য ভরতর্ষভ
পাপ্নানং প্রজহি  হ্যেনং জ্ঞান-বিজ্ঞান-নাশনম্। (৩/৪১)

মানুষের মন-বুদ্ধি-ইন্দ্রিয়গণই কামের অধিষ্ঠান ক্ষেত্র। এদের আশ্রয় করেই কাম জ্ঞানকে আবৃত করে মানুষকে  মুগ্ধ করে। হে ভারতশ্রেষ্ঠ, এই কারনে তুমি ইন্দ্রিয়গণ বশীভূত করে জ্ঞান-বিজ্ঞান-নাশক পাপরূপ কামকে বিনষ্ট করো। 

এই শ্লোকেও যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেই ইন্দ্রিয়-দমনের কথা বলছেন। ইন্দ্রিসকল কামের আশ্রয়। আর কামবশিভূত ইন্দ্রিয় চিত্তের বিক্ষেপের কারন। ইন্দ্রিয়গুলো বিষয়ের দিকে যতক্ষন আকৃষ্ট না হচ্ছে, ততক্ষন কামের উদ্ভব হতে পারে না। কিন্তু দৃঢ়চেতা যোগীপুরুষ ব্রহ্মভাবাপন্ন হওয়ায়, তার মধ্যে বিষয়বোধ থাকে না। আর ইন্দ্রিয় যখন বিষয়ের সংস্পর্শে আসতে  অপারগ হয়, তখন ভোগের কথাও মনে আসে না। ইন্দ্রিয় সদা সক্রিয়।  ইন্দ্রিয়ের সামনে বিষয় এলেই, সে তাকে প্রাপ্তির কামনা করে থাকে। 
এখন কথা হচ্ছে, আমি এই স্থুল দেহ যা প্রকৃতির উপাদানে তৈরী, যা প্রকৃতির থেকে খাদ্য সংগ্রহ করছে, সেখানে বাস করবো, আর বাহ্যিক জগৎকেই উপেক্ষা করবো - তা কিভাবে সম্ভব ? তাহলে তো জীবনের সব আনন্দই নষ্ট হয়ে যাবে।  শরীর রক্ষার উপাদান সংগ্রহে যদি মনোযোগ নিবদ্ধ না হয়, তবে প্রকৃতির নিয়মেই শরীরের নাশ ঘটবে। আবার ইন্দ্রিয় বশীভূত মন আমাদের বুদ্ধিকে মলিন করে দেবে। আর বুদ্ধি মলিন হলে, আমাদের বিচারশক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। আর বুদ্ধিনাশ হলে, মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। একথা আমরা আগে ভগবানের মুখে আগেই শুনেছি। 
 
তো এই দ্বিবিধ ব্যবস্থার মধ্যে সামজ্ঞস্য কিভাবে রক্ষা করা যাবে। দুটো জিনিস, একটা হচ্ছে মনকে দৃঢ় রাখতে হবে, অপরটি হচ্ছে লক্ষে স্থির থাকতে হবে। লক্ষ হবে ব্রহ্মে স্থিতি। আর এই লক্ষে আমাদের মনকে দৃঢ় করতে হবে। ইন্দ্রিয়ের সামনে বিষয় এলে, ইন্দ্রিয়  বিষয়ে আসক্ত হবে, মনের মধ্যে কামনার উদয় হবে।  কিন্তু বিচারশক্তি দিয়ে মনকে ব্রহ্মভাবাপন্ন করতে হবে। আর তখন মন ব্রহ্মভাব অনুসরণ করায়, বিচারশক্তি বিষয়কে অবশ্য়ই হেয় প্রতিপন্ন করবে। 
প্রথমে দেখুন, বিষয়ের প্রয়োজন কতটুকু।  যেটুকু বিষয়ের প্রয়োজন সেটুকু অবশ্য়ই গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু মানুষ একমাত্র জীব, যে সংগ্রহ করতে ভালোবাসে, তার কারন হচ্ছে অনিশ্চয়তা।  তার জীবনে সে এতবেশি আশঙ্কায় ভোগে, যে কতটুকু তার প্রয়োজন তার বিচার করতে সে চায় না।  বরং উল্টোটা করে থাকে। অর্থাৎ প্রয়োজন অতিরিক্ত খাবার খেয়ে ফেলে, খেতে না পারলে ব্যাগের মধ্যে পুরে  রাখে। আবার অন্যের প্রাচুর্য্য দেখে, তার মনের মধ্যেও অনাবশ্যক অথচ মনোহর, বা বিলাসবহুল বস্তুর প্রতি ধাবিত হয়। অর্থাৎ কামকে আমরা প্রজ্বলিত করে ফেলি। এইভাবে কেউ কামকে জয় করতে পারে না। মন ভালো-মন্দ চিন্তা করবেই ।  আবার প্রয়োজনীয়-অপ্রোজনীয় উভয় চিন্তাই সে  করবে। এটি মনের স্বভাব। প্রথমে আমাদের আবশ্যক ও অনাবশ্যক বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে হবে। দ্বিতীয়তঃ, যাকে পরিবর্তন করবার ক্ষমতা আমাদের নেই, অর্থাৎ যে ঘটনা অনিবার্য, সেই বিষয়ে চিন্তা পরিহার করতে হবে। তৃতীয়তঃ, আমাদের প্রয়োজন কতটুকু অর্থাৎ সর্ব্বনিম্ন প্রয়োজনের জন্য সচেষ্ট হতে হবে। আসলে আমাদের বেঁচে থাকবার জন্য, শরীর  রক্ষার জন্য,  জীবনের মূল লক্ষকে পূরণ করবার জন্য, আমাদের উদ্যোগী হতে হবে। 
 সত্য হচ্ছে, আমাদে বেঁচে থাকবার জন্য, প্রয়োজন খুবই অল্প। এই অল্প-অল্প  বিষয়-চিন্তা আমাদের ক্ষতি করতে পারে না, আমাদের লক্ষ থেকেও বিচ্যুত  করতে পারে না। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে চিন্তা করতে গিয়ে আমরা দুঃখকে ডেকে আনি। আর আমাদের এই যে অমূল্য মনুষ্য জীবন  অকারনে ব্যয় করে ফেলি। এমনকি সারাজীবন এই অপ্রোজনীয় চিন্তাতেই কাটিয়ে দেই। 
এখন কথা হচ্ছে এই অপ্রয়োজনীয় চিন্তা কি ? যা আমাদের ইহলোকে বা পরলোকে কোনো কাজে লাগবে না - তার জন্য চিন্তা করাই হচ্ছে অপ্রোজনীয় চিন্তা।  দেখুন, আমরা যে অতিরিক্ত বিষয়-সম্পত্তির  জন্য চিন্তা করি, এমনকি হয়তো সেগুলো সংগ্রহও  করি, তা আসলে আখেরে  আমার কোনো কাজেই  লাগে না। আপনি হয়তো বলবেন, আমার কাজে না লাগুক, আমার ছেলে-মেয়েদের জন্য, এমনকি আমার দেশের-দশের কাজে লাগতে পারে। রবীন্দ্রনাথের একটা কথা আছে, অতি-প্রাচুর্য্য শিশুর খেলা মাটি করে দেয়।  যাদের জন্য এই বিষয়সম্পত্তি রেখে যাচ্ছেন, আপনি কি জানেন, তাতে তার অভাব পূরণ হবে ? এমনকি আপনি কি জানেন, এই অতিরিক্ত বিষয় সম্পত্তি আপনার সন্তানের বিড়ম্বনার কারন হবে কি না, বা আপনার সন্তানের কাছে, এগুলো বোঝা হয়ে যাবে কি না ? কেননা বিষয় রক্ষা করতে গেলেও রেকারিং ইনকাম দরকার। যা আপনার সন্তানকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে বাধ্য করবে। ফলে সে তার জীবনে শান্তিতে থাকতে পারবে না। জীবনের ভারসাম্য  নষ্ট হবে।  অর্থাৎ বিষয়কে রক্ষা করতে গেলে, আরো বিষয়ের প্রয়োজন, যা আরো বিড়ম্বনার কারন। যার  জন্য এগুলোকে বলা হয় অনর্থক চিন্তা। অর্থাৎ আমাদের শক্তির বাইরে প্রাপ্তির জন্য চিন্তা করা, এমনকি ত্যাগের জন্য চিন্তা করাও অনর্থক চিন্তা। কেননা কি আছে আপনার যে আপনি ত্যাগ করবেন ? আপনার যা কিছু আছে, তাতো আসলে ভগবানের সম্পত্তি। এইসব চিন্তা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখুন। মনে রাখবেন,  এই অনর্থ চিন্তার নাশ হতে পারে, একমাত্র ভগবৎ চিন্তায় নিজেকে নিয়োগ করতে পারলে। 

মনকে দৃঢ় করে প্রাণায়ামের মধ্যে প্রিতিষ্ঠিত করতে পারলে, কূটস্থের দিকে লক্ষ রেখে বসে থাকতে পারলে, এমনকি প্রাণের ক্রিয়াকে লক্ষ করে বসে থাকলেও, আমাদের কামের জয় হতে পারে। জপ-ধ্যান করাও উৎকৃষ্ট উপায়। আমরা যাকে  প্রয়োজনীয় ভাবছি, অথাৎ বিষয়কে যদি আমরা প্রয়োজনীয় ভাবি, তবে জানবেন, তা আপনি ভুল ভাবছেন। আসলে আমাদের প্রয়োজনীয় হচ্ছে ভগবানের সান্নিধ্য লাভ। আর সবই অপ্রয়োজনীয়। এই যে দেহ থেকে দেহান্তরে ঘুরে ঘুরে সুখ-দুঃখের মধ্যে নিজেকে নিয়ে চলেছি, এই যাত্রার কোনোদিন শেষ হবে না, যতদিন না আমরা সেই ভগবানকে লাভ করতে পারি। যে আনন্দের জন্য আমরা হন্যে  হয়ে ঘুরছি জন্ম-জন্মান্তরের ধরে, তার অবসান হবে না , যতক্ষন না আমরা তাঁর শরণ নিচ্ছি। যতক্ষন না তার কথা আমাদের স্মরণে আসছে, ততক্ষন আমরা চরকির মতো ঘুরপাক খাবো। চোখে ঠুসি পড়া কলুর বলদের মতো, একই জায়গায় ঘুরতে থাকবো। ফিরে ফিরে একই জায়গায় আসবো। 
একবার ভেবে দেখুন তো, কতো কতো জন্মে আপনি-আমি কতকিছু সংগ্রহ করেছি। কিন্তু যাবার বেলায়, একগাছি সুতোও নিয়ে যেতে পারিনি। ন্যাংটা হয়ে  অগ্নিতে পুড়ে মরেছি, আবার এসেছি ন্যাংটা হয়ে। আবার এসেছি - জামা-কাপড় দিয়ে শরীরকে ঢেকেছি, আবার ন্যাংটা হয়ে পৃথিবী ছেড়েছি। এতেও কি সাধ মেটে  নি ? এখনো  বাসনার শেষ হলো না ? এখনো আশা মিটলো না ? এখনো  সেই পতঙ্গের মতো অগ্নির দিকে ধাবিত হচ্ছি, নিজেকে আহুতি দেবার জন্য ? 
তাই মহাত্মা যোগীপুরুষগন বলছেন, ভগবান যোগেশ্বর বলছেন,  তুমি ইন্দ্রিয়গণ বশীভূত করে জ্ঞান-বিজ্ঞান-নাশক পাপরূপ কামকে বিনষ্ট করো। বিচারশক্তি প্রয়োগ করো। ভগবানের বাক্যে বিশ্বাসী হও। গুরুবাক্যে আস্থা রাখো। গুরুর উপদেশ অনুযায়ী সাধনক্রিয়া শুরু করো। বৃথা সময় নষ্ট করো না। ভগবানের শরণাগত হও।  আর মনকে দৃঢ় করে লক্ষে স্থির হয়ে, কোমরবেঁধে লেগে পড়। মানুষের অসাধ্য কিছু নেই।  মানুষই একমাত্র প্রাণী যে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করে ধন্য হতে পরে।  অন্য কোনো জীবদেহে এই সাধন ক্রিয়া করবার ক্ষমতা নেই।  তাই যদি ভাগ্যক্রমে, এই মনুষ্য  দেহ পেয়েছো, তার উপযুক্ত ব্যবহার করে জীবন ধন্য করো। হৃদয় গুহার অভ্যন্তরে সেই শ্যামসুন্দর অপূর্ব উজ্জ্বল সেই নক্ষত্রের দিকে একবার ফিরে তাকাও, তখন তোমার সব কাম অকাম হয়ে যাবে। সব ইন্দ্রিয় তখন বিষয় ছেড়ে আত্মস্থ হবে।  আর তুমি নীলকমলের মধু পান করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবে।  ওঁং শুভম। 
-----------        
০১.০২.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - তৃতীয় অধ্যায়  - কর্ম্মযোগঃ      
শ্লোক নং ৩/৪২-৪৩
ইন্দ্রিয়াণি পরাণি-আহু-ইন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ
মনসস্তু পরা বুদ্ধির্যো বুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ (৩/৪২)

ইন্দ্রিসকল দেহ থেকে শ্রেষ্ঠ বা ভিন্ন বলা হয়। ইন্দ্রিয়গণ থেকে মন শ্রেষ্ঠ।  মন হতে কিন্তু বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধি হতে শ্রেষ্ঠ আত্মা। 
দেহ থেকে ইন্দ্রিয় শ্রেষ্ঠ, কারন এই দেহের সমস্ত বিষয়বোধ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যই হয়ে থাকে, একথা আমরা বুঝি । কিন্তু দেহ থেকে ইন্দ্রিয় ভিন্ন একথা আমাদের বোধগম্য নয়। কেননা আমরা জানি দেহ ও ইন্দ্রিয় অভিন্ন। যার দেহ নেই, তার কি ইন্দ্রিয়শক্তি থাকে ?  
দেখুন আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি তখন আমাদের দেহ নিষ্ক্রিয় থাকে। এই অবস্থায়, আমরা স্বপ্ন দেখি।  স্বপ্নে আমরা সমস্ত রকম শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ ইত্যাদির উপলব্ধি করি। আবার আমরা যখন ধ্যানস্থ হই , তখন ধ্যানের  মধ্যে আমরা  অনেকে বিভিন্ন দৃশ্য দেখতে পাই।  বিভিন্ন ধ্বনির আওয়াজ শুনতে পাই। এইসময় দেহস্থিত ইন্দ্রিয় তখন নিষ্ক্রিয় থাকে।  অর্থাৎ আমাদের চোখ বন্ধ থাকলেও আমরা দেখতে পাই। আবার আমাদের যখন মৃত্যু হয়, তখন কোথায় কি অবস্থায় থাকি ? স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, এই অবস্থায় আমরা গভীর স্বপ্নের মধ্যে অবস্থান করি।  উপনিষদ বলছে, স্থূল দেহের মৃত্যুর পরে, আমরা আমাদের মন-বুদ্ধি-চিত্ত-অহংকার এমনকি ইন্দ্রিয়সকলকে সংস্কার আকারে সঙ্গে নিয়ে বাতাসের মধ্যে ঘুরতে থাকি। 

কঠোপনিষদ (২/১) বলছে, এই দেহ একাদশ দ্বার বিশিষ্ট একটা নগর। এই ১১টি দ্বার হচ্ছে, চোখ-২, কান-২, নাকের ছিদ্র-২, মুখ, নাভি, জননেন্দ্রিয়, গুহ্যদ্বার এবং মস্তকের ব্রহ্মদ্বার। আত্মা এখানে বাস করেন মাত্র। এখন কথা হচ্ছে, আত্মা আমাদের অন্তরেই বাস করছেন, কিন্তু আমরা তাদের দেখতে পাচ্ছি না কেন ? কঠোপনিষদ বলছে, (১/১) - যে  বাইরে, সে ভিতরে দেখবে কি করে, আমাদের সকল ইন্দ্রিয় বহির্মুখী, তাই মানুষ বহির্জগৎকে দেখতে পায়, অন্তর্জগতের সন্ধান সে পায়  না। তাই ইন্দ্রিয়গুলোকে গুটিয়ে আমাদের অন্তর্মুখী করতে হবে। আর এই ইন্দ্রিয়গুলোকে পরিচালনা করে থাকে মন। মন হচ্ছে ইন্দ্রিয়-সকলের রাজা।   তাই যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, ইন্দ্রিয় থেকে মন শ্রেষ্ঠ। 

আবার মন থেকে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ। অপরিণত বুদ্ধির মানুষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর দিকে ধাবিত হন। ফলে তারা মৃত্যুর জালে ধরা পড়েন। কিন্তু বুদ্ধিমান সাধক  নিত্যবস্তুর খোঁজ পেয়েছেন, তাই  তিনি অনিত্য পার্থিব বস্তুকে পরিত্যাগ করে থাকেন। তো মন বুদ্ধির সাহায্যে নিত্য বস্তুর সন্ধান পেতে পারেন। এই নিত্য বস্তু হচ্ছে আত্মা। আত্মাই একমাত্র সত্য। আত্মাই সমস্ত সাধকের সাধনার ধন। আত্মাকে জেনে, আত্মার সঙ্গে একাত্ম হয়ে, অভিন্ন বোধ করে জীবনে পরম  শান্তি লাভ করা যায়। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, বুদ্ধি থেকে আত্মা শ্রেষ্ট। 

আমরা জানি, মনের দ্বারাই ইন্দ্রিয়গণ পরিচালিত হয়ে থাকে।  কিন্তু সাধারণ  মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায় , ব্যাপারটা হচ্ছে উল্টো অর্থাৎ ইন্দ্রিয় দ্বারা মন পরিচালিত হচ্ছে। দেখুন ঘোড়ায় গাড়ি টানবে, একথা সত্য, কিন্তু ঘোড়া কোন্ দিকে যাবে তা ঠিক করে দেবে সারথি।  সারথির (মনের) হাতে থাকবে লাগাম অর্থাৎ বুদ্ধি। এই বুদ্ধির সাহায্যে মনরূপ সারথি তার তার রথকে আরোহীসহ নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যাবে। এখানে আরোহী হচ্ছে স্বয়ং আত্মা।  রথ  হচ্ছে দেহ, সারথি হচ্ছে মন, লাগাম হচ্ছে বুদ্ধি আর ঘোড়া হচ্ছে ইন্দ্রিয়সকল। 

এখন মন যদি ইন্দ্রিয়-সকলের বশে  থাকে, আর ইন্দ্রিয়েরা  যেসব বিষয়ের দিকে মনকে টেনে নিয়ে যায়, মন যদি নির্বিচারে তাই গ্রহণ করতে উদ্দত হয়, তবে মনকে ইন্দ্রিয়গুলো অবশ্য়ই  বিষয় ভোগ করাবে। এইজন্যই আমাদের সাধনক্রিয়া করবার দরকার। অর্থাৎ কর্ম্মের কৌশলকে আয়ত্ব করতে হবে। সাধন ক্রিয়া করতে করতে মন স্থির হয়ে আসবে। মনের স্থিরতার কালে, অর্থাৎ মনের একাগ্র অবস্থায় বুদ্ধি তার সঠিক ক্রিয়া শুরু করবে। এই বুদ্ধিকে সাধনার  দ্বারা বিচারশীল করে, বিষয়কে হেয় করে, আত্মার শ্রেষ্ঠত্ব নিরুপন করতে হবে। আর তখন শ্রেষ্ট বস্তু অর্থাৎ আত্মাতে নিরুদ্ধ হবে মন। এই সাধন আয়ত্ত্ব করবার জন্য দরকার শ্রদ্ধা-ভক্তি। মনের চঞ্চলতা দূর করবার জন্য, দরকার  বায়ুকে স্থির করা। এই বায়ুর ক্রিয়াকে স্থির করবার প্রক্রিয়া হচ্ছে, আসন-প্রাণায়াম-ধ্যান,ধারণা ইত্যাদি।            

এবং বুদ্ধেঃ পরং বুদ্ধা সংস্তভ্য-আত্মনাং-আত্মনা 
জহি শত্রুং মহাবাহো কামরূপং দুরাসদম্ (৩/৪৩)

হে মহাবাহো এইভাবে বুদ্ধি থেকে শ্রেষ্ঠ আত্মাকে  জেনে বুদ্ধির দ্বারা মনকে স্থির করে কামরূপ দুর্ধর্ষ শত্রুকে বিনাশ করো। 

কামরূপং দূরাসদম শত্রুং - কামরূপ দুর্ধর্ষ শত্রু। ভগবান এখানে কামকে দুর্ধর্ষ শত্রু, অর্থাৎ সাংঘাতিক বলবান শত্রু বলছেন । দেহ থেকে ইন্দ্রিয় শ্রেষ্ঠ, এটা  না হয় বোঝা গেলো। কিন্তু কাম যার সঙ্গে একমাত্র বিষয়ের সম্পর্ক সেই কামনার বিষয় কিভাবে আমাদের ক্ষতি করতে পারে ? আর বিষয় কিভাবেই অধিক বলবান হতে পারে ? 

আমরা জানি বিষয় মনকে আকৃষ্ট করে। বিষয় দুই প্রকার।  এক - বাহিরিন্দ্রিয় দ্বারা যাকে আমরা অনুভব করে থাকি। আরও  একটা বিষয় আছে, যা আমাদের অন্তর্মুখী ইন্দ্রিয় দ্বারা  অনুভূত হয়। এই যে অন্তরের  বিষয়, এঁকে বিষয় ছাড়া কি বলা যেতে পারে ? এই দুই বিষয়কে অনুভব করবার জন্য দরকার আমাদের মন। তাই মনকে শ্রেষ্ট বলা হচ্ছে।  অর্থাৎ মনের সাহায্যেই এই দুই বিষয়কেই আমরা অনুভব করতে পারি। যার মন দুর্বল সে এই অনুভবের অধিকারী নয়।  তা সে বাইরের বিষয় বলুন, আর অন্তরের বিষয় বলুন। ফুলের সৌন্দর্য্য অনুভব করতে গেলে একটা শুদ্ধ মনের দরকার। আবার অন্তরের  মানুষটিকে অনুভব করতে গেলে আরো অধিক শুদ্ধ মনের অধিকারী হতে হয়। তা না হলে সেই অন্তর্নিহিত অন্তর্যামিকে অনুভব করা যায় না। চঞ্চল মন বহিঃর্বিশ্বে ঘুরে বেড়ায়, আর স্থির মন, অর্থাৎ চাঞ্চল্যরহিত মন একাগ্র হয়ে নিরুদ্ধ হয়, অন্তরের গভীরে। আর মন যখন একাগ্র হয়ে অন্তর জগতে স্থিতবান  হয়, তখন মন থেকে  সেই বুদ্ধি সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হয়ে মনের সঙ্গে অবস্থান করে। আর এই বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন মন, তখন অন্তর ইন্দ্রিয়ের সাহায্যেই বিচিত্র বর্ণের জ্যোতির দর্শন করে থাকেন । এই জ্যোতির্মন্ডলের মধ্যভাগে দেখা দেয় একটি কৃষ্ণবর্ণের গুহা।  এই কৃষ্ণবর্ণের  গুহার মধ্যে দেখা দেয় অমাবস্যার চাঁদ। 

হিন্দুশাস্ত্রে চন্দ্রলোক  থেকে জীবের আগমন হয়েছে বলে বলা হয়ে থাকে।  এই  সেই মূলীভূত কারণস্বরূপা দেবী ভগবতী। যার থেকে জগৎ সৃষ্ট হয়েছে। যার জন্য জগৎ ক্রিয়াশীল হয়ে আছে। সগুন ব্রহ্মের প্রথম প্রকাশ। এই প্রকাশ সর্ব্বভূতের মধ্যেই গূঢ়ভাবে অবস্থিত। কিন্তু দুঃখের কথা, এই আত্মা সকলের নিকট প্রকাশিত নয়।  কেবলমাত্র সাধনার  দ্বারা যে ভাগ্যবান পুরুষ এই সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন হতে পেরেছেন, যাঁর মধ্যে ধ্যানাবস্থা নিশ্চল হয়েছে,  তাঁর কাছে এই আত্মস্বরূপ দৃষ্ট হন। অর্থাৎ আত্মা সর্বত্র প্রকাশিত হলেও নিগূঢ় আত্মাকে চঞ্চল মনের সাথী বাইরে বিচরণশীল ইন্দ্রিয় দ্বারা সাক্ষাৎ করা যাবে না।  সাধনক্রিয়ার দ্বারা মনের নিশ্চল অবস্থা লাভ করতে পারলে, এনার স্বরূপ উপলব্ধ হতে পারে। আর এই অবস্থা লাভ হলে তবেই কাম ইত্যাদি  রিপু গুলোকে  বশীভূত করা সম্ভব।

সুতরাং কামকে পরাভূত করতে হলে প্রাণকে মহাশূন্যে প্রবেশ করাতে হবে। প্রাণকে মহাশূন্যে প্রবেশ করতে গেলে ওঙ্কারের ধ্বনির সাহায্য নিতে হবে।  অথবা  বলা যেতে পারে, ওঙ্কারের ধ্বনি শুনতে শুনতে,  ওঙ্কারের লয়ের সাথে প্রান পরব্রহ্ম-এ লয় হবে।  নিখিল রসের কেন্দ্র হচ্ছে স্বয়ং ভগবান। নিরন্তর তাকে স্মরণ দ্বারাই তাকে স্পর্শ বা অনুভব করা সম্ভব। আর তাকে যিনি স্পর্শ করতে পেরেছেন, তিনিই কামকে জয় করতে পেরেছেন। মনের চঞ্চলতা হচ্ছে কামভাব, আর মনের স্থিরতা হচ্ছে কাম জয়। তাই মনের স্থিরতাই সাধকের সাধনা। মন স্থির হলে মনের সঙ্কল্পভাব চলে যায়। আর সংকল্প শূন্য মন অনাত্মভাবে থাকতেই পারে না, আত্মস্বরূপ হয়ে যায়। এই আত্মস্বরূপে স্থিতিই সাধকের কামরোহিত অবস্থা । যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাই বলছেন, বুদ্ধির (যোগ-কৌশল) দ্বারা মনকে স্থির করতে পারলে, কামের ধংশ হবে, আর কামের ধংশ হলেই সেই শ্রেষ্ট আত্মাতে স্থির হতে পারবে।         

শেষ হলো শ্রীগীতায় ভগবান শ্রীমুখনিঃসৃত কর্ম্মযোগ নামে তৃতীয় অধ্যায়।। 
        
 ------------------                        


   

  

 

                       
    

         

                      






















 









   

No comments:

Post a Comment