Sunday 20 February 2022

পশুর দেহে কি মনুষ থাকতে পারে ?


পশুর দেহে  কি মানুষ থাকতে পারে ?

মনুষ্য দেহ ধারন করবার পরেও, আমাদের অনেকের মধ্যে থেকে পশুবৃত্তি লোপ পায়নি। আর  এটা আমরা প্রতিদিন মানুষের আচরণ দেখলেই ধরতে পারি। কিন্তু পশুর মধ্যে কি কখনো মানুষের বৃত্তি দেখতে পাওয়া যায় ?  আমরা মহাভারতের গল্পে পড়েছি, মানুষ বা দেবতাগণ নাকি কখনো কখনো মানুষের দেহ প্রাপ্ত হন, আবার মানুষ কখনো কখনো  পশুর দেহ প্রাপ্ত হন । রাজা ভরত নাকি  হরিণ হয়ে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। ভাগবতে আছে, কুবের পুত্র নলকুবর ও মণিগ্রীব, নারদের সাথে অসম্মানজনক ব্যবহার  করবার ফলে, এই দুজন গাছ হয়ে জন্মেছিলেন। শেষে শিশু ভগবান  শ্রীকৃষ্ণের হাতে তাদের উদ্ধ্বার হয়েছিল। আবার  আমরা অনেক সময় দেখেছি, কোনো কোনো পশু বা বৃক্ষ মনুষ্যেতর ভিন্ন  দেহে অবস্থান করেও, তাদের মধ্যে উচ্চভাবের লক্ষণ প্রকাশ পায়। হরিনাম সংকীর্তনের  আসরে অনেক সময় কুকুর এসে, চুপচাপ বসে থাকে। এইযে পশু হয়েও, মানুষের বিভিন্ন ধর্ম্মকর্ম্মে নিজেকে নিযুক্ত করা, এর মধ্যে কি কোনো কারন আছে, নাকি এগুলো আমাদের নিতান্তই ভ্রম দর্শন ? 

আমাদের বাড়িতে দুটো বিড়াল আছে, একটা কুকুর আছে ।  যাদেরকে আমার স্ত্রী খুবই যত্ন আত্তি করে থাকে। ধনীর ঘরে কুকুরের যত্ন দেখলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন । কি না খেতে দিচ্ছে তাকে। প্রতিদিন তার জন্য সুস্বাদু পুষ্টিকর খাবার চাই। কতই না আদরে রাখা হয়েছে  এই কুকুরগুলোকে।    আবার কুকুরের জন্য, নিয়মিত ডাক্তার আসেন বাড়িতে। যা ভারতের বেশিরভাগ শিশুর কপালে জোটে না। আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, এরা মানুষের সন্তানের চেয়ে  অনেক বেশি পুণ্যবান, ভাগ্যবান। আমার ভাবতে অবাক লাগে, এরা  মানুষের ভাষা বোঝে। আমি অনেক সাধু সন্ন্যাসীদের দেখেছি, পশুদের সাথে মানুষের মতো আচরণ করতে।  তাদের সাথে কথা বলছেন, তাদের আদরযত্ন করছেন। এই পশুগুলোও সাধুর নির্দেশ উঠছে বসছে।  এমনকি এরা সাধারণ  মানুষের নির্দেশেও  কাজ করে থাকে ।  এমনকি মানুষের  বিপদে আপদে এরা রক্ষকের কাজ করে থাকে।  আমরা বরং এদেরকে মাঝে মধ্যে বুঝতে পারি না।

 আপনারা সেই সাপ ও বেজীর গল্পটা জানেন।  এক দম্পতি  একটা ছোট্ট  বেজী পুষেছিলো । বেজীটা খুবই উপকারী  ছিলো। ওই দম্পতির একটি শিশুপুত্র ছিল। তো একদিন ঘুমন্ত  শিশুপুত্রের ঘরে যখন একটা সাপ শিশুটিকে ঘিরে ধরে, তখন বেজীটি সাপটিকে মেরে শিশুটিকে রক্ষা করে। দম্পতি বেজিটিকে শিশুর ঘর থেকে হাত-মুখে  রক্তমাখা অবস্থায় বেরিয়ে আসতে  দেখে, রাগের চোটে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে, বেজিকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে।  আর ঘরের মধ্যে এসে যখন দেখে তার শিশু পুত্রের কাছে খন্ড-খন্ড সাপের দেহ, তখন তারা আপসোস করতে থাকে। তো আমরা সবসময় পশুদের বুঝতে পারি না। তাই আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, পশুর মধ্যেও  কি মানুষ  আছে ?   

মহাত্মাগণ বলছেন, এই প্রশ্নের উত্তর বুঝতে গেলে, আমাদের জীবের বা প্রকৃতির ক্রমবিকাশের ধারাকে বুঝতে হবে। আমাদের শাস্ত্রে আছে, চুরাশি লক্ষ যোনি ভ্রমনের পরে, জীবের মনুষ্য দেহ প্রাপ্তি হয়ে থাকে । এটি আসলে সৃষ্টির ক্রমবিকাশের ধারা। এর সঙ্গে আমাদের কর্ম্মের কোনো সম্পর্ক নেই। বস্তু থেকে ভাইরাস, ভাইরাস  থেকে এককোষী প্রাণী।  এককোষী থেকে বহুকোষী প্রাণী। ধীরে  ধীরে মনুষ্য দেহ ধারণ। এই যে প্রক্রিয়া, এটি প্রকৃতির স্বাভাবিক বিবর্তনের নিয়মেই ঘটে থাকে।  মনুষ্যদেহ যেমন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন, যৌবন থেকে প্রৌঢ়, প্রৌঢ় থেকে বার্ধক্য পৌঁছে যায়, এর সঙ্গে কর্ম্মের কোনো সম্পর্ক নেই। ঠিক  তেমনি এই প্রকৃতির ক্রমবিকাশের ধারা অনুযায়ী স্থাবর থেকে জঙ্গম, জঙ্গম থেকে অধিক বিকাশশীল জীবের উৎপত্তি, যার পরিণতি আজ মনুষ্য দেহ। এমনও হতে পারে, পৃথিবীর বাইরে যদি কোথাও জীবন প্রকাশের খেলা চলে, তবে  সেখানে মানুষের থেকেও আরো উন্নত ধরনের  জীব অন্যগ্রহে বিরাজ করতে পারে। কেননা প্রকৃতির বিকাশের কোনো সীমা থাকতে পারে না। আসলে কোটি কোটি বছর ধরে, প্রকৃতির মধ্যে এই  বিবর্তন ক্রিয়া চলছে।  আর প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রকৃতি বিকশিত হচ্ছে।

আমরা পঞ্চকোষের কথা শুনেছি।  অর্থাৎ অনন্ময়, প্রাণময়, মনোময় কোষ, বিজ্ঞানময় কোষ, ও আনন্দময় কোষ, এদের কথা আমরা শুনেছি । বলা হয়ে থাকে, পঞ্চকোষের সমষ্টি  এই মনুষ্যদেহ। এর মধ্যে অনন্ময়, প্রাণময়, ও মনোময় দেহ পার্থিব।  আর বিজ্ঞানময় ও  আনন্দময় দেহ অপার্থিব। আবার অন্য দিক থেকে দেখতে গেলে দেহ তিন প্রকার। স্থুল,  সূক্ষ্ম,  ও কারন। এই যে স্থুল  ও সূক্ষ্ম দেহ এরা পরিবর্তনশীল। কিন্তু কারনদেহ অপরিবর্তনীয়। এই যে দেহের পরিবর্তন এর কারন দ্বিবিধ।  এক প্রকৃতিজাত, আর একটি কর্ম্ম বা চিন্তাপ্রসূত কর্ম্মজাত। আমরা যে শিশু  থেকে বৃদ্ধ হচ্ছি, তা প্রকৃতি জাত।  আবার আমরা যে অজ্ঞানী থেকে জ্ঞানী হচ্ছি, আমরা যে নিরানন্দ থেকে আনন্দের মধ্যে প্রবেশ করছি, তা আমাদের চিন্তাজাত কর্ম্ম প্রসূত।    

প্রকৃতির রাজ্যে, অনন্ময় কোষের বিকাশের পরে, প্রাণময় কোষের বিকাশ হয়। অনন্ময় কোষ অর্থাৎ যে শরীর অন্নদ্বারা পুষ্টি লাভ করে। আবার প্রাণময় কোষ যা প্রাণবায়ুর দ্বারা পুষ্টি  লাভ করে থাকে। এইসময় পর্যন্ত, অর্থাৎ একটা সময় ছিল, যখন  মনোময় কোষের আবির্ভাব হয়নি। প্রাণময় কোষের পরে, মনোময় কোষের বিকাশ হতে শুরু করে। আর এই মনোময় কোষের  ক্রমবিকাশের ফলে, ধীরে ধীরে অনন্ত প্রকার বৈচিত্র সংগঠিত হতে থাকে, যাকে  আমরা মনের ক্রিয়া বলে থাকি ।  মনোময় কোষ হওয়ার পর, একদিকে যেমন মনের আবির্ভাব হয়, তেমনি কর্ম্মের অধিকার জন্মে। মনোময় কোষের নিচে যে স্তরগুলো আছে, তার  কোনো কর্ম্মসত্তা নেই। এইজন্য পশু দেহে কর্ম্মের প্রভাব নেই। কর্ম্মের জন্য এদের অধোগতি বা উর্দ্ধগতি লাভ হয় না। এইজন্য হরিণ, গরু, ছাগল ঘাসপাতা খায় বলে,  হিংসা করে না বলে তাদের পুন্য সঞ্চয় হচ্ছে এমনটা নয়।  আবার হিংস্র বাঘ-সিংহ, হিংসা করে বলে, তাদের পাপ হবে এমনটাও  নয়। যাদের মনোময় দেহ নেই, তাদের প্রকৃতির অভিব্যক্তি অনুসারে অগ্রগতি সম্পন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু মনোময় কোষে কর্ম্মের প্রভাব থাকার দরুন, প্রাকৃতিক স্বাভাবিক অভিব্যক্তিকে, কর্ম্ম এসে বাধা দেয়। এই মনোময় কোষ বৈচিত্রপূর্ণ হয়ে থাকে। মানুষের মধ্যে মনোময় কোষের প্রাধান্য হেতু, মানুষ নিজের কর্ম্ম প্রভাবে অধোগতি বা উর্দ্ধগতি লাভ করতে  পারে। এই অবস্থায় কর্তৃত্বাভিমান থাকে, এবং কর্ম্মফল ভোগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে থাকে। 

সুতরাং কর্ম্ম অনুসারে, এবং মৃত্যুকালীন চিন্তার প্রভাবে কেউ মনুষ্য দেহ থেকে পশুপাখির দেহ অর্থাৎ  আদি যোনিতে জন্ম গ্রহণ করতে পারে। অর্থাৎ  দেবতা বা পশু যোনিতে জন্ম গ্রহণ করতে পারে। একেই বলে কর্ম্মজাত দেহ লাভ। এইজন্য যে আত্মসত্তাকে   আমরা কুকুরের শরীরে দেখছি, বা পশুর শরীরে দেখছি, এমনকি যাকে  আমরা মানুষের শরীরে দেখছি, সে আসলে মানুষ না পশু তা নির্ণয় করা আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। এইজন্য শরীর দেখে, কে মহাপুরুষ, আর কে পশুসুলভ চরিত্র তা নির্ণয় করতে যাবেন না। এরা, যাদের আপনি আজ পশু দেখছেন, তাদের মধ্যে এমন কেউ থাকতে পারে যিনি কর্ম্মজাত, আবার কেউ থাকতে পারে যিনি প্রকৃতিজাত। মনুষ্য-জন্মের কর্ম্ম প্রভাবে বা অন্তিমকালের চিন্তা অনুসারে, সে এই  দেহ প্রাপ্ত হয়েছে। এই কর্ম্মজাত যে শরীর এরা মৃত্যুর পরে, আবার মনুষ্যদেহ ধারণ করবে, বা স্বমহিমায় ফিরে যাবে। এই দেহ আসলে প্রকৃতির ক্রমবিকাশের ধারা অনুযায়ী অনুসৃত নয়। এই অধোগতি বা উর্দ্ধগতি প্রকৃত অর্থে  প্রকৃতির নিয়মের বাইরে ঘটে  থাকে। অথবা বলা যেতে পরে, এটা  প্রকৃতির নিয়ম বহির্ভূত হলেও, প্রকৃতির মধ্যে ইটা ঘটে থাকে । 

প্রকৃতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে যে শুদ্ধতত্বের উদয় হয়, সেটাই আসল অভিব্যক্তি। এর থেকেই মনোময় কোষ ভেদ হয়ে যায়। আর যে নতুন কোষের জন্ম হয়, তাকে বলে বিজ্ঞানময়কোষ। বিজ্ঞানময় কোষে কর্ম্ম থাকে না। মহাত্মাগণ বলছেন, মানুষকে লক্ষ-লক্ষ বছর এই মনোময় কোষে অবস্থান করতে হয়। 

 তাই বলা হয়ে থাকে, এইযে বাহ্যজগতে যা কিছু আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, তাতে তার সঠিক স্বরূপ প্রকাশিত নয়। একটা কুকুর, বা একটা গাছ, বা একটা মানুষ - যে দেহ ধারণ করে আছে, সেই দেহ তার প্রকৃতি লব্ধ  হতেও পারে,আবার তার কর্ম্ম জনিত কারণেও হতে পারে। প্রকৃতির ক্রমবিকাশের নিয়মে যে দেহ প্রাপ্তি হয়, তা স্বাভাবিক। কিন্তু কর্ম্মজনিত যে দেহ তা তার উপার্জিত ধন। কর্ম্ম অনুযায়ী দেহত্যাগের পর পুনরায় মনুষ্যদেহে প্রত্যাগমন করে, ও  প্রকৃতির বিকাশ অনুসারে গতিলাভ করে,বলা যেতে পারে। 

এখন কথা হচ্ছে, এই দেহের স্বরূপকে কি চেনা যায় ? অর্থাৎ কে আসলে কি, সেটা কি বোঝা যায় ? যায়, তবে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে তা সম্ভব নয়।  কেননা আমরা জীবাত্মাকে দেহের অতিরিক্ত কিছু অনুমান করতে সক্ষম নোই।  কিন্তু যারা যোগী পুরুষ, জ্ঞানী পুরুষ তারা জীবসত্ত্বাকে চিহ্নিত করতে পারেন।  তাই দেখবেন, যোগীপুরুষ কাউকে কাছে টেনে নেন, হতে পারে সে পশুর দেহধারী, আবার কাউকে দূরে সরিয়ে  দেন, হতে পরে সে মনুষ্যদেহ ধারী। এমনকি আমাদের মতো সাধারণ  মানুষও অনেক সময় আমাদের থার্ড-সেন্স দিয়ে বুঝতে পারি, লোকটা ভালো কি মন্দ। আবার কোনো-কোনো পশুকে আমরা ঘরের মধ্যে আশ্রয় দিয়ে থাকি। এর কারন হচ্ছে, এদের সঙ্গে কোথাও যেন একটা সাদৃশ্য অনুভব হয় নিজের মধ্যে।  অথবা এদের প্রতি যেন একটা করুনার উদ্রেগ  হয়। এর কারণই হচ্ছে, আমাদের সূক্ষদৃষ্টি বলে দিচ্ছে, একে কাছে টান, বা একে দূর করে দাও। তবে একথা ঠিক, কর্ম্মফল ভোগান্তে এরা  আবার প্রকৃতির কোলে ফিরে যাবে, এবং প্রকৃতি প্রদত্ত শরীর ফিরে পাবে। জ্ঞানীর চোখে  এসব ধরা পড়ে ।

এইযে ভোগজনিত দেহ সেখানে যার যে স্বাভাবিক কোষ অর্থাৎ মনোময় কোষ এটি দেবদেহেও থাকে আবার মনুষ্য ও পশু-পাখির দেহেও থাকে কিন্তু থাকে একটু অন্তরালে। যে স্তরে এরা  বাস করে, সেই স্তরের অন্তরালে, পূর্বজন্মের স্বাভাবিক  সত্তাটা অভিব্যক্ত থাকে। কিন্তু প্রাকৃতিক কারনে যাদের মধ্যে মনোময় কোষের জন্ম হয়নি, তাদের সম্পর্কে এই কথা খাটে না। 

যাইহোক, মনুষ্য শরীর মাত্রেই বিজ্ঞানময় কোষের  বিকাশ  আছে, এমনটা নাও হতে পারে। তবে মনোময় কোষ অবশ্য়ই আছে। তবে সবার মনোময় কোষের বিকাশও সবার ক্ষেত্রে  সমান হয় না ।  আবার পশু মাত্রেই মনোময় কোষ নেই তা নয়। তবে তার বিকাশ নানান করনে সুপ্ত থাকতে পারে। 

সবশেষে বলি, ধর্ম্মরাজ একসময় কুকুরের বেশে যুধিষ্ঠিরকে স্বর্গের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কাউকেই অবহেলা করা একদম উচিত নয়। কার মধ্যে কে বাস করছে, কে বলতে পারে ?  

-ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি  ওম।             













      

No comments:

Post a Comment