Sunday 20 February 2022

সূর্য্যমন্ত্রের যথার্থ অর্থ


সূর্য্যপ্রণাম মন্ত্রের যথার্থ অর্থ :

ওঁং নমঃ জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং 
ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্ন প্ৰণতোঽস্মি দিবাকরং। ওঁং 

সূর্য শ্রীভগবানের শুদ্ধিকরণ সত্ত্বা। এই সূর্য্যের আরো একটা নাম হচ্ছে বিবস্বান। এই বিবস্বান থেকে উৎপন্ন হন বৈবস্বত।  বৈবস্বত হচ্ছেন, স্বয়ং কাল, যম, অগ্নি, রুদ্রদেব। এই কাল হচ্ছে সংহারক রুদ্রদেব। সমস্ত ভূতকে যথা স্থানে, অর্থাৎ উৎসে  নিয়ে যেতে পারে এই অগ্নিরূপ তেজঃশক্তি । আবার কাল সমস্ত ভূতকে পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। তো সেই দিক থেকে দেখতে গেলে, বৈবস্বত হচ্ছেন পরিনাম সাধক। অর্থাৎ সবকিছুকে পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে যায়।  আবার এই সূর্য থেকেই পৃথিবী সহ সমস্ত গ্রহ উৎপন্ন হয়েছে । এই সূর্য  থেকেই চন্দ্রের উৎপত্তি। চন্দ্র থেকে সমস্ত অন্নের  উৎপত্তি হয়েছে। অন্ন থেকে জীবজগতের উৎপত্তি হয়েছে।  তাই সূর্য্যকে বলা হয় সবিতা। এই তেজঃশক্তি  থেকেই জলের উৎপত্তি। এই জল হচ্ছে প্রাণের উৎপাদক। তাই  জল হচ্ছে সৃষ্টি সাধক। এই জলেই স্থিত স্বয়বিষ্ণু  বা নারায়ণ। 
সূর্যপ্রণাম মন্ত্রে  প্রভাতসূর্য্যকে নমস্কারের কথা বলা হচ্ছে।  দুপুরের  বা সন্ধ্যার অস্তগামী  সূর্য্যের উদ্দেশ্যে এই প্রণাম মন্ত্র নয়। তার কারন হচ্ছে,  প্রভাত সূর্যই  সমস্ত জীবজগৎকে জাগ্রত করে তোলে। এই প্রভাত সূর্য আমাদের জৈবিক কর্ম্মের উদ্দীপনা প্রদান করে থাকে। এমনকি এই প্রভাত সূর্য সমস্ত আধ্যাত্মিক জগতের বাসিন্দাদেরও জাগিয়ে অধ্যাত্ম কর্ম্মে নিযুক্ত করে থাকে।  দুপুরের সূর্য প্রখর, প্রভাতের সূর্য স্নিগ্ধ, কোমল। প্রভাতের সূর্য জাগরনের সময় নির্দিষ্ট করে, আর সন্ধ্যার সূর্য নিদ্রামুখী করে।  সন্ধ্যার সূর্য  জীবজগৎকে নিষ্ক্রিয় করে।  প্রভাতের সূর্য আলোকে বিচ্ছুরিত করে, সন্ধ্যার সূর্য আলোকে গুটিয়ে নেয়। তাই আমাদের জীবনকে বিকশিত করতে, প্রভাত সূর্য্যের আরাধনা করতে বলা হয়েছে।   
এবার আমার এই প্রণাম মন্ত্রের যথার্থ অর্থ বুঝবার চেষ্টা করবো। মন্ত্র কথাটা অর্থ আমরা জানি মনন করা।  বা মনকে যে ত্রাণ  করে, তাকে বলা হয় মন্ত্র। তো এখানে সর্য্যপ্রণাম মন্ত্রে বলা হচ্ছে ওঁং নমঃ অর্থাৎ সেই সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের যিনি কর্তা  তাকে নমস্কার  করি। ওঁং সমস্ত মন্ত্রের বাঁধন। সমস্ত মন্ত্রকেই  প্রণব পুটিত করেই উচ্চারণ করতে হয়। এখানেও তাই আমরা শুরুতে প্রণব উচ্চারণ করলাম। এর পরে বলা হচ্ছে, জবাকুসুম সঙ্কাশং। এই প্রভাত সূর্য জবাকুসুম অর্থাৎ জবাফুলের মতো লালবর্ণের, সঙ্কাশং মানে নব-উদিত সূর্য  দীপ্তিময়, কাশ্যপেয়ং অর্থাৎ কাশ্যপের ধারা থেকে উৎপন্ন এই সূর্য ।  কশ্যপ কথার অর্থ হচ্ছে আদিকালের  পশ্যক। পশ্যক মানে দ্রষ্টা। অর্থাৎ আদি দ্রষ্টা হচ্ছেন কশ্যপ । সমস্ত সৃষ্টির আদি দ্রষ্টা। এই পশ্যকের (দ্রষ্টা)  যে শক্তি তার নাম হচ্ছে অদিতি ও দিতি।  অদিতি মানে অখন্ড,  আর দিতি অর্থে খণ্ডিত। তো একটা হচ্ছে অখন্ড শক্তি আর একটা হচ্ছে খণ্ডিত শক্তি। তো এই দুই শক্তির যিনি দ্রষ্টা (পশ্যক) তিনি হচ্ছেন কাশ্যপ বা কশ্যপ । আবার এই সমগ্র বিশ্ব সৃষ্টির যিনি আদি দ্রষ্টা বা পশ্যক তিনি হচ্ছেন কাশ্যপ। অদিতি ও দিতি শক্তি অর্থাৎ অখন্ড ও খণ্ডিত শক্তি তার সঙ্গেই সংযুক্ত আছেন। কশ্যপ - অর্থাৎ দেখাও। যে শক্তির দ্বারা দৃকশক্তি তাকে বলা হয়,  অদিতি।  আর উল্টোটা হচ্ছে দিতি অর্থাৎ যে শক্তি দ্বারা সব অদৃশ্য হয়ে যায়।  একটা আলো আর  একটা অন্ধকার। এই দুই শক্তিরই ধারক হচ্ছেন কাশ্যপ। স্বয়ং প্রকাশ যিনি তিনি হচ্ছেন অদিতি শক্তি, আর তার আভা, অর্থাৎএই  শক্তির যিনি আশ্রয় যিনি তিনি হচ্ছেন কাশ্যপ। 
সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, সেই কাশ্যপ থেকে যিনি প্রকাশমান হয়েছেন, অর্থাৎ সেই আদি অনন্ত বিরাট জ্যোতি যার থেকে যে প্রথম জ্যোতি প্রকাশ হয়, তাকে আমরা সূর্য বলি। সৃষ্টি হচ্ছে তার পরে। তো আদি দ্রষ্টা পরম-পুরুষ হেকে আবির্ভূত। তিনি হচ্ছেন, সূর্য। এখন এই সূর্য কোথা থেকে এলো ? সূর্য পরা প্রকৃতি থেকে এসেছে । এরপরে  পরম প্রকৃতি তার সঙ্গে অভিন্ন হয়ে রয়েছেন। 
ধ্বান্তারিং - অর্থাৎ অন্ধকার। অন্ধকার অর্থে বাইরের অন্ধকার। সমস্ত অন্ধকারকে যিনি সরিয়ে দেন, যত  রকমের আবরণ আছে, তা সে মায়ার আবরণ হতে পারে, অবিদ্যার আবরণ হতে পারে, অজ্ঞানের আবরণ হতে পারে, মোহের আবরণ হতে পারে, যত  রকমের আবরণ আছে, সমস্ত আবরণকে তিনি সরান। অর্থাৎ সমস্ত রাত্রির বা অন্ধকারের অপসারণকরেন এই সূর্যদেব।  
সর্বপাপঘ্ন - যত  রকমের পাপ আছে, তা সে কৃত  হতে পারে, ক্রিয়মান হতে পারে, অতীতের হতে পারে, বর্তমানের হতে পারে, এমনকি ভবিষ্যতের হতে পারে, যাকিছু পাপ আছে, তাঁকে চিন্তা করলে আর কোনো পাপ থাকতে পারে না। এখন কথা হচ্ছে সূর্য যা দৃশ্যমান বস্তু তা আমাদের পাপকে কিভাবে নষ্ট করবে ? আমাদের এই দৃশ্যমান সূর্য্যের সেই শক্তি কোথায় ? আসলে এই দৃশ্যমান সূর্যের সঙ্গে পরম-সূর্য্যের কল্পনা করে, অন্তরের  সূর্য্যেকে   মনে মনে চিন্তা করতে হবে। 
প্ৰণতোঽস্মি দিবাকরম -  যিনি দিনের উদ্রেগ করেন, যিনি দিনের আগমন নিশ্চিত করান, তিনি দিবাকর। দিনের রচয়িতা তিনি দিবাকর। এই দিবাকরকে যদি চিন্তা করা জয়, তবে আমাদের মধ্যে সমস্ত কলুষতা, সমস্ত মালিন্য তার দূর হয়ে, আমাদের ভিতরটা শুদ্ধ রূপ ধারণ করে। এই শুদ্ধিকরণ শক্তিকে আমি নমস্কার করি।  

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।        


No comments:

Post a Comment