Thursday 24 February 2022

ব্রহ্মের খোঁজে।

 


ব্রহ্মের খোঁজে। (ছান্দোগ্য উপনিষদ - অষ্টম অধ্যায় ) ব্রহ্মজ্ঞান 

আবার সেই ব্রহ্মরূপ চরম সত্যের খোঁজে। আমরা যখন কারুর খোঁজ করতে চাই, তখন প্রথমে আমরা তার বাড়ির ঠিকানার জোগাড় করি। তো আমরা আজ ব্রহ্মের খোঁজ করবো। তো প্রথমে তার ঠিকানাটা বুঝে নেই। ছান্দোগ্য উপনিষদ বলছেন,  (শ্লোক :৮/১/১) এই দেহ হচ্ছে ব্রহ্মনগর। এর ভিতরে পদ্মের মতো একটা অনুপম গৃহ আছে, যার নাম হৃদয়।  এই হৃদয়ের ভিতরে একটা ক্ষুদ্র আকাশ আছে। এই আকাশের মধ্যে বিরাজ করছেন  সেই ব্রহ্ম বা পরম-আত্মা।

উপনিষদ বলছে, এই আকাশের মধ্যে আছে স্বর্গ-মর্ত। এই আকাশের মধ্যে আছে অগ্নি, বায়ু, চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র এমনকি আছে বিদ্যুৎ যা আমরা মাঝে মধ্যে বাইরের আকাশে দেখতে পাই। তো এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের এই শরীর তো নশ্বর, এই আছে এই নাই। তো ব্রহ্ম যদি  হৃদয় মধ্যে  বাস করেন, তবে আমাদের এই শরীরের মৃত্যুর পরে, তাঁর গতি কি হয় ? তখন তিনি কোথায় থাকেন ? আসলে এই দেহের নাশ হতে পারে, জরাগ্রস্থ হতে পরে, কিন্তু এর মধ্যে যে অন্তরাকাশ আছে সেই ব্রহ্মপুর না জরাগ্রস্থ হয়, না তার মৃত্যু হয়। তিনি তখনও সেই আকাশেই বিরাজ করেন।  কখনো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, কখনো বৃহৎ থেকে বৃহত্তর।

দেখো তুমি যখন ঘুমুচ্ছ, তখনও তুমি আছো, আবার তুমি যখন জেগে আছো, তখনও তুমিই আছো। আমরা যখন জেগে থাকি, তখন আমাদের দেহ-মন দুইই সক্রিয় থাকে। আর ঘুমুলে আমাদের কি হয় ? আমাদের দেহ কাজ করে না। ঘুম আবার আমাদের দুই প্রকার, একটা গভীর ঘুম, আর একটা হালকা ঘুম।  হালকা ঘুমে আমরা স্বপ দেখে থাকি।  অর্থাৎ হালকা ঘুমে আমাদের মন কাজ করে, কিন্তু দেহ নিষ্ক্রিয় থাকে। কিন্তু গভীর ঘুমে আমরা দেহ-মন কোনোটাই কাজ করে না। অর্থাৎ এই সময় আমাদের দেহ ও মন দুইই নিষ্ক্রিয় থাকে।  তাই গভীর ঘুমে  দেহ-মন দুইই সম্পূর্ণ রূপে বিশ্রামের অবস্থায় থাকে। তাই গভীর ঘুম থেকে আমরা যখন জেগে উঠি তখন সম্পূর্ণ সতেজ হয়ে উঠি। উপনিষদ বলছে, গভীর ঘুমের নাম সুষুপ্তি।  এই সুসুপ্তিতে আমরা নাকি আত্মার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাই। কথাটা ভালোকরে খেয়াল করুন, উপনিষদের দ্রোষ্টাপুরুষগন বলছেন, এই গভীর ঘুমে আমরা আত্মার সঙ্গে এক হয়ে যাই।  কিন্তু আবার যখন আমরা জেগে উঠি, তখন আমরা আবার যা ছিলাম, তাই হয়ে যাই। আমরা যদিও অজ্ঞান কিন্তু এই সুসুপ্তির সময় আমাদের অজ্ঞানতার আড়াল সাময়িকভাবে সরে যায়।  কিন্তু এই কথা আমারা জানি না। প্রতিদিন রাতে বা গভীর ঘুমে আমরা আত্মার সাথে মিলিত হই। কিন্তু আমরা তা মনে রাখতে পারি না। আর কজনই বা তা আমরা জানি ?  সেই সচেতনতা আমাদের কোথায় ? ঘুমিয়ে থাকলে, বাঘ আর হরিনের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না।  কিন্তু জেগে উঠলেই বাঘ হয় হিংস্র-শক্তিশালী  আর হরিণ হয় নিরীহ-দুর্বল। আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি, তখন আমাদের অজ্ঞানতাও  ঘুমিয়ে থাকে। আবার যখন জেগে উঠি তখন অজ্ঞানতা আমাদেরকে ঘিরে রাখে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলতেন, পাপী যখন  গঙ্গাস্নানে যায়, তখন পাপ গঙ্গার পাড়ে গাছে চড়ে  বসে। গঙ্গা থেকে উঠে এলেই পাপ আবার আমাদের ঘাড়ে  চেপে বসে।

সুষুপ্তি বা গভীর ঘুম আমাদের সাময়িকভাবে পূর্ন  বিশ্রামের মধ্যে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু আমাদের অজ্ঞানতা দূর করতে পারে না। তাহলে আমাদের এই অজ্ঞানতা যাবে কি করে ? মহাত্মাগণ বলছেন, জ্ঞান হচ্ছে তরবারি যা সাহায্যে অজ্ঞানকে দূর করা যায়। অন্ধকারকে দূর করবার জন্য যেমন আলো জ্বালাতে  হয়, তেমনি অজ্ঞান-অন্ধকারকে দূর করতে গেলে, জ্ঞান-আলো প্রজ্বলিত    করতে হয়। 

ঋষি উদ্দালক আরুণি পুত্র শ্বেতকেতুকে বলছেন, দড়িতে বাঁধা একটা পাখী এদিক ওদিক উড়ে মুক্ত হতে চায়,  শেষে অপারগ হয়ে  বন্দীদশাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়।  তেমনি সুসুপ্তিতে আমাদের মন ছোটাছুটি করে কোনো আশ্রয় না পেয়ে, নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে প্রানকেই অর্থাৎ আত্মাকেই আশ্রয় করে। মন তখন প্রাণে আশ্রয় নেয়। 

দেখো আমাদের শরীরের ক্ষুধা তৃষ্ণা আছে। আর এই ক্ষুধা-তৃষ্ণা পায়  তখনই  যখন খাদ্য বা পানীয়ের অর্থাৎ অন্ন বা জলের অভাব বোধ করে শরীর। তো এই শরীরের কারন হচ্ছে খাদ্য ও জল। অর্থাৎ শরীর খাদ্য ও পানীয় দ্বারা তৈরী। একটু আগে যে কলা আমার খাবার টেবিলে ছিলো, তা এখন খাবার পরে, আমার শরীরে ঢুকে আমার শরীর হয়ে গেছে। একটু আগে যে জল গেলাসের মধ্যে ছিল, তা পান করবার পরে,  এখন আমার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে আমার দেহ হয়ে গেছে। অদ্ভুত এই গতিক্রিয়া। অদ্ভুত এই গতিশীল জগৎ। যা ক্ষনে ক্ষনে পরিবর্তিত আকার নিচ্ছে।  

এই জগতে সব সময় আমরা দুটো জিনিস দেখতে পাই।  একটা হচ্ছে খাদ্য আর একটা হচ্ছে খাদক। একটা হচ্ছে কারন, আর একটা হচ্ছে কার্য্য। এই কার্য-কারন সবসময় চলছে, মুরগি  থেকে ডিম্ হচ্ছে, আবার ডিম্ থেকে মুরগি হচ্ছে। বীজ থেকে গাছ হচ্ছে, আবার গাছ থেকে বীজ হচ্ছে। আজ যে পুত্র, কাল সে পিতা, আজ যে কন্যা কাল সে মাতা। আজ যে ছাত্র কাল সে শিক্ষক। আজ যে শিষ্য কাল সে গুরু। আজ যে যুবক, কাল সে বৃদ্ধ।  আজ যে জীবিত, কাল সে মৃত।  আজ যে কার্য্য কাল সে অন্যকার্য্যের কারন হচ্ছে। তো দেহের একটা উৎস আছে, তেমনি এই জগতেরও একটা উৎস আছে। দেহের কার্য্য আছে , আবার সেই কার্য্যের  কারণও আছে।  দেহের উৎস  কখনো মাতা-পিতা আবার কখনো খাদ্য-পানীয়, ইত্যাদি । 

তো যা শুনছিলাম, ব্রহ্ম কোথায়, না ব্রহ্ম আমাদের হৃদয়ে। ব্রহ্মপুরে।  আমরা যখন সুসুপ্তিতে থাকি তখন আমরা সবাই এই ব্রহ্মপুরে ব্রহ্মের সঙ্গে এক হয়ে যাই । আবার যখন আমাদের গভীর ঘুম বা সুসুপ্তির নিদ্রা আসে, তখন আমাদের আর কিছুই মনে থাকে না। এই ব্রহ্ম বলতে আমাদের কাছে কোনো স্পষ্ট ছবি ভাসে না, বা ব্রহ্ম বলতে আমরা কিছুই বুঝতে পারি না। আসলে ব্রহ্ম আছেন প্রাণের সঙ্গে মিশে। হৃদয় আকাশে অবস্থান করছেন । তাই এই প্রানকেই বলা হয় আত্মা। প্রাণের গতাগতি সম্পর্কে আমাদের একটা উপলব্ধি আছে।  অর্থাৎ শ্বাসপ্রশ্বাস সম্পর্কে আমাদের একটা প্রতক্ষ্য অনুভূতি আছে। তাই প্রাণ বলতে  আমরা ব্রহ্মকেই বুঝবো।  আর সেই  ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার বা আত্মসাক্ষাৎকারের স্থান হচ্ছে এই ব্রহ্মপুর, অর্থাৎ হৃদয়স্থল, হৃদয়-আকাশ।  

ঋষি উদ্দালক আরুণি বলছেন, আমরা যখন সুসুপ্তিতে যাই, তখন একটা আনন্দঘন মূর্তি এই শরীর  থেকে উত্থিত হয়ে, পরম-জ্যোতি লাভ করে, স্ব-স্বরূপে বিরাজ করেন। ইনিই আত্মা, ইনিই ব্রহ্ম, ইনিই সত্য-স্বরূপ। 

সুষুপ্তি বলতে আমরা বুঝি গভীর ঘুম, যেখানে স্বপ্ন বলে কিছু থাকে না। এই সুষুপ্তি অবস্থায় জীবাত্মা স্থুল দেহ ছেড়ে নিজের প্রকৃত স্বরূপে অবস্থান করে থাকেন। এখন কথা হচ্ছে নিজের স্বরূপটা কি ? জীবাত্মার  কি কোনো রূপ আছে ? না এই জীবাত্মার কোনো রূপ নেই, আবার অন্য দিক থেকে বলতে গেলে রূপ আছে, কারন আলো বা জ্যোতিঃ অগ্নি থেকে উৎপন্ন।  আমরা জানি অগ্নির রূপ আছে। তাহলে জ্যোতিরও একটা রূপ আছে।  আর তা হচ্ছে এই স্থুল-মানব দেহ সদৃশ্য অবয়ব । 

আমাদের যতক্ষন দেহবোধ থাকে, ততক্ষন আমরা দেহের প্রতি আসক্ত হয়ে থাকে। আর এই দেহের সাহায্যেই আমরা ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করে থাকি। আর এই ইন্দ্রিয়সুখভোগের লিপ্সা থেকেই আমাদের যত  অশান্তি। কিন্তু মহাত্মাদের মূর্তির দিকে তাকিয়ে দেখবেন, একটা শান্ত-স্নিগ্ধ-উজ্বল মূর্তি। এই যে মহাত্মাদের স্থুল দেহের মধ্যে প্রশান্ত ভাব, তা আমাদের সবার স্ব-রূপেই আছে। তাই আমাদের ধর্ম্ম শাস্ত্রগুলো বারবার বলছে, দেখো সবকিছুই তোমার ভিতরে আছে। সমস্ত শক্তি, সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত আনন্দ আমাদের সবার মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় আছে। 

নিজের এই প্রকৃত স্বরূপটা যখন আমাদের উপল্বদ্ধিতে আসে, তখন এই স্থুলদেহের প্রতি আসক্তি থাকে না। এমনকি এই যে দেহের কষ্ট, এগুলোকেও আমল দিতে ইচ্ছে করে না। সমাধি  অবস্থায় মা সারদা, এই জ্যোতিঃ স্বরূপ-কে  উপলব্ধি করে বলেছিলেন, "কি করে আবার এই বিশ্রী শরীরটায় ঢুকবো? " 

আত্মার সঙ্গে মিলনে যে অপূর্ব আনন্দ, সুসুপ্তির অভিজ্ঞতা থেকে সে সম্পর্কে আমাদের সামান্য একটু ধারণা  হতে পারি । কিন্তু সুষুপ্তি আমাদের বেশিক্ষন স্থায়ী হয় না। তো  এই সুসুপ্তির অবস্থা আমরা কিভাবে চিরস্থায়ী করতে পারি  ? আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, ক্রমাগত ধ্যান করে যেতে হবে।  ক্রমাগত ভাবতে হবে, আমরা স্বরূপতঃ ব্রহ্মের সঙ্গে এক  ও অভিন্ন। এইভাবে ধ্যান করতে করতে একদিন আমাদের এই উপলব্ধি  হবে। অনুভূতি বা উপলব্ধি না হলে আমাদের স্বরূপের জ্ঞান হবে না। দিনের পর দিন যদি আমরা ব্রহ্ম-প্রসঙ্গ নিয়ে ধ্যানস্থ হতে পারি, তবে আমরা উপকৃত হবো। 

উপনিষদ বলছে, ব্রহ্মচর্য ও আত্মসংযমের দ্বারাই ব্রহ্মকে জানা যায়। 

তদ্য এবৈতং ব্রহ্মলোকং ব্রহ্মচর্য্যেণ-অনুবিন্দন্তি 
তেষাম-এব-এষ ব্রহ্মলোকঃ-তেষাম সর্বেষু লোকেষু কামচারঃ ভবতি। 

অর্থাৎ যারা ব্রহ্মচর্য্যের দ্বারা ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হন, সেই ব্রহ্মলোক তাঁদেরই হয় ।  তারা তখন ইচ্ছেমতো সবলোকেই যেতে পারেন। 

এখন কথা হচ্ছে, আমরা যখন শাস্ত্রে  এই  মিষ্টি মিষ্টি কথা পড়ি, যা আমাদের শুনতে বা পড়তেও   ভালো লাগে, কিন্তু, এই শুষ্ক   কথাতে কি আমাদের ব্রহ্ম সম্পর্কে কোনো জ্ঞান বা উপলব্ধি হতে পারে ? দেখুন "ব্রহ্মচর্য" শব্দটির অর্থ হচ্ছে "ব্রহ্ম চরতি" অর্থাৎ যিনি সর্বদা ব্রহ্মে বিচরণ করেন। কঠোপনিষদে দুটি পথের কথা বলা হয়েছে, একটা শ্রেয় আর একটা প্রেয়। যারা ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করতে চান, তাঁদের বিচারশক্তি কাজে লাগাতে হবে। মনে মনে ভাবতে হবে, যা কেবল আপাতমধুর, অথচ ভবিষতের পক্ষে ক্ষতিকর, তা আমরা গ্রহণ করবো না। আর যা শ্রেয়, হিতকর তাই আমি লাভ করতে চাই। 

দেখুন ধর্ম্ম কোনো জাদুকরের জাদুবিদ্যা নয়। ধর্ম্ম মানে সংযমী কঠোর জীবন। ধর্ম্ম মানে সত্যকে উপলব্ধি করবার জন্য হৃদয়ের ব্যাকুলতা। আমাকে  দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে।  সমস্ত কাজের মধ্যে, সমস্ত চিন্তার মধ্যে "আমি ব্রহ্মকে চাই" এই ভাব জাগিয়ে রাখতে হবে। ইন্দ্রিয় তার নিজস্ব কাজ করবেই ।  কিন্তু মনকে সারাক্ষন ব্রহ্মচিন্তায় মগ্ন করে রাখতে হবে। তখন দেখবেন, আপনার আর জগতের মধ্যে কোনো আড়াল নেই। আমি বাইরেও আছি, আবার ভিতরেও আছি। আমাদের মধ্যে থেকে তখন দ্বৈতবোধ চলে যাবে। বাহির-ভিতর এক হয়ে যাবে। তখন সবকিছুর মধ্যে সেই এক এবং অদ্বিতীয় ব্রহ্মকেই অনুভব করবো। এই ব্রহ্মচর্যকেই আবার বলা হয় যজ্ঞ। এই যজ্ঞ বা ব্রহ্মচর্য নিয়ে পরবর্তীতে আমরা আবার শুনবো।  আজ ব্রহ্মবাক্যের বিরাম দিলাম।

 ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।         

 

    

        






    

No comments:

Post a Comment