Thursday 13 December 2018

মানুষের আসা যাওয়া-জন্মান্তর (এক)

মানুষের আসা  যাওয়া (এক)



মানুষের আসা  যাওয়া, এ এক অদ্ভুত রহস্য। কে আসে ? কে যায় ?কোথা থেকে আসে আর কোথায়-ই বা যায় ? কেউ বলে মনুষ্য জন্ম বিরল। এর পরে আর কবে হবে, তার কথা কেউ বলতে পারে না। তাই ঈশ্বরকে পেতে হলে এই মনুষ্য জন্মেই সচেষ্ট হও।  
যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, অর্জুন তোমার আমার বহু জন্ম ব্যতীত হয়েছে। আমি জানি, কিন্তু তুমি  তা জান  না। এই জন্মে যারা তোমার মাতা পিতা কে বলতে পারে তাদের সঙ্গে আগের জীবনে কোনো সম্পর্ক ছিল কি না ? 
একদিন  সময় বুঝে এক জিজ্ঞাসু গুরুদেবকে  জিজ্ঞেস করে বসলো:
হে গুরুদেব জীবের আসা যাওয়া সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই। দয়া করে পুনর্জন্ম সম্পর্কে আপনি যদি কৃপা করে কিছু বলেন। 
গুরুদেব  : হে পুত্র  ! এই সৃষ্টির পেছনের কাহিনী অতি সরল আবার জটিল। সহজ করে যদি বলতে হয় তবে বলি প্রাণীদের নিজ নিজ কর্ম অনুসারে, প্রথমে পরলোকে গিয়ে, কিছু সময় কাটাতে হয়। সেখানে সে আগের জন্মের করা পাপকর্ম অথবা পুণ্যকর্মের ফল ভোগ করে। এর পরে যখন ওর পাপ পুণ্যের ফল ভোগ  সম্পূর্ণ হয়ে যায়, তখন আবার সে এই মৃত্যুলোকে জন্ম গ্রহণ করে, তার বাসনা পূরণের জন্য । এই মৃত্যুলোককে আবার কর্মলোকও বলে। কারন এই লোকে প্রাণীদের কর্ম করবার অধিকার প্রদান করা হয়। 
জিজ্ঞাসু : আমাদের পৃথিবীকে মৃত্যুলোক কেন বলা হয় ?
গুরুদেব : কারন এখানেই জীবের জন্ম মৃত্যু হয়।
জিজ্ঞাসু : তাহলে কি অন্যকোনো লোকে জন্ম বা মৃত্যু হয় না ?
গুরুদেব : না পুত্র, ওই সব লোকের বাসিন্দার না হয় জন্ম, না হয় মৃত্যু। তুমি তো জানো মৃত্যু কেবল এই শরীরের হয়। আত্মা কখনো জন্মায় না, মরেও না। আত্মা জন্ম মৃত্যু রোহিত।
জিজ্ঞাসু : আপনি তো আগে বলেছিলেন, যে আত্মার কোনো সুখ-দুঃখ হয় না। এখন বলছেন, পান-পুন্য ভোগ করার জন্য, অর্থাৎ শাস্তি - বা পুরস্কার ভোগের জন্য অন্য লোকে যেতে হয়। সেখানে তো শরীর  যায় না নিশ্চই । আত্মাই যায়। তবে সেখানে নিশ্চই আত্মাই সুখ দুঃখ ভোগ করে। তাহলে আপনি বলছেন, শরীর  শুধু  সুখ-দুঃখ ভোগ করে না।  আত্মাও সুখ দুঃখ ভোগ করে ?
গুরুদেব : না পুত্র। আত্মাকে কোথাও কোনো স্থানেই সুখ অথবা দুঃখ ভোগ করতে হয় না। সুখ দুঃখ আত্মাকে ছুঁতেও পারে না। আত্মাতো পরম-ঈশ্বরের রূপের প্রকাশ। পরম-ঈশ্বর কারুর অধীন নয়। সুখ দুঃখ তো মায়ার খেলা। আর মায়ায় আবদ্ধ হয়ে জীব সুখ দুঃখ ভোগ করে। সুখ দুঃখ কেবল শরীরের ভোগ। আত্মার নয়। 
জিজ্ঞাসু : হে গুরুদেব, আমাকে আপনি দ্বিধায় ফেলে দিলেন। একবার বলছেন,শরীর  ত্যাগের পর মানুষ অন্য লোকে গিয়ে সুখ-দুঃখ ভোগ করে। সেখানে তো শরীর থাকে না। থাকে আত্মা। আত্মার যদি সুখ-দুঃখ ভোগ না থাকে বা না হয়,তাহলে সেখানে  কে সুখ-দুঃখ ভোগ করে ? 
গুরুদেব : জীবাত্মা। বা সূক্ষ্ম শরীর।  
জিজ্ঞাসু : এই জীব-আত্মা বা সূক্ষ্ম শরীর আবার কি ?
গুরুদেব : দেখো, জীবের শরীর একটি নয়, তিনটি। তুমি যে শরীরটাকে দেখতে পারছো, সেটা হচ্ছে স্থুল শরীর, তোমার আরো দুটো শরীর আছে। অর্থাৎ শরীর তিনটি।  স্থুল, সূক্ষ্ম ও কারন  শরীর।
কারন শরীরে আত্মা অপ্রকাশিত, অর্থাৎ আছে কিন্তু বোঝা যায় না ।   যেমন দুধের মধ্যে মাখন। বিশেষ প্রক্রিয়ার সাহায্যেই পাওয়া যায় মাত্র।  নতুবা নেই বলে মনে হয়।  মুখে নিলেও বোঝা যায় না।
কিন্তু   সূক্ষ্ম শরীরে আত্মা সূক্ষ্মরূপে আছেন। যেমন লবনাক্ত জল।দেখা যায় না। মুখে দিলে বোঝা যায়। সূক্ষ্ম শরীর আর কিছু নয় আমাদের ভাবনার জগৎ। আমাদের চিন্তার জগৎ।
আর হচ্ছে স্থূল শরীর যা পঞ্চভূতের তৈরী।  অর্থাৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম এই পাঁচ ভূতের সংমিশ্রণ মাত্র। 
যখন কারুর মৃত্যু হয় তখন এই যে বাইরের স্থুল  শরীর, তারই মৃত্যু হয়। অর্থাৎ পঞ্চভূতে অর্থাৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম -এ  মিশে যায়।
স্থুল শরীর-এর ভিতরে যে সূক্ষ্ম শরীর আছে তার মৃত্যু হয় না। ওই সূক্ষ্ম শরীর আত্মার প্রকাশকে নিজের সাথে নিয়ে, মৃত্যু লোক থেকে বেরিয়ে অন্য লোকে চলে যায়। ওই সূক্ষ্ম শরীরকে জীবাত্মা বলে। আর এটি আমাদের চিন্তার জগৎ, ভাবনার জগৎ মাত্র। তাই সূক্ষ্ম শরীরেই আমাদের কর্মফল, বা সংস্কার সঞ্চিত থাকে।
স্থুল  শরীরে আমরা বাহ্যিক সুখ-দুঃখ ভোগ করি। আমাদের শরীর খারাপ এই স্থূল শরীরের হয়।  এটা বুঝতে নিশ্চয়ই অসুবিধা হয় না। জন্ম মৃত্যু বলতে আমরা যা বুঝি তা এই স্থুল শরীরের ক্রিয়া।
শরীর যেমন আমাদের তিন রকম, ভোগ আমাদের তিন রকম। একটা শারীরিক, যা এই স্থূল শরীরে ভোগ করতে হয়। একটা মানসিক - যা আমাদের সুক্ষ শরীরে ভোগ করতে হয়।  আর একটা হচ্ছে আধ্যাত্মিক যা আমাদের কারন শরীরে হয়।
এইবার আমরা  জন্ম-মৃত্যু, বা আসা যাওয়ার খেলাটা একটু দেখে নেই। আমাদের দেহ অর্থাৎ স্থুল দেহ  পঞ্চভূতের সংমিশ্রণ। পুরুষ-প্রকৃতির খেলাতেই এই সংমিশ্রণ ঘটে।  প্রথমে মাংসপিন্ড, পরে ধীরে ধীরে জন্মদাতার-জন্মদাত্রীর আকার গ্রহণ।  এটি তখন দেহ মাত্র। এই দেহে ৪৪ থেকে ৪৮ দিনের মধ্যেই প্রাণের গমন নির্গমন গুরু হয়। তবে সেটা মায়ের প্রাণের অংশ মাত্র। সব থেকে বেশি হলে ৮৪ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হওয়া চাই।  এই সময় থেকেই আমরা মায়ের দেহের মধ্যে সন্তানের নাড়াচাড়া টের পাই। যদি না হয় জানবে কিছু গোলমাল আছে।  অর্থাৎ যে দেহটি তৈরি হচ্ছে সে মায়ের প্রাণের গতি গ্রহণ করছে পারছে না। এমনটি হলে জানবেন কিছু গড়বার আছে।    যখন সে মায়ের দেহ থেকে আলাদা হয়ে যায় তখন মায়ের প্রাণের সঙ্গে তার বিচ্ছিন্নতা ঘটে।  । তখন তার নিজস্ব প্রাণক্রিয়া,  অর্থাৎ  প্রাণের গমন-নির্গমন শুরু হয়। এবং সেটা যদি তাৎক্ষণিক ভাবে শুরু না হয় তখন সন্তানকে এই প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে ধাঁই। সে তখন ফুসফুসকে উল্টে-পাল্টে ক্রিয়াশীল করে তোলে। বাচ্চা কেঁদে ওঠে। শুরু হলো জীবনের খেলা। 
এইবার চলে যাবো মৃত্যু প্রক্রিয়ায়। জীবন হচ্ছে শ্বাসের খেলা। এই শ্বাসের মাধ্যমেই আমাদের সমস্ত প্রক্রিয়া চলে। পঞ্চভূতের মধ্যে  মরুৎ অর্থাৎ বায়ু সবথেকে শক্তিশালী ও সংযোগকারী। উপনিষদে একে ব্রহ্ম বলে আখ্যা  দেওয়া হয়েছে। প্রাণ শরীরের কোনে কোনে পরিব্যাপ্ত হয়।
 শরীরের কৰ্মইন্দ্রিয় (বাক,পানি,পাদ, পায়ু,উপস্থ ) জ্ঞান ইন্দ্রিয় (কর্ন, চর্ম, চক্ষু, জিহবা, ও নাসিকা) অর্থাৎ কান, ত্বক, চোখ, জিভ, নাক, মুখ, হাত,পা, মলদ্বার, ও লিঙ্গ, তখন ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।   আমাদের  স্বাস প্রক্রিয়ার জন্য দুটো ইন্দ্রিয় কাজ করে, এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে নাক।  যদি কোনো কারণে নাক বন্ধ  হয়ে যায় মুখ দিয়ে আমরা এই স্বাস প্রক্রিয়া চালাই । একমাত্র স্বাস প্রক্রিয়ার জন্য দুটো অঙ্গ বা দুটো ইন্দ্রিয় ব্যবহার করতে পারি।  শরীরের অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলো বিশ্রাম নিলেও, নিদ্রা গেলেও এই প্রাণশক্তির ক্রিয়া চলতে থাকে।  কখনই বিশ্রাম নিতে পারে না। দিন-রাত অনবড়ত  কাজ করতে থাকে। যতক্ষন এই প্রাণশক্তি প্রবাহমান থাকে ততক্ষনই আমাদের আয়ু থাকে। প্রাণ যতক্ষন কর্মক্ষম থাকে ততক্ষনই আমাদের জীবিত বলা হয়।  এই প্রাণশক্তির কাজ শেষ হয়ে গেলে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। এই প্রাণের শক্তিতেই দৃষ্টি-শক্তি, এই প্রাণের শক্তিতেই শ্রবণ শক্তি, এই প্রাণের শক্তিতেই ঘ্রান শক্তি, বাক শক্তি, জ্ঞানশক্তি, পাচন  শক্তি। প্রাণের ক্রিয়া শুরুতে জীবন শুরু হয় - আবার প্রাণের ক্রিয়া শেষে জীবনের শেষ হয়। ত্রিলোকে যা কিছু বর্তমান সবই প্রাণের অন্তর্গত। 
এবার আমরা যাবো আর একটু গভীরে। প্রাণ তো দেহটা কে বাঁচিয়ে রাখে। সবার মধ্যেই প্রাণ।  তাহলে "অমি"  কে ? এই দেহ যখন অকেজো হয়ে যায়, তখন তাকে আমরা পুড়িয়ে ফেলি, কবর দেই।  এর সঙ্গেই "আমি"  শেষ হয়ে গেলাম ? "আমি" যদি শেষ হয়ে গেলাম, তবে আর পুনর্জন্ম বলে কিছু থাকে কি ? "আমি" বলে কিছু আছে কি ? তাহলে কি, জগৎ সত্য, আমি মিথ্যা। 
এখান থেকেই ধোঁয়াশার শুরু। এই জায়গাটা উপল্বদ্ধির জায়গা। এই জায়গাটা বুদ্ধি দিয়ে, জ্ঞান দিয়ে, বেশিদূর এগোনো যায় না।  মৃত্যুর পরে কেউ ফিরে আসেনা। এসে কেউ পরপারের কথা, পরপারের বর্ণনা দিতে পারে না।  এখানেই চতুর পন্ডিতরা গল্প ফাঁদে। স্বর্গ, নরকের গল্প ফাঁদে। যে যত রসালো গল্প বলতে পারে তাকে আমরা ততো বড় সাধক ভাবি। আসলে কল্পনা শক্তি, আমাদের ভাবের জগতে নিয়ে যায়। আমরাও আমাদের একটা কাল্পনিক ভাবের জগৎ তৈরি করি। কিন্তু বাস্তব  অন্য কথা বলে। সব ভাষায় বলা যায় না। কাউকে সেখানে নিয়ে যাওয়া যায় না।
এই খান থেকেই শুরু হয় আমাদের সূক্ষ্ম শরীরের খেলা। 
তাই বলছিলাম : 
আমাদের স্থুল শরীরের মতো  আর একটা শরীর  আছে, তাকে বলে সূক্ষ্ম শরীর।  এই শরীরেরও সুখ দুঃখ ভোগ আছে। খেয়াল করো - তুমি ঘুমিয়ে আছো।  স্বপ্ন দেখছো। তোমাকে স্বপ্নে ষাঁড়ে তারা করেছে, তুমি ভয় পাচ্ছো।  তুমি সমুদ্রে সাঁতার কাটছো।  বা পাখির মতো আকাশে উড়ছো। বা বহু সোনাদানা পাচ্ছো। এসবই কিন্তু ওই মুহূর্তের জন্য তোমার কাছে সত্যি। এবং এর জন্য তোমার স্থুল  শরীরেও ভয়, আনন্দ, উদ্বেগ অনুভূত হচ্ছে। অথচ তোমার স্থূল শরীর  কিন্তু বিছানায় পরে আছে। এই সূক্ষ্ম শরীরেই   আমাদের সংস্কার বাসা বাঁধে। স্থুল শরীরের মৃত্যুর পরে এই সূক্ষ্ম  শরীর তার স্থূল শরীরের কর্ম অনুসারে, ভাবনা অনুসারে, চিন্তা অনুসারে যে সংস্কার তৈরী সেই  সংস্কারকে নিয়ে ঘুরতে থাকে। একেই আমরা জীবাত্মা বলি।
এর পরে আছে কারন শরীর। এই শরীরেই ব্রহ্মানন্দ উপলব্ধি হয়। এই শরীর  আমাদের সুসুপ্তির সময় কাজ করে। সুসুপ্তিতে আমাদের সুখ দুঃখ উপলব্ধি থাকে না। শুধু সাম্যাবস্থা বজায় থাকে। গভীর ঘুমে আমরা বাহ্যিক সমস্ত কিছু ভুলে যাই।  কোথায় থাকি তা আমরা বুঝতে পারি না।  আমরা অজ্ঞান তাই এই অবস্থা সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারণা নেই । যারা জ্ঞানী তারা এই সুসুপ্তির অবস্থায় চেতন থাকতে পারেন। ধ্যানে এই সুষুপ্তি লাভ করা যায়।  আর সুসুপ্তির পরে আমাদের শরীর  মন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। প্রত্যেকটি মানুষেরই এই তিন অবস্থাই হয় বা আছে।
জিজ্ঞাসু : তার মানে, যখন আত্মা এক স্থুল শরীরকে ছেড়ে যায়, তখন সূক্ষ্ম শরীর জীবাত্মাকে বা সুক্ষ শরীরকে  সঙ্গে নিয়ে যায় ?
গুরুদেব : না পুত্র ! ব্যাপারটা এত সরল নয়। দেখো, সমুদ্রের মধ্যে জলের এক বুঁদ।  সমুদ্র থেকে ওই বুঁদ আলাদা নয়।  ওই মহাসাগরের এক অংশ মাত্র। ওই বিন্দু সাগরের বাইরে যায় না। হ্যাঁ কেউ যদি সমুদ্র থেকে একটা পাত্রে করে জল নিয়ে যায়, তবে ওই জল সমুদ্র থেকে আলাদা দেখা যায় মাত্র। ওই জল কিন্তু সমুদ্রের অংশ।  আবার এও ঠিক ওই জল এক দিন না একদিন সমুদ্রে মিশে যাবে , এটা নিশ্চিত। ওই রকম সূক্ষ্ম শরীর রুপী জীবাত্মা, ওই আত্মজ্যোতি-খন্ড নিজের মধ্যে রেখে, সঙ্গে করে নিয়ে যায়। এটাই জীব-আত্মার যাত্রা। যা এক শরীর  থেকে অন্য শরীরের মধ্যে, যা এক যোনি থেকে অন্য যোনিতে বিচরণ করে বেড়ায়। 
হে পুত্র ! জীবাত্মা যখন এক শরীর ত্যাগ করে অন্য শরীরে প্রবেশ যাত্রায় বেরিয়ে পরে, তখন ওর সাথে ও ওর পুরোনো শরীরের বৃত্তি, ওর সংস্কার, অর্থাৎ প্রারব্ধ সূক্ষ্ম রূপে সাথে করে  নিয়ে যায়। 
জিজ্ঞাসু : হে পিতা : মানুষ শরীর ত্যাগ করার পরে, জীবআত্মা কোথায় যায় ?  
গুরুদেব : মানুষ স্থুল  শরীর ত্যাগের পরে, মানুষ তার প্রারব্ধ অনুসারে, নিজের পাপ ও পুন্য ভোগ করতে হয়। এর জন্য ভোগযোনি  তৈরী হয়েছে।  যা দুই প্রকার। উচ্চযোনি ও নীচযোনি।  মানুষ অর্থাৎ জীবাত্মা  তার পাপ পুন্য অনুসারে উচ্চযোনিতে  অর্থাৎ স্বর্গে থেকে নিজের পুন্য ভোগ করে। বা নীচযোনিতে অর্থাৎ নরকে থেকে নিজের পাপ ভোগ করে। এই স্বর্গ নরক আর কিছুই নয় আমাদের সংস্কার। আমাদের ভাবনা। সুক্ষ শরীর তার পূর্বকর্মের পাপপুণ্য উপলব্ধি করে।  এবং পাপের জন্য নিজেকে দগ্ধ করে।  এটাই নরক যন্ত্রনা। আর  ভালো কর্মের স্মৃতি তাকে উৎফুল্ল করে।  এটাই স্বর্গভোগ।  
তাহলে বুঝতে পারছো - স্থুল শরীর পঞ্চভূতের তৈরী। সূক্ষ্ম শরীর আমাদের ভাবনা বা সংস্কার দ্বারা তৈরী। আর কারন শরীর হচ্ছে শরীর তৈরির অব্যক্ত উৎস। 
জিজ্ঞাসু : এই স্বর্গ নরক কোথায় ? উচ্চযোনি বা নীচযোনিই বা কি ?
গুরুদেব :এই স্বর্গ নরক আর কোথায়ও নয়। এই পৃথিবী। এখানেই আমাদের শারীরিক, মানসিক, ও আধ্যাত্মিক ভোগ করতে পারি। যদি আমরা স্থূল দেহ থাকা কালীন ভোগ সম্পূর্ণ না করতে পারি, তখন আমাদের সুক্ষ দেহে এই ভোগ করতে হয়। এই সূক্ষ্ম দেহের ভোগকেই আমরা স্বর্গ সুখ, বা নরক যন্ত্রনা বলে  থাকি।  
জিজ্ঞাসু : এখানেই স্বর্গ নরক  ? এটা কেমন ? 
গুরুদেব : একটা উদাহরণ দিয়ে বলি তোমায়। আসলে পাপ-পুণ্যময় এই জীবন। অর্থাৎ সুকর্ম, দুস্কর্ম, আর নিস্কর্ম নিয়েই আমাদের জীবন। সুকর্মের জন্য সুখ, দুস্কর্মের জন্য দুঃখ, আর নিস্কর্মের জন্যও একটা ফল আছে সেটা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই দুঃখ, আবার সুখও আছে। 
ধরো এক সম্পন্ন গৃহস্থ। বিশাল বাড়ী, গাড়ী, দাস দাসী।  কোনো কিছুর অভাব নেই। তার একটি সুসন্তান। পিতা মাতার বাধ্য সন্তান। জোয়ান ছেলে। যাকে ঘিরে, গৃহস্থ ভবিষ্যতের সুখের কল্পনায় হাবুডুবু খাচ্ছে। নিজেকে সবচেয়ে ভাগ্যশালী মানুষ মনে করে। কিন্তু একদিন  ওঁর ওই জোয়ান ছেলে আকস্মিক দুর্ঘটনায় মারা গেলো। দুঃখের পাহাড় ওর উপরে ভেঙে পরে। সংসারের সমস্ত বস্তু ওর কাছে থাকা সত্ত্বেও ও দুঃখীই থাকে। এবং যতদিন বেঁচে থাকে নিজের পুত্রের মৃত্যুশোক, তাকে ঘিরে থাকে। ওই গৃহস্থ পুত্রের জোয়ান হাওয়া পর্যন্ত যে সুখ ভোগ করেছিল সেটা ওর স্বর্গ সুখ।  আর পুত্রের মৃত্যুর পরে যে দুঃখ ভোগ করেছিল সেটা ওর নরক যন্ত্রনা। এই ভাবে মানুষকে এই জীবনেই তার প্রারব্ধ অনুসারে সুখ দুঃখ ভোগ করতে হয়। 
এবার তোমাকে বলি উচ্চ যোনি ও নিচ যোনির কথা। উচ্চযোনি আর কিছুই নয় শ্রেষ্ট মনুষ্য ঘরে জন্ম গ্রহণই উচ্চ যোনি জাত।  অর্থাৎ সেখানে সে  সর্ব সুবিধা পাবে। এবং মোক্ষের পথে এগিয়ে যাবে। আর নিচ যোনী মানে হিনতর প্রাণিকূলে জন্ম গ্রহণ।  যেখানে সে সাধনমার্গে যাবার চিন্তা রোহিত হবে। 
আবার কেউ কেউ বলেন, পুণ্যবান মনুষ্য নিজের পুণ্যে কিন্নর, গান্ধর্ব, অথবা দেবতাদের যোনি ধারণ করে স্বর্গলোকে অবস্থান করবে, যতক্ষন না তার অর্জিত পুন্য ক্ষয় হচ্ছে। পুন্য ক্ষয় হয়ে গেলে আবার তাকে পৃথিবী লোকে তাকে  জন্ম গ্রহণ করতে হবে ।
জিজ্ঞাসু : স্বর্গলোকে মানুষের পুন্য কেন শেষ হয়ে যায় ? স্বর্গ থেকে যদি ফিরেই আসতে  হবে, তবে স্বর্গে গিয়ে কি লাভ ? শুনেছি স্বর্গে তারাই যায়. যারা ভালো কাজ করেছিল।  আর স্বর্গে গিয়েও তো তার পুন্য অর্জন হবে। তবে সে আবার পৃথিবীলোকে ফিরে আসবে কেন ?
গুরুদেব : উচ্চ যোনিতে বা দেবতা হয়ে অর্থাৎ অশরীরী হয়ে  কেউ  কোনো কাজ করতে পারে না। তাই তার কোনো ফলও  হয় না।  তেমনি নিচ যোনিতে জন্ম গ্রহণ করে সে যে কাজ করে তার কোনো ফল হয় না।  এই জন্য এগুলোকে ভোগ-যোনি  বলা হয়। এই ভোগযোনিতে কেবল ভালো কর্ম বা খারাপ কর্মের জন্য সুখ বা দুঃখ ভোগ করতে পারে।  এই সময় তার কোনো কর্মফল সঞ্চয় হয় না।
অর্থাৎ কোনো পশু যদি কাউকে হত্যা করে, তবে তার পাপ হবে না।  আবার নিরীহ প্রাণী, যারা ঘাসপাতা খায় কাউকে  হিংসা করে না তাদেরও কোনো পুন্য হবে না। তাই বাঘ কাউকে মারলে যেমন কোনো পাপ হবে না, তেমনি ছাগল বা হরিণ ঘাসপাতা খায়, হিংসা করে না বলে তাদের কোনো পুন্য হবে না।  
হে পুত্র।  কেবল মনুষ্য জন্মেই  কর্মফল সঞ্চয় হয়। নিকৃষ্ট বা উৎকৃষ্ট যোনিতে কর্মফল  সঞ্চয় হয় না। অর্থাৎ দেবতা বা পশু, কোনো জন্মেই কর্মফল সঞ্চয় করা যায় না। আর এই কর্মই মানুষকে মোক্ষ বা জন্ম-মৃত্যু চক্র থেকে বের করে আন্তে পারে।  পরম-পিতার ধামে পৌঁছে দিতে পারে। তাই দেবতা বলো, আর গান্ধর্ব, কিন্নর বলো সবাই মানুষ হয়ে জন্মাতে চায়।  তাইতো বলা হয় দুর্লভ এই মানুষ্য জীবন।
হে পুত্র ! সমস্ত লোকের মধ্যে এই পৃথিবী লোকে, আর সমস্ত জীবের মধ্যে কেবলমাত্র মানুষেরই বিবেক আছে। যে খারাপ ভালো বোঝে।  অন্য কোনো প্রাণী ভালো মন্দ বিচার করতে পারে না। সে কেবল নিজের রক্ষা করতে ব্যস্ত। তা সে দেবতা বলো আর পশু  বলো, সবাই খালি নিজেরটা বোঝে। ভালো মন্দো বোঝে না। তাই জানোয়ার যখন জানোয়ারকে মারে, বা অদিতির পুত্র যখন দিতির পুত্রদের মারে, বা উল্টোটা যখন হয় তখন তাদের কোনো পাপ লাগে না। পাপ-পুণ্যের লেখাজোকা কেবল মানুষের জন্য। তাই মানুষই পশু হয়ে জন্মায় দুর্ভোগ পোহাবার জন্য, আবার মানুষই দেবতা হয়ে জন্মায় পুন্য ভোগ করার জন্য। ভোগ শেষে  আবার মনুষ্য।  এই চক্রে আবর্তিত হচ্ছে  জীব জগৎ। 
জিজ্ঞাসু : এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে গেলে আর মৃত্যু পুরীতে ফিরে আসতে  হয় না ? আর জন্ম-মরন চক্র শেষ হয়ে যায় ? 
গুরুদেব : হ্যাঁ সেই স্থানই  পরমধাম। পরমাত্মার ধাম। যেখানে গেলে কাউকে ফিরে আসতে   হয় না। একেই বলে মোক্ষ। 
হে পুত্র ! মনুষ্য জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য মোক্ষপ্রাপ্তি করা। আর এই মোক্ষ কেবল মনুষ্যযোনি দ্বারাই প্রাপ্ত হতে পারে। এই জন্য মানুষের শরীরকে মোক্ষপ্রাপ্তির দ্বার বলা হয়ে থাকে। হে পুত্র মানবশরীর বড়ো  দুর্লভ। কত জন্মের সাধনার ফলে, কত কঠিন সাধনার ফলে এই মানব শরীর প্রাপ্ত হয়েছো।  এঁকে অবহেলায় কাটানো উচিত নয়। দেবতারাও মানব শরীরের আকাঙ্ক্ষা করে। কিন্তু মানুষের বিড়ম্বনা এই যে মানুষ তার মূল্যবান শরীরকে অর্থাৎ মোক্ষপ্রাপ্তির সুযোগকে অবহেলা করে।জাগতিক ভোগ বিলাসে, অনিত্য বস্তুতে মগ্ন থাকে।   এমনকি শরীর  ছাড়ার যখন সময় আসে, তখনও বাসনা তার পিছন ছাড়ে  না। হে পুত্র মৃত্যুর সময় যে বাসনা মানুষের মনে দৃঢ় থাকে, মানুষ সেইমত পরবর্তী জীবন প্রাপ্ত হয়। 
হে পুত্র ! প্রাণী সারা জীবন যেমন-ই  কাটাক, অন্তত অন্তঃকালে যদি একাগ্র মনে কেবল পরম-পিতার  ধ্যান করে, এবং তৎক্ষণাৎ শরীর  ত্যাগ করে তবে সে সোজা পরমধামে পৌঁছে যায়।  সেখান থেকে ওর আর ফিরে আসতে  হয় না। আর এই অন্তঃকালে পরম-পিতার ধ্যান তখনই সম্ভব, তাদের পক্ষেই সম্ভব, যারা সারা জীবন তাঁরই ধ্যানের অভ্যাস করে। তাই তোমাকে বলি, সব ছেড়ে, তার ধ্যান করো, আর মোক্ষলাভ করো।
আজ বাক্যকে বিরাম  দিলাম।  
ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ    
         


      

              
      

















No comments:

Post a Comment