Thursday 4 June 2020

অনুগীতা


অনুগীতা
করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক আমাদের কাটেনি। কিন্তু কেউ কেউ এর মধ্যে বলা শুরু করেছেন, হয়তো  করোনা ভাইরাস-কে সঙ্গে নিয়েই আমাদের ভবিষ্যতে চলতে হবে। তো যাকে নিয়ে আমাদের চলতে হবে, তার ভালো-মন্দ  দিকগুলো একবার আমরা দেখে নেই। 

দেখুন প্রথমেই বলি, পৃথিবীতে আমাদের ইচ্ছেতে কেউ আসেনি, আবার আমাদের ইচ্ছেতেই কেউ চলেও যাবে না। আমরা চেয়েছিলাম, পৃথিবীর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে, কিন্তু পৃথিবীর জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। আমরা চেয়েছিলাম, নারীসন্তানদের ভ্রূনেই ক্ষতম করে দিতে। তা আমরা পারিনি। এখনো পৃথিবীতে নর-নারীর জনসংখ্যার অনুপাত ১০০০:৯৩৫ বা তার কাছাকাছি। আমরা তো প্রকৃতিকে প্রতিনিয়ত নিয়ন্ত্রণে আনতে  চাইছি, তার স্বাভাবিক শুদ্ধতাকে নষ্ট করতে চাইছি ।  তো আমরা চাইলেই সবাই  চলে যাবে, বা আমরা চাইলেই সবাই থাকবে এমন শক্তিধর আমরা কেউ নোই। আবার পৃথিবীতে একমাত্র মানুষই শক্তিশালী, আবার মানুষই সবথেকে ভীতু। পৃথিবীর আর কোনো জীব অস্ত্র হাতে ঘোরে  না। মানুষই একমাত্র অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়ায়। তা সে অন্যকে মারবার জন্য হোক, বা নিজেকে বাঁচাবার ব্যর্থ চেষ্টার কারণে হোক। তাই সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে যদি হয়, তবে ভাইরাস পৃথিবীতে থাকবে।  তা রোখে  কার সাধ্য। কর্ম্মে আমাদের অধিকার, ফলের উপরে আমাদের কোনো কর্তৃত্ত্ব নেই। 

আমি আগেই বলেছি, ভাইরাস কোনো জীবানু  বা অণুজীব নয়।  এটি  জড় ও জীবের মধ্যবর্তী অবস্থা। এদের দেহ প্রোটিন দ্বারা  গঠিত আর নিউক্লিক এসিড দ্বারা কেন্দ্রীয় বস্তু। ভাইরাসের দেহে DNA  বা RNA যেকোনো একরকমের নিউক্লিক এসিড থাকে। ভাইরাস পরজীবী, কেবলমাত্র পোষক কোষের সংস্পর্শে এলে, এরা প্রজনন করতে পারে, বাইরে এরা  জড়ের মতোই আচরণ করে থাকে। এদের না আছে কোনো শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া, না আছে হজম শক্তি। ভাইরাসের   কোনো বৃদ্ধি নেই, এমনকি বিভাজিত হতেও পারে না। 

এখন কথা হচ্ছে, ভাইরাস  যেহেতু পরজীবী, তাই সে পোষক কোষের সংস্পর্শে এলে উদ্ভিদ বা যেকোনো প্রাণীর এমনকি মানুষের যে-কোনো রোগের  কারন হতে পারে। কিন্তু একটা জিনিস আমাদের বুঝতে হবে,যা পরা-বিদ্যাবিদগন বলছেন,  জীবসৃষ্টির প্রক্রিয়া পৃথিবীতে এখনো অব্যাহত। আমরা জীবের ক্রমোন্নতির পঞ্চম স্তরের বাসিন্দা, আরো দুটো স্তর অর্থাৎ ষষ্ঠ ও সপ্তম স্তরে জীবের সৃষ্টি ভবিষ্যতে হবে। তো জীবের দৈহিক গঠনের পরিবর্তন হবে। এটাকে শত চেষ্টা করেও, এই প্রক্রিয়াকে রোখা যাবে না। জড় থেকে রূপান্তরিত করে, ঈশ্বর প্রকৃতির সাহায্য নিয়ে, যখন  জীব সৃষ্টি করতে যান, তখন জীব ও জড়ের মধ্যবর্তী অবস্থা হচ্ছে ভাইরাস। এটি একটি সেতুবন্ধক বস্তু। জীবনের উৎপত্তি, জীবসৃষ্টি ইত্যাদি বিষয় নিরুপন করতে গেলে, ভাইরাস-বিজ্ঞানীদের এই ভাইরাসকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে হয়।গবেষণামূলক  বিজ্ঞানের জন্য, ভাইরাস অতি গুরুত্ত্বপূর্ন। জীবদেহে প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তোলার  জন্য,  রসায়নাগারে ভাইরাস থেকেই  টিকা বা ভ্যাকসিন প্রস্তুত করা হচ্ছে। এমনকি উদ্ভিদের বা শস্যের ক্ষতিকারক কিট -পতঙ্গের ধংসের জন্য এই ভাইরাসকেই ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে, মলিকিউলার বায়োলজি, বা ঔষধ সংক্রান্ত গবেষণামূলক কাজে ভাইরাসকেই গবেষণার বস্তু হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। 

তাই মা-ভৈ, ভাইরাস আমাদের গৃহপালিত হয়ে থাকুক।  কিন্তু আমাদের বিছানায় না উঠে পরে, আমাদের গা বেয়ে না উঠতে পারে। আমাদের নাকে, মুখে, চোখে না যেতে পারে, সেটা যেমন খেয়াল রাখতে হবে। তেমনি প্রতিনিয়ত প্রাণের সাধনা করতে হবে, ধ্যান ধারণা, প্রার্থনার মাধমে নিজেদেরকে ভয়শূন্য করতে হবে, আর সত্যকে ভালোভাবে জেনে-বুঝে গ্রহণ করতে হবে। প্রাণের সাধনা, প্রার্থনা, ধারণা, ধ্যান যদি আপনার জীবনের নিত্য সাথী হয়, তবে জানবেন, আপনি অশ্বিনীকুমারদ্বয় আপনাকে সব সময় সুস্থ রেখেছেন।
 বাইরের ডাক্তারের কাছে তখনই যাবেন, যখন আপনাকে পাগলা কুত্তায় কামড়াবে, অর্থাৎ আকস্মিক দুর্ঘটনায় ঘটলে।  আর একটা সময় যেতেহবে, যখন ডেথ সার্টিফিকেট দরকার পড়বে। হোটেল মালিকের ইচ্ছেয় আমি হোটেল ছাড়বো না।  আমার যখন হোটেলে থাকতে ইচ্ছে হবে না, আমার যখন বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে হবে, তখনই আমি হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়বো, অনন্তের  যাত্রায়।  

 সবাইকে ভালো রাখুন, তবে আপনিও অবশ্য়ই ভালো থাকবেন।

অনুগীতা : (পর্ব্ব -১) ( মহাভারত - আশ্বমেধিক পর্ব্ব - অনুগীতা পর্ব্বাধ্যায় ) 

আমরা শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা শুনেছি। এক মহাযুদ্ধের প্রারম্ভে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে  আশু কর্তব্যে উদ্দীপিত করবার জন্য, তার মানসিক দ্বন্দ্বকে দূর করবার জন্য, সত্যের শেষ কথা শুনিয়েছেন। এমনকি অর্জুনকে ভগবান তার বিশ্বরূপ দর্শন করিয়েছিলেন।  যা আজও  আমাদেরকে অনুপ্রেরণা জোগায়। গীতা শেষে ভগবান অর্জুনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,   হে পার্থ,  তুমি একাগ্র মনে আমার কথা শুনেছ তো ? তোমার অজ্ঞানজনিত মোহ দূর হয়েছে তো ? তো অর্জুন বললেন, হে অচ্যুত ! তোমার কৃপায় আমার মোহ  দূর হয়েছে, আমি আমার আত্মস্মৃতি ফিরে পেয়েছি। আমার আর কোনো সংশয় নেই।  এখন আমি তোমার কথা ও নির্দেশ পালন করবো। 

এখন, যুদ্ধ শেষ হয়েছে। পান্ডবগন জয়লাভ করেছে। ধৃতরাষ্ট্র পুত্রগণ সদলবলে নিহত হয়েছে। যুধিষ্ঠির রাজা হয়েছেন। তো বাসুদেব ও ধনঞ্জয় নতুন রাজসভায় ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। দেখতে দেখতে অর্জুন প্রফুল্ল চিত্তে বাসুদেবকে সম্মোধন করে বললেন, হে মধুসূদন, যুদ্ধকালে আমি তোমার মাহাত্ম বুঝতে পেরেছি। এমনকি আমি তোমার   বিশ্বরূপ-মুর্তি দর্শন করেছি। কিন্তু বন্ধু, তুমি সেই সময় বন্ধুত্ত্বের খাতিরে যেসব উপদেশ দিয়েছিলে, তা আমি আমার বুদ্ধির দোষে, সব ভুলে বসে আছি। এখন আমার আবার সেই সব কথা জানতে ইচ্ছে করছে। তুমিতো শীঘ্র দ্বারকায় চলে যাবে। তার আগে যদি এইসময় আমাদের পুনরায়, সেই কথাগুলো শোনাও, তাহলে ভালো হয়। 

আসলে এটাই আমাদের অবস্থা। শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা আমাদের একটা রক্ষা-কবচের মতো হয়ে গেছে। বেঁচে থাকতে আমরা গীতাকে ঠাকুর ঘরে রাখি।  ফুল চন্দন-তুলসীপাতা দিয়ে পুজো করি। মৃত্যুর সময় আমরা গীতাকে বুকে জড়িয়ে থাকি। কিন্তু গীতার ভিতরে আমরা প্রবেশ করতে পারি না। এমন অনেক পণ্ডিত আছেন, গীতার সমস্ত শ্লোক  মুখস্ত করে ফেলেছেন,  কিন্তু গীতাকে নিজের জীবনে প্রতিফলিত করতে পারেন নি। আর সত্যি কথা বলতে কি গীতা এমনই একটা গ্রন্থ যা আমাদের কাছে ব্যাখ্যা  করে না বোঝালে, আমরা বুঝতে পারি না। আবার ব্যাখ্যাকারগন গীতার  শ্লোককে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন। ফলত আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে, গীতা অবোধ্য। কিন্তু পূজনীয়। 

মহামুনি ব্যাসদেব বেদ বিভাজন করতে গিয়ে বুঝেছিলেন, এই জ্ঞানের ভান্ডার সাধারণের বোধগম্য নয়। তাই বেদের সারমর্ম্ম সাধারণের কাছে, গল্পের আকারে উপস্থিত করবার জন্য, মহাভারতের উপস্থাপনা করেছিলেন। আমাদের মা-ভাই-বোনদের কাছে, রামায়ন  মহাভারত তাই আকর্ষণীয় ধর্ম্মের উপাখ্যান। এই মহাভারতের মধ্যে, সর্বোৎকৃষ্ট সংযোজন হচ্ছে, গীতা। কিন্তু মহামুনি ব্যাসদেব মহাভারত লিখতে লিখতে বুঝেছিলেন, এই গীতা সার্বজনীন হবে, কিন্তু গীতার মর্মার্থ সবার কাছে নাও পৌঁছতে পারে। তারই মহাভারতের শেষ দিকে এসে, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের মুখ দিয়েই প্রকাশ করলেন "অনুগীতা" ।  
 
যাই হোক, শ্রীকৃষ্ণ যখন শুনলেন, পরমাত্মার বাণী বা উপদেশ,  স্বয়ং অর্জুন, যে একমাত্র  নিজের কানে শুনেছিল, সেও এসব কথা কিছুই মনে রাখতে পারেনি, একথা শুনে, মহাত্মা বাসুদেব, ধনঞ্জয়কে জড়িয়ে  করলেন। এবং বললেন, দেখো, আমি তোমাকে ধর্মের নিগূঢ় তত্ত্ব ও নিত্যলোক সমুদায়ের বিষয়ে বলেছিলাম। কিন্তু তুমি যে তা মনোযোগ দিয়ে শোনো নি, তুমি যে তা বিচার-বুদ্ধি দিয়ে নিজের মধ্যে ধারণ করে রাখোনি, এতে আমি খুব দুঃখ পেয়েছি। আর সত্যি কথা বলতে কি, আগে আমি তোমাকে যা  বলেছিলাম, সেসব এখন আমার স্মৃতিতে নেই। আমার খুব খারাপ লাগছে, এটা ভেবে যে, তুমি এতটা নির্বোধ ও শ্রদ্ধাশূন্য ? আমি আর তোমাকে  কোনোভাবেই সেইসব উপদেশ দিতে পারবো না। সেই ধর্ম্ম-উপদেশ প্রভাবে ব্রহ্মপদ লাভ করা যায়। এখন আর আমি পুনরায়, সেসব কথা বলতে সমর্থ নোই। আমি আসলে সেই সময় যোগযুক্ত হয়ে, সেই পরব্রহ্ম প্রাপক বিষয় তোমাকে বলেছিলাম।এখন আর তোমাকে সেই সব কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যাই হোক, আজ আমি বরং তোমার কাছে, পরব্রহ্ম-সম্পাদক এক পুরোনো গল্প বলি, তুমি মনোযোগ দিয়ে শোনো। এই ইতিহাস শুনলেও  তুমি উৎকৃষ্ট বুদ্ধি-লাভ করতে পারবে,  এমনকি শ্রেষ্ঠগতি প্রাপ্ত হতে সমর্থ হতে পারবে।

গল্পটা এইরকম : শ্রীকৃষ বলছেন - কোনো এক ব্রহ্মজ্ঞ একসময়, স্বর্গলোক-ব্রহ্মলোক ভ্রমন করে, আমাদের কাছে এসেছিলেন। আমরা তাকে যথাযথ সেবা-যত্ন করে, মোক্ষধর্ম্মের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। তো তখন তিনি যা বলেছিলেন, তা আমি বলছি, তুমি মনোযোগ দিয়ে শোনো। একথা শুনলেও  তোমার মোহ  দূর হবে।

মহামুনি কাশ্যপ নামে এক ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি একসময় এক সিদ্ধপুরুষের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। এই সিদ্ধপুরুষ সুখ-দুঃখ, পাপপুণ্য, জীবন-মৃত্যু, ইত্যাদির শাস্ত্রসম্মত মর্ম কথা জানেন।  ইনি  জিতেন্দ্রিয়,  সর্বত্র সঞ্চরণশীল, অন্তর্ধান-গতিবেত্তা প্রশান্ত চিত্ত। প্রাণীগণ নিজ নিজ কর্ম্ম-প্রভাবে যেমন যেমন গতি লাভ করে থাকে, সে সমস্ত কিছুই তিনি  বিলক্ষণ জানেন। উনি সিদ্ধপুরুষগণের গমনাগমন, উপবেশন, এবং নির্জনে তাদের সাথে কথোপথন করতেন। তো মহামুনি কাশ্যপ সেবা-যত্ন করে সেই সিদ্ধপুরুষকে  সন্তুষ্ট করবার পরে, সিদ্ধপুরুষ বললেন :

হে কাশ্যপ শোনো, মানুষ বিভিন্ন কার্য্য ও পুণ্যযোগ বলে উৎকৃষ্ট গতিলাভ ও দেবলোক প্রাপ্ত হয়ে থাকে। কোনো মানুষই নিরন্তর সুখ ভোগ করতে পারে না। উৎকৃষ্ট লোকসমূহ অতিকষ্টে উপলব্ধ হওয়া সত্ত্বেও বারবার তার পতন হয়ে থাকে। আমাদের কাম-ক্রোধ-তৃষ্ণা-মোহ ইত্যাদির জন্য, কষ্টকর অশুভ গতিসমূহ প্রাপ্ত হতে হয়। আমাদের বার বার জন্ম-মৃত্যু ভোগ করতে হয়। আমাদের বিবিধ খাবার পানীয় উপভোগ করতে হয়। অসংখ্য মায়ের স্তন পান করতে হয়। বহুবার আমাদের বিভিন্ন পিতা-মাতার আশ্রয়ে থাকতে হয়। আমাদের নানান রকম সুখ-দুঃখ ভোগ করতে হয়। কতবার যে আমাদের প্রিয়জনের বিচ্ছেদ হয়েছে, আবার অপ্রিয়দের সংযোগ ঘটেছে,  কতবার যে আমরা  ধনসঞ্চয় করেছি, আর তার উপভোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি,  কতবার যে আমরা  আত্মীয়স্বজন থেকে জমিদারের কাছ থেকে রাষ্ট্রনায়কদের কাছ থেকে অপমানিত হয়েছি, নিগৃহীত হয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। কতবার আমরা শারীরিক ও মানসিক কষ্ট  সহ্য করেছি। কতবার বধবন্ধন (ভববন্ধন ) যাতনা অনুভব করেছি, কতবার আমাদেরকে নরক-যন্ত্রনা, যম-যন্ত্রনা, জরা-ব্যাধি জনিত যন্ত্রনায় নিপীড়িত হয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। লৌকিক বিপদসমূহ আমাদেরকে কতবার আক্রমন করেছে। সিদ্ধপুরুষ বলছেন, আমাকেও এই সবই একসময়  ভোগ করতে হয়েছে। এতেকরে, সবশেষে নিতান্ত বিরক্ত হয়ে, সমস্ত লোকতন্ত্র পরিত্যাগ করে, আজ আমি এই পথ অবলম্বন  করেছি।  আজ আমার মনের প্রশান্তিদায়ক সিদ্ধি লাভ হয়েছে। এই সিদ্ধি প্রভাবে, আর আমাদের এই সংসারে আগমন করতে হবে না। এর পর যতক্ষন প্রলয় না হবে, বা আমার মুক্তিলাভ  না হবে, ততকাল আমি আপনাদের ও এই লোকসমূহের শুভ গতি সমুদায় প্রত্যক্ষ করতে থাকবো। 
সিদ্ধপুরুষ বলছেন, আমি দেহ ত্যাগের পরে এই সংসার থেকে সত্য-লোকে  গমন করবো। এবং সেই সত্যলোক  থেকে মুক্তি লাভ করে, ব্রহ্মের স্বরূপতা  প্রাপ্ত হবো। তুমি আমার এই কথায় বিন্দুমাত্র সন্দেহ করো না। আমি আর কখনোই এই মর্তলোকে আগমন করবো না। এখন বলো, তুমি আমার কাছে, যা লাভ করবার অভিলাষে এসেছো,  তা স্বয়ং ব্যক্ত করো। আমার মনে হচ্ছে, তুমি আমাকে চিনতে পেরেছো। তোমার বুদ্ধি অতি উৎকৃষ্ট, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।  কিন্তু শোনো, আমি অতিসত্ত্বর এই সংসার পরিত্যাগ করবো, তাই  তুমি আমার কাছে যা জিজ্ঞাস্য তা অকপটে জিজ্ঞাসা করতে পারো।  আমি তা তোমাকে অবশ্যই  শোনাবো। 
কাশ্যপ তখন তাকে নমস্কার করে বললেন, ভগবন ! জীবাত্মা কিভাবে এক দেহ পরিত্যাগ ও অন্য দেহ আশ্রয় করে ? আর কিভাবেই বা স্থূল ও সূক্ষ্ম দেহ পরিত্যাগ করে, এই ক্লেশকর সংসার থেকে মুক্ত হয় ? কিভাবে এর শুভ-অশুভ কাজের ফল ভোগ করে থাকে এবং দেহত্যাগের পর এর কর্ম্মসমূদায় কোথায় অবস্থান করে থাকে ? এই সমস্ত কিছু আমাকে  দয়াকরে বলুন। 

গল্পো শুনছি আমরা অর্জুনসখা শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে। এ-তো গল্প নয়,  এ হচ্ছে জীবনের তত্ত্ব কথা। মহামুনি কাশ্যপমুনি প্রশ্ন করেছিলেন এক সিদ্ধ পুরুষের কাছে। প্রশ্ন ছিল,  জীবাত্মা কিভাবে এক দেহ পরিত্যাগ ও অন্য দেহ আশ্রয় করে ? আর কিভাবেই বা স্থূল ও সূক্ষ্ম দেহ পরিত্যাগ ক'রে, এই ক্লেশকর সংসার থেকে মুক্ত হয় ? কিভাবে এর শুভ-অশুভ কাজের ফল ভোগ করে থাকে এবং দেহত্যাগের পর এর কর্ম্মসমূদায় কোথায় অবস্থান করে থাকে ? 

তো সিদ্ধপুরুষ বলছেন : জীব দেহ আশ্রয় ক'রে, যে সব আয়ুষ্কর কাজ করে থাকে, সেই সমস্ত কাজের ফলাভোগ শেষ হলে, তার আয়ুক্ষয় হয়। এরপর সে বিপরীতমুখী হয়ে, বা বিপরীতবুদ্ধি আশ্রয় করে নিরন্তর অসৎ কার্য্যে লিপ্ত হয়। নিজের শরীরের অবস্থা ও ক্ষমতা জেনেও সে অহিতকর বস্তু খেতে প্রবৃত্ত হয়। কোনোদিন অতিভোজন, তো  কোনোদিন অনাহার। কখনো অপেয় পান, কখনো অতিরিক্ত বাসিপচা  অন্ন ভক্ষণ, কখনো আমিষ, কখনো গুরুপাক বস্তু ভোজনে আসক্ত হয়। কখনো খাবার হজম হওয়ার আগেই আবার ভোজনে বসে যায়। কোনোদিন  দিনের বেলায় ঘুম। কোনোদিন অত্যধিক পরিশ্রম করে ।  এমনকি অত্যধিক স্ত্রীসঙ্গ, এইভাবে সে শরীরকে দুর্বল করে ফেলে। কোনোদিন বিষয়কর্ম্মে এতটাই উদ্বিগ্ন থাকে যে মল-মূত্রাদির বেগ ধারণ করে রাখে। অসময়ে ভোজন করে। এইভাবে সে শরীরকে বায়ু-পিত্ত-কফ এর  প্রকোপ বাড়িয়ে তোলে। জীব এইভাবে নিজেকে অত্যাচার করে, প্রাণনাশক রোগকে আহ্বান করে থাকে। সবশেষে হয় তার বুদ্ধিনাশ। শ্রেয় থেকে প্রিয়বস্তুর দিকে আকৃষ্ট হয়ে,দেহ ত্যাগ করে। এই হচ্ছে, জীব দেহ থেকে আত্মার নির্গতের কারন। 

অনুগীতা : (পর্ব্ব -২) ( মহাভারত - আশ্বমেধিক পর্ব্ব - অনুগীতা পর্ব্বাধ্যায় ) 

আমরা শুনছিলাম অর্জুনসখা শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমুখ থেকে অনুগীতার বাণী।আমরা এর আগের দিন, শুনেছি জীবাত্মা যে  নিমিত্তের কারনে দেহ ত্যাগ করে থাকে। আজ আমরা আবার শুনবো, শ্রীকৃষ্ণের মুখ নিঃসৃত নীতিগল্প কথা, যা তিনি অর্জুনকে শুনিয়েছিলেন। তো শ্রীকৃষ্ণের বলা গল্পের   সিদ্ধপুরুষ বলছেন, এবার জীবাত্মা কিভাবে দেহ থেকে বেরিয়ে পড়ে বা জীবাত্মা কিভাবে দেহত্যাগ করে থাকে, সে সম্পর্কে শোনো। 

জীবাত্মা দেহত্যাগের সময়, শরীরের অন্তর্গত অগ্নি বা উত্তাপ বায়ুবেগ বশতঃ  প্রোকোপিত হয়ে দেহকে উত্তপ্ত  করে, ও প্রাণবায়ুকে রুদ্ধ ক'রে সমুদয় মর্ম্মভেদ করতে থাকে। তখন জীবাত্মা মর্ম্মভেদী ভীষণ যন্ত্রনায় আক্রান্ত হয়ে দেহ ত্যাগ করে থাকে। সমস্ত জীব বারবার জন্ম-মৃত্যুর বশীভূত হয়ে থাকে। জীব মৃত্যর সময় যেমন কষ্ট  ভোগ করে থাকে, তেমনি জন্ম নেবার কালে  গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসবার সময়ও ঠিক একই রকম কষ্ট  ভোগ করতে হয়। এই সময় সে তীব্র বায়ু প্রভাবে শীতে কম্পিত হয়, সারা শরীরে রক্ত-কফ মাখানো থাকে। মৃত্যুকালে, অর্থাৎ পঞ্চভূতের পৃথক-করনের সময়ে শরীরের ভিতরের প্রাণ ও অপান বায়ু উর্দ্ধগামী হয়ে দেহকে পরিত্যাগ করে থাকে। তখন এই দেহ একটা বিশ্রী  পচনশীল পদার্থে  পরিণত হয়, বিচেতন, এবং উত্তাপ ও উচ্ছাস বিহীন হয়ে পড়ে, যাকে আমরা  মৃতদেহ বলে নির্দিষ্ট করি । এবং দ্রুত তাকে পরিত্যাগ  করে থাকি।
সিদ্ধপুরুষ বলছেন, দেখো কাশ্যপ  জীবাত্মা ইন্দ্রিয়দ্বারা রূপ-রস ইত্যাদি বিষয় সমূহের্ আস্বাদ গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু এর দ্বারা ভুক্ত-দ্রব্য থেকে জাত প্রাণকে বিশেষভাবে জ্ঞাত হতে পারে না।  আসলে সনাতন জীবাত্মাই শরীরের মধ্যে অবস্থান পূর্বক শরীর দ্বারা সমস্ত কার্য্য সম্পাদন করে থাকে। পন্ডিতগণ শরীরের সন্ধিস্থানগুলোকে মর্ম্মস্থান বলে নির্দেশ করে থাকেন। এই সন্ধিস্থল ছিন্ন হলে, জীবাত্মা এইসমস্ত কিছুকে পরিত্যাগ করে বুদ্ধিকে রুদ্ধ করে থাকে। আবার বুদ্ধি রুদ্ধ হলে, জীবাত্মা সচেতন থাকলেও, জীবাত্মা কোনো বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত হতে পারে না। এই সময় বায়ু সে আশ্রয়চ্যুত জীবাত্মাকে মহাবেগে চালিত করতে থাকে। তখন জীবাত্মা অসহায় হয়ে, দেহকে কম্পিত ক'রে, দেহ থেকে নির্গত হয়। 

জীবাত্মা এইভাবে দেহথেকে বেরিয়ে গেলেও তার দ্বারা অনুষ্ঠিত  কর্ম্ম কিন্তু তাকে পরিত্যাগ করে না।  জীবাত্মা তখন কর্ম্মের দ্বারা আবদ্ধ হয়ে আবার ভুমন্ডলেই জন্ম গ্রহণ করে থাকে। যার জন্য, জ্ঞানীগণ শিশুর লক্ষণ দেখে তাকে পুণ্যবান অর্থাৎ পুন্য কর্ম্মের অধিকারী বলে চিহ্নিত করতে পারেন। আবার পাপ-কর্ম্মের অধিকারীকেও চিহ্নিত করতে পারেন। আসলে জ্ঞানী সিদ্ধপুরুষগন তাদের জ্ঞান-চক্ষুর দ্বারা জীবাত্মার জন্ম-মরন এমনকি গর্ভে প্রবেশ ইত্যাদি  দর্শন করতে সমর্থ হন। 

সিদ্ধপুরুষ বলছেন, শাস্ত্রে জীবের স্বর্গ-মর্ত্য ও নরক এই ত্রিবিধ স্থানে যাতায়াতের কথা বলা হয়ে থাকে। কেউ কেউ এই কর্মভূমি বা মর্তে শুভ অশুভ যে কার্য্যই হোক না কেন, তার যে কর্ম্মফল সেসব এই কর্ম্মভূমিতেই ভোগ করতে পারে। কেউ কেউ পুন্যবলে স্বর্গে গিয়ে শুভ কর্ম্মের ফল ভোগ করতে পারে।  আবার যারা অশুভ কার্য করেছেন, তারা অনন্তকাল নরকভোগ করে থাকেন। জীব একবার নরকে গেলে সেখান থেকে মোক্ষলাভ করা, অত্যন্ত কঠিন। অতএব যাতে জীবের নরক প্রাপ্তি না হয়, তার জন্য সবাইকে সচেষ্ট থাকা উচিত। (আসলে মানুষের বা জীবের চিন্তাধারায় যদি একবার মলিনতার ছাপ  পড়ে, তবে সে সারাক্ষন অশুভ চিন্তার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে।  সেখান থেকে বেরিয়ে আসা মুশকিল, মানুষ একবার অসৎসংগে পড়লে, বা নিষিদ্ধ দ্রব্যে আকৃষ্ট হলে, এই আকর্ষণ এতটাই প্রবল যে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা ভীষণ কঠিন। প্রবল ইচ্ছাশক্তি অথবা সৎসঙ্গই পারে, জীবকে  এখান থেকে বের করে আনতে। এইজন্যই বলা হয়েছে, মানুষ একবার নরকযাত্রা করলে, তা দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়।)

সিদ্ধপুরুষ বলছেন, হে কাশ্যপ এবার তোমাকে জীবাত্মা স্বর্গগামী হয়ে, যেখানে যেখানে  অবস্থান করে থাকে, সে সম্পর্কে বলছি।  এসব কথা শুনলে,  তোমার কর্ম্ম-গতি সম্পর্কে জ্ঞান হবে। যাঁরা ইহলোকে পুন্যকার্য্যের অনুষ্ঠান করেন, তাঁরা দেহান্তে উর্দ্ধগামী হয়ে, চন্দ্র, সূর্য্য অথবা নক্ষত্রলোক লাভ করে থাকেন। কিন্তু কর্ম্মক্ষয় হলেই, তাঁদেরকে পুনর্বার এইসব লোক থেকে অর্থাৎ স্বর্গ থেকে  নিপতিত হতে হয়। পুন্য-কর্ম্মের অধিকারীগণ এইভাবে, বারবার মর্ত্যলোকে জন্ম গ্রহণ করে থাকেন। অর্থাৎ স্বর্গে যারা যান, তাঁরা পুনঃপুনঃ জন্মগ্রহণ করে থাকেন, এবং স্বর্গবাসী থেকে যাঁরা  উন্নত সেইসব জীবাত্মাকে  দেখে ঈর্ষান্বিত হন। 

এরপর শোনো জীবের দেহ পরিগ্রহের বিষয়। আমরা অর্জুনসখা শ্রীকৃষ্ণের মুখ দিয়ে গল্প শুনছি। শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, এর পর সেই সিদ্ধপুরুষ বলছেন, শুভই হোক আর অশুভ হোক, সমস্ত কর্ম্মের ফল ভোগবিনা কর্ম্মের ধ্বংস হয় না। যে ব্যক্তি যেমন যেমন কাজ করেন, জন্মান্তরে তাকে সেই সেই কর্ম্মের ফল অবশ্যই  ভোগ করতে হয়। বনস্পতি যেমন ফলদানের সময় এলে ফল দান করবে, তেমনি শুভ বা অশুভ কাৰ্য্য সম্পাদন করলে অবশ্যই  কর্ম্মফল প্রদান করবে। শুভ কার্য্যের অনুষ্ঠানে পুণ্যফল আর অশুভকার্য্যের অনুষ্ঠানে পাপফল উৎপন্ন হয়ে থাকে। জীবাত্মা মনকে সামনে রেখে কার্য্যে প্রবৃত্ত হয়।অর্থাৎ জীবাত্মার চিন্তা-ভাবনা মানসিক শরীরের মাধ্যমেই করে থাকে।  

এখন মানুষ  স্ব-কর্ম্মের  দ্বারা আবৃত হয়ে, যেভাবে জন্মান্তরে মাতৃগর্ভে প্রবেশ করে, সে-সম্পর্কে বলছি শোনো। শোনিত-মিশ্রিত শুক্র স্ত্রী-জাতির গর্ভকোষে প্রবিষ্ট হয়ে, জীবের কর্ম্ম-অনুরূপ দেহে পরিণত হয়। অর্থাৎ একটা কর্ম্মযোগ্য একটা শরীরের উৎপন্ন হয়। এবং পিতা-মাতার শরীর নিঃসৃত রস থেকে যেহেতু শরীর তৈরি হয়, তাই এই শরীর মাতা-পিতার অনুরূপ হয়ে থাকে।  পরে জীবাত্মা তার সংকল্প পূরণের জন্য, বা কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য,  যে ধরনের দেহের প্রয়োজন হয়, সেই দেহমধ্যে প্রবেশ করে থাকেন। (এইঘটনা, অর্থাৎ শরীরের মধ্যে চেতন-যোগে প্রাণবায়ু  মাতৃগর্ভে শিশুর ৪৪-৫০ দিনের মধ্যেই ঘটে থাকে।  সব থেকে বেশি হলে ৮৪-৯০ দিনের মধ্যেই এই প্রবেশক্রিয়া সংগঠিত হয়ে থাকে।  আর তা-যদি না হয়, তবে মাতৃগর্ভের এই মাংসপিন্ড বিনাশের পথে এগিয়ে যায়।) অতিশয় সূক্ষ্ম এই জীবাত্মা। যিনি দৃষ্টিগোচর নন।  সবার অলক্ষে তিনি অবস্থান করেন, জীবদেহের সঙ্গে কখনো লিপ্ত হন না। আসলে এই জীবাত্মাই , পরমাত্মা বা শ্বাশত ব্রহ্ম। জীবাত্মাই সমুদয় লোকের বীজ স্বরূপ। সমস্ত প্রাণীই এই আত্মার প্রভাবে জীবিত থাকে। তামার পাত্র  সোনার রসে ভেজালে যেমন তামার পাত্রকে সোনার পাত্র বলে মনে হয়, লৌহখন্ডে অগ্নি প্রবেশ করলে যেমন লৌহখন্ড উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনি মাংসপিন্ডের মধ্যে বা জীবদেহের মধ্যে জীবাত্মা প্রবেশ করলে, জীবদেহ জীবময় ও সচেতন বলে বোধ হয়ে থাকে। অন্ধকার রাত্রিতে প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ যেমন গৃহের সমুদয় বস্তুকে প্রকাশ করে, ঠিক তেমনি জীবদেহে জীবাত্মার প্রবেশ ঘটলে, জীবদেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গ কর্ম্মক্ষম হয়ে ওঠে, চেতনা-সম্পন্ন হয়ে ওঠে । জীবাত্মা মাত্রেই শরীর আশ্রয় করে, পূর্ব-পূর্ব জন্মের কার্য্যের ফল ভোগ করে থাকে। এবং বিভিন্ন কর্ম্মের অনুষ্ঠান করে থাকে। এইভাবে জীবাত্মা যতদিন না  পর্যন্ত মোক্ষধর্ম্ম সম্পর্কে অবগত হতে সমর্থ হয়, ততদিন পর্যন্ত ফলভোগ দ্বারা জন্মান্তরীন শুভ-অশুভ কার্যক্ষয় ও বর্তমান জন্মে আবার কর্ম্মদ্বারা  তা সে শুভ হোক বা অশুভ হোক, কর্ম্মফল সঞ্চয় করে থাকে। এইভাবে জীবাত্মা জন্মের পর জন্ম, দেহের পর দেহ ধারণ করে, কর্ম্ম সঞ্চয় ও তার ভোগকার্য্য করে চলেছে। তাহলে কি এর জন্ম-জন্মান্তরের ভোগ থেকে আমাদের নিস্তার নেই ?

 আমরা শুনছি, অর্জুনসখা শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকে অনুগীতা। এর পরে আমরা আবার শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকে শুনবো, সেই  সিদ্ধপুরুষের মহৎ উপদেশ কথা, অর্থাৎ কি করলে আমরা সুখী হতে পারবো। সিদ্ধ পুরুষ বলছেন, দান, ব্রতচর্য্যা, ব্রহ্মচর্য্য বেদাভ্যাস, শান্তি, ইন্দ্রিয়-সংযম, জীবের প্রতি দয়া, সরলতা, পরের দ্রব্য হরণে নিস্পৃহতা, প্রাণীগণের অহিতচিন্তা পরিত্যাগ, পিতামাতার শুশ্রুষা, দয়া, শুদ্ধতা এবং গুরুজন, দেবতা ও অতিথিগণের পূজা প্রভৃতি শুভ কার্য্যের অনুষ্ঠানই একজন মানুষকে স্বভাবসিদ্ধ সাধুতে পরিণত করতে পারে। একেই ধর্ম্মানুষ্ঠান বলা হয়ে থাকে। এই ধর্মানুষ্ঠানের মাধ্যমেই সমস্ত প্রজাগণ রক্ষিত হতে পারে।  দানাদির অভ্যাস  ও সদাচার, সনাতন ধর্ম্ম নামে অভিহিত হয়। যারা এই সদাচার  সমূহ অবলম্বন করেন, তাদের কোনো দুর্গতি ভোগ করতে হয় না। মানুষ যখন ধর্ম্ম পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়, তখন  এই সদাচারের উপদেশই  মানুষকে সৎপথে ফিরিয়ে আনতে পারে।  আর সদাচরণ পরায়ণ ব্যক্তিই একমাত্র সদাচরণের উপদেশ দেবার অধিকারী। কিন্তু যোগী ব্যাক্তিগন এই সদাচারণ পরায়ণ  ব্যক্তির থেকেও শ্রেষ্ঠ।  কারন যোগীপুরুষ যোগবলে, অচিরেই সংসারবন্ধন  থেকে মুক্ত হতে পারেন। কিন্তু দানাদি প্রদানকারী  বা সদাচরণ পরায়ণ ব্যক্তি দীর্ঘকাল সংসারে থেকে তবে মুক্তির পথের  সন্ধান পান। জীব জন্মগ্রহণ ক'রে, পূর্বপূর্ব জীবনের কর্ম্মফল ভোগ করতে থাকে। আর এই কর্ম্মই  জীবাত্মাকে বার বার জীব রূপে জন্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করে থাকে।

কিন্তু কথা হচ্ছে, কর্ম্ম-ই যদি জীবাত্মার শরীর ধারনের কারন হয়, তবে প্রথম যিনি জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, তাঁরতো কোনো কর্ম্ম ছিল না, তিনি কেন জন্ম গ্রহণ করলেন ? আর সর্বপ্রথম কে শরীর  ধারণ করলেন ? 

সিদ্ধ পুরুষ বললেন, এই সংশয় মানুষের মনের মধ্যে উদয় হতেই পারে। আমি এই সংশয়ের অপনোদন করছি,  তুমি মনোযোগ দিয়ে শোনো। সর্ব্বলোকের পিতামহ ব্রহ্ম সর্ব প্রথম শরীর ধারণ করেন। এবং তার পর অন্যান্য শরীরির অর্থাৎ জীবের বা প্রাণীর শরীর কল্পনা ক'রে, এই চরাচর বিশ্বের সৃষ্টি করেন। তিনিই দেহের অনিত্যত্ব ও জীবের বিবিধ দেহ পরিগ্রহের নিয়ম করেছেন। জীবাত্মার এইযে বসবাস  গৃহ অর্থাৎ বিভিন্ন রকম দেহ, এইসব হচ্ছে ক্ষর অর্থাৎ বিনাশশীল আর জীবাত্মা ও পরমাত্মা হচ্ছেন অক্ষর অর্থাৎ অবিনাশী। এইযে তিনটি নাম আমি বললাম, অর্থাৎ শরীর অর্থাৎ প্রাণী, এবং জীবাত্মা ও পরমাত্মা, এর মধ্যে দেহ ও জীবাত্মা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে অবস্থান করে থাকে। 

মানুষের  মধ্যে অর্থাৎ  যিনি সুখ-দুঃখকে অনিত্য বলে জেনেছেন, শরীরকে যিনি ক্ষয়িষ্ণু এমনকি অপবিত্র বস্তুর সমষ্টি বলে জেনেছেন, বিনাশকে যিনি কর্ম্মের ফল ও সুখকে যিনি দুঃখ বলে জ্ঞান করেন, তিনি অনায়াসেই এই সংসারসাগর হতে উত্তীর্ন হতে পারেন। যিনি এই  জরা, রোগ-ব্যাধি, ইত্যাদির অধীন এই শরীর ধারণ করে সমুদয় জীবে  সমভাবে দৃষ্টিপাত করতে পারেন, তিনি ব্রহ্মকে অনুসন্ধান করলে, অনায়াসে তাঁকে অবগত হতে সমর্থ হন। 

অনুগীতা : (পর্ব্ব -৩) ( মহাভারত - আশ্বমেধিক পর্ব্ব - অনুগীতা পর্ব্বাধ্যায় ) 

আমরা শুনছিলাম অর্জুনসখা শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমুখ থেকে অনুগীতা। আজ আমরা তিনটি বিষয়ের উপরে উপদেশ শুনবো।  এক) মুক্ত মহাত্মার লক্ষণ কি ? ; দুই) যোগের সাহায্যে   মুক্তির উপায়বিধি কি ? এবং তিন) ধ্যানযোগে ব্রহ্ম-সাক্ষাৎকার লাভ কিভাবে করা যাবে । অর্থাৎ মহাপুরুষের লক্ষ্মণ ও মহাপুরুষ হবার উপায়। 

মহাপুরুষের লক্ষ্মণ  অর্থাৎ আমাদের কোথায় যেতে হবে, আমাদের কি হতে হবে। প্রথমে আমাদের লক্ষ ঠিক করতে হবে। পতঞ্জলির যোগদর্শনেও আমরা দেখেছি, প্রথমে সমাধিপাদের কথা বলেছেন। তারপরে সাধন পাদের কথা। আমরা শ্রীমদ্ভগবতেও  আমরা দেখেছি, প্রথমেই ভগবান আত্মতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তারপরে বিভিন্ন মার্গের কথা অর্থাৎ কর্ম্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগের কথা বলেছেন। এখানেও প্রথমে মুক্ত মহাত্মার পরিচয় দিচ্ছেন।   
 
মহাপুরুষের লক্ষ্মণ সম্পর্কে  সিদ্ধপুরুষ বললেন, হে কাশ্যপ যে ব্যক্তি এই স্থুল এবং সূক্ষ্ম দেহের অভিমান ত্যাগ করে, চিন্তাশূন্য হয়ে ব্রহ্মে লীন হন, যিনি সকলের মিত্র, যিনি সর্বসহিষ্ণু, শান্তিনীড়ত বীতরাগ,  যিনি জিতেন্দ্রিয়, ক্রোধ ও ভয় শূন্য, যিনি অভিমানবিহীন, যিনি সকলের প্রতি আত্মবৎ ব্যবহার করে থাকেন, যিনি জন্ম-মৃত্যু, সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, প্রিয়-অপ্রিয় ইত্যাদি সমান জ্ঞান করে থাকেন, যাঁর কারো দ্রব্যের প্রতি স্পৃহা নেই, যিনি কাউকেই অবজ্ঞা করেন না, যার না আছে শত্রু না আছে মিত্র, যিনি ধর্ম্ম-অর্থ-কাম এই তিনকেই পরিহার করেছেন, যার মধ্যে অপত্য স্নেহ বলে কিছু নেই , যিনি না ধার্মিক না অধার্মিক, যার পূর্ব জন্মের সমস্ত কর্ম্মফল শেষ হয়ে   গেছে,  যিনি জন্ম-মৃত্যু চক্রে  গমনাগমন করেন না,  যার কাম্য-কর্ম বলে কিছু নেই,  যিনি এই জন্ম-জরা-মৃত্যুর জগৎকে অনিত্য বলে বুঝেছেন,  যার অন্তরে বৈরাগ্য বুদ্ধি জাগরুক,  যিনি সবসময় নিজের নিজের দোষ  দর্শন করে থাকেন, যিনি শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ পরিহার করেছেন, যিনি কারুর কাছ থেকে দান গ্রহণ করেন না, যিনি অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য কোনো কর্ম করেন না, যিনি অহঙ্কারশূন্য, স্বয়ম্ভূ-নির্গুণ ও গুনভোক্তা  পরমাত্মার দর্শনলাভে সমর্থ হন - তিনি এই সংসার থেকে মুক্তি লাভ করতে পারেন। যিনি বুদ্ধিবলে দৈহিক ও মানসিক সঙ্কল্পগুলোকে পরিত্যাগ করতে  পারেন, তিনিই ইন্ধনবিহীন আগুনের মতো নির্বানপদ প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। যিনি সমস্ত সংস্কার থেকে মুক্ত, যিনি সমস্ত দ্বন্দ্বের অতীত এবং নিষ্পরিগ্রহ হয়ে তপোবলে ইন্দ্রিয়-নিগ্রহ করেন, তিনিই মুক্ত পুরুষ, তিনিই সনাতন প্রশান্ত নিত্য পরম-ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হয়ে থাকেন।

কিন্তু কথা হচ্ছে, মহাত্মা, মহাপুরুষ, ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ বা সিদ্ধ পুরুষ ইত্যাদি   কেমন হবেন সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু সাধারণ মানুষ থেকে কিভাবে বা কি করলে আমরা মহাপুরুষ বা  দেবমানব হতে পারবো, সে সম্পর্কে না জানলে, সেই উপায় সম্পর্কে না জানলে, আমাদের কাছে এইসব কথা কোনো উপকারে আসবে না।  
 
তাই এবার সিদ্ধপুরুষ বলছেন, যোগের সাহায্যে কিভাবে সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে মহাপুরুষ হতে পারেন, সেই সম্পর্কে শোনো।   
সিদ্ধপুরুষ বলছেন, হে মহামুনি কাশ্যপ, যোগীগণ যোগযুক্ত হয়ে কিভাবে বিশুদ্ধ চৈতন্যকে দর্শন  করে থাকেন, এবং যে সমস্ত নিগুড় উপায় অবলম্বনে চিত্তকে  বিষয়াসক্তি থেকে  নিবৃত্ত করতে হয়, আমি সেই সব কথা কীর্তন করছি।  তুমি শ্রদ্ধা সহকারে শ্রবণ করো। 

তীব্র তপের অনুষ্ঠান করে ইন্দ্রিয়গুলোকে স্ব-স্ব বিষয় থেকে নিবৃত্ত করে, আত্মাতে চিত্তকে ধারণ করতে হবে, যদি মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থাকে। আমরা অষ্টাবক্র সংহিতার আলোচনার সময় শুনেছিলাম, যদি মুক্তির ইচ্ছা চিত্তে জাগে তবে বিষয়কে বিষবৎ ত্যাগ করতে হবে। এখনও সিদ্ধপুরুষ বলছেন, তীব্র তপের  অনুষ্ঠান করে, অর্থাৎ তপস্যা দ্বারা বা অভ্যাসের দ্বারা  ইন্দ্রিয়গুলোকে স্ব-স্ব বিষয় থেকে নিবৃত করতে হবে।আমরা জানি আমাদের প্রত্যেক ইন্দ্রিয়ের একটা প্রথক পৃথক শক্তি আছে, যেমন কানের শক্তি বা ক্ষমতা  হচ্ছে, শোনা, তেমনি চোখের শক্তি হচ্ছে দেখতে পারা।  এইরকম প্রত্যেক ইন্দ্রিয়ের আলাদা আলাদা শক্তি নিহিত আছে। এক ইন্দ্রিয়ের কাজ অন্য ইন্দ্রিয় করতে পারে না। এখন সিদ্ধ পুরুষ বলছেন, তপ বা পুনঃ পুনঃ অভ্যাসের দ্বারা এই ইন্দ্রিয় শক্তিকে যা ছিল বহির্মুখী, তাকে অন্তর্মুখী করতে হবে। অর্থাৎ বাইরের বিষয় থেকে সরিয়ে অন্তরের  বিষয়ের মধ্যে নিবদ্ধ করতে হবে। আমরা এতদিন বাইরের শব্দ শুনতাম  কানের সাহায্যে, এখন কানের এই শক্তির সাহায্যে আমাদের অন্তরের শব্দ বা ডাক বা ধ্বনি শুনতে হবে। আর একটা কথা বলছেন, আত্মাতে চিত্তকে  ধারণ করতে হবে। এখন কথা হচ্ছে, আত্মা কি তা আমরা জানি না। চিত্ত হচ্ছে মনের আয়না।  মন যা কিছু চিন্তা ভাবনা করে থাকে, সেই সবকিছু চিত্তে প্রতিফলিত হয়। তেমনি চিত্তে যা কিছু প্রবুদ্ধ   হচ্ছে, তাকে প্রতিফলিত করতে হবে আত্মা বা নিজের মধ্যে। যা আসলে আমি স্বয়ং। তাহলে স্বয়ং-এ প্রতিফলিত হবে চিত্ত।  চিত্তে প্রতিফলিত হবে মন. আর মনে প্রতিফলিত হবে ইন্দ্রিয়লব্ধ বিষয়। এই ইন্দ্রিয়লব্ধ বিষয় যদি বাইরের প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল বস্তু হয়, তবে মন, বা  চিত্তরূপ আয়নায় যাকিছু প্রতিফলিত হবে তাও প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হতে থাকবে। তাই সিদ্ধ পুরুষ বলছেন, ইন্দ্রিয়শক্তিকে বহির্মুখী না করে যদি অভ্যাসের দ্বারা অন্তর্মুখীন করতে পারি তবে আমার ভিতরে যে অক্ষর বস্তু বা অপরিবর্তনশীল অব্যয় বা অপ্রকাশিত বস্তু আছে, তা চিত্তরূপ আয়নায় প্রতিফলিত হবে। আর চিত্ত যদি স্বয়ং-আয়নায় প্রতিফলিত হয়, তবে আমরা নিজেকে বুঝতে পারবো, জানতে পারবো।

 সিদ্ধপুরুষ এর পরে বলছেন,  তপস্যারত সাধক সবসময় মনদ্বারা হৃদয়ের মধ্যে দর্শন করতে চেষ্টা করবেন। এখানে সিদ্ধপুরুষ দুটো জিনিসের কথা বলছেন, একহচ্ছে মন দ্বারা দেখতে হবে, আর দেখতে হবে হৃদয়ের মধ্যে। আমরা সাধারণত জানি চক্ষু দ্বারা আমরা  দেখে থাকি। এখানে বলছেন, মন দ্বারা দেখতে হবে। সহজভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে, হৃদয় মধ্যে। আসলে আমাদের মন যদি, বাইরের বস্তু গ্রহণ করবার জন্য প্রস্তুত না থাকে, তবে আমরা বাইরের বস্তু দেখতে পাই না। এই উপলব্ধি আপনাদের সবার আছে। মনোযোগ দিয়ে গান শুনবার সময়, আমরা অন্য কারুর কথা শুনতে পাইনা। তখন কেউ ডাকলে আমরা সারা দেই  না। আসলে চোখ থাকলে আপনি দেখবেন, কান থাকলে আপনি শুনবেন, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু মন যদি অন্যত্র থাকে, মন যদি অন্য চিন্তায় মগ্ন থাকে, তবে আপনি যা চোখের সাহায্যে দেখছেন, তা আপনার বোধের মধ্যে প্রবেশ করবে না।  অর্থাৎ বোধগম্য  হবে না। তাই সেই দিকথেকে বলতে গেলে মন-ই একমাত্র দেখে, চোখ নয়। আর একথাগুলো আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলোর জন্যই প্রযোজ্য।

সিদ্ধপুরুষ বলছেন, মন দ্বারা হৃদয়ের মধ্যে দর্শন করবে। এইবার কথা হচ্ছে, হৃদয় কি ও কোথায়, আর হৃদয়ের মধ্যে আমরা কি দেখবো ? আমাদের শরীরের মধ্যে যে হৃদযন্ত্র আছে, সেই হৃদযন্ত্রের কথা এখানে বলা হচ্ছে না। আসলে আমাদের বুকের  মধ্যে হৃদযন্ত্রের কাছে  একটা ফাঁকা জায়গা আছে। যেখানে আমরা শ্বাসক্রিয়া সাহায্যে বাইরের বাতাস দিয়ে প্রতিনিয়ত ভর্তি করছি, আবার খালি করছি। এই জায়গায় আমাদের মনকে গভীর ভাবে নিবদ্ধ করতে হবে। এখন কথা হচ্ছে, আমাদের শরীরের এত অঙ্গ থাকতে এখানে কেন মনকে বেঁধে রাখতে হবে ? আসলে এখানেই বাতাসের মধ্যে নিহিত আছে চৈতন্যশক্তি। এই চৈতন্যশক্তিকে আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। চৈতন্য শক্তিকে আমাদের ধরতে হবে। এইজন্যই সিদ্ধপুরুষ বলছেন, মন দ্বারা হৃদয়ের মধ্যে দর্শন করতে হবে।

সিদ্ধপুরুষ বলছেন, যখন সাধক  হৃদয়ে আত্মাকে যোগ  করতে পারবেন, তখনই তিনি একান্ত মনে হৃদয়ে পরম-আত্মার সাক্ষাৎ লাভে সমর্থ হবেন। অর্থাৎ মন যখন হৃদয়মধ্যে সন্ধানরত থাকবে, তখন ধীরে ধীরে ধীশক্তির সাহায্যে সে চৈতন্য শক্তিকে বাতাস থেকে আলাদা করতে সক্ষম হবেন। অর্থাৎ চমৎকারটা ঘটবে তক্ষুনি, আমরা   চৈতন্য শক্তি বা আত্মার সাক্ষাৎ করতে সমর্থ হবো । 

সিদ্ধপুরুষ বলছেন, মানুষ প্রথমে কল্পনার সাহায্যে কোনো বস্তুর রূপ দেখে। মানুষ স্বপ্ন দেখে একটি সন্তানের বা একটি বাড়ির বা গাড়ির। বাস্তবে তখনও কিন্তু সেই স্বপ্নের বস্তু রূপ পরিগ্রহ করে নি। পরিবর্তীকালে একসময় এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। তখন স্বপ্নের বস্তু রূপ পরিগ্রহ করে। ঠিক তেমনি সমাধিকালে সাধক বিশ্বরূপ আত্মাকে প্রতক্ষ্য করে, এবং এর পরে যখন ধ্যান ভঙ্গ  হয়, তখনও  তার আত্মা প্রত্যক্ষের অভিজ্ঞতা প্রবল থাকে।মুঞ্জা ঘাস থেকে তার বাইরের আভরণ ফেলে দিলে ভিতরের  বস্তু একটা তীক্ষ্ণ তীরে পরিণত হয়।অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য একসময় বিমর্ষচিত্তে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন।  মাঠের মধ্যে কুরু বংশের ছেলেরা বল নিয়ে খেলা করছিলো। তো খেলতে খেলতে বলটি একটা গভীর গর্তের  মধ্যে পড়ে যায়। তো ছেলেরা দ্রোণাচার্য্যকে দেখে বলটা তুলে দেবার জন্য অনুরোধ করলো। তখন দ্রোণাচার্য এই মুঞ্জা ঘাসের তীর দিয়ে বলকে বিদ্ধ করে, তীরের পিছনে পর পর কয়েকটা   তীর নিক্ষেপ করে, বলটিকে গর্ত থেকে তুলে নিয়ে আসেন। যাইহোক, আমাদের কথা হচ্ছে, আঁশ ছাড়ালে তীক্ষ্ণ তীর পাওয়া যায়। তেমনি দেহ থেকে আত্মাকে পৃথক করতে পারলে, আত্মাকে প্রত্যক্ষ করা যায়। অর্থাৎ স্থুল দেহের মধ্যেই আমাদের যে মনময় ও প্রাণময় দেহ আছে, সেই দুটো দেহকে আমাদের উপল্বদ্ধিতে আনতে  হবে। অর্থাৎ আমার শরীরে যে প্রতিনিয়ত বায়ুর গমন-নির্গমন চলছে, তার মধ্যেই ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছেন সেই চৈতন্যময়  শক্তি। তাকে উপল্বদ্ধিতে আনতে  হবে। আর সেই উপলব্ধি করবে আমাদের মনময় শরীর, অর্থাৎ আমাদের চিন্তা-ভাবনার শক্তি দিয়ে যে শরীর  গঠিত। স্থুল শরীরকে বাদ  দিয়ে এই ক্রিয়া করতে হবে। কিন্তু স্থূল শরীরে থেকেই সেটা করতে হবে। 

এবারে সিদ্ধপুরুষ বলছেন, এইসময় সাধকের কি হয় ? যোগী যোগবলে যখন আত্মাকে নিরীক্ষণ করেন, তখন কোনো শক্তি এমনকি ত্রিলোকের অধিপতিও তার উপরে আধিপত্য বিস্তার করতে পারেন না। তার মধ্যে সব অতিভৌতিক শক্তির জাগরণ হয়। এইসময় তিনি ইচ্ছামূর্তি ধারণ করতে পারেন। জরা-মৃত্যু-শোক-হর্ষ আর তাকে স্পর্শ করতে পারে না। তিনি এই অনিত্য স্থূল  দেহ ত্যাগ করে, অক্ষয় ব্রহ্মকে  লাভ করতে সমর্থ হন। 

সিদ্ধপুরুষ বলছেন, লোকক্ষয় আরম্ভ হলে, চারিদিকে মৃত্যু মিছিল দেখে, বা প্রকৃতির ধংসলীলা দেখেও তিনি বিচলিত হন না  তার মধ্যে কোনোরূপ ভয়ের সঞ্চার হয় না। সমস্ত প্রাণী যখন ক্লেশদগ্ধ তখন তিনি ক্লেশহীন। তার চাওয়া-পাওয়ার কিছু থাকে না। তিনি তখন সমস্ত শাস্ত্র নির্দেশের উর্দ্ধে, তার কাছে মৃত্যু বলে কিছু থাকে না। 

যাইহোক, এর পরে আমরা শুনবো ধ্যান-পরায়ণ হয়ে কিভাবে যোগলাভ করা যায়, বা ধ্যানের  মধ্যে আমরা  চৈতন্যের  সান্নিধ্য কিভাবে উপলব্ধি করবো  । সিদ্ধপুরুষ বলছেন, মনকে কখনোই আমাদের দেহের বহির্ভাগে স্থাপন করা উচিত নয়। আমাদের শরীরে মূলাধার  থেকে সহস্রার পর্যন্ত যে চক্র  আছে, অর্থাৎ মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান , মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধি, আজ্ঞা, সহস্রার ইত্যাদি যেসব চক্র  আছে, মনকে সেই চক্রে স্থাপন করতে হবে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমাদের মনের সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। ইন্দ্রিয় গুলোকে দমন করে, নির্জনে একাগ্রচিত্তে দেহের অভ্যন্তরে পূর্ণব্রহ্মকে চিন্তা করতে হবে। সত্য-সনাতন সেই ব্রহ্ম আমাদের স্থূল শরীরের সমস্ত অংশের মধ্যেই সদা দীপ্তিমান হয়ে আছেন। অতএব প্রথমে ব্রহ্ম আমাদের সমস্ত শরীরের মধ্যে আছেন, সেটা গভীর ভাবে চিন্তা করতে হবে।  এর পরে, বাড়ির মধ্যে রত্ন থাকলে, যেমন কোন ঘরে সে রত্ন  আছে, তার সন্ধান করি, ঠিক তেমনি, ইন্দ্রিয়সংযম করে, দেহের মধ্যে মনকে প্রবেশ করিয়ে, দেহের কোথায় এই ব্রহ্ম নামক রত্ন  আছে, তার সন্ধান করতে হবে। এইভাবে, গভীর অনুসন্ধানের দ্বারা শীঘ্রই তাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। জীব যত  আকুলভাবে তার অনুসন্ধান করবে, মনকে বুদ্ধিকে যত সে তীক্ষ্ণ করতে পারবে, তত তাড়াতাড়ি তাকে লাভ করতে পারবে। আসলে ইনিতো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নন। তাই মনরূপ চক্ষুপ্রদীপকে যত  আমরা উজ্জ্বল করতে পারবো, তত তাঁকে স্পষ্ট দেখতে পাবো। তার হাত-পা-চোখ-কান-মুখ-মাথা সবত্র বিদ্যমান আছে। সেই সর্ব্বশক্তিমান, এই বিশ্বের আদি-অন্ত -মধ্য সর্বত্র বিদ্যমান আছেন । যোগী প্রথমে দেহ থেকে ভিন্ন এই আত্মাকে দেহের মধ্যেই প্রতক্ষ্য করবেন। এরপর সেই আত্মাকে ব্রহ্মে লীন করে দিতে হবে, চিত্তকে নিরোধ করে, প্রফুল্ল  মনে নির্গুণ ব্রহ্মের  সাথে সাক্ষাৎকারে প্রবৃত্ত হতে হবে। এই নির্গুণ ব্রহ্মকে আশ্রয় করলেই মোক্ষ লাভ হয়। সিদ্ধপুরুষ একথা বলে, কাশ্যপমুনিকে বললেন, তোমাকে এই মোক্ষধর্ম্ম বিষয়ক রহস্যঃ  বললাম। এবার আমি প্রস্থান  করবো, তুমিও যথা ইচ্ছে গমন করতে পারো।  

শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, এই কাহিনী বলে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ আমাদের সবার সম্মুখ থেকে মুহূর্তের মধ্যে বাতাসে মিলিয়ে গেলেন। হে অর্জুন, আশাকরি তুমি এবার একাগ্র চিত্তে ব্রহ্মকথা শুনলে।  যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, হে পার্থ, যুদ্ধের সময় এই কথাগুলোই তোমাকে আমি যোগযুক্ত হয়ে  বলেছিলাম। চঞ্চলচিত্ত, অকৃতজ্ঞ, শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তি এইসব কথার যথার্থ অর্থ বুঝতে পারে না। এই ধর্ম্ম-উপদেশ দেবগণের কাছেও গোপনীয়। যাগ্-যজ্ঞ ইত্যাদি করে মানুষ দেবলোক প্রাপ্ত হয়। কিন্তু .জ্ঞানমার্গে  মানুষ মুক্তি লাভ করতে পারে।  এই আত্মদর্শনরূপ ধর্ম্ম ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শুদ্র-স্ত্রী-পুরুষ সবাইকেই পরমগতি লাভে সমর্থ করে তুলতে পারে। কেবলমাত্র ছয়-মাস প্রতিনিয়ত এই যোগসাধন করলে, যোগের ফললাভ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কি সে প্রক্রিয়া ? সেই প্রক্রিয়াই আজকের আলোচ্য বিষয়। 

ওম শ্রী কৃষ্ণায় নমঃ। ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ হরি ওম।   



No comments:

Post a Comment