Friday 15 May 2020

শ্রীকৃষ্ণ উক্ত প্রাণায়াম

 
শ্রীকৃষ্ণ উক্ত প্রাণায়াম।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বারোটি যজ্ঞের কথা বলেছেন। যজ্ঞ বলতে আমরা সাধারণত বুঝে থাকি, অগ্নিতে আহুতি দেওয়া, বা অগ্নিতে নিক্ষেপ করা । তা সে ঘি হতে পারেন, বেলপাতা হতে পারে। বা অন্য কিছু নিদিষ্ট দ্রব্য হতে পারে। কিন্তু ভগবান যজ্ঞের আরো গভীরে প্রবেশ করেছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, এমনকি ঋষি  পতঞ্জলি বলছেন, প্রাণায়াম করাটাও একটা যজ্ঞ। কিভাবে সেই কথাই আমরা আজ শুনবো। এমনকি যোগীশ্রেষ্ঠ দুটো প্রাণায়ামের কথা বলেছেন।  আমরা সেই দুটো প্রাণায়ামের কথাও শুনবো। 

ছোটবেলা থেকে খাবার আগে আমাদের পিতৃদেব একটা মন্ত্র আওড়াতে বলতেন। এই মন্ত্রটি আপনারা সবাই শুনে থাকবেন। সেটি হচ্ছে :

ব্রহ্মার্পনং ব্রহ্ম  হবির্ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মনা হুতম।
ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্ম্মসমাধিনা। (গীতা শ্লোক  ৪/২৪)

অর্থাৎ যাকিছু যজ্ঞাগ্নিতে অর্পণ করা হচ্ছে, সবই ব্রহ্ম।  ঘৃত ইত্যাদি ব্রহ্ম, যিনি অর্পণ করছেন, তিনিও ব্রহ্ম, অগ্নিও ব্রহ্ম।  এমনকি এই যে আহুতি প্রদান ক্রিয়া এটাও ব্রহ্ম। যজ্ঞকারী ব্যক্তির ব্রহ্মেই কর্ম্মসমাধি হয়েছে।  আর এর ফলে যে কর্ম্মফল প্রাপ্তি সেটাও ব্রহ্ম। 
যজ্ঞে আহুতি হলো প্রধান ব্যাপার। সেই আহুতি-প্রদান কর্ম্ম তখনই সার্থক বা পূর্ন  হয়, যখন সেই পদার্থটি অগ্নির রূপ ধারণ করে থাকে। আহুতি দ্রব্যের তখন আর পৃথক সত্ত্বা থাকে না। ঠিক তেমনি যত রকম সাধনক্রিয়া আছে, সেসব তখনই সার্থক হয়, যখন সেই সাধন ক্রিয়া যজ্ঞে পরিণত হয়। যজ্ঞের উদ্দেশ্য হচ্ছে, আত্মতত্ত্ব অনুভব করা। আমরা যখন যজ্ঞ করি, তখন আহুতি দেই দ্রব্যরূপ আমাদের ভাবনাকে।

জগতের স্বরূপ হলো, কার্য্য ও পদার্থ। এই যে প্রকৃতি, যা আমাদের সম্মুখে উদ্ভাসিত, তা আসলে কর্ম্মের রূপ মাত্র। পদার্থ কখনো স্থির ভাবে থাকে না। পদার্থ প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে রূপান্তর হয়েই চলেছে। তাই সমস্ত পদার্থকে বলা যেতে পারে, পরিবর্তনশীল ক্রিয়াপূঞ্জ। আমাদের আসক্তির জন্য, আমরা পদার্থগুলোকে গুরুত্ত্ব দিয়ে থাকি। কিন্তু আমরা জানি সমস্ত ক্রিয়াই লয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। অতয়েব জগৎ হলো, লয়রূপ ক্রিয়ার তাৎক্ষণিক ফল মাত্র। জগতের আমরা তিনটি অবস্থা সাধারণত দেখতে পাই, আর তা হলো, উৎপত্তি-স্থিতি-লয়। আর এই স্থিতিকাল এতটাই সামান্য যে এর উৎপত্তির আগের সময় ও লয়ের পরের সময়ের সঙ্গে বিচার করলে, এর কোনো স্থিতিকালকেই আমরা ধরতে পারি না। স্রোতের জলের স্থিতিকালের থেকেও কোটিভাগের এক ভাগ হবে কিনা সন্দেহ। জীবের দেহ প্রতিমুহূর্তেই নাশ হচ্ছে। এবং এই  পরিবর্তন এতটাই দ্রুত তালে সংগঠিত হচ্ছে, আমরা এটাকে ধরতে পারি না। 

ভগবান বলছেন, যজ্ঞাগ্নিতে যা কিছু সমর্পিত হচ্ছে, এবং যিনি সমর্পন করছেন, সবই ব্রহ্ম। এর পরে ৪/২৬নং শ্লোকে বলছেন, 
শ্রোত্রাদীনি-ইন্দ্রিয়াণি-অন্যে  সংয়ম-অগ্নিষু জুহ্বতি। 
শব্দাদীন বিষয়ান-অন্যে  ইন্দ্রিয়-অগ্নিসু জুহ্বতি। 
অর্থাৎ শ্রোত্র বা কর্ন ইত্যাদি ইন্দ্রিয়াগুলোকে সংযমরূপ অগ্নিতে আহুতি দিতে হবে। অন্যদিকে ইন্দ্রিয় যা গ্রহণ করছে, অর্থাৎ শব্দাদি বিষয়গুলোকে ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে আহুতি দিতে হবে।  একটু ভালোভাবে বিষয়টি বুঝবার চেষ্টা করি -আমাদের পাঁচটি জ্ঞান ইন্দ্রিয় - চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্ববা, ত্বক। আর এদের বিষয় হচ্ছে, রূপ, শব্দ, গন্ধ,রস, স্পর্শ।  ভগবান বলছেন, আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো যেন, এই বিষয়ের দিকে ধাবিত না হয়। সম্পূর্ণ সংযম তখনই  সম্ভব হবে, যখন এই পাঁচ ইন্দ্রিয় ও মন-বুদ্ধি-অহংকার এই সবগুলো থেকে অনুরাগ ও আসক্তি চিরতরে নাশ হয়ে যায়। অর্থাৎ শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ এইযে  বিষয়, এগুলো ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে কাজ করলেও, ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে যেন কোনো বিকার উপস্থিত না হয়। এই যজ্ঞ সম্পাদিত হলে,  অর্থাৎ আমাদের অনুরাগ ও আসক্তি সর্বোতভাবে নাশ হলে আমাদের পরমাত্মার প্রাপ্তি হবে। সংযম হলে আসক্তির লয় হয়, আবার আসক্তির লয় হলে সংযম হয়। 

এর পরে শ্লোকে বলছেন,
 সর্ব-ইন্দ্রিয়-কর্মাণি প্রাণ-কর্মাণি  চাপরে।
 আত্ম সংযম যোগাগ্নৌ জুহ্বতি জ্ঞানদীপিতে।  ৪/২৭ -
 অর্থাৎ যোগীগণ সমস্ত ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়াগুলো এবং প্রাণের ক্রিয়াগুলো জ্ঞানদ্বারা প্রকাশিত আত্মসংযম যোগরূপ অগ্নিতে হোম করে থাকেন। এর আগে আমরা সংযমের কথা শুনেছি, এবার বলছেন সমাধির কথা। এর আগে আমরা ইন্দ্রিয়ের আহুতির শুনেছি, এবার বলছেন প্রাণের আহুতির কথা। সমাধিকালে প্রাণকে অগ্নিতে আহুতি দিতে হবে। প্রথমে প্রাণকে রুদ্ধ করতে হবে। হঠযোগ যেমন বলছে, প্রাণকে কুম্ভকের সাহায্যে রুদ্ধ করা যায়, আবার  মনকে একাগ্র করলেও প্রাণের গতি স্বাভাবিক ভাবেই রুদ্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থাকে সমাধি বলা হয়ে থাকে। এখন কথা হচ্ছে, প্রাণের গতি যদি রুদ্ধ হয়ে যায়, তবে তো আমাদের মৃত্যু হয়ে যাবে।  না মৃত্যু হবে না। বর্ষা চলে গেলে পুকুরগুলো ধীরে ধীরে শুকোতে থাকে। পুকুরের মধ্যে যে সব প্রাণী ছিল, অর্থাৎ মাছ, ব্যাঙ, সাপ ইত্যাদি কোথায় গেলো ? বলবেন, মারা গেলো।  না সবাই মারা যায় না। আপনি খেয়াল করলে দেখতে পারবেন, আবার যখন বর্ষাকালে পুকুর জলে ভরাট হয়ে যায়, তখন রাতারাতি ব্যাঙের ডাকাডাকি শুরু হয়ে যায়। ছোট-ছোট মাছের খেলা, এমনকি  জলপোকার আবির্ভাব ঘটে। এগুলো কিভাবে হয় ? বর্ষার জল স্থির হলে, জলের মধ্যে যে পলিমাটি ছিল, সেগুলো থিতু হয়। আর পলির মধ্যেই এই সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীব এমনকি ব্যাঙ প্রায় প্রাণহীন অবস্থায় মাটির নিচে চাপা পরে থাকে। আবার বর্ষায় যখন মাটি নরম হয়, তখন এগুলো উপরে উঠে আসে, এবং আবার স্বশনক্রিয়া শুরু করে থাকে। সমাধিতেও মানুষ কয়েক ঘন্টা থেকে শুরু  করে, কয়েকদিন পর্যন্ত প্রাণক্রিয়া রুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে পারেন। তখন তার  না জীবিত  না মৃত অবস্থা, যাকে   জীবন্মৃত অবস্থা বলা হয়ে থাকে ।

ভগবান এর পরে বলছেন,   
অপানে জুহ্বতি প্রাণং প্রাণে-অপানং তথা পরে, 
প্রাণ-অপান গতিঃ রুদ্ধা প্রাণায়াম-পরায়ণাঃ।(৪/২৯)
 অর্থাৎ যোগীগণ প্রাণায়াম পরায়ণ  হয়ে, অপানে প্রাণকে পূরক করে, প্রাণ ও অপান -এর গতি রুদ্ধ করে, পরে প্রাণে অপানের আহুতি দেন।
 ৪/৩০ নং শ্লোকে বলছেন অপরে নিয়তহারাঃ প্রাণান প্রাণেষু জুহ্বতি , সর্বেঽঅপ্যেতে যজ্ঞবিদো যজ্ঞক্ষপিতকল্মসা।  

দ্রব্যযজ্ঞে দ্রব্য আহুতি দেওয়া হয়, তপযজ্ঞে তপস্যা করা হয়ে থাকে, জ্ঞানযজ্ঞে ঈশ্বরজ্ঞানের স্বাধ্যায় করা হয়ে থাকে, আবার প্রাণযজ্ঞে প্রাণকে জঠরাগ্নিতে আহুতি দেওয়া হয়ে থাকে। আমরা জানি, প্রাণবায়ুর অবস্থান বা ক্রিয়াক্ষেত্র হচ্ছে হৃদয়দেশ। অপান বায়ুর কার্যক্ষেত্র হচ্ছে নাভির নিচের স্থান। আর সমান বায়ুর কার্যক্ষেত্র হচ্ছে এই দুইয়ের মাঝখানে।
যোগী প্রথমে চন্দ্রনাড়ীর মাধ্যমে বায়ুকে গ্রহণ করে থাকে। একে বলে পূরক।এই সময় বায়ু হৃদয়ে অবস্থিত প্রাণবায়ুকে সঙ্গে করে, নাভি থেকে স্বাভাবিক ভাবেই অপানে লিন হয়ে যায়। এরপর প্রাণবায়ু ও অপান বায়ু রুদ্ধ করা হয়। একেই বলে কুম্ভক।  কুম্ভকের পরে আবার সূর্য্য নাড়ী দিয়ে রেচক করে থাকে। এর পর, সূর্যনাড়ী দিয়ে পূরক তারপরে কুম্ভক, অর্থাৎ বায়ুকে বদ্ধ করে রাখা, এবং শেষে চন্দ্রনাড়ী দিয়ে রেচক করা। রেচকের পরেও কুম্ভক করা হয়ে থাকে। এতে করে আমাদের ভিতরে যে অগ্নিশক্তি আছে, তা  জাগ্রত হয়ে থাকে।আর এই অগ্নিশিখায় প্রাণবায়ু-অপান বায়ু উদ্দীপ্ত হয়ে শুদ্ধ সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর  হয়ে ওঠে, অর্থাৎ তখন বায়ুর মধ্যে যে চেতন শক্তি আছে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবং তখন সে ব্রহ্মরন্ধ্রের খোঁজ করে, অর্থাৎ উর্দ্ধগামী হবার জন্য রাস্তা খোঁজে। এবং নির্মল  সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে যে বজ্রাক্ষা ও তার ভিতরে যে চিত্রাণি নাড়ী  আছে, বায়ুর সূক্ষ্মতা অনুযায়ী সেই  রন্ধ্র পথে উর্দ্ধমুখী হয়ে যায়। এই উপলব্ধি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তা হলে কি ভাবে প্রকাশ করা যাবে। আসলে যে কোনোদিন লংকা  খায়নি, তাকে বোঝানো কঠিন লংকা খেতে কেমন লাগে। আমরা সেইদিনই লংকার প্রকৃত স্বাদ বুঝতে পারবো, যেদিন আমার জিভে কেউ লংকা ঘষে দেবে।  
 
ভগবান বলছেন, যিনি পরিমিত আহার করেন, তারাই প্রাণকে প্রাণে আহুতি দিতে পারেন। শরীর ও মনকে যারা পবিত্র করতে পেরেছেন, কামনা-বাসনার উর্দ্ধে যারা উঠতে পেরেছেন, তারাই এই যজ্ঞ করবার যোগ্য।  প্রাণকে প্রাণে আহুতি দেবার অর্থ প্রাণকে প্রাণে ও অপানকে অপানে আহুতি দেওয়া। এবং প্রাণ ও অপানকে নিজ নিজ স্থানে রুদ্ধ করে রাখা। এই প্রাণায়ামের অভ্যাসে আমাদের বৃত্তিগুলো শান্ত হয়ে যায়। আর আমাদের পরম-আত্মার প্রাপ্তি হয়। 

সব শেষে বলি, প্রত্যেক যজ্ঞে যেমন যজমান ও পুরোহিতের প্রয়োজন, তেমনি প্রাণায়ামরুপ যজ্ঞেও সাধক ও গুরুদেব প্রয়োজন। গুরুভিন্ন এই যজ্ঞ নিষ্ফল। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।  
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                        
 
            

No comments:

Post a Comment