Wednesday 10 June 2020

মানসিক ও শারীরিক শান্তির পথ - যোগ

মানসিক ও শারীরিক  শান্তির পথ - যোগ 

আমাদের জীবনের সবথেকে বড়  সমস্যা হলো আমাদের মানসিক অশান্তি । পৃথিবীর অনেক ঐশর্য্য আমাদের হাতের মুঠোয় এসে গেছে, জীবন এখন অনেক সুযোগ-সুবিধায় ভরপুর হয়ে গেছে। আমাদের এখন কাঠের উনুনে রান্না করতে হয় না। বাজার করবার জন্য, এমনকি বাজারেও যেতে হয় না। ঘরে বসেই সব কিছু পেতে পারি। শারীরিক চিকিৎসা-বিদ্যার  উন্নতি যেমন হয়েছে, চিকিৎসা সহজলভ্য হয়েছে। কিন্তু রুগীর সংখ্যা  কমেনি। এখনো রান্না করা খাবার খেতে হয় ।  মানসিক চিকিৎসার জন্য মনোবিদ্যার প্রসার ঘটেছে। কিন্তু মানসিক অশান্তিও বেড়েছে। আসলে যতদিন আমি আমাকে ভালো রাখার কৌশল আয়ত্ত্ব না করতে পারবো, ততদিন আমাদের এই বাইরের সুযোগ সুবিধা আমাকে ভালো রাখতে পারবে না। 
আর নিজেকে ভালো রাখার কৌশল হলো, নিজেকে জানা।  নিজের মনকে জানা। আর এই মনের মধ্যে দুটো জিনিষ আমাদের মনকে অশান্ত করে ফেলে, তার মধ্যে একটা হচ্ছে, রাগ, আর একটা হচ্ছে ভয়। তো আজ আমরা এই ভয় সম্পর্কে দুচার কথা শুনবো। 
দারিদ্রতার ভয় : দেখুন যে যাই বলুক না কেন, পেটের  জ্বালা বড় জ্বালা। কথায় বলে পেটে  দিলে পিঠে সয়। আর এই জ্বালা সমস্ত শরীরধারীর, সমস্ত জীবের। অথচ আশ্চর্য্য ব্যাপার হচ্ছে, পৃথিবীতে যেমন বাসস্থানের অভাব নেই, তেমনি খাদ্যের অভাব নেই। ভগবান এমন কোনো জীব সৃষ্টি করেন না, যার খাবার পৃথিবীতে নেই। ভগবান আগে সৃষ্টি করেন খাবার, তারপরে সৃষ্টি করেন জীব বা প্রাণী। তাই উদ্ভিদের জন্ম হয় আগে, তার পরে প্রাণীর।  সন্তানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই মায়ের বুকে দুধ আসে। ফল পাঁকলে ফলের মধ্যে পোকা জন্মায়। আসলে পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সবার সঙ্গে খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক। তাই খাদ্য তৈরি হয় আগে, তারপরে খাদক।  আমার এই দেহ যখন প্রাণহীন হয়ে যাবে, তখন সেটা কারুর খাদ্য হয়ে যে পারে।  এমনকি আমি যে জীবিত আছি, এই অবস্থাতেই আমার শরীরে অসংখ্য কৃমিকীট আমাকে খেয়ে বেঁচে আছে। আসলে ভগবান আমাদের খাদ্যের অভাব রাখেননি। আমরাই কৃত্তিম অভাব তৈরি করেছি। এর প্রথম কারন হচ্ছে, সঞ্চয়, দ্বিতীয়তঃ খাদ্যের অপব্যবহার, তৃতীয়ত অসম-বন্টন ব্যবস্থা। আমাদের খাদ্য সংগ্রহশালায় বিপুল পরিমান, খাদ্য নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এক্শ্রেণীর মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে। এখন কথা হচ্ছে, এর থেকে পরিত্রানের উপায় কি ? আসলে আমাদের এই আলোচনা, সামগ্রিক সমস্যা মেটানো  নয়, আমাদের আলোচনা ব্যক্তির সমস্যা মেটানো।  আর ব্যক্তির সমস্যা মেটাতে পারলে, ধীরে ধীরে সামগ্রিক সমস্যাও মিটে  যেতে  পারে। 
দেখুন, আপনি গরিব হয়ে জন্মেছেন কি না, সেটা বড়  কথা নয়, আপনি গরিব হয়ে থাকতে চান কি না সেটাই  বড় কথা। আপনাকে প্রথমেই স্থির করতে হবে, আপনি বড়লোক হবেন কি না। আপনি গরিব থাকবেন কি গরিব থাকবেন না সেটা বড়  কথা নয়। আপনাকে ভাবতে হবে আপনি বড়লোক হবেন, কি হবেন না। দেখুন, আপনি যদি সামান্য আর্থিক ক্ষমতা অর্জন করতে না পারেন, তবে এটা নিশ্চিত যে আপনার অধ্যাত্ম জীবন কিছুতেই সম্পূর্ণ হতে পারেই না। তাই আমাদের উচিত অর্থ উপার্জনে মনোযোগ দেওয়া। আর এটা  করতে গেলে দরকার শুধু আপনার ভাবনার পরিবর্তন। আপনি আজ যাদের বড়োলোক দেখছেন, তারা সবাই অর্থচিন্তাতেই মগ্ন। আর আপনি আজ যা চিন্তা করবেন, ভবিষ্যতে আপনি সেটাই হবেন। অর্থ তার কাছেই আসে, যে সবছেড়ে  অর্থ চিন্তাতে  মগ্ন থাকে। তো আপনি সদর্থক ভাবে, ভগবানের কাছে চাইতে শিখুন। গরীব কেন গরীব থাকে জানেন, তারা সবসময় ভাবে আমরা গরীব।  আর এই ভাবনাই  তাকে চিরকাল গরিব করে রাখে। আমি বড়লোক  হবো, এই ভাবনা যখন তার মধ্যে আসবে, সেদিন থেকে তার পরিবর্তন  হতে থাকবে। আর বড়োলোক কখন গরীব হয় জানেন, যখন তার ভিতরে ধন হারানোর ভয় উৎপন্ন হয়। তো ভুলে যান আপনি গরিব ঘরে জন্মেছেন, ভুলে যান আপনি গরিব। আপনি যখনি বড়লোক হবার কথা ভাবতে শুরু করবেন , সেদিন থেকেই আপনার সামনে বড়লোক হবার উপায় এসে যাবে। আপনার কাজ হচ্ছে, সেই উপায় গুলোকে কার্যকরী করা। একটা কথা মনে রাখবেন, আজ আমরা যে অবস্থায় আছি, সেটা আমার পূর্ব্ব-পূর্ব্ব জীবনের ভাবনা ও কর্ম্মের ফল।  আর আজ আমি যা ভাববো, আজ আমি যা করবো, সেটা আমার ভবিষ্যৎ জীবন গড়ে দেবে । তাই অতীতে কি করেছিলাম, সে কথা ভুলে যান, কেবল সামনের দিকে নজর দিন। তাই আমি যদি ভবিষ্যতে ভালো থাকতে চাই, তবে আমাকে এখনই  তার ভীত গড়তে  হবে।ছোটবেলায় আমরা একটা খেলা খেলতাম, সেটা হচ্ছে, লাঠি দৌড়। প্রত্যেক দলে চারজন করে ছেলে থাকতো, লাঠি থাকতো একটা। তো একজন লাঠিটা নিয়ে একটা গোলাকার বৃত্তকে পাক দিয়ে, পরবর্তী জনকে দিয়ে দিতো, সে আবার বৃত্তকে পাক দিয়ে লাঠিটাকে পরের জনকে  দিয়ে দিত। জীবন একটা লাঠি দৌড়। আপনি আজ যা সংগ্রহ করছেন, তা আপনার পরবর্তী জীবনের জন্য সঞ্চয়। তা সে জ্ঞান সঞ্চয় বলুন, বা ধন সঞ্চয় বলুন। আমরা আগের জীবনে যা রেখে গিয়েছিলাম, আজ আমি সেখান থেকেই শুরু করবো। জ্ঞান সঞ্চয় আপনার সূক্ষ্ম শরীরের কাজে লাগবে। ধন আপনার স্থূল শরীরের কাজে লাগবে। তো আজ থেকেই শুরু করুন, আপনার ভবিষ্যতের সঞ্চয়। আপনি কি নিয়ে এসেছিলেন, সেটা ভুলে যান, আপনাকে কি নিয়ে যেতে হবে সেটার জন্য প্রস্তুত হোন।    
অসুস্থতার ভয় : শরীর  খারাপের ভয়। কিছু লোক আছেন, যারা সারাক্ষন কেবল শরীর  নিয়েই চিন্তা করতে ভালোবাসেন। বিশেষ করে, তারা সারাক্ষন তাদের অসুখ-বিসুখ নিয়ে কথা বলতে ভালো বাসেন। এরা  আসলে মানসিক রুগী। এরা সবসময় কল্পিত অসুস্থতার ভয়ে তটস্থ হয়ে আছেন। আর এই নেতিবাচক ভাবনা আমাদের শরীরকে অসুস্থ হবার রসদ যোগাচ্ছে । তবে, স্বস্তির কথা হচ্ছে, আমরা ছোটবেলায় শুনতাম, সব রোগের  ঔষধ আছে, মনের রোগের ঔষধ নেই। আর এই কারণেই আমাদের কুলগুরুরগন, একটা সন্মানীয় জায়গা পেতেন। কারন এই গুরুদেবের কাছেই, আমাদের মনের রোগের  ঔষধ অর্থাৎ সৎ-পরামর্শ পাওয়া যেত।  আজ অবশ্য সেই দিনটা পাল্টে গেছে। এখন কুলগুরুর সংখ্যা কমে গেছে, যদিও এখনো ধর্ম্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সেই কাজ করে যাচ্ছে। তবে, বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে, এখন ডাক্তাররাও শরীরের রোগের  সাথে সাথে মনের রোগের  চিকিৎসা শুরু করেছেন। এবং ডাক্তাররাই বলছেন, বা বুঝেছেন, আমাদের মানসিক দ্বন্দ্ব, আমাদের ভয়, আমাদের দুশ্চিন্তা নানান রোগের কারন। মাথাব্যথা, বদহজম, আলসার, চর্মরোগ, এমনকি বাতের বেদনা, আমাদের ক্লান্তি, অনিদ্রা, পেশির খিঁচুনি, আমাদের কিডনির অসুখ, এমনকি মানুষ যে পাগল হয়ে যায়, এগুলো সবই মানসিক ভারসাম্যহীনতা থেকে হয়ে থাকে। আর এই সব রোগ থেকে বাঁচতে গেলে, আমাদের তথাকথিত ডাক্তারের কাছে না যেয়েও আমরা শুধু আমাদের ভাবনার পরিবর্তনের সাহায্যে এইসব রোগের  নিরাময় করতে পারি।
আর এই পথের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে, আমরা যেন কেউ কাল্পনিক রোগ নিয়ে বাস না করি। আমরা যেন সব সময় নিজেদেরকে সুস্বাস্থের অধিকারী ভাবি। এমনকি আমরা যদি, কোনো আঘাতের সাহায্যে ক্ষতিগ্রস্থ হই, সেটা সারানোর জন্য ডাক্তারের কাছে যাওয়া নিশ্চই প্রয়োজন, তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, আমি যেন মানসিক দিক থেকে ভেঙে না পড়ি। আমি যেন নিজেকে বোঝাতে পারি, যে শরীর  থাকলে রোগ হতেই পারে। এর জন্য উদ্বিগ হবার কিছু নেই।  আর উদ্বিগ্ন হলেতো আমার অসুখ সেরে যাবে না। বরং উৎফুল্ল হলে শরীর নিরাময় সহজ হবে। ডাক্তারবাবু যখন আমাদের ইনজেকশন দিতে আসেন, ভয়ে আমাদের মাংশপেশী শক্ত হয়ে যায়। আর আমাদের মাংসপেশি যখন শক্ত হয়ে যায়, ডাক্তারবাবুর পক্ষে তখন ইনজেকশন দেওয়া কঠিন হয়ে যায়।  এমনকি আমাদের পেশী তখন ছিঁড়ে যায় আর  বেশী ব্যথা হয়। অর্থাৎ পেশী অনমনীয় হওয়ায় পেশী ছিঁড়ে যেতে পারে। ঠিক তেমনি, শরীর নিরাময়ের জন্য, আমাদের শরীরের ভিতরেই যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া সংগঠিত হয়, সেই প্রক্রিয়ায় আমাদের সাহায্য করা উচিত। আমার যদি কোথাও কেটে যায়, আমি ডাক্তারের কাছে যাই না। আমার মনের ডাক্তারকে সেখানে পাঠিয়ে দেই, আর বিশ্বশক্তির কাছে নিরাময়ের দায়িত্ত্ব ছেড়ে দেই। আমি কাটা  স্থানে আমার নিজের মূত্র লাগিয়ে দেখেছি, রক্তপড়া তৎক্ষণাৎ বন্ধ হয়ে যায়। 
রোগ সারাবার সবচেয়ে বড় ঔষধ হচ্ছে, মনের জোর বা মনের বিশ্বাস।  আপনার যে ডাক্তারের প্রতি বিশ্বাস নেই, তার কাছে হার্গিস যাবেন না।  কারন তার কাছে আপনার অসুখ সারবে না। তার চেয়ে অচেনা ডাক্তারের কাছে যান। আপনি ঔষধ খাবার সঙ্গে সঙ্গে যদি বিশ্বাসকে দৃঢ় করতে পারেন, তবে আপনার শরীর সেই ঔষধের  ক্রিয়াকে সহযোগিতা  করবে।  এবং আপনি দ্রুত ভালো হয়ে যাবেন। 
আমরা আগেই শুনেছি , আপনার আমার শরীরে দুজন ডাক্তার আছেন। তারা হচ্ছে, আমাদের স্বাস-প্রশ্বাস। এই শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে  নিয়ন্ত্রণ করবার  বিদ্যা যার জানা আছে, তিনি সর্বদা সুস্থ থাকেন। সবশেষে বলি, অসুস্থতার কথা ভুলে যান। সমস্ত রোগ আপনি ডাক্তারকে দিয়ে দিন।  সমস্ত ঔষধ আপনি ড্রেনে ফেলে দিন, মন থেকে সমস্ত অসুখভীতি  দূর করে দিন। আপনি অবশ্য়ই সুস্থ থাকবেন। ভগবান আমাদের এই শরীর তৈরি করেছেন,  প্রকৃতিকে অবহেলা করলে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। আর এই অসুস্থতাকে কাটিয়ে উঠবার জন্যও তিনি আমাদের মধ্যেই নিরাময়ের ব্যবস্থা  দিয়েছেন। শুধু সেই ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখুন, ও আর আমাদের মুনি-ঋষিদের কথা অনুযায়ী জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করুন।  তাহলে আমাদের সমস্ত শারীরিক সমস্যা দূর হয়ে যাবে।  
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি  ওম। 

জীবন সমস্যার সমাধান। (১)

আমাদের শরীর খারাপ হলে শারীরিক চিকিৎসকের কাছে যাবো। মন খারাপ হলে মানসিক ডাক্তারের কাছে যাবো।এটাই বিজ্ঞানসম্মত। এর বাইরে জীবসমস্যার আর কোনো সমাধানের রাস্তা আছে, তা আমাদের জানা নেই। আজ আমরা সেইসব কথাই শুনবো।  প্রাচীন ভারতবর্ষে  বিজ্ঞান সম্মত আরো একটি রাস্তা ছিল, যা আসলে আজ লুপ্ত বিদ্যা, আজ আমরা সেই সব কথা শুনবো। 

আমার মাঝে মাঝে মনে হয়,  ভালো থাকার জন্য আমরা জন্মাই  না। আমরা কেবলমাত্র  সারা জীবন ভালো থাকার লড়াই করবার জন্য জন্মাই। আর এইজন্য সারা জীবন লড়াই করে করে ক্লান্ত হয়ে একসময় মৃত্যুর মুখে ঢোলে পড়ি। এই লড়াই থেকে আমাদের সরে দাঁড়াতে  হবে। মনে আছে, আমি একদিন নিজের মনে, রেলস্টশনে দিয়ে হেটে টিকিট কউন্টারের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি কিছু লোক হুড়মুড় করে দৌড়াচ্ছে। আমি পেছন দিকে তাকালাম, দেখি একটা শীর্ণকায়  পাগল হাতে একটা কাটারি নিয়ে দৌড়ে  আসছে। আমি ওর পথ ছেড়ে পাশে দাঁড়ালাম। পাগলটি আমাকে কিছু বললো না, কিন্তু যারা প্রাণভয়ে ছুটছে তাদের দিকে তারা করে এগিয়ে গেলো। আপনি বলতে পারেন, পাগলটা তো আপনাকেও মারতে পারতো। নিশ্চই পারতো, কিন্তু প্রথমত আমি জানতাম ও আমাকে মারবে না। কারন ওকে আমি খেপাইনি, আর ওকে আমি ভয় পাইনি। পাগল দুই ধরনের মানুষের দিকে তেড়ে যায়, যারা খেপায়, আর যারা ভয় পায়। তো আমি সেই দলের কেউ নোই। 

আসলে আমরা যারা ভীতু, আর যারা অন্যকে বিরক্ত করে বা বঞ্চিত করে  আনন্দ পাই,  তাদেরকে বিভিন্ন ভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।  ঠিক তেমনি, জীবনে যারা নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে দিয়ে চলেন, সময় থাকতে যারা সাবধান থাকেন, সময়মতো যারা কর্তব্য পালন করেন,  তাদের জীবনে আকস্মিক দুর্ঘটনা বলে কিছু হয় না। আসলে তারা  ভবিতব্য সম্পর্কে সম্যক  অবহিত থাকেন,  তাই ঘটনা তাদেরকে বিব্রত করতে পারে না। 

আমি লক্ষ করেছি, মানুষের মধ্যে একটা অসন্তোষ কাজ করছে। নিজে সম্পর্কে সে সন্তুষ্ট নয়, যাদের সঙ্গে সে মিশছে, তাদের প্রতি সে সন্তুষ্ট নয়, কর্ম্মস্থলে বসেদের প্রতি সে অসন্তুষ্ট, দেশনায়কদের প্রতি অসন্তুষ্ট, এমনকি নিজের স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে-আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি সে অসন্তুষ্ট। আর এই অসন্তোষ আমাদের মধ্যে একটা মানসিক সংঘাত একটা মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে। আর এই মানসিক সংঘাত ও মানসিক চাপ আমাদের শারীরিক ভাবে অসুস্থ করে তুলেছে। তখন আমাদের জীবন  অর্থহীন ও উদ্দেশ্যহীন মনে হয়। যারা নিজেদের মধ্যে অসন্তোষের স্তুপ নিয়ে ঘুরছেন, তারা সময় সুযোগ পেলেই অসন্তুষের বোঝা অন্যের ঘরে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন। এটাই স্বাভাবিক। তাই অসন্তুষ্ট ব্যক্তির সংখ্যা যখন বেড়ে যায়, তখন অসন্তুষ্ট-বিশৃঙ্খল  সমাজের তৈরী হয়। অর্থাৎ শারীরিক রোগ  যেমন  সংক্রামক   হতে পারে, আমাদের মানসিকরোগও   তেমনি সংক্রামক হতে পারে।

আমরা বেকার থাকতে অসন্তোষের বোঝা নিয়ে ঘুরি।  যেকোনো চাকরির সুযোগ হাত ছাড়া করতে চাই না। কিন্তু চাকরিটা পেলেই, তার কাজের ধরণ, তার কাজের সময়, ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে নিজের মধ্যে একটা নিজস্ব  দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলি। আর এই দৃষ্টিভঙ্গি, যখন ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করতে পারি না, তখন আমাদের মধ্যে আসে হতাশা। আর এই হতাশা থেকে তৈরী হয়, একধরনের ক্ষতিকর মনোভাব। আমাদের তখন মনে হতে থাকে, চারিদিকে আমাদের শত্রূ ঘোরাফেরা করছে। আর তখন শুরু হয়, এইসব কাল্পনিক  লড়াই, যাতে আমাদের  জীবনীশক্তি নষ্ট হয়। এইভাবে নিজেকে যেমন দুর্বল করে ফেলি, তেমনি আবার অন্যদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলি। এ থেকেই সৃষ্টি হয়, মানসিক রোগ, দুশ্চিন্তা, এমনকি এই মানসিক দুশ্চিন্তা থেকে তৈরি হয়, নানান রকম শারীরিক রোগ। যা আমাদের জীবনকে শোচনীয় ভাবে পরাস্থ করে। 

এখন কথা হচ্ছে, এর প্রতিকার কি ? মনোবিজ্ঞানীগন বলবেন, মনঃ সমীক্ষার দ্বারা এই ধারণার পরিবর্তন সম্ভব। বুদ্ধিগম্য প্রশ্নের মাধ্যমে মনোবিজ্ঞনীগন আমাদের ব্যাক্তিত্ত্বের গভীরতা বুঝতে চেষ্টা করেন। আমাদের কাছে অজানা যে মানসিক জটিলতা আছে, তা তিনি আমাদের ধরিয়ে দিতে পারেন।  তিনি বলতে পারেন, আমাদের ভুল কোথায় ? আপাতত মনে হতে পারে, এই পদ্ধতি ঠিকই আছে।  কেউ কেউ উপকার পেয়েছেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, এই পদ্ধতিতে মনোবিজ্ঞানী  তার নিজের অভিজ্ঞতার সাহায্যে অপরের সন্মন্ধে জানতে চান। মানব মনের গভীরতায় তাদের পৌঁছনো সম্ভব নয়। তারা চেতন মন ও অবচেতন মনের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব চলছে, সেটাকে ধরে, আচরণের মধ্যে প্রকাশকে ধরতে চেষ্টা করেন। চেতন মনের চাহিদা ও অবচেতন মনের চাহিদার মধ্যে তারা পার্থক্য ধরে, মনোবিজ্ঞনী অবচেতন মনের চাহিদা পূরণের জন্য উপদেশ দিয়ে থাকেন। এতে ফল ভালো না হয়ে খারাপও হতে পারে। এখন তাহলে উপায় কি ?

এইখানেই ভারতের প্রাচীন যোগশাস্ত্র আমাদের সাহায্য করতে পারে। যোগ কখনো, অবচেতন মনের চাহিদা পূরণের কথা বলে না।  যোগ বলে অবচেতন মনের সংস্কারের শুদ্ধিকরণ। শুদ্ধিকরণ মানে পরিবর্তন নয়। শুদ্ধিকরণ মানে ঘষেমেজে পরিষ্কার করা  ও  আমাদের প্রকৃত স্বভাবকে পরিস্ফুট করা। পবিত্রতা মানুষের প্রকৃত স্বভাব। প্রত্যেক জীবের যেমন নিজস্ব স্বভাব আছে, ঠিক তেমনি মানুষেরও জাতিগত একটা স্বভাব আছে। আর তা হচ্ছে পবিত্রতা। এটাই মানব-আত্মার সত্যিকারের স্বভাব বা স্বরূপ। মানুষের এই প্রকৃত স্বভাবের সন্ধান পেয়েছিলেন আমাদের মুনিঋষিগন। বিজ্ঞান দুটো মনের সন্ধান জেনেছে। কিন্তু আমাদের মুনিঋষিগন আরো একটা মনের সন্ধান জানতেন।  আর তা হচ্ছে অতিচেতন মন। জাগ্রত অবস্থায় আমাদের চেতন মন কাজ করে, স্বপ্নাবস্থায় আমাদের অবচেতন মন কাজ করে, আর তুরীয় অবস্থায় আমাদের অতিচেতন মন কাজ করে। আর এই তুরীয় অবস্থার মাধ্যমেই আমরা আমাদের উচ্চতর মানবাত্মার সন্ধান পেতে পারি। এই অতিচেতন মন থেকেই আমাদের আত্মজ্যোতি প্রতিফলিত হয়। এই আত্মজ্যোতিস্বরূপ জ্ঞান আলোক আমাদের অবচেতন মনের মলিনতাকে দূর করতে পারে। আর তখনই চেতন মন ও অবচেতন মনের সঙ্গে সহযোগিতা গড়ে ওঠে। এবং আমাদের বিভিন্ন মনের যে দ্বন্দ্ব যা আমাদের মানসিক চাপ বলে মনে হয়, তা দূরীভূত হয়। অন্তরের  শান্তি  ও মনের সমন্বয় অর্জনের জন্য, মনের এই তুরীয় অবস্থার সন্ধান করতে হবে। আর জ্ঞানাতীত এই তুরীয় অবস্থা সন্ধানের নামই সাধনা। আর এই অবস্থায় পৌঁছলে আমাদের যে অনুভূতি হয়, তাকেই বলে আত্মোপলব্ধি। এই অবস্থা লাভের  ফলে আমাদের মনের সংহতি, শান্তি, সাম্যাবস্থা স্বাভাবিক  ভাবেই এসে যায়। 

কিন্তু কথা হচ্ছে, শারীরিক চিকিৎসার জন্য ডাক্তার, বা মনের চিকিৎসার জন্য মানসিক ডাক্তার আমরা সহজে পেতে পারি। কিন্তু আত্মউপল্দ্ধির জন্য সহায়ক আমরা কোথায় পাবো ? এর জন্য প্রথমদিকে আমাদের বিষয়গত তথ্য জানবার জন্য সৎ গ্রন্থ পাঠের প্রয়োজন। স্থুল জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজন।  কিন্তু কেবল মাত্র বই পড়ে বা কারুর কাছ থেকে শুনে এই পথে বেশিদূর এগুলো যায় না। সঠিক পথ আপনাকেই বেছে  নিতে হবে। এর জন্য কিছু যোগক্রিয়া আছে, সেগুলো সম্পর্কে জানতে হবে। সেগুলোর সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। দোকান থেকে ঔষধ কিনে খেতে পারি। কিন্তু রোগের  মাত্রা বুঝে  ডাক্তারবাবু যেমন ঔষধের মাত্রা ও প্রয়োগ বিধি  নির্দিষ্ট করে দেন, সেরকম আমাদের এই শাস্ত্র-প্রয়োগে যারা অভিজ্ঞ আমাদের তাদের কাছে যেতে হবে। আর এইজন্য বিভিন্ন আশ্রম আছে, যেখানে এই অভিজ্ঞ সন্তের সন্ধান পাবেন। আমরা যেমন ডাক্তারবাবুদের কাছে সমর্পিত হয়ে, ডাক্তারবাবুর চাহিদা পূরণ করে, তার উপদেশের  প্রত্যাশী হই। এবং তার নির্দেশ মতো ঔষধ সেবন করি এক্ষেত্রেও জীবন যন্ত্রনা  থেকে  রেহাই পাবার জন্য আমাদের সন্ত মহাত্মাদের আদেশ/নির্দেশ যাঞা করতে হবে। এবং সেইমতো কর্তব্য পালন করতে হবে। আর এই যোগক্রিয়া হচ্ছে কর্ম্মযোগ, রাজযোগ, ভক্তিযোগ, জ্ঞান যোগ। এগুলো সবই একটার সঙ্গে আর একটা সম্পর্ক যুক্ত। আমরা সব মানুষকে সমান বলি  বটে, কিন্তু বাস্তব হচ্ছে, পরিবেশ যেমন মানুষের স্বভাবের মধ্যে প্রভাব ফেলে, ঠিক তেমনি, আমরা সবাই এক-জন্মের মানুষ নোই। যে যত বেশি মনুষ্যজন্ম লাভ করবার সুযোগ পেয়েছেন, যত  বেশি জীবনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ পেয়েছেন , তার মানবাত্মার উন্নতির ধারাও সেইমতো প্রবাহিত হচ্ছে। তাই সব মানুষের চিন্তাধারার মধ্যে একটা পার্থক্য লক্ষ করা যায়। আর এই পার্থক্য অনুযায়ী যোগের ঔষধ প্রয়োগ করতে হয়। আমরা ধীরে ধীরে এইসব আলোচনা শুনবো।  আজ বাক্যের বিরাম দিলাম।  

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম।
  
 জীবন সমস্যার সমাধান ( ২) গূঢ় সাধন জীবন। 

প্রকৃতি বৈচিত্রময়।  প্রকৃতি রহস্যময়। এই রহস্যঃ, এই বৈচিত্র কেন ? বৈজ্ঞানিকের  বুদ্ধি দিয়ে বা পন্ডিতের পান্ডিত্য দিয়ে, এই সত্যের স্বরূপ প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কেন ফুলে গন্ধ হয়, কেন বিভিন্ন ফুলে বিভিন্ন রকমের  গন্ধ   হয়, কেন ফুলের রং আলাদা আলাদা। কেন প্রত্যেক মানুষ আলাদা, কেন মানুষ হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকে না। এই রহস্যঃ উন্মোচন করবে কে ? বিজ্ঞান কেবলমাত্র কিভাবে হয়, সেটা বলতে পারে বড়োজোর। কিন্তু কেন হয় - সেকথা বলতে পারে না। ঘুমিয়ে থাকলে কেন আমরা ঠিক এমনিতর একটা বিশ্ব  দেখতে পাই।  ঘুম ভাঙলে কেন তাকে দেখতে পাই না। এইসব কথা পণ্ডিত বা বিজ্ঞানী বলতে পারে না। এর জন্য দরকার সূক্ষ্ম ও গূঢ় সাধন জীবন। শরীর - মন - বুদ্ধি - স্মৃতি আবার চারিদিকে এই যে বৈচিত্রময় জগৎ এ এক মাজার ব্যাপার। এসবের আদৌ কোনো অর্থ আছে কি ? নিরাকার থেকে সাকারের জন্ম। কিন্তু কথা হচ্ছে দরকারটা কি ? এর কোনো উত্তর নেই। মায়াশক্তির এইযে ভাঙা-গড়ার খেলা এর কোনো যুক্তিসংগত কারন নেই। জগৎ পরিবর্তনশীল, কিন্তু কেন পরিবর্তনশীল, তার কোনো জবাব নেই। কেউ বলে, ঈশ্বরের ইচ্ছে, কেউ বলে বলে এসবি ঈশ্বরের লীলা-খেলা। জগৎ কেন অনিত্য ? পঞ্চভূত কেন মিলিত হয়ে এই দেহ তৈরি করে থাকে ?এইসব কিছুর জবাব নেই।একটা কথা বলতে পারেন, মানুষ কেন ভালো থাকতে চাই ? এইসব প্রশ্নের ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তবে এই সব প্রশ্নের উর্দ্ধে ওঠা যায়। 

ঈশ্বর ঈশ্বর করে থাকি  আমরা অনেকেই। কিন্তু যে ঈশ্বরের অনুভূতি আমার মধ্যে জাগ্রত হয় নি, সে ঈশ্বরে আমার কি কাজ ? এইজন্য বলা হয়ে থাকে ঈশ্বর আছে কি নেই, এই সিদ্ধান্ত নেবার আগে, যারা ঈশ্বরকে অনুভব করেছেন, তাদের পথ অনুসরণ করে দেখো।  কিঁছু অনুভব করতে পারো কি না। আমরা আসলে যারা ঈশ্বর অনুভব করেন  নি, তাদের চতুর সুমধুর বাক্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আছি। আর আমরা ঈশ্বর থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আছি। ঈশ্বর কোনো কল্পনার বিষয় নয়, ঈশ্বর কোনো বুদ্ধির বিষয় নয়, ঈশ্বর কোনো যুক্তির বিষয় নয়, ঈশ্বর অনুভূতির বিষয়। আর স্বয়ং যতক্ষন না সেই অনুভূতির নাগাল পাচ্ছেন, ততক্ষন আমরা কেউ ঈশ্বর আছেন, এই কথা বলবার অধিকার আমাদের নেই। যোগবিদগন বলছেন, যোগের সাহায্যে এই অনুভূতির স্পর্শ অনুভব করা যায়। 

যোগাচার্য্য বলছেন, যোগের সাহায্যে আমরা এই জ্ঞানাতীত স্তরে উন্নীত হতে পারি।  আর এই জ্ঞানাতীর অনুভূতিই সমস্ত ধর্ম্মের মূল। এই জ্ঞানাতীর অনুভূতি লাভ করেই তথাকথিত শিক্ষা অর্জন না করেও ঠাকুর রামকৃষ্ণ, পরমহংস হয়েছিলেন। যিশুখ্রিস্ট লক্ষ-কোটি মানুষের প্রভু হতে পেরেছিলেন। মহম্মদ পয়গম্বর হয়েছিলেন। নিমাই হয়েছিলেন শ্রীশ্রী চৈতন্যদেব। এই জ্ঞানাতীত অবস্থায় যেতে গেলে, আমাদের অন্তরের অন্তস্থলে ডুব দিতে হবে। আমরা কেউ কেউ বিশ্বাস করি, মন্দিরে দেবতা  আছেন। এর কোনো সত্যতা আছে, তা আমরা জানি না।  ঠিক তেমনি মনে করুন না, দেহ-মন্দিরে মানব-আত্মা বা জীবাত্মা আছেন। আরো একটু এগিয়ে গিয়ে মনে করুন না আমাদের সবার অন্তরে ঈশ্বর বা পরমাত্মা আছেন। এইবার এর অনুসন্ধান করুন।  সত্যিই তিনি আছেন কি না। এই সন্ধানের পদ্ধতিই হচ্ছে যোগ। আমরা সবাই আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র দেখতে পাই। সেই দিক থেকে গেলে আমি একজন দ্রষ্টা। আবার কেউ কেউ আছেন, মানুষের মনের কথা জানতে পারেন, এই মনের কথা যিনি জানতে পারেন, তিনিও একজন দ্রষ্টা। তাহলে মনের ভিতরে দেখারও একটা চোখ আছে আমাদের সবার। এইবার মন থেকে সূক্ষ্ম হচ্ছে আমাদের অন্তর এই অন্তরকে যিনি পর্যবেক্ষন করতে পারেন তিনি  সত্যদৃষ্টা ঋষি। আর এই দৃষ্টিকেই বলা হয়ে থাকে দিব্যচক্ষুর দ্বারা দেখা। যা আমাদের সবার মধ্যে প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। এই দিব্যচক্ষুকে আমাদের উন্মিলিত করতে হবে। তবেই আমরা ঈশ্বরকে দেখতে পারবো। তিনি কোথায় কি করছেন, সবই আমরা তখন দেখতে পারবো। আর এটাকেই বলে আত্মদর্শন। অর্থাৎ নিজেই নিজেকে দেখা। 

এখন কথা হচ্ছে, এই দিব্যচক্ষু উন্মিলিত করতে অসুবিধা কি ? বেদান্ত মতে এই অসুবিধা হচ্ছে, আমাদের অজ্ঞান, আমাদের অবিদ্যা। যা আমাদের দিব্যচক্ষুকে ঢেকে রেখেছে। তো আমাদের কাজ হচ্ছে , চোখের উপরথেকে এই অজ্ঞানস্বরূপ আভরণতাকে সরিয়ে ফেলা।  ব্যাস কেল্লা ফতে।  এইবার চোখ অর্থাৎ দিব্যচক্ষু তখন সবকিছুকে উদ্ভাসিত করে দেবে। যোগ দর্শন বলছে, অনিত্য, অপবিত্র, দুঃখকর পদার্থে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে, আর সেটাকেই আমরা সত্য বলে মনে করছি। এটি আসলে আমাদের ভ্রম। এই ভ্রম আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে।  তবেই আমরা সত্যের সন্ধান পাবো। 

এখন কথা হচ্ছে, কিভাবে এই অবিদ্যাকে অতিক্রম করে জ্ঞানাতীত অনুভূতি সম্পন্ন হবো ? আসলে উত্তমকুমারকে আমি সিনেমায় রাজা হিসেবে দেখছি। যতক্ষন আমি সিনেমা দেখছি, ততক্ষন আমি উত্তমকুমারকে রাজাই ভাববো। কিন্তু আমি জানি, উত্তমকুমার রাজা  নয়, এই সত্য তখনই আমার উপল্বদ্ধিতে আসবে, যখন আমি জানবো সে রাজা সেজেছে। উনি নিতান্তই আমার মতো সাধারণ প্রজা।
তো আমাদের বোঝার চেষ্টা করতে হবে, সত্যিকারের রাজা কে, আর সাজানো রাজা কে ? আসলে অবিদ্যাকে অবিদ্যা রূপেই সহজে জানা যায় না। অর্থাৎ আমরা যখন সিনেমা দেখি, তখন যা কিছু দেখছি, সবই তখনকার মতো সত্য বলেই মনে হবে। অবিদ্যার প্রথম স্তর  হচ্ছে অহংকার যা আত্মাকে ঢেকে রেখেছে। এর আসে আসক্তি বা বাসনা। এদের যখন আপনি সরাতে যাবেন, তখন আসবে ক্রোধ অথবা ভীতি। আমরা অজ্ঞান জনিত অহংবোধ এবং এর সহজাত প্রবৃত্তির কারনে এই জগতে বদ্ধ অবস্থায় পরে আছি। আজকালকার মনোবিজ্ঞনীগন তিন রকম মানসিক জটিলতার কথা বলে থাকেন। কামানজনিত, অহংকারজনিত, এবং সম্প্রদায় বা গোষ্ঠিজনিত।  এই মানসিক জটিলতার থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। তবেই আমরা আধ্যাত্মিক জীবন শুরু করতে পারবো। এই মানসিক জটিলতা কাটিয়ে উঠবার জন্য আমাদের ভিতরে ভিতরে যে সংগ্রাম করতে হয়, তাকেই বলে আধ্যাত্মিক জীবনীর সংগ্রাম। এমন ভাবার কোনো কারন নেই, একদিনেই আমাদের এই জটিলতা দূর হয়ে যাবে।  দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলে এই জটিলতা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারবো। তাই আমাদের সমগ্র ব্যক্তিত্ত্ব কে নতুন করে সাজাতে হবে। কিন্তু কিভাবে ? 

দেখুন ঈশ্বর, পরমাত্মা যাই বলুন না কেন, এঁকে যদি আমি আমার তীক্ষ্ণ স্বজ্ঞায় নিজের মধ্যে অনুভব না করতে পারি, তবে তা আমার অন্ধ বিশ্বাস বা কল্পনার বিষয় হিসেবে থেকে যাবে। আমাদের প্রাচীন মুনি ঋষিগন অথবা বলা যেতে পারে, হিন্দু ধর্ম্মের মহাত্মাগন এই অপরোক্ষ অনুভূতি লাভের  জন্য যোগ অভ্যাস করবার কথা বলেছেন।  এগুলো হলো, কর্ম্মযোগ, রাজযোগ, ভক্তিযোগ ও জ্ঞানযোগ। এর মধ্যে রাজযোগ যা আসলে ধ্যানের  পথ, আমাদের দৃষ্টিতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট, এবং  যেকোনো ধর্ম্ম বিশ্বাসী অনুসরণ করতে পারেন। এর পরের দিন আমরা রাজযোগ নিয়ে আলোচনা করবো। 

জীবন সমস্যার সমাধান ( ৩) - রাজযোগ - অনুশীলনী - ১ 

রাজযোগ :  যেহেতু চারটি রাস্তার মধ্যে থেকে একটি মাত্র পথ আমরা বেছে  নিচ্ছি, তথাপি আমাদের জানার জন্য, অন্যযোগগুলো সম্পর্কে  এক কথায়  শুনে নেবো। আসলে কর্ম্মযোগ অনাসক্ত কর্ম্মের উপরে জোর দিয়েছে। আবার  ভক্তিযোগে আমাদের সমস্ত ইচ্ছা ও উদ্দীপনাকে ঈশ্বরের দিকে ঘুরিয়ে দেবার কথা বলা হয়েছে। আর জ্ঞানযোগের পথে নিত্য ও অনিত্য বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের উপরে জোর দেবার কথা বলা হয়েছে।  এইবার আমরা রাজযোগের কথায় যাবো।

মহর্ষি পতঞ্জলির যোগসূত্র সমস্ত  যোগশাস্ত্রে মূল। বলা হয়ে থাকে সাংখ্যের দর্শন আসলে তত্ত্বশিক্ষার গ্রন্থ। আর মহর্ষি পতঞ্জলির গ্রন্থ সাধনকান্ড। আমাদের অনেকের ধারণা হচ্ছে, যোগক্রিয়া মানে কিছু শারীরিক ব্যায়াম ও শ্বাসপ্রশ্বাসের ক্রিয়া বা ধ্যানে লিপ্ত থাকা । আসলে কিন্তু ব্যাপারটা এমন নয়। আমাদের মনে যে ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়-এর চিন্তা ওঠে তাকে নিরোধ করা এবং মনকে উচ্চতর চিন্তার খাতে প্রবাহিত করা, এই যোগের উদ্দেশ্য। ঋষি পতঞ্জলি এই প্রক্রিয়াকে কয়েকটি ভাগে বা স্তরে ভাগ করেছেন। যম-নিয়ম-আসন-প্রাণায়াম-প্রত্যাহার-ধারণা-ধ্যান-সমাধি। আমাদের অনেকের ধারণা হচ্ছে, সরাসরি ধ্যানে বসে গেলেই হলো। বা রেচক-পূরক-কুম্ভক শুরু করলেই হলো। আর ধ্যানে বসলেই আমাদের সমাধি হয়ে যাবে। তাই  ধ্যানের আগে যে স্তরগুলো আছে, সেগুলোকে আমরা বিশেষ গুরুত্ত্ব দেই  না। আর এই কারণেই আমাদের লক্ষ পূরণ হয় না।  বরং আমরা এইসব করতে গিয়ে মানসিক ও শারীরিক জটিলতাকে আহ্ববান করি। একটা জিনিষ  শুনুন, আধ্যাত্মিক জীবন সাংসারিক জীবন থেকেও অনেক জটিল ও কঠিন।  ক্ষুরধার অস্ত্রের উপর দিয়ে হাটা। এই হাঁটার সাফল্যে   যেমন আনন্দ আছে, তেমনি বিপদের  সম্ভাবনা  আছে। তাই একটা একটা সিঁড়ি অতিক্রম করে পরের ধাপে পা দিন। লাফ  দিয়ে ছাদে উঠতে যাবেন  না। তাতে উদ্দেশ্যপূরন  তো দূরের কথা, বিপদের সম্ভাবনা বেশী। বহু ঔষধ আছে ভীষণ শক্তিশালী, কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া খাওয়া উচিত নয়। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। আমরা কয়েকটা ধাপে এই আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাবো। 

যেকোনো যোগ-সাধনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, ব্যক্তির ব্যক্তিত্ত্বের প্রকাশ। আমাদের  সবার মধ্যে একটা বিশাল সম্ভাবনা আছে।  এই সুপ্ত সম্ভাবনাকে জাগ্রত করাই যোগের উদ্দেশ্য। রাজযোগ আমাদের পুরুষাকারকে ব্যবহার করে ব্যক্তিত্বের উন্মেষ ঘটায়। 

প্রথম অনুশীলন : কল্পনা করতে শিখুন। নিজে স্বপ্ন দেখতে শিখুন। আসলে কল্পনাই আমাদের সমস্ত ভাবনার মূল। জীবনে যে লক্ষ তা আমাদের ভাবনার ফল। আর ভাবনা থেকেই আসে কর্ম্ম করবার উৎসাহ, উদ্দীপনা। আর সফল কর্ম্ম আমাদের সাফল্যের শিখরে নিয়ে যেতে পারে। 

এইবার কল্পনার মধ্যে বিশুদ্ধতা আনুন। অর্থাৎ একদিকে অন্যের জন্য ক্ষতিকর চিন্তা যেমন করবেন না, তেমনি কল্পনায় নিজের ভবিষ্যৎ  জীবনকে একটা উচ্চপর্য্যায়ে নিয়ে যান। আপনি  চান, সেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করুন।  

সহ্য করবার ক্ষমতা, ধৈর্য্য ধরবার ক্ষমতা বৃদ্ধি করুন। বিপদের সময় মনকে স্থির রাখুন। বিচারশীল 
হোন। ভেঙে পড়বেন  না। নিশ্চিত সত্যকে মেনে নিতে শিখুন। যেমন আমি যেমন কর্ম্ম করেছি, তার ফল পেয়েছি। মৃত্যু একটা সত্য, প্রত্যেকের জীবনে আসবেই। একে এড়িয়ে যাওয়া   যাবে না, তাই একে  মেনে নিতে  শিখুন। প্রতিদিন একমিনিট মৃত্যু চিন্তা করুন। এবং  নিষ্ঠা সহকারে নিজের কাজ সময়মতো শেষ করুন। 

অধ্যাত্ম জীবনের প্রথম কাজই হচ্ছে  নিজের জন্য ক্ষানিকটা  সময় বেছে  নেওয়া। এইসময় আপনি নিজেকে ছাড়া অন্য কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করবেন না। এই সময়টা যদি ব্রাহ্মমুহূর্ত হয় তবে ভালো। যদি  না হয়, তবে স্নানের পরে, বা  ঘুমুতে যাবার আগে, একটা  সময় বেছে  নিয়ে, ৫-৪৫ মিনিট, যে যেমন সময় বার করতে পারবেন, সেইমতো প্রতিদিন সময়, একই আসনে,  মেরুদন্ড  সোজা রেখে একটা  জায়গায় বসুন। এইসময় আপনি নিজে কি চান, এবং সেটা কিভাবে পেতে পারেন, তার সম্ভাব্য উত্তর  খুঁজুন । নিজের কাজে কোনো ভূলত্রূটি হয়ে থাকলে, তাকে কিভাবে শোধরানো যায়, তার উত্তর খুজুন। প্রথম সাত দিন এই অভ্যাস চালিয়ে যান। 

এর পরের ধাপে মনকে শান্ত করতে হবে। ৫ মিনিট অনুলোম বিলোম  করুন। এবং আগে যা বলেছি, সেইমতো চিন্তা  করতে থাকুন। 

এর পরের ধাপে ৫ মিনিট অনুলোম বিলম্ব করুন, এবং পায়ের বুড়ো আঙ্গুল থেকে শুরু করে আপনার প্রতিটি অঙ্গের দিকে মন দিন। অর্থাৎ পায়ের আঙ্গুল-পায়ের পাতা-গোড়ালি-পায়ের নিম্নাঙ্গ-উর্দ্ধাঙ্গ-হয়ে নাভিমূলে নিজের মনকে স্থির করুন। নাভি থেকে পেট-বুক-কন্ঠ-নাক-চোখ-কপাল-কান-মাথা-মাথার তালু। প্রতিটি অঙ্গে ৩০ সেকেন্ড থামুন ও মনে করতে থাকুন, আমার অঙ্গ বিশ্বশক্তি সংগ্রহ করছে, আমি শুদ্ধ হচ্ছি, শক্তিশালী হচ্ছি। এই প্রক্রিয়া অর্থাৎ পায়ের বুড়ো আঙ্গুল থেকে মাথা আবার মাথা থেকে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল, তিন রাউন্ড করুন। ব্যাস এই প্রক্রিয়া ৭ দিন চলতে দিন। সাতদিন অতিবাহিত না হলে আমাদের পরবর্তী পর্ব্ব শুনবেন না। নিজের মধ্যে কোনো প্রশ্ন জাগ্রত হলে, নিজেকে প্রশ্ন করুন। বার বার শুধাতে থাকুন নিজেকে, আমি কি করবো ? জবাব অবশ্য়ই পেয়ে যাবেন। কেননা এই প্রক্রিয়া আপনার ধীশক্তিকে অর্থাৎ বিষয়ের গভীরে যাবার শক্তি দেবে। দেবেই দেবে।  

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম। 

জীবন সমস্যার সমাধান ( ৪) - রাজযোগ - অনুশীলনী - ১/১
 
আজ আমরা রাজযোগের প্রথম অনুশীলন সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে শুনবো। বিবেকানন্দ বলছেন, ব্যাক্তিত্ত্বের বিকাশ সাধনের জন্য, যোগের অভ্যাস করতে হবে। কল্পনাই প্রেরণার প্রবেশপথ।  কল্পনাই সমস্ত ভাবনার ভিত্তি। সমস্ত যোগী, বৈজ্ঞানিক অর্থাৎ আবিষ্কারকগন, এমনকি কবি, মাহাহাত্মাগণ অসীম  কল্পনা শক্তির অধিকারী ছিলেন। প্রকৃতির নিয়মের ব্যাখ্যা মানুষের শরীরের মধ্যেই পাওয়া যায়। মাধ্যাকর্ষণ নিহিত রয়েছে আমাদের দেহের মধ্যে, বহির্জগতে নয়। যোগীদের হতে হবে, স্বল্পাহারী কিন্তু উপবাসী নয়। নিদ্রাবিলাসী হলে চলবে না, আবার পরিমিত নিদ্রা অবশ্য়ই শরীরের জন্য দরকার। আমাদের অজ্ঞানতা কাটিয়ে উঠতে হবে। আমাদের স্থির হতে হবে। আমাদের হিংসা, অলসতা পরিত্যাগ করতে হবে। আমাদের লোভ-লালসা কাটিয়ে উঠতে হবে। তা না হলে আমরা যোগাভ্যাসের সুফল পাবো না। 
বিবেকানন্দ বলছেন, আমাদের  মানসিক ও শারীরিক বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে হবে। অপরিছন্ন মন, অপরিছন্ন শরীর, নোংরা পরিবেশ আমাদের মনকে নিম্নগামী করে। তাই এসবের দিকে খেয়াল রেখে চলতে হবে। দ্বিতীয়তঃ হচ্ছে আমাদের ধৈর্য্যধরে যোগের অভ্যাস করে যেতে হবে। প্রথমদিকে কিছু চিত্তাকর্ষক অনুভূতি হলেও, সেগুলোকে দূর করতে হবে। আমাদের দৃঢ়ভাবে লক্ষের  দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আর এতেকরে আমাদের অবশ্যই  সুফল মিলবে। তৃতীয়তঃ হচ্ছে, অধ্যাবসায়। সমস্ত কাজের মধ্যে, এমনকি অসুস্থ শরীরেও আমাদের নিষ্ঠাসহকারে অভ্যাস চালিয়ে যেতে হবে। একটা দিনও যাতে নষ্ট না হয়, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। 

আমরা আগেই শুনেছি, অভ্যাসের উৎকৃষ্ট সময় হচ্ছে, ব্রাহ্ম-মুহূর্ত । ব্রাহ্ম মুহূর্ত দিন ও রাতের সন্ধি-ক্ষণ । এই সন্ধি-ক্ষণে আমাদের দেহতরঙ্গ দিনের অন্যসময়ের তুলনায় বেশি শান্ত থাকে। দিন ও রাত্রি এই যে দুটি পৰ্য্যায় এর মধ্যিখানে অবস্থান ক্ষণে শুন্যবিন্দু বিরাজ করে। যদি এই ব্রাহ্ম মুহূর্তকে আমরা ব্যবহার করতে না পারি, তবে হয় বিছানা ত্যাগের পরে, অথবা বিছানায় যাবার আগে অর্থাৎ রাতে ঘুমের আগে, আমাদের এই অভ্যাস করা উচিত। স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, শরীরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, প্রতিদিন অবশ্য়ই ভালোভাবে স্নান করতে হবে। 

আমরা যখন আসনে বসবো, আমাদের শরীরের নাড়াচাড়াকে বন্ধ করতে হবে। পাথরের মতো অনড় করে রাখতে হবে শরীরকে। মাথা, দুই কাঁধ, এবং নিতম্বকে সমান্তরাল রাখতে হবে। মেরুদন্ডকে সহজ ও সরল রেখায় রাখতে হবে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, এই মেরুদণ্ডের মধ্যে দিয়েই আমাদের সমস্ত শক্তি ওঠা-নামা  করছে, তো সমস্ত শক্তির বাহক এই মেরুদন্ডকে  দুর্বল করা চলবে না। 

আমাদের শরীরের সমস্ত অঙ্গ  তা সে পায়ের পাতা হোক বা মাথার তালু হোক, সমস্ত অঙ্গই পবিত্র, এবং এই কথাটা সব সময় মনে রাখতে হবে। নিচ থেকে উপরের দিকে সমস্ত অঙ্গের দিকে মনোযোগ দিতে হবে, আর তাকে পবিত্র নীরোগ ভাবতে হবে। প্রথমে যেমন আমরা অঙ্গগুলোকে আলাদা আলাদা ভাবে শুদ্ধ-পবিত্র-নীরোগ ভাববো, তেমনি সবশেষে আমাদের দেহকে অর্থাৎ অঙ্গ সমষ্টিকে একত্রে শুদ্ধ-পবিত্র-নীরোগ ভাববো। একটা কথা মনে রাখতে হবে, ঈশ্বর উপলব্ধি করতে হলে ঈশ্বর-প্রদত্ত এই দেহকে একটা যন্ত্র হিসেবে কল্পনা করতে হবে। একে   একটা নৌকা হিসেবে কল্পনা করতে হবে। এবং সত্য হচ্ছে, এই নৌকা-রূপ দেহের সাহায্যেই আমরা জগৎ-সমুদ্র পাড়ি দেব, আর চিরন্তন সত্যের সমুদ্রে উপনীত হবো। এইসব চিন্তা সমাপ্ত হলে, আমরা  নাকের দুই ছিদ্র  দিয়ে দীর্ঘ শ্বাস গ্রহণ করবো অর্থাৎ পূরক করবো, আবার রেচক করবো। তার পর যতক্ষন পারবো, শ্বাসক্রিয়া বন্ধ করে রাখবো। বিবেকানন্দ বলছেন, এইরকম চারবার শ্বাস গ্রহণ  করতে হবে, তারপর স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে হবে। 
এইসংগে একটা জিনিস করতে হবে তা হচ্ছে প্রার্থনা, অর্থাৎ আমাদের জ্ঞানের উন্মেষ যাতে হয়, তার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে হবে। 

বিবেকানন্দের ভাষায় প্রার্থনা - "যিনি এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন, তার গৌরব-দ্যুতিকে আমি স্মরণ করি, তিনি আমার অন্তর্লোক উদ্ভাসিত করুন।" আসনে বসে দশ থেকে পনেরো মিনিট এই ধ্যানের অভ্যাস করতে হবে। 

এই অভ্যাস চলাকালীন, নিজের অভিজ্ঞতা গোপনে রাখুন। গুরুভিন্ন কাউকে এই কথা বলতে  যাবেন  না। কথা কম বলুন। সবসময় পবিত্র চিন্তায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখুন। একটা কথা মনে রাখবেন, আমরা যে যেমন চিন্তা করি, আমাদের মধ্যে আমাদের অজ্ঞাতসারেই সেইমতো হয়ে যাবার প্রবণতা তৈরি হয়। শুভ পুন্য চিন্তা আমাদের আমাদের মানসিক অপবিত্রতাকে দূর করে দেয়। বিবেকানন্দ বলছেন, যারা যোগী নয়, তার ইন্দ্রিয়ের দাস। নিজেকে মুক্ত করবার জন্য এই দাসপ্রথা থেকে নিজেকে বের করে নিয়ে আসতে  হবে। 

বিবেকানন্দ বলছেন, পরমার্থের  সন্ধান আমরা সবাই পেতে পারি। ঈশ্বর যদি সত্য হন, তাহলে স্ট্যরূপেই আমরা তাকে উপলব্ধি করতে পারবো। যদি আত্মা বলে কিছু থাকে, তাহলে আমরা নিশ্চই সেই আত্মাকে প্রতক্ষ্য উপলব্ধি করবো। আর এই দর্শনের উপায় হচ্ছে দেহাতীত হয়ে যাওয়া। 

যোগীগণ আমাদের এই স্থূল দেহের অঙ্গকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন, একটা হচ্ছে অনুভূতির অঙ্গ আর একটা হচ্ছে জ্ঞান বা কর্ম্মের অঙ্গ। মনের চারটি স্তর - প্রথমত চিন্তা করবার ক্ষমতা বা চিন্তা শক্তি। সাধারণত এই শক্তিকে আমরা অপচয় করে থাকি। কারন আমরা আমরা আমাদের চিন্তাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। এই চিন্তাশক্তিকে আমরা যদি সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারি, তবে এই শক্তি বিষ্ময়কর ফল প্রদান করতে পারে। দ্বিতীয়তঃ হচ্ছে আমাদের বুদ্ধি বা ইচ্ছাশক্তি। তৃতীয়তঃ হচ্ছে আমাদের অহঙ্কার - আমাদের আত্মসচেতন অহংবোধ।  চতুর্থ হচ্ছে আমাদের চিত্ত  হচ্ছে সে পদার্থ যার মাধ্যমে  সমস্ত শক্তি কাজ করে থাকে। একে মনের মেঝে বলা যেতে পারে। অথবা চিত্ত হলো সমুদ্র এবং বিভিন্ন শক্তিগুলো হলো তরঙ্গরাশি। চিত্তে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শক্তি প্রবাহিত হচ্ছে। আর যোগ হচ্ছে এমন একটা বিদ্যা যার সাহায্যে এই চিত্তকে বিভিন্ন শক্তিতে রূপান্তরিত হওয়াকে বন্ধ করতে পারে। বিবেকানন্দ বলছেন, সমুদ্রে চাঁদের ছায়া। ঢেউয়ের ওঠাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদকে কখনো অস্পষ্ট, কখনো খণ্ডিত দেখা যায়।  ঠিক তেমনি আত্মা বা আমাদের প্রকৃত সত্ত্বার যে প্রতিবিম্ব আমাদের মনের তরঙ্গে প্রতিফলিত হচ্ছে, মনের তরঙ্গ ভেদে সেই আত্মনকে কখনো খণ্ডিত, কখনো অস্পষ্ট লক্ষিত হচ্ছে। সমুদ্রের তরঙ্গ স্থির হলে, চাঁদকে স্পষ্ট দেখা যায়, ঠিক তেমনি আমাদের মনে চিন্তা তরঙ্গকে স্থির করতে পারলে চিত্তে আত্ম্যের ছায়া স্পষ্ট দেখতে পারা  যায়। 

আমরা জানি মন দেহ নয়, কিন্তু মনও একটা পদার্থ, সূক্ষতম পদার্থ। স্থুল দেহের সঙ্গে মন চিরকালীন ভাবে বাঁধা নয়। মাঝে মাঝে আমরা যখন স্থুল দেহের বন্ধন শিথিল করতে পারি, তখন এর উপলব্ধি হয় আমাদের। আমাদের অনুভূতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ ক'রে, আমরা আমাদের মনকে ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। যখন এই কাজটি আমরা সম্পূর্ণ ভাবে করতে পারবো, তখন সমস্ত ব্রহ্মান্ডকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো।  আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো যা আমাদের সামনে তুলে  ধরে, তাকেই আমরা জগৎ বলি, যা আসলে পরিদৃশ্যমান জগৎ মাত্র। এর বাইরেও জগতের অস্তিত্ত্ব আছে, কিন্তু আমাদের ইন্দ্রিয় তা ধরতে পারে না। তাই সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। 

এই ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে যখন আমরা বেরিয়ে আসতে  পারবো, তখন আমাদের মধ্যে একটা পরিবর্তন আসবে, একেই বলে আধ্যাত্মিক জীবন। বিষয়ী মানুষ ইন্দ্রিয়ের দাস। আমাদের মনটাকে যদি আমরা বিভিন্ন তরঙ্গে খণ্ডিত হতে না দেই, তবে আমাদের দেহবোধ বিলুপ্ত হবে। 

লক্ষ লক্ষ বাছরের কঠিন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আমাদের এই দেহ তৈরি হয়েছে। আর এই লড়াই করতে গিয়ে দেহ তৈরির যে মূলউদ্দেশ্য তা আমরা ভুলে গেছি। দেহের সঙ্গে থাকতে থাকতে, দেহের কথা চিন্তা করতে করতে আমরা নিজেদেরকে দেহ হিসেবেই ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল পূর্ণ হয়ে ওঠা। কিন্তু দেহ তৈরিতে আমরা এতটাই মনোযোগ দিয়েছি যে আমরা আর পাল নেই, আমরা যেন হাড়ি কড়াই হয়ে গেছি।  আমরা আর শিল্পী নেই, আমরা যেন শিল্প হয়ে গেছি।  এই মোহ  থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। আমাদের আসল লক্ষের  দিকে  নজর দিতে হবে। উপলব্ধি করতে হবে, আমরা দেহ নোই, আমরা দেহী, আমরা শরীর নোই, আমরা শরীরী। দেহ আমাদের উৎসে যাবার বাহন মাত্র। আমাদের অনন্ত যাত্রায়, দেহ আমাদের বিশ্রামাগার। দেহ আমাদের কর্ম্মক্ষেত্ৰ মাত্র।  আমি নোই। 
আমাদের মনকে ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে আসতে  হবে। মনকে দেহ থেকে আলাদা করতে হবে। দেহকে আমরা সর্ব্বশক্তি দিয়ে সমৃদ্ধ করি। তাই একেই আমরা সজীব ও আমাদের প্রকৃত সত্ত্বা হিসেবে চিন্তা করি। জন্ম থেকে জন্মান্তর ধরে আমরা নানান রকম দেহ ধারণ করেছি। তাই আমরা বিহুল হয়ে গেছি, দেহ আর আমি এক হয়ে গেছি, কিন্তু সত্য হচ্ছে দেহ আমি  নোই। দেহ আমার সম -গোত্রীয় নয়। রাজযোগ বা যোগ  এমনই একটা বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি যা আমাদের দেহকে আমি থেকে আলাদা করে দেখতে বা ভাবতে সাহায্য করে। যোগী দেহকে তখন দাস ভাবতে পারে। এবং সেইমতো সে তার দেহকে পরিচালিত করতে পারে। আসলে মানসিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করাই যোগের লক্ষ। আত্মশক্তিকে যেকোনো বিষয়ে কেন্দ্রীভূত করার নামই যোগ। 
এই সম্পর্কে আমরা আরো শুনবো।  আজ বাক্যের বিরাম দিলাম। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।  

 জীবন সমস্যার সমাধান ( ৪) - রাজযোগ - অনুশীলনী - ২
সূচনা : সমাধি লাভের  উপায়। 
যোগের উদ্দেশ্য সত্যকে উপলব্ধি করা। আর সত্যকে উপলব্ধি করতে হলে আমাদের যে অবস্থার মধ্যে প্রবেশ করতে হয়, তা হলো সমাধি। আজ আমরা সমাধি লাভের  বিভিন্ন উপায় সম্পর্কে একটা সাধারণজ্ঞান নিয়ে নেবো। যোগের জগৎগুরু হচ্ছেন ঋষি পতঞ্জলি।  তিনি তার যোগদর্শন গ্রন্থে সমাধিপাদের ২০ নং শ্লোকে বলছেন, শ্রদ্ধা-ভক্তি, বীর্য অর্থাৎ কর্ম্মশক্তি, স্মৃতি অর্থাৎ ধ্যানশক্তি, মনের একাগ্রতা ও একতানতা  ও প্রজ্ঞা অর্থাৎ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি থেকে সমাধি লাভ সম্ভব। আসলে ভক্তিযোগ, কর্ম্মযোগ, জ্ঞানযোগ সবই সমাধি লাভের এক-একটি পথ। ঋষি পতঞ্জলি সমাধিপাদের ২৩ নং শ্লোকে বলছেন, ঈশ্বর-প্রণিধান দ্বারাও সমাধিলাভ সম্ভব। 
.আমরা শুনেছি সাংখ্য দর্শন হচ্ছে তত্ত্বকথা, আর যোগদর্শন হচ্ছে তত্ত্বের প্রয়োগ বিধি। সাংখ্য দর্শন ঈশ্বরের অস্তিত্ত্বে বিশ্বাস করে না। প্রকৃতির উপরে যিনি আধিপত্য বিস্তার করতে পারেন,  সেই পুরুষশক্তির অস্তিত্ত্বের কথাই  স্বীকার করে থাকেন মাত্র । ঋষি পতঞ্জলি মনে করেন, দুই ধরনের মানুষ আছেন, একদল জ্ঞানী ও আরেকদল অজ্ঞানী। প্রকৃতির উপরে আধিপত্য  বিস্তারকারী যোগীগনের  মন প্রকৃতিতে লিন থাকে, কিন্তু যখন তিনি আবার স্থূল দেহ ধারণ করেন, তখন এঁরা প্রকৃতির প্রভু রূপে মুক্ত  পুরুষ হয়েই অবস্থান করে থাকেন। এঁরাই যোগগুরু। সংসারী আত্মা যখন জ্ঞান ও বৈরাগ্য দ্বারা সর্বজ্ঞ-অনন্ত-জ্ঞানস্বরূপ হন, তখন তাঁরা মুক্ত পুরুষ  হিসেবে ইতস্তত বিচরণ করে থাকেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে যে সামান্য পার্থিব জ্ঞান, তাও এই অনন্ত জ্ঞানের কনাবিশেষ। গুরুদিগের গুরু হচ্ছেন ঈশ্বর। এই ঈশ্বর দেশ কালের উর্দ্ধে।  এই ঈশ্বরের আদি নেই অন্ত  নেই। 

ঋষি পতঞ্জলি, সমাধিপাদে, ২৭ নং শ্লোকে বলছেন, এই ঈশ্বরের নামই হচ্ছে প্রণব বা ওঙ্কার।  এই ওঙ্কারের অর্থ জেনে, এই ধ্বনির বারবার উচ্চারণ করলে সমাধি হয়। 

হঠযোগীগণ বলে থাকেন,  হঠযোগ সমাধি লাভের  শ্রেষ্ট উপায়। এই উদ্দেশ্যে, ঘটের সাধনা করতে হয়, সর্বাগ্রে। ঘট  অর্থাৎ শরীর। তারা বলেন, এই ঘটেই আছে, প্রাণ-অপান, নাদ , বিন্দু, জীবাত্মা ও পরমাত্মা। তাই হঠযোগীগণ শরীরকে দীর্ঘস্থায়ী ও রোগমুক্ত রাখবার জন্য শোধনক্রিয়া অর্থাৎ ধৌতি -বস্তি-লৌলিক-ত্রাটক-কপালভাতি এই ছয়টি শোধনক্রিয়া অভ্যাস করতে বলে থাকেন। এর দ্বারা আমাদের শরীরের মধ্যে একটা সাম্য  বজায় থাকে।  ধৌতি - শরীরের মল নাশ করে, বস্তি -  পেট সুস্থ  থাকে, নেতি - শ্লেষ্মা নিবারণ হয়,  লৌলিক -দেহের অগ্নি বৃদ্ধি পায়, ত্রাটক - দৃষ্টিশক্তি অক্ষয় থাকে, কপালভাতি - জরা ও বার্ধক্য নিবারিত হয়। বত্রিশটি আসন অভ্যাসের কথা বলেছেন।  এগুলো হচ্ছে,  সিদ্ধাসন, পদ্মাসন, স্বস্তিকাসন, বজ্রাসন,   ভদ্রাসন, মুক্তাসন, বিরাসন, গুপ্তাসন, সিংহাসন, মৃতাসন, ধনুরাসন, মৎস্যাসন, গুমুখাসন, মৎসেন্দ্রাসন, সংকটাসন, গোরক্ষাসন, উৎকটাসন, পশ্চিমোত্তানাসন, যোগাসন, ভূজঙ্গাসন উষ্ট্রাসন মকরাসন বৃষাসন গরুড়াসন শলভাসন মণ্ডূকাশন বৃক্ষাসন কূর্মাসন কুক্কুটাশন, ময়ূরাসন উত্তানকূর্মাসন উত্তমান্ডুকাসন। 

এছাড়া আমাদের শরীর  ও মনের স্থিরতা বজায় রাখবার জন্য, দেহমধ্যস্থ কুল-কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করবার জন্য ২৫টি মুদ্রার অভ্যাস করবার কথা বলে থাকেন হঠযোগীগণ । সেগুলো হলো,  মহামুদ্রা-নভোমুদ্রা-মাহমেধ-মহাবন্ধ-মূলবন্ধ-উড্ডীয়ান-জলন্ধর-খেচরী-যোনী-বিপরীতকরণী-বজ্রোলী-মান্ডবী-শক্তিচালনী-তরাগী-শাম্ভবী - ভুজঙ্গিনী-মাতঙ্গী-অস্বিনী-কাকী-পাশিনী-পার্থিবীধারনা-আন্তসীধারণা-বৈশ্বানরী ধারণা-বায়বীধারণা-আকাশীধারণা।

এদিকে রাজযোগীগণ বলেন, যতই তুমি চেষ্টা করো না কেন, শরীর নশ্বর, ধংশশীল। শরীরকে কোনো জীব এমনকি কোনো মানুষ চিরকাল রক্ষা করতে পারে না।  যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকেও দেহ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে।ঋষি পাতঞ্জলকেও দেহ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে।   এইজন্য আমাদের যেটা আদর্শ হাওয়া উচিত সে হচ্ছে সমাধিলাভের জন্য শরীরকে সুস্থ  ও সবল রাখা এবং মনকে বশীভূত রাখবার জন্য চেষ্টা করা। এইজন্য রাজযোগে শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য যতটা জোর দেওয়া হয়েছে, তার থেকে মনকে বশীভূত রাখবার জন্য অধিক গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে। আর এই মনকে বশীভূত রাখবার জন্য যুক্তির সাহায্য নেওয়া হয়েছে। মহর্ষি বশিষ্ঠ বলছেন, আধ্যাত্মিক বিদ্যা অর্জন করতে গেলে, আমাদের সাধু-সঙ্গ  করতে হবে, সম্পূর্ণভাবে বাসনা ত্যাগ করতে হবে এবং প্রাণবায়ুকে নিরোধ করতে হবে।  তবেই আমরা মনের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে  পারবো।  সমাধি লাভের  এটাই শ্রেষ্ঠ উপায়। 

ক্রিয়াযোগ ব'লে একটা কথা আমরা শুনে থাকি। ঋষি পতঞ্জলি যোগদর্শনের সাধনপদের ১ নং শ্লোকে বলছেন তপস্যা, স্বাধ্যায় এবং ঈশ্বর-প্রণিধান অর্থাৎ  ঈশ্বরে আমাদের সমুদয় কর্ম্মফল সমর্পনই ক্রিয়াযোগ। আমাদের জড়তা, আমাদের শারীরিক রোগভোগ, আমাদের সন্দেহবাতিক মন , আমাদের উদ্দমহীনতা, আমাদের আলস্য, আমাদের বিষয় তৃষ্ণা, আমাদের অজ্ঞান, আমাদের অসংযত শ্বাস-প্রশ্বাস এগুলো আমাদের মনকে বিক্ষিপ্ত করছে। এইজন্য আমাদের যেমন আহারের প্রতি সংযম পালন  করতে হবে, তেমনি কঠোরতার সঙ্গে আমাদের নিয়মিতভাবে যোগের অভ্যাস করতে হবে। সবচেয়ে বড়ো কথা একজন উপযুক্ত গুরুর সান্নিধ্যে থেকে এইসব কঠোর নিয়মের পালন করতে হবে। একমাত্র অভিজ্ঞ গুরুই পারেন যোগের সঠিক পদ্ধতি বলে দিতে। অনিয়মিত যোগের অভ্যাস বা সঠিক পদ্ধতিতে যোগের অভ্যাস না করায় আমাদের  শরীর  ও মনের উপরে যে চাপ সৃষ্টি হতে পারে, তা আমাদের স্বাভাবিক সামাজিক জীবনযাপনে বাধাস্বরূপ হতে পারে। একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, নিয়মিত শ্বাসপ্রশ্বাস জীবকে জীবন্ত করে রেখেছে, অনিমিয়ত শ্বাসপ্রশ্বাস আমাদের শারীরিক ও মানসিক দিকে থেকে অসুস্থ করে তোলে। আর শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি রুদ্ধ হয়ে গেলে এই শরীর মৃতদেহ বা শব মাত্র। চেতনাহীন  জীবন হয়, কিন্তু প্রাণহীন জীবন হয় না। তাই যোগ বিশেষ করে বায়ু রুদ্ধ করবার যে প্রক্রিয়া তা অভিজ্ঞ গুরুর সান্নিধ্যেই অভ্যাস করা উচিত।  অভিজ্ঞ গুরু সময়মতো সঠিক নির্দেশ দিয়ে, যোগের সাফল্য অনুভব করাতে পারেন। অন্যথা যোগ অধরা হয়েই থাকবে। আর সমাধির অভিজ্ঞতাও আমরা লাভ করতে পারবো না।   

এর পরের দিন আমরা স্বামী বিবেকানন্দের সাথে রাজযোগের দ্বিতীয় অনুশীলনের শিক্ষা নেবো।তথ্যসূত্রঃ বিবেকানন্দ রচনাসংগ্রহ - প্রথম খন্ড - প্রবন্ধ - রাজযোগ সংক্রান্ত ছটি অনুশীলনী।  

সমাধি লাভের উপায় (২

জীব বহু-জন্মের সঞ্চিত সুকৃতির ফলে সমাধির সন্ধান পায়। আমরা মাণ্ডুক্য উপনিষদ আলোচনার সময় শুনেছি, ব্রহ্মর চার অবস্থা। জীব তিনটি অবস্থা নিয়ত ভোগ করে থাকে। জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি। এই তিনটি অবস্থা ছাড়া আর একটা অবস্থা আছে, যাক বলা হয় তুরীয়। এই তুরীয় অবস্থাই সমাধির অবস্থা। খুবই অল্প সংখ্যক  মানুষ এই সমাধি অবস্থার সন্ধান পেয়ে থাকেন। আমরা শুনেছি, জাগ্রত অবস্থায়, আমাদের মন, বুদ্ধি, চিত্ত অহংকার, পাঁচটি কর্ম্ম ইন্দ্রিয়, পাঁচটি জ্ঞান ইন্দ্রিয় ক্রিয়াশীল থাকে। যখন কর্ম্ম-ইন্দ্রিয়, জ্ঞান-ইন্দ্রিয় বাদে বাকি চারটি অর্থাৎ মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার ক্রিয়াশীল থাকে তাকে বলা হয় আমাদের স্বপাবস্থা। যখন এই চোদ্দটি করনই নিষ্ক্রিয় হয়, তখন আমাদের সুসুপ্তির অবস্থা।  এই সুসুপ্তির অবস্থায় আমরা "আমি"কে পর্যন্ত ভুলে যাই। তখন জগৎজ্ঞান এমনকি "আমি আছি"  এই জ্ঞানও আমাদের থাকে না। একে মৃতপ্রায় অবস্থা বলা যায়। এর পরের  স্তর হচ্ছে সমাধি। এই সমাধির অবস্থায়, আমাদের জগৎজ্ঞান থাকে না, কিন্তু আত্মসত্তাটি প্রবুদ্ধ থাকে। যাকে  বলা যেতে পারে জেগে ঘুমোনো। জগতভাবে আমরা নিদ্রিত, কিন্তু আত্মভাবে আমরা জাগ্রত বা প্রবুদ্ধ। একেই বলে সমাধি। রাজযোগের ফলে বা বুদ্ধির প্রভাবে, আমাদের চৈতন্যময় সত্তা মহাব্যোম মন্ডলে অবস্থান করতে অভ্যস্ত হবার পর, এই অবস্থা আপনা-আপনি উপস্থিত হয়। এটাই ব্রহ্মে স্থিতি বলা হয়ে থাকে । এটাই মায়ের কোল। যাঁরা ভক্তিরসে ধনবান, যাঁরা বুদ্ধিযুক্ত কর্ম্মফলে চিন্ময়-জ্যোতির্ধনে ধনবান, এই ধনবানদের কাছে সমাধির আবির্ভাব ঘটে । অষ্টাঙ্গ যোগের চরম অংঙ্গ এই সমাধি। আমরা জানি যোগশাস্ত্রে আটটি যোগের কথা বলা হয়েছে। এগুলো যে কেবল ভগবান লাভের  পক্ষে উপযুক্ত তাই নয়, যোগ ছাড়া জগতের কোনো ব্যাপারই নিস্পন্ন হতে পারে না। যোগ শব্দটির  অর্থ মিলন। তা সে ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে মিলন হতে পারে। মনের সঙ্গে বুদ্ধির মিলন হতে পারে। আবার বুদ্ধির সঙ্গে আত্মার মিলন হতে পারে। জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন হতে পারে, ভক্তের সাথে ভগবানের মিলন হতে পারে। মায়ের সঙ্গে ছেলের মিলন হতে পারে। আটটি অঙ্গের সমষ্টি হচ্ছে যোগ। 

ধরুন আমি খেতে বসবো, এখন এই খাবার জন্য, আমাকে একটা মানষিক প্রস্তুতি দরকার। অর্থাৎ এখন খেতে হবে, এই ভাবনা।  একেই যোগের ভাষায় বলে যম।  অর্থাৎ অন্য সমস্ত কিছু থেকে নিবৃত্ত হয়ে আমি খাবার জন্য প্রস্তুত হবো। এখন ধরুন খাবার আগে হাতে পায়ে চোখে মুখে  জল দিয়ে পরিষ্কার করবো। এরই নাম নিয়ম। আমরা যখন খেতে বসবো, তখন একটা নির্দিষ্ট আসনে বসবো।  তা সে চেয়ারে হতে পারে, বা মাটিতে হতে পারে। এই যে একটা নিষদিস্ট আসনে বসা একেই যোগের ভাষায় আসন। এর পর প্রাণায়াম। যারা জানেন, তারা খাবার আগে ডান  নাসিকা দিয়ে, শ্বাস প্রবাহিত করতে চেষ্টা করেন, কারন এতে আমাদের হজম কার্য্য সহজে হতে পারে। অর্থাৎ যে কার্য্যের জন্য যেরূপ শ্বাস এর প্রয়োজন সেটা করতে হবে। এর পরে প্রত্যাহার। ইন্দ্রিয়বৃত্তিগুলোকে অন্যান্য বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে খাবার দিকে মনো নিবেশ করে প্রত্যাহার। এর পর ধারণা। আমাদের ক্ষুধা সম্পর্কে একটা ধারণা রাখতে হয়। আর সেই অনুযায়ী আমাদের খাবার খেতে হবে, আবার  খাওয়া  থেকে বিরত হতে হবে। চিত্তকে আহার গ্রহণ ও তারজন্য তৃপ্তি ও ক্ষুন্নি-বৃত্তির দিকে ধারণা করে রাখতে হয়। তাই ক্ষুধার তৃপ্তি বা নিবৃত্তি হলেই আমাদের খাবার কাজ শেষ করতে হয়। এই যে আহার বিষয়ে ধ্যান বা চিন্তা এবং তার জন্য আমাদের খুই অল্প সময়ের জন্য সমাধি হয়।  ক্ষণকালের জন্য, মন আজ্ঞাচক্র স্পর্শ করে আসে।  এবং এর ফলেই আহারকার্য্য নিস্পন্ন হয়ে থাকে। 

ঠিক তেমনি আমাদের সমস্ত কার্য্য। আমাদের সমস্ত কাজের ভিতর দিয়েই এই অষ্টাঙ্গযোগ সাধিত হচ্ছে। আসলে জাগতিক কাজগুলোতে আমরা এতটাই অভ্যস্ত যে প্রত্যেক কাজের মধ্যেই আমরা অষ্টাঙ্গযোগ সাধন করছি, কিন্তু তা আমরা ধরতে পারি না। অথচ এটা আমাদের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই হচ্ছে। 

আসলে সমাধি কোনো কাজ নিস্পন্ন করতে পারে না। মন যখন বুদ্ধিতে সংস্থাপিত হয়, তখন আমাদের সমাধি হয়। মন যখন নিশ্চয়াত্মিকা বৃত্তিতে সমাহিত হয়, তখন সমাধি হয়। গায়ে একটা মশা পড়লো বা মশায় কামড়ালো, ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে এই মশায় কামড়ানো ব্যাপারটা মনের কাছে উপস্থিত হয় । মন কিছু বলতে পারে না, সে আবার একে বুদ্ধির কাছে উপস্থিত করে, এই যে উপস্থিত করা এর নাম সমাধি। এই সময় মন আজ্ঞাচক্রে বুদ্ধির সাথে মিলিত হয়। আর বুদ্ধি বলে দেয়, এটা মশার কামড়। তাই যন্ত্রনা হচ্ছে। অমনি মন "উঃ মশা" বলে যন্ত্রনা অনুভব করে। এই খেলাই  সবসময়-সর্বত্র চলছে। আমরা ধরতে পারি না। এই যে মন ও বুদ্ধির মিলনরূপ, একেই বলে সমাধি। জাগতিক সমস্ত কাজের মূল হচ্ছে এই সমাধি। আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত এই সমাধির খেলা চলছে। অষ্টাঙ্গ যোগের খেলা চলছে। 

কিন্তু এই যে সমাধি, একে ধরবার জন্য যোগীদের প্রয়াস নয়। যোগীদের সমাধি হচ্ছে প্রজ্ঞার সাথে মনের মিলন। প্রজ্ঞানই ব্রহ্ম। মন যখন প্রজ্ঞান আকারে আকারিত  হয়, অথবা মন যখন প্রজ্ঞায় বিলীন হয়ে যায়, তখনই যথার্থ সমাধি হয়। সমাধিতে জ্ঞান-জ্ঞাতা-জ্ঞেয়  তখন এক হয়ে যায়। এরই নাম অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি। সমাধি সমস্ত মিলনের দ্বার। জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলের নাম সমাধি। প্রতিনিয়ত জীব-চৈতন্যে পরম-চৈতন্যের আবির্ভাব ও তিরোভাব হচ্ছে, যতদিন আমরা এই আবির্ভাব ও তিরোভাব আমরা প্রতক্ষ্য করতে না পারি, যতদিন না উপলব্ধি করতে পারি, ততদিন আমাদের জীবসত্তা জন্ম-মৃত্যু- দুঃখ-কষ্ট , শোক-তাপ থেকে পরিত্রান পেতে পারে না।  সমাধি লাভই মানুষের জীবনের চরম ও পরম চরিতার্থতা। 

প্রথমদিকে সমাধি মলিন ভাবাপন্ন থাকে।  ধীরে ধীরে এই মলিন ভাব কেটে যাবে, আমাদের শোক-তাপ দূরীভূত হবে। দুরন্ত মন তখন শান্ত হবে। 

স্থুলদৃষ্টিতে আমাদের মনে হয়, যম-নিয়ম ইত্যাদি এক-এক অঙ্গগুলোর পরিপক্কতা অনুসারে অপরটি আবির্ভূত হয়।  ব্যাপারটা আসলে তা নয়। সমাধি আসবার সময় হলে, অন্যান্য যোগাঙ্গগুলো, যেন আপনা থেকেই সম্পন্ন হতে থাকে। সমাধি আসলে নীতিসিদ্ধ। সমাধি কোনো জড় পদার্থ নয়। ধ্যান হতে সমাধি আসে না। সমাধি আসলে ধ্যান সিদ্ধ  হয়। তথাপি আমাদের যম থেকেই শুরু করতে হয়, সমাধিতে শেষ হয়। 

যাইহোক, এর পরের দিন আমরা স্বামী বিবেকানন্দের সাথে রাজযোগের অনুশীলনের দ্বিতীয় ভাগের কথা শুনবো। যোগ সাধনের ক্রিয়াগুলোর মধ্যে প্রবেশ করবো। তথ্যসূত্রঃ বিবেকানন্দ রচনাসংগ্রহ - প্রথম খন্ড - প্রবন্ধ - রাজযোগ সংক্রান্ত ছটি অনুশীলনী।  

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 
 
জীবন সমস্যার সমাধান ( ৪) - স্বামী বিবেকানন্দের সাথে রাজযোগ - অনুশীলনী - ২

রাজযোগ অষ্টমুখী যোগ। এগুলো হলো :  যম, নিয়ম, আসন,প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান, সমাধি। আমরা সংক্ষেপে এ সম্পর্কে শুনে নেবো। 
যম :  যমের কথা শুনলেই আমাদের মনে মৃত্যুর দেবতা এক ভীষণ আকৃতির শাক্তিশালী পুরুষের চিত্র ভেসে ওঠে আমাদের মনে। যম কথাটার অর্থ হচ্ছে সংযম বা সংযত হওয়া।  যম  আমাদের সবকিছু থেকে নিবৃত্ত করেন। আমাদের জীবনকে যদি সঠিক ভাবে পরিচালিত করতে হয়, তবে আমরা যমের সাহায্য নিতে পারি। তো কথা হচ্ছে, আমরা কিসের থেকে নিবৃত্ত 
থাকবো ? 
১. আমাদের চিন্তায়, আমাদের কথায়, আমাদের কাজে যেকোনো জীবের অনিষ্ট থেকে নিবৃত্ত থাকে হবে।
২. আমাদের সমস্ত লালসা থেকে নিবৃত্ত থাকতে হবে। 
৩. অসত্যকে বর্জন করতে হবে।  আমরা যেন কাজে, কথায়, চিন্তায় সত্যকে রক্ষা করে চলি। 
৪. কারুর জিনিস না বলে নেওয়া চলবে না।  অর্থাৎ চৌর্যবৃত্তি থেকে নিবৃত্ত থাকতে হবে। 
৫. দান  গ্রহণ করা থেকে নিবৃত্ত থাকতে হবে। 

নিয়ম : জীবনকে আমাদের একটা নিয়মের মধ্যে বেঁধে নিতে হবে। স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিতে হবে। নিয়মিত নিদ্রা, ও পরিমিত আহার গ্রহণ করতে হবে। 

আসন : আমি দেখেছি, বহু মানুষ মেরুদন্ড  সোজা রেখে  দাঁড়াতে চান না, এমনকি দুই পায়ে দাঁড়াতেও চান না। একপায়ে দাঁড়িয়ে অন্য পা-কে বিশ্রামে রাখেন। এইসব মানুষ মানসিক দিক থেকে দুর্বল। দৃঢ়চেতা মানুষ সব সময় মেরুদন্ড সোজা রেখে চোখে চোখ রেখে কথা বলে থাকেন। এই জায়গাটা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। আমরা যেন ত্রিভঙ্গ শরীরের অধিকারী  না হই। যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, মেরুদন্ড সোজা রাখুন। আমরা যখন ধ্যানে বসবো আমাদের নিতম্ব কাঁধ মাথা সোজা রাখতে হবে। 

প্রাণায়াম : প্রাণকে নিয়মিত আরামের মধ্যে রাখতে হবে। প্রাণের আয়াম হচ্ছে প্রাণায়াম। আমরা আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রতি, যা আমাদের জীবনীশক্তি প্রদান করে, যা আমাদের বাঁচিয়ে রাখে তার দিকে আমাদের কোনো যত্ন তো দূরের কথা খেয়ালই  রাখি না। শ্বাস কখন এলো, আবার কখন গেলো, সেটা আমাদের নজরে পড়ে না। আমরা ভাবি ওটাতো এমনি এমনি হয়। এর জন্য আমাদের কোনো প্রয়াস করতে হয় না। কিন্তু সত্য হচ্ছে, যিনি এই শ্বাস-প্রশ্বাসের গতির দিকে খেয়াল রাখতে পারেন, তিনি শুধু  শারীরিক দিক থেকে সুস্থ  থাকতে পারেন তাই নয়, তিনি উন্নত মানসিক চিন্তাধারার মানুষ হয়ে যান। এইজন্য শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হবে। 

প্রত্যাহার : আমাদের মন স্বাভাবিক ভাবে বহির্মুখী। এই বহির্মুখী মনকে আমাদের অন্তর্মুখী করতে হবে। যে কোনো বিষয়কে যদি বুঝতে হয়, তবে সেই জিনিসের প্রতি বা বিষয়ের প্রতি আমাদের মনঃসংযোগ করতে হবে। আর অধ্যাত্ম সাধনা যেহেতু অন্তরের  বস্তুকে উপলব্ধির সাধনা, তাই আমাদের বহির্মুখী মনকে অন্তর্মুখী করার চেষ্টা করতে হবে।  একেই বলে প্রত্যাহার। 

ধারণা :  কোনো একটা বিষয়ে মনকে একাগ্র করা। অর্থাৎ বিষয়-বহির্ভূত চিন্তা মনে আনতে  দেওয়া চলবে না। 
ধ্যান : ধ্যান আর কিছু নয়, গভীর চিন্তন।  অর্থাৎ নির্দিষ্ট বিষয়ে গভীর চিন্তা করবার অভ্যাস করাই ধ্যান। 
সমাধি :সমাধি একটা বোধদয় অবস্থা। আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টার মূল লক্ষ হচ্ছে এই সমাধির অবস্থা।

ঘোড়া দাঁড়িয়ে ঘুমায়। ঘোড়ায় কামড়ালে সেখান থেকে মাংসের দলা নিয়ে তবে ছাড়বে। জোঁক একটা  গাছ আঁকড়ে ধরে তবে অন্য গাছ ছাড়বে। এর দ্বারা আমি বলছে চাইছি, যে - যে বিষয়টি আপনি ধরবেন, তার শেষ দেখে তবে ছাড়বেন। যতক্ষন বিষয়টি আপনার আয়ত্ত্বে না আসবে, ততক্ষন অন্য বিষয়ের দিকে নজর দেবেন না। আর এই যে পর্যায়গুলো আমরা আলোচনা করলাম, এর প্রত্যেকটি পর্যায় আপনাকে অনুশীলনের মাধ্যমে আয়ত্ত্বে আনতে  হবে। যম ও নিয়ম আমাদের সারা জীবন ধরে চর্চা করতে হবে। এর থেকে বিচ্যুত হওয়া মানে সাধন জীবন থেকে ছিঁটকে যাওয়া। 

এবার আমরা প্রাণের নিয়ন্ত্রণ বা প্রাণায়ামের সম্পর্কে শুনবো । স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, রাজযোগের মাধ্যমে শ্বাস আমাদের মনোজগতে প্রবেশ ক'রে আমাদের অতীন্দ্রিয় মার্গে উন্নীত করতে পারে। আমাদের সমস্ত দৈহিক গঠনতন্ত্রের পরিচালক হচ্ছে এই শ্বাস-প্রশ্বাস।  প্রাণায়াম প্রথমে ফুসফুসের উপরে কাজ করে। ফুসফুস প্রভাবিত করে হৃদপিন্ডকে। হৃৎপিন্ড প্রভাবিত করে আমাদের রক্ত চলাচল ব্যবস্থাকে। আবার রক্ত চলাচলের দ্বারা  প্রভাবিত হয় আমাদের মস্তিস্ক। মস্তিস্ক প্রভাবিত করে আমাদের মনকে। আমাদের যে ইচ্ছাশক্তি তা বাহ্যিক বিষয়ের অনুভূতিসম্পন্ন। আবার বাহ্যিক বিষয়ের অনুভূতি আমাদের ইচ্ছাশক্তিকে জাগ্রত করতে পারে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ইচ্ছাশক্তি ভীষণভাবে দুর্বল। ইচ্ছাশক্তির অসীম ক্ষমতাকে আমরা উপল্বদ্ধি করতে পারি না। তার কারন হচ্ছে জড় জগতের বন্ধনীতে আমরা আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পরে আছি। আমাদের প্রায় সব কাজই বহির্জগতের প্রেরণায় ঘটে থাকে। আর বহির্বিশ্ব আমাদের অন্তরের ভারসাম্যকে নষ্ট করে থাকে। আমরা প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করতে পারি না, উপেক্ষাও করতে পারি না,যা আমাদের পারা  উচিত। আমাদের মধ্যে এক বৃহত্তর শক্তি আছে, যা আমাদের কাছে অজ্ঞাত ও নিষ্ক্রিয়। 

যোগ সাধনায় অভিজ্ঞ যোগীগণ আমাদের পথপ্রদর্শক। তাঁরা যোগসাধনার সাহায্যে এই ইন্দ্রিয়প্রসূত জগৎকে জয় করতে পেরেছিলেন। তাঁরা তাদের কথায় ও কাজে এই শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস-এর ক্রিয়াকে বা প্রাণায়ামকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ১. পূরক অর্থাৎ শ্বাস গ্রহণ, ২. কুম্ভক অর্থাৎ শ্বাসকে নিরুদ্ধ করা।  এই কুম্ভক আবার দুই রকম, অন্তর কুম্ভক অর্থাৎ বায়ুকে ভিতরে আটকে দেওয়া, আবার বাহ্য  কুম্ভক অর্থাৎ বায়ুকে বাইরে আটকে রাখা। ৩. রেচক অর্থাৎ শ্বাস ত্যাগ করা। 

এইবার বায়ুর গমন পথ সম্পর্কে একটু বুঝে নেই। আমাদের নাকে দুটো ছিদ্র আছে। ঠিক তেমনি আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে দিয়ে দুটি তরঙ্গ প্রবাহিত হয়। এই তরঙ্গদুটি নিম্নগামী হয়ে মেরুদণ্ডের দুই পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়।  এবং মেরুদণ্ডের কেন্দ্রবিদু স্পর্শ করে আবার মস্তিষ্কে ফিরে আসে। এই তরঙ্গ, দুটো নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়। একটি সূর্য নাড়ী বা পিঙ্গলা নাড়ী। আর একটা চন্দ্র নাড়ী বা ইড়া নাড়ী। এই নাড়ীদুটোর গতিপথ বাংলা ৪ এর আর্দ্ধ্যাংশের মতো। আর এদের প্রবাহিত হবার সময় ৪ সংখ্যাটি সম্পূর্ণ হয়। আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস যেমন দিবারাত্র প্রবাহিত হচ্ছে, ঠিক তেমনি এই তরঙ্গদুটো দিবারাত্রি প্রবাহিত হচ্ছে। আবার এই তরঙ্গ আমাদের মেরুদণ্ডের বিভিন্ন বিন্দুতে অর্থাৎ চক্রে জীবনীশক্তির একটা বিশাল ভান্ডার গড়ে তোলে। আমরা সাধারণত এই শক্তি সম্পর্কে সচেতন নোই। তাই একে আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। কিন্তু যদি আমরা এইসব চক্রে  মনঃসংযোগ করি, তবে এই শক্তিগুলোকে উপলব্ধি করতে পারি। এমনকি আমরা যদি আমাদের দেহের ভিতরের অঙ্গে একটু বেশি মনোযোগ দেই , তবে সেই  অঙ্গক্রিয়া   সম্পর্কেও আমাদের উপল্বদ্ধির মাত্রা বৃদ্ধি  পাবে। ইড়া  ও পিঙ্গলা নাড়ী দুটি শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে নিবিড় ভাবে যুক্ত।  আর এই শ্বাস-প্রশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ ক'রে আমরা আমাদের এই দেহযন্ত্রকে বশে  আনতে  পারি। 

যোগ আমাদের নৈতিক হতে সাহায্য করে। আর এই নৈতিকতার নিয়ন্ত্রক হচ্ছে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস। শ্বাস-প্রশ্বাস আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করে। তো শ্বাস-প্রশ্বাসকে যদি আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি, তবে আমাদের মন নিয়ন্ত্রণে থাকবে। যোগ আমাদের নিয়ন্ত্রণবিদ্যায় পারদর্শী করে তোলে। সমস্ত তরঙ্গগুলোকে যোগীগণ মেরুদণ্ডের বিভিন্ন চক্রে ধরে রাখেন, এবং নিজেদের ইচ্ছামত পরিচালিত করে থাকেন। এই তরঙ্গ তখন জ্ঞান তরঙ্গে পরিণত হয়।  যোগীগণ তাই জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ হয়ে থাকেন।

এবার আমরা তরঙ্গ  প্রবাহিত করবার সঠিক পদ্ধতির দিকে নজর দেবো। প্রথমেই বলি, এই পদ্ধতি সাধারণের জন্য নয়। যারা আমাদের আগের আলোচনা শুনেছেন, এবং সেইমতো নিজেকে প্রস্তুত করেছেন, তারাই একমাত্র এই পদ্ধতি অবলম্বন করবার যোগ্য বিবেচিত হবেন। আসলে আমাদের শ্বাস-প্রশাসকে ছন্দবদ্ধ করতে হবে। এর জন্য আমরা পূরক ও রেচকের সময় ১২৩৪ গুনতে পারি।  কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, এই সময়ে ওঁ এই ধ্বনি পরপর চারবার উচ্চারণ করতে পারি। আমরা জানি  বায়ু তরঙ্গের মধ্যে  ধ্বনি ভেসে বেড়াচ্ছে। আর সমস্ত শব্দ বা ধ্বনির  বীজ বা মূল  হচ্ছে এই ওঙ্কার বা  ওং।  তাই এই ওং ধ্বনির স্মরণ আমাদের দুই দিক থেকে লাভবান করবে। যাই হোক, ধর্মীয় দিক থেকে না দেখে আমরা যদি বিজ্ঞানের দিক থেকে দেখি তবে প্রণবের মাহাত্ম আমাদের শরীর  তরঙ্গে একটা প্রভাব ফেলছে, তা আমাদের স্বীকার করতে হয়।  যাই হোক এবার আমরা প্রাণায়ামের প্রক্রিয়ার কথা শুনবো, স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে।  

১. ডান হাতের  বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ডান নাকের নাসারন্ধ্র বন্ধ করুন। বা নাসারন্ধ্র দিয়ে ওং শব্দটি  চারবার মনে মনে  উচ্চারণ করতে করতে শ্বাস গ্রহণ করুন।  
২. এবার বামনাশা, তৰ্জনী বা অনামিকা দিয়ে বন্ধ করুন, অর্থাৎ এখন আপনার ডান নাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে বন্ধ, বাম  নাক অনামিকা দিয়ে বন্ধ। এবার  শ্বাসকে ধরে রাখুন বা অন্তর-কুম্ভক করুন  ও  আটবার মনে মনে  ওঁ শব্দটি উচ্চারণ করুন। 

৩. এবার ডান নাক  থেকে বুড়ো আঙ্গুল সরিয়ে নিঁশ্বাস ছাড়তে থাকুন।  এইসময় চারবার মনে মনে  ওং বলতে হবে।  শ্বাস পুরো ছেড়ে দেওয়া হলে তলপেট পিঠের দিকে অর্থাৎ ভিতরের দিকে টেনে নিন যাতে ফুসফুসে কোনো বাতাস না থাকে। এবার বাহ্য-কুম্ভক করুন সঙ্গে সঙ্গে ৮ বার ওং  উচ্চারণ করুন।
 
৪, এরপর বা নাকের নাসারন্ধ্র বন্ধ করে, ডানদিক দিয়ে গভীর শ্বাস নিতে হবে।  এইসময় চারবার ওং  বলতে হবে। শ্বাস নেওয়া পূর্ন হলে, অন্তরকুম্ভক করুন, এবং মনে মনে আটবার ওং  উচ্চারণ করুন।  
৫.. এবার ডান নাক বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে বন্ধ করতে হবে বাম নাক দিয়েধীরে ধীরে  নিশ্বাস ছাড়তে হবে।  আবার 
বাহ্য-কুম্ভক করতে হবে, ও আটবার ওং উচ্চারণ করতে হবে।  

অর্থাৎ পূরক একবার ডান  নাকে একবার বা নাকে। রেচক ঠিক বিপরীত ভাবে একবার বাম নাকে একবার ডান নাকে। বাহ্য কুম্ভক একবার বাতাস বাইরে রেখে, অন্তর কুম্ভক একবার বাতাস ভিতরে রেখে। এই হচ্ছে এক রাউন্ড। এমনি চারবার করতে হবে। এই প্রক্রিয়া একসপ্তাহ করতে হবে। ৪:৮:৪:৮
অর্থাৎ শ্বাস ছাড়ার বা নেবার জন্য যে সময় নেবো তার দ্বিগুন সময় কুম্ভক করতে হবে। ধীরে ধীরে মাত্রা বাড়াতে হবে যেমন ৪ থেকে ৬ রেচক ও পুরকের  জন্য, এবং ৮ থেকে ১২ কুম্ভকের জন্য। তবে নিজের শরীর বুঝে এটা  করতে হবে। বেশিক্ষন কুম্ভক করলে মাথা ঘুরতে পারে। যাদের রক্তচাপ বা হার্টের সমস্যা আছে - তারা এসবের মধ্যে যাবেন না। তারা বরং অনুলোম বিলোম, কাপালভাতি ইত্যাদি করুন। 
স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, আসনে বসার  আগে, একবার প্রার্থনা করে নিতে হবে।  "ওম অসতো মা সৎ গময়। তমসো মা জ্যোতির্গময়। মৃত্যুর্মা অমৃতম্ গময়।   হে জগতস্রষ্টা আমরা সেই  জ্যোতিঃ ছটাকে ধ্যান করছি। তিনি আমাদের অন্তর্লোক উদ্ভাসিত করুন।  
তথ্যসূত্রঃ বিবেকানন্দ রচনাসংগ্রহ - প্রথম খন্ড - প্রবন্ধ - রাজযোগ সংক্রান্ত ছটি অনুশীলনী।  
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম। 

রাজযোগ অনুশীলনী - ৩ - স্বামী বিবেকানন্দের সাথে :

আমাদের শরীরের  ত্রিকাস্থির কাছাকাছি,  একটা স্নায়ুকেন্দ্র আছে। যেখানে আমাদের সমস্ত জৈবশক্তি বলুন আধ্যাত্মিক শক্তি বলুন, অর্থাৎ পরা ও অপরা শক্তি এখানেই সুপ্ত অবস্থায় আছে। ত্রিক কথাটার মানে হচ্ছে মুরুদন্ডের নিম্ন প্রদেশ। আর অস্থি মানে হাড়। অর্থাৎ মেরুদণ্ডের নিম্ন ভাগে।  আসলে এটা  আছে, আমাদের গুহ্যদ্বার ও মূত্রদ্বারের মাঝামাঝি স্থানে। এই স্নায়ুকেন্দ্রকে সাধকগণ বলে থাকেন মূলাধার।  অর্থাৎ মূল বা প্রধান আধার। সাধন জীবনে এই স্থানটির গুরুত্ত্ব অপরিসীম। এই স্নায়ুকেন্দ্রটিকে প্রথম দিকে ধারণা করবার জন্য ত্রিকোণ হিসেবে কল্পনা করতে হয়, উলটো ত্রিভুজ এবং মনে করতে হয়, যে এখানে একটা ঘুমন্ত সর্প কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে । এটা নিছক আমাদের কল্পনা। কিন্তু যেটা গুরুত্ত্বপূর্ন সেটা হচ্ছে,  এই স্নায়ুকেন্দ্র সম্পর্কে আমাদের সর্বাধিক সচেতন থাকতে হবে। 

আমি আমাকে চিনিনা। আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ  শরীরকেই "আমি" বলে ভাবি।  কেউ কেউ একে আত্মা বলে থাকি। যে যাই বলি না কেন, এর দ্বারা সত্যকে আমরা জানতে পারি না। শরীর বললে তবুও  একটা বস্তু আমাদের ধারণাতে আসে।  কিন্তু আত্মা বললে, আমরা কিছুই বুঝতে পারি না। প্রথমত আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে, আমরা কেউ শরীর নোই, আর আমরা সবাই অমর। সত্যিকারের আমার জন্ম-মৃত্যু বলে কিছু নেই।  ধরুন আমার নাম আত্মা।  এখন আত্মার স্বরূপ সম্পর্কে আমাদের বুঝতে হবে,  বা আত্মা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান সঞ্চয় করতে হবে। তবে একটা বলি, এই আত্মা সম্পর্কে আগে থেকে কোনো ধারণা করে নেবেন না। এই আত্মা যেমনই হোক, আমাদের উচিত হবে, আত্মাকে সেইভাবে উপলব্ধি করা। অর্থাৎ আত্মাকে আমাদের আত্মা রূপেই  অনুভব করতে হবে। তবেই  সত্য প্রকাশিত হবে।

আমরা যাকে মৃত্যু বলি, তা আসলে পরিবর্তন মাত্র। আর পরিবর্তনের অর্থ হচ্ছে কার্য্য কারণের দ্বৈততা। আমাদের দেহ একটা গতিশীল পদার্থ। দেহের এই যে সূক্ষ্ম  গতি এটা আমরা ধরতে পারি না।  তবে এটা আমরা বুঝতে পারি, আমাদের দেহ প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। আর  যাকিছু গতিশীল তা কখনো চিরস্থায়ী হতে পারে না। তাই গতিশীল এই জীবদেহ কখনো অমর হতে পারে না। এমনকি আমাদের যে মন, তার চঞ্চলতা আমরা উপলব্ধি করি, অর্থাৎ মন সদা পরিবর্তিত হচ্ছে। অতএব মনও চিরস্থায়ী বস্তু নয়। আমাদের দেহ যেমন স্থুল পদার্থ, তেমনি আমাদের মন সূক্ষ্ম পদার্থ। কিন্তু পরিবর্তনশীল এবং মরণশীল। 

তাহলে আমরা কি ? আমরা একটা শক্তি। আর এই শক্তি হচ্ছে চিরস্থায়ী। এই শক্তি সৃষ্টি করা যায় না। একে প্রকাশিত করা যায়। এই চিরসত্য শক্তি আমাদের অজ্ঞতার অন্ধকারে, অজ্ঞতার আবরনে ঢাকা পড়ে  আছে। আমাদের কাজ হচ্ছে এই অজ্ঞতার আবরণকে অপসারিত করে, সত্যকে উন্মোচন করা। দেহ হলো চিন্তার অভিব্যক্ত রূপ।  সূর্য ও চন্দ্র এই দুটি তরঙ্গ দেহের সমস্ত অঙ্গে শক্তি সঞ্চারিত করে। অতিরিক্ত শক্তি আমাদের মেরুদণ্ডের কয়েকটি চক্রে  বা কেন্দ্রে সঞ্চিত হয়। এগুলোকে স্নায়ুকেন্দ্র বলে। এই কেন্দ্রগুলোতে একটা ঝলক বা ঝিল্লি দেখা দেয়। এই ঝিল্লি মৃতদেহে দেখা দেয়  না। এই তরঙ্গগুলোও মৃতদেহের মধ্যে দেখা যায় না। একমাত্র যে দেহের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার দেখা যায়, সেখানে এই তরঙ্গ বা ঝিল্লির দেখা মেলে। আর যোগীগণ এই তরঙ্গগুলোকে শুধু উপলব্ধি করেন তাই নয়, এগুলোকে মানসচোক্ষে দেখতে পান। যোগীগণ এই তরঙ্গের গতাগতি, স্নায়ুকেন্দ্রে এর প্রভাব ইত্যাদি  উপলব্ধি করতে পারেন।

আমাদের কর্ম্ম দুই প্রকার।  এক হচ্ছে চেতন মনের কর্ম্ম, আর এক হচ্ছে অবচেতন মনের কর্ম্ম। যোগীগণের আর ধরনের কর্ম্ম আছে, যাকে  বলা হয় অতিচেতন মনের কর্ম্ম। এই যে অতিচেতন মনের কর্ম্ম এটাই আমাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞানের উৎস। এই অতিচেতন অবস্থায় আমাদের কোনোরূপ ভ্রান্তি থাকে না। একেই বলে অপরোক্ষ অনুভূতি। 

অতিচেতন মনের কর্ম্ম আমাদের দৈব অনুপ্রেরণায় হয়ে থাকে। রাজযোগীগণ বলছেন, এই গুন্ সমস্ত মনুষ্যের মধ্যে বিদ্যমান। এঁকে সমস্ত মানুষই ব্যবহার করতে পারেন । এখন কথা হচ্ছে এর জন্য আমাদের কি করতে হবে ?

আমরা যে দুটো তরঙ্গের কথা বলছিলাম, অর্থাৎ সূর্য তরঙ্গ ও চন্দ্র তরঙ্গ এই দুটোকে আমাদের একটা নতুন পথে পরিচালিত করতে হবে। আর এই কাজটাই যোগীগণ করে থাকেন। আর সেই পথ হচ্ছে সুষুম্নার পথ। আমাদের কাজ হচ্ছে দুটো ১. সুষুম্না নাড়ীর দ্বার উন্মোচন করতে হবে। ২. বায়ুশক্তিকে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর করতে হবে অগ্নি-শক্তির  সাহায্যে। আর এই কাজটি যখন সম্পন্ন হবে, তখন মেরুদণ্ডের মধ্যবর্তী এই সুষুম্না নাড়ীপথ দিয়ে এই তরঙ্গ আমাদের মস্তিস্কগামী হবে, আর তখনি আমাদের দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার ক্ষমতা জন্মাবে। 

প্রত্যেক মানুষের মধ্যে জৈবক্রিয়ার   মাধ্যমে নির্দিষ্ট বয়সে রজঃ ও শুক্রউৎপন্ন হয়, যাকে  আমরা যৌন শক্তি বলে থাকি । সাধারণের মানুষের এই শক্তি নিম্নগামী। এই শক্তি যখন সূক্ষ্ম হয় তখন তাকে বলে ওজঃশক্তি। রাজযোগীগণের মতে,  ঈশ্বরত্ব লাভের  প্রথম ধাপ হচ্ছে, এই যৌনশক্তিকে ওজ্সে রুপান্তরিত করা। তাই রাজযোগীগণ ওজস্বী হবার কথা বলেন, ওজস্বী ভাবে কথা বলেন, তাঁর বক্তব্যে সমগ্র পৃথিবী অনুপ্রাণিত হয়। 

রাজযোগী প্রথমে কল্পনার সাহায্যে, ভাবনার সাহায্যে এই শক্তি বা কুণ্ডলিনীকৃত সাপটাকে ধীরে ধীরে জাগ্রত করেন। এবং সুষুম্না নাড়ী দিয়ে ঊর্ধ্মুখে চালিত করতে পারেন। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলা যেতে পারে, সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে আছে  বজ্রাক্ষা নাড়ী, আবার বজ্রাক্ষা নাড়ীর মধ্যে আছে চিত্রাণি নাড়ী। আমাদের ওজঃশক্তি যত  সূক্ষ্ম হবে, তত ধীরে ধীরে আমরা সুষুম্নার পরে, বজ্রাক্ষা, বজ্রাক্ষার পরে চিত্রাণি নাড়ী দিয়ে এই শক্তি চালিত করতে পারবো। কিন্তু আমাদের সাধন প্রক্রিয়া এই সুষুম্না নাড়ীতে কিভাবে এই চালিত করতে পারা  যায়, আমাদের আলোচনা তার মধ্যেই সীমিত থাকবে ।

আমরা আগেই শুনেছি, কোনো শক্তিই সৃষ্টি করা চলে না।  কিন্তু আমরা যেটা পারি সেটা হচ্ছে,  শক্তিকে আমাদের ইচ্ছে মতো পরিচালনা করতে। আর এই শক্তি সবার  মধ্যে আছে। সুতরাং আমাদের উচিত, এই বিরাট শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা। 

আমাদের ইচ্ছাশক্তিকে পাশবিক কাজে না  লাগিয়ে, ইচ্ছাশক্তিকে আমাদের আধ্যাত্মিক কাজে নিয়োজিত করতে হবে। এই রূপান্তরের প্রক্রিয়াই আসলে ধার্মিকতা, যা আমাদের রাজযোগ শেখায়। তাই রাজযোগের প্রথম পাঠই হচ্ছে, নৈতিকতা, শুদ্ধতা। রাজযোগের ক্ষেত্রে ভাবনা-চিন্তায়, কথায়-কাজে আমাদের প্রশ্নাতীত পরিশুদ্ধি আনতে  হবে। এবং একমাত্র পরিশুদ্ধ জীবনেই ভগবৎ দর্শন সম্ভব। 

প্রাণায়াম যা আমরা আগে বলেছি, পূরক, রেচক, ও কুম্ভক  করবার ঠিক আগমুহূর্তে ওই ত্রিকোনটি কল্পনা করুন। যার মধ্যে একটি ঘুমন্ত সাপ কুণ্ডলিনী  পাকিয়ে অবস্থান করছে। আর এই ত্রিকোণের অবস্থান হচ্ছে আমাদের মেরুদণ্ডের মুলে। কল্পনা করুন, যেন একটা অগ্নি শিখা ওই ত্রিকোনটিকে ঘিরে রেখেছে। আর ছোট্ট সাপটি ত্রিকোণের মাঝখানে কুণ্ডলিনী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। যখন এই কুন্ডলিনীকে আপনি স্পষ্ট দেখতে পাবেন, তখন আপনার কাজ হবে আপনার সংযত নিঃশ্বাস ওই সাপটির মাথায় ফেলা। যাতে সে জেগে ওঠে। এসব প্রথমে আপনাকে কল্পনার সাহায্যেই করতে হবে। আর আপনার কল্পনা শক্তি যত  প্রবল হবে, যত  প্রখর হবে, তত তাড়াতাড়ি ফল পাওয়া যাবে এবং এই শক্তি তখন জেগে উঠবে। যতক্ষন না এই জাগরণ হচ্ছে, ততক্ষন একে জাগ্রত রূপে কল্পনা করতে থাকুন। আপনার ভিতরে যে তরঙ্গ বইছে, তাকে অনুভব করবার চেষ্টা করুন। এবং সুষুম্নার মধ্যে দিয়ে একে চালিত করবার চেষ্টা করুন। স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, এতেই  দ্রুত ফল মিলবে। 
প্রার্থনা দিয়ে শুরু করুন, আবার প্রার্থনা দিয়ে প্রক্রিয়া সমাপ্ত করুন, ওম অসতো মা সৎ গময় ..........
তথ্যসূত্রঃ বিবেকানন্দ রচনাসংগ্রহ - প্রথম খন্ড - প্রবন্ধ - রাজযোগ সংক্রান্ত ছটি অনুশীলনী।  
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।

রাজযোগ অনুশীলনী - ৪ - স্বামী বিবেকানন্দের সাথে। 

ভারতবর্ষে এমন কিছু মানুষের কথা আমরা   শুনে থাকি, যারা তাদের জীবদ্দশাতেই মৃত্যুকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছেন । এই সব যোগীগণ স্ব-ইচ্ছায় স্বজ্ঞানে দেহ পরিত্যাগ করেছেন। না আত্মহত্যা নয়। এইসব যোগীমহাপুরুষগন সমাধি অবস্থায় অতিমানস চৈতন্যে স্থিত হয়ে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ-ইন্দ্রিয়াদিতে পরিব্যাপ্ত যে শক্তি তাকে প্রত্যাহার করে  এমন কৌশলে দেহ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন, যেন সাপ  তার খোলস বদলাচ্ছে। যোগীগন তাদের আরব্ধ কাজ শেষ করে পরম-আনন্দে নির্ভয়চিত্তে দেহ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন, কিন্তু দেহ ত্যাগের আগে সকলকে জানিয়ে দেন।  এমনকি অন্তিমমুহূর্তের আগাম দিন-ক্ষণ বলে দিয়ে থাকেন। এখন কথা হচ্ছে এই কাজটা কিভাবে সম্ভব ? 

একটা কথা বলি কোনো মানুষ যখন স্বেচ্ছায় আত্মাকে বিমুক্ত করে বেরিয়ে যাবার যোগ্য হয়ে ওঠে, তখন বুঝতে হবে তিনি মৃত্যুর অনিত্যতার উপলব্ধি করেই মৃত্যুকে জয় করেছেন। আর এই মৃত্যুঞ্জয়ী হবার প্রয়াসে আমাদের কোনো উৎকট ধারণা, কোনো মতবাদ ও উৎকট পদ্ধতি আশ্রয় করবার প্রয়োজন নেই। রাজযোগ  সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান হলে আমরা দেখতে পাবো যে রাজযোগ কতদূর বিজ্ঞান সম্মত। রাজযোগ অভ্যাসের দ্বারা আমরা দেহ থেকে আত্মাকে প্রত্যাহার করে নিয়ে মরনের পারে চলে যেতে পারি। কোনো অবৈজ্ঞানিক কিম্ভুত বিশ্বাস বা পথ বা যুক্তিহীন ব্যক্তির প্রভাবে কিছুতেই আমরা মৃত্যুর রাজ্য অতিক্রম করতে পারবো না। আমাদের আত্মা যখন দেহ ও ইন্দ্রিয়গ্রাম পরিত্যাগ ক'রে পরিত্যক্ত দেহটির বাইরে সাক্ষী রূপে জাগ্রত থাকবে কেবল তখনই বুঝতে হবে যে আমাদের পক্ষে মৃত্যুকে জয় করা সম্ভব হয়েছে। এই অবস্থায় আমরা যখন পৌঁছুতে পারবো, তখন জগতের কারুর সাধ্য নেই যে আমাদের বিনাশ সাধন করে। 

আজ আমরা সেই রাজযোগের চতুর্থ পর্ব্বের কথা শুনবো। শুনবো স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে। আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিন্তু মনকে নিয়ন্ত্রণ করবার আগে যা  করতে হবে তা হচ্ছে, মনকে আমাদের নিরীক্ষণ করতে হবে। আমাদের মন অস্থির।  এই অস্থির মনকে স্থির করতে হবে। মনকে বন্দি করতে হবে। উদ্ভ্রান্ত এই মনকে বিভিন্ন বিষয় থেকে একটা নির্দিষ্ট ধারণায় স্থিরকৃত করতে হবে। প্রথম দিকে এটা অসম্ভব মনে হবে, কিন্তু বার বার এই চেষ্টা করতে হবে। আমাদের ইচ্ছাশক্তির দ্বারা নিশ্চই আমরা আমাদের মনকে আয়ত্তে আনতে  পারবো। চেষ্টা করতে হবে আমাদের মনকে স্থির করে ঈশ্বরের মহিমায় অনুধ্যানে যাতে  নিয়োজিত করতে পারি । মনকে আয়ত্ত্বে আনবার উপায় হলো, প্রথমে স্থির হয়ে বসে, মনকে স্বেচ্ছাচারী হতে দেওয়া। একান্ত ভাবে ভাবতে হবে, "আমি প্রতক্ষ্যদর্শী, আমার মনকে আমি বিকশিত হতে দেখছি। আমার সঙ্গে আমার মনের কোনো সম্পর্ক নেই।" .এর পর ভাবতে চেষ্টা করুন, আমি এবং আমার মন পৃথক সত্তা। নিজেকে ঈশ্বরের সমগোত্রীয় ভাবুন, আমি জড় নোই, আমি মন নোই।  এই ভাবে ভাবতে থাকুন। 

কল্পনা করুন, যে একটা শান্ত সরোবরের মতো আমর মন আমার সামনে প্রসারিত হয়ে আছে। আর যে সব চিন্তা এই মনে আনাগোনা করছে, সেগুলো যেন এই সরোবরের বুদ্বুদ। চিন্তারূপ বুদ্বুদ একবার জলের উপরে ভেসে উঠছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। চিন্তাগুলোকে দমন করবার কোনো দরকার নেই। সেগুলোকে শুধু নিরিক্ষন করতে থাকুন। এবং কল্পনায় সেই ভেসে বেড়ানো চিন্তাগুলোকে অনুসরণ করুন। এর ফলে দেখবেন চিন্তার পরিধি ক্রমশঃ ছোট হয়ে আসছে। কারন মন চিন্তার বিস্তীর্ন গন্ডির মধ্যে ঘুরে বেড়ায় এবং এই গণ্ডিগুলো প্রসারিত হয়ে ক্রমবর্ধমান গন্ডিতে পরিণত হয়। পুকুরে ঢিল ছুড়লে যেমন ঢেউ ধীরে ধীরে ক্রমবর্ধমান গন্ডি সৃষ্টি করতে করতে একসময় মিলিয়ে যায়। আমরা এবার এই চিন্তারূপ ঢেউয়ের উল্টো দিক থেকে শুরু করবো। অর্থাৎ চিন্তারূপ যে গন্ডি আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে, সেই গণ্ডিটাকে ধীরে ধীরে ছোট করে আনবো। যতক্ষন না এই কেন্দ্রবিন্দুতে মনকে আবদ্ধ করতে পারছি, ততক্ষন আমরা চেষ্টা করে যাবো। এই সময় একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, যে আমি ও আমার মন আলাদা। আমি নিজেকে চিন্তা মগ্ন দেখছি, আমি আমার মনের ক্রিয়াকলাপ লক্ষ করছি। এইভাবে প্রতিদিন অভ্যাস করলে, নিজের সঙ্গে নিজের চিন্তার ও অনুভূতির একত্রীকরণের প্রয়াস কমে আসবে। যতক্ষন না, শেষ পর্যন্ত নিজেকে মন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করতে পারছেন, ততক্ষন চেষ্টা করতে হবে। যতক্ষন না আমাকে আমি আমার মন থেকে একটা পৃথক সত্তা বলে চিনতে পারছি, ততক্ষন আমাদের এই চেষ্টা করে যেতে হবে।  অর্থাৎ আমি এবং আমার মন সম্পূর্ণ আলাদা এই ভাবনায় নিজেকে দৃঢ় করতে হবে। 

স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, এই কাজ সম্পাদিত হলে, মন আপনার দাসে  পরিণত হয়ে যাবে। এবং আপনি তখন আপনার মনকে ইচ্ছেমত নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। যোগী হবার প্রথম শর্তই   হলো, ইন্দ্রিয়ের বেড়াগুলোকে অতিক্রম করা। মন যখন সাধকের  বশীভূত হয়, তখন সাধক  তুরীয় অবস্থায় উন্নীত হয়। 

বিবেকানন্দ বলছেন, যতদূর সম্ভব এই অভ্যাস চলাকালীন সময় একাকী থাকুন।  আপনার আসনটি যেন আরামদায়ক দৈর্ঘের হয়। প্রথমে কুশাসন, তারপর ছালের  এবং পরে একটি রেশমের ঢাকনা পেতে নিন। আসনে হেলান দেবার ব্যবস্থা না থাকাই  ভালো। 

চিন্তাগুলো যেহেতু ছবির  মতো, সেহেতু আমরা তাদের সৃষ্টি  করবো না। সমস্ত চিন্তা আমাদের মন থেকে সরাতে হবে। মনকে সম্পূর্ণ শূন্য করতে হবে। যখনই চিন্তার উদ্রেক হবে, তখনই তাকে বিতাড়িত করতে হবে।  আর এই সামর্থ অর্জন করতে হলে, আমাদের জড়ের উর্দ্ধে উঠতে হবে। দৈহিক চেতনাকে অতিক্রমকরে যেতে হবে। প্রকৃত পক্ষে মানুষের সমস্ত জীবন এই কর্ম্ম সম্পাদনেরই প্রচেষ্টা স্বরূপ।

মনে করুন, বিশ্বচরাচর আমাদের দেহ, আর এই ক্ষুদ্র দেহ হচ্ছে একটা আয়না। আমিই বিশ্ব। আমি যা কিছু দেখছি, তা আমারই প্রতিচ্ছবি। সুপারিচালিত কল্পনাই আমাদের পরম বন্ধু। এই কল্পনা যুক্তির উর্দ্ধে, কিন্তু এটাই একমাত্র আলোকবর্তিকা যা আমাদের সত্যে উপনীত করবে । অন্তঃস্থল থেকে প্রেরণা অনুভব করুন। ঈশ্বরের ধ্যান করুন।  জ্ঞানদাতাকে আমরা জানতে পারি না, কিন্তু আমরা তারই অংশ, এই অনুভব দৃঢ় হোক আপনার মধ্যে।  

এর পরে আরো দুটো অনুশীলনী আছে, আমরা সেগুলো ধীরে ধীরে শুনবো।  আজ এই পর্যন্ত। তথ্যসূত্রঃ বিবেকানন্দ রচনাসংগ্রহ - প্রথম খন্ড - প্রবন্ধ - রাজযোগ সংক্রান্ত ছটি অনুশীলনী।  

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম। 

রাজযোগ অনুশীলনী - ৫ - স্বামী বিবেকানন্দের সাথে।

আজ আমরা শুনবো, প্রত্যাহার ও ধারণা সম্পর্কে। ভগৱান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন "যে যেভাবেই হোক  যে মাধ্যমের সাহায্যেই হোক,  আমাকেই সে চায়, এবং সে আমার কাছেই পৌঁছবে। প্রত্যেক ব্যক্তি আমাতেই উপনীত হবে।
স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, প্রত্যাহার হলো মনকে আয়ত্তে আনার প্রচেষ্টা এবং কাঙ্খিত বিষয়ে মনকে নিয়োজিত করা। এর জন্য মনকে প্রথমে তার ইচ্ছেমতো ভাসতে দাও। এবং লক্ষ করো, মন কি ভাবছে।শুধু নীরব সাক্ষী হয়ে যাও। মন আসলে স্থুল পদার্থেরই সূক্ষ্মতম  রূপ। আমরা সবাই এই সূক্ষ্ম বস্তুটির অধিকারী।  এই মনকে স্নায়ুশক্তিগুলোর মধ্যে নিয়োজিত করতে হবে। আমরা যাকে  দেহ বলি সেটি হচ্ছে আমাদের মনের বিষয়মুখী রূপ। আমাদের আত্মা বা "আমি" আসলে এই দেহ ও মনের উর্দ্ধে। দেহ হচ্ছে, চিন্তার বিমূর্ত রূপ। এই আমি বা আত্মন শাশ্বত অপরিবর্তনশীল দর্শক মাত্র। 

আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস যখন বাম নাসারন্ধ্র দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন আমাদের বিশ্রামের সময়। এই শ্বাস-প্রশ্বাস যখন আমাদের ডান  নাক দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন আমাদের কাজ করবার সময়। আবার শ্বাস-প্রশ্বাস যখন আমাদের উভয় নাসিকা দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন আমাদের ধ্যানের সময়। অর্থাৎ বিশ্রাম, কাজ ও ধ্যানের সময়গুলোকে আমাদের খেয়াল করতে হবে, এবং সেইমতো আমাদের সময়কে ভাগ করে নিতে হবে। তো এইজন্য আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি প্রকৃতির দিকে খেয়াল রেখে জীবন ধারাকে পরিচালিত করতে হবে। যখন আমরা প্রশান্তিতে থাকি, তখন আমাদের দুই নাসারন্ধ্র দিয়েই সমান ভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রবাহিত হয়, এই সময়টা আমাদের ধ্যানের  পক্ষে আদর্শ সময়। স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, প্রথমেই মনঃসংযোগের চেষ্টা করা অর্থ হীন। চিন্তার সংযম নিজের থেকেই আসবে, যদি আমরা আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে ইচ্ছেমতো প্রবাহিত করতে পারি। এই ইচ্ছেমতো প্রবাহিত করবার জন্য, প্রথমে আমাদের হাতের তালু ও তর্জনী দিয়ে নাসারন্ধ বন্ধ করে অনুশীলনী চালিয়ে যেতে হবে।  এর পরে আমরা ইচ্ছেশক্তির দ্বারাই, শুধুমাত্র চিন্তার মাধ্যমে এই শ্বাস-প্রশ্বাসের গতির পরিবর্তনে সমর্থ হবো।শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি পরিবর্তনের জন্য এই ভিডিওটি দেখতে পারেন।  https://www.youtube.com/watch?v=464wi5sOWmA&t=681s

এর আগে যে পদ্ধতিতে প্রাণায়ামের কথা বলেছিলাম, এবার সেই প্রাণায়ামের সামান্য পরিবর্তন করতে হবে। সাধকের  যদি নির্ধারিত কোনো আদর্শ থাকে, অর্থাৎ যদি কোনো ইষ্ট  থাকে, বা কোনো বিশেষ মন্ত্র থাকে, তবে শ্বাস গ্রহণ ও শ্বাস ত্যাগের সময়, ওঁং এর  পরিবর্তে  সেটাকেই ব্যবহার করুন। কুম্ভক করবার সময় "হুম" এই ধ্বনিটি ব্যবহার করতে হবে। প্রত্যেকবার হুম ধ্বনিটি ব্যবহার করবার সময়, নিয়ন্ত্রিত শ্বাসকে জোরে কুন্ডলিনীর মাথায় ফেলতে হবে এবং ভাবতে হবে, এর ফলে কুন্ডলিনীর জাগরণ হচ্ছে। একটা ভাবনা সব সময় জাগিয়ে রাখতে হবে, যে আমরা সবাই ঈশ্বরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। 

কিছুক্ষন পরে, ভাবনার আবির্ভাব হবে। অর্থাৎ ভাবনার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাবো। এবং আমরা আমাদের ভাবনার প্রারম্ভিক রূপের সঙ্গে পরিচিত হবো। এইবার আমাদের আগামী চিন্তাগুলো সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। তখন চিন্তা এবং আমি এই দুটোকে আলাদা করতে হবে। অর্থাৎ চিন্তা আমাদের সামনে সামনে চলছে, আর আমি তার পিছন পিছন চলছি।  এই ভাবে, আমাদের চিন্তা ও অমিকে আলাদা করতে হবে। অর্থাৎ এখন দুটি পৃথক সত্তা, একটা আমি, আর একটা আমার চিন্তা। চিন্তা এবং আমি যেন  গুলিয়ে না যায়। যখন এইভাবে আমি আমার চিন্তা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারবো, তখন আমাদের চিন্তাগুলো স্বাভাবিক ভাবেই অবলুপ্ত হয়ে যাবে। 

এইবার পুণ্যচিন্তা অর্থাৎ শুভ বা ভালো চিন্তাগুলোকে অনুসরণ করতে থাকো। এই শুভচিন্তাগুলো যখন তোমার আমির মধ্যে বিগলিত হবে, তখন তুমি ঈশ্বরের পদতলে উপনীত হবে। এইটাই হলো আমাদের অবচেতন অবস্থা। যখন ধারণা বিগলিত হয়, তখন তুমি তাকে অনুসরণ করো, এবং তুমিও বিগলিত হও। 
এইসময় যোগীগণ একটা জ্যোতি দেখতে পায় । কখনো কখনো একটা মুখ দেখে মনে হয়, যে উজ্জ্বল আলোর দ্যুতিটাকে ঘিরে রেখেছে। যেন  সূর্য্যের মধ্যে একটা মুখ। এই দ্যুতির মধ্যে যে মুখের অবয়ব দেখতে পাচ্ছ, তাকে চিনে নেবার চেষ্টা কর। নির্ভুল ভাবে তাকে বিশ্লেষণ কর। এই মুখটি তোমার  ইষ্ট হতে পারে। বা কোনো চিহ্ন হতে পারে, যা তুমি  ধ্যানের প্রথমে প্রতীক হিসেবে জেক  চিহ্নিত করেছিলে।

অর্থাৎ এখন তুমি তোমার  ইষ্টকে মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছ। অর্থাৎ ইষ্ট তোমার  সামনে দৃশ্য হয়ে উঠেছে। এইজন্য ইষ্ট নিদির্ষ্ট করবার আগেই আমাদের একটা নির্ভরযোগ্য প্রতীক ঠিক করতে হয়, যার উপরে আমি নিশ্চিন্তে নির্ভর করতে পারি। যাতে আমি সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করতে পারি। সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়েই যাঁকে  আমরা কল্পনা করতে পারি। 

আসলে সমস্ত চিন্তার একটা রূপ আছে। তাই আমাদের চিন্তার বস্তু যদি আমাদের ইষ্ট হয়, তবে সেই ইষ্ট আমাদের সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা চোখের মাধ্যমে আমরা কল্পনা করি। আমরা যখন আমাদের গুরুদেবের কথা কল্পনা করি, তখন আমাদের চোখের সামনে গুরুদেবের অবয়ব ভেসে ওঠে। প্রত্যেক কল্পনাই অর্দ্ধবাস্তব। অর্থাৎ কিছু অলৌকিকের সংমিশ্রণ ছাড়া আমরা চিন্তা  করতে পারি না। আমাদের অনেকের মনে হয়, চিন্তা ও বাস্তবের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই, কিন্তু আসলে বাস্তব হচ্ছে চিন্তার ফল মাত্র । 

যাইহোক, যোগে এই কল্পনাকে জীইয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে । কিন্তু সতর্ক থাকবে, যাতে কল্পনা আমাদের পবিত্র হয়, শুদ্ধ হয়। আমাদের প্রতীকের কল্পনা শক্তির একটা নিজস্বতা আছে।  যে পথটি তোমার  কাছে সবচেয়ে স্বাভাবিক মনে হবে, তুমি  সেটাকেই অনুসরন করবে । সেটাই তোমার  কাছে সহজ পথ হবে। 

দেখ, তুমি  বিশ্বাস কর আর না কর, পূর্ব-পূর্ব জীবনের কর্ম্মফল অনুযায়ী আমাদের পুনর্জন্ম হয়েছে। বৌদ্ধগণ বলে থাকেন, একটা প্রদীপ থেকে আর একটা প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত হয়েছে। প্রদীপ একাধিক হলেও, আলো  কিন্তু একটাই। অতএব জানবেন, তুমি  একটি পবিত্র আত্মা। এই চিন্তাকে সদা মনের মধ্যে প্রবাহিত কর। নিজেকে উৎফুল রাখ, উদ্দমী রাখ, সাহসী রাখ। প্রতিদিন শরীর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখো । মনের চিন্তার মধ্যে সবসময় পবিত্রতা রাখ। ধৈর্য্যশীল হও । নিরন্তর সুচিন্তার অভ্যাসের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখ। পবিত্র গ্রন্থ পাঠ  কর। সৎ সঙ্গ কর। তাহলেই তুমি  প্রকৃত অর্থে যোগী হতে পারবে। কখনো ব্যস্ত হবে না। যদি কোনো উচ্চতর শক্তির সন্ধান পাও , তাহলেও নিজেকে বিচলিত হতে দেবে না।  জানবে, এই শক্তি মূলশক্তির  কনা  মাত্র, শাখা-প্রশাখা মাত্র । এই শক্তি অনেকসময় যোগীকে পথভ্রষ্ট করে দেয়।  তাই যোগীকে সবসময় সাবধান থাকে হয়। লক্ষে স্থির থকো , ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস রাখ।  তুমি  জানবে, মূল লক্ষ হচ্ছে, ঈশ্বরকে অনুভব করা। একমাত্র চিরন্ত্রন সত্যকে উপলব্ধি করা।  যতদিন না আমার সে উপলব্ধি হচ্ছে, ততদিন আমি বিশ্রাম নেবো না। নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে, এই পথে অগ্রসর হবার জন্য। জাগতিক সমস্ত সংগ্রামের বিলুপ্তি ঘটবে, যদি আমরা পরম সত্তার উপলব্ধি করতে পারি। পরম সত্তায় বিলীন হয়ে যেতে পারি। পরম-সত্তাই সৎ-চিৎ-আনন্দম। তথ্যসূত্রঃ বিবেকানন্দ রচনাসংগ্রহ - প্রথম খন্ড - প্রবন্ধ - রাজযোগ সংক্রান্ত ছটি অনুশীলনী।  

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম। 

রাজযোগ অনুশীলনী - ৬ (শেষ)  - স্বামী বিবেকানন্দের সাথে।

স্বামী বিবেকানন্দ তার রাজযোগ সংক্রান্ত প্রবন্ধে ছয়টি অনুশীলনীর কথা বলেছেন।  এর মধ্যে সবশেষে বলেছেন, কুন্ডলিনীকে জাগ্রত করবার কথা, বলছেন, সুষুম্নার ধ্যান করা প্রয়োজন । সুষুম্নার কল্পনা মূর্তিও তুমি দেখতে পারো। আর এই কল্পনা মূর্তিতে দীর্ঘসময় ধ্যান করো। সুষুম্না নাড়ী অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও অত্যন্ত চমৎকার একটা তন্ত্রী। এটি মেরুদণ্ডের মধ্যবর্তী, যার মধ্য দিয়ে  কুণ্ডলিনী শক্তির জাগরণ হয়। যোগীর ভাষায়, সুষুম্নার দুই প্রান্তে দুটি পদ্ম।  নিচের দিকে আছে মূলাধারে, আর উপরেরটি আছে সহস্রারে। এই দুটির মধ্যে রয়েছে, আরো চারটি পদ্ম। তাই মোট ছটি  পদ্ম, মেরুদণ্ডের মূলভাগে মূলাধার, নাভির বিপরীতে আছে মনিপুর, এছাড়া আছে স্বাধিষ্ঠান যা এই মনিপুর ও মূলাধারের মাঝখানে, সেটা স্বামীজী উল্লেখ করেন নি। হৃদপিণ্ডের সমস্তরে আছে অনাহত, কণ্ঠনালির উপরিভাগে বিশুদ্ধ, দুই চোখের মাঝখানে, অর্থাৎ ভ্রূদ্বয়ের মাঝে,  এবং মস্তিষ্কে মূলগ্রন্থি সহস্রার। এগুলো আসলে আমাদের শরীরের খুব  স্পর্শকাতর জায়গা।    

এই কুণ্ডলিনীকে আমাদের জাগ্রত করতে হবে। অর্থাৎ এইগুলোর দিকে মনকে স্থির করতে হবে,  তার পর ধীরে ধীরে এক স্তর  থেকে আর এক স্তরে বা চক্রে  নিয়ে যেতে হবে যতক্ষন না সেটি আমাদের মস্তিষ্কে পৌঁছছে। প্রতিটি পৰ্য্যায়ের সঙ্গে মনের একটি নতুন স্তরের যোগসূত্র রয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ এই কুন্ডলিনীশক্তি সম্পর্কে এর বেশি কিছু বলেন নি । তবে সাধনার প্রথম দিকে এই চক্রগুলোকে কল্পনা করে নিতে হয়। সাধনার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এই চক্রে একটা কম্পন অনুভূত হয়, এথেকে চক্রের নিদিষ্ট স্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা জন্মে। কুলকুন্ডলিনী সম্পর্কে আরো বিশদ যারা জানতে চান, তারা শশাঙ্ক শেখর পিস ফাউন্ডেশন এর লিংক ভিডিও  গুলো থেকে জেনে নিতে পারেন । এখানে আপনি সমস্ত চক্র সম্পর্কে একটা কাল্পনিক ধারণা পাবেন। যা আপনাকে কাল্পনিক চিত্রের  রসদ জোগাতে পারে।
  

রাজযোগের অনুশীলনী ষষ্ঠ পর্ব্বের সাথে রাজযোগের আলোচনার আজ সমাপ্তি হলো। এই অনুশীলনী একযোগে কয়েকজন মিলে  করতে পারলে ভালো হয়। ভালো থাকবেন। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

ভুলে যাওয়া রোগ নিরাময়  

আমরা ছোটবেলায়, মুখস্ত করা পড়া, পরীক্ষার হলে গিয়ে ভুলে যাই। একটু বয়স হলে চেনা মানুষের নাম ভুলে যাই। এখন এই বৃদ্ধ বয়সে, আমরা অনেকেই  মোবাইল, চশমা, গামছা, কোথায় রেখেছি ভুলে যাই। এই ভুলে যাওয়া রোগ থেকে আমরা কিভাবে ভালো থাকবো, বা  স্মৃতিশক্তি কিভাবে বাড়াবো ?
ছোটবেলার কথা বলছি, ষাটের দশকের প্রথম দিকের  কথা।  আমাদের প্রতিবেশী অসীমদার বাবা, তরনিকান্ত দাস, যার বয়স আশি  পেরিয়ে গেছে,  প্রতিদিন  ভোর বেলায়,উনি বেড়াতে বেরোন। তখন আমাদের লাইনে ইলেক্ট্রিক ট্রেন হয় নি। নটার কাছাকাছি শিয়ালদা থেকে  একটা স্টিম ইঞ্জিনের ট্রেন আসতো। ওই ট্রেনে খবরের কাগজ আসতো।  তো অসীমদার বাবা সকল নটা  অবধি সারা গ্রামে চক্কর দিতেন, আর নটার সময় রেললাইনের কাছে চলে যেতেন। রেলের কামরা থেকে হকার  যুগান্তর পত্রিকা  মুঠো করে, ছুড়ে  দিতেন, তরুণীবাবু, সেটি সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরতেন। এছিলো তার প্রতিদিনকার প্রাতঃকালের  রুটিন। রেললাইন থেকে বাড়ি ফিরবার পথে ছিল আমাদের বাড়ি।  তো একদিন, অসীমদার বাবা, আমাদের বাড়িতে এসে বারান্দার সিঁড়িতে বসলেন। বললেন, খাদ-দাও। তো আমরা বিশেষ করে আমার মা একটু অবাক হয়ে গেলেন।  তরনি বাবুর দুই ছেলে, এক মেয়ে। ইনি এক সময়, ল্যান্ড-রেভিনিউ বিভাগে চাকরি করতেন। পেনশন পান। তিন ছেলে-মেয়ে শিক্ষিত। অসীমদার  দাদা অমিত-দা আইএএস অফিসার। দিল্লিতে পোস্টিং। অসীমদা এম.এ. পাশ করে  বৌবাজারের একটা স্কুলে মাস্টারি করেন। জামাই, তখন জিপিও-তে সুপারিনটেনডেন্ট। এছাড়া বেশ কয়েক-বিঘা চাষের জমিও আছে। বাড়িতে পুকুর ভরা মাছ ।   অর্থাৎ আমাদের সেই  সময়ের শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবার। তো হঠাৎ করে তরনীবাবু আমাদের বাড়িতে এসে বলছেন, খাদ-দাও, অর্থাৎ খেতে দাও। এর অর্থ আমাদের পক্ষে বোঝা মুশকিল। আসলে তখন তরনীবাবুর  স্মৃতি ঠিকমতো কাজ করতো না। 

যাইহোক, এর পরেও আমরা দেখেছি, তরণীবাবু  নিজের বাড়ির রাস্তা ভুলে, অন্যের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন, সেখানে গিয়ে হঠাৎ করে হয়তো বললেন, চা হয়েছে ? অসীমদা ও তার পরিবারের সকলে এইসব দেখে শুনে, ও দেখে, লজ্জ্বা পেতেন।  শেষে তাকে পরিবারের লোকেরা বাড়ি থেকে বার হাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পাছে রাস্তা হারিয়ে  দূরে কোথাও চলে যান। 

প্রতিনিয়ত পৃথিবীতে নতুন নতুন অনেক কিছু আসছে। এখন যেমন আমরা আর উপন্যাসের বই নিয়ে বসি না।  গুগুল বা ইউটুবে বিনোদন খুঁজি। আমাদের স্বছন্দের জন্য যেমন অনেক নতুন নতুন সামগ্রী বাজারে আসছে, তেমনি আসছে, নতুন নতুন রোগ। যার লেটেস্ট আইটেম হচ্ছে করোনা। আজ থেকে ৫০/৬০ বছর আগে আমাদের কাছে, এই ভুলে যাওয়া রোগ ছিল নতুন।  যার আধুলিক নাম হচ্ছে ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্ৰংশ। আজ আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, এই স্মৃতিভ্ৰংশ রোগ থেকে কিভাবে আমরা রেহাই পেতে পারি। অবশ্য়ই কোনো ঔষধ না খেয়ে।

সাধারণত এই রোগটা হয়, একটু বেশি বয়েসে হয় । কিন্তু আজকাল দেখা যাচ্ছে কম বয়সের ছেলে-মেয়েদেরও এই রোগ দেখা দিচ্ছে। তো প্রথমে আমরা দেখে নেই   স্মৃতিভ্ৰংশ রোগটা কেন হয় ? 

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, আমাদের মস্তিষ্কে নার্ভকোষের মধ্যে আমাদের স্মৃতি বা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়ে থাকে।  বয়স বারবার সঙ্গে সঙ্গে বা অন্য কোনো রোগ সংক্রমণে, যেমন হার্টএটাক ইত্যাদির কারনে এই কোষগুলো শুকোতে শুরু করে।  এই কোষগুলো যদি একেবারেই শুকিয়ে যায়, তবে আমাদের আর কোনো স্মৃতি থাকে না। 

পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন, চৈতন্য শক্তির সাথে আমাদের যত যোগাযোগ কমতে থাকে আমরা তত স্মৃতির ভান্ডার ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে উঠি। আসলে স্মৃতির ভান্ডার হচ্ছে বিশ্বশক্তি। বিশ্বশক্তি হচ্ছে সমুদ্র আর আমাদের মস্তিস্ক  হচ্ছে জলের কলসি মাত্র। কলসি থেকে আমরা জলকে ব্যবহারিক কাজে ব্যবহার করে থাকি। স্মৃতি বা আমাদের অভিজ্ঞতার ভান্ডার  কখনো নিঃশেষিত হয় না।  যেমন সমুদ্রের জলের ভান্ডার কখনো শেষ হতে পারে না। জল যেমন সমুদ্র থেকে মেঘে পরিণত হয়, আবার বৃষ্টির আকারে নদীর আকার নেয়, তেমনি আমাদের স্মৃতির ভান্ডার বা অভিজ্ঞতার ভান্ডার জন্ম জন্মান্তর ধরে বহন করে নিয়ে চলি। 

তাই উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে আমরা আমাদের স্মৃতিকে ফিরে পেতে অবশ্যই পারি। 

চিকিৎসা বিজ্ঞানীগন বলছেন, এই রোগ দুই ধরনের, ১. আলঝাইমার ডিমেনশিয়া, ২. ফ্রন্টটেমপোরাল ডিমেনশিয়া। দেখুন এই রোগ প্রাথমিক দিকে আমাদের ভুলে যাবার থেকে, আচরণের পরিবর্তন ঘটায় বেশি ।  অর্থাৎ হঠাৎ রেগে যাওয়া, অকারণে উদ্বিগ্ন হওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। পরবর্তীতে ভুলে যাওয়া রোগটি দেখা যায়। চশমাটা কোথায় রাখলাম, মোবাইলটা কোথায় রাখলাম, নাম মনে করতে না পারা, এমনকি সকালবেলা খেয়েছিলাম কি না সেটাও ভুলে যেতে শুরু করে। এই রোগের  বাড়াবাড়ির পর্যায়ে যখন যায়, তখন কি করলে কি হবে সেটা ভুলে যেতে থাকেন।  যেমন চশমা পড়লে আমি ভালো দেখতে পাবো, বা খেলে আমার ক্ষুধা চলে যাবে, এই যে দৈনন্দিন সমস্যা ও তার সমাধান - এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি সচেতন থাকেন না। সমাধানসূত্র হারিয়ে যায়। এমনকি সময়মতো  বাহ্যক্রিয়া করতেও  ভুলে যান। 

এখন কথা হচ্ছে, এই রোগের চিকিৎসা কি ? মস্তিষ্কের কোষ যা শুকোতে শুরু করেছে, বা শুকিয়ে গেছে, সেগুলোকে আমাদের আবার সতেজ বা প্রাণবন্ত করতে হবে। এটি আসলে আমাদের বায়ুর ক্রিয়া। পৰ্য্যাপ্ত বায়ু মস্তিষ্কে সঞ্চালন করতে পারলে, আমরা এই রোগ থেকে মুক্ত হতে পারি। ধরুন একটা রাবারের পাইপ চিপসে গেছে। সেটিকে ধীরে ধীরে বাতাস দিয়ে পূরণ করতে পারলেই, আমাদের উদ্দেশ্য সার্থক হতে পারে। এখন শুকিয়ে গেছে যে কোষ বা পাইপ তাকে  প্রথমে একটু নাড়াচাড়া করতে হবে। এইজন্য আমাদের মস্তিষ্কেও কাজ বাড়াতে হবে। দাবা খেলা , লুডো খেলা, শব্দজব্দ খেলা  করতে হবে। দিনে অন্তত একঘন্টা হাটতে হবে। সবচেয়ে যেটা অবশ্য়ই করতে হবে, সেটা হচ্ছে প্রাণায়াম। বিশেষ করে অনুলোম-বিলোম।এর ফলে আমাদের মস্তিষ্কে প্রচুর অক্সিজেন যেতে থাকবে।ধীরে ধীরে ৫ মিনিট থেকে শুরু করে,  অন্তত আধাঘন্টা এই অনুলোম বিলম্ব করতে হবে। বায়ুকে দূষিত করতে পারে, এমন কোনো খাবার বা পানীয় গ্রহণ করা চলবে না। যেমন সিগরেট, মদ পান, জাঙ্কফুড, বেশি মসলাপাতি, ইত্যাদি বর্জন করতে হবে। মাছ-মাংস বর্জন করুন। শাকসবজি বেশি করে খান। সহজে হজম হয়, এমন খাদ্যই খান, দুধ হজম হলে অবশ্য়ই খাবার শেষে দুধ খান।  

এই রোগের মোক্ষম দাওয়াই হচ্ছে ধ্যান। নিয়মিত ধ্যান অভ্যাস করুন। দেখুন বায়ুর সঙ্গে মিশে আছে চৈতন্যশক্তি। এই চৈতন্যশক্তিকে ধরতে গেলে আমাদের নিয়ম করে প্রতিদিন একঘন্টা ধ্যান করতে হবে। ধ্যান আসলে মন-মস্তিষ্কের খেলা। ধ্যান যত গভীর হবে, মস্তিস্ক তত সক্রিয় হবে। আমাদের ধীশক্তি তত তীক্ষ্ণ হবে, আমাদের পূর্বস্মৃতি তখন জেগে উঠবে। আমরা তখন সব কিছু মনে করতে পারবো। এমনকি আমরা তখন বহু পুরো দিনের কথা মনে করতে পারবো। আর এই চিকিৎসা বছরের পর  বছর করতে হবে, এমন নয়।  মাত্র পনের দিন থেকে তিন মাসের মধ্যেই আপনার স্মৃতি আগের মতো তো বটেই, তার চেয়েও আরো বেশি ভালো হয়ে যাবে। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম।   


No comments:

Post a Comment