Monday 29 June 2020

উপাসনা - শশাঙ্ক শেখর শান্তি ধাম / বিপাশনা/খেচরী


উপাসনা - শশাঙ্ক শেখর শান্তি ধাম 

হরি স্মরণম শ্রী হরি স্মরণম।
গুরু স্মরণম সৎ গুরু স্মরণম।
শিব স্মরণম উমা শিব স্মরণম।
শ্যাম স্মরণম রাধে শ্যাম স্মরণম।

ওম সত্যম শিবম সুন্দরম।
ওম অসতো মা সৎ গময়।
তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যুর মা অমৃতম গময়।

জয় জয় শ্রী রাধে কৃষ্ণের জয়।
জয় জয় দেবাদিদেব মহাদেবের জয়।

বিপাশনা ধ্যান 

জীবন হচ্ছে শ্বাসের খেলা। আর এই এই শ্বাসক্রিয়া আমাদের এমনি এমনি হয়।  এর জন্য আমাদের কোনো  চেষ্টা করবার দরকার পরে না। শ্বাস যেমন আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, ঠিক তেমনি আমরা যদি এই শ্বাসের দিকে একটু মনোযোগ দিতে পারি, তবে এই শ্বাসই আমাদের জীবন বদলে দিতে পারে। আজ আমরা সেই কথাই শুনবো। বিপাশনা ধ্যান। 

মহামুনি বশিষ্টদেব স্বয়ং শোকপাশে আবদ্ধ হয়ে  যে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, সেটি হচ্ছে বিপাশা। বিপাশনা মানুষকে পাশমুক্ত করতে পারে। বিপাশনা ধ্যান এমন একটা পদ্ধতি যা  যে কোনো মানুষ এমনকি একটা বাচ্চা ছেলেও করতে পারে। আর সত্যি কথা বলতে কি, এই বিপাশনা ধ্যানের মাধ্যমেই বেশিরভাগ সিদ্ধপুরুষ সিদ্ধিলাভ করেছেন। 

বিপাশনা ধ্যানে দুটো পদক্ষেপ : প্রথমত, আপনি যা কিছু করছেন, সে সম্পর্কে সচেতন থাকুন। তা সে শারীরিক কর্ম্ম হোক, বা মানসিক চিন্তা-ভাবনা, এমনকি হতে পারে আপনার হৃদয়ের আবেগ, ভালোবাসার মুহূর্ত বা আপনার দুঃখের মুহূর্ত। সবসময় আপনি চেতন থাকুন। আপনি সিগারেট খাচ্ছেন, মনোযোগ দিয়ে খান। আপনি কোনো খারাপ কাজ করছেন, তার মধ্যেও আপনি গভীর মনোযোগ দিন। আপনি মশা মারছেন সচেতন ভাবে মারুন। অর্থাৎ যা কিছু করছেন  আপনি তা জেনেবুঝে করুন। আপনি হাঁটছেন, আপনার পা-ই আপনাকে গতি দিচ্ছে, কিন্তু আপনি পা সম্পর্কে সচেতন নন।  এমনটা হতে দেবেন না। আপনি কিছু দেখছেন, হয়তো গাছের ডালে বসা পাখি দেখছেন, মনোযোগ দিয়ে দেখুন। আপনি কিছু শুনছেন, তা সে গান হোক, বা বক্তৃতা সব  মনোযোগ দিয়ে শুনুন। আপনি কোনো সুস্বাদু খাবার খাচ্ছেন, তাড়িয়ে তাড়িয়ে সেটা উপভোগ করুন। স্বাদ তো জিভে, খাবার যতক্ষন মুখে থাকে ততক্ষন তার স্বাদ পাওয়া যায়। অর্থাৎ হড়বড় করে কিছু করবেন না।  তাতে একটু সময় লাগে লাগুক, কিন্তু সিগারেটের শেষ টানটা পর্যন্ত উপভোগ করুন। আপনি প্রাতঃভ্রমনে বেড়িয়েছেন, আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ, আপনার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কি করছে, সেটা খেয়াল করুন। আপনার মন কি করছে কি ভাবছে, সেটা খেয়াল করুন, ঠান্ডা বাতাসের দোলায় আপনার মধ্যে যে আনন্দ অনুভব হচ্ছে, সেটাকে উপভোগ করুন। অর্থাৎ যাকিছু আপনি করছেন, তা সচেতন ভাবে করুন। 

এবার একটু নিজেকে আলাদা করুন, আপনার মনের মধ্যে যে চিন্তার স্রোত বইছে  সেটাকে আলাদা করে দেখতে থাকুন, আপনি হাঁটছেন, নিজেকে সামনে থেকে দেখুন। পেছন থেকে দেখুন,, ডান পাশ থেকে দেখুন, বাঁ পাশ থেকে দেখুন, উপর থেকে দেখুন, এমনকি নিচ থেকে দেখুন। অর্থাৎ যা কিছু আপনি ভাবছেন বা করছেন, তাকে বাইরের থেকে দেখুন। নিজেকে ওই কাজের মধ্যে বা ভাবনার মধ্যে,  জড়িয়ে ফেলবেন না। এই সময় এটা ভাববেন  না যে এটা ভালো হচ্ছে কি খারাপ হচ্ছে, অর্থাৎ আপনি বা আপনার শরীর -মন যা করছে, সেটা ভালো করছে কি মন্দ করছে, সেটা ভাবতে যাবেন না, আপনি শুধু দেখতে থাকুন ।

এর পরের  পদক্ষেপ হচ্ছে, শ্বাসপ্রশ্বাস। খেয়াল  করুন, আপনার নাকে ছিদ্র দিয়ে  শরীরে বাতাস ঢুকছে, আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। আপনি যখন শ্বাস  নিচ্ছেন, আপনার বুক-বা পেট ফুলে উঠছে। স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস  নিলে আপনার পেট উপরে উঠবে। চেতন ভাবে নিলে আপনার ইচ্ছে মতো বুক বা পেটে  নিতে পারেন। না আপনি স্বাসের স্বাভাবিক গতিকে পরিবর্তন করতে যাবেন না। পেটে  যাচ্ছে, পেটেই  যেতে দিন। 

এরপর পেটের দিকে খেয়াল করুন। দেখুন পেটটা একবার উপরের দিকে উঠছে, একবার নিচের দিকে নাবছে। শুধু খেয়াল করতে থাকুন। আসলে পেটের  সঙ্গে আমাদের চিরকালীন সম্পর্ক। পেটের সঙ্গেই আমাদের জীবনের সম্পর্ক। বস্তু থেকে জীবন তৈরির কারখানা হচ্ছে এই পেট। আমরা যখন বিন্দুর আকারে ছিলাম, যখন মাংসপিন্ড ছিলাম, এমনকি যখন আমাদের দেহে প্রাণ আসে, তখনও আমি এই পেটের  মধ্যে। এখনো আমরা এই পেটের  ক্ষুধা মেটাবার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছি। তাই পেট জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। এই পেটের  দিকে খেয়াল করতে থাকুন। দেখুন পেট একবার উঠছে, একবার নাবছে। পেটের সঙ্গে আমাদের বেঁচে থাকার সম্পর্ক। পেট যখন উপরে উঠছে তখন আমরা  জীবনীশক্তি অর্জন করছি। পেট যখন নিচের দিকে নাবছে, জীবনীশক্তি বর্জন করছি।  

পুরো ব্যাপারটা আবার একবার আমরা ভালো করে বুঝে নেই। প্রথমে আমরা শরীর  সম্পর্কে সচেতন হবো, তার পরে আমরা মন সম্পর্কে সচেতন হবো। এর পর আমরা আমাদের আবেগ সম্পর্কে সচেতন হবো। এর পরের  পদক্ষেপ হচ্ছে, স্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে আমাদের পেটের ওঠা নাবার দিকে খেয়াল রাখবো। এইভাবে চলতে থাকলে আমরা একসময় দেখবো, আমাদের মধ্যে আবেগ বলে কিছু নেই। আমরা বাস্তবে চলে এসেছি। 

এর পরের পদক্ষেপ হচ্ছে, নাকে দিকে খেয়াল রাখা। শ্বাস নাক দিয়ে ঢুকছে, আবার বেরিয়ে যাচ্ছে, এটাকে ভালো করে খেয়াল করুন। শ্বাস কোথায় যাচ্ছে, অর্থাৎ পেটে যাচ্ছে, না বুকে যাচ্ছে, সেদিকে আমাদের নজর থাকবে না। আমরা শুধু দেখবো, শ্বাস নাক দিয়ে ঢুকছে, আবার নাক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। খুবই সহজ একটা পদ্ধতি। মেয়েদের পক্ষে এটা আরো সহজ।  কারন, মেয়েরা পেট সম্পর্কে আরো বেশি সচেতন। মেয়েদের শ্বাস বুক হয়ে পেটেই যায়, ।  কিন্তু স্বাস্থ্য সচেতন পুরুষের বুকের মধ্যে বাতাস প্রবেশ করে বুকের পাঁজরকে বর্ধিত করে, কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে তা হয় না। এইজন্য পুরুষের বুকের আকৃতি হয় বড়। এবং পেট সংকুচিত থাকে। অর্থাৎ সিংহের আকৃতি নেয়। যারা শারীরিক পরিশ্রম করে থাকে তাদের আকৃতি হয়, সিংহের মতো। পেটকে সংকুচিত করবার জন্য পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়। কিন্তু পেটকে বর্ধিত করবার জন্য, কিছুই করতে হয় না। এটা স্বাভাবিক। তাই শ্বাস-প্রশ্বাস পেটের ভিতরে অবধি যাতায়াত করা স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক। আমরা যখন  ঘুমিয়ে থাকি তখন আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস-এর গতিপথ পেট অবধি বিস্তৃত থাকে। এবং এইজন্য  রাতে বা বিছানায় শুয়ে থাকলে আমরা স্বাচ্ছন্দ বা আরামদায়ক বোধ করে থাকি। 

যাইহোক, আমাদেরএখন খেয়াল রাখতে হবে নাকের অগ্রভাগে, যেখান থেকে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রবাহিত হচ্ছে। শুধু মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকুন, শ্বাস ঢুকছে, আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। শুধু শ্বাসের প্রতি ধ্যান দিয়ে বসে থাকুন। তখন মন শান্ত হয়ে যাবে, অহংভাব দূর হয়ে যাবে। আর এই আমিভাব যখন দূরীভূত হবে, তখন অধ্যাত্ম জগতের দরজা খুলে যাবে। যেকোনো মানুষের জীবনে এই সহজ প্রক্রিয়াতেই সমাধি সম্ভব। যখন একবার এই পথে আপনি নিবিষ্ট থাকবেন, যখন যথার্থ দ্রষ্টা হয়ে যাবেন , তখন আপনার জীবনে এক উজ্জ্বল দিব্যআলো আপনাকে পরিবর্তন করে দেবে। পুরাতন আপনি আর থাকবে না, এক নতুন মানুষের জন্ম হবে, আপনার ভিতরে । 

চল্লিশ থেকে ষাট মিনিট এই প্রক্রিয়ার অভ্যাস করুন। মেরুদন্ড সোজা করে বসুন। শরীরকে স্থির করবেন অবশ্যই । চোখ বন্ধ  করুন। আসন তখনই পরিবর্তন করবেন, যখন একান্তই প্রয়োজন হয়ে পড়বে , নতুবা এক আসনে বসে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চেষ্টা করুন। স্থির হয়ে বসে, প্রথমে পেটের  ওঠা-নাবা লক্ষ করতে থাকুন।  এটা কোনো মনোযোগের ব্যাপার নয়, শুধু মানশ্চোক্ষে  দেখতে থাকুন, পেটের  ওঠা নাবা। অর্থাৎ শুধু উপলব্ধি করুন , শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে আপনার পেট ওঠা-নাবা করছে। পনেরো মিনিট এই অবস্থায় থাকুন।  এর পরে নাকের দিকে নজর দিন। শ্বাস-প্রশ্বাসের গমন-নির্গমন লক্ষ করতে থাকুন। এই সময় আপনার মনের মধ্যে নানান রকম চিন্তার উদয় হবে। আপনি নিস্পৃহ থাকুন, শুধু শ্বাসের দিকে খেয়াল রাখুন। এতে করেই আপনি লক্ষ করবেন আপনার জীবনের গতি পরিবর্তন হয়ে গেছে। আপনি একজন নতুন মানুষ হয়ে গেছেন। এই অভ্যাস যত  দীর্ঘদিন করবেন, তত আপনার ভোগ-লালসা-রাগ-ভয় দূর হতে থাকবে। আপনি সমস্ত পাশমুক্ত এক মুক্ত মানুষ  হয়ে উঠেছেন। আর আপনার জীবনপথ  হবে মসৃন। আপনি এখন শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত-চৈতন্য স্বরূপ ।    

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

খেচরী মুদ্রা :
আজ আমরা শুনবো, খেচরীমুদ্রা সম্পর্কে। আসলে আধ্যাত্মিক জগৎটাই খেচরী বিদ্যা। এবং খেচরী মুদ্রা তার একটা অঙ্গমাত্র। 
আমি তখন নেখড়িতে থাকি।  নেখড়ি হচ্ছে উত্তরাখণ্ডের  গাড়োয়াল অঞ্চলের তেহরির মধ্যে।  ওখানে একটা মায়ের মন্দির আছে, চন্দ্রবদনী মন্দির ।   একদম পাহাড়ের চূড়ায়। পাহাড়টি জঙ্গলে ঢাকা। এমনকি হিংস্র জীবজন্তুর বাস সেখানে। দিনের বেলায় ওখানে বাঘ দেখা যায়।  ওখানকার গ্রাম্য লোকগাঁথা অনুসারে ওখানে নাকি সতী মায়ের ধর পড়েছিল। ওই মন্দির কত পুরোনো, সে সম্পর্কে সঠিক কিঁছু না জানা থাকলেও, শোনা যায়, এখন যেখানে মন্দির সেটি আচার্য্য শংকর প্রতিষ্ঠা করেছেন। পাশেই  পাহাড়ের চূড়ায়, একটা মন্দিরের ধংসাবশেষ আছে, যেটা নাকি আসল স্থান।  এখন সেখানে কেউ যায় না। হিংস্র জন্তু জানোয়ারের ভয় আছে, এমনকি সেখানে দিনের বেলাতেও বাঘ দেখা যায়। আমি সেখানে খানিক্ষণের জন্য গিয়েছিলাম। চন্দ্রবদনী মন্দির দুপুরের পর থেকে ফাঁকা হতে থাকে। কেবলমাত্র পূজারী পুরোহিত, এবং দুই-একজন দোকানদার সেখানে রাতে বাস করে।  যাত্রীদের থাকবার জন্য সেখানে ব্যবস্থা আছে, তবে সাধারণত সেটি ফাঁকাই থাকে। আমি ওই মন্দিরে কয়েকটা  রাত কাটিয়ে ছিলাম।  ওই মন্দিরের ভিতরে একটা যন্ত্র আছে। যা বাইরে থেকে দেখা যায় না।  যন্ত্রের নিচে মায়ের একটা ছোট্ট মূর্তি, আর একপাশে একটা প্রদীপ আছে যা কবে জ্বালানো হয়েছে তা কেউ বলতে পারে না। ওই মন্দিরে মায়ের পাশে  বসে আমি ধ্যান করতাম। দিনের বেলা পূজা দেবার জন্য বহু লোক আসতো।  দুপুরের পর থেকেই জনশূন্য হয়ে যেত। যাই হোক এত কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে,  ওই সময় আমি একজন শিবভক্তের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম।সে যখন কথা বলতো, তার জিভটা বেরিয়ে আসতো ।  সে তার জিভ দিয়ে নাককে ছুঁতে পারতো। এবং সে বলতো, তার গুরুদেবের জিহ্বা নাকি কপাল স্পর্শ করে। ওদের ধারণা ছিল, যার যত  বড় জিহ্বা সে তত বড়ো  সাধক। প্রতিদিন দেখতাম, সে একটা তামার পাত  দিয়ে টেনে টেনে  জিভ পরিষ্কার করবার নামে জিভটাকে লম্বা করতো। ওর কাছেই প্রথম আমি খেচরী মুদ্রার কথা শুনি। তো এই মুদ্রা সম্পর্কে আমার নিজের কোনো আগ্রহ নেই।  কারন, ঈশ্বরের দেওয়া এই শরীরকে ছেদন করে, রসের স্বাদ নিতে হবে, এতে আমি বিশ্বাসী নোই। কিন্তু এই বিদ্যা সম্পর্কে জানতে আমার আগ্রহ আছে। তো এ সম্পর্কে হঠযোগ প্রদীপিকা যা বলছে, আমরা  আজ সেই কথাই শুনবো।   
   
"খ" কথাটির অর্থ আকাশ, খে অর্থাৎ আকাশে, চর অর্থাৎ যে গমন করে তাকে বলা হয় খেচর। তা সে পাখী  হতে পারে, বা চাঁদ-সূর্য-নক্ষত্র হতে পারে। খেচরী মুদ্রা হচ্ছে একটা প্রক্রিয়া যার সাহায্যে আমরা আমাদের চিত্তাকাশে বা মন-আকাশে, চিদাকাশে  ইচ্ছেমত বিচরণ করতে পারি। অনেকের ধারণা খেচরী মুদ্রা অভ্যাস করলে, আকাশে যত্র তত্র বিচরণ করা যায়, ব্যাপারটা আদৌ তা নয়। 

হঠযোগীগণ বলে থাকেন, সাধক জিহ্বাকে বিপরীতমুখী করে, কপালরন্ধ্রে প্রবেশ করিয়ে স্থির দৃষ্টিতে  ভ্রূযুগলের মধ্যে দেখতে থাকবে। একেই খেচরী মুদ্রা বলে। 

খেচরী মুদ্রা সাধন করতে গেলে, জিহ্বাকে লম্বা করতে হবে।  আর এই জিহ্ববাকে লম্বা করবার জন্য জিহবার নিচের দিকে যে চামড়া আছে তাকে তীক্ষ্ণ ধারালো অস্ত্র দিয়ে কাটতে হবে।  ধীরে ধীরে কাটতে হবে। জিহবার মূল যে শিরা তাকে প্রথম দিন চুল  পরিমান কাটতে হবে। আর সাতদিন যাবৎ প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় সৈন্ধব চূর্ন ও হরিতকি দ্বারা ওই ছিন্ন স্থানে ঘর্ষন করতে  হবে। কেউ কেউ বলে থাকেন, সৈন্ধক না লাগিয়ে, খয়ের ও  হরিতকি চূর্ন  দিয়ে ঘর্ষণ করতে হবে। প্রতি ৭ দিন অন্তর এই ভাবে ছেদন করতে হবে আর খয়ের ও হরিতকি চূর্ন দিয়ে ঘর্ষণ করতে হবে।  এই ভাবে ছয়  মাস যাবৎ প্রতি সাত দিনে একবার করে লোম পরিমান জিহ্বার মূলগতা নাড়ী ছেদন করতে হবে। এভাবে ছেদন করতে করতে একসময় আমাদের জিহ্বার  মুলে যে কপালকুহরে রসনা সংযোগের প্রতি বন্ধকীভূত শিরা আছে, সেই নাড়ীর বন্ধন কেটে যাবে।  

এই খেচরী মুদ্রার অভ্যাস করতে গেলে, আমাদের আগে সিদ্ধাসন, পদ্মাসন বা বজ্রাসনে বসবার অভ্যাস করতে হবে। যে কোনো একটি আসনে বসে প্রথমে মহামুদ্রা, মহাবন্ধ , ও মহাবেধ মুদ্রার  অভ্যাস করতে হবে। এই যোগ তিনটি আমাদের প্রতিদিন, প্রতি প্রহরে একবার করে আট প্রহরে আটবার অভ্যাস করতে হবে। 

খেচরী মুদ্রার সাধক এই ছেদন কার্য্য করতে করতে  জিহবা বর্দ্ধিত হলে, সেই জিহ্বাকে বিপরীত অভিমুখী করে অর্থাৎ জিভ উল্টে দিয়ে  নাড়ীত্রয়ের সঙ্গমস্থলে অর্থাৎ ইড়া -পিঙ্গলা ও সুষুম্না নাড়ীর সঙ্গমস্থলে স্পর্শ করতে হবে। এই যে তিন নাড়ীর সঙ্গমস্থল একে বলে ব্যোমচক্র । হঠযোগীগণ বলে থাকেন, মাত্র একঘন্টা এই অবস্থায় থাকতে পারলে, জরা ব্যাধি মৃত্যুকে জয় করতে পারে।  এমনকি তাকে যদি বিষধর সাপে  কামড়ায় , তথাপি তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এতে করে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা এমনকি মূর্ছা থেকে  রেহাই পাওয়া যাবে । খেচরী মুদ্রার সাধককে কর্ম্মফল  দ্বারা  বাঁধা যায় না। অর্থাৎ সাধক কালের উর্দ্ধে উঠতে পারেন । এই মুদ্রা সাধনকালে সাধককে ভ্রূযুগলের মধ্যে মনকে আবদ্ধ   রাখতে হয়, ফলতঃ তিনি  সব সময় চিদাকাশে বিচরণ করে থাকেন । এমনকি এই অবস্থায় সাধকের রেতঃপাত হতে পারে না। অর্থাৎ স্বাভাবিক ভাবেই সে ব্রহ্মচারী হয়ে যায়। এই সময় চন্দ্রামৃত অর্থাৎ তালুস্থিত ছিদ্র দ্বারা গলিত সুধা পান করতে থাকেন । হঠযোগীগণ বলে থাকেন, যোগস্থ  সাধক ১৫ দিনের মধ্যেই মৃত্যুকে জয় করতে পারেন। যোগীগণ বলছেন, দীপশিখা যেমন তৈলপূর্ন বর্তিকা ত্যাগ করে না, অগ্নি কখনো কাঠকে ত্যাগ করে না, তেমনি জীবাত্মা চন্দ্রামৃত পুর্ন শরীর  ত্যাগ করে না।হঠযোগীগণ বলে থাকেন, নিত্য গোমাংস ভক্ষণ করবে, এবং অমর বারুনী পান করবে। এখানে গো শব্দের দ্বারা জিহ্বাকে বোঝায়। সেই জিহ্ববা তালুতে প্রবেশ করলে, গোমাংস ভক্ষণ হয়। জিহ্ববা তালুতে প্রবেশ করলে, দেহে তাপ  উৎপাদন হয়, এবং তার ফলে চন্দ্র হতে অর্থাৎ ভ্রূমধ্য থেকে যে সুধা বা রসামৃত ক্ষরিত হয়, তাকে অমরবারুনী বলে। 

খেচরী মুদ্রাকারীর জিহ্বা লম্বা হয়ে থাকে। আর সেই লম্বা জিহ্বার অগ্রভাগ নিরন্তর ক্ষার-কটু-অম্ল-মধু-ঘৃত ও দুধের ন্যায়  স্বাদ-বিশিষ্ট লালা ক্ষরণকারিনী হয়ে চুম্বনকারিনী অর্থাৎ স্পর্শ করে তার স্বাদ গ্রহণ করে থাকেন । যোগী উর্দ্ধমুখ হয়ে জিহ্বাকে কপাল কুহরে সংযত করে পরাশক্তিকে চিন্তা বা ধ্যান করতে করতে করতে প্রাণ বায়ুর দ্বারা মূর্দ্ধা থেকে গলিত রস আমাদের কন্ঠকে পূরণ করতে পারেন।  এই কণ্ঠদেশকে হঠযোগীগণ বলে থাকেন, বিশুদ্ধ চক্র যা ষোলোটি পাপড়ি বিশিষ্ট পদ্ম। এই রস যিনি পান করেন, তিনি সারাজীবন ব্যাধীশূন্য হয়ে কোমল পদ্মের ন্যায় দেহের অধিকারী হয়ে থাকেন। 

মেরু ও মুর্দ্ধা উভয়ের মধ্যে যে ছিদ্র বা আকাশ আছে, সেই আকাশে শীতল রস  আছে। সেখানে যে তত্ত্ব আছে অর্থাৎ ব্রহ্মতত্ত্ব আছে, তাকে ব্রহ্মের মুখ বা প্রধান স্থান বলা হয়ে থাকে। আমাদের দেহের বাম দিকে অবস্থিত প্রশস্ত ইড়া নাড়ী থেকে সেই রস  ক্ষরিত হয়। আর এই রসের দ্বারাই রোগ উৎপন্ন হয়ে অধোগামী মানুষের মৃত্যু হয়। অতএব হঠযোগীগণ এই খেচরী মুদ্রা দ্বারা শরীরে রোগের প্রবেশদ্বারকে বন্ধ  করে থাকেন । সুস্বাস্থের জন্য এ একটি উত্তম উপায়। 

যাইহোক, খেচরী মুদ্রা আসলে আমাদের অন্তর্জগতে নির্বিবাদে ভ্রমনের একটা যান। হঠযোগীগণ এমনি অনেক উপায় বা মুদ্রার কথা বলেছেন, যা আমাদের ভারতীয় আধ্যাত্মিক যোগবিদ্যার একটা অমূল্য সম্পদ। কিন্তু কথা হচ্ছে, এগুলো সবই গুরুবিদ্যা। গুরুর সান্নিধ্যে থেকেই এর চর্চা করতে হয়। আর এই গুরুদেবদের সন্ধান পাওয়া দুর্লভ। তবে নিজের শরীর  বুঝে একটু আধটু যোগক্রিয়ার অভ্যাস করলে, আমার এর সুফল অবশ্যই  অনুধাবন করতে পারবো।  এবং আমাদের মধ্যে এই বিদ্যাকে আয়ত্ত্ব  করবার একটা আগ্রহ জাগ্রত হতে পারে। তখন আমরা উপায়ও নিশ্চই খুঁজে পাবো। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।  

  

 









  
















      















      



No comments:

Post a Comment