Tuesday 9 April 2019

হরে রাম হরে কৃষ্ণ - সত্য শব্দার্থ

হরে রাম হরে কৃষ্ণ - সত্য শব্দার্থ 


হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে 
হরে রাম  হরে রাম রাম রাম হরে হরে।  

এর আগে আমরা এই মহামন্ত্রের  অর্থ শ্রী শ্রীচরণ দাস মহাশয়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম।  আজ আমরা এই মন্ত্রের শব্দার্থ শুনবো।
মন্ত্র বলতে আমরা সেই শব্দ বা শব্দভাণ্ডার বুঝি, যা আমাদের মনকে ত্রাণ করে । বেদে আমরা যে মন্ত্র আমরা পাই, তাতে ব্রাহ্মণদের একাধিপত্য। এই সব মন্ত্রে শুদ্র বা স্ত্রীজাতির অধিকার নেই। তা ছাড়া এই সব মন্ত্রের একটা নির্দিষ্ট ছন্দ আছে. যেমন গায়েত্রী ত্রিস্টুপ ছন্দে গাইতে হয়। এইগুলো আবার গুরুপ্রদত্ত। অর্থাৎ গুরুর কাছ থেকে এর যথাযথ উচ্চারণ শিখে নিতে হয়। নতুবা মন্ত্র শক্তি জাগ্রত হয় না। শ্রী শ্রীচৈতন্যদেব আমাদের একটা সহজ সরল, ও সর্ব্ব সাধারণের জন্য একটি সার্বজনীন মংত্র দান করলেন। যার কোনো নির্দিষ্ট সুর নেই। যার কোনো গোপনীয়তা নেই। এই মন্ত্র যেমন উচ্চস্বরে গাইতে পারেন। আবার জপের সময় আপনি অস্ফুট স্বরেও  গাইতে পারেন। এই সর্ব্বজনীন মন্ত্র আপামর জনসাধারণকে আপ্লুত করেছে।  ঘরে ঘরে অষ্টপ্রহর গীত হয় এই মন্ত্র, খোল করতাল সহযোগে। আবার খালি গলাতেও আপনি গাইতে পারেন। অদ্ভুত আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন এই মহামন্ত্র।    

এখানে তিনটি শব্দ আছে ১. হরে - আটবার ; ২. কৃষ্ণ চারবার  ; ৩. রাম চারবার। মোট ষোলোটি শব্দ ও বত্রিশটি অক্ষর। এই মন্ত্রের উদ্গাতা হচ্ছেন, শ্রী শ্রী চৈতন্যদেব।  

হরে :
হরে কথাটা এসেছে হরি থেকে। হরি  অর্থাৎ পরম-পুরুষ পরমেশ্বর। আর হরে  হচ্ছে হরি এর স্ত্রী লিঙ্গ। অর্থাৎ শ্রীলক্ষ্মী।

হরে কথাটার আর একটা অর্থ  হচ্ছে হরন  করা। অর্থাৎ সকলের হৃদয় হরণ  করেন যিনি তিনিই হরি বা হরে  । 

আবার বলা যেতে পারে, হরে কথাটার মাধ্যমে  ভক্ত ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছে, সমস্ত দুঃখ কষ্ট হরণ  করবার জন্য। একবার রামের কাছে, একবার কৃষ্ণের কাছে আর্তি জানানো হচ্ছে। এই রামচন্দ্র এবং শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন,  হিন্দুদের মতে  পালন কর্তা শ্রীবিষ্ণুর অবতার।  

হরি কথাটার আর একটি আভিধানিক অর্থ  হচ্ছে  হিন্দুসমাজের অস্পৃশ্য করে রাখা সম্প্রদায়ের লোক। এই মন্ত্রের স্রষ্টা  হচ্ছেন, শ্রী শ্রীচৈতন্যদেব। তিনি হিন্দু ধর্মের পুনরুদ্ধারের একজন অবতার পুরুষ। তিনি দেখেছিলেন,স্ব-ঘোষিত পন্ডিত ব্রাহ্মণদের বর্বরতা, এবং মূর্খতা ।  নিজে এর ভুক্তভোগী।  তথাকথিত এইসব ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের হাত থেকে হিন্দু সমাজকে উদ্ধার করতে এই সহজ সরল মংত্র দান করেছেন তিনি । হরি অর্থাৎ ভগবানের অংশ সমস্ত জীব। এই অন্তজ শ্রেণীর মানুষেরাও যে ভগবানের  অংশ,  সমাজকে চৈতন্যদেব এই বার্তা দিতে দিয়েছেন, এই মন্ত্রের মাধ্যমে । আর একটা জিনিস খেয়াল করবেন।  চৈতন্যদেব বুঝেছিলেন, খালিপেটে ভগবানের স্মরণ হয় না। তাই প্রচলন করেছিলেন, নর-নারায়ণের সেবা। অর্থাৎ হরিনাম সংকীর্তনের শেষে নারায়ণের সেবার নামে মহোৎসবের ব্যবস্থা।এটি বাধ্যতামূলক।  উপস্থিত সবাইকে অর্থাৎ ধনী দরিদ্র, জ্ঞানী অজ্ঞানী নির্বিশেষে খাবারের ব্যবস্থা।  এবং সেই খাবার খুব সাধারণ মানের  ও নিরামিষ খাবার। কিন্তু যিনি খেয়েছেন, তিনি জানেন,অপূর্ব স্বাদ হয়, এই অন্নে।   অর্থাৎ মানুষকে অন্নদান। এবং সবাই এক পংক্তিতে বসে এই খাবার গ্রহণ করে মানুষ। এইখানেই শ্রী শ্রীচৈতন্যদেবের বৈশিষ্ট। আজও  আপনি যদি বৃন্দাবনে যান দেখবেন , বহু নিরাশ্রয় ব্যক্তির খাবারের ব্যবস্থা হয় এই সংকীর্তনের আসরে।  এখানে, কীর্তনে অংশ গ্রহণ করলে, পয়সা, খাবার  ইত্যাদি পাওয়া যায়। এইখানেই  শ্রী চৈতন্যদেব সব ধর্মের মাহাত্মকে ছাপিয়ে গিয়েছেন। এই কীর্তনের আসরে, না থাকে জাতিভেদ, না থাকে লিঙ্গভেদ। সবাই সবাইকে আপন করে নেয়। সনাতন হিন্দু ধর্মের এই তো ছিল মাহাত্ম।সর্ব্বেসাম স্বস্তিরভবতু, সর্ব্বেসাম শান্তিরভবতু, সর্ব্বেসাম পূর্নম ভবতু, সর্ব্বেসাম মঙ্গলম ভবতু  .কোথায় হারিয়ে গেছে সে সব।   

কৃষ্ণ

কৃষ্ণ আমাদের মহাভারতের দেবকী নন্দন। যারা শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত তারা এই অর্থই গ্রহণ করে থাকেন।

কৃষ্ণ কথাটা কৃষ ধাতু থেকে উৎপত্তি।(কৃষ + ন ) কৃষ মানে আকর্ষণ করা। যিনি সকলের হৃদয়  আকর্ষণ করেন, তিনিই কৃষ্ণ । কৃষ্ণ কথাটার আর একটি অর্থ হচ্ছে আকর্ষক বা মাধ্যাকর্ষন শক্তি । অর্থাৎ যা  আমাদের সকলকে আকর্ষণ করছে। জগৎ,  এই প্রেম বা আকর্ষণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। আকর্ষণই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডকে সঠিকভাবে  শৃঙ্খলিত করে  রেখেছে। তাই কৃষ্ণকে বলা হয় প্রেমপুরুষ। 

আবার কৃষ্ণকে ভাগ করলে দাঁড়ায় কৃৎস্ন + ন। কৃষ কথাটার মানে  সর্ব্ব। অন্য মানে, স্তূপ, জল। ন কথাটার মানে আত্মা।অর্থাৎ জলে স্থিত বা স্তূপাকৃতি আত্মা তাকেই বলে কৃষ্ণ। এই জন্য কৃষ্ণ বা বিষ্ণুকে আমরা দেখি সমুদ্রের মধ্যে শায়িত। ক্ষিরোদসাগরে শায়িত, পাশে শ্রীলক্ষ্মী বসা।     

কৃষ্ণ কথাটার আর একটি অর্থ হচ্ছে "কালো" । অর্থাৎ অন্ধকার। অর্থাৎ শুন্য। শুন্য থেকেই জগতের সৃষ্টি। অর্থাৎ কৃষ্ণ কথাটা দিয়ে সেই সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করা হচ্ছে, বা তার কাছে আর্তি বা আমাদের প্রার্থনা করা হচ্ছে। 

রাম :

রামায়ণের দশরথ রাজার প্রথম পুত্র রামচন্দ্র। যিনি বিষ্ণুর অবতার। যারা রামভক্ত তারা এই অর্থ গ্রহণ করে থাকেন। 

রাম কথাটার আর একটা মানে হচ্ছে বৃহৎ।

রাম কথাটার অন্য একটি গ্রহণযোগ্য অর্থ হচ্ছে - রময়তি য স রামঃ। অর্থাৎ যিনি  ক্রিয়ারত আছেন। ভগবানের দুটি সত্ত্বা একটি ক্রিয়ারত অর্থাৎ সৃষ্টিতত্ত্ব আর একটি হচ্ছে অক্রিয় বা নিষ্ক্রিয়। রাম  কথাটার মাধ্যমে  ভগবানের  এই ক্রিয়ারতসত্ত্বা বা সক্রিয়  ভগবানের কথা বলা হচ্ছে।

রময়তি য স রামঃ।  যিনি রমার বা লক্ষ্মীর সাথে রমন করেন। রা শব্দটি মহৎ-ঈশ্বর বাচক। ম শব্দে মঙ্গলের সূচক। অর্থাৎ পরম-মঙ্গলময় ঈশ্বর।
  
রময়তি য স রামঃ। কেউ কেউ  এখানে রাধা অর্থাৎ ভগবানের  সাথে যিনি  রমন করছেন সেই শ্রীরাধাকে স্মরণ করা হচ্ছে, বলে মনে করেন ।  

যাই হোক, ভক্তের শ্রেণী অনুযায়ী যে যার মতো বুঝে নেবেন।  তবে একটা কথা সত্যি এই মন্ত্র যেমন সর্ব্বজনীন, তেমনি এর আধ্যাত্মিক মূল্য অসীম। একই কথা বার বার উচ্চারণের ফলে আমাদের মানস শরীরে, একটা আনন্দ অনুভূতি এনে দেয়। ভয় দূর করে, একটা অদ্ভুত হিল্লোল তোলে আমাদের শরীর  ও মনে। 

হরিবোল হরিবোল হরিবোল জয় শ্রী শ্রীচৈতন্যদেবের জয়। 
        

  


No comments:

Post a Comment