Thursday 11 April 2019

সাপ্তাহিক আলোচনা (পঞ্চম)-বিবেকচূড়ামণি (শ্লোক নং ৬৫)

বিবেকচূড়ামণি  (শ্লোক নং ৬৫)
আমাদের সাপ্তাহিক ধর্ম্ম আলোচনায় ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ হয় ।  আজ সাপ্তাহিক আলোচনার পঞ্চম দিন। আমাদের আলোচনায় একটা কথা উঠে এসেছে, যে আমাদের কথা আমরাই বুঝতে পারছি না। অর্থাৎ নিতান্ত গ্রন্থপাঠ করে গেলে, বিস্তারিত ভাবে আলোচনা না করলে, আমরা কিছুই অনুভব করতে পারছি না। এখন কথা হচ্ছে অন্ধ অন্ধকে পথ দেখাবে কি করে ? আমরা যারা একত্র হয়েছি, তারাতো কেউ শাস্ত্রজ্ঞ নোই। তাই শাস্ত্রের গুড়কথা আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না। তাই ঠিক হয়েছে, একদিনে বেশি পাঠ না করে, বিষয়ের মধ্যে প্রবেশ করার চেষ্টা করি। তাই আজ এবং এখন থেকে  আমরা একটা-আধটা  শ্লোক নিয়েই আলোচনা করবো। ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করবো। আমরা পাঠ করছিলাম বা শুনছিলাম, আচার্য্য শঙ্করের বিবেকচূড়ামণি  গ্রন্থ থেকে। গতদিন যেখানে শেষ করেছিলাম, আজ সেখান থেকেই শুরু করবো। 

শ্লোক  ৬৫ :

আপ্তোক্তিং খননং তথোপরি শিলাদ্যুৎকর্ষণং স্বীকৃতিং 
নিক্ষেপঃ সমপেক্ষতে ন হি বহিঃ শব্দৈন্তু নির্গচ্ছতি। 
তদ্ বদ্ ব্রহ্মবিদ-উপদেশ-মনন-ধ্যানাদিভিঃ লভ্যতে 
মায়াকার্য্যতিরহিতং স্বম মল তত্ত্বং ন দুর্যুক্তিভিঃ ।। 

এই একটা শ্লোকের মধ্যে দিয়ে আধ্যাত্মিক জগতের প্রবেশের পথ, সঠিক সাধনার সংক্ষিপ্ত পথ বলে দিলেন আচার্য শঙ্কর । বলছেন : 
আপ্তোক্তিং : আপ্ত উক্তি অর্থাৎ জ্ঞানী ব্যক্তির উপদেশ।  
খননং : খননকার্য্য অর্থাৎ ভূমি খোরা।  
তথোপরি : তথা উপরি অর্থাৎ ভূমির উপরে, বা সেই মূল্যবান ধনের উপরে যে মাটি আছে বা পাথর আছে তার উপরে।   
শিলাদ্যুৎকর্ষণং : শিলাদি-উৎকর্ষণং অর্থাৎ ধনের উপরে যে পাথর ইত্যাদি আছে তার অপসারণ  
স্বীকৃতিং : ধন পাওয়ার স্বীকৃতি, অর্থাৎ নিজে থেকেই ধন সংগ্রহ করতে হবে।  
নিক্ষেপঃ : যা ভিতরে ছড়িয়ে আছে, অর্থাৎ ভুমধ্যে যে ধন ছড়িয়ে আছে। 
সমপেক্ষতে ন হি বহিঃ : সমপেক্ষতে অর্থাৎ অপেক্ষা করে, অর্থাৎ ওই পাথর গুলোর সরানোর অপেক্ষায় থাকে, ন হি বহি অর্থাৎ বাহির হয় না। 
শব্দৈন্তু নির্গচ্ছতি: শব্দের দ্বারা বাইরে আসে না। 
তদ্ বদ্ ব্রহ্মবিদ-উপদেশ-মনন-ধ্যানাদিভিঃ : সেই রকম, ব্রহ্মবিদদের উপদেশ, সেই উপদেশের মনন, তার ধ্যান দ্বারা ;
লভ্যতে : অর্থাৎ লাভ করা যায়।  
মায়াকার্য্যতিরহিতং : মায়া অর্থাৎ মিথ্যা অহং-এর কাজ দূর হয়ে যায়। 
স্বমমল তত্ত্বং : স্বং তত্ত্বং অমলং অর্থাৎ নির্মল সেই তত্ত্ব অর্থাৎ ব্রহ্মতত্ত্ব 
ন দুর্যুক্তিভিঃ : অর্থাৎ দুর্যুক্তি বা কুতর্কের দ্বারা পাওয়া যাবে না।
এই একটা কথার মাধ্যমে,  ব্রহ্মকে কি করে জানা যাবে বা পাওয়া যাবে, সেটা যেমন বলে দিলেন, তেমনি এও বলে দিলেন, যে কিসে সেটা পাওয়া যাবে না।  

পুরো অর্থটা একবার দেখে নেই : 
 ভূগর্ভস্থ  সম্পত্তি পেতে গেলে যেমন প্রথমে যে ব্যক্তি এর সন্ধান জানেন, তার কাছ থেকে উপদেশ নিতে হয়, তার পরে,  ভূমি খনন করতে হয়, ধনের উপরে রাখা পাথর সরাতে হয়, সব শেষে নিজেকেই ধন সংগ্রহ করতে হয়, কেবলমাত্র ধন তুমি এস, ধন তুমি এস, বললেই ধন নিজের আয়ত্ত্বে আসে না, তেমনি মায়া-মুক্ত নিজের শুদ্ধ স্ব-রূপকে জানতে গেলে, যিনি এটা জানেন, অর্থাৎ সেই ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের কাছে উপদেশ নিতে হয়, পরে তার সেই উপদেশের মনন করা দরকার, সবশেষে সেই সর্বজ্ঞ পুরুষের ধ্যান  ইত্যাদির দ্বারা, তাকে অনুভব করা যায়। 
ভগবান শঙ্কর বলছেন, ব্রহ্মকে জানতে গেলে আগে, ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের  স্মরণ নিতে হবে। তার উপদেশ শুনতে হবে। অন্ধ অন্ধকে রাস্তা দেখাতে পারে না। তাই আমাদের জ্ঞানীর অর্থাৎ গুরুদেবের কাছে যেতে হবে।  এই গুরুদেব কেমন হবে, তা তিনি আগে বলেছেন। গুরুদেব হবেন ব্রহ্মজ্ঞ। 
এখন কথা হচ্ছে এই ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ আমরা কোথায় পাবো? তাদের চিনবোই বা কি করে ? আর ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ আমাদের জ্ঞান দান করবেন, এই সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। তাহলে আমাদের কি করণীয় ? এই জায়গায় পারাবিদ্যাবিদগন বলছেন, আগে নিজেকে তৈরী করতে হবে। শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ, সৎ-সঙ্গ যাপন এবং সর্বক্ষণ শাস্ত্রগ্রন্থের বিষয় বা বক্তব্যকে মনন করা। এই মনন করতে করতেই, শাস্ত্রের যথার্থ অর্থ আপনার কাছে পরিষ্কার হবে। আগে নিজেকে উপযুক্ত শিষ্য হিসেবে তৈরী করতে হবে। তবেই সেই ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের সন্ধান পাওয়া যাবে। এখন নিজেকে উপযুক্ত শিষ্য করতে গেলে আর কি করতে 
হবে ? গুরুকে বাইরে খুঁজতে যাবেন না। গুরু আপনার ভিতরে আছেন।  বিবেক আপনার পরম গুরু। আপনি বিবেকের নির্দেশে চলুন।পরম-ঈশ্বরই সবার আসল গুরু। তিনি-ই আপনাকে বিবেকের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠাবেন। তাই আপনি বিবেকের নির্দেশ অনুসরণ করুন।
মহতের অনুসরণ করো,  দীক্ষা নাও, গুরুর সাক্ষাৎ করো। গুরুর উপদেশ অনুযায়ী কাজ করো এইসব কথা  চির-পুরাতন।  কিন্তু আত্ম অনুসন্ধান করলে বোঝা যায়, সঠিক প্রক্রিয়া সম্পন্দন ব্যতীত, কারুরই আধ্যাত্মিক উন্নতি সম্ভব নয়। দুর্গম এই পথ, অলসতা বা অবসর বলে এখানে কিছু নেই। নিরন্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে হয়। দিনের অবসর মতো ক্ষাণিক্ষনের জন্য গুরুমন্ত্র জপ্ করলাম, তাতে আধ্যাত্মিক জগতের কণামাত্রও সংগ্রহ করা যায় না। নিরন্তর নিজের মধ্যে ডুবে যেতে হবে। গুরুলাভের জন্য চেষ্টা করতে হবে না। উপযুক্ত হলে গুরু এসে যাবেন। গুরুরাও বসে থাকেন  উপযুক্ত পাত্রের জন্য। যাদের অন্তরাত্মা শুদ্ধ হয় নি, তার গুরু করে কি হবে ? গুরুমন্ত্র জপ্ করলে ক্ষতি নেই, কিন্তু আধ্যাত্মিক পথে বহুদূর পর্যন্ত একাই যেতে হয়। অন্তিম সময়ে গুরু এসে হাত ধরেন। তিনি দেহধারী গুরু নাও হতে পারেন, বহু পারলৌকিক মহাত্মারা আমাদের আধ্যাত্মিক পথে হাত ধরে নিয়ে যাবার জন্য সদা জাগ্রত আছেন। একটা নির্দিষ্ট পথ পর্যন্ত নিজেকেই যেতে হয়। তার জন্য আপনার সহায় হবে, ধর্মশাস্ত্র, শরণ, মনন, বিবেক বৈরাগ্য। 
এই পথে চলতে গেলে সৎ, অসৎ, এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে। চরিত্র শোধন, অসতের প্রতি অনাসক্ত থাকতে হবে।  কর্তব্য কর্মে অবহেলা নয়, কিন্তু মোহের বন্ধন  থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে। আধ্যাত্মিক প্রেম বৃদ্ধি করতে হবে। চিত্ত সংযম, শারীরিক পবিত্রতা, বিশ্বাস, ধৈর্য্য, শ্রদ্ধা, তিতিক্ষা ইত্যাদির বৃদ্ধির দ্বারা মানবিক সম্পদ বৃদ্ধি করতে হবে। সবশেষে পরম-পিতার সাথে মিলিত হতে গেলে নিজেকে পরিচ্ছন্ন করতে হবে। আকুলতা বাড়াতে হবে।  তবেই সেই পরম-পিতা আমাদের কোলে তুলে নেবেন। 
সুতরাং দীক্ষা নিতান্ত একটা অনুষ্ঠান নয়। দীক্ষা গ্রহণ একটি সাধনা। 
এর পরে ধ্যানের প্রস্তুতি, অর্থাৎ ধ্যানের যে কোনো প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢোকা। কেউ কেউ ত্রাটক দিয়ে শুরু করেন, কেউ ভ্রূযুগলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন, কেউ নাসিকা অগ্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন, কেউ হৃদয়ে মনোনিবেশ করেন, এমনি বহু প্রক্রিয়া আছে। যার কাছে যেটা সহজ মনে হয় সেটা দিয়ে শুরু করতে পারেন। তবে সব থেকে সহজ হচ্ছে, উদ্গীথ অর্থাৎ "ওম" দিয়ে শুরু করা। সশব্দে "ওম" দিয়ে শুরু করেন। একটা সময়, ধীরে ধীরে এই "ওম" শব্দ  আপনার নাভি থেকে উদ্গত হতে থাকবে, আপনার নিশ্বাস প্রশ্বাস -এর গতি ধীর হবে। একটা সময় আপনি "ওম" এই নাদব্রহ্মকে  আপনার ভেতর থেকে শুনতে পাবেন। অভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে  এই অক্ষর-ব্রহ্মের সঙ্গে আপনি নিজেকে দেখতে পাবেন। 
সমুদ্রে প্রবেশের পথ বহু, নদী, নালা বহু আছে। সূর্য্যে যাবার জন্য নির্দিষ্ট কোনো রাস্তা নেই । যে যেখানে আছেন, সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করতে পারেন। শুধু লক্ষ ঠিক রাখতে হবে। আপনার রুচি অনুসারে পথ অবলম্বন করা যেতে পারে। আপনার সাংসারিক কাজের ব্যাঘাত না করে, ন্যায় পথে থেকে জীবনকে চালিত করলেই উন্নতির পথে অগ্রসর হওয়া যায়। মানুষের হৃদয় ও মন, সমস্ত কাজের উৎপত্তিস্থান। মানুষের চিন্তা, বিচার, বুদ্ধি, যত তীক্ষ্ন হবে, যত পবিত্র হবে, ততো আপনার জ্ঞান, স্বচ্ছ হবে।  এবং আপনার আত্মার উন্নতি হবে, অর্থাৎ আপনার আত্মার উপরে যে ভাব আত্মাকে অস্বচ্ছ করে রেখেছে, সেই মল দূরীভূত হবে। অবিদ্যা দূর হবে। আত্ম সমর্পনের ভাব যত বাড়বে, মনের উচ্চ স্তর  থেকে, আলোক রেখা এসে অবিদ্যারূপ অন্ধকারকে দুর করে, মানুষকে দেবত্ব আরোপ করবে। 

ওম নমঃ শিবায়ঃ।

সপ্তম সপ্তাহ  
৬৬ নং শ্লোক :
তস্মাৎ সর্ব প্রযত্নেন ভববন্ধ বিমুক্তয়ে 
স্বৈরেব যত্নঃ কর্তব্যো রোগাদৌ-ইব পণ্ডিতৈঃ।
তস্মাৎ - সেই রকম বা সেই জন্য
সর্ব প্রযত্নেন - সব রকম যত্ন  বা চেষ্টা করে 
ভববন্ধ - ভববন্ধন বা সংসার বন্ধন
বিমুক্তয়ে - মুখ হবার জন্য অর্থাৎ সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত হবার জন্য
স্বৈরেব - স্বৈঃ+এব - অর্থাৎ নিজের থেকেই বা নিজের দ্বারাই
যত্নঃ কর্তব্যো - যত্ন বা চেষ্টা করা কর্তব্য
রোগাদৌ-ইব -  রোগ আদি যেমন
পণ্ডিতৈঃ।  - পণ্ডিত বা বিচারশীল ব্যক্তিগণ।

অর্থাৎ রোগ থেকে মুক্তি পাবার জন্য, যেমন নিজেকেই ঔষধ খেতে হয়, তেমনি ভব বা এই সংসারের  বন্ধন  থেকে মুক্তি লাভ কারবার জন্য, পণ্ডিত ব্যক্তিগণ বা বিচারশীল ব্যক্তিগণ নিজে থেকেই সব রকম উপায় অবলম্বন করেন।
এর আগে আমরা ৫৩ নং শ্লোকে এই একই রকম কথা পেয়েছি।  সেখানেও তিনি বলেছিলেন,  যে রুগী, নিজে থেকেই  ঔষধ ও পথ্য  সেবন করে, তাকেই আরোগ্য হতে দেখা যায়। অন্য কেউ ঔষধ খেলে আমার তাতে অন্যের কোনো উপকার হবে না।
অতয়েব সাধন জাগতে, আমাদেরকেই সক্রিয় হতে হবে। কেবল গুরু করলেই হবে না। গুরুর নির্দেশ অনুযায়ী আমাদেরকে স্বয়ং সাধনায় লিপ্ত বা যোগক্রিয়া করতে হবে।

৬৭ নং শ্লোক :
যস্ত্বয়াদ্য কৃতঃ প্রশ্নো বরীয়াঞ্ ছাস্ত্রবিম্মতঃ
সূত্ৰপ্ৰায়ো নিগূঢ়ার্থো জ্ঞাতব্যশ্চ মুমুক্ষুভিঃ
গুরুদেব এবার শিষ্যের প্রসংশা করছেন। বলছেন :
যস্ত্বয়াদ্য - যঃ ত্বয়া অদ্য - অর্থাৎ যা তুমি আজ
 কৃতঃ প্রশ্নো - প্রশ্ন করেছো
 বরীয়াঞ্ ছাস্ত্রবিম্মতঃ - বরিয়ান-চ  শাস্ত্রবিৎ মৎ -  বরিয়ান চ অর্থাৎ বড় উৎকৃষ্ট।  শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তির মতো।
সূত্ৰপ্ৰায়ো - সূত্রের মতো অর্থাৎ সংক্ষেপে 
 নিগূঢ়ার্থো  - গভীর ভাবপূর্ণ বা গভীর অর্থবহ।
জ্ঞাতব্যশ্চ - জ্ঞাতব্য বা যা জানা উচিত
মুমুক্ষুভিঃ। - অর্থাৎ মুমুক্ষ ব্যক্তির জন্য, অর্থাৎ মুক্তি লাভের ইচ্ছুক ব্যক্তির জন্য।

৬৮ নং শ্লোক :
শৃণুষ্বাবহিতো বিদ্বন্  যন্ময়া সমুদীর্ঘতে
তদ্-এতত্-শ্রবণাৎ সদ্যো ভববন্ধনাৎ-বিমোক্ষসে।
শৃণুষ্বাবহিতো - শৃণুষ্ব অবহিত - অবধান সহ শোনো, অর্থাৎ স্থির হয়ে শোনো। 
বিদ্বন্  যন্ময়া সমুদীর্ঘতে - হে বিদ্বান, যন ময়া অর্থাৎ যা আমি, বা  আমার দ্বারা কথিত হচ্ছে  
তদ্-এতত্-শ্রবণাৎ - এর শ্রবণ থেকে সেই 
সদ্যো ভববন্ধনাৎ-বিমোক্ষসে। - সদ্য অর্থাৎ এখনি ভববন্ধনাৎ-বিমোক্ষসে অর্থাৎ ভববন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করবে।  

গুরুদেব বলছেন,  আজ যে প্রশ্ন তুমি করছো, তা সংক্ষিপ্ত ও শাস্ত্রবিদদের মনমতো। এবং মুমুক্ষব্যাক্তিদের জ্ঞাতব্য। কি প্রশ্ন করেছিলেন,  তা একবার একটু দেখে নেবো।  ৪৯ নং শ্লোকে শিষ্য জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বন্ধন  কি ? বন্ধন এলো কি করে ? বন্ধনের কিরকম স্থিতি। কি করলে মুক্তি হয় ? অনাত্মা কি ? পরম-আত্মাই বা কি ? কোনটা অনাত্মা, আর কোনটা আত্মা এটা কি করে বোঝা যাবে ?
জিজ্ঞাসুর এই প্রশ্ন শুনে, আচার্যদেব উত্তর শুরু করেছিলেন, উত্তর দিতে দিতে, তার মনে হলো, এই প্রশ্নই যথাযথ যা শুনলে, আমাদের সবার মুক্তি হতে পারে।
হে প্রিয় শিষ্য, তোমাকে যা বলছি, তা তুমি মনোযোগ সহকারে শোনো।  এই সব কথা শুনলে, তুমি অচিরে ভববন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যাবে।
ভালো শিষ্য পেলে গুরুর খুব আনন্দ হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলছেন, "শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানম"(৪/৩৯) ;  "সংশয়াত্মা বিনশ্যতি "  (৪/৪০) ।
গুরুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে গুরুর কাছে, মনের সংশয় দূর করবার জন্য, জ্ঞান  লাভের জন্য, প্রশ্ন করতে হবে। আমি এক স্বামীজীর কাছে শুনেছিলাম, বলছেন : আমার কাছে যারা প্রশ্ন নিয়ে আসে, তাদের মধ্যে সত্যিকারের জিজ্ঞাসু দেখতে পাই না। তারা আসে, প্রশ্নও করে, কিন্তু তাদের মনে যে  বিশ্বাস দৃঢ় হয়ে আছে, সে সেই বিশ্বাসের সমর্থনে তারা আমাদের কাছ থেকে সমর্থন চায়। সত্যকে জানবার আগ্রহ তাদের নেই। যারা কৃষ্ণের ভক্ত তারা কৃষ্ণই একমাত্র পরম-ঈশ্বর সেটা তারা শুনতে চান। আবার যারা বুদ্ধের ভক্ত তারা বুদ্ধের ভগবানত্ত্ব শুনতে চান। এরা  নতুন কিছু, শুনলে পালাতে চায়। আমি যখন এই সব আহাম্মকদের তাড়াতে চাই, তখন বিপরীত কথা বলি। সত্যিকারের ভগবানের কথা কে শুনতে চায় ? মুক্তির কথা কে শুনতে চায় ? কেউ মূর্তিপূজার সমর্থনে বক্তব্য শুনতে চায়। কেউ আবার নিরাকারের উপাসনায় সর্বোচ্চ ফল জানতে চায়। খালি পেতে কেউ আসেনা।  বাসি পচা খেয়ে বদ হাজামের রুগী সব। আসলে গুরু সব সময় যোগ্য শিষ্য খোঁজে। অষ্টাবক্র মুনি পেয়েছিলেন, বিদেহী রাজা জনককে, কৃষ্ণ পেয়েছিলো অর্জুনকে, ধর্মরাজ পেয়েছিলো নাচিকেতাকে।

রাজা জনকের প্রশ্ন শুনুন :
কথং  জ্ঞানম  অবাপ্নোতি কথং মুক্তির্ভবিষ্যতি
বৈরাগ্যং চ কথং প্রাপ্তম এতদ ব্রূহি মম প্রভো। 

হে আমার প্রভু, জ্ঞান কি ভাবে হবে, মুক্তি কি ভাবে হবে, বৈরাগ্য প্রাপ্ত হাওয়া যায় কি ভাবে ? এই সব কথা আমাকে বলুন।
সংক্ষেপে অথচ জীবনের সার প্রশ্ন। যা আমাদের সবার প্রশ্ন।

এবার নচিকেতা কি বলছেন শুনুন :
যেয়ং প্রেতে বিচিকিৎসা মনুষ্যে  অস্তিত্যেকে নায়ম অস্তীতি চৈকে 
এতদ বিদ্যাম অনুশিষ্ট স্বত্বায় অহং, বরাণামেষ বরস-তৃতীয়ঃ। 

মানুষের মৃত্যুর পরে, যে সংশয় উপস্থিত হয়, অর্থাৎ পরলোকগত আত্মা - কেউ বলেন তিনি আছেন, কেউ বলেন, নেই - সেই সংশয়ের অর্থাৎ আত্মা আছেন কি নেই, অর্থাৎ আত্মার অস্তিত্ত্ব অনস্তিত্ত্ব জানতে চাই।
সূত্রাকারে, সূত্র কথাটার মানে সংক্ষেপে সার কথা।  সংক্ষেপে মূল প্রশ্ন করার মতো শিষ্যের অভাব। আমরা তো আমাদের সঞ্চিত অজ্ঞান গুরুদেবকে শোনাতে চাই, এবং গুরুদেবের কাছ থেকে সেই অজ্ঞানের রক্ষার্থে মংত্র চাই।
আমাদের ভিতরের সংশয় দূর করবার জন্য শ্রদ্ধাশীল হয়ে জ্ঞানীর কাছে অর্থাৎ আচার্য্যের কাছে তাকে  সেবায় সন্তুষ্ট করে, জীবনের অর্থ, উদ্দেশ্য, ও উপায় জেনে সাধনায় লিপ্ত হওয়া উচিত।
যখন গুরু বোঝেন, শিষ্য এখন তত্ত্বজ্ঞান গ্রহণ করবার জন্য প্রস্তুত। তখনি তিনি তত্ত্বজ্ঞান প্রদান করবার জন্য আগ্রহী হন। এবং সংসার বন্ধন   থেকে মুক্ত করার জন্য উপদেশ দিয়ে থাকেন, আর গুরুর উপদেশ শুনেই আমরা মুক্তির পথ লাভ করতে পারবো। বই পরে, এমনকি গুরুর কথা শুনে আমাদের কিছুই হবে না , যদি না আমরা নিজেরা সক্রিয় হই । আকুল না হই।

ওঁম নমঃ শিবায়ঃ।

 








    

   















        

No comments:

Post a Comment