Tuesday 30 April 2019

আচার্য্য ও গুরুদেব GURUDEV

 গুরুদেব 

ওং গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণু গুরুর্দেব মহেশ্বরঃ
গুরুরেব পরম-ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ।

ভারতবর্ষে বহু অবতারের প্রাদুর্ভাব। শাস্ত্রকাররা বলেন, অনন্ত কি ভাবে সান্ত হবে ? অতএব সত্যিকারের ভগবানের অবতরণ হয় না।আবার কেউ কেউ বলেন, ঈশ্বরের অনন্ত গুনের মধ্যে যাঁরা বিশেষ কিছু  বা একাধিক গুনের অধিকারী হয়েছেন, তাঁকে অবতার বলা হয়।এদেরকে পরমহংস বলা যেতে পারে। এনার কোনো বিশেষ বসন নেই। ইনি যাদৃচ্ছিক, নিবন্ধ রোহিত।এই যতির বা চেতন মানুষের স্তূতি-নিন্দা নেই। নেই কোনো লৌকিক ব্যবহার, নেই কোনো ধরাবাঁধা  অনুষ্ঠান। এঁরা  লোক শিক্ষার জন্য জগতে আসেন। তিনি স্থায়ী বাসের জন্য কোনো ম্ঠ  বা ডেরা  স্বীকার করেন না। সংসারে তাঁর আমি আমার বোধ নেই। যিনি কারুর স্তূতি করেন না, কাকেও নমস্কার করেন না. চল-স্বভাব শরীর এবং অচলস্বভাব আত্মা ভিন্ন অন্য কোনো নিকেতন স্বীকার করেন না। তিনি  ইচ্ছাপ্রাপ্ত মাত্র দেহযাত্রা নির্বাহ করেন। এটি সাধনার উচ্চতম মার্গ। আমাদের ভারত মাতা বন্ধ্যা নন। হিমালয়ের কন্দরে কন্দরে আজও  এই উচ্চকোটির অনেক মহাত্মা আছেন। এঁরা নিজেদেরকে অবতার বলে প্রচার করেন না।  এমনকি যাঁরা এদের সন্ধান রাখেন, তারাও এঁদেরকে যুগাবতার বলে প্রচার করার দুর্মতি করেন না। কারন এই ধরনের প্রচার হাস্যকর। এই সব অবতাররাই আমাদের বিচারবুদ্ধির উন্নতির জন্য অবিরত কাজ করে চলেছেন। 
     
আমার বাড়ির কাছেও এক ভগবানের আশ্রম  আছে। তিনি নিজেকে ভগবান বলে পরিচয় দেন। আমি একবার তাকে এক অনুষ্ঠানে দেখতেও গিয়েছিলাম। খুব কৌতুক বোধ করেছিলাম। ঝুটা গুরু, ঝুটা ভগবানে দেশ ভরাট  হয়ে গেছে। 

বালকের সরলতার সুযোগে অভিভাবক মিথ্যে বলে। একটা বাচ্চাকে নিয়ে মা যাচ্ছিলো। রাস্তায় ঠাকুরের মূর্তি নিয়ে যাচ্ছিলো একটা লোক। বাচ্চাটি যুক্তকরে প্রণাম করলো বললো,  দেখো মা ঠাকুর যাচ্ছেন। মা জানে, এ মাটির মূর্তি মাত্র, ঠাকুর নয়।   তবুও  তাতেই সে  সায়  দেয়। শুধু তাই নয়, সেই মূর্তিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠার অভিনয়ও করে। হে ভগবান। সাধারণের মানুষের বিশ্বাস সরলতার সুযোগে এই সব তথাকথিত গুরুদেবরা  বাহ্যিক ধন সম্পদ সংগ্রহে ব্যস্ত। এরা আসলে অসৎ-ধর্মের ব্যবসায়ী।
ব্যবসায়ী গুরুর রমরমা আজকাল । 

আমরা আজ  দেহধারী গুরুর লক্ষণ সন্মন্ধে আলোচনা করবো।তার আগে একটাকথা বলি, বহু জ্ঞানী ব্যক্তি আছেন, যাঁরা আমাদের আচার্য্য হতে পারেন। কিন্তু সৎ গুরু  পরম-পিতার  কৃপাদিষ্ট। জ্ঞান সঞ্চয় করে গুরু হওয়া যায় না। জ্ঞান সঞ্চয় করে আচার্য্য হওয়া যায়। আমাদের জীবনে এই দুজনেরই প্রভাব আছে। আমরা অনেক সময় আচার্য্য ও গুরুদেবকে গুলিয়ে ফেলি। যিনি আমাদের  শিক্ষা দান  করেন, তিনি আমাদের শিক্ষাগুরু, অর্থাৎ আচার্য্য। কিন্তু গুরুদেব আচার্য্য থেকে আলাদা। যিনি আমাদের মধ্যে ভিতরের বিবর্তন আনেন, তিনি আমাদের গুরুদেব। সৎগুরুদেবের লক্ষণগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করবো।    

১. সৎগুরু শান্তিদাতা -   সাপুড়ের কাছে গেলে, সাপ  যেমন নিস্তেজ হয়ে যায়। ঠিক তেমনি , আমাদের মন যতই চঞ্চল,বিষন্ন, চিন্তামগ্ন, বিরক্ত বা বিক্ষিপ্ত থাকুক না কেন, সৎগুরুর কাছে গেলে, তার দেহনিঃসৃত অদৃশ্য দিব্য  জ্যোতিঃকনা এবং সুগন্ধে আমাদের মন শান্ত ও শান্তিতে ভরপুর হয়ে যাবে ।

২. সৎগুরুর কোনো নিজস্বতা নেই : তরল পদার্থের যেমন নিজস্ব আকার নেই, যে পাত্রে রাখা হয়,  তার আকার ধারণ করে, ঠিক তেমনি সৎগুরুর চিত্তবৃত্তি ও মনের নাশ ঘটে গেছে বলে, তার মধ্যে নিজস্ব কোনো ভাবের লহর খেলে না। যে যেমন ভাব নিয়ে তার কাছে উপস্থিত হয়, তিনি গুরুদেবকে সেই ভাবেই দেখেন। গুরুরূপী আধারটির মধ্যে আকার প্রকার আচরণ ও কথাবার্তায় খনে খনে পট পরিবর্তন হতে পারে। কখনো তার রুদ্র রূপ কখন বা শান্ত, কখন প্রসন্ন। সমস্ত স্থুল ব্যাপার আলোচনাতে তিনি যেমন পটু, তেমনি পরা বিদ্যা বা শাস্ত্র আলোচনায় তিনি নিপুন। শাস্ত্রের দুরূহ আলোচনায়তে তিনি স্বছন্দ।

৩. যিনি সদ্গুরু, তিনি অহরহ দিব্য  ভাবলোকে বিচরণ করেন। স্তর  ও মন্ডল ভেদে তার দেহের জ্যোতিচ্ছটায় প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটে। ফলত স্থূল চোখে ধরা না পড়লেও, শক্তিশালী ক্যামেরায় এটি ধরা সম্ভব।  তাই তার ফটো, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম হবে।  এবং  সদ্গুরুর  স্থুল ভাব অনুসারে তার ফটোও  পৃথক পৃথক দেখা যাবে।

৪. সদ্গুরু স্থুল, সূক্ষ্ম, কারন, কারনাতীত, সমস্ত জগতের তাবৎ প্রশ্নের উত্তরদানে সমর্থ। তার কথা শুনলে মনে হবে, সহজ সরল বিষয় যেন সব। আসলে ব্রহ্মকে  জানলে, সমুদয় তত্ত্বই বিজ্ঞাত হয়ে যায়। সদ্গুরু ব্রহ্মসিদ্ধ  তাই তিনি জ্ঞানসিদ্ধ। শাস্ত্রের কঠিন তত্ত্বকথা তার মুখে শুনলে মনে হবে, সবই সহজ। 

৫.সদ্গুরুর কাছে, একই প্রশ্ন বিভিন্ন লোক, বা বিভিন্ন সময়ে উত্থাপন করলে, প্রত্যেকের মস্তিষ্কের স্পন্দন অনুসারে, পৃথক ভাবে ভিন্ন ভিন্ন উত্তর দানে সমর্থ।

৬. কোনো বিজ্ঞানী বা বিজ্ঞানের ছাত্র কোনো জটিল সূত্র সম্পর্কে যদি প্রশ্ন করেন,তবে সদ্গুরু জিজ্ঞাসুর প্রজ্ঞাক্ষেত্রে এমন এক চেতনার উন্মেষ ঘটান, এমন এক চিৎ-স্পন্দনের উদ্ভব ঘটান, যাতে জিজ্ঞাসুর মধ্যে সেই বিষয়ে জ্ঞান স্বাভাবিক ভাবেই উজ্জীবিত হয়।  ফলে, এক মুহূর্তের মধ্যে জিজ্ঞাসুর মধ্যে যা অজ্ঞাত ছিল তা জ্ঞাত হয়ে যায়। তাই গুরুকে বলা হয় সমাধিবান, সমাধানের জীবন্ত বিগ্রহ। 

৭. সদ্গুরুর কাছে বহু লোক বহু প্রশ নিয়ে আসে। গুরুদেব, একজনের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে, সবার প্রশ্নের  সমাধান করে দেন। 

৮. সৎগুরু নিজে কখনো বিভূতি দেখান না। তার যোগৈশ্বর্য্য বা বিভূতি, তার যোগ্য শিষ্যের মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়। সদ্গুরুর যোগৈশ্বর্য্য় বিনা সাধনে, সদ্গুরু আশ্রিত শিষ্যের মধ্যে প্রকাশ পায়। 

৯. যেটা সবথেকে বড়  কথা আপনার  জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে সদ্গুরুর দর্শন ঘটলে, আপনার অহংয়ের মৃত্যু ঘটবে। আপনি আর আপনাতে  থাকতে পারবেন না। সদ্গুরু পরিচালিত যন্ত্রে পরিণত হয়ে যাবেন।মুহূর্তে বিবর্তন ঘটবে আপনার মধ্যে। 

১০. জীবনের যেকোনো মুহূর্তে, তা সে সঙ্কটকালেই হোক, বা সুসময় হোক, স্মরণমাত্র সদ্গুরু আপনাকে রক্ষা করবেন, বা দর্শন দেবেন, এর অন্যথা হবে না। এমনকি সৎগুরু দেহাতীত হয়ে গেলেও, প্রতিপদে আপনি তার উপস্থিতি টের পাবেন। সংকটকালে সঠিক পথ দেখাবেন।

আজ এখানে গুরুকথার বিরাম দিলাম।  

ওং ব্রহ্মানন্দং পরমসুখদং কেবলং জ্ঞানমূর্ত্তিম
দ্বন্দ্বাতীতং গগনসদৃশং তত্ত্বমস্যাদিলক্ষ্যম। 
একং নিত্যং বিমলমচলম সর্ব্বধী সাক্ষীভূতম 
ভবাতীতং ত্রিগুন রহিতং সদ্গুরুং তং নমামি।   







    


   

No comments:

Post a Comment