সত্যধর্ম - গুরুতত্ত্ব
গুরুবিনা কি সাধন হবে না ? (চতুর্থ ভাগ )
অধ্যাত্ম জীবনে সাহায্য নেওয়া বা দেওয়া :
গুরুতত্ব সম্পর্কে লিখতে লিখতে এক সময় মনে হয়, আমার নিজেরই তো জ্ঞান হয় নি। আমার নিজেরই তো মুক্তি হয় নি। তো আমি আবার জ্ঞান দেওয়া শুরু করেছি। গুরুদেবতো বলেছেন উপযুক্ত গুরু না পেলে চিরজীবন গুরুহীন থাকা ভালো। আমি যা বলছি তা তো এক রকম গুরুগীরি। এটা কি একটা প্রবঞ্চনা নয় ?
আসলে আমার নিজের মনে হয়, অধ্যাত্ম জীবনে প্রথম প্রথম সংগঠিত ভাবে এগোতে পারলে ভালো হয়। অর্থাৎ সৎসঙ্গ খুব জরুরি। আর তা ছাড়া একটু ভাবুন, আমরা তো সবাই শৃঙ্খলে আবদ্ধ। বন্ধনে আবদ্ধ। এক জনের হাত আর একজনের হাতে বাঁধা। আমরা কারারুদ্ধ। আমাদের সামনে খাবার আছে জল আছে। দেখছি কিন্তু খেতে পারছি না। আমরা এই শৃঙ্খলবদ্ধ হাত দিয়েই কিন্তু অন্যদের খাইয়ে দিতে পারি। তো একজন আর এক জনকে যদি খাইয়ে দেই, তবে আমাদের সবার ক্ষিদে মিটতে পারে। দর্শনটা এখানেই। আমি নিজের ভালোর জন্য, অপরের ভালো করতে চাইছি। নিজের ক্ষিদে মেটানোর জন্য অপরকে খাইয়ে দিচ্ছি। আখেরে আমার পেট ভরবে। এটাই উদ্দেশ্য।
আমি একবার এক স্বামীজিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। আপনি কি সত্যি কিছু পেয়েছেন ? যা অন্যকে দিতে চাইছেন ? তো তিনি আমাকে একটা সুন্দর উত্তর দিয়েছিলেন। বলছেন : আমি তো এইভাবেই বড়ো হয়েছি। ছোটবেলায় অর্থাৎ স্কুল জীবনে আমি পরের বাড়ি থেকে পড়াশুনা করতাম। আমরা বলতাম লজিং থাকা। তো সেখানে আমাকে ওই বাড়ির ছোটছোট ছেলেমেয়েদের পড়াতে হতো । আমি নিজেও পড়তাম, আবার অন্যদের পড়াতাম। তাতে আমাদের কোনো ক্ষতি হয় নি। বরং তাদেরও লাভ হয়েছে। আমারও লাভ হয়েছে।
অধ্যাত্মজীবনেও কিছুটা উন্নীত হলে অন্যকে সাহায্য করা উচিত। তবে হ্যাঁ নিজ শক্তির সীমানা অতিক্রম করো না। আর যদি সাহায্য করতে চাও, তবে অন্যের জন্য জগদীশ্বরের কাছে প্রার্থনা করো। এটা তো পারো। আমি মনে করি, নিজে সাধনা না করলে, আমি নিজে শুদ্ধ না হলে, অন্যকে সেই ব্যাপারে উপদেশ দেওয়া অপরাধ। আর তাতে কোনো কাজও হয় না।
আসলে প্রকৃত গুরু তো সবার ভাগ্যে জোটে না। হ্যাঁ ভন্ড গুরুর অভাব নেই। সত্যিকারের গুরুর কিন্তু সত্যিই অভাব। তাই গুরু না পেলে কি ভাবে নিজেকে উন্নত করা যায়, সেই উদ্দেশ্যে নিজের কাছে প্রশ্ন অনেক। নিজেই নিজের আচার্য্য হয়ে উত্তর দেওয়া। তাই কাউকে ভুল বোঝানো, বা কাউকে জ্ঞান দান করা আমার উদ্দেশ্য নয়। নিজের প্রস্তুতির জন্য এ সব লেখা বা বলা। আমি নিজের কথা নিজে শুনি। আমার মনন করতে সুবিধা হয়।
যাই হোক যে কথা বলছিলাম। আগের দিন আমরা গুরুদেব মহাত্মা গুরুনাথের দেওয়া ১০টি নির্দেশ-এর মধ্যে প্রথম নির্দেশ নিয়ে আলোচনা করছিলাম। অর্থাৎ উপাসনার কথা আলোচনা করছিলাম, আজ আমরা দ্বিতীয় নির্দেশ নিয়ে আলোচনা করবো আর তা হচ্ছে -
২) গুরুজনের প্রতি ভক্তি করো।
সাংসারিক জীবন থেকে আধ্যাত্মিক জীবন অনেক অনেক বেশী কঠিন। সাংসারিক জীবন, পাপ পুণ্যের জীবন, ভালো মন্দ নিয়ে আমাদের সংসার। কিন্তু আধ্যাত্মিক জীবনে পাপ বলে কিছু নেই। মুহূর্তের জন্যও যদি তোমার মধ্যে পাপ ঢুকে যায় বা অসৎ প্রবৃত্তি জেগে ওঠে তোমার আধ্যাত্মিক জীবন আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। সেই জন্য তোমাকে প্রতি মুহূর্তে সজাগ থাকতে হবে। সাংসারিক জীবনে বিশ্রাম আছে, সংশোধন বলে একটা কথা আছে। কিন্তু আধ্যাত্মিক জীবনে না আছে বিশ্রাম, না আছে সংশোধনের কোনো সুযোগ। তোমাকে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। জন্ম জন্মান্তর ধরে এই ভাঙা গড়ার খেলা চলছে। একটা উদাহরণ দিয়ে কথাটা বলি। তোমাকে হয়তো কেউ বললো, তুমি যদি দম বন্ধ্ করে থাকতে পারো তবে তুমি আকাশে বিচরণ করতে পারবে। এখন তুমি খানিকক্ষন দম বন্ধ করে দেখলে, তুমি ধীরে ধীরে পৃথিবী ছেড়ে আকাশের দিকে যাচ্ছো। এখন আকাশে ওঠার পরে যদি ভাব, একটু দম নিয়ে দেখি কি হয়। তাহলে কি
হবে ? তুমি ধরাশায়ী হবে। এবং আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। তাই মহাত্মাগণ আধ্যাত্মিক জীবন শুরুর প্রথমে কিছু কঠোর নিয়ম পালন করতে বলেন। ছেলেবেলায় মাকে দেখতাম, রুটি শেঁকার আগে তাওয়া গরম করে নিতো। ঠিক ঠিক মতো তাওয়া গরম না হলে রুটি ঠিক মতো হবে না। এও তেমনি, আধ্যাত্মিক জীবনে প্রবেশের শুরুতে নিজেকে তৈরী করে নেওয়া। আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য, প্রাথমিক দিকে সাংসারিক জীবনে আগে আমাদের নৈতিক হতে হবে। তাই গুরুদেব বলছেন, গুরুজনদের প্রতি ভক্তি করো। এখন গুরুজন কারা ? আর ভক্তিই বা কী ?
গুরুদেব বলছেন, মাতা-পিতা আমাদের জন্মের কারন। তারাই আমাকে প্রতিপালন করে বড়ো করেছেন। এঁরাই আমার সবথেকে কাছের মানুষ। এরাই আমাকে প্রথম ভালোবাসার স্পর্শ দিয়েছেন। প্রকৃতির জগতে বেঁচে থাকার জন্য সহযোগিতা করেছেন, বেঁচে থাকার শিক্ষা দিয়েছেন। গুরুদেব বলছেন, যে পরম আরাধ্যা জননী ৯ মাস ১০ দিন গর্ভে ধারণ করে অশেষ কষ্ট ভোগ করেছেন। আমাকে স্তন সুধা পান করিয়ে, সমস্ত বিপত্তি থেকে রক্ষা করেছেন। আমাদের মল-মূত্র পরিষ্কার করেছেন। আমার রোগভোগে সেবা-যত্ন করেছেন। আমার সুখে সুখিনী, আমার দুঃখে দুঃখিনী হয়েছেন। আসলে মায়ের কথা বলে বোঝানোর দরকার নেই। আমরা সবাই উপলব্ধি করি। কিন্তু মায়ের প্রতি আমাদের কর্তব্য সবাই সমান মতো পালন করি না। মায়ের প্রতি কর্তব্য পালনে যদি আমাদের এতটুকু অনীহা বা ঘাটতি থাকে, তবে আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনে আসা বৃথা। পণ্ডশ্রম মাত্র। এইজন্য আমরা দেখি, সন্যাস জীবনে প্রবেশের জন্য মায়ের অনুমতি নিতে হয়। মায়ের অনুমতি ছাড়া সন্যাস জীবন সফল হয় না। আদি শঙ্করাচার্যকে আমরা দেখেছি, তাঁর নিজের প্রবল ইচ্ছা সত্ত্বেও, যতক্ষন মা অনুমতি দেন নি, ততক্ষন তিনি সংসারেই ছিলেন। সচল শিব ত্রৈলঙ্গস্বামীকে আমরা দেখেছি, ঘর ছাড়ার আগে মায়ের দেহত্যাগ অবধি অপেক্ষা করেছেন। তো মাকে কষ্ট দিয়ে যারা আধ্যাত্মিক জীবনের সুখ খুঁজছেন, তারা বৃথা মরীচিকার পিছনে ছুটছেন। তো আধ্যাত্মিক জীবনের প্রথম কর্তব্য মায়ের সেবা করা। মাকে সুখে রাখা। এর কোনো বিকল্প নেই।
গুরুদেব মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন পিতা আমাদের ভরণপোষণের জন্য অবিরাম পরিশ্রম করেও ক্লান্তি বোধ করেন নি। আমাদের সুখের জন্য, আমাদের ভালো থাকার জন্য, আমাদের লেখাপড়া শেখাবার জন্য, আমাকে রক্ষা করার জন্য, পিতা অক্লান্ত পরিশ্রম করে, জীবনের সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে, আমাকে রক্ষা করেছেন। আমরা যতটুকু জ্ঞান লাভ করেছি, তার বীজ মাতা-পিতাই রোপন করেছেন। তো এই আমাদের জীবনে সর্বোত্তম ও ভক্তিভাজন এই পিতা মাতা।
এর পরে যারা আমাদের শিক্ষাগুরু আছেন, অর্থাৎ পরিবারের বয়স্কজন, আমার শিক্ষাক্ষেত্রের শিক্ষকজন, এবং সবশেষে আমার আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশের জন্য যিনি উৎসাহিত করেছেন, সম্যক জ্ঞান দান করেছেন, তারা সবাই আমাদের ভক্তিভাজন। এদের প্রতি যথাযোগ্য সন্মান, ভক্তি বিনা আমার অধ্যাত্ম জীবনের কোনো উন্নতি সম্ভব নয়।মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন - তুমি যদি এদের প্রতি ভক্তি না করতে পারো তবে সেই জগৎপিতার, জগৎগুরুর প্রতি ভক্তি করা দুঃসাধ্য।
গুরুভক্তি আমাদের কি আশ্চর্য্য ফল দান করতে পারে, তারই একটা কাহিনী বলবো। আচার্য্য আদি শঙ্করের নাম নিশ্চয় শুনেছ। তার এক শিষ্য ছিল যার নাম আনন্দগিরি। ডাকনাম শুধু গিরি। সে লেখাপড়া বিশেষ জানতো না। কিন্তু দেখতে শুনতে খুব ভালো ছিল। সে ছিল শুদ্ধচেতা, সরলমতি।আর প্রচণ্ড গুরুভক্ত। সে সারাক্ষন গুরুসেবায় নিযুক্ত থাকতো। সব সময় তার মনে হতো এই বুঝি গুরুদেব তাকে ডাকছে। সে জন্য, সে মাঝে মধ্যে গুরুদেবের ঘরের সামনে, শীতের রাতে, উন্মুক্ত জায়গায় মাটির উপরে শুয়ে থাকতো। যাতে গুরুদেবের ডাক সে শুনতে পারে। আচার্য্যের অন্য সমস্ত শিষ্যই বেশ পণ্ডিত ছিল। যার জন্য আচার্য্য শঙ্কর তার শিষ্যদের বিষয় নির্বাচন করে, তার উপরে লিখতে বলতেন। এখন গিরি তো কিছু লিখতে পারতো না। গুরুদেব তাকে কিছু লিখতেও দেয় না। এর জন্য গিরির মনে খুব দুঃখ।গিরি মনে মনে গুরুদেবের কাছে প্রার্থনা করতো, হে গুরুদেব, আমাকে জ্ঞান দাও। আমি যেন অন্যদের মতো শাস্ত্র বুঝতে পারি, ভাষ্য লিখতে পারি। হে গুরুদেব আমাকে দয়া করো, করুনা করো। আর, গিরি কিছু বুঝুক না বুঝুক, গুরুদেব যখন কিছু বলতেন, বা উপদেশ দিতেন, তখন গিরি,আচার্যের পাশে গিয়ে তাকে বাতাস করতো, বা গামছা নাড়িয়ে গুরুদেবকে মশা মাছি থেকে রক্ষা করতো। এবং নিষ্ঠা সহকারে গুরুদেবের বাণী শুনতো। পান্ডিত্যের দিক থেকে, গিরি যেমন অন্য্ শিষ্যদের পাশে আসতে পারতো না, তেমনি গুরুভক্তির দিক থেকে গিরি ছিল সবচেয়ে উঁচুতে।
তো একদিন হো'লকি, গুরুদেব সবাইকে নিয়ে বসেছেন উপদেশ দান করার জন্য, শাস্ত্র ব্যাখ্যা শোনাবার জন্য। কিন্তু গিরি নেই। গুরুদেব জিজ্ঞেস করলেন, গিরিকে তো দেখছি না ! সবাই বললো, গিরি নদীতে গেছে, স্নান করার জন্য, আর ও তো স্নান করার সময় একটু বেশিই নেয় তার কারন ওই সময় গিরি আপনার বস্ত্র ধৌত করে। তো গুরুদেব বসে আছেন। সবাই বলছে, উপদেশ শুরু করতে। কিন্তু গুরুদেব গিরির অপেক্ষায় বসে আছেন। আচার্য্য বললেন, একটু অপেক্ষা কর। গিরি এখুনি আসবে। কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পরও গিরি এলো না দেখে, পদ্মপাদ নামে তার প্রধান জ্ঞানী শিষ্য বললো : গিরি কি আপনার শাস্ত্র ব্যাখ্যা বুঝতে পারে ? আচার্য্য বললেন, গিরি বুঝতে পারেনা ঠিক, কিন্তু সে অতি নিষ্ঠা ভরে, অতি শ্রদ্ধা সহকারে সবকিছু শোনে।
এদিকে গিরি কাপড়চোপড় পরিষ্কার করছে আর মনে মনে বলছে, হে গুরুদেব, তুমি আমাকে জ্ঞান দাও। আমি যেন ওদের মতো শাস্ত্র বুঝতে পারি, আর ভাষ্য লিখতে পারি। এমন সময়, সেই নদীর পারে, অর্থাৎ তুঙ্গা ও ভদ্রা নদীর সঙ্গম স্থলে তার যেন মনে হল, গুরুদেব তার দিকে প্রসন্ন চিত্তে তাকিয়ে আশীর্বাদ করছেন। আর তার অন্তর লোক এক দিব্য আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। গিরির মনে হলো, সে যেন সর্ব বিদ্যার অধিকারী হয়ে গেছে। তার সমগ্র মন, প্রাণ, এক অনির্বচনীয় আনন্দে ভরপুর হয়ে গেল। গিরি, গুরুদেবের উদ্দেশে দৌড় শুরু করলো। এবং গুরুদেবের কাছে এসে, তার চরণ বন্দনা শুরু করলো, এক ছন্দবদ্ধ শ্লোকে।
দ্বাদশাক্ষরী তোটক ছন্দে পরম পবিত্র সেই আকুতি : বলছেন : সমুদ্রের জল আমার জন্ম-মরন, সমুদ্রের মাছ আমার সুখ দুঃখ। হে ভগবান, হে গুরুদেব সেই ভবসমুদ্রে পতিত হয়ে আমি অশেষ দুঃখ ভোগ করছি। আমি অন্য কোনো গতি না পেয়ে, হে গুরুদেব তোমার শরণ নিলাম। দয়াকরে, কৃপা করে, শরণাগতকে উদ্ধার করো।
তখন গুরুদেব বলছেন : তোমার বিষয়ে আসক্তিই সব দুঃখের কারন। বিষয়ে আসক্তি ত্যাগ করে, দেহাত্মবুদ্ধি ত্যাগ করে, পরম-আত্মার চরণে নিবেদিত হও। হে তত্ত্ব-পিপাসু সমস্ত মোহপাশ ছিন্ন করো।
গিরির মুখে এই বিশুদ্ধ শ্লোক শুনে, যার মধ্যে সেই চিরকালীন আবেদনের সুর, উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে গেল। গুরুদেব তাকে সস্নেহ কাছে টেনে নিলেন। সকলে বুঝলো গুরুদেবের কৃপা হলে সব সম্ভব।
জানিনা গল্প কথা কিনা। তবে আমি মনে করি তার কৃপা হলে সব সম্ভব। তার কৃপা যখন বর্ষিত হয়, তখন আমাদের দ্বারা এমন সব কাজ সম্ভব, যা আমার যোগ্যতার বাইরে। আর তার কৃপা থেকে যখন আমরা বঞ্চিত হই, তখন আর সেই মতো কাজ করতে পারি না। আমাদের দিয়ে তিনিই সব কাজ করিয়ে নেন। আমরা তার হাতের ক্রীড়নক মাত্র।
অর্জুন একবার শ্রীকৃষ্ণকে বলেছিল : তুমি তখন যুদ্ধে ক্ষেত্রে বসে কি সব আত্মতত্ব ইত্যাদি গুড় রহস্যঃ বলেছিলে, তো যুদ্ধক্ষেত্রে আমিতো সব বুঝিনি, তুমি কি দয়াকরে, আবার আমাকে সেই সব কথা একবার বলবে ?যোগেশ্বের
শ্রীকৃষ্ণ তখন বলেছিলো, তখন কি বলেছিলাম তাতো আমার মনে নেই, তা আর আমি জীবনে কোনোদিন বলতেও পারবো না। তবে আত্মতত্ব সম্পর্কে এখন যা বলতে পারি, তা তুমি শোনো। আগের কথা গুলো গীতা হয়েছিল, একই শ্রীকৃষ্ণের একই বিষয়ের কথা আর কিন্তু গীতা হয় নি। একই শিল্পীর, এক একটি স্টেজে এক একদিনের গান বা নাচ খুব ভালো হয়। কেন হয়, সেই ব্যাখ্যা সে নিজেও জানতে পারে না। তবে হয়। তাই পরমাত্মা-পরম-ঈশ্বর আসলে আমাদের গুরুরূপে, পিতা-মাতা রূপে আসেন, শিক্ষক রূপে আসেন, তাদের আমাদের ভক্তি করা উচিত। তাদের কথা আমাদের পালন করা উচিত। তাদের সেবা করা উচিত। এর কোনো বিকল্প নেই।
এইবার মা-বাবার ভক্তি প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি। তারপরেই এই প্রসঙ্গ শেষ করবো। পুরাকালে পুণ্ডরীক নামে এক ব্রাহ্মণ ছেলে বিয়ের পরে বউ ভক্ত হয়ে গেল। এখন বাবা যা বলে তা আর তার ভালো লাগে না। মা যা বলে তা তার ভালো লাগে না। বৌ বাপের বাড়ি গেলে, সেও শ্বশুর বাড়ি চলে যায়। এখন মায়ের কাজে সাহায্য করতে বললে, ছেলে বলে,বৌ কি তোমাদের বাড়ির কাজের লোক ? বাবা ছেলেকে পৌরিহিত্য করার কথা বলতেই, ছেলে বলে উঠলো, আমি চালকলার ব্যবসা করবো না। বাবা জিজ্ঞেস করলো, তা তুই কি করবি ? ছেলে বললো, শ্বশুরমশায় আমাকে চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন বলেছেন। আমি তাই করবো।
ব্রাহ্মণ বাবা-মা ছেলের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে, ঠিক করলো - তারা সংসার ছেলের উপরে ছেড়ে দিয়ে, তীর্থ যাত্রায় বেরিয়ে পরবে। যেমন কথা তেমনি কাজ। তারা দুই জন্য তীর্থ যাত্রায় বেরিয়ে পড়লো। এদিকে ছেলে তার বৌকে ঘোড়ায় চাপিয়ে বাবা-মায়ের পিছন পিছন চলতে লাগলো। এক আশ্রমে এসে বাবা-মা রাত্রি যাপন করতে লাগলো। ছেলে-বৌমাও সেই আশ্রমে রাতের জন্য আশ্রয় নিলো। গভীর রাতে ছেলেটি দেখলো, তিনজন নোংরা শাড়ী পরিহিত সুন্দরী নারী বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলো এবং কিছুক্ষন পরে, পরিচ্ছন্ন পোশাক পড়ে বেরিয়ে গেল। পরদিন রাতেও সেই একই দৃশ্য দেখলো। তারপরদিনও অর্থাৎ তৃতীয় দিনে যখন আবার সুন্দরীদের সেই গৃহে প্রবেশ করতে দেখলো, সে তখন বিছানা থেকে উঠে, সুন্দরীদের পরিচয় জানতে চাইলো, তখন সুন্দরীরা তাকে বললো - আমরা গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী। সারাদিন সবাই আমাদের সলিলে অবগাহন করে, সমস্ত পাপ দিয়ে যায়। আমরা এখানে আসি সারাদিনের সেই পাপ পরিষ্কার করার জন্য। তোমার মতো যারা পাপী, মাতা-পিতাকে কষ্ট দেয়, পাপ কর্মে লিপ্ত থাকে, আর পাপ মোচনের জন্য আমাদের সলিলে অবগাহন করে। তাদের জন্যই আমাদের এই দুর্দশা।এ কথা শুনে, ছেলেটির চৈতন্য হলো। এবং প্রতিজ্ঞা করলো আজ থেকে সে মাতা-পিতার সেবা করবে, তাদের কোনো কষ্ট দেব না।
সেইমতো বাবা-মাকে নিয়ে বাড়ী ফিরলো। এবং বাবা মায়ের বাধ্য ছেলে হয়ে গেল। রাতে শোবার আগে, ছেলে-বৌ দুজনে মিলে বাবা-মায়ের পা টিপে দেয়, যতক্ষন না তারা ঘুমায়। তো একদিন হলো কি, স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এলো ছেলেটাকে ডাকতে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললো তোমার সাথে আমার কিছু কাজ আছে। ছেলেটি বললো, এখন আমি ব্যস্ত আছি। শ্রীকৃষ্ণ বললো আমাকে বসতে দেবে না ? ছেলেটি একটা ইটের টুকরা ছুড়ে দিয়ে বললো, হয় বসো নয় দাঁড়িয়ে থাক, আমার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমার সাথে কথা বলতে পারবো না। অর্থাৎ বাবার ঘুম না আসা পর্যন্ত আমি বাবার সেবা করবো। আর এই সময় যত বড় কাজই থাকুক, আর যেই আসুক, পিতা সেবায় সে বিরত হতে পারবে না। শ্রীকৃষ্ণ সারারাত সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলো। প্রচলিত কাহিনী যে, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ ইট-এর উপরে দাঁড়িয়ে ছিল, কালান্তরে সেখানে বিটঠলা, অর্থাৎ ইটের উপরে দাঁড়ানো বিষ্ণু মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
এটাই বহিরঙ্গ সাধনা। এই বহিরঙ্গ সাধনায় পারঙ্গম হলে, তবেই অন্তরঙ্গ সাধনার যোগ্য উঠতে পারি আমরা। গুরুজনদের প্রতি যদি আমরা ভক্তি, শ্রদ্ধা না করতে পারি, তবে ঈশ্বরের ভক্তি শ্রদ্ধা কি করে করবো ?
পরম-ঈশ্বরই আমাদের কাছে, পিতামাতা রূপে আসেন। গুরু রূপে আসেন। ইষ্ট রূপে আসেন। তাই আমাদের মাতা-পিতার মাধ্যমে, গুরুজনের মাধ্যমে, গুরুদেবের মাধ্যমে, ইষ্টের মাধ্যমে, দেবতার মাধ্যমে, এগুতে হবে। এইজন্য মহাত্মা গুরুনাথ "ধর্ম্মার্থীর কর্তব্য" সন্মন্ধে বলছেন মাতা, পিতা, শিক্ষক, রাজা, ও অন্যান্য গুরুজনদিগকে যথোচিত ভক্তি করবে। দেবদেবীগনের প্রতি ভক্তি । এটাই মহাত্মা গুরুনাথের শিক্ষা। গুরুদেব আসলে সাধন পথে আসতে গেলে তিনটি জিনিসের প্রতি গুরুত্ত্ব দিতে বলেছেন, আর তা হচ্ছে - প্রেম, ভক্তি, ও একাগ্রতা। এই ভক্তির বহিরঙ্গ সাধনাই গুরুভক্তি, বা গুরুজনের প্রতি বা মাতা-পিতার প্রতি ভক্তি। আমরা এই বহিরঙ্গ সাধনা না করে অন্তরঙ্গ সাধনায় সিদ্ধ হতে পারবো না। আমরা এই গুরুজনদের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধার মাধ্যমেই ঈশ্বর ভক্তি লাভ করতে পারবো।
সমাপ্ত।
No comments:
Post a Comment