Sunday, 16 September 2018

সত্যধর্ম - গুরুতত্ত্ব - গুরুবিনা কি সাধন হবে না ? (৩)

সত্যধর্ম - গুরুতত্ত্ব
গুরুবিনা কি সাধন হবে না ? (তৃতীয় ভাগ )




আগেরদিন আমরা সত্যকামের  কথা শুনছিলাম।  এবং শুনেছিলাম  যে , আমাদের   যদি ব্যাকুলতা  থাকে, তবে গুরু ছাড়াও আমাদের ব্রহ্মজ্ঞান হতে পারে। আমরা  যদি যোগ্য হতে পারি, তবে প্রকৃতি আমাদের আচার্য্য বোনে যান। আমরা যে কোনো জায়গা থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। কিন্তু  আমাদের  যদি চেষ্টা না থাকে, হাজার গুরু করলেও আমাদের   কোনো উন্নতি হবে না। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন : যদি তেত্রিশ কোটি দেবতায় তোমার বিশ্বাস থাকে অথচ তোমার নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস না থাকে, তবে কখনোই তোমার মুক্তি হবে না।

আমরা একলব্যের কথা শুনেছি। মহাভারতের আদিপর্ব্বে এই কাহিনীর উল্লেখ আছে। জাত-ব্যবস্থা আমাদেরকে কি ভাবে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করেছিল, গুরু থেকে বঞ্চিত করেছিল তারই এক নির্মম কাহিনী, এই একলব্যের কাহিনী। ভ্রষ্ট  গুরুর কাহিনী। মহাভারতের যুগে, নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র এই একলব্য। একলব্য ছিল ভীল সম্প্রদায় ভুক্ত।  এই সময়ে দ্রোণাচার্য নামে এক ব্রাহ্মণ শস্ত্র বিশারদ ছিলেন। তিনি কৌরব বংশীয় রাজার সন্তানদের অস্ত্র শিক্ষা দিতেন।  গুরু দ্রোণাচার্য্যের সংগ্রামনৈপুণ্য শুনে, বহু জায়গা থেকে তার কাছে  অস্ত্র শিক্ষা লাভ করবার জন্য শিক্ষার্থী  আসতো।  এমনি ভাবে একদিন একলব্য এলো শিক্ষাগুরু, অস্ত্র শিক্ষক দ্রোণাচার্য্যের কাছে। কিন্তু সে ছিল মূলনিবাসী, আর্যদের দৃষ্টিতে ম্লেচ্ছ , অস্পৃশ্য, সতীর্থদের অর্থাৎ অন্যান্য শিক্ষার্থীদের  সমতুল্য নয়। অর্থাৎ আর্য্যদের সমতুল্য নয়। তাই একলব্য যখন গুরু দ্রোণাচার্যকে অস্ত্র শিক্ষা দেবার জন্য অনুরোধ করলো দ্রোণাচার্য একলব্যকে  শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করতে রাজী হলেন  না। তখন নিষাদরাজ-তনয় একলব্য দ্রোণাচার্য্য কে প্রণাম করে, বিষাদমগ্ন হয়ে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করলো। যা তার নিজের বিচরণ ভূমি। সেখানে সে গুরু দ্রোণাচার্যের মাটির মূর্তি তৈরি করে, অস্ত্র শিক্ষার অভ্যাস করতে লাগলো। যার নিষ্ঠা গভীর, তাকে ভগবান সহযোগিতা করেন। একলব্যও ধীরে ধীরে, কিছুদিনের মধ্যেই সমস্ত অস্ত্রের প্রয়োগ, সংহার, সন্ধানবিষয়ে পারঙ্গম হয়ে উঠলো। আসলে গুরু তোমার  মনে, তোমার  অন্তরে, তোমার  ভিতরে,  তোমার বাহিরে।  তোমার  ভাবনাই  তোমার  গুরুর কাছে পৌঁছে দেবে। তোমার  বিবেক সর্বোত্তম গুরু।  তার কাছে আশ্রয় নাও ।  তিনিই তোমাকে  পথ দেখাবেন। তোমার  কাজ বিবেকের নির্দেশে কাজ করা। বিবেকবর্জিত কাজ করা মানে, অধঃপতন।  আর বিবেক নির্দেশিত কাজ করা মানে  ঈশ্বরের কাজ করা। আর সেটাই উন্নতির গোপন কথা। আর সেটাই সাম্যাবস্থায় থাকা। আনন্দে থাকা।

এর পরের কাহিনী অতি নির্মম। তোমরা  সবাই জান,  গুরু দ্রোণাচার্য , গুরুদক্ষিণার নামে, একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ, কেটে নিয়ে   তার প্রিয় শিষ্য  অর্জুনের ধনুর্বিদ্যায় একাধিপত্য নিশ্চিত করেছিলো।  অর্জুনকে খুশি করেছিল। আমরাও এইসব  গুরুদেবের সন্তুষ্টির জন্য সব করি।  কিন্তু তাদের কাছে আমাদেরকে  দেবার জন্য কিছুই থাকে না। আমি এইসব গুরু যারা গুরুমাহাত্য জানে না , গুরুর কর্তব্য জানে না, তাদের থেকে দূরে থাকতে বলছি। মহাত্মা গুরুনাথ বলেছেন, উপযুক্ত গুরু যদি না মেলে তবে সারাজীবন গুরুহীন থাকা ভালো।

কিন্তু শুনলে অবাক হবে, পাপ ছাড়েনা বাপকে। পাপ মানুষের জন্ম-জন্মান্তরের সাথী। এই একলব্য-ই মৃত্যুর পরে ধৃষ্টদ্যুম্ন হয়ে জন্মে ছিল, আর আচার্য্য দ্রোণের মস্তক, ধর থেকে আলাদা করে দিয়েছিলো। একলব্য কত বড়  বীর ছিলেন, তা শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর পরে তার পিতা বসুদেবের বিলাপ থেকে পাওয়া যায়।  বসুদেব বলছেন : হে ভাগ্নে  অর্জুন, যে কৃষ্ণ আগে মহাবল পরাক্রান্ত কেশী কংস, শিশুপাল, নিষাদরাজ একলব্য প্রভৃতি ভূপালগনকে নিহত করেছিলেন, এখন তিনিই যদুকুল ক্ষয় হতে দেখেও উপেক্ষা করেছেন। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস।

আর একটা গল্প বলি :

রাস্তায়, এক বৃদ্ধা, তন্ন তন্ন করে কি যেন খুঁজছেন । জিজ্ঞেস করলাম কি খুঁজছেন ? বললো আমার গোপালকে খুঁজছি। আমি ভাবলাম, গোপাল, তাও আবার রাস্তায় ? কে গোপাল ? আপনার ছেলে ? বললো না আমার সোনার গোপাল। আমার ঠাকুর। জিজ্ঞেস করলাম কোথায় হারিয়েছে ? বললো ঠাকুর ঘরে ছিল। তো সেখানে না খুঁজে এখানে খুঁজছেন কেন ? তখন বৃদ্ধা আমাকে একটা আশ্চর্য সত্য বললো, তা হচ্ছে - গুরুদেব যে বললো : আলোতে খুঁজতে।  ঠাকুর-ঘরে তো আলো নেই, তাই এখানে খুঁজছি। এখানে আলো  আছে।
আমরাও ঈশ্বরকে খুঁজি গুরুদেবের কাছে, অন্তরের বাইরে। ঈশ্বর তো গুরুদেবের কাছে নয়।  ঈশ্বর আমাদের অন্তরে। আমরা, গুরুদেব যা বলছেন তা বুঝি না। বুঝলেও সে অনুযায়ী কাজ করি না।   করলেও উল্টোটা করি। গুরুদেব তো রাস্তা বলে দেন। চলতে হবে আমাদের।

ছেলেবেলায় একটা কথা শুনতাম , শিক্ষক ছাত্রকে   বলেছেন,  বলো : My Head মানে আমার মাথা, ছাত্র বলছে , My Head মানে মাস্টার মহাশয়ের মাথা।

ভগবান বলছেন:
"সর্ব ধর্ম্নান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।"

তথাকথিত  সমস্ত ধর্ম্ম, অর্থাৎ তোমার পূর্ব সংস্কার অনুযায়ী যাকে তুমি ধর্ম্ম ভাবছো, সেই ভাবনা ত্যাগ করে মামেকং অর্থাৎ সেই এক এবং  অদ্বিতীয় আমিকে শরণ করো , অর্থাৎ পরম পিতাকে আশ্রয় করো।  আমরা তা না করে, মানুষ শ্রীকৃষ্ণের ছবি  নিয়ে বসে গেছি পূজা করতে। এতে কি হবে ?

তবু বলি আধ্যাত্মিক গুরু, আধ্যাত্মিক জগতে হাত ধরে নিয়ে যান । তাই গুরুকরন অতি আবশ্যক। আমরা বাড়ি বসে পড়াশুনা করতে পারি।  তবু আমরা ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে পাঠাই।  কেবল গুরুকরনেই আমাদের সন্দেহ জাগা উচিত নয়। কেবল বয়স বাড়লেই, আমাদের জ্ঞান বাড়ে না। হ্যাঁ এমন কিছু মানুষ আছেন, যারা জন্ম থেকেই ভগবানকে অনুভব করেন , এরা ঈশ্বরীয় চেতনা  নিয়েই জন্মান । তাদের ক্ষেত্রে হয়তো গুরুদেবের দরকার পারে না। কিন্তু তবু আমরা দেখি, রামকৃষ্ণদেবেরও   গুরু ছিলো। যোগেশ্বর  শ্রীকৃষ্ণেরও  গুরু ছিল।  আচার্য্য প্রণবানন্দের গুরু ছিলো।   আদি শঙ্করাচার্যেরও  গুরু ছিল।     

কিন্তু সবার গুরু ছিল বলেই আমারো গুরু থাকবে, তার কোনো মানে নেই। আমার যোগ্যতা অনুসারে, আমার গুরুলাভ হবে। তাই বলছিলাম নিজেকে যোগ্য করে তোলো। কিন্তু কি করলে আমরা যোগ্য হয়ে উঠবো ? মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্ত কি বলছেন এই প্রসঙ্গে ? আমরা সংক্ষেপে আলোচনা করবো। 

মহাত্মা গুরুনাথ দশটি নির্দেশ দিয়েছেন।  বলছেন  :

১) প্রতিদিন অন্তত তিন ঘন্টা জগদীশ্বরের উপাসনা করো।
২) গুরুজনের প্রতি ভক্তি করো।
৩) সর্বদা সত্য কথা বলবে। 
৪) পরের দ্রব্য হরণ করবে না।
৫) জিতেন্দ্রিয় হবে।
৬) আত্মহত্যা বা নরহত্যা করবে না
৭) যাতে বুদ্ধি বাড়ে, তার জন্য চেষ্টা করবে।
৮)  ধৈর্য্য ও ক্ষমা গুনের সাধনা করবে।
৯) শরীর ও মন পবিত্র রাখবে। 
১০) প্রতিদিন গুরুমূর্তি ধ্যান করবে।

আমরা এগুলো এক এক করে আলোচনা করবো : কিন্তু আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে, যাদের উপযুক্ত গুরুদীক্ষা হয় নি, তাদের জন্যই এই আলোচনা। 

১) প্রতিদিন অন্তত তিন ঘন্টা জগদীশ্বরের উপাসনা করো।

জগদীশ্বরের উপাসনা বলতে আমরা কি বুঝি ? জগদীশ্বর সম্পর্কে আমাদের কি ধারণা ?
সাধারণতঃ ঈশ্বর বা জগদীশ্বর বলতে আমরা বুঝি সৃষ্টি, স্থিতি, লয়-এর কর্তা। তার থেকেই সব সৃষ্টি, আবার তাতেই লয়। যদিও তিনি আসলে আরো বড় কিছু। তার কাজ শুধু, সৃষ্টি, স্থিতি বা লয় নয়। এই সৃষ্টি-স্থিতি-লয় এর কর্তা তার একটি অংশ মাত্র।  তিনি এসবেরও উর্দ্ধে বৃহৎ  কিছু। এই সত্য উপলব্ধি করতে গেলে আমরা জীবাত্মা, আর তিনি পরমাত্মা- এটা দৃঢ় ভাবে বুঝতে হবে। আমাদের উপলব্ধি করতে হবে  । আমরা যাকে আমি বলি, অর্থাৎ মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার, ইন্দ্রিয়-বর্গ বা এই দেহ, এর থেকে সত্যিকারের আমি সম্পূর্ণ  আলাদা। আমরা এক একটি আত্মা, সেই পরম-আত্মা বা অনন্ত চৈতন্যের অংশ। নিজেকে যতক্ষন অবধি মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার, ইন্দ্রিয়-বর্গ বা এই দেহ থেকে স্বতন্ত্র না ভাবতে পারছি ততক্ষন সেই পরম-আত্মা বা পরম চৈতন্য সম্পর্কে কিছুই জানতে সক্ষম হবো না। উপাসনার শুরুতে আমাদের জানতে হবে বা উপলব্ধি করতে হবে, পরম-আত্মার  সঙ্গে জীবাত্মার সম্পর্ক চিরন্তন। এই মিলন শাশ্বত।  তবু মনের মালিন্য হেতু আমরা ঈশ্বরকে ছেড়ে তারই  সৃষ্টিতে আসক্ত হয়ে পড়েছি । 

আমরা তো ঈশ্বরকে চাই না। আমরা তাকে আমাদের ইচ্ছা পূরণের জন্য,  কাজে লাগাতে চাই। আমাদের বাসনাগুলো পূরণের জন্য তাকে কাজে লাগাতে চাই। আর যখন,সেই বাসনা পূরণ না হয়, তখন আমরা অবিশ্বাসী হয়ে পড়ি। এইজন্য ঈশ্বর সম্পর্কে আমাদের একটি সঠিক ধারণা চাই। একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, ঈশ্বর আমাদের বাসনাপূরণের যন্ত্র নয়। তিনি এসব থেকে বহুগুন বেশী কিছু।

আমরা ভাবি, ঈশ্বর সর্বশক্তিমান একজন পুরুষ মাত্র। তারও আমাদের মতো দেহ আছে। সেই দেহ কখনো স্থুল আবার কখনো সূক্ষ্ম। আমরা তাঁর  সেই স্থুল  দেহ দেখতে চাই। এই ভ্রমে যাঁরা পতিত তাঁরা সেইমতো আবদ্ধ হয়ে পড়েন। 

কেউ ভাবেন "অহং ব্রহ্মাস্মিন্" । আমিই ব্রহ্ম। "সোঽহং" - তিনিই আমি। "তত্ত্বমসি" -  আমিই সেই। এটি একটি ভয়ানয়ক অসত্য কথন।  মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন,  হে ক্ষুদ্র মানব, তুমি যখন অপর একজন মানুষকেই আত্মতুল্য জ্ঞান করতে পারো না, তখন অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডেশ্বরকে কিভাবে আত্মতুল্য বোধ করবে ? ক্ষুদ্রতম প্রস্তরকণা কিভাবে নিজেকে হিমাচলকে আত্মসদৃশ্য বিবেচনা করবে ? আমি ভাবি, শরীরের অসংখ্য কৃমিকীট, অসংখ্য কোষ তারা কি নিজেদেরকে মানুষ ভাবে  ? জীবাত্মা কখনো পরম-আত্মার তুল্য হতে পারে না। এ সবই  আমাদের অহং-এর ভ্রম। 

ঈশ্বর সচ্চিদানন্দ, - তিনি অনন্ত অস্তিত্ব, অনন্ত চেতনা, অনন্ত আনন্দ। তিনি জীবাত্মায় স্ফূরিত হন মাত্র। আবার আমরাও তাতেই থাকি। 

আমাদের এই অনুভূতি আনতে  হবে যে,  আমরা জীবাত্মা, আমরা পরম-আত্মার মধ্যে, আমরা তাঁরই পরম সান্নিধ্যে আছি।  তিনিই  আমাদের প্রিয় থেকে প্রিয়তর, নিকট থেকে নিকটতর। এই চেতনা আমাদের ভিতর জাগিয়ে তুলতে হবে। এটাই উপাসনা। অর্থাৎ ঈশ্বরের কাছে আসন পেতে বসা।  সমুদ্রের মধ্যে বুদ্বুদ আমি। মহাসাগর আমাদের ধারণার বাইরে। তাই আমরা যে ঢেউয়ের উপরে খেলছি, তার সাথে একাত্ম হতে হবে।  এবং সময় হলে, এই ঢেউয়ের মাধ্যমে মহাসাগরের সঙ্গে আমাদের একাত্মতা হবে। 

তাই আমাদের  মাতা-পিতার মাধ্যমে, গুরুদেবের মাধ্যমে, ইষ্টের মাধ্যমে, দেবতার মাধ্যমে, এগুতে হবে। এইজন্য মহাত্মা গুরুনাথ  "ধর্ম্মার্থীর কর্তব্য" সন্মন্ধে বলছেন  মাতা পিতা শিক্ষক, রাজা, ও অন্যান্য গুরুজনদিগকে যথোচিত ভক্তি করবে।  দেবদেবীগনের প্রতি ভক্তি করবে। পূজা করবে, কিন্তু মনে রাখতে হবে - তাঁরা কেউ জগদীশ্বর নয়। সব থেকে  বড় কথা হচ্ছে, যার কৃপায় তুমি জগদীশ্বর লাভের পথ প্রাপ্ত হয়েছো, সেই গুরুদেবের প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি করবে। এই সমর্পন-ই উপাসনা। 

কখন উপাসনা করবো, বা কতক্ষন উপাসনা করবো। মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন অন্ততঃ তিন ঘন্টা উপাসনা করবে।  উপাসনার পক্ষে ব্রাহ্ম-মুহূর্ত  ও  নিশীথ অর্থাৎ গভীর রাত অতি প্রশস্ত সময়।  এছাড়া সকাল, দুপুর, ও সন্ধ্যা এই পাঁচ সময় উপাসনার উপযুক্ত সময়।যাদের পক্ষে পাঁচবার উপাসনায় বসা সম্ভব নয়, তারা অন্তত  দুই বার, বিশেষ করে ভোরবেলা অর্থাৎ ব্রাহ্মমুহূর্ত ও সন্ধ্যাবেলা উপাসনায় বসা উচিত। মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন, যারা আত্মউন্নতির জন্য বিশেষভাবে লালায়িত, তারা প্রতিমুহূর্তে জগদ্বিশ্বরের মঙ্গলময় নাম উচ্চারণ স্মরণ করবে। 

আমি অনেককে বলতে শুনেছি, আমরা গৃহী মানুষ, আমাদের এতো সময় কোথায় ? আমার মনে হয় এটা একটা অজুহাত মাত্র। আমরা প্রতিদিন খাবার সময় পাই।  শোবার  সময় পাই। প্রকৃতির ডাকে সারা দেবার সময় পাই। এমনকি আড্ডা দেবার সময় পাই। কিন্তু উপাসনার সময় পাই না। শরীরের ক্ষিদে  মেটানোর জন্য, মনের ক্ষিদে মেটানোর জন্য, সময় পাই কিন্তু আত্মার ক্ষিদে মেটানোর সময় পাই না। অতয়েব সময়-অভাবের ওজর ত্যাগ করতে হবে আমাদের। 

উপাসনার জন্য, ব্রাহ্মহ্মমুহূর্ত বা ভোরবেলা সবথেকে ভালো। রাতের ঘুম আমাদের স্মৃতিকে বিলুপ্ত করে দেয়। বাহ্যিক পরিবেশ শান্ত থাকে।  আমাদের মন শান্ত থাকে।  তখন মনকে একাগ্র করা সহজ হয়। যখন আমরা ঘুম থেকে উঠি, তখন আমাদের চেতন মন ক্রিয়াশীল থাকে না। অবচেতন মন তখন সহজে সব কিছু ধরতে পারে। তাই সে সময় মনকে যা কিছু নির্দেশ করা হয়, তখন তা অবচেতন মনের গভীরে প্রবেশ করে। এই সময় ধ্যানের গভীরে সহজে প্রবেশ করা সম্ভব হয়। মনের গভীর স্তরে প্রবেশ করা সম্ভব হয়। এবং এই সময় জগদীশ্বরের নাম-গুনগান আমাদের এক উচ্চতর আনন্দ অনুভূতি প্রদান করে। এটা আসে মনের গভীরতম স্তর থেকে। এই আনন্দ-অনুভূতিকে ধরে রাখবার জন্য, আমাদের উপাসনার পরে, খানিক্ষন নীরব থেকে এই আনন্দানুভূতি উপভোগ করা উচিত।  এতে যেমন নিজের অন্তরে শান্তি বজায় থাকবে, তেমনি সংসারে শান্তি বৃদ্ধি পাবে। এবং আমার সারাদিনের আচরণে এই শান্ত ভাব অন্যকে প্রভাবিত করবে। নিরবিচ্ছিন্ন উপাসনার  অভ্যাস তোমার মনকে উচ্চস্তরে তুলে রাখতে সহায়তা করবে। 

গুরুদেব, মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন এই সময় দীক্ষাবীজ উচ্চারণ করবে।  যা আসলে পরম-ঈশ্বরের গুনবাচক শব্দ মাত্র। আমাদের আলোচ্য বিষয় যেহেতু, অদীক্ষিত ব্যক্তিদের জন্য। তাই আমি বলবো আপনি যেকোনো  ইষ্ট-দেবতার নামের সঙ্গে প্রণব (ওঁং)আদি-অন্তে  যোগ করে, অথবা গায়েত্রী মন্ত্র , মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র ইত্যাদি যে কোন মন্ত্র উচ্চারণ করতে পারেন। তবে মন্ত্রের সঠিক অর্থ ও উচ্চারণ জেনে নেবেন। মন্ত্রের অর্থ না জানলে সেই  শব্দ আপনার ভিতরে আলোড়ন তুলতে পারবে না। 

এই প্রসঙ্গে একটা সত্য ঘটনা বলি।  আমি তখন দুর্গাপুরে কাজ করি। আমাদের অফিসে একজন সহজ-সরল ইংরেজি না জানা কর্মচারী ছিল। তাকে কেউ একজন "thank  you" বলেছিলো।  ও আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো "থ্যাংক্যু" কাকে বলে ? আমি বললাম - thank you মানে ধন্যবাদ। ও আবার জিজ্ঞেস করলো সেটা কি ভালো না খারাপ। বললাম ভালো-খারাপ কিছু নয়। ও সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গেলো লোকটার কাছে। গিয়ে বললো : থ্যাংক্যু যদি ভালো হয় তো ভালো।  আর যদি খারাপ হয় তবে তোর  বাবা থ্যাংক্যু তোর মা থ্যাংক্যু তো চোদ্দগুষ্ঠী থ্যাংক্যু। বলে গর্বের  সঙ্গে আমার দিকে তাকালো। তো বুঝুন শব্দের মানে যদি আপনি না বোঝেন, অর্থাৎ মন্ত্রের মানে যদি আপনি না বোঝেন, তবে আপনার মধ্যে কোনো আলোড়ন হবে না। আর যদি বোঝেন আপনি সেইমতো আন্দোলিত হবেন।   

তবে আমি একটা কথা বলি, আপনি সব কিছু ছেড়ে, শুধু "ওঁং" এই শব্দটিকে আশ্রয় করুন। ইনিই সব মন্ত্রের মূল। এটি এমন একটি শব্দ - যা অদৃশ্য নিরাকার, নিরপক্ষের প্রতীক। আবার সাকারের ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার করা চলে। এটি একাধারে শব্দ আবার ধ্বনি। শব্দ অর্থাৎ যার অর্থ আছে। আর ধ্বনি অর্থাৎ মূর্ছনা আছে কিন্তু মানে নেই। আবার ধ্বনিরও উর্দ্ধে।  অর্থাৎ ধ্বনি সৃষ্টি হয় আঘাতে, অর্থাৎ দুটো জিনিসের আঘাতে ধ্বনির সৃষ্টি। ওঁং এমন জাদুকাঠি যা এমনি এমনি হয়। একটু ব্যাখা  করে বলি।  যখন আমরা কথা বলি, তখন আমরা শব্দব্রহ্মের   স্থুল রূপটি শুনতে পাই।  একে বলে বৈখরী। এই বৈখরী সাধারণত কন্ঠনালী ও জিহ্বা প্রভৃতির আলোড়নে সৃষ্টি হয়। এর পেছনে আছে শব্দ যা চিন্তাপ্রণালীর কাজ। একে বলে মধ্যমা ধ্বনি। চিন্তা আরো সূক্ষ্মতর আবেগের ফল। চিন্তাও শব্দ সমষ্টি মাত্র।  একে বলে পশ্যন্তি ধ্বনি।  এই পশ্যন্তি ধ্বনির  উৎপত্তি শব্দব্রহ্ম থেকে। এই স্তরের ধ্বনিকে বলে পরা। সুতরং বলা যেতে পারে শব্দের শুরু প্রথমে পরা, তারপর পশ্যন্তি, তারপরে মধ্যমা, তারপরে বৈখরী যা আমরা শুনে থাকি। 
চিন্তা এক গতিশীল কার্যপদ্ধতি। আর তার জন্ম  হলো এক অপ্রকাশিত উৎস থেকে। যা আমাদের দেহ-মনকে প্রভাবিত করে। সাধারণত  অশুভ চিন্তায় আমরা মনের গভীরে প্রবেশ করি না। শুভ চিন্তায় আমরা  গভীরে প্রবেশ করি। আর আধ্যাত্মিক চিন্তা আমাদের আরো বেশী গভীরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। মন্ত্র আমাদের উৎসে পৌঁছিবার পথ দেখিয়ে দেয়। মন্ত্র আমাদের উৎসের অনুভূতি অর্থাৎ আনন্দ উপলব্ধি করায়।  এটাই আধ্যাত্মিক অনুভূতি। ঠিক ঠিক জপ্ করতে পারলে আপাত-স্তব্ধ ধ্বনি, জীবন্ত হয়ে ওঠে, শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এটা ঠিক ভাষায় বোঝানো যায় না। যে ভাগ্যবান সাধক এই অকৃত্তিম-অনাবিল আনন্দ  উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তিনিই একমাত্র জানেন।

আমি বেশি কথায়  যাবো না। যদিও ওম, বা ওং  বা ওঁং এর কোনো মানে হয় না।  এটি নাদব্রহ্ম। আমাদের উৎসের সঙ্গে ওঁনার সন্মন্ধ। তাই এঁকে ব্যাখ্যা করা মানে ওঁনাকে সীমিত করা। তবু ঋষিরা যা বলেছেন তাই বলি।  সত্ত্ব রজঃ তম - অর্থাৎ সমস্ত গুনের প্রতীক উঁনি। সৃষ্টি-স্থিতি-লয় এর প্রতীক উঁনি। সমস্ত দুঃখ হরণকারী, সুখদায়ক এই "ওঁং"।

এবারে বলি, এই প্রণব কি ভাবে জপ্ করতে হবে।  আসলে জপ্ যখন জোরে উচ্চারিত হয় তখন তাকে বলে বাচিক জপ্। যখন মন্ত্র মনে মনে উচ্চারিত হয় কিন্তু ঠোঁট নড়ে, তখন বলে উপাংশু জপ্। আর যখন ঠোঁটও নড়বে না অথচ মনে মনে জপ্ করাকে বলে মানসিক জপ্। এই জপ্ প্রথম দিকে বাচিক, তারপরে উপাংশু, এবং সবথেকে শেষে মানসিক জপ্ করতে বলা হয়। আমি বলি - আপনি প্রথমে শব্দ বা মন্ত্র উচ্চারণ করুন, যতক্ষন পারেন করতে থাকুন , একসময় দেখবেন, আপনার আর উচ্চারণ করতে ইচ্ছা করছে না। তখন আপনি যদি লেগে থাকেন  তখন আপনার জপ্ উপাংশুতে পরিণত হবে। ধীরে ধীরে মানসিক জপে পরিণত হয়ে যাবে ।  আপনি শুধু জপে  লেগে থাকুন।সময়ের দিকে নয়। মনটা ভিতরে নিবিষ্ট করুন।  অল্প দিনেই আপনার নেশা ধরে যাবে। ভালো থাকার অদ্ভুত উপায়। ঘড়ি ধরে কখনো উপাসনা হয় না। যতক্ষন পারবেন, উপাসনায় থাকুন। যখন আপনার জিহ্বা আপনা আপনি থেমে যাবে, তখন মনে হবে মন্ত্র আপনার ভেতর থেকে বেরুচ্ছে। আর আপনি মন্ত্রের অক্ষর বা আকার দেখতে পাচ্ছেন। এর পরে আকার মুছে যাবে শুধু অহং আর চৈতন্য থাকবে।

রামকৃষ্ণ বলতেন জপ্ করো মনে, বোনে আর কোনে। একটা নির্জন জায়গায় বেছে  
নাও । সচেতন ভাবে জপ্ শুরু করো। আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা সূক্ষ্ম থেকে বৌদ্ধিক বা চিন্তার স্তরে  যাবো। তারপর আধ্যাত্বিক বা চেতন স্তরে  যাবো। এই সময় নিম্ন স্তরের স্পন্দন বা চিন্তা আমাদের পরিহার করতে হবে। অন্তরীক্ষে শব্দ, ছবি  ভেসে বেড়াচ্ছে। রেডিও/টিভি যেমন এগুলোকে ধরবার জন্য রিসেপ্টর হিসেবে কাজ করে আবার প্রজেক্টর হিসেবে কাজ করে,  তেমনি তুমি যখন অন্তরে লিন হবে তখন তোমার তিনটি সত্ত্বা সক্রিয় থাকবে। রিসেপ্টর(গ্রাহক), প্রজেক্টর (অভিক্ষেপক) এবং ভিউয়ার বা দর্শক। এই সময় তোমার মধ্যে পবিত্রতার তারতম্য অনুযায়ী মনের ইচ্ছে অনুযায়ী বা মনের শক্তি অনুযায়ী অর্থাৎ তোমার অবচেতন মন যা দেখতে চায় তাই দেখতে, শুনতে থাকবে। এই অবস্থা, যে কোনো সাধক উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু মন যত পবিত্র থাকবে তুমি ততো তাড়াতাড়ি এই স্তর পেরোতে পারবে। এইজন্য আধ্যাত্মিক জীবনে পবিত্রতা দরকার। সেই কারণেই, আধ্যাত্মিক জীবনে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে কিছু কঠোর নিয়ম পালন করতে বলেন গুরুদেবরা। আমার কথা শুনে বা এই লেখা পড়ে তোমার কোনো উপলব্ধি হবে  না।
সতর্কতা :
ধ্যান বা জপের সময় ঘুম বা তন্দ্রা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। ঘুম ঘুম ভাব এলে কিছুক্ষন পায়চারি করে নিলে ভালো হয়।  আর মন যখন চঞ্চল থাকে, তখন জোরে জোরে জপ্ করা উচিত। তাহলে মনের চঞ্চলতা দূর হয়ে যাবে। জপ্ শুরু করার আগে, বিশ্বাস একান্ত প্রয়োজন। কেননা জপের পরিণতি তুমি জানো  না। আর এ এমন একটা রাস্তা যা সময় দিয়ে বা দৈর্ঘ দিয়ে মাপা যায় না। তোমার গভীর বিশ্বাস না থাকলে, তুমি সন্দেহজনক মন নিয়ে এগুতে গেলে তুমি হয় পথভ্ৰষ্ট হবে বা গতি হারিয়ে ফেলবে। ফলতঃ অবিস্বাসী মন নিয়ে এ পথে একদম পা বাড়াবে না। তার চাইতে যেমন আছো তেমন থাকো।  অহেতুক সময় নষ্ট না করা ভালো। 

সমাপ্ত    তৃতীয় ভাগ ।    
        
          


  

 

No comments:

Post a Comment