গুরুবিনা কি সাধন হবে না ? (দ্বিতীয় ভাগ )
আগেরদিন আলোচনা করছিলাম - গুরুতত্ব সত্যধর্মের আলোতে। এবং বলছিলাম যে ,
আমার যদি ব্যাকুলতা না থাকে, আমার যদি চেষ্টা না থাকে, হাজার গুরু করলেও আমার কোনো
উন্নতি হবে না। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন : যদি তেত্রিশ কোটি দেবতায় বিশ্বাস থাকে অথচ তোমার আত্মবিশ্বাস না থাকে, তবে কখনোই তোমার মুক্তি হবে না।
আমি যদি আন্তরিক না হই স্বয়ং ভগবানও আমার ভালো করতে পারবে না। আর আমার যদি ব্যাকুলতা থাকে, আমার যদি আন্তরিকতা থাকে, আমার যদি প্রবল আগ্রহ থাকে, তবে ভালো গুরুও পাওয়া যাবে, ভগবানকেও পাওয়া যাবে। মাটিতে চিনি ফেলে রাখুন, কোত্থেকে পিঁপড়ে এসে যাবে, আপনি জানেন না। গাছে ফল পাঁকলে, কোত্থেকে কাঠবিড়াল এসে যাবে, পাখি এসে যাবে তা আপনি জানেন না। কিন্তু আসে। এটাই সত্য। আমরা যদি খাঁটি শিষ্য হতে পারি, তবে সত্যিকারের গুরু কোত্থেকে আসবেন, কবে আসবেন, তা আপনি-আমি জানি না। তবে আসবে এটা নিশ্চিত।
এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি। গল্প তো অনেক আছে। গুরু ছাড়াও যে বিদ্যালাভ হয় এমনকি ব্রহ্ম-বিদ্যা লাভ হয়, সে প্রসঙ্গে ছান্দোগ্য-উপনিষদ থেকে একটা কাহিনী বলি।
সত্যকামের নাম শুনেছেন নিশ্চই। মহান ঋষি। যিনি জাবাল সত্যকাম নামে পরিচিত। জাবাল হচ্ছে তাঁর মায়ের নাম। গোত্র পরিচয়হীন সত্যকাম। অর্থাৎ পিতৃ পরিচয় যার জ্ঞাত নেই। সেই গোত্র পরিচয় হীন সত্যকাম, তার সরলতার জন্য, মহাঋষি গৌতমের আশ্রমে জায়গায় পেয়েছিলেন । সত্যকাম গুরুকরনের আশায় যেদিন ঋষি গৌতমের সামনে উপস্থিত হলেন, প্রথম দর্শনেই সত্যকামকে ঋষি গৌতমের ভালো লেগে গেল। কিন্তু এই গোত্র পরিচয় হীন বালককে দীক্ষা দিলেন না। তাকে আগে উপনয়ন করালেন। অর্থাৎ পৈতে পড়ালেন। সোজা কথায় ব্রাহ্মণ সন্তান বানালেন। আর অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, কোনো এক অজ্ঞাত কারনে, এমনও হতে পারে, আশ্রমবাসী ব্রাহ্মণ সন্তানরা গুঞ্জন তোলায়, তাকে তিনি আশ্রমে রাখলেন না, কোনো উপদেশ দিলেন না। কেবল শ-চারেক দুর্বল ও কৃশ অর্থাৎ হাড্ডি মাস সার গরু দিয়ে বললেন, যাও এদের সেবা করো। সত্যকাম অভিমানের সুরে বললেন - ঠিক আছে, এরা যতদিননা সংখ্যায় হাজার হচ্ছে ততদিন আমি ফিরবো না। এই বলে গুরুগুলোকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
সত্যকাম গরুগুলোকে নিয়ে চললেন গভীর জঙ্গলে। যেখানে লোকালয়ের কোনো খবর না পৌঁছয়। যেখানে আশ্রমের কোনো খবর না পৌঁছয়। যেখানে শুধু প্রকৃতির অঢেল আশীর্বাদ। মানুষের কোলাহল বর্জিত নির্জনস্থান। শুধু নদীর শীতল জলের কলকল ধ্বনি। পাখির কুজন। কোমল কচি ঘাস। আর আছে গাছ ভরা ফল। শান্ত, নীরব, ধ্যানময় জীবনের জন্য অপূর্ব দেব-ভূমি। বালক সত্যকাম গরুগুলোর দেখা শুনা করেন, সকাল সন্ধ্যা ধ্যানে মগ্ন থাকেন। নির্জনে গরুদের সঙ্গে কথা বলেন। গাছের সঙ্গে কথা বলেন। নদির জলের সঙ্গে কথা বলেন। অদ্ভুত ভাবে প্রকৃতির একজন হয়ে গেলেন। এখন গরুরাও ওর কথা বোঝে, সত্যকামও গরুদের কথা বোঝে, গাছেরা ওর কথা বোঝে, গাছের কথা সত্যকাম বোঝে, নদীর ভাষায় সত্যকাম কথা বলে। সমস্ত কিছুর মধ্যে ও অর্থাৎ সত্যকাম চেতনার সাক্ষাৎ করে। মাঝে মাঝে আশ্রমের কথা মনে পড়ে। মায়ের মুখ খানি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। আবার সব ভুলে যায়। প্রকৃতির একজন হয়ে যায়।
এই ভাবে কত দিন, কত মাস, কত বছর কেটে গেছে, তা সে জানে না। একদিন শুনলো, একটা বৃষ বলছে এসো সত্যবান আমি তোমাকে ব্রহ্ম-কথা বলি। আমরা তো এখন হাজার হয়ে গেছি। এখন তো তোমার আশ্রমে ফিরে যাবার সময় হলো। তার আগে ব্রহ্ম কথা শোনো। যে কথা শোনার জন্য, যাঁকে জানার জন্য তুমি প্রানপ্রিয় মাকে ছেড়ে আশ্রমে এসেছিলে সেই ব্রহ্ম-কথা বলি শোনো। এই বলে বৃষরুপী বায়ুদেবতা, অগ্নিদেবতা, হংসরূপী সূর্যদেব, এবং মদগু নাম্নী এক জলচর পাখী যা বলেছিলো তা হলো :
ব্রহ্মের চারি পাদ : প্রতি পাদের চারটি কলা :
প্রথম পাদের : পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ এই চারটি কলা।
দ্বিতীয় পাদ : জীবজন্তু, তরুলতা পূর্ন সুন্দর পৃথিবী এক কলা ; অন্তরিক্ষ আর একটি কলা ; দীপ্ত দ্যুলোক একটি কলা ; বিশাল সমুদ্র আর একটি কলা।
তৃতীয় পাদ : অগ্নি, চন্দ্র, সূর্য ও বিদ্যুৎ - এক একটি কলা।
চতুর্থ পাদ : প্রাণ শক্তি, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণ শক্তি, এবং মন - এক একটি কলা।
সত্যকাম সহস্রাধিক হৃষ্টপুষ্ট ধেনু সকল নিয়ে এবার গুরু গৌতমের আশ্রমে এলেন। গুরুকরণের মোহ তার কেটে গাছে। মনে তার অনাবিল আনন্দ, অহেতুক আনন্দ।নির্মল আনন্দ। শরীরে তার জ্যোতি বেরোচ্ছে। সারা মুখে এক জ্যোতি। সত্যকাম এসে গুরুকে প্রণাম করলেন। গুরুত্ব সত্যকামকে দেখে অবাক। সারা মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তির জ্যোতিঃ, এক দীপ্তি, অথচ বিনম্র।
এর পরের ব্যাপারটা শুনুন : গুরুদেব গৌতম ভাবলেন, কাম সারছে। এই ব্যাটা তো গুরুগিরি ঘুচিয়ে দেবে। বললেন : হে সৌম্য ! তোমাকে ব্রহ্মজ্ঞানীর ন্যায় দীপ্ত দেখাচ্ছে। তুমি কি কারুর কাছ থেকে ব্রহ্ম-জ্ঞান লাভ করেছো ? সত্যি করে বলো।
সত্যকাম বিনম্র ভাবে বললো : হ্যাঁ ভগবান, আমি ব্রহ্ম-জ্ঞান লাভ করেছি। কিন্তু কোনো মানুষের কাছ থেকে নয়, প্রকৃতি-দেবতাদের কাছ থেকে আমি এই গুহ্য বিদ্যা লাভ করেছি।
গুরুদেবের চিন্তা হয়ে গেলো। বললেন : শোনো গুরু ছাড়া কোনো মানুষ বা দেবতার কাছ থেকে এই শিক্ষা লাভ করা যায় না। আমি তোমাকে সমুদয় ব্রহ্ম তত্ত্ব উপদেশ করছি। তুমি স্থির চিত্তে এই ব্রহ্মবিদ্যা গ্রহণ করো। এই বলে আবার একবার গুরুদেব, একই কথা অর্থাৎ যে কথা প্রকৃতির কাছ থেকে শুনেছিলেন, সেই কথাই বলে গেলেন।
তো যেটা বলছিলাম। নিজের মধ্যে আকুতি জাগলে, নিজেকে তৈরী করতে পারলে, নিজেকে উপযুক্ত করে তুলতে পারলে গুরু এসে যাবে। শুধু নিজেকে জাগান, আর অপেক্ষা করুন । নিজের ভিতরেই গুরু জাগ্রত হয়ে যাবেন।
মহাত্মা গুরুনাথের দেহধারী গুরু কে ছিলেন ? শুনেছি দেবাদিদেব মহাদেব তার গুরু ছিলেন। তাহলে তো এটা মনে হয়, দেহধারী ব্যক্তি ছাড়াও গুরুকরন হয়। আসলে আপনি কাকে গুরু ভাবছেন সেটাই বড় কথা। আপনি নিজেকে কতটা যোগ্য করে তুলতে পারছেন সেটাই বড় কথা। আপনার গুরু কে ছিলেন, তিনি কত গুণী ছিলেন, তার কত নামডাক ছিল, তার কত শিষ্য আছে বা ছিল, সেটা বড় কথা নয়। আপনি গুরু হতে পেরেছেন কি না সেটাই বড় কথা। প্রকৃত গুরুর কাজ শিষ্য করা নয়। প্রকৃত গুরুর কাজ গুরু তৈরি করা। শিষ্য তৈরি করা নয়। চেলা তৈরী করা নয়। প্রজ্বলিত প্রদীপ থেকে প্রদীপ জ্বলতে পারে। প্রকৃত গুরু থেকে গুরুই হতে পারে। যারা নিজেরা চেলা, তারা চেলাই তৈরী করে। সত্যিকারের গুরু কখনো চেলা তৈরী করে না। সত্যিকারের গুরু সর্বদা গুরু তৈরী করে।
No comments:
Post a Comment