Monday 4 April 2022

যোগবীজ ,আত্মদর্শন ও তত্ত্বকথা ক্ষুধা-তৃষ্ণাহীন


 যোগবীজ 
শ্রীমৎ স্বামী বিজ্ঞানানন্দ সরস্বতী সম্পাদিত। 

জ্ঞানী না যোগী কে শ্রেষ্ঠ ? 

শ্রীদেবী উবাচঃ  

নমস্তে পরিপূর্ণায় জগদানন্দ হেতবে 
সদাশিব জগন্নাথ করুনামৃত বারিধে। (শ্লোক - ১)
সর্ব্বজীবাঃ সুখৈ-দুঃখৈ-মায়াজালেন-বেষ্টিতাঃ
তেষাং মুক্তিঃ কথং দেব কৃপায়বদ শঙ্করঃ।  (শ্লোক-২)
  
শ্রীদেবী বললেন, হে সদাশিব জগন্নাথ, পরিপূর্ন জগতের আনন্দ হেতু ! করুণাসাগর ! আপনাকে নমস্কার। জীবসকল মায়াজালে বেষ্টিত, সুখ-দুঃখে কাতর।  তাদের মুক্তি কিভাবে হবে ? হে দেবাদিদেব শঙ্কর কৃপাকরে জীবের মুক্তির উপায় সম্পর্কে বলুন। 

সমস্ত মুমুক্ষু জীবের অন্তরের আকুতি, হচ্ছে মুক্তি লাভ। কিন্তু অজ্ঞান জীবকুল, সেই মুক্তির পথের  সন্ধান  জানে না। 

শ্রীদেবী বলছেন : 
হে মহাদেব, মায়াজাল ছিন্নকারী, সর্ব্ব-সিদ্ধি-প্রদানকারী, জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধি নাশকারী সুখদানকারী পথের  সন্ধান দিন। হে মহেশ্বর, আপনি নানাবিধ পথের  কথা বলেছেন, এখন হে যোগীবর, আমাকে মোক্ষমার্গের কথা বলুন। 

ঈশ্বর উবাচঃ 
ঈশ্বর বলছেন, হে সুরেশ্বরী, বদ্ধজীবকুল  যেপথে বিমুক্ত হতে পারে, তোমার প্রীতার্থে এখন সেই পরম নাথমার্গের কথা বলছি। জীবনে জরা-ব্যাধি-মৃত্যু থেকে রেহাই পাবার জন্য, পথ অনেক আছে, কিন্তু কৈবল্যলাভের পথ একটাই,সেটি হচ্ছে সিদ্ধিমার্গ। মানুষ নানান শাস্ত্র পাঠ করে, শাস্ত্রজালের মধ্যে পড়ে, শাস্ত্রজালের কুযুক্তিতে  আবৃত হয়ে বিমোহিত হয়ে আছে। সত্যের সন্ধান মেলেনি।  নিখিল শাস্ত্র-দর্শন, ব্যাকরণ  ইত্যাদি বারবার বিচারপূর্বক স্থির হয়েছে, যে একমাত্র যোগশাস্ত্রই  সমস্ত শাস্ত্র অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আর কেবলমাত্র  শাস্ত্রপাঠে সেই অনির্বচনীয় ব্রহ্মকে লাভ করা সম্ভব নয়। সেই ব্রহ্ম যিনি নিস্কল, নির্মল, শান্ত, সর্বাতীত, নিরাময়, সেই ব্রহ্ম  স্বয়ং জীবরূপে পানপুণ্য ফলভাগী হয়েছেন। 
শ্রীদেবী বললেন : 
নিত্য, তত্ত্বাতীত সেই  পরব্রহ্ম কেন জীব প্রাপ্ত হলেন ? হে মহাদেব, সেকথা আমাকে কৃপা করে বলুন। 
ঈশ্বর বললেন : 
সর্ব ভাবের অতীত, সর্ব পদের অতীত, সেই জ্ঞানরূপ নিরঞ্জন জলতরঙ্গের ন্যায় স্ফূর্ত হলেন। আর এই তরঙ্গে উত্থিত   হলো অহংকার। আর এই অহঙ্কার  মধ্যে ধাতুবদ্ধ গুণাত্মক  সুখ-দুঃখ-অনিত্য যুক্ত জীব-ভাবনা-আকুলিত পঞ্চাত্মক  পিন্ড উৎপন্ন হলো। সেই পিণ্ডমধ্যে বিশুদ্ধ পরমাত্মায় প্রকটিত হলো জীব-ভাব। আছন্ন হলো কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-ভয়-মাৎসর্য নামক রিপু দ্বারা। জেগে উঠলো জরা, মৃত্যু, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, লোভ, শোক, সুখ, দুঃখ, হর্ষ, বিষাদ। এই রিপুর বিতারণ হলেই, জীব পুনরায় শিবরূপ প্রাপ্ত হয়। তো জীবের মধ্যে এই দোষ  কিভাবে বিনষ্ট হয়, তার উপায় সম্পর্কে বলবো। হে সুরেশ্বরী, কেবল জ্ঞানে সিদ্ধিলাভ হয় না। যোগহীন জ্ঞান, কখনো মোক্ষ দিতে পারে না। আবার জ্ঞানহীন যোগ মোক্ষদানে অক্ষম। 
শ্রীদেবী বললেন : 
আমরা শুনেছি, অজ্ঞানে আচ্ছন্ন জীবকুল। জ্ঞান হলেই সে স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। তো জ্ঞানের মুক্তি, এখানে যোগের কি করণীয় আছে ? 
ঈশ্বর বললেন : হে সুরেশ্বরী, তুমি ঠিকই বলেছো। কিন্তু জ্ঞানের স্বরূপ, জ্ঞান ও জ্ঞেয়  আলাদা নয়  . তাই জ্ঞানসাধন সম্পর্কে আগে শোনো। জ্ঞেয় বস্তু সম্পর্কে জানাই জ্ঞান। এখন জীব তার নিজের দোষ সম্পর্কে জ্ঞাত হলেই, কি সে সেই দোষমুক্ত হয়।  শিব যখন দোষযুক্ত হয়, তখন সে জীব, আবার জীব যখন দোষমুক্ত হয়, তখন সে শিব। শিবে কখনো দোষ থাকে না। 

শ্রীদেবী : পূর্ন ব্যাপক সত্ত্বার যখন আত্মজ্ঞান হয়েছে, তখন তাতে আর কাম-ক্রোধ ইত্যাদি দোষ থাকে কি করে ? 

ঈশ্বর বললেন : যিনি পূর্ন,তার  পূর্ণত্বসকলও  নিস্কল। আর এই নিস্কল-নির্মল ব্রহ্ম কলনা-স্ফূরিত রূপ হেতু সংসার ভ্র্রমে পতিত। সৃষ্টি স্থিতি লয় এই স্ফূর্তিজ্ঞান বর্জিত ব্রহ্ম।  তিনি এই মোহসাগরে ভাসেন না। হে বরারোহে, অবিদ্যাজনিত কারনে সুখ-দুঃখের মোহে নিমজ্জিত জীব, সংসারে মুগ্ধ। যথার্থ জ্ঞানী যথা স্থানেই থাকেন। তিনি বাসনা-বাসিত হয়েই থাকেন। সংসারী ও জ্ঞানীর মধ্যে ভেদ হচ্ছে, জ্ঞানী বিষয়ে বিরক্ত, তিনি ধর্মজ্ঞ, যিনি জিতেন্দ্রিয়। আর সংসারী বিষয়ে আসক্ত।  

শ্রীদেবী : হে শঙ্কর জ্ঞানী ব্যক্তির তো আর কিছুই জ্ঞাত হবার নেই। তাহলে বিষয়-বিরক্ত, সেই আত্মনিষ্ঠ জ্ঞানীর কেন মোক্ষলাভ হবে না ? 

ঈশ্বর বললেন : সংসারে দুই প্রকারের দেহ আছে, এক পক্ক দেহ, দুই অপক্ক দেহ। যোগীর পরিপক্ক দেহ, আর যোগহীনের অপক্ক দেহ। যোগাগ্নি দ্বারা যোগী শোকবর্জিত, অজর। যোগহীনের অপক্ক দেহ, দুঃখপ্রদ। যোগহীন জ্ঞানীসাধক ধ্যানস্থ হলেও, তার অপক্ক দেহ হেতু, তিনি ইন্দ্রিয়ের বশীভূত হন। অর্থাৎ অন্যের দ্বারা বাধ্য হন। এঁদের শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, সুখ-দুঃখ, শারীরিক ব্যাধি, মানসিক অশান্তি, এমনকি জীব-জন্তু থেকে, বা শস্ত্র দ্বারা শরীর পীড়িত হবার সম্ভাবনা থাকে। আর শরীর  পীড়িত হলে, চিত্ত বিক্ষুব্ধ হয়। আসলে প্রাণবায়ুর বিক্ষেপ হেতু, মানব চিত্তে ক্ষোভ জাগে। দুঃখ-প্রাপ্ত মানব চিত্ত ক্ষুব্ধ হয়। আবার এই চিত্ত বিক্ষেপ হেতু, দেহান্তর কালে, জীবচিত্তে যেসব ভাবনার উদ্রেগ হয়, পরবর্তী জন্মে জীবাত্মা সেই মতো দেহ প্রাপ্ত হয়। মানুষ পরজন্মে কোন দেহ ধারণ করবে, তা সে জানে না। তো তার জ্ঞান এমনকি বৈরাগ্য কোনো কাজেই লাগে না। এদের দেহে সামান্য পিঁপড়ে কামড়ালেই, এদের ধ্যান ভঙ্গ  হয়। তো এঁরা সংসাররূপ বৃশ্চিক দংশনে এর ইহজন্মে বা পরজন্মে কিভাবে সুখী হবে ? এঁরা অহংকারকে আশ্রয় করে ধ্যানাদিতে  লিপ্ত হয়। মিথ্যে জ্ঞানের গর্ভ করে, মিথ্যে তর্কে লিপ্ত হয়। অহংকার নষ্ট না হলে, প্রকৃত জ্ঞানের উদয়  হয় না। পক্কদেহীর অহঙ্কার বলে কিছু থাকে না। দেহব্যাধি বলে কিছু থাকে না। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষার, এমকি অস্ত্রের আঘাতও তাকে বিড়ম্বিত করতে পারে না। পাখীর পাখা গজালে, অহঙ্কার জাগে, আবার পাখার বিলুপ্তি হলে, দুঃখের মধ্যে সুখের সূচনা হয়। কারন-বিনা কার্য্য হয় না। তেমনি অহঙ্কার না থাকলে, সুখ-দুঃখ হয় না। 

শ্রীদেবী : হে শঙ্কর,  যোগীর লক্ষণ কি ? তিনি কেমন ব্যবহার করেন, বা করেন না। তাঁর কিভাবেই  মৃত্যু হয় ?   

ঈশ্বর বললেন : যোগী শিবময়, যোগী জিতেন্দ্রিয়।  ফলে তার সুখ-দুঃখ বলে কিছু  নেই। যোগী যোগের সাহায্যে সমস্ত ইন্দ্রিয়গণকে এমনকি মন-বুদ্ধি,কাম-ক্রোধাদি সমস্ত রিপুকে জয় করেছেন। তিনি কারুর দ্বারাই বধ্য হয়। যোগী পঞ্চমহাভূত-তত্ত্ব যোগাগ্নিতে আহুতি দিয়েছেন। সপ্তধাতুময় এই দেহ ক্রমে যোগাগ্নিতে দগ্ধ হয়েছে। এই যোগদেহ মহাবল সম্পন্ন, ছেদ বন্ধনহীন। নানা শক্তিধর বিশিষ্ট এই দেহ দেবতার কাছেও দুর্লভ। এই দেহ তখন আকাশের মতো নির্ম্মল। সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্তর, আবার স্থুল  থেকে স্থুলতর, জড় হতেও জড়, অজর-অমর । যোগীন্দ্র তখন ত্রিলোকে ক্রিয়া করে থাকেন। তিনি অচিন্ত শক্তিমান, নানারূপে বিচরণ করেন। তাঁর  স্বেচ্ছা মৃত্যু। তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী।  হঠযোগে যোগীর পূর্বেই মৃত্যু হয়েছে। তাই মৃতের আবার মৃত্যু হবার প্রশ্ন আসে না। 
যেখানে সকলে মরা যান, সেখানে যোগী জীবিত থাকেন। আবার তিনি যেখানে জীবিত, সেখানে অজ্ঞানীর মৃত্যু হয়। তার কর্তব্য বলে কিছু নেই।  আবার কর্ম্ম করেও তিনি ফলভাগী  হন না। তিনি জীবম্মুক্ত, স্বচ্ছ, সর্বদোষ বর্জিত। বিরক্ত জ্ঞানী  দেহের অধীন।তাই যোগীর দেহতুল্য মাংস পিণ্ডাদির দেহের সঙ্গে  জ্ঞানীর  রক্ত-মাংসের দেহের তুলনা করা যায় না। 

শ্রীদেবী বললেন : 

জ্ঞানীদের মৃত্যু হলে তাঁদের কি গতি হয় ? 

ঈশ্বর বলছেন : 
জ্ঞানীগণ পানপুন্য  কর্ম্ম অনুযায়ী দেহান্তে স্ব-স্ব কৃত কর্ম্মের ফল ভোগ করবার জন্য, পুনরায় পূর্ব্বসিদ্ধিসহ জ্ঞানী হয়ে জন্মায়। তখন সিদ্ধযোগীর কৃপায়, তার সংসার নষ্ট হয়। 

শ্রীদেবী : জ্ঞানীগণ বলে থাকেন, জ্ঞানেই মোক্ষলাভ হয়ে থাকে। কিন্তু জ্ঞানীকে যদি আবার দেহ ধারন করতে হয়, তাহলে জ্ঞান দ্বারা মুক্ত হওয়া যায়  একথা সিদ্ধ নয় ? যোগ কি মোক্ষদানে সমর্থ ? 

ঈশ্বর : লোকে বলে, জ্ঞানে মোক্ষ হয়, লোকে বলে খঙ্গে যুদ্ধ হয়। খঙ্গ অর্থাৎ ক্রোধ। যুদ্ধে জয়প্রাপ্ত হতে   গেলে, প্রথমে  যুদ্ধটা হওয়া চাই, যুদ্ধে বীর্যের প্রয়োগ করতে হবে, তবেই যুদ্ধজয় হতে পারে।  বিনা যুদ্ধে যুদ্ধজয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই। তেমনি ক্রিয়াহীন জ্ঞান দ্বারা মোক্ষ লাভ হতে পারে না। যোগ বিনা জ্ঞান মোক্ষ হতে পারে না, আবার জ্ঞানবিনা যোগ মোক্ষ দিতে পারেনা। বহু জন্মের জ্ঞান দ্বারা যোগের লাভ হতে পারে। কিন্তু এক জন্মেই যোগদ্বারা জ্ঞান লাভ হতে পারে। তাই মোক্ষমার্গের জন্য যোগ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আর কিছু নেই। 
শ্রীদেবী : বহু জন্মের পর  জ্ঞান দ্বারা যোগ লাভ হয় কেন ? আবার একজন্মে যোগদ্বারা জ্ঞান হয় কেন ? 

ঈশ্বর : জ্ঞানীব্যক্তি "আমি চিরমুক্ত" এইভাবে মনন করতে করতে  মুক্ত হতে চান। কিন্তু এতেকরে কি মুক্তি হয় ? 
বহুজন্মের পর যোগ দ্বারাই মুক্ত হয়। আর যোগীর বারবার জন্ম বা মৃত্য হয় না। আমরা এর পরের দিন শুনবো, কি সেই যোগক্রিয়া, বা কি সেই কৌশল যার দ্বারা এই  মায়াজাল ছিন্নকারী, সর্ব্ব-সিদ্ধি-প্রদানকারী, জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধি নাশকারী সুখদানকারী পথের  সন্ধান মেলে। 
----------------------------

মহাদেবের শ্রীমুখে যোগের কথা 

দেখুন যোগ সম্পর্কে আমরা অনেক কথা শুনে থাকি। যোগের উপরে হাজার হাজার বই বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। এর মধ্যে বোধহয়, সবচেয়ে ক্ষুদ্র আকারে একটা বই বাজারে আছে, যার নাম "যোগবীজ"। এই বইয়ের  লেখক কে তা আমরা জানি না। মূল বইটি সংস্কৃতে লেখা।  মাত্র ১৭২টি শ্লোকে যোগের মূল কথাগুলো লেখা আছে এখানে। আমরা শ্রীমৎ স্বামী বিজ্ঞানানন্দ সরস্বতী সম্পাদিত এই "যোগবীজ"  বই থেকে  আজ কয়েকটা যোগের প্রক্রিয়ার কথা শুনবো। আসলে যে-কয়টি যোগপ্রক্রিয়ার কথা এখানে বলা হয়েছে, তার অনুশীলনীতে সাধককে সাধনক্রিয়ার সর্ব্বোচ ফল প্রদান করতে পারে।   আমরা বহুরকম যোগের কথা শুনে, বিভ্রান্ত। কোনটা রেখে কোনটা করলে, আমাদের উপকার হবে , তা আমরা জানি না। তাই এখান থেকে আমরা যোগের নির্ভরযোগ্য  নির্যাস পেতে পারি।  যা আমাদের সাধন জগতে সহায়ক হতে পারে। এমনকি এই প্রক্রিয়া কতদিন করতে হবে, তার একটা নির্দেশিকা এখানে আছে। 

প্রাণ ও অপানের সাময়িক যোগে চন্দ্র-সূর্য্যের (ইড়া-পিঙ্গলার) ঐক্য হয়। আর সপ্তধাতুময় এই দেহ যোগাগ্নিতে জীর্ন হয়। সপ্তধাতু বলতে বোঝায়, রস, রক্ত, মাংস, মেদ, অস্থি, মজ্জা, শুক্র। এছাড়া আরো একটা ধাতু আছে, যাকে  বলা হয় ওজস, একে মহাধাতুও বলা হয়। 

ঈশ্বর বলছেন : যোগকিরয়ার ফলে, যোগীর দেহ থেকে সর্বরোগ দূর হয়ে যায় এমনকি ছেদ-ঘাতাদিও  হয় না। অর্থাৎ অস্ত্রের আঘাতেও তার শরীর ছিন্ন হয় না। তিনি পরম-আকাশরূপ দিব্যদেহ ধারণ করে স্থিত  হন। যোগীর মৃত্যু নেই, দগ্ধ কর্পূরের মতো দেহের ন্যায় দৃশ্যমান হন। সমস্ত জীবের চিত্ত প্রাণের দ্বারা সংবদ্ধ হয়ে স্থিত। দড়িতে বাঁধা পাখির ন্যায় মন তার চঞ্চল। যোগে সিদ্ধ না হলে, তর্ক  করে, শাস্ত্রজ্ঞান লাভ করে, এমনকি যুক্তি দ্বারাও প্রাণকে বশ করা যায় না। যোগমার্গই একমাত্র পথ - যা প্রাণকে ধরতে পারে।  যোগের জ্ঞান অখণ্ডিত।  খণ্ডজ্ঞানে মানুষের ক্লেশ বর্দ্ধিত হয়। যিনি মোহের বশে বায়ুকে অগ্রাহ্য করে যোগসিদ্ধি লাভ করতে চান, তিনি কাঁচা কলসি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দেবার কথা ভাবছেন। সাধক দেহে থাকাকালে প্রাণ মনের বিলোপ সাধন হলে তার দেহনাশ হয় না, কিন্তু চিত্তবিক্ষেপ দূর হয়। স্থির চিত্তে, তাঁর আত্মজ্ঞান প্রকাশ হয়। হে পার্বতী একজন্মেই যোগে জ্ঞান হয়। (শ্লোক-৭৫ শেষ হলো) 
এইকারনে সমস্ত সাধকের প্রতিদিন যোগাভ্যাস করা কর্তব্য। এবং মুমুক্ষুর প্রাণ জয়  করা কর্তব্য। যোগক্রিয়া অপেক্ষা পুন্য, যোগ  অপেক্ষা শুভ, সূক্ষ্ম, শ্রেষ্ট আর কিছু নেই। 
   
শ্রীদেবী : হে দেব, যোগ কাকে বলে ? যোগের অভ্যাস কিভাবে করতে হয় ? যোগের দ্বারা কি হয় ? 

ঈশ্বর : প্রাণ ও  অপানের যোগ, রজঃ ও বীর্যের যোগ, সূর্য ও চন্দ্রর যোগ, জীবাত্মা ও পরমাত্মার যোগ - এই সংযোগই   যোগ নামে উক্ত। দেবাদিদেব শিব বলছেন,  এখন যোগ-অভ্যাস কি করে করতে হবে, সে সম্পর্কে বলছি।
যিনি  বায়ুসিদ্ধি লাভ করেছেন, এমন গুরুর সেবা করবে। বিবেকবান সাধক, গুরুর কৃপালব্ধ উপদেশে প্রাণ জয় করবে। দেবাদিদেব শিব এখানে কয়েকটি প্রক্রিয়ার কথা নির্দিষ্ট করে বলেছেন। আমরা স্বয়ং শিবমুখে সেই যোগের প্রক্রিয়ার কথা শুনে নেবো।  
শক্তি চালনী মুদ্রা : 
আধারকমলে সুপ্তাং চালিয়েত কুন্ডলীং দৃঢ়াম 
অপান-বায়ুমারুহ্য় বলাদাকৃষ্য বুদ্ধিমান। 
শক্তিচালন-মুদ্রেয়ং সর্ব্বশক্তি প্রদায়িনী (শিবসংহিতা-১০৫)
 
আধারকমলে অর্থাৎ মূলাধার পদ্মে  কুন্ডলিনীশক্তি সুপ্ত আছেন।  বুদ্ধিমান সাধক অপানবায়ুর সহায়তায় বলপূর্বক কুণ্ডলিনী শক্তিকে আকর্ষণ করে উর্দ্ধে অর্থাৎ সুষুম্নাপথে  পরিচালনা করবে। 
অষ্টধা কুটিলাভূতা কুন্ডলীকে সহজে সোজা করবার জন্য, শক্তিচালনী মুদ্রা অনুযায়ী গভীরভাবে বায়ুকে নিরুদ্ধ করবে।  সূর্যকে আকুঞ্চন করবে, এবং কুন্ডলিনীকে চালনা করবে। এর ফলে যোগী মৃত্যুমুখে প্রবেশ করবে। আর মৃত্যুমুখে প্রবেশ করায় , যোগীর মৃত্যুভয় দূর হয়ে যাবে।  ঈশ্বর বলছেন, এই পরম গুহ্যকথা আমি তোমাকে বললাম।  বজ্রাসনে বসে এই মুদ্রার অভ্যাস সাময়িকভাবে একমাস-পনেরদিন নিত্য  করবে।

এখানে একটা প্রক্রিয়ার কথা আমরা শুনলাম, তা হচ্ছে শক্তিচালনী মুদ্রা। মহাদেব বলছেন, এই মুদ্রা বজ্রাসনে বসে করতে হয়। কোনো-কোনো যোগীপুরুষ (স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী) বলছেন, এই মুদ্রা পদ্মাসন বা গোমুখাসনে উপবেশন করেও করা যেতে পারে। তো পদ্মাসনে, বজ্রাসনে, বা গোমুখাসনে বসতে হবে। কিন্তু বজ্রাসনে এই মুদ্রার অভ্যাস করলে, এটি অল্প সময়ে অধিক ফলপ্রদ হয়।  তাই আমরা বজ্রাসনে বসেই এই মুদ্রার  অভ্যাস করবো।   এবার শ্বাসের সাথে শাখা-প্রশাখা সহ কুহু ও শঙ্খিনী নাড়ীকে উর্ধে আকর্ষণ করতে হবে। তো এই আকর্ষণের ফলে আমাদের তলপেট, নাভিমণ্ডল, এবং উদর সংকুচিত করে মেরুদণ্ডের নিকটবর্তী করতে হবে। এই অবস্থায় ৫/১০ সেকেন্ড পর্যন্ত অবরুদ্ধ রেখে, শ্বাস ত্যাগ করতে হবে। ধীরে ধীরে পেট, নাভি, তলপেট শিথিল করে দিতে হবে। দশ থেকে কুড়িবার, এবং দিনে দুই বার এই ক্রিয়ার অভ্যাস করতে হবে। 

হঠযোগ প্রদীপিকায় বলা হচ্ছে, সর্পাকৃতি কুণ্ডলিনী নিদ্রিতা আছেন। এই শক্তি কুণ্ডলিনী শক্তি মূলাধারে  কুন্ডলি পাঁকিয়ে তার পুচ্ছকে বা লেজকে  সুষুম্নার দ্বারের বাইরে স্থাপন করে ব্রহ্মদ্বারে প্রবেশের পথ রুদ্ধ করে নিদ্রিত আছেন। যোগীরাজ বলছেন, তার পুচ্ছ ধরে টান মারতে হবে। তাহলে সাপ  যেমন লেজে টান  পড়লে, সামনের দিকে দৌড়তে চায়, তেমনি সর্পাকৃতি কুণ্ডলিনী শক্তির লেজে টান  দিলে, তিনি নিদ্রা ত্যাগ করে, উর্ধপথে অর্থাৎ সুষুম্নার পথ ধরে, উর্দ্ধগামী হবেন। আর এই যে লেজ ধরে টান মারার কথা বলা হচ্ছে, তা পূরক কার্য্যের দ্বারা করতে হয়। সূর্য নাড়ী বা পিঙ্গলা সহজে বলতে গেলে বলতে হয়, ডান নাক দিয়ে বায়ুকে ভিতরে টানতে হবে। এইবার এই পূরক বায়ুকে ধারণ করে,  কুণ্ডলিনীরূপ সর্পের পুচ্ছকে টেনে তাঁকে উর্দ্ধমুখী করে তুলতে হবে। অর্থাৎ বায়ু যেন একটা কাপড়, জড়িয়ে প্রথমে এই শক্তিকে আচ্ছাদিত করতে হবে, তার পরে বায়ুকে গুটিয়ে আনতে হবে। যেমন কোনো পিচ্ছল বস্তুকে ধরবার জন্য, আমরা  বস্তুটিকে কাপড়ের আচ্ছাদন দিয়ে ঢেকে তার পরে ধরি ,  তবে এই মূলাধারস্থিত শক্তি জেগে উঠে সুষুম্নার মুখ ধরে ব্রহ্মরন্ধ্রে প্রবেশ করবে।  প্রতিদিন সকল-সন্ধ্যা আধাঘন্টা যাবৎ এই ক্রিয়া করতে হবে। 

মূলাধারের উপরে, বারো আঙ্গুল পরিমিত স্থান দৈর্ঘ-প্রস্থে চার আঙ্গুল পরিমিত স্থানটি খুবই কোমল শুভ্রবর্ণের। একে যোগীপুরষগন বলেন কন্দ।  বজ্রাসনে অভ্যাসকালে গোড়ালির কাছে দুই হাতের দ্বারা দুই পা শক্তকরে ধরে পা দিয়ে এই কন্দ  স্থানটিকে চেপে ধরবেন।  
 
বায়ু দ্বারা প্রজ্বলিত বহ্নি কুন্ডলিনীকে অহর্নিশ দগ্ধ করে। সেই সন্তপ্তা অগ্নিদগ্ধা ত্রৈলোক্য মোহিনী জীবশক্তি চন্দ্রদণ্ডে সুষুম্না বদন অভ্যন্তরে প্রবেশ  করে। বায়ু ও অগ্নির সাথে সেই শক্তি প্রথমে ব্রহ্মগ্রন্থি ভেদ করে।  তারপর বিষ্ণুগ্রন্থি ভেদ করে রুদ্র গ্রন্থিতে স্থিত হন।  এইসময় কুম্ভক গাঢ়  হলে, বারবার পূরক করে, সূর্যভেদ, উজ্জায়ী  ও শীতলী অভ্যাস করবে। এবং ভস্ত্রিকা ও সহিত নামক কুম্ভক চতুষ্টয় অভ্যাস করবে। ( বন্ধত্ৰয় - মুলবন্ধ - উড্ডীয়ান বন্ধ -জালন্ধর বন্ধ। সহিত নামক কুম্ভক চতুষ্টয় বলতে বোঝায়, সূর্যভেদ, উজ্জায়ী, শীতলী ও ভস্ত্রিকা অর্থাৎ এই চারটি মুদ্রায় যে কুম্ভক)  বন্ধত্রয় কেবলমাত্র কুম্ভক-সিদ্ধির কারনে অভ্যাস করবে। যোগের অভ্যাসের জন্য  প্রথমে দরকার আহারে সংযম। লঘু আহারী হয়ে পরমার্থ বিষয়ে চিন্তা করবে। 
একাকী উন্মুক্ত অথচ নির্জন স্থানে আসনে বসে, সূর্যনাড়ী (পিঙ্গলা) দ্বারা বায়ুকে আকর্ষণ করবে, সাধ্য অনুযায়ী বিধিবৎ কুম্ভক করবে। এবার চন্দ্র নাড়ী (ইড়া) দ্বারা রেচন করবে।  চন্দ্রনাড়ী অর্থাৎ ইড়ানাড়ী বা  বাম নাসাপুট  ও সূর্যনাড়ী অর্থে পিঙ্গলা বা  দক্ষিণ নাসাপুট।  পরম গুহ্যকথা আমি তোমাকে বললাম।  বজ্রাসনে বসে, এর  অভ্যাস করবে। একমাস পনের দিন নিত্য করবে। (৮৬)

বায়ুদ্বারা প্রজ্বলিত বহ্নি কুন্ডলীকে অহর্নিশ দগ্ধ করে। সেই সন্তপ্তা অগ্নিদগ্ধা জীবশক্তি তখন চন্দ্র নাড়ীকে অবলম্বন করে, সুষুম্নার বদনান্তরে প্রবেশ করে। এবার প্রাণবায়ুর সাথে সেই শক্তি ব্রহ্মগ্রন্থি ভেদ করে। ক্রমে, বিষ্ণুগ্রন্থি ভেদ করে রুদ্রগ্রন্থিতে স্থিত হন।  এইসময় কুম্ভক গাঢ়  হলে, বারবার পূরক করে, সূর্যভেদ উজ্জায়ী ও শীতলী অভ্যাস করবে এবং ভস্ত্রিকা ও সহিত-কুম্ভক নামক চতুষ্টয়ের অভ্যাস করবে। 

বিদ্রঃ এখানে আমরা চারটে বিশেষ প্রক্রিয়ার  অভ্যাসের কথা শুনলাম সূর্যভেদ, উজ্জায়ী, শীতলী ও ভস্ত্রিকা। 

এবার বন্ধত্রয়-এর কথা ও  চার প্রকার কুম্ভকের কথা :

সূর্যভেদ কুম্ভক   : ঈশ্বর বলছেন : বন্ধত্রয় কেবল কুম্ভক সিদ্ধির জন্য। উন্মুক্ত স্থানে, একাকী আসনে উপবিষ্ট হয়ে, লঘু আহারী ধৃতিমান যোগী প্রাণ-ইত্যাদি রূপ অমৃত পরমার্থ তত্ত্ব চিন্তা করবে। আর সূর্য নাড়ী (ডান নাক) দিয়ে বায়ুকে আকর্ষণ করে কুম্ভক করবে। এর পরে চন্দ্র নাড়ী (বাম নাক) দিয়ে রেচন করতে হবে। বারবার এরই প্রক্রিয়ার অনুষ্ঠানকেই সূর্যভেদ বলা হয়। (৯৩) এর ক্রিয়ার দ্বারা বাতরোগ ও কীটদোষ বিনষ্ট হবে। 

উজ্জায়ী কুম্ভক  : এবার উভয় নাসিকা দিয়ে বায়ু আকর্ষণ করে, কুণ্ডলিনী পার্শ্বে অর্থাৎ তলপেটে  ধারন করবে, এবং ইড়ানাড়ী দিয়ে (বামনাক) বারবার রেচন করবে। এর ফলে উদরী ধাতুরোগ বিনষ্ট হবে। 

শীতলী কুম্ভক : মুখের দ্বারা বায়ু আকর্ষণ করে, উভয় নাসিকা দ্বারা রেচন করবে। একে  শীতলী বলে।  এই শীতলী ক্রিয়ার দ্বারা পিত্ত  ও ক্ষুধা তৃষ্ণা দূর হবে।
 
ভস্ত্রিকা কুম্ভক  : কামারের হাপরের মতো শব্দ করে দেহস্থ বায়ুকে সবেগে রেচক-পূরক করবে। 
যখন দেহে ঘাম বেরুতে শুরু করবে, অর্থাৎ দেহে যখন শ্রম হবে, তখন সূর্য নাড়ীতে (ডান নাক) পূরক করতে হবে, এবার কণ্ঠনালীকে সংকুচিত করে চন্দ্র নাড়ী (বাম নাক)  দিয়ে রেচন  করতে হবে। এতে বাত-পিত্ত-শ্লেষ্মা দূর হবে।  এই  শরীরের অগ্নিবর্ধক। কুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করে, রক্তাল্পতা  দূর করে, এটি সুখপ্রদ, ও শুভফল প্রদায়ক। এতে করে ব্রহ্মনাড়ীর  মুখে যে কফ শ্লেষ্মা ইত্যাদির দূর হবে। ভস্ত্ৰাখ্য প্রাণায়াম অবশ্য করণীয়। এবার বন্ধত্ৰয় লক্ষণ সম্পর্কে বলছি। (১০২) 

এই বন্ধত্রয় চতুর্বিধ কুম্ভকে অভ্যস্ত হলে তবেই করবে। প্রথমে মূলবন্ধ : দ্বিতীয় উড্ডীয়ানবন্ধ, তৃতীয় জালন্ধরবন্ধ .

মূলবন্ধ : গোড়ালি দ্বারা গুহ্যদেশ চেপে ধরে জোরে করে গুহ্যদেশ আকুঞ্চন করবে, ততক্ষন না বায়ুর উর্দ্ধগতি হয়। মূলবন্ধ দ্বারা প্রাণ, অপান, নাদবিন্দু মূলবন্ধ দ্বারা একতাপ্রাপ্ত হলে, যোগসিদ্ধি হয়। 

উড্ডীয়ান বন্ধ : অন্তর কুম্ভক ও বাহ্য কুম্ভক অন্তে উড্ডীয়ান বন্ধ করা কর্তব্য। অর্থাৎ পূরক শেষে কুম্ভক করে, ও রেচক শেষে কুম্ভক করে এই উড্ডীয়ানবন্ধ ক্রিয়া করতে হয়. এতে করে সুষুম্না নাড়ীতে বদ্ধ প্রাণবায়ু উর্দ্ধগামী হয়। গুরুর উপদেশক্রমে এই উড্ডীয়ান বন্ধ ক্রিয়া অভ্যাসে বৃদ্ধ তরুণ হয়।  এইসময় সযত্নে নাভির উর্দ্ধদেশে ও অধোদেশে প্রাণবায়ুকে আকর্ষণ করবে। ছয়মাস এইরূপ করলে, যোগী মৃত্যুঞ্জয়ী হতে পরে। 

জালন্ধর বন্ধ : পূরক শেষে কন্ঠ সংকোচন করে, বায়ুকে নিরুদ্ধ করতে  হয়। এইসময় বায়ুকে হৃদয়ে স্থাপন করতে হয়। অধোদেশের আকুঞ্চন ও কণ্ঠসংকোচনের ফলে প্রাণের মধ্যমাগতি হয়।  এতেকরে শীঘ্রই প্রাণ ব্রহ্মনাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করে। বজ্রাসনে বসে যোগী কুণ্ডলিনী চালনা করে, পরে ভস্ত্রা অভ্যাস করবে ও কুণ্ডলিনীকে সঠিক ভাবে প্রবুদ্ধ করবে।
উত্তপ্ত লোহার দন্ড যেমন বাঁশের  মধ্যে প্রবেশ করে, বাঁশকে  বিদ্ধ করে, তেমনি উত্তপ্ত বায়ু মেরুদণ্ডের মধ্যে যে গ্রস্থিসকল  আছে, তাকে উত্তপ্ত বায়ু ভেদ করে। (১১৪) পিঁপড়ে লাগলে যেমন কুন্ড বা ছিদ্রের সৃষ্ট হয়, তেমনি বায়ু দ্বারা নিরন্তর সুষুম্না স্থিত মেরুদণ্ডে কুন্ডের সৃষ্টি হয়। রুদ্রগ্রন্থি ভেদ হলে সুষুম্না শিবাত্মতা প্রাপ্ত হয়। সূর্য ও চন্দ্র সমতা প্রাপ্ত হলে, এই যোগের প্রবর্তন হয়ে থাকে।
গ্রন্থিত্রয় ভেদ হলে, গুণত্রয় অতিক্রম করে যোগী গুণাতীত অবস্থায় চলে যান। তখন শিবশক্তির মিলনে পরমস্থিতি লাভ হয়। হাতি যেমন শুঁড় দ্বারা সর্বদা জল পান করে, তেমনই সুষুম্না বজ্রনালের দ্বারা (বজ্রাক্ষ নাড়ীর) দ্বারা  শুদ্ধ বায়ুকে পান করে। এই বজ্রদণ্ডে ২১টি মনির স্থিতি।  এই মনি মালার-ন্যায় সুষুম্নায় গ্রথিত আছে। সেই বিশ্বধারিনী সুষুম্না মোক্ষমার্গে প্রসিদ্ধ, সেখানে চন্দ্র নাড়ী ও সূর্য নাড়ী নিবদ্ধ থাকার জন্য কালের জয় হয়ে থাকে। সাধকের পুরকের  দ্বারা আহুত বায়ু কুম্ভকের কারনে বাইরে বের হতে পারে না। বারবার একইভাবে এই পূরক কুম্ভকের অনুষ্ঠান পশ্চিম দ্বারের লক্ষণ। নবদ্বার থেকে পূরিত বায়ু ঈষৎ কুম্ভিত হবার কারনে পশ্চিমপথে সর্বত্র গমন করে। (নবদ্বার হচ্ছে - শরীরের নটি ছিদ্র, চোখ-২, কান-২, নাক-২, মুখ-১, গুহ্য-১, মূত্রদ্বার-১, - এছাড়া আছে নাভিদ্বার।  পশ্চিম গাত্র হচ্ছে - শরীরের পিছন দিকে মেরুদন্ড স্থিত যে নাড়ী অর্থাৎ সুষুম্না, বজ্রাক্ষ্যা ও চিত্রাণি।) 
রেচক ক্ষীণ হলে, পুরকের সাহায্যে আবার বায়ু গ্রহণ করবে। একে  নাথ সঙ্কেত বা সিদ্ধ সঙ্কেত বলে। যেখানে কলেবরের সাথে মনের জন্ম অর্থাৎষট্ চক্রের মধ্যে স্পন্দন হেতু মনের জন্ম হয়ে থাকে। সেখানে যিনি বায়ুকে স্থির করতে পারেন, অর্থাৎ স্পন্দনহীন করতে পারেন, তিনিই যোগবিৎ।  তিনি মুক্ত ও সুখী। এই যে নাথ সঙ্কেত পিন্ডপাত একে পণ্ডিত-মূর্খগন জানতে পারেন না। যদি চিত্ত লয় হয়, তাহলে প্রাণেরও লয় হয়। যদি চিত্ত লয় না হয়, তবে প্রাণের লয় হয় না। তো মন ও বায়ুর সমতা না হলে যতই শাস্ত্র মুখস্ত করো, যতই গুরুবাক্য শ্রবণ করো, যতই আত্মপ্রীতির ভাব দেখাও, সবই নিষ্ফল। মন-বায়ুর সমতা না হলে মোক্ষ দুরস্ত। জোঁক যেমন বলপূর্বক রক্ত শোষণ করে, তেমনি যোগের নিরন্তর অভ্যাসের দ্বারা ব্রহ্ম নাড়ী সপ্ত ধাতুকে শোষণ করে। আসন, বন্ধত্রয় ক্রমানুসারে নিত্যদিন অভ্যাসের ফলে, চিত্ত বিলীন হয় এবং বিন্দু অধঃপতিত হতে পারে না। (১২৭)

দেবাদিদেব মহাদেব বলছেন, রেচক, পূরক, কুম্ভকের দ্বারা চিরকাল বেঁচে থাকা যায়।  এতে করে একসময় নাদের আবির্ভাব হয়। তখন চন্দ্রমন্ডলস্থ অমৃতসুধা প্রবাহিত হতে শুরু করে, তখন আর ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকে না। যোগীপুরুষ তখন সর্বদা সচ্চিদানন্দে অবস্থান করে। হে দেবী তোমার প্রীতার্থে এই অভ্যাস লক্ষণের কথা বললাম।
আসলে যোগশিক্ষা দেওয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু যোগের উদ্দেশ্য ও যোগের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ুক, এটাই আমাদের উদ্দেশ্য। পূরক, অন্তর-কুম্ভক, রেচক ও বাহ্য-কুম্ভক এই হচ্ছে, চারটি ক্রিয়া। বিভিন্ন আসনে, বিভিন্ন মুদ্রায় স্থিত থেকে এর অভ্যাস করতে হয়। তো আমরা এখানে চারটি কুম্ভকের প্রক্রিয়া, ও তিনটি মুদ্রাবন্ধ-র  কথা শুনলাম।  এমনিতে প্রাণায়ামের শতশত প্রক্রিয়া আছে, কিন্তু মোক্ষার্থীর এই ৭টি প্রক্রিয়া তার লক্ষে পৌঁছে দিতে পারে। এই অনৃত কথাই আমরা যোগবীজ গ্রন্থ থেকে পেলাম।   
---------------------------------------

মন্ত্রযোগ, লয়য়োগঃ, হঠযোগ, রাজযোগ, এই চারপ্রকার যোগকে একত্রে মহাযোগ বলে। (১৩০)

শ্রীদেবী বললেন : 

হে মহাদেব, এই চারিপ্রকার যোগতত্ত্ব ভূমিকা সহ যথাযথ শাস্ত্রসম্মত ভাবে আমাকে বলুন। 

ঈশ্বর উবাচ : 

প্রাণবায়ু হ-কার শব্দে বাইরে বেরিয়ে যায়। আবার স-কার শব্দে ভিতরে প্রবেশ করে। আর জীবসকল নিজের অজ্ঞাতসারে এই হংসবীজের অজপা জপ, প্রতিনিয়ত জপ (উচ্চারণ) করছে। আবার গুরুবাক্যঃ অনুসারে, সুষুম্নায় এই হংস বিপরীত রূপে অর্থাৎ  সোঽহং রূপে জপ হয়. একে  মন্ত্র জপ বলে। (১৩৩)  

           
     `
আত্মদর্শন  নিজেকে দেখা 
মূল সূত্র : স্বসংবেদন - শ্রী গোপীনাথ কবিরাজ পৃষ্ঠা-১৯৮

আত্মদর্শন বলতে আমরা বুঝি নিজেকে দেখা। আয়নায় আমরা নিজেকে যখন দেখি, তখন আমরা আমার এই স্থুল দেহের অনুরূপ একটা দেহ দেখি। যোগীপুরুষগন যখন প্রথমে নিজেকে দেখেন, তখন নিজের দেহের অনুরূপ একটা আলোক-দেহ বা একটা লিঙ্গদেহ দেখে থাকেন। এই লিঙ্গদেহের আকৃতি হুবহু স্থুল দেহেরই  মতো।  পার্থক্য  হচ্ছে, স্থুল দেহ হাড়-মাস-রক্ত দ্বারা তৈরী, আর লিঙ্গদেহ আলোক রশ্মি দ্বারা তৈরী। যাঁরা ধ্যানের  গভীরতায় প্রবেশ করতে পেরেছেন, তাদের এই দর্শন প্রত্যক্ষ হয়ে থাকবে।   
আমরা জানি, আমরা  যখন যার মধ্যে প্রবেশ করি, তখন তাকেই আমরা আমি ভেবে বসি, বা আমরা  তাই হয়ে যাই। আমরা যখন জ্ঞানের মধ্যে প্রবেশ করি, তখন জ্ঞানী হয়ে যাই।  আমরা যখন পাপের  মধ্যে প্রবেশ করি, তখন আমরা পাপী হয়ে যাই। আমরা যখন অজ্ঞানের মধ্যে প্রবেশ করি, তখন অজ্ঞানী হয়ে যাই। আবার আমরা যখন দেহের মধ্যে প্রবেশ করি, তখন আমরা দেহ হয়ে যাই। এই যে আমাদের দেহবোধ, অর্থাৎ আমাদের  স্থুল দেহে অভিনিবেশ বা তদাত্মা ভাব, অর্থাৎ দেহই আমিরূপ আত্মা,, এই  বোধ যখন সাধনক্রিয়ার ফলে, অর্থাৎ ধ্যানাদির দ্বারা কমতে শুরু করে, তখন এই আত্মদর্শন হয়ে থাকে।  প্রথম দিকে এই যে  আত্মদর্শন এটি লিঙ্গরূপী আত্মার দর্শন। লিঙ্গ  হচ্ছে জ্যোতিঃস্বরূপ। কারণরূপী আত্মার জ্যোতিকে  চারিদিকে বিকীর্ণ হয় তাকে বলা হয় লিঙ্গ।   এই লিঙ্গের আবির্ভাব-স্থল হচ্ছে আমাদের কারন দেহ।  আর কারন দেহের আবির্ভাব-স্থল হচ্ছেন স্বয়ং আত্মা। আত্মা যখন কারণরূপী জ্যোতিকে আশ্রয় করেন, তখন এই লিঙ্গদেহের উৎপত্তি হয়। আমরা দেহে থাকাকালীন, এই লিঙ্গদেহকে মাঝে মধ্যে দর্শন  করতে পারি। কেউ কেউ এই লিঙ্গরূপী দেহকেই আউড়া  (AURA) বলে থাকেন। আসলে সমস্ত জীবের এমনকি সমস্ত বস্তুর এই কারণরূপী লিঙ্গদেহ বর্তমান। দেহ যখন বিস্তার লাভ করে, তখন সে জ্যোতিতে প্রবেশ করে। এইসময় দেহস্মৃতি না থাকলেও, দৈহিক সংস্কার, এমনকি মনের ক্রিয়া চলতে থাকে। যোগীপুরুষ দীর্ঘদিনের সাধনার ফলে আত্মার এই জ্ঞানরূপ দেখতে পান । এই সময় যোগীপুরুষ  বা দ্রষ্টা, লিঙ্গজ্যোতিতে  অবস্থান করেন, তবে অন্তর্মুখীন অবস্থায় থাকেন। 

এই লিঙ্গজ্যোতিই আমাদের স্থূল দেহের সমস্ত জ্ঞান ও ক্রিয়ার যাবতীয় ব্যাপার সংগঠিত করে থাকে।  এই আত্মজ্যোতি যখন  দেহে থাকে না, অথবা থাকলেও, নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে  তখন এই স্থুল দেহ, শববৎ হয়ে অর্থাৎ মৃতবৎ অবস্থায় অবস্থান করে। এই জ্যোতির যিনি কারন তিনি হচ্ছেন আত্মা। যদিও এই আত্মা পরমাত্মা নহেন। পরমাত্মা হচ্ছেন মহাকারন বা কারনেরও  কারন। আমাদের স্থুল  দেহের যে ইন্দ্রিয়-প্রাণ-মন সবই এই জ্যোতির কারণেই ক্রিয়াশীল। এই জ্যোতি যখন নিষ্প্রভ হয়ে যায়, তখন শরীর অক্রিয় হয়ে যায়। বস্তুতে এই জ্যোতি নিষ্প্রভ। 
এই জ্যোতিই আমাদের উৎস, আবার  এই জ্যোতি থেকে জাত করন সমূহের উপরে সাধকের একাগ্রতার ফলে এই জ্যোতি পুনরুদ্ধ্বার করা সম্ভব । অর্থাৎ সাধকের সংযম অবস্থায়, বা বলা যেতে পারে, ধ্যানাদিতে সিদ্ধ হলে তবে সংযম, এবং এই সংযমের ফলেই, আত্মজ্যোতির দর্শন হয়ে থাকে। 

সাধারণত আত্মার যে রূপ দর্শন তা আসলে আত্মার সালোক্য অবস্থায় ঘটে থাকে। দেহে থেকে আত্মার যে রূপ দেখা যায়, তা শুধুই জ্যোতিস্বরূপ। চক্ষু মুদ্রিত করলে, এই আলোর প্রভাবে আমাদের সমস্ত অন্ধকার দূর হয়ে যায়। এই আলোই জ্ঞানের আলো, এই আলোই  আত্মজ্যোতি - একেই আত্মার লিঙ্গ অবস্থা বলা হয়ে থাকে । এই আলোর মধ্যে সমস্ত জগৎ বিলীন হয়ে আছে। এখানেই সব দেখা যায়। বিশ্বরূপ এখানে ইচ্ছা অনুসারে  দর্শন হয়ে থাকে। 
এর পরে একটা সময় এই রূপে, আর কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না। তখন শুধুই আলোকজ্যোতি থাকে ।  একেই পরাশক্তির অবস্থা বা শিব ও শক্তি বলা হয়ে থাকে । এরপরে শিব ও শক্তির মিলন হয়ে গেলে, তখন আর কিছুই দেখা যায় না। তখন সবই "আমি" বলে বোধ হয়। সবই আত্মা বা আমি  বলে একটা অপরোক্ষ বোধের উদয় হয়।  এই যে শিব ও শক্তির অবস্থা একেই সাম্যাবস্থা বলা হয়ে থাকে। এই অবস্থাতে একসময় পূর্ন কৃপার উদয় হয়, যার ফলে একাত্বলাভ হয়, বা পূর্নত্ত্ব প্রাপ্তি হয়। এই যে কারন-আত্মা এটি দেবতাবিশেষ।  আর লিঙ্গ্জ্যোতি হচ্ছে দেবলোক।  সুতরাং দেবলোকে গমন, আর স্থুল দেহকে শুদ্ধ করে, লিঙ্গমধ্যে অবস্থান করা  একই কথা। আবার একটু অন্যভাবে দেখলে, বোঝা যায়, আত্ম-লিঙ্গের বিস্তার অনন্ত - এর মধ্যে একটি মাত্র দেশ  হচ্ছে দেবলিঙ্গ । ঠিক তেমনি আত্মস্বরূপ বা কারনরুপী আত্মার একটি ভাব হচ্ছে একটি দেবতা। সুতরাং কোনো দেবতার সঙ্গে সাযুজ্য হলেও আত্মার এক ভাব বিশেষ মাত্র অধিগত হয়। পৃথক ভাবে দেখতে গেলে, আত্মার অনন্তভাব। সুতরাং মহাভাবের আশ্রয় গ্রহণ তখন অনিবার্য হয়ে পড়ে । কারন, তা না হলে ভাব থেকে ভাবাতিত অবস্থায় যাওয়া যায় না। তখন এই ভাবেই থাকতে হয়। এই মহাভাবে যেতে গেলে সাধনার ক্রমপর্য্যায়ে উন্নতির সাথে সাথে সেটি হয়ে থাকে। যোগীগণ বলে থাকেন, গোলকে মহাভাব, তারপরে ভাবতিত অবস্থা। 

দেবলোকে দেবতাদের সঙ্গে সাযুজ্য হলে, দেবতাদের যতদূর অধিকার, ততদূর পর্যন্ত লিঙ্গজ্যোতির মধ্যে আমি ভাব বজায়  থাকে।  এর ফল হচ্ছে আত্মস্থিতি। এই শরীরকে যেমন আমি বলে বোধ হয়, সমগ্র দেবলোককে, তখন স্পষ্ট আমি বলেই বোধ হয়।  তখন আমি ভিন্ন কিছু থাকে না। এখানে যেমন সবকিছুকে পৃথক দর্শন করছি, দেবলোকে সবই অভিন্ন দর্শন হয়।  এই অভেদ দর্শনকেই আত্মদর্শন বলে। এর পর মহাভাবের মধ্যে, কোনো বিশিষ্ট লোককে নয়, তখন সমগ্ৰলোককেই আমি বলে বোধ হয়। তখন আমিই বিশ্ব, বিশ্বই আমি এইভাবে নিজের বিস্তার ঘটে। একেও সেই অদ্বৈত দর্শন বলা হয়ে থাকে। একেই আত্মার বিশ্বরূপ দর্শন বলা হয়ে থাকে। 

---------------------  
আত্ম-তত্ত্বকথা (মূল সূত্র : বিবিধ প্ৰাণায়াম ও নেতি-ধৌতি - স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী)

আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমরা এই যে স্থুল  শরীরের মধ্যে বাস করি, এমনকি সমস্ত জগৎ নাকি পঞ্চভূতের তৈরী। আর এই পঞ্চভূতই নাকি মূল ভূত। অর্থাৎ পাঁচটি ভূত আছে, মিশ্রনে এই শরীরের সৃষ্টি হয়েছে। এখন কথা হচ্ছে, এই পঞ্চভূতের সৃষ্টি কে করলো ?আর পঞ্চভূতের মিশ্রনে যদি সমস্ত জগৎ সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে, জগতের সমস্ত কিছু সমস্ত বস্তু কেন একই গুন্ সম্পন্ন, একই আকারের হলো না ? জীবজন্তু ও মানুষের মধ্যে প্রবৃত্তির এতো ফারাক কেন ?   জগতে এতো তারতম্য কেন ? মানুষে মানুষেই বা এতো গুনগত দিকে থেকে পার্থক্য কেন ? এর উত্তরে মহাত্মাগণ বলছেন, পঞ্চভূতের পরিমানের তারতম্যের জন্য এই রূপ হয়েছে। হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন মিলে ।  তো জল কি করে মূল ভূত হলো ? এতো মিশ্র বস্তু। আবার বাতাসের মধ্যে আছে হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন ইত্যাদি এগুলো কিভাবে মূল ভূত হয় ? 

পঞ্চভূত থেকে শরীর কিভাবে তৈরি হলো ?  মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন, প্রাজ্ঞাদির ভোগের নিমিত্ত তমোগুণ প্রধানা 

পঞ্চ-তত্ত্বকথা (১)  
আমরা জানি পঞ্চভূতের তৈরী এই শরীর। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। এই পঞ্চভূতকেই বলা হয় পঞ্চতত্ত্ব। সৃষ্টির সমস্ত পদার্থ তা সে চেতন বলুন, আর অচেতন বলুন, সবই এই পঞ্চতত্ত্বের মিশ্রণ মাত্র। যিনি এই তত্ত্বের অতীত তিনি অক্ষয় নিরঞ্জন। 
আমাদের শরীরের হাড়, মাংস, ত্বক, নাড়ী ও লোম এই চারটি পৃথ্বী বা ক্ষিতিতত্ত্ব থেকে উৎপন্ন। শুক্র, রস, রক্ত, মজ্জ্বা, মূত্র এই পাঁচটি অপতত্ত্ব থেকে উদ্ভূত। আমাদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘুম, শ্রান্তি  ও আলস্য এই পাঁচটি তেজতত্ত্ব থেকে উৎপন্ন। ধারণ, চালন, সংকোচন, সম্প্রসারণ ও ক্ষেপন এই পাঁচটি বায়ু তত্ত্ব থেকে জাত। সবশেষে রাগ, দ্বেষ, লজ্জ্বা, ভয় মোহ  এই পাঁচটি ব্যোম তত্ত্ব থেকে উৎপন্ন।  জড় জগতের যে সব নিম্ন স্তরীয় জীব বাস করে, তাদের মধ্যে ক্ষিতিতত্ত্বের প্রাধান্য। অর্থাৎ যারা ভূ-লোকের বাসিন্দা বা  পৃথিবীবাসী তাদের  মধ্যে ক্ষিতিতত্ত্বের আধিক্য। কিন্তু যারা ভুবর্লোকের বাসিন্দা, বা স্বর্গলোকের বাসিন্দা তাদের মধ্যে অপতত্ত্বের প্রাধান্য বেশী লক্ষিত হয়। যারা অন্তর্লোকের বা অন্তরীক্ষের  বাসিন্দা, তাদের মধ্যে তেজতত্ত্ব ও বায়ুতত্ত্বের প্রাধান্য বেশী। যাদের অন্তর দীপ্তিমান, যারা শুদ্ধ মনের অধিকারী, এঁরা বিদ্যুৎ বা বায়ুর মতো অবাধগতি সম্পন্ন। সৃষ্টির সবচেয়ে উচ্চস্তরে বসবাসকারীর মধ্যে ব্যোমতত্ত্বের প্রাধান্য দেখতে পাওয়া যায়। আর সমস্ত তত্ত্বের অতীত হচ্ছে সেই পরম-পিতা পরমেশ্বের পরমাত্মা। 
এই তত্ত্বের লীলা খেলা বুঝতে গেলে, আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়াকে বুঝতে হবে। অর্থাৎ আমাদের ইড়া নাড়ী ও পিঙ্গলা নাড়ী দিয়ে যে শ্বাসবায়ু প্রবাহিত হচ্ছে, তাকে ধরবার চেষ্টা করতে হবে।
যোগীপুরুষগন বিশেষভাবে লক্ষ করেছেন, যে আমরা যে শ্বাস গ্রহণ করি এবং প্রশ্বাস ত্যাগ করি, এর মাঝে একটা ছন্দ আছে,  একটা নিয়ম আছে।  জগতের কোনোকিছুই নিয়ম বহির্ভূত নয়। এই যে সূর্য-চন্দ্র প্রতিক্ষনে স্থান পরিবর্তন করছে, এই যে বাতাস গতিসম্পন্ন তার মধ্যেও একটা নিয়ম আছে।  নিয়ম বহির্ভূত কেউ নয়।   তেমনি এই যে আমাদের, বা জীবকুলের যে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রবাহিত হচ্ছে, তার মধ্যেও একটা নিয়ম আছে। আমরা জানি চাঁদের গতিকে মাপকাঠি ধরে, শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষ নির্ধারণ  করা হয়। আবার শুক্লপক্ষে ও কৃষ্ণপক্ষের মধ্যে দিন-রাত  গুলোকে প্রতিপদ, দ্বিতীয়, তৃতীয়া ইত্যাদি থেকে চতুর্দশী পর্য্যন্ত একটা পক্ষকাল ধরা হয় । এইযে শুক্লপক্ষ, এর প্রতিপদ তিথিতে সূর্যোদয়ের ক্ষণ  থেকে আমাদের ইড়া অর্থাৎ বাম নাসিকায় শ্বাস প্রশ্বাস আরম্ভ হয়। এবং প্রতি আড়াই ঘন্টা অন্তর  এই ধারার পরিবর্তন হয়।   অর্থাৎ আড়াই-ঘন্টা পরে, ডান  নাসিকা দিয়ে শ্বাস প্রবাহিত হতে শুরু করে।  আবার আড়াই ঘন্টা পরে, বাম নাসিকা দিয়ে বায়ু প্রবাহিত হতে শুরু করে। তো আড়াই ঘন্টা অন্তর আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিপথের  পরিবর্তন হতে থাকে। 

আবার কৃষ্ণপক্ষে এর শুরুতে  ঠিক বিপরীত ক্রিয়া শুরু হয়। অর্থাৎ শুক্লপক্ষের প্রতিপদে সূর্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে পিঙ্গলা বা ডান  নাক দিয়ে শ্বাস প্রবাহ শুরু হয়। আবার প্রথম তিন দিন ভোরবেলা যে নাসিকা দিয়ে প্রথম শ্বাস প্রবাহ শুরু হবে, তিনদিন পরে তার বিপরীত নাসিকা দিয়ে প্রথম শ্বাসপ্রবাহ আরম্ভ হবে। এইভাবে পক্ষকাল ধরে অর্থাৎ অমাবস্যা থেকে পূর্ণিমা আবার পূর্ণিমা থেকে অমাবস্যা পর্যন্ত এই নিয়মে শ্বাসক্রিয়া চলতে থাকে। তো ইড়া  বা পিঙ্গলা দিয়ে শ্বাসের উদয় হয়ে সাধারণত আড়াই ঘন্টা থাকে। এই যে আড়াই ঘন্টা এর মধ্যেই বিভিন্ন তত্ত্বের উদয় হতে থাকে।  অর্থাৎ পাঁচটি তত্ত্বের উদয় হতে থাকে। প্রথমে ক্ষিতিতত্ত্ব বা পৃত্থিতত্ত্ব উদয় হয়ে ২০ মিনিট থাকে। তার পরে অপতত্ত্ব ১৬ মিনিট থাকে। এর পরে, অগ্নিতত্ত্ব ১২ মিনিট থাকে,  তারপরে মরুৎতত্ত্ব ৮ মিনিট থাকে  এবং ব্যোম তত্ত্ব ৪ মিনিট থাকে। তো মোট একঘন্টার  (২০+১৬+১২+৮+৪)  মধ্যে সমস্ত তত্ত্বের ক্রমানুসারে উদয় হয়ে থাকে। 

এই যে ব্যোমতত্ত্ব যা মাত্র মিনিটে ৪ সেকেন্ড বা ঘন্টায় ৪ মিনিট থাকে, ঠিক এই সময় সুষুম্না নাড়ীতে  বায়ু প্রবাহের সময়। এইসময় খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন, উভয় নাসিকা দিয়ে সম ভাবে শ্বাস প্রবাহিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই অবস্থা অর্থাৎ উভয় নাকে সমান ভাবে বায়ুর প্রবাহ সাধারণত তখনই হয়, যখন বায়ুর প্রবাহের ধারার পরিবর্তন হয়।  অর্থাৎ বাম  নাসিকে থেকে ডান নাসিকায়, বা ডান  নাসিকা থেকে বাম নাসিকায় বায়ুর প্রবাহ শুরু হবার ঠিক মাঝের অবস্থায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য সুষুম্নায় বায়ু প্রবাহিত হয়। এই সুষুম্নায় বায়ুর প্রবাহ চলাকালীন, আমাদের কোনো জাগতিক কর্ম্ম করা উচিত নয়।  কারন এইসময়ের কর্ম্ম নিস্ফলা, অর্থাৎ কোনো ফল প্রদান করে না। যোগশাস্ত্র অনুসারে, এইসময় জপ-তপ, ধ্যান-ধারণাতে অর্থাৎ ঐশ্বরিক কাজে মনকে নিয়োজিত করে রাখতে হয়। সাধকের কাছে এইসময় খুবই আকাঙ্খিত বা গুরুত্ত্বপূর্ন সময়। এই অবস্থাতেই সাধকের মধ্যে নানান ঐশ্বরিক শক্তি বা বিভূতির প্রকাশ ঘটে থাকে। মন যখন কাম-ক্রোধশূন্য হয়ে ধীর ও শান্ত হয়, ইষ্টচিন্তায় একাগ্র হয়, তখন স্বাভাবিক ভাবেই শ্বাসবায়ু সুষুম্নাগামী হয়। আবার যোগশাস্ত্র বিধি মেনে প্রাণায়াম ইত্যাদি করলেও বায়ুকে সুষুম্নাগামী করা সম্ভব হয়। সুষুম্নায় যখন বায়ু প্রবাহিত হতে শুরু করে, তখন কুণ্ডলিনী শক্তি জাগ্রত হন। আর এই শক্তি তখন উর্দ্ধগামিনী হয়ে একসময় আজ্ঞাচক্রে বিদ্যুৎ বর্ণের জ্যোতির প্রকাশ ঘটে। এখন কথা হচ্ছে,,কখন কোনো তত্ত্বের উদয় হচ্ছে, তা কিভাবে আমরা ধরতে পারবো ? স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী এটি ধরবার চারটি সহজ উপায় আছে। যদিও যোগশাস্ত্রে ১২টি উপায়ের কথা বলা আছে। আমরা কিন্তু মাত্র একটি উপায়ের কথা শুনবো। 

আয়নার কাছের উপরে শ্বাস ত্যাগ করুন। দেখবেন, আয়নার উপরে শ্বাস ফেলার ফলে আয়না  ঝাপসা হয়ে গেছে। এই ধাপসা বা সূক্ষ্ম জলের বিন্দু দিয়ে আয়নার উপরে একটা বিশেষ আকারের জন্ম হয়েছে। এই আকার যদি চতুস্কোন হয়, তবে জানবেন, এটি ক্ষিতিতত্ত্বের লক্ষণ। যদি ত্রিকোণ হয়, তবে জানবেন, এটি অগ্নি বা তেজঃ তত্ত্বের লক্ষণ। যদি বৃত্তাকার হয়, তবে জানবেন এটি বায়ুতত্ত্বের লক্ষণ। যদি অর্ধ চন্দ্রাকার হয়, তবে এটি অপ বা জলতত্ত্বের লক্ষণ। আর যদি আকারবিহীন কেবলমাত্র বিন্দু দৃষ্টিগোচর হয়, তবে এটি ব্যোমতত্ত্বের লক্ষণ। এখন কথা হচ্ছে, আমরা এই তত্ত্বকথা জেনে কি করবো ? যা হবার তাতো হবেই। এই প্রশ্নের উত্তর আমরা ভবিষ্যতের জন্য রেখে গেলাম। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।  

মানুষ কি ক্ষুধা-তৃষ্ণাহীন হতে পারে ? ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবৃত্তির যোগক্রিয়া।  যোগবিভূতি 

সারা পৃথিবীতে  একদল মানুষ না খেতে পেয়ে অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগে মারা যাচ্ছে। আবার একদল মানুষ অতিরিক্ত খেয়ে মেদবাহুল্যে নানান রোগের  শিকার হচ্ছে। আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমাদের যদি খাবার খাওয়ার  দরকার  না পড়তো, তবে হয়তো আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। উপনিষদে পড়ছিলাম, মানুষ যেখান থেকে এসেছে, সেখানেই চলে যায়।  তো স্থূল দেহ যেখান থেকে এসেছে, স্থূল দেহের্ মৃত্যুর পরে,  আবার সেই পঞ্চভূতেই ফিরে যাচ্ছে।  আবার আমরা যে খাবার খাচ্ছি, তা নাকি যেখান থেকে এসেছে, সেখানে চলে যাচ্ছে। তো তাই যদি হয়, তবে আমি খাবার না খেলে, যেখানে ছিলাম সেখানেই থাকবো। তো খাবার না খেয়ে বেঁচে থাকা যায় কি না, সেই  উপায়ের খোঁজ করছিলাম। 
 শ্রী শ্রী পরমহংস যোগানন্দ তাঁর Autobiograhy of  a Yogi - যোগীকথামৃত বইতে এক নারীর সন্ধান পেলাম, যিনি ১২/১৩ বছর  বয়স  থেকে কিছুই না খেয়ে, বা বলা যেতে পারে, বায়ুভুক হয়ে বেঁচে ছিলেন। দিনটা ছিল, ১৯৩৬ সালের ৫-ই মে। স্থান উত্তরবঙ্গের বিউর গ্রামে। যোগিজী   বলছেন, "ঈশ্বরের যদি ইচ্ছে হয়, তাহলে আজ আমরা বেরুচ্ছি পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য্য দেখতে - একটি সাধ্বী মহিলা, যিনি মাত্র বায়ু সেবন করেই বেঁচে আছেন ।" 
এই অষ্টম আশ্চর্য্য সাধ্বী যোগিনীর নাম গিরিবালা দেবী। যিনি দীর্ঘ ৫৬ বছর (যখন যোগানন্দের সঙ্গে এই যোগিনীর সাক্ষাৎ হয়, তখন তার বয়স ৬৮ বছর, আর তিনি খাদ্য পরিত্যাগ করেছেন, ১২ বছর ৮ মাস বয়স থেকে) কোনো কিছু না খেয়ে বেঁচেছিলেন। তাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, "আমার জন্ম জঙ্গলের দেশে।  ছোটবেলায় আমার ক্ষিধে ছিল রাক্ষুসে।  আমার ন'বছর  বয়সে বিয়ের কথাবার্তা হয়। শশুর বাড়িতে গিয়ে, এই খাই-খাই স্বভাবের জন্য, বকুনি খেতে হতো। একদিন নির্মম, হৃদয়হীন বকুনির কারনে আমি বলে ফেললুম, যতদিন আমি বাঁচবো, ততদিন আমি আর কোনো খাবার ছোঁবো না। এবার  নিরালায় গিয়ে ঈশ্বরের কাছে, প্রার্থনা করতে লাগলাম, ভগবান আমাকে গুরু পাঠিয়ে দাও, যিনি আমাকে না খেয়ে বেঁচে থাকতে শিখিয়ে দেবেন। গিরিবালা দেবী বলছেন, পুকুরের ঘাটের দিকে যাচ্ছি, রাস্তায় পুরোহিত ঠাকুরকে দেখে, তাকে প্রশ্ন করলাম, ঠাকুরমশাই দয়া করে বলুন না, না খেয়ে কি করে বেঁচে থাকা যায় ? ঠাকুর মশায় কোনো জবাব দিলেন না, শুধু আশ্বাসের সুরে বললেন, সন্ধ্যের সময় মন্দিরে এস, তোমার জন্য একটা বিশেষ বৈদিক প্রক্রিয়া বলবো। কিন্তু সেই কথায় আমি ভরসা রাখতে পারলুম না। ঘাটের দিকে এগিয়ে গেলুম।  স্নান করলাম।  ঘাঁট ছেড়ে  ভিজে কাপড়ে যখন এগিয়ে আসছি, তখন দিনের আলোয় গুরুদেব আমার সামনে সশরীরে আবির্ভূত হলেন। বললেন, মালক্ষ্মী আমি তোমার গুরু। আজ হতে তুমি সূক্ষ্মশক্তির বলে তোমার জীবন ধারণ হবে।  তোমার শরীরের অণুপরমাণু সেই অনন্ত শক্তির সাহায্যেই পুষ্ট  হবে।" 

সেই থেকে অর্থাৎ মাত্র ১২ বাঁচার ৮ মাস বয়স থেকেই তিনি নিরাহারী। এমনকি তার নাকি, অসুখ-বিসুখ ছিলো না।  ঘুম ছিলো না।  মলমূত্র ত্যাগের প্রয়োজন ছিল না। ঈশ্বরের অপূর্ব সৃষ্টি এই গিরিবালা দেবী । 

কিন্তু কথা হচ্ছে, প্রতিটি জীবকুল এই খাবারের সন্ধানে ঘুরে ঘুরে মরছে। কত লোক যে পৃথিবীতে অনিচ্ছাকৃত ভাবে অনাহারে দিন যাপন করছে, তার ঠিক নেই। তো এই বিদ্যা যদি আমরা শিখতে পারতাম, তবে তো আমরাও সবাই এই ক্ষুধা-তৃষ্ণার হাত থেকে রেহাই পেতে পারতাম। তো পরমহংস যোগানন্দ এই  আবেদনটি করেছিলেন, গিরিবালা দেবীর কাছে। তো গিরিবালা দেবী বলেছিলেন, না তা হয় না। গুরুদেব এই রহস্যঃ প্রকাশ করতে বিশেষভাবে নিষেধ করেছেন। গুরুদেব নাকি তাঁকে  এমন একটা ক্রিয়াযোগ শিখিয়ে দিয়েছিলেন, যার মধ্যে একটা মন্ত্র আছে আর আছে শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম, যা সাধারণ লোকের পক্ষে করা কঠিন। আমরা জানিনা কত কঠিন সেই শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম। তবে এটা ঠিক, এইভাবে এই বহু অমূল্য গুহ্যবিদ্যা লুপ্তপ্রায় হয়ে গেছে, আমাদের জীবন থেকে।  

আমরা  পওহারী বাবার নাম শুনেছি, তিনি বেলপাতার রস পান করতেন। আমি নিজে অনেক মহাপুরুষদের দেখেছি, এঁরা সবাই স্বল্পাহারী। কেউ শুধু নিমপাতার রস খেয়ে দিব্যি আছেন।  আসলে যাঁরা যোগের অভ্যাস করেন, তাদেরকে এমনিতেই স্বল্পাহারী  হতে হয়। না হলে যোগে সিদ্ধ হওয়া যায় না।

ঋষি উদ্দালক পুত্র শ্বেতকেতুকে না খেয়ে থাকতে বলেছিলেন, মনের শক্তিকে বোঝাবার জন্য। বাবা লোকনাথ, শ্রী শ্রী রামঠাকুর, মহাত্মা গুরুনাথ এঁরা সবাই স্বল্পাহারী ছিলেন।  ভগবান বুদ্ধ সত্যের সন্ধানে নিজেকে অভুক্ত রেখে সাধনা করেছিলেন।

এখন কথা হচ্ছে, না খেয়ে থাকলেই, ভগবানকে পাওয়া যাবে, ব্যাপারটা এমন নয়। তা যদি হতো, তবে প্রথিবীর সমস্ত অনাহারী অর্দ্ধাহারী  মানুষের ঈশ্বরপ্রাপ্তি হতে পারতো। তা কিন্তু হয় নি। তো ভগবানকে পেতে গেলে, অনাহারে থাকতে হবে, ব্যাপারটা এমন নয়। তথাপি আমরা দেখতে পাই বহু যোগীপুরুষ খাবার ব্যাপারে, অত্যন্ত সংযমী, নির্লোভী। 
(আবার  হঠযোগ প্রদীপিকা বলছে, আমাদের পাকস্থলীতে যা ধরে, তার অর্দ্ধেক (!/২) খাবার, ১/৪ ভাগ জল দিয়ে পূরণ করবে, বাকি ১/৪ ভাগ খালি রাখবে।)         
যাইহোক, প্রশ্ন থেকে গেলো, কিভাবে খাবার না খেয়ে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকা যায়। তো এই প্রশ্নের একটা জবাব পেলাম, যোগবিজ গ্রন্থে। যোগবীজ গ্রন্থে স্বয়ং শিব বলছেন, (৯৭) মুখ দ্বারা বায়ুকে আকর্ষণ করে নাক দিয়ে রেচন করবে। একে শীতলী কুম্ভক  বলে।  এই শীতলীকরণ শরীরের পিত্তদোষ যেমন দূর করে, তেমনি ক্ষুধা-তৃষ্ণা দূর করে।
এখন কথা হচ্ছে, যোগীপুরুষগন বা গিরিবালা দেবী কি এমন যোগক্রিয়া করতেন, বা করেন, যাতে তাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকে না ? এই প্রশ্নের আরো একটা উত্তর আছে, পতঞ্জলির যোগদর্শন বইতে।  এখানে বিভূতিপাতে শ্লোক নং ৩০-এ  বলা হচ্ছে : "কণ্ঠকূপে ক্ষুৎপিপাসা-নিবৃত্তিঃ" অর্থাৎ কণ্ঠকূপে বা  জিহ্বামূলে সংযম করলে ক্ষুধা তৃষ্ণার নিবৃত্তি হয়। জিহ্বার মুলদেশের নিচে হচ্ছে তন্তু স্থান।  এর নিচের অংশকে বলে কন্ঠ, আবার এই কন্ঠের নিচের অংশকে  বলে কণ্ঠকূপ। ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, এই কণ্ঠকূপে সংযম করলে ক্ষুধাতৃষ্ণা থাকে না। এই প্রক্রিয়ায় যে সাফল্য আছে, তা আমাদের অভিজ্ঞতা লব্ধ। 

বিষয়টি আরো  একটু খুলে বলি।  আমাদের শরীরের কন্ঠ হচ্ছে, আমাদের বাকযন্ত্র। এখানে যেসব উপশিরা অর্থাৎ তন্তু বা তার আছে, তা অনেকটা বীনার তারের মতো। আমাদের যখন কথা বলার বা শব্দ করবার ইচ্ছে হয়, তখন অদ্ভুত ভাবে এই ইচ্ছেশক্তির প্রভাবে তন্তু ঝংকৃত হয়। আর আমাদের আকাঙ্খ্যা অনুযায়ী শব্দ বা ধ্বনি বের হয়। এই বাকযন্ত্রের নিচে আছে আমাদের শ্বাসনালী ও খাদ্য নালী।  এই যে শ্বাসনালী ও খাদ্যনালীর  যেখানে সন্ধিস্থল একেই বলে কণ্ঠকূপ। যোগীগণ এই কণ্ঠকূপে সংযম করে, ক্ষুধা-তৃষ্ণা থেকে রেহাই পান। এখন কথা হচ্ছে সংযম কাকে বলে। 
ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, "দেশবন্ধশ্চিত্তশ্য ধারণা, তত্র প্রত্যয়-একতানতা ধ্যানম, তদেবার্থমাত্র নির্ভাসং স্বরূপ শূন্যমিব সমাধিঃ। ত্রয়মেকত্র সংযমঃ।" 
অর্থাৎ বিশেষ দেশে অর্থাৎ স্থানে চিত্তের স্থিত বা বন্ধ  হলো ধারণা। ধারণা-জনিত প্রত্যয় অর্থাৎ জ্ঞান বৃত্তির একতানতা হলো ধ্যান। আর সেই ধ্যান যখন তার বিষয়মাত্র প্রকাশে স্বরূপ-শুন্য মতো হয়, তখন তা হলো সমাধি।  আর এই তিনটি অর্থাৎ ধারণা-ধ্যান-সমাধি এই তিনটেকে একত্রে একটি বিষয়ে যুক্ত করলে হয় সংযম। অর্থাৎ ধারণা-ধ্যান-সমাধিতে যিনি সিদ্ধি লাভ করেছেন, তিনি সংযমী পুরুষ। 

তো  যখন ধ্যানসিদ্ধ সমাধিবান পুরুষ তাঁর  কণ্ঠকূপে সংযম অভ্যাস করেন, তখন তিনি ক্ষুধা-তৃষ্ণার উর্দ্ধে চলে যান। আসলে যোগশাস্ত্র বলছে, আমাদের কন্ঠের বিপরীতে আছে আমাদের বিশুদ্ধচক্র। আমাদের শরীর  পঞ্চভূতের মিশ্রণ। বিশেষ করে, বায়ু,অগ্নি ও অপ এই তিন ভূতের প্রভাবে, আমাদের শরীর আকাশভূতের মধ্যে যে ইথারীয় শক্তি আছে তাকে আকর্ষণ করে ক্রিয়াশীল থাকে। এই ইথার আমাদের শরীরের জড় কোষসমূহের মধ্যে যে শূন্য স্থান আছে, তার মধ্যে পূর্ন হয়ে আছে।  তো সাধক যখন এই বিশুদ্ধ চক্রে  মনসংযোগ করেন, তখন তিনি এই ইথারীয় শক্তিবলে নিজেকে প্রাণবন্ত রাখতে সমর্থ  হন। 
এবার আমরা আরো একটু সহজ করে ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করবো। দেখুন প্রাণায়ামের উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রাণশক্তির সঞ্চয়ের মাধ্যমে দেহকে প্রাণবান করে তোলা। স্থুল দৃষ্টিতে এটাই প্রাণায়ামের কার্যকারিতা। আমাদের ধারণা  হচ্ছে, প্রাণীর মধ্যেই প্রাণশক্তি আছে।  জড় বস্তুর মধ্যে প্রাণশক্তি নেই।  আসলে ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়।  প্রাণশক্তি একাংশ জড়বস্তু রূপেও  আছে। তো জড়বস্তুর মধ্যেও  মহাপ্রাণশক্তির  দিব্য অবতরণ ঘটেছে প্রতিনিয়ত । একসময় যা বাষ্প বা মেঘ ছিল, তা একসময় জল হয়েছে, জল একসময় বরফ হয়েছে। অর্থাৎ সূক্ষ্ম থেকে স্থুল হয়েছে। আরো একটা কথা হচ্ছে, আমাদের ধারণা  হচ্ছে, বাতাসের মধ্যে থেকে আমরা প্রাণশক্তি সংগ্রহ করি। কিন্তু সত্য হচ্ছে, জল, বা খাদ্যবস্তু থেকেও আমরা প্রাণশক্তি সংগ্রহ করি। 

আরো  একটা জিনিস জানবেন, খাদ্য ও খাদক ভিন্ন নয়। প্রাণই প্রাণের খাদ্য, আবার প্রাণই প্রাণের রক্ষাকর্তা। তো যে খাদ্যে অধিক প্রাণশক্তি আছে, সেই খাদ্যকে আমরা পুষ্টিকর খাদ্য বলে থাকি। আমাদের শরীর হচ্ছে অসংখ্য কোষের সমষ্টি। এই যে অসংখ্য কোষ এর মধ্যে শতকরা  ৮৬ ভাগ কোষ বাতাস থেকে অক্সিজেন নিয়ে বেঁচে থাকে। এই অক্সিজেনের অভাব হলে এদের মৃত্যু হয়। উদ্ভিদ যেমন সূর্য থেকে প্রাণশক্তি সংগ্রহ করে, তেমনি মাটির ভিতরে, জলের ভিতরে, এমনকি পাথরের  ভিতরে শিকড় প্রবেশ করিয়ে প্রাণশক্তিকে আহরণ করতে পারে। কিন্তু মানুষের এই ক্ষমতা নেই। এইজন্য মানুষকে প্রানধারনের জন্য উদ্ভিজ প্রাণীর অথবা উদ্বিজপ্রাণীর মাংসের উপরে নির্ভর করতে হয়। আলো  বাতাস থেকে উদ্ভিদ খাদ্যপ্রাণ সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু মানুষের মধ্যে এই আলো -বাতাস থেকে সরাসরি খাদ্যপ্রাণ সংগ্রহ করবার ক্ষমতা নেই। আর এই কারণেই মানুষ বা জীবজন্তু প্রকৃতির ভাণ্ডারে যে অফুরন্ত খাদ্যপ্রাণ আছে, তাকে সে সংগ্রহ করতে পারে না। আর অনাহারে প্রাণের অভাবে মৃত্যু বরণ  করে। যেদিন মানুষ প্রকৃতির এই অক্ষয় ভান্ডার থেকে গিরিবালা দেবীর মতো, বা আমাদের মুনিঋষিদের মতো নিজের দেহ রক্ষার প্রয়োজনীয় খাদ্যপ্রাণ সংগ্রহ করবার কৌশল আয়ত্ত্ব করতে পারবে, সেদিন মানুষের খাদ্য সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।  এমনকি মানুষে মানুষে এই যে মারামারি কাটাকাটি, এমনকি জীবকুলের মধ্যে যে হিংসা তা লোপ পাবে। তাই আশাবাদী স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী মহাশয় বলছেন, ভাবীযুগের অন্ন সমস্যা সমাধানে একদিন এই প্রাণায়াম শুধু সহযোগী হয়, প্রধান সহায়ক হতে পারে। 
আমরা যদি প্রাণায়াম ইত্যাদির সাহায্যে আমাদের ফুসফুসকে শক্তিশালী করতে পারি, এবং বাতাসের মধ্যে যে খাদ্যপ্রাণ তাকে সহজে আলাদা করে নিজেদের শরীরে কাজে লাগাতে পারি, তবে আমাদের শরীর  রক্ষা হতে পারে, তথাকথিত খাদ্য ছাড়াই। আমরা যে শ্বাসবায়ু গ্রহণ করি, তার মধ্যে বড়োজোর ১৮-২০ ভাগ আছে অক্সিজেন, যা আসলে খাদ্যপ্রাণ । ৭৭ ভাগ আছে নাইট্রোজেন।  বাকিটা অন্যান্য গ্যাসীয় পদার্থ।  কিন্তু এই যে ১৮-২০ ভাগ অক্সিজেন বা খাদ্যপ্রাণ এর মধ্যে আমরা মাত্র ৩-৪ ভাগ অক্সিজেন আমরা সংগ্রহ করতে পড়ি, বাকিটা আমাদের প্রশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। বায়ুর মধ্যে যে কার্বন গ্যাস আছে, তা আমাদের শরীরের তাপ  উৎপন্ন করে, দেহের প্রাণকোষের নির্মাণ করে থাকে। আবার এই কার্বন গ্যাস প্রয়োজন অতিরিক্ত থাকলে, শরীরের যে অক্সিজেন থাকে তাকে ধংশ করে দেয়। আবার নাইট্রোজেন-এর সাহায্যেই অক্সিজেন দেহপুষ্টির কাজে লাগে। 
এখন কথা হচ্ছে, আমার যদি পর্যাপ্ত খাদ্য থাকে, তবে না খেয়ে থেকে কি লাভ ? ঠিক একই ধরনের একটা প্রশ্ন করেছিলেন, পরমহংস যোগানন্দ, যোগীন্দ্র গিরিবালা দেবীকে।  তো গিরিবালা দেবী এর উত্তরে একটা মূল্যবান কথা বলেছিলেন, যা আধ্যাত্মিক জগতে  খুবই গুরুত্ত্বপূর্ন।  বলেছিলেন "মানুষ যে নিজেই আত্মা তা প্রমান করবার জন্য। বেঁচে থাকতে গেলে, অন্ন অপরিহার্য নয়, ঈশ্বরের জ্যোতিতে বেঁচে থাকা যায়, তা প্রদর্শন করবার জন্য।" তো আসুন আমরা যে সবাই আত্মা, তা প্রমান করবার জন্য যোগক্রিয়ায় নিযুক্ত হই।  

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম । 

এক মহাত্মা বলেছিলেন, জীবনের অশান্তি দূর করবার জন্য কাজ করুন, হয় নিজের জন্য নতুবা পরের জন্য। জীবন সমস্যা থেকে রেহাই পাবার আর থেকে মূল্যবান উপদেশ আর কিছু হতে পারে না। কথাটা শুনে দ্বন্দে পড়ে গিয়েছিলাম। আমরা তো সবাই  কাজ করি হয়, নিজের জন্য নতুবা পরের  জন্য।  এর মধ্যে নতুন কি আছে ? পড়াশুনা করেছিলাম, নিজের জন্য, বড়ো চাকরি পাবো, গাড়ি হবে, বাড়ি হবে, সুন্দরী বৌ হবে ইত্যাদি ইত্যাদি স্বপ্ন পূরণের ইচ্ছে থেকেই ভালো করে পড়াশুনা করেছি।  আর এখন কাজ করছি, ছেলেমেয়েদের জন্য, স্ত্রীর জন্য। ভবিষ্যতে যাতে স্ত্রী-ছেলেমেয়ে ভালো থাকবে।  আর এরা  সবাই ভালো থাকলে, আমি নিজেও সুখী হবো। 

মহাত্মা বলছেন, ব্যাপারটা এমন নয়। একটু খুলেই বলি। দেখো নিজের কাজ করতে গেলে আগে নিজেকে চিনতে হবে।  তুমি কে তাকি  তুমি জানো ? তুমি হয়তো বলবে । আমি অমুক, পিতার নাম অমুক। অমুক জায়গার বাসিন্দা। আমি একজন শিক্ষক। আমার ববয়স ৪৫ বছর। ইত্যাদি ইত্যাদি বলে, নিজের পরিচয় দেবে। আসলে এই যাকিছু  তুমি নিজের বলে ভাবছো, বা যাকে  তুমি "আমি" বলে ভাবছো, এরা  কেউ তুমি নও। এরা সবাই "তোমার".এমনকি তুমি, না এই শরীর, না এই মন, এগুলো সবই "তোমার" "তুমি" নয়। তুমি হোচ্ছ আত্মা। যা তুমি ভুলে বসে আছো। তো নিজের স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলো, আগে নিজেকে সনাক্ত করো। তাহলেই না তুমি নিজের জন্য কাজ করতে পারবে। এর জন্য দরকার সাধনক্রিয়া।  যা তুমি করো না। সাধনক্রিয়া করে, যখন তুমি তোমার স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলতে পারবে, তখন তুমি তোমার স্বরূপকে জানতে পারবে।  তখন তুমি যাকিছু করবে, তা হবে তোমার নিজের কর্ম্ম। যদিও তখন তোমার আর কর্ম্ম অবশিষ্ট থাকবে না। তখন যা কিছু করবে, তা হবে সেই পরমপুরুষের কাজ। আর পরমপুরুষ কাজে যখন তুমি নিযুক্ত হবে, তখন দেখবে, তোমার মধ্যে থেকে সমস্ত দুশ্চিন্তা চলে গেছে। কোনো কাজের পরিনাম নিয়ে তখন তোমাকে আর ভাবতে হবে না। কারন যাঁর হয়ে তখন তুমি কাজ করবে, সে-ই তোমার সমস্ত কাজের ভালো-মন্দ নিয়ে নেবেন।  তুমি তখন নিমিত্ত মাত্র।  সমস্ত কর্ম্মের কর্তা  হয়ে যাবেন, তখন সেই পরমপুরুষ।  আর তুমি নিশ্চিন্তে জীবন অতিবাহিত করতে থাকবে। তো যা বলছিলাম নিজের জন্য যদি কিছু করতে চাও, তবে তা হবে তোমার সাধনা - সাধনকর্ম্ম। এই সাধনক্রিয়া না করে, আর যাকিছু জাগতিক কর্ম্ম করছো, তা আসলে তোমার জন্য নয়, এগুলো সবই অন্যের জন্য, আর এই অন্যের জন্য কাজ করতে করতে তুমি হয়রান হয়ে গেছো, নিজেকে ফলাফলের ভাগিদার ভেবে, নিজেকে বঞ্চিত করছো। তো আগে নিজেকে চেনো, তার পরে নিজের জন্য কাজ করতে পারবে। 

এখন শোনো পরের জন্য কিভাবে কাজ করতে হয়। তুমি কোথায় কাজ করো ? রেলে ? দেখো রেখে কাজ করছো, রেল তোমাকে মাস গেলে মাইনে  দিচ্ছে। মাইনের টাকা দিয়ে তুমি তোমার স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের, পিতা-মাতার ভরন-পোষণের দায়িত্ত্ব পালন করছো। দূর্গা পুজোর মায়ের মূর্তি দেখেছো ? সামনে থেকে তো নিশ্চই দেখেছো। কি সুন্দর মায়ের মূর্তি। দেখলে মন জুড়িয়ে যায়।  কিন্তু পিছন দিকে গিয়ে দেখেছো কখনো ? পিছনে গেলে দেখতে পারবে, মায়ের পিছনটা খড়-কুটো-বাঁশ-কাঠ দিয়ে তৈরী।  এতটুকু রং তো দূরের কথা একমুঠো মাটি দিয়ে তাকে ঢাকার চেষ্টা করা হয় নি। তুমি হয়তো বলবে, হ্যাঁ তা আমি জানি। মায়ের পুজো হয় সামনের দিকে, পিছনটা ওমনিই থাকে। কখনো কি ভেবে দেখেছো, সামনের দিকটা এতো সুন্দর করা হলেও, কেন মায়ের পিছন দিকে নগ্ন করে রাখা হয় ? কখনো কি ভেবে দেখেছো, মায়ের সামনের দিকে কাপড় থাকলেও, মায়ের পিছন দিকটা কেন উন্মুক্ত থাকে।  উদ্যোক্তাদের কি সত্যিই টাকা পয়সার  অভাব বা এতটুকু কাপড়ের অভাব, বা মাটি রঙের অভাব, যাতে তারা মায়ের পিছন দিকটাকে সুন্দর করে তৈরী করতে পারে না। কখনো কি ভেবে দেখেছো, মা কালীর পায়ের তলায় কেন দেবাদিদেব  শিব ঠাকুরকে শুইয়ে, মা পা দিয়ে চেপে ধরেছেন। আবার লজ্জ্বায় জীব কাটছেন ?             

         

        

      


   



        
 



 
       

     

   

















No comments:

Post a Comment