Wednesday 9 March 2022

কথাবলা


কথাবলা বা শোনা কি ধ্যান হতে পারে ?
 

আমাদের একটা ধারণা  হচ্ছে বেশি কথাবলা ভালো না। কিন্তু কথা বলে ভগবানকে পাওয়া যায়, এমন কথা কখনো শুনিনি। ধ্যানে আমরা সবাই নীরব হয়ে যাই। এক  স্বামীজীর সাথে আমার একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, একটা সময় ।  আজ সেই স্বামীজী আর স্থুল শরীরে  নেই। কিন্তু তার কথা আমার আজও মনে আছে, আমি  ভুলতে পারিনি। 
স্বামীজী সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত নানান লোকের নানান সমস্যার কথা শুনতেন। কিন্তু তিনি নিজে খুব কম কথা বলতেন।  বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখতাম মাথা নাড়তেন। কিছুক্ষন পরে, হাত নেড়ে, বক্তাকে চলে যেতে বলতেন। তো আমি একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি সারাদিন মানুষের নানান ধরনের সমস্যার কথা শোনেন। আর লোকগুলো পাগলের মতো বকবক করে। একই কথা বারবার বলে, আপনার শুনতে ভালো লাগে ?  আপনার মধ্যে কোনো পরিবর্তনও দেখা যায় না। আপনি সুখের কথা শুনছেন, না দুঃখের কথা শুনছেন, তাও আপনার মুখ দেখে বোঝা যায় না। আপনি কেবল  নির্বিকারভাবে তাদের কথা শুনে যান। আপনার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। আপনার মধ্যে কোনো ক্লান্তিও দেখা যায়  না।  আপনি কিভাবে এদেরকে সামাল দেন ?  আমি দেখেছি, ৭/৮ ঘন্টা এদের  বকবকানি শুনেও আপনার মধ্যে কোনো ক্লান্তি নেই। সকালে যেমন আপনাকে যেমন ফ্রেশ লাগে, সন্ধ্যাতেও আপনি ততোধিক ফ্রেশ-ই  থাকেন। আমার তো দু-এক ঘন্টা কথা শোনার পরে, বিরক্তি লাগে। আপনার এই কথাশোনার, বলা যেতে পারে বকবকানি শোনার কৌশল তা কি ? কি সেই রহস্য  রহস্যঃ যাতে আপনার মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখা  যায় না।  তখন তিনি একটা সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়েছিলেন, "শুনছে কে?"  তো আমি বললাম, শুনছে কে, মানে।  আপনি কি তাহলে এদের কথা শোনেন না ? এবার শুধু উনি মাথা নাড়লেন। বললেন, কত লোকে ভগবানকে কতো কথা বলে, তুমি কি ভাবছো, ভগবান তোমাদের কথা শুনছেন ? 

আমার এক পরম-আত্মীয়া আছেন। তিনি একটু বেশি কথা বলেন। তো তার নিজেরই  মাঝে মধ্যে মনে হয়, এতো বেশি কথা বলা ভালো নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বেশি কথা ভালো, না কম কথা বলা ভালো। লোকে বলে বুদ্ধিমান কম কথা বলে, আর বোকা বা পাগলে বেশি কথা বলে।
দেখুন,  কথা যদি আপনার ভিতরের জিনিষকে বাইরে বের করে দিতে পারে, তবে জানবেন, সেটি ভালো। দুঃখের কথা কাউকে বলে হালকা হাওয়া যায়। এতে করে,  যদি একটু বেশি কথা বলা হয়ে যায়, তবে তাতে কোনো ক্ষতি নেই। হ্যাঁ আপনার কথা কাউকে আঘাত না করে, সেটা খেয়াল করতে হবে। স্বামীজী বলছেন, "কে কার কথা শোনে" ? আপনার কথা কেউ শুনলো,কি শুনলো না তাতে আপনার কিছুই এসে যায় না। আপনি আপনার কথা বলে যান।  আপনার ভিতরে একটা শক্তি আছে, সে কোনো না কোনো ভাবে বের হতে চাইছে।  এখন আপনি সেটা কিভাবে বের করবেন, সেটা আপনার ব্যাপার। কথা বলেও সেটা বার করা যেতে পারে। কথা বলাকে একটা খেলা হিসেবে ভাবুন। কখনো এটাকে বেশি গুরুত্ত্ব দিয়ে ভাবতে যাবেন না। আপনার মধ্যে বেশি কথা বলার অভ্যাস থাকলে, এই নিয়ে  নিজেকে অপরাধী ভাবতে যাবেন না। কেউ যদি আপনার কথা না শুনতে চায়, তাকে বলুন, আমরা কথা শুনুক  না শুনুক , শুনবার  ভান  যেন সে করে ।  তাতেও যদি কেউ আপনার কথা না শুনতে চায়, তবে আপনি গাছের সাথে কথা বলুন। আপনি দেওয়ালের সাথে কথা বলুন, আপনি চাঁদের সাথে কথা বলুন।  আপনি পাথরের মূর্তির সাথে কথা বলুন, আপনি ছবির সাথে কথা বলুন। কিন্তু কথা বন্ধ করতে যাবেন না।  

একটা গোপন কথা বলি, যখন আপনার ভিতরের আমিটা ধ্যানে বসবে, তখন আপনার ভিতরে একটা সুপ্ত সূক্ষ্ম শক্তি পাপড়ি মেলবে। আর সেই শক্তি কোনো না কোনো  আকার ধারণ করবে। হতে পারে, সেটি একটি গাছ, হচ্ছে পারে, সেটি একটি গান , হতে পারে সেটি একটা গুন্, হতে পারে সেটি একটা শিল্প। ভিতরের আমি ধ্যানস্থ হলেই, আপনার  অন্তর্নিহিত শক্তি তখন কোনো না কোনো গুনের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে। হয় আপনি নাচ শুরু করবেন, নয়  আপনি গান শুরু করবেন।  আপনি হয়তো ছবি  আঁকা শুরু করবেন। নয় আপনি কথা বলা শুরু করবেন। এটা নির্ভর করবে, আপনার ভিতরে কোনো গুনের বীজ ভগবান পুঁতে রেখেছেন তার উপরে। আপনি জানেন না, ভগবান আপনার ভিতরে কোন গুনের বীজ রোপন করে রেখেছেন ।  কিন্তু সেই গুন্ আপনার মধ্যে থেকে একদিন অংকুরিত হবে, আর তার জন্য আপনাকে কিছুই করতে হবে না।  শুধু জানবেন, আপনার মধ্যে যে সত্যিকারের অমিটা  আছে, সে এখন ধ্যানে বসেছেন।  আর এই ধ্যানস্থ মহাপুরুষ থেকে যে জ্যোতিঃ ছটা বিচ্ছুরিত হচ্ছে, তারই প্রকাশ বাইরে আপনার কাজের মধ্যে ফুটে বেরুচ্ছে। এর জন্য আপনার দুশ্চিন্তা করবার কিছু নেই। একে  আটকাতে যাবেন না। যদি দেখেন, আপনার কথায় কেউ বিরক্ত হচ্ছে, তাহলে পাথরের মূর্তির কাছে বসে যান, গাছের কাছে চলে যান, খোলা আকাশের নিচে চলে যান, আর যথেচ্ছ ভাবে এই শক্তিকে বের করে  দিন। কেউ একজন আমাদের ভিতরে এই শক্তিকে দান করেছেন। নিজেই নিজের কথা শুনুন, নিজেই নিজের নাচ দেখুন, নিজেই নিজের গান শুনুন। নিজেই নিজেকে দেখতে থাকুন। ধীরে ধীরে আপনি আপনার গভীরে প্রবেশ করবেন। আপনি তখন শুধু নিজেকেই দেখছেন। আপনাকে নিয়ে  অন্যকে চিন্তা করতে দেবেন না। আপনি আপনার মধ্যে প্রবেশ করুন । আপনি নিজেই নিজের বক্তা ও শ্রোতা হয়ে যান। কি বলছেন সেটা বড়  কথা নয়, ভালো না মন্দ সেটাও বড়ো কথা নয়।আপনার কথার কাটাছেড়া করতে যাবেন না,  বিশ্লেষণ করতে যাবেন না। মার্জিত হতে যাবেন না। ভদ্রলোক হতে যাবেন না। মন আর মুখ এক হয়ে যাক। যা কিছু মনে আসছে, তাই বলুন। মনের এই অদ্ভুত খেলাকে শুধু দেখতে থাকুন। জানবেন, এটি একটি বিষ্ময়কর ধ্যান। যা কখনো কোনো মহাপুরুষ আপনাকে বলে দেয় নি।  জানবেন, এই ধ্যানের  প্রক্রিয়া আপনার নিজের আবিষ্কার। হতে পারে, আপনাকে লোকে পাগল বলবে। কিন্তু তাতে কিছুই এসে-যায় না। যারা আপনাকে পাগোল ভাবছে, জানবেন, এটা তাদের সমস্যা, আপনার নয়। আসলে তারা নিজেরা পাগল কিনা কে বলে দেবে ? বরং আপনার মতো যদি কোনো পাগোল দেখতে পান, তবে তার কথা আপনি একঘন্টা শুনুন, আর আপনার কথা তাকে একঘন্টা শুনতে দিন। কোনো কথার সঙ্গে  কোনো কথার সম্পর্ক খুঁজতে যাবেন না। কথার  কোনো অর্থ আবিষ্কার করতে যাবেন না। শুধু শুনুন আর শোনান।  চাঁদের কথা শুনুন , মেঘের আওয়াজ শুনুন। পাখির ডাক শুনুন।  গাছের কথা শুনুন। দেওয়ালের কথা শুনুন। পাথরের মূর্তির কথা শুনুন ।  পাহাড়ের কথা শুনুন।  নদীর  কথা শুনুন। একটু মনোযোগ  দিলেই বুঝতে পারবেন, এরা  সবাই কি মনোযোগ দিয়ে আপনার কথা শুনছে। আর আপনিও এদের কথায় মনোযোগ দিন। 
ভালো কথা বলতে জানা ভালো, কিন্তু মনের কথা বলতে জানা আরো ভালো। আপনি দেখবেন, গাছ দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আছে, আপনার কথা শুনবার জন্য। নদী আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে না, আপনার কথা না শুনে। আপনি শুধু কানকে অনুভূতি সম্পন্ন করুন, তখন দেখেন, এরা সবাই ভালো ভালো কথা বলছে, যাদের কথা কেউ কোনোদিন শোনে নি। যাদের সবাই অবজ্ঞা করেছে, তারা সবাই মধুর স্বরে গান গাইছে, আপনাকে মোহিত হতেই হবে। আপনি তখন এক অন্য জগতের বাসিন্দা হয়ে যাবেন। আপনার সত্যিকারের বন্ধুর  সংখ্যা বেড়ে যাবে। আর আপনাকে সবাই আনন্দ দেবে। আপনি এক অনাবিল আনন্দের মধ্যে ডুবে যাবেন। জানবেন, ভগবানের সাথে নির্জনে একাকী কথা বলা, বা ঠাকুর কথা শোনার চেয়ে আধ্যাত্মিক উত্তম অবস্থা আর কিছু হতে পারে না। শুধু মন দিয়ে কথা বলুন, আর কান খুলে শুনুন। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম।   
-----------------                

 
















 

No comments:

Post a Comment