Monday 11 May 2020

শান্তির সন্ধান





শান্তির সন্ধান

আমরা হাজার হাজার বই পড়ি, কিন্তু নিজেকে পড়ি না। আমরা হাজার লোকের কথা শুনি কিন্তু নিজের কথা শুনি না। আমরা হাজার হাজার দৃশ্য দেখি কিন্তু নিজেকে দেখি না। আমরা সব ছেড়ে ঈশ্বরের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ি, কিন্তু নিজের সন্ধান করি না। আমরা শান্তির সন্ধান করি, সুখের সন্ধান করি, নিজের সন্ধান করি না।  কিন্তু কথা হচ্ছে, নিজের সন্ধান আবার করা যায় নাকি ? যে সন্ধান করে, তার আবার সন্ধান করা যায় নাকি ? আজ আমরা সেই মহাত্মার কথা শুনবো, যিনি নিজেকে সন্ধানের কথা বলেছেন।
এক কিশোর তার মা-বাবার হাত ধরে, মেলায় গিয়েছিলো।  তো মেলায় ভিড়ের মধ্যে মা-বাবার কাছ থেকে সে হারিয়ে গেলো। তো যখন তাকে খুঁজে পাওয়া গেলো, তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, তুই হারালি কি করে ? তো ছেলেটি বললো, বা-রে, আমি হারালাম কোথায় ? তোমরাই তো হারিয়ে গেলে। আসলে আমাদের কাছ থেকে শান্তি হারিয়ে গেছে, না আমরা শান্তির কাছ থেকে দূরে সরে গেছি ? একথাটা বোঝার চেষ্টা করবো আমরা আজকে। 

এক ভদ্রলোক, একদিন এক  মঠাধিসের কাছে গিয়ে নিবেদন করলো, আমি অতিরিক্ত টাকা-পয়সা  চাই না, আমি সন্মান চাই না, আমি যশ  চাই না, ক্ষমতা চাই না। আমি শান্তিতে বাঁচতে চাই। আমাকে দয়াকরে পথ দেখান।

মঠাধিস বললেন  : আমি কিছুই চান না, আবার শান্তিতে  থাকে চান। কে বলেছে আপনাকে যে  টাকা-পয়সা-নাম-যশ-ক্ষমতা-গাড়ি-বাড়ি-ছেলে-মেয়ে-বৌ-বন্ধু -বান্ধব-আত্মীয়-স্বজন এগুলো শান্তির অন্তরায় ? কে বলেছে যে এগুলো শান্তি  পেতে বাধা দেয় ? এগুলো নিয়েই তো অনেক মানুষ ভালো আছেন । তো আপনার সমস্যাটা  কোথায় ? দেখুন মানুষ কেন এগুলো চায় ? আনন্দের জন্য চায়। তো আপনি এগুলো চাইছেন না, তাও ওই আনন্দের জন্যই। আসল সমস্যা লুকিয়ে আছে, আপনার নিজের মধ্যে, আপনার অহংয়ের মধ্যে। আসলে আপনি একটা মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্যে আছেন, আপনি দৈন্যতার মধ্যে শান্তি খুঁজছেন, আবার কেউ প্রাচুর্য্যের মধ্যে শান্তি খুঁজছে।  পার্থক্যটা এখানে।  দুটোই মেন্টাল কমপ্লেক্স, একটা সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স, একটা ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স। দীনতার মাধ্যমে আপনি অহংয়ের পরিতৃপ্তি চাইছেন। আর অন্যরা হয়তো প্রাচুর্য্যের মধ্যে পরিতৃপ্তি চাইছে। 

ভদ্রলোক : না আমি অহং-কে জয় করতে চাইছি।

মঠাধিস : অহং-কে ক জয় করবেন আপনি ? আবার আপনি শান্তি খুঁজছেন। শান্তি খুঁজছে কে ? শান্তি খুঁজছে আপনার  অহং। আগে অহংকে ধরুন। তারপর-তো অহংকে জয় করবেন।   দেখুন অহং হচ্ছে, আমাদের "আমি"-বোধ। এই আমিকে ধরবার চেষ্টা করুন। এই আমি কে ? আমি অমুক,   আমি অমুকের ছেলে, আমি অমুকের পিতা, আমি অমুক জায়গার বাসিন্দা, আমি  IPS Officer. ইত্যাদি ইত্যাদি।  এগুলো আপনার পরিচয়। কিন্তু আপনি কি কখনো ভেবেছেন, আপনার নাম অম্বরীষ না হয়ে বীরেশ্বর হতে পারতো। অম্বরীষ বা IPS Officer জন্ম নেয় নি। আপনার বাবা আপনার নাম অম্বরীষ রেখেছে, তাই আপনি অম্বরীষ। আপনি ভালো পড়াশুনা করে, পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছেন, তাই আপনি IPS Officer . এগুলো আপনার পরিচয় মাত্র, এগুলো আপনি নন। IPS Officr একদিন আপনি থাকবেন না।  কিন্তু তখনো আপনি থাকবেন। আপনি বাড়ি পাল্টালে, আপনার ঠিকানা পাল্টে যাবে, কিন্তু আপনি থাকবেন। আপনি সুখে থাকলেও আপনি থাকবেন। আপনি দুঃখে থাকলেও আপনি থাকবেন। অর্থাৎ আপনি সুখী বা দুঃখী নন। আপনার একটা আসল সত্ত্বা আছে।  যা এই সবকিছুর উর্দ্ধে। এবং এই সত্ত্বার সহজে কোনো পরিবর্তন হয় না। আসলে এই সত্ত্বাকে কেন্দ্র করেই আমাদের চিন্তা-ভাবনা ঘুরপাক খায়।আর এই চিন্তাই  আপনি সুখী বা দুঃখী করে থাকে।  আসলে আপনার শিক্ষা, আপনার সমাজ, আপনার রুচি, আপনার সংস্কার, আপনার সৎগুন ইত্যাদি নিয়ে আপনার মধ্যে একটা ব্যক্তিত্ত্ব গড়ে উঠেছে। এই ব্যাক্তিত্ত্বকেই আপনি "আমি" বলে ভাবছেন। কিন্তু আসলে এই ব্যক্তিত্ত্ব যাকে  ঘিরে অবস্থান করছে, সেটিই আসল "আমি"। আমার ব্যাক্তিত্ত্বের পরিবর্তন আছে। আপনার কোনো পরিবর্তন নেই।  আপনি যখন কলেজে পড়তেন, তখন আপনার একরকম ব্যক্তিত্ত্ব ছিল।  আপনি যখন IPS Officer হলেন, তখন আপনার ব্যাক্তিত্ত্বের পরিবর্তন হলো। আপনি স্ত্রীর কাছে, স্বামী হিসেবে, ছেলের কাছে পিতা হিসেবে,  অফিসে বস হিসেবে, বন্ধুদের সঙ্গে বন্ধু হিসেবে আপনি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের আচরণ করছেন। আসলে আপনি "আমি"র উপরে  মনের কোনো চিন্তা বা বৃত্তি আরোপ করছেন, আর সেটাকেই আপনি "আমি" ভাবছেন।

আসলে আমাদের সুখ-দুঃখ-ভালো-মন্দ এগুলো আমাদের মানসিক বৃত্তি। আমাদের বহুদিনের অভ্যাসের ফলে আমরা ভাবতে শিখেছি, এই বৃত্তিগুলোই "আমি" । এই বৃত্তিগুলোকে বাদ  দিয়ে আসল "আমি"কে ধরবার চেষ্টা করুন। গভীর ধ্যানে অহং তার নিজস্ব অস্তিত্ত্বটুকু নিয়েই আমাদের কাছে ধরা দেয়।  সে যাই হোক, অহং আর বৃত্তি আলাদা কিন্তু অহংকে বাদ  দিয়ে শুধু বৃত্তি বলে কিছু থাকতে পারে না।  আবার এই বৃত্তি পরিবর্তনশীল। চঞ্চল মনের মানুষের ক্ষেত্রে এই বৃত্তি দ্রুত পরিবর্তিত হয়। আর স্থির মনের মানুষের বৃত্তির সহজে পরিবর্তন হয় না।

আমরা কথা বলছিলাম শান্তি নিয়ে। সাধারনতঃ সংসারী ব্যক্তি  প্রাচুর্য্যের মধ্যে শান্তি পায়। আবার সান্যাসীগণ ত্যাগের মধ্যে বা দীনতার মধ্যে শান্তি খোঁজেন । উদ্দেশ্য একই - আর তা হচ্ছে শান্তি। আবার আমরা দেখেছি, ভবিষ্যতের সুখের জন্য, আমরা বর্তমানকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখছি। শান্তির আশায়  আমরা কঠোর তপস্যা  করছি। তা সে পার্থিব বস্তু পাবার জন্যই হোক, বা অপার্থিব বস্তু পাবার জন্যই হোক। আমরা বর্তমানকে বিসর্জন দিচ্ছি কাল্পনিক ভবিষ্যতের সুখের আশায়। কাল্পনিক ভবিষ্যতের উপরে যে  আরোপিত সুখের কল্পনা সে-তো  অলীক। আবার  সেই স্বপ্ন পূরণ না হলে আমরা দুঃখী হচ্ছি। আরো একটা কারণে আমরা দুঃখী হই, সেটা হচ্ছে একঘেয়েমি। সারাক্ষন আমরা ঘরের মধ্যে থাকতে চাই না। সারাক্ষন আমরা গাছের ছায়ায় থাকতে চাই না। সারাক্ষন আমরা রসগোল্লা খেতে চাই না, তাই  এই একঘেয়েমি ভাব এলে আমাদের মন তখন নতুন বৃত্তি ওঠাতে চায়। এটাকেই আমরা বলি মনের চঞ্চলতা বা মনের অস্থিরমতি ভাব। আর এই কারণেই  আমরা একটার পর একটা আশার  জাল বুনে চলেছি। আমরা আমাদের জীবন গড়ে তুলছি, একটা কাল্পনিক দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে। তাই আমরা  সুখ, হয় কোনো স্থূল বস্তুর মধ্যে খুঁজছি অথবা সূক্ষ্ম অন্তরের মধ্যে খুঁজছি ।  এতে করে আমরা  কখনোই সত্যের সন্ধান পাবো না। কারন আমর মন   সত্যকে একটা  পরিচিত মোড়কে দেখতে চায়, যা তার কল্পনার মধ্যে এসেছিলো। কিন্তু সত্য তো কখনো দ্বন্দ্বের  মধ্যে নেই। সত্য এক ও অপরিবর্তনীয়।

যতক্ষন আমরা সুখের জন্য লালাইত  হবো, ততক্ষন আমরা সুখের সন্ধান পাবো না। যতক্ষন আমরা সুখের জন্য কিছু করবো, ততক্ষন আমাদের  সুখ  হতে পারে না।  কারন সুখ আমাদের কল্পনায়, সুখ আমাদের ভাবনায়। মন যখন বুঝতে পারবে, সুখের সন্ধান নিরর্থক, সুখের সন্ধান কেবল নতুন নতুন বন্ধনের সন্ধান দেয়, তখন মন শান্ত হয়ে যাবে। মানুষ  যখন কিছু আশা করে না, আবার যখন কিছু এড়িয়েও যায় না, তখন মানুষ শান্ত হয়ে যায়।  তখন মানুষ  নিরুদ্বিগ্ন  হয়ে যায়।

শান্তি মানে আমাদের মনের একটা অবস্থা। যেখানে মনে কোনো চিন্তা  থাকবে না। কিন্তু চিন্তাহীন মানুষ মানে তো জড় বস্তু। অথবা বলা যেতে পারে, মৃত অবস্থা। আসলে  শান্তিকে খুঁজলে হবে না। শান্তিকে বুঝতে হবে। আপনি যখনই সুখকে কাছে ডাকবেন , তখন সে দুঃখকে সঙ্গে নিয়ে আসবে। আপনি যখন শান্তিকে খুজবেন, তখন সে অশান্তিকে সঙ্গে নিয়ে আসবে। আপনি শান্তিকে না খুঁজে আপনি শান্তিকে বুঝবার চেষ্টা করুন। আসল শান্তি বাইরে নয়, যে তাকে খুঁজতে হবে।  শান্তি আমার  অন্তরে, আমরা সেটা বুঝি না। তাই  আমাদের  শান্তিকে বুঝতে হবে। কোনো বস্তুর মধ্যে, বা কোনো মানুষের মধ্যে আমরা  যে শান্তিকে খুঁজছেন, সেটি ক্ষণস্থায়ী। শুধু ক্ষণস্থায়ী নয় এটি অশান্তির লবনে মিশ্রিত। একে আপনি আলাদা করতে পারবেন না।  আমাদের অশান্তির কারন হচ্ছে, আমাদের অতৃপ্তি। অশান্তির কারন হচ্ছে বাহ্য বস্তু বা বাইরের মানুষের মধ্যে শান্তিকে খোঁজা। 

তৃষ্ণা পেলে আমাদের জল পান করতে হবে। ক্ষুধা পেলে আমাদের খেতে হবে। তৃষ্ণা মিটে  গেলে আমরা স্বস্তি বোধ করি। খিদের সময় খাবার পেলে আমরা সুস্থ বোধ করি। এই তৃষ্ণা বা ক্ষিদে যেমন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বার বার ফিরে ফিরে আসে। আর প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে  তাকে মেটাতেও হয়। যদি না মেটাতে পারি তবে আমাদের কষ্ট  হয়। এই কষ্ট আর অশান্তি কিন্তু এক নয়। এখন কথা হচ্ছে আমার তৃষ্ণা পেলে যদি শরবত খেতে হয়, খিদে পেলে যদি পোলাই-কোর্মা ক্ষেতে হয়, তবে শুরু হয়   অশান্তি । অর্থাৎ আমার প্রয়োজন ও চাহিদার মধ্যে ফারাক হচ্ছে।   গোলযোগটা এইখানেই।   আমরা কি করি, আমাদের মনের অতৃপ্তি দূর করতে চাই, অন্য একটা বৃত্তি উঠিয়ে। প্রথমে ভেবেছিলাম, ভালো রেজাল্ট। তারপর ভেবেছি, ভালো চাকরি, তার পর ভেবেছি, ভালো সংসার। ভালো বাড়ি, গাড়ি।  মনের খেলা লক্ষ করুন। আজ আপনি আমার কথা শুনে বুঝতে চাইছেন, কাল অমুক বই পড়ে জানতে চাইছেন।  এই বিভিন্ন মতামত নিচ্ছেন, এর মধ্যে আপনার যেটি পছন্দ হচ্ছে, সেটিকে আপনি বেছে নিতে চাইছেন। কিন্তু সত্য কখনো বাছাবাছির বিষয় নয়। অর্থাৎ আপনি সত্যকে নিজের মতো করে দেখতে চাইছেন। মানুষ নিজের কাছে যেটা পছন্দ হয়, সেটাই সে গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু সত্য যে আপনার মনের মতো হবেই, তার কোনো মানে নেই। এখন কথা হচ্ছে, আমরা তো পাঁচজনের কথা শুনে, বা পাঁচটা বই পড়ে , বিচার করে তবেই সঠিকটাকে  ধরতে পারবো।  তাই নয় কি ?  দেখুন বিচার করা তখনই সম্ভব যখন আপনার নিজের মধ্যে যে ভালো-মন্দ ধারণা আছে, সেটাকে সরিয়ে রেখে বিষয়টিকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখতে পারবেন । সুতরাং দরকার যেটা সেটা হচ্ছে, বোঝা, পছন্দ বা অপছন্দ নয়। আপনি হয়তো শান্তি খুঁজছেন, কোনো কাজের মধ্যে। বা আপনি হয়তো শান্তি খুঁজছেন কোনো জ্ঞানের মধ্যে। অথবা আপনি হয়তো শান্তি খুঁজছেন কোনো বিষয়ের মধ্যে, বা মানুষের মধ্যে । অর্থাৎ একটা ধারাবাহিক শান্তির আশা নিয়ে আমরা  বিভিন্ন  উপায়ের সন্ধান করছি ।  আর আমরা সত্য বলতে কি, ধারাবাহিক ভাবে অশান্তির মধ্যে ডুবে যাচ্ছি। একটা আশা যখন মানুষকে   সম্পূর্ণ তৃপ্তি দিলো, তখন মানুষ আবার অন্য আশা নিয়ে ঘুরতে থাকে। আসলে সমস্ত আশা তো মনের কল্পনা। আর আশা না মিটলেই হতাশা। হতাশা থেকে আবার নতুন আশা। 
  
কিন্তু কথা হচ্ছে, তাই বলে  কি আমরা কোনো আশা করবো না।  আশা না থাকলে  মানুষ বাঁচবে কি করে ? দেখুন কর্ম্মই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে।  আশা নয়। লক্ষ নিয়ে কর্ম্ম করা আর আশা নিয়ে কর্ম্ম করা এক নয়। লক্ষ পূরণের জন্য আমাদের পরিস্থিতির দাস হতে হয় না। আমরা তখন পরিস্থিতিকে  অনুকূল করে নেই।  কিন্তু আশা নিয়ে কর্ম্ম করতে গেলে আমরা পরিস্থিতির দাস  বোনে যাই। দেখুন আমরা কি চাই ? দুটো জিনিস আমরা চাই এক) আমাদের দৈহিক অস্তিত্ত্ব ; দুই) আমাদের মানসিক তৃপ্তি। দৈহিক অস্তিত্ত্ব বজায় রাখবার জন্য, আমরা দেহের যা প্রয়োজন তা অর্জন করবার চেষ্টা করি। অর্থাৎ অন্ন ঔষধ ইত্যাদি। আর এই অন্ন -ঔষধ পাবার জন্যই আমরা পড়াশুনার প্রস্তুতি নেই, পরীক্ষা দেই , চাকরি করি, বিয়ে করি, সন্তান উৎপাদন করি ইত্যাদি ইত্যাদি। আর মানসিক তৃপ্তি খুঁজি আমরা সমাজের মধ্যে। আমি প্রতিষ্ঠা চাই, আমি ক্ষমতা চাই। আর সেই কারণেই আমি IPS/IAS/ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মন্ত্রী হতে চাই। অর্থাৎ সামাজিক স্বীকৃতির নিরিখেই আমি তৃপ্তি খুঁজছি। আর এখান থেকেই শুরু হয় আমাদের মধ্যে স্ব-বিরোধিতা। এখন কথা হচ্ছে সমাজের উপরে যদি আমার তৃপ্তি নির্ভর করে, তবে আমাদের সমাজের রীতি-নীতি মেনে নিতে হবে। অর্থাৎ এক কথায় সমাজের সঙ্গে আমাদের  আপোষ করতে হবে। সমাজ কেন একজন ঝাড়ুদারকে সমাজের উচ্চস্থান দেবে না, সে প্রশ্ন করা চলবে না। সমাজ যাকে স্বীকৃতি দেয়, আমাকে তাই হতে হবে। আমি যা চাই, অর্থাৎ আমার যা ভালো লাগে সেটা হলে. সমাজ আমাকে স্বীকৃতি দেবে না। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, আমি আমাতেই পূর্ন  হতে চাই। আমার স্বকীয়তাতেই স্বাধীনতা, আমার স্বকীয়তাতেই আমার পূর্নতা, আমার শান্তি। তাই আমাদের  স্বকীয়তা যখন সমুজ্বল হয়ে ওঠে তখন আমরা আসলে শান্তি পেতে পারি। আমাদের মানসিক পূর্নতার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে   আমাদের মানসিক শান্তি। অন্যের স্বীকৃতির জন্য, সামাজিক স্বীকৃতির জন্য, আমি নেতা হতে চাইছি, সরকারি পদাধিকারী হতে চাইছি। অন্যের হাততালিকে আমি গুরুত্ত্ব দিচ্ছি।  আমার স্বীয় প্রজ্ঞা এখানে গুরুত্ত্বহীন হয়ে গেছে। 

কিন্তু কথা হচ্ছে,  উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা না হয় বাদ  দিলাম। শান্তির আশা তো করতেই পারি। দেখুন আশা করলেই হতাশা থাকবে। সুখ চাইলে তার সঙ্গে দুঃখ আসবেই। সেইজন্য আমাদের দরকার হচ্ছে, শান্তিকে বোঝা, শান্তিকে খোঁজা  নয়। কামনাই আমাদের সব অশান্তির কারন। আমাদের কামনা যেদিন থাকবে না, সেদিন আমার অশান্তিও থাকবে না।  কিন্তু মানুষের পক্ষে কি কামনা দূর করা সম্ভব ? দেখুন জোর করে কামনাকে তাড়ানো যাবে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনার ধারণার যত  পরিবর্তন হবে, তত আপনি কামনা রহিত  হতে পারবেন। ধরুন, আপনি ছোটবেলায় খেলনা গাড়ি, বা খেলনা বন্দুক, বা পুতুল খুব ভালোবাসতেন।  বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আপনার মধ্যে ধারণার পরিবর্তন হয়েছে, এখন আপনি আর সেই খেলনা গাড়ি বা বন্দুকের প্রত্যাশা করেন না।  এগুলো আপনার কাছে এখন ছেলেমানুষি মনে হয়।  এর জন্য কিন্তু আপনাকে আলাদাকরে কিছুই করতে হয় নি। এমনি এমনি চলে গেছে ? না আপনার মধ্যে একটা নতুন ধারণার জন্ম নিয়েছে। আর পুরুনো ধারণা বদলে গেছে।  অর্থাৎ এখন আপনি, বাড়ি-গাড়ি-টাকা- পয়সা এসবের প্রত্যাশী হয়েছেন। কিন্তু আপনার যখন আরো বয়স হবে, তখন দেখবেন,  আপনার আজকের গুরুত্ত্বপূর্ন জিনিসগুলোর প্রতি আকর্ষণ কমে গেছে, বা একেবারেই নেই। তখন আপনার কাছে হয়তো অন্য চাহিদা হয়েছে। হয়তো এখন আপনি স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে-নাতি-নাতনির ভালোবাসার প্রত্যাশী হয়ে গেছেন। এগুলো আপনার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হয়েছে, বা আপনার মধ্যে ধারণার পরিবর্তনের জন্যই হয়েছে, এর জন্য আপনাকে আলাদা করে কিছু করতে হয় নি। এর পরের ধাপই  হচ্ছে হচ্ছে ঈশ্বরের ভালোবাসার জন্য কাঙাল হয়ে যাওয়া। ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা। এবং  এটাই পরিণতি।  এইখানে আপনাকে যেতে হবে। এখন সেটার জন্য, বা সেই অবস্থার জন্য আপনি বছরের পর বছর অপেক্ষা করবেন, না এখনই নিজেকে  তৈরি করবেন, সেটা আপনার ব্যাপার।  স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলুন। মায়ের কোলে ফিরে যান। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই বয়সে সেটা কি করা সম্ভব ? হ্যাঁ এর জন্যই দরকার আমাদের ধ্যান। ধ্যানের  মধ্যে "আমি" কে ধরবার চেষ্টা করুন। প্রথমদিকে আমরা আমাদের বৃত্তিগুলোকেই দেখতে পাবো। এই বৃত্তিগুলোকে ওল্টাতে থাকুন। ওল্টাতেও; ওলটাতে একসময় "আমি" সত্ত্বাকে ধরতে পারবেন। আর আমিকে যখন ধরতে পারবেন, তখন আপনার মন শান্ত হয়ে যাবে। এইসময় মন বৃত্তিগুলোকে আঁকড়ে থাকতে চায়। ধীরে ধীরে মন বুঝতে পারে, বৃত্তিগুলো আমার ভাবমূতি মাত্র, আমি নয়। এবং এই বৃত্তি বা ভাবমূর্তি সতত পরিবর্তনশীল। তথাপি সে মনে করে, আমার ভাবমূর্তি চলে গেলে আমি ধংশ হয়ে যাবো। ছোট্ট নরেনের একসময় এইরকমই মনে হয়েছিল, যখন ঠাকুর চৈতণ্যানুভূতির অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিলেন, নরেনের শরীরে। আমাদের ধ্যান যত  গভীর হবে, তত আমরা ঈশ্বরের ভালোবাসার জন্য ব্যাকুল হবো। আর জাগতিক বস্তুর প্রতি আমাদের মায়া-মোহ-লোভ-লালসা যা আমাদের দুঃখের কারন, সেগুলো দূর হয়ে যাবে। য্খনই নিজের মধ্যে অতৃপ্তি আসবে, ভালো করে বিশ্লেষণ করতে থাকুন সেই  অতৃপ্তি বোধকে। এগুলোকে সরাবার চেষ্টা না করে, দরকার শুধু বোঝা। সমস্যাকে ধরবার চেষ্টা করুন, তবেই সমস্যা বিলীন হয়ে যাবে আর সমস্ত মন জুড়ে নেবে আসবে এক অপূর্ব শান্তি। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।      
      

No comments:

Post a Comment