Tuesday 17 December 2019

প্রশ্ন উপনিষদ


 প্রশ্ন উপনিষদ - ১
প্রাণী কোথা থেকে  আসে, আবার কোথায় চলে যায় ?
ভালোকথা শুনতে কার না ভালো লাগে। কিন্তু ভালো কথা বলার লোক কোথায়  ? আর ভালো বলতেই বা আমরা কি বুঝি ?  আসলে ভালো বলতে আমরা  সেই কথাই বুঝি, যা আমার পছন্দের কথা। কিন্তু সত্য হচ্ছে, যা আমাদের পক্ষে কল্যাণকর, সেটাই ভালো কথা । আমাদের দর্শন শাস্ত্রগুলো একটা একটা কঠিন হীরের খন্ড । এর থেকে রস বার করা ভীষণ শক্ত। আর এই সব শাস্ত্র বুঝতে গেলে, আমাদের ভাষার উপরে দখল চাই, পান্ডিত্য চাই, আর চাই গভীর মনোযোগ। বিষয় বা ভাষা যদি খটোমটো   হয়, তবে মনোযোগ দেওয়া খুব কঠিন। তাই আমরা একটু সহজ করে বুঝবার চেষ্টা করবো, কঠিন বিষয়গুলোকে। 

প্রশ্ন হচ্ছে কোথা থেকে আমরা এসেছি ? আবার কোথায় চলে যাবো  ? অর্থাৎ প্রাণীসকল কোথা থেকেই বা  আসে আর কোথায় যায়  ?  আমাদের এই জীবনের উৎসই বা কি ? ঠিক এরকম একটা প্রশ্ন করেছিলেন, কবন্ধী নামক  এক জিজ্ঞাসু  ঋষিগুরু  পিপ্পলাদকে। ঋষি পিপ্পলাদ এর উত্তরে যা বলেছিলেন, তা "প্রশ্ন" উপনিষদ নাম খ্যাত। আমরা সেই প্রশ্ন উপনিষদ থেকে পিপ্পলাদের মুখে শুনবো, এই প্রশ্নের উত্তর। প্রাণী কোথা থেকে আসে, আবার কোথায় চলে যায়  ?

ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন - প্রজাপতির সন্তান সৃষ্টির ইচ্ছে হলো। সেই উদ্দেশ্যে তিনি তপস্যা শুরু করলেন। এবং তিনি এই জ্ঞান লাভ করলেন যে, যদি অন্ন থাকে আর সেই অন্নের একজন ভোক্তা থাকেন, তবে তারা সম্মিলিত ভাবে বহু সন্তান সৃষ্টি করতে পারবে। 

এখন কথা হচ্ছে এই প্রজাপতি কে ? তাকেই বা কে সৃষ্টি করলো ? দেখুন প্রজাপতি কোনো ব্যক্তি নন। 
প্রজা কথাটার মানে যা সৃষ্টি হয়েছে। পতি  কথাটার মানে স্বামী বা প্রভু। ইনি  কোনো ব্যক্তি নন। যেখানে বা যার কাছে, সৃষ্টির বীজ সংগ্রহীত থাকে তাকে  বলে প্রজাপতি। এই সংগ্রহশালায় কোটি কোটি তাক, কোটি কোটি খোপ। সীমাহীন মৌচাক।   অর্থাৎ এটি একটি সীমাহীন  সংগ্রহশালা। অর্থাৎ এটি একটি বৃহত্তর শক্তিমাত্র যা সৃষ্টির বীজকে যুগ  যুগান্তর ধরে বয়ে নিয়ে চলেছে।  আসলে প্রাণের কোনো সৃষ্টি নেই, প্রাণের কোনো বিনাশ নেই। কখনো এটি কারণরূপে বা বীজ আকারে আছে, আবার কখনো কার্যরূপে প্রতীয়মান হচ্ছে। পিতা থেকে সন্তান আবার সন্তান থেকে পিতা। বীজ থেকে গাছ আবার গাছ থেকে বীজ। ডিম্ থেকে মুরগী আবার মুরগী থেকে ডিম্। এটি একটি প্রবহমান ধারা। কালের অতীত এই ধারা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বয়ে চলেছে। এর না আছে শুরু, না আছে শেষ। কখনো কারণে লয় হয়ে আছে, কখনো প্রকাশিত হচ্ছে । জগৎ কারুর সৃষ্টি নয়, জগৎ একটা অভিব্যক্তি মাত্র। এটি কখনো প্রকাশিত, কখনো অপ্রকাশিত। চন্দ্র তার আদ্রতা দিয়ে, অন্ন সৃষ্টি করেন। সূর্য্য তাকে অর্থাৎ অন্নকে  টেনে তোলেন। তাই চন্দ্রকে বলে অন্ন আর সূর্যকে বলা হয় অন্যের ভোক্তা। প্রাণ এবং অন্ন দুটি পৃথক বস্তু নয়, রূপের পার্থক্য মাত্র। প্রতিযুগে কত কিছু  আসে যায়, আবার কল্পান্তে সেসব বীজ আকারে উৎসে ফিরে যায়। এযেন সেই অন্ধ পাগলি বুড়ির মতো, যা কিছু পায়, যা কিছু সে অবহেলায় থাকতে দেখে, সব সে তার ঝুড়িতে ভরে রাখে। এক এক সময় সে সব আবার সে মাটিতে ছড়িয়ে ফেলে। তখন সেই বীজ থেকে অংকুর হয়ে গাছ জন্মায়। গাছ বড় হয়, ফল দেয়, বীজ হয়, আবার সে মরে যায়।  বুড়ি আবার গাছের নিচে আসে অবহেলায়  ছড়িয়ে থাকা ফল-বীজ ঢুকিয়ে রাখে ঝোলার মধ্যে। 

জীবন এই ভাবেই চক্রাকারে ঘুরপাক খাচ্ছে। জন্ম থেকে মৃত্যু আবার মৃত্যু থেকে জন্ম। কার্য্য থেকে কারন, আবার কারন থেকে কার্য্য। প্রাণের না আছে সৃষ্টি না আছে লয়।  না আছে জন্ম না আছে মৃত্যু। একবার প্রকাশিত একবার অপ্রকাশিত। একবার বীজ একবার গাছ। একবার কার্য্য, একবার কারন। কারণে অপ্রকাশিত, কার্য্যে প্রকাশিত। 

বেদান্ত বলছে, এই প্রজাপতি এসেছেন ব্রহ্ম থেকে।  মৌচাকের খোপগুলো প্রজাপতি। এখানেই বীজ। এখানেই মধু। খোপ যেমন একাধিক, প্রজাপতিও একাধিক। আমরা সবাই একএকটা প্রজাপতি। আমরাই বীজের আকার ধারণ করি। আবার আমরাই গাছে পরিণত হই। ব্রহ্মার কোনো ইচ্ছে বা আকাঙ্খা নেই। তাই তিনি নির্গুণ।   কিন্তু আমার বা প্রজাপতির আছে। প্রজাপতি থেকে সৃষ্টি হয়, আবার প্রজাপতিতেই ফিরে যায়। প্রজাপতি কোনো চেষ্টা করেন না। তিনি কেবল সংকল্প করেন, তিনি কেবল চিন্তা করেন। তাঁর এই সৃষ্টির সংকল্প-চিন্তা থেকেই চন্দ্র-সূর্য্যের যুগলবস্তু প্রকাশিত। চন্দ্র অর্থাৎ রয়ি বা অন্ন বা খাদ্য। আদ্রতা চন্দ্রের বিশেষত্ব। যা সবকিছুকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। আবার অন্ন থাকলে তার একজন ভোক্তা থাকবে।  সেই ভোক্তা হচ্ছেন সূর্য। এই সূর্যই প্রাণ। আর এই প্রাণের প্রকাশ ত্রিবিধ। সূর্য, ভূতাগ্নি, জঠরাগ্নি। এই জঠরাগ্নি আমাদের খাদ্য হজম করায়। ভূতাগ্নি ভূতকে দাহ  করে। সূর্য গ্যাসীয় পদার্থকে দাহ করে, যাকে  আমরা হিলিয়াম  গ্যাস বলি। প্রাণ আসে সূর্য থেকে, খাদ্য যা আমাদের বেঁচে থাকতে  সাহায্য করে, তা আসে চন্দ্র থেকে। আবার এই চন্দ্র সূর্য পৃথক নয়, শুধু নাম আর রূপেই পার্থক্য মাত্র । 

উপনিষদ বলছেন, জগতে দুটো বস্তূ প্রাণ ও অন্ন।  আর দুটোই প্রাণীর  খাদ্য। আবার প্রাণ খাদ্যকে অর্থাৎ অন্নকে গ্রহণ করে। প্রাণ হচ্ছে সূক্ষ্ম খাদ্য, অন্ন হচ্ছে স্থূল খাদ্য।  আপাত দৃষ্টিতে এই দুটো আলাদা মনে হলেও, তারা এক, আলাদা নয়। প্রাণ ও খাদ্যের মিলিত সত্ত্বাই প্রাণী। 

সূর্যই সমস্ত কিছুকে প্রকাশ করেন ।  সূর্যই জীবের অন্তরাত্মা। জগতের সব রূপই সূর্য্যের রূপ। সূর্যের তেজ প্রকাশকে  যে বস্তু প্রতিফলিত করতে  অক্ষম সেই বস্তু ভূতে পরিণত হয়।  তাই মানুষ মারা গেলে ঠান্ডা হয়ে যায়। দেহের উত্তাপ জীবনের লক্ষ্মণ। প্রাণের লক্ষণ। এই প্রাণ যখন অগ্নি রূপে থাকেন, তখন তিনি আধিভৌতিক, অর্থাৎ পদার্থগত। আবার এই প্রাণ যখন জীবন তখন আধ্যাত্মিক। তাই প্রাণ আমাদের আয়ু প্রদান করে, আর এটি প্রাণের  প্রকাশক্ষন, অর্থাৎ কতদিন প্রাণী বেঁচে থাকবে  তা  স্থির করে, আবার গ্রহণ করে বা অপ্রকাশের ক্ষণ ঠিক করে, বা মৃত্যুক্ষণ ঠিক করে। 

এই সূর্যই আমাদের প্রাণের উৎস।  এই সূর্যই আমাদের জ্ঞানের উৎস। আপনারা যারা বেদ  পড়েছেন তারা জানেন, বেদে কেবলই সূর্য্যের উপাসনা, তা সে প্রতক্ষ্য হোক বা অপ্রত্যক্ষ হোক। সূর্যকে সর্ব্ব দেবতার উর্দ্ধে স্থান দেওয়া হয়েছে। যারা সেই বিখ্যাত মন্ত্র গায়ত্রী, শুনেছেন তারা জানেন। এই  মন্ত্রে জ্ঞানের প্রতীক সেই সূর্য বা সাবিতদেবকে আহ্বান করা হচ্ছে। সূর্যদেবের কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে। উপনিষদে সূর্যকে বলা হচ্ছে, বিশ্বরূপং (সমস্ত রূপ), হরিণং, (উজ্জ্বল)  জাতবেদসম (সর্বজ্ঞ) পরায়নম (সকলের আশ্রয়) একং জ্যোতিঃ (একমাত্র আলো ) ।

আবার আমরা প্রজাপতির কথায় ফিরে যাই। এই প্রজাপতি সংবৎসর, অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা ।  দুই পথে তার যাতায়াত।  উত্তর ও দক্ষিণ। জগতে দুই শ্রেণীর মানুষ আছেন, একদল জ্ঞান লাভের  জন্য, কর্ম্ম
করেন, অর্থাৎ ঈশ্বর চিন্তন করেন।  আর এক শ্রেণীর মানুষ আছেন, যারা সন্তান লাভের   জন্য কর্ম্ম করেন। অর্থাৎ বিষয় চিন্তায় মগ্ন থাকেন।   আর এদের জন্য পথও দুটো। একটা উত্তরায়ণ আর একটা দক্ষিণায়ন। সূর্য যখন দক্ষিণ গোলার্ধে থাকে তখন দক্ষিণায়ন। একেই বলে চন্দ্রের পথ। আবার সূর্য যখন উত্তর গোলার্ধে থাকে তখন তাকে বলে উত্তরায়ণ। এই পথ হচ্ছে সূর্য্যের পথ।

জ্ঞান লাভের পথই সূর্য্যের পথ। অর্থাৎ আলোর পথ। আর ভোগ বিলাসীর জন্য চন্দ্রের পথ। অর্থাৎ অন্ধকারের পথ। উত্তরমার্গীগন অর্থাৎ আলোর পথের যাত্রী, ধীরে ধীরে আদিত্যপদ লাভ করেন। আদিত্য সমস্ত প্রাণীর আশ্রয়। এটাই প্রাণীর সর্ব্বোত্তম অবস্থা। একবার এই পদ লাভ হলে মানুষ আর ফিরে আসে না। আত্মানম্ অন্বিষ্য। আত্মাকে অনুসন্ধান করো। কিন্তু এই আত্মাকে অনুসন্ধান করবো কি করে ? উপনিষদ বলছেন,  তপস্যা ও কৃচ্ছ্র সাধনার দ্বারা।

অন্যদিকে ভোগ বিলাসীরা চন্দ্র পথের যাত্রী। অর্থাৎ অন্ধকারের যাত্রী। এরা বার বার ফিরে ফিরে আসেন। আর সুখ-দুঃখ ভোগ করেন।  চন্দ্রের পথ অন্ধকার আচ্ছন্ন। চাঁদ সব সময় বদলাচ্ছে।  কখনো পূর্ণচন্দ্র। কখনো অর্দ্ধচন্দ্র আবার  কখনো অমাবস্যা।  সূর্য্যের কোনো পরিবর্তন নেই। চন্দ্রের ক্ষয়-বৃদ্ধি আছে সূর্য্যের ক্ষয়-বৃদ্ধি  নেই। আমরা যদি নিজেকে মৃত্যুর অধীন মনে করি, তবে সব সময় ভয় আমাদের তারা করে বেড়াবে। আর যদি আমরা যদি নিদেরকে শ্বাশত আত্মা মনে করি, তবে আমরা নির্ভয় থাকতে পারবো। 

অন্নই প্রজাপতি। অন্ন থেকে আসে প্রাণের বীজ। এই বীজ থেকে সমস্ত প্রাণীর জন্ম। আবার প্রাণী থেকে প্রাণ বেরিয়ে গেলে অন্নে পরিণত হয়ে যায়। অন্ন থেকে আবার প্রাণের বীজ। এই চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে প্রাণী জগৎ। একেই বলে জন্ম মৃত্যুর চক্র। আত্মজ্ঞান এই চক্র  থেকে বেরিয়ে যাবার উপায়। উপনিষদ এই শিক্ষাই  দেয় আমাদের। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি  ওম।

 প্রশ্ন উপনিষদ -২

কথায় বলে কান টানলে মাথা আসে। ঠিক তেমনি প্রাণ টানলে আত্মা আসে। আসলে সরাসরি আমরা ঈশ্বরের কাছে যেতে পারি না। তাই ঈশ্বরের সঙ্গে যিনি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, আমরা তার সঙ্গে ভাব জমাতে চাই। যাতে একসময় আমরা ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে যেতে পারি ।  আমি অনেক গো-পালককে দেখেছি, গরুর বাচ্চাটাকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছেন, আর পিছন পিছন মা-গরু আপনা আপনি আসছে। তাই আমরা যদি প্রাণ সম্পর্কে ভালো ভাবে জানতে পারি, তবে আমাদের ঈশ্বর জ্ঞান স্বভাবিক ভাবেই এসে যাবে।   তাই আধ্যাত্মিক সাধকদের কাছে প্রাণের খুব কদর। বাহ্যিক দিক থেকে দেখতে গেলে, সমস্ত সাধক এই প্রাণের সাধনাই করে থাকেন। আজ আমরা এই প্রাণের কথা শুনবো। প্রাণ কোথা থেকে আসে?  তিনি কি ভাবে শরীরে প্রবেশ  করেন ? কি ভাবে তিনি সারা শরীরে ছড়িয়ে যান ?  কি ভাবে তিনি শরীরকে কর্মক্ষম করেন। কি ভাবেই বা তিনি আবার শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যান ? কি ভাবে তিনি প্রাণী ও পদার্থসমূহকে ধারণ করেন ? আমাদের যে ইন্দ্রিয়শক্তি আছে, তা কিভাবে এই প্রাণকে আশ্রয় করে থাকে ? ঠিক এই প্রশ্নগুলো করেছিলেন, অশ্বলপুত্র  ঋষি পিপ্পলাদকে। আমরা সেই সব কথা শুনবো। কিন্তু তার আগে শুনে নেবো, আমাদের শরীরের মধ্যে যে ইন্দ্রিয়গুলো আছে, যাদের সাহায্যে আমরা বহির্জগতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখি তার  সঙ্গে আমাদের প্রাণের সম্পর্ক কি ? আর এসব কথাই শুনবো  আমরা ঋষি পিপ্পলাদের কাছ থেকে। 


ইন্দ্রিয় ও প্রাণের কথা  আমরা শুনছি প্রশ্ন উপনিষদের কথা। প্রশ্ন কথাটার অর্থ হচ্ছে জিজ্ঞাসা। আমাদের মতো সাধারণের মানুষের মধ্যে মাঝে মধ্যে নানান রকম প্রশ্ন জেগে ওঠে । প্রশ্ন উপনিষদে এই সাধারণ মানুষের প্রশ্নগুলোকে নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ভৃগুবংশীয় ভার্গব। প্রশ্নটা খুবই সাধারণ। ভার্গব বলছেন, হে গুরুদেব, কয়টি ইন্দ্রিয় প্রাণীর দেহকে ধারণ করে থাকে ? তার মধ্যে কোন ইন্দ্রিয় দেহকে প্রকাশ করে থাকে ? আবার ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে কোনটি প্রধানতম ? 
ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন।  এই আকাশের মধ্যে আছেন বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী, বাক, মন, চক্ষু ও কান। এঁরা সবাই দেবতা অর্থাৎ বিশেষ গুনের অধিকারী। এরাই বানম বা দেহকে বলিষ্ঠ করে। বানম  অর্থাৎ অস্থায়ী।  দেহের কর্ম্ম শেষ হলে  যেহেতু দেহের নাশ হয়। তাই দেহকে বলছেন বানম।

আমরা জানি আমাদের এই দেহ পাঁচটি উপাদানে গঠিত। অর্থাৎ আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল ও পৃথিবী এই পাঁচটি উপাদানে এই প্রাণীদেহ গঠিত। আবার এই পাঁচটি উপাদান দিয়েই তৈরি হয়েছে, আমাদের কর্ম্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞান ইন্দ্রিয়। কর্ম-ইন্দ্রিয় অর্থাৎ বাক(মুখ), পাণি(হাত), পাদ(পা), পায়ু (মল-মূত্র), উপস্থ (জনন-ইন্দ্রিয়) । আর জ্ঞান ইন্দ্রিয়গুলো হচ্ছে, চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক। এছাড়া আর একটা ইন্দ্রিয় আছে, তা হচ্ছে আমাদের মন। আর এই সব কিছুর পিছনে আছেন আমাদের প্রাণশক্তি বা জীবনীশক্তি। এর মধ্যে প্রাণ-ই সবথেকে শ্রেষ্ট। এই প্রাণের ক্রিয়াতেই জীবন শুরু হয়।  আবার প্রাণের ক্রিয়াশেষে জীবনের শেষ। 

ঋষি পিপ্পলাদ একটা গল্পের মাধ্যমে, প্রাণের শ্রেষ্ঠত্ব বুঝিয়েছেন। বলছেন, একবার ইন্দ্রিয়সকল দাবি করলো, যে তারাই দেহকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সক্রিয় রেখেছে। তারা বলছে, আমরাই দেহকে ধারণ করে আছি। তো প্রাণ বললো, এইভাবে তোমরা মোহগ্রস্থ হয়ো না, অহংকার কোরো না। আমার শক্তিতেই তোমাদের শক্তি। আমিই নিজেকে পাঁচ ভাগ করে এই দেহকে  ধারণ করে আছি।  আর আমার এই পাঁচ ভাগ হচ্ছে, প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান।  প্রাণের কাজ হচ্ছে শ্বাস গ্রহণ ও শ্বাস  ত্যাগ করা । অপানের কাজ হচ্ছে, খাদ্য বস্তু থেকে অসার পদার্থ বর্জন করা।  ব্যান দেহের স্নায়ুকে ক্রিয়াশীল করে। উদ্যান দেহের তাপ রক্ষা করে, সমান খাদ্যকে হজম করতে সাহায্য করে। এই পাঁচটি শক্তি দ্বারা আমি অর্থাৎ প্রাণ দেহকে সচল রাখি, ও কারক্ষাম রাখি। 

তো প্রাণের এসব কথায়, ইন্দ্রিয়গণ কর্নপাত  করলো না। তারা তাদের অহংকারে মত্ত হয়ে রইলো। প্রাণ এতে ক্ষুব্ধ হলো, এবং দেহ ছেড়ে বেরিয়ে যাবার ভান করলো। যেই না প্রাণ বেরিয়ে যাবার উপক্রম করলো, তখন ইন্দ্রিয়গণ শক্তিহীন হয়ে পড়লো। ত্রাহি ত্রাহি রব শুরু হয়ে গেল। উপনিষদ বলছেন, মৌচাক থেকে যখন রানী মৌমাছি বেরিয়ে যায়, তখন সব মৌমাছি তাকে অনুসরণ করে। শরীর  থেকে প্রাণ যদি বেরিয়ে যায়, তবে ইন্দ্রিয়সকলও প্রাণের সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হয়।  তারা কেউই প্রাণ বিহীন দেহে থাকতে পারে না। প্রাণ ছাড়া তাদের কোনো কর্ম্ম ক্ষমতা থাকে না। সমস্ত ইন্দ্রিয় এমনকি মনও প্রাণের শক্তিতে সক্রিয় থাকে। 

ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, এই প্রাণ-ই পৃথিবী, প্রাণই চন্দ্র, প্রাণই সূর্য, এমনকি মেঘ-বৃষ্টি-বায়ু, সব-ই প্রাণের অন্তর্গত। প্রাণ কার্যরূপে স্থূল, আবার কারন রূপে সূক্ষ্ম। স্থূল-সূক্ষ্ম যা কিছু পদার্থ সবই প্রাণ।  তাই প্রাণ অমর - চিরস্থায়ী। 

এই প্রাণ-ই সূর্য-রূপে বাইরে উত্তাপ বিকিরণ করছেন, আবার অগ্নি-রূপে শরীরের ভিতরে উত্তাপ রক্ষা করছেন। এই প্রাণের সাহায্যে যেমন তাপ-আলো উৎপাদন হচ্ছে, তেমনি মেঘ, বৃষ্টি, অন্নের সৃষ্টি হচ্ছে। তাই প্রাণ হচ্ছে, অমৃত, সমস্ত জীবের আশ্রয় এই প্রাণ। 

জ্ঞান অর্থাৎ সমস্ত বেদাদিও এই প্রাণকে আশ্রয় করে অবস্থান করছেন। প্রাণেই সবকিছু প্রতিষ্ঠিত। "প্রাণে সর্বং প্রতিষ্ঠিতম।" আমরা যা কিছু শুনছি, দেখছি, এমনকি অনুভব করছি, সবই প্রাণের প্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। 

প্রাণ প্রজাপতি রূপে মাতৃগর্ভে অবস্থান করে। প্রাণ-ই পিতা-মাতার রূপ নিয়ে, সন্তান হয়ে জন্মায়। ইন্দ্রিয়গণ আসলে প্রাণের জন্য উপহার নিয়ে আসে। চোখ নিজের জন্য কিছু  দেখে না। কান নিজের জন্য কিছু শোনে না। সমস্ত ইন্দ্রিয় আসলে প্রাণের জন্য উপহার সংগ্রহ করছে মাত্র। প্রাণ-ই দেবতা, আর তাকে আহুতি দিচ্ছে ইন্দ্রিয়সকল। আসলে ইন্দ্রিয়গণ বাহক মাত্র। ইন্দ্রিয়গুলো আসলে যেন এক এক জন ঋষি। ঋষিরা যেমন আমাদের সত্য উপলব্ধি করতে সাহায্য করেন , ইন্দ্রিয়গণ তেমনি আমাদের এই জগৎকে জানতে সাহায্য করে।  প্রাণশক্তি ইন্দ্রিয়কে সঠিক ভাবে চালনা  করে, সত্যকে জ্ঞাত হচ্ছে। প্রাণ-ই সমস্ত প্রাণীগণের পিতা, প্রাণ-ই সমস্ত ইন্দ্রিয়গনের পিতা। আমাদের দেখা, শোনা, কথাবলা, চিন্তা করা, এমনকি আমাদের যত  মানসিক কর্ম্ম আছে, সবই এই প্রাণের জন্যই সম্ভব হচ্ছে। প্রাণ ছাড়া আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয় অকেজো। জগতে যা কিছু আছে, সবই প্রাণ রক্ষা করছে। প্রাণের নিয়ন্ত্রনেই জীব জগতের সমস্ত কার্য্য সম্পাদিত হচ্ছে। মা যেমন সন্তানকে রক্ষা করেন, প্রাণ তেমনি আমাদের সকলকে রক্ষা করছেন। অতএব আসুন আমরা প্রানেরই উপাসনা করি। 

প্রশ্ন উপনিষদ -৩

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, প্রাণ কোথা থেকে আসে?  তিনি কি ভাবে প্রবেশ শরীরে করেন ? কি ভাবে তিনি আমাদের  সারা শরীরে ছড়িয়ে যান ?  কি ভাবে তিনি শরীরকে কর্মক্ষম করেন। কি ভাবেই বা তিনি আবার শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যান ? কি ভাবে তিনি জীব  ও পদার্থসমূহকে প্রাণ ধারণ করেন ? আমাদের যে ইন্দ্রিয়শক্তি আছে, তা কিভাবে এই প্রাণকে আশ্রয় করে থাকে ? ঠিক এই প্রশ্নগুলো করেছিলেন, অশ্বলপুত্র কৌসল্য ঋষিগুরু পিপ্পলাদকে। আমরা এই ঋষি পিপ্পলাদের মুখ থেকে এই সব প্রশ্নের জবাব শুনবো। 

আমাদের প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে প্রাণ কোথা থেকে আসে ? ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, প্রাণ আসে আত্মা থেকে। আমাদের দেহের যেমন একটা ছায়া থাকে, এবং এই ছায়াকে যেমন দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না, তেমনি আত্মার ছায়াই হচ্ছে প্রাণ। আত্মাতেই প্রাণ নিহিত আছে, আর এই প্রাণের ইচ্ছেতেই, অর্থাৎ এই প্রাণ যখন ইচ্ছে করেন, তখন তিনি শরীরকে ধারণ করেন। অর্থাৎ শরীরে প্রবেশ করেন। তো প্রাণ যখন শরীরে প্রবেশ করেন, তখন এটা বুঝতে হবে,  আত্মাও তখন শরীরে প্রবেশ করেন। কেননা ছায়াকে তো শরীর  থেকে আলাদা করা যায় না। তেমনি আত্মাকে ছায়া থেকে বা ছায়াকে আত্মা থেকে আলাদা করা যায় না। সমুদ্র থেকে যেমন তার ঢেউকে আলাদা করা যায় না। সমুদ্র না থাকলে ঢেউয়ের কথা ভাবা যায় না।  তেমনি আত্মা না থাকলে তার ছায়া অর্থাৎ প্রাণকে ভাবাই  যায় না। আর প্রাণকে সত্য বলে মনে হয়, তার কারন তার প্রাণ  আত্মার সঙ্গেই প্রাণ ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছেন। সাপ ততক্ষনই পুজো পায়, যতক্ষন সে শিব ঠাকুরের গলায় জড়িয়ে থাকে, শিব ঠাকুরের গলা থেকে বেরিয়ে গেলে সাপ ধংসাত্মক। তেমনি আত্মা থেকে প্রাণকে আলাদা করলে কেবল বাতাস। প্রাণহীন বাতাস বলে যেমন কিছু হয় না, আত্মাহীন  মানুষ বলে যেমন কিছু হয় না, তেমনি  প্রাণহীন আত্মা বলেকিছু হয় না। আত্মাতে  প্রাণ ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।  কিন্তু প্রাণ হচ্ছে ভৌতিক, আর আত্মা হচ্ছে অভৌতিক। তা হলে আমরা বুঝলাম, প্রাণ আসে আত্মা থেকে। প্রাণ ভৌতিক, আর  আত্মা হচ্ছেন অভৌতিক। কিন্তু দুজনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।  

আমাদের পরবর্তী প্রশ্ন হচ্ছে প্রাণ  কি ভাবে শরীরে প্রবেশ করেন ? জীবাত্মাতে অন্তর্নিহিত মনের ইচ্ছেতেই এই স্থূল শরীরে তিনি আসেন। অর্থাৎ শরীরে প্রাণ আলাদা করে কখনো আসেন না, আসতে  পারেন না। আসেন আত্মা, আর স্বাভাবিক ভাবেই প্রাণ এই আত্মাকে বহন করে নিয়ে আসেন। এই কথাটা আমরা আরো একটু ভালো-ভাবে বুঝবার চেষ্টা করবো।  উপনিষদ বলছেন, আমাদের মনের গতি বা আমাদের মনের যে প্রবণতা, আমাদের মনের যে সংকল্প, যে আকাঙ্খা তাকে রূপ দেবার জন্য, মন এই দেহ সৃষ্টি করে। তাই উন্নত  মন উন্নত  দেহের সৃষ্টি করে, সংকল্প অনুযায়ী যোগ্য শরীরে সে প্রবেশ করে । শরীরবিহীন কোনো সংকল্পই পূরণ হবার নয়, তা সে ভালো বলুন, বা মন্দ বলুন।  অনুসন্ধান তা সে ঈশ্বরের অনুসন্ধানই হোক, আর জাগতিক বস্তুর অনুসন্ধান হোক,   সবই  কেবলমাত্র শরীর  সাধ্য। অর্থাৎ আমাদের আকাঙ্ক্ষা বা সংকল্প পুরনের জন্য আমাদের উপযুক্ত শরীর  লাভ হয়। বেদান্ত দর্শন বলছে, শরীর যেন একটা জোঁক, এক পাতা থেকে আর এক পাতায় ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।  তেমনি প্রাণ, এক দেহ থেকে আর এক দেহে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অর্থাৎ জীবাত্মাই এক দেহ থেকে আর দেহে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সংকল্প সাধনের জন্য। আর প্রাণ  ইন্দ্রিয়গুলোর সাহায্যে নিদিষ্ট কর্ম্ম সম্পাদন করতে থাকেন।  বা বলা যেতে পারে, প্রাণ ইন্দ্রিয়গুলোকে যথা নির্দিষ্ট  কর্ম্মে নিযুক্ত করছেন। 

 আমাদের পরের প্রশ্ন ছিল, কি ভাবে  প্রাণ  সারা শরীরে ছড়িয়ে যান ? কি ভাবে তিনি শরীরকে কর্মক্ষম করেন ?


প্রাণ যখন আমাদের এই স্থূল শরীরে প্রবেশ করেন, তখন আমাদের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে বা বলা যেতে পারে, কর্মক্ষম  হয়ে ওঠে। প্রাণের অবর্তমানে শরীরে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বর্তমান থাকা সত্ত্বেও কর্ম্ম ক্ষমতাহীন হয়ে, অর্থাৎ নির্জীব অবস্থায়  অবস্থান করে মাত্র। প্রাণ স্থূল শরীরে প্রবেশ করেই যেটা করেন, সেটা হচ্ছে ক্ষমতা প্রদান।  তিনি নিজেকে ৫টি ভাগে ভাগ করে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে দেন। চোখ, কান, মুখ, নাক - এখানে প্রাণ নিজে অবস্থান করেন। শরীরের মাঝামাঝি অংশে পাঠিয়ে দেন সমান বায়ুকে। শরীরের নিমাঙ্গে পাঠিয়ে দেন অপান বায়ুকে। ব্যান বায়ু সমস্ত ধমনীর মধ্যে প্রবেশ করেন। আর উদান বায়ু প্রবেশ করেন, আমাদের কেন্দ্রীয় ধমনীতে অর্থাৎ ইড়া, পিঙ্গলা,  সুষুম্না, নাড়ীর মধ্যে। এখানেই  চিত্রাণি, বজ্রাক্ষা,  নাড়ী অবস্থান করে । এইভাবে তিনি সমস্ত শরীরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েন ও শরীরকে জীবন্ত করে তোলেন, ক্রিয়াশীল করে তোলেন।  

একদম শেষ প্রশ্ন ছিল,  কি ভাবেই বা তিনি আবার শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যান ? 


উপনিষদ বলছেন : প্রাণীর মৃত্যুকালে উদানবায়ুর ভূমিকা গুরুত্ত্বপূর্ন। এই উদানবায়ু জীবাত্মাকে দেহের বাইরে নিয়ে যায়। এই উদান বায়ুর ত্রিবিধ গতি, উর্দ্ধ-নিম্ন-মধ্যে। জীবাত্মার কর্ম্ম অনুসারে, উদান  বায়ু এই গতি নির্দিষ্ট করে। কেউ পুণ্যলোকে, কেউ পাপলোকে, আবার কেউ মনুষ্যলোকে গতিলাভ করে। উদ্যান বায়ু শরীরে উত্তাপ দান করে। উদ্যান বায়ুর অবর্তমানে শরীর শীতল হয়ে যায়। আর সমস্ত ইন্দ্রিয় তখন মনে লীন হয়ে যায়। এবং সে তখন জন্মান্তরের জন্য প্রস্তুত হয়।  এই সময় মন  সূক্ষ্ম অবস্থায় ইন্দ্রিয়গুলোকে  নিয়ে, প্রাণে প্রবেশ করে, আর প্রাণ তখন আত্মার অনুসরণ করে। নাক বা মুখ বা বিশেষ ক্ষেত্রে ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে আত্মা বেরিয়ে যায়।

সাধন মার্গের লোকেরা যখন একটু উচ্চ পর্যায়ে চলে যান, তখন তারা এই উদ্যান বায়ুকে  করেন। উদ্যান বায়ুর অবস্থান যেহেতু, সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে, তাই উদ্যান বায়ুকে উর্দ্ধগতি করবার জন্য চেষ্টা করেন। এবং উদ্যান বায়ুকে ব্রহ্মরন্ধ্রে চালান করেন। এসব কথা আমরা পরিবর্তিতে আলোচনা করবো।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।  

প্রশ্ন উপনিষদ -৪

 এর আমরা শুনবো আমাদের বিভিন্ন অবস্থা সম্পর্কে।  অর্থাৎ জাগ্রত - স্বপ্ন - সুষুপ্তি - তুরীয় অবস্থা সম্পর্কে। প্রত্যেক মানুষের এই চারটি অবস্থা আছে। এর মধ্যে তিনটি অবস্থা সম্পর্কে আমাদের সাময়িক ধারণা আছে। জাগ্রত অবস্থায় আমরা বাহ্যিক জগতের জ্ঞান অনুভব করি। স্বপ্নাবস্থায় আমরা আর একটা জগতে বাস করি, যেখানে বাহ্যিক জগতের অনুরূপ একটা জগতে ঘোরাফেরা করি, যার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। কিন্তু ওই মুহূর্তের জন্য সবই আমাদের সত্য প্রতীয়মান হয়। কিন্তু আমাদের যখন নিদ্রা ভগ্ন হয়, তখন সেই দৃশ্যমান জগৎ আমাদের কাছ থেকে অপসৃত হয়ে যায়। আর একটা অবস্থা আমাদের হয়, যাকে  বলে সুসুপ্তির অবস্থা, যাকে  আমরা গভীর নিদ্রা বলি, সেখানে আমাদের কাছে, এই বাস্তব জগৎ, বা স্বপ্ন জগৎ কোনোটার উপস্থিতি থাকে না। আমরা তখন, আমাদের আমি বোধ থাকে না। আর জগতের কোনো অস্তিত্ত্ব আমাদের কাছে ধরা পরে না। 

জাগ্রত অবস্থায় আমাদের শরীর ও মন দুইই ক্রিয়াশীল থাকে। কিন্তু স্বপ্নাবস্থায়, আমাদের শরীর ক্রিয়াশীল থাকে না। কিন্তু মন ক্রিয়াশীল থাকে।  সুসুপ্তির অবস্থায় আমাদের শরীর ও মন দুই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তখন ইন্দ্রিয়গুলোর কোনো পৃথক অস্তিত্ত্ব থাকে না। কিন্তু এই সুষুপ্তি বা গভীর নিদ্রার পরে, আবার আমরা যেখানে ছিলাম সেখানে ফিরে আসি। এই অবস্থায় জীবাত্মা পরম-আত্মায় অবস্থান করে। তাই আমাদের শরীর বোধ থাকে না। ইন্দ্রিয়গুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে। মন তখন আত্মাতে নিবদ্ধ থাকে। এত আত্মা পরম-আত্মায় স্থির হয়। এর পরে আমাদের আর একটা অবস্থা আছে, যাকে  বলে তুরীয় অবস্থা। এই অবস্থায় জীবাত্মা পরম-আত্মায় লিন হয়ে যায়। এখানেই আমাদের বিশ্রাম। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।  

ওম্-এর ধ্যান করলে কি হয় ?
প্রশ্ন উপনিষদ - ৫
হিন্দু ধর্ম্মের সমস্ত শাস্ত্রে ওম্ এই ধ্বনির গুরুত্ত্ব স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু এই ওম ধ্বনির ধ্যান করলে কি হয়, অর্থাৎ এই ধ্যানের  পরিণতি কি তা আমরা সম্যকরূপে জানি  না। আজ আমরা সেই কথা শুনবো। আমরা সবাই প্রশ্ন উপনিষদের নাম শুনেছি। এই উপনিষদে ঋষি সত্যকাম ঋষি পিপ্পলাদকে একবার এই প্রশ্ন করেছিলেন। তো আমরা তার কাছ থেকে শুনে নেবো, ওম-এর ধ্যান করলে কি হয় ? কেউ যদি সারা জীবন ধরে, ওম-এর ধ্যান করেন, মৃত্যুর পরে তার গতি কি হয় ? তিনি কি আবার মানুষ রূপে ফিরে আসেন, না আর আসেন না? যদি না আসেন তবে তিনি কোন লোক প্রাপ্ত হন ? অর্থাৎ মৃত্যুর পরে, তার প্ৰস্থান কোথায় হয়, বা তিনি কেমন থাকেন। 

প্রথমে বলি, ধ্যান হচ্ছে একটি স্থির প্রদীপ শিখা। অগ্নিশিখা যেমন সবসময় উর্দ্ধমুখী হয়, তেমনি ধ্যান মানুষকে উর্দ্ধমুখী করে তোলে। আর এই ধ্যান তখনই সম্পন্ন হতে পারে, যখন মানুষ যম -নিয়ম-আসন-প্রাণায়াম-ধারণা ইত্যাদি গুলোতে সিদ্ধ হয়। এগুলো সম্পর্কে আগে শুনেছি। কিন্তু ধ্যান তো অনেক কিছুর উপরে করতে পারি। তাহলে ওম-এর ধ্যানের  বিশেষত্ত্ব কোথায় ? ধ্যানের  উদ্দেশ্য ঈশ্বর-প্রণিধান বা ঈশ্বরকে ভালোবাসা, ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগ বৃদ্ধি করা। ওম সেক্ষেত্রে আমাদের কিভাবে সাহায্য করতে পারে। এসব কথা জানতে গেলে আমাদের আগে জানতে হবে, ঈশ্বর কি আর ওম-এর সঙ্গে এর সম্পর্ক কোথায় ?

দেখুন, বেদান্ত বলছে, ব্রহ্ম-এর দুটো দিক। একটা সগুন আর একটা নির্গুণ। এই দুয়ে মিলেই ঈশ্বর। ঈশ্বর যেখানে মায়া  দ্বারা বিশেষিত সেটা সগুন ব্রহ্ম। আর যেখানে তিনি মায়া দ্বারা আবিষ্ট নন, সেখানে তিনি নির্গুণ ব্রহ্ম। এই দুয়ে মিলেই ব্রহ্ম। সমুদ্র ও তার বুদ্বুদ যেমন আলাদা নয়। তেমনি ব্রহ্ম, সগুন ও নির্গুণ ভেদে  আলাদা নন। জগৎ তারই প্রকাশ কিন্তু জগতের মধ্যে নীতি নিঃশেষিত নন। সবকিছুর ভিতরে যেমন তিনি আছেন, সবকিছুর বাইরেও তিনি আছেন। 

এইবার ওম-এর কথায় আসি। কিন্তু তার আগে, আমরা একটু শুনে নেই, ধ্যানে আমরা প্রতীকের ব্যবহার কেন করি ? দেখুন, ঈশ্বর এই কথাটার দ্বারা আমরা কিছু ধারণা করতে পারি না। আর ধারণা বিহীন ধ্যান হতে পারে না। নাম-রূপ আমাদেরকে একটা ধারণা দিতে পারে। দেবাদিদেব  শিব, বা ধরুন ঠাকুর রামকৃষ্ণ বা জঙ্গলের সিংহ বললেই আমাদের মধ্যে শিব বা রামকৃষ্ণের সেই ধ্যানময় মূর্তিটি ভেসে ওঠে। এমনকি সিংহ বলতেও  সিংহের একটা প্রতিচ্ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু আমরা যখন ব্রহ্ম এই শব্দটি উচ্চারণ করি, তখন আমাদের মনে নির্দিষ্ট কিছু ভেসে ওঠে না। আসলে ব্রহ্ম-কথাটার  মধ্যে কোনো বৈশিষ্ট খুঁজে পাই না। কারন সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই।   কিন্তু নাম-রূপের সঙ্গে একটা বৈশিষ্ট আছে। প্রতীক আমাদের কাছে দৃশ্যমান। তাই সেখানে আমরা আমাদের মনকে একাগ্র করতে পারি। কিন্তু যাকে দেখা তো দূরের কথা কল্পনাতেও আনতে  পারি না, সেখানে আমরা নিজেকে একাগ্র করতে পারি না। আর ধ্যানে একাগ্রতা অবশ্য়ই গুরুত্ত্বপূর্ন। 

এখন কথা হচ্ছে, এই প্রতীক হিসেবে, ওম - কে কেন বেছে  নেবো ? দেখুন ওম যখন আমরা উচ্চারণ করি তখন আমরা আমাদের গলার পিছন দিক থেকে বদ্ধ ওষ্ঠ পর্যন্ত প্রতিটি অংশকে স্পর্শ করে থাকি। অ-উ-ম এই তিনে মিলে  ওম। সৃষ্টি শুরু হয়, শব্দ বা ধ্বনি দিয়ে। তাই আমরা যদি ব্রহ্ম-কে শব্দ হিসেবে কল্পনা করতে পারি, তাহলে ওম হচ্ছে সেই শব্দ যার দ্বারা আমরা ব্রহ্মকে চিহ্নিত করতে পারি।  
অ - উপনিষদ বলছে, অ-উ-ম এর মধ্যে অ-এর ধ্যান করলে, আমরা জাগতিক জ্ঞান লাভ করতে পারি। অ হচ্ছে ঋগ্বেদের প্রতীক। অ-এর ধ্যান করলে বা অ-এর ধ্যান করেই আমরা মনুষ্য জীবন  লাভ করতে করেছি। আবার অ-এর ধ্যান করলে আমরা আবার উন্নত মনুষ্য  জন্ম লাভ করতে পারবো। অর্থাৎ অ-এর ধ্যান করলে আমরা পরবর্তী জীবনে মুনি-ঋষি হয়ে জন্মে মনুষ্য-জীবনকে সার্থক করতে পারবো। এই দৃশ্যমান জগৎ তো ব্রহ্ম ভিন্ন কিছু নয়। এই সত্যকে তখন আমরা উপলব্ধি করতে পারবো। অ-কার হচ্ছে জগৎ। অ-কে ধ্যান করলে, প্রকাশ -স্বরূপ ব্রহ্মকে ধ্যান করা হয়। অর্থাৎ অ-কার হচ্ছে, আমাদের জাগ্রত অবস্থা। আর এই জাগ্রত অবস্থায় যে অনুভূতিগুলো আমাদের হয়, সেগুলোকে আমরা সঠিকভাবে ধরতে পারবো। এবং এই প্রতক্ষ্য জগৎকে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় আনতে  পারবো। জাগ্রত অবস্থায়, আমরা যে  জগতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকি, সেই জগৎকে আমরা সঠিক উপায়ে জানতে পারবো এই অ-এর ধ্যান করে। কিন্তু আমাদের আবার ফিরে ফিরে আসতে  হবে। এবং পুনঃ পুনঃ মানুষই জীবন ধারণ করতে হবে। 

উ - এবার জানবো  আমরা উ এর ধ্যান করলে কি হয়।  উ  হচ্ছে যজুর্বেদের প্রতীক। এর দ্বারা আমরা আমাদের মনকে উন্নত করতে পারি। মৃত্যুর পরেও আমরা আমাদের মানসিক শরীরে, মানস লোকে বাস করি। বেদ বলছে যে,,  তিনটি লোক আছে অর্থাৎ, ভূঃ - ভুবঃ - স্বঃ অর্থাৎ পৃথিবী, অন্তরীক্ষ ও স্বর্গলোক। এই তিনি লোকে আমাদের সাধারণত যাতায়ত করতে হয়, জন্ম জন্মান্তর ধরে। তো আমরা যখন ভূলোক ছেড়ে ভুবর্লোকে যাবো, তখন যে শরীর অর্থাৎ মানস শরীরে বা যে লোক অর্থাৎ মানসলোকে আমরা বাস করবো, সে সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান হবে। এবং আমরা উন্নতমানস লোকের বাসিন্দা হতে পারবো। উ-এর ধ্যান করলে আমরা তখন পার্থিব ভোগ সুখের প্রতি আকৃষ্ট বা আসক্ত হবো  না। বরং আমরা পরহিতকর কর্ম্মে আকৃষ্ট হবো। উপনিষদ বলছে, স্বর্গ ও মর্তের  মধ্যবর্তী আকাশ স্থান হচ্ছে অন্তরীক্ষ। এই লোকে আমরা আমাদের পূর্ব-পুরুষদের সঙ্গ  লাভ করে থাকি।  এমনকি দেব-দেবতাদের সান্নিধ্যও  লাভ করে থাকি। কিন্তু এই লোক থেকেও আমাদের আবার ফিরে আসতে  হবে, মনুষ্য  রূপে আবার জন্ম গ্রহণ করতে হবে। 

ম -  ম-এর ধ্যান করলে সাধক  সূর্যলোক প্রাপ্ত হন। সূর্য্য হচ্ছে আমাদের জ্ঞান, জ্যোতিঃ ও পবিত্রতার প্রতীক। সাধক তখন এই সব গুনের অধিকারী হন। এই অবস্থায় চিত্ত শুদ্ধির ফলে তাঁর আত্মজ্ঞান লাভ হয়। তখন তিনি আর পৃথিবীতে ফিরে আসেন না।কিন্তু ব্রহ্মেও লিন হন না।  সাধক তখন সবকিছুর সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেন। কিন্তু এই অবস্থা শেষ অবস্থা নয়। 

ওম - অ-উ-ম এই তিনটি অক্ষরকে যিনি আলাদা ভাবে ধ্যান করেন, তিনি মৃত্যুর অধীন। আলাদা ভাবে ধ্যান করলে, আমরা প্রথমে জাগতিক, পরে স্বপ্নাবস্থা, শেষে সুষুপ্তিতে চলে যেতে পারি। কিন্তু এই তিনকে একত্রে ধ্যান করলে তিনি তুরীয় অবস্থায় চলে যেতে পারেন। আমরা সকলে এই প্রথম তিন অবস্থার অধীন। কিন্তু ওম-এর ধ্যান করলে, সাধক যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, তিনি ব্রহ্মের সাথে একাত্মতা অনুভব করেন। তিনি জ্বরা-ব্যাধি-মৃত্যু-ভয় থেকে মুক্তি লাভ করেন। তিনি সত্যিকারের মুক্ত পুরুষ হয়ে যান। 

পিপ্পলাদ বলছেন, সাধক যদি ওম-এর ধ্যান করেন, তবে তিনি ঋক মন্ত্রের সাহায্যে মনুষ্যলোক, যজুর্মন্ত্রের দ্বারা চন্দ্রলোক, এবং সাম মন্ত্রের সহায়ে ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হন। পরম শান্তি লাভ করেন। নিখিল বিশ্বের সাথে তিনি তখন এক হয়ে যান। তিনি তুরীয় অবস্থা প্রাপ্ত হন। সমস্ত লোক, সমস্ত বন্ধনের  উর্দ্ধে চলে যান তিনি। তিনি তখন শান্তম -অজরম -অমৃতম-অভয়ম-পরং চ।

 শান্তম - সাধক তখন শান্ত স্থির। একটা অবিচল প্রশান্তি অনুভব করেন। 
অজরম - জ্বরা -ব্যাধি -বার্ধক্য তাকে স্পর্শ করতে পারে না। তিনি পরিবর্তন রোহিত হয়ে যান। 
অমৃতম- তিনি অমৃতত্ব প্রাপ্ত হন। অর্থাৎ মৃত্যুহীন বা জন্ম-মৃত্যু রহিত হয়ে যান। 
অভয়ম- তিনি অভয়ম হয়ে যান।  তাঁর ভয়-ভীতি বলে কিছু থাকে না। তিনি স্থির শান্ত সমাহিত। 
পরং চ - তিনি সর্বোচ্চ অবস্থা প্রাপ্ত হন। 

অতএব আমরা শেষ করতে পারি এই কথা দিয়ে যে, ওম-এর ধ্যানে সর্বোচ্চ পরম-সত্যকে লাভ করা সম্ভব।আসুন আমরা সবাই ওম-এর ধ্যানে লিপ্ত হয়।  

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।


  









   

  









      













   















    

No comments:

Post a Comment