Saturday 7 December 2019

মহর্ষি পতঞ্জলির যোগদর্শন "বিভূতিপাদ " PATANJALI - BIBHUTIPAD




 মহর্ষি পতঞ্জলির যোগদর্শন
"বিভূতিপাদ "  PATANJALI - BIBHUTIPAD
২৬.১১.২০১৯ - পতঞ্জলির যোগদর্শন, যোগের উপরে একমাত্র প্রামাণ্য বই।  যোগের উপরে এর থেকে ভালো বই আছে  আর আছে  কিনা আমার জানা নেই। আর এই বইয়ের মধ্যে একটা অধ্যায় আছে, যার নাম "বিভূতিপাদ"।  এই বিভূতিপাদ সম্পর্কে আছে আমাদের অসীম কৌতূহল। তার কারন, এখানে আছে, সব অলৌকিক ক্ষমতা অর্জনের উপায়।  যদিও আমি কিন্তু  এই সব ক্ষমতার অধিকারী নোই। তথাপি আমরা এই অধ্যায়  পড়ে দেখবো, এতে কি আছে। কিভাবেই বা অলৌকিক ক্ষমতা অর্জন করেন, সব সাধু মহাত্মারা। আমরা অনেক সময় অলৌকিক ক্ষমতার বা ঘটনার কথা শুনি, কেউ কেউ দেখেছি হয়তো, কিন্তু কিভাবে  যে এটা হয়, সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। এর বৈজ্ঞনিক ব্যাখ্যাই বা কি ? শুধু এইটাই জানি, সাধনা করলে নাকি এই সব ক্ষমতা অর্জন করা যায়। আজ আমরা এই বইয়ের পাঠক মাত্র। আমরা শুধু শুনবো, এখানে মহর্ষি পতঞ্জলি কি বলছেন। তবে একটা কথা বলি, এসব কথা আমাদের কাছে নিছক সাধারণ  জ্ঞানের বিষয় মাত্র । এই জ্ঞান অনুধাবন করা জন্ম-জন্মান্তরের সাধনার ফলেই একমাত্র লভ্য হতে পারে। তবে এইসব কথা শুনলে আমাদের মধ্যে একটা ঔৎসুক্য জাগ্রত হতে পারে, এবং এই পথে এগুনোর  একটা সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।  

মহর্ষি পতঞ্জলি, বিভূতিপাদ -এর কথা বলার আগে, সাধন পদের কথা বলেছেন। এমনকি সমাধিপাদের কথাও বিস্তারিত ভাবে  বলেছেন। সাধনপাদে, তিনি অষ্টাঙ্গ  যোগের কথা বলেছেন।  অর্থাৎ যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার এই পাঁচটি সাধনপথের কথা বলেছেন। এই বিভূতিপাদে আসলে ধারণা, ধ্যান, ও সমাধির বর্ননা করেছেন। এই তিনটি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে  ধ্যেয় বস্তুতে মানুষ সম্পূর্ণতা লাভ করে। আর এই অবস্থাকে বলে "সংযম" । আর এই "সংযম"  যিনি লাভ করতে পেরেছেন, তিনিই যোগবিভূতি লাভ করতে পেরেছেন। আমরা এক এক করে শুনবো তিনি কি বলছেন। বিভূতিপাদে খুবই সংক্ষিপ্ত ৫৫টি শ্লোক আছে। এর মধ্যে আজ আমরা কেবল মাত্র ১৬টি শ্লোকের কথা  শুনবো। 

১.ধারণা :  কোনো এক দেশে, অর্থাৎ শরীরের বাইরে হোকে বা ভিতরে হোক, চিত্তকে স্থির করার নাম ধারণা। অর্থাৎ শরীরের যে কোনো অঙ্গে যদিও মহাত্মারা বলছেন, শরীরের ভিতরে বলতে তিনি বলছেন, নাভিচক্র, হৃদয়চক্র, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা, সহস্রার  ইত্যাদি যে সব চক্র  আছে, তা যে কোনো একটিতে চিত্তকে স্থির করাকে ধারণা বলে। আবার শরীরের বাইরে, তা সে সূর্য্য, চন্দ্র, আকাশ, বা যে কোনো মূর্তি, বা পদার্থে যখন চিত্ত স্থির হয় তখন তাকে বলে ধারণা। 

২.ধ্যান : এইবার যেখানে চিত্তকে নিবিষ্ট করা হচ্ছে, সেখানে আমাদের বৃত্তিকে স্থির করার নাম ধ্যান। ধ্যানে আমাদের বৃত্তিকে ধ্যেয়বস্তুর প্রতি প্রবাহিত করে দিতে হবে। 

৩.সমাধি : ধ্যানে যখন শুধু ধ্যেয় বস্তুই মাত্র প্রতিত হয়, অন্য কোনো কিছুর দিকে বৃত্তি ধাবিত  হতে না পারে, তখন যে অবস্থা হয়, তাকে বলে ধ্যান। এই সময় দ্রষ্টা ও দৃশ্য একাকার  হয়ে যায়। ধ্যানীর নিজের আলাদা কোনো অস্তিত্ত্ব বোধ থাকে না। তখন একমাত্র ধ্যেয় বস্তুই পরিলক্ষিত হয়। এই অবস্থাকেই বলে সমাধি। 

৪.সংযম :  আর এই তিনটি, অর্থাৎ ধারণা, ধ্যান, সমাধি যার যথাযথ সম্পন্ন হয়েছে, তখন তাকে বলা হয় সংযম। এই সংযমী অবস্থায়, সাধক এমনকি স্ব-রূপের কথাও  বিস্মৃত হন। তার কাছে একমাত্র ধ্যেয় বস্তুই  প্রতীয়মান হয়।

৫.প্রজ্ঞালোক : এই সংযম যখন সাধকের আয়ত্বে আসে, তার মধ্যে তখন বুদ্ধির প্রকাশ ঘটে। একটা জ্ঞানের আলোক তার মধ্যে প্রস্ফুটিত হয়, আর  একেই  বলে প্রজ্ঞালোক। সংযমে যখন মানুষ বিজয়লাভ করে, অর্থাৎ সাধক যখন বিষয় বিষয়ে সংযমী হয়ে যায়, তখন তার মধ্যে ধীশক্তির বিকাশ ঘটে অর্থাৎ তার মধ্যে তখন বুদ্ধির এক অলৌকিক জ্ঞান  উদ্ভাসিত হয়।  একেই বলে আত্মপ্রসাদ বা ঋতম্ভরা প্রজ্ঞা। ঋ কথাটার মানে হচ্ছে জ্ঞান অর্থাৎ সত্যিকারের জ্ঞান। যে জ্ঞান আমাদের শুধু শোনা, বই থেকে পড়া বা  অনুমান করা জ্ঞান নয়। যার জন্য এই জ্ঞানকে বলা হয়, প্রকৃত জ্ঞান বা সর্ব্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান। তো সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সেই জ্ঞানের আলোক রশ্মি সাধকের ভেতরে তখন উদ্ভাসিত হয়।

৬.ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, এই সংযম প্রয়োগ বিধি  ধীরে ধীরে স্থূল থেকে সূক্ষ্ম বিষয়ে আয়ত্ত্ব করতে হয়। অর্থাৎ প্রথমে স্থূল বিষয়ে নিজেকে স্থির করতে হয়, এবং ক্রমান্বয়ে সূক্ষ্ম বিষয়ে সংযম সাধনা করতে হয়।
৭. ধারণা, ধ্যান ও সমাধি এই যে তিনটি যোগাঙ্গ তাকে ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, এগুলো হচ্ছে অন্তরঙ্গ সাধনা। সাধনার প্রথম দিকে যে সাধনা গুলো করতে হয়, অর্থাৎ যম-নিয়ম-আসন-প্রাণায়াম-প্রত্যাহার  এগুলো হচ্ছে বহিরঙ্গ সাধনা। আর ধারণা-ধ্যান-সমাধি হচ্ছে অন্তরঙ্গ সাধনা।

৮. এইযে অন্তরঙ্গ সাধনা, এগুলো আবার নির্বীজ সমাধির বহিরঙ্গ সাধন।  নির্বীজ সমাধি বলতে বোঝায় যে সমাধির কোনো বীজ অর্থাৎ সংস্কার নেই। এইসময় অর্থাৎ নির্বীজ সমাধিতে আমাদের সংস্কার লুপ্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ এইসময় আমাদের অভ্যাস বলতে যা বোঝায় তা আর থাকে না।

৯. এর পরে পতঞ্জলি বলছেন - নিরোধ সমাধি আর নির্বীজ সমাধি এক নয়। নিরোধ সমাধি হচ্ছে চিত্তবৃত্তির নাশ কিন্তু সংস্কারকে রুখে দেওয়া বা দমিয়ে দেওয়া, নাশ করা নয়।  কিন্তু নির্বীজ সমাধিতে এই চিত্তবৃত্তি তো নাশ হবেই,অর্থাৎ নতুন করে আর সংস্কারের উৎপাদন হবে না। অন্যদিকে   আবার পুরোনো সংস্কারের নাশ হয়ে যাবে।  একই বলে নির্বীজ সমাধি।  অর্থাৎ কোনো বীজ রেখে যাবে না।  অর্থাৎ ভবিষ্যতেও কোনো সংস্কারের জন্ম হতে পারবে না।

১০. সমস্ত সংস্কারের যখন দমন হয়,তখন সেই দমিত সংস্কারের আধিক্যতা বশতঃ চিত্তের একটা স্থিতি জন্ম নেয়।

১১. এই সময় অন্য কোনো বিষয়ে চিন্তা করার প্রবৃত্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। কেবলমাত্র ধ্য়েয় বস্তুর বিষয়ে চিন্তা করার একাগ্রতা বৃদ্ধি পায়।  একেই বলে সমাধি-পরিনাম  বা সাধনার পরিনাম।

১২. এর পর আবার শান্তির স্থিতি ও উদয়ের স্থিতি - এই দুটো বৃত্তিই যেন একাকার হয়ে যায়।  এই অবস্থাকে বলে চিত্তের একাগ্রতা পরিনাম। অর্থাৎ চিত্তের যে বিক্ষিপ্ত অবস্থা, সেখান থেকে চিত্ত যখন একাগ্র অবস্থায় প্রবেশ করে, তাকে বলা হয় সমাধি-পরিনাম। আবার যখন চিত্ত সম্পূর্ণভাবে সমাহিত হয়ে যায়, এই অবস্থাকে বলে চিত্তের একাগ্রতা-পরিনাম। এটাকে আরো একবার বুঝে নেই - সমাধি-পরিণামে চিত্তের বৃত্তি দুই ধরনের থাকে এক হচ্ছে শান্ত বৃত্তি ও উদয়কারী বৃত্তি। এবং এই দুটোর মধ্যে একটা ভেদ থাকে।  কিন্তু একাগ্রতা পরিণামের মধ্যে এই প্রভেদ বা ভাগ থাকে না।

১৩. পতঞ্জলি এবার উদাহরণের সাহায্যে এইসব পরিণামের ব্যাখ্যা করছেন।  বলছেন - এই যে চিত্তের পরিনাম এর দ্বারা পঞ্চভূত এবং সমস্ত ইন্দ্রিয়ের মধ্যে একটা প্রক্রিয়া সংগঠিত হয়। আর এগুলোকে বলে ধর্ম্ম-পরিনাম, লক্ষণ-পরিনাম এবং অবস্থা পরিনাম।

ধর্ম্ম-পরিনাম - যখন কোনো ধর্মীর মধ্যে এক ধর্ম্মের লয় হয়ে, অন্য ধর্ম্মের উদয় হয় তখন তাকে বলে ধর্ম্ম-পরিনাম। লক্ষ্মণ পরিনাম - তিন  রকম অর্থাৎ বর্তমান  ধর্ম্মের লুপ্তির পরে যে অবস্থা হয় তাকে বলে অতীত লক্ষণ-পরিনাম।  অর্থাৎ অতীতে যে লক্ষণ ছিল তার লোপ পেয়ে নতুন অবস্থায় এলো। এইযে নতুন অবস্থায় এলো, এর থেকে আবার ভবিষ্যৎ ধর্ম্মের লক্ষণ প্রকাশ হবে। এই অবস্থাকে বলে বর্তমান লক্ষণ পরিনাম। অর্থাৎধর্মীয়  অবস্থার তিনটি পরিনাম। আগে যা ছিলাম, বর্তমানে যা হয়েছি, ভবিষ্যতে  যা হবো। এই পরিবর্তন আমাদের প্রতিনিয়ত চলছে। আমরা সেটা ধরতে পারি না। জন্মের পূর্বাবস্থা, অর্থাৎ অতীত, জন্মের পরবর্তী অবস্থা অর্থাৎ বর্তমান জীবন, আবার মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থা। আবার দেখুন, শৈশব - যৌবন - বৃদ্ধ। প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জীবজগৎ এগুচ্ছে। এই যে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে এটাকে বলে অবস্থা পরিনাম। তো ধর্মীর এই অবস্থা পরিবর্তনে আসলে নিয়তি। এটির রোধ করা যায় না।

এই যে অবস্থার পরিবর্তন এটিকে বিচারের সাহায্যে ধরা যায়। এবং আমাদের যখন ক্রমবিকাশের জ্ঞান হবে, তখন আমাদের পরিণামের অবসান হবে। 

১৪. ধর্ম্ম ও ধর্ম্মী কাকে বলে ?
দ্রব্যের মধ্যে বা আমাদের মধ্যে সদা বিদ্যমান শক্তির নাম ধর্ম্ম। অর্থাৎ যে কোনো দ্রব্যের স্বাভাবিক গুনের নামই ধর্ম্ম। ধর্ম্ম একটা স্বভাবগত শক্তি মাত্র। এই ধর্ম্ম যে আঁধারে থাকে, তাকে বলে ধর্ম্মী। অর্থাৎ যে কারণরূপ পদার্থের দ্বারা কোনোকিছু তৈরি হয়েছিল, বা বর্তমানে তৈরি হয়েছে, অথবা ভবিষ্যতে তৈরি হতে পারে, সেই কারণরূপই হচ্ছে ধর্ম্ম।
এক ধর্ম্মীর মধ্যে বহু ধর্ম্ম বা শক্তি বিদ্যমান। এর মধ্যে কোনো গুন্ বা শক্তি হয়তো এখনো প্রকাশিত হয় নি। এই অবস্থাটাকে বলে অতীত। যেমন মাটির মধ্যে কলসি হবার শক্তি আছে, সোনার মধ্যে গয়না হবার শক্তি আছে। বীজের মধ্যে গাছ হবার শক্তি আছে। জলের মধ্যে বরফ হবার শক্তি আছে। শুধু সময় ও পরিবেশ পেলে এগুলো প্রকাশিত হতে পারে।
ধর্ম্ম যখন আপন কাজ সমাপ্ত ক'রে, আবার ধৰ্ম্মীর মধ্যে বিলীন হয়ে যায়, একে বলে শান্ত অবস্থা। এটাই পরিণতি বা ভবিষ্যৎ বলতে পারেন। ঘট্ আবার মাটির সঙ্গে মিশে যায়, গয়না আবার সোনা হয়ে যায়।
ধর্ম্ম আসলে একটা শক্তি যা আগে থেকেই ধর্ম্মীর মধ্যে লুক্কায়িত। নিজ কার্য্য উপলক্ষে যখন তা প্রকাশিত হয় তাকেই আমরা বর্তমান বলি। অর্থাৎ মাটি যখন ঘট্ হয়, জল যখন বরফ হয়, সোনা যখন কানের দুল হয়, বীজ যখন গাছে রূপান্তরিত হয়, তখন আমরা তাকে বর্তমান বলি।
আমরা যদি সমাধি লাভ করতে চাই, এই ধর্ম্মের গতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে হবে।

১৫. ধর্ম্মীর মধ্যে ধর্ম্ম প্রথম অবস্থায় সুপ্ত বা অব্যক্ত, তারপরে প্রকাশ, তারপরে আবার অব্যক্ত বা শান্ত। আর এই ধর্ম্মের বিকাশ বা প্রকাশ হয় ক্রোম অনুসারে।যেমন তুলো থেকে সুতো, এই সুতো থেকে সলতে হতে পারে, দড়ি হতে পারে, আবার কাপড় হতে পারে। অর্থাৎ নির্মাতার ইচ্ছে বা ক্ষমতা অনুযায়ী ধর্ম্মের প্রকাশ হয়। এর থেকে আমরা বুঝতে পারি, ক্রোমের পরিবর্তন ঘটলে, একই ধর্ম্মী বিভিন্ন নাম বা রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। এই যে ক্রোমের বা পরিণতির বিভিন্নতা, এটি সহকারী কারণের জন্য ঘটে থাকে। অর্থাৎ জল অতিরিক্ত ঠান্ডার জন্য বরফ হয়, আবার গরমের জন্য জল হয়। আরো উত্তাপ পেলে জল বাস্পে পরিণত হয়ে যায়। অর্থাৎ কাল-
১৬. এই যে তিনটি পরিনাম অর্থাৎ অতীতের আমি, বর্তমানের আমি ও ভবিষ্যতের আমি এই তিন পরিণামের উপরে আমরা যদি সংযম অভ্যাস করতে পারি তাহলে আমাদের অতীতে কি ঘটেছিলো,বা ভবিষ্যতে কি ঘটবে সে সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান লাভ হবে। যদি আমরা সংযম করতে পারি, এই সংযম কথাটা আগে আমরা শুনেছি, সংযম হচ্ছে ধারণা-ধ্যান-সমাধিতে যিনি সিদ্ধি লাভ করেছেন। অর্থাৎ ধর্ম্ম-পরিনাম, লক্ষণ-পরিনাম, ও অবস্থা-পরিনাম এই তিন রকম পরিণামের উপর ধারণা-ধ্যান-সমাধি দ্বারা যদি আমরা সিদ্ধি লাভ করতে পারি, তবে আমরা সংযমী হবো। আর এই সংযমী হলে আমরা আমাদের পূর্ব-বৃত্তান্ত ও ভবিষ্যৎ-বৃত্তান্ত জানতে পারবো।

একজন যোগী যখন বর্তমান কোনো বস্তুর বা জীবের বিষয়ে জানতে চান, তবে সেই বস্তুর মূল কারন, তার পরিবর্তন প্রক্রিয়া অর্থাৎ কতদিন ধরে পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সে এই অবস্থায় এসেছে, এবং ভবিষ্যতে তার কি পরিনাম হবে, এবং সেটা হতে তার কত কাল লাগবে, এইসব পরিণামের উপরে যোগী যখন সংযম প্রয়োগ করবেন, তখন তার সামনে সমস্ত কিছু প্রতক্ষ্যবৎ প্রতিভাত হবে। তখন তিনি বস্তুর ভূতকাল, বর্তমানকাল, ও ভবিষ্যৎকালের স্থিতি-কাল, তার নাম-রূপ ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞাত হন।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম।

আমি একবার একটা সাপের চিড়িয়াখানায় (স্নেক পার্কে) গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে একটা আশ্চার্য্য ঘটনা পর্যবেক্ষেপন করলাম। ভদ্রলোক সাপেদের সাথে কথা বলছেন। একটা ব্যাঙ সামনে ফেলে দিয়ে বলছেন, খা - খা। না খেলে অন্য কাউকে দিয়ে দেবো। যেই বলছে, অন্য কাউকে দিয়ে দেবো, অমনি লক্ষ করলাম, সাপটি এগিয়ে গিয়ে ব্যাঙটাকে খপ করলে ধরলো।

আমার ছেলের তখন বছর তিনেক বয়স। সেই সময়, আমাদের বাড়িতে আজাদ নামে আমার এক সহকর্মী বন্ধু এসেছিলো দিল্লী থেকে। ও আসলে চন্ডিগড়ের ছেলে । ও বাংলা কিছু বুঝতে পারতো না। হিন্দি ও ইংরেজি ছাড়া কিছু জানতো না। তো একসময় দেখি, বারান্দায় পুটপুট করে আমার ছেলের সঙ্গে কথা বলছে। আমার ছেলের সাথে ওর বন্ধুত্ত্ব হয়ে গেছে। কেউ কারুর ভাষা বোঝে না। কিন্তু ভাবের বিনিময়ে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। আর আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, আমার স্ত্রীর কথা সে কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না। তো অন্যের ভাষা আমরা কি করে বুঝবো ?

১৭, "শব্দার্থ প্রত্যয়ানাম ইতরেতর অধ্যাসাৎ সংকরঃ তৎ প্রবিভাগ সংযমাৎ সর্বভূতরুৎ জ্ঞানম্।"  

সমস্ত প্রাণীর ভাষা সন্মন্ধে জ্ঞান লাভের উপায় : মহর্ষি পতঞ্জলি বলছেন, শব্দ অর্থ ও জ্ঞান এই তিনের একের মধ্যে অন্যের অধ্যাস অর্থাৎ আরোপ বশতঃ, এই তিনের মধ্যে যে মিশ্রণ হয়ে চলেছে তার বিভাগ অর্থাৎ তাকে পৃথক বোধের বিষয়ে সংযম পালন করলে সমস্ত প্রাণীর ভাষা সন্মন্ধে জ্ঞান লাভ করা যায়। আর একটু পরিষ্কার করে বলি, শব্দ ও তার অর্থের জ্ঞানগুলোর পরপস্পরের আরোপ বা অধ্যাস থেকে একটা মিশ্র বা শংকর জাতীয় অভিন্ন জ্ঞান হয়, তাদের প্রত্যেকটিকে পৃথক ভাবে সংযমের সাহায্যে যোগীর সমস্ত জীবের উচ্চারিত শব্দের জ্ঞান হতে পারে।

একটা শব্দ বাতাসের সাহায্যে আমাদের কানের পর্দায় আন্দোলন তুললো। আমাদের কানের সঙ্গে মাথার পিছন অবধি যে গ্রাহক তন্ত্রী আছে, এই তন্ত্রীর সাহায্যে শব্দ-তরঙ্গকে সে মস্তিষ্কের স্নায়ুতে পাঠিয়ে দিলো । সেখানে অর্থাৎ মস্তিষ্কে আমাদের যে পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল, তার সাহায্যে সে এই শব্দের অর্থ নির্ধারণ করলো। এবং নির্দিষ্ট অঙ্গে বিশেষ নির্দেশ পাঠিয়ে দিলো। যদি পূর্ব অভিজ্ঞতায়, তার এই অর্থ জ্ঞান নাও থাকে, তথাপি সে সতর্ক হলো, এবং এর অর্থ ও পরিনাম পর্যবেক্ষন করতে থাকলো। এর মাধ্যমে সে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করলো। অর্থাৎ প্রথমে শব্দ বাহিত হয়ে অর্থ, নিরুপন হলো, এবং শেষে তা জ্ঞানে পরিণত হলো। আসলে শব্দের মধ্যে কোনো অর্থ নেই। অর্থ আছে আমাদের মস্তিষ্কে বা মনে। সেখান থেকেই সে শব্দাদির অর্থ সংগ্রহ করে। এইজন্য ঋষি পতঞ্জলি শব্দ-অর্থ-জ্ঞান এই তিনটি জিনিসের প্রতি ধ্যান দিতে বলছেন। আমরা আর একটু বিস্তারিত ভাবে বুঝে নেবো।

পৃথিবী সৃষ্টির আদিতে ভাষার সৃষ্টি হয় নি।  তখন শুধু ধ্বনির  মাধ্যমেই ভাবের বিনিময় হতো। জীবের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ভাষার সৃষ্টি হয়েছে, এবং ধীরে ধীরে ভাষার উন্নতি হয়েছে। কিন্তু ভাষার বিভিন্নতাও বেড়েছে। কিন্তু অনুন্নত জীবের ক্ষেত্রে আজো সেই প্রাচীন শব্দ বা ধ্বনি দিয়েই তারা তাদের ভাব প্রকাশ করে থাকে। আর এই শব্দ বা জীবজন্তুর ভাষা আপনি যদি একটু খেয়াল করেন, তবে আপনিও বুঝতে পারবেন। যারা জীবজন্তুকে ভালো বাসেন, তারা এটা ভালোভাবে বোঝেন। এদের যখন খিদে পায়, এরা  যখন ভালোবাসা পায়, বা এরা যখন ভালোবাসা জানায়,  এদের যখন যৌনক্ষুধা পায়, এরা  যখন ঝগড়া করে, এরা  যখন ভয় পায়, যখন খুশি হয়,  এদের স্বরের মধ্যে একটা তারতম্য লক্ষ করা যায়। আর এসব আপনি একটু মনোযোগ দিলেই বুঝতে পারবেন।  এর জন্য আপনাকে বেশি বেগ পেতে হবে না। আপনি বাড়ির পোষ্য বিড়াল, কুকুর, পাখি - এমনকি গরু, ছাগল - এদের কথা আপনার বুঝতে বেশি বেগ পেতে হয় না। আমার স্ত্রীকে দেখেছি, সে তার পোষ্য বিড়ালের সাথে, কুকুরের সাথে কথা বলে। যখন সে তাদের আদর করে, তখন তারা এক ধরনের আওয়াজ তোলে। আসলে শুধু আপনার আন্তরিকতা ও মনোযোগ বা একাগ্রতা দরকার। তখন  এদের কথা আপনি আপনার মতো করে বুঝতে পারেন। ছোটবেলায়, আমি দেখেছি, গাভী গর্ভবতী হবার আগে ডাক ছাড়ে, আর গৃহস্থ ঠিক বুঝে যান, গরুর গর্ভবতী হবার সময় এসেছে। বিড়াল, কুকুর, বা বাড়ির যেকোনো  পোষ্য,  খাবার সময় ডাকে।  আপনি তখন তাকে খাবার দেন। পছন্দমত খাবার হয়ে গেলে, তার স্বরের পরিবর্তন হয়। এবং আপনি সেটা বুঝতে পারেন। এমনকি আপনার বাড়ির পাম্প  মেশিনেরও একটা আওয়াজ আছে,  যা শুনে  আমরা বুঝতে পারি, মেশিন ঠিক আছে কি নেই।

ধ্বনির গতি ভেদে ধ্বনির চারটি পর্যায়।   পরা, পশ্যন্তী, মধ্যমা ও বৈখরী।
শব্দের বা স্বরের উৎপত্তি হচ্ছে পরা - আমাদের শরীরের ক্ষেত্রে এটি মূলাধার। এই মূলাধারে আছে বায়ুশক্তি বা উর্জা শক্তি। সৃষ্টিতত্ত্বের এখানেই অবস্থান।  এইখানেই ধ্বনির উৎপত্তি। পরা  কথাটার অর্থ হচ্ছে উচ্চ। অর্থাৎ ধ্বনির সর্বোচ্চ পর্যায়, যা আমাদের গোচরীভূত নয়।
এর পরে আছে পশ্যন্তি : ধ্বনি মূলাধার থেকে উঠে আসে  আমাদের নাভিমূলে। যার জন্য কেউ কেউ বলে থাকেন, প্রণব নাভি থেকে উৎপন্ন শব্দ। নাভিতে থাকাকালীন ধ্বনি থাকে  অতি সূক্ষ্ম।  আমাদের নাভিচক্রের বায়ু সঙ্গে মিশে থাকে, এই ধ্বনি । আপনি যদি গভীর ধ্যানে নিমগ্ন থাকেন,তবে এই ধ্বনি শুনতে পাবেন ।  একে বলে নাদব্রহ্ম।
ধ্বনি এর পরে, নাভি থেকে চলে আসে হৃদয়ে। এখানকার অবস্থানে ধ্বনিকে বলা হয়, মধ্যমা। হৃদয়ের বায়ুচক্রে  যখন ধ্বনি অবস্থান করে, তখন তাকে বলে মধ্যমা।  এটিও সূক্ষ্ম।  তাই হৃদয়ের ডাক আমরা সবাই শুনতে পাই   না।
এরপরে, কন্ঠে - যেখান থেকে ধ্বনির  উৎপত্তি বলে সাধারণের ধারণা। আসলে এই পর্যায়ে এসে ধ্বনি শব্দে পরিণত হয়ে যায়। এই ধ্বনি বা শব্দ আমরা শুনতে পাই।  একে বলে বৈখরী

এবার  বিশ্বব্রহ্মান্ডকে যদি আমরা বিরাট পুরুষের দেহ বলে কল্পনা  করি, তবে দেখতে পাবো, সেই বিরাট পুরুষের মূল ঊর্যাশক্তি থেকে এই ধ্বনির উৎপত্তি। এটি সৃষ্টির সূচক মাত্র। আসলে ধ্বনির  কোনো অর্থ হয় না। কেবল গুন্ বর্তমান। আর এই গুনের বিচার করে, আমরা এর অর্থ বের করেছি মাত্র।
শব্দ আবার দুই রকম : ধ্বনি ও বর্ণ। ধ্বনি অর্থবহ নয়। যেমন বিভিন্ন বাদ্যের বাজনা।কাঁসর ঘন্টা,বাঁশির সুর, বজ্রের ধ্বনি। মেঘের ডাক। ইত্যাদি। এমনকি  প্রণব কোনো  অর্থবহ ধ্বনি নয়।

ধ্বনি রূপান্তরিত হয় বর্ণে। আর বর্ণ  কিন্তু অর্থবহ। মানুষ এই বর্ণের সাহায্যেই কথা বলে।  তাই অর্থবহ। বর্ণ আবার দুই প্রকার ব্যঞ্জন  বর্ণ ও স্বরবর্ণ। স্বরবর্ণ নিজে থেকে উচ্চারিত হতে পারে। কিন্তু ব্যঞ্জন বর্ণ স্বরবর্ণের সাহায্যে উচ্চারিত হয়।

অগ্নি ও বায়ুর মিশ্রনেই  বর্ণের সৃষ্টি।  বর্ন আর কিছুই নয় আলোর বিন্দুর সমষ্টি।  পরাবিদ্যাবিদ-গন  বলছেন, দেবতারা যখন কথা বলেন, তখন এক আলোর আভা দেখতে পাওয়া যায়। আসলে আমরাও যখন কথা বলি, তখন বাতাসের মধ্যে একটা অগ্নির তরঙ্গ  প্রবাহিত হতে শুরু  করে, সেটাই আমরা আমাদের কান নামক রিসেপ্টর বা গ্রাহক যন্ত্রের সাহায্যে অনুধাবন করি। আর এর পারে প্রক্রিয়া আমরা আলোচনার প্রথমে শুনেছি।

এইবার আমরা শব্দের অর্থ সম্পর্কে শুনবো। শব্দ সবসময় অর্থবহ। আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করবার জন্য এই শব্দের ব্যবহার করি। শব্দের মধ্যে  ধ্বনি অনুরণিত হয়।   এই শব্দের মাধ্যমেই আমাদের জ্ঞানের বিতরণ সম্ভব হয়। আমাদের মধ্যে যে ভাবের উদয় হয়, সেই ভাব প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে এই শব্দ। আবার আমাদের মধ্যে যে জ্ঞানের উদয় হয়, সেই জ্ঞান প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে এই শব্দ। কতকগুলো শব্দের মিশ্রনে তৈরি হয় বাক্য। কতকগুলো বাক্যের মিশ্রণকে আমরা বলি ভাষা। এই ভাষা যেমন সময় ও স্থান ভেদে, জাতিভেদে, অর্থাৎ মানুষই জাতির ক্ষেত্রে এক রকম, জীব জন্তু  ক্ষেত্রে এক রকম, পাখিদের ক্ষেত্রে একরকম। প্রত্যেক জাতির ভাষা আলাদা। তেমনি এই ভাষার আবার ক্রমবিকাশ আছে।

যাই হোক। সৃষ্টির আদি ভাষার নাম বৈজিক বা বৈচিক  ভাষা। অর্থাৎ সমস্ত ভাষার বীজ আছে এই ভাষার মধ্যে। এই বৈজিক ভাষা থেকেই এসেছে আমাদের বৈদিক ভাষা।  বৈদিক ভাষা থেকে এসেছে সংস্কৃত, গ্রিক, ল্যাটিন, আরবি, হিব্রু, ইত্যাদি ভাষা।  আর সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে প্রাকৃত তারপর  সমস্ত আঞ্চলিক ভাষা অর্থাৎ বাংলা - ওড়িয়া - আসামি - মারাঠি -হিন্দি- গুজরাটি-তামিল-তেলেগু ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন আমরা যদি বৈজিক ভাষা জানি তবে আমরা সমস্ত জীবের ভাষা, বা নিখিল বিশ্বের ভাষা  জানতে পারবো, তা সে মানুষের হোক, আর পশু-পাখির ভাষাই হোক।

এখন এটা আমরা জানতে পারবো কি করে ? এর জন্য তো কোনো বিদ্যালয় নেই। এটাই বলছেন, আমাদের মহর্ষি পতঞ্জলি, বলছেন শব্দ-অর্থ-জ্ঞান, এই তিনের মিশ্রিত অবস্থাকে আমাদের ধারনার বিষয় করতে হবে। এই তিনকে একবার আলাদা করে, আবার এই তিনকে একত্রিত করে বোধের বিষয়ে সংযম পালন করতে হবে।  এই সংযম পালন মানে আমরা শুনেছি, ধারণা-ধ্যান-সমাধি করে সংযম আয়ত্ত্ব করা যায়। বাকশক্তির  ধর্ম্ম হচ্ছে শব্দ। আর শব্দই  ভাষার জন্ম দেয়। তাই জগতের প্রথম ভাষা, এই বৈজিক ভাষার উপরে সংযমের সাহায্যেই আমরা এই ক্ষমতা অর্জন করতে পারবো।  অর্থাৎ ধ্বনির তারতম্য অনুসারে এর অর্থ জানতে পারলে যে জ্ঞান আমাদের হবে, তাতেই আমরা সমস্ত প্রাণীর ভাষা বুঝতে পারবো। আসলে সংযম-ই মূল, যা আমাদের সাধনার সাহায্যে আয়ত্ত্ব করতে হবে। ঔষধ একটাই, মাপকাঠি একটাই আর তা হচ্ছে সংযম, যা আমাদের ধারণা-ধ্যান ও সমাধির মাধ্যমে অর্জন করতে হবে, তবেই আমরা সমস্ত বিভূতি বা তথাকথিত অলৌকিক শক্তি অর্জন করতে পারবো। আর এই পথেরই সন্ধান দিয়েছেন, ঋষি পতঞ্জলি। সংযম হচ্ছে আমাদের একটা গুন্ বা শক্তি যা আমাদের চিত্তবৃত্তিকে ধ্যেয় বস্তুতে প্রবাহিত করতে সাহায্য করে, আর ঠিক তখন-ই  আমাদের সেই বস্তু সম্পর্কে সত্যিকারের  জ্ঞান  লাভ হয় ।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।

পূর্ব জন্মের জ্ঞান কি ভাবে লাভ করা যায় ?

মহর্ষি পতঞ্জলি তাঁর যোগদর্শন বইতে বিভূতিপাদ অধ্যায়ের ১৮ নং শ্লোকে পূর্বজন্মের জ্ঞান লাভের উপায় বলেছেন। তিনি বলছেন :
সংস্কার সাক্ষাৎ করনাৎ পূর্বজাতি  জ্ঞানম।
অর্থাৎ সংস্কারের সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষীকরন থেকে পূর্ব জন্মের জ্ঞান লাভ করা যায়।

মহর্ষি পতঞ্জলি বলছেন, সংস্কারের  সাক্ষাৎ করতে পারলে আমরা  আমাদের পূর্ব জন্মের সম্পর্কে জানতে পারবো। অর্থাৎআমার  সংস্কারকে  যদি আমরা ধরতে পারি, তবে আমরা আমাদের আগের  জন্মগুলো সন্মন্ধে জানতে পারবো। তাহলে আমাদের আগে আমাদের জানতে হবে সংস্কার কি ? এবং তাকে আমরা জানবো  কি করে ? সংস্কার হচ্ছে, আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয়ের সংগৃহিত জ্ঞান, যা আমরা আগেই সংগ্রহ করেছিলাম।  অর্থাৎ যে জ্ঞান আমরা আগেই সংগ্রহ করেছি। আর এই জ্ঞান কোথায় থাকে - না এটি আমাদের অবচেতন মনের স্তরে থাকে। আজকের এই যে আমি আর ৬০ বছর আগের যে আমি, তা-যে একই তা আমি বুঝি কি করে, কারন আমার স্মৃতিতে সেই পুরোনো ছবি ধরা আছে। আর সেই স্মৃতি যখন তখন  আমি ইচ্ছে করলেই জাগ্রত করতে পারি। ছোটবেলায় আমি কেমন ছিলাম, কাদের সঙ্গে আমি মেলামেশা করতাম, কিভাবে আমি জীবন-যাপন করতাম তা সব আমার মনে আছে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, স্মৃতির সাহায্যেই আমরা আমাদের পূর্ব জীবনের কথা জানতে পারি। এখন কথা হচ্ছে, আমার এই জীবনের কথা আমি বলতে  পারি, কিন্তু আমি আমার পূর্ব জীবনের কথা অর্থাৎ ১০০ বা ১০০০ বছর  আগে আমি কোথায় ছিলাম, কাদের সাথে ছিলাম, কেমন দেখতে ছিলাম সে সব আমি জানি না কারন আমার মধ্যে সেই স্মৃতি জাগিয়ে তোলার ক্ষমতা নেই। আর পূর্বজীবনের যে দেহ ছিলো, তাও আমার কিছুই মনে নেই।  তাই আমি বলতে পারি না যে আমি আগের  জীবনে কে বা কি ছিলাম। তার মানে এই দেহ ধারণের পর থেকে যা কিছুর আমি সাক্ষী, তার কিছু কিছু আমার মনে আছে মাত্র, সব কিছু নয় ।

এইবার আমরা দেখে নেই স্মৃতি কোথায় সংরক্ষিত হয়, কি ভাবে সংরক্ষিত হয়। আমরা সবাই জানি, স্মৃতি আমাদের মস্তিষ্কে সংরক্ষিত হয়। আর মস্তিস্ক যেহেতু আমাদের স্থূল দেহের অঙ্গ, তাই এই স্থূল দেহের বিনাশে আমাদের কোনো স্মৃতি থাকবার কথা নয়, থাকেও না। এইজন্য আমরা কেউই পূর্ব জীবনের কথা স্মরণে আনতে  পারি না।

এখন দেখে নেই, আমাদের স্মৃতি লোপ পায়  কেন ?  আমরা যেটা ভাবি যে,মস্তিস্ক আমাদের স্মৃতির আধার, সেকথা সত্য। তবে এই স্মৃতি কেবলমাত্র স্থূলদেহের মস্তিষ্কেই থাকে সেটা সত্য নয়। স্থূল দেহের বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে এই স্মৃতি স্থানান্তরিত হয়, এক দেহ থেকে আর এক দেহে। অর্থাৎ আমাদের যে পাঁচটি দেহ আছে, তার মধ্যেও এই স্মৃতি সূক্ষ্ম আকারে থাকে। এবং এক-একটি দেহের নাশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সংস্কার স্থানান্তিরত হতে হতে একদম শেষে আমাদের অভৌতিক দেহ অর্থাৎ কারন দেহে এই স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে। অর্থাৎ  স্মৃতি থাকে আমাদের আত্মা-বুদ্ধি-মন যুক্ত আমাদের কারন দেহে। বার বার জন্ম গ্রহণের ফলে, আমাদের যত  অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে, স্বর্লোক  থেকে বিদায়কালে প্রত্যেকবারই সেগুলো আমাদের কারন দেহকে উপহার হওয়া হয়েছে। সুতরাং  কারন দেহে আমাদের সমস্ত স্মৃতি সংগৃহিত বা সঞ্চিত আছে। স্বর্লোক থেকে যখন আমরা মানসলোকে নেবে এসেছি, তখন আমরা নতুন মানসদেহ ধারণ করেছি। সুতরাং আমাদের পূর্ব জীবনের মানস  দেহে যে  স্মৃতি সঞ্চিত ছিল, সেই মানস  দেহ ত্যাগের ফলে, সেই স্মৃতি আমাদের কারন দেহে স্থানান্তরিত হয়েছে। এবং নতুন উপকরণে আবার নতুন মানসদেহ উৎপন্ন হয়েছে। এই নতুন দেহে পূর্বস্মৃতি কিছুই থাকে না। তবে যে হেতু, আমাদের কারন দেহ চিরস্থায়ী, সেখানে সকল স্মৃতি সঞ্চিত থাকে। কিন্তু জীব যখন নতুন দেহ ধারণ করে, তখন সেই পুরোনো কারন দেহ নতুন শরীরের মধ্যে বর্তমান থাকলেও, মানসদেহ ও মস্তিস্ক নতুন হওয়ায় এবং জীবের জ্ঞান স্থূলে নিবদ্ধ হওয়ায়, অতি সূক্ষ্ম কারন দেহের স্পন্দন তার মস্তিষ্কে কোনো ক্রিয়া উৎপন্ন করতে পারে না। আর এই কারণেই আমাদের মনে কোনো পুরোনো স্মৃতির উদয় হয় না। কোনো কারণে এই স্থূল জগতের জ্ঞান আছন্ন হলে, বা স্থূল জগতের জ্ঞান বদ্ধমূল হলে, কখনো কখনো আমাদের পূর্ব স্মৃতি জেগে উঠতে পারে। অনেক সময় শৈশবে, বা বিকারের ঘোরে, এই ধরনের জ্ঞানের বিকাশ দেখা দেয়।

মানুষ যদি সাধন বলে বর্তমানকে অতিক্রম করে, চিত্তকে প্রশান্ত ও নির্মল করতে পারে তবে কারন দেহের স্পন্দন গ্রহণ করতে সমর্থ হয়। সাধক যখন সাধনার সাহায্যে এই কোষগুলোর উন্মোচন করেন, অর্থাৎ অনন্ময় কোষ, প্রাণময় কোষ, মনময় কোষ, বিজ্ঞানময় কোষ, এবং সব শেষে আনন্দময় কোষে অবস্থান করেন, তখন, তার  এই অবস্থায়, তাঁদের  পূর্ব-পূর্ব জীবনের স্মৃতি মনে জেগে ওঠে। সত্য কথা বলতে গেলে, আমাদের এই কারন দেহই সমস্ত সংস্কারের আঁধার। আর কারন দেহ হচ্ছে, চিরস্থায়ী, লিঙ্গহীন, কিন্তু মানব আকৃতি বিশিষ্ট। ধ্যানের গভীরে যারা প্রবেশ করেছেন, তাদের কাছে এগুলো উপলব্ধির বিষয়। কোনো কল্পনা বা কেবলমাত্র ধারণা নয়। যদিও সাধারণ লোকের পক্ষে এগুলো বোধগম্য না হওয়াই স্বাভাবিক।এই সব অবস্থা, কেবলমাত্র জন্ম জন্মান্তরের সাধনার ফলেই সম্ভব হতে পরে। আর এটাই বলেছেন মহর্ষি পতঞ্জলি, আমাদের সংস্কারকে প্রতক্ষ্য করতে হবে।

যে সব সংস্কার নিয়ে আমরা এই জগতে জন্ম গ্রহণ করেছি, সেগুলো আর কিছুই নয়, পূর্ব জন্মের অভিজ্ঞতা মাত্র। অনেকসময় আমরা আমাদের নিজেদের অজ্ঞাতসারে এটা আমরা অনুভব করে পারি। আমাদের বাড়ির পাশের সাহাবাবুকে দেখেছি, ঝড় হতে পারে, এই কথা শুনলে, তিনি উতালা হয়ে ওঠেন। পেপারে যদি ঝড়ের খবর নজরে পড়ে, তবে সামনে যাকে পাবেন, তাকেই জিজ্ঞেস করবেন, আবহাওয়া দপ্তর ঠিক বলছে কি?  যদি বলে ঠিক বলছে, তবে সাহাবাবু দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে, উর্দ্ধশ্বাসে বাড়ির দিকে ছুটবেন। এগুলো সবই পূর্ব জীবনের ভয়ানক অভিজ্ঞতার অস্পষ্ট স্মৃতি। অনেকের, অনেক ছোট বয়সে, বিভিন্ন প্রতিভা দেখতে পাই। অনেক সময় দেখবেন, দুদিনের পরিচয়ে কাউকে মনে হয় যেন কত কালের আপন জন। আবার অনেকের সাথে বহুদিনের আলাপ সত্ত্বেও ঘনিষ্টতা জন্মায় না। অনেক সময় আমাদের যদি বাহ্যজ্ঞান লোপ পায়, তখন আমাদের অন্তরের চৈতন্য দ্বারা সঞ্চিত সংস্কারপুঞ্জ অবস্থা বিশেষে সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে।

মানুষে মানুষে এত বৈষ্যমের কারণও এই সংস্কার। আসলে আমরা কে কত জীবন ধরে এই মনুষ্যদেহ ধারণ করছি তা আমরা জানি না। আগের জন্মে কি ছিলাম, কি করতাম তা আমরা জানি না। কিন্তু একথা সত্য, আপনি এই জন্ম যেখানে শেষ করছেন, সামনের জীবনে সেখান থেকে শুরু করবেন। আগের জীবনে আমি যদি পশু থেকে থাকি, তবে, এই জনমে আমার মধ্যে সেই পাশবিক প্রবৃত্তি দেখা দিতেই পারে। কারন সেই পূর্বজন্মের সংস্কার তো এত তাড়াতাড়ি চাপা পড়বার নয়। নতুন সংস্কার এসে পুরোনো সংস্কার চাপা দিতে পারে। অতএব যে যত  তাড়াতাড়ি নতুন ও শুভ সংস্কারের জন্ম দিতে পারবেন, সে তত তাড়াতাড়ি পুরুনো সংস্কারকে চাপা দিতে পারবেন।অথবা পুরোনো সংস্কারকে পরিশীলিত করে নিতে পারবেন। আগের জীবনে যিনি পশুরাজ ছিলেন, এই জীবনেও তার রাজা হবার ইচ্ছে বা সংস্কার কাজ শুরু করে দেবে।  সংস্কার কখনো লোপ পায় না, অনুরূপ পরিস্থিতির ছোঁয়া পেলেই পুরুনো সংস্কার  ক্রিয়াশীল হতে শুরু করে, সংস্কারকে জাগিয়ে তুলতে দরকার শুধু অনুকুল  পরিস্থিতি।  অর্থাৎ সংস্কারগুলোকে  অবচেতন স্তর থেকে চেতন স্তরে নিয়ে আসতে কেবলমাত্র পরিবেশ-পরিস্থিতি ।  তা সে শুভ হোক আর অশুভ হোক। অশুভ সংস্কার জাগ্রত হতে পারে না, যদি  নতুন ভাবনা চিন্তা দ্বারা মানুষ শুভ সংস্কার তৈরি করতে পারেন । আধ্যাত্মিক জগৎ-এর মানুষেরা এই কাজটাই করে থাকেন।  অর্থাৎ তাদের চিন্তার জগতে শুভ সংস্কার বা শুভ চিন্তার জন্ম দিতে থাকেন, অনবরত । নতুবা মানুষ তার পুরোনো সংস্কার অনুযায়ী, অনুন্নত জীবনের পথে বা বর্বর জীবনের প্রতি ধাবিত হবে, স্বভাব বশতঃ । এটাই সাধারণ মানুষের জন্য স্বাভাবিক পরিণতি। তাই আমরা যদি মানব থেকে মহামানব হতে চাই, তবে আমাদের প্রতিনিয়ত নতুন শুভ সংস্কারের জন্ম দিতে হবে। একটু খেয়াল করলে দেখতে পারবেন, পৃথিবী থেকে ধীরে ধীরে হিংস্র জীব লোপ পাচ্ছে, কিন্তু হিংস্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তার কারন, জীবের ক্রমবিকাশের নিয়মেই জীবের উন্নতি হচ্ছে। ক্রমবিকাশে দেহের পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু বৃত্তির পরিবর্তন হতে আরো সময় লাগবে।  যাইহোক, আমাদের আলোচ্য বিষয় আজ এটা নয়, তাই এব্যাপারে আমরা আর কথা বাড়াবো না।

সবশেষে আমি বলবো, আমাদের পূর্ব জীবনের কথা আমরা নাই বা জানতে চাইলাম, নাই বা নিজেকে লজ্জ্বা দিলাম। বরং আসুন আমরা ধ্যানের  মাধ্যমে  চিত্তকে শান্ত করি আর প্রতিনিয়ত শুভ চিন্তার আকর্ষণ করি। নিজেকে সমৃদ্ধ করি।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।  

আলোচনা শুনছিলাম , ঋষি পতঞ্জলি উক্ত বিভূতিপাদ থেকে। আর এখানে, এই বিভূতিপাদে  আছে, সব অলৌকিক শক্তি লাভের  উপায়। আর এ সব কথা শুনে, কিছু বিজ্ঞান-মনস্ক, আর কিছু উর্বর মস্তিষ্কের মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন, আপনার কি এসব সিদ্ধিলাভ হয়েছে ? তাদেরকে আমরা  বলি, দয়াকরে, আজকের কথাগুলো একটু ধৈর্য্য ধরে শুনবেন। সংযমে সিদ্ধিলাভ আর তার বিভিন্ন প্রয়োগ-ফল উপলব্ধি করা এক জিনিস নয়।  না আমাদের  সে উপল্বদ্ধিও হয় নি। উপলব্ধি করবার ইচ্ছেও আমাদের  জাগ্রত হয় নি। আমরা  এইসব শ্লোকের ব্যাখ্যাকার মাত্র। আমরা  এর অর্থ বর্ণনা করেছি মাত্র। তর্ক দ্বারা এসব বোধগম্য হতে পারে না। যাঁরা  এই বিষয়টি অনুভব  করেছেন, আপনি তাদের নিকট বিষয়ের গভীরে গিয়ে অনুধাবন করতে পারলে, আপনার কাছে বিষয়ের সত্যতা অনুভব অবশ্য়ই হতে পারে । অন্ধ বিশ্বাস যেমন আমাদের  বিষয়ের গভীরে নিয়ে যেতে পারবে না, তেমনি অন্ধ অবিশ্বাস, বা  অন্যকে প্রশ্ন করে, এসব বিশেষ জ্ঞান আমাদের  উপল্বদ্ধিতে আসবে না। নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, এবং বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে হবে । ধ্যান ধারণা করলে   এই সত্যে উপনীত হওয়া যাবে যে, এগুলো প্রতিষ্ঠিত সত্য। তা কেউ  বিশ্বাস করুন, আর নাই করুন। সত্য সত্যই থাকবে, আপনার আমার  বিশ্বাস বা অবিশ্বাস এই সত্যের  পরিবর্তন করতে পারে না।
যাঁরা মহর্ষি পতঞ্জলির যোগদর্শন বইটি ভালোভাবে বুঝেছেন, তারা দেখেছেন, মহর্ষি প্রথমে সমাধিপাদের কথা, অর্থাৎ কোথায় যেতে হবে, অর্থাৎ আমাদের লক্ষ্য কি হবে। তারপরে সাধন পাদের কথা, অর্থাৎ আমাদের কি করতে হবে। এর পর বিভূতিপাদের কথা, অর্থাৎ এই সাধনপথে যাবার বাঁধা কি হতে পারে,অর্থাৎ  এসব করতে গেলে, যে শক্তি সাধকের মধ্যে জাগ্রত হবে তা অলৌকিক। আর  এইসব অলৌকিক শক্তির প্রয়োগ করতে গেলে, আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশের পথ থেকে ভ্রষ্ট হবার সম্ভাবনা, সেই কথাই  স্বয়ং ঋষি পতঞ্জলি  উল্লেখ করেছেন, এই বিভূতিপাদে । একদম শেষে বলেছেন, কৈবল্যপাদের কথা।  অর্থাৎ সাধনার সমাপ্তি। আসলে আমরা অষ্টাঙ্গ সাধনার পথের কথা শুনতে বা সেই পথে চলতে অক্ষম, অথবা বলা যেতে পারে এই পথে চলতে আমরা আগ্রহী নোই। কিন্তু অলৌকিক শক্তি আয়ত্ত্ব হতে পারেএটা  শুনলে আমাদের আগ্রহ হতে পারে। এই সব অলৌকিক শক্তি আসলে সাধনার পার্শ্ব-প্রিতিক্রিয়া মাত্র , এগুলোর দিকে খেয়াল দিলে, সাধক পথভ্রষ্ট হন। জমি-তো সবারই সাড়ে-তিন হাত, তাতে আপনি লাউ-কুমড়োর চাষ করবেন, না ফুলের চাষ করবেন, সেটা আপনার উপরে নির্ভর করবে। কোনো মহাপুরুষেরই চারটে  কান, চারটে চোখ, ১০টা হাত হয় না। এসব আমাদের কল্পনা। আপনার মধ্যে সমস্ত শক্তি সুপ্ত অবস্থায় আছে, তাকে জাগিয়ে তোলা বা না তোলা, আপনার ইচ্ছাশক্তির বিভিন্নতার উপরে নির্ভর করবে। বিশ্বাস -অবিশ্বাসের দোলায় দোল না খেয়ে, কর্ম্মে নিজেকে নিয়োজিত করুন, আর তার ফল প্রতক্ষ্য করুন। আবারো বলি, এগুলো আসলে সাধনপথের বাঁধা স্বরূপ। তাই মহর্ষি আমাদের এই সব বিষয়ে সতর্ক করেছেন মাত্র। আমরা সেই সতর্ক বাণীগুলোই শুনছি।
এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি, গল্প তো অনেক আছে, আসলে যোগীদের অলৌকিক প্রকাশ পায়  মাত্র। প্রকাশ করেন না। একবার মহাযোগী গোক্ষনাথ পথ চলতে চলতে পাঞ্জাবের পালামপুরে এসেছেন, পাহাড়ের কোলে জনবিরল গ্রাম। ভাবলেন, এখানে থেকে কিছুদিন সাধন ভজন করবেন। দেহমনে ক্লান্তি, ক্ষুধাও পেয়েছে। একটা বট  গাছের নিচে  আসন পেতে ঘুমিয়ে পড়লেন। সরলসোজা এক চাষীর ছেলে, হঠাৎ সেখানে এসে দেখে, এক প্রসন্ন-বদন সাধু।  সাধুকে দেখে ছেলেটি আকৃষ্ট হলো। নিদ্রা ভঙ্গ হলে, ছেলেটি সাধুকে বললো, আপনি যতদিন ইচ্ছে এখানে  থাকুন,  আমি আপনার খাবারদাবার সমস্ত ব্যবস্থা করে দেব। গোরক্ষনাথ বললেন, বেটা, আমি কিছুদিন উপবাসী থাকবো, আমার খাবার দাবার দরকার নেই, বরং তুমি কিছু শুকনো কাঠ এনে দাও আমাকে। আমি এখানে ধুনি জ্বেলে ধ্যান-জপ করবো। আর একটা কথা শোনো, আমার কথা তুমি কাউকে বোলো না। তাহলে আমার কাজের ব্যাঘাত হবে। তো কিছুদিন এইভাবে চললো, ছেলেটি গোরক্ষনাথকে ধুনীর শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে এনে দেয়।  আর গোরক্ষনাথ ধ্যান-জপে নিমগ্ন থাকে। একদিন হলো কি, ছেলেটির কি মনে হলো, গোরক্ষনাথকে দিনের পর দিন, অভুক্ত থাকতে  দেখে, বাড়িতে মা-বাবাকে বলে, সে গোরক্ষনাথের জন্য, কিছু আটা, ঘি, চিনি, সবজি নিয়ে এলো। তো গোরক্ষনাথ ছেলেটিকে বকাবকি করলো। বললো, তোকে না বলেছি, কাউকে কিছু না বলতে। এতে, ছেলেটি কাঁদতে লাগলো। ছেলেটির কান্না দেখে, গোরক্ষনাথের মন কোমল হয়ে পড়লো। বললো, ঠিক আছে, সব রেখে দে, শিবজীর ভোগ হবে। এখন ছেলেটি সবই এনেছে, আগুনও ধুনিতে আছে, কিন্তু জল নেই। কাছে কোথাও জল  নেই। যোগী তার দন্ডটি দিয়ে, কাছেই ভূমিতে বিদ্ধ করতেই সেখানে স্বচ্ছ জলের ঝর্ণাধারা বইতে লাগলো। ছেলেটির তো চোখ ছানাবড়া। যাই হোক, শিবজীর ভোগ রান্না হলো। শিবজীকে, নিবেদন করা হলো। তারপর সেই ভোগসামগ্রী ছেলেটির হাতে দিয়ে বললো, বাড়ি নিয়ে যা, সবাইমিলে প্রসাদ খাবি। তো ঠিক তক্ষুনি ঘটে গেলো, এক অলৌকিক ঘটনা, গোরক্ষনাথের হাতের ছোঁয়ায় ছেলেটি অজ্ঞান হয়ে গেলো। আর গোরক্ষনাথ সেখান থেকে ভেগে পড়লো, অন্য সাধনক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে।

এই ছেলেটির নাম গুগা।  আজ সেখানে অর্থাৎ পাঞ্জাবের পালামপুরে, গুগার মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিবছর সেখানে বিশাল মেলা বসে।

তো যে কথা বলছিলাম,  যোগীর সংযম আয়ত্ত্ব হলে, সংযমের মাধ্যমে তিনি অসীম ধীশক্তির অধিকারী হন। আর তিনি যে বিষয়ে মনোনিবেশ করেন, সে বিষয়ে তার সজ্ঞা উপস্থিত হয়। এই সজ্ঞাই আমাদের উপল্বদ্ধিজাত জ্ঞান। এগুলো বিশ্বাসের বস্তু নয়, আবার অবিশ্বাসের বস্তুও নয়, সাধনায় উৎকর্ষতা অর্জন করতে পারলে, এগুলো অনুভূতিতে আসে। আর একটা কথা বলি, আপনি যখন কষ্ট  করে অর্থ উপার্জন করেছেন, তার অপব্যায় নিশ্চই আপনি চাইবেন না। যোগীরাও তাদের অর্জিত শক্তির অপচয় চান না।

এবার আমরা আসবো, মহা-ঋষি পতঞ্জলির যোগদর্শনের বিভূতিপাদের ১৯ নং শ্লোক থেকে কি কি বলেছেন ।

১৯ নং শ্লোকে বলছেন : সংযমের অপরের চিত্তের সাক্ষাৎকার করলে, অপরের চিত্তের জ্ঞান হয়।
২০ নং শ্লোকে বলছেন : কিন্তু সেই জ্ঞান, যোগীর অবলম্বন হয় না।  কেননা অপরের চিত্ত যোগীর চিত্তের বিষয় নয়।
২১ নং শ্লোকে বলছেন : এই স্থূল শরীরের রূপের উপরে সংযম করলে,  শরীরের যে গ্রাহ্য শক্তি তাকে অবরোধ করা সম্ভব হয়। তখন চোখের প্রকাশের সঙ্গে যোগী অন্তর্ধান করেন। এখানে মহর্ষি পতঞ্জলি এক অদ্ভুত বিদ্যার কথা বলছেন। যোগী অর্থাৎ যিনি সংযম আয়ত্ত্ব করতে পেরেছেন, তিনি ইচ্ছে করলে, নিজের এই স্থূল দেহকে বা অবয়বকে অন্যের দৃষ্টিশক্তির বাইরে নিয়ে যেতে পারেন। এগুলো আমাদের কাছে, ম্যাজিকের মতো। একটা জলজ্যান্ত  মনুষ্য দেহ আপনার আমার চোখের সামনে থেকে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাবে, এটা আমরা ভাবতেই পারি না।

এইব্যাপারটা বুঝতে গেলে আমাদের তত্ত্ব সম্পর্কে একটা ধারণা থাকতে হবে। সৃষ্টির চেতন-অচেতন যাবতীয় পদার্থ পঞ্চ-তত্ত্বে গড়া। যিনি এই তত্ত্বের অতীত তিনিই পরম -ঈশ্বর। এই পঞ্চতত্ত্বের অধিদৈব রুপই বিশ্বসৃষ্টির মূল উপাদান  অর্থাৎ পঞ্চমহাভূত। এই পঞ্চতত্ত্বের আধ্যাত্মিক রূপই প্রাণময় জগৎ এবং পঞ্চপ্রাণ যুক্ত আমাদের এই ব্যষ্টি  দেহ।

আমাদের দেহের হাড়, মাংস, চামড়া, নাড়ী এবং লোম, এই পাঁচটি জিনিস ক্ষিতিতত্ত্ব থেকে উৎপন্ন হয়েছে। শুক্র, লালা অর্থাৎ রস, রক্ত, মজ্জা, মূত্র এই পাঁচটা জিনিস অপ তত্ত্ব থেকে উৎপন্ন হয়েছে। তেজ তত্ত্ব থেকে উৎপন্ন হয়েছে, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা, শ্রান্তি ও আলস্য।  ধারণ, চালান, ক্ষেপন, সংকোচন ও প্রসারণ, এই পাঁচটি বায়ুতত্ত্ব থেকে উৎপন্ন হয়েছে।  আর ব্যোম তত্ত্ব থেকে এসেছে, রাগ দ্বেষ, লজ্জ্বা, ভয় ও মোহ।

যোগঋষিরা কখন কোন তত্ত্ব আমাদের দেহের উপরে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে, এবং কোন দেহে কতক্ষন স্থায়ী হয়, এগুলো নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষেপন করেছেন। আমাদের দেহ স্থুল, এখানে পৃথ্বী তত্ত্বের আধিপত্য। এই পৃথ্বী বা ক্ষিতিতত্ত্বই আমাদের দেহে দীর্ঘ সময় কার্যকরী থাকে। তাই এই দেহ দৃশ্যমান। আমাদের এই দেহ থেকে যদি আমরা পৃথ্বী তত্ত্বের প্রভাবকে স্তিমিত করে, অপি তত্ত্বের প্রাধান্য বাড়াতে পারি, তবে আমাদের দেহ গ্যাসীয় পদার্থে পরিণত হয়ে যাবে। লবন যখন  জলে মিশ্রিত হয়, তখন লবন দৃশ্যমান থাকে না।   আবার আমরা যদি আমাদের তেজতত্ত্ব বা বায়ুতত্ত্বের প্রাধান্য বাড়াতে পারি, তবে বায়বীয় বা তেজময় দেহ হয়ে হবে আমাদের।কর্পূর যথন যখন বায়ুর মধ্যে উবে রায়, তখন তা দৃশ্যমান থাকে না।  তখন আমরা বায়ুর মতো বা বিদ্যুতের মতো সবত্র অবাধ গতি লাভ করতে পারবো। এইসময় আমরা শুদ্ধমনের দীপ্তিমান অন্তরে বাস করবো। এরও পরে, আমরা যদি ব্যোমতত্ত্বের সীমানা অতিক্রম করতে পারি তবে আমরা সেই তত্ত্বাতীত পরমাত্মাকে লাভ করতে পারবো।

এইসব কথা আমি যত  সাধারণ ভাবে বলে গেলাম, এগুলো বোঝা, উপলব্ধি করা ও কার্যকরী করা, আমাদের মতো সাধারণের পক্ষে অসম্ভব। জন্ম জন্মান্তরের সাধনাই এই জ্ঞান দান  করতে  সক্ষম।আর   এই জ্ঞান বিতরণের মাধ্যম একমাত্র মৌনতা।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।

আলোচনা চলবে। .........

12/02/2020.

বিভূতিপাদ - শ্লোক নং -  ২২-২৫
১২৯৪ সালের অগ্রহায়ন মাস। মহাত্মা ত্রৈলঙ্গ স্বামী তার ভক্ত ও শিষ্যদের ডেকে বললেন, ঠিক একমাস বাদে, আগামী জন্ম তিথিতে আমি দেহত্যাগ করবো। মৃত্যুর ঠিক একদিন আগে আবার, তিনি সবাইকে ডেকে বললেন,  আগামীকাল আমি আর বিশেষ কথা বলবো না, তোমাদের যার যা ইচ্ছে তা আজ রাতেই তোমরা জেনে নাও।  এর পরে, ১২৯৪ সালের, পৌষ মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে তিনি তাঁর ইচ্ছে মতো, দেহ রেখেছিলেন। এগুলো কোনো গল্প কথা নয়, বাস্তব সত্য। কি ভাবে, এটা সম্ভব ? আগাম মৃত্যু সংবাদ সংবাদ জানা, না ইচ্ছে মৃত্যু ?

ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, (শ্লোক -২২ - বিভূতিপাদ) মানুষের কর্ম্ম যখন ফল-প্রসবে উন্মুখ হয়,অথবা ফল প্রদানে বিমুখ হয়, অর্থাৎ এক্ষুনি ফল দেবে, অথবা ভবিষ্যতে ফল দেবে এমনসব কর্ম্ম, এই দুই ধরনের কর্ম্মে প্রতি সংযম পালন করলে, অরিষ্ট নামক কতকগুলো লক্ষণ দ্বারা যোগী মৃত্যুকালের জ্ঞান লাভ করতে পারেন।
অর্থাৎ আমাদের কর্ম্ম দুই প্রকার প্রথমত যে কর্ম্ম এক্ষুনি ফল প্রদান করবে। আর যেসব কর্ম্ম ভবিষ্যতে ফল প্রদান করবে। একটাকে বলছেন, সোপক্রম অন্যটি নিরুপক্রম। এই ব্যাপারটা আচার্য্য শঙ্করাচার্য্য এক সুন্দর উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন।  বলছেন, একটা শাড়ী ভেজানো হলো।    মনে করুন জল হচ্ছে, কর্ম্ম। তো একটা শাড়িতে  জল দিয়ে ভেজানো হলো। এইবার স্বাভাবিক প্রকৃতির নিয়মে শাড়ী কিন্তু শুকোবে। এখন যদি আপনি শাড়িটাকে বিছিয়ে দেন, তবে শাড়ি তাড়াতাড়ি শুকোবে আর আপনি যদি  শাড়িটাকে স্তুপ করে রাখেন, তবে শাড়ি শুকোতে দেরি হবে। এখন আমাদের  দেহ যখন  কর্ম্মে  লিপ্ত হলো। তখন সে ভেজা শাড়ির অবস্থায় গেল। এইবার একে  শুকোতে গেলে, তো শরীর যদি উন্মুক্ত থাকে তবে তাড়াতাড়ি শুকোবে আর যদি শরীর যদি স্তূপীকৃত থাকে তবে শুকোতে দেরি হবে।
আমরা জন্ম গ্রহণ করি আমারদের প্রারব্ধ কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য। কিন্তু আমাদের বিড়ম্বনা হচ্ছে, কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য যে যে শরীর আমরা পেয়েছি বা ধারণ করেছি, সেই শরীরের দ্বারা  আমরা আবার কর্ম্মে প্রবৃত্ত হচ্ছি। ফলতঃ ভালো বা খারাপ যে কর্ম্মই আমরা করি না কেন, তার ফল ভোগ করবার জন্য আমাদের আবার শরীর ধারণ করতে হচ্ছে। অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আমরা আবার নিজেদেরকে  আবদ্ধ করছি।

ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, আমাদের এক জীবনে যে কর্ম্ম আমরা করে থাকি, তা দুই রকম, একটা এক্ষুনি ফল প্রদান করবে অর্থাৎ সোপক্রম আর অন্যটি নিরুপক্রম অর্থাৎ ভবিষ্যতে ফল প্রদান করবে। এই দুটো কর্ম্মের উপরে আমরা যদি ধ্যান লাগাতে পারি, তাহলে আমাদের মরন কালের জ্ঞান হয়ে যায়। তিনটি মরন চিহ্ন - বা অরিষ্ট - আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক, আধিদৈবিক।

আধ্যাত্মিক - কান বন্ধ  করলে আমরা একটা  শব্দ শুনতেপাই, মৃত্যু আসন্ন হলে আমরা সেই শব্দ শুনতে পাই না। অথবা চোখ বন্ধ করলে আমরা জ্যোতি না দেখতে পাওয়া।
আধিভৌতিক : যম-পুরুষের দর্শন। পিতৃপুরুষদের দর্শন।
আধিদৈবিক : হঠাৎ সিদ্ধ পুরুষদের দর্শন, বা স্বর্গ-দর্শন।

ঋষি পাতাঞ্জন বলছেন, এইভাবে বিভিন্ন লক্ষণ দেখলে বুঝতে হবে, তার মৃত্যুকাল উপস্থিত হয়েছে।

শ্রী বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী, একবার তার গুরুদেবকে (ব্রহ্মানন্দ পরমহংস) জিজ্ঞেস করলেন, অনিমাদি সিদ্ধির কথা যে শাস্ত্রে আছে, তা কি সত্য ?" তো গুরুদেব তাকে একটা নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে, অষ্টসিদ্ধির অবস্থাগুলো একেএকে দেখাতে লাগলেন।  অর্থাৎ শুন্যে ভাসা, সূক্ষ্ম হয়ে এক পর্বত থেকে আর এক পর্বতে চলে যাওয়া, নিজ দেহ থেকে আত্মাকে বের করে, অন্য মৃত দেহে প্রবেশ করানো, এবং সেই মৃত দেহের সাহায্যে কথা বলা ইত্যাদি ইত্যাদি।  এর পর জিজ্ঞেস করলেন, এবার বিশ্বাস হয়েছে ?  সাধন করতে থাকো, এই সব ক্ষমতা তোমারও  জন্মাবে।  কিন্তু জেনে  রেখো এগুলো কিছুই নয়, সাধন জগতের বিভূতি মাত্র। এর পর গোস্বামিজী, বিন্ধ্যাচলে গিয়ে কঠোর সাধনা করতে থাকেন। এতে করে তার মধ্যে একটা অদ্ভুত ভাব প্রকাশ পেতে থাকে। এতে তিনি ভয় পেয়ে যান এবং ভাবতে থাকেন, এটা আমার মানষিক নয় তো ? পরে গুরু সাক্ষাৎকালে গুরুদেবকে এই কথা বললে, গুরুদেব তাকে হঠযোগ প্রদীপিকা, ও বিচার সাগর নাম দুটো বই পড়তে  বলেন। বই-দুটো পড়ার পরে, তিনি বুঝতে পারেন,  এগুলো যোগেরই অবস্থা মাত্র।  কোনো রোগ নয়।

এর পরের শ্লোকে বলছেন - (২৩) মৈত্রী, করুনা ও মুদ্রিতাকে সংযম করলে আমরা চিত্ত প্রসাদরূপ বল লাভ হয়।
নির্দিষ্ট কোনো কিছুর প্রতি চিত্তকে নিবিষ্ট করলে আমাদের মধ্যে ভাবনার উদয় হয়। এই ভাবনা তিন প্রকার।  ১. মৈত্রী বা মিত্রতা ; ২. করুনা ও ৩. মুদিতা।যিনি ভালো আছেন বা সুখে আছেন, অর্থাৎ  প্রাণীতে ভাবনা চিন্তন করলে আমাদের মৈত্রী-বল উৎপন্ন হয়। আবার দুঃখিত প্রাণীদের উপরে করুন প্রদান করলে আমাদের করুনা-বল উৎপন্ন হয়। আবার পুণ্যশীল মানুষের মধ্যে আমরা ভাবনাকে প্রবাহিত করতে পারলে আমাদের মুদিতা বা হর্ষ বল লাভ হতে পারে। আসলে সংযম-ই বল উৎপাদনের উৎস।

(২৪) যোগী যদি হাতির বলের উপরে সংযম করেন, তবে তিনি হাতির মতো বলশালী হতে পারেন।

অর্থাৎ যা কিছুর উপরে আপনার ভাবনাকে নিবদ্ধ করছেন, বা সংযম করছেন, তিনি সেই মত বল লাভ করতে পারেন।  আপনি যদি বায়ুর উপরে সংযম করেন, তবে আপনি বায়ুর শক্তি অর্জন করতে পারবেন। দেবতাদের উপরে সংযম করেন, তবে আপনি দেবতাদের মতো বলশালী হতে পারেন। অর্থাৎ আপনার মন কিসের উপরে ভাবনা চিন্তা করছে, কিসের উপরে আপনার মনকে নিবিষ্ট করছেন, সেই শক্তি আপনার আয়ত্ত্বে আসতে  থাকবে।

(২৫) প্রবৃত্তি আলোক চিত্তে পড়লে, যোগীর সূক্ষ্ম, ব্যবহিত ও বিপ্রকৃস্ট বস্তুর জ্ঞান লাভ হয়।

প্রবৃত্তির আলোক চিত্তে পড়লে অর্থাৎ মনের জ্যোতিস্মতি প্রবৃত্তি তার যে আলো, তাতে সংযম করলে যোগী সূক্ষ্ম বস্তু, আড়ালে থাকা বস্তু ও দূরে থাকা বস্তু সম্পর্কে জানতে পারেন। এখন কথা হচ্ছে, এই জ্যোতিষ্মতী আলোক ব্যাপারটা কি ? আমরা যখন হৃদয়পদ্মে ধ্যান ধারণা করি তখন এক বুদ্ধিসত্ত্বের সাক্ষাৎ হয়।  সেই বুদ্ধিসত্ত্ব জ্যোতির্ময় আকাশ হিসেবে কল্পনা করা হয়। এই আলোর স্থিতির গভিরতা অনুযায়ী একে সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, মনি, ইত্যাদির প্রভার সঙ্গে এর সাদৃশ্য লক্ষিত হয়।  এইসময় আমিত্বে অর্থাৎ আমার হৃদয়পদ্মে স্থিত শুভ্র জ্যোতিষ্ময় ব্রহ্মে স্থিত চিত্ত একটা শান্ত, তরঙ্গবিহীন  আলোর সমুদ্রের মতো নিজেকে বা আমিত্বকে অন্তহীন বলে ধারণা হয়।  এই অবস্থায় যোগী বিষয়বতী কিন্তু একমাত্র আমি - এইরূপ উপলব্ধি করতে থাকে। একেই বলাহয় জ্যোতিষ্মতী।

আরো একটু খোলসা ভাবে ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করা যাক। আমাদের হৃদয়দেশে যে খালি জায়গা আছে তাকে মহাকাশের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। নাভিদেশ থেকে বারো আঙ্গুল উপরে, কণ্ঠদেশ থেকে নিচে, শুনি স্থান।  এখানে পদ্মের মাঝখানের অংশের মতো কিন্তু অধোমুখ হয়ে অবস্থান করছেন, হৃদয় পুন্ডরীক। ধ্যান ধারণায় এই পদ্ম প্রস্ফুটিত হয়। তখন হৃদাকাশ হয় জ্যোতিস্মান। আমাদের আনন্দের আতিশয্যে বা গভীর দুঃখের অনুভূতিতে এই হৃদেশে একটা অনুভূতি হয়। ঠিক তেমনি ধ্যান-ধারণায় ধীরে ধীরে আমাদের সমাধি লাভ হয়। এই সমাধি অবস্থায় এই জ্যোতির্ময় আলোকের মধ্যে বুদ্ হয়ে বসে থাকে আমরা। আর এই অবস্থা আমাদের ভাবনার বোধিসত্ত্বে পৌঁছে দেয়।  ধারণা ধ্যান ও সমাধি যখন পরিপক্ক হয়, তখন তাকে বলে সংযম।

মহর্ষি পতঞ্জলি বলছেন,  যোগী যখন জ্যোতিস্মতী প্রভার সঙ্গে ধ্যানস্থ থাকেন, তখন তার মধ্যে দূরের বস্তু, বা সূক্ষ্ম বস্তু, বা লুক্কায়িত বস্তু, অর্থাৎ সব বস্তু সম্পর্কে সম্যক  জ্ঞান হয়।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।   হরি ওম।

সমস্ত ভুবন জ্ঞান :

ঋষি পতঞ্জলি তাঁর যোগ দর্শনের বিভূতিপাদ অধ্যায়ে (২৬)নম্বর শ্লোকে বলছেন :
ভুবনজ্ঞানং সূর্যে সংযমাৎ। অর্থাৎ সূর্যদ্বারে সংযম করলে ভুবন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়।

এখানে দুটো জিনিস বুঝবার আছে।  এক ) আমাদের সংযম করতে হবে সূর্যদ্বারে। দুই) তাহলে নাকি আমাদের ভুবন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ হবে।
এখন কথা হচ্ছে সূর্যদ্বার কি ?  আমাদের শরীরের ব্রহ্মদ্বার হচ্ছে সূর্যদ্বার। আমাদের সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে আছে, বজ্রাক্ষা নাড়ী, বজ্রাক্ষা নাড়ীর মধ্যে আছে চিত্রাণি নাড়ী। এই সুষুম্না নাড়ী তার মধ্যে অন্তর্লীন দুটো নাড়ী নিয়ে কুণ্ডলিনী থেকে আমাদের মস্তিষ্কের উর্ধভাগে ব্রহ্মান্ড বিন্দুতে মিলিত হয়েছে। এই ব্রহ্মান্ড বিন্দুতে যখন যোগী ধ্যান করেন, তখন তার সমস্ত ব্রহ্মান্ড সম্পর্কে জ্ঞানের  উদয় হয়। এই ব্রহ্মান্ড বিন্দুই আসলে সূর্যদ্বার। এখানেই সূর্য্যশক্তি বা বিশ্বশক্তির সঙ্গে জীবশক্তির মিলন হয়।

এবার আমরা আরো গভীরে যাবো, এই ব্রহ্মান্ড বলতে আমরা কি বুঝি ? আসলে ব্রহ্মান্ড সন্মন্ধে আমাদের পক্ষে ধারণা করা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভব। মানুষ এই পৃথিবীর মধ্যে একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কিট  মাত্র। আর এই পৃথিবী ব্রহ্মান্ডের মধ্যে একটা টিটিকির ডিম্ মাত্র। আসলে বীজ তার সম্ভাবনা সম্পর্কে জ্ঞাত নয়। একটা শিশু যেমন জানে না, সে ভবিষ্যতে কি হতে পারে। একটা বটবৃক্ষের বীজ জানে না তার মধ্যে এক বিশাল মহীরুহ অপ্রকাশিত হয়ে রয়েছে। আমরা জানি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে, আমরা দেহাতীত হয়ে যেতে বাধ্য হবো। কিন্তু এমন যোগী আছেন, যিনি তার এই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াকে সম্পূর্ণভাবে  নিজের আয়ত্ত্বে রাখতে পারেন।  এমনকি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ  করে রাখতে পারেন, আবার তারা শরীর  ছেড়েও যান না। এইরকমই এক মহাত্মা ছিলেন, আমাদের আচার্য্য শঙ্করাচার্য। আমরা তার মুখ থেকে শুনবো, ব্রহ্মান্ড বা ভুবন বলতে কি বোঝায় ?

ভুবনের বিন্যাস করা হয়েছে প্রথমত সপ্তলোকে। ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ, তপঃ ও সত্যম।

প্রথম পর্য্যায়ে অবীচি  অর্থাৎ নরক বা পাতাল  থেকে শুরু করে, মেরুপৃষ্ঠ পর্য্যন্ত - ভূ-লোক। বীচি কথাটার অর্থ হচ্ছে তরঙ্গ, তো অবীচি কথাটার  অর্থ হচ্ছে তরঙ্গবিহীন, তো  যে স্তরে কোনো তরঙ্গ থাকে না তাকে বলে ভূ-লোক বা ভুর্লোক।    
দ্বিতীয় পর্য্যায় হচ্ছে মেরুপৃষ্ঠ থেকে ধ্রুবলোক পর্যন্ত অর্থাৎ গ্রহ নক্ষত্র তারায় শোভিত যে লোক তাকে বলে - অন্তরীক্ষ লোক বা ভুবর্লোক। 
এর পরে আছে স্বর্গ লোক। এই স্বর্গলোক পাঁচ রকমের। 
তৃতীয় পর্য্যায়ে আছে - মাহেন্দ্র লোক।
চতুর্থ পর্য্যায়ে আছে - মহর্লোক - যা প্রজাপতি সম্মন্ধীয়।
পঞ্চম - জনলোক
ষষ্ঠ - তপোলক
সপ্তম - সত্যলোক।
 এই শেষ তিনটি লোককে অর্থাৎ জনঃ তপঃ সত্যঃ - এই তিনটি লোককে একত্রে বলা হয়ে থাকে ব্রাহ্মলোক।

অর্থাৎ একদম উপরে, ব্রাহ্মলোক, যার তিনটি ভাগ, সত্যঃ, তপঃ, জনঃ,। এর পরে দ্বিতীয় স্তরে  স্বর্গলোক যা পাঁচ রকমের। তৃতীয় স্তরে মাহেন্দ্র লোক। চতুর্থে আছে, মহর্লোক। পঞ্চম স্তরে আছে ভুর্লোক।  

আচার্য্য শংকর বলছেন, অবীচির অর্থাৎ তরঙ্গ বিহীন স্তরের  সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে, ছটি মহা নরকভূমি বা নরকলোক।  সেগুলো ঘন, সলিল, অনল, অনিল, আকাশ ও তমঃতে আশ্রিত। অর্থাৎ ঘনীভূত, জল, আগুন, বাতাস,আকাশ, এবং অন্ধকার আচ্ছন্ন স্থান। এদের নাম হচ্ছে, মহাকাল, অম্বরীষ, রৌরব, মহারৌরব, কালসূত্র, ও অন্ধতামিশ্র। এখানকার বাসিন্দারা হয়, নিজ কর্মার্জিত দুঃখ-কষ্টের-বেদনায়  আশ্রিত  দীর্ঘায়ু জীব।

এর নিচে  রয়েছে, সাত রকম পাতাল - সেগুলো হলো,  পাতাল, তলাতল, বিতল, সুতল, অতল, রসাতল, মহাতল । আচার্য্য শংকর বলছেন, এই সপ্তদ্বীপা বসুমতী হলো অষ্টম স্থানে।  যার ভিতরে অবস্থান করছে কাঞ্চনময় পর্বতরাজ সুমেরু। এই পর্বতরাজের চূড়ায় বৈদুর্য, স্ফটিক, সুবর্ন ও মনি কাঞ্চনে সুশোভিত। এই বৈদুর্য্মনির উজ্জ্বলতায় রঞ্জিত হয়ে আছে আকাশের দক্ষিণভাগ। যা কিনা নীল-পদ্মের পাপড়ির মতো শ্যামবর্ণ ধারণ করেছে। এর পূর্বভাগ স্বেতবর্ণের।  পশ্চিমভাগ উজ্জ্বল স্বচ্ছ প্রভায় দীপ্তিমান। আর উত্তরভাগ কুরন্ডক অর্থাৎ যে শক্তি দ্বারা বীর্যশক্তি নষ্ট হয়, সেই শক্তির  প্রভাবে  পশ্চিমভাগ সোনালী আভাযুক্ত হয়ে আছে।  

এই পার্বতরাজের দক্ষিণ দিকে আছে জম্বু, যা থেকে জম্বুদ্বীপের নাম হয়েছে। সুমেরু পর্বতে সূর্য্যকিরণ প্রসারে রাত্রি,দিন ও লগ্ন পরিভ্রমণের ফলে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। এই সুমেরু পর্বতের উত্তরে দুই হাজার যোজন  (একক্রোশ = ৮০০০ হাত বা দুই মাইলের থেকে একটু বেশি, আবার ৪ মতান্তরে ৫  ক্রোশে এক যোজন)  বিস্তার করে আছে তিনটি পর্বত।  যাদের নাম হচ্ছে নীল, শ্বেত ও শৃঙ্গবন্ত। এদের ভিতর আছে, রমনক, হিরন্ময়, ও উত্তর কুরু নাম তিনটি বর্ষ আছে। বর্ষ কথাটার মানে হচ্ছে কাল, বা যিনি বর্ষণ করেন। এখানে জলাধার বা বারিধারা। এই বর্ষগুলোর  বিস্তার এক-একটি নয়-নয় হাজার যোজন। দক্ষিণে দুই হাজার যোজন বিস্তার করে আছে, নিষধ, হেমকুট ও  হিমশৈল। তাদের মধ্যে নয়,নয় হাজার বিস্তার করে আছে হরিবর্ষ, কিম্পুরুষ বর্ষ ও ভারত নামক  তিন বর্ষ দেশ। 

সুমেরুর পূর্বে মাল্যবৎ বা মাল্যবান পর্যন্ত ভদ্রাশ্ব ও পশ্চিমে গন্ধমাদন পর্যন্ত কেতুমালা মাঝে রয়েছে ইলাবর্ত বর্ষ দেশ। তারা এই সুমেরুর চারিদিকে শত সহস্র যোজন বিস্তারে রক্ষিত। এই সেই জন্মুদ্বীপ যা শত-সহস্র যোজন বিস্তার লাভ করে আছে। সে তার দ্বিগুন বলয় আকারে লবন সমুদ্রের দ্বারা বেষ্টিত।

যাই হোক আমাদের আলোচনা সংক্ষেপ করবো। শংকরাচার্য বিভিন্ন লোকের যে বিস্তারিত বর্ননা করেছেন, তা আমাদের মতো সাধারণের পক্ষে বোধগম্য হওয়া সম্ভব নয়। এইসব তত্ত্বকথার গূঢ়ার্থ আছে। সেসব কথা আমরা ধীরে ধীরে শুনবো। আজ আমাদের আলোচনাকে যাই। আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, মহর্লোক দেবভূমি। এখানে কুমুদ, (কেউ কথাটার অর্থ পৃথিবী, আর মুদ মানে হৃষ্ট অর্থাৎ যাক দেখে পৃথিবীর সবাই হৃষ্ট বা আনন্দিত হয় ) ঋভুকুল, (বৈবস্বত মন্বন্তর-এর দেবতাগণ, এরাই অগ্নির উপাসক ছিলেন, এবং বেদমন্ত্র বা সূর্যদেবের স্তুতি  এঁরাই রচনা করেন। )  প্রতর্দন, অঞ্জনাভ, ( অর্থাৎ দোষহীন ব্রহ্মজ্ঞানী  ও প্রচিতাভ (অর্থাৎ হৃষ্টমনা) এইসব  সমগোত্রীয় পুরুষ বাস করেন। এরা পঞ্চভূতকে নিজের বশে এনেছেন। এঁরা সহস্র-কল্পের আয়ু সম্পন্ন। 

এর পরে আছে, ব্রহ্মার প্রথম লোক, জম্মু। এই জনলোকে আছেন, চার রকম দেবতাদের সম গোত্রীয় দেবযোনি।  এঁরা ব্রহ্মপুরোহিত এঁরা ব্রহ্ম-কায়িক, ব্রহ্ম-মহাকায়িক ও অমর।  এঁরা সূক্ষ্ম ভূতকে বশ করেছেন। এঁরা আগের চাইতে দুইগুণ আয়ুযুক্ত।  

 তপোলোক : ব্রহ্মার দ্বিতীয় লোক হচ্ছে, তপলোক। এখানে আছেন, আভাস্বর, মহাভাস্বর, ও সত্য-মহাভাস্বর। এঁরাও ভুতেন্দ্রিয় ও প্রকৃতিবশী এবং পূর্বের পূর্বের তুলনায় দ্বিগুন আয়ু বিশিষ্ঠ। এঁরা  সবাই ধ্যানাহারী, উর্দ্ধরেতা, ও এঁরা উপরের লোকগুলো সম্পর্কে জ্ঞাত এমনকি নিচ নিচ লোকগুলো সম্পর্কেও জ্ঞানসম্পন্ন। 

সত্যলোক : ব্রহ্মার তৃতীয়লোক হচ্ছে সত্যলোক দেবতাগণ বাস করেন। তাদের জ্যোতিঃ ভেদে চার প্রকার। তাঁরা হলেন, অচ্যুত, শুদ্ধনিবাস, সত্যাভ ও সংজ্ঞা ও সজ্ঞী। 

           























No comments:

Post a Comment