Tuesday 3 December 2019

শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি পরিবর্তন ও রোগমুক্ত শরীর


শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি পরিবর্তন  ও রোগমুক্ত  শরীর 

জীবন তো শ্বাসের খেলা। আর এই শ্বাসের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছেন চৈতন্য। প্রতিনিয়ত তাঁর আসা যাওয়ার খেলা চলছে।  আমরা এই শ্বাসের  দিকে কখনো খেয়াল করে দেখি না। শ্বাস তো এমনি এমনি প্রবাহিত হয়, এটাই আমাদের ধারণা ।  কিন্তু আমাদের মন যদি এই শ্বাসক্রিয়া দিকে খেয়াল রেখে চলতে পারে, তবে, আমাদের এই স্থুল দেহকে আমরা সুস্থ-সবল রাখতে পারি  । এমনকি আমরা আধ্যাত্মিক উন্নতিও করতে পারি এবং আমাদের  জীবন সার্থক করতে পারি ।

শ্রীমৎ স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী মহারাজ বলছেন, আমরা যদি শ্বাসপ্রশ্বাসের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারি, শ্বাস-প্রশ্বাসের উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি, তাহলে আমাদের শরীর সব সময় রোগমুক্ত থাকবে। বলা হয়ে থাকে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস হচ্ছে স্বয়ং অশ্বিনী কুমারদ্বয়। অর্থাৎ দেবরাজ ইন্দ্রের চিকিৎসক । কুমারদ্বয়ের নাম হচ্ছে, আশ্বিন ও রেবন্তঃ। এঁরা  জমজপুত্র।  এদের দেখতে একই রকম। থাকেও  একই সাথে। এরা চিকিৎসা বিদ্যায় পারদর্শী অর্থাৎ দুজন চিকিৎসক আমাদের দেহে প্রতিনিয়ত আসছেন-যাচ্ছেন। তো আমরা যদি এই চিকিৎসকদের গতাগতিতে  একটু মনোযোগ দেই, তবে আমরা সারা জীবন রোগমুক্ত থাকতে পারি।

যোগীরা বলছেন, আমরা যে শ্বাস গ্রহণ করি, এবং প্রশ্বাস ত্যাগ করি, এর একটা ছন্দ আছে,  একটা নিয়ম  আছে। আমাদের শরীরের মধ্যে যখন ব্যাধিরাজ প্রবেশ করেন, তখন আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস  উতলা হয়ে ওঠে। শ্বাস প্রশ্বাসের যে স্বাভাবিক নিয়ম, যে ছন্দ, যে তাল, তা তখন কেটে যায়। আমরা যদি তখন সতর্ক হয়ে, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে স্বাভাবিক নিয়মে প্রবাহিত করতে পারি, তবে ব্যাধিরাজ আমাদের শরীরে থাকতে পারবেন না। আমাদের শরীর  ছেড়ে ভেগে পড়বেন। আর আমরা নীরোগ থাকতে  পারবো ।
এই বাম  নাসিকাকে যোগের ভাষায় বলে ইড়া  আর ডান  নাসিকাকে বলে পিঙ্গলা।  আসলে আমাদের মেরুদণ্ডের ভিতরে এই নাড়ি দুটির অবস্থান। অর্থাৎ বাম  নাসিকায় শ্বাস প্রবাহ হচ্ছে মানে শ্বাস ইড়ানাড়িতে প্রবেশ করছে। আবার ডান নাসিকা দিয়ে যখন শ্বাস প্রবাহিত হচ্ছে, তখন তা আমাদের পিঙ্গলা নারীতে  প্রবাহিত হচ্ছে। আবার আমাদের দুটো নাসারন্ধ্র  দিয়ে যখন  শ্বাস প্রবাহিত হয়, তখন বুঝতে হবে আমাদের সুষুম্না নাড়ীতে শ্বাসবায়ু  প্রবাহিত হচ্ছে।

যোগীরা বলছেন, শুক্লপক্ষের প্রতিপদ, দ্বিতীয়া ও তৃতীয়া তিথিতে সূর্যোদয়ের সময় আমাদের বাম  নাসিকায় বা ইড়া নাড়ীতে  শ্বাস-প্রশ্বাস আরম্ভ হয়। এই শ্বাস-প্রশ্বাস এক ঘন্টা পর পর  পরিবর্তন হতে থাকে । অর্থাৎ একঘন্টা  আরম্ভ হয় ডান নাসিকার ক্রিয়া, বা পিঙ্গলা নাড়ীতে শ্বাস প্রবাহিত হয় । এর পরে, আবার যখন কৃষ্ণপক্ষ শুরু হয়, তখন ঠিক এর বিপরীত হয়।  অর্থাৎ কৃষ্ণের পক্ষের প্রতিপদে, দ্বিতীয়া, তৃতীয়ায়  সূর্য উদয়ের সময় আমাদের ডান  নাসিকায় শ্বাস-প্রশ্বাস আরম্ভ হয়।  এবং এক ঘন্টা  অন্তর অন্তর পরিবর্তিত হতে থাকে। এটা হচ্ছে স্বাভাবিক নিয়ম।

 যদি এর ব্যতিক্রম হয়, তবে বুঝতে হবে, আমাদের শরীরের মধ্যে রোগের  বীজ উৎপন্ন হয়েছে, বা বাইরে থেকে রোগবীজ প্রবেশ করেছে। স্বামীজী বলছেন, আমাদের শরীর তখন এক  পক্ষকালের মধ্যেই অর্থাৎ ১৪ দিনের মধ্যেই  অসুস্থ হয়ে পড়বে । এই সময় যদি উভয় নাসিকা দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রবাহিত হয়, তবে রোগের  প্রকোপ খুব জোরালো হতে পারে না। কিন্তু যদি এক নাসিকা দিয়েই ঘন্টার পর ঘন্টা শ্বাস-প্রশ্বাস চলতে থাকে তবে, রোগের প্রকোপ বাড়বে। যদি এই অনিয়ম ৭-১৫-৩০ দিন বা তার  বেশি থাকে, তাহলে রোগ অত্যন্ত কঠিন বুঝতে হবে। এমনকি এই অবস্থায় প্রাণসংশয় দেখা দিতে পারে। এই অবস্থায় যদি, আমরা শ্বাস-প্রশ্বাস গতি এক নাসিকা থেকে অন্য নাসিকায় পরিবর্তন করতে পারি, তবে আমাদের জীবন সংশয় কেটে হবে। কিন্তু যদি সুস্থ  অবস্থায়, আমরা যদি এই শ্বাস পরিবর্তন করতে পারি, তবে আমরা চিরকাল সুস্থ থাকতে পারি। যারা নীরোগ থাকা কালীন, এই শ্বাস পরিবর্তনের কৌশল আয়ত্ত্ব করতে পারেন নি, তাদের পক্ষে  রোগে আক্রান্ত হলে এই শ্বাস পরিবর্তন সহজ সাধ্য নয় ।

শ্রীমৎ স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী বলছেন, হঠাৎ পেটে অসহ্য যন্ত্রনা শুরু হলে, অথবা বুকে ব্যথা বা মাথায় যন্ত্রনা আরাম্ভ হলে,ঐ সময়  যে নাসিকায়  শ্বাস প্রশ্বাস চলছে, তার পরবর্তন করে, বিপরীত নাসিকায় শ্বাস প্রবাহিত করতে পারলে, ওই যন্ত্রনা দ্রুত উপশম হতে আরম্ভ করে। অজীর্ণ, পিত্তশূল,অম্লশূল, এইসব রোগের  হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, যদি আমরা আমাদের ইচ্ছা মতো যে কোনো নাসিকায় শ্বাস-প্রশ্বাসের পরিবর্তনের ক্ষমতা আয়ত্ত করতে পারি।

স্বামীজী বলছেন, আমাদের খাবার সময়, বা খাবার অব্যবহিত পরে, যদি আমাদের ডান  নাক দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রবাহিত হয়, তবে আমাদের খাদ্য সহজে হজম হয়।  যদি কোনো কারণে, খাবার সময় আমাদের বাম নাসিকা দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রবাহিত হয়, তবে আমাদের অবশ্যই  উচিত খাবার ঠিক পরেই ডান  নাসিকা দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রবাহিত করা। পেটের রোগের অব্যর্থ ঔষধ হচ্ছে, খাবার সময় ও খাবার পরে ১ ঘন্টা যাবৎ ডান নাক দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রবাহিত করা।

আসলে আমরা কেউই এ ব্যাপারটাতে কখনো নজর দেবার চেষ্টা করি না। আর এই শ্বাস-প্রশ্বাসের পরিবর্তন কি ভাবে করতে হয়, তাও আমরা জানি না। এখন আমরা শ্বাস-প্রশ্বাস পরিবর্তনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে  শুনবো, শ্রীমৎ স্বামী শিবানন্দ সরস্বতীর কাছ থেকে।

আগেই আমরা শুনেছি, এক ঘন্টা অন্তর অন্তর আমাদের এক নাড়ী থেকে অন্য নাড়ীতে শ্বাসবায়ু যাতায়াত করে, এটাই  প্রাকৃতিক নিয়ম। কিন্তু এটাকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করবো কি করে ?

একটু খেয়াল করুন, এই মুহূর্তে কোন নাক দিয়ে বায়ু চলাচল করছে। ধরুন, আপনার বা নাক দিয়ে শ্বাস বইছে। তো ডান  নাক বন্ধ করে,বা  নাক দিয়ে আপনি বুক ভরে শ্বাস নিন। এবার বা নাক বন্ধ করে, ডান নাক  দিয়ে শ্বাস ছাড়ুন। অর্থাৎ যে নাক খোলা  আছে, সেই নাক দিয়ে আগে শ্বাস নিন, আর যে নাক বন্ধ আছে, সেই নাক দিয়ে শ্বাস ছাড়ুন। ৫/১০ মিনিট এটা করতে থাকুন। দেখবে, বন্ধ নাক ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে।

শ্বাসের গতি পরিবর্তনের আর একটা কার্যকরী উপায়  হচ্ছে, আপনার যে নাকে শ্বাস প্রবাহিত হচ্ছে, সেই দিকে কাত হয়ে শুয়ে পড়ুন। অর্থাৎ যদি বাম নাসিকায়  শ্বাস প্রবাহিত হয়, এবং ডান নাসিকায় শ্বাস প্রবাহিত করতে চাই, তাহলে বাম কাতে শুয়ে বাম  বগলের নিচে একটা বালিশ রাখুন। এবার, প্রথমে বাম নাসিকা দ্বারা শ্বাস গ্রহণ করুন,  এরপর  কনিষ্ঠা বা অনামিকা আঙ্গুল দিয়ে বাম নাক বন্ধ করে , ডান নাক দিয়ে বায়ু ছাড়ুন। এইভাবে কয়েকবার করলেই, ডান পরিষ্কার হয়ে শ্বাস বইতে শুরু করবে। তবে, যদি দেখা যায়, বাম নাক দিয়ে শ্বাস টানা যাচ্ছে না, তখন বুঝতে হবে, ইড়া বা বাম  নাড়ীর শ্বাস পিঙ্গলা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যদি পিঙ্গলা থেকে ইড়া নাড়ীতে শ্বাস পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়, তবে, ডান  কাত  হয়ে বগলের নিচে বালিশ রেখে শুতে হবে, তারপর ডান নাক দিয়ে শ্বাস নিতে হবে, আর বাম নাক দিয়ে শ্বাস ত্যাগ করতে হবে। কয়েক মিনিট এইরকম করলে, ডান নাক বন্ধ হয়ে যাবে, এবং বাম নাক দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস প্রবাহিত হতে শুরু করবে।

এইভাবে শ্বাস পরিবর্তনের ক্রিয়া কিছুদিন অভ্যাসের পর, আর শোবার দরকার পড়বে  না। তখন শরীরকে একটু হেলিয়ে বা বাঁকিয়ে অনায়াসে শ্বাস পরিবর্তন করা যেতে পারে।  নিয়মিত অভ্যাসের ফলে, আপনি কেবলমাত্র ইচ্ছেমাত্রই  শ্বাসের গতি এক নাসারন্ধ্র থেকে আর এক নাসারন্ধ্রে পরিবর্তন করে নিতে পারেন । তখন আর দেহকে হেলাতেও হবে না। আপনার ইচ্ছেই আপনাকে ইচ্ছেমতো নাসারন্ধ্র দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রবাহিত করতে সাহায্য করবে। আর এইসব করেই, আপনি আপনার  দেহকে সর্ব্ব-ব্যাধি হতে মুক্ত করতে পারেন।

এখন কথা হচ্ছে, কখন আমরা কোন নাকে শ্বাস গ্রহণ করবো। স্বামী সরস্বতী মহারাজ বলছেন, বাম  নাসিকায়, অর্থাৎ ইড়া  নাড়ীতে  স্বাস প্রবাহকালে শুভ কাজে হাত দেওয়া উচিত। আবার ভোজন, শত্রূর সাথে লড়াই করবার সময়, ডান  নাক বা পিঙ্গলা দিয়ে শ্বাস প্রবাহ করা উচিত। আর দুটো নাক দিয়েই যদি শ্বাস-প্রশ্বাস প্রবাহিত হয়, জানবেন সুষুম্না নারী দিয়ে শ্বাস প্রবাহিত হচ্ছে, তখন ধারণা-ধ্যান-সমাধিতে লিপ্ত থাকা উচিত। এবং এই সময় খুবই ফলপ্রদ।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।

















No comments:

Post a Comment