Sunday 20 October 2019

কুলকুণ্ডলিনী


কুলকুণ্ডলিনী শক্তি (তথ্যসূত্র : বাংলার বাউল ও বাউল গান - অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য অন্যান্য বই  )

কুল কথাটার আক্ষরিক অর্থ বংশ বা জাতি। কুন্ড কথাটার মানে গর্ত। কুলকুণ্ডলিনী, বলতে আমরা বুঝি একটা শক্তিকেন্দ্র যেখানে জীবসৃষ্টির সমস্ত শক্তি সুপ্ত অবস্থায় আছে। সমস্ত সাধকদের কাছে, এই কেন্দ্র খুবই গুরুত্ত্বপূর্ন। বিশেষকরে, তান্ত্রিকদের কাছে, এই চক্র বা কেন্দ্র সাধনভূমি। মানুষের মধ্যে একটি অতিশক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র আছে।  আমাদের যে বিন্দুকেন্দ্র যা আমাদের   সহস্রারের উপরে  অবস্থান করছে , সেখানে এই বিশ্বশক্তি আকৃষ্ট হয়, পুঞ্জীভূত হয়। এর পরে সেই শক্তি আমাদের মস্তিষ্কের ভিতর দিয়ে সুষুম্না নাড়ীতে প্রবেশ করে। সুষুম্না নাড়ীর সর্ব্বনিম্ন ভাগ অর্থাৎ মূলাধারে তখন এই শক্তি সঞ্চিত হয়। সাপ বা কুকুর যেমন কুণ্ডলী পাকিয়ে স্থির হয়ে থাকে তেমনি এই শক্তি আমাদের মূলাধারে নিস্পৃহ অবস্থায় অবস্থান করে। এই শক্তিকে বা বিশ্বশক্তিকে অনুভব করাই আসলে আমাদের সাধনা। আর এই সাধনা এমনকিছু কঠিন ব্যাপারও  নয়। আসলে এই ব্যাপারটায় আমরা ধ্যান দেই  না বলেই  এই বিশ্বশক্তি আমরা অনুভব করতে পারি না। দেখুন আমাদের দৃষ্টি শক্তি, ঘ্রান শক্তি, শ্রবণ শক্তি, স্পর্শশক্তি  ইত্যাদি অনুভব করি কি ভাবে ? আমরা জানি কান কিন্তু কিছুই  শোনে  না। নাক কিন্তু গন্ধ পায়  না।  চোখ কিন্তু কিছুই দেখে না। তো দেখে কে ? শোনে কে ? এই ইন্দ্রিয়গুলোর সাহায্যে দেখে আসলে  আমাদের মন। যতক্ষন আমাদের মন ইন্দ্রিয়গুলোর  উপরে ধ্যান দেয়, ততক্ষন ইন্দ্রিয়গুলোর  কার্যকারিতা আমরা অনুভব করি। যখনই এসব ইন্দ্রিয়গুলো থেকে আমার মন অন্যদিকে চলে যায়, তখন আমরা এই ইন্দ্রিয়গুলোর কাজ অনুভব করতে পারি না। আসলে এইসব ইন্দ্রিয়ের উপরে ধ্যান দেওয়া আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। তাই আলাদা করে চেতনমনকে সেখানে টেনে নিয়ে যেতে হয় না। এই কাজ আমাদের অবচেতন মনই করে থাকে।
কিন্তু বিশ্বশক্তির চেতনাকেন্দ্র সম্পর্কে আমাদের অবচেতন মনের কোনো ধারণা নেই।  তাই সেখানে সে মনোযোগ দেয়  না। আর  বিশ্বশক্তি আমাদের যে অঙ্গে প্রতিফলিত হচ্ছে, সেখানে আমাদের ধ্যান না থাকার জন্য এই বিশ্বশক্তির কার্যকারিতা সম্পর্কে আমরা কিছুই অনুভব করতে পারি না। তাই ঋষিগণ বলেছেন, এই সব অঙ্গে, যেখানে বিশ্বশক্তি প্রতিফলিত হয়, সেখানে  ধ্যান করবার জন্য। তাহলেই আমরা এই বিশ্বশক্তির আশ্চার্য্য  কার্যকারিতা অনুভব করতে পারবো। এবং এর থেকে আমাদের জীবন আরো উপভোগ্য হয়ে উঠবে। আর এই ধ্যানের কেন্দ্র হিসেবে ঋষিগণ ৭টি কেন্দ্রের কথা নির্দিষ্ট করেছেন।  সেগুলো হচ্ছে, মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধি, আজ্ঞা, এবং  সহস্রার। আর এই কেন্দ্রগুলোকে নির্দিষ্ট করার কারন হচ্ছে, এখানে আমাদের বিভিন্ন স্নায়ুর সংযোগস্থল। আর এই সব স্নায়ুর সংযোগস্থলে বিশ্বশক্তির গতি সাময়িক ভাবে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার ফলে, তার অবস্থানের সময় বৃদ্ধি পায়। তাই এই বিশ্বশক্তিকে এই সব কেন্দ্রের সাহায্যে অনুভব করা যায়। আজ আমরা ৭টি কেন্দ্রের মধ্যে শুধু মূলাধার নিয়ে আলোচনা শুনবো । অর্থাৎ আমাদের শরীরের সবথেকে নিচে যে কেন্দ্র আছে, সেটা নিয়ে আলোচনা শুনবো ।  ধীরে ধীরে উপরের কেন্দ্রগুলো সম্পর্কে শুনবো।

আর যেহেতু, তান্ত্রিকগন এই চক্রের উপরে সবথেকে বেশি মনোনিবেশ করেছেন , অর্থাৎ তাদের সাধন কেন্দ্র হচ্ছে, এই চেতনকেন্দ্র বা চক্র তাই  আমরা  তান্ত্রিকরা এই কেন্দ্র সন্মন্ধে কি বলছেন, সেটা ভালোকরে জেনে নেবো।

তান্ত্রিকরা বলছেন,  মূলাধার চক্র আমাদের  গুহ্যদেশ ও জনন-ইন্দ্রিয়ের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত। অন্যান্য চক্রের মতো অর্থাৎ স্বাধিষ্ঠান, মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা, ও  সহস্রার চক্রের মতো এই মূলাধার বা কুলকুণ্ডলিনী  চক্রের মধ্যে একটি পদ্ম কল্পনা করা হয়েছে। এই পদ্মের চারটি পাপড়ি, এর মুখ নিচের দিকে, এই পদ্মের রঙ গাঢ় লাল বা রক্তবর্ণ। এই চারটি পাপড়িতে চারটি অক্ষর বা বৈচিকভাষায় চারটি  মন্ত্র কল্পনা করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে, বঁ, শঁ,ষঁ,সঁ অর্থাৎ তিনটি (স,শ,ষ) ও ল ও শ এর মাঝে যে ব যার উচ্চারণ "ওঁয়া" এই চারটি স্বর্ণ বর্ণের অক্ষর দক্ষিণাবর্তে অর্থাৎ ডানদিকে মুখ করে  সন্নিবিষ্ট আছে।

মূলাধার পদ্মের মাঝখানে উজ্জ্বল একটা চতুস্কোন ধরাচক্র। ধরাচক্র কথাটার অর্থ পৃথিবী, তাই
পৃথ্বী-চক্র অর্থাৎ যেখানে জীবের জন্ম-মৃত্যু হয়। তার চারিদিকে, আটটি শূলবেষ্টিত একটা স্থান শোভা পাচ্ছে। এই ধরাচক্রের মাঝখানে পীতবর্ণ ও বিদ্যুতের মতো কোমল অঙ্গ বীজমন্ত্র "লং" বিরাজ করছে। এই ধরাবীজ বা পৃথ্বী-বীজ চারটি হস্ত সমন্বিত। সমস্ত অঙ্গে অলংকার। হাতির পিঠে বসা। এই বীজের মাঝখানে আবার  বিন্দুস্থানে (অর্থাৎ লং অক্ষরের যে বিন্দু) সকালের সূর্য্যের মত রক্তিম-বর্ন শিশু-ব্রহ্মা বসে আছেন। তাঁর চারটি মুখ, এবং প্রত্যেক মুখে একটা করে বেদগ্রন্থ। এই শিশুব্রহ্মার চারটি হাত। একহাতে, দন্ড,একহাতে কমণ্ডলু, একহাতে রুদ্রাক্ষের মালা, আর অন্য হাত অভয়মুদ্রা ধারণ করে আছেন।

এই ধারা চক্রে, গাঢ় লাল রঙের ন্যায় অতি তেজস্বী সূর্য্যের মতো তেজঃপুঞ্জশালিনী ডাকিনি শক্তি বাস করেন। তিনি তাঁর চার হাতে, শূল, খট্টাঙ্গ,(মুগুর) খড়্গ ও চষক (পানপাত্র) ধারণ করে আছেন।
মূলাধার পদ্মের কর্ণিকা (বীজ) অভ্যন্তরে সুষুম্নার ভিতরে যে বজ্রাক্ষ নাড়ী আছে, তার মুখে একটি ত্রৈপুর নামে একটা ত্রিকোণ যন্ত্র অবস্থিত। এই ত্রিপুর যন্ত্র আসলে একটি আবাসস্থান। এই আবাসস্থল বিদ্যুতের মতো দীপ্তিশালী, অথচ ভীষণ কোমল স্থান। এই যন্ত্রের মধ্যেই জবা ফুলের মতো লাল রঙের কন্দর্প বায়ু ও কাম বীজ বিরাজ করছে। এই ত্রিকোণের ভিতরে, কচি পাতা-বর্ণের, গলানো সোনার মতো কোমল, পূর্ন চন্দ্রের জ্যোৎস্নার মতো উজ্জ্বল কান্তি বিশিষ্ঠ নদীর ঘূর্ণির মতো গোলাকার লিঙ্গরূপী স্বয়ম্ভূ  নিচের দিকে মুখ করে অবস্থান করছেন। এই স্বয়ম্ভূ লিঙ্গের উপরের দিকে রেশম সুতোর মতো অতিসূক্ষ্ম, কুণ্ডলিনী মুখ হা করে, ব্রহ্মনাড়ীর মুখ আচ্ছাদন করে, ব্রহ্মনাড়ী থেকে উৎসারিত সুধাধারা পান করছেন। যিনি সাপের মতো, স্বয়ম্ভূ লিঙ্গকে তিন পাকে আবদ্ধ  করে, স্বয়ম্ভূ লিঙ্গের মাথার উপরে ঘুমিয়ে আছেন। এই অতি বিচিত্র সাপ আমাদের মূলাধার কমলে অবস্থান করে, শ্বাসপ্রশ্বাস গমনাগমন ক্রিয়া পরিচালিত করছেন ও সমস্ত প্রাণীকে রক্ষা করছেন।

এগুলো সবই কল্পনাপ্রসূত চিত্র। তবে এই মত চিন্তা করতে পারলে, মূলাধারের শক্তি ও কার্যকারিতা সম্পর্কে আমাদের মনোনিবেশ সহজ হয়। মূলাধার যে বিশেষ শক্তির সূচক সেটা আমরা ভালোভাবে বুঝতে পারবো।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি  ওম। 

কুলকুণ্ডলিনী শক্তি (দুই ) 


স্বাধিষ্ঠান ও মনিপুর চক্র :

হিন্দু ভাবধারার আধ্যাত্মিক জগতে যারা বিচরণ করেন, তারা একটা জিনিস লক্ষ করেছেন, এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে সসীম থেকে অসীমে ঝাঁপ দেওয়া। আমরা কেউ আবেগপ্রবণ, কেউ বিচারপ্রবণ, কেউ আবার ইচ্ছেপ্রবণ । যে যেমনই হোন, আপনার যখন অদ্বৈত অনুভূতি উপলব্ধি হবে, তখনই একমাত্র অনন্তে পৌঁছাতে পারবেন।
এই ইচ্ছেপ্রবণ মানুষেরা কুণ্ডলিনীর উর্দ্ধগমনের মাধ্যমে যৌগিক সমাধি লাভ করে থাকেন। আবেগপ্রবণ মানুষেরা ভক্তির চর্চা করে থাকেন। ভক্ত তার সব কিছু ঈশ্বরের চরণে নিবেদন করেন। এইভাবে তিনি ঈশ্বরের সাথে একাত্ত্বতা অনুভব করেন। এটিকে বিশ্লেষণ করার ব্যাপারে গুরুত্ত্ব দেন না। আর যারা বিচার প্রবন, তাঁরা এই ব্যাপারটাকে বিশ্লেষণ করে দার্শনিক মত দান করে থাকেন।

আমাদের আলোচ্য বিষয় কুলকুণ্ডলিনীর অবস্থান। আজ আমরা আলোচনা শুনবো  স্বাধিষ্ঠান  ও মনিপুর চক্র  সম্পর্কে।

স্বাধিষ্ঠান চক্র :
আমরা জানি আমাদের যে সুষুম্না নাড়ী আছে, তার মধ্যে আছে, বজ্রাক্ষ নাড়ী।  আর এই বজ্রাক্ষ নাড়ীর মধ্যে আছে চিত্রিণী নাড়ী। তান্ত্রিক সাধকগণ বলছেন, আমাদের জনন-ইন্দ্রিয়ের মুলে সুষুম্নার মধ্যস্থ চিত্রিণী নাড়ীর মধ্যে সিঁদুরের মতো লাল রঙের  উজ্বল মনোহর কান্তি ছটি পাঁপড়ি  বা দল বিশিষ্ট অনুস্বরযুক্ত ব, ভ, ম, য়, র, ল, এই ছয়টি বৈচিক বর্ণ পরপর সন্নিবিষ্ট আছে।

এই স্বাধিষ্ঠান চক্রের মধ্যে যে যে পদ্ম আছে, তাতে ছয়টি পাঁপড়ি। এই পদ্মের মধ্যে সাদা রঙের বরুণচক্র। বরুণচক্র অর্থাৎ বাতাসের ঘূর্ণি। এই  বরুন মন্ডলের  মধ্যে অবস্থান করছে মকরবাহন (মকর হচ্ছে এমন একটা জীব যার মুখ কৃষ্ণসার হরিনের মতো, আর দেহ হচ্ছে মাছের মতো পুচ্ছ বিশিষ্ট ) বরুনবীজ "বং" (ওয়াং) এখানেই  বিদ্যমান।

এই বরুন বীজের কোলে নীল-পীতাম্বর অতি মনোহর এক নব্য যুবক শ্রীবৎস-কৌস্তভ মনি ভূষিত হয়ে গরুড় পাখির উপরে বসে আছেন। ইনি চতুর্ভূজ নারায়ণ। এনার চারি হস্তে শঙ্খ -চক্র -গদা-পদ্ম  শোভা পাচ্ছে।

এই বরুন চক্রে উন্মত্তচিত্ত রাকিনী শক্তি   বিরাজ করছেন। তাঁর চার হাতে, শূল-পদ্ম-ডমরু-টঙ্ক। ত্রিনেত্র ধারিণী এই দেবী দিব্য অলংকার দ্বারা সুশোভিত।  ইনি ভীষণদর্শন, রক্তধারা বিগলিত নাসা।

মনিপুর চক্র  :
স্বাধিষ্ঠান চক্রের  উপরে নাভিমূলে আছে মনিপুর চক্র। দশদল বিশিষ্ট এই মনিপুর চক্র।  গাঢ় মেঘের মতো নীলবর্ণ  এই মনিপুরপদ্ম। এই পদ্মের দশটি দলে, অনুস্বার বিশিষ্ট ড, ঢ, ণ, ত, থ, দ, ধ, ন, প. ফ এই দশটি বৈচিক বর্ণ যথাক্রমে সন্নিবিষ্ট আছে। এই পদ্মের অভ্যন্তর প্রভাতের সূর্য্যের মতো দীপ্তিশালী, রক্তিমবর্ন একটা ত্রিকোণ অগ্নিমণ্ডল বিরাজ করছে।

এই অগ্নি বীজ-এর মধ্যে চতুর্ভূজ বরাভয় বজ্রশক্তি নিহিত আছে। এই বীজের কোলদেশে মহাকাল বিরাজ করছেন। তার ভষ্মলিপ্ত দেহ, বিশুদ্ধ সিঁদুরের ন্যায় গাত্রবর্ণ। ষাঁড়ের উপরে অরূহ। এই পদ্মবীজের মধ্যে লাকিনি শক্তি বিরাজ করছেন। যিনি রক্তপদ্মের উপরে দন্ডায়মান শ্যামা মা। পিতাম্বরধারিনী বরাভয় করাল বদনী মত্তচিত্তা  চতুর্ভূজা।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।


কুলকুণ্ডলিনী শক্তি (তিন) 
অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা চক্র
এতক্ষন আমরা মনিপুর, স্বাধিষ্ঠান চক্রের  শুনছিলাম।   এর আগে আমরা মূলাধার সম্পর্কেও শুনেছি। এর পরে আমরা অনাহত চক্র  সম্পর্কে শুনবো।  তার আগে সাধকদের জন্য, কিছু গুরুত্ত্বপূর্ন কথা শুনে নেবো।
আমরা সবাই জানি, আমাদের এই স্থূল দেহ পঞ্চভূতের তৈরি। পঞ্চভূতের মধ্যে বায়ু প্রধান।  বায়ু দশ রকম বা বায়ুর দশটি গুন্ - প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান (এগুলো অর্থাৎ এই পাঁচটি  আমরা জানি ) এছাড়া আছে, নাগ, কূর্ম, কৃকর অর্থাৎ কয়ার পাখি, দেবদত্ত্ব (দেবতাদের কর্তৃক প্রদত্ত্ব ) ও ধনঞ্জয় (যিনি ধনকে জয় করেছেন)। এই মোট দশটি বায়ুর গুন্। প্রাণবায়ু আমাদের হৃদয়ে অবস্থিত। অপান আমাদের গুহ্যদেশে। নাভিদেশে আছে সমান, কন্ঠে উদানবায়ু, এবং সর্বশরীরে ছড়িয়ে আছে ব্যানবায়ু। এই পাঁচটি বায়ু প্রধান।  নাগ, কূর্ম, কৃকর, দেবদত্ত্ব ও ধনঞ্জয় - এগুলো আমাদের নাড়ীতে অবস্থান করে। অর্থাৎ আমাদের শরীরে যে হাজার হাজার  নাড়ী  আছে, তার মধ্যে অবস্থান করে।  তবে প্রধানত পাঁচটি নাড়ী অর্থাৎ ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, বজ্রাক্ষ্যা ও চিত্রাণি এই পাঁচটি নাড়ীতে অবস্থান করে থাকে । আর এই বায়ুর সঙ্গে চৈতন্য শক্তি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। তাই সাধকগণ বায়ুর সাহায্যে চৈতন্যকে ধরতে চায়। পঞ্চবায়ুর মধ্যে নাভিদেশ থেকে নিচের দিকে  সমান বায়ুর কর্মক্ষেত্র। আর এই সমান বায়ু সব সময় নিম্নমুখী। এই সমান বায়ুর সাহায্যেই আমাদের বর্জ্যপদার্থ নিচের দিকে চলে যায়। সন্তানের জন্ম হয়। আমাদের বীর্য নিম্নগামী হয়ে সৃষ্টি রক্ষা করে। তাই এই তিনটি অঞ্চলে অর্থাৎ মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, ও মনিপুরে আমরা যদি বেশী  ধ্যান দেই তবে নিম্নগামী বিশ্বশক্তি আরো কার্যকরী হয়ে উঠবে। এবং আমাদেরকে  নিম্নগামী করবে। এবং আমরা লক্ষভ্রষ্ট হবো। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে, এই তিনটি কেন্দ্রে আমাদের ধ্যান যেন নামমাত্র হয়। আসলে অনাহত চক্র থেকে আমাদের ধ্যানের শুরু হবে, যদি আমরা ঈশ্বরের খেলা, বা বিশ্বশক্তিকে  অনুভব করতে চাই।

অনাহত চক্র : 
মনিপুর চক্রের উপরিভাগে দ্বাদশদল বিশিষ্ট অনাহত পদ্ম। আমাদের বুকের ভিতরে যে হৃৎপিন্ড আছে, ঠিক তার সোজাসুজি, মেরুদন্ডের মধ্যে আছে অনাহত চক্র। তান্ত্রিক সাধকগণ বলছেন,  আমাদের হৃদয় দেশে উজ্জ্বল লহিত বর্ণের এই বারোটি পাপড়ি বিশিষ্ট একটি  পদ্ম আছে । এই পদ্মের  প্রত্যেকটি পাপড়িতে সিঁদুর রঙের অনুস্বর যুক্ত ক, খ, অর্থাৎ কঁ,খঁ,গঁ,ঘঁ,ঙঁ, চঁ,ছঁ,জঁ,ঝঁ,ঞঁ,  টঁ,ঠঁ - এর অধিষ্ঠান । এই পদ্মের অভ্যন্তরে ধুম্র বর্ণের একটি ছয়কোন বিশিষ্ট বায়ুমণ্ডল শোভা পাচ্ছে। এই বায়ুমণ্ডলের মধ্যে ত্রিকোণ-যুক্ত কোটি বিদ্যুৎ-প্রভাযুক্ত সূর্য্যমন্ডল অবস্থান করছে। এইযে ছয়কোন যুক্ত বায়ুমণ্ডল, এর মধ্যে ধুম্রবর্ণের চতুস্কোন বায়ুবীজ "যং" বর্তমান। এই বায়ুবীজ "যং" আবার কৃষ্ণসার হরিনের পিঠে অবস্থান করছে। এই বায়ুবীজের মধ্যে স্থলে স্বয়ং ঈশ্বর ঈশান নামক শিব হয়ে অবস্থান করছেন। এই ঈশান শিব হাঁসের মতো শ্বেতবর্ণের। ইনি দ্বিহস্ত বিশিষ্ট।  বরাভয় মুদ্রায় অবস্থান করছেন। এনার তিনটি নেত্র।এই পদ্মে আরো অবস্থান করছেন কাকিনী শক্তি। যিনি বিদ্যুতের ন্যায় পীতবর্ণা। ইনি নানা অলংকার শোভিতা, চতুর্ভূজা, কঙ্কাল-মালা ধারিনী।  ইনি  আনন্দে উন্মত্ত। অমৃত রসে অভিষিক্ত হৃদয় সম্পন্ন। বরাভয়কারীনি ।এই পদ্মের মধ্যস্থ যে বীজ কোষ অর্থাৎ কর্ণিকা আছে তার  ত্রিকোণে অবস্থান করছেন, বাণলিঙ্গ শিব ও ত্রিনেত্রা নামের শক্তি বিরাজমান। এই বানলিঙ্গের মস্তক অর্ধচন্দ্র শোভিত। আর ত্রিনেত্রাদেবী  শক্তি কোটি-বিদ্যুৎ-তুল্য কোমলাঙ্গী।

বিশুদ্ধ চক্র :
গলায় আমাদের যে কন্ঠা আছে, তার ঠিক পিছনে, মেরুদণ্ডের মধ্যে অবস্থান করছে বিশুদ্ধ চক্র। এই বিশুদ্ধ চক্র ষোড়শদল পদ্ম বিশিষ্ট। এই পদ্ম ধোঁয়াটে রঙের। আর এই ষোলোটি পদ্মের মধ্যে লোহিত বর্ণের বিন্দু-যুক্ত ষোলোটি স্বরবর্ণ লিপিবদ্ধ আছে।  এই বর্ণগুলো হচ্ছে, অ, আ, ই, ঈ,উ,ঊ,ঋ,এ,ঐ,ও,ঔ, ঋ,ঌ,ৡ,এ,ঐ,ও,ঔ,অং,অঃ। এই পদ্মে পূর্ন চাঁদের মতো গোলাকার একটা নভোমণ্ডল আছে।  আর এই নভোমন্ডল মধ্যে একটা সাদা রঙের হাতির পিঠে ব্যোম বীজ হং অবস্থান  করছে। এটি পাশাঙ্কুশ  বরাভয় হস্ত বিশিষ্ট। অঙ্কুশ কথাটার অর্থ হচ্ছে, হাতিকে চালান করবার লৌহদণ্ড যার মুখটা সুচালু ও বাঁকা।  এই "হং" কারের যে গগনমণ্ডল তার মধ্যে অবস্থান করছেন, দশ হাত বিশিষ্ট, পাঁচটি মুখ বিশিষ্ট, তিনটি নেত্র বিশিষ্ট, বাঘের চামড়া পরিহিত অর্ধ-নারীশ্বর সদাশিব বিরাজ করছেন। তিনি বৃষপৃষ্ঠে আরোহন করে আছেন, তাঁর দক্ষিণভাগ শ্বেতবর্ণ আর বাম  ভাগ স্বর্ণবর্ন। তাঁর দশহাতে শুল,ডঙ্কা, খড়্গ, বজ্র, দাহন অর্থাৎ আগ্নেয়াস্ত্র, একটি বিশাল সাপ, ঘন্টা, অঙ্কুশ, পাশ ও অভয়মুদ্রা। এই পদ্মের কর্নিকায় অর্থাৎ পদ্মবীজে  শাকিনী শক্তি বিদ্যমান। ইনি শ্বেতবর্ণা, পিত-বসনা, চতুর হস্ত বিশিষ্ট। আর এই চার হাতে, শর, ধনু,পাশ, অঙ্কুশ ধারণ করে আছেন । এইবার কর্নিকার ভিতরে, আছে নিস্কলঙ্ক বিশুদ্ধ শশাঙ্ক মন্ডল।  এই শশাঙ্ক মন্ডলকেই মনে করা হয়, অতিশয় বিশুদ্ধ ব্যক্তির মুক্তিদ্বার  স্বরূপ।

আজ্ঞা চক্র :
আজ্ঞাচক্রের অবস্থান মেরুদণ্ডের মধ্যে নয়, এটির অবস্থান মাথায়।আমাদের ভ্রুদ্বয়ের পিছনদিকে মাথায় মধ্যে এর অবস্থান।  তন্ত্রমতে ভ্রূ-দ্বয়ের মধ্যে অবস্থান করছে, আমাদের আজ্ঞাচক্র। এখানে দ্বিদল বিশিষ্ট অজ্ঞাপদ্ম বিরাজ করছে। এই পদ্ম, শশধর সম উজ্বল শ্বেত বর্ণের।  এই দ্বিদল পদ্মের  দুটি পাপড়িতে আছে অনুস্বর-যুক্ত  হঁ ও ক্ষঁ। এই আজ্ঞা চক্রের মধ্যেই  আছে ষড়াননা। অর্থাৎ ছটি মুখ বিশিষ্ট মাতৃমূর্তি। যার প্রত্যেকটি আননে  অর্থাৎ মুখে তিনটি নয়ন, চারটি হাত।  এক হাতে বিদ্যামুদ্রা, এক হাতে ডমরু, একহাতে জপমালা, আর এক হাতে কপাল অর্থাৎ  মাথার খুলি। পূর্ন চন্দ্রের মতো শুভ্র জ্যোতিসম্পন্ন। এঁনাকে বলা হয় হাকিনী শক্তি। এই অক্ষি মধ্যস্থ  দ্বিদল যুক্ত পদ্মের মধ্যস্থলে বিরাজ করছেন, যোনি রূপিণী ত্রিকোণ।  যার প্রত্যেকটি কোনে ইতর-শিবলিঙ্গ বিদ্যমান। এই শিবলিঙ্গ তরিৎমালার মতো উজ্বল। এবং এই স্থানে বেদের প্রথম বীজ ওঁকার অবস্থিত। আর এই পদ্মের মধ্যে আমাদের সূক্ষ্মরূপী মন অবস্থান করছে। এই পদ্মের অন্তশ্চক্রে পরম শক্তি স্থলে ত্রিকোণে ভ্রূর ঠিক উপরে বিশুদ্ধ জ্ঞান ও জ্ঞেয়স্বরূপ অন্তরাত্মা অবস্থান করছেন। এই অন্তরাত্মা দীপ শিখার  ন্যায় উজ্বল আকৃতি বিশিষ্ঠ এবং প্রবনাত্মক। এই প্রণবের উর্দ্ধ ভাগে বিন্দু রুপি 'ম'কার। আর এই "ম"কারের আদিভাগে শুভ্রবর্ণ চাঁদের মতো নাদ অর্থাৎ শিবলিঙ্গ হাসিমুখে বিরাজ করছেন।
যেখানে অন্তরাত্মা অবস্থিত, সেখানে জ্বলন্ত দীপশিখার ন্যায় উজ্বল প্রভাত সূর্য্যের জ্যোতিঃ। এই জ্যোতিঃ আমাদের মাথা থেকে মূলাধার কমলের মধ্যস্থ ধরাচক্র পর্যন্ত বিস্তৃত আছেন। এখানেই সেই জ্যোতির্ময় সত্ত্বা, পূর্ন-ঐশ্বর্য্য অব্যয় ভগবানের সাক্ষাৎ  লাভ হয়। এই আজ্ঞাচক্র-এর দ্বিদলপদ্মে বায়ুর লয়স্থান।  তার উপরে মনশ্চক্র।  মনশ্চক্রের উপরে আছে সোমচক্র । এই সোমচক্রে হংস বীজ অধিষ্ঠিত। এই হংস বীজের কোলে অবস্থান করছেন, পরম-শিব। পরমশিবের বাম  দিকে আছেন নিত্যানন্দ স্বরূপিণী সিদ্ধকালী।
এই হলো মোটামুটি তন্ত্রমতে চক্রের অবস্থান বিবরণ। এর পরের  দিনে  আমরা সহস্রার চক্র-এর কথা শুনবো।
শেষ করার আগে, দু-একটা কথা বলি, তন্ত্রমতে এই যে বর্ণনা এগুলো আমাদের কাছে গভীর কল্পনার বিষয়, কিন্তু তান্ত্রিকদের কাছে, এগুলো স্পষ্টভাবেই  দৃষ্টিগোচর হয়। আমরা সাধারণত জ্ঞান বলে, আমরা দেখি কখন, যখন আলো কোনো বস্তুতে বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখন তাকে আমরা দেখতে পারি। কিন্তু আসলে আমরা তখনই দেখি যখন আমরা দেখতে চাই।  আমাদের সামনে অসংখ্য ধূলিকণা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা তাদের দেখতে পাই না। কিন্তু যখন আলোর-রশ্মি ঘরের জানালার ক্ষুদ্র স্থান দিয়ে ধূলিকণার উপরে পড়ে, তখন ধূলিকণা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। এ এক ধরনের দেখা। আবার দেখুন, দুধের মধ্যে অসংখ্য পোকা কিলবিল করছে, আমরা তাদের দেখতে পাই না। কিন্তু যদি অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখি, তখন সেই পোকা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। তো একটা হচ্ছে,স্বাভাবিক ভাবে দেখা, যা আমরা দেখতে না চাইলেও দেখি, আর একটা তীব্র আলোক রশ্মির সাহায্যে দেখা, অর্থাৎ ধূলিকানাকে দেখা। আর একটা বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে দেখা। আরও একটা দেখা আছে।  দূরে সমুদ্রের মধ্যে একটা কলার খোলার মতো  নৌকা ভাসছে। বা দূর আকাশে একটা চিল  উড়ছে। কেউ আমাকে বললো, ওই দেখ একটা নৌকা ভাসছে, বা একটা চিল উড়ছে, তখন আমি বিশেষ মনোযোগ দিয়ে দেখবার চেষ্টা করলে আমরা বুঝতে পারি যে হ্যাঁ  দূরে সমুদ্রের মধ্যে একটা নৌকা ভাসছে  বা দূরে আকাশের মধ্যে একটা চি ল ভাসছে। এই যে শেষের দেখা, চিল বা নৌকাকে দেখা, এটা  হচ্ছে, মনোযোগ দিয়ে দেখা। এই মনোযোগ যখন আরো গভীর হয়, তখন আমরা আমাদের ভিতরের জিনিসও  দেখতে পাই। এই দেখায় আমাদের চর্মচক্ষুর প্রয়োজন হয় না। তখন আমরা অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পারি। আমাদের মনোযোগ যখন গভীর হয়, তখন আমাদের এই দর্শন শক্তি জাগ্রত হয় ,  এবং সেটা এই চোখের দেখার চেয়েও অধিকতর স্পষ্ট হয়ে যায়।  এটা কাউকে দেখানো যায় না, শুধু দেখা যায়। আমাদের মুনিঋষিরা তাদের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে এই চক্রগুলোকে দেখেছিলেন।  আর তার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বর্ণনা আছে এই তন্ত্র  শাস্ত্রে। আমাদের অন্তর্দৃষ্টি যখন খুলে যাবে, তখন আমরাও  এসব দেখতে পাবো। প্রথমে একটু কল্পনা করে এগুতে হয়।  ধীরে ধীরে এই সব স্থানগুলোকে আমরা নির্দিষ্ট করতে পারি। আর সেখানে তখন একটা মৃদু কম্পন অনুভূত হয়।

আজ্ঞাচক্র কথাটার মধ্যে একটা একটা বিশেষত্ত্ব আছে।  আজ্ঞা কথাটার অর্থ নির্দেশ বা অনুশাসন। এই অনুশাসনের মাধ্যমেই আমরা আমাদের জীবনক্রিয়াকে সংগঠিত করছি। অর্থাৎ আমাদের ভিতরে একজন শাসক আছেন, যিনি প্রতিনিয়ত আমাদের নির্দেশ  দিচ্ছেন।  এই আজ্ঞাচক্রের নির্দেশেই আমাদের শরীরের সমস্ত অঙ্গ ক্রিয়াশীল হয়।  এমনকি আমাদের যে যৌন-ইন্দ্রিয় আছে, তাও এই আজ্ঞাচক্রের নির্দেশে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।

কুলকুণ্ডলিনী শক্তি (চার ) 
সহস্রার  :
আমরা আলোচনা করছিলাম,  আমাদের শরীরে অবস্থিত নানান  চক্র সন্মন্ধে।  আমরা শুনে ছিলাম, হৃদয়-কেন্দ্র থেকে  উচ্চতর কেন্দ্রগুলো  মানুষের আধ্যাত্মিক   উপলব্ধির জন্য চিহ্নিত।   অর্থাৎ হৃদয়, কন্ঠ, ভ্রু-যুগল এবং শীর্ষদেশ আধ্যাত্মিক অনুভূতির কেন্দ্রস্থল। তবে একটা কথা বলি, এইসব কেন্দ্রগুলোকে শারীরবিদ্যার সাহায্যে না বোঝাই ভালো। তাহলে আমাদের সব গুলিয়ে যাবে। এগুলো আসলে অধ্যাত্ম চেতনার ভিন্ন ভিন্ন স্তরের দ্বার -স্বরূপ। বিশ্বশক্তির সঙ্গে আমাদের প্রতিনিয়ত একটা যোগাযোগের  একটা ধারাবাহিকতা চলছে। সেটা আমি বুঝি আর না বুঝি। বিশ্বশক্তি আমাদের আজ্ঞাচক্রের উপরিভাগে মহানাদ- রূপে এক শুন্যস্থান বিরাজ করছে। এই স্থানে কেবলমাত্র শুদ্ধবুদ্ধি প্রকাশমান। একে বলে নির্বাত স্থান। অর্থাৎ বায়ুহীন একটা স্থির অবস্থা। এর উপরে পরম ব্যোম। এই বায়ুহীনশূন্যস্থানে, শঙ্খিনী নাড়ীর মস্তকে বিসর্গ শক্তির নিচে, সহস্র পাপড়ি বিশিষ্ট পদ্ম বিরাজ করছেন। এই পদ্ম নিচের দিকে মুখ করে আছেন। এর কেশরগুলো, প্রভাতের সূর্য্যের মতো দীপ্তিশালী। এই পদ্মের দলগুলোতে পঞ্চাশটি  অক্ষর কুড়িবার ঘুরে ঘুরে আবর্তিত হচ্ছে। এই যে অক্ষর অর্থাৎ অ, আ, ক,খ, ... এগুলো আসলে বৈজিক বর্নমালা। এই সহস্রদল পদ্মমধ্যে নির্মল এক পূর্ণচন্দ্র তার জ্যোৎস্নাজাল বিস্তার করে, স্নিগ্ধ সুধাময় হাসির মতো শোভা পাচ্ছেন । এরই ভিতরে বিদ্যুৎরূপী অনির্বচনীয় বাক্য অর্থাৎ যা ভাষায় প্রকাশ যায় না, এমনি একটা ত্রিকোণ শোভা  পাচ্ছে। আর এই ত্রিকোণের মধ্যস্থলে মহাশূন্য-স্থানে অধিষ্ঠিত আছেন, সমস্ত দেবগন এবং কৌল সাধকগণের গুরুস্বরূপ মহাবিন্দু।

এই শূন্যস্থান পরম আনন্দময়। অতীব সূক্ষ্ম ও পূর্ন চন্দ্রসম দীপ্তি বিশিষ্ট। এখানেই আকাশরূপী পরম-আত্মা-স্বরূপ পরমশিব অবস্থান করছেন। এর অভ্যন্তর-স্থানের উপরিভাগে একটা দ্বাদশদল পদ্মে স্বয়ং গুরুদেব উপবিষ্ট আছেন। তিনিই পরম-শিব, পরম-আত্মা বা ব্রহ্ম।

এখানেই পূর্ন সূর্য্যের মতো অরুণবর্ন মৃনাল-তন্তুর শত ভাগের এক ভাগ সম স্থুলা, বিদ্যুতের ন্যায় দীপ্তিশালীনী "অমা" নাম্নী ষোড়শী কলা বিদ্যমান। এই "অমা" নাম্নী ষোড়শী কলা, সতত প্রকাশমানা ও অধোমুখী। আর এই মুখ থেকে নিরন্তর সুধা-রসধারা বিগলিত হচ্ছে।

এই "অমা"-কলার  ভিতরে, কেশাগ্রের সহস্র অংশের এক অংশ পরিমিত "নির্বাণ" নাম কলা বিদ্যমান আছে। এই কলা সমস্ত ভূতের দেবতা স্বরূপিণী, ইনিই তত্ত্বজ্ঞান। এঁনার আকৃতি অর্ধ-চন্দ্রের  ন্যায়, এনার প্রভা দ্বাদশ আদিত্যের মতো। ইনিই মহাকুণ্ডলিনী।

এই নির্বাণ কলার অন্তরে পরম-আশ্চর্য নির্বাণশক্তি। এই পরম-আশ্চর্য নির্বাণ শক্তি কেশাগ্রের কোটি-ভাগের এক-ভাগ সম সূক্ষ্ম এবং কোটি সূর্য্যসম দীপ্তিশালিনী।  ইনিই ত্রিভুবন জননী - নিরন্তর প্রেমসুধা বর্ষণ করছেন।

আবার এই নির্বাণশক্তির মধ্যস্থলে নিত্যানন্দ নাম্নী, সর্বশক্তি আধারস্বরূপ বিশুদ্ধ তত্ত্ব-জ্ঞান দাতা পরম-শিব অবস্থান করছেন ।

এই নির্বানকলার নিচের  দিকে অব্যক্ত আনন্দ স্বরূপিণী "নিবোধিতা" নামক অগ্নি প্রজ্বলিত। আবার এই  নির্বানকলার মধ্যে পরবিন্দু  বা শিব ও শক্তির মিলিত সত্তা অবস্থান করছেন।
সবশেষে বলি, এই স্থানই সমস্ত সাধকের পরম-স্থান। বৈষ্ণবেরা একে বলেন, বিষ্ণুর স্থান, শাক্তরা বলেন মহাদেবীর স্থান, আবার মুনি -ঋষিরা বলেন প্রকৃতি-পুরুষের মিলন স্থান।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।

কুলকুণ্ডলিনী শক্তি (পাঁচ )

শরীরের বায়ু ও নাড়ীর ক্রিয়া :- 
আসলে কুণ্ডলিনী বুঝতে গেলে আমাদের শরীরের বায়ু ও নাড়ীর ক্রিয়া বুঝতে হবে। অর্থাৎ কুণ্ডলিনী শক্তি কি ও তার চলাচলের রাস্তাই বা কোথায় সে সম্পর্কে আমাদের বিষদ ভাবে বুঝতে হবে।  তো এই সম্পর্কে দুচার কথা বলি।

আসলে যোগের মূল ভিত্তি হচ্ছে, বায়ু। অর্থাৎ বায়ুকে চালনা করা। এখন কথা হচ্ছে বায়ুকে কোথায় চালান করবো ? বায়ুকে চালান করবো, নাড়ীর মধ্যে। নাড়ীর মধ্যে যে সুক্ষ সুড়ঙ্গ আছে, সেই পথে বায়ুকে চালনা করতে হয়। বায়ুকে দেহের নাড়ীসমূহের মধ্যে সঞ্চালন করে, উর্দ্ধগতি দান  করাই যোগের উদ্দেশ্য । আর এই উর্দ্ধগতি যখন হবে, বায়ু তখন  নির্মল হবে, শুদ্ধ হবে। অথবা উল্টো ভাবে বলা যায়, বায়ু যত  নির্মল হবে, বায়ু যত  শুদ্ধ হবে, বায়ু তখন স্বাভাবিক ভাবেই উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হবে। আমরা আগে শুনেছি, বায়ুর দশটি গুনের মধ্যে ৫টি গুন্ নাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করে।  আর সেগুলো হচ্ছে, নাগ, কূর্ম, কৃকর, দেবদত্ত্ব ও ধনঞ্জয় - এগুলো আমাদের নাড়ীতে প্রবেশ করে।

মানব দেহে জালের মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নাড়ী।  এইসব নাড়ী  বা নাড়ীর  অভ্যন্তরস্থ ছিদ্র সাধারণত আমাদের পিত্ত -শ্লেষা দ্বারা ভরপুর থাকে।  তাই সেখান দিয়ে আমাদের বায়ু যাতায়াত করতে পারে না। তাই প্রথমে আমাদের দরকার আমাদের নাড়ী শুদ্ধি।  এই নাড়ীকে যথাযথ ভাবে শোধন করতে পারলে, নাড়ীতে বায়ুর প্রবেশ সুগম হবে। আমাদের এই নাড়ীমণ্ডলীর মধ্যে বায়ু যত সহজে সোজা রাস্তা ধরে এগুতে পারবে, তত বায়ু সূক্ষ্ম থেকে সুক্ষ গুন্ প্রাপ্ত হবে। এবং সাধক ততই যোগমার্গের উচ্চস্তরে উত্তীর্ন হতে পারবেন।  সুতরাং  আমাদের এই নাড়ীগুলো সম্পর্কে তাদের অবস্থান  সম্পর্কে  আমাদের যেমন  একটা স্পষ্ট ধারণা দরকার, তেমনি দরকার বায়ুর ক্রিয়া সম্পর্কে। তন্ত্র  শাস্ত্র মতে আমাদের শরীরে তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার নাড়ী আছে। এর মধ্যে চোদ্দটি নাড়ী প্রধান। ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, গান্ধারী, হস্তিজীহ্বা, কুহু, সরস্বতী,পূষা, শঙ্খিনী, পয়স্বিনী, বারুনী,অলম্বুষা, বিশ্বোদরী, ও যশস্বিনী। এই চোদ্দটা নাড়ীর  মধ্যে আবার তিনটি নাড়ী শ্রেষ্ঠ।  সেগুলো হচ্ছে ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না। এই তিনটি নাড়ীর মধ্যে আবার সুষুম্না নাড়ী প্রধান। আমাদের যোগক্রিয়ায় এই সুষুম্না নাড়ীকে অব্লম্বন করেই করতে হয়। আর এই সুষুম্না নাড়ীকে আশ্রয় করে, অন্যান্য নাড়ী অবস্থান করছে।

সুষুম্না নাড়ী আমাদের মেরুদণ্ডের মধ্যভাগে অবস্থিত। তাই একে মধ্যে-নাড়ীও বলা হয়ে থাকে। এই নাড়ী আমাদের মূলাধার থেকে শুরু করে, মাথার উপরে যে সহস্র দল পদ্ম আছে, সেখান পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি সূর্য ও বহ্নি রূপিণী। এটি সত্ত্ব-রজ-তম এই তিন গুনের আঁধার। এটি দেখতে খানিকটা প্রস্ফুটিত ধুতুরা ফুলের মতো। এই সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে আছে, বজ্রাক্ষা নাড়ী। বজ্রাক্ষা নাড়ীর মধ্যে আছে আবার চিত্রিণী নাড়ী।  আর এই চিত্রিণী নাড়ীর মধ্যে আছে ব্রহ্ম নাড়ী। চিত্রিণী নাড়ীর ভিতরে যে ব্রহ্ম পথ আছে, সেই ব্রহ্ম বিবর বেয়ে কুণ্ডলিনী শক্তি আমাদের সহস্রারে পৌঁছে, পরম-ব্রহ্মে মিলিত হন।

ইড়া নাড়ী অবস্থান মেরুদণ্ডের বাইরে বাম  ভাগে বিদ্যমান ।   কিন্তু সুষুম্না নাড়িকে চক্ৰে-চক্রে বেষ্টন  করে আমাদের ডান নাকের ছিদ্র দিয়ে আজ্ঞা চক্রে মিলিত হয়েছে। ঠিক একই  ভাবে পিঙ্গলা নাড়ী সুষুম্না   নাড়ীকে ধরে চক্রে চক্রে বেষ্টন  করে, আমাদের বাম নাসাপুট দিয়ে মুক্ত ত্রিবেণী স্থলে মিলিত হয়েছে।

 এই তিনটি নাড়ী অর্থাৎ ইড়া পিঙ্গলা ও সুষুম্না নাড়ী আমাদের মূলাধারে একত্রিত হয়েছে বলে, এই মূলাধারকে তিনটি নদীর সঙ্গম বা ত্রিবেণী বলা হয়ে থাকে। এখান থেকে এঁরা  আবার আলাদা হয়ে যায়  এবং পুনরায় ভ্রুদ্বয়ের নিম্নে অর্থাৎ আজ্ঞাচক্রে মিলিত হয়। এইজন্য এই স্থানকেও ত্রিবেণী বলা হয়ে থাকে। প্রথমটি অর্থাৎ মূলাধারে যুক্ত ত্রিবেণী আর শেষেরটি অর্থাৎ আজ্ঞাচক্রে মুক্ত-ত্রিবেণী।

সমস্ত নাড়ীর উৎপত্তি স্থান হচ্ছে মূলাধার পদ্ম। এই সব নাড়ী আমাদের জিহবা, পুরুষ-চিহ্ন, স্ত্রীচিহ্ন, পায়ের আঙ্গুল, নাক, চোখ, কান, কক্ষ,(বুকের উভয় পাশের মর্ম্মস্থল, বা প্রকোষ্ঠ )  কুক্ষি অর্থাৎ কোটর , পায়ু  অর্থাৎ সমস্ত অঙ্গ -প্রত্যঙ্গে গিয়ে, নিজ নিজ কাজ ক'রে,  আবার মূলাধারে ফিরে আসে।এই সব নাড়ী  থেকেই অসংখ্য শাখা - প্রশাখা যার সংখ্যা সাড়েতিন  লক্ষ যথাস্থানে আমাদের দেহে বিদ্যমান আছে। এইসব নারীকে ভোগবহা  নাড়ী বলে। এইসব নাড়ী দ্বারা আমাদের সমস্ত দেহে বায়ু সঞ্চারিত হয়। এবং সর্ব্বক্ষন এই বায়ু আমাদের দেহে ওতপ্রোত থেকে চৈতন্য শক্তি জাগ্রত রাখে।

মেরুদণ্ডের একদম উপরে, অর্থাৎ মেরুশৃঙ্গে ষোড়শ কলায় পূর্ণ চন্দ্রমা বিরাজমান রয়েছেন। এই চন্দ্রমা অধোমুখী হয়ে সর্বদা সুধা বর্ষণ করছেন। এই সুধামৃত দুই ভাগে ভাগ হয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অবস্থায় প্রবাহিত হতে থাকে। এর মধ্যে একভাগ অমৃত, শরীরের পুষ্টির জন্য ইড়া  নাড়ীতে প্রবেশ করে, মন্দাকিনী নদীর ন্যায় প্রবাহিত হতে থাকে। এই সুধাই জলরূপে আমাদের শরীরের পুষ্টি বর্ধন করে থাকে। এই সুধাময় কিরণ আমাদের শরীরের বাম  ভাগে সঞ্চারিত হচ্ছে। তার কারন হচ্ছে, ইড়া নাড়ী আমাদের বাম  পাশেই অবস্থান করে থাকে। আর দ্বিতীয়ভাগ  শ্বেতবর্ণ দুগ্ধের ন্যায় আমাদের আনন্দ প্রদান  করে থাকে। সৃষ্টি কার্য রক্ষার জন্য, এই অমৃতময় চন্দ্রমন্ডল জাত কিরণ আমাদের সুষুম্না
নাড়ী- পথ বেয়ে মেরুদণ্ডের নিচের দিকে গমন করে থাকে।

মূলাধারে দ্বাদশ-কলাযুক্ত প্রজাপতি সূর্য অবস্থান করছেন। এই সূর্য্যই উর্দ্ধ-রশ্মি হয়ে দাক্ষিন্মার্গে অর্থাৎ পিঙ্গলা নাড়ীতে প্রবাহমান হন। এবং নিজস্ব কিরণ-রশ্মি  দ্বারা,  চন্দ্রমন্ডলের অমৃতময় কিরণ  ও শরীরের ধাতুকে গ্রাস করতে থাকেন। এই সূর্য্যমন্ডল-ই আবার বায়ুমণ্ডল দ্বারা পরিচালিত হয়ে সমস্ত শরীরে বিচরণ করেন।

এই বিচরণকারী সূর্য আমাদের মেরুমন্ডল-স্থিত অপর একটা  মূর্তি। ইনিই লগ্ন-যোগে অর্থাৎ উপযুক্ত সময়ে দাক্ষিন্মার্গে অর্থাৎ পিঙ্গলা  নাড়ীতে সঞ্চালিত হয়ে, মুক্তিকাঙ্খীকে মুক্তি দান  করেন। আবার অন্য সময়ে,ইনিই সৃষ্ট সমস্ত বস্তুকে নাশ করে থাকেন।

সব শেষে বলি, আমাদের সমস্ত নাড়ীই বায়ু চলাচলের পথ স্বরূপ।  আমাদের মূলাধার থেকে মস্তক পর্যন্ত যত  নাড়ী  বিস্তৃত রয়েছে, এঁরা সবাই রস-রক্ত বাহক, রূপ-বাহক, শব্দ-বাহক এমনকি আমাদের মনেরও বাহক। আর এগুলো সবই প্রাণবাহী নাড়ী। আসলে নাড়ী মাত্রেই বায়ু চলাচলের রাস্তা স্বরূপ, এবং প্রানক্রিয়ার  সহায়ক হিসেবে কাজ করে থাকে।

আমাদের যা কিছু ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া, মনের ক্রিয়া, এমনকি বুদ্ধির ক্রিয়া,সবই এই বায়ুর স্পন্দন থেকে জাত। আর এগুলো নাড়ী-চক্রের দ্বারাই সম্পাদিত হচ্ছে। আমাদের জ্ঞানশক্তি, আমাদের ইচ্ছাশক্তি, এই বায়ুর স্পন্দনজাত।  বায়ুর স্থুলতা ও সূক্ষ্মতার উপরে নির্ভর করছে, নাড়ীর স্থূলতা বা সূক্ষ্মতা। সাধক বায়ুকে যোগক্রিয়ার দ্বারা ক্রমে সুক্ষ অবস্থা প্রাপ্ত হয়ে যখন নিরুদ্ধগতি হন, তখন নাড়ী-জাল ধীরে ধীরে গুটিয়ে আসে। তখন জ্ঞান ইত্যাদি যাবতীয় ব্যাপার নিরুদ্ধ হয়ে যায়। পতঞ্জলি যোগশাস্ত্রের মতে এই অবস্থাই চিত্ত বৃত্তির নিরুদ্ধ অবস্থা। এই সময় সাধকের দ্বন্দ্বাতীত অবস্থা হয়। পরম-সাম্য ভাবের উদয় হয়। এই বায়ুর নিবৃত্ত অবস্থাই নির্বাণ অবস্থা নামে খ্যাত।

সমস্ত সাধকের সাধনার অগ্রগতি নিভর করে, তার  ভিতরের বায়ুশুদ্ধির উপরে। বায়ুই আমাদের আধ্যাত্মিক পথের শক্তি। আর এই শক্তির গতিপথ নাড়ীর ভিতরে অবস্থান করছে। আর একটা কথা, আমাদের দেহে বা দেহভান্ডে  যেমন নাড়ীর জাল বিস্তার করে আছে, ঠিক তেমনি এই বিশ্বব্রহ্মান্ডেও একটা বিশাল নাড়ী-জাল বিস্তার করে আছে। আমাদের দেহে যেমন সূর্য্যরশ্মি বায়ুর সাহায্যে প্রবেশ করছে, ঠিক তেমনি এই বিশ্বব্রহ্মান্ডেও এই অনন্ত সূর্য্যরশ্মি ছড়িয়ে পড়ছে। জীবাত্মা স্থুলদেহের মৃত্যুকালে যখন এই মরদেহ ত্যাগ করে, তখন সে যে নাড়ী-দ্বারে নির্গত হয়, সেই নাড়ীই তাকে যথাস্থানে বহন করে নিয়ে যায়। এই সূর্য্যরশ্মি আসলে ব্রহ্মান্ডের নাড়িপথ। এই সূর্য্যরশ্মি বা ব্রহ্মান্ডের নাড়ী-পথ অবলম্বন করে, মহাত্মারা সূক্ষ্মদেহে ইতস্তত ভ্রমন করে থাকেন। এমনকি এই সূর্য্যরশ্মি অবলম্বন করে, মহাত্মারা পরদেহে প্রবেশ করতে পারেন। যেমন করেছিলেন, আচার্য্য আদি-শঙ্কর। বা গোরক্ষনাথ ও তাঁর  গুরুদেব মৎসেন্দ্রনাথ।   যোগাচার্য্যগণ নাড়ীমন্ডলীর মধ্যে বায়ুর স্থুলতা,সূক্ষ্মতা, ও বায়ুর নিরোধ অবস্থা পর্যবেক্ষন করে বুঝতে চেষ্টা করেন, তার যোগক্রিয়ার সাফল্য।

আমাদের যে মলনাড়ী আছে, তার মধ্যে যে বায়ু সঞ্চরণ করছে, সেই বায়ু স্থুল বায়ু এবং এর গতি বক্রাকার । এই স্থুলবায়ুকে জড় শক্তি বলা হয়ে থাকে। যোগীগণ যোগের সাহায্যে, এই বায়ুকে সরলরেখায় প্রবাহিত করবার প্রয়াস করেন, স্থুল থেকে সূক্ষ্মেপরিবর্তন করবার চেষ্টা করেন। আর তখন নাড়ী-মার্গ ক্রমে বিশুদ্ধ হয়, আর এই নাড়ীমার্গ যখন বিশুদ্ধ হয়ে যায়, তখন বায়ুর গমনপথ সরল-সোজা হয়ে যায়। এই সরল-পথ-ই হচ্ছে সুষুম্না নাড়ী। সাধক প্রথম অবস্থায়, সুষুম্না নাড়ীর সরলপথ অনুধাবন করতেও পারে না, উপল্বদ্ধিও করতে পারে না। আমরা জানি, সুষুম্নার মধ্যে আছে বজ্রাক্ষা নাড়ী, আর এই বজ্রাক্ষার মধ্যে আছে চিত্রিণী নাড়ী, আবার চিত্রিণী নাড়ীর মধ্যে আছে ব্রহ্মনাড়ী। যোগের সাহায্যে বায়ু শুদ্ধিকরণের সঙ্গে সঙ্গে বায়ু সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম হতে থাকে। আর এই বায়ু যত  সূক্ষ্ম হতে থাকবে, তত সে সুষুম্না থেকে ধীরে ধীরে ব্রহ্মনাড়ীতে প্রবেশের যোগ্য হয়ে উঠবে। অতএব, নাড়ীশুদ্ধিকরণের যেমন প্রয়োজন, তেমনি দরকার বায়ুকে স্থূল থেকে সূক্ষ্ম, সুক্ষ থেকে সূক্ষ্মতর, সূক্ষ্মতর  থেকে সূক্ষ্মতম করে তোলা। তবেই আমরা ব্রহ্মপথের সন্ধান পাবো।

একই শক্তির দুই অবস্থা, স্থুল ও সূক্ষ্ম। একই শক্তির দুই অবস্থা জড় ও চেতন। আমাদের সাধনার উদ্দেশ্য এই জড়কে চেতনে পরিণত করা। স্থুলকে সূক্ষ্মে পরিণত করা। আর এরই নাম যোগ সাধনা।আর এই যোগ সাধনা করতে গেলে আমাদের বায়ুকে যেমন বুঝতে হবে, তেমনি বুঝতে হবে বায়ুর গতিপথ অর্থাৎ নাড়ীকে।

এর পরের  দিন আমরা কুণ্ডলিনী শক্তির ক্রিয়া গতিপথ সন্মন্ধে আরো বিস্তারিত ও সূক্ষ্মতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করবো। কিন্তু আমরা বার বার বলছি, যোগক্রিয়া সাধারণের জ্ঞানের বিষয় নয়, এর জন্য চাই পাকা দেহ, এর জন্য চাই গভীর নিষ্ঠা, আত্মত্যাগ ও মানসিক পবিত্রতা। তবে আমরা বিশ্বাস করি, এগুলো অর্জন করার সাধ্য আমাদের সবার মধ্যেই নিহিত আছে। আর এই সজ্ঞা যতদিন না ভিতর থেকে জাগবে, ততদিন আমাদের প্রতীক্ষা করতে হবে।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।

কুলকুণ্ডলিনী শক্তি  - ছয়

সুপ্ত কুণ্ডলিনী শক্তির জাগরণের পরে তার কি গতি হয় ?  
কুলকুণ্ডলিনী সম্পর্কে আজ আমরা সর্বোচ্চ পৰ্য্যায়ের জ্ঞানের কথা শুনবো। যোগের সাহায্যে বিশেষ করে আমরা যখন মহাবন্ধ মুদ্রা, ও মূলবন্ধ মুদ্রা বা মহাবেধ মুদ্রা, মহামুদ্রা যোগমুদ্রা, শক্তিচালনী  মুদ্রা   ইত্যাদি দ্বারা, বায়ুকে রোধ করতে পারি, বা বায়ুকে উর্দ্ধগামী করে কুম্ভক অবলম্বন  করতে পারি, তখন এই নিরুদ্ধ বায়ু আমাদের শরীরের অগ্নিস্থানের অগ্নিকে আঘাত দিয়ে জাগিয়ে তোলে। তখন এই উদ্দীপিত বহ্নি ও বেগবান বায়ু কুণ্ডলিনীকে প্রবুদ্ধ বা জাগ্রত করে। তখন অধোগামী অপানবায়ু উর্দ্ধগতিশীল হয়ে ওঠে, এবং নাভির নিচে যে মনিপুর চক্র আছে সেখানকার বায়ুমন্ডলে আঘাত করতে থাকে । আর এই আঘাতে সেখানে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে। এবং এই অগ্নি শিখা ও অপান  বায়ু তখন প্রণবায়ুকে স্পর্শ করে। তখন আমাদের সমস্ত শরীর-ব্যাপী অগ্নিময় হয়ে ওঠে। এই অগ্নিতাপে দগ্ধ হয়ে, সুপ্ত কুণ্ডলিনী ক্রিয়াশীল বা গতিশীল হয়ে ওঠে,  ও সুষুম্নার নাড়ীর মধ্যস্থ সুড়ঙ্গে প্রবেশ করে। একেই  বলে কুণ্ডলিনী জাগরণ।

এই কুণ্ডলিনী অর্থাৎ বায়ুশক্তি যখন  জাগ্রত হয়, তখন এর গতি হয় উর্দ্ধ মুখী। আর এই কুণ্ডলিনী শক্তির সঙ্গে তখন  মিলিত হয়, মূলাধারের  মধ্যে ঘুমন্ত ব্রহ্মা, ডাকিনীশক্তি, এবং অন্যান্য দেবতা, চতুর্দলের চারটি বর্ণ ও গন্ধতত্ত্ব ধরাবীজ "লং"  এগুলো সবই তখন  মিলিত হয়ে, কুন্ডলিনীর দেহে লয় প্রাপ্ত হয়।

এই কুণ্ডলিনী শক্তি তখন মূলাধার-চক্র থেকে জীবাত্মাকে সঙ্গে নিয়ে স্বাধিষ্ঠান  চক্রে  প্রবেশ করে। আর ঠিক তখনই স্বাধিষ্ঠান  চক্রের যে পদ্মদল সেগুলো উর্দ্ধমুখী হয়ে যায়। এই স্বাধিষ্ঠান  চক্রের মহাবিষ্ণু, রাকিনি শক্তি, এবং অন্যান্য দেবতা পদ্মদলের ছটি বর্ণ এবং গন্ধতত্ত্ব তখন রস তত্ত্বে মিশে যায়। অর্থাৎ আমাদের মধ্যে যে পৃথ্বী তত্ত্ব অর্থাৎ মাটি আছে, তখন তা রসতত্ত্বে  মিশে যায়। আর কুণ্ডলিনী-দেহে যে পৃথ্বী বীজ অর্থাৎ লং আমাদের কারন শরীরে অবস্থান করছিলো, তা "বং" নামক বরুন বীজের সঙ্গে মিশে কুন্ডলিনীর দেহে বিলীন হয়ে যায়।

এর পরে এই রস-তত্ত্ব ও জীবাত্মাকে সঙ্গে নিয়ে কুণ্ডলিনী শক্তি মনিপুর চক্রে প্রবেশ করে। আবার এই মনিপুর চক্রে  অবস্থিত রুদ্রদেব, লাকিনি শক্তি, ও অন্যান্য দেবতা, দশদল পদ্মের দশটি বর্ণ  এবং রস-তত্ত্ব, রূপতত্ত্বে মিশে নয়। এইসময়, কুন্ডলিনীর দেহে সুক্ষভাবে অবস্থিত বরুন-বীজ "বং" তেজ-বীজ "রং" এর সাথে মিশে যায়। অর্থাৎ রসতত্ত্ব তখন অগ্নি তত্ত্বে মিশে যায়। এবং শেষেমেষ কুণ্ডলিনীর দেহে বিলীন হয়ে যায়।

এই মনিপুর চক্র হতে অনাহত-চক্রে  উঠতে গেলে সাধককে ব্রহ্ম-গ্রন্থি  ভেদ করতে হয়। এই ব্রহ্ম-গ্রন্থি ভেদ সাধকের পক্ষে একটা কঠিন পরীক্ষা। আসলে আমাদের মনিপুর চক্র পর্যন্ত জড়বস্তুর বিস্তার স্থান।  বা বলা যেতে পারে, প্রকৃতির জড় শক্তির অবস্থান কেন্দ্র এটি। এই জড়শক্তিকে শুদ্ধ ও সূক্ষ্ম না করতে পারলে, এখান থেকে উত্তরণ সম্ভব হয় না। তাই এই কাজ সাধকের পক্ষে প্রচন্ড দুরূহ।এই সময়টা সাধকের জীবনে সবথেকে কঠিন সময়। আসলে এই সময় আমাদের মধ্যে যে পশুত্ত্ব-ভাব আছে তা সমূলে উৎপাটন করতে হয়ে। এই পশুভাব দূর করতে না পারলে, সাধক ব্রহ্ম-গ্রন্থির সন্ধান পান না। আর ব্রহ্ম-গ্রন্থি ভেদও করতে পারেন না।

তবে যাদের বহু জন্মের সুকৃতি আছে, অথবা যাদের দৃঢ়তা আছে, তারা অবশ্য়ই প্রয়াসসাধ্যে  অনাহত চক্রে উত্তীর্ন হন। এবং কুণ্ডলিনী শক্তি যখন অনাহত চক্রে উপনীত হয়, তখন এখানকার ঈশ অর্থাৎ ঈশ্বরশক্তি শিব, ডাকিনী শক্তি, অন্যান্য দেবতা, অনাহত পদ্মের বারটি পাপড়ির বারোটি অক্ষর ও স্পর্শতত্ত্ব কূল কুণ্ডলিনীর মধ্যে বিগলিত হয়ে যায়। এই সময় কুণ্ডলিনী-দেহের রূপতত্ত্ব ও অগ্নি বীজ ও বায়ু বীজ তখন অনাহত চক্রের "যং" বীজমন্ত্রে মিশে যায়।  অর্থাৎ  অগ্নি তখন বাস্পে পরিণত হয়।  এবং শেষে এই সমস্ত কুল কুণ্ডলিনীর  দেহে বিলীন হয়ে যায়।

এবার অনাহত চক্র  থেকে বিশুদ্ধ চক্রে উত্তরণ করতে হবে। এই বিশুদ্ধ চক্রের আর একটা নাম বিষ্ণু গ্রন্থি। আমাদের যতক্ষন দ্বায়িত্বজ্ঞান বিলুপ্তি না হবে, ততক্ষন আমাদের এই বিশুদ্ধ চক্রে আরোহন সম্ভব নয়।  আর যখন কুণ্ডলিনী জীবাত্মাকে সঙ্গে নিয়ে, এই বিশুদ্ধ চক্রে প্রবেশ করে, তখন অর্ধনারীশ্বর সদাশিব, শাকিনীশক্তি, বিশুদ্ধ পদ্মের ষোলোটি পাপড়ির ষোলোটি বর্ণ ব্যোমতত্ত্বে বা শব্দতত্ত্বে পরিণত হয়। এবং কুণ্ডলিনী-দেহের বায়ু বীজ যং তখন আকাশ বীজ হং-এ মিশে যায়।  অর্থাৎ বাষ্প তখন শব্দ তরঙ্গে বা ইথারে পরিণত হয়। এবং শেষে এই শব্দতত্ত্ব কুণ্ডলিনীর দেহে বিলীন হয়।

এইভাবে কুন্ডলিনীর যাত্রা চলতে থাকে।  এর পর কুন্ডলিনী আজ্ঞাচক্রে প্রবেশ করে। এবং সেখানে আজ্ঞা চক্রে  স্থিত পর-শিব, হাকিনীশক্তি, ও অন্যান্য দেবতা, এবং  বর্ণ এবং কুন্ডলিনীর দেহের শব্দ-তত্ত্ব অহংকার তত্ত্বে মিশে গিয়ে কুন্ডলিনীর দেহে বিলীন হয়ে যায়।

এর পর শুরু হয়, সাধকের কঠিন পরীক্ষা। কুণ্ডলিনীকে সহস্রারে উত্তরণ। এখানে তাকে রুদ্রগ্রন্থির মোচন করতে হয়। এই রুদ্রগ্রন্থি ছেদন হলে তবে সাধকের কুণ্ডলিনী সাধকের সহস্রারে প্রবেশ করে। সহস্রারে কুণ্ডলিনী পরম-শিবের সঙ্গে আলিঙ্গনে অবাধ্য  হয়। আর এই আলিঙ্গন থেকেই অমৃতসুধা ধারা বা  আনন্দ ধারা বর্ষণ শুরু হয়। আর জীবাত্মা তখন এই অমৃতধারা পান করে, পরমতৃপ্তি লাভ  করে।
 এই কুণ্ডলিনী যখন উর্দ্ধদিকে ধাবিত হয়, তখন পদ্মের সমস্ত  পাপড়ি  তার সেই গতি অনুসারে উর্দ্ধমুখী হয়ে যায়। এবং অতি উজ্জ্বল বর্ণ ধারণ করে। এইসময়, একটা চৌম্বকীয় শক্তি, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত সমস্ত শক্তিকে চারিদিক  থেকে আকর্ষণ করে কুন্ডলিনীতে লীন  হয়।  এবং তিনটি শিব-লিঙ্গ অর্থাৎ মূলাধারের স্বয়ম্ভূ  লিঙ্গ, অনাহতের  বাণলিঙ্গ, এবং আজ্ঞাচক্রের ইতর লিঙ্গ সমস্ত শক্তিকে ভেদ করে পরমশিবের সঙ্গে মিলিত হন।
এই হচ্ছে কুন্ডলিনীর যাত্রা, যাত্রাপথের বিবরণ, পরম-শিবের সঙ্গে মিলন। এর পরে আমরা শুনবো সেই যোগ প্রক্রিয়া, যার সাহায্যে মুনিঋষিরা কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করতেন। এ যেন একটা খেলা, কুণ্ডলিনী হচ্ছে একটা চৌম্বকীয় শক্তি এবং এই শক্তি ধীরে ধীরে এক চক্র থেকে আর এক চক্রে  আরোহন করছে, স্থূল বস্তু ধীরে ধীরে আরো সূক্ষ্ম, সূক্ষ্মতর, সূক্ষ্মতম  হচ্ছে, আর শক্তিশালী হচ্ছে। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।  




No comments:

Post a Comment