Thursday, 31 May 2018

জীবাত্মা - সত্যধর্ম ও আমি

জীবাত্মা - সত্যধর্ম ও আমি 



মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্ত তার তত্ত্বজ্ঞান উপাসনা গ্রন্থে বলছেন। জ্ঞানের আশ্রয়-দ্রব্য হচ্ছে  "আত্মা"। অর্থাৎ জ্ঞানকে যিনি আশ্রয় করে আছেন তিনিই আত্মা। আর মহাত্মা গুরুনাথ প্রথম কথাতেই আত্মার স্বরূপ বলে দিলেন।  অর্থাৎ আত্মা  হচ্ছে জ্ঞানের আশ্রয় দ্রব্য। এবার বলছেন, আত্মা দুই প্রকার : পরমাত্মা বা ঈশ্বর ও জীবাত্মা। ক্ষিতি ও অঙ্কুরাদির কর্তৃত্ব যিনি করেন, তিনিই   ঈশ্বররূপে  অনুমেয়। আর জীবাত্মা হচ্ছে  মানস-প্রত্যক্ষ-সিদ্ধ। কথাটা আবার বলি : ক্ষিতি ও অঙ্কুরাদির কর্তৃত্ব যিনি করেন, তিনিই   ঈশ্বররূপে  অনুমেয়। আর জীবাত্মা হচ্ছে  মানস-প্রত্যক্ষ-সিদ্ধ।

 ক্ষিতি অর্থাৎ পৃথিবী  . গুরুদেব কিন্তু পৃথিবী কথাটা ব্যবহার করেন নি। বলছেন ক্ষিতি অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যত মৃত্তিকা বা মৃত্তিকা দ্বারা নির্মিত বস্তু আছে অর্থাৎ জড়বস্তু আছে তার যে কর্তৃত্ত্ব করেন, এবং অঙ্কুরাদি অর্থাৎ  প্রাণ সৃষ্টির প্রক্রিয়ার উপরে যিনি কর্তৃত্ত্ব করেন, তিনিই ঈশ্বর। অর্থাৎ বিশ্ব শক্তি নিয়ন্ত্রক-ই  হচ্ছেন ঈশ্বর বা পরমাত্মা।    

গুরুদেব কিন্তু তার আলোচ্য গ্রন্থ, তত্ত্বজ্ঞান-উপাসনায়   প্রথমে বৈশেষিকদর্শন, সাংখ্যদর্শন, তারপরে পাতঞ্জলদর্শন থেকে আত্মা সম্পর্কে বলেছেন।  আমরা কিন্তু সেই আলোচনায় যাবো না। আমরা গুরুদেব  কি বলছেন সেটা দেখবো।  গুরুদেব একদম শেষে তারই লেখা  সংস্কৃত তত্ত্বজ্ঞানম   থেকে বঙ্গানুবাদ করে  যা বলছেন সেখান থেকেই আমরা শুনবো।

আমি তো সংস্কৃত বুঝি না, তবুও যারা বোঝেন তাদের জন্য গুরুদেবের লেখা সংস্কৃত তত্ত্বজ্ঞানম গ্রন্থ থেকে মূল কথা (সংস্কৃত) পড়ে শোনাচ্ছি।

"নায়মাত্মা শরীর মিন্দ্রিয়ং বা। আত্মা শরীর  বা ইন্দ্রিয় নয়।

আহতে শরীরে, বিষয়ে ইন্দ্রিয়-প্রবিষ্টে চ অন্যমনস স্তদুভয়াননুভাবাৎ।   শরীর আঘাত প্রাপ্ত হলে, বা  বিষয়ে ইন্দ্রিয় প্রবিষ্ট হলেও, যদি অন্যমনস্ক থাকা যায়, তবে এই উভয়েরই  অনুভব হয় না।

প্রাঞ্চ ঊচুঃ, চাতুর্দ্দশসু  ( নব্যাস্তূ  সপ্তসু ) বর্ষেষু গতেষু  পরিবর্তণীয়ানি শারীরস্য মস্তিস্কস্য চ উপাদানানি, নতু স্মৃত্যাদয়ো ভাবাঃ।  প্রাচীনদিগের  মতে  ১৪ বছর, আধুনিক মতে  ৭ বছরের মধ্যে  শরীরের  ও মস্তিষ্কের সমস্ত উপাদানের পরিবর্তন হয়।  কিন্তু স্মৃতি প্রভৃতি  ভাব পরিবর্তিত হয় না।

অতএব স্মৃত্যাদয়ো যত্র বিদ্যন্তে  স আত্মা, ন শরীরং ন মস্তিস্কঞ্চ। অতয়েব স্মৃতি ইত্যাদি ভাব যাতে বিদ্যমান আছে বা  ধরা থাকে সে-ই আত্মা, এটি না শরীর  না মস্তিস্ক।

পরং স চৈতন্যবান্। কিন্তু ইহা  চৈতন্য বিশিষ্ট।  

শরীরমিন্দ্রিয়ানিচ  করণানি, আত্মা তু কর্ত্তা। শরীর  বা ইন্দ্রিয়গণ হচ্ছে করন, আর আত্মা হচ্ছে কর্তা।

 অতএব শরীরেন্দ্রিয় মস্তিস্কাতিরিক্ত  শ্চৈতন্যবান  এবং আত্মা। এতএব শরীর, ইন্দ্রিয়, মস্তিস্ক থেকে অতিরিক্ত কিছু, যা চৈতন্যবান  এবং তিনিই আত্মা।

এর পরে গুরুদেব একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা  বলছেন সেটা হচ্ছে আত্মা ও প্রাণ বা জীবন সম্পর্কে। আমাদের মধ্যে একটা ধারণা আছে যে আত্মা আমাদের শরীরকে  বাঁচিয়ে রাখে। আত্মা বা চেতন শক্তি চলে গেলে আমাদের শরীরের মৃত্যু হয়। ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়।  জীবনী শক্তি ও চেতনা  শক্তি দুটো আলাদা জিনিস।

শুনুন গুরুদেব কি বলছেন :

জীবনী-শক্তিঃ প্রাণ-সংজ্ঞয়া অভিধীয়তে, সা চ আত্মনঃ পৃথক্। জীবনী শক্তি যা প্রাণ নামে খ্যাত, সেটা আত্মা থেকে পৃথক।

আত্মনো ধর্ম্ম   শ্চৈতন্যং তওু প্রাণ-ধর্ম্মো ন। আত্মার ধৰ্ম চৈতন্য যা প্রাণের ধৰ্ম নয়।

 তথাত্বে সতি শ্বাসাদীনি প্রাণ কার্য্যাণি চৈতন্যাভাবে  ন  ভবিতুং শক্ন্ু বন্তি। তাই যদি হতো তবে শ্বাস প্রভৃতি প্রাণ-কার্য্য-সমূহ চৈতন্য অভাবে হতে পারতো না।

অতএব  দেহেন্দ্রিয়-মস্তিস্কপ্রাণাতিরিক্ত আত্মা।" অতয়েব দেহ, ইন্দ্রিয়, প্রাণ ইত্যাদি থেকে অতিরিক্ত কিছুই হচ্ছে  আত্মা।      


 আমাদের দৈহিক সব কিছুর পরিবর্তন হয়, কিন্তু আমাদের  স্মৃতির পরিবর্তন হয় না।  স্মৃতি বা ভাব পরিবর্তিত হয় না। অতএব গুরুদেব বলছেন, এই স্মৃতির ভাব যাতে বিদ্যমান আছে তিনিই আত্মা। ।

খেয়াল করুন, গুরুদেব বলছেন : এই শরীরে অবস্থিত ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যিনি জ্ঞাত হন তিনিই  আত্মা। কে জ্ঞাত হয় ? ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যে জ্ঞান আমরা সংগ্রহ করি, তা আসলে  কে বোঝে বা জ্ঞাত হন ? আমাদের সাধারণ ভাবে মনে হয় মন এই জ্ঞাতা। আমরা যখন যা কিছু দেখছি, শুনছি, বা আস্বাদন করছি, সেটি প্রথমে যায় আমাদের মস্তিষ্কে। মস্তিস্ক পাঠিয়ে দেয় চেতনমনে, চেতনমন পাঠিয়ে দেয়, বুদ্ধির কাছে। বুদ্ধি তার  পূর্ব সংস্কার অনুযায়ী  ইন্দ্রিয়লবদ্ধ বিষয়ের সঙ্গে জ্ঞানকে মেশায়। বা  জ্ঞান প্রদান করে। এইবার  বিচার করে। এবং মনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়।  এই সমগ্র ব্যাপার থেকে যে জ্ঞান হয় সেটা আমাদের স্মৃতিতে চলে যায়।  এই স্মৃতিকে যিনি ধরে রেখেছেন তিনিই চেতনা বা আত্মা, চৈতন্য শক্তি। ইনি অকর্তা।  কিছুই করেন না। দ্রষ্টা মাত্র। সাক্ষী মাত্র। সাক্ষী যেমন শুধু দেখেন না - স্মৃতিতে ধরে রাখেন , এবং প্রয়োজনে প্রকাশ করতে পারেন বা করেন । আত্মা তাই সাক্ষী, বিভু, চৈতন্য, নিরাকার, নির্বিকার।

গুরুদেব বলছেন ৭ বা ১৪ বছরের মধ্যে  আমাদের শরীরের বা মস্তিষ্কের সমস্ত উপাদান পরিবর্তিত হয়ে যায়। আসলে আমাদের শরীর অসংখ্যা কোষের সমষ্টি।  এই কোষ প্রতিনিয়ত জন্মাচ্ছে, প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি প্রাপ্ত হচ্ছে আবার মারা যাচ্ছে।  এই মৃত কোষগুলোই বিভিন্ন ভাবে আমাদের শরীর  থেকে মল-মূত্রের সঙ্গে  বেরিয়ে যায়। আমাদের অল্প বয়সে এই কোষ বৃদ্ধি,  কোষ অবলুপ্তের থেকে বেশি হয়। তাই আমাদের শরীর  বৃদ্ধি পায়।  একটা বয়সের পরে আমাদের এই কোষের প্রজনন ক্ষমতা কমে যায় ফলত  আমাদের শরীরের  বৃদ্ধি হয় না। আমরা বৃদ্ধ হবার পথে এগিয়ে যাই। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজ আমার শরীরে বা মস্তিষ্কে যে উপাদান আছে, একটা সময়ের পরে তা আর একেবারেই থাকবে না। শরীর  তখন সম্পূর্ণ নতুন উপাদানের মিশ্রণ হবে। একটা নয়  বছরের শিশুর শরীরে  আজ যা আছে - ষোলো বছর বয়সে, তার পুরোনো শরীরের কিছুই আর থাকবে না। এমনকি মনও এক থাকবে না। কিন্তু স্মৃতি থেকে যাবে। আমি, আমার শরীর-মন  কিন্তু আর আগের মতো নেই।  এটা  আমরা সবাই বুঝি। এমনকি আমাদের শরীরের একটা অঙ্গহানি হয়ে গেলেও আমরা  কিন্তু আমরা ভাবি আমিতো আছি । কিন্তু এই আমি আর সেই আমি এক নই অর্থাৎ সেই শরীর  নেই,সেই  মন, আমার আর এখন নেই।   তবু স্মৃতি আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে।  তাই আমরা ভাবি।  সেই শিশু বিনয় আর  এই প্রৌঢ়  বিনয় একই। এই স্মৃতি যিনি ধরে রাখেন তিনিই আত্মা বা জীবাত্মা।

ব্যক্তিগত স্মৃতি যিনি ধরে রাখেন তিনি জীবাত্মা। আর যিনি সমগ্র জগতের স্মৃতি যিনি ধরে রাখেন তিনিই পরমাত্মা বা পরমপিতা পরমেশ্বর। ।  
   
এরপরে  গুরুদেব আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছেন, সেটা হচ্ছে, আমরা যাকে  প্রাণ শক্তি বা জীবনী শক্তি বলি. অর্থাৎ যার দ্বারা মানুষ বেঁচে থাকে,  সেই  প্রাণ কিন্তু আত্মা থেকে আলাদা। আত্মার ধৰ্ম হচ্ছে  চৈতন্য।  আর প্রাণের ধৰ্ম  হচ্ছে  জীবনীশক্তি  । চৈতন্য না থাকলেও মানুষের প্রাণের কাজ চলতে পারে। তাই তো দেখি চেতনাবিহীন মানুষেরও স্বাসপ্রস্বাস চলতে থাকে।

শরীরে এমন একটা কিছু আছে যার সুখ, দুঃখ, প্রযত্ন, ইচ্ছা ও দ্বেষ  জ্ঞান আছে, কিন্তু অনুভব নেই। ইনিই আত্মা। ইনি  না শরীর, না মন. না মস্তিস্ক।  এগুলোর অর্থাৎ শরীর, মন, মস্তিষ্কের  পরিবর্তন আছে।  কিন্তু স্মৃতির পরিবর্তন নেই। এই স্মৃতি যাতে থাকে তাকেই  বলে আত্মা ।

মহাত্মা গুরুদেব বলছেন, আত্মার কর্মক্ষেত্র হচ্ছে অন্তঃকরণ অর্থাৎ মন, বুদ্ধি, অহংকার ও চিত্ত । আত্মার আছে  ইচ্ছা।  অন্তঃকরণের আছে প্রবৃত্তি।   সংশয়, নিশ্চয়, অহংকার, স্মরণ।  মন কোনো কিছু দেখলেই সংশয় সৃষ্টি করে, বুদ্ধি এই সংশয় দূর করে, অহংকার গর্ব্ব করে, অর্থাৎ আমার-আমি করে।   আর চিত্ত স্বরণ করে।
আত্মা যখন অন্তঃকরণের সাথে তন্ময় হয়ে থাকে, তখন তারও প্রবৃত্তি থাকে। এই অবস্থায়
জীবাত্মার সমস্ত কর্মই  ত্রিবিধ : কর্ম, ভোগ, জ্ঞান।  এই কারণে জীব, একাধারে কর্তা,  আবার ভোক্তা, ও জ্ঞাতা  বলে কথিত হয়। আত্মা চৈতন্যাত্মক, শারীরাদি  জড়াত্মক।

তাহলে গুরুদেবের কথায় আমাদের কাছে দুটো জিনিস পরিষ্কার হলো।  একটা হচ্ছে জীবনীশক্তি বা প্রাণশক্তি।  যা আমাদের শরীরকে বাঁচিয়ে রাখে।  আর একটা হচ্ছে চেতন শক্তি যা স্মৃতির ধারক, ইনিই আত্মা।

বিখ্যাত শাস্ত্র গ্রন্থে যা পাইনি তাই পেলাম গুরুদেব মহাত্মা গুরুনাথের গ্রন্থে। আপনারা যারা মহাত্মা গুরুনাথের বই পড়ার সৌভাগ্য পান নি, বা পেলেও পড়েন  নি, তাদের অনুরোধ করবো, শুধু হাজার বছরের পুরোনো হলেই ভালো হয়,  বিশ্বাসযোগ্য হয়, তা নয়। বরং নতুনের মধ্যে আরো ভালো জিনিস পেতে পারেন। জাগতিক বিজ্ঞান যেমন উন্নতি করছে, আধুনিক  আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানও  সত্যের গভীরে ঢুকছে। খোলা মন নিয়ে  এগিয়ে আসুন।  সত্যকে উপলব্ধি করুন। 

জয় গুরুদেব ; জয় গুরুদেব ; জয় গুরুদেব ; জয় গুরুদেব।
নমঃ গুরুদেব ;নমঃ গুরুদেব ;নমঃ গুরুদেব ;নমঃ গুরুদেব।
জয় গুরুনাথ ;জয় গুরুনাথ ; জয় গুরুনাথ ; জয় গুরুনাথ।
নমঃ গুরুনাথ ;নমঃ গুরুনাথ ; নমঃ গুরুনাথ ;নমঃ গুরুনাথ।

জয় জয় সদগুরুর জয় ;  জয় জয় জগৎ-গুরুর জয়। জয় জয় গুরুনাথের জয়। জয় জয় পরমপিতা পরমেশ্বরের জয়। হরি  ওঁং।

       


   

No comments:

Post a Comment