কর্মফল -শ্রীমদ্ভগবৎ গীতার বিখ্যাত শ্লোকের অপব্যাখ্যা বা অন্য ভাবে দেখা
শ্রীমদ্ভগবৎ গীতার কতকগুলো শ্লোক মানুষের মুখে মুখে ফেরে : এই রকম একটা বিখ্যাত উক্তি নিয়ে আমরা আজকে আলোচনা করবো।
শ্লোকটি হল : (২/৪৭)
কর্ম্মন্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন
মা কর্ম্মফলহেতুর্ভূমা তে সঙ্গোঽস্ত্বকর্ম্মণি।
শ্লোকটাকে যদি ভেঙে বলি তা হলে দাঁড়ায় এই রকম।
কর্ম্মণি এব তে অধিকারঃ, কদাচন ফলেষু মা, কর্ম্মফলহেতুঃ মা ভূঃ, অকর্মণি তে সঙ্গঃ মা অস্ত্ব।
কর্মে তোমার অধিকার, ফলে কখনোই নয়, কর্মফল যেন তোমার কর্ম্ম প্রবৃত্তির হেতু না হয়, কর্ম্ম ত্যাগেও যেন তোমার প্রবৃত্তি না হয়।
এই শ্লোকটিতে চারটি কথা বলা আছে।
১. কর্ম্মেই অর্থাৎ কর্ম্ম করাতেই তোমার অধিকার।
২. ফলে তোমার কোনো অধিকার নেই।
৩. কর্ম্মফলের হেতুও হয়ো না তুমি।
৪. কর্ম্মত্যাগ বা কর্ম্মরহিত হতেও যেন তোমার আসক্তি না জন্মায়।
এই শ্লোকটি আসলে যুদ্ধক্ষেত্রে আগত অর্জুনকে তার কর্তব্য সম্পর্কে ভগবানের উপদেশ।
যে পরিস্থিতিতে এই কথাগুলো উচ্চারণ করা হয়েছে, যে পরিস্থিতিতে কথাগুলো বলা হয়েছে, এবং যে উদ্দেশ্য নিয়ে কথা গুলো বলা হয়েছে, তা সময়-উপযোগী, এ ব্যাপারে আমার মনে কোনো দ্বিধা বা দ্বন্ধ নেই। কিন্তু এটি চিরকালীন বক্তব্য নয়। আমরা যদি এটাকে আমাদের জীবনসাথী করে নেই, তাহলে আমাদের সমূহ বিপদ। আমরা যদি জীবনের চলার পথে এটাকে ধ্রূবসত্য বলে মেনে নেই, তাহলে আমরা পথভ্রষ্ট হবো। আজ আমি সেই কথা গুলোই বলবো।
আগে আমরা পরিস্থিতিটা দেখে নেই।
অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে এসে গেছে। সামনে তার আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব দেখে তার মনে স্বজন বধের কাল্পনিক পীড়া উপস্থিত হয়েছে। তার মনে দয়া-মায়া উপস্থিত হয়েছে। এমনকি ভীতি ও আশঙ্কা উপস্থিত হয়েছে। যুদ্ধের পরিনাম তো মৃত্যু। যুদ্ধে বিপক্ষে যারা দাঁড়িয়ে আছে তারাও তার আত্মীয়, স্বজন, বন্ধু-বান্ধব গুরুজন, এমনকি স্বয়ং গুরুদেব তার বিপক্ষে। আবার তার নিজের পক্ষে যারা আছে তারা তার ভাই-ভাইপো, এমনকি তার নিজের সন্তান। এই যুদ্ধে পরিনাম যাই হোক, যারাই মারা যাক তারা সবাই তার নিজের লোক, নিজের আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, গুরুজন, স্নেহাস্পদ। এদের মধ্যে যে কারুর মৃত্যুই তার কাছে পীড়াদায়ক। ভবিষ্যৎ শুন্যতা তাঁকে চঞ্চল করে তুললো। এমনকি তার নিজের মৃত্যুভয়ের আশঙ্কা করাও অমূলক নয়। এই অবস্থায় অর্জুন ধনুর্বান রেখে দিয়ে "আমি যুদ্ধ করবো না " বলে বসে পড়লো।
এখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেখলেন, এতো সব কেঁচে দেবে। আসলে পাণ্ডব পক্ষের সব থেকে বড়ো যোদ্ধা হচ্ছে, অর্জুন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বড়ো যোদ্ধা হলেও, প্রতিজ্ঞা করে বসে আছেন যে সে যুদ্ধে অস্ত্র ওঠাবেন না। এখন অর্জুন যদি যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে, তবে দুর্যোধনদের জয় অবশ্যম্ভাবী। যেটা শ্রীকৃষ্ণ চান না। কেননা, অন্যদের কথা ছাড়ুন, শ্রীকৃষ্ণ নিজেও তো , দুর্যোধন ও তার পারিষদ দ্বারা অপমানিত হয়েছেন । এই অবস্থায় অর্জুনকে উজ্জীবিত করা ছাড়া উপায় নেই। তাই নানান ভাবে তাকে বোঝাতে লাগলো। এবং কথায় কথায় বাস্তবের বেলাভূমি থেকে তাকে কাল্পনিক জগতের নীতি কথা শোনাতে লাগলেন । মাঝে মধ্যে তাকে ধমক দিতে লাগলেন । অর্থাৎ যেন তেন প্রকারেন তাকে যুদ্ধে রাজি করাতে চাইলেন ।এমনকি তাকে এও বলতে হলো যে এই "যুদ্ধ না করলে তুমি স্বর্গে যেতে পারবে না"। অর্থাৎ সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে অনেক কথা তাকে ওই পরিস্থিতে বলতে হয়েছিল।
আমাদেরকে এই সত্য মিথ্যার পার্থক্য বোঝার চেষ্টা করতে হবে। তবেই আমরা প্রকৃত সত্য লাভ করতে পারবো।
ভগবান বলছে : কর্মে তোমার অধিকার, ফলে কখনো নয়। অর্থাৎ যুদ্ধে কি ফল হবে তা তুমি জান না। যুদ্ধে তোমার জয় হতে পারে আবার পরাজয় হতে পারে। এখন পরাজয় হবে ভেবে যদি তুমি যদি সেঁদিয়ে থাকো, তাহলে তুমি জয়ের আনন্দও উপভোগ করতে পারবে না। অতয়েব যেহেতু যুদ্ধের পরিনাম তুমি জানো না, তাই তুমি এসব নিয়ে ভাবতে বোসো না। অর্থাৎ ফল কি হবে, সেটা ভেবে যদি সময় নষ্ট করো, তবে সময়ের কাজ সময়ে করতে পারবে না। ফলতঃ পরিনাম আরো খারাপ হবে।
এই যে ভগবান বলছেন ফলে তোমার অধিকার নেই, ব্যাপারটা তা নয়। ফল অবশ্যই তোমাকে ভোগ করতে হবে, কিন্তু সেই ভেবে যদি তুমি আগে থাকতেই নিশ্চুপ থাকো, তবে সময় মতো কর্ম না করার জন্য যে দুর্ভোগ, তা তোমাকে পোহাতে হবে। কর্ম করলে তার ফল ভালোও হতে পারে,মন্দও হতে পারে, তোমার প্রত্যাশা মতো হতে পারে, আবার প্রত্যাশা মতো নাও হতে পারে, কিন্তু তাই বলে পরিনাম ভাবতে গিয়ে যদি কর্মে বিরত থাকো, তাহলে নিস্কর্ম থাকার জন্য তোমাকে দুর্ভোগ পোহাতে হবে। একটা কথা খেয়াল করুন কাজ না করলে বা সময়মতো কাজ না করলেও একটা ফল হয়। এবং সেটা আমাদের বাধ্যতামূলক ভাবে ভোগ করতে হয়। আমি সময়মতো পড়াশুনা করলাম না - তাহলে বছরের শেষে আমাকে পরীক্ষায় ফেল করা জনিত দুর্ভোগ আমাকে ভোগ করতে হবে।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন :
নেহাভিক্রমনাশোঽস্তি প্রত্যবায়ো না বিদ্যতে
স্বল্পমপ্যস্য ধর্ম্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ।
ইহ অভিক্রম নাশঃ ন অস্তি প্রত্যবায়ঃ ন বিদ্যতে ; অস্য ধর্ম্মস্য স্বল্পম অপি মহতঃ ভয়াৎ ত্রায়তে।
এই শ্লোকের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেকে "ইহ" অর্থাৎ " ইহা" কথাটার মানে বলেছেন নিষ্কাম কর্ম। তারা বলছেন :
নিষ্কাম কর্ম কখনো ব্যর্থ হয় না। এই নিষ্কাম কর্মে পাপ নাই। বিঘ্ন নাই। নিষ্কাম কর্মের অনুষ্ঠানে সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায়। মৃত্যু-ভয় থেকেও মুক্ত হওয়া যায়।
আসলে ভগবান কিন্তু আসক্তিহীন কর্মের কথা বলেছেন, নিষ্কাম কর্মের কথা বলেন নি।
আসক্তিহীন কর্ম দ্বারা বুদ্ধি এক বিষয়ে স্থির হয়। মন যার এক বিষয়ে স্থির নয়,আসক্তির নিমিত্ত তার বুদ্ধি - মন নানা বিষয়ের দিকে ধাবিত হয়। জন্ম কর্ম নিমিত্য। জন্ম হলেই তার কর্ম আছে। আর কর্ম সর্বদা ফল-দায়ক। আর কর্মের ভোগও আপনার আপনার। ভোগযুক্ত মন কখনো ঈশ্বরে স্থির হয় না। সমস্ত কর্মফলের আশা পরিত্যাগ করে, আত্মতত্ত্ব জ্ঞানসম্পন্য হয়ে,সুখে-দুঃখে অবিচল থেকে, নিরাসক্ত হয়ে, কর্ম করো। কিসে কি হবে, এই চিন্তা পরিহার করে আত্মাবান হও। বেদের কর্মকাণ্ডও ত্রিগুণাত্বক। বেদের কর্মকান্ডের অনুসরণ, তোমাকে কর্মফল ভোগ করাবে। বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু কর্ম প্রয়োজন, তুমি তাই করো।এর বেশী প্রয়োজন নাই। কর্মে তোমার অধিকার কিনতু কর্মফলে নয়। অর্থাৎ কর্মফলের তুমি নিয়ন্ত্রক নয়। কর্মফল তা সে কর্ম, অকর্ম, নিস্কর্ম, দুস্কর্ম ইত্যাদি সবরকম কর্মের ফল তোমার নিয়ন্ত্রণে নেই। তাই কর্মফলের আশা ত্যাগ করো। কর্ম ত্যাগ করো না। কর্ম ত্যাগ করলে নিস্কর্মা থাকার জন্য তোমাকে দুর্ভোগ পোহাতে হবে। তাই সময় মতো কর্ম করো এবং তা বুদ্ধি সহযোগে করো। ফলের আশা ত্যাগ করে যোগস্থ হয়ে কর্ম করো। সুফল কুফল সমান জ্ঞান করে, কর্ম করো। সর্বাবস্থায় মনকে সাম্য- অবস্থায় রাখাই যোগ। মনকে স্থির রাখাই যোগ। চিত্তকে বিক্ষিপ্ত হতে না দেওয়াই যোগ। আসক্তিহীন কর্মই কাম্য ও উত্তম । সকাম কর্ম বা আসক্তিযুক্ত কর্ম নিকৃষ্ট ও পরিত্যাজ্য। ফলাফলে সমান জ্ঞান জন্মালে, তাকে জ্ঞানী--ব্যক্তি বলে অভিহিত করা হয়। এবং এই জন্মেই পাপ-পুন্য উভয়কেই ছাড়িয়ে যান । আসক্তিহীন কর্মের কৌশল-ই যোগ। কর্মযোগ। কর্মযোগের এই কৌশল যে আয়ত্ব করেছে, সেই জন্ম-মৃত্যু-সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে মোক্ষ লাভ করেন।
শ্রীকৃষ্ণ বলছেন : কর্ম করার অধিকার তোমার কিনতু ফলের অধিকার তোমার নয়।
আমি বলি কর্ম যদি আমার, ফলও আমার।
তবে হ্যাঁ এই কর্ম ফল ভোগ করার জন্য আমি অর্থাৎ আমার এই দেহ, থাকবে কিনা, সেটা আমার উপরে নয়। গাছে কবে ফল হবে, ততদিন আমি বাঁচবো কি না, তা আমি জানিনা। কিনতু অনুকূল পরিবেশ পেলে অবশ্যই ফল হবে। আর তা, আমার অবর্তমানে, এমন কি আমার বর্তমানেও আমি বা অন্য কেই ভোগ করবে। আমার কাছাকাছি, অর্থাৎ ফলের কাছাকাছি যারা থাকবে তারাই ভোগ করবে। এটা ভালো ফলের ক্ষেত্রেও হবে, খারাপ ফলের ক্ষেত্রেও হবে। মৌচাকে ঢিল মারলাম আমি, মৌমাছি কিনতু আমাদের সবাইকে কামড়াবে। পাপকর্ম আমার, পুন্যকর্ম আমার, অথচ ফলের ভাগিদার উপস্থিত সবাই। তেমনি ফলদানের সময় হলে ফল হবেই। তখন যারা, অর্থাৎ যে সব দেহধারী জীব থাকবেন তারই ভোগ করবেন। এমন নয় যে আমাকেই ভোগ করতে হবে।
তাই তো দেখি, আমরা শুধু আপন আপন কর্ম ফল ভোগ করি তা নয়। আমার চারিধারে যত কর্ম সাধিত হচ্ছে, সে সমস্ত কর্মের ফলই আমাকে প্রভাবিত করবে। সেটা আমি চাই আর না চাই। আমি যার যার সঙ্গে সম্পর্কে যুক্ত, তাদের সবার কর্ম ফল আমাকে ভোগ করতে হবে। আমার কর্মফল, আমার পরিবারের সদস্যের কর্মফল, আমারা যে গ্রামে বাস করি, যে দেশে বাস করি, আমি যে জাতিভুক্ত, আমি যে সম্প্রদায়ভুক্ত সবারই কর্মফল আমাকে ভুগতে হবে। আপনারা সবাই জানেন দেশ স্বাধীনতার সুফল যেমন আমরা ভোগ করছি, তেমনি দেশভাগ জনিত যে দুর্ভোগ আমাদের সবাইকে ভোগ করতে হয়েছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার হাজার লোক মারা গেছেন। দুর্ভোগে পড়েছেন। সহায়-সম্বলহীন হয়ে গেছেন। কিন্তু এতে আমার ব্যক্তিগত কোনো ভূমিকা হয়তো ছিল না, কিন্তু ভাল-মন্দের ভাগিদার আমাদেরকে হতে হয়েছে। ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছায় সমষ্টিগত কর্মফল আমাদের উপরে বার্তায়। সরকারের সিদ্ধান্ত, দেশে-দেশে যুদ্ধের দুর্ভোগ, সাধারণ জনগণকে পোহাতে হয়। অতয়েব কর্মফলে আমার অধিকার নেই তা নয়। মানুষের জীবন, জীব দেহ যেমন কর্ম করার জন্য জন্মেছে, তেমনি কর্মফলে একমাত্র তারই অধিকার। তাই কর্মফল ভোগও এই শরীরেই হবে। এর অন্যথা নয়। মৃত্যুর পরে, স্থূল শরীর ত্যাগের পরে, আমরা কেউই আর যেমন কর্ম করার করার শক্তি পাই না, তেমনি কর্মফলও ভোগ করতে পারি না। কর্মফল ভোগ করার জন্য, আমাদের রক্ত-মাংসের শরীরের প্রয়োজন।
তাই তো দেখি, আমরা শুধু আপন আপন কর্ম ফল ভোগ করি তা নয়। আমার চারিধারে যত কর্ম সাধিত হচ্ছে, সে সমস্ত কর্মের ফলই আমাকে প্রভাবিত করবে। সেটা আমি চাই আর না চাই। আমি যার যার সঙ্গে সম্পর্কে যুক্ত, তাদের সবার কর্ম ফল আমাকে ভোগ করতে হবে। আমার কর্মফল, আমার পরিবারের সদস্যের কর্মফল, আমারা যে গ্রামে বাস করি, যে দেশে বাস করি, আমি যে জাতিভুক্ত, আমি যে সম্প্রদায়ভুক্ত সবারই কর্মফল আমাকে ভুগতে হবে। আপনারা সবাই জানেন দেশ স্বাধীনতার সুফল যেমন আমরা ভোগ করছি, তেমনি দেশভাগ জনিত যে দুর্ভোগ আমাদের সবাইকে ভোগ করতে হয়েছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার হাজার লোক মারা গেছেন। দুর্ভোগে পড়েছেন। সহায়-সম্বলহীন হয়ে গেছেন। কিন্তু এতে আমার ব্যক্তিগত কোনো ভূমিকা হয়তো ছিল না, কিন্তু ভাল-মন্দের ভাগিদার আমাদেরকে হতে হয়েছে। ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছায় সমষ্টিগত কর্মফল আমাদের উপরে বার্তায়। সরকারের সিদ্ধান্ত, দেশে-দেশে যুদ্ধের দুর্ভোগ, সাধারণ জনগণকে পোহাতে হয়। অতয়েব কর্মফলে আমার অধিকার নেই তা নয়। মানুষের জীবন, জীব দেহ যেমন কর্ম করার জন্য জন্মেছে, তেমনি কর্মফলে একমাত্র তারই অধিকার। তাই কর্মফল ভোগও এই শরীরেই হবে। এর অন্যথা নয়। মৃত্যুর পরে, স্থূল শরীর ত্যাগের পরে, আমরা কেউই আর যেমন কর্ম করার করার শক্তি পাই না, তেমনি কর্মফলও ভোগ করতে পারি না। কর্মফল ভোগ করার জন্য, আমাদের রক্ত-মাংসের শরীরের প্রয়োজন।
কতকগুলো কর্মের ফল তাৎক্ষণিক হয়। কতকগুলো কর্মের ফল দেরিতে হয়। কতকগুলো কর্মের ফল ধীরে ধীরে অনেক দিন ধরে চলে। আবার কতকগুলো কর্মের ফল স্বল্প স্থায়ী হয়। এগুলো নির্ভর করে কর্মের প্রকারভেদের উপর। সাধনার ফল ধীরে ধীরে হয়। অগ্নি তাৎক্ষণিক ফল দেয়।
কামনা-বাসনা রোহিত কর্ম হয় কি না আমার জানা নেই। নিষ্কাম কর্ম তারাই করতে পারে যারা অন্যের জন্য কর্ম করে। তাও বলা চলে এটিও বাসনা রোহিত নয়। কর্মের ফল অন্যে ভোগ করুক, এই ভাবনা থেকেই সে সব কর্ম। এই জগৎ-তো কামনা-বাসনার ফল। এই সৃষ্টি তো বাসনার হাত ধরেই এগোচ্ছে। বাসনা রোহিত মানে জগৎ স্থবির হয়ে যাওয়া। জন্ম তো বাসনার ফল। ঈশ্বর স্ব-স্বরূপে স্থিত থেকে আপন খেলায় মাততে চেয়ে ছিলেন। তাই তো তার বিভিন্ন রূপ। এই চাওয়াই তো বাসনা। মানুষ যে এতো সাধনা করে - ঈশ্বরকে পাবার জন্য, এও তো এক প্রকার বাসনা। ঈশ্বরকে পাবার বাসনা থেকেই সাধনা শুরু হয় । আমার মনে হয় ভগবান বলতে চেয়েছেন : কর্মে তোমার পুরুষকার কাজে লাগবে, কর্মের খানিকটা হলেও তুমি নিয়ন্ত্রক। কিন্তু ফলের নিয়ন্ত্রক তুমি নও। তুমি গাছ লাগাতে পারো। কিন্তু তুমি ফুল ফোটাতে পারো না। গন্ধ দিতে পারো না। এইখানে তোমার সীমাবদ্ধতা। এটি প্রকৃতির উপরে নির্ভরশীল।
আসলে আমার মনে হয় আসক্তিহীন কর্মই কাম্য। আসক্তি নিয়ে কর্ম করলে সুখ-দুঃখের ভাগিদার হতে হয় সহজেই। তাই প্রত্যাশিত ফল পেলে আমার সুখী হই। প্রত্যাশিত ফল না পেলে দুঃখী হই। এই জায়গা থেকে শ্রীকৃষ্ণ বেরিয়ে আসতে বলছেন। তুমি যেমন দশটা-পাঁচটা অফিস করে বেরিয়ে যাও। মালিক তোমার গ্রাসাচ্ছাদনের দায়িত্ব নেন। ঠিক তেমনি আসক্তিহীন কর্ম করো। তবে তুমি সাম্যাবস্থায় থাকবে। না দুঃখের বিলাপ - না সুখের উচ্ছাস। এই সাম্যাবস্থাই শান্তির জায়গা।
রামকৃষ্ণদেব বলতেন : পরের বাড়ির কাজ করো। পরের ছেলেকে দেখাশুনা করো। ধাঁই দেখেছো ? কেমন পরের ছেলেকে, আদর করে, স্নান করায়, গা মুছে দেয়, খাওয়ায়, ঘুম পাড়ায়, কাঁদলে চাঁদ দেখায়, গল্প বলে। কিন্তু মনে মনে জানে, ও আমার কেউ না। কাজ ছাড়িয়ে দিলে, আবার অন্য বাড়িতে গিয়ে ঠিক একই রকম করে। কাজ শেষ হয়ে গেলে বাড়িতে দৌড় লাগায়, নিজের ছেলের কাছে ফিরে যায়। নিজের বাবার-মায়ের কাছে ফিরে যায়। যেটা ওর আসল বাড়ী। তোমরাও সংসারে পাঁকাল মাছের মতো থাকো। পাঁক জড়াতে দিও না। এখানকার কাজ তো একদিন শেষ হবেই। তখন বাড়ি যেতে হবে। সঙ্গে তোমার মনিবের ছেলে যাবে না।
No comments:
Post a Comment