Thursday 13 April 2023

বাবাসাহেবের শেষ ইচ্ছে

 বাবাসাহেবের শেষ ইচ্ছে

১৯৫৬  সালের ৩১-সে জুলাই, সন্ধ্যেবেলা। বাবাসাহেব, বারান্দায় বসে, আপ্তসহায়ক শ্রীরক্তু সাহেবকে, ডিকটেশন দিচ্ছেলেন। হঠাৎ বাবা সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়লেন।  রক্তুসাহেব তাকে বিছানায় শুইয়ে সেবাযত্ন করতে লাগলেন। এইসময় রক্তু সাহেবের মনের মধ্যে  ,একটা  আশঙ্কা জেগে উঠলো। তাহলে কি বাবাসাহেব শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন ? আজকাল বাবাসাহেবের মধ্যে যেন একটা বিষণ্ণতার  ছায়া পড়েছে। তাঁকে  আর আগের মতো উদ্দমী হতে দেখা যায় না। মাঝে মধ্যে একাএকা কাঁদেন, তাঁর  চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কেন ? রক্তুসাহেব আর নিজেকে চেপে না রাখতে পেরে, বাবাসাহেবকে প্রশ্ন করলেন, স্যার, আজকাল আপনাকে এতো বিষন্ন ও হতোদ্যম দেখায় কেন ?

এইসময় বাবাসাহেব, ছিলেন, বাকরুদ্ধ। তার শরীর  মন আজকাল বিপর্যস্থ। কোথাও যেন একটা না পাওয়ার বেদনা। আবেগরুদ্ধ কন্ঠে বাবাসাহেব হাতটা কপালে তুললেন। যেন সেই ঈশ্বরকে প্রণাম করলেন।  তারপর বললেন, আমার দুশ্চিন্তা হলো, আমি আমর সাধনা পূরণ করতে পারিনি। আমি দেখতে চেয়েছিলাম, আমার জীবদ্দশাতে আমার লোকজন এদেশের শাসক হয়ে বসেছে। তারা অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে ও একই মাপকাঠিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা ভাগ করে নিয়েছে। যতটুকু আমি করতে পেরেছি, তার সবটাই অল্প কয়েকজন শিক্ষিত দলিত ভোগ করছে। আর এরা  নিজেদের সঙ্গেই প্রতারণা করছে। নিজেদের পদদলিত নির্যাতিত নিরক্ষর ভাইবোনদের প্রতিও এদের কোনো সহানুভূতি নেই। এসব আমার কল্পনার বাইরে ছিল। এরা  কেবল ব্যক্তিগত লাভের  জন্য, বেঁচে আছে। একজনও  সমাজের জন্য কাজ করতে প্রস্তুত নয়। এরা  নিজেদের ধংসের পথ ধরেই এগিয়ে চলেছে। এখন আমার দৃষ্টি গ্রামের বিরাট  নিরক্ষর আমজনতার দিকেই ফেরাবো ভাবছি। আজও  আমার গ্রামের ভাইবোন চরম দুর্ভোগের মধ্যে বাস করছে। তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক কোনো পরিবর্তন আসেনি। অথচ আমার পরমায়ু কমে আসছে।

আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, যে দেশের মানুষ এতটা জাতিবিদ্বেষী, এবং পূর্বসংস্কার দ্বারা আবদ্ধ সে দেশে জন্মানোটাই একটা পাপ। দেশের মানুষ একমাত্র রাষ্ট্রশক্তির (প্রধানমন্ত্রীর) কথা  ছাড়া অন্য কিছু শুনতে বা মানতে চায় না। দেশটা যে কোথায় তলিয়ে যাচ্ছে, তা বলার নয়। সে যাই হোক, আমার চারিদিক থেকে আমার উপরে ভর্ৎসনা বর্ষিত হচ্ছে, তথাপি আমি আমার মৃত্যু পর্যন্ত আমার লোকেদের জন্যই  যথাসাধ্য করে যাবো। 

বলতে বলতে তার গালবেয়ে অশ্রুধারা নেমে এলো। বাবাসাহেব, এবার এদিক ওদিক তাকিয়ে সোজা হয়ে বসলেন। আবার আস্তে আস্তে বললেন "রক্তু ভেঙে পড়ো  না। এই শরীর  তো একদিন ভেঙে পড়বে, এই জীবন একদিন নিঃশেষিত হবে। তথাপি জেনো, জীবন  একটা লড়াই। লড়াই করেই বাঁচতে হয়। লড়াই থেকে কখনো যেন পিছিয়ে এসো না। জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাও। আজ যে ক্যারাভ্যান দেখতে পাচ্ছো, সেটাকে-তো বহুকষ্টে এখানে টেনে  নিয়ে এসেছি। বা বলা যায় , আনতে পেরেছি।  এই ক্যারাভ্যান আরো এগিয়ে চলুক।  রাস্তায় তো বাধা থাকবেই, রাস্তায় তো গভীর খাদ থাকবেই, জীবনে তো সমস্যা থাকবেই। আমি জানিনা, আমার লোকেরা এই ক্যারাভ্যান সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে  কি না। যদি নাও পারে, তথাপি যেন এই ক্যারাভ্যানকে এখানেই এই অবস্থাতেই রেখে দেয়।  একে যেন কেউ পিছনে হটিয়ে  না দেয়, এতটুকু যেন আমার লোকেরা আমার জন্য করে। আমার লোকজনের প্রতি এই আমার শেষ বার্তা। আবার বিশ্বাস, আমার লোকেরা আমার এই কথার মান্যতা দেবে। হে রক্তু, যাও  সবাইকে ডেকে আমার এই শেষ বাণী তাদের  কাছে পৌঁছে দাও। সবাইকে  ডেকে  আমার শেষ ইচ্ছেটা বলে দাও। 
এই কথা বলতে বলতে বাবাসাহেব, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। তার চোখ অশ্রুতে  ঝাপসা হয়ে গেলো।  বাবাসাহেব ধীরে ধীরে বিছানায় শরীরটাকে এলিয়ে দিলেন। 

এর মাত্র চারমাস, ৬ দিন পরে, ৬-ই ডিসেম্বর ১৯৫৬ বাবাসাহেবের পার্থিব দেহ নির্ব্বান লাভ করে। আমরা সবাই যেন তাঁর শেষ বাণীর কথা স্মরণ রেখে, যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব, সেই মতো আমাদের লোকের জন্য একটু সময় দেই, আমরা যেন আমাদের লোকের জন্য একটু শ্রম দান  করি, আমরা যেন আমাদের লোকের জন্য, একটু আর্থিক সাহায্য করি, আমরা যেন আমাদের লোকের জন্য একটু শিক্ষার প্রদীপ জ্বেলে  দেই, আমরা যেন আমাদের লোকের জন্য সামাজিক ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করি।   .এই আমরা প্রার্থনা।  

  


No comments:

Post a Comment