Monday 9 August 2021

নিত্যকথা - ভগবৎ ও ভাগবত / মৃত্যুকালে মানুষ অজ্ঞান


নিত্যকথা : 
ভগবৎ ও ভাগবত এর মধ্যে পার্থক্য কি ?  

ভগবৎ - ভগবান শ্রীকৃষ্ণের  মুখনিঃসৃত বাণী বা উপদেশ হচ্ছে শ্রীমৎ ভগবৎ গীতা, যা শ্রী অর্জুনকে ধর্ম্ম-যুদ্ধের সময় ভগবান স্বয়ং দান করেছিলেন। 

ভাগবত - ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সম্মন্ধীয় কথা বা কাহিনী হচ্ছে ভাগবত কথা। অর্থাৎ ভগবানের কথা। 

---------

১৮-০৬-২০২১

মৃত্যুকালে  মানুষ অজ্ঞান হয়ে যান কেন ? এটা কি মৃত্যুভয় জনিত ভয়ের কারনে ? নাকি এটা মৃত্যু-প্রক্রিয়ার একটি অঙ্গ মাত্র ? 

না মৃত্যুভয় না মৃত্যু প্রোক্রিয়াজাত কারন, এর কোনটি মানুষকে মৃত্যুর সময়  অজ্ঞান করে না। আসলে আমরা সারা জীবন ধরে এই অজ্ঞানতার শিক্ষাই গ্রহণ করে থাকি। মৃত্যুকালে আমরা সেই শংসাপত্রটি গ্রহণ করি মাত্র। অর্থাৎ সারা জীবনে তুমি অজ্ঞানশিক্ষা কতটা গ্রহণ করতে পেরেছো, তার পরীক্ষা হয় মৃত্যুকালে, এবং একটা সার্টিফিকেট পেয়ে থাকো এই সময় । এবং এবার তুমি "কোমা" ক্লাসের যোগ্য হলে। এর পর থেকে তুমি কোমা-ক্লাসে  উত্তীর্ন হলে।  

চেতন মানুষের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটে না। কারন  সারাজীবন তার শিক্ষা ছিল অন্য রকম। সে সারাজীবন ধরে চেতন থাকবার পাঠ  গ্রহণ করেছে। এই চেতন ব্যক্তিরও স্থূল দেহের নাশ হয়। এদের মৃত্যু হয় উপর উপর। এদের ভিতরে একটা আলোকশিখা জ্বলতে থাকে। মৃত্যুকালে অর্থাৎ স্থূল দেহত্যাগের এই আলোকশিখার রূপান্তর ঘটে মাত্র। তার দেহত্যাগ মানে হচ্ছে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন। এঁরা আর দেহে ফিরে আসেন না। এঁরা নিজেকে হারান না। এঁরা চেতন-অবস্থায়  সমগ্রের সঙ্গে একাত্মীভূত হয়ে যান মাত্র। 

মানুষ যে জন্মের পর জন্ম,  গ্রহণ করে থাকে, এর কারন হচ্ছে তার মধ্যে অজ্ঞানতার দূরীকরণ সম্ভব হয় নি। জীবন হচ্ছে একটা শিক্ষাকেন্দ্র।  শাশ্বত সত্যকে জানবার জন্য, আমাদের জীবন ধারণ করতে হয়। কিন্তু সেটা সম্ভব হতে পারে তখনই  যখন তুমি সচেতন থাকবে। আমরা যাকে জাগ্রত অবস্থা বলি , সেই সময়ও আমরা আসলে  চেতন থাকি না। আমরা চলাফেরা করি, আমরা কাজকর্ম্ম করি, আমরা চিন্তা করি, আমরা ভাবি যে আমরা জেগে আছি।  আসলে আমরা কখনোই আমাদের সম্পর্কে সচেতন হতে পারি না। আমরা ভাবি আমাদের চেতনা আছে, কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমরা সব কিছু করি  অভ্যাসের বসে, আমরা কখনও  নিজের দিকে দেখি না। এমনকি আমরা কখনো আমাদের কাজের দিকেও  দেখি না।  আমরা কখনো চিন্তার দিকে ফিরেও তাকাই না। আমরা একটা যান্ত্রিক ক্রিয়া করে থাকি মাত্র। আমরা এক-একটা যন্ত্র মাত্র। আমরা যেন এক-একটা যন্ত্র চালিত মূর্তি-রোবট । তুমি  সচেতন ভাবে দু-পা হেটে দেখো, তুমি  পার্থক্যটা বুঝতে পারবে। অচেতন অবস্থা আমাদের আমি-কে ভুলিয়ে রাখে। চেতন  অবস্থা নিজের অস্তিত্ত্বকে জানান দেয়। হাজার হাজার আলোকবর্ষ ধরে, আমরা এই অচেতন অবস্থায় পথ চলছি। এই অচেতন অবস্থায়, তুমি আসলে একটা বস্তু বৈ  কিছু নও। অচেতন ব্যক্তি আর চেতন মহাপুরুষের মধ্যে বাহ্যিক দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই। হুবহু একই রকম।  কিন্তু চেতন  ব্যক্তির মধ্যে আছে একটা আলোর শিখা, আর অচেতন মানুষের মধ্যে আছে একরাশ অন্ধকার। তোমারা  সবকিছুকে জানার চেষ্টা করো, শুধু  নিজেকে ছাড়া। আমরা কথার মধ্যে জড়িয়ে, নিজেকে  ঝামেলার মধ্যে ফেলে দেই।  কিন্তু একটু নীরব থেকে দেখো, তোমার জীবন থেকে  নব্বুই ভাগ ঝামেলা দূর হয়ে যাবে। কথায় বলে, ভগবান তোমাকে  একটা মুখ, আর দুটো চোখ আর দুটো কান, দিয়েছেন, অর্থাৎ দেখবে বেশি, শুনবে বেশি কিন্তু বলবে কম। আমরা সারা জীবন ধরে শুধু  ভুল বুঝে গেছি। কেউ কিছু বললে আমরা তার হাজার রকমের ব্যাখ্যা করতে পারি, কিন্তু সত্যটা  ধরতে পারি না। স্ত্রী কিছু বললে,  স্বামী ভুল  বোঝে।  স্বামী কিছু বললে স্ত্রী ভুল বোঝে। তোমাদের এই ভুল বোঝার মধ্যে  কোনো নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই। আর এই করতে করতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কথা বন্ধ হয়ে যায়। কারন তখন তারা বুঝতে পারে, কথা বললেই ঝগড়ার সৃষ্টি হবে। এর পর স্ত্রী করবে কান্নাকাটি, আর পুরুষ চেঁচাতে থাকবে। আর এই পরিণতির জন্য,  কোনো কথা কিন্তু দায়ী নয়, দায়ী হচ্ছে ভুল বোঝা বা কথার ভুল ব্যাখ্যা । 

আর ঠিক এই জিনিসটাই ঘটে থাকে আমাদের প্রত্যেকের  জীবনে। যার ফল হয়, দুঃখ কষ্ট  অথবা বিরক্তি ঘৃণা । আর তথাপি এই একই ভুল আমরা বারবার করতে থাকি। একজন অচেতন মানুষের এটাই পরিণতি। একজন চেতন মানুষ ভুল করতে পারে না তা নয়, কিন্তু সে ভুল করে একবার। আর তক্ষুনি সে ভুল থেকে  শিক্ষা গ্রহণ করে। চেতন পুরুষ তার ভুল করা, আর ভুলকে বোঝা ও শুধরে নিতে নিতে সে একদিন সমস্ত ভুলের উর্দ্ধে উঠে যায়। তখন জীবন হয়, শান্ত আনন্দপূর্ণ। 

এটা মৃত্যু ভয় নয়।  তুমিতো মৃত্যু কি তা জানো  না। মৃত্যু সম্পর্কে মৃত্যুর আগে কোনো ধারণা  তোমার জন্মাতে পারে না।  তাই মৃত্যুর সময় তুমি মৃত্যুকে ভয় পাও, এটা সত্য নয়। মৃত্যু আসন্ন হলে, প্রত্যেকের মনের দরজায়, মৃত্যু কড়া নাড়ে।  কেউ শুনতে পায়, কেউ শুনতে পায়  না। এই সময় কেউ বিষয় বন্টন করে, কেউ ঈশ্বর চিন্তন করে। ত্রৈলঙ্গ স্বামী দেহ ছাড়বেন, এইসময় তিনি  দরজা বন্ধ করে ধ্যানে রত হলেন। স্বামী বিবেকানন্দ দেহ ছেড়ে চলে যাবার বেদের বাণী শুনতে চাইলেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণ চলে যাবার আগে পঞ্জিকা পড়ে শোনাতে বললেন। ভগবান বুদ্ধ দেহ ছাড়বার  আগে, শিষ্যদের বললেন, আমি মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি, তোমাদের যদি কিছুপ্রশ্ন থাকে, তো আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারো।  এরপরে আমাকে আর দেহের মধ্যে পাবে না।  কেননা, আমি আর দেহে ফিরবো না, এটাই আমার শেষ মৃত্যু। জন্ম মৃত্যুর চক্র আমার জন্য  শেষ হতে চলেছে।  তো তোমরা আজ যেকোনো প্রশ্ন করতে পারো ।  সে প্রশ্ন যদি বোকা বোকা হয়, তাহলেও করতে পারো ।  দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে ভগবান বুদ্ধ তার শিষ্যদের সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিয়ে গেছেন। কিন্তু আশ্চর্য্যের ব্যাপার হচ্ছে, শিষ্যদের প্রশ্নের শেষ হয় নি। তথাপি বুদ্ধের মৃত্যুর প্রাগ মুহূর্তে  কেউ কোনো প্রশ্ন করতে পারে নি। 

তাই প্রিয়জনের মৃত্যুর সময় আমাদের কোনো প্রশ্ন জাগে না। এমন নয়, যে আমরা সবাই সমস্ত প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেছি। আসলে মৃত্যুর সময় আমরা কাউকে বিরক্ত করতে চাই না। মৃত্যুর সময় আমরা মৃত্যু সংবাদে বাক-রোহিত হয়ে যাই। আমাদের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। চোখে জল ঝরে। বুদ্ধ বলছেন, মৃত্যুর জন্য আমাদের চারটি পদক্ষেপ নিতে হবে। ১. আমি চোখ বন্ধ  করে মনকে শরীর  থেকে আলাদা করে নেবো।  ২) এর পরে মন থেকে আমি নিজেকে আলাদা করে নেবো। ৩) আমি সমস্ত অনুভূতির জগৎ থেকে অর্থাৎ হৃদয় থেকে  নিজেকে আলাদা করে নেবো। ৪) সবশেষে অবশেষবিন্দু অনন্তে মিলিয়ে যাবে। 

একজন চেতন পুরুষ  কখনও সংজ্ঞাহীন হতে পারেন  না। একজন চেতন মানুষ কখনো কোমাতে যেতে পারেন  না। তিনি  তাঁর মৃত্যুর বা স্থুল বা সূক্ষ্ম দেহত্যাগের সময়, সমস্ত প্রক্রিয়াকে সচেতন ভাবে দেখতে পারেন, এমনকি বর্ননা করতে পারেন । চেতন ব্যক্তি মৃত্যুর প্রতিটি পদক্ষেপকে সম্যক  রূপে উপলব্ধি করে থাকেন। এমনকি যদি তিনি চান, চতুর্থ পদক্ষেপ শুরুর আগে তিনি আবার দেহে ফিরে আসতে  পারেন। মহাত্মাগণ কেবলমাত্র দেহটাকে ছেড়ে চলে যান। যেন হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলেন। অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন। কর্ম্মজীবন থেকে বেরিয়ে গেলেন। দেহ, মন, হৃদয়, এবং সবশেষে ব্যক্তিসত্ত্বাকে বিসর্জন দিয়ে অনন্তে বিলীন হয়ে গেলেন। এই সমস্ত কিছুই তিনি সজ্ঞানে করে থাকেন।  

আমরা ভাবি, ভগবান তো আছেন, আজ না হয় কাল তার সাথে সাক্ষাৎ করা যাবে। এখন বন্ধুদের  সাথে একটু স্ফূর্তি করে নেই, কালকে ভগবানের সাথে সাক্ষাৎ করে নেবো। আমরা তো শিক্ষা নেবার জন্য জীবন ধারণ করি, কিন্তু জীবন পাবার পরে, আমরা জীবনটাকে ব্যবসার কাজে লাগিয়ে দেই। তখন মনে হয়, ব্যবসা করবার জন্যই  জীবন ধারণ করি।  আর তাই, আমরা একজন পাকা ব্যবসায়ীর মতো, খদ্দের  ছাড়তে চাই না। আমাদের সামনে সন্মন্ধের জট যত আসে, তত আমরা ভগবানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকি। আমরা ভাবি, বৃদ্ধ হলে ভগবানের কথা শোনা যাবে। 

মৃত্যুই জীবন সম্পর্কে শেষ কথা বলে থাকে। আপনার মৃত্যুই জানান দেয়, যে আপনি বেঁচে  ছিলেন। আপনার মৃত্যুই একমাত্র প্রমান যে আপনি জীবনে ছিলেন। মৃত্যুতেই জীবনের সবকিছু নির্ধারিত হয়। কিভাবে আপনি বেঁচে ছিলেন, অর্থাৎ আপনি যদি কোমাতে চলে যান, তবে বুঝতে হবে, আপনি অচেতন ভাবেই জীবন প্রবাহ করেছেন। তার মানে আপনি আদৌ বেঁচে থাকবার উদ্দেশ্যই বুঝতে পারেন নি।  আপনি শুধু আগামী সুখের আশায় বেঁচে ছিলেন। আপনি কখনোই বর্তমানে ছিলেন না, আপনি বর্তমানকে কোনো কাজেই লাগাতে পারেন নি। আপনি কেবল আগামীকালের জন্য বেঁচে ছিলেন। কিন্তু আগামী কাল সবসময় আগামীকালই রয়ে গেলো। আপনি যদি বর্তমানের জন্য প্রস্তুত হতে পারতেন, তবে মৃত্যু আপনার কাছে একটা উৎসব হতে পারতো। এটা সম্পূর্ণ আপনার উপরেই নির্ভর করে, আপনি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হবেন কি না। আপনি যখন প্রকৃত জ্ঞান থেকে দূরে থাকবেন, তখন আপনার পক্ষে বেঁচে থাকা সহজ হতে পারে। এটা বেঁচে থাকার জন্য ভালো। মৃত্যু আসলে একটা শস্ত্র চিকিৎসা।  আর এই শস্ত্র চিকিৎসার জন্য ভীতু মানুষকে অজ্ঞান করে নেওয়া। এই মৃত্যুর মাধ্যমেই মানুষ নিজেকে শরীর থেকে আলাদা করতে পারে। আপনাকে শরীর  থেকে আলাদা করতে হবে, আপনাকে মন থেকে আলাদা করতে হবে। আপনাকে হৃদয় থেকে আলাদা করতে হবে। এমনকি আপনাকে ক্ষুদ্র আমি থেকে আলাদা করতে হবে। এইজন্য মৃত্যুকালে সাধারণ মানুষকে অজ্ঞান করা খুব দরকার। 

আমার এক বন্ধু ছিল. আজ একবছর হলো তিনি শরীর ছেড়েছেন।  তো তার একসময় স্পাইনাল কর্ডে কি সব সমস্যা দেখা দিচ্ছিলো।  ডাক্তার বললেন, অপারেশন করতে হবে। তো ডাক্তার অপারেশান করবার আগে এনেস্থেসিস্ট ডাকলেন। বন্ধু বললো, আমাকে অজ্ঞান করবার দরকার নেই। ডাক্তার বললেন, এটি প্রথমত দীর্ঘ সময়ের অপারেশন। এমনকি এই অপারেশন খুবই যন্ত্রণাদায়ক।  এই অপেরেশনের সময় আপনি জ্ঞান হারিয়ে মারা যেতেও পারেন। তো বন্ধুটি বললেন, তবেতো ঘনটানাটা নিশ্চই খুব মজার হবে। আর দেখুন, অপেরেশনের এই অভিজ্ঞতা আমার জীবনে আগে কখনো আসেনি, ভবিষ্যতেও  আর আসবে কি না তা আমি জানিনা। তো এই দুর্লভ অভিজ্ঞতা থেকে আমি নিজেকে বঞ্চিত হতে করতে  চাই না। ডাক্তার বললেন,  দেখুন,  কাউকে অজ্ঞান না করে, আমি জীবনে এই ধরনের কোনো অপারেশন করিনি। এটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বন্ধুটি বললো, এই অপারেশন করবার সময় যদি আমি মারা যাই, তাতেও আমার কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু আমি মরবার সময় জ্ঞানত মারা যেতে চাই।  অজ্ঞান হয়ে এমনকি আমি বেঁচে থাকতেও চাই না। যাইহোক, অপারেশন করাটা খুবই জরুরি ছিল।  ডাক্তারবাবু অপারেশন করবার জন্য উদ্যোগী হলেন । কিন্তু এই প্রথম তিনি অনুভব করলেন, যে অপেরেশনের সময়  তার হাত কাঁপছে।  বন্ধু কিন্তু নির্বিকার। স্বাভাবিক চোখে সে ডাক্তারবাবুদের   ক্রিয়াকলাপ্  দেখতে লাগলো। মুখে না আছে কোনো যন্ত্রণার ছাপ , না আছে কোনো কাতর ধ্বনি। নির্বিকার চিত্তে সে ডাক্তারদের  সহযোগিতা করতে লাগলো। অপারেশন শেষ হয়ে যাবার পরে, ডাক্তারবাবুরা জিজ্ঞেস করলো, ব্যাপারটা কি বলুন তো ? আমি বহু রুগীর অপারেশন করেছি, কিন্তু আপনার মতো কাউকে আমার চোখে পরে নি। বন্ধু বললো, ব্যাপার কিছুই না.আমি বাঁচতে হলে সচেতন ভাবেই বাঁচতে চাই।  এমনকি আমার যদি মৃত্যু হয়, তখনও আমি সচেতন থাকতে চাই। আপনি যখন বললেন, এই অপারেশন খুবই কঠিন, এমনকি এতে করে আমার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে, তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমাকে সচেতন থাকতে হবে।  আমাকে জ্ঞান হারালে চলবে না। 

তো মনে রাখবেন, না মৃত্যুভীতি, না মৃত্যু প্রক্রিয়া, কোনো কিছুই আমাদেরকে অচেতন করতে পারে না, যদি না কিনা আমি বেঁচে থাকতে অচেতন থাকি। যে বেঁচে থাকে অজ্ঞান অবস্থায়, মৃত্যুকালে তাদেরকেই মনে হয় অজ্ঞান।  এটা নতুন কিছু নয়, সারাজীবনে সে যেমন ছিল, মৃত্যুর সময়ও সে তেমনই থাকে। তুমি যদি মৃত্যুর সময় জ্ঞান হারাতে না চাও, তুমি যদি মৃত্যুর সময় চেতন থাকতে চাও।  তুমি যদি মৃত্যুকে  প্রত্যক্ষ করতে চাও, তবে, এখনই, এই মুহূর্ত থেকেই নিজেকে সজাগ করো। আর জানবে, তুমি যদি নিজেকে সচেতন করতে পারো, তবে তুমি তোমার মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পারবে। কেননা মৃত্যু কখনোই দূরে থাকে না, মৃত্যু সবসময় জীবনের সঙ্গে সঙ্গে চলছে। মৃত্যু জীবন থেকে দূরে নয়, জীবনও মৃত্যু থেকে দূরে নয়।  দুটোই পাশাপাশি চলছে। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি না, কারন আমরা তো চেতন  নোই, আমরা সজাগ নোই । চৈতন্যবান পুরুষ কখনোই মৃত্যুকে দূরে দেখেন না, চৈতন্যবান পুরুষ কখনোই মৃত্যুকে শত্রু ভাবেন না, চৈতন্যবান পুরুষ মৃত্যুকে ভয়ও  করেন না।যেকোনো মানুষ তার মৃত্যুর ছয়মাস আগে থেকেই স্বাভাবিক ভাবেই, প্রাকৃতিক ভাবেই, একটা আভাস পায়। কেউ সেটা বুঝতে পারে, কেউ সেটি বুঝতে পারে না। এইখানেই চৈতন্যবান পুরুষ ও অচেতন পুরুষের মধ্যে পার্থক্য। 

ওম নমঃ শিবায়ঃ। ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম।

আমরা জাগতিক সমস্ত সম্পর্ক স্থাপন করে থাকি আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে। আর এই ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমাদের মন সমস্ত কিছু উপলব্ধি করে থাকে। এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের মধ্যে চারটি ইন্দ্রিয়ই আমাদের শরীরের প্রধান অঙ্গ মস্তিষ্কের সঙ্গে স্থাপন করা আছে।   আর এই ইন্দ্রিয়গুলোর প্রত্যেকটির নিজস্ব গ্রহণ- ক্ষমতা বা গ্রাহক-শক্তি নিহিত আছে। আর অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, কারুর যদি একটি অঙ্গের কার্যকারী শক্তি কমে যায় বা না থাকে, তবে সেই শক্তি অন্য কোনো না কোনো ইন্দ্রিয়ের মিলিত হয়ে যায়। তাই আমরা দেখি যিনি চোখে দেখতে পান না তার কান সজাগ থাকে, বা স্পর্শশক্তি বেশি থাকে। স্বামীজী বলছেন, তোমরা যদি জগৎকে সত্যিকারের উপলব্ধিতে আনতে  চাও, প্রকৃত জ্ঞান সংগ্রহ করতে চাও, তবে মনটাকে মাথা থেকে নামিয়ে হৃদয়কেন্দ্রে স্থাপন করো। মাথা থেকে মনটাকে নামিয়ে হৃদয়ে নিয়ে এসো। তাহলে সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।  জীবন হবে সুগন্ধিময়, সমস্যা উধাও হয়ে যাবে। মনে করো তোমার মাথা বলে কিছু নেই। আছে শুধু হৃদয়। যদি কিছু জানতে চাও, দেখতে চাও, বুঝতে চাও তবে হৃদয় দিয়ে দেখো, হৃদয় দিয়ে জানো। তবে তোমার চারিদিকে সুগন্ধিতে ভরপুর হয়ে যাবে।

---------

 কোনো বস্তু, চিত্র, আলোর শিখা, এমনকি নীল আকাশের দিকে মনকে একাগ্র করাকে বলা হয় ধারণা। এই ধারণা  উন্মিলিত নেত্রে অথবা অর্ধউন্মীলিত নেত্রে, বা চোখ বন্ধ রেখে করা যেতে পারে। উন্মিলিত নেত্রে এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ত্রাটক। চোখ বন্ধ রেখে কল্পনায় গুরুদেবের ছবি, সূর্যদেব, বা যেকোনো দেবদেবীর মূর্তি  দর্শনকেও ধারণা বলা যেতে পারে। বারবার মূর্তি বা ইষ্টবস্তু থেকে যখন মন দূরে চলে যায়, তখন মনকে  আবার ফিরিয়ে এনে ইষ্ট বস্তুতে নিবদ্ধ করতে হয়।  একে বলে প্রত্যাহার। চিন্তারহিত অবস্থাকে প্রাথমিকভাবে ধ্যানের প্রথম স্তর  বলা যেতে পারে।  চিন্তা হচ্ছে মনের ক্রিয়া। তো মন যখন নির্লিপ্ত হয়, অর্থাৎ মন যখন সমস্ত বস্তু থেকে নিজেকে প্রত্যাহার ক'রে  নিষ্ক্রিয় দ্রোষ্টামাত্র হয়ে যায়, তখন ধ্যানের শুরু। ধ্যানের  গভীরতায় মনের বিলুপ্তি ঘটে। তখন মন বলে কিছু থাকে না। ধ্যানের গভীরতা অনুসারে বিভিন্ন পৰ্য্যায় লক্ষিত হয়।  এসব গুরুবিদ্যা। শুনে বা বই পড়ে, এই উপলব্ধি লাভ সম্ভব নয়।গল্পটি পুরানো, বহুবার শুনেছেন, আবার একবার শুনুন।

25-06-2021

এক যুদ্ধবাজ রাজা ছিল। সমগ্র পৃথিবী জয় করবার ভূত তার মাথায় চেপেছিল। আর সমস্ত যুবক প্রজাকে সে সৈন্যবাহীতে যোগদিতে বাধ্য করেছিল। তো রাস্তার উপরে শুয়ে শুয়ে এক যুবক পায়ের উপরে পা তুলে, নাচাচ্ছিলো। রাজার পেয়াদাগণ তাকে রাজার আদেশ শুনিয়ে সৈন্য-বাহিনীতে যোগ দেবার কথা বললো। তো যুবক তাচ্ছিল্য করে, রাজাকে ব্যঙ্গ করতে লাগলো। রাজার কাছে খবর গেলো,
রাজা স্বয়ং দলবল নিয়ে, ছেলেটির কাছে গেলো, তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবার জন্য। কিন্তু দেখা গেলো, ছেলেটি মিটি মিটি হাসছে, আর পায়ের উপরে পা তুলে নাচাচ্ছে । স্বয়ং রাজা এসেছেন, সে দিকে তার ভ্রূক্ষেপও নেই। রাজার লোকজন তাকে তুলতে গিয়েও তুলতে পারলো না।

রাজা বললো - রে অবাধ্য যুবক, তুমি কি জানো না, রাজার আদেশ ?
যুবক বললো, কে রাজা ?
রাজা অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি রাজা।
ওহ তুমিই রাজা ? তো যুদ্ধ করে তুমি কি করবে ?
রাজা - কেন ? যুদ্ধ করে আমি আমার রাজত্ত্ব বাড়াবো।
যুবক - তারপর তুমি কি করবে ?
রাজা : আমি সমস্ত পৃথিবীর ভূস্বামী হবো।
যুবক - তো সমস্ত পৃথিবী জয় করা হয়ে গেলে, তুমি কি করবে ?
রাজা - কেন ? পায়ের উপরে পা তুলে আনন্দ করবো।
যুবক - মহাশয়, আমি তো সেটাই করছি ?

এই কথা বলে রাজার সামনে, তার পা দোলানোটা বাড়িয়ে দিলো। আর রাজা, ক্ষনিকের জন্য বোবা হয়ে গেলো, হতবুদ্ধি হয়ে গেলো, আর সবাইকে অবাক করে রাজামহাশয় যুবকের পায়ে পড়লো। আমাদের এই বিদ্যা শিখিয়ে দিন, আমিতো এটাই চাইছি।

আমাদের পাশের বাড়ীর এক ভদ্রমহিলা ভোম্বলের মা বছর ৬০/৬৫ বয়স হবে, আজ সন্ধেবেলা আত্মহত্যা করলো। এই আত্মহত্যার কারন কেউ জানে না।
পুনঃপ্রকাশিত : চিত্রগুপ্ত আপনার  সম্পর্কে কিছু লিখে রেখেছেন কি না, তা কি আপনি জানেন ? ভগবানের কোনো তৈলচিত্র আকাশে আঁকা আছে কি না তা কি আপনি দেখেছেন ?  ঈশ্বরের মনে আপনার  সম্পর্কে সত্যিই কিছু আছে কি না তা কি আপনি কখনো শুনেছেন ? আপনি  আগের জন্মে কি ছিলেন, তা কি জানেন ?  আমি ভবিষ্যতে কি হবেন , তাও কি আপনি জানেন ?  কিন্তু আপনি জানেন   আপনার  "এখন"-কে। আপনি চেনেন আপনার  "এখন"-কে। আপনি  এখন যা বলেন , তাই  আপনি । আপনি  এখন যা করেন, তাই আপনি । আপনি এখন  যা স্থির করেন , সেটাই আপনার  লক্ষ্য। আপনার  জীবন তেমনই হবে যেমন আপনি  রচনা করবেন । আপনার  কর্ম্মের বিচার ভবিষ্যতে  হবে কি না তা আপনি জানেন না।   তাই আপনি আপনার ভবিষ্যৎ   জীবনচিত্র এখনই এঁকে ফেলুন।জানবেন, আপনার  জীবনী আপনাকেই  লিখতে হবে। অন্যকেউ আপনার  জীবনী কি করে লিখবে ? আপনি  আপনার  অতীতকে মুছে ফেলুন। শুধু আপনি  সেই অতীতের কাছে কৃতজ্ঞ থাকুন  যে অতীত  আপনাকে আজ  এখানে পৌঁছে দিয়েছে। আপনি  ভবিষ্যতের কাছে কৃতজ্ঞ থাকুন, সামনের জীবনের জন্য। কিন্তু আপনি আপনার  নিজের কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে থাকুন, আপনার  বর্তমান জীবনের জন্য। আর এই বর্তমানে আপনি  আনন্দে থাকুন,  সুখে থাকুন । আর এই জন্য আপনার  যা ভালো লাগে আপনি  তাই করুন । আপনার  যাতে আনন্দ হয়, আপনি  তাই করুন । আপনি  যা মনেপ্রাণে  বিশ্বাস  করেন আপনি, তাই  করুন । আপনি  নিজেই নিজেকে সন্মান করুন । নিজেই নিজের পিট চাপড়ান । নিজেই নিজেকে বকাবকি করুন । আর  বিশ্বাস করতে থাকুন , আপনার  ঈশ্বর এতেই  সন্তুষ্ট হন।

২৭-০৬-২০২১
জিজ্ঞাসু : মন কেন সুখ চায় ? 
আচার্য্য : মনের স্বভাব এটি। 
জিজ্ঞাসু : মনের এই স্বভাব কেন ? 
আচার্য্য : মন একটা পরিবর্তনশীল বস্তু। তার এই পরিবর্তন যাত্রাকে সে নির্বিঘ্ন করে চায়। স্থুল দেহ থেকে মন সুক্ষ দেহে বিচরণ করে থাকে। তাই কখনো সে স্থুল সুখ চায়, আবার কখনো সে সূক্ষ্ম সুখ চায়। 

জীব জন্ম থেকেই অস্তিত্বের স্বীকৃতি চায়। কিন্তু যে নিয়ত পরিবর্তনশীল সে তার স্থায়ী অস্তিত্ব কোথায় পাবে ? তাই পরিবর্তনশীল মন, পরিবর্তনশীল শরীর একটি ব্যক্তিত্ত্ব বা ভাবমূর্তি গড়ে তোলে। অর্থাৎ আমার একটা ভাবমূর্তি আছে, যেটি আমার নিজস্ব। সামাজিক  শিক্ষা সংস্কৃতি, ইত্যাদি রপ্ত  করতে করতে একটা ইচ্ছে অনিচ্ছা, রুচি, অভ্যাস, দ্বারা একটা সংস্কারের সে জন্ম দেয়। আর এটাকেই সে মনে করে আমি। অর্থাৎ আমার একটা ভাবমূর্তি আছে, আমরা একটা ব্যক্তিত্ত্ব আছে। সেই আমির সে স্বীকৃতি চায়। এবং এই ব্যক্তিত্ত্ব  বা ভাবমূর্তির রক্ষার জন্য, সে সাধ্যমতো কার্য করে থাকে। এবং এই আমিকে সে সুখী করতে চায়। আমরা তাই বলি মন সুখী হতে চায়। 

 কিন্তু সাধক যখন ধ্যানের গভীরে প্রবেশ করে, তখন তার ব্যাক্তিত্ত্বের সঙ্গে আসল আমির সংঘাত শুরু হয়। আমাদের ভাবমূর্তি হচ্ছে কতকগুলো চিন্তা বা মানসিক বৃত্তির  খেলা। এই চিন্তা বা মানসিক বৃত্তি সদা পরিবর্তনশীল। স্মৃতি আমাদের ব্যাক্তিত্ত্বকে বাঁচিয়ে রাখে এবং কল্পনা এই ব্যাক্তিত্ত্বের পুষ্টি সাধন করে থাকে। কিন্তু এই বৃত্তিগুলোকে বাদ  দিলে যা পরে থাকে সেই অবশিষ্ট বা সম্পূর্ণ সত্ত্বাই আসল আমি। এই আমিকে  যদি আপনি ধ্যানে ধরতে পারেন, তবে আপনার ব্যবহারিক জীবনেও এর প্রভাব পড়বে। কিন্তু দুঃখের কথা হচ্ছে,  আমরা বা আমাদের মন আসল  আমিকে না ধরে আমাদের ভাবমূর্তিকে ধরে স্থায়িত্ত্ব খুঁজছি ।  ফলত মন অসুখী হয়ে পড়ছে। মন তখনই  চিরসুখী হতে পারে, যদি সে ভাবমূর্তিকে ছেড়ে আমিকে আঁকড়ে থাকে। কারন এই আমি সদা-আনন্দময় সত্ত্বার অংশ। যাকে মুনি-ঋষিগণ বলছেন, সৎ-চিৎ-আনন্দম। 
-----------------  

 যখন সহস্রারের  পদ্মদল খুলে যাবে। (১) 

যখন এই অবস্থা সাধকের হবে, তখন এটি সে জ্ঞাত হতে পারবে, কিন্তু উপল্বদ্ধিতে আনতে  পারবে না। বুদ্ধি দিয়ে তা ব্যাখ্যা করতে পারবে না।   বুঝতে পারবে, কিছু একটা ঘটছে, কিন্তু কি হচ্ছে সেটা অনুভবে আসবে না।

 আমাদের শরীরের কোনো একটা অঙ্গে বা অংশে যখন সুস্থতার অভাব হয়, তখন মন আমাদের অজ্ঞাতসারে সেই দিকে ধাবিত হয়।  যখন কান আমার স্বাভাবিক  ছিল, চোখ যখন  সুস্থ  ছিল, তখন কান বা চোখের দিকে আমার খেয়াল হয় না। কান বা চোখ আছে, এই অবধি।  এর বেশি কিছু নয়।  কিন্তু যখন কানে টনটন ব্যথা শুরু হলো , বা চোখের মধ্যে যখন খচখচ করতে লাগলো, তখন মন আমার চোখের দিকে বার বার মনোযোগ দিতে লাগলো। তো যখন আমাদের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুস্থ  স্বাভাবিক থাকে, তখন আমরা সেদিকে খেয়াল করি না, আছে এই পর্যন্ত । আমরা যখন স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া করি, তখন আমরা সেদিকে খেয়াল করি না। কিন্তু আমরা যখন, অতিরিক্ত পরিশ্রম করি, বা রেগে যাই, তখন আমাদের শ্বাসের গতি বৃদ্ধি পায় ।  তখন আমরা বেগবান শ্বাস-প্রশ্বাসকে ধরতে পারি।  আমরা যখন  ভয় পাই, তখন আমাদের শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যায়। তখন আমাদের শ্বাসের দিকে মন চলে যায়।

আমাদের সহস্রারের  পদ্মদল যখন এক এক করে খুলে যায়, তখন কোনো অনুভূতি হয় না, কিন্তু মনের মধ্যে একটা শূন্যতা, একটা নীরবতা বিরাজ করতে থাকে। কিন্তু শরীরে এই ক্রিয়া শুরুর প্রথম দিকে, একটা অস্বস্তির  অনুভূতি প্রবল হয়। যখন প্রথম প্রথম এই ঘটনা আপনার শরীরে ঘটতে থাকবে, তখন একটা অস্বস্তির মাত্রা  তীব্র থাকে । আর   মনটা বারবার এই অস্বস্তির দিকে চলে যাবে। ধীরে ধীরে অবশ্য এই অস্বস্তি কমতে থাকবে। এই বিরল ঘটনা ক্রোম যত  বাড়তে থাকে, তত    ধীরে ধীরে সমস্ত অস্বস্তির অবসান ঘটিয়ে দেয় । একটা সময় আসে, যখন আপনার অনুভূতিশক্তির সম্পূর্ণ  বিলোপ ঘটবে। আসলে যেকোনো অনুভূতি, যা আপনি প্রথমবার অনুভব করছেন, তখন অনুভূতির মাত্রা থাকে তীব্র।  ধীরে ধীরে এই অনুভূতির মাত্রা স্তিমিত হতে থাকে।  একটা সময় আসে, যখন সমস্ত অনুভূতি শূন্য হয়ে যায় । সহস্রার পদ্মদল প্রস্ফুটিত হলে, সমস্ত কিছুই শান্ত ও নীরবতায় অবস্থান করে থাকে।   

 সহস্রার খুলে যাওয়া, আমাদের শরীরের একটা বিরল ঘটনা।  প্রথমদিকে এটিকে শরীরের অসুস্থতা বলেই মনে হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে এই অস্বস্তি কেটে গিয়ে আপনাকে একটা গভীর শান্তি-নীরবতার মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেয়।  আর আপনি একটি অপার্থিব শান্তির জগতে বাস করতে থাকেন। আগে যা কিছু দেখে, আপনার মধ্যে বিস্ময় জেগেছিলো, ধীরে ধীরে সেই বিস্ময়ের মাত্রা কমতে থাকে। কিন্তু তার মানে এই নয়, যে ঘটনা ঘটছে না, ঘটনা ঘটছে, কিন্তু আপনার মধ্যে আর সেই বিস্ময়ের অনুভূতি এনে দিতে পারছে না।  -মূলসূত্র ; Meditation - The Art of Ecstasy -OSSO PAGE - ১১০ 

 যখন সহস্রারের পদ্মদল খুলতে শুরু হবে তখন সমস্ত জগৎ উবে যাবে। সমস্ত দৃশ্য উধাও হয়ে যাবে। দৃষ্টিশক্তির বিস্তর পরিবর্তন সাধন হবে।  কেননা জগৎ দৃশ্যমান হয়, বিশেষ তরঙ্গ মাত্রায় । যে তরঙ্গমাত্রা আমাদের চক্ষুর আয়ত্ত্বের মধ্যে। আমাদের চক্ষু বা যেকোনো ইন্দ্রিয় একটা বিশেষ আলোর ওয়েবকে ধরতে পারে মাত্র । এই তরঙ্গের মাত্রার হেরফের হলে, অর্থাৎ বেশি বা কম হলে, আমাদের ইন্দ্রিয়শক্তির বাইরে চলে যায় দৃশ্য। এটি যেমন দৃশ্যের ক্ষেত্রে ঘটে তেমনি ঘটে শব্দতরঙ্গের ক্ষেত্রেও। 

সহস্রার পদ্মদল যখন খুলবার যখন খুলবার প্রক্রিয়া শুরু করে, সেই সময় বিভিন্ন দৃশ্য চোখের সামনে ভাসতে থাকে। এই দর্শন অবাস্তব নয়, দর্শন সত্য কিন্তু সহস্রার খুলবার সঙ্গে সঙ্গে সেই দৃশ্যপট চোখের সামনে থেকে সরে  যায়। মনের সর্বোচ্চ অভিজ্ঞতা হচ্ছে সহস্রার পদ্মের পাপড়ির ফুটে ওঠা। এর পরে  মন উধাও হয়ে যায়। r



---------------------

স্বজ্ঞা, অনুভূতি, স্বতঃস্ফূর্ত জ্ঞান একে কোনো যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায় না। এই জ্ঞান কোথেকে আসে, কিভাবে আসে, তা বলা শুধু মুশকিল নয়,  অসম্ভব। ঠাকুর রামকৃষ্ণ লেখাপড়া জানতেন না।  কিন্তু তার " "কথামৃত" সারা পৃথিবীর কাছে গবেষনার বিষয়। শোনা যায়, মোহাম্মদ লেখাপড়া জানতেন না। মোহাম্মদ কোনো বিখ্যাত ব্যক্তিও ছিলেন না। কিন্তু তার দেওয়া কোরআন আজ বিশ্বের বিস্ময়। একদিন এক দেবদূত এসে মোহাম্মদকে  বললেন, "পড়ো"। মোহাম্মদ বললেন, আমি কি করে পড়বো ? আমি তো লেখাপড়া জানি না। দেবদূত বললেন, "পড়ো"।  মোহাম্মদ আবার বললেন, আমি পড়তে  জানি না। দেবদূত আবার বললেন, "পড়ো" - ঈশ্বরের আশীর্বাদে তুমি পারবে। মোহাম্মদ পড়তে শুরু করলেন। কোরআন-এর প্রথম আয়াত নাকি এই দেবদূত তাকে দিয়েছিলেন,  মোহাম্মদ এর অর্থ  জানতেন না।একেই বলে স্বজ্ঞা।  (মেডিটেশন ওশো - পৃষ্ঠা -১৮০)  

দেখুন প্রয়োজন ছাড়া মানুষ কিছুই করতে চায় না। আমার কার্যসিদ্ধি হবে, এমনটা না হলে আমরা মহাত্মাদের কথাতেও কান দেই  না। অর্জুন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে জ্ঞান যোগের শ্রেষ্ঠত্বের কথা শুনে, বলেছিলেন, জ্ঞানযোগ যদি শ্রেষ্ঠ তবে আমাকে কর্ম্মে অর্থাৎ অহিতকর সর্বনাশা  যুদ্ধে প্রবৃত্ত করছেন কেন ? ভগবান বুঝেছিলেন, অর্জুন কর্ম্ম না করেই জ্ঞানের পথ অবলম্বন করতে চাইছে। আসলে কর্ম্ম আগে, তার পরে জ্ঞান। আর শুধু শুকনো জ্ঞানে আমাদের কোনো উপকার হতে পারে না যদিনা না সেই অর্জিত জ্ঞান আমি নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে পারি। আসলে আমাদের যোগী হতে হবে, তাই গীতার সমস্ত অধ্যায় হচ্ছে  যোগ।  যদি যোগী হতে চান, তবে কি করবেন, কেন করবেন ?

প্রয়োজন : 
প্রথমেই বলি, আপনি কেন যোগী হবেন ? দেখুন ইহকাল ও পরকাল দুটোতেই যদি ভালো থাকতে চান, তবে তবে যোগী হওয়া আবশ্যিক। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যোগী যদি যোগভ্রষ্টও হয়ে দেহ ত্যাগ করেন, তবে তিনি পরবর্তী জীবনেও যোগের সুফল পেতে পারেন। আমাকে একজন প্রশ্ন করেছিলেন, রাজা জনক তো অষ্টাবক্রের কাছ থেকে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন, কোনো যোগের সাধন ছাড়াই।  আসলে এঁরা  সবাই পূর্ব পূর্ব জীবনে যোগী ছিলেন। তো যোগী হতে গেলে, আপনি কোথেকে শুরু করবেন।    

আসন : প্রথমে স্থির আসনে বসার অভ্যাস করুন। যে আসনে আপনি, স্বছন্দ হবেন , সেই আসন-ই আপনার পক্ষে শ্রেষ্ট। সর্বোৎকৃষ্ট আসন হচ্ছে, সিদ্ধাসন।   যোনিস্থানে অর্থাৎ গুহ্যদ্বার ও উপস্থের মাঝখানে বাম  পায়ের গোড়ালি স্থাপন করে, ডান  পা  বাম  পায়ের উপরে রাখুন । চিবুকস্থানকে  হৃদয়-এর উপরে স্থাপন করুন।  এর পরে, সমস্ত ইন্দ্রিয়কে বিষয় থেকে নিরুদ্ধ করে, স্থির দৃষ্টিতে ভ্রুদ্বয় দেখতে থাকুন। শিব সংহিতায় বলা হয়েছে, মোক্ষলাভের সমস্ত প্রতিবন্ধক বিনাশ হয়ে থাকে এই সিদ্ধাসনে। আপনি যদি শুধু এই সিদ্ধাসনে বসে থাকবার অভ্যাস  করতে পারেন, তবে আপনার মন শান্ত হবে। আপনার সমস্ত সমস্যায় সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। শুধু এই সিদ্ধাসনে বসেই আপনার নাড়ীর মল-শোধন হয়ে যাবে। শরীরের বায়ু চঞ্চল থাকলে, আমাদের চিত্তও চঞ্চল হয়।  আর বায়ু নিশ্চল থাকলে চিত্ত স্থির হয়। আর স্থির চিত্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা বেশি থাকে।  

প্রাণায়াম : চন্দ্র বা ইড়া (বাম) নাড়ী দিয়ে ধীরে ধীরে বুক-পেট ভরে বায়ু গ্রহণ করুন।  এবার যথাসম্ভব কুম্ভক করুন। সূর্য বা পিঙ্গলা (ডান) নাড়ী দ্বারা বায়ু ছাড়ুন। এবার উল্টোটা করুন, অর্থাৎ ডান নাক দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস নিন, বাম  নাক দিয়ে ধীরে ধীরে  শ্বাস ছাড়ুন। ১০ মিনিট করুন। যদি সম্ভব হয়, কুম্ভক ততক্ষন করুন, যতক্ষন না আপনার ঘাম নিঃসরণ হচ্ছে। তবে প্রথম দিকে সাধ্যের বাইরে না যাওয়াই ভালো।  

বিশ্রাম : এর পর  ৫ মিনিট বিশ্রাম করুন। যদি সম্ভব হয়, শবাসনে বিশ্রাম নিন। 

ব্যাস, প্রতিদিন খালিপেটে সকাল-সন্ধ্যা এই আবশ্যিক কাজটি করতে থাকুন। ধীরে ধীরে আপনি এর সুফল  অবশ্যই উপলব্ধি করতে পারবেন। 

আপনাকে যদি বিচুটিতে কামড়ায়, তবে চিকিৎসা করে, একদিনের মধ্যেই ভালো হয়ে যেতে পারেন।  আপনাকে যদি সাপে  কামরায়, তাহলে আপনি চিকিৎসার সাহায্যে তিন দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যেতে পারেন, আপনাকে যদি পাগলা কুকুরে কামড়ায় , তবে এখন কিছু না হলেও, পরবর্তীতে আপনার জলাতঙ্ক রোগ হতে পারে। আর যদি আপনাকে সাধারণ মানুষ-পাগোলে ধরে, তাহলে আপনি তার সঙ্গ না ছাড়া পর্যন্ত ভালো হতে পারবেন না।  আর যদি   জীবনে ভালো নাও হতে পারেন। 

--------
সিদ্ধার্থ কেন সন্যাস নিলেন  ? 

সংসারত্যাগ যত  সহজে করা যায়, দুঃখের নিবৃত্তি কিন্তু অত  সহজে সম্ভব নয়।      

এখন কথা হচ্ছে দুঃখের হাত  থেকে বাঁচার রাস্তা কি সন্যাস ? বহূ মুনি-ঋষি তো সংসারী ছিলেন।  তারাও তো জীবনের অর্থ খুঁজবার জন্য, সাধনপথ বেছে জপ-তপে নিয়োজিত ছিলেন।  তো সিদ্ধার্থ কেন সন্ন্যাস নিলেন ?    
দেখুন কেউ কাউকে পথ দেখাতে পারে না। পথ খুঁজে নিতে হয়। সিদ্ধার্থ কেন সংসার ত্যাগ করেছিলেন ? আমরা সবাই জানি, নগর ভ্রমনে  বেরিয়ে, বৃদ্ধ ব্যক্তি, ব্যাধিগ্রস্থ ব্যক্তি ও মৃত ব্যক্তি দেখে তার মধ্যে  প্রশ্নের উদয় হয়েছিল। মানুষের অবশ্য-অন্তিম-পরিণতি প্রতক্ষ্য করে, সেই সম্পর্কে অর্থাৎ জরা-ব্যাধি-মৃত্যু থেকে  রেহাই পাবার জন্য, উত্তর খুঁজছিলেন। এই পরিনাম থেকে নিষ্কৃতি পথ খুঁজবার জন্য, তিনি রাজসুখ ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়েছিলেন।
এই বেরিয়ে পড়বার পিছনে, আরো একটা দৃশ্য আছে, যা তিনি প্রতক্ষ্য করেছিলেন। আর তা হচ্ছে, এক চাষী চাষ করছিলো, তো লাঙ্গলের আঘাতে, ভূমি থেকে কুশ, শিকড় শুদ্ধ আগাছা, উৎপাটিত হয়ে অসহায় হয়ে যাচ্ছিলো।  মাটিতে গ্রথিত কীট  পোকা-মাকড়,  আর অতিক্ষুদ্র জীবসকল  তীক্ষ্ণ হালের আঘাতে  খন্ড খন্ড হয়ে নিহত হয়ে যাচ্ছিলো।  এই দৃশ্য যুবরাজের মনে আত্মীয় বিয়োগের শোক অনুভব করিয়ে দিচ্ছিলো । ভাবছিলেন, যারা জমিতে এই চাষবাস করছে, তারা নিজেরাও রৌদ্রের প্রখর তাপে  ক্লান্ত, অবসন্ন । শরীরের ঘামের সঙ্গে ধুলোবালি মিশে মলিন চেহারা হয়েছে। ক্লান্ত অবসন্ন শরীর। যে শরীরকে   বাঁচানোর জন্য এতো চেষ্টা, তাকেই সে এতো কষ্ট  দিচ্ছে ? 
এইসব দেখে যুবরাজের মন এই অসহায় মানুষের প্রতি করুনার উদ্রেগ হলো। এবার সে ব্যথিত চিত্তে শোকে মুহ্যমান হয়ে, নত  মস্তকে চিন্তা করতে লাগলো - এই জগতে জন্ম হলে, সবাইকেই মরতে হবে, সবাইকেই রোগগ্রস্থ হতে হবে, সবাইকেই বৃদ্ধ হতে  হবে। এই জগতে কেউ সুখী নয়, এই জগত সুখকর স্থান নয়। এই সব চিন্তা করতে করতে জম্বু গাছের পাদদেশে, ঘাসপাতায় আচ্ছাদিত ভূমিতে স্থির চিত্তে জীবের উৎপত্তি ও বিনাশের কারন নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করতে লাগলেন। নিজের মনের মধ্যে বিতর্ক জুড়ে দিলেন, স্থির চিত্তে বিচার করতে লাগলেন। ভাবলেন, নির্বোধ এই মনুষ্যসকল স্বয়ং জরা, ব্যাধি মৃত্যু যুক্ত হয়েও, সম-ধর্ম্ম বিশিষ্ট অপরকে ঘৃণা করে। জীবের এই স্বভাব যুবরাজ সম্যকরূপে বুঝতে সমর্থ হলেন।  আর তার মধ্যে থেকে সমস্ত গর্ব-মোহ-বাসনা দূর হতে লাগলো। এখন না তিনি আনন্দিত, না তিনি অনুত্তপ্ত, না থাকলো তার মধ্যে বিদ্বেষ, না থাকলো তার মধ্যে অবজ্ঞার  ভাব। তিনি সংশয়রহিত হতে চাইলেন। 
এইসময় তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো, এক সন্ন্যাসী মূর্তি। এই সন্ন্যাসী যেন বলে উঠলেন, হে নরশ্রেষ্ট, মৃত্যুভয়ে ভীত এক সন্ন্যাসী আমি। এই দুঃসহ জগৎ থেকে পরিত্রানের আশায় আমি বাসনা পরিবৃত সংসার ত্যাগ করে, মুক্তির সন্ধানে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছি।  নশ্বর অনিত্য এই জগৎ সংসার থেকে মুক্তির আশায়, আমি মঙ্গলদায়ী পথের সন্ধানে বেড়িয়েছি। আমার না আছে কোনো সংশ্রব, না আছে কোনো আসক্তি।  আমি বনে-জঙ্গলে, পথে-প্রান্তরে, পর্বত-কন্দরে বা অন্যকোনো নির্জন স্থানে অবস্থান করে থাকি। আমি কামনা-বাসনা হীন, পরিবার-পরিজন হীন, পরিব্রাজক সন্যাসী। আকাশবৃত্তি আমার ভোজন সংগ্রহের উপায়। এই কথা বলে, সন্ন্যাসী যুবরাজের মানসচক্ষু থেকে  অদৃশ্য হয়ে গেলেন।  এই সন্ন্যাসীই পরবর্তীকালে,  যুবরাজ সিদ্ধার্থকে  সন্ন্যাস নিতে উদ্দীপ্ত করেছিল। 

এখন কথা হচ্ছে সংসারত্যাগ যত  সহজে করা যায়, দুঃখের নিবৃত্তি কিন্তু অত  সহজে সম্ভব নয়। আর এই চরম সত্য উপলব্ধি করতে সিদ্ধার্থের বেশি দিন লাগে নি। প্রথমে তো রাজবেশ অলঙ্কারাদি পরিত্যাগ করলেন, এক ব্যাধের কাছ থেকে কাষায় বস্ত্র চেয়ে নিলেন। প্রথমে তিনি ভার্গব মুনির কাছে গেলেন। সেখানে ধ্যানের  বিভিন্ন প্রক্রিয়া শিখলেন। কিন্তু  সেখানে তার প্রশ্নের উত্তর পেলেন না। ঋষি ভার্গবের নির্দেশে গেলেন ঋষি অরাঢ়-এর কাছে । সেখানে তিনি সাংখ্যদর্শন সমন্ধে জ্ঞাত হলেন। ধ্যান সাধনায় অরাঢ় মুনির সমকক্ষ হলেন।  কিন্তু প্রশ্নের উত্তর পেলেন না। সঠিক পথের সন্ধান পেলেন না। এর পর তিনি গেলেন ঋষি উদ্দক-এর  কাছে। ঋষি উদ্দকের কাছেও - তিনি যা খুঁজছিলেন, তা তিনি পেলেন না। ঋষি উদ্দক দুঃখ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে স্বর্গলাভের কথা বললেন। যুবরাজ হতাশ হলেন। 

এর পরে কোনো গুরুর সন্ধান না করে, একলা চলা শুরু করলেন।  অর্থাৎ নিজের  অন্তরেই নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে লাগলেন। চলতে চলতে একসময় নৈরঞ্জনা নদীর তীরে ৫জন পরিব্রাজক সন্ন্যাসীর সাক্ষাৎ পেলেন। এবং তাদের কথামতো কঠিন  কৃচ্ছ্র-সাধনায় লিপ্ত হলেন। এই সাধনার ফলে তার শরীর ভেঙে পড়লো। একটা সময় মনে হলো কঠিন কৃচ্ছ্র-সাধনা সত্যের সন্ধান দিতে পারবে না। আর শরীরের মৃত্যু হলে, সত্যের সন্ধান তিনি করবেন কি করে ? দেহের কষ্টে মানসিক সমতা বা স্থিরতা থাকে না। শরীর দুর্বল হলে মন দুর্বল হয়ে পড়ে। আর মন দুর্বল হলে, মনে উচ্চ-স্তরের চিন্তা আসতে  পারে না। অতয়েব শরীরকে সুস্থ  রাখতে হবে, মনকে সুস্থ রাখতে হবে। তাহলে মনে সুস্থ চিন্তা আসতে  পারবে। এই চিন্তার উদয় হতেই, সেই অলৌকিক ঘটনা ঘটলো, আর তা হচ্ছে, সুজাতা নামে এক গোয়ালিনী কন্যার  পায়েসের থালা হাতে সিদ্ধার্থের  নিকটে আগমন। আর সুজাতার দেওয়া পায়েস ভক্ষণে, সিদ্ধার্থর শরীররক্ষা । 

এর পর, সিদ্ধার্থ শরীরে বল পেয়ে, নৈরঞ্জনা নদী পার হলেন। নদীতে স্নান করলেন। হাটতে হাটতে বনের  মধ্যে একটা অশ্বত্থ গাছের সামনে এসে দাঁড়ালেন। অন্ধকারেও গাছের পাতাগুলোতে আলোর ঝলকানি দিছিলো। সিদ্ধার্থ গৌতম বারবার গাছটাকে দেখছিলেন । মনে হলো, গাছটা যেন তার প্রতীক্ষা করছিলো। গাছের নিচে ঘাসের আসনে পুবদিকে মুখ করে, পদ্মাসনে বসলেন। বনের পাখির কলতান থেমে  গেলো, গাছের পাতার মর্মর ধ্বনি স্তব্ধ হয়ে গেলো। চারিদিকে অন্ধকারের নিস্তব্ধতা নেমে এলো। সিদ্ধার্থ গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হলেন। 

বহু বহু জন্মের সাধনার ফল ফলতে  লাগলো। সিদ্ধার্থের মনের ঝড় থেমে  গেলো। সমস্ত প্রশ্ন নিঃশেষ হয়ে গেলো। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় সারা বন আলোকিত হয়ে উঠলো। একসময় সিদ্ধার্থের জন্মের কথা স্মরণ হলো। তার মধ্যে দিব্যদৃষ্টির শক্তি প্রকাশিত হলো।  সিদ্ধার্থ জন্ম-মৃত্যুর রহস্যঃ জ্ঞাত  হলেন। জগতের সুখ-দুঃখের কারন জ্ঞাত হলেন। জগতের পরম সত্য জ্ঞাত হলেন। সিদ্ধার্থ বুদ্ধত্ব লাভ করলেন। গৌতম সিদ্ধার্থ হলেন বোধিসত্ত্ব বুদ্ধ। 
তো যা বলছিলাম, নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজের মধ্যেই খুঁজে নিতে হয়। জানবেন, প্রশ্ন যদি আপনার মনে উদয় হয়, সঙ্গে সঙ্গে সেই একই মনের মধ্যে উত্তরের বীজ জন্ম নেয়।  আপনাকে প্রতীক্ষা করতে হবে।  আপনাকে খুঁজতে হবে। তবেই সমস্ত সমস্যার সমাধান নিজের মধ্যেই খুঁজে পাবেন। বহির্মুখী নয়, মনকে অন্তর্মুখী করতে হবে । 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।
       
ওম এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। 

ওম উচ্চারণের সমস্ত প্রক্রিয়াই বিজ্ঞান ভিত্তিক। ওম ধ্বনি নাভিস্থল থেকে উচ্চারিত হয়ে, ধীরে ধীরে ব্রহ্মতালুতে প্রবেশ ক'রে সমস্ত শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে বিচ্ছুরিত হয়। আমরা শারীরিক ব্যায়ামের কথা জানি। কিন্তু ওম ধ্বনি যে আমাদের শারীরিক ও মানসিক শরীরে ম্যাজিকের মতো কাজ করতে পারে তা আমরা জানি না। আন্তর্জাতিক শব্দ বিশারদ ও কম্পন বিশারদগণ বলছেন, শব্দবন্ধ সঠিকভাবে নিয়মিত অনুশীলনে মানব দেহে প্রতক্ষ্যভাবে রাসায়নিক রূপান্তর ঘটায়। আর এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। না আছে কোনো ভাষাভেদ, না আছে জাতিভেদ, না আছে, নারীপুরুষ ভেদ, না আছে বয়সের ভেদ। যেকেউ এই ধ্বনির মাহাত্ম উপলব্ধি করতে পারবেন।  যেকেউ এর থেকে শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে উপকৃত হতে পারবেন। এটি ফলিত বিজ্ঞান। ওম ধ্বনি প্রথমে আমাদের নিম্নাঙ্গের উপরে প্রভাব বিস্তার করে থাকে, ধীরে ধীরে মধ্যভাগে এবং সব শেষে আমাদের ব্রহ্মতালুতে বা মস্তিষ্কে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এরপর  এই শব্দ তরঙ্গের প্রবাহ সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে  পড়ে এবং আমাদের সর্বাঙ্গ শরীর এক ঝংকারের উপলব্ধি করতে পারে। আমাদের সমস্ত প্রাণকোষ এই শব্দধ্বনিতে জেগে ওঠে, ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। সুমধুর সংগীত যেমন সময় ও সঠিক সুরের সঙ্গে গীত  হলে, আমাদের শরীর-মনে প্রভাব ফেলে, তেমনি এই ওঙ্কার  ধ্বনি  সমস্ত সুরের রাজা। এই ধ্বনি শরীরের অভ্যন্তরে শক্তির উজ্জীবনরূপ শিরা-উপশিরায় প্রয়োজনীয় উষ্ম প্রবাহ সৃষ্টি করে থাকে। আমাদের মন থেকে সমস্ত কু -চিন্তা, বা কু-ভাবনা দূরীভূত করে দেয়।  এই ধ্বনির স্বর-মাধুর্য্য শরীরের সমস্ত গ্রন্থিকে বলবান করে। এই ধ্বনির ধারাবাহিক অভ্যাসে বৃদ্ধ বয়সেও মেধাশক্তি, চেতনশক্তি, স্মৃতিশক্তি সচল থাকে। রক্তচাপ, সাইনাস, গলগন্ড, ইত্যাদি রোগে আশু উপকার পাওয়া যায়। এই ধ্বনি আমাদের একাগ্রতা বৃদ্ধি করে, ওম ধ্বনি আলস্য নিবারক, জ্ঞানবর্ধক, হতাশা নিবারক, দুর্বল শরীরের কম্পনরোধক, শ্বাসকষ্ট নিবারক। এই ধ্বনি আমাদের অন্তর-হৃদয়েকে প্রদীপ্ত হরে। ওঙ্কার  ধ্বনি আমাদের জৈব জগৎ থেকে আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করিয়ে দেয়।  স্থুল  থেকে সূক্ষ্ম, সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর, সূক্ষ্মতর থেকে সূক্ষ্মতম শরীরের জ্ঞান প্রদান করে থাকে। ঋষি পতঞ্জলি দর্শনে সমাধিপাদ অধ্যায়ে বলছেন, এই ওঙ্কার বীজরূপ ধ্বনি, মানব জীবনের কর্ম্ম-যোগ শেষে ঈশ্বর-তীর্থ যাত্রায়, বৈতরণী বিশেষ। প্রণব জপ ও চিন্তন থেকেই চেতনসত্তার জ্ঞান লাভ হয়।

ওঙ্কার  কিভাবে কাজ করে ? দেখুন, আমাদের সাধারনের জীবন প্রবৃত্তি আকর্ষণ ভিত্তিক। সবসময় কোনো না কোনো কিছু আমাদের আকৃষ্ট করছে। কেউ হয়তো প্রিয়জনের আকর্ষণ অনুভব করছে, কেউ হয়তো বিষয়জনিত আকর্ষণ অবুভব করছে। এই মানবিক সম্পর্ক ও জড়বস্তুর চিন্তা, এটি আমাদের সুখ-দুঃখ এনে দেয়। আমরা নিজেরদেরকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীবসত্তা হিসেবেই ভাবি বা জানি। আমরা যে এক অখন্ড পরমসত্তার মধ্যে বাস করছি, এই বোধ আমাদের মধ্যে সুপ্ত। আমাদের এই জীবসত্তা যেমন সত্য, তেমনি আমাদের এই ব্রহ্মসত্তাও সত্য। বেদ  অর্থাৎ জ্ঞানের সার হচ্ছে গায়েত্রী।  আর গায়েত্রীর সার হচ্ছে ওঙ্কার।  এই ওঁকারকেই বলা হয়ে থাকে প্রণব, অর্থাৎ প্রতিনিয়ত নতুন। তো ওঙ্কারের স্মরণ-মনন-এর ফলে  আমাদের উপল্বদ্ধিতে জীবসত্তা থেকে পরম-সত্তায় উপনীত হই। আমাদের অন্তর থেকে খণ্ডজ্ঞান দূর হয়। তখন সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, ভালো-মন্দ এই হিসেবের মাপকাঠির পরিবর্তন হয়ে যায়। প্রণবের জপ অর্থাৎ নিজেকে প্রতিনিয়ত নতুন ভাবে আবিষ্কার করা।   

বিবেকানন্দ বলছেন, ওঁ এই শব্দের চিন্তা করতে হবে, সেই সঙ্গে ওঙ্কারের অর্থও  চিন্তাও করতে হবে।তো ওঙ্কারের অর্থ কি সে সম্পর্কে আমরা একটু শুনে নেই। ওঙ্কার  হচ্ছে পরব্রহ্ম, আবার সগুন ব্রহ্ম ও নির্গুণ ব্রহ্ম উভয়ের প্রতীক। আপনি যখন ওম এর উচ্চারণ করেন, তখন আপনি অ-আ-উ-ঊ-ম (ঁং) এই পাঁচটি অক্ষর উচ্চারণ করে থাকেন। জন্মের ক্ষণ  থেকেই এই প্রণব ধ্বনি আমাদের উচ্চারণ করতে হয়। তা সে জ্ঞাত সারেই হোক, বা অজ্ঞাত সারেই হোক।  এমনকি আমাদের কর্নকুহরে যত  শব্দ বা ধ্বনি প্রবেশ করছে, তার নির্যাস হচ্ছে এই প্রণব ধ্বনি। আমরা যত  কথা বলি, বা আমরা জিহ্ববা সহযোগে কন্ঠ-তালু-ওষ্ঠ স্পর্শ করে যাকিছু শব্দের সৃষ্টি করি, সেই সমস্ত শব্দের আশ্রয়স্থল হচ্ছে ওঁ। 

ওঙ্কার  সম্পর্কে বলা   থাকে, এটি এক, দুই, তিন, চার,  পাঁচ,   অক্ষরের সমষ্টি। এটি আবার ৭ অক্ষরের প্রতীক।অ-আ-উ-ঊ-ম (ঁং) । এটি যখন এক অক্ষর তখন তখন যিনি পরব্রহ্মের প্রতীক, এটি যখন দুই অক্ষর (ওং বা ওঁ) তখন সগুন ও নির্গুণ ব্রহ্মের প্রতীক, ওঙ্কার যখন তিন অক্ষর (অ-উ-ম) তখন এটি সত্ত্ব-রজঃ-তম গুনের প্রতীক, সৃষ্টি-স্থিতি-লয়-এর প্রতীক।পূরক-রেচক-কুম্ভকের প্রতীক।  ওঙ্কারে যখন চারক্ষর, তখন চারদিকের প্রতীক, জাগরণ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি ও তুরীয় অবস্থার প্রতীক। যাকে ব্রহ্মার চার অবস্থা বলা হয়ে থাকে।  ওঙ্কার যখন পাঁচ অক্ষরের তখন এটি পঞ্চভূতের প্রতীক অর্থাৎ ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্রহ্ম। শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস গন্ধের প্রতীক। 
              
   "ওঁং" বানানের প্রতিধ্বনি পাই শিব পূরণে। সেখানে ভগবান শিব, ব্রহ্মা ও বিষ্ণুকে বলছেন : আমার পাঁচটা মুখ। আর তা হচ্ছে সৃষ্টি, পালন, সংহার, তিরোভাব এবং অনুগ্রহ। সৃষ্টি ভূমিতে, স্থিতি জলে,সংহার অগ্নিতে, তিরোভাব বায়ুতে,অনুগ্রহ আকাশে স্থিত। পৃথিবী থেকে সৃষ্টি, জল থেকে বৃদ্ধি, অগ্নিতে সংহার, বায়ুতে স্থানান্তর আর আকাশ সকলকে অনুগ্রহিত করে। সর্বপ্রথম আমার মুখ থেকে ওঁংকার উদ্গারিত হয়। উত্তরদিকের মুখ থেকে অকার, পশ্চিম মুখ থেকে উকার, দক্ষিণ মুখ থেকে মকার, পূর্ব মুখ থেকে বিন্দু (ঁ) মধ্যের  মুখ থেকে নাদ (ং) উচ্চারিত হয়েছে।  এইভাবে পাঁচ অবয়ব দ্বারা "ওঁং"কার বিস্তারিত হয়েছে।  
বেশিরভাগ পন্ডিতদের মতে,  প্রণব আসলে ত্রিবর্ণাত্মক। আ বর্ণটি  প্রথমটির অর্থাৎ অ এর উচ্চারণ ভেদ মাত্র।

প্রণবকে ত্রিবর্ণাত্মক, অর্থাৎ সত্ত্ব, রজ, তম গুনের প্রতীক বলা যেতে পারে।  আবার পঞ্চবর্নাত্বক  অর্থাৎ অ-আ-উ-ঊ-ম  অর্থাৎ পঞ্চভূতের (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম )-এর  প্রতীক বলা যেতে পারে।

 আবার একাক্ষর বলা যেতে পারে।  অর্থাৎ অনুস্বার, চন্দ্রবিন্দু  এগুলোকে বর্ণ থেকে বাদ  দিয়ে  এক অক্ষর বলা যেতে পারে। সত্যি কথা বলতে কি  স্বরই পূর্ণ বর্ণ। কেবল স্বরেই পূর্ণমাত্রা আছে। ব্যঞ্জন  পূর্ণ বর্ণ নহে।  স্বর, স্বয়ং উচ্চারিত হতে পারে। কিন্তু ব্যঞ্জন, অন্যকে আশ্রয় করে উচ্চারিত হয়। সুতরং "ও" এবং "ম"  এই দুটিতে মিলিত হয়ে যে ওম বা ওং হয়েছে, এঁকে এক বর্ণ বা এক অক্ষর বলা যেতে পারে। অতএব ব্যঞ্জন ও একটি স্বর একত্র থাকলে, এই দুটিকে একটি বর্ণ বলা হয়। 
 স্রষ্টা-সৃষ্টি-সৃষ্ট  এ তিনই এক। কিন্তু এ সব কথা যতক্ষন সাধকের  ব্রহ্মজ্ঞান না জন্মায় অর্থাৎ এক ব্রহ্মর জ্ঞান না জন্মায় ততক্ষন অনুধাবন করা যায় না। এইজন্য, যেমন সাধক, সে অনুযায়ী সে  বোঝে বা  তাকে সেইভাবে বোঝানো হয়। 
প্রণব অসীম শক্তির আধার। এই শক্তি অজ্ঞানীর কাছে সুপ্ত।  জ্ঞানীর কাছে উদ্ভাসিত। 
"ওম" বা প্রণবের মাহাত্য ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। অবিরত জপ্-ই এর উত্তর দিতে পারে।
এইবার প্রণব সম্পর্কে সুপ্ত সত্য   কথা বলবো, প্রণব আসলে একটা ধ্বনি।জীবনরূপ অগ্নি ও প্রাণরূপ বায়ুর মিথুনে বা সংঘর্ষে এই ব্রহ্ম-শব্দ উৎপত্তি হয়েছে। এটি   অর্থবহ শব্দ নয়। এই ধ্বনির  কোনো অর্থ হয় না। পন্ডিতরা যে যার মতো করে অর্থ বের করেছেন।এই ধ্বনি প্রতিনিয়ত উদ্গীথ হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সর্বত্র, ও সর্বদা। ধ্যানস্থ হয়ে কান পাতলে এই শব্দ শোনা যায়।  এবার, ধ্বনি বা শব্দ  সৃষ্টির রহস্যঃ একটু        


 রামায়ণের ইতিহাস 

অযোধ্যা নগরী থেকে ঋষি বাল্মীকির আশ্রম বেশি দূরে নয়।  এনার  আশ্রমে ঋষি নারদের আনাগোনা আছে। তো একদিন বাল্মীকি নারদকে বলছেন, (বাল্মীকি রামাযান বালকান্ড) - 

"এখন এই পৃথিবীতে কোনো  ব্যক্তি গুণবান, বিদ্যান, মহাবল, পরাক্রান্ত, মহাত্মা, ধর্ম্মপরায়ণ, সত্যবাদী, কৃতজ্ঞ, দৃঢ়ব্রত ও সচ্চরিত্র আছেন ? এমন কেউ কি আছেন, যিনি সমস্ত প্রাণীর হিট সাধন করে থাকেন ? কোন ব্যক্তি লোকব্যবহারকুশল , অদ্বিতীয় সুচতুর  ও প্রিয়দর্শন ? কোন  ব্যক্তিই বা রোষ ও অসূয়ার বশবর্তী নহেন ? রণস্থলে জাতক্রোধ হলে কাকে দেখে দেবতারাও ভীত হন ? হে তপধন ! এমন গুণসম্পন্ন মানুষ কে আছেন, তা নিশ্চয় জানেন।  আমার কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য, দয়া করে আমাকে সেই পুরুষের কথা বলুন।"

 তো নারদ তখন, তাকে বললেন, দেখো, এমন গুণবান মানুষ পৃথিবীতে সুলভ নয়। রাম  নামে  ইক্ষাকু বংশীয় সুবিখ্যাত এক নরপতি আছেন। ইত্যাদি ইত্যাদি করে শ্রীরামের কিছু গুনগান, কৈকেয়ীর ষড়যন্ত্র সীতাকে লঙ্কা  থেকে উদ্ধার ইত্যাদি বলে বললেন, অযোধ্যাপতি রামচন্দ্র এখন পিতার মতো প্রজা পালন করছেন। আবার এই বলে ভবিষ্যৎ বাণী করলেন, যে রামচন্দ্র দশ হাজার দশ শত (১০০১০) বৎসর রাজত্ব করে তিনি ব্রহ্মলোকে গমন করবেন।

---------
মোক্ষ কাকে বলে ? 

এই বিষয়টি একটা উদাহরনের সাহায্যে ছান্দোগ্য উপনিষদে বোঝানো হয়েছে। ধরুন কোনো ব্যক্তির হাত বেঁধে আনা  হয়েছে, এবং সবাই বলছে, "এ চুরি করেছে" তো চোর বলছে, আমি চুরি করিনি। তো সবাই  বললো,  "এর পরীক্ষার জন্য একে লোহা গরম করে ছেঁকা দাও।" সে যদি সত্যি চুরি করে থাকে, এবং সত্যকে গোপন করে, অর্থাৎ মিথ্যা বলে থাকে তবে সে মিথ্যের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখার জন্য, তপ্ত লোহার আঘাতে নিজেকে দগ্ধ করুক। 

চোর এবার বললো, সাক্ষ কোথায়, যে তোমরা আমাকে  চোর সাব্যস্ত করছো ?  তো সাক্ষ্য প্রমান হাজির করা হলো।  এবং প্রমান বলছে, যে সে চোর। এখন কি করা উচিত ? সবাই বলছে, লোহা পুড়িয়ে ছেঁকা  দাও। নির্দোষ হলে তার হাত পুড়বে  না। আর ও যদি সত্যি চুরি না করে, ও যদি মিথ্যে না বলে, তবে সত্য ওকে রক্ষা করবে। 

মোক্ষ হচ্ছে এমন একটা অবস্থা যখন আমি জেনেছি যে আমি "আত্মা" বৈ কিছু নোই, আমার জন্ম নেই, আমার মৃত্যু নেই। আপ্তকাম পুরুষের কিছু চাওয়ার নেই, কিছু হারানোর নেই। যাকিছু আছে, তা আমার মধ্যেই আছে, বাইরে নয়। বাইরের জিনিস  চাওয়ার  বা পাওয়ার  প্রবণতা থাকে। কিন্তু আমার মধ্যেই যদি সবকিছু থাকে, সবকিছুর মধ্যে যদি আমি নিজেকে একাত্ব বোধ করে থাকি তাহলে নতুন করে আর কিই বা চাওয়ার থাকতে পারে ?  বা  পাওয়ার থাকতে পারে ? সর্বম খলু ইদম ব্রহ্ম - এই সবকিছুই ব্রহ্ম। আর আমিই সেই ব্রহ্ম। আমি মুক্ত অবিনাশী - আমি চাওয়া পাওয়ার উর্দ্ধে।  এই  আত্মজ্ঞান উপল্বদ্ধিতে না আসা পর্যন্ত আমরা সংসারজ্বালায় দগ্ধ হতে থাকি। আর আত্মজ্ঞান হলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়। এই ব্যক্তি কাউকে কষ্ট  দিতে পারেন না,  কাউকে আঘাত করতে পারেন না, কেননা কেউ তার কাছে পর নয়, সবাই আপনার। শুধু আপনার নয়, সবই তিনি। অন্যের সুখে তিনি সুখী। অন্যের দুঃখে তিনি দুঃখী। হিংসা দ্বেষ তার মধ্যে থাকে না। কারন সবার মধ্যে তিনি নিজেকেই দেখতে পান। 

সে যদি চুরি না করে থাকে, তবে অবশ্যই  সে নিজেকে সত্যবাদী প্রমান করে।  সদা সত্যনিষ্ঠ এই ব্যক্তি নিজেকে সত্যের আবরনে সুরক্ষিত করে তপ্ত লোহার আঘাত গ্রহণ করে, কিন্তু দগ্ধ হয় না।  সত্যই তাকে রক্ষা করে, এবং শেষে মুক্ত হয়ে যান।

কথায় বলে শরীর থাকলে রোগ থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রোগ কেন থাকবে ? আমাদের সবার মৃত্যুর আগে রোগ আসে। আর এই রোগের কারণেই মানুষের মৃত্যু হয়। তো মৃত্যু যদি রোগের কারনে হয়ে থাকে তবে কি একথা বলা যেতে পারে যে রোগ হচ্ছে মৃত্যুর দূত!  তো মৃত্যুর আগে কেন আমাদের শরীরে রোগ অবস্থান করবে ? এটি তো তার অনাধিকার প্রবেশ। আমার যখন কোনো রোগ হয়, তখন আমি রোগকে বলি, হে মৃত্যুর দূত, তুমি কেন আমার কাছে এসেছো ? আমার এখনো মৃত্যুর সময় আসেনি। আমি যে কাজের জন্য, এই স্থুল শরীরে অবস্থান করছি, সেই কাজ এখনো আমার সমাপ্ত হয় নি। বরং তুমি আমার শরীরে বারবার এসে, আমাকে আমার কাজে বাধা সৃষ্টি করছো। এটি অবশ্যই  তোমার পক্ষে গর্হিত কাজ। বরং প্রাণের অবস্থানের জন্য, এই শরীর। আবার প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে, অন্য প্রাণের প্রয়োজন, দেহকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে অন্য দেহের প্রয়োজন। তো তুমিতো মৃত্যুর সাথী, তুমি কেন প্রাণের সাথে অবস্থান করছো ? তুমি তো দেহহীন, তবে তুমি কেন দেহে অবস্থান করছো ?  তুমি যদি সত্যি মৃত্যুর দূত হয়ে থাকো, তবে  প্রাণের সাথে সহাবস্থান তোমার পক্ষে অপমানকর । তুমি শীঘ্র আমার দেহ ছেড়ে প্রাণহীন দেহে অবস্থান করো। হে মৃত্যুর দূত রোগ-ব্যাধি, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ ? যদি শুনে থাকো তবে দূর হও। 

সাধু হলে কি হয় ? 
একদিন মা সারদার কাছে একটি ছেলে এলো, দীক্ষা ও গেরুয়া যাবার জন্য। শ্রীশ্রী মা তার ইচ্ছে পূরণ  করলেন। এতেকরে ছেলেটি খুব খুশি হলো।  শ্রীশ্রী মায়ের এই ধরে ধরে যুবকদের সাধু বানানোর কাজ অনেকের পছন্দ ছিল না। তাঁর এক ভাইবৌ বললেন, এই যুবাটিকে সাধু করে দিয়েছেন ? ভাইঝি মাকু বললো, "দেখনা পিসিমার কাজ। তিনি এইসব ভালো ছেলেগুলোকে সন্ন্যাস জীবন নেওয়াচ্ছেন।  তাদের মা-বাবা কত কষ্ট  করে এদের এতো বড়টি করেছে।  মা-বাবার সব প্রত্যাশা ছেলেকে কেন্দ্র করে।  ছেলেটির উপরে কতো আশাই না তারা পোষণ করেন।  সেসব এখন সব ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো।  এই ছেলের এখন কি হবে ? হয় হৃষিকেশে গিয়ে ভিক্ষে করবে, নয়তো হাসপাতালে গিয়ে রুগীদের মলমূত্র পরিষ্কার করবে।  কেন, বিয়ে করে সংসার করা  তো এক-রকম ধর্ম্ম। আচ্ছা পিসিমা, এইসব ছেলেদের যে তুমি সাধু করে দিচ্ছ, এতেকরে মহামায়া তোমার উপরে রাগ করবেন।  এরা  যদি সাধু হতে চায়, তা সে নিজেদের ইচ্ছেয় হোক, তুমি কেন এদের সন্ন্যাসী হবার ব্যাপারে নিমিত্তের ভাগিদার হোচ্ছ ? 

এর উত্তরে পিসিমা অর্থাৎ শ্রীশ্রী মা সারদা বলেছিলেন, দেখ মাকু, এরা  সব দেবশিশু। এরা  সংসারে নিস্কলুষ হয়ে বাস করবে, অনাঘ্রাত ফুলের মতো। তার থেকে আর কি ভালো হতে পারে ? তোরা তো নিজেরাই দেখছিস সংসারে কতো সুখ ! এতদিন আমার কাছে থেকে থেকে কি শিখলি ? সংসারে জীবনে এতো আকর্ষণ কেন ? এতো পশুবৃত্তি কেন ? তোরা কি পবিত্র জীবনের আদর্শ স্বপ্নেও ভাবতে প্যারিস না ? ........শুয়োরের মতো বেঁচে থাকার বাসনা কেন ? ...... 

আমরা পৃথিবীতে অবস্থান করছি।  অথচ  আশ্চর্য্যের ব্যাপার হচ্ছে আমরা পৃথিবীকে সম্পূর্ণ রূপে  দেখতে পাই না।  আমরা সূর্যকে সম্পূর্ণ রূপে  দেখতে পাই, চন্দ্রকে সম্পূর্ণরূপে দেখতে পাই, যা আমাদের থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে অথচ যা আমাদের সবচেয়ে কাছের তাকে আমরা দেখতে পাই না।  
মেঘ যতক্ষন জল দান  না ক'রে, সূর্যকে ঢেকে রাখে, ততক্ষন সে আমাদের অন্ধকারে ঢেকে রাখে। কৃপণ যদি ধন সংগ্রহ করে কুক্ষিগত করে রাখে, তবে  সে সমাজের কোনো কাজে আসে না, বরং সমাজের অর্থব্যবস্থার সে ক্ষতি সাধন করে থাকে । জ্ঞান যতক্ষন বিস্তারলাভ না করতে পারে, ততক্ষন সেই জ্ঞান বন্ধ্যা। বেদ যদি বিশেষ শ্রেণীর জন্য কুক্ষিগত থাকে, তবে সেই বেদ অন্ধ। 
বেদবিদ্যা পরা ও অপরা উভয়ই। যিনি ইন্দ্রিয়ের অগোচর, যিনি অদৃশ্য, যিনি অগ্রাহ্য, যিনি অগোত্র, যিনি সমস্ত রূপের কারন হয়েও নিরাকার, যিনি ইন্দ্রিয়হীন হয়েও ইন্দ্রিয়শক্তির কারন, সেই বিভু সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়াকেই পরাবিদ্যা বিষয় বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এই তত্ত্বকথায় আমাদের কাজ কি ? আমরা যারা কর্ম্ম-ব্যস্ত  মানুষ, যাদের আহার-নিদ্রা আবশ্যিক, আমরা তো অন্নের খোঁজ চাই, আমরা তো নিরুপদ্রুপে নিদ্রা যেতে চাই।  তো তত্ত্বকথায় আমাদের কি উপকার হবে ? ক্ষুধার্থের অন্ন চাই, ধর্ম্ম কথায় পেটের  খিদে মমেটে  না। আমরা আমাদের অনন্ময় ও প্রাণময় শরীর রক্ষায় ব্যস্ত। আমাদের জন্য এই তত্ত্ব কি কোনো মূল্য বহন করবে ? 

যে বিদ্যার ব্যবহারিক উপযোগিতা আছে সেই বিদ্যা আমরা চাই। ব্রহ্মবিদ বলছেন, যার পেটে  অন্ন নেই, তার প্রজ্ঞা নেই। যাঁর প্রজ্ঞা নেই, তার বলও নেই।  আর যার বল নেই, তিনি নিজেকে জানতে পারেন না। তিনি আত্মাকে জানতে পারেন না। তিনি সেই অজ্ঞাত পুরুষকে জানতে পারেন না। আর আত্মাকে জানলে পরাবিদ্যার পথ প্রশস্ত হয়। প্রথমে অনন্ময় শরীর, তারপরে প্রাণময় শরীর, তারপরে মনময় শরীর তারপরে বিজ্ঞানময় শরীর এবং সবশেষে আনন্দময় শরীর। এক-এক করে সমস্ত শরীরের মধ্যে দিয়েই সেই পরমপুরুষ তত্ত্ব গ্রহণে সমর্থ হয়। যে বিদ্যার ব্যবহারিক উপযোগিতা আছে, যা আমাদের ইহলোকে সুখের সন্ধান দিতে পারে, এমনকি আমাদের পারলৌকিক মুক্তির উপায় বাতলে দিতে পারে, তাই অপরাবিদ্যা।  এই অপরাবিদ্যা বা প্রযুক্তি বিদ্যা আমাদের দুঃখের পরপারে নিয়ে যেতে পারে। এমনকি আত্মার সাক্ষাৎকারে সহায়ক হতে পারে। এই অপরা বিদ্যা আছে আমাদের বেদ বেদান্তে। এই বেদ  চর্চার মাধ্যমে প্রত্যেকটি মানুষ জ্ঞান অর্জন করে তার ইষ্টবস্তু লাভ করতে পারে।  নিজের যোগ্যতা অনুসারে বেদ  অর্থাৎ জ্ঞানের চর্চা করলে, ক্রমেই মানুষ শ্রেষ্ট থেকে শ্রেষ্টতর হতে পারেন। বেদবিদ্যা পরা ও অপরা উভয়ই। বেদের মধ্যেই প্রযুক্তি আছে, বেদের মধ্যেই আছে পরম-পুরুষের সন্ধান। তাই সবাইকে ক্ষমতা অনুসারে বেদ অধ্যয়নের অনুরোধ করি। বেদ অর্থাৎ জ্ঞান।  এই জ্ঞানের উৎপত্তি নেই, এই জ্ঞানের নাশ নেই। ইনি স্ব-ইচ্ছায় জাত। এই বেদ কোনো বিশেষ ধর্ম্মের নয়, বিশেষ শ্রেণীর জন্য নয়, বেদবিদ্যায় নারী-পুরুষ, সবার অধিকার।   

-------------
গায়েত্রী মন্ত্রের ভাব :

গায়ত্রী মন্ত্র কেবল মুখস্তবিদ্যা নয়। গায়ত্রী মন্ত্র কেবল কবিতার মতো আবৃত্তি বা গানের মতো করে সুর করে গাইলেই মন্ত্রের সুফল মিলবে না। গায়ত্রী মন্ত্র একটা ভাবনা।  নিজেকে প্রসারিত করবার ভাবনা। চারিদিক থেকে সমস্ত শুভ শক্তিকে আহরণ করে নিজের মধ্যে সঞ্চারিত করবার  মন্ত্র  গায়ত্রী।
 ওঁং ভূর্ভুবঃ স্বঃ - এই মন্ত্র মননকালে বা ধ্যান কালে আমাদের সমস্ত বিশ্বজগৎকে অর্থাৎ ত্রিভুবনকে মনের মধ্যে আহরণ  করে আনতে  হবে। এই সময় আমাদের যেন মনে হয়, আমি ভূলোক, স্বর্গলোক ও অন্তরীক্ষ লোক - এই তিন ভুবনের বাসিন্দা। আমি যেন এই তিন ভুবনের মধ্যেই ব্যাপ্ত হয়ে আছি। অর্থাৎ নিজের অবস্থানকে ব্যাপ্ত করতে হবে। 
তৎ সবিতুর বরেণ্যম - এবার এই বিশ্বজগতের যিনি স্রষ্টা, পালয়িতা  অর্থাৎ সবিতা, সেই সূর্যদেবকে নিজের মধ্যে বরণ  করে আনতে হবে। তাঁর শক্তির ধ্যান করতে হবে। মনে মনে ভাবতে হবে, এই যে বিপুল বিশ্বশক্তি - এই বিশ্বশক্তি থেকেই বিশ্বজগৎ বিচ্ছুরিত হচ্ছে, বিকীর্ণ হচ্ছে, প্রকাশিত হচ্ছে । আর এই যে অসীম শক্তিপুঞ্জ দ্বারা তিন  ভুবন প্রকাশিত হচ্ছে, তার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক ? কোন সূত্রে আমি এই শক্তির সঙ্গে গ্রথিত ? 
এই সূত্রটি হচ্ছে ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ - ধীশক্তি হচ্ছে এই সূত্রটি। এই ধীশক্তি-সূত্র প্রতিনিয়ত সবিতা ও  আমাকে যুক্ত করছে। সেই ধীসুত্রের সাহায্যেই তাঁকে ধ্যান করতে হবে। সূর্য্যের আলোক রশ্মিকে আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি। সূর্য্যের কিরনের সাহায্যে আমরা সূর্য্যের শক্তিকে গ্রহণ করতে পারি।  ঠিক তেমনি বিশ্বজগতের সবিতা আমাদের মধ্যে অহরহ যে ধীশক্তি প্রেরণ করছেন, এই ধীশক্তির সাহায্যেই আমি নিজেকে ও বহির্বিশ্বকে উপলব্ধি করতে পারছি।  এই ধীশক্তি সেই বিশ্বশক্তি। আর এই ধীশক্তির রশি ধরেই আমরা বিশ্বশক্তিকে অন্তরের মধ্যে উপলব্ধি করতে পারি। বিশ্বশক্তিকে এই ধীশক্তির সাহায্যেই আমাদের অন্তরতম রূপে অনুভব করতে পারি। দৃশ্যমান জগতে যেমন সূর্য, অন্তর্জগতে তেমনি সবিতা। বহির্জগৎকে প্রকাশিত করে সূর্য। আর অন্তর্জগৎকে প্রকাশিত করে সবিতা। বাইরের জগতের সঙ্গে যেমন আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর সাহায্যে যোগাযোগ রক্ষা করি। তেমনি এই সবিতার সঙ্গে যোযোগের মাধ্যম হচ্ছে ধীশক্তি।  তো এই ধীশক্তির ধারাবাহারিক প্রেরণকর্তাকে আমাদের অপরোক্ষ জ্ঞানের বিষয় করে তুলতে হবে। 
বাইরের জগৎ যেমন সত্য, আর তা আমরা বুঝতে পারি আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়সকল দ্বারা।  তেমনি আমাদের অন্তর জগৎ সত্য, সেই উপলব্ধি হয়, আমাদের ধীশক্তির দ্বারা।  এই দুই শক্তি আসলে একই শক্তির বিকাশ। এই সত্য আমাদের উপল্বদ্ধিতে এলে, আমাদের ক্ষুদ্র স্বার্থ, আমাদের সংকীর্নতা, আমাদের ভীতি, আমাদের বিষাদ, আমাদের দন্দ্ব দূর হয়ে যাবে। এই পবিত্র গায়েত্রী মন্ত্র-ই পারে আমাদের বাইরের জগতের সাথে অন্তর্জগতের মিলন ঘটাতে ।  আবার অন্তর্জগতের সঙ্গে যে অন্তর্যামী আছেন, সেই অন্তর্তমের যোগ সাধন করে দিতে। 
-----------

প্রশ্ন উঠেছে, বেদে কি সবার অধিকার ? 
দেখুন বেদ অপৌরুষেয়। কোনো বিশেষ পুরুষ এই বেদের রচনাকার নয়। গাছে একটা সুন্দর পাখী বসে আছে, আপনি এটি দেখছেন, পাখী গান গাইছে, আপনি শুনছেন। এই শোনা বা দেখায় সবার অধিকার। এখন এই পাখীর  গানের কি অর্থ করবেন, বৌ কথা কও, না চোখ গেলো, না কুহু কুহু এটি আপনার নিজস্ব। বেদ হচ্ছে ঈশ্বরের গান। এই গান স্বয়ং ঈশ্বর থেকে নিঃসৃত। এই গানের দৃশ্যপট  যিনি প্রথম অন্তর দৃষ্টি দিয়ে প্রতক্ষ্য করেছিলেন, তিনি বেদের মন্ত্রের দ্রষ্টা। বেদপাঠে সবার অধিকার। বেদ কারুর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। বেদ কোনো বিশেষ ধর্ম্মীয় মত নয়। বেদ মানুষের  আত্মবিকাশের ঔষধী বৃক্ষ-সমতুল। তাই ঔষধ যেমন ধর্ম্মের বাধা মানে না, সমস্ত ধর্ম্মের মানুষকে, সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষকে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রোগমুক্ত করতে পারে, তেমনি বেদ জীবন বিকাশের সমস্ত বাধাকে দূর করতে পারে। বেদ জীবনের সমস্ত রোগ নিরাময়ক। ঔষধে যেমন সবার অধিকার তেমনি বেদে সবার অধিকার। 
এখন কথা হচ্ছে, ডাক্তারের নির্দেশ ছাড়া আপনি ঔষধ সেবন করবেন কিনা, সেটা আপনিই ঠিক করবেন। কোন্ ডাক্তারের কাছে আপনি যাবেন, সেটিও আপনার সামর্থ, অবস্থানের উপরে নির্ভর করছে। 
শেষ কথা হচ্ছে, বেদে সবার অধিকার আছে, বললেই তো বেদ আপনার কাছে বোধগম্য হয়ে উঠবে না। তাই বলা হয়, বেদে সবার অধিকার নেই। কোন্ শব্দের কি অর্থ, কোন মন্ত্রের কোন দেবতা, এগুলো যেমন জানা চাই, তেমনি বেদের আধ্যাত্মিক অর্থ, আধিদৈবিক অর্থ, অধিযাজ্ঞিক অর্থ জানার উপায় খুবই সীমিত। বিদেশী পরিব্রাজক বেদের একরকম অর্থ করেছেন, ঐতিহাসিকগণ বেদের অন্যরকম অর্থ করেছেন। আবার কোনো কোনো পণ্ডিত বলছেন, বেদের মন্ত্রের কোনো অর্থ নেই। উচ্চারণই সব। বেদের ধ্বনি মাহাত্ম্যই সব। আবার কেউ বলছেন, বেদের মধ্যে যে সুরের মূর্ছনা আছে, সেটাই সব। 

আমাদের মনে হয়, বেদের সমস্ত মন্ত্রের মধ্যে অবশ্য়ই অর্থ আছে।  হতে পারে দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী অর্থের পার্থক্য। আর একটা কথা হচ্ছে, বেদের ভাষা হচ্ছে বৈদিক, যা বৈজিক ভাষার অংকুর মাত্র। তো অংকুর দেখে যেমন সবার পক্ষে সঠিক বৃক্ষের অনুমান বা অনুধাবন সম্ভব নয়, তেমনি বৈদিক ভাষার মন্ত্র আমাদেরকে অনুমান নির্ভর করে দেয়। আমরা এখন যে বেদ  পাই, তা সংস্কৃত ভাষায়। বৈদিক ভাষায় ব্যবহৃত অনেক শব্দ একাধিক অর্থ বহন করে থাকে। এখন বৈদিক ভাষা থেকে ভাষান্তরিত হয়ে, যখন বেদ সংস্কৃত ভাষার মধ্যে এলো, তখন অনেক শব্দের অর্থ পরিবর্তিত আকারে পাই। এসব কথা "নিঘন্টু" নামক শব্দ-সংকলন থেকে অনুমিত হয়।  যেমন ধরুন, গো শব্দ - গো শব্দের দ্বারা গরু, পৃথিবী, বাক্য, রশ্মি, জল ইত্যাদি হতে পারে। অশ্ম বলতে আমরা ঘোড়া বুঝি, কিন্তু অশ্ম বলতে, রশ্মি, বেগ ইত্যাদিও বোঝায়। আসলে একই শব্দ প্রয়োগকালে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ পোষন করতে পারে। সুতরাং বেদের মন্ত্রের ব্যাখ্যা শুধু শব্দ নয়, ভাবের উপরে হয়ে থাকে। 
এসব কথা বেদ সম্পর্কে জানার আগ্রহ না থাকলে, জানতে পারবেন না। অধিকার কেউ দেয় না, অধিকার আদায় করে নিতে হয়। বেদে কার অধিকার আছে, আর কার অধিকার নেই, এই সম্পর্কে আজ রাষ্ট্র-আইন নীরব। তাই নীরবে বেদ অধ্যয়ন করে, বেদের যথার্থ মর্মার্থ উপলব্ধি করবার চেষ্টা করুন। কারুর দ্বারা প্রভাবিত হবেন না। 

ভ্যাকসিন : বিভ্রান্তিকর তথ্য ? 

আনন্দবাজার (২৫.০৭.২০২১) ডাঃ রাজা ধর লিখছেন, প্রশ্ন আসে, যারা ভ্যাকসিন নিচ্ছেন দুটো ডোজ, তারাও আক্রান্ত হয়েছেন, মারাও গেছেন। তাঁদেরও বলা হচ্ছে, মাস্ক পড়তে বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে।  এর কারন কি ? ডাক্তারবাবুদের  সাফ জবাব ভ্যাকসিন সম্পূর্ণ ডোজ নিলে, তার দুই সপ্তাহের পর থেকে সংক্রমিত হবার সম্ভাবনা অনেক কম। সংক্রমিত হলেও দেখা গেছে তাদের মধ্যে অসুখের ভয়াবহতা অনেক কমে গেছে।  হাসপাতালেও ভর্তি হতে হচ্ছে না। ৫ থেকে ১০ শতাংশ হয়তো মারাও  যাচ্ছেন।  কিন্তু ৯০ শতাংশের  বিপদ হচ্ছে না। "

তার মানে ভ্যাকসিন দুই ডোজ নিলেও প্রথম পনেরো দিন নিরাপদ সময় নয়। আবার পনেরো দিন পরেও প্রাথমিক সুরক্ষা কবজ অর্থাৎ মাস্ক ও দূরত্ত্ব বজায় রাখা জরুরি। এর পরেও ৫ থেকে ১০ শতাংশ হয়তো মারা যাচ্ছেন। 

এখন কথা হচ্ছে, ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আগে, এমনকি কোরোনার কোনো নির্দিষ্ট ঔষধ না থাকা সত্ত্বেও মৃত্যুর হার ছিল ২-৩ শতাংশ। তো এখন ভ্যাকসিন দিয়ে এই মৃত্যুর হার কি বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে ?  ঈশ্বর এদের সুমতি দিন । 

এখন কথা হচ্ছে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে  আমরা  রেহাই পাবো কি করে ?  দেখুন ঈশ্বরের পরেই  রাষ্ট্রপ্রধানের স্থান। ঈশ্বর আপনার কৃত-কর্ম্মের বিচারের জন্য মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন।  কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান আপনাকে এক্ষুনি শাস্তির বিধান দেবেন।  তাই  মানুষের দেওয়া শাস্তি থেকে বাঁচতে গেলে, আপনাকে রাষ্ট্রের নিয়ম মেনে চলতে হবে।  আবার ভাইরাস থেকে বাঁচতে গেলে, আপনার মধ্যে যে রোগপ্রতিরোধ শক্তি আছে, তাকে বাড়িয়ে তুলতে হবে। 

করোনায় কি করণীয় নয়। 
করোনা-আতঙ্ক নিয়ে আমাদের প্রায় এক বছর   ছয় মাস  কেটে গেছে। কোরোনাকে যারা সঙ্গী করে দেহত্যাগ করেছেন, তাদের অমর আত্মার শান্তি কামনা করি। কোরোনায় যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে প্রায় ২ শতাংশ মানুষ মারা গেছেন। কিন্তু করোনা নিয়ে ভুল বুঝে বা গুজবে আক্রান্তের সংখ্যা শতকরা একশ ভাগ। এই করোনা-আতঙ্ক এখন দুরারোগ্য ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এর থেকে আমরা মুক্তি পাবো কি করে ? কোরোনার কোনো ঔষধ নেই বললেই চলে। কিন্তু ৯৮ শতাংশ করণারূগী ভালো হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। কিন্তু সমাজে জ্বলে উঠেছে, করোনা হিংসার আগুন। এই আগুন নিভবে কি করে ?

নোবেল করোনা ভাইরাস ডিজিস-১৯। নোবেল কথাটার অর্থ অভিজাত বা উন্নতমানের।  করোনা কথাটার মানে হচ্ছে, মুকুট, সূর্য্যের বা চন্দ্রের গ্রহণকালে দৃষ্ট আলোকমণ্ডল। পুষ্প দলের মধ্যে মুকুট। এই ভাইরাসের গায়ে  ব্যাঙের ছাতার মতো দেখতে প্রোটিন স্পাইক থাকে । যা দেখতে মুকুটের  মতো। তাই একে বলা হচ্ছে করোনা। ভাইরাস জীবাণু ও বস্তুর মধ্যবর্তী অবস্থা। ডিজিস অর্থাৎ রোগ। বা ভাইরাস বাহিত রোগ। ১৯ অর্থাৎ ২০১৯ সালে এটির সন্ধান মেলে। 

রোগের উপসর্গ - যেমন সর্দি, কাশি, মাথাধরা, জ্বর, নাক বন্ধ, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, ঘ্রাণশক্তি কমে যাওয়া, জিভে স্বাদ না পাওয়া, পেটের অসুখ, এমনকি চুলকানি। আবার উপসর্গহীন থাকতেও পারে। 

এইসব উপসর্গের বা রোগের  চিকিৎসা বাড়িতে বসেই করা সম্ভব। অর্থাৎ এইসব রোগের জন্য আমরা আগে যেমন করতাম, তেমন ভাবেই চিরাচরিত চিকিৎসা করতে পারি। তবে বাড়াবাড়ি হলে অবশ্যই  হাসপাতালে যাওয়া প্রয়োজন। কেননা সেখানে ডাক্তারদের আনাগোনা বেশি থাকে, যন্ত্রপাতির অর্থাৎ অক্সিজেন অর্থাৎ অক্সিমিটার ও অক্সিজেন সিলিন্ডার পাবার সুবিধা অনেক বেশি থাকে।

তবে একটা কথা বলি, আপনার আশঙ্কা থেকে আপনার মধ্যে ভয়ের উদ্রেক হবে। কিছু লোকের মধ্যে এই ভয় একটা বাতিকে পরিণত হয়ে গেছে। এমনকি পাগলামিতে পরিণত হয়েছে। কারুর বাড়িতে করোনা হয়েছে শুনলে, তাদের বাড়ি বাইরে থেকে তালা দিয়ে দিচ্ছে। এমনকি নিজের স্বামীকে বা স্ত্রীকে হাসপাতাল থেকে নিজের বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছে না। এ এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি।  তাই বলি অহেতুক টেনশন করবেন না, টেনশন থেকেও আপনার শ্বাস-কষ্ট হতে পারে। এমনকি আপনার দেহের তাপমাত্রাও বেড়ে যেতে পারে। আপনার হার্টবিট বেড়ে যেতে পারে। প্রেশার বেড়ে যেতে পারে। তাই এইসময় টেনশন মুক্ত জীবনই মুক্তির উপায়। 

আমরা আগেই বলেছি, যেকোনো রোগের হাত থেকে বাঁচতে গেলে, আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে।  তার জন্য, আমাদের প্রতিনিয়ত প্রাণায়ামের অভ্যাস করতে হবে। একটা জিনিস আমাদের বুঝতে হবে, করোনা কোনো রোগ নয়। তাই কোরোনার কোনো ঔষধ হয় না। করোনা আমাদের শরীরে স্থিত রোগবৃদ্ধিতে অনুপান হিসেবে কাজ করে। যেকোনো রোগ যখন আপনার শরীরে আশ্রয় করে, তখন তাকে সহযোগিতা করে, এই করোনা। করোনা নিজে বহিরাগত, প্রাণবন্ত হবার জন্য, আমাদের শরীরকে আশ্রয় করে থাকে, অর্থাৎ সে জীবন্ত হতে চায়  - আর অন্য বহিরাগতের সঙ্গে সে বন্ধুত্ত্ব গড়ে তোলে মাত্র।  

কিছু স্বঘোষিত বিশেষজ্ঞ সংবাদ মাধ্যমে, বা সামাজিক মাধ্যমে নানান-রকম বিভ্রান্তি প্রচার করছেন। এদের গল্পের গরু গাছে চড়ছে । এদের থেকে সাবধান থাকুন। দরকার হয়, এইসব প্রচার শোনা বন্ধ রাখুন। 

যেহেতু মনে করা হচ্ছে, কোরোনার প্রাথমিক উপসর্গ হচ্ছে, সর্দ্দি, কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট।ঋতু পরিবর্তনের সময় এগুলোর উৎপাত বাড়ে।  এবং এগুলো থেকে বাঁচবার জন্য, আমরা আমলকি, চ্যাবনপ্রাস ইত্যাদি সেবন করে থাকি। তাই অনেকের ধারণা  হয়েছে, ভিটামিন সি স্ট্রিপ বেশি খেলে করোনা চলে যাবে ? যেকোনো ভিটামিন আমাদের শরীরের পক্ষে ভালো।  কিন্তু ভিটামিন অতিরিক্ত খেলে, তা আমাদের শরীরের কাজে লাগবে, এমন ধারণা ভুল।    একজন মানুষের দেহে ৫০-১০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি প্রয়োজন।  তার বেশি নয়।  বাজারি ট্যাবলেটে ৫০০মিলি ভিটামিন সি থাকে। শরীর  এই অতিরিক্ত জমিয়ে রাখতে পারে না। তাই এর কোনো প্রয়োজন নেই।  আমাদের প্রতিনিয়ত খাবার  থেকেই ভিটামিন পেতে পারি। হ্যাঁ কেউ যদি অপুষ্টিতে ভোগেন, তবে তার অবশ্যই  ভিটামিন আলাদা করে নেবার প্রয়োজন পড়তে পারে। ডাক্তার অমিতাভ ভট্টাচার্য্য বলছেন, অতিরিক্ত ভিটামিন সি খেলে আমাদের মূত্রে অক্সালেটের পরিমান বাড়বে, কিডনিরও  ক্ষতি হতে পারে। তাই করোনা থেকে বাঁচবার জন্য, অতিরিক্ত ভিটামিন সি স্ট্রিপ যেন না গ্রহণ করি। বরং পাতিলেবুর রস, কুল, টম্যাটো, লিচু, পেঁপে, জাম, নানান ধরনের শাক, আলু খান।  এতে করে আপনি ভিটামিন সি পেতে পারেন। 

হলুদ, নিমপাতার রস, তুলসী পাতার রস, - এগুলো করোনা ভালো করতে পারে, এমন তথ্য এখনো , আমাদের হাতে আসে নি। এগুলোর আলাদা আলাদা গুন্ নিশ্চই আছে, কিন্তু কোরোনাকে তাড়াবার জন্য,  এর কোনো ভূমিকা আছে, এমন কোনো প্রমান আজও  পাওয়া যায় নি।

গার্গলিং - ঈষদ গরম জলে এক চিমটে লবন ফেলে,  দিনে দুই তিন বার গার্গলিং করা যেতে পারে। এতে করে গলা ভালো থাকবে, রোগ জীবাণু থেকে গলাকে ভালো রাখা যাবে। কিন্তু ঘন ঘন গার্গলিং, বা অতিরিক্ত গরম জলে গার্গলিং বা অতিরিক্ত লবন মিশিয়ে গার্গলিং করতে যাবেন না। 

এখন একটা সরকারি নিয়ম হয়ে গেছে, মাস্ক না পড়ে  কোথাও যাবেন না। WHO এতদিন বলছিলো, N -৯৫ মাস্ক ছাড়া করোনা আটকানো যায় না।এখন উল্টো কথা বলছে। দেখুন করোনা ভাইরাস মাত্র ১০০মাইক্রোমিটার বা তার কাছাকাছি ব্যাপ্তির। ফলে ১০০-মাইক্রোমিটার এর বেশি বড়ো ছিদ্রে সে অনায়াসে ঢুকে যেতে পারে। আমরা যে মাস্ক ব্যবহার করি, অর্থাৎ দ্বিস্তরের বা ত্রিস্তরের মাস্ক দিনে অন্তত একবার গরম জলে ধুয়ে ব্যবহার করুন। যদিও চরম সত্যি হচ্ছে, মাস্ক আপনি কতক্ষন পরে থাকবেন, আপনি নিশ্চয়ই খাবার  সময় পড়বেন না । সরকার বলছে, বাড়ির মধ্যে মাস্ক না পড়লেও চলবে। যেন আপনার বাড়ির মধ্যে করোনা ঢুকতে পারবে না। ব্যাপারগুলো ভীষণ ভাবে অবৈজ্ঞানিক। আসলে মাস্ক পড়ুন, আর মানুষ থেকে  চোদ্দ-ফুট দূরে অবস্থান করুন, আপনার করোনা থেকে রেহাই নেই। তবে ভয় পাবেন না, করোনা আপনার ক্ষতি তখনি করবে, যখন আপনার শরীরে অন্য কোনো রোগের  প্রকোপ হবে। এখন কথা হচ্ছে, আমরা কেউ নীরোগ নোই আমাদের প্রত্যেকের  শরীরে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, জন্ম থেকেই আমরা কোনো না কোনো রোগ  বা জীবাণুর বাহক। কিন্তু তথাপি আমরা স্বাভাবিক জীবনেই আছি।  তাই বলছি, ভয় পাবার কিছু নেই। শুধু রোগ প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তুলুন আপনার ভিতরে। আর এর জন্য নিয়ম করে প্রাণায়াম করুন।  প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা আধাঘন্টা করে প্রাণায়াম করুন।  অর্থাৎ ভস্ত্রিকা, কপালভাতি, অনুলোম বিলোম, অগ্নিসার, বাহ্য,  ভ্রামরী, উদ্গীথ। এর মধ্যে অনুলোম বিলোম  ও কপালভাতি ১০/১৫ মিনিট করুন। বাকিগুলো ২ মিনিট করলেই যথেষ্ট। আপনি দুইবেলা এই প্রাণায়ামের ধারাবাহিকতা বজায় রাখলে, আপনার সমস্ত রোগ-ভীতি দূর হয়ে যাবে। অন্তর কুম্ভক করুন। অর্থাৎ শ্বাসকে পেটের-বুকের ভিতর নিয়ে ১০ সেকেন্ড থেকে ধীরে ধীরে ১ মিনিট রুখে দেবার চেষ্টা করুন।  ব্যাস কেল্লা ফতে।  আপনি এখন রোগমুক্ত জানবেন। 

-------------    
সিদ্ধাসনে বসা যায় যেকোনো সময়।  কিন্তু নিজেকে প্রশ্ন করুন, কেন বসবেন ? সিদ্ধাসনে বসে কুম্ভক করতে হয়, অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে রুদ্ধ করতে হয়। আজ্ঞাচক্রে মন নিবিষ্ট করতে হয়। সৃষ্টিশক্তিকে রুদ্ধ করতে হয়, এগুলো, খাবার ৪/৫ ঘন্টা পরেই করা উচিত। খাবার পরে বজ্রাসনে বসা যায়, তাতে পেটের  খাবার হজমে সাহায্য করে। সিদ্ধাসন নিতান্ত কোনো ব্যায়াম, মুদ্রা বা আসন নয়। সিদ্ধাসন একটি উচ্চাঙ্গের সাধন প্রক্রিয়া।
----------------------------  

মানুষ কেন বুড়ো হয় ? 

শুধু মানুষ কেন, সমুদয় জীব জন্তু এমনকি ইট কাঠ পাথর ধীরে ধীরে বুড়ো হয়ে যায়।  কিন্তু কেন ? আজ আমরা জীবকুলের বুড়ো হওয়ার কারন অনুসন্ধান করবো। 

জীব দুই প্রকার, এককোষী জীব, এবং বহুকোষী জীব। এই এককোষী জীবটির কোষ বৃদ্ধি পেতে পেতে একসময় পরিণতি প্রাপ্ত হয়। আর বহুকোষী  জীবের ক্ষেত্রে কোষের বিভাজন ঘটে থাকে বার বার। ফলত কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবং কালান্তরে এই কোষগুলোই বিন্যস্ত হয়ে বিভিন্ন অঙ্গ -প্রতঙ্গ সৃষ্টির মাধ্যমে জীবের পূর্ন অবয়ব প্রকাশ পায়। জীবের এই বিকাশের সাথে কোষের বিভাজন একই সাথে ঘটতে থাকে। বিকাশের সময় যে মাত্রাগত পরিবর্তন তাকে বলা হয়, বৃদ্ধি। আবার এই বিকাশের সময় কোষের যে গুনগত পরিবর্তন হয়, তাকে বলা হয়, পরিস্ফুরন বা differentiation. অর্থাৎ একটা হচ্ছে গুনগত পরিবর্তন, আর একটি হচ্ছে পরিমাণগত পরিবর্তন। 

জীবের জন্মের পর থেকেই, এই বৃদ্ধি লক্ষ করা যায়। উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও অংকুর উদ্গমনের পর থেকেই এই বৃদ্ধি  দেখতে পাওয়া যায়। বস্তুত একেই জীবনের বিকাশ বলা হয়ে থাকে। 

সমস্ত জীবের মধ্যে কোষ বিভাজনের মাধ্যমে কোষের মধ্যে গুনগত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। আর এই পরিবর্তন আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে থাকে। এই পরিবর্তনই আমাদের বয়সকে বাড়িয়ে দেয়।  অর্থাৎ একেই বলে বয়সায়ন বা aging । বয়সায়ন হচ্ছে বিভেদের একটা রূপ মাত্র। এই পদ্ধিতির পর জীব বার্ধক্যে পৌঁছে যায়। অন্যদিকে থেকে বলা যায়, জীবের মৃত্যুর আগে, জীবকোষের পরিবর্তনের অবনতির ফলে, সমগ্র জীবদেহে যে অবস্থা দেখা যায়, তাকেই বলে বার্ধক্য। উদ্ভিদের বা গাছের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বেশি বয়সের পাতাগুলোও বুড়ো হয়, আর মৃত্যু ঘটে বা  ঝড়তে থাকে।  

বার্ধক্যে অনেকগুলো কারন আছে।  

 ১. আমাদের শরীরের কোষের অঙ্গাণুগুলো সাধারণ ভাবে ব্যবহারের ফলে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, আর আমরা বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে চলি। 
২. কোষের মধ্যে বিষবৎ (toxic) পদার্থের সঞ্চয়ের ফলে, জীবের বিভিন্ন বিপাক পদ্ধতির অবনতি ঘটে। ৩. জিনগত কারণেও বার্ধক্য সংগঠিত  হয়। 
৪. কোষের mutation বা পরিব্যাক্তির ফলে, আমাদের বার্ধক্য সংগঠিত হয়। 
৫.বিপাকীয় অন্ত্রের ভুলভ্রান্তির ফলে, কোষের মধ্যকার প্রয়োজনীয় পদার্থের অপসারণ ঘটে। 

এইগুলো সবই বাহ্যিক কারন বা জৈবিক কারন।  আসল করেন হচ্ছে,  জীবের বার্ধক্য বা আমাদের জীবন কাল নির্ভর করে আমাদের কোষের মধ্যস্থ  inherent বা সহজাত বৃত্তির উপরে যিনি প্রভাব ফেলছেন তাঁর ইচ্ছের  উপরে। অর্থাৎ আমাদের প্রভুশক্তি।  আমাদের উদ্ভবের মহিমাশক্তি। যে শক্তি আমাদেরকে জন্ম-বৃদ্ধি-মৃত্যুর পরিচালক।  তিনিই আমাদের বার্ধক্যের কারন। জৈবিক কারনেরও  নির্ধারক এই প্রভুশক্তি।   
----------------  

কেউকেউ বলে, আমি নাকি ভালো আছি। না আছে আমার শরীরে কোনো রোগ-ব্যাধি, না আছে সুখ-দুঃখের  উচ্ছাস। আমি ভালো আছি। আমি কেন ভালো আছি ? 

১. ভালো থাকার  উপায় সম্পর্কে যে যা বলে, আমি সেসব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনি। কিন্তু প্রয়োগ করি না। ভক্তিভরে প্রত্যাখ্যান করি। 
২. খারাপ সময় এলে, আমি আমার কর্তব্য কর্ম্মে ঝাঁপিয়ে পড়ি। লোকে বলে খারাপ সময়, বিশ্রামের সময়। এই সময় নাকি যে কাজই করা হোক না কেন, তা নাকি শুভ ফল প্রদান করে না। আমি উল্টোটা করি, আমি মনে করি, ভালো সময়ে যে কাজে অবহেলা করেছিলাম, সেগুলো এখন ভালোভাবে করবার সময়।  আমার এখন প্রায়শ্চিত্তের সময়। কেননা এই খারাপ সময়ের জন্য আমিই দায়ী। 
৩.খারাপ সময় এলে, আমি আমার পরলোকগত পিতা-মাতাকে আঁকড়ে ধরি। সকাল সন্ধ্যে তাঁদের উদ্দেশ্যে জল দান  করি, প্রার্থনা করি। 
৪. গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে, মনে মনে আমি মায়ের কোলে অথবা বাবার বুকে ঘুমুবার চেষ্টা করি। 

৫. খারাপ সময়ে আমি অবশ্য়ই নিরামিষ খাওয়া শুরু করি। এইসময় ঝাল-মসলা কম খাই। সাত্ত্বিক আহার গ্রহণ করি। শরীর যা সহজে গ্রহণ করতে পারে, সেইমতো পরিমিত আহার গ্রহণ করে থাকি।   
৬. খারাপ সময়ে আমি সবাইকে ক্ষমা করে দেই। কারুর সঙ্গে বিবাদে যাওয়া তো দূরে থাকুক, আমি ছোট-বড়ো  সবাইকে সমীহ করে চলি। 
৭. খারাপ সময় আমি কথা কম বলি, তবে নিজের সঙ্গে, অনেক সময় আয়নার সামনে নিজেকে দাঁড় করিয়ে নিজেকেই বকাঝকা করি। আবার বলি, তুমি খুব ভালো। যা কিছু ভুল করেছো, তাতে তোমার কোনো দোষ নেই। পরিবেশ এর জন্য দায়ী, তুমি নও। 
৮. খারাপ সময়ে আমি ভালো-মানুষের সঙ্গে মিশি।  শিশুদের সঙ্গে মিশি। তাদের মতো হয়ে যাবার চেষ্টা করি, বা অভিনয় করি । অসহায়-দুর্বলদের সঙ্গে থেকে, তাদের কষ্ট  লাঘব করবার চেষ্টা করি। তাদের কাছথেকে  তাদের কষ্টের কথা শুনি।  
৯. খারাপ সময় আমি হেড়ে  গলায় কীর্তন শুরু করে দেই।  কখনো কীর্তনের আসরে বসে কীর্ত্তনীয়াদের সঙ্গে গলা মেলাই। কখনো  বাড়িতে ভজন-কীর্তনের গান চালিয়ে তন্ময় হয়ে শুনি।
১০. খারাপ সময়, আমি বাড়িঘর পরিষ্কার করা শুরু করে দেই।  জমে থাকা আবর্জনা, অপ্রয়োজনীয় শিশি-বোতল, প্লাস্টিকের ব্যাগ, ইত্যাদি বাইরে বের করে দেই। 
১১.খারাপ সময় আমি মহাপুরুষের জীবনীর বই নিয়ে পড়তে বসে যাই। জপ-ধ্যানে সময় বাড়িয়ে দেই।  এমনকি রাতে ঘুম না এলে বিছানায় বসে ধ্যান-জপে নিমগ্ন থাকবার চেষ্টা করি। 
১২.অনেকে বলেন, কষ্টের কথা অন্যকে বললে, কষ্টের লাঘব হয়, আমি কিন্তু তা করি না। আমি যাকিছু কথা তখন আমি  আমার পরলোকগত  মা-বাবার সঙ্গে শেয়ার  করি।
১৩. খারাপ সময়কে আমি মনে করি, ভালো হবার সময়।  এই সময় বিশ্বশক্তি আমাকে অধিক শক্তি প্রদান করছেন। 
১৪.খারাপ সময়ে আমি পশু-পাখিদের খাওয়াই। তাদের পরিচর্যা করি। তাদের সঙ্গে কথা বলি। 
১৫. আমার খারাপ সময়ে ওং দুর্গতি নাশিনী দুর্গে আমার দুঃখ হরণ করো বা "ওঁং দূর্গা" জপ করতে থাকি। কারন বর্ণ হলো ভাবের প্রতীক। প্রত্যেক বর্ণের আকর্ষণী বিকর্ষণী ক্ষমতা আছে।  কিন্তু  "দ" হচ্ছে এমন একটি বর্ণ যা এই আকর্ষণ-বিকর্ষণের মধ্যাবস্থায় বিরাজ করছে। এর সঙ্গে "ঊ" যোগ করলে আকর্ষণ ক্ষমতা বাড়ে। "গ" হচ্ছে তেজের প্রতীক। "র" হচ্ছে শক্তির প্রতীক। এর সঙ্গে আ অর্থাৎ স্ত্রী  লিঙ্গ বোধক স্বরবর্ণ । এই জপে আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি ধীর হয়ে  যায় এবং এই দুইয়ের (নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস) মধ্যে অন্তর-ক্ষণ বাড়তে থাকে।  ফলে আমি পরমার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম অনুভব করি।
   
সবশেষে বলি, মনুষ্য জীবনকাল, আসলে দুঃখের সময়। সুখের ঝলক আসতে  না আসতেই মিলিয়ে যায়। সমগ্র জীবনটাই আসলে খারাপ সময়।   তাই সমগ্র  জীবন কালকেই আমি প্রায়শ্চিত্তের সময় বলে মনে করি। আর ঈশ্বরের নির্দেশে নিজের কর্তব্য সমাধানে ব্যস্ত থাকি।  আর ব্যস্ত থাকলে দেখেছি, আমার মধ্যে কোনো দুঃখের উদয় হতে পারে না। মাত্র ৭০-৮০ বছর জীবনকাল।  দেখতে দেখতে কেটে যাবে। আমি আবার স্ব-স্বরূপে ফিরে যাবো। 
৪.১০.২১ 
বনের বানর যদি কখনো লোকালয়ে ঢুকে পরে, আর মানুষের হাত ধরা পড়ে, তবে এইসব বানর ফিরে গেলে, বনের বানর তাকে দলে মিশতে দেয়  না। সাপ নিয়ে যারা খেলা করে, সাধারণ মানুষ তাদের থেকে শতহস্ত দূরে থাকে। শুধু দূর থেকে সাপের খেলা দেখে। আপনি যদি সাধু হয়ে যান,  তবে  সাধারণ মানুষ আপনাকে সম্ভ্রমের চোখে দেখবে। কিন্তু নিজের লোক ভাববে না।  আপনাকে  যখন সে অন্ন ভোজন করাবে, তখন সে আপনার জন্য আলাদা করে নিরামিষ এনে দেবে। তো আপনি যদি সাধু হতে চান, তবে আপনি সত্যিকরে সাধু হয়ে যান । সাধারণ সমাজ থেকে আর পাঁচজনের মতো ব্যবহার আশা করবেন না। আধা-সাধু বা আধা-সাধারণ হতে যাবেন না। আরো একটা কথা জানবেন, বিপদে পড়লে, সাপ-ব্যাঙ একত্রে বাস করে, বন্যার সময় মানুষ আর সাপ একই গাছে থাকতে পারে।  কিন্তু তাই বলে ভাববেন না যে সাপ ভয় পেলে, তার স্বাভাবিক হিংসা পরিত্যাগ করবে। বা আপনি অহিংস মনোভাব নিয়ে  সাপের মাথায় হাত বোলাতে গেলে, আপনাকে সাপ ছেড়ে দেবে। অবস্থা বুঝে চলুন।  আপনি যা আপনি তাই থাকুন, আপনি যেমন, তেমন লোকের সাথে বন্ধুত্ত্ব গড়ে তুলুন।

মনকে শান্ত করবার সাতটি উপায়।  

শিশু অর্থাৎ যারা এখনো অজ্ঞান তাদের শান্ত করবার জন্য, আমরা দুটো উপায় অবলম্বন করে থাকি। প্রথমত তাকে বিষয় থেকে নিবৃত্ত করা।  ধরুন বাচ্ছাটা কান্না কাটি করছে, কারন সে ব্যথা পেয়েছে। বা সে মাকে  দেখতে পাচ্ছে না। তো আপনি কি করবেন ? আপনি তার মনটাকে ঘুরিয়ে হয় খেলনার দিকে, বা চাঁদের দিকে ফেরাবার চেষ্টা করবেন। আয় আয় চাঁদমামা, গোপালের  কপালে টিপ্ দিয়ে যা। তো তখন শিশুর মন ঘুরে যাবে। আর কান্না থামিয়ে সে খেলনা বা চাঁদের দিকে মন দেবে।  কান্না থেমে  যাবে। ঠিক তেমনি, আমাদের মন যখন বিষয়গত কারনে উদ্বিগ্ন বা চঞ্চল হচ্ছে, তখন  এই অস্থির মনকে শান্ত করবার জন্য, সেই অস্থিরতার কারন যে বিষয় চিন্তা সেখান থেকে তাকে সরিয়ে অন্য বিষয়ে নিবদ্ধ করা।  এতে করে মন শান্ত হয়ে উঠবে।  

২) অস্থির বাচ্চা ছেলেকে শান্ত করবার জন্য, যেমন  আমরা তাকে ধমক দিয়ে বসিয়ে রাখি, তেমনি মনকে শান্ত করবার জন্য আমাদের মৃত্যু চিন্তা করা উচিত।  মৃত্যু চিন্তা করলেই দেখবেন, মন এক লহমায় শান্ত হয়ে গেছে। মনকে শান্ত করবার এটি সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। 
  
৩) মহাত্মা গন বলছেন,  নাসিকাগ্রে,  তালুতে প্রভৃতি ইন্দ্রিয়স্থানে মনকে ধারণা বা একাগ্র করলে, অলৌকিক দিব্য  গন্ধাদির সাক্ষাৎ লাভ হয়, এতেকরে আমাদের শাস্ত্রে বিশ্বাস বা আগ্রহ জন্মে এবং চিত্ত স্থির হয়।
৪) হৃদয়মধ্যে প্রকাশশীল চিত্তসত্ব বিষয়ে ধারণা  করলে, শোকরহিত জ্যোতির্ময়ী প্রবৃত্তি উৎপন্ন হয়, তাতেও চিত্তের স্থৈর্য সম্পাদন হয়।
৫) যাঁদের মধ্যে আসক্তি নেই, তেমন মহাপুরুষের চিত্তে সমাধি করলে চিত্ত স্থির হয়। 
৬) স্বপ্নে দেখা, দেবতামূর্তি অথবা সাত্ত্বিকী সুষুপ্তি-বৃত্তিকে অবলম্বন দ্বারাও, যোগীর চিত্ত স্থির হয়। 
৭) সুখদায়ক কোনো স্মৃতি মনের মধ্যে জাগিয়ে তুললে, মন আনন্দে  ভরপুর হয়ে ওঠে ও চিত্ত স্থির হয়।

২৭/১০/২০২১
চোখ বুজলে ভগবান, আর চোখ মেললে ভগবান নেই ? এই কথা হৃদয় দিয়ে বুঝতে গেলে নির্বিকল্প সমাধির প্রয়োজন। তো একদিন, এই উচ্চকোটির সাধক সন্ধ্যার পরে,  নির্বিকল্প সমাধিতে আরূঢ় হলেন। সঙ্গে এক বন্ধু - নাম গোপাল।  একসময়  সাধকের মনে হলো. যেন মাথার পিছন ভাগে উজ্জ্বল আলোকরাশি প্রজ্বলিত হয়েছে।  দেখতে দেখতে সেই আলোর  ক্রমবর্ধমান জ্যোতিঃ  সমস্তকিছুকে ছাপিয়ে  সর্বত্র পরিব্যাপ্ত  হয়ে উঠলো। বিশ্বসংসার যেন দুলতে থাকলো। মন বাহ্য জগৎ ছেড়ে, এক অখন্ড-জ্যোতিঃ-সমুদ্রের মধ্যে নিমজ্জিত হলো। তখন দেশ-কাল-পাত্রের আর বোধ রইলো না। থাকলো শুধু এক অখন্ড সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মসত্তা। দেহ-বোধ লোপ পেয়ে গেলো। ভাষা হারিয়ে গেলো।  যেন মহাসমুদ্রের জল বই কিছুই নেই। একসময় মনে হলো, দেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিলোপ সাধন হয়ে গেছে। কিন্তু মস্তিস্ক বোধ রয়ে গেলো। সাধক কাতর কন্ঠে অস্ফুট শব্দে গোঙাতে গোঙাতে বলে উঠলো,গোপালদা আমার শরীর কোথায় গেলো ? গোপাল সাধকের দেহের বিভিন্ন স্থানে টিপে টিপে বলতে লাগলো, কেন ? এই তো এই-যে।  তবু সাধকের মনে হতে লাগলো, তার মুখখানি শুধু আছে, আর কিছু নেই। গোপাল ভয় পেয়ে গেলো। সবাইকে ডাকতে লাগলো, ঠাকুর   এসে বললেন, "বেশ হয়েছে, থাকে খানিক্ষন এই রকম ভাবে। এরজন্যই ও আমাকে জ্বালাতন করে তুলেছিল। এই সাধক  আর কেউ নয়, নরেন্দ্র নাথ দত্ত।  

২৯.১০.২১
শব্দই ব্রহ্ম :
উপনিষদের ঋষিগণ বলছেন, "শব্দই ব্রহ্ম"।  শব্দ আমাদের কর্নেন্দ্রিয় দ্বারা গোচারীয়ভূত হয়। শব্দকে আমরা অনুভব করতে পারি। কিন্তু এই শব্দই ব্রহ্ম এই অনুভূতি আমাদের নেই। কেননা ব্রহ্ম আমাদের অনুভূতিতে আসে না। তাহলে কি যে শব্দ আমাদের অনুভূতিতে আসে, সেই শব্দ ছাড়াও  আলাদা কোনো শব্দ আছে, যাকে ঋষিগণ "ব্রহ্ম" বলছেন ? 

দেখুন শব্দ দুই প্রকার অনাহত, আর আহত। আঘাতের সাহায্যে যে শব্দের উৎপত্তি হয়, তাকে বলে আহত শব্দ, যা আমাদের  সাধারণ ভাবে শ্রুতিগোচর হয়। আর কোনো আঘাত ছাড়াই যে শব্দ প্রতিনিয়ত ধ্বনিত হচ্ছে তাকে বলা হয় অনাহত শব্দ।  এই অনাহত শব্দকে ঋষিগণ বলছেন "নাদ"। এখন এই নাদ বা অনাহত শব্দকে কেন ব্রহ্ম বলছেন, সেটা আমরা একটু বুঝবার চেষ্টা করি। 

আমরা জানি আকাশের গুন্ হচ্ছে শব্দ। এই আকাশ বিশ্বচরাচর ব্যাপ্ত হয়ে আছে।  এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে আকাশ নেই। আকাশ নিত্য ও অনাদি। 

এখন শব্দ বলতে আমরা কি বুঝি ? যা শুনলে, বা যা উচ্চারিত হলে, আমাদের মধ্যে কোনো বস্তুর উপলব্ধি হয়, বা জ্ঞানের উদয় হয় তাকে আমরা শব্দ বলে থাকি। অর্থাৎ শব্দ আমাদের কাছে অর্থবোধক। শব্দ থেকেই আমাদের মধ্যে  বস্তুর বা ভাবের অর্থ বোধগম্য হয়।

এখন কথা হচ্ছে অর্থ বলতে আমরা কি বুঝি ? যা অর্থিত বা যাচিত তাই আমাদের কাছে অর্থ। অর্থাৎ শব্দের কাছে আমরা যা যাচ্ঞা করি, তাকেই শব্দের অর্থ বলা হয়ে থাকে। আর এই অর্থকে কে প্রকাশ করে, না অর্থকে প্রকাশ করে শব্দ। অতয়েব শব্দের সাথে অর্থের একটা সম্মন্ধ আছে। অর্থাৎ শব্দ হচ্ছে প্রকাশক, আর অর্থ হচ্ছে প্রকাশ্য। 

শব্দ আবার দুই প্রকার ধ্বনাত্মক ও বর্ণাত্মক। অর্থাৎ একটা হচ্ছে ধ্বনি, আর একটি হচ্ছে বর্ণ। আমাদের কন্ঠ-জিহবা-নাক-মুখ থেকে যে শব্দ বের হয়, তাকে বলা হয় বর্ণ। আর বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের থেকে শব্দের উদ্ভৱ হয়, তাকে বলা হয় ধ্বনি। এই দুই ধরনের শব্দই শ্রুতিগোচর। অর্থাৎ আমরা কান দিয়ে শুনতে পাই। শব্দের একটা শক্তি আছে, অর্থাৎ শব্দ যখন আমাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে, তখন কোনো না কোনো স্বরূপের প্রকাশ করে, অথবা কোনো না কোনো মানস ক্রিয়া বা জ্ঞান উৎপাদন করে থাকে।আবার  দেখুন, আমরা যখন হাসি, কান্নাকাটি করি, উদ্বেগ প্রকাশ করি, বা ভয় পাই, তখন আমরা বিভিন্ন ধরনের শব্দের সৃষ্টি করে থাকি, এর কোনো নির্দিষ্ট অর্থ নেই, কিন্তু এইসব শব্দ মাত্রেই একটা মানসিক বিকার বা অবস্থার প্রকাশ করে থাকে। অর্থাৎ এইসব শব্দের মধ্যে কোনো ছবি সংলগ্ন নেই কিন্তু একটা মানসিক অনুভূতির প্রকাশ হয়ে থাকে।  তেমনি, আমরা যখন বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি শুনি, তখনও আমাদের মনের মধ্যে একটা বিকার বা উৎফুল্ল ভাবের জন্ম হয়। 

বর্ণ বলতে আমরা সেই শব্দকে বুঝি তা মানুষের কন্ঠ থেকে বুদ্ধিসহযোগে নির্গত হয়। অর্থাৎ এর একটা অর্থ আছে। তা হতে পারে কোনো বস্তুর প্রতিচ্ছবি বা মনের ভাবের প্রতিচ্ছবি। তো ধ্বনি বা বর্ণ উভয়ই আহত শব্দ।  অর্থাৎ কোনো না কোনো আঘাতের ফলে এর জন্ম হয়েছে।
 কিন্তু আহত শব্দের অতীত এক প্রকার শব্দ আছে, যাকে  বলা হয় অনাহত  ধ্বনি। একে মহাত্মাগণ বলে থাকেন অশরীরি বাণী। এই অশরীরি বাণী আমাদের হৃদয় আকাশে উদ্ভূত হয়। আমাদের হৃদয় থেকে অনেক কথা বা বাণী আমরা শুনতে পাই। এই অশরীরি বাণী আমরা কানে শুনি না, কিন্তু উপলব্ধি করি।আবার আমাদের শরীর যখন বিভিন্ন তপঃ সাধনার দ্বারা শুদ্ধ হয়, মন যখন সংযত হয়, তখন আমাদের বুদ্ধির উৎকর্ষতা দেখা দেয়। আবার সাধক যখন ধ্যান সাধনা দ্বারা নিজেকে উচ্চস্তরে নিয়ে যেতে পারেন, তখন আমাদের মধ্যে সত্ত্বগুণের উৎকর্ষতার ফলে ও বুদ্ধি নির্মল হলে, সাধকের বহু ভাগ্যফলে, সাধকের দক্ষিণ দিকের কানে, এক অস্ফুট নাদধ্বনি প্রকাশিত হয়। যা তার একান্ত নিজস্ব সম্পত্তি। শব্দ বা ধ্বনি অর্থাৎ আহত ধ্বনি আমরা সবাই যারা নির্দিষ্ট পরিসরে অবস্থান করছি, তারা সবাই শুনতে পাই। কিন্তু অনাহত ধ্বনি কেবল সাধক শুনতে পান। এইজন্য বলা হয়ে থাকে নাদধ্বনি কেবল সাধকের শ্রুতিগোচর হয়।  ........  এখন এই অনাহত ধ্বনির মধ্যে কি রহস্য আছে, যার জন্য স্বয়ং  "ব্রহ্ম"কে এই শব্দের মধ্যে অনুভব করা যায়, তা আমরা পরের দিন শুনবো। 

-------------
শব্দই ব্রহ্ম (২)
এখন পদ বা শব্দবোধ্য অর্থের নাম হচ্ছে পদার্থ। আবার বলি কথাটা, পদ+অর্থ = পদার্থ। বাক্যের অর্থের দ্বারা যাকে  প্রতিপন্ন করা হয়, তাকে বলা হয় পদার্থ। যেকোনো পদার্থকে আমরা শব্দের দ্বারা  বুঝি ও তাকে চিহ্নিত করি। বিষয়ের উর্দ্ধে অর্থাৎ বাক্যের অতীত যা তাকে বলা হয়ে অজ্ঞেয়। আর যা বাক্যের বিষয়ভূত অর্থাৎ যাকে  আমরা বাক্য দ্বারা প্রকাশ করতে পারি, তাকে বলা হয় জ্ঞেয়। অর্থাৎ যে বস্তু আমাদের জ্ঞানের-শক্তি মাধ্যমে  বাক্যের আকারে প্রকাশিত হয়,  আমরা তাকে জ্ঞেয়বস্তু বলে থাকি। জ্ঞেয়বস্তু আমাদের জ্ঞানের অধীন। অর্থাৎ যা কিছু আমরা চিন্তা করতে পারি, এবং বাক্যের দ্বারা প্রকাশ করতে পারি, তাকেই আমরা পদার্থ বলে থাকি।  জগতে এমন কোনো পদার্থ নেই, যার কোনো নাম নেই। নাম আর নামি তাই আমাদের কাছে একই। আমাদের স্বপ্ন, আমাদের কল্পনা, আমাদের চিন্তা, আমাদের অভাববোধ সবই আমরা বাক্যের দ্বারা প্রকাশ করতে পারি।  তাই এগুলো সবই পদার্থ। আঘাতের দ্বারা যে শব্দের উৎপত্তি হয়, তাকে বাচক বলা হয়ে থাকে। এই বাচক শব্দই  সংকেত বাহক। শব্দ  ও অর্থ দুই-এর প্রকারে  প্রকৃতির পরিনাম বা পরিণতি নির্মাণরূপ আবহের সাথে প্রতিনিয়ত গতিশীল হয়ে চলেছে। সুতরাং শব্দই পরিনাম বাচক। এই আকাশতত্ত্ব বা শব্দতত্ত্ব বিভক্ত হয়ে, মরুৎ বা বায়ু, তেজ, বা অগ্নি, অপ বা জল ক্ষিতি বা পৃথিবী - এই ভিন্ন ভিন্ন পদার্থরূপে অবস্থান করছে। প্রকৃতি যেমন শব্দময়, তেমনি শব্দও প্রকৃতিতে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। 

উপনিষদ বলছেন, শব্দ স্ব-প্রকাশ। শব্দ নিজেই নিজের প্রকাশক। আবার শব্দ অর্থের প্রকাশক । বলা হয়ে থাকে, প্রণব  শব্দ বিশ্ব প্রকাশক। বলা হয়ে থাকে শব্দশক্তির (প্রণব) মাধ্যমেই জগৎ প্রতিভাত হয়েছে। শব্দজ্যোতি যদি না থাকতো, তবে  ত্রিভুবন অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকতো। এখন আমাদের ধারণা  হচ্ছে, আলো বা আলোক রশ্মিই জগৎকে প্রকাশ করেছে। সূর্য্যের উদয়ে  সর্ব্ববস্তুর প্রকাশ হয়। আসলে শব্দ-ব্রহ্মই সূর্য্যের প্রকাশক। সূর্য জগতের অংশমাত্র।   শব্দ-জ্যোতির কারনে জগতের উদ্ভব হয়েছে। মহাত্মাগণ বলছেন,  শব্দই আমাদেরকে রাজা-প্রজা, মাতা-পিতা, ভাই-বোন ইত্যাদির বোধশক্তির জন্ম দিয়ে থাকে। আবার এই শব্দের মধ্যেই আছে সমস্ত জ্ঞানভাণ্ডার। আমাদের ইতিহাস বলুন, পুরাণ বলুন, বেদ বলুন, উপনিষদ বলুন সবই কেবল শব্দ ভান্ডার মাত্র। শব্দ না থাকলে, আমরা ধর্ম্ম-অধর্ম্ম, ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, কিছুই জানতে পারতাম না। শব্দই সমস্ত কিছুকে প্রকাশ করে থাকে। শব্দই আমাদের চেতনা বা জ্ঞানজ্যোতিঃ  দান করছে।  বলা হয়ে থাকে স্বয়ং ব্রহ্মের প্রকাশক হচ্ছে শব্দ।  অর্থাৎ শব্দই পরাব্রহ্ম। শব্দ থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, তেমনি শব্দেই তার স্থিতি, আবার শব্দেই বিলীন হয়ে যায়। শব্দই বিশ্বকে বন্ধনের দ্বারা আবৃত করে রেখেছে। শব্দ চক্রেই সমস্ত কিছু আবৃত হচ্ছে। 

পদার্থের বিভাজন পরিণতি হচ্ছে পরমাণু, আবার পরমাণুর একত্রীকরণ পরিণতি হচ্ছে পদার্থ। অতয়েব, পদার্থের যদি শব্দগুন্  থাকে তবে পরমাণুতেও  শব্দ গুন্ আছে। আবার পরমাণুর যে  কার্য্যশক্তি বা পরমাণুর যে কারণশক্তি তার মধ্যেও শব্দ আছে। বিন্দু বা পরমাণু হচ্ছে বস্তুর শেষ বিভাজ্য বস্তু।  অর্থাৎ যার আর বিভাজন করা যায় না। কাকে আমরা  বিন্দু বলি, যার অস্তিত্ত্ব আছে, কিন্তু তার আর ভাগ হতে পারে না। অর্থাৎ ভাগের অতীত এই পরমাণু। অন্য দিক থেকে বলা যায়, শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ এই যে শক্তিগুন এর শেষ বিভাজ্য বস্তু হচ্ছে বিন্দু।  

এখন ব্রহ্ম কাকে বলে, যার বিভাজন নেই, যার ক্ষয় নেই, অর্থাৎ পদার্থের শেষ সীমায় যিনি অবস্থান করছেন তাকেই বলা হয়ে থাকে ব্রহ্ম।  অর্থাৎ সমস্ত সৃষ্টির কারন-রূপে  যিনি অবস্থান করছেন। যার সীমা নেই, যার ক্ষয় নেই, যাকে বিভাগ করা যায় না, তাকেই বলা হয় ব্রহ্ম। আবার এই পদার্থই কিন্তু এক এবং শব্দময়। সুতরাং বলা যেতে পারে, শব্দ, পরমাণু, বিন্দু, বা ক্ষণ সমস্তই এক ব্রহ্ম-পদবাচ্য। 

এখন কথা হচ্ছে, এই তিন  আলাদা ভাবে প্রত্যক্ষভূত নয়। কিন্তু সমষ্টিভূত অবস্থায় প্রতক্ষ্য-গোচর হয়, এবং আমাদের বুদ্ধির গোচর  হয় ।  যখন দুই বস্তুর সংঘাতে শব্দ শ্রুত হয়, তখন তা ব্রহ্ম অনুসৃত। অব্যক্ত অবস্থায় চেতনার মধ্যে ছিল, আবার অচেতনের মধ্যেও ছিল। এই  দুয়ের সংযোগে অব্যক্ত শব্দ ব্যক্ত হলো। এই ব্যক্ত শব্দই প্রণব মন্ত্র বা ওঙ্কার। 

বলা হয়ে থাকে, পরমেশ্বর জগৎরূপ ধারণ করবার সময় বিন্দু, নাদ ও বীজ এই ত্রিধা-বিভক্ত অবস্থায় ছিল। বিন্দু হচ্ছে শিব, বীজ হচ্ছে শক্তি, আর এই শিব ও শক্তির মিলনে হচ্ছে নাদ। অর্থাৎ নাদ শিব-শক্তি-আত্মক। আমরা জানি চাঁদ ও সূর্য যে-যে আধারে প্রতিবিম্বিত হয়, সেই আধারে তখন স্পন্দন ওঠে, আধার তখন চঞ্চল হয়ে ওঠে, আবার এই  শব্দ বা নাদতত্ত্ব হচ্ছে এই আধারের নির্মাতা। সমস্ত আধারে, তা সে পৃথিবী বলুন বা চন্দ্র-সূর্য বলুন, গ্রহ-নক্ষত্র বলুন, সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত আধার এই শব্দব্রহ্ম থেকে সৃষ্ট। বিশ্ব ব্রহ্মান্ডেরও  হয়তো সীমা  থাকতে পারে, কিন্তু শব্দের কোনো সীমা  নেই। শব্দ অনন্ত। বিশ্ব-জগৎ শব্দব্রহ্মের পরিনাম।  আদি অনাদিকাল থেকেই এই শব্দব্রহ্ম (প্রণব বা ওঙ্কার)   জগৎ-আকারে বিবর্তিত হয়ে চলেছেন। তাই উপনিষদের ঋষিগণ বলছেন, "শব্দই ব্রহ্ম"। বাক্যের মাধ্যমে অর্থাৎ শব্দের মাধ্যমে (ওঙ্কার) আমরা সেই পরমপুরুষের উপলব্ধি করতে পারি। এগুলো কোনো কল্পকথা নয়, এগুলো ভারতীয় মুনিঋষিদের অনুভূতিলব্ধ জ্ঞান। আজও এই সত্য অনড়।  

এর পরের ভিডিও-গুলোতে (কমিউনিটিতে নয়)  আমরা সূর্যবিজ্ঞান সম্পর্কে কিছু কথা শুনবো। শুন্য থেকে কি কিছু সৃষ্টি করা যায়। আমরা অনেক সাধু সন্যাসীর সম্পর্কে শুনে থাকি, তাঁরা তাদের শিষ্যদেরকে বাঞ্চিত ফল, দ্রব্য শূন্য থেকে এনে চমকে দিচ্ছেন। কেউ বলেন এইগুলো বুজরুকি, কেউ বলেন ভেলকি বা ম্যাজিক, কেউ বলে আমরা শুনেছি, বা দেখেছি । আমরা জানতে চাই সত্য কি ? শূন্য থেকে কি মানুষের জন্ম হতে পারে ?    

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ 

৩০.১০২০২১।
সাধকের সাধনায় যত  উন্নতি হতে তত তার মধ্যে একটা পরিবর্তন হতে দেখা দেয়। 

১. প্রথম পর্য্যায়ে আমাদের মনে হয়, আমিই সমস্ত কার্য্যের কর্তা। আর এই সুখ-দুঃখ আমারই কর্ম্মের ফল। এই অবস্থা আমাদের সংসার বা বদ্ধ অবস্থা। 
২. দ্বিতীয় পর্যায়ে, একটা সময়ে এসে মনে হয়, আমি করছি বটে কিন্তু কেউ যেন আমাকে দিয়ে করাচ্ছে। সমস্ত কর্ম্মের ফল আমার কর্ম্ম অনুসারে হচ্ছে না। তখন নিজেকে আর কর্তা  মনে হয় না।  এটা ঠিক সাংসারিক অবস্থা নয়। আবার দেহাত্ম-বুদ্ধির উপরেও নয়। এই অবস্থায় স্থিতি লাভ করলে, সাধকের জীবনমুক্তির অভিব্যক্তি ঘটে থাকে। এইসময় বিবেকের নির্দেশে সে কাজ করে থাকে। 
৩. একসময় বিবেকের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। আর কাজ করবার মতো অভিমান থাকে না।  মনে হয়, প্রকৃতিই সব কিছু করছে। 
৪. এর পরে আরও একটা স্থিতি আছে।  তখন মনে হয়, আমি করছি না, তবে করছে কে ? এই প্রশ্ন বারবার মনে উঁকি দেয়। কে তিনি ? এটি জ্ঞানমিশ্র ভক্তির অবস্থা। 
৫. এর পরে মনে হয়, ধীরে ধীরে শুদ্ধ ভক্তির উদয় হয়।  তখন মনে হয়, তিনি করেন না, তিনি করান।  তার দ্বারা আমিই করি। তিনি যন্ত্রী  আমি যন্ত্র। তিনি নাচান আমি নাচি। এই অবস্থায় জ্ঞান ও ভক্তি, উভয়ের বিকাশ দেখা যায়। আবার শুদ্ধা ভক্তিও কাজ করে থাকে। 
৬. এর পরে লীলারসের আস্বাদন শুরু হয়। এই স্থিতির প্রকাশ ভাষায় যথাযথ প্রকাশ সম্ভব নয়।   
..............................       

২.১১.২০২১
জীবন রহস্যে ঢাকা। জীবনকে উন্মোচন না করলে, জীবনের রহস্যঃ উদ্ঘাটন করা সম্ভব নয়। আমরা এই রহস্যঃ উন্মোচনের জন্য, বাহ্যিক সাহায্যের অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু গুরুদেব বলছেন, সহজে কাউকেই বিশ্বাস করে নিজের জীবনকে উজাড় করে দেওয়া উচিত নয়। বিশ্বাস করলেই ঠকতে হবে। জগৎ তোমার বন্ধু নয়, জগতের সমস্ত কিছু তোমার থেকে আলাদা। জগতের প্রত্যেকটি অনু -পরমাণু তোমার থেকে আলাদা। তোমার বন্ধু একমাত্র তুমিই। তো তুমি তোমার এই মিত্রকে ভুলে জগতের দিকে আকৃষ্ট হয়ো না। নিজেকে জগতের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলো না। বরং যা হয়েছে সেটা এক্ষুনি শেষ হতে দাও। জগৎ থেকে নিজেকে গুটিয়ে আনো। তাহলে তুমি তোমার নিজের পূর্ন ঘনীভূত রূপ দেখতে পারবে। যা তোমার প্রকৃত বন্ধু। যা তোমার সবথেকে প্রিয়বস্তু। আর এই প্রিয়বস্তুর সন্ধানে, কস্তুরী নাভীর সন্ধানে,   তুমি হরিনের মতো জঙ্গলের মধ্যে ইতস্তত ঘুরে  মরছ। কত জন্ম যে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গেছো, সে কথাও তুমি বিস্মৃত হয়েছো। এবার এঁকে  পেয়ে শান্তি লাভ করো। বিশ্বাস বড়ো  দুর্লভ বস্তু, এঁকে  যেখানে সেখানে স্থাপন করো না। প্রতিপদে পরীক্ষা করো। প্রতিপদে প্রশ্ন করো। প্রতিপদে প্রতিবাদ করো। তবেই সত্য তোমার কাছে উপস্থিত হবে। নিজেকে ঝাঁকাও, নিজেকে কাদা ছানার মতো করে ছানো, তবে তা দিয়ে প্রতিমা তৈরী হবে। নিজেকে রোদে রেখে তপঃ সাধনা করো। তখন তোমার কাছে সত্য প্রকাশ হবে। আর  এই সত্যে প্রতিষ্ঠিত হলে তোমার বিশ্বাস দৃঢ় হবে। অস্থানে কুস্থানে বিশ্বাস স্থাপন না করে, সংশয় প্রকাশ করো। সংশয় তোমাকে অটল বিশ্বাসে স্থাপন করে দেবে। আর তুমি স্থিতি লাভ করবে। পুরুষাকারকে প্রয়োগ করো। তবেই তোমার জ্ঞানের উন্মেষ হবে। জ্ঞান থেকে আসবে ভক্তি, ভক্তি থেকে শুদ্ধা ভক্তি। শুদ্ধাভক্তি তোমাকে ঈশ্বর সান্নিধ্য এনে দেবে। জীবন সেই সৎ-চিৎ-আনন্দ।  এই উপলব্ধি তোমাকে করতে হবে। এই লক্ষে স্থির  ও দৃঢ় থেকো।  
---------------------- 

বন্ধু, আমি কোনো আচার্য্য নোই, গুরু নোই, সাধনার পথে আমি একজন জিজ্ঞাসু মাত্র।  মনের গভীরে  যে প্রশ্ন জাগে, তার উত্তর খুঁজি মহাত্মাদের বাণীর  মধ্যে। নিরন্তর প্রণব জপ্ সাধককে কিছুক্ষনের জন্য কুম্ভকে স্থিত করে দেয়, এটা স্বাভাবিক । আঙ্গুল বা মালার সাহায্যে জপের সংখ্যা গুনে বা  সংখ্যা না গুনে জপে কখনোই কোনো বিঘ্ন ঘটবার কথা নয়। মন্ত্রের উপরে বিশ্বাস রাখুন। মন্ত্রের যথাযথ অর্থ জেনে নিন। যতদিন বুঝতে না পারেন, যতদিন সন্দেহ না মেটে, যতদিন বিষয় ব্যাকুলতা না মেটে, যতদিন কামনাগ্রন্থি ছিন্ন না হয়,  ততদিন গুরুপ্রদত্ত মন্ত্রকে গলার মালা করে রাখুন। দৃঢ়চেতা হয়ে, আশ্রয়টিকে ধরে রাখুন। জগৎগুরু স্বয়ং শিব বলছেন, সাধনার সময় মন একদিকে ছুটছে, আর আত্মা অন্যত্র গড়াগড়ি খাচ্ছে  অন্যত্র।  আবার প্রাণ একদিকে তো মহাপ্রাণ আর-এক দিকে।  এতে সাধকের লক্ষ্য পূরণ সম্ভব নয়। তন্ময় হয়ে যান। এদিক ওদিক কোনোদিকে লক্ষ্য না করে, আত্মসাক্ষাৎকারের জন্য মনকে ধাবিত করুন।     














   

         

   








      
         

 



   

    

 

     

       
 

      

  


No comments:

Post a Comment