Monday 9 August 2021

মৃত্যুর পরে AFTER DEATH

 


মৃত্যুর পরে 

মৃত্যুর পরে মানুষ কোথায় যায় ?  মৃত্যুর পরে আমাদের দেহ ও বাসস্থান কেমন হবে ?
তথ্যসূত্রঃ ১) "শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা" - মহামতি ব্যাসদেব।  
২)  "জীবন ও মরন" - লেখক : শ্রী ক্ষিতিনাথ ঘোষ। প্রায় ১০০ বছর আগেকার লেখা  একটা পরাবিদ্যার বই। অধুনা বাংলাদেশের যশোহর জেলাবোর্ডের ভূতপূর্ব ইঞ্জিনিয়ার ও তত্ত্ববিদ্যা সমিতির যশোহর পরিনির্বাণ লজ নামক শাখার সম্পাদক শ্রী ক্ষিতিনাথ ঘোষ, বি.এ, বি.ই. মহাশয়ের প্রণীত এই বই। প্রথম প্রকাশ ১৯৫২ সন।  কিন্তু লেখা হয়েছে আরো অনেক আগে।
৩) অন্যান্য গ্রন্থবিশেষ।   

 মানুষের সৃষ্টির  আদিম কাল থেকেই এই প্রশ্ন তার মনে জেগেছে। আসলে আমাদের স্মৃতিশক্তি বড়োই দুর্বল। আমরা ৭দিন আগের দিনপঞ্জি  ভুলে গেছি। এমনকি দুদিনের আগের কথাও  আমাদের  হুবহু আর মনে পড়ে  না। এই স্মৃতি শক্তি যদি আমাদের শক্তিশালী হতো তাহলে আমরা দুদিন আগের কেন, আমাদের পূর্ব-পূর্ব জীবন সম্পর্কে বলতে পারতাম। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, আমার তোমার বহুবার জন্ম হয়েছে, সেসব কথা তুমি জান  না, আমি জানি। অর্থাৎ আপনি-আমি বহুবার জন্ম গ্রহণ করেছি, কিন্তু সেসব জীবনের কথা আমরা ভুলে গেছি। ঠিক তেমনি, যতবার আমরা জন্ম গ্রহণ করেছি, ততবার আমাদের মৃত্যুর সম্মুখীন হতে  হয়েছে।  অতএব  মৃত্যু সম্পর্কেও আমাদের সবার একটা অভিজ্ঞতা আছে। কিছু সেই অভিজ্ঞতার কথা আমরা ভুলে গেছি।  স্মৃতিতে সেই মৃত্যু-দিনের কথা আর মনে পড়ে  না।

 কিন্তু যোগেশ্বর  শ্রীকৃষ্ণের মতো যোগী-মহাপুরুষ সেই স্মৃতি জাগ্রত করতে  পারেন, আর আমাদের মতো সাধারণ মানুষ সেই স্মৃতি জাগ্রত করতে পারি না। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ তো ছাড় অর্জুনের মতো ভাগ্যশালী যিনি স্বয়ং ভগবানের বিশ্বরূপ দর্শন করবার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন,  যিনি জন্ম জন্মান্তর ধরে নারায়ণের সাথী, তিনিও সব ভুলে বসে আছেন। আসলে শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন, যোগারূঢ় মহাযোগী।  তিনি জানতেন কিভাবে এই স্মৃতিকে জাগ্রত করতে হয়। তাই তো তিনি ত্রিকালেশ্বর।  ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান তিনি জানতেন।  

এখন  আমাদের মৃত্যুর পরে কি হবে, কোথায় যাবো, কেমন থাকবো, সেই প্রশ্ন যখন মনে জাগে, তখন আপ্তবাক্য অর্থাৎ মহাপুরুষের কথার উপরে বিশ্বাস করতে হয়, শাস্ত্র-বাক্যের উপরে নির্ভর করতে হে, নতুবা আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, সেই জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা পাবার জন্য। কথায় বলে, যার যেমন ভাব, তার তেমন লাভ।  যোগেশ্বর  শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, একবার যিনি যোগের পথে পা দিয়েছেন, তিনি যদি কোনো কারনে, যোগভ্রষ্টও  হন, তথাপি তাঁর ইহলোকে বা পরলোকে বিনাশ নেই.। এমনকি এই কল্যাণকামী ব্যক্তি কখনো দুর্গতি প্রাপ্ত হন না। এই যোগভ্রষ্ট  সাধক  তার পুন্য-কর্ম হেতু, স্বর্গাদি বা দুর্লভলোক  প্রাপ্ত হন। 

পার্থ নৈবেহ নামুত্র বিনাশস্ত্স্য বিদ্যতে। 
নহি কল্যানকৃৎ কশ্চিৎ দুর্গতিং তাত গচ্ছতি। (৬/৪০)

প্রাপ্য পুনঃকৃতাং লোকানুষিত্বা শাশ্বতীঃ সমাঃ।
শুচীনাং শ্রীমতাং গেহে যোগভ্রষ্টঃ অভিজায়তে।  (৬/৪১)

অথবা যোগিনামেব কূলে ভবতি ধীমতাম। 
এতৎ হি দূর্লভতরংলোকে জন্ম যদিদৃশম।  (৬/৪২)
  

কথাটা খেয়াল করুন, যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি, মৃত্যুর পরে নাকি দুর্লভতর লোকে বাস  করেন। এই দুর্লভতর-লোককে ব্যাখ্যাকারীগণ বলছেন স্বর্গ।   সেখানে, অর্থাৎ স্বর্গে  দীর্ঘকাল বাস করবার পরে, পুণ্যক্ষয় হলে, আবার তিনি ধনীবংশে অথবা যোগীকুলে  জন্ম গ্রহণ করে থাকেন। 

অর্থাৎ আমরা  যেকথা বলতে চাইছি, আপনি ইহজগতে যেমন কর্ম্ম করছেন, সেইমতো মৃত্যুর পরে, আপনার বাসস্থান নির্মিত হবে, বা নির্দিষ্ট হবে, আবার পুনর্জন্মও হবে সেইমতো গৃহে  । অর্থাৎ মৃত্যুর পরে, আমরা কোথায় যাবো, কেমন থাকবো, তা নির্ভর করছে আমার কর্ম্মের উপরে, আমাদের চিন্তা ভাবনার উপরে ।  আর একটা কথা জানবেন, কর্ম্ম মানে শুধু বাহ্যিক কর্ম্ম নয়। কর্ম্ম হচ্ছে আমাদের চিন্তার ফসল। তাই  বলা যেতে পারে, আমরা যেমন চিন্তা করবো,  সেই মতো আমাদের ভবিষ্যৎ স্থিতিস্থান ও স্থিতিকাল অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। এমনকি আমাদের পরবর্তী দেহধারণও নির্ভর করছে, আমাদেরই এই চিন্তাধারার উপরে। 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবার বলছেন, 
অন্তকালে চ মামেব স্মরণ মুক্তি্বা  (মুক্তা) কলেবরম। 
যঃ প্রয়াতি স মদ্ভাবং যাতি নাস্ত্যত্র সংশয়ঃ।  (৮/৫) 
যং যং বাপি স্মরণ ভাবং ত্যজত্যন্তে কলেবরম। 
তং তমেবৈতি কৌন্তেয় সদা তদ্ভাবভাবিতঃ। (৮/৬)

অন্তকালে যে আমাকে স্মরণপূর্বক দেহ ত্যাগ ক'রে যে  প্রয়াণ করে, সে আমার (পরম-ঈশ্বরের) ভাব প্রাপ্ত হয়। এতে কোনো সংশয় নেই।  (৮/৫)
হে কুন্তীপুত্র, মৃত্যুকালে যে-যেমন ভাব স্মরণ করতে করতে দেহ ত্যাগ করে, সে সেই ভাবেই তন্ময় চিত্ত থাকায়, সেই ভাবই প্রাপ্ত হয়ে থাকে।  (৮/৬) 

এখানে দুই-তিনটে জিনিস আমরা লক্ষ করলাম, এক যদি আপনি পুণ্যাত্মা যোগীপুরুষ হন, এবং এক জীবনে আপনার যোগ-সাধন সম্পূর্ণ করতে না পারেন, তবে আপনি মৃত্যুর পরে স্বর্গাদিতে কিছুকাল বাস করে, সেখানে আপনার পুণ্য-কর্ম্মের  ফল ভোগের পরে, আপনি আবার ধনীগৃহে বা যোগের পরিবেশে জন্ম গ্রহণ করবেন। দুই এর পরে আরো একটা জিনিস দেখলাম, ভগবান বলছেন, আপনি যদি মৃত্যুকালে ভগবানের স্মরণ নিতে নিতে দেহ ত্যাগ করেন, তবে আপনি স্বয়ং ভগবানের ভাব প্রাপ্ত হবেনা। তৃতীয়তঃ আপনি মৃত্যুকালে যে ভাবে তন্ময়  থাকবেন, মৃত্যুর পরেও আপনি সেই ভাবের মধ্যেই বাস করতে থাকবেন। তো এই যে তৃতীয় অবস্থা, এটিই আমাদের মতো সাধারনের গতি হয়ে থাকে। 

এখন কথা হচ্ছে, মৃত্যুর পরে, আমরা একটা ভিন্ন জগতে  বাস করবো, অর্থাৎ  আমাদের অস্তিত্ত্ব থাকবে, কিন্তু আমরা এই ইহজগতের বাসিন্দা থাকবো না। আমাদের এই স্থুলদেহ থাকবে না।   তবে আমরা কোন জগতে থাকবো ? আর সেখানে আমাদের  রূপ কেমন হবে ?  

দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর আমরা আগে খুঁজে নেই। অর্থাৎ আমাদের রূপ কেমন হবে ? প্রথমে আমাদের একটা কথা স্বীকার করে নিতে হবে, যে আমরা কেউ এই দেহ নোই। আমরা আত্মা।  আর এই দেহ আমাদের আস্তানা স্বরূপ।  এখানে আমরা সাময়িক সময়ের জন্য, বাস করি মাত্র। আমরা জানি আমাদের প্রধানত দুটো দেহ।  এক হচ্ছে ভৌতিক, অন্যটি হচ্ছে অভৌতিক। ভৌতিক দেহের মধ্যে আছে  স্থুলদেহ, সূক্ষ্মদেহ, অতি সূক্ষ্মদেহ  । আর অভৌতিক দেহে আছে কারন দেহ অর্থাৎ বিজ্ঞানময় ও আনন্দময় দেহ। এখন   এই ভৌতিক  পঞ্চভূতের দ্বারা তৈরি। পঞ্চভূতের মিশ্রণস্বরূপ এই যে দেহ, প্রকৃতির নিয়মে এর জন্ম মৃত্যু আছে, একেই অনন্ময় অর্থাৎ স্থুল দেহ  ও অতিসূক্ষ্ম হচ্ছে প্রাণময় দেহ ও মনময় দেহ। এগুলো সবই ভৌতিক দেহ।  মৃত্যুতে আমরা এই স্থূল দেহকে হারাই। কিন্তু সূক্ষ্ম দেহ আমরা সকলে সহজে  ছাড়তে পারি না। অর্থাৎ আমাদের মানস  দেহ  বা কামদেহ  আমরা সবাই ছাড়তে পারি না। বেশিরভাগ উন্নয়নশীল, অর্থাৎ উন্নতপথের যাত্রী,  বা অনুন্নত  জীবাত্মা এখানেই অবস্থান করে থাকেন। আর উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা অভৌতিক দেহে অবস্থান করে থাকি। আর  যোগীশ্রেষ্ঠ পুরুষগন সমস্ত দেহ ত্যাগ করে,  অর্থাৎ ভৌতিক ও অভৌতিক দেহ ত্যাগ করে, পরমধামে অর্থাৎ পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে যান। 

এখন, আমরা জানি দেহ হচ্ছে একটা গতিশীল আলোর তরঙ্গ মাত্র। এই কথাগুলো আমাদের পক্ষে বোঝা বা বিশ্বাস করা কষ্টসাধ্য ।  এগুলো আমরা দীর্ঘদিন সাধনার মাধ্যমে জানতে পারি। তখন আমাদের কাছে, এইসব কথা প্রত্যক্ষবৎ মনে হবে। তার আগে আমাদের বিশ্বাসের পথ ধরেই এগুতে হবে। আর বিশ্বাস আপনার তখনি জাগ্রত হতে পায়ে, যখন আপনার শাস্ত্রবাক্যের প্রতি শ্রদ্ধা জাগবে। তার আগে এইসব কথা অলীক বলেই মনে হবে। 

আমাদের যতগুলো দেহ আছে, তার মধ্যে কারন-দেহ হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী।  আমাদের মনে যে চিন্তা, আমাদের মনের যে ভাব, এমনকি সমস্ত কর্ম্মফল এই কারন দেহে সঞ্চিত থাকে। জন্মের পর জন্ম আমরা এই কারন দেহ বহন করে নিয়ে যাই।  এই দেহ অদৃশ্য উপকরণে তৈরী। এই দেহের আকৃতি জীবাত্মার ক্ষেত্রে জীবের আকার অনুযায়ী হয়ে থাকে।  তেমনি মানুষের আত্মার ক্ষেত্রে মানুষের মতোই হয়ে থাকে। কিন্তু এটি লিঙ্গহীন। অর্থাৎ না পুরুষ, না স্ত্রী, না ক্লীবলিঙ্গ। 

এখন কথা হচ্ছে  যে দেহেই অবস্থান করুন না কেন, এবং সেই দেহে থেকে আপনি যা কিছু চিন্তা করুন না কেন, বা হৃদয়ে যে ভাব পোষন করুন না কেন, বা যে কাজ করুন না কেন, এই কারন দেহই তার মূল। আর এই দেহে যিনি বাস করেন, অর্থাৎ আত্মা তিনি অমর, অজর, শ্বাশ্বত। কালের গতির সঙ্গে সঙ্গে এই আত্মার ক্ষমতা বৃদ্ধি  পায়।  এখন কথা হচ্ছে, যে আত্মা শ্বাশ্বত তার আবার উন্নতি-অবনতি, ক্ষয়-বৃদ্ধি কিভাবে সম্ভব ?  আসলে এটি হচ্ছে জীবাত্মা।  অর্থাৎ পরমাত্মার প্রতিফলন মাত্র। তো পরমাত্মার প্রতিফলন  যেখানে ঘটে, তার স্বচ্ছতার উপরে নির্ভর করে, প্রতিফলন  কতটা যথাযথ হবে। অস্বচ্ছ পদার্থের উপরে সূর্য্যরশ্মির প্রতিফলন  হয় না। পদার্থের স্বচ্ছতা যত  বৃদ্ধি পাবে, পদার্থটি যখন হিরে-জহরত  হবে, তখন সে সূর্য্যের রশ্মির প্রতিফলন বা আলোকরশ্মি তত উজ্জ্বলতর হয়ে উঠবে। তাই বলা হচ্ছে, জীবাত্মা কারন দেহ প্রাপ্ত হয়ে যত অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত হতে থাকে, যত  জ্ঞান বৃদ্ধি হতে  থাকে,  তত সে ভগবানের সাযুজ্য লাভ করতে থাকে। 

এতক্ষন আমরা লিঙ্গহীন কারনদেহের কথা শুনলাম। অন্যদিকে যাকে সূক্ষ্মদেহ বা লিঙ্গদেহ যাকে  বলে, তারই আর একটা নাম হচ্ছে কামদেহ। এই দেহে স্ত্রী-পুরুষ ভেদ থাকে। এখানে কামনা থাকে প্রবল। এই সুক্ষ দেহের উপকরণগুলোও অদৃশ্য সূক্ষ্ম পদার্থ। সাধারণভাবে আমরা আমাদের চিন্তা, বা কামনাকে আমরা পদার্থ  বলে মনে করি না। আমরা একে  একপ্রকার ভাব বলে মনে করি। আসলে এগুলোও অর্থাৎ আমাদের চিন্তা কামনা ইত্যাদিগুলোও সূক্ষ্ম পদার্থ বৈ কিছু নয়। এগুলো আমাদের ইন্দ্রিয়ের অগোচর। ঠিক তেমনি অনেক আলোর তরঙ্গ আছে, যা একপ্রকার পদার্থ।  যা ওজন করা যায়।

পরাবিদ্যাবিদগণ বলছেন,  পরলোকতত্ত্ব সন্মন্ধে বুঝতে গেলে, আমাদের বর্ণচ্ছটা সম্পর্কে একটা ধারণা  থাকা আবশ্যিক। যাঁরা দিব্যদৃষ্টি লাভ করেছেন, তারা সুক্ষদেহধারী কামলোকবাসী জীবগনকে দেখতে পান। এমনকি কামলোকবাসীগণও  পৃথিবীর আত্মীয়স্বজনগনদের জ্যোতির্বিম্ব দেখতে পান। আর এই কামদেহীর জ্যোতির্বিম্ব, মনের ভাব পরিবর্তনের সাথে সাথে সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বর্ণ ধারণ করে থাকে।  মানুষের শিক্ষা, দীক্ষা, রুচি, কৃষ্টি, স্বভাবের উৎকর্ষ ও অপকার্ষের উপর এই বর্ণ  নির্ভর করে।  সুক্ষভাবে এই বিষয় বর্ননা করা কঠিন।  একই বর্ণের নানান প্রকার পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়।  আবার মানুষের ভাব-নিচয় অসংখ্য, সুতরাং তাদের প্রভেদ ব্যক্ত করাও সহজ সাধ্য নয়। দেখুন আমাদের ভালোবাসা নিঃস্বার্থ হতে পারে আবার স্বার্থসংশ্লিষ্ট হতে পারে। আমরা যে ধর্ম্মাচারন করি, তার মধ্যেও আমাদের বাসনা, ভীতি ইত্যাদি কাজ করে থাকে। সুতরাং সূক্ষ্মভাবে এর বিশ্লেষণ করা দুরূহ।  তাই এ সম্পর্কে আমরা একটা মোটামুটি ধারণা নিয়ে নেবো। 

রক্তবর্ণ হচ্ছে ক্রোধের চিহ্ন। সকালের সূর্য্যের যে গোলাপি আভা, তা প্রেমের চিহ্ন। দ্বেষ-হিংসা হচ্ছে কৃষ্ণবর্ণ।  স্বার্থহীন ক্রোধ রক্তবর্ণ। আবার স্বার্থের ব্যাঘাতে যে ক্রোধের উৎপত্তি, তা বাদামিরঙ যুক্ত রক্তবর্ণ। কামনাব্যঞ্জক ইন্দ্রিয়-বৃত্তির পারিচয়াক হচ্ছে আগুনের রঙ । লোভের  চিহ্ন বাদামি রঙ। স্বার্থপরতার  চিহ্ন ধূসরবর্ন মিশ্রিত বাদামি রঙ। সবুজমিশ্রিত বাদামি রঙ ঈর্ষাজনিত। মানসিক অবসাদের চিহ্ন ধূসরবর্ন। ধূসরবর্ন যখন গভীরতা প্রাপ্ত হয়, তখন বুঝতে হবে এটি ভয়ের চিহ্ন। কমলা রঙ হচ্ছে গর্ব্ব ও উচ্চাকাঙ্খ্যার প্রকাশ। হরিদ্রাবর্ন বুদ্ধির নিদর্শন। আর নীলবর্ণ হচ্ছে ধর্ম্ম-ম্ভাব বা আধ্যাত্মিকতার লক্ষণ।

এখন এই বর্ণচ্ছটাই আমাদের সূক্ষ্ম ও স্থূল শরীর।  আপনারা যারা গভীর ধ্যানের মধ্যে প্রবেশ করেছেন, তারা এই বর্ণচ্ছটা প্রতক্ষ্য করতে পারেন। কেননা এই ধ্যানের সময় অন্ধকারের মধ্যে বর্ণচ্ছটা গাঢ় আকার ধারণ করে থাকে।  সূক্ষ্মলোকবাসী বা সুখদেহধারী আত্মাগণ এই বর্ণময়-ছটা ভিন্ন কিছু নয়। আমরা সাধারণ দৃষ্টিতে এই বর্ণময়-ছটা দেখতে পাই না।  কিন্তু সূক্ষ্মলোকবাসীগণ আমাদেরকে এই বর্ণময় ছটা হিসেবেই দেখতে পান। সুতরাং আমাদের মৃত আত্মীয়-প্রিয়জন আমাদের দেখলে, আমাদের মনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যে বর্ণচ্ছটা সেটাই তারা দেখতে পান। অর্থাৎ তারা আমাদের মনের অবস্থা বুঝতে পারেন। আমরাও যদি দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন হতে  পারতাম,তবে এই কামলোকবাসীদের আমরা একটা জ্যোতির্ময় গোলকের মধ্যে তাদের ভাবব্যঞ্জক বর্ণচ্ছটা সমন্বিত কাম দেহ দেখতে পারতাম। এইসময় তাদের বয়স কম বলে মনে হয়। স্ত্রী তার বৃদ্ধ স্বামীকে যুবকের মতো দেখবেন। এর কারন হচ্ছে, কামলোকবাসীগণ নিজেদেরকে জরাগ্রস্থ বা দুর্বল বলে মনে করতে চান না। কিন্তু অন্য বিষয়ে তাদের কোনো পরিবর্তন হয় না। এমনকি তাদের সে সাধারণ জামাকাপড় পোশাকপরিচ্ছেদ পৃথিবীতে যেমন ছিল, ওই সূক্ষ্ম জগতেও ঠিক তেমনি দেখবেন। আর এগুলো সবই তার চিন্তার ফল। কেবল এই কামলোকে নয়, স্বর্গলোকেও এই একই রকম দেখতে পাওয়া যায়। সুতরাং  কামলোকে, বা স্বর্গলোকে কারুর মৃত আত্মীয়স্বজনকে চিনতে কোনো কষ্ট  পেতে হয় না।  স্বর্গের উন্নতস্তরে যখন তিনি কারনদেহে অবস্থান করেন,  তখনও তার আকৃতি আগের মতো থাকে বটে, কিন্তু সেই আকৃতি গত পার্থিব জীবনের আকৃতির মত নয়, বরং বলা যেতে পারে, বহু জন্মের আকৃতির অপূর্ব একটা ব্যতিক্রমী  ভাব। যা বর্ণনার অতীত। ভাষা এখানে নীরব। 

তো আমাদের সূক্ষ্ম  দেহ সম্পর্কে শুনলাম, এখন আমরা দেখে নেই, আমাদের সূক্ষ্মলোক কেমন ?

আমরা আমাদের স্থুল শরীর ছাড়ার পরে, কামলোকে কামদেহ ধারণ করে অবস্থান করে থাকি। এই কামলোকের স্থিতিকাল শেষ হলে, জীব তন্দ্রাভিভূত হয়ে পড়েন। কামলোকের কোনো স্পন্দন তখন তার দেহে ধরা পড়ে না। অর্থাৎ কামদেহে স্পন্দন গ্রহণ করবার কোনো উপকরণ তখন থাকে না। এরফলে তার সম্বিৎশক্তি তখন অন্তর্মুখী হয়। এবং কামলোক সন্মন্ধে কোনো জ্ঞান থাকে না। মনোময় দেহের উপকরণগুলো সজ্জিত হওয়ায়, মানসদেহ পরিপুষ্ট হতে থাকে। আর মানসদেহ পরিপুষ্ট হলে, কামদেহ, ত্যাগ করে, জীব মানসলোকে উপনীত হয়। এটাই স্বর্গের নিম্নতর স্তর। এই স্বর্গলোক সম্পর্কে আমরা আগেও শুনেছি । পরবর্তীতে আবার শুনবো, কারন এই আলোচনা কখনো শেষ হয় না । এ এক বিচিত্র জগৎ।    
 
আমরা বিকল্প জগতের কথা শুনেছি। আমাদের এই দৃশ্যমান জগতের মতোই অসংখ্য জগৎ আমাদের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। একে আমরা সমান্তরাল পৃথিবীও বলতে পারি। এগুলো আমাদের কাছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে, আমাদের কাছে অদৃশ্য। এইসব জগতে নানান ধরনের জীব আছে । আমাদের যেমন অর্গানিক শরীর তাদের ইনঅর্গানিক শরীর।  আমরা যেমন অক্সিজেন নিয়ে বেঁচে থাকি। গাছ যেমন কার্বনডাইঅক্সিডে নিয়ে বেঁচে থাকে, তেমনি এই  জগতের জীবগন নাইট্রোজেনের সাহায্যে বেঁচে থাকে। এই অদৃশ্য জগতে সব কিছুই সূক্ষ্ম, এমনকি সেখানকার জীবজন্তুও সূক্ষ্ম পদার্থে নির্মিত। আর এইজন্যই সেগুলো আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। কিন্তু তাই  বলে সেগুলো সব রূপহীন , বর্নহীন, শুধুই শূন্য তা কিন্তু হয়। এই সূক্ষ্মলোকে বর্ণ ও জ্যোতির যে প্রাচুর্য্য, পার্থিব জগতে তার তুলনা নেই।

 কঠোপনিষদ (২/২/১৫) বলছেন, 

ন তত্র সূর্য্যো ভাতি, ন চন্দ্র তারকং 
নেমা বিদ্যূতো ভান্তি কুতঃ অয়ম অগ্নিঃ। 
তমেব ভান্তং অনুভাতি  সর্বং 
তস্য ভাসা সর্বম ইদং বিভাতি। 

বলছেন, সেখানে সূর্য দীপ্তি দান করেন না। চন্দ্র-তারকারাও দীপ্তি দেন করেন না,  এই বিদ্যুৎ সকলও দীপ্তি দান করেন না। বলছেন, 
এই অগ্নি কিভাবে দীপ্তি পাবেন ?  আসলে, তাঁরই  জ্যোতিতে সবকিছু জ্যোতির্ময়, তাঁরই দীপ্তিতে সবকিছু দীপ্যমান।                                                                                                                          

তাই এই জগৎ অনির্বচনীয়, বলে জানবেন। কিন্তু এই জগৎ আমাদের চর্ম্মচক্ষুর অগোচর, যাদের দিব্যদৃষ্টি আছে,  যাদের কাছে, এই জগৎ দৃশ্যমান। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যখন এই ভৌতিক স্থুলদেহ ত্যাগ করবার  পরে, এই অতুলনীয় সৌন্দর্য্য উপভোগ করবার যোগ্যতা  লাভ করে  থাকেন। তখন তাদের কাছে, এই পৃথিবীর সৌন্দর্য্য তুচ্ছ বলে বোধ হয়। আপনারা যারা এইসব অতীন্দ্রিয় অবগত হতে চান, তারা ভারতীয় যোগশাস্ত্রের যথাযথ প্রয়োগ করে, ক্রমশ এইসব সন্মন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞানলাভ করতে পারবেন।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।  

এখন দেখি, আমাদের মৃত্যুর পরে কি হয় ?  দেখুন, বিভিন্ন ভাবের মানুষের গতাগতি বিভিন্ন রকমের হয়। মৃত্যুর সময় একটা জিনিস হয়, তা হলো, তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থা।  এটি সবার ক্ষেত্রেই হয়, একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনার সময় হঠাৎ তিনি অনুভূতিশুন্য হয়ে যান। এই মৃত্যুর ঘটনা তিনি দেখতে পান। যদিও দুর্ঘটনাজনিত আঘাত সম্পর্কেও তার কোনো অনুভূতি থাকে না। এ ক্ষেত্রে মৃত্যুর বেশ ক্ষাণিক্ষণ  পরে তার তন্দ্রাভাব আসে। 
অন্য সমস্ত ক্ষেত্রে মৃত্যুর আগেই তিনি গভীর ঘুমে আছন্ন হয়ে যান। কেমন যেন একটা স্বপ্নের মধ্যে তিনি ডুবে যান। এই স্বপ্নের মধ্যে তিনি দেখতে থাকেন, কেউ যেন তাকে ডাকতে এসেছে। হয়তো তার মৃত মা-বাবা বা অন্য কোনো প্রিয়জন যারা আগেই দেহ ত্যাগ করেছেন, তারা তাকে ডাকতে এসেছেন। এই অবস্থাটা মৃত্যুর আগে থেকেই দেখা দেয়। এরপর যখন তিনি শরীর  ছেড়ে দেন, তখন তিনি দেখতে পান, তার শরীর  বিছানায় শোয়া অবস্থায় পরে আছে। চারিদিকে সবাই কান্নাকাটি, হা-হুতাশ করছে।এইসময়  নিজের শরীরকে তিনি নানান রকম ভাবে নাড়াচাড়া বা নির্দেশ পাঠাতে থাকেন।  কিন্তু কোনো নির্দেশ এই মৃত শরীর পালন করে না দেখে সে ভয় পেয়ে যায়।  একটা অস্থিরতা তার মধ্যে কাজ করে, তবে এতক্ষন তার শরীরে যে অসহ্য কাস্ট হচ্ছিলো, তা যেন হঠাৎ দূর হয়ে গেছে।  নিজেকে তখন হালকা মনে হয়।  দেওয়ালের ভিতর দিয়েও তিনি যাতায়াত করতে পারেন।  এইসময় বারবার মৃত           শরীরের কাছে, বা অতি প্রিয়জনের কাছে ছুঁটে  যান।  অর্থাৎ কোনো বিপদ হয়েছে, সেই খবর  তাকে জানবার জন্য, কাছাকাছি যারা থাকেন, তাদের কাছে গিয়ে বলতে থাকেন।  কিন্তু কেউ কোনো কথা শুনছে না বলে নিজেকে অসহায় মনে হয়।

শিবযোগ সাধনা :

তথ্যসূত্রঃ 1)  OSHO - MEDITATION - THE FIRST AND LAST FREEDOM - A PRACTICAL GUIDE TO MEDITATION COMPILED BY SWAMI DEVA WADUD. ২) যোগবীজ - স্বামী বিজ্ঞানান্দ সরস্বতী সম্পাদিত। ৩) হঠযোগ-প্রদীপিকা, শ্রী মহেশ চন্দ্র পাল সংকলিত, ও শ্রী অভিজিৎ শীল সম্পাদিত। ৪) ঘেরন্ড সংহিতা, শিব-সংহিতা, হঠযোগ প্রদীপিকা - অনুবাদক শ্রী পরিতোষ ঠাকুর, সম্পাদনা দীপেন সেনগুপ্ত। যোগসূত্র-ঋষি পতঞ্জলি। পাতঞ্জল যোগদর্শন - স্বামী ভার্গানন্দ অনূদিত।

চলো যাই যমের বাড়ী। (১)

আমরা জানি, নচিকেতা নাকি, যমের-বাড়ি  গিয়ে যমের  বাড়ির দুয়ারে তিনদিন বসেছিল। ভাবলে কেমন অবাক লাগে, একটা জলজ্যান্ত মানুষ সশরীরে মৃত্যুপুরীতে চলে গেছে।  আর সেখানে স্বয়ং যমরাজের দ্বারা আপ্যায়িত হচ্ছে। আজ আমরা শুনবো, যমের বাড়ি কিভাবে যাওয়া যায়। যমের  বাড়ি যাবার প্রক্রিয়া। 
 
প্রথমে শুনে নেই, এই সম্পর্কে  প্রাথমিক কিছু কথা।  প্রথমেই বলি, দুর্বল চিত্তের মানুষ - এই কথা শুনবেন না বা এই লেখা পড়বেন না।  

একটা কথা আমরা সবাই জানি, অন্তত চারিদিক  দেখে শুনে, বুঝে গেছি, আমরা চাই আর না চাই, সাধের এই দেহ একদিন অগ্নিতে  ভস্মিভূত হবে। মিশে যাবে মাটির সাথে। একবার ভাবুন তো সেই দিনের কথা যেদিন আপনার দেহ শ্মশানে অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে। আর আপনার প্রিয়জন অসহায় হয়ে  তাকিয়ে দেখছে। 

 আজ আপনি কোনোভাবেই অগ্নির মধ্যে প্রবেশ করতে পারবেন না, কিন্তু কল্পনা করতে হয়তো পারবেন, সেই ভয়াবহ দিনে কথা। আর আপনি ভীত হবেন।  তো ভয় আপনার যতই আসুক না কেন, মৃত্যু একদিন আপনার সামনে এসে দাঁড়াবে। মৃত্যুহীন জীবন বলে কিছু হয় না। এই জীবনে সবকিছু অনিশ্চিত, মৃত্যুই কেবলমাত্র নিশ্চিত। আপনার জীবনে অনেক দুর্ঘটনা আসতে  পারে, যা আপনি আগে থেকে আঁচ করতে পারেন নি,  কিন্তু আপনি নিশ্চিত ছিলেন, যে মৃত্যু একদিন আসবেই। মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা নয়, মৃত্যু সময়-মেনে আপনার আছে  অবশ্য়ই পৌঁছে যাবে। 

মানুষ ভাবে, মৃত্যু যেন একটা দুর্ঘটনা। আমরা যখন কারুর মৃত্যু দেখি, তখন বলি, হায়রে লোকটা অকালে চলে গেলো। আপনি একটা জিনিস নিশ্চিত জানবেন, মৃত্যু কখনো হঠাৎ আসে না, অকালেও আসে না। ।  মৃত্যু সবসময় নিয়ম মেনে সময় মতোই  আসে। কেউ তাকে আটকাতেও পারে না, আবার কেউ তাকে ডেকে আনতেও পারে না। আপনি কখনো অসময়ে চাঁদের উদয়, বা প্রভাত সূর্য দেখতে পারবেন না। বিশ্বব্রহ্মান্ড-এর সবকিছু একটা নিয়মের বাঁধনে বাঁধা।  আমরা ভাবি, ছেলেটি আত্মহত্যা  করলো। একটা কথা জানবেন, কেউ কখনো কাউকে হত্যা করতে পারে না, যদি না নিয়তি দ্বারা বধ্য হয়। আপনার জীবনে আর সব কিছুই  দুর্ঘটনা হতে পারে, আপনার জীবনে অনেক কিছু হটাৎ হয়ে যেতে পারে, যা আপনি কখনো চিন্তা করেন নি। হঠাৎ আপনার চাকরি হতে পারে, বা চলে যেতে পারে। হঠাৎ আপনার বিয়ে হয়ে যেতে পারে, বা বিয়ে ভেঙে যেতে পারে । এমনকি আপনার জীবন থেকে অনেক কিছুই হঠাৎ হারিয়ে যেতে পারে, বা সংযোগ হতে পারে।  কিন্তু মৃত্যু এমন একটা ঘটনা যা ঠিক নির্দিষ্ট সময়েই হেবে। যা আপনি জানেন, আবার জানেন না।  যা আপনি ভাবেন, আবার ভাবতেই পারেন না।
 
আমরা যখন মৃত্যুর কথা বলি, তখন আমরা ভবিষ্যতের কথা বলি বা ভবিষ্যতের মৃত্যুর দিনের কথা ভাবি । অর্থাৎ মৃত্যু মানেই যেন ভবিষ্যৎ। কিন্তু সত্য হচ্ছে, জীবন যেমন বর্তমান, মৃত্যুও বর্তমান।আপনি এর মধ্যেই মারা গেছেন। যা আপনি জানেন না। যে মুহূর্তে আপনি জন্ম গ্রহণ করেছেন, সেই মুহূর্তেই আপনার মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে গেছে।  এমনকি আপনার মধ্যে প্রতিদিনই, মৃত্যুর মিছিল চলছে। আপনি সেদিকে খেয়াল করেন না। কারন জন্ম-মৃত্যু পাশাপাশি চলছে। জন্ম মৃত্যু একই সঙ্গে চলছে। মানুষ জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর জগতে প্রবেশের টিকিট কেটে নিয়েছে।  শুধু সময়ের অপেক্ষা কখন যমের বাড়ির দরজা আপনার জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে। এ যেন সেই  সিনেমার টিকিট কেটে অপেক্ষা করা, কখন পরবর্তী শো শুরু হবে।
 
আর এই মৃত্যুর, আপনি কোনো পরিবর্তন করতে পারবেন না। এমনকি এই মৃত্যুর দিন-ক্ষণও পরিবর্তন করতে পারবেন না  অর্থাৎ এই পরিণতির আপনি কোনো পরিবর্তন করতে পারবেন না। জন্ম হয়েছে, মানেই আপনি যমের বাড়ির দিকে যাত্রা করেছেন, বা বলা যেতে পারে যমের দুয়ারে  পৌঁছে গেছেন। এমন নয়, যে জীবনের শেষে এই মৃত্যু আসবে। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে আপনার মধ্যেই প্রতিনিয়ত  মৃত্যু প্রক্রিয়া চলছে। আসলে জীবন হচ্ছে, একটা মৃত্যু প্রক্রিয়া মাত্র। জন্ম এর কাঁচা মাল  বা র-ম্যাটেরিয়াল, মৃত্যু হচ্ছে finished product.

 আমরা জন্ম-মৃত্যু দুটোকে আলাদা করে ভাবি, কিন্তু সত্য হচ্ছে, হাটতে গেলে যেমন আমরা দুটো পায়ের সাহায্যে এগিয়ে যাই, ঠিক তেমনি, আমরা যাকে  জীবন বলি সেটি আসলে জন্ম-মৃত্যু নামক দুটো সুতোর টানে দোল খাওয়া। জীবন আসলে একটা মৃত্যুযাত্রা।  আপনি যখন শ্বাস নিচ্ছেন, তখন জীবন শুরু হচ্ছে, আবার আপনি যখন শ্বাস ছাড়ছেন, তখন আপনি  মারা যাচ্ছেন। একটা শিশু যখন ভূমিষ্ট হয়, তখন সে শ্বাসগ্রহণ দিয়ে জীবন শুরু করে, শিশু কখনো শ্বাস ছেড়ে জীবন শুরু করতে পারে না। তার কারন হচ্ছে, তার বুকের মধ্যে আগে থেকে কোনো বাতাস ছিল না, যা সে ছেড়ে দিতে পারে। তাই তখন সে ছিল মৃত শিশু মাত্র।  যখন সে  শ্বাস নেওয়া শুরু করলো, তখন তার জীবন শুরু হলো, আবার শ্বাস ছেড়ে দিয়ে সে মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিলো। এই প্রক্রিয়ায় চলছে, শিশুর শৈশব থেকে শুরু করে বার্ধক্য পর্যন্ত। আমাদের জীবনের প্রথম ক্রিয়া শুরু হয়, শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে। এবং জীবন শেষ হয়, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের মাধ্যমে। আপনি যখন, মারা যান, তখন আর আপনি শতচেষ্টা করেও শ্বাস নিতে পারেন না। শ্বাস গ্রহণ জীবন, শ্বাস ত্যাগ মৃত্যু।  এই দুটো একসাথে চলছে, আমরা খেয়াল করি না। 
আর একটা কথা, আপনি যখন শ্বাস ছেড়ে দেন, তখন আপনি  আপনার মধ্যে শান্তি বজায় থাকে, আর যখন শ্বাস গ্রহণ করেন, তখন আপনার মধ্যে একটা অস্থিরতা তৈরী হয়। শ্বাস গ্রহণ আমাদের মধ্যে চঞ্চলতা তৈরী করে, শ্বাস ত্যাগ আমাদের শান্তির রাজ্যে নিয়ে যায়। আপনি যখন শ্বাস নিচ্ছেন, তখন আপনি উদ্বিগ্ন, আর যখন শ্বাস ছাড়ছেন, তখন আপনি নিরুদ্বিগ্ন। আমি যদি আপনাকে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বাড়াতে বলি, বা শ্বাস শুরু করতে বলি, আপনি তখন  নির্ঘাত শ্বাস গ্রহণ দিয়ে শুরু করবেন। আসলে শ্বাস ছেড়ে দেওয়াকে আমরা ভয় পাই।  শ্বাস আমাদের নিতে হয়,  কিন্তু প্রশ্বাস আমাদের এমনি এমনি হয়। জীবন তাই সংগ্রাম, আর মৃত্যু শান্তির অবস্থা।  জন্ম আমাদের নিতে হয়, মৃত্যু আমাদের এমনি এমনি হয়। উদ্বিগ্নতা আমরা সৃষ্টি করি, শান্তি আমাদের প্রকৃত অবস্থা।  বেঁচে থাকতে গেলে, আমাদের অনেক কিছু করতে হয়, মারা  যাবার জন্য আমাদের কিছুই করতে হয় না। আমাদের দেহ এমন প্রক্রিয়ায় ক্রিয়াশীল, যেখানে শ্বাস-প্রশ্বাস দুইই চলছে। এর যেকোনো একটি বন্ধ  হয়ে গেলে, অর্থাৎ শ্বাস যদি আপনার দেহের ভিতরে আটকে যায়, তবে আপনি মারা যাবেন, আবার শ্বাস যদি শরীরের মধ্যে প্রবেশ না করে, অর্থাৎ বাইরে আটকে যায়, তাহলেও শরীর মারা যাবে। অর্থাৎ জীবন হচ্ছে জন্ম-মৃত্যুর খেলা।  শ্বাস-প্রশ্বাসের খেলা। 

পরের দিন আমরা মৃত্যুর সাথে সহ-অবস্থানের  প্রক্রিয়ার কথা শুনবো। তবে দুর্বল চিত্তের মানুষ - এই কথা শুনবেন না বা এই লেখা পড়বেন না।

চলো যাই যমের বাড়ী। (২) 

যমের  বাড়িতে যাবার জন্য, আমাদের তিনটে সিঁড়ি ভাঙতে  হবে। কিন্তু এই কথাগুলো  আপনি হয়তো কোনোদিন শোনেননি। এই তিনটে সিঁড়ির মধ্যে  প্রথম সিঁড়িটার কথা আজ আমরা শুনবো।  কিন্তু যারা কঠোপনিষদ পড়েছেন, তারা জানেন,  কঠোপনিষদে যমের বাড়ির রাস্তা সম্পর্কে কিছু বলা হয় নি। মহাভারতের পঞ্চপান্ডব ও দ্রৌপদী  ইহলোক ছেড়ে যাবার জন্য পাহাড়ের পথে যাত্রা করেছিলেন, পথে যেতে যেতে পাঁচ জন ( ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব, দ্রৌপদী ) মারা যান।  একমাত্র যুধিষ্ঠির নাকি স্বর্গারোহিনী থেকে যমরাজের রথে চড়ে, সশরীরে স্বর্গে যাত্রা করেছিলেন। আর সেখানে গিয়ে দুর্যোধনকে দেখে মর্মাহত হয়েছিলেন। এর চেয়ে নরকবাস ভালো বলে, নিজেই স্বর্গ থেকে প্রস্থান করতে  চেয়েছিলেন। এখন আপনি যদি স্বর্গারোহিনী যান, তাহলে, যমরাজ আপনার জন্য রথ নিয়ে এসে আপনাকে স্বর্গের পথে নিয়ে যাবেন, এমনটা ভাববার কোনো কারন নেই। কারন আমরা কেউ যুধিষ্ঠির নোই।  আর   কঠোপনিষদেও যমরাজ নাচিকেতাকে স্বর্গে যাবার  রাস্তা দেখিয়েছিলেন।  অর্থাৎ বিভিন্ন প্রকার যাগ-যজ্ঞ-এর অনুষ্ঠান করতে বলেছিলেন। তো এখন না পাবেন, আপনি যমরাজের রথ, না জানেন আপনি যাগ-যজ্ঞ সম্পর্কে নিয়মকানুন।   তো কিভাবেই বা আপনি স্বর্গে যাবেন ? যদিও আমাদের আলোচা বিষয় স্বর্গে আরোহন নয়।  আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে যমের বাড়ি যাওয়া। প্রসঙ্গত একটা কথা বলি, আমাদের শাস্ত্র অনুসারে, স্বর্গ হচ্ছে চরম ভোগ-বিলাসিতার জায়গা, যেখানে পুণ্যবানগন  যেতে পারেন, আর দুর্ভাগারা যান নরকে, যেটি শাস্তিপ্রাপ্ত মানুষের জন্য । এমনই একটা ধারণা, আমাদের শাস্ত্র আমাদের দিয়ে থাকে। যদিও এইসব রূপক কাহিনীর মধ্যে লুকিয়ে আছে, অনেক সুপ্ত জ্ঞান।  যা আমাদের কাছে অজানা, তাই এসব আমাদের কাছে, কল্প-কাহিনী। 
যাই হোক, আমরা স্বর্গ নরক কোথাও যেতে চাই না। আমরা যেতে চাই যমের বাড়ি।  আসলে শাস্ত্রে বলা হয়েছে, যমের বাড়ি হচ্ছে, একটি বিচারশালা।  যেখানে মানুষের মৃত্যুর পরে, তার কাজকর্ম্মের পাপ-পুন্য বিচার করা হয়। এখন মৃত্যুর পরে, শাস্ত্র অনুযায়ী আমরা নাকি সবাই এই যমের  বাড়িতেই যাই, আর সেখানে বিচার অপেক্ষায় থাকি ।  আজ কিন্তু আমরা এই স্থুল-শরীরে থাকা কালীন, কিভাবেই বা যমের বাড়ি যেতে পারি, সেই সম্পর্কে শুনবো । আবার  সেখানে আমরা বিচার চাইতে যাবো না, যাবো, দর্শক হিসেবে।  

প্রক্রিয়া - ১ 

আপনার আমার সবার মধ্যে দুটো শক্তি ক্রিয়াশীল। একটা হচ্ছে শিবশক্তি, আর একটি হচ্ছে বিষ্ণু শক্তি। শিবশক্তি হচ্ছে সংহারকর্তা, আর বিষ্ণুশক্তি হচ্ছে পালন কর্তা। আর এই দুয়ে মিলে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস। 
 একটা অভিজ্ঞতা নেবার চেষ্টা করুন। সারাদিনের মধ্যে যখনই আপনার মনে পড়বে, তখন যথাসম্ভব দীর্ঘসময় ধরে শ্বাস ছাড়তে থাকুন। শ্বাস গ্রহণ করবার জন্য, কোনো প্রয়াস করবেন না।  স্বাভাবিক  ভাবেই, শ্বাস ভিতরে ঢুকতে দিন।  কিন্তু সচেতন ভাবে, দীর্ঘ-সময় নিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়তে থাকুন। এই প্রক্রিয়া আপনি প্রথম দিকে নিরন্তর  করতে পারবেন না, কেননা, একটু পরেই, আপনার মন অন্য বিষয়ে ধাবিত হবে। কিন্তু যখনই আপনি খেয়াল করবেন, যে মনটা অন্য দিকে চলে গেছে, তখন মনকে ধরে এনে আপনার শ্বাস ছাড়বার কাজে নিয়োগ করুন। আপনি শুধু শ্বাস ছাড়ুন। ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়ুন। দ্রুততার সঙ্গে নয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রবেশ করলে, আপনার মধ্যে একটা শান্তির বাতাবরণ অনুভব করবেন। 
আমরা আগেই শুনেছি।  জীবন হচ্ছে শ্বাসের  খেলা, আর শ্বাস নেওয়া মানে আপনি জীবিত হচ্ছেন, আবার শ্বাস যখন ছাড়ছেন, আপনি তখন মারা যাচ্ছেন। মৃত্যু হচ্ছে, একটা নিঃশব্দতা, নিস্তব্ধতা । মৃত্যু মানে আপনি কিছু বলছেন না, মৃত্যু মানে কিছু শুনছেন না, মৃত্যু মানে আপনি কিছু করছেন না। তো মৃত্যু মানে একটা স্থির, নিষ্ক্রিয়  অবস্থা। এই প্রক্রিয়াতে আপনি যত  মনোযোগ গভীর  করতে পারবেন, এই প্রক্রিয়াতে আপনি যত  বেশিক্ষন নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারবেন, আপনি তত আমিত্ত্ব-বিহীন অবস্থায় যেতে পারবেন। শ্বাস ছেড়ে দেবার দিকে মনোযোগ বাড়ান। সারাদিন ধরে এই কাজটি করতে থাকুন। যখনই আপনার মনে পড়বে, তখনই দীর্ঘসময় ধরে, শ্বাস  ছাড়তে থাকুন। শ্বাস নিতে যাবেন না।  শ্বাস নেবার কাজটি শরীরের উপরে ছেড়ে দিন। স্থূল শরীর নিজেকে বাঁচাবার তাগিদেই শ্বাস নেবে।  এর জন্য আপনার কোনো মনোযোগ দেবার, বা চিন্তা করবার দরকার নেই। আপনি যত  শ্বাস ছাড়বার  দিকে জোর দেবেন, আর শ্বাস গ্রহণ স্বাভাবিক শারীরিক ক্রিয়া হিসেবে করতে দেবেন, শরীর আপন প্রয়োজনে শ্বাস নেবে, তখনই আপনার ভিতরে একটা নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম হবে। 
এতদিন  আপনার শরীর শ্বাসক্রিয়া মাধ্যমে বাঁচা-মরার খেলায় রপ্ত ছিল। যাকে  আমরা জীবন বলে থাকি । এবার আপনি শুধু মৃত্যু প্রক্রিয়া অর্থাৎ শ্বাস ছেড়ে দেওয়া, বা জীবনকে ছেড়ে দেওয়া, বা প্রাণকে ছেড়ে দেওয়ার দিকে নজর দিচ্ছেন। অর্থাৎ আপনি মৃত্যুকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন।  মৃত্যুকে বরণ  করবার জন্য আপনি প্রস্তুত হচ্ছেন। যেকোনো কাজ করবার জন্য, একটা আগাম [প্রস্তুতি দরকার।  আপনি নদীতে ঝাঁপ দেবার আগে,শরীরকে দুটো ঝাকি দিয়ে প্রস্তুত করে নেন।  মনকে প্রস্তুত করে নেন, জলে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে আপনার হাত-পা সাঁতার কাটবার প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়। তো জলে ঝাঁপ দেবার আগে, গায়ে তেল মেখে, কোমরের গামছাটা ভালো করে বেঁধে নিতে হয়। এমনকি একটা মানসিক প্রস্তুতিরও দরকার হয়। তো শ্বাস ছেড়ে দেবার দিকে আপনার মন যত আগ্রহী হবে, তত আপনি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে পারবেন। এইজন্য, বলা হয়ে থাকে নিজেকে প্রস্তুত করাটা জরুরি, না হলে প্রক্রিয়া কার্যকরী হবে না। মনে রাখবেন, একটা নতুন স্বাদ আপনি পেতে চলেছেন, মনোরম, যা সুস্বাদু, এবং যার প্রয়াসী আমি। মৃত্যু মানেই সুন্দর।  প্রত্যেকটি মৃত্যুই সুন্দর। আর মৃত্যুর সৌন্দর্য্যের সঙ্গে অন্য কোনো সৌন্দর্য্যের তুলনা হয় না।  মৃত্যু একটা অদ্ভুত বিরল অভিজ্ঞতা, যা আপনি সারা জীবনে কখনো পান নি। মৃতাবস্থা মানে শান্তির অবস্থা।  মৃতাবস্থা মানে স্থির অবস্থা।  মৃতাবস্থা মানে আলোড়নহীন অবস্থা। মৃতাবস্থা মানে অচঞ্চল অবস্থা।  মৃতের কোনো চিন্তা নেই, মৃতের কোনো কর্ম্ম  নেই। মৃতের কোনো দুর্ভোগ নেই। মৃত্যু মানে বিশ্রাম। মৃত্যু মানে উদ্বেগহীন। 
কিন্তু বাস্তব হচ্ছে, আমরা ভাবি, মৃত্যু মানে ভয়ঙ্কর।  তাই আমরা মৃত্যুকে ভয় করি, মৃত্যুর কথা শুনলে আমাদের মধ্যে একটা ভয়ের বাতাবরণ তৈরী হয়। এর কারন হচ্ছে, মৃত্যু সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা।  কিন্তু এমনটা হবার কথা ছিল না। হাজার বার, লক্ষবার আমরা সবাই মৃত্যুর মধ্য দিয়েই নতুন জীবনকে লাভ করেছি। কিন্তু সেই স্মৃতি আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আমরা মৃত্যুর সময় সঙ্গাহীন ছিলাম, তাই মৃত্যুর মুহূর্তের কথা আমাদের স্মৃতিতে নেই। আসলে মৃত্যুকে আমরা ভয় পাই না। আমরা ভয় পাই অজ্ঞানকে। যা আমাদের কাছে অজানা, তাই আমাদের মধ্যে আশঙ্কার সৃষ্টি করে, তাই আমাদের মধ্যে ভয়ের ভাব জাগিয়ে তোলে। 
আর একটা কথা হচ্ছে, মৃত্যুকে আমরা প্রতিরোধ করতে পারি না। মৃত্যুর সময় সম্পর্কে আমাদের কোনো পূর্বজ্ঞান নেই। মৃত্যুর শক্তি সম্পর্কে, এমনকি মৃত্যুর ভালো-মন্দ সম্পর্কেও  আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। আর যার সম্পর্কে কিছুই জানিনা, তাকে না দেখলেও ভয় হয়, তার কথা শুনলেও ভয় হয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, যার সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন না, তাকে কেন আপনি ভয় পাচ্ছেন ? যার সম্পর্কে আপনার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা আপনার স্মৃতিতে নেই, তাকে কেন আপনি ভয় পাবেন ? হয় সে ভালো, নয় সে মন্দ। তো হোক না সে ভালো বা মন্দ, আমি তাকে ভয় পেতে যাবো কেন ? কম পক্ষে মৃত্যু সম্পর্কে একটু ভালোভাবে জানুন, দেখুন না তার মধ্যে ভয় পাবার কিছু আছে কি না।
আসলে প্রতিমুহূর্তে আমাদের মনে হয়, আমি বেঁচে আছি তো ? বেঁচে থাকবো তো ? এই ভাবনা অর্থাৎ বেঁচে থাকবার দুর্ভাবনা আমাদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। আমরা সবাই ভাবি, জীবন  অসম্পূর্ন। আমার যে অনেক কিছু করতে হবে, আমার অনেক কিছু পেতে হবে, আমার অসংখ্য সংকল্প পূরণ করতে হবে, আমার বাসনার তৃপ্তি এখনো হয় নি। তো আমরা সবসময় বাঁচতে চাই, আর বাসনা পূরণের জন্য, শরীরকে ক্রিয়াশীল রাখতে চাই । আর এই যে অদম্য ইচ্ছাপূরণ, আমাদের মৃত্যু সম্পর্কে ভয়ের সৃষ্টি করেছে। আসলে আমাদের মৃত্যুকে ভয় নয়, আমরা ভয় পাই, ক্রিয়াহীন হবার। আমরা ভয় পাই অনিশ্চিত ভবিষৎকে। আর এইজন্যই আমরা আসলে  জীবন্মৃত  অবস্থাতে দিন কাটাই। আমরা না বেঁচে আছি, না আমরা মারা গেছি। আমরা বেঁচেও  মৃতবৎ জীবন কাটাচ্ছি।  তাই আমরা জীবনের সবটুকু আনন্দ হারিয়ে নিঃস, নিঃসঙ্গ, অস্থির জীবনরূপ বোঝাকে বয়ে নিয়ে চলেছি। আপনি যদি বেঁচে থাকেন, তবে জানবেন, মৃত্যুকে সঙ্গে নিয়েই আপনি বেঁচে আছেন।  আর আপনি যদি মৃত্যুকে ছাড়া বাঁচতে চান, তবে মৃত্যুভয় আপনার পিছু ছাড়বে না। 
আসলে মৃত্যু কোনো ভয়ের ব্যাপার নয়। আপনি যদি জীবনকে জানতে পারেন, জীবন কে বুঝতে পারেন, তবে আপনি মৃত্যুকেও বুঝতে পারবেন, আপনি মৃত্যুকেও বুঝতে পারবেন।  জীবন-মৃত্যু পরস্পরের পরিপূরক। জীবন ছাড়া যেমন মৃত্যু থাকতে পারে না, তেমনি মৃত্যু ছাড়া জীবন থাকতে পারে না। যারা জীবনের গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছেন, তারা মৃত্যুকেও ভিতর থেকে দেখতে পেয়েছেন। তাই জীবন-মৃত্যু দুটো শব্দ মাত্র। যা আসলে একই সত্ত্বার উপরে দাঁড়িয়ে। 
এবারে শেষ কথাটা বলি, আপনি যদি আমাদের প্রক্রিয়ার গভীরে প্রবেশ করেন, অর্থাৎ যখনই মনে পড়বে সচেতন ভাবে ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়ুন, আর শ্বাস নেবার জন্য কোনো প্রয়াস না করে, প্রকৃতিদত্ত এই শরীরকেই শ্বাস গ্রহণ করতে দিন। আর এটা করতে পারলে,  আপনি মরনসমুদ্রে ঝাঁপ দেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছেন, বলা যেতে পারে। আর এটা করতে পারলে,  আপনি মৃত্যুভীতির জগতে প্রবেশ করবেন।  আর যখন মৃত্যু-ভীতির জগতে প্রবেশ করবেন, তখন মৃত্যু-ভীতির সম্পর্কে আপনার জ্ঞান জন্মাবে। আর যখন মৃত্যু-ভীতির জ্ঞান জন্মাবে, তখন মৃত্যুভয় বলে আপনার মধ্যে কিছু থাকবে না। আপনি শুধু গভীর মনোযোগের সাথে শ্বাস ছাড়তে থাকেন। ধীর অথচ দীর্গ শ্বাস ছাড়ুন। জোরে নয়, ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়ুন। দেখবেন, মানুষ যখন শোকাহত হয়, মানুষ যখন বিরহ যন্ত্রনা থেকে রেহাই পেতে চায়, তখন সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।  এটি সে জ্ঞানত  করে না। আমরা বলছি, সচেতনভাবে এই শ্বাস ছাড়তে থাকুন। শ্বাস নেবার প্রক্রিয়া দেহের উপরে ছেড়ে দিন। এতে আপনার মধ্যে একটা শান্তি, শান্ত, অচঞ্চলতা, উদ্বেগহীন, আশংকাহীন, ভয়রহিত জীবনের সন্ধান পাবেন। 

এর পরের দিন আমরা দ্বিতীয় প্রক্রিয়া সম্পর্কে শুনবো। 

চলো যাই যমের বাড়ী। (৩) প্রক্রিয়া - ২ 

আগের দিন আমরা শুনেছি প্রথম প্রক্রিয়ার কথা অর্থাৎ শ্বাস যখন আমরা ছাড়ছি , তখন সচেতন থাকা। আর শ্বাস যখন আমরা গ্রহণ করছি, তখন কোনো প্রয়াস না করা। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যেমন শরীর তার নিজের প্রয়োজনে যেমন শ্বাস গ্রহণ করে, তেমনি চলতে দিন। আর শ্বাস ত্যাগ করবার সময় দীর্ঘসময় নিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ত্যাগ করুন। এবার  আমরা দ্বিতীয় প্রক্রিয়ার কথা শুনবো। 
দ্বিতীয় প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করবার আগে, আমরা দুটো গল্প শুনে নেই। 
গ্রামে এক মহামানবের আবির্ভাব হয়েছে।  আর তিনি সমস্ত মরা মানুষকে বাঁচিয়ে দিচ্ছেন। এ এক অদ্ভুত ক্রিয়াকৌশল। শুধু মন্ত্রপূত জল ছিঁটিয়ে দিলেই মরা মানুষ ধড়ফড় করে উঠে বসছে।  মহাত্মার এই কান্ড-কারখানা  দেখে, কিছু যুবক ছেলে, তাঁকে ধরে বসলো, আমাদের এই মন্ত্র শিখিয়ে দিতে হবে।  তো মহাত্মা বললেন, বাবা, মরা মানুষ জ্যান্ত করবার কৌশল শিখে কি করবে ? এই মন্ত্রের সাহায্যে অন্যকে বাঁচানো যায় সত্য, কিন্তু নিজের  মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। তো আমি তোমাদের নিজেকে বাঁচাবার মন্ত্র শিখিয়ে দেবো।  যাতে তোমরা নিজেরা বাঁচতে পারো।  কিন্তু যুবককূল, নাছোড়বান্দা। তারা মরা মানুষ জ্যান্ত করবার মন্ত্র শিখতে চায়।  তো কি আর করা, মহাত্মা তাদের মরা মানুষ জ্যান্ত করবার মন্ত্র শিখিয়ে দিলো। এখন কথা হচ্ছে, মরা মানুষ জ্যান্ত করতে গেলে তো মরা মানুষ চাই। কিন্তু মরা মানুষের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তার গ্রামের পর গ্রাম খুঁজতে লাগলো। কিন্তু মরা মানুষ আর পাওয়া যাচ্ছে না। এবার তারা শ্মশানে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু সেখানেও কোনো মরা মানুষ আসে না। কারন কেউ মারা গেলেই, মহাত্মার তার  কাছে চলে যায়, আর তাকে বাঁচিয়ে তোলে। তাই শ্মশানেও কোনো মরা মানুষ পেলো না। এবার তারা জঙ্গলের পথে হাটতে লাগলো। জঙ্গলে যেতে যেতে তারা কিছু হাড়গোড় দেখতে পেলো। মনে মনে ভাবলো, এই হাড়গোড় নিশ্চয় কোনো মানুষের হবে। অনেকদিন আগে মারা গেছে, তাই তার শরীরে কোনো রক্ত-মাংস নেই। যাইহোক, এবার এরা অতি উৎসাহে মন্ত্র-পড়া জল ছেঁটাতে লাগলো। আর আশ্চর্য্যের ব্যাপার হচ্ছে, ধীরে ধীরে সেই হাড়গুলো জোড়া লাগতে লাগলো, এবং তাতে  মাংস-রক্ত দেখা দিতে লাগলো।  আর কিছুক্ষনের মধ্যেই তাদের সামনে একটা ভয়ঙ্কর বাঘ প্রকটিত হয়ে গেলো । বাঘ জীবন ফিরে পেয়ে, প্রথমেই যুবকদের আক্রমন করলো। আর বাঘের খপ্পরে পড়লে যা হয়, যুবকগুলোর সেই পরিণতি হলো। কারন নিজেকে বাঁচাবার মন্ত্র তো যুবকদের  জানা নেই।  

এবার আমরা দ্বিতীয় গল্প শুনবো আমরা শিবপুরান থেকে। ভোলানাথ শিব,  ভক্তের যেকোনো মনোবাঞ্ছা পূরণ করে থাকেন। তো একবার হলো কি,  এক অসুর সাধনবলে ভোলানাথকে তৃপ্ত করে, তাঁর কাছে বর চাইলো।  হে দেবাদিদেব শিব, আমরা  শুনেছি আপনি কোনো ভক্তের মনোবাঞ্ছা অপূর্ন রাখেন না। তো আমার সাধনভক্তিতে আপনি যদি সন্তুষ্ট হয়ে থাকেন, তবে আমাকে আপনি এই বর দান করুন, যাতে আমি যার মাথায় হাতের তালু রাখবো, তিনি তৎক্ষণাৎ পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হবেন। তো সদাশিব ভোলানাথ। বললেন, ঠিক আছে তাই হবে। এর পর থেকে তুমি যার মাথায় হাত রাখবে, সে তৎক্ষণাৎ ভষ্ম হয়ে যাবে। তো অসুর তো মহা খুশী।  কিন্তু তার মনে সন্দেহ হলো, সত্যিই কি এমনতরো অলৌকিক কান্ড ঘটতে পারে ? কারুর মাথায় আমি হাত দিলেই, সে অমনি আগুনে পুড়ে চাই হয়ে যাবে ? তো ভাবলো, শিব ঠাকুর তো আমার সামনে প্রকাশিত হয়েছে, কখন আবার অদৃশ্য হয়ে যাবেন, তার ঠিক নেই।  বহু বছরের সাধনার ফলে তাকে আজ সামনে পেয়েছি।  আর তার বরও পেয়েছি।  কিন্তু শিব ঠাকুরের দেওয়া বর যদি কার্যকরী না হয় ? কিন্তু এখানে তো কাউকে দেখছি না, যাকে দিয়ে এই অলৌকিক শক্তির পরীক্ষা করা যেতে পারে। এইসব সাতপাঁচ ভেবে, সে শিবঠাকুরকে বললো, হে পরমারাধ্যদেব, আপনি যা বলছেন, তা সত্যি তো ? তো শিবঠাকুর বললেন, দেখো, শিবমুখ নিঃসৃতবাণী কখনো নিষ্ফলা হয় না।  তুমি পরীক্ষা করে দেখতে পারো। তো অসুর ভাবলো, এখানে তো কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না। একমাত্র শিবঠাকুর আর আমি স্বয়ং। তো পরীক্ষার নামে সে তক্ষুনি শিবঠাকুরের মাথায় হাত রাখতে গেলো। শিব ঠাকুর তো ভয় পেয়ে গেলেন। এতো দেখছি গুরুমারা বিদ্যা গুরুর উপরেই প্রয়োগ করতে চায়। শিবঠাকুর আর কিছু না ভেবে, সেখানে থেকে উর্দ্ধগতিতে পালাতে লাগলেন। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত অবশ্য ভগবান বিষ্ণুর সাহায্যে এযাত্রা রক্ষা পেলো।  ভগবান বিষ্ণুর ছলচাতুরীতে বোকারাম অসুর নিজের হাত নিজের মাথায় দিয়ে, নিজেই ভস্মিভূত হয়ে গেলো। 

এসব গল্পকথা। কিন্তু এই গল্পের মধ্যেই লুকিয়ে আছে, চিরসত্য। শক্তিশালী বিদ্যা, সবসময় গুহ্য রাখা হয়।  উপযুক্ত আধার ব্যাতিত এই সব বিদ্যা দান শুধু শিষ্যের ক্ষতি নয়, এমনকি গুরুদেবেরও  ক্ষতিসাধন হতে পারে।  গুরুদেব হয়তো বেঁচে যেতে পারেন, কিন্তু অযোগ্য  শিষ্যের ক্ষতি রোধ করা যায় না। আবার এইসব গুহ্য  যোগকথা স্বয়ং শিব আমাদেরকে বলে গেছেন, এবং তা লিপিবদ্ধ আকারেই  শিবসংহিতা শিবপুরান ইত্যাদি  নামক গ্রন্থ আকারে আজকের বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।  তো আধ্যাত্মিক জগতে একটা কথা আছে, স্বাধ্যায়।  অর্থাৎ পঠন-পাঠন ও মনন। তো আমরা এইসব শাস্ত্র গ্রন্থ যেখানে যোগের কথা লিপিবদ্ধ আছে, সেগুলোর কথা আমরা অবশ্য়ই শুনতে পারি, এমনকি সেসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনাও করতে পারি। আশাকরি তাতে অধ্যাত্ব জগতে প্রবেশের পথ সুগম হবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয় ।        

যাই হোক, এবার আমরা দ্বিতীয় প্রক্রিয়ার কথা শুনবো।  তবে  প্রথম প্রক্রিয়ায় যতক্ষন অভ্যস্থ না হতে পারছেন, ততক্ষন দ্বিতীয় প্রক্রিয়া কোনো কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারবে না। তাই প্রথম প্রক্রিয়াতে আগে, সাবলীল হতে হবে, সহজ হতে হবে । প্রথম প্রক্রিয়ায় নিজের অনুভবকে প্রত্যক্ষ করতে হবে। তবেই আমরা দ্বিতীয় প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করতে পারবো। 

চেয়ারে বা মাটিতে শরীরকে স্থির করে বসুন। বুক-পেট থেকে সমস্ত বায়ু ধীরে ধীরে বাইরে বের করে দিন।  এবার চোখদুটো বন্ধ করুন। এবং নিজেকে শরীরের অন্দরে প্রবেশ ঘটান। প্রতক্ষ্য করবার চেষ্টা করুন, শরীরের ভিতরে কি ঘটছে। বায়ু যখন বাইরে, আপনি তখন ভিতরে। এবার শ্বাসকে ভিতরে প্রবেশ করতে দিন। যখন শরীরে বায়ুর প্রবেশ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে, চোখদুটো মেলে দিন বাইরে। মনটাকে বাইরে বিস্তার করে দিন। অর্থাৎ বায়ু যখন শরীরের বাইরে আপনি তখন শরীরের ভিতরে, আবার বায়ু যখন ভিতরে আপনি তখন বাইরে। ঠিক বিপরীত অবস্থান হবে, আপনার মনের। বাতাস যখন বাইরে অর্থাৎ আপনি যখন শ্বাস ছাড়ছেন, তখন আপনার ভিতরে একটা আকাশ তৈরী হবে, একটা শুন্যস্থান তৈরী হবে, জীবনীশক্তি, প্রাণবায়ু তখন বাইরে।  যদিও সত্য হচ্ছে, প্রাণবায়ু ভিতর থেকে নিঃশেষিত হয় নি। বায়ুর বা প্রাণবায়ুর একটা অংশ অবশ্য়ই ভিতরে শরীরের আনাচে কানাচে অবস্থান করছে। কিন্তু আপনি  জানবেন, আপনার দেহে আর প্রাণ নেই। প্রাণ এখন বাইরে অবস্থান করছে। এই মুহূর্তে কোনো না কোনো ভাবে  আপনি মৃত। মৃত্যুর এই নীরব মুহূর্তে আপনি ভিতরে প্রবেশ করুন। এবং মৃত্যু-অবস্থার সাক্ষী হয়ে যান। বাতাস যখন বাইরে, আপনার চোখের পাতা তখন বাইরের থেকে বন্ধ, কিন্তু ভিতর দিকে খোলা। আর আপনি প্রবেশ করেছেন মৃত্যুর সাথে সাক্ষাৎ করতে। যমরাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। যেহেতু এইসময় বাতাস থাকবে বাইরে, আপনার ভিতরে তৈরী হবে একটা শূন্যতা।  আর এই শূন্যতার মধ্যে আপনি একাকী বিচরণ করবেন। এই প্রক্রিয়া আপনি প্রতিদিন ১৫ মিনিট ধরে অভ্যাস করতে থাকুন। এই প্রক্রিয়া আপনাকে মৃত্যুর রাজা যমের সাক্ষাতের জন্য উপযুক্ত করে তুলবে। নিজেকে উপযুক্ত না করতে পারলে, নিজেকে উপযুক্ত গ্রাহক না করতে পারলে, পরবর্তী পদক্ষেপে যাওয়া যাবে না। দ্রষ্টার দৃষ্টিশক্তি চাই, শ্রোতার শ্রবণশক্তি চাই, গ্রহীতার গ্রহনশক্তি চাই। আবার চোখ বুজে থাকলে, কান বন্ধ করে রাখলে, দৃশ্য বা শব্দ আপনাকে কোনো অনুভূতি বা উপলব্ধি  এনে দিতে পারবে না। অর্থাৎ শক্তি থাকলে হবে না, শক্তিকে প্রয়োগ করতে হবে,  শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। তবেই প্রতক্ষ্য অনুভূতির স্বাদ পাওয়া যাবে। এই প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে আপনাকে ভিতর থেকে  মৃত্যুভয় দূর করে দেবে।এইসময় আপনি চিন্তাহীন অবস্থায় থাকবেন, এই চিন্তাহীন অবস্থাই মৃত্যু।  এই সময় আপনি বিশ্রামের মধ্যে থাকবেন। এই বিশ্রামের অপর নামই মৃত্যু।  

পরের-দিন আমরা তৃতীয় বা শেষ প্রক্রিয়ার কথা শুনবো। তবে একটা কথা বলি, অভ্যাস যত দীর্ঘস্থায়ী ও দৃঢ় হবে, অনুভূতির  স্তরে তত উন্নতি হতে থাকবে। যোগের এই প্রক্রিয়াকে বলা হয়ে থাকে শিবধ্যান। শিব অর্থাৎ মঙ্গলময়, শিব অর্থাৎ সংহার কর্তা। শিব যিনি আমাদের পরপারের কান্ডারী। বলা হয়ে থাকে,  সমস্ত যোগ-পদ্ধতি  এই শিবগুরু প্রদত্ব।

চলো যাই যমের বাড়ী। (৪)  প্রক্রিয়া - ৩  

দেখুন আমি সাধু-সন্ত নোই,  গুরুজী নোই, আমি না শিক্ষক, না আচার্য্য।  আমি একজন বক্তা মাত্র।আমি আর পাঁচজনের মতো একজন সাধারণ  মানুষ।  নিজের মনের মধ্যে যে প্রশ্ন জাগে, তার উত্তর আমি মহাত্মাদের কাছ থেকে পাবার চেষ্টা করি। মহাত্মাদের কথা গুলো নিজের বিচার বুদ্ধি দিয়ে বুঝবার চেষ্টা করি মাত্র। কঠোপনিষদ পড়তে পড়তে একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে উদয় হয়েছিল, কিভাবে নচিকেতা  যমের বাড়ি সশরীরে উপস্থিত হলো ? আপনারা যারা কঠোপনিষদ পড়েছেন, তারা জানেন, এই প্রশ্নের  উত্তর কঠোপনিষদে নেই। তার উত্তর  আছে এই যোগক্রিয়াতে। 
যোগ উপযুক্ত গুরুর সান্নিধ্যে দীর্ঘ সাধনার ফলেই রপ্ত হতে পারে, এইসব কথা তাদেরই কথা যারা এই সাধনায় লিপ্ত আছেন। তবে বিবেকগুরু যার জাগ্রত হয় নি, তার পক্ষে কোনো সাধনাই ফলপ্রসূ হতে পারে না।  আমি ভাষ্যকার মাত্র। যোগের মূলসূত্রের কথা মহাত্মাগণ হাজার হাজার বছর আগে বলে গেছেন, এরমধ্যে কিছু কিছু লিপিবদ্ধ হয়েছে। আমরা এই লিপিবদ্ধ সূত্র, ও যোগগুরুদের মুখনিঃসৃত বাণী  থেকেই সাধারনের আগ্রহ বৃদ্ধির জন্য, যোগকথা সর্ব-সম্মুখে আনবার চেষ্টা করছি মাত্র। যোগ লুপ্তপ্রায় বিদ্যা। মুষ্টিমেয় কিছু মহাত্মার কাছে, এগুলো সংরক্ষিত। সাধারনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আমরা চাই এগুলো সবার সামনে আসুক। তারাই পরীক্ষা করে দেখুক, বিচার করে দেখুক, এর মধ্যে আদৌ কোনো শক্তি আছে কি না। 
আর একটা কথা, অনেকে জানতে চেয়েছেন, এই প্রক্রিয়া কতদিন করতে  হবে।  যারা যোগ শুরুর আগেই জানতে চান কবে যোগসিদ্ধি হবে, তাদের যোগের মধ্যে প্রবেশ না করাই ভালো। দিল্লি কত দূর ? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না।  আসলে আপনি কোথায় আছেন, আপনার অবস্থান কোথায়, আপনি কিসে সওয়ার হচ্ছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছুর উপরে নির্ভর করে আপনার গন্তব্যে পৌঁছনোর সময়সীমা। যাইহোক, আমরা এবার শুনে নেই, যমের বাড়ি যাবার তৃতীয় বা শেষ প্রক্রিয়া।     

যমের বাড়ি যাবার জন্য, আমরা আগে দুটো প্রক্রিয়ার কথা শুনেছি। ওই দুটো প্রক্রিয়াতে যারা অভ্যস্থ হবেন, এবং প্রক্রিয়ার  অনুভূতিগুলোকে ধরতে পারবেন, তারাই পরবর্তী অর্থাৎ তৃতীয় প্রক্রিয়াতে প্রবেশ করতে পারবেন। অন্যথা এই প্রক্রিয়ায় প্রবেশ শুধু নিষিদ্ধ নয়, অসাধ্য ও ভয়ংকর ফলপ্রদ হতে পারে।  এমনকি আপনার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই কৌতূহল মেটানোর জন্য, পড়ুন, শুনুন, বুঝুন, কিন্তু নিজের সাধ্য অনুযায়ী এগোন।  
ভোরের দিকে অথবা সারাদিন কাজের শেষে বিশ্রামের পরে, স্নান সেরে নিন। আজ একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হবে, যা একমাত্র আপনার মৃত্যুর পরেই হতে পারে । তো মনে মনে ভাবুন, আজ আপনি স্থূল দেহ ত্যাগ করে মহাশূন্যে পাড়ি  দেবেন। না আপনাকে স্থূল দেহ সত্যি সত্যি ত্যাগ করতে হবে না। কেবলমাত্র ধ্যানের  এই প্রক্রিয়া আপনাকে স্থূল দেহের বাইরে নিয়ে যাবে। কেননা এই দেহ তখন বাসযোগ্য থাকবে না। 

সাবধানবানী : এই প্রক্রিয়া শুরু করবার আগে, কাউকে বলে রাখুন, আপনাকে খেয়াল রাখতে। নির্দিষ্ট সময়ের পরে, আপনাকে স্পর্শ করে জাগিয়ে তুলতে, বা কানের মধ্যে প্রণব ধ্বনি দিয়ে আপনার স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলতে। কেননা, এই প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করা মানে আপনি অন্তিম যাত্রায় সামিল হচ্ছেন। তাই আমার কথায় এইসব প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রবেশ করবেন না। সাধু সাবধান। 

যেকোনো নির্জন জায়গায় বসে পড়ুন। সমস্ত শরীরকে শিথিল করে দিন, চোখ দুটো মুদ্রিত করে রাখুন। ভাবুন, আপনি কোথায় বসে আছেন ? গোলাকার  বলের আকৃতি এই পৃথিবী। তো একটা বিরাট গোলাকার পৃথিবীর উপরে আপনি বসে আছেন। স্বয়ং শিব যেমন কৈলাশ পর্বতের উপরে আসীন আছেন, আপনি তেমনি পাহাড়ের চূড়ায় বসে আছেন। এখন গভীর রাত।  পাহাড় থেকে নিচের দিকে তাকালে, পাহাড়ের শহরের আলোর বিন্দুগুলোকে আপনি দেখতে পাচ্ছেন। আপনার মনে হচ্ছে, আকাশ নিচে নেমে  গেছে। উপরের দিকে তাকালে আপনি নক্ষত্র ক্ষচিত আকাশ  দেখতে পাচ্ছেন। আকাশের তারাগুলো জ্বলজ্বল করছে।  অর্থাৎ নিচে কৃত্তিম আলোর রোশনাই, আকাশে প্রকৃতির আলোর বাহার । অসংখ্য আলোর বিন্দু আপনাকে ঘিরে রেখেছে। আপনি ধ্যানমুদ্রায়, বা সিদ্ধাসনে পাহাড়ের চূড়ায় একাকী বসে আছেন। 
ভাবুন, আপনি পাহাড়ের উপরে বসে আছেন, চারিদিকে বরফের পাহাড়। অসহ্য ঠান্ডা আবহাওয়া। ধীরে ধীরে আপনার শরীরও   ঠান্ডা নিস্তেজ হয়ে আসছে। আপনার শরীর ঠান্ডায় অবশ হয়ে গেছে। আপনার শরীর  স্থির হয়ে গেছে। এবার আপনি দেহ ছেড়ে বাইরে চলে এসেছেন। আপনার দেহ এখন আর জীবিত নয়, মৃত-শরীর। ভাবুন, আপনি জীবিত নয় মৃত। শুধু ভাবুন, আপনি এখন শরীরে নেই।  আপনার শরীরে এখন প্রাণহীন। 
এবার কল্পনা করুন, আর দেখতে থাকুন, সমস্ত নক্ষত্রের আলোর বিন্দু আপনার স্থুল শরীরে প্রবেশ করছে। ধীরে ধীরে আপনার শরীরে উত্তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আপনার শরীর  এখন একটা অগ্নিগোলক। হ্যাঁ শুধু ভাবুন। একসময় যেন মনে হলো আপনার গোড়ালিতে উত্তাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর সেখানে একটা আলোর স্ফুলিঙ্গ দেখা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে সেই আলো অগ্নি-রেখার  রূপ নিয়েছে। অগ্নি ধীরে ধীরে প্রজ্বলিত হচ্ছে।  আপনার মনকে গোড়ালির কাছে নিয়ে যান। আপনি শুধু দেখছেন, এবং অনুভব  করবার চেষ্টা করুন, ধীরে ধীরে অগ্নিশিখা উপরের দিকে উঠছে।  আর আপনার পিতৃমাতৃ প্রদত্ত পঞ্চভূতের এই শরীর অগ্নিতে পুড়ে ছাই  হয়ে যাচ্ছে। গোড়ালি থেকে পায়ের পাতা, পায়ের আঙ্গুল, হাটু, থাই, কোমড়, পেট বুক, গলা মুখ সবশেষে মাথা অগ্নিতে পুড়ে ছাই  হয়ে যাচ্ছে । আর আপনি সেই দৃশ্য দেখছেন। আপনার স্মৃতি বলে কিছু নেই, আপনার মন বলে কিছু নেই। এমনকি   এখন আপনার দেহ বলে কিছু নেই, আপনার রক্তমাংসের শরীর  এখন দেহভস্ম বই কিছু নয়। কিন্তু আপনি আছেন, একটা একটা চেতন শক্তি,  চেতন বিন্দু। এইসময় আপনি নিজেকে হালকা বোধ করছেন। এইসময় আপনার  অপূর্ন বাসনার ভার যত  বেশি হবে, তত আপনি এই দেহভষ্মের কাছে ঘুরঘুর করতে থাকবেন।  আর  যদি আপনি কামনা বাসনার উর্দ্ধে জীবন ধারণ করে থাকেন,  জীবন সম্পর্কে যদি আপনার একটা উদাসীন ভাব থাকে, তবে আপনি দেহ ছেড়ে অসীম আকাশের মধ্যে দিয়ে উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হবেন। এর জন্য আলাদা কোনো প্রয়াস করতে হবে না। যদি আপনি পবিত্র জীবন -যাপন করে থাকেন, আপনার মনের মধ্যে যদি কোনো অপরাধবোধ না থাকে, একসময় আপনি নীলাভ আলোর আভা দেখতে পারবেন, আপনার চতুর্দিকে। এবং নিজের মধ্যে একটা প্রশান্তির ভাব অনুভব করতে থাকবেন। এইসময় আপনার অন্তর্দৃষ্টিতে যা কিছু দেখতে থাকবেন, তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনা করাও যায় না।  এইসময় আপনার ঘুমঘুম ভাব আসবে।  সতর্ক থাকুন, ঘুমুলে সর্বনাশ। চেতন থাকুন।  
এই অবস্থায় আপনি যদি সম্ভব হয় অন্ততঃ ঘন্টাখানেক অবস্থান করুন। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনার মধ্যে যখনই  স্মৃতি জাগ্রত হবে,  আপনি তক্ষুনি  আবার স্থুল দেহে ফিরে আসবেন। আর যদি স্মৃতি জাগ্রত না হয়, বা স্মৃতি জাগ্রত করতে না পারেন, তবে আপনার আর দেহে ফেরা হবে না। তাই এই প্রক্রিয়া শুরু করবার আগেই কাউকে বলে রাখুন, নির্দিষ্ট সময়ের পরে, আপনার শরীরকে স্পর্শ করতে। কানে প্রণব ধ্বনি উচ্চারণ করতে। তবে হঠাৎ শরীরকে ধাক্কা দিতে নিষেধ করবেন। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। আপনার শরীরে ফেরা নাও হতে পারে। মনে রাখবেন, নিজের ইচ্ছেয় যমের  বাড়ি যাওয়া যায়।  কিন্তু নিজের ইচ্ছেয় যমের  বাড়ি থেকে নাও ফিরতে পারেন। তাই সাধু  সাবধান। 
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম। 

শিবনেত্র বা তৃতীয় নয়ন :

কেউ বলে শিবনেত্র, কেউ বলে তৃতীয় নয়ন। আমাদের দুই চোখের মাঝখানে নাকি একটা চোখ আছে। এই অদ্ভুত কথা বিজ্ঞান কখনো প্রমান করতে পারে নি। পশ্চিমের দেশ এটা জানে না, কিন্তু প্রাচ্যের বিশেষ করে ভারতের মতো দেশে এই কথাটা একটা বাচ্চা  ছেলেও জানে, যে আমাদের একটা তৃতীয় নয়ন  আছে। আমরা যখন শিব ঠাকুর মূর্তি বানাই, তাকে এমনকি আমরা যখন দূর্গা মূর্তি বানাই, তখন তাঁর দুই চোখের মধ্যিখানে একটা চোখ  এঁকে দেই। এই বাড়তি চোখের কোনো পর্দা নেই।অর্থাৎ এই চোখ কখনো বন্ধ হয় না।  অদ্ভুত এই ভারতীয় দর্শন। এই তৃতীয় নয়নের কথা আজও বিজ্ঞান জানতে পারে নি।  কিন্তু ভারতীয় ঋষিগণ হাজার হাজার বছর আগে থেকেই এই তৃতীয় নয়নের কথা বলে গেছেন।  হয়তো এমন একদিন আসবে, বিজ্ঞান এই তৃতীয় নয়নের স্থিতি আবিষ্কার করবে।  

ঋষিমুনিগন বলেছেন, এই তৃতীয় নয়ন আছে সমস্ত মানুষের কিন্তু তা সুপ্ত, নিষ্ক্রিয় । একে বাইরে থেকে দেখা যায় না।  আর এই সুপ্ত নয়নকে ক্রিয়াশীল করতে গেলে, আমাদের বীর্যশক্তি বা সৃষ্টিশক্তিকে উর্দ্ধমুখী করতে হবে।  সাধারণত আমাদের এই সৃষ্টিশক্তি নিম্নগামী। মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে উপেক্ষা করে, এই সৃষ্টিশক্তিকে উর্দ্ধমুখী করতে পারলে নাকি আমাদের এই তৃতীয় নয়ন ক্রিয়াশীল হতে পারে। 

আর একদল মহাত্মা বলছেন, আমাদের এই তৃতীয় নয়ন আসলে সবারই ক্রিয়াশীল। কিন্তু সেই সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। তাই আমরা ভাবি, তৃতীয় নয়ন হয় নেই, বা থাকলেও তা সুপ্ত।  এর কার্যপ্রণালী সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। চোখ দিয়ে আমরা কি করি ? চোখ দিয়ে আমরা দেখি।  কি দেখি না বাইরের জগৎকে দেখি। কিন্তু আমরা সবাই জানি, এই দুটো চোখ মুদ্রিত থাকলেও, আমরা অনেক কিছুই দেখতে পাই। তা বাইরের জগতের অনুরূপ দৃশ্য হতে পারে, বা অন্তর্জগতের  দৃশ্য হতে পারে । চোখ বুজেও আমরা সবাই কিছু না কিছু দেখতে পাই। এই দেখা আসলে সেই তৃতীয় নয়নের কাজ। আমরা ভাবি, চোখ বুজলে আমরা যা দেখি তা আসলে আমাদের কল্পনা, যা আমাদের মনের কাজ। জানবেন, মনের কাজ হচ্ছে, চিন্তা করা।  মন কখনো দেখতে পায়  না।  দেখতে পায়, এই তৃতীয় নয়ন। আপনি যখন ভালোবাসেন, আপনি যখন রেগে যান, আপনার যখন ঈর্ষা হয়, আপনার যখন হিংসা হয়, তখন এগুলোকে কে দেখে ?এটি আসলে আমাদের তৃতীয় নয়নের কাজ। এমনকি আপনার চিন্তাকে  দেখছে, এই তৃতীয় নয়ন। 
এই তৃতীয় নয়নের দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করবার উপায় আছে।  এই তৃতীয় নয়ন শারীরবিদ্যাবিদগন খুঁজে পান না। কিন্তু সত্য হচ্ছে, আপনার রাগ, আপনার ভালোলাগা অনুভূতি, খারাপলাগা অনুভূতি, এগুলো দৃশ্যমান, আর তা যার সাহায্যে আমরা দেখতে পাই, তার রূপক নাম হচ্ছে শিবনেত্র বা তৃতীয় নয়ন। এটির অবস্থান মুনিঋষিগন বলেছেন, আমাদের দুই চোখের মাঝখানে।  যে স্থানকে বলা হয়, আজ্ঞাচক্র। 
এই তৃতীয় নয়নকে খোলার জন্য, অনেক উপায় আছে, যা আমাদের ঋষিগণ বলে গেছেন। সেই উপায়গুলোর মধ্যে থেকে একটি উপায় আমরা আগামীদিন শুনবো। 
----------

এই প্রক্রিয়াতে চারটি  পদক্ষেপ।  আর প্রত্যেকটি পদক্ষেপে ১৫ মিনিট সময় দিতে হবে। এর মধ্যে প্রথম দুটো নিজেকে তৈরি করবার জন্য, অর্থাৎ পরবর্তী পদক্ষেপে পা বারবার যোগ্য হয়ে উঠবার জন্য। যদি প্রথম পদক্ষেপে শ্বাসপ্রশ্বাস ঠিকঠাক মতো রপ্ত করা যায়, তবে রক্তধারায়   কার্বনডাইঅক্সাইডের মাত্রা মেরে যাবে। এবং নিজেকে উর্দ্ধগতি সম্পন্ন মনে হবে। যাই হোক, 

প্রক্রিয়া - ১ 
চোখ বুজে বসুন। নাক দিয়ে গভীর ভাবে শ্বাস নিন। বুক-ভোরে শ্বাস নিন। এবার নিজের সাধ্য অনুযায়ী অন্তর-কুম্ভক  করুন। এবার ধীরে ধীরে মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়তে থাকুন। বুক-পেট থেকে যথাসম্ভব বাতাস বাইরে বের করে দিন। এই প্রক্রিয়া ১৫ মিনিট করতে হবে। 
প্রক্রিয়া - ২ 
এবার শ্বাস প্রশ্বাসকে  স্বাভাবিক করুন। অন্ততঃ তিন ফুট দূর থেকে প্রদীপের স্থির  শিখার দিকে নজর দিন। যতক্ষন সম্ভব অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকুন। স্থির  প্রদীপ অর্থাৎ বহমান বাতাসের মধ্যে বসলে প্রদীপ শিখা স্থির হবে না।  এর  একটা বিকল্প হচ্ছে, একটা নীল রঙের নাইট ল্যাম্পের আলো জ্বালিয়ে বসুন। আর স্থির দৃর্ষ্টিতে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকুন। এইসময় আপনার শরীরকে স্থির রাখুন।  নড়াচড়া করবেন না। চোখের পাতা  যথা সম্ভব স্থির থাকবে। ১৫ মিনিটের এই প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াকে ত্রাটক বলা হয়ে থাকে।  যাদের চোখের সমস্যা আছে, তাদের পক্ষে এই প্রক্রিয়া নিষিদ্ধ।   
প্রক্রিয়া - ৩ 
এবারে দাঁড়িয়ে পড়ুন। চোখের পাতা বন্ধ  করে দিন। শরীরকে ঢিলে করে ছেড়ে দিন। বাহ্যিক সমস্ত অনুভূতিকে গ্রহণ করবার জন্য নিজেকে মেলে ধরুন। এই সময় আপনার শরীরকে ঘিরে একটা সূক্ষ্ম  শক্তি ঘিরে ধরবে, যা আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এই ঘটনাকে ঘটতে দিন। শরীরকে একদম স্থির রাখুন, এতটুকু নাড়াচাড়া, অনুভূতির স্তরকে নাড়িয়ে  পারে। কিছুক্ষনের মধ্যেই আপনার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে পারে। হতে দিন, যা হচ্ছে হতে দিন। এই অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে যাবেন না। 
প্রক্রিয়া - ৪ 
চোখ বুজে শুয়ে  পড়ুন। শান্ত ও স্থির। শরীর ঢিলে  ছেড়ে দিন।  আর দেখতে থাকুন, আপনার ভিতরে কি হচ্ছে। এইযে দেখা একেই তৃতীয়-নয়নের দেখা বলা হয়েছে। 
এই ধরনের আরো অনেক প্রক্রিয়া আছে, যা আপনারা বিভিন্ন যোগসূত্রের বই থেকে পেয়ে যাবেন। তবে নিজের সাধ্য অনুযায়ী করবেন। যোগ গুরু সান্নিধ্যে করতে হয়।  তবে উপযুক্ত গুরু না পেলে, নিজেরদের মধ্যে একটা সংগঠন করে নিন। কয়েকজন বন্ধু মিলে, নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমেও এগুনো সম্ভব।  এতে করে, একজনের সুবিধা অসুবিধা অন্য জনের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারবেন।  
তথ্যসূত্রঃ 1)  OSHO - MEDITATION - THE FIRST AND LAST FREEDOM - A PRACTICAL GUIDE TO MEDITATION COMPILED BY SWAMI DEVA WADUD. ২) যোগবীজ - স্বামী বিজ্ঞানান্দ সরস্বতী সম্পাদিত। ৩) হঠযোগ-প্রদীপিকা, শ্রী মহেশ চন্দ্র পাল সংকলিত, ও শ্রী অভিজিৎ শীল সম্পাদিত। ৪) ঘেরন্ড সংহিতা, শিব-সংহিতা, হঠযোগ প্রদীপিকা - অনুবাদক শ্রী পরিতোষ ঠাকুর, সম্পাদনা দীপেন সেনগুপ্ত। যোগসূত্র-ঋষি পতঞ্জলি। পাতঞ্জল যোগদর্শন - স্বামী ভর্গানন্দ অনূদিত।

আমরা তৃতীয় নয়নের কথা শুনছিলাম। এই  তৃতীয় নয়নের মধ্যে একটা বিন্দু যাকে  বলা হয় আজ্ঞাচক্র। এই আজ্ঞাচক্রকে কেউ কেউ বলে থাকেন, সংকল্প বিন্দু। আমাদের শরীরে বিভিন্ন রকমের চক্র আছে।  আর তার অবস্থানও শরীরের বিভিন্ন স্থানে। এদের কাজও ভিন্ন-ভিন্ন। আর এগুলো সবই আমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত। এই চক্রগুলোই আমাদেরকে পরিচালনা করে থাকে। আমরা সেসব বুঝি না। আমাদের জীবনে যে অনুশাসন তা এই আজ্ঞাচক্রের কাজ। আমাদের যৌন চক্র  আমাদের কাম-বাসনার সৃষ্টি  করে, বা বলা যেতে পারে, আমাদের উত্তক্ত বা  উদ্দীপ্ত করে। কাম-চক্র বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় হয়ে ওঠে। আবার কতকগুলো চক্র আমাদের  থেমে  থাকে অথবা এই চক্রের ক্রিয়াশীলতার গতি ধীর। যে চক্রগুলো প্রকৃতি ক্রিয়াশীল করে তোলে, সেগুলো সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। কিন্তু  আজ্ঞাচক্র সবার সমান ভাবে ক্রিয়াশীল হতে পারে না।  এমনকি বয়সের সঙ্গে সঙ্গেও এর গতি বৃদ্ধি পায় না। ভাবুন, চিন্তা  আমাদের মস্তিষ্কের কাজ। কিন্তু চক্র থাকে মাথা থেকে অনেক দূরে।  কিন্তু চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চক্র ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। আপনার মধ্যে যখন কাম-বাসনার জেগে হয়, তখন আপনার যৌনকেন্দ্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। আমাদের আজ্ঞাচক্রও চিন্তা থেকে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। যেসব লোকের আজ্ঞাচক্র ক্রিয়াশীল না হতে পারে, সে সারা জীবন দাসত্ত্ব করে যাবে। এই চক্র ক্রিয়াশীল না হলে, নিজের মধ্যে কোনো স্বতন্ত্রতা তৈরী হয় না। এদের কাছে মালিক হবার কোনো রশ্মি ধরা পড়বে  না। এদের প্রতিজ্ঞা দুর্বল।  সংকল্প সাধনের মতো দৃঢ়তা তার মধ্যে থাকে না। সে কাউকে আজ্ঞা দিতে পারে না, এমনকি নিজেকেও সে কোনো আজ্ঞা দিতে পারে না। বরং ইদ্রিয়গুলো তাকে আজ্ঞা দিতে থাকে। এদের শরীর-সর্বস্য জীবন ।  খিদে পেলে খায়, ঘুম পেলে ঘুমায়, বাহ্য  পেলে বাহ্য করে। শরীর যখন বলে অসুখ, তখন সে অসুস্থ হয়ে যায়। শরীর যখন বলে সে যুবক, তখন সে যুবক, শরীর  যখন বলে সে বৃদ্ধ, তখন সে বৃদ্ধ হয়ে যায় । এরা শরীর সর্বস্য জীব। এদের শরীর যা আজ্ঞা দেয়, সেই আজ্ঞা সে মেনে চলে।  কিন্তু যে আজ্ঞাচক্র শরীরের মধ্যেই অবস্থান করছে, তা যখন ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে, বা জেগে ওঠে তখন শরীর আজ্ঞা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। মালিক এসে গেলে, যেমন ম্যানেজার ম্রিয়মান হয়ে যায়, তেমনি আজ্ঞাচক্রের জাগরনে, মানুষের মধ্যে প্রভুত্ত্বশক্তি জেগে ওঠে। সে তখন নজ্যের শরীরকেই নির্দেশ দিতে থাকে। এবং শরীর তখন এই চক্রের নির্দেশে চলতে থাকে।

-----------------

কাল-কে অর্থাৎ  মৃত্যকে  জয় করবার উপায়। 
কালজয়ী নাদব্রহ্ম সাধনা।  (তথ্যসূত্রঃ শিবপুরান)

ওম নমঃ শিবায়ঃ। 
এই নাদব্রহ্ম সাধনার উপদেশ স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব দেবী পার্বতীকে দিয়েছিলেন। 
মহাদেব বলছেন, এই শব্দই ব্রহ্ম। না এঁকে ওঙ্কার বলা যেতে পারে, না এঁকে মন্ত্র বলা যেতে পারে, না এঁকে বীজমন্ত্র বলা  যেতে পারে, না এঁকে অক্ষর বলা যেতে পারে। এ হলো অনাহত নাদ। নাদ কথাটার অর্থ শব্দ। এই শব্দ না উচ্চারণ করতে হয়, অর্থাৎ এটি আমাদের মুখর কসরত নয়, না এটিকে আঘাতের দ্বারা তৈরী করা যায়। বিনা আঘাতেই, বিনা বাজনাতেই, এই শব্দ প্রকটিত  হয়। এর জন্য আমাদের মুখের বা গলার কোনো কসরত করতে হয় না। এঁকে  শুধু   অনুসন্ধান করতে হয়। এই অনাহত ধ্বনি সদা-সর্বদা, সর্বত্র ধ্বনিত হচ্ছে। আমরা একটু চেষ্টা করলেই, এই ধ্বনির স্বাদ গ্রহণ করতে পারি। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন যোগীপুরুষগন এই ধ্বনির অনুসন্ধান করে থাকেন। 

দেখুন আমরা জানি শব্দ নয় প্রকার। এই শব্দ বা ধ্বনিকে নাদসিদ্ধিও বলা হয়ে থাকে। ঘোষ, কাংস্য, শৃঙ্গ, ঘন্টা, বীনা, বাঁশি, দুন্দুভি, শঙ্খ, সবশেষে মেঘগর্জন। এই আহত শব্দগুলোকে ত্যাগ করে আমাদের তুঙ্কারের অভ্যাস করতে হবে। প্রথমে আমরা বিভিন্ন ধ্বনির মাহাত্ম শুনে নেই। 

১) ঘোষ - ঘোষাত্মক নাদ - যেমন ওঙ্কার। সৃষ্টির প্রথমে এই ঘোষাত্মক নাদ প্রকটিত হয়। এটি আত্মশুদ্ধির উৎকৃষ্ট সাধন। 
২) কাংস্য -নাদ  - যা প্রাণীদের গতি স্তব্ধ করে দেয় । এটি বিষকে রুদ্ধ পারে,, এমনকি ভূত, গ্রহ সবাইকে রুদ্ধ করতে পারে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। 
৩) শৃঙ্গনাদ -  অভিচারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এই শৃঙ্গনাদ । এটি শত্রুর উৎপাত ও মারনে নিয়োগ ও প্রয়োগ করতে হয়। 
৪) ঘন্টানাদ - স্বয়ং পরমেশ্বর শিব এই নাদ  উচ্চারণ করে থাকেন। এই নাদ সমস্ত দেবতাদের আকৃষ্ট করে থাকে। পৃথিবীর মানুষ তো বটেই, এমনকি যক্ষ-গন্ধর্ব কন্যাদের এই নাদ  আকর্ষণ করে থাকে। যোগীগণ এই নাদের সাহায্যে তার কামনা পূরণ করে থাকেন।
৫) বীনা-নাদ - যোগীপুরুষগন এই বীনা-নাদ সর্বদা শুনতে থাকেন। এই নাদ দূরদর্শন শক্তি প্রদান করে থাকে। 
৬) বংশীনাদ  - ধ্যানাবিষ্ট যোগী সমস্ত তত্ত্ব সম্পর্কে অবহিত হন, এই বংশীনাদের সাহায্যে। 
৭) দুন্দুভি -   সাধক জরা ও মৃত্যুর কষ্ট  থেকে রেহাই পান দুন্দুভি-নাদ চিন্তনের সাহায্যে । 
৮) শঙ্খনাদ : শঙ্খনাদের অনুসন্ধানকারী ইচ্ছে অনুযায়ী রূপ ধারণ করবার শক্তি লাভ করে থাকেন। 
৯) মেঘনাদ - মেঘনাদের কথা চিন্তা করলে, যোগী কখনও বিপত্তির সম্মুখীন হন না। 

এই নয়টি নাদ অতিরিক্ত যে ব্রহ্মরূপ তুঙ্কার, সেই তুঙ্কারের ধ্যান করলে, তার কাছে অসাধ্য বলে কিছু হয় না। তাঁর সমস্ত মনোবাঞ্ছণা পূর্ন হয়।  তিনি সর্বজ্ঞ, তিনি সর্বদর্শী, তিনি সর্বরূপধারী, তিনি সর্বত্র বিচরণে সক্ষম। কখনোই তিনি কোনো বিকারের সম্মুখীন হন না। তিনি  সমস্ত সংশয়ের অতীত। স্বয়ং শিব।      

মহাদেব বলছেন, কাল জয় করবার ইচ্ছে জাগলে, প্রতিদিন গভীর মনোযোগের সাথে কালের অংশ-ভুতের গুণাদির চিন্তা করা উচিত। আপনি দেবতা হন বা দৈত্য হন, যক্ষ হন বা রাক্ষস হন, নাগজাতির হন, বা মনুষ্যজাতির হন, কালের বিনাশ আপনার দ্বারা সম্ভব নয়।  কিন্তু যদি আপনি ধ্যান-পরায়ন যোগীপুরুষ হন, তবে আপনি সহজেই কালকে বিনাশ করতে পারেন। পঞ্চভূতের এই শরীর জানবেন, ভূতাদির পঞ্চগুণাদি যুক্ত হয়ে উৎপন্ন হয়েছে। আবার বিনাশকালে এই পঞ্চভূতেই লয়প্রাপ্ত হয়। মাটির দেহ মাটিতেই মিশে যাবে। আকাশ থেকে বায়ুর উৎপত্তি। বায়ু থেকে তেজের উৎপত্তি। তেজ থেকে জলের উৎপত্তি এবং জল থেকে পৃথিবীর উৎপত্তি। সমস্ত ভূত ক্রমশ নিজ কারনেই  লিন হয়। পৃথিবীর  পাঁচ, জলের চার, তেজের তিন, বায়ুর দুই, এবং আকাশের একটি মাত্র গুন্।  আমরা সবাই জানি, রূপ-রস-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শ পঞ্চতত্ত্বের এই গুণগুলোর কথা। এই পঞ্চভূত যখন নিজ নিজ গুন্ ত্যাগ  করে, তখন তার নাশ, আবার যখন এই গুগুলোকে গ্রহণ করে, তখন সব কিছুর প্রাদুর্ভাব হয়। এই হচ্ছে পঞ্চভূতের যথার্থ সূক্ষ্ম স্বরূপএবং জগৎ সৃষ্টির রহস্যঃ।  

যোগবত্তা পুরুষের উচিত সুখাসনে বসে বিশুদ্ধ চিত্তে প্রাণায়ামের অভ্যাস করা।  গভীর রাতে যখন সবাই নিদ্রামগ্ন, সেইসময় অন্ধকার ঘরে যোগের অভ্যাস করা উচিত। আপন তর্জনী দিয়ে দুই কান বন্ধ করুন। ৪৮ মিনিট এই প্রক্রিয়ার অভ্যাস করা উচিত। গভীর রাতে, অন্ধকার রাতে, যোগাসনে বা সিদ্ধাসনে বসে দুইটি কান অর্থাৎ বাহ্যিক শব্দ গ্রাহকযন্ত্র যখন বন্ধ  থাকবে,তখন আপনি অগ্নি-প্রেরিত শব্দ শুনতে পারবেন। এতে সন্ধ্যায় আহার করা খাদ্য অল্প সময়ের মধ্যেই হজম হয়ে যায়। সমস্ত রোগ-জ্বর ইত্যাদির উপদ্রপ বিনাশপ্রাপ্ত হয়। স্বয়ং শিব বলছেন, যে যোগী, এইভাবে ৪৮ মিনিট পর্যন্ত শব্দব্রহ্মের সাক্ষাৎ করেন, তিনি মৃত্যু ও কাম জয় ক'রে, স্বচ্ছন্দে জগতে বিচরণ করেন। তিনি হন সর্বজ্ঞ, তিনি হন সমদর্শী, সমস্ত সিদ্ধি তার করতলগত। আকাশে যেমন বর্ষাযুক্ত মেঘ গর্জন করে, শব্দব্রহ্মের সাক্ষাৎকারী সংসার বন্ধন  থেকে মুক্ত হয়ে যান। এরপর, এই শব্দব্রহ্মের চিন্তনকারীর কাছে, শব্দ সূক্ষ্ম  থেকে সূক্ষ্মতর হয়ে যায়। এই হচ্ছে শব্দব্রহ্ম চিন্তার ক্রম। চালের চিন্তা করলে, ধান থেকে খোসাকে ছাড়াতে হয়। তেমনি মোক্ষ আকাঙ্খ্যাকারীকে সমস্ত বন্ধন ত্যাগ করতে হয়।  

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।  

বন্ধু গোপাল মজুমদার, আপনি হয়তো জানেন না,  YOUTUBE - এ অন্য কারুর VIDEO  করতে গেলে, আগে সেই CHANNEL  -এর আগাম  লিখিত অনুমতি নিতে হয়। আপনি SASANKA  SEKHAR PEACE FOUNDATION -এর "গায়ত্রী মন্ত্র - যথার্থ অর্থ" VIDEO  টি আপনার CHANNEL-এ  UPLOAD করেছেন, যা আপনি করতে পারেন না।

কালকে জয় করবার দুটি  প্রক্রিয়া (তথ্যসূত্রঃ -  উমা সংহিতা)

এর আগের দিন আমরা শিবসংহিতা থেকে কালকে অর্থাৎ মৃত্যুকে জয় করবার একটা বিশেষ প্রক্রিয়ার কথা শুনেছিলাম। আজ আমরা উমা-সংহিতা থেকে কালকে জয় করবার দুটো  বিশেষ প্রক্রিয়ার কথা শুনবো। এখানেও স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব শিব এই গুহ্য যোগের কথা দেবী পার্বতীকে বলছেন।

তার আগে দু-একটি কথা বলতে চাই।  দেখুন,  আমাদের মধ্যে অনেকে আছেন, যারা শাস্ত্রবাক্যে বিশ্বাস করেন, আবার এমন অনেকেই আছেন যারা এইসব কথা গল্প বলে মনে করেন। এই দুই দলের কেউই কখনো শাস্ত্রবাক্য অনুসারে কর্ম্মে লিপ্ত হননি, একথা হলফ করে বলা যায়। আমরা কিন্তু  কোন শাস্ত্রে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী কোনোটাই নোই। আমরা  শাস্ত্রে আস্থাবান। কারন একটু আধটু যোগ অভ্যাস করতে গিয়ে দেখেছি, যোগের পরিণতি হিসেবে শাস্ত্রে যা লেখা আছে, তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। তবে আমরা  শাস্ত্রের রূপক গল্পকে গল্প হিসেবে দেখি না । আমরা  সেই রূপকের মধ্যে সত্যকে অনুসন্ধান করি। আর ফল স্বরূপ আমারা  অজ্ঞাতসারেই কখন শাস্ত্রের প্রতি আস্থাবান হয়ে উঠেছি।   

তো শাস্ত্রে বলছে,  যোগক্রিয়া ঠিকঠিক মতো ধৈর্য্য সহকারে  করতে পারলে, আপনি মৃত্যুকে জয় করতে পারবেন। মৃত্যুকে জয় করা মানে আমরা সাধারণ ভাবে  বুঝি চিরদিন এই স্থুল শরীরকে নিয়ে বেঁচে থাকা। আমরা  কিন্তু ব্যাপারটাকে এইভাবে দেখি না, আমরা  মনে করি মৃত্যুকে জয় করা মানে, জন্ম থেকে রেহাই পাওয়া।  কেননা, যার জন্ম আছে, তার অবশ্য়ই মৃত্যু আছে।  এই সব শাস্ত্র যারা লিখেছেন, তাঁরাও একদিন এই পৃথিবীতে স্থুল  দেহে বিচরণ  করেছিলেন। আবার একদিন স্থুল  দেহ পরিত্যাগ করে চলে গেছেন। তো মহাপুরুষদের দেহ একদিন জন্ম গ্রহণ করেছিল, আবার সেই স্থুল  দেহের যা কারন, অর্থাৎ পঞ্চভূত তা আবার বিনাশকালে পঞ্চভূতেই লয়প্রাপ্ত হয়েছে। তো আমরা যাকে মৃত্যু বলি, তা কিন্তু  সেইসব  মহাত্মাদেরও হয়েছে। অর্থাৎ  এই বিনাশ বা পরিণতি সমস্ত দেহের, এমনকি সমস্ত বস্তুর জন্য  নির্দিষ্ট করা আছে।  এখান থেকে কারুর পরিত্রান নেই। 
এখন কথা হচ্ছে, তা হলে মৃত্যুকে জয় করা কথাটার অর্থ কি ? এর অর্থ হচ্ছে জন্ম থেকে রেহাই পাওয়া, আর জন্ম থেকে রেহাই পাওয়া মানেই হচ্ছে মৃত্যু থেকে রেহাই পাওয়া। কেননা যার জন্ম আছে তারই মৃত্যু আছে, যার জন্ম নেই তার আবার মৃত্যু কি ? তো যোগ আমাদের এমন একটা অবস্থার মধ্যে নিয়ে যায়, যেখানে আমরা স্বরূপ সম্পর্কে সচেতন হই।  অর্থাৎ আমি যে জন্ম মৃত্যু রোহিত, সেই জ্ঞান আমাদের মধ্যে জাগ্রত হয়। অর্থাৎ আমার স্ব-স্বরূপ সম্পর্কে জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে। আমরা পাল্টায় না, আমাদের দেহের পরিণতির কোনো পরিবর্তন হয় না। প্রাকৃতিকভাবে দেহের যা পরিণতি তা আমাদের অবশ্য়ই মেনে নিতে হবে।  তবে, একথা ঠিক, যোগ করতে গিয়ে এটা আমাদের মনে হয়েছে, ভারতের মুনি-ঋষিদের  দেওয়া অধ্যাত্ম যোগ-সাধনার পার্ষফল হিসেবে, শরীরের রোগ-ভোগের পরিনাম অবশ্য়ই  অনেকটা কমতে থাকে। এমনকি নীরোগ শরীরেও থাকা সম্ভব। আমাদের স্বরূপ সম্পর্কে জ্ঞান   হলেই আমরা বুঝতে পারি, আমরা কেউ জন্মাই না আবার আমরা কেউ মারাও যাই না। 

 স্থুল শরীর জানবেন, ভূতাদির পঞ্চগুণাদি যুক্ত হয়ে উৎপন্ন হয়েছে। আবার বিনাশকালে এই পঞ্চভূতেই লয়প্রাপ্ত হয়। মাটির দেহ মাটিতেই মিশে যাবে। তাই যা থেকে আমাদের উৎপত্তি হয়েছে, অর্থাৎ পঞ্চভূতের গুণগুলো সম্পর্কে আমরা যদি অনুসন্ধিৎসু হয়, এবং আমরা যদি এই পঞ্চভূতের গভীরে মনন করতে পারি, তবে আমাদের এই জ্ঞান জন্মাতে পারে। 

তো আসুন এবার আমরা স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেবরে মুখ থেকে শুনি, কোন প্রক্রিয়ায় আমাদের এই জ্ঞান জন্মাতে পারে।  বা কি করলে আমাদের এই অমরত্বের  জ্ঞান হতে পারে। 

স্বয়ং মহাদেব বলছেন, আমাদের হৃদয়ে স্থিত প্রাণবায়ু সবসময় অগ্নিকে উদীপ্ত করে থাকে। তাই অগ্নির সহায়ক হচ্ছে প্রাণবায়ু। বায়ু আমাদের ভিতরে বাইরে সর্বত্র ব্যাপ্ত।  এবং এই বায়ুকে মহান বলে জানবে। আমাদের যে প্রবৃত্তি, জ্ঞান আহরণের প্রবৃত্তি বা উৎসাহ এটি আসে এই বায়ু থেকেই। তো যিনি বায়ুকে জয় করতে পারেন, জানবে তিনি সমগ্র জগৎকে জয় করতে পারেন। মহাদেব বলছেন, যোগপরায়ণ যোগীর ঠিকমতো ধারণা ও ধ্যানে তৎপর থাকা উচিত। কামার যেমন ফাপরের মধ্যে বাতাস প্রবেশ করিয়ে, তার সমস্ত কাজ সম্পন্ন করে থাকেন, তেমনি যোগীর প্রাণায়াম অভ্যাস অবশ্য়ই করা উচিত। প্রাণায়াম করতে করতে যিনি স্বভাবতঃ ধ্যানে লিপ্ত হন, তখন আরাধ্যদেব পরমেশ্বর অসংখ্য হস্ত -পদ- মস্তক যুক্ত হয়ে এবং সাধকের সমস্ত গ্রন্থি আবৃত ক'রে তার দশ আঙ্গুল দূরে অবস্থান করেন।

মহাদেব বলছেন : 

প্রক্রিয়া ১ : বায়ুসাধন প্রক্রিয়া :  প্রথমে ব্যাহৃতি অর্থাৎ প্রথাগত মন্ত্রপাঠ।  এবং শেষে শিবমন্ত্র সহ তিন বার গায়ত্রী জপ্ করবে এবং প্রাণবায়ু রুদ্ধ করবে অর্থাৎ কুম্ভক করবে। প্রাণের এই অয়ামকে বলে প্রাণায়াম। মহাদেব বলছেন, সূর্য, সন্ধ্যা কালে অস্ত যায়, আবার প্রভাতে ফিরে আসে।  চন্দ্র দিনদিন বৃদ্ধি পায়, পূর্ণচন্দ্র অর্থাৎ পূর্ণিমা হয়, আবার একসময় অন্ধকার জগতের সঙ্গে মিশে অমাবশ্যায় নিজেকে আবৃত করে রাখে। সবাই ফিরে ফিরে  আসে। কিন্তু প্রাণায়ামপূর্বক ধ্যান-যোগী দেহত্যাগ ক'রে আর ফিরে আসেনি অর্থাৎ মুক্ত হয়ে গেছেন ।  প্রাণায়ামসিদ্ধ ব্যক্তি আর জন্মগ্রহণ করে না। স্বয়ং শিব বলছেন, প্রাণায়ামের অভ্যাস করতে হবে প্রভাতে। ব্রাহ্ম-মুহূর্তে প্রাণায়ামের পরিণতি হচ্ছে ব্রহ্মলোক প্রাপ্তি। যিনি আলস্য রোহিত হয়ে, প্রভাতকালে প্রাণের গতিকে হৃদয়মধ্যে রুদ্ধ করতে পারেন, তিনি জরা-মৃত্যুকে জয় করে বায়ুর ন্যায় গতিশীল হয়ে আকাশে বিচরণ করতে পারেন। প্রাণায়ামসিদ্ধ পুরুষের মেধা, পরাক্রম, শৌর্য, ও কান্তি বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়ে থাকে। বায়ুসম তার গতি হয়, সৌম্যকান্তি,  পরমসুখী পুরুষ বায়ুর ন্যায় নির্ভয়ে সর্বত্র তার গতি হয়। 

প্রক্রিয়া ২ : তেজের সাধন : মহাদেব বলছেন, যেখানে মানুষের কোলাহল পৌঁছায় না, এমনিতর শান্ত-নির্জন স্থানে, সুখাসনে বসে মুদ্রিত নয়নে আলোকবর্জিত অন্ধকার স্থানে মনের চিন্তার দিকে দৃষ্টি দিলে, চন্দ্র ও সূর্য্যের ( বাম  ও ডান চক্ষু) কান্তি  দ্বারা প্রকাশিত ভ্রূমধ্যে চিদাকাশে অগ্নির তেজ অব্যক্তরূপে প্রকাশিত হয়। এই অগ্নিতেজ দ্বারা প্রকাশিত আলোক রশ্মি সবাই দেখতে সক্ষম, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। যোগী হাতের আঙুল দিয়ে যত্নসহকারে স্বল্প-স্বল্প চাপ দিয়ে চোখের মনিকে দেখতে দেখতে একাগ্র চিত্তে অর্ধ মুহূর্ত পর্যন্ত পরমেশ্বরের চিন্তা করবেন। তারপর ঘন অন্ধকারেও ধ্যান করলে তিনি সেই ঈশ্বরীয় জ্যোতি অবশ্য়ই দেখতে পাবেন। এই জ্যোতি সাদা-লাল-হলুদ-কালো এবং ইন্দ্রধনুর মতো বিচিত্র রঙযুক্ত হয়ে থাকে। দেবাদিদেব  শিব বলছেন, ভ্রুর মধ্যভাগে ললাটের মধ্যে ভোরের সূর্য্যের মতো তেজসম্পন্ন এই যে অগ্নি জ্যোতি যিনি প্রতিনিয়ত সাক্ষাৎ করেন, সেই যোগীপুরুষ ইচ্ছে অনুযায়ী রূপ ধারণ করতে পারেন। এই মহাপুরুষ আপন মনোবাঞ্ছা অনুসারে দেহে অবস্থান করে ক্রীড়া করে থাকেন। এই যোগক্রিয়ার নিরন্তর অভ্যাসে কারনতত্ত্ব শান্ত হয় এবং যোগী কারন তত্ত্বে আবিষ্ট হয়ে যান। মহাদেব বলছেন, এই মহাযোগী অন্য শরীরে প্রবেশ করতে পারেন, ইচ্ছে মতো ক্ষুদ্র বা  বৃহৎ আকার ধারণ করতে পারেন।  ইনি মনের দ্বারা সবকিছু দেখার ক্ষমতা প্রাপ্ত হন। দূরের কথা শোনা, দূরে জিনিস সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া, অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, বহু-রূপ ধারণ করা, আকাশে বিচরণ করা ইত্যাদি সমস্ত সিদ্ধি তার করায়ত্ত্ব হয়। 

এই সাধনবলে যিনি অন্ধকারের অতীত, সেই জ্যোতির্ময় পুরুষকে বা পরমাত্মাকে সাধক  জানতে পারেন।  আর পরমাত্মাকে জানলে মানুষ কাল বা মৃত্যুকে লঙ্ঘন  করতে পারে। স্বয়ং মহাদেব দেবী পার্বতীকে বলছেন, মোক্ষের জন্য, তেজতত্ত্বের ও  বায়ুতত্বের সাধনাই  উত্তম। . কালের উপর বিজয় লাভ ক'রে, অমরত্ব লাভের এটি উত্তম পন্থা।

প্রক্রিয়া - ৩ 

     

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।

জীবের  জীবনচক্র  
 জীব যাত্রা করে দেহে থেকে দেহান্তরে। এই দেহ ৭ প্রকার। 
১. স্থুল - অনন্ময়, 
২. সূক্ষ্ম : প্রাণময়, মনোময়
৩. অতিসূক্ষ্ম : বিজ্ঞানময়,
৩. কারন : আনন্দময়। 
PHYSICAL, ETHERIC, ASTRAL, MENTRAL,  SPIRITUAL, COSMIC, NIRVANIC এই ৭ রকম দেহের মধ্যে আমাদের প্রবেশ করতে হয়, তবেই মোক্ষ লাভ সম্ভব হতে পারে।    

 
অনন্ত যাত্রার ধারাবিবরণী  (১)

আজ চৌঠা জুলাই, ২০২১, ঠিক এমনই এক জুলাই মাসের ৪ তারিখে  স্বামী বিবেকানন্দের স্থুল দেহ ছেড়েছিলেন । আজ মনের মধ্যে শুধু প্রশ্ন জাগছে।  যত  বয়স বাড়ছে, তত যেন মৃত্যু আমাকে আকৃষ্ট করছে। মৃত্যুতে কে চলে যায় ? মৃত্যুতে কে শরীর ছেড়ে যায় ? আমি চলে যাই।  কে এই আমি ? আমি প্রাণ। কে এই প্রাণ ? প্রশ্ন উপনিষদ বলেছে, "কষ্মিন অহম উৎক্রান্তে  উৎক্রান্তঃ ভবিষ্যামি" - কে শরীর থেকে চলে গেলে, আমার মনে হয় আমি শরীর  ত্যাগ করেছি ? যখন কেউ মারা যান, তখন আসলে কে শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যান ? আবার কার জন্যই বা আমরা জীবিত আছি ? 

উপনিষদ (প্রশ্ন) বলছে, তিনি প্রাণ। তিনি প্রাণ  সৃষ্টি করলেন।  তিনি কে না ব্রহ্ম। প্রাণ থেকে এলো শ্রদ্ধা।  শ্রদ্ধা অর্থে জলের সূক্ষাতিসূক্ষ্ম অংশ। শ্রদ্ধা থেকে আকাশ, আকাশ থেকে বায়ু, বায়ু থেকে অগ্নি, অগ্নি থেকে জল, জল থেকে পৃথিবী, পৃথিবী থেকে ইন্দ্রিয়ের রাজা মন, মন থেকে অন্ন, অন্ন থেকে বীর্য, এরপর জ্ঞান ও কর্ম্ম সমূহ, স্বর্গ ইত্যাদি ইত্যাদি  লোক।  লোকের আবার বিভিন্ন নাম হলো, পদ হলো। 

তো মৃত্যুর সময় আমাদের দেহ ছেড়ে প্রাণ বেরিয়ে যান। প্রাণ হচ্ছে শক্তি energy . এই প্রাণকেই বলা হয়, হিরণ্যগর্ভ। প্রাণ বা হিরণ্যগর্ভ হলো সগুন ব্রহ্মের প্রথম প্রকাশ। 

আমরা শুনেছি, আমাদের নাকি মৃত্যু নেই। অর্থাৎ আমি তো শরীর  নোই।  আমি আত্মা।  আর এই আত্মা অবিনাশী। তো যিনি  অবিনাশী তার নাশ হবে কেমন করে ? তো আমি এই শরীর ছেড়ে কোথায় যাই ? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, দেহ থেকে দেহান্তরে।  এক দেহ ছেড়ে আর এক দেহে। এই আর এক দেহটা কি আরো একটা স্থুল দেহ। নাকি অন্য কোনো দেহ আছে ? শুনেছি, আমরা সবাই এক অনন্ত যাত্রার পথিক। তো কোথা থেকে কোথায়  যাই ? তো ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা যদি মেনে নেই তবে এক দেহ ছেড়ে আর এক দেহে আমরা স্থান্তারিত হই। এই দেহগুলো কেমন ? আর সেখানে আমাদের অবস্থানের সময়সীমা কতটা ?  

হিন্দু ধর্ম্ম শাস্ত্র বলছে, স্থুল সূক্ষ্ম ও কারন, পার্থিব অপার্থিব দেহ মিলিয়ে আমাদের পাঁচটি দেহ। পুনর্জন্মের এই ধারণা  খুবই গুরুত্ত্বপূর্ন।  বেদান্তদর্শন বলছে শরীর "জলৌকাবৎ" অর্থাৎ জোঁকের মতো। জোঁক গাছের এক পাতা থেকে আর এক পাতায় যায়, প্রাণ তেমনি এক দেহ থেকে অন্য দেহে যান। প্রাণ নিজেকে পাঁচভাগে বিভক্ত করে, শরীরের মধ্যে অবস্থান করেন। প্রাণ, অপান, সমান, ব্যান,  উদান।আবার  প্রাণকে উপনিষদ বলছে, আত্মার ছায়া। ছায়ার যেমন কোনো নিজস্বতা নেই, সদাই সে পুরুষের সাথী, তেমনি আত্মার ছায়া স্বরূপ প্রাণও  আত্মার সাথী। তো আমি যদি আত্মা হই, তবে প্রাণও নিশ্চই  আমার সাথে সাথে ঘুরবে। এখন কথা হচ্ছে কোন অবস্থায়, আমরা কোন দেহে প্রাণকে সাথে নিয়ে  অবস্থান করি ? এই জায়গাটা আমাদের একটু ভালোভাবে বুঝতে হবে। আমরা যেসব শরীরের মধ্যে প্রবেশ করি, আবার  একটা নির্দিষ্ট  সময়ের পরে, প্রস্থান করি, সেগুলো হচ্ছে :

PHYSICAL BODY  : অর্থাৎ দৃশ্যমান জাগতিক বস্তুদ্বারা গঠিত শরীর 
ETHERIC BODY - মহাশূন্যে পরিব্যাপ্ত অতিসুক্ষ পদার্থ দ্বারা তৈরী  শরীর।
 ASTRAL BODY , : সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক শরীর  
MENTRAL BODY , মানসিক, চিন্তা দ্বারা গঠিত শরীর   
SPIRITUAL BODY , অতিসূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক শরীর  
COSMIC BODY , মহাজাগতিক রশ্মি দ্বারা গঠিত শরীর 
NIRVANIC BODY  : নির্বাণ লাভের পরে যে শরীরের প্রাপ্তি হয়। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

অনন্ত যাত্রার ধারাবিবরণী  (১/২)
প্রথমত হচ্ছে, PHYSICAL BODY  : অর্থাৎ দৃশ্যমান জাগতিক বস্তুদ্বারা গঠিত শরীর। যাকে  আপনি অন্নময়  শরীর  বলতে পারেন। এটি পঞ্চভূতের সমাহার মাত্র।  অন্নদ্বারা পরিপুষ্ট হয়, এই স্থুল শরীর।
কথাছিলো, শরীর নিয়ে কথা বলবো।  কিন্তু শরীর কিসে প্রকাশিত থাকে তা না জানলে, আমরা শরীর সম্পর্কে বিশেষ কিছু বুঝতে পারবো না। তাই দুটো প্রাণের কথা বলে নেই। 
 দেখুন প্রাণ শরীরকে প্রকাশিত করেছে, প্রকাশিত রেখেছে। প্রাণের অবর্তমানে শরীর শূন্যে মিলিয়ে যাবে। প্রাণবিহীন শরীর তার উৎসে ফিরে যাবে।  প্রাণ কোনো বস্তু নয়, প্রাণ হচ্ছে একটা শক্তি। বেঁচে থাকবার শক্তি। আমাদের শরীরের জীবনীশক্তি। জীবনের প্রকাশ হচ্ছে এই শরীর।  এই শরীরের মধ্যে প্রতিনিয়ত শ্বাস ঢুকছে, আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। আমরা যাকে  শ্বাসক্রিয়া বলে থাকি, তার দুটো দিক, প্রবেশ ও প্রস্থান।  একবার ঢুকছে, একবার বেরুচ্ছে।  প্রতিটি শক্তির যেমন দুটো বিপরীত দিক বা প্রান্ত আছে, প্রাণের মধ্যেও দুটো গতিমুখ আছে। একটা ঋণাত্মক, আরেকটা ধনাত্মক। একটা negative আর একটা positive . ভিতরে ঢুকছে যে প্রাণবায়ু, আর বেরিয়ে আসছে যে প্রাণবায়ু দুটোরই গতিপথ আলাদা। একটা অন্তর্মুখী, আর একটা বহির্মুখী। প্রাণ যখন অন্তর্মুখী হয়, তখন আমরা প্রাণবন্ত হই , অর্থাৎ বেঁচে উঠি, ক্রিয়াশীল হই। আবার এই প্রাণ যখন বহির্মুখী হয়, তখন আমরা মারা যাই, ক্রিয়াহীন হই ।  প্রতিমুহূর্তে এই ঘটনা বিরামহীন ভাবে সংগঠিত হচ্ছে। স্থুল  শরীরে এই প্রক্রিয়ায় শক্তি-কোষের আবির্ভাব ঘটছে, যার স্থায়িত্ত্ব হচ্ছে মাত্র ৭ বছর বা তার কম। অর্থাৎ আমাদের শরীরে যে শক্তিকোষের  জন্ম হচ্ছে, তার আয়ু সর্বোচ্চ ৭ বছর। এই প্রক্রিয়া চলছে, সারা বিশ্বব্রহ্মান্ড জুড়ে। অর্থাৎ প্রতি মুহূর্তে শক্তির জন্ম হচ্ছে, আবার প্রতিমুহূর্তে শক্তির বিলোপ হচ্ছে। কিন্তু আমাদের চোখে এই আবির্ভাব ও বিলোপ বা জন্ম-মৃত্যু ধরা পড়ছে না। কারন এর গতি এতটাই দ্রুত যে আমাদের চোখ এমনকি অনুভূতিও  এটাকে ধরতে পারে না।
স্থুল শরীরে এই প্রাণের আসা যাওয়ার মাধ্যমে শরীরকে প্রকাশিত করছে, আমরা বেঁচে আছি।  ঠিক তেমনি আমাদের মানসিক শরীরে এই শক্তি কাজ করে চিন্তার মধ্যে। মনের মধ্যে চিন্তা আসছে আবার চলে যাচ্ছে। এই চিন্তার সঙ্গে আমাদের শ্বাসের সম্পর্ক আছে। এইজন্য বলা হয়ে থাকে, আপনি আমাদের চিন্তার পরিবর্তন করতে পারেন শ্বাসের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। আপনি যদি শ্বাস বন্ধ রাখেন, অর্থাৎ কুম্ভক করেন, তখন আপনার মানসিক শরীর  থেকে সমস্ত চিন্তা ওই সময়ের জন্য উধাও হয়ে যাবে। অর্থাৎ স্থুল শরীর যদি অস্বস্তিতে  থাকে, তবে জানবেন, আপনার মনও অস্থির হয়ে উঠবে। 
তবে বাতাস বা আমাদের শ্বাস মানেই প্রাণ, এমন ভাবার কোনো কারন নেই। প্রাণ হচ্ছে, বাতাসের মধ্যে মিশ্রিত  গুরুত্ত্বপূর্ন শক্তি। আমরা যখন বায়ু গ্রহণ করি, তখন আমরা প্রাণশক্তিকেই টেনে নেই, বাতাসকে নয়। আবার প্রাণশক্তিকেই ছেড়ে দেই, বাতাসকে নয় । 
আমাদের একটা ধারনা  হচ্ছে, বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করি, আর কার্বনডাই-অক্সাইড ছেড়ে দেই। শরীর বিজ্ঞানীগন বলে থাকেন, এই অক্সিজেন ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না। আসলে প্রাণশক্তি ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না। উপনিষদ বলছে, সূর্য, চন্দ্র, মেঘ, বায়ু, পৃথিবী, ইন্দ্র বা বৃষ্টি এদের সবাইকে প্রকাশ করেন প্রাণ। 

এষো-অগ্নি-তপতে এষ -সূর্য,  এষ পর্জন্যো মঘবান এষ বায়ুঃ। 
এষ পৃথিবী রয়ির্দেবঃ, সদসচ্চামৃতং চ যৎ। (প্রশ্ন- শ্লোক ২/৫)

এষঃ অগ্নি অর্থাৎ এই প্রাণই অগ্নি।  যিনি অগ্নি রূপে তাপ  প্রদান করেন। এষঃ সূর্য, অর্থাৎ এই প্রাণই সূর্য। আবার  মেঘ রূপে বৃষ্টি প্রদান করেন। ইন্দ্ররূপে সব কিছু পালন করেন, বায়ু রূপে সর্বত্র বিদ্যমান।  ইনিই সবকিছুর প্রকাশক।  এই পৃথিবী, এই চন্দ্র, সৎ অর্থাৎ সমস্ত স্থূল কার্য্য, অসৎ অর্থাৎ সূক্ষ্ম কারন অমৃতম অর্থাৎ অমর চ যৎ অর্থাৎ এই সবই প্রাণ।    
উপনিষদ উক্ত  এই প্রাণশক্তিকে শারীরবিদ্যা-বিদগন  আজও  আয়ত্ত্ব করতে পেরেছেন কী ?  সে যাই হোক, প্রাণশক্তি আমাদের শরীরের ভিতরে ঢুকে দশ ভাগে ভাগ হয়ে যায়। প্রাণ, অপান, সমান, ব্যান, উদান, নাগ, কূর্ম, কৃকর, দেবদত্ত ও ধনঞ্জয়। আসলে প্রাণ বায়ুর নানা প্রকার কর্ম্মের জন্য, তার নামও নানা প্রকার হয়ে থাকে।  শিব সংহিতায় বলা হয়েছে, প্রাণবায়ুর কর্ম্মের অসংখ্য কাজের সবগুলো  বলা সম্ভব নয়, তবে প্রধান বায়ু হচ্ছে, প্রাণ, অপান, সমান, ব্যান, উদান এর মধ্যে আবার ,প্রাণ ও অপান।প্রধান। 

শিবসংহিতায় প্রাণের অবস্থান সম্পর্কে বলা হয়েছে (তৃতীয় পটল শ্লোক ১-৮)মানুষের হৃদয়পদ্মে শিবলিঙ্গ দ্বারা অলংকৃত সেই  দ্বাদশ দল পদ্মের মধ্যে প্রাণ বাস করেন। সেই প্রাণ, পূর্বপূর্ব আদি-অন্তহীন কৃত-কর্ম্মের  সঙ্গে যুক্ত থেকে, কর্ম্মফল হেতু লভ্য অহংকার যুক্ত হয়ে, হৃদয়পদ্মে প্রাণ বাস করেন।    
১. প্রাণ, - অবস্থান - হৃদয়ে। আমাদের শোনা, দেখা, এমনকি শ্বাসক্রিয়া ইত্যাদির দায়িত্ত্বে থাকেন। 
২. অপান - গুহ্যদেশে অবস্থান। শরীরের আবর্জনা বের করবার কাজ করে থাকেন। জন্-ইন্দ্রিয়ের পরিচালনাও  করে থাকেন, অপান বায়ু।   
৩.সমান - নাভিমন্ডলে অবস্থান। খাদ্য ও পানীয়কে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে দেন।  
 ৪.ব্যান -  সর্ব শরীর জুড়ে অবস্থান। সমস্ত শরীরে যে রক্ত প্রবাহ চলে তা এই ব্যান বায়ুর ক্রিয়া। আমাদের শরীরে যে অসংখ্য ধমনী ও তার শাখা প্রশাখা আছে, এর মধ্যেই ব্যান বায়ু চলাফেরা করেন।  
৫.উদান - কণ্ঠদেশে অবস্থান। উদ্যান বায়ু জীবাত্মাকে মৃত্যকালে দেহের বাইরে নিয়ে যায়। 
৬.নাগ - বায়ুর কর্ম্ম উদ্গার তোলা। 
 ৭.কূর্ম - প্রসারণ, সংকোচন, উন্মীলন।  
৮.কৃকর - ক্ষুধা তৃষ্ণা 
 ৯.দেবদত্ত - জৃম্ভন অর্থাৎ হাই-তোলা  
 ১০.ধনঞ্জয় - হিক্কা তোলা।  
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।
 
অনন্ত যাত্রা (২)

 জীবন হচ্ছে  শ্বাসের খেলা। শ্বাসের শুরুতে প্রাণের শুরু, শ্বাসের  শেষে প্রাণের শেষ। চৈতন্য-হীন মানুষ বা জীব বেঁচে থাকতে পারে,  কিন্তু প্রাণহীন  জীব হয় না।   আমাদের সবাইকে বেঁচে থাকতে গেলে,  এই  প্রাণের সাধনা  করতে হয়।   আবার আত্মজ্ঞান লাভ করতে গেলেও প্রাণের সাধনা করতে হয়।  শারীরবিনা সাধন হয় না। আর আমাদের শরীরের প্রধান হচ্ছে  প্রাণ অর্থাৎ বায়ু। আমরা আজ এই প্রাণ বা বায়ু নিয়ে আলোচনা করবো। 
কোনো বাড়িতে ঢুকতে গেলে, কর্তার  সাথে দেখা করতে গেলে, যার সেই বাড়িতে যাতায়ত আছে, তেমন কারুর  সাহায্যে প্রবেশ করতে হয়।  আমাদের শরীরে এই বায়ু প্রতিনিয়ত যাতায়াত করছে, অর্থাৎ একবার ঢুকছে, একবার বেরোচ্ছে। আমাদেরও, ভগবানের তৈরি এই  দেহ-মন্দিরে ঢুকতে গেলে, এই প্রাণবায়ুর সাহায্য নিতে হবে। তাই আধ্যাত্মিক জগতে এই বায়ুর বা স্বাসপ্রস্বাস-এর  গুরুত্ত্ব অপরিসীম। বায়ু আমাদের আত্মা বা পরমাত্মার কাছে নিয়ে যাবার জন্য বাহক হিসেবে কাজ করতে পারে।
আজ আমরা  বায়ুর অর্থাৎ প্রাণের  গোড়ার কথায় যাবো। আমাদের সমস্ত সৃষ্টি প্রকৃতি প্রসূত। প্রকৃতি ত্রিগুণাত্বক - সত্ত্বঃ -রজঃ -তমঃ। এই ত্রিগুণের সাম্য়-অবস্থায় অব্যক্ত। আর বৈষম্য অবস্থায় হচ্ছে সৃষ্টি। সমস্ত সৃষ্টি তা চেতন বা অচেতন, যাই হোক না কেন, তা  এই প্রকৃতির সাহায্যেই  হয়েছে। সত্ত্বগুণ হচ্ছে আত্মশক্তির মুলস্পন্দন।  রজঃগুন হচ্ছে ক্রিয়া শক্তির মূল স্পন্দন। এই ক্রিয়া শক্তিই সৃষ্টিকে ভাঙে গড়ে। ক্রিয়াশক্তির এই যে কার্যরূপ তাকে বলে তমোগুণ।
শক্তির এই তমোগুণ থেকেই পঞ্চতত্ত্ব সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমে কারন-রুপী  মহাকাশ। এই আকাশ থেকে বায়ু, অর্থাৎ মহাপ্রাণশক্তি উৎপন্ন হয়েছে। মহাত্মারা বলেন, আমাদের এই দেহটি একটি ক্ষুদ্র ব্রহ্মান্ড। পঞ্চতত্ত্বের সমস্ত তত্ত্ব আমাদেরই এই দেহে বর্তমান।
এখন, আকাশ থেকে সৃষ্টি হয়েছে, বায়ু। আকাশের গুন হচ্ছে  শব্দ। বাতাসের,   নিজস্ব,গুন হচ্ছে স্পর্শ।   আর বায়ু আকাশের উত্তরাধিকারী হিসেবে যে গুন্ পেয়েছে তা হচ্ছে শব্দ । এই বায়ুই আমাদের স্পর্শ ইন্দ্রিয় অর্থাৎ ত্বকে অনুভব জাগায়। এই বায়ুই আমাদের দেহের প্রাণশক্তি, প্রাণবীজ ও প্রাণকোষ নির্মাতা। এই বায়ু আমাদের দেহের সমস্ত যন্ত্রগুলোকে, দেহের রস-রক্তকে দেহের সর্বাঙ্গে পরিচালিত করে।
আকাশভূতের ক্রিয়া আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না।  বায়ুকেও  আমরা চোখে দেখি না বটে, কিন্তু তার স্পর্শ অনুভব করি। আমরা যেমন আকাশ জুড়ে, বায়ু অগ্নি ও বরুনের খেলা প্রত্যক্ষ করি, অর্থাৎ ঝড়, বিদ্যুৎ ও মেঘ বা বৃষ্টির খেলা দেখতে পাই, তেমনি আমাদের দেহের মধ্যেও এই ত্রিদেবতার খেলা চলছে, এবং আমাদের দেহ যদিও পঞ্চভূতের তৈরি, তথাপি এই তিন ভূতের অধিক প্রাধান্য, আমাদের শরীরে। এর মধ্যে আবার বায়ু ভূতের প্রাধান্যই সর্বাধিক।
বক্ষ প্রদেশ বায়ুশক্তির প্রধান কর্ম্মকেন্দ্র।  যদিও সমস্ত দেহেই সমস্ত ভূতের কাজ চলতে থাকে, তথাপি প্রত্যেক তত্ত্বের একটি প্রধান কেন্দ্র আছে। বায়ুর প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে আমাদের বুক।  এখানে, ফুসফুসহৃদযন্ত্র, মঙ্গলগ্রন্থি এবং প্রাণকোষ নির্মাণকারী গ্রন্থি ইত্যাদি পাঁচটি গ্রন্থি ও অনেকগুলি উপগ্রন্থি আছে এখানে।  হৃদয়কেকে সাধকরা  অনাহত চক্রে কর্ম্মস্থল  বলে থাকেন । এই চক্রে অবিরত কাজ চলছে, একমুহূর্তের জন্য বিশ্রাম নেই। এই চক্রের বিশ্রাম মানে, আমাদের চিরবিশ্রাম বা মৃত্যু। বিজ্ঞান বলছে,  আমাদের বুকের পিছনের স্পাইনাল কর্ড লেভেল, বা সুষুম্না নাড়িতে অবস্থিত  অনাহত চক্র থেকে, অর্থাৎ আমাদের বুকের পিছনের সুষুম্না নাড়ি থেকে  বারোজোড়া স্নায়ু যার প্রত্যেক জোড়ায়  একটি  গ্রাহক, অন্যটি প্রেরক  স্নায়ু ( রিসেপ্টর আর একটি কন্ডাকটর ) আমাদের বুকের মধ্যে বিস্তার করে আছে।
বায়ুকে উপনিষদ পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন।  প্রাণ-ব্যান-অপান -সমান-উদান। এঁরা আমাদের দেহমন্দিরের রক্ষক। এইপাঁচজন দ্বাররক্ষক আমাদের হৃদযন্ত্রের পাঁচদিকে অবস্থান করছে।
ছান্দোগ্য উপনিষদ বলছে : আমাদের হৃদয়ের পুব দিকে প্রাণ, পশ্চিমে অপান ,দক্ষিণে ব্যান, উত্তরে সম বা সমান আর উর্দ্ধ দিকে উদান।
পূর্ব দিকে আছেন - প্রাণ। হৃদয়ের যে পূর্বদ্বার সেখানে তিনি অবস্থান করছেন। প্রাণকে বলা হচ্ছে আদিত্য বা সূর্য্য । ইনি আমাদের চক্ষুস্বরূপ। আদিত্য অর্থাৎ তেজ। এই প্রাণ বায়ুর কাজ হচ্ছে শ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ, হৃদযন্ত্র পরিচালন, খাদ্য বস্তুকে পেটের  মধ্যে পাঠানো। ধমনীর সাহায্যে আমাদের সর্ব্ব অঙ্গে রক্ত পরিচালনা - অর্থাৎ পাঠানো ও গ্রহণ করা। অর্থাৎ শিরা এবং স্নায়ুগুলোকে তাদের কাজে প্রবৃত্ত করা। 
দক্ষিণ দিকে আছেন - ব্যান।  হৃদয়ের দক্ষিণ দ্বারে ব্যানবায়ু অবস্থান করেন। ব্যান-কে  বলা হচ্ছে চন্দ্র। ইনি আমাদের কর্ন  স্বরূপ। মানুষ কানের সাহায্যে জ্ঞান লাভ করে। চন্দ্র আমাদের খাদ্যের উৎস - খাদ্য আমাদের শক্তি যোগায়। শরীরের রস-রক্তকে প্রয়োজনমতো সমস্ত শরীরে দ্রুত পরিবেশন করা, আমাদের শরীরের সংকোচন-সম্প্রসারণ, মস্তিষ্কে রক্ত পাঠানো, শরীর থেকে ঘাম বের করে দেওয়া  এই ব্যান বায়ুর কাজ। এই ব্যানবায়ু কুপিত হলে, আমাদের সমস্ত দেহে রোগের  প্রকপ হয়, এবং আমরা মারা যাই।  
পশ্চিমদ্বার, অর্থাৎ হৃদয়ের যে পশ্চিম দ্বার সেখানে অবস্থান করছেন  অপান। এটা আমাদের বাকশক্তি, আবার এই অপান-ই হচ্ছে অগ্নি। অপান বায়ুর প্রধান কাজ, প্রাণ বায়ুকে আকর্ষণ করে, প্রাণবায়ুর স্বাস প্রশ্বাস কাজকে সহায়তা করা। মল,মূত্র, শুক্র, প্রভৃতিকে নিচের দিকে চালিত করা। নারী দেহের সন্তান পোষণ, সন্তান ভূমিষ্ট করার ব্যবস্থা করা, রজঃ নিঃস্বরণ  ইত্যাদি ক্রিয়াও অপান বায়ুর অন্তর্গত।
এর পরে,হৃদয়ের উত্তর দ্বারে আছেন সমান বা সম।  আমরা যা কিছু খাই বা পান করি, সেই সকল বস্তুকে জীর্ন করে, রূপান্তরিত করে এই সমান বায়ু। অর্থাৎ সমান বায়ু আমাদের হজমশক্তি। জীর্ন খাদ্যের সার, ও অসার ভাগ অর্থাৎ প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়জনীয় অংশকে পৃথক করে অসার ভাগ বৃহৎ-অন্ত্রের ভিতর দিয়ে মলনারীতে প্রেরণ করে, এই সমান বায়ু। অপান  ও প্রাণ  বায়ুর কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করার দায়িত্ব এই সমান বায়ুর।
হৃদয়ের উর্দ্ধদিকের দিকে যে দ্বার সেখানে আছেন, উদান । পা থেকে উর্দ্ধগমনকারী বায়ু, এই ছিদ্রের মধ্য দিয়ে উপরের দিকে যায়। এই উদান বায়ুর সাহায্যেই মানুষ শব্দ করে, কথা বলে, গান ইত্যাদি করে। এই উদান বায়ুর সাহায্যেই আমাদের মন বুদ্ধি স্মৃতিশক্তি পরিপুষ্ট হয়। সাধকের কাছে, এই উদান বায়ুর খুব গুরুত্ত্ব , কারন  এই উদান বায়ুর সাহায্যেই কুন্ডলিনী শক্তিকে সাহস্রারের দিকে নিয়ে যায়। এর উদান বায়ুর সাহায্যেই  আমাদের মন অতীন্দ্রিয় জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
অতএব সচেতন ভাবে, আমাদের প্রাণকে রক্ষা করতে হবে, শক্তিশালী করতে হবে। আর এটা  করবার জন্য, আমাদের প্রতিনিয়ত খানিকটা সময়, প্রাণের অর্থাৎ স্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়াকে একাগ্রভাবে পর্যবেক্ষন করতে হবে। তার কাছে উপবেশন করতে হবে, তাতেই তিনি খুশি হবেন, এবং আমরাও ভালো থাকবো।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ - হরি  ওঁং

অনন্ত যাত্রার ধারাবিবরণী - ৩

আমাদের দেহ পাঁচ প্রকার। অর্থাৎ অন্নময়, প্রাণময়, মনময়, বিজ্ঞানময়, আনন্দময়।   এর মধ্যে একটা স্থূল, দুটি সূক্ষ্ম  (এদের বলে ভৌতিকদেহ) মানুষের যে দেহটা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়, তা আসলে অন্ন দ্বারা গঠিত, অন্ন দ্বারাই পরিপুষ্ট। একেই আমরা স্থুল  দেহ বলি। এই দেহই  আমাদের সকল দোষ-গুনের আধার, এর পরে আর কিছু নেই এমন  ধারণা কিন্তু ঠিক নয়।মৃত্যুর পরে, আমাদের দোষ-গুন্ শেষ হয়ে গেলো, এমনটা নয়। মৃত্যুর পরেও আমাদের কর্মফল, আমাদের জ্ঞান, আমাদের স্মৃতি অর্থাৎ আমাদের সঞ্চিত দোষগুণ বা অর্জিত সংস্কার, প্রারব্ধ রূপে  আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। এসব বুঝতে গেলে আগে আমাদের দেহকে আগে বুঝতে হবে।

আমরা সবাই জানি, পঞ্চভূতের তৈরী  এই দেহ।  এই দেহ বিনষ্ট হয়ে গেলে, পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাবে। আমাদের আর একটা দেহ আছে, সেটা হচ্ছে সূক্ষ্মদেহ বা লিঙ্গদেহ। এই দেহে স্থুল কোনো উপকরণ নেই। আমাদের আবেগ, কামনা, বাসনা, প্রভৃতি সূক্ষ্ম উপকরণে এই দেহ গঠিত।

এই সূক্ষ্ম দেহের ভেতরে আছে আর একটি দেহ  তার নাম মানস দেহ।

এই মানস দেহের অভ্যন্তরে অতি সূক্ষ্ম উপকরণে  তৈরী, আরও  একটি দেহ আছে তার নাম কারণদেহ। এটাই আমাদের মন, বুদ্ধির আধার।

 আমাদের দেহ আসলে পঞ্চকোষের সমষ্টি।  এগুলো হচ্ছে, অন্নময় , প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময়, এবং আনন্দময়। পরা-বিদ্যাবিদগন একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছন।

ধরুন  জলের মধ্যে একটা স্পঞ্জের বল - স্পঞ্জের বল হচ্ছে আমাদের এই স্থুলদেহ, আর স্পঞ্জের মধ্যে যে জল সেটা হচ্ছে সূক্ষ্ম দেহ, আর জলের মধ্যে যে বাতাস সেটা হচ্ছে মনোময় দেহ। বাতাসের মধ্যে যে ইথার আছে সেটা হচ্ছে বিজ্ঞানময় দেহ,  আর ইথারের মধ্যে আরো সূক্ষ্ম পদার্থ বা গুন্  আছে তাকে বলা হয় আনন্দময় দেহ । অর্থাৎ আমাদের শরীরের সর্বত্র পরস্পরের মধ্যে ওতপ্রোত ভাবে সব দেহ একত্রে অবস্থান করছে।

অন্নময় কোষ : অন্ন অর্থাৎ খাবার, অন্নময়  কোষ মানে খাবার দিয়ে  তৈরি যে কোষ রয়েছে আমাদের শরীরে। আমরা তৈত্তিরীয় উপনিষদে দ্বিতীয় অধ্যায়ে পাই : আমরা সংস্কৃত বলতে যাবো না। বাংলায় শুনবো।  এখানে বলছেন, এই জগতে যত  প্রাণী আছে, সব খাদ্য থেকে উৎপন্ন। খাদ্য দ্বারাই তারা পুষ্ট হচ্ছে আবার খাদ্যতেই বিলীন হচ্ছে।মৃত্যুর পরে আমরা সবাই খাদ্য হয়ে যাই।

প্রাণময় কোষ : অর্থাৎ উর্জা শরীর।  এই শরীর বায়ুর শক্তিতে তৈরী। খাদ্য দ্বারা তৈরী আমাদের যে শরীর তার ভিতরে প্রাণময় শরীর। এটি বায়ু দ্বারা গঠিত।  এর আকারও অন্নময় দেহেরই মতো। উপনিষদ এঁকে একটা পাখির সঙ্গে তুলনা করেছে।  প্রাণবায়ু, অর্থাৎ যে বায়ু আমরা গ্রহণ করছি সেটি হচ্ছে এই কল্পিত পাখির মাথা, ব্যান  বায়ু অর্থাৎ যে বায়ু আমাদের সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে আছে তা  হচ্ছে  ওই পাখির ডান ডানা, অপান  বায়ু অর্থাৎ যে বায়ু আমরা ছেড়ে দিচ্ছি বা নিশ্বাস  তা হচ্ছে পাখির  বাম  ডানা, এর পরে আছে সমান বায়ু বা  আকাশ যা আমাদের খাদ্য পরিপাক করে, তা আছে আমাদের পাখিটির  মধ্যে ভাগে, এবং সব শেষে উদান বায়ু  বা পৃথিবী যা আমাদের দেহের ভারসাম্য রক্ষা করছে তা হচ্ছে পাখিটির লেজ। প্রাণ আমাদের একটিমাত্র অংশে রয়েছে তা নয়। এর অবস্থান দেহের সর্বত্র। এই দেহ আমাদের প্রাণ বায়ুতে পূর্ন। 

মনময়  কোষ : অর্থাৎ মানসিক শরীর, মনের চিন্তার জগৎ । প্রাণময় কোষের ভিতরে আছে মনোময় কোষ অর্থাৎ মনের স্তর। প্রাণময় কোষ যেমন অন্নময় কোষকে পূর্ণ করে রাখে তেমনি মনময় কোষ প্রাণময় কোষকে পূর্ন করে রাখে।

এই তিন শরীরকে  ভৌতিক শরীর  বলে। অন্নময়  শরীর স্থূল।  প্রাণময় শরীর  সূক্ষ্ম  ও মনময়  শরীর অতি সূক্ষ্ম।  কিন্তু এই তিন শরীর-ই  ভৌতিক। এই তিন শরীরের উপরেই আমাদের কর্মের প্রভাব পড়বে। স্থূল শরীর  অর্থাৎ অন্নময় কোষ দ্বারা গঠিত শরীরের উপরে যেমন  কর্মের ছাপ পড়বে।  তেমনি প্রাণময় ও মনময় শরীরের উপরেও কর্মের প্রভাব আছে। কর্ম-বন্ধন  এই তিন শরীরকে জুড়ে রেখেছে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, সিমেন্ট বা আঠার মতো কর্ম এই তিন শরীরকে জুড়ে রাখতে সাহায্য করে। কর্ম বন্ধন এই তিন শরীরকে জুড়ে রাখে। অর্থাৎ আমাদের কামনা বাসনা থেকে উদ্ভুত কর্ম এই শরীরকে সজীব রেখেছে।

এর পরে আছে :
বিজ্ঞানময় কোষ (বুদ্ধির স্তর ): এটি ভৌতিক নয় কিন্তু ভৌতিক শরীরের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। মনোময় কোষ আবার বিজ্ঞানময় কোষ দ্বারা পূর্ন। বিজ্ঞানময় কোষও মানব-আকৃতি সম্পন্ন। এই কোষ মস্তকের প্রতীক। এই কোষে আমাদের শ্রদ্ধা অর্থাৎ ঋষিবাক্যের প্রতি  শ্রদ্ধা, ঋষিবাক্যের অর্থ মনন করা, সত্যকে উপলব্ধি করা, এবং আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা এর কাজ। আত্মাকে উপলব্ধি করতে গেলে আমাদের এই বিজ্ঞানময় কোষকে পুষ্ট করতে হবে। বিজ্ঞানময় কোষ বলতে বুদ্ধির স্তরকে বোঝায়। এটি আমাদের সিদ্ধান্ত নেবার বা সংকল্প গ্রহণ করার স্তর। মনোময় স্তরে অর্থাৎ আমাদের মনে সবসময় "করবো কি করবো না " এই সংশয় বা দ্বিধা থাকে।  এখান থেকে আমাদেরকে  বের করে নিয়ে আসে, এই বিজ্ঞানময় কোষ অর্থাৎ বুদ্ধির স্তর।  কোনোকিছুর সঠিক তাৎপর্য আমরা বুদ্ধির দ্বারাই বুঝতে পারি। শ্রদ্ধা, আত্মবিশ্বাস, সত্য, ন্য়য়পরায়ণতা, এবং যোগ বা একাগ্রতা আর সবশেষে মহঃ, এগুলো বিজ্ঞানময় কোষের কাজ।

আনন্দময় কোষ :  পুরোপুরি অভৌতিক। বিজ্ঞানময় কোষের মধ্যে বুদ্ধিরূপ আত্মা আছেন। বিজ্ঞানময় কোষের অভ্যন্তরে আছে আনন্দময় কোষ। এখানেই আনন্দস্বরূপ আত্মা বিচরণ করছেন। বিজ্ঞানময় কোষ এই আনন্দময় কোষ দ্বারা পরিপূর্ন। উপনিষদ বলছেন, এই আনন্দময় কোষের আকৃতিও মনুষ্যদেহীর অনুরূপ। প্রিয় জিনিস দেখার আনন্দ, প্রিয় বস্তু লাভ করার আনন্দ, প্রিয় বস্তু ভোগ করার আনন্দ, এই বিশুদ্ধ অদ্বয় আনন্দই জীবাত্মা। এইখানেই পরমাত্মার প্রতিফলন। আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মের প্রকাশ এখানেই।

বিজ্ঞানময় শরীর যা আসলে অভৌতিক, এই আনন্দময় শরীরের অর্থাৎ অভৌতিক শরীর ও ভৌতিক (মনোময়) শরীরের  সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। তার মানে বিজ্ঞানময় কোষ নিজে অভৌতিক, কিন্তু তিনি ভৌতিক ও অভৌতিক শরীরের মধ্যে সম্পর্ক জুড়ে রাখে।

ভৌতিক শরীরের রূপ বা আকার আছে। অন্নময় শরীর অতি স্থূল, তাই আমরা দেখতে পাই। প্রাণময় ও মনময় সূক্ষ্ম কিন্তু আমাদের অনুভূতির বাইরে নয়। এদুটো আসলে আউড়া বা জ্যোতি। দেখতে না পেলেও আমরা এর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি। যোগীরা এই প্রাণময় ও মনময় দেহ অর্থাৎ জ্যোতি দেখতে পান।  আর এটি আমাদের স্থূল শরীরকে ঘিরে রেখেছে।

যদি ভৌতিক শরীর নষ্ট হয়ে যায়, তবে এই বিজ্ঞানময় শরীর আনন্দময় শরীরের সঙ্গে মিশে যায় ,এবং তৎপর  আনন্দময় শরীর বিশ্বব্রমান্ডের সাথে বিলীন হয়ে যায় বা একাত্বিভূত হয়ে যায়।

ভৌতিক শরীর পঞ্চভূতের মিশ্রণ।  মৃত্যুর পরে, আমাদের ভৌতিক শরীর পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের কর্মবন্ধন, আমাদের আবার দেহধারণের জন্য উদগ্রীব হয়। ও আমরা আবার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করি। যখন আমরা কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারি তখন আমরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সাথে এক হয়ে যাই।  জন্মমৃত্যুর চক্রের থেকে মুক্ত হয়ে যাই। একে বলে, মুক্তি।  কেউ বলে সমাধি।

শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

জীবাত্মার অনন্ত যাত্রা - দেহ থেকে দেহান্তরে  - ৪ শেষ 
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, জীবাত্মা দেহ থেকে দেহান্তরে গমন করে। দেখুন দেহান্তর আর জন্মান্তর কিন্তু এক কথা নয়। স্থুল দেহে বার বার ফিরে আসাকে বলে জন্মান্তর।  আর স্থূল দেহ থেকে সূক্ষ্ম দেহে অবস্থান করাকে বলে দেহান্তর। তো আমরা সবাই শরীর  সর্বস্য। এই শরীরেই আমরা সুখ-দুঃখের অনুভূতি লাভ করে থাকি। তাই  স্থুল শরীর সম্পর্কে আমাদের প্রত্যক্ষ  ধারণা আছে । এই স্থুল শরীরের মধ্যেই জীব-শ্রেণীর বাস। কিন্তু মানুষ একাধিক দেহ সম্পর্কে সচেতন থাকতে পারে।   আমাদের দ্বিতীয় শরীর হচ্ছে,  ETHERIC BODY - মহাশূন্যে পরিব্যাপ্ত অতিসুক্ষ পদার্থ দ্বারা তৈরী  শরীর । এই সুক্ষ শরীর-এর মধ্যেও প্রবেশ-প্রস্থানের ব্যাপার আছে। আমরা যেহেতু স্থুল শরীর সম্পর্কে বেশি সচেতন, তাই শ্বাসের গমনাগমন সম্পর্কে বুঝতে পারি। আমাদের যে ৭টি শরীর  আছে, সেই  ৭টি শরীরেই এই প্রবেশ-প্রস্থানের ঘটনা ঘটতে থাকে। যখন কোনো অনুভূতি আপনার কাছে আসে, আবার চলে যায়, এটি এই ETHERIC শরীরের মধ্যে ঘটে থাকে। ধরুন আপনার কারুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হ'ল, যাকে  আপনি আগে কখনো দেখেন নি, যার কথা আপনি কখনো শোনেননি, তার সম্পর্কেও আপনার মধ্যে কিছু একটা আসছে -যাচ্ছে।হয়তো ভাবছেন, লোকটি কে ? বা দেখতে তো বেশ স্মার্ট। আপনার মনের মধ্যে যদি অপরাধবোধ থাকে, তবে তাকে আপনি পুলিশ ভাবতে পারেন। আপনার মধ্যে ভীতি জাগ্রত হতে পারে। আবার আপনার মধ্যে যদি প্রেমের আকাঙ্খ্যা থাকে, তবে তার প্রতি আপনি আকৃষ্ট হতে পারেন। আবার নাও হতে পারেন। 
 যখন আপনি তার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন, তাকে বলে প্রেম বা ঘৃণা। আকর্ষণ বা বিকর্ষণ। এই যে অনুভূতি আমাদের মধ্যে আসে, এটি আমাদের স্থুল  শরীরে আসে না, এটি আসে ETHERIC BODY  বা সূক্ষ্ম  শরীরে। এবং প্রতিমুহূর্তে এই দ্বিতীয় শরীরের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এখানে প্রেম অর্থাৎ শ্বাস নেওয়া, আর ঘৃণা অর্থাৎ শ্বাস ছেড়ে দেওয়া। এই প্রেম ও ঘৃণা একই মুদ্রার এপিঠ ও পিঠ। আবার আজ যাকে  আপনি ভালো বাসছেন, কাল আপনি তাকেই ঘৃণা করছেন। প্রেম - ঘৃণা  কখনো নদীর স্রোতের মতো একমুখী হতে পারে না। নদীর একদিক  পাহাড় মুখী , আর একটা সমুদ্র মুখী।  কিন্তু নদী একটাই। এর একদিকে উৎস আর অপরদিকে নাশ। কেউ যদি বলে আমি ভালোবাসা নেবো, ঘৃণা নেবো না তা যেমন হতে পারে না, তেমনি আমি কেবল শ্বাস নেবো, শ্বাস কখনো ছাড়বো না, তা হতে পারে না।  কেউ যদি বলে আমি কেবল জীবন  নেবো, মৃত্যু নেবো না, তা হতে পারে না।  এগুলো সবই একটা আরেকটার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।  একটাকে ছেড়ে আরেকটাকে ধরা যায় না। আপনি যখনই পছন্দের ধান্ধায় যাবেন, তখন আপনার মধ্যে একটা বৈষম্য শুরু হবে। শ্বাস নেবেন, শ্বাস ছাড়বেন না, তবে আপনার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়বে। আপনি যদি বলেন, আমি শুধু ভালোবাসা নেবো, ঘৃণা নেবো না, তবে আপনার এই দ্বিতীয় শরীর অর্থাৎ  সুক্ষ শরীর  অসুস্থ হয়ে পড়বে। শ্বাস আসবে যাবে, আপনাকে শুধু দ্রষ্টা হয়ে যেতে হবে। ভালোবাসা, প্রেম ঘৃণা আসবে যাবে, আপনাকে শুধু দ্রষ্টা হয়ে যেতে হবে। আপনি দ্রষ্টা তো সব স্বাভাবিক। তবে আমাদের শরীর সুস্থ-স্বাভাবিক। আর এই দেওয়া নেওয়া আছে বলেই, আগমন-প্রস্থান আছে বলেই সব কিছু স্বাভাবিক।  নতুবা আপনি অস্থির।  আপনার শরীর অস্থির অসুস্থ।  আপনি যদি একটিকে পছন্দ করেন, আর একটিকে অপছন্দ করেন, তবে নিজেকে বোকা বানাবেন। এই প্রথম ও দ্বিতীয় শরীরের খেলা যদি আপনি ধরতে পারেন, তবে আপনি তৃতীয় শরীর সম্পর্কে বুঝতে পারবেন। 

আমাদের তৃতীয় শরীর হচ্ছে, ASTRAL BODY. সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক শরীর।  এই সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক শরীরের একটা চুম্বকিয়  শক্তি আছে।  এই শরীর অন্যকে প্রভাবিত করতে পারে। এখানেও সেই আসা যাওয়ার খেলা। আপনি কখনো আশাবাদী, কখনো নিরাশায় ভরপুর। কখনো আপনি অতি বিশ্বাসী, সাহসী, নির্ভরশীল,  আবার কখনো আপনি ভীরু, কাপুরুষ, অবিশ্বাসী। এমন একটা সময় থাকে যখন মানুষ ঈশ্বরকেও অগ্রাহ্য করতে পারেন, আবার কখনো আপনি ভীত সন্ত্রস্ত, ঈশ্বর বিশ্বাসী, ঈশ্বরের উপরে নির্ভরশীল। যখন আমাদের তৃতীয় শরীরে চুম্বকীয় শক্তি প্রবেশ করে, তখন  আপনি মহান, আর যখন এই শক্তি আপনার থেকে বাইরে চলে যায়, তখন আপনি কিছু না, আহাম্মক।যুগ  যুগ ধরে এই প্রক্রিয়া চলছে।  প্রত্যেক মানুষ এই দ্বৈত শক্তি নিয়ে বেঁচে থাকে। এর যেকোনো একটিকে বাদ  দিয়ে, অন্যটিকে নিয়ে চলা যায় না। ঋষি অরবিন্দ একসময় জেলের মধ্যে অসহায় হয়ে গিয়েছিলেন। আবার একসময় ঈশ্বর অনুগ্রহে  অসীম শক্তির অধিকারী হতে পেরেছিলেন।  নেপোলিয়ান, বার বার হেরে গিয়েছেন, আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন।  একজন ভীরু মানুষ একসময়, সাহসী হয়ে উঠতে পারে, যখন তার মধ্যে এই চৌম্বকীয় শক্তির প্রবেশ ঘটে। আমাদের তৃতীয় শরীর  বাস করে এই চুম্বক-ক্ষেত্রে, বায়ুর মতো। এই চুম্বকশক্তি একবার আসছে, আবার চলে যাচ্ছে।  
আমাদের চতুর্থ শরীর  হচ্ছে মানসিক শরীর MENTAL BODY । যেখানে কেবল চিন্তা আসছে আবার চলে যাচ্ছে।  চিন্তা এই মানসিক শরীরে উৎসারিত হচ্ছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। আপনি যখন শ্বাস নিচ্ছেন, তখন চিন্তার জন্ম হচ্ছে, আবার যখন শ্বাস ছাড়ছেন, তখন আর কোনো নতুন চিন্তার উদয় হচ্ছে না। যখন নতুন চিন্তার জন্ম হচ্ছে, তখন আপনার শরীর  শ্বাস ছাড়তে পারবে না। যখন আপনার এই চিন্তার আসা যাওয়াকে ধরতে পারবেন, তখন আপনি আপনার মানসিক শরীরকে ধরতে পারবেন।  এই মানসিক শরীর  সম্পর্কে আমাদের সবারই একটা ধারণা  আছে, তাই এই শরীরকে বোঝা আমাদের পক্ষে সহজ।

আমাদের পঞ্চম শরীর হচ্ছে আধ্যাত্মিক শরীর, SPIRITUAL BODY . পঞ্চম শরীর জন্মের সময় আসে, আবার মৃত্যুর সময় চলে যায়। জীবন-মৃত্যু বোধ এই পঞ্চম শরীরের মধ্যে আসে।  আমরা সাধারণত শ্বাস-প্রশ্বাস ও প্রাণবায়ুকে বলতে একই জিনিস বুঝি, তার কারন হচ্ছে এই পঞ্চম শরীর।  আপনি বেশ বুঝতে পারেন, প্রাণ আপনার শরীরে আসছে, আবার প্রাণ আপনার শরীর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।  জীবন আপনার  ভিতরে আছে, তা নয়, জীবন আসছে আবার চলে যাচ্ছে স্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে। মানুষ একসময় বুঝতে পারে, জীবন কখনো একজায়গায় স্থিত নেই, কোনো কিছুই এক জায়গায় স্থিত নেই।  জীবন আসছে আবার জীবনই  বেরিয়ে যাচ্ছে। জীবনের অনুপস্থিতিকে বলা হয় মৃত্যু। মৃত্যু বলে আলাদা কিছু নেই। হয়, জীবন আছে, নয় জীবন নেই। তাই মাহাত্ম্যন বলে থাকেন,  জীবন-মৃত্যু পাশাপাশি চলছে। কখনো জীবনের আসতে  দেরি হলে, মৃত্যু আপনাকে  নিয়ে দৌড় লাগাবে। যখন আপনি এই SPIRITUAL বা আধ্যাত্মিক শরীর সম্পর্কে বুঝতে পারবেন, তখন আপনার কাছে জীবন  ও মৃত্যুর আলাদা কোনো অর্থ থাকবে না। আপনি তখন বুঝতে পারবেন, আপনি জীবন-মৃত্যুর দোলাতেই দোল খাচ্ছেন ।  একবার জীবনের দিকে এগিয়ে, একবার মৃত্যুর দিকে এগিয়ে। কোনো মানুষের জীবন দীর্ঘায়িত হয়, আবার কোনো মানুষের মৃত্যু দীর্ঘায়িত হয়। দুটো একই কথা। মানুষ কখনো বেঁচে থাকে জীবনের জন্য, আবার মানুষও কখনো বেঁচে থাকে মৃত্যুর জন্য।  হয়তো বলবেন, একই মানুষের মধ্যে এই দ্বৈত -ভাব  কেমন করে আসবে। আসবে, আসে।  মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে।  একটা পশু আত্মহত্যা  করতে পারে না , কিন্তু মানুষ আত্মহত্যা  করতে পারে। আত্মহত্যা করতে গেলে, একটা জিনিস বোঝা খুব জরুরি সেটা হচ্ছে জীবন। পশু কখনো জীবনের মানে বোঝে না। আত্মহত্যা করতে গেলে আরো একটা জিনিস দরকার সেটা হচ্ছে, মৃত্যু সম্পর্কে অজ্ঞতা। যে মৃত্যুর মানে মুঝতে পারে না, সে-ই তথাকথিত  মৃত্যুকে মৃত্যু ভাবে। তাহলে পশু আত্মহত্যা করতে পারে না, কারন সে জীবন সম্পর্কে কিছুই জানে না। কিন্তু কথা হচ্ছে আমরা অনেকেই  তো জীবন সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি, তথাপি  আমরা  কেন আত্মহত্যা  করতে পারি  না, কারন আমরা  মৃত্যু সম্পর্কে কিছু জানি  না। বুদ্ধ কখনো আত্মহত্যা করতে পারে না, কারন সে জানে এটি বেবোধের কাজ। সে জানে আমরা কাউকেই মারতে পারি না, তা সে নিজেকেই হোক বা অপরকে হোক। আমরা সাধারণ মানুষ,  আসলে না বেঁচে আছি, না মরে  গেছি। আমাদের জীবন  মৃত্যু আসলে এই পঞ্চম শরীরে অবস্থান করে। একটা শক্তি যাকে  বলা যেতে পারে জীবনী শক্তি আসছে, আবার চলে যাচ্ছে, আপনি আসলে একটা পাত্র যার ভিতরে এটি ঘটছে। আপনি যদি প্রথমটিকে ধরতে পারেন, তবে দ্বিতীয়টিকেও বুঝতে পারবেন। আপনি যদি জীবনকে ধরতে না পারেন, তবেই আপনি মারা যেতে চাইবেন। কিন্তু যদি আপনি জীবনকে ধরতে পারেন, তবে মৃত্যু চিন্তা আসবে না। প্রত্যেকের জীবনে এমন একদিন আসে যেদিন সে মৃত্যু কামনা করে থাকে। কারন সে তখন জীবনের কোনো মানে খুঁজে পায়  না। 
এই পঞ্চম শরীর আপনার কাছে, জীবন-মৃত্যু নিয়ে আসে। জীবন আসে, জীবন যায়।  আমরা কেউ এই জীবন মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত নোই। আপনি যদি একটিকে আঁকড়ে ধরতে চান, তবে অপরটি আসবে। কারন এদুটোই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। চতুর্থ শরীর পর্যন্ত জীবন ও মৃত্যুর  খেলা ধরা সম্ভব নয়। পঞ্চম শরীর পার্থক্যটা বুঝতে পারে। আবার এও বুঝতে পারে যে জীবন মৃত্যু আলাদা নয়, একই জিনিসের এপিঠ-ওপিঠ। এই পঞ্চম শরীর  পর্যন্ত আমাদের বুদ্ধির দ্বারা ধরা যায়।
 কিন্তু  ষষ্ঠ শরীর আমাদের কাছে দুর্বোধ্য।  কারন এখানে জীবন-মৃত্যু বলে কিছু নেই। এখানে আমি বলে কিছু নেই।  অহং বলে কিছু নেই। এই শরীরে অবস্থানকালে, সবকিছুর সঙ্গে একাত্ম বোধ করি। এখানে কিছু আসছে বা যাচ্ছে বলে কিছু নেই। পঞ্চম শরীর  পর্যন্ত আসা যাওয়ার খেলা চলতে থাকে। কিন্তু ষষ্ঠ শরীরে আসা যাওয়া বলে কিছু নেই। এখন সবই স্থিতিহীন, ঐশ্বরিক। দ্বৈতভাব ততক্ষনই থাকে যতক্ষন আমরা সৃষ্টি ও প্রলয়  বর্তমান থাকে।  আসা যাওয়া থাকে। জন্ম মৃত্যু থাকে। কিন্তু ষষ্ঠ শরীরের সৃষ্টি শক্তি ও প্রলয়ের শক্তি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।  হিন্দু মতে এই শক্তি বা শরীর হচ্ছে ব্রহ্মা ও  শিব। ব্রহ্মা হচ্ছে সৃষ্টির দেবতা আর শিব হচ্ছেন প্রলয়ের দেবতা। হিন্দু মতে বিষ্ণু হচ্ছেন, পালনকর্তা। শিব হচ্ছেন, সমস্ত দ্রবীভূত করন কর্তা।  সমস্ত জিনিষকে তার স্বক্ষেত্রে ফিরিয়ে দেয়। আপনার প্রতিটি মুহূর্ত সৃষ্টির জন্য, আবার প্রতিটি মুহূর্তই ধংসের জন্য।  প্রতিটি মুহূর্তে আপনার কাছে স্রষ্টা  আসছেন, আবার প্রতিটি মুহূর্তেই আপনার কাছে প্রলয়কর্তা  আসছেন। তাই যোগী যখন সৃষ্টিকে প্রতক্ষ্য করেন, যখন প্রলয়কে প্রতক্ষ্য করেন, তখন জানবেন, তিনি ষষ্ঠ শরীরে অবস্থান করছেন। এখানে আমি বলে আলাদা কিছু নেই।  এখানে যাকিছু আসছে, তা তুমি, আবার যা কিছু যাচ্ছে তাও তুমি। এখানে তুমি-আমি বলে কিছু নেই, এখানে একটাই সত্ত্বা বিরাজ করছে। নক্ষত্রের জন্ম হচ্ছে, মৃত্যু হচ্ছে। এই যাওয়া আসা আসলে তোমারই আসা যাওয়া।  এইজন্য হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়ে থাকে, ব্রহ্মার শ্বাস-প্রশ্বাস ।  ব্রহ্মা যখন  শ্বাস নিচ্ছেন, তখন সৃষ্টি প্রকাশিত হচ্ছে, নক্ষত্রের জন্ম হচ্ছে, আর যখন ব্রহ্মা শ্বাস ছাড়ছেন, তখন সবকিছুর ব্রহ্মার ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে, অর্থাৎ প্রলয় হচ্ছে। সৃষ্টি নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে। এইসব কথা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা খুবই মুশকিল। ষষ্ঠ শরীরে আমিত্ব থাকে না, এখানে শরীর হচ্ছে মহাজাগতিক রশ্মি। সমস্ত ধর্ম্ম যখন সৃষ্টির কথা বলে থাকে, তখন তারা সবাই এই মহাজাগতিক রশ্মির কথা বলে থাকেন। ষষ্ঠ শরীরে যারা অবস্থান করেন, সমস্ত কিছুর মৃত্যুকে নিজের মৃত্যু বলে দেখেন, সমস্ত কিছুর জন্মকে নিজের জন্ম বলে দেখেন।  সমস্ত  জীব-জন্তুর মধ্যেও তিনি নিজেকে দেখতে পান। তাই ঠাকুর রামকৃষ্ণের  শরীরে নৌকার মাঝির ব্যথার দাগ ফুটে ওঠে। আপনি যখন সত্যি সত্যি সৃষ্টি-প্রলয়ের রহস্যঃ উপলব্ধি করতে পারবেন, তখন আপনি জানবেন শাস্তি শরীরে অবস্থান করছেন। নাদির একুল ভাঙ্গে অকুল গড়ে, আজ কোনো মৃত্যু ঘটলে, জানবেন কোথাও না কোথাও কেউ জন্ম গ্রহণ করেছে। একটা চাঁদের মৃত্যু হলে, অন্য চাঁদের জন্ম হবে , একটা পৃথিবীর মৃত্যু হলে, অন্য একটা পৃথিবীর জন্ম হবে। আপনি কোথাও গর্ত করবেন তো কোথাও স্তুপ হবে। মনুষ্যত্ত্বের মৃত্যু হয় না, মানুষের মৃত্যু হয়। আপনার অসুখ করলে জানবেন, প্রকৃতির মধ্যে কোথাও না কোথাও  তার ঔষধী-গাছের জন্ম হয়েছে। আমাদের ষষ্ঠ শরীর এই সৃষ্টির রহস্যঃ ধরতে পারে। উপলব্ধি করতে পারে। সৃষ্টি স্থিতি লয়।  রেচক-কুম্ভক-পূরক।  স্বয়ং ব্রহ্মার এই অপূর্ব খেলা যিনি ধরতে পারেন, তিনি জানবেন ষষ্ঠ শরীরে মধ্যেই অবস্থান করতে পারেন। আপনি যদি জন্ম-মৃত্যুকে ধরতে পারেন, তবে আপনি স্থিতিকেও ধরতে পারবেন। বিষ্ণু বর্তমান, শিব ভবিষ্যৎ, ব্রহ্মা অতীত। এই তিনে মিলে  কাল। এই তিনকে যিনি সম্যকরূপে জানতে পেরেছেন, তিনি ষষ্ঠ শরীরকে ধরতে পেরেছেন। 
সপ্তম শরীরকে ধরতে পারা, আরো কঠিন। ভগবান বুদ্ধ এই শরীরকে বলছেন, জ্ঞানময় শরীর, নির্বাণ-কায়া BODY OF  ELLIGHTMENT ।  দেহের অন্তিম সর্বোচ্চ  অবস্থা হচ্ছে এই সপ্তম শরীর। এর পরে আমরা শারীরবিহীন হয়ে যাই। সপ্তম শরীরে শূন্যই সত্য। অন্তিম অবস্থা থাকা বা না থাকা কোনোটাই যখন প্রকাশিত নয়, তখন সপ্তম শরীরের কথা জানা যায়। ঘর থেকে বেরিয়ে পড়া।  এতদিন এঘর  ওঘর করছিলাম।  এবার বাইরে বেরিয়ে এলাম। অনন্ত আকাশ, অসীম তার ব্যাপ্তি। কিন্তু আকাশ তখন ছাদ , বাতাস তখন চাদর, পৃথিবী তখন বিছানা। কিন্তু একটা আশ্রয় আছে।  এর পরের অবস্থা শরীরের বাইরে। তখন এই অসীমকেও  ছাড়িয়ে,  শরীরের বাইরে অবস্থান করতে হয় ।  
প্রাণ হচ্ছে সেই শক্তি, যা আমাদেরকে এক দেহ থেকে আর দেহে নিয়ে যায়। এ প্রাণের শক্তি দিয়েই আমরা স্থুল দেহে থাকি, এই প্রাণের শক্তি আমাদের কাছে প্রকট হয় শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে। প্রভাবশক্তি  চুম্বকশক্তি, চিন্তাশক্তি, জীবনীশক্তি, সৃষ্টিশক্তি, স্থিতিশক্তি - এই সমস্ত শক্তিগুলোকে চালনা করে থাকে প্রাণ শক্তি। অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, উপলব্ধি, অনুভব মানুষকে পরিবর্তন করতে থাকে। এই পরিবর্তনের মধ্যে দিয়েই জীবাত্মা একটি শরীর  ছেড়ে অন্য শরীরে প্রবেশ করতে পারে। এই যাত্রাকেই বলে অনন্ত যাত্রা।  ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম।  
                 
আমাদের এই দেহ অসংখ্য স্তরে বিভক্ত। অসংখ্য বলতে আমরা যেহেতু কিছুই বুঝতে পারি না।  তাই বুঝবার সুবিধার জন্য  এই দেহকে আমরা পাঁচটি ভাগে ভাগ করতে পারি। ১. অন্নময় , ২. প্রাণময়,
৩. মনোময়, ৪. বিজ্ঞানময়, ও ৫. আনন্দময়। এর মধ্যে অন্নময় দেহ স্থুল, প্রাণময় ও মনোময় সূক্ষ্ম। এই তিনটি দেহকেই একত্রে বলা হয় ভৌতিক দেহ। বিজ্ঞানময় ও আনন্দময় দেহ অভৌতিক দেহ। 

অন্নময় দেহ   : আমরা আমাদের যে দেহটা দেখতে পাই সেটা অন্নময় অর্থাৎ খাদ্য দ্বারা গঠিত ও খাদ্যদ্বারা পরিপুষ্টি লাভ করে। এটি স্থূল দেহ।
এর পরে আছে প্রাণময় দেহ যা আমাদের বাতাস থেকে সংগৃহিত উর্জা শক্তি দ্বারা গঠিত। সবশেষে মনোময় দেহ যা আমাদের কামনা বাসনা আবেগ দ্বারা গঠিত। এই দুটো দেহকে সুক্ষ দেহ বা লিঙ্গদেহ  বলা হয়।
এর পরে আছে কারন দেহ অর্থাৎ বিজ্ঞানময় ও আনন্দময় দেহ। আত্মা সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই বললেই চলে। আত্মা আছে, এটা বুঝি বা স্বীকার করি, কিন্তু কি সে বস্তূ তা আমরা জানিনা। আমাদের বুঝবার সুবিধার জন্য একে আমরা জ্ঞান বা চৈতন্য বলতে পারি। এই আত্মার অবস্থানের জন্য বা বসবাস করবার জন্য, অদৃশ্য উপকরণে তৈরী, আমাদের একটি দেহ আছে, তাকে বলা হয় কারন দেহ। এই দেহ লিঙ্গহীন। আমাদের চিন্তা, মনের ভাব ইত্যাদির উৎপত্তি স্থান হচ্ছে এই কারন দেহ। মানুষের যে দেহ যখন সক্রিয় থাকে, তখন সে সেই ভাব পোষন করে। এবং কারন দেহে যিনি বাস করেন, তিনিই সেই অজর, অমর, শাশ্বত আত্মা। অর্থাৎ প্রতিবিম্বিত পরম-আত্মা। আবার বলি এই কারন দেহেই পরম-আত্মা প্রতিফলিত হন। সূর্য যেমন সৌরজগতের সবকিছুর মধ্যে প্রতিফলিত হন ও বিকশিত করেন, তেমনি পরম-আত্মা শতকোটি ব্রহ্মাণ্ডে প্রতিফলিত হচ্ছেন। শেষে একটা কথা বলি, আমাদের পাঁচটি দেহেরই উপকরণ সূক্ষ্ম। সূক্ষ্মের ঘনত্ত্ব যখন বৃদ্ধি পায় তখন তাকে আমরা স্থূল বলি, অর্থাৎ আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় ।

আমাদের স্থূল শরীর  যখন ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যায়, তখন আমাদের অহং অর্থাৎ আমরা  কামদেহে অবস্থান করি। অর্থাৎ স্থূল দেহের সাথে আমাদের অন্নময় ও প্রানময় দেহ লোপ পায় তখন আমরা কামদেহে অবস্থান করি। কামদেহ আর কিছু নয়, আমাদের মনোময় দেহের দুটি অংশ। একটা কামনাময় আর একটা বাসনাময়। কামদেহে আমরা ততক্ষনই অবস্থান করি, যতক্ষন আমাদের কামনা পূরণের প্রবৃত্তি থাকে।এই জগৎটাকে বলা হয় ভুবর্লোক। অর্থাৎ মৃত্যুর পরেই আমরা এই ভুবর্লোকে প্রবেশ করি।এই ভুবর্লোকের অবস্থান কাল শেষ হয়ে গেলে বা কামনা পূরণের অবস্থা না থাকলে, বা কামনা পূরণ  হয়ে গেলে, তবেই আমরা মনোময় শরীরের অন্য অংশের মধ্যে প্রবেশ করি। এই মনময় শরীরে সংকল্প সিদ্ধ করবার জন্য, অর্থাৎ বাসনা পূরণের জন্য আমাদের যে অবস্থা চলতে থাকে  তাকেই আমরা স্বর্গবাস বলি।

এখানে আমি দুটো শব্দ ব্যবহার করলাম, একটা হচ্ছে কামনা, আর একটা হচ্ছে বাসনা। আমাদের সাধারণের দৃষ্টিতে কামনা ও বাসনা একই অর্থ। আসলে কিন্তু তা নয়।  কামনা হচ্ছে আপন বা নিজের  সুখের নিমিত্ত ভোগে প্রবৃত্ত হওয়া।  আর বাসনা হচ্ছে সংকল্প বা কিছু করবার ইচ্ছে।

এবার আমরা মূল আলোচ্য বিষয়ে যাবো। পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন :

কামনার লোক হতে মানুষ  স্বর্গলোকে গমন  করে। 

আমাদের কামদেহ  যে স্তরে কাজ করে, তাকে বলা হয় কামলোক।  আর মানস দেহের্ যে অবস্থা  বা যে স্তরে সংকল্প  কাজ করে তাকে বলা হয় স্বর্গলোক। 

মানুষ মৃত্যুর পরে,   প্রথমে কিছুদিন কামলোকে বা ভুবর্লোকে বাস করেন।  সেখানকার স্থিস্তিকাল শেষ হলে, জীব তন্দ্রাভিভূত হয়ে পড়েন। কামলোকের কোনো স্পন্দন গ্রহণ করবার উপকরণ তার দেহে না থাকার জন্য তার সংবিৎশক্তি অধিক পরিমানে অন্তর্মুখী হয়। এর ফলে কামলোকে সন্মন্ধে তার আর কোনো জ্ঞান থাকে না। মনোময় দেহের উপকরণগুলি সজ্জিত হওয়ায় মানসদেহ পরিপুষ্ট হয়, এবং জীব তখন কামদেহ ত্যাগ করে, মনোময় দেহ ধারণ করে এবং মানস লোকে উপনীত হয়। এই অবস্থাই স্বর্গলোকের নিম্নতর স্তর। 

এইখানে আমরা আবার একবার বলি  - সেটা হচ্ছে আমাদের দেহ পাঁচ প্রকার।অর্থাৎ অন্নময়, প্রাণময়, মনময়, বিজ্ঞানময়, আনন্দময়।   এর মধ্যে একটা স্থূল, দুটি সূক্ষ্ম  (এদের বলে ভৌতিকদেহ) মানুষের যে দেহটা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়, তা আসলে অন্ন দ্বারা গঠিত, অন্ন দ্বারাই পরিপুষ্ট। একেই আমরা স্থুল  দেহ বলি। এই দেহই  আমাদের সকল দোষ-গুনের আধার, এর পরে আর কিছু নেই এমন  ধারণা কিন্তু ঠিক নয়।মৃত্যুর পরে, আমাদের দোষ-গুন্ শেষ হয়ে গেলো, এমনটা নয়। মৃত্যুর পরেও আমাদের কর্মফল, আমাদের জ্ঞান, আমাদের স্মৃতি অর্থাৎ আমাদের সঞ্চিত দোষগুণ বা অর্জিত সংস্কার, প্রারব্ধ রূপে  আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। এসব বুঝতে গেলে আগে আমাদের দেহকে আগে বুঝতে হবে।

আমরা সবাই জানি, পঞ্চভূতের তৈরী  এই দেহ।  এই দেহ বিনষ্ট হয়ে গেলে, পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাবে। আমাদের আর একটা দেহ আছে, সেটা হচ্ছে সূক্ষ্মদেহ বা লিঙ্গদেহ। এই দেহে স্থুল কোনো উপকরণ নেই। আমাদের আবেগ, কামনা, বাসনা, প্রভৃতি সূক্ষ্ম উপকরণে এই দেহ গঠিত।

এই সূক্ষ্ম দেহের ভেতরে আছে আর একটি দেহ  তার নাম মানস দেহ।

এই মানস দেহের অভ্যন্তরে অতি সূক্ষ্ম উপকরণে  তৈরী, আরও  একটি দেহ আছে তার নাম কারণদেহ। এটাই আমাদের মন, বুদ্ধির আধার।

 আমাদের দেহ আসলে পঞ্চকোষের সমষ্টি।  এগুলো হচ্ছে, অন্নময় , প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময়, এবং আনন্দময়। পরা-বিদ্যাবিদগন একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছন।

ধরুন  জলের মধ্যে একটা স্পঞ্জের বল - স্পঞ্জের বল হচ্ছে আমাদের এই স্থুলদেহ, আর স্পঞ্জের মধ্যে যে জল সেটা হচ্ছে সূক্ষ্ম দেহ, আর জলের মধ্যে যে বাতাস সেটা হচ্ছে মনোময় দেহ। বাতাসের মধ্যে যে ইথার আছে সেটা হচ্ছে বিজ্ঞানময় দেহ,  আর ইথারের মধ্যে আরো সূক্ষ্ম পদার্থ বা গুন্  আছে তাকে বলা হয় আনন্দময় দেহ । অর্থাৎ আমাদের শরীরের সর্বত্র পরস্পরের মধ্যে ওতপ্রোত ভাবে সব দেহ একত্রে অবস্থান করছে।

অন্নময় কোষ : অন্ন অর্থাৎ খাবার, অন্নময়  কোষ মানে খাবার দিয়ে  তৈরি যে কোষ রয়েছে আমাদের শরীরে। আমরা তৈত্তিরীয় উপনিষদে দ্বিতীয় অধ্যায়ে পাই : আমরা সংস্কৃত বলতে যাবো না। বাংলায় শুনবো।  এখানে বলছেন, এই জগতে যত  প্রাণী আছে, সব খাদ্য থেকে উৎপন্ন। খাদ্য দ্বারাই তারা পুষ্ট হচ্ছে আবার খাদ্যতেই বিলীন হচ্ছে।মৃত্যুর পরে আমরা সবাই খাদ্য হয়ে যাই।

প্রাণময় কোষ : অর্থাৎ উর্জা শরীর।  এই শরীর বায়ুর শক্তিতে তৈরী। খাদ্য দ্বারা তৈরী আমাদের যে শরীর তার ভিতরে প্রাণময় শরীর। এটি বায়ু দ্বারা গঠিত।  এর আকারও অন্নময় দেহেরই মতো। উপনিষদ এঁকে একটা পাখির সঙ্গে তুলনা করেছে।  প্রাণবায়ু, অর্থাৎ যে বায়ু আমরা গ্রহণ করছি সেটি হচ্ছে এই কল্পিত পাখির মাথা, ব্যান  বায়ু অর্থাৎ যে বায়ু আমাদের সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে আছে তা  হচ্ছে  ওই পাখির ডান ডানা, অপান  বায়ু অর্থাৎ যে বায়ু আমরা ছেড়ে দিচ্ছি বা নিশ্বাস  তা হচ্ছে পাখির  বাম  ডানা, এর পরে আছে সমান বায়ু বা  আকাশ যা আমাদের খাদ্য পরিপাক করে, তা আছে আমাদের পাখিটির  মধ্যে ভাগে, এবং সব শেষে উদান বায়ু  বা পৃথিবী যা আমাদের দেহের ভারসাম্য রক্ষা করছে তা হচ্ছে পাখিটির লেজ। প্রাণ আমাদের একটিমাত্র অংশে রয়েছে তা নয়। এর অবস্থান দেহের সর্বত্র। এই দেহ আমাদের প্রাণ বায়ুতে পূর্ন। 

মনময়  কোষ : অর্থাৎ মানসিক শরীর, মনের চিন্তার জগৎ । প্রাণময় কোষের ভিতরে আছে মনোময় কোষ অর্থাৎ মনের স্তর। প্রাণময় কোষ যেমন অন্নময় কোষকে পূর্ণ করে রাখে তেমনি মনময় কোষ প্রাণময় কোষকে পূর্ন করে রাখে।

এই তিন শরীরকে  ভৌতিক শরীর  বলে। অন্নময়  শরীর স্থূল।  প্রাণময় শরীর  সূক্ষ্ম  ও মনময়  শরীর অতি সূক্ষ্ম।  কিন্তু এই তিন শরীর-ই  ভৌতিক। এই তিন শরীরের উপরেই আমাদের কর্মের প্রভাব পড়বে। স্থূল শরীর  অর্থাৎ অন্নময় কোষ দ্বারা গঠিত শরীরের উপরে যেমন  কর্মের ছাপ পড়বে।  তেমনি প্রাণময় ও মনময় শরীরের উপরেও কর্মের প্রভাব আছে। কর্ম-বন্ধন  এই তিন শরীরকে জুড়ে রেখেছে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, সিমেন্ট বা আঠার মতো কর্ম এই তিন শরীরকে জুড়ে রাখতে সাহায্য করে। কর্ম বন্ধন এই তিন শরীরকে জুড়ে রাখে। অর্থাৎ আমাদের কামনা বাসনা থেকে উদ্ভুত কর্ম এই শরীরকে সজীব রেখেছে।

এর পরে আছে :
বিজ্ঞানময় কোষ (বুদ্ধির স্তর ): এটি ভৌতিক নয় কিন্তু ভৌতিক শরীরের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। মনোময় কোষ আবার বিজ্ঞানময় কোষ দ্বারা পূর্ন। বিজ্ঞানময় কোষও মানব-আকৃতি সম্পন্ন। এই কোষ মস্তকের প্রতীক। এই কোষে আমাদের শ্রদ্ধা অর্থাৎ ঋষিবাক্যের প্রতি  শ্রদ্ধা, ঋষিবাক্যের অর্থ মনন করা, সত্যকে উপলব্ধি করা, এবং আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা এর কাজ। আত্মাকে উপলব্ধি করতে গেলে আমাদের এই বিজ্ঞানময় কোষকে পুষ্ট করতে হবে। বিজ্ঞানময় কোষ বলতে বুদ্ধির স্তরকে বোঝায়। এটি আমাদের সিদ্ধান্ত নেবার বা সংকল্প গ্রহণ করার স্তর। মনোময় স্তরে অর্থাৎ আমাদের মনে সবসময় "করবো কি করবো না " এই সংশয় বা দ্বিধা থাকে।  এখান থেকে আমাদেরকে  বের করে নিয়ে আসে, এই বিজ্ঞানময় কোষ অর্থাৎ বুদ্ধির স্তর।  কোনোকিছুর সঠিক তাৎপর্য আমরা বুদ্ধির দ্বারাই বুঝতে পারি। শ্রদ্ধা, আত্মবিশ্বাস, সত্য, ন্য়য়পরায়ণতা, এবং যোগ বা একাগ্রতা আর সবশেষে মহঃ, এগুলো বিজ্ঞানময় কোষের কাজ।

আনন্দময় কোষ :  পুরোপুরি অভৌতিক। বিজ্ঞানময় কোষের মধ্যে বুদ্ধিরূপ আত্মা আছেন। বিজ্ঞানময় কোষের অভ্যন্তরে আছে আনন্দময় কোষ। এখানেই আনন্দস্বরূপ আত্মা বিচরণ করছেন। বিজ্ঞানময় কোষ এই আনন্দময় কোষ দ্বারা পরিপূর্ন। উপনিষদ বলছেন, এই আনন্দময় কোষের আকৃতিও মনুষ্যদেহীর অনুরূপ। প্রিয় জিনিস দেখার আনন্দ, প্রিয় বস্তু লাভ করার আনন্দ, প্রিয় বস্তু ভোগ করার আনন্দ, এই বিশুদ্ধ অদ্বয় আনন্দই জীবাত্মা। এইখানেই পরমাত্মার প্রতিফলন। আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মের প্রকাশ এখানেই।

বিজ্ঞানময় শরীর যা আসলে অভৌতিক, এই আনন্দময় শরীরের অর্থাৎ অভৌতিক শরীর ও ভৌতিক (মনোময়) শরীরের  সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। তার মানে বিজ্ঞানময় কোষ নিজে অভৌতিক, কিন্তু তিনি ভৌতিক ও অভৌতিক শরীরের মধ্যে সম্পর্ক জুড়ে রাখে।

ভৌতিক শরীরের রূপ বা আকার আছে। অন্নময় শরীর অতি স্থূল, তাই আমরা দেখতে পাই। প্রাণময় ও মনময় সূক্ষ্ম কিন্তু আমাদের অনুভূতির বাইরে নয়। এদুটো আসলে আউড়া বা জ্যোতি। দেখতে না পেলেও আমরা এর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি। যোগীরা এই প্রাণময় ও মনময় দেহ অর্থাৎ জ্যোতি দেখতে পান।  আর এটি আমাদের স্থূল শরীরকে ঘিরে রেখেছে।

যদি ভৌতিক শরীর নষ্ট হয়ে যায়, তবে এই বিজ্ঞানময় শরীর আনন্দময় শরীরের সঙ্গে মিশে যায় ,এবং তৎপর  আনন্দময় শরীর বিশ্বব্রমান্ডের সাথে বিলীন হয়ে যায় বা একাত্বিভূত হয়ে যায়।

ভৌতিক শরীর পঞ্চভূতের মিশ্রণ।  মৃত্যুর পরে, আমাদের ভৌতিক শরীর পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের কর্মবন্ধন, আমাদের আবার দেহধারণের জন্য উদগ্রীব হয়। ও আমরা আবার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করি। যখন আমরা কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারি তখন আমরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সাথে এক হয়ে যাই।  জন্মমৃত্যুর চক্রের থেকে মুক্ত হয়ে যাই। একে বলে, মুক্তি।  কেউ বলে সমাধি।


   



  
 ASTRAL, : সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক শরীর  
MENTRAL, মানসিক, চিন্তা দ্বারা গঠিত শরীর   
SPIRITUAL, অতিসূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক শরীর  
COSMIC, মহাজাগতিক রশ্মি দ্বারা গঠিত শরীর 
NIRVANIC : নির্বাণ লাভের পরে যে শরীরের প্রাপ্তি হয়।  
        

   

    

       
        ,   

         

      

           

  

 








No comments:

Post a Comment