Friday 19 February 2021

প্রাণ - রহস্যঃ : প্রশ্ন উপনিষদ

 


মৃত্যু রহস্যঃ (৬) : প্রাণ - রহস্যঃ

মরা মানুষ কি কখনো বেঁচে উঠতে পারে ? মৃত দেহে কি প্রাণের সঞ্চার সম্ভব ? জিজ্ঞাসুর এই প্রশ্ন শুনে স্বামীজী যেন বিরক্ত হলেন।  কোনো জবাব দিলেন না। পরদিন সকালবেলা, স্বামীজী কতকগুলো শুকনো কাঠ-পাতা জোগাড় করে আগুন জ্বালাতে বললেন। আমরা ভাবলাম, শীতের সকালে উত্তাপ নেবার জন্য বোধহয়, আগুন জ্বালাতে বলেছেন। কিছুক্ষন পরে, অগ্নিশিখা মিলিয়ে গেলো, আগুন নিভু-নিভু হয়ে এলো।   তখনও  জ্বালনির ভিতরে অগ্নি-স্ফুলিঙ্গ জোনাকির মতো  রয়ে গেছে। বললেন, আরো কিছু কাঠ পাতা ছাইয়ের উপরে দিয়ে দিতে। এবারে ফুঁ দিতে বললেন। আমরা তাই দিলাম, আগুন আবার তীব্র আকার নিলো। অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত হয়ে আবার আগের মতো হয়ে উঠলো। কিন্তু ধীরে ধীরে, ইন্ধনের অভাবে, একসময় আগুন আবার নিভে যেতে লাগলো। এর পরে একসময় পড়ে রইলো শুধুই  ছাই। স্বামীজী  আবার কাঠ-পাতা দিতে বললেন, ফুঁ দিতে বললেন। কিন্তু আগুন আর জ্বলে উঠলো না। স্বামীজী বললেন, এই হচ্ছে তোমাদের কালকের প্রশ্নের জবাব।       

স্বামীজী বলছেন, কাল কাউকে ছাড়বে না। সবাইকেই কালের কবলে পড়তে হবে। এখন কথা হচ্ছে, দিন রাত্রি আছে বলেই, আমরা কালের ধারণা  করে থাকি। অর্থাৎ চন্দ্র সূর্য আছে বলে, কালের পরিবর্তন লক্ষিত হয়। আমরা যদি চন্দ্র সূর্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম, তবে কাল আমাদের ইচ্ছেমতো প্রবাহিত হতো।  অথবা নিজেকে যদি চন্দ্র সূর্য্যের গন্ডির বাইরে  নিয়ে যেতে পারি, তবে চন্দ্র সূর্য যার প্রভাবে কাল গতি সম্পন্ন হয়েছে, তার প্রভাব থেকে আমরা মুক্ত থাকতে পারতাম। আসলে আমাদের মনে হয়, কাল গতিশীল, কিন্তু সত্য হচ্ছে কাল স্থির, আমরা এই জগৎ, জগতের সমস্ত বস্তু, এমনকি আমার এই দেহ  গতিশীল। 

আমাদের দেহের মধ্যেও আছে এই চন্দ্র-সূর্য। সূর্য অর্থাৎ পিঙ্গলা নাড়ী, আর চন্দ্র অর্থাৎ ইড়া নাড়ী। এই দুই নাড়ী আমাদের দেহের মধ্যে কালপ্রবাহ সৃষ্টি করে থাকে। কিন্তু সুষুম্না নাড়ী ওই দুই নাড়ীর অর্থাৎ ইড়া ও পিংলা নাড়ীর মধ্যবর্তী হওয়ায় সাধকগণ সাধন বলে জানতে পেরেছেন, কালের অধীনে থাকলে মৃত্যু অনিবার্য।  তারা তাদের গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন, সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রাণবায়ু প্রবাহিত হলে কালকে জয় করা যায়, ওমর হাওয়া যায়। সুষুম্না নাড়ী কালের অধীন নয়, বরং কালের বিনাশকারিনী। এই কারনে বলা হয়ে থাকে, কালজয়ী হতে গেলে, এই কালবিনাশিনী এই সুষুম্না নাড়ীর তত্ত্বের গুহ্য-রহস্যঃ জানতে হবে। প্রাণ বায়ু যখন সুষুম্না মার্গে প্রবেশ ক'রে ব্রহ্মরন্ধ্রে লিন হয় তখন দিন ও রাত্রি রূপ কালের অভাব বসতঃ যোগীর আয়ু বৃদ্ধি  হয়। যিনি এই সমাধির অভ্যাস দীর্ঘকাল করেছেন, তিনি দেহান্ত হবার পূর্বেই জানতে পারেন, কখন তার দেহান্ত হবে। আর তিনি তখন ব্রহ্মরন্ধ্রে প্রাণ বায়ুকে ধারণ করে কালের নিবারণ করেন, এবং স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করেন। যাইহোক, এসব গুহ্যবিদ্যা, গুরুবিদ্যা, এসব গুরুমুখে শুনতে হয়, আর শুধু শুনলেই হবে না, নিরন্তর অভ্যাস করতে হবে।  তবে আজ আমরা প্রাণের কথা  শুনবো।      

জন্ম মৃত্যু হচ্ছে প্রাণের আসা যাওয়ার খেলা।  অথবা অন্যভাবে বলা যায়, জীবন হচ্ছে শ্বাসের খেলা। শ্বাসের শুরুতে প্রাণের শুরু, শ্বাসের শেষে প্রাণের শেষ। দেখুন চৈতন্যহীন জীব বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু প্রাণহীন জীব বলে কিছু নয় না। এই প্রাণের সাহায্যে আমরা সবাই যেমন বেঁচেবর্তে  থাকি, ঠিক তেমনি আবার এই  প্রাণের সাধনা করেই আমরা আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ  করতে পারি। কিন্তু আশ্চর্য্যের কথা হচ্ছে প্রাণ কোথা থেকে  আসে, আবার কোথায় চলে যায়, তা আমরা জানি না। আবার দেখুন শরীর  বিনা সাধন হয় না। কিন্তু এই শরীরে কিভাবেই বা প্রাণের গমন নির্গমন হয়, তা আমরা জানি না। এসব কথা বুঝতে গেলে, আগে এই দেহে বায়ুর ক্রিয়া সম্পর্কে, তেজের ক্রিয়া সম্পর্কে ও জলের ক্রিয়া সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝতে হবে। প্রথমে আমরা বায়ুর কথা শুনে নেবো। 

আমরা জানি পঞ্চভূতের তৈরী এই শরীর। এই শরীর প্রকৃতি প্রসূত। আর প্রকৃতি ত্রিগুণাত্বক - সত্ত্বঃ-রজঃ-তমঃ । প্রকৃতির এই তিনটি গুন্ যখন সাম্যাবস্থায় থাকে তখন প্রকৃতি অব্যক্ত। আবার এই ত্রিগুণের মধ্যে যখন স্পন্দন ওঠে শুরু হয় সৃষ্টি। সমস্ত সৃষ্টি তা সে চেতন বলুন, আর অচেতন বলুন সবই প্রকৃতির অঙ্গ-প্রতঙ্গ। সত্ত্বগুণ হচ্ছে আত্মশক্তির মূল স্পন্দন। রজঃগুন হচ্ছে ক্রিয়াশক্তির মূল স্পন্দন। ক্রিয়াশক্তির এই যে কার্যরূপ তাকে বলে তমোগুণ। এই ক্রিয়াশক্তিই সৃষ্টিকে ভাঙে গড়ে।  

শক্তির এই তমোগুণ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে পঞ্চতত্ত্ব।  প্রথমে কারণ-রূপী মহাকাশ, যার গুন্ হচ্ছে শব্দ । এই মহাকাশ থেকে বায়ু অর্থাৎ প্রানশক্তি  উৎপন্ন হয়েছে। বায়ুর নিজস্ব গুন্ হচ্ছে, স্পর্শ,  আর উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে শব্দ। তাই বায়ুর দ্বিবিধ গুন্ শব্দ ও স্পর্শ। এই বায়ু যেমন আমাদের ত্বক অর্থাৎ স্পর্শ-ইন্দ্রিয়ে অনুভব জাগায়, তেমনি এই বায়ু আমাদের দেহের সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলোকে অর্থাৎ দেহের রক্ত-রসকে দেহের সর্বাঙ্গে পরিচালিত করে থাকে। এই বায়ুই আমাদের দেহের প্রাণশক্তি, প্রাণবিজ ও প্রাণকোষ নির্মাতা। 

আকাশ আমাদের দৃষ্টিগোচর নয়, বায়ুও আমাদের দৃষ্টিগোচর নয়। কিন্তু আকাশে স্থিত বায়ু সাহায্যেই আমরা স্পর্শ অনুভব করে থাকি। মুনিঋষিগন বলে থাকেন, আমাদের এই স্থূল দেহ একটি ক্ষুদ্র ব্রহ্মান্ড বিশেষ। আমরা আকাশে যেমন বায়ু-অগ্নি-ব্রুনের খেলা প্রতক্ষ্য করে থাকি, অর্থাৎ ঝড়, বিদ্যুৎ, মেঘ বা বৃষ্টির খেলা দেখতে পাই, তেমনি আমাদের দেহের মধ্যেও এই ত্রিদেবতার খেলা চলছে। আমাদের দেহভান্ড যদিও পঞ্চভূতের মিশ্রণ, তথাপি এই তিন ভূতের অর্থাৎ জল, বায়ু ও অগ্নির অধিক প্রাধান্য দেখতে পাই আমাদের শরীরে। আবার এই তিন ভূতের মধ্যে বায়ু ভূতের প্রাধান্য অধিক। 

এখন কথা হচ্ছে এই বায়ু  আমাদের শরীরের কোথায় বসে কি কাজ করে থাকে। দেখুন সমস্ত ভূতগুলোই যেমন আমাদের শরীরের সমস্ত অঙ্গে   ক্রীড়ারত, তেমনি বায়ুভূত  আমাদের সমস্ত শরীরেই ক্রিয়াশীল। তথাপি প্রত্যেকটি ভূতের কর্ম্মকেন্দ্র আলাদা আলাদা। যেমন বায়ু-ভূতের প্রধান কর্ম্মকেন্দ্র হচ্ছে আমাদের বক্ষ-প্রদেশ। এই বুকের মধ্যে আছে ফুসফুস, হৃদযন্ত্র, মঙ্গলগ্রন্থি এবং প্রাণকোষ নির্মাণকারী গ্রন্থি ইত্যাদি পাঁচটি গ্রন্থি ও অনেকগুলো উপগ্রন্থি আছে এখানে। এই হৃদয়ক্ষেত্রকেই সাধকগণ অনাহত চক্রের কর্ম্মস্থল বলে থাকেন। এই চক্রের কাজ বিরামহীন ভাবে চলছে। এই চক্রে অবিরত কাজ চলছে। এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্রাম নেই।  আসলে এই চক্রের বিশ্রাম মানে আমাদের চির বিশ্রাম বা মৃত্যু। বিজ্ঞান বলছে বুকের পিছনের স্পাইনাল কর্ড লেভেল বা সুষুম্না নাড়ী থেকে বারো-জোড়া স্নায়ু যার প্রত্যেক জোড়ায় একটি গ্রাহক ও অন্যটি প্রেরক স্নায়ু, আমাদের বুকের মধ্যে বিস্তার করে আছে।  
পঞ্চভূতের মধ্যে  মরুৎ অর্থাৎ বায়ু সবথেকে শক্তিশালী ও সংযোগকারী। উপনিষদে একেই  ব্রহ্ম বলে আখ্যা  দেওয়া হয়েছে। এবং প্রাণ যখন আমাদের শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যায়, তখন  প্রাণের সঙ্গে সঙ্গে আত্মাও আমাদের শরীর  ছেড়ে চলে যায়।  অর্থাৎ প্রাণের সঙ্গে আত্মার একটা ঘনিষ্ট সংযোগ আছে।  উপনিষদ বলছে, প্রাণ হচ্ছে আত্মার ছায়া। অর্থাৎ প্রাণ ও আত্মাকে আলাদা করা যায় না। প্রাণ আমাদের শরীরের সমস্ত জায়গায়  পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। এই বায়ুকে বা মরুৎকে  পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রাণ-অপান-সমান-ব্যান-উদান।
শ্বাসের সঙ্গে আমরা যে বায়ু গ্রহণ করি, ফুসফুস এই বায়ুকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করে দেয়।  আর তা হলো প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ও ব্যান বায়ু। এগুলো আসলে বায়ুর কর্ম্মের  বিভাগ মাত্র, বায়ুর নয়। যাই হোক,  

প্রাণ - অর্থাৎ উইন্ড অফ লাইফ (wind of  life ) : এর কাজ হচ্ছে, শ্বাসগ্রহণ ও শ্বাস ত্যাগ।  অর্থাৎ ফুসফুসকে পরিচালনা করা। প্রাণ আমাদের শরীরের তেজ, আদিত্য, চক্ষু স্বরূপ। আমরা খাবার খাওয়ার  সঙ্গে সঙ্গে যে খাবার পেটে চলে যায়, এটা এই প্রাণবায়ুর কাজ। ধমনীর সাহায্যে আমাদের সর্ব্ব অঙ্গে রক্ত পরিচালনা, অর্থাৎ শিরা, উপশিরা, স্নায়ু ইত্যাদির কাজকে পরিচালনা করে থাকে, এই প্রাণ বায়ু। 

অপান - অর্থাৎ ইন্টেস্টিনাল ওইন্ড (intestinal wind) : এই বায়ু সাধারণত আমাদের নিম্নাঙ্গে প্রবাহিত হয়।  অর্থাৎ মলমূত্র-শুক্র, রজঃ নিঃস্বরণ,  এমনকি সন্তানকে নিচে নাবিয়ে আনতে  সাহায্য করে এই অপান বায়ু। অপান  আমাদের বাকশক্তি, আবার অপান আমাদের শরীরের অগ্নি। অপান  বায়ুর প্রধান কাজ প্রাণবায়ুকে আকর্ষণ ক'রে, প্রাণ বায়ুর শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়াকে সাহায্য করা।

সমান - সমান কথাটার ইংরেজি হতে পারে smooth  । অর্থাৎ যে বায়ু প্রাণ ও অপান বায়ুর ক্রিয়ার মধ্যে  একটা সমতা বজায় রাখে, তাকে বলে সমান বায়ু । আমরা যা কিছু খাই বা পান করি, সেই  সকল বস্তুকে জীর্ন করা, রূপান্তরিত করা এই সমান বায়ুর কাজ।  সমান বায়ু আমাদের হজম শক্তি। জীর্ন খাদ্যের সার ও অসার অর্থাৎ প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয়  অংশকে পৃথক করে অসার ভাগ বৃহৎ-অন্ত্রের ভিতর দিয়ে মলনারীতে প্রেরণ করে থাকে এই সমান বায়ু।  প্রাণ ও অপান বায়ুর কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করার দায়িত্ব এই সমান বায়ুর।

ব্যান - ব্যান বায়ুর সাহায্যে আমরা আমাদের সর্ব শরীরে এমনকি মস্তিষ্কে রক্ত প্রেরণ করতে পারি। এই ব্যান বায়ুর সাহায্যে আমরা রোগমুক্ত হতে পারি। ব্যান-বায়ুকে বলা হয় আমাদের কারন স্বরূপ। মানুষ কানের সাহায্যে জ্ঞান লাভ করে থাকে, চন্দ্র আমাদের খাদ্যের উৎস।  খাদ্য আমাদের শক্তি যোগায়। শরীরের রস-রক্তকে প্রয়োজন মতো সমস্ত শরীরে দ্রুত পরিবেশন করা, আমাদের শরীরের সংকোচন-সম্প্রসারণ, মস্তিষ্কে রক্ত পাঠানো, শরীর  থেকে ঘাম বের করে দেওয়া, এই ব্যান বায়ুর কাজ। এই ব্যান বায়ু কুপিত হলে আমাদের দেহে রোগের  প্রকোপ হয়, এমনকি আমরা মারা  যাই।  

উদান - গুট্টুরাল ওইন্ড guttural air  এই উদান  বায়ুর সাহায্যেই  আমরা কথা বলি। আবার এই উদান বায়ুর সাহায্যে আমরা কুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করতে পারি। হৃদয়ের উর্দ্ধদিকে যে দ্বার আছে, আমাদের পা থেকে উর্দ্ধগামী বায়ু, এই ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে উপরের দিকে উঠে যায়। এই উদান  বায়ুর সাহায্যেই মানুষ শব্দ করে থাকে, কথা বলে, গান করে। এই উদান  বায়ুর সাহায্যেই আমাদের মন-বুদ্ধি স্মৃতি পরিপুষ্ট হয়ে থাকে। সাধকের কাছে এই উদান  বায়ুর খুব গুরুত্ত্ব।  কারন, এই উদান  বায়ুর সাহায্যেই সাধকের  মন অতীন্দ্রিয় জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করে। 

বায়ুর অবশ্য আরো পাঁচ রকম হয়। অর্থাৎ বায়ু দশ রকম। এবং তাদের আলাদা আলাদা কাজ আছে যা আমাদের শরীরে সংগঠিত হয়।   আমরা সেই বিষয়ে যাবো না।  

আমাদের  শরীরের শ্বাসক্রিয়া শুরু হলে তবেই  আমাদের  কৰ্মইন্দ্রিয় (বাক,পানি,পাদ, পায়ু,উপস্থ ) জ্ঞান ইন্দ্রিয় (কর্ন, চর্ম, চক্ষু, জিহবা, ও নাসিকা)  ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। শ্বাস-প্রক্রিয়ার গুরুত্বের কথা চিন্তা করে ভগবান বোধহয়,  শ্বাস  প্রক্রিয়ার জন্য দুটো অঙ্গ বা দুটো ইন্দ্রিয় ব্যবহার করার ব্যবস্থা করেছেন । এই জন্য  শরীরের অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলো বিশ্রাম নিলেও, নিদ্রা গেলেও এই প্রাণশক্তির ক্রিয়া প্রতিনিয়ত চলতে থাকে।  কখনই বিশ্রাম নিতে পারে না। দিন-রাত অনবড়ত  কাজ করতে থাকে। যতক্ষন এই প্রাণশক্তি প্রবাহমান থাকে ততক্ষনই আমাদের আয়ু থাকে। প্রাণ যতক্ষন কর্মক্ষম থাকে ততক্ষনই আমাদের জীবিত বলা হয়।  এই প্রাণশক্তির কাজ শেষ হয়ে গেলে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। এই প্রাণের শক্তিতেই দৃষ্টি-শক্তি, এই প্রাণের শক্তিতেই শ্রবণ শক্তি, এই প্রাণের শক্তিতেই ঘ্রান শক্তি, বাক শক্তি, জ্ঞানশক্তি, পাচন  শক্তি। প্রাণের ক্রিয়া শুরুতে জীবন শুরু হয় - আবার প্রাণের ক্রিয়া শেষে জীবনের শেষ হয়। ত্রিলোকে যা কিছু বর্তমান সবই প্রাণের অন্তর্গত।

অতএব এই প্রাণক্রিয়া আমাদের স্থূল শরীরকে বাঁচিয়ে রাখে। আমাদের মৃত্যুর সময়, আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়শক্তি সংকুচিত হতে থাকে। এবং অপানবায়ু প্রথমে আমাদের শরীর  ছেড়ে দেয়। ফলতঃ মৃত্যুকালীন সময় আমরা মল-মূত্র ত্যাগের উপরে নিয়ন্ত্রণ হারাই। তার পরে ধীরে ধীরে ব্যান, উদ্যান, সমান এবং সব শেষে প্রাণবায়ু আমাদের দেহ ছেড়ে দেয়। এই প্রাণবায়ুর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চেতনশক্তি, বা আত্মা আমাদের স্থূল শরীর ছেড়ে দিয়ে আমাদের সংস্কারকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে থাকে। অর্থাৎ তখন আমরা সাধারণ মানুষরা মনোময় দেহে অবস্থান করি। উন্নত মহাত্মারা মনময় দেহকে  ছেড়ে দেন, তারা বিজ্ঞানময় দেহে অবস্থান করেন। অর্থাৎ বাসনা-সংকল্প বিহীন অবস্থায় শুধু জ্ঞানময় জগতে  তাঁরা অবস্থান করেন। এর পরে বিজ্ঞানময় দেহ ছেড়ে আনন্দময় শরীরে, এবং সব শেষে অনন্তে অর্থাৎ পরমাত্মার সঙ্গে বিলীন হয়ে যান।  যাই হোক, এর পরের দিন আমরা শুনবো, প্রাণ কোথা থেকে আসেন , কিভাবেই বা শরীরে প্রবেশ করেন, কিভাবেই বা সারা শরীরে ছড়িয়ে আমাদের কর্ম্মক্ষম  করে তোলেন , আবার কিভাবেই বা তিনি আবার আমাদের শরীরে ছেড়ে বেরিয়ে যান। আর  কোথায়-ই বা  চলে যান। আজ এই পর্যন্ত। 
   
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।  

প্রাণের উদ্ভব পৃথিবীতে বা বিশ্বের অন্য কোথাও কবে কিভাবে হয়েছিল, তার সঠিক তথ্য এখনো পর্যন্ত বিজ্ঞান দিতে নি। প্রাণের সৃষ্টি পৃথিবীতেই প্রথম হয়, নাকি বিশ্বের অন্য কোথাও প্রাণীর সৃষ্টির পরে, পৃথিবীতে তার আগমন হয়, এই ব্যাপারটাও বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। এই সম্পর্কে পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন, পৃথিবীর আগেও প্রাণের অস্তিত্ত্ব এই সৌর মন্ডলের চন্দ্রে  ছিল, পরে বুধে এই প্রাণক্রিয়া চলবে, বর্তমানে শুক্র ও প্রথিবীতে এই প্রাণক্রিয়া চলছে। তবে শুক্রে মানুষের থেকেও উন্নত ধরনের জীব বর্তমান। বিজ্ঞান বলছে (energy) E = mc২ (mass*current)  
--------------------------------
--------------------------------

ছান্দোগ্য উপনিষদ : ওম্

উপনিষ বলছে, "ওম্ ইতি এতৎ অক্ষরম্ উদ্ গীথম্ উপাসিত" অর্থাৎ ওম ব্রহ্মের সবচেয়ে নিকটবর্তী। এই অক্ষরকে উদ্গীথ রূপে উপাসনা করবে। ব্রহ্মের নিকটবর্তী অর্থাৎ এ যেন ব্রহ্মের ছায়া স্বরূপ। অক্ষর অর্থাৎ যার ক্ষয় নেই, আবার অক্ষর অর্থাৎ লিপি, অর্থাৎ ব্রহ্মকে যদি লিপির মধ্যে আবদ্ধ করতে হয়, তবে তাকে "ওম্" এই অক্ষরের সাহায্যে প্রকাশ করা যেতে পারে।  এই ওম-কে উদ্গীথ অর্থাৎ উচ্চস্বরে  গীত - এইভাবে ব্রহ্মার উপাসনা করতে হবে। 

সমস্ত ভূতাদি বস্তুর  সার হচ্ছে পৃথিবী। অর্থাৎ পৃথিবীই সমস্ত কিছুর ধারক।  আবার পৃথিবীর ধারক  হচ্ছে জল। জল আবার সমস্ত উদ্ভিদের ধারক। অর্থাৎ জলবিহীন উদ্ভিদ থাকতে পারে না।  উদ্ভিদ আবার সমস্ত জীবজন্তুর ধারক। অর্থাৎ সমস্ত জীবজন্তু এই উদ্ভিদের উপরে নির্ভরশীল।  এই উদ্ভিদ বিভিন্ন ভাবে সমস্ত জীবজন্তুকে বাঁচিয়ে রেখেছে। মানুষের সার হচ্ছে তার বাকশক্তি। এই বাক্শক্তির মধ্যে শ্রেষ্ট হচ্ছে স্তূতি  বা ঋকমন্ত্র। এই স্তূতি সর্বকালে সর্বজনকে সন্তুষ্ট করতে পারে। আবার এই স্তুতিবাক্যঃ যদি সুর করে গাওয়া হয়, তবে তা আমাদেরকে আরো প্রীতি দান করে থাকে। তো সুর করে যদি স্তুতিবাক্যঃ গীত হয়, তবে সেখানে একটা মধুময় আবহাওয়া তৈরী হয়। আবার এই বাক  আসছে প্রাণ অর্থাৎ প্রাণবয়ুর থেকে। অর্থাৎ প্রাণের সাহায্যেই ওম উদ্গীথ হচ্ছে। 

    


















------------
ভালোকথা শুনতে কার না ভালো লাগে। কিন্তু ভালো কথা বলার লোক কোথায়  ? আর ভালো বলতেই বা আমরা কি বুঝি ?  আসলে ভালো বলতে আমরা  সেই কথাই বুঝি, যা আমার পছন্দের কথা। কিন্তু সত্য হচ্ছে, যা আমাদের পক্ষে কল্যাণকর, সেটাই ভালো কথা । আমাদের দর্শন শাস্ত্রগুলো একটা একটা কঠিন হীরের খন্ড । এর থেকে রস বার করা ভীষণ শক্ত। আর এই সব শাস্ত্র বুঝতে গেলে, আমাদের ভাষার উপরে দখল চাই, পান্ডিত্য চাই, আর চাই গভীর মনোযোগ। বিষয় বা ভাষা যদি খটোমটো   হয়, তবে মনোযোগ দেওয়া খুব কঠিন। তাই আমরা একটু সহজ করে বুঝবার চেষ্টা করবো, কঠিন বিষয়গুলোকে। 

প্রশ্ন হচ্ছে কোথা থেকে আমরা এসেছি ? আবার কোথায় চলে যাবো  ? অর্থাৎ প্রাণীসকল কোথা থেকেই বা  আসে আর কোথায় যায়  ?  আমাদের এই জীবনের উৎসই বা কি ? ঠিক এরকম একটা প্রশ্ন করেছিলেন, কবন্ধী নামক  এক জিজ্ঞাসু  ঋষিগুরু  পিপ্পলাদকে। ঋষি পিপ্পলাদ এর উত্তরে যা বলেছিলেন, তা "প্রশ্ন" উপনিষদ নাম খ্যাত। আমরা সেই প্রশ্ন উপনিষদ থেকে পিপ্পলাদের মুখে শুনবো, এই প্রশ্নের উত্তর। প্রাণী কোথা থেকে আসে, আবার কোথায় চলে যায়  ?

ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন - প্রজাপতির সন্তান সৃষ্টির ইচ্ছে হলো। সেই উদ্দেশ্যে তিনি তপস্যা শুরু করলেন। এবং তিনি এই জ্ঞান লাভ করলেন যে, যদি অন্ন থাকে আর সেই অন্নের একজন ভোক্তা থাকেন, তবে তারা সম্মিলিত ভাবে বহু সন্তান সৃষ্টি করতে পারবে। 

এখন কথা হচ্ছে এই প্রজাপতি কে ? তাকেই বা কে সৃষ্টি করলো ? দেখুন প্রজাপতি কোনো ব্যক্তি নন। 
প্রজা কথাটার মানে যা সৃষ্টি হয়েছে। পতি  কথাটার মানে স্বামী বা প্রভু। ইনি  কোনো ব্যক্তি নন। যেখানে বা যার কাছে, সৃষ্টির বীজ সংগ্রহীত থাকে তাকে  বলে প্রজাপতি। এই সংগ্রহশালায় কোটি কোটি তাক, কোটি কোটি খোপ। সীমাহীন মৌচাক।   অর্থাৎ এটি একটি সীমাহীন  সংগ্রহশালা। অর্থাৎ এটি একটি বৃহত্তর শক্তিমাত্র যা সৃষ্টির বীজকে যুগ  যুগান্তর ধরে বয়ে নিয়ে চলেছে।  আসলে প্রাণের কোনো সৃষ্টি নেই, প্রাণের কোনো বিনাশ নেই। কখনো এটি কারণরূপে বা বীজ আকারে আছে, আবার কখনো কার্যরূপে প্রতীয়মান হচ্ছে। পিতা থেকে সন্তান আবার সন্তান থেকে পিতা। বীজ থেকে গাছ আবার গাছ থেকে বীজ। ডিম্ থেকে মুরগী আবার মুরগী থেকে ডিম্। এটি একটি প্রবহমান ধারা। কালের অতীত এই ধারা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বয়ে চলেছে। এর না আছে শুরু, না আছে শেষ। কখনো কারণে লয় হয়ে আছে, কখনো প্রকাশিত হচ্ছে । জগৎ কারুর সৃষ্টি নয়, জগৎ একটা অভিব্যক্তি মাত্র। এটি কখনো প্রকাশিত, কখনো অপ্রকাশিত। চন্দ্র তার আদ্রতা দিয়ে, অন্ন সৃষ্টি করেন। সূর্য্য তাকে অর্থাৎ অন্নকে  টেনে তোলেন। তাই চন্দ্রকে বলে অন্ন আর সূর্যকে বলা হয় অন্যের ভোক্তা। প্রাণ এবং অন্ন দুটি পৃথক বস্তু নয়, রূপের পার্থক্য মাত্র। প্রতিযুগে কত কিছু  আসে যায়, আবার কল্পান্তে সেসব বীজ আকারে উৎসে ফিরে যায়। এযেন সেই অন্ধ পাগলি বুড়ির মতো, যা কিছু পায়, যা কিছু সে অবহেলায় থাকতে দেখে, সব সে তার ঝুড়িতে ভরে রাখে। এক এক সময় সে সব আবার সে মাটিতে ছড়িয়ে ফেলে। তখন সেই বীজ থেকে অংকুর হয়ে গাছ জন্মায়। গাছ বড় হয়, ফল দেয়, বীজ হয়, আবার সে মরে যায়।  বুড়ি আবার গাছের নিচে আসে অবহেলায়  ছড়িয়ে থাকা ফল-বীজ ঢুকিয়ে রাখে ঝোলার মধ্যে। 

জীবন এই ভাবেই চক্রাকারে ঘুরপাক খাচ্ছে। জন্ম থেকে মৃত্যু আবার মৃত্যু থেকে জন্ম। কার্য্য থেকে কারন, আবার কারন থেকে কার্য্য। প্রাণের না আছে সৃষ্টি না আছে লয়।  না আছে জন্ম না আছে মৃত্যু। একবার প্রকাশিত একবার অপ্রকাশিত। একবার বীজ একবার গাছ। একবার কার্য্য, একবার কারন। কারণে অপ্রকাশিত, কার্য্যে প্রকাশিত। 

বেদান্ত বলছে, এই প্রজাপতি এসেছেন ব্রহ্ম থেকে।  মৌচাকের খোপগুলো প্রজাপতি। এখানেই বীজ। এখানেই মধু। খোপ যেমন একাধিক, প্রজাপতিও একাধিক। আমরা সবাই একএকটা প্রজাপতি। আমরাই বীজের আকার ধারণ করি। আবার আমরাই গাছে পরিণত হই। ব্রহ্মার কোনো ইচ্ছে বা আকাঙ্খা নেই। তাই তিনি নির্গুণ।   কিন্তু আমার বা প্রজাপতির আছে। প্রজাপতি থেকে সৃষ্টি হয়, আবার প্রজাপতিতেই ফিরে যায়। প্রজাপতি কোনো চেষ্টা করেন না। তিনি কেবল সংকল্প করেন, তিনি কেবল চিন্তা করেন। তাঁর এই সৃষ্টির সংকল্প-চিন্তা থেকেই চন্দ্র-সূর্য্যের যুগলবস্তু প্রকাশিত। চন্দ্র অর্থাৎ রয়ি বা অন্ন বা খাদ্য। আদ্রতা চন্দ্রের বিশেষত্ব। যা সবকিছুকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। আবার অন্ন থাকলে তার একজন ভোক্তা থাকবে।  সেই ভোক্তা হচ্ছেন সূর্য। এই সূর্যই প্রাণ। আর এই প্রাণের প্রকাশ ত্রিবিধ। সূর্য, ভূতাগ্নি, জঠরাগ্নি। এই জঠরাগ্নি আমাদের খাদ্য হজম করায়। ভূতাগ্নি ভূতকে দাহ  করে। সূর্য গ্যাসীয় পদার্থকে দাহ করে, যাকে  আমরা হিলিয়াম  গ্যাস বলি। প্রাণ আসে সূর্য থেকে, খাদ্য যা আমাদের বেঁচে থাকতে  সাহায্য করে, তা আসে চন্দ্র থেকে। আবার এই চন্দ্র সূর্য পৃথক নয়, শুধু নাম আর রূপেই পার্থক্য মাত্র । 

উপনিষদ বলছেন, জগতে দুটো বস্তূ প্রাণ ও অন্ন।  আর দুটোই প্রাণীর  খাদ্য। আবার প্রাণ খাদ্যকে অর্থাৎ অন্নকে গ্রহণ করে। প্রাণ হচ্ছে সূক্ষ্ম খাদ্য, অন্ন হচ্ছে স্থূল খাদ্য।  আপাত দৃষ্টিতে এই দুটো আলাদা মনে হলেও, তারা এক, আলাদা নয়। প্রাণ ও খাদ্যের মিলিত সত্ত্বাই প্রাণী। 

সূর্যই সমস্ত কিছুকে প্রকাশ করেন ।  সূর্যই জীবের অন্তরাত্মা। জগতের সব রূপই সূর্য্যের রূপ। সূর্যের তেজ প্রকাশকে  যে বস্তু প্রতিফলিত করতে  অক্ষম সেই বস্তু ভূতে পরিণত হয়।  তাই মানুষ মারা গেলে ঠান্ডা হয়ে যায়। দেহের উত্তাপ জীবনের লক্ষ্মণ। প্রাণের লক্ষণ। এই প্রাণ যখন অগ্নি রূপে থাকেন, তখন তিনি আধিভৌতিক, অর্থাৎ পদার্থগত। আবার এই প্রাণ যখন জীবন তখন আধ্যাত্মিক। তাই প্রাণ আমাদের আয়ু প্রদান করে, আর এটি প্রাণের  প্রকাশক্ষন, অর্থাৎ কতদিন প্রাণী বেঁচে থাকবে  তা  স্থির করে, আবার গ্রহণ করে বা অপ্রকাশের ক্ষণ ঠিক করে, বা মৃত্যুক্ষণ ঠিক করে। 

এই সূর্যই আমাদের প্রাণের উৎস।  এই সূর্যই আমাদের জ্ঞানের উৎস। আপনারা যারা বেদ  পড়েছেন তারা জানেন, বেদে কেবলই সূর্য্যের উপাসনা, তা সে প্রতক্ষ্য হোক বা অপ্রত্যক্ষ হোক। সূর্যকে সর্ব্ব দেবতার উর্দ্ধে স্থান দেওয়া হয়েছে। যারা সেই বিখ্যাত মন্ত্র গায়ত্রী, শুনেছেন তারা জানেন। এই  মন্ত্রে জ্ঞানের প্রতীক সেই সূর্য বা সাবিতদেবকে আহ্বান করা হচ্ছে। সূর্যদেবের কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে। উপনিষদে সূর্যকে বলা হচ্ছে, বিশ্বরূপং (সমস্ত রূপ), হরিণং, (উজ্জ্বল)  জাতবেদসম (সর্বজ্ঞ) পরায়নম (সকলের আশ্রয়) একং জ্যোতিঃ (একমাত্র আলো ) ।

আবার আমরা প্রজাপতির কথায় ফিরে যাই। এই প্রজাপতি সংবৎসর, অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা ।  দুই পথে তার যাতায়াত।  উত্তর ও দক্ষিণ। জগতে দুই শ্রেণীর মানুষ আছেন, একদল জ্ঞান লাভের  জন্য, কর্ম্ম
করেন, অর্থাৎ ঈশ্বর চিন্তন করেন।  আর এক শ্রেণীর মানুষ আছেন, যারা সন্তান লাভের   জন্য কর্ম্ম করেন। অর্থাৎ বিষয় চিন্তায় মগ্ন থাকেন।   আর এদের জন্য পথও দুটো। একটা উত্তরায়ণ আর একটা দক্ষিণায়ন। সূর্য যখন দক্ষিণ গোলার্ধে থাকে তখন দক্ষিণায়ন। একেই বলে চন্দ্রের পথ। আবার সূর্য যখন উত্তর গোলার্ধে থাকে তখন তাকে বলে উত্তরায়ণ। এই পথ হচ্ছে সূর্য্যের পথ।

জ্ঞান লাভের পথই সূর্য্যের পথ। অর্থাৎ আলোর পথ। আর ভোগ বিলাসীর জন্য চন্দ্রের পথ। অর্থাৎ অন্ধকারের পথ। উত্তরমার্গীগন অর্থাৎ আলোর পথের যাত্রী, ধীরে ধীরে আদিত্যপদ লাভ করেন। আদিত্য সমস্ত প্রাণীর আশ্রয়। এটাই প্রাণীর সর্ব্বোত্তম অবস্থা। একবার এই পদ লাভ হলে মানুষ আর ফিরে আসে না। আত্মানম্ অন্বিষ্য। আত্মাকে অনুসন্ধান করো। কিন্তু এই আত্মাকে অনুসন্ধান করবো কি করে ? উপনিষদ বলছেন,  তপস্যা ও কৃচ্ছ্র সাধনার দ্বারা।

অন্যদিকে ভোগ বিলাসীরা চন্দ্র পথের যাত্রী। অর্থাৎ অন্ধকারের যাত্রী। এরা বার বার ফিরে ফিরে আসেন। আর সুখ-দুঃখ ভোগ করেন।  চন্দ্রের পথ অন্ধকার আচ্ছন্ন। চাঁদ সব সময় বদলাচ্ছে।  কখনো পূর্ণচন্দ্র। কখনো অর্দ্ধচন্দ্র আবার  কখনো অমাবস্যা।  সূর্য্যের কোনো পরিবর্তন নেই। চন্দ্রের ক্ষয়-বৃদ্ধি আছে সূর্য্যের ক্ষয়-বৃদ্ধি  নেই। আমরা যদি নিজেকে মৃত্যুর অধীন মনে করি, তবে সব সময় ভয় আমাদের তারা করে বেড়াবে। আর যদি আমরা যদি নিদেরকে শ্বাশত আত্মা মনে করি, তবে আমরা নির্ভয় থাকতে পারবো। 

অন্নই প্রজাপতি। অন্ন থেকে আসে প্রাণের বীজ। এই বীজ থেকে সমস্ত প্রাণীর জন্ম। আবার প্রাণী থেকে প্রাণ বেরিয়ে গেলে অন্নে পরিণত হয়ে যায়। অন্ন থেকে আবার প্রাণের বীজ। এই চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে প্রাণী জগৎ। একেই বলে জন্ম মৃত্যুর চক্র। আত্মজ্ঞান এই চক্র  থেকে বেরিয়ে যাবার উপায়। উপনিষদ এই শিক্ষাই  দেয় আমাদের। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি  ওম।

 প্রশ্ন উপনিষদ -২

কথায় বলে কান টানলে মাথা আসে। ঠিক তেমনি প্রাণ টানলে আত্মা আসে। আসলে সরাসরি আমরা ঈশ্বরের কাছে যেতে পারি না। তাই ঈশ্বরের সঙ্গে যিনি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, আমরা তার সঙ্গে ভাব জমাতে চাই। যাতে একসময় আমরা ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে যেতে পারি ।  আমি অনেক গো-পালককে দেখেছি, গরুর বাচ্চাটাকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছেন, আর পিছন পিছন মা-গরু আপনা আপনি আসছে। তাই আমরা যদি প্রাণ সম্পর্কে ভালো ভাবে জানতে পারি, তবে আমাদের ঈশ্বর জ্ঞান স্বভাবিক ভাবেই এসে যাবে।   তাই আধ্যাত্মিক সাধকদের কাছে প্রাণের খুব কদর। বাহ্যিক দিক থেকে দেখতে গেলে, সমস্ত সাধক এই প্রাণের সাধনাই করে থাকেন। আজ আমরা এই প্রাণের কথা শুনবো। প্রাণ কোথা থেকে আসে?  তিনি কি ভাবে শরীরে প্রবেশ  করেন ? কি ভাবে তিনি সারা শরীরে ছড়িয়ে যান ?  কি ভাবে তিনি শরীরকে কর্মক্ষম করেন। কি ভাবেই বা তিনি আবার শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যান ? কি ভাবে তিনি প্রাণী ও পদার্থসমূহকে ধারণ করেন ? আমাদের যে ইন্দ্রিয়শক্তি আছে, তা কিভাবে এই প্রাণকে আশ্রয় করে থাকে ? ঠিক এই প্রশ্নগুলো করেছিলেন, অশ্বলপুত্র  ঋষি পিপ্পলাদকে। আমরা সেই সব কথা শুনবো। কিন্তু তার আগে শুনে নেবো, আমাদের শরীরের মধ্যে যে ইন্দ্রিয়গুলো আছে, যাদের সাহায্যে আমরা বহির্জগতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখি তার  সঙ্গে আমাদের প্রাণের সম্পর্ক কি ? আর এসব কথাই শুনবো  আমরা ঋষি পিপ্পলাদের কাছ থেকে। 


ইন্দ্রিয় ও প্রাণের কথা  আমরা শুনছি প্রশ্ন উপনিষদের কথা। প্রশ্ন কথাটার অর্থ হচ্ছে জিজ্ঞাসা। আমাদের মতো সাধারণের মানুষের মধ্যে মাঝে মধ্যে নানান রকম প্রশ্ন জেগে ওঠে । প্রশ্ন উপনিষদে এই সাধারণ মানুষের প্রশ্নগুলোকে নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ভৃগুবংশীয় ভার্গব। প্রশ্নটা খুবই সাধারণ। ভার্গব বলছেন, হে গুরুদেব, কয়টি ইন্দ্রিয় প্রাণীর দেহকে ধারণ করে থাকে ? তার মধ্যে কোন ইন্দ্রিয় দেহকে প্রকাশ করে থাকে ? আবার ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে কোনটি প্রধানতম ? 
ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন।  এই আকাশের মধ্যে আছেন বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী, বাক, মন, চক্ষু ও কান। এঁরা সবাই দেবতা অর্থাৎ বিশেষ গুনের অধিকারী। এরাই বানম বা দেহকে বলিষ্ঠ করে। বানম  অর্থাৎ অস্থায়ী।  দেহের কর্ম্ম শেষ হলে  যেহেতু দেহের নাশ হয়। তাই দেহকে বলছেন বানম।

আমরা জানি আমাদের এই দেহ পাঁচটি উপাদানে গঠিত। অর্থাৎ আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল ও পৃথিবী এই পাঁচটি উপাদানে এই প্রাণীদেহ গঠিত। আবার এই পাঁচটি উপাদান দিয়েই তৈরি হয়েছে, আমাদের কর্ম্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞান ইন্দ্রিয়। কর্ম-ইন্দ্রিয় অর্থাৎ বাক(মুখ), পাণি(হাত), পাদ(পা), পায়ু (মল-মূত্র), উপস্থ (জনন-ইন্দ্রিয়) । আর জ্ঞান ইন্দ্রিয়গুলো হচ্ছে, চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক। এছাড়া আর একটা ইন্দ্রিয় আছে, তা হচ্ছে আমাদের মন। আর এই সব কিছুর পিছনে আছেন আমাদের প্রাণশক্তি বা জীবনীশক্তি। এর মধ্যে প্রাণ-ই সবথেকে শ্রেষ্ট। এই প্রাণের ক্রিয়াতেই জীবন শুরু হয়।  আবার প্রাণের ক্রিয়াশেষে জীবনের শেষ। 

ঋষি পিপ্পলাদ একটা গল্পের মাধ্যমে, প্রাণের শ্রেষ্ঠত্ব বুঝিয়েছেন। বলছেন, একবার ইন্দ্রিয়সকল দাবি করলো, যে তারাই দেহকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সক্রিয় রেখেছে। তারা বলছে, আমরাই দেহকে ধারণ করে আছি। তো প্রাণ বললো, এইভাবে তোমরা মোহগ্রস্থ হয়ো না, অহংকার কোরো না। আমার শক্তিতেই তোমাদের শক্তি। আমিই নিজেকে পাঁচ ভাগ করে এই দেহকে  ধারণ করে আছি।  আর আমার এই পাঁচ ভাগ হচ্ছে, প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান।  প্রাণের কাজ হচ্ছে শ্বাস গ্রহণ ও শ্বাস  ত্যাগ করা । অপানের কাজ হচ্ছে, খাদ্য বস্তু থেকে অসার পদার্থ বর্জন করা।  ব্যান দেহের স্নায়ুকে ক্রিয়াশীল করে। উদ্যান দেহের তাপ রক্ষা করে, সমান খাদ্যকে হজম করতে সাহায্য করে। এই পাঁচটি শক্তি দ্বারা আমি অর্থাৎ প্রাণ দেহকে সচল রাখি, ও কারক্ষাম রাখি। 

তো প্রাণের এসব কথায়, ইন্দ্রিয়গণ কর্নপাত  করলো না। তারা তাদের অহংকারে মত্ত হয়ে রইলো। প্রাণ এতে ক্ষুব্ধ হলো, এবং দেহ ছেড়ে বেরিয়ে যাবার ভান করলো। যেই না প্রাণ বেরিয়ে যাবার উপক্রম করলো, তখন ইন্দ্রিয়গণ শক্তিহীন হয়ে পড়লো। ত্রাহি ত্রাহি রব শুরু হয়ে গেল। উপনিষদ বলছেন, মৌচাক থেকে যখন রানী মৌমাছি বেরিয়ে যায়, তখন সব মৌমাছি তাকে অনুসরণ করে। শরীর  থেকে প্রাণ যদি বেরিয়ে যায়, তবে ইন্দ্রিয়সকলও প্রাণের সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হয়।  তারা কেউই প্রাণ বিহীন দেহে থাকতে পারে না। প্রাণ ছাড়া তাদের কোনো কর্ম্ম ক্ষমতা থাকে না। সমস্ত ইন্দ্রিয় এমনকি মনও প্রাণের শক্তিতে সক্রিয় থাকে। 

ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, এই প্রাণ-ই পৃথিবী, প্রাণই চন্দ্র, প্রাণই সূর্য, এমনকি মেঘ-বৃষ্টি-বায়ু, সব-ই প্রাণের অন্তর্গত। প্রাণ কার্যরূপে স্থূল, আবার কারন রূপে সূক্ষ্ম। স্থূল-সূক্ষ্ম যা কিছু পদার্থ সবই প্রাণ।  তাই প্রাণ অমর - চিরস্থায়ী। 

এই প্রাণ-ই সূর্য-রূপে বাইরে উত্তাপ বিকিরণ করছেন, আবার অগ্নি-রূপে শরীরের ভিতরে উত্তাপ রক্ষা করছেন। এই প্রাণের সাহায্যে যেমন তাপ-আলো উৎপাদন হচ্ছে, তেমনি মেঘ, বৃষ্টি, অন্নের সৃষ্টি হচ্ছে। তাই প্রাণ হচ্ছে, অমৃত, সমস্ত জীবের আশ্রয় এই প্রাণ। 

জ্ঞান অর্থাৎ সমস্ত বেদাদিও এই প্রাণকে আশ্রয় করে অবস্থান করছেন। প্রাণেই সবকিছু প্রতিষ্ঠিত। "প্রাণে সর্বং প্রতিষ্ঠিতম।" আমরা যা কিছু শুনছি, দেখছি, এমনকি অনুভব করছি, সবই প্রাণের প্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। 

প্রাণ প্রজাপতি রূপে মাতৃগর্ভে অবস্থান করে। প্রাণ-ই পিতা-মাতার রূপ নিয়ে, সন্তান হয়ে জন্মায়। ইন্দ্রিয়গণ আসলে প্রাণের জন্য উপহার নিয়ে আসে। চোখ নিজের জন্য কিছু  দেখে না। কান নিজের জন্য কিছু শোনে না। সমস্ত ইন্দ্রিয় আসলে প্রাণের জন্য উপহার সংগ্রহ করছে মাত্র। প্রাণ-ই দেবতা, আর তাকে আহুতি দিচ্ছে ইন্দ্রিয়সকল। আসলে ইন্দ্রিয়গণ বাহক মাত্র। ইন্দ্রিয়গুলো আসলে যেন এক এক জন ঋষি। ঋষিরা যেমন আমাদের সত্য উপলব্ধি করতে সাহায্য করেন , ইন্দ্রিয়গণ তেমনি আমাদের এই জগৎকে জানতে সাহায্য করে।  প্রাণশক্তি ইন্দ্রিয়কে সঠিক ভাবে চালনা  করে, সত্যকে জ্ঞাত হচ্ছে। প্রাণ-ই সমস্ত প্রাণীগণের পিতা, প্রাণ-ই সমস্ত ইন্দ্রিয়গনের পিতা। আমাদের দেখা, শোনা, কথাবলা, চিন্তা করা, এমনকি আমাদের যত  মানসিক কর্ম্ম আছে, সবই এই প্রাণের জন্যই সম্ভব হচ্ছে। প্রাণ ছাড়া আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয় অকেজো। জগতে যা কিছু আছে, সবই প্রাণ রক্ষা করছে। প্রাণের নিয়ন্ত্রনেই জীব জগতের সমস্ত কার্য্য সম্পাদিত হচ্ছে। মা যেমন সন্তানকে রক্ষা করেন, প্রাণ তেমনি আমাদের সকলকে রক্ষা করছেন। অতএব আসুন আমরা প্রানেরই উপাসনা করি। 

প্রশ্ন উপনিষদ -৩

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, প্রাণ কোথা থেকে আসে?  তিনি কি ভাবে প্রবেশ শরীরে করেন ? কি ভাবে তিনি আমাদের  সারা শরীরে ছড়িয়ে যান ?  কি ভাবে তিনি শরীরকে কর্মক্ষম করেন। কি ভাবেই বা তিনি আবার শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যান ? কি ভাবে তিনি জীব  ও পদার্থসমূহকে প্রাণ ধারণ করেন ? আমাদের যে ইন্দ্রিয়শক্তি আছে, তা কিভাবে এই প্রাণকে আশ্রয় করে থাকে ? ঠিক এই প্রশ্নগুলো করেছিলেন, অশ্বলপুত্র কৌসল্য ঋষিগুরু পিপ্পলাদকে। আমরা এই ঋষি পিপ্পলাদের মুখ থেকে এই সব প্রশ্নের জবাব শুনবো। 

আমাদের প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে প্রাণ কোথা থেকে আসে ? ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, প্রাণ আসে আত্মা থেকে। আমাদের দেহের যেমন একটা ছায়া থাকে, এবং এই ছায়াকে যেমন দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না, তেমনি আত্মার ছায়াই হচ্ছে প্রাণ। আত্মাতেই প্রাণ নিহিত আছে, আর এই প্রাণের ইচ্ছেতেই, অর্থাৎ এই প্রাণ যখন ইচ্ছে করেন, তখন তিনি শরীরকে ধারণ করেন। অর্থাৎ শরীরে প্রবেশ করেন। তো প্রাণ যখন শরীরে প্রবেশ করেন, তখন এটা বুঝতে হবে,  আত্মাও তখন শরীরে প্রবেশ করেন। কেননা ছায়াকে তো শরীর  থেকে আলাদা করা যায় না। তেমনি আত্মাকে ছায়া থেকে বা ছায়াকে আত্মা থেকে আলাদা করা যায় না। সমুদ্র থেকে যেমন তার ঢেউকে আলাদা করা যায় না। সমুদ্র না থাকলে ঢেউয়ের কথা ভাবা যায় না।  তেমনি আত্মা না থাকলে তার ছায়া অর্থাৎ প্রাণকে ভাবাই  যায় না। আর প্রাণকে সত্য বলে মনে হয়, তার কারন তার প্রাণ  আত্মার সঙ্গেই প্রাণ ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছেন।  আত্মা থেকে প্রাণকে আলাদা করলে কেবল বাতাস। প্রাণহীন বাতাস বলে যেমন কিছু হয় না, আত্মাহীন  জীব  বলে যেমন কিছু হয় না, তেমনি  প্রাণহীন আত্মা বলেকিছু হয় না। আত্মাতে  প্রাণ ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।  কিন্তু প্রাণ হচ্ছে ভৌতিক, আর আত্মা হচ্ছে অভৌতিক। তা হলে আমরা বুঝলাম, প্রাণ আসে আত্মা থেকে। প্রাণ ভৌতিক, আর  আত্মা হচ্ছেন অভৌতিক। কিন্তু দুজনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।  

আমাদের পরবর্তী প্রশ্ন হচ্ছে প্রাণ  কি ভাবে শরীরে প্রবেশ করেন ? জীবাত্মাতে অন্তর্নিহিত মনের ইচ্ছেতেই এই স্থূল শরীরে তিনি আসেন। অর্থাৎ শরীরে প্রাণ আলাদা করে কখনো আসেন না, আসতে  পারেন না। আসেন আত্মা, আর স্বাভাবিক ভাবেই প্রাণ এই আত্মাকে বহন করে নিয়ে আসেন। এই কথাটা আমরা আরো একটু ভালো-ভাবে বুঝবার চেষ্টা করবো।  উপনিষদ বলছেন, আমাদের মনের গতি বা আমাদের মনের যে প্রবণতা, আমাদের মনের যে সংকল্প, যে আকাঙ্খা তাকে রূপ দেবার জন্য, মন এই দেহ সৃষ্টি করে। তাই উন্নত  মন উন্নত  দেহের সৃষ্টি করে, সংকল্প অনুযায়ী যোগ্য শরীরে সে প্রবেশ করে । শরীরবিহীন কোনো সংকল্পই পূরণ হবার নয়, তা সে ভালো বলুন, বা মন্দ বলুন। সংকল্প পূরণ কেবলমাত্র  শরীর  সাধ্য। অর্থাৎ আমাদের আকাঙ্ক্ষা বা সংকল্প পুরনের জন্য আমাদের উপযুক্ত শরীর  লাভ হয়। বেদান্ত দর্শন বলছে, শরীর যেন একটা জোঁক, এক পাতা থেকে আর এক পাতায় ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।  তেমনি প্রাণ, এক দেহ থেকে আর এক দেহে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অর্থাৎ জীবাত্মাই এক দেহ থেকে আর দেহে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সংকল্প সাধনের জন্য। আর প্রাণ  ইন্দ্রিয়গুলোর সাহায্যে নিদিষ্ট কর্ম্ম সম্পাদন করতে থাকেন।  বা বলা যেতে পারে, প্রাণ ইন্দ্রিয়গুলোকে যথা নির্দিষ্ট  কর্ম্মে নিযুক্ত করছেন। এখন কথা হচ্ছে,  প্রাণ আমাদের জীবদেহে কখন প্রবেশ করেন। আমরা জানি, আমরা যখন শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া করছি, তখন আমাদের শরীরে প্রাণের প্রবেশ ঘটছে। আর ক্রিয়া শুরু হয়েছিল, মায়ের পেট থেকে শিশু হিসেবে বেরিয়ে পড়বার সঙ্গে সঙ্গেই।  তাহলে কথা হচ্ছে, আমরা যখন মায়ের পেটে বা গর্ভে   ছিলাম, তখন কি আমাদের  শরীরের মধ্যে প্রাণের যাতায়াত ছিল না ? ছিল, কিন্তু তা ছিল, মায়ের প্রাণের অংশ।  অর্থাৎ মায়ের মধ্যে যে প্রাণের যাতায়াত ছিল, সেই প্রাণ-ই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো।  তার আগে আমার শরীর ছিল ভ্রূণ আকারে, তখনও আমি মায়ের প্রাণের আশ্রয়ে ছিলাম । তারও আগে, আমার দুটি শারীরিক সত্ত্বা ছিল, একটা হচ্ছে রজঃ আর একটা হচ্ছে শুক্র। শুক্র ছিল, পিতার দেহে, রজঃ ছিল, মায়ের দেহে। এই দুই শক্তি তখন যে শরীরে অবস্থান করতো, তখন সেই শরীরের প্রাণের আশ্রয়ে ছিল। শুক্রের/রজঃ সৃষ্টির আগে আমি  ছিলাম, অন্নের আকারে। তখনও আমার মধ্যে প্রাণের শক্তি বিরাজ করতো।  

 আমাদের পরের প্রশ্ন ছিল, কি ভাবে  প্রাণ  সারা শরীরে ছড়িয়ে যান ? কি ভাবে তিনি শরীরকে কর্মক্ষম করেন ?


প্রাণ যখন আমাদের এই স্থূল শরীরে প্রবেশ করেন, তখন আমাদের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে বা বলা যেতে পারে, কর্মক্ষম  হয়ে ওঠে। প্রাণের অবর্তমানে শরীরে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বর্তমান থাকা সত্ত্বেও কর্ম্মক্ষমতাহীন হয়ে, অর্থাৎ নির্জীব অবস্থায়  অবস্থান করে মাত্র। প্রাণ স্থূল শরীরে প্রবেশ করেই যেটা করেন, সেটা হচ্ছে ক্ষমতা প্রদান।  তিনি নিজেকে ৫টি ভাগে ভাগ করে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে দেন। চোখ, কান, মুখ, নাক - এখানে প্রাণ নিজে অবস্থান করেন। শরীরের মাঝামাঝি অংশে পাঠিয়ে দেন সমান বায়ুকে। শরীরের নিমাঙ্গে পাঠিয়ে দেন অপান বায়ুকে। ব্যান বায়ু সমস্ত ধমনীর মধ্যে প্রবেশ করেন। আর উদান বায়ু প্রবেশ করেন, আমাদের কেন্দ্রীয় ধমনীতে অর্থাৎ ইড়া, পিঙ্গলা,  সুষুম্না, নাড়ীর মধ্যে। এখানেই  চিত্রাণি, বজ্রাক্ষা,  নাড়ী অবস্থান করে । এইভাবে তিনি সমস্ত শরীরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েন ও শরীরকে জীবন্ত করে তোলেন, ক্রিয়াশীল করে তোলেন।  

একদম শেষ প্রশ্ন ছিল,  কি ভাবেই বা তিনি আবার শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যান ? 

উপনিষদ বলছেন : প্রাণীর মৃত্যুকালে উদানবায়ুর ভূমিকা গুরুত্ত্বপূর্ন। এই উদানবায়ু জীবাত্মাকে দেহের বাইরে নিয়ে যায়। এই উদান বায়ুর ত্রিবিধ গতি, উর্দ্ধ-নিম্ন-মধ্যে। জীবাত্মার কর্ম্ম অনুসারে, উদান  বায়ু এই গতি নির্দিষ্ট করে। কেউ পুণ্যলোকে, কেউ পাপলোকে, আবার কেউ মনুষ্যলোকে গতিলাভ করে। উদ্যান বায়ু শরীরে উত্তাপ দান করে। উদ্যান বায়ুর অবর্তমানে শরীর শীতল হয়ে যায়। আর সমস্ত ইন্দ্রিয় তখন মনে লীন হয়ে যায়। এবং সে তখন জন্মান্তরের জন্য প্রস্তুত হয়।  এই সময় মন  সূক্ষ্ম অবস্থায় ইন্দ্রিয়গুলোকে  নিয়ে, প্রাণে প্রবেশ করে, আর প্রাণ তখন আত্মার অনুসরণ করে। নাক বা মুখ বা বিশেষ ক্ষেত্রে ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে আত্মা বেরিয়ে যায়।

সাধন মার্গের লোকেরা যখন একটু উচ্চ পর্যায়ে চলে যান, তখন তারা এই উদ্যান বায়ুকে  করেন। উদ্যান বায়ুর অবস্থান যেহেতু, সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে, তাই উদ্যান বায়ুকে উর্দ্ধগতি করবার জন্য চেষ্টা করেন। এবং উদ্যান বায়ুকে ব্রহ্মরন্ধ্রে চালান করেন। এসব কথা আমরা পরিবর্তিতে আলোচনা করবো।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।  
আমরা কি আমাদের মৃত্যুকে পিছিয়ে দিতে পারি ?

যার জন্ম আছে তার মৃত্যুও আছে।  হাজার সাধ্য-সাধনা করেও কেউ অমরত্ত্বের বর লাভ করতে পারেনি।   এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু ইচ্ছে করলে কি আমরা আমাদের মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখতে পারি ? আমাদের কি ইচ্ছামৃত্যু সম্ভব ? না আমি আত্মহত্যার কথা বলছি না। আত্মহত্যা যে করা যায়, অর্থাৎ যেকোনো সময় যে আমি নিজেকে মেরে ফেলতে পারি, সেটা তো আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। কিন্তু আমরা কি আমাদের মৃত্যুকে কিছু দিনের জন্য হলেও পিছিয়ে দিতে পারি।

আমরা মহাভারতে পড়েছি, মহাত্মা ভীষ্ম যখন যুদ্ধক্ষেত্রে শর-শয্যায় শায়িত হলেন,  তখন দক্ষিণায়ন চলছে। মহাত্মা ভীষ্ম দক্ষিণায়নে দেহত্যাগ করতে চান নি। উত্তরায়নের অপেক্ষায় নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। অচেতন অবস্থায় নয়, সচেতন ভাবেই তিনি বেঁচে ছিলেন। আর এই সময় যুধিষ্ঠিরকে যে  আপ্তবাক্য শুনিয়েছিলেন,তা  আমাদের কাছে চিরস্বরণীয় হয়ে আছে।

এতো গেলো পূরাণের কথা।  কিন্তু আমরা মহাযোগী গোরক্ষনাথের কথা শুনেছি। এই মহাযোগী নাকি মৃত্যুর সময়  বলেছিলেন, এই দেহ ছাড়ার  পরে আমি সিদ্ধ দেহে অবস্থান করবো, তোমরা আমার দর্শন পাবে, সাহায্য পাবে। এই বলে মন্দির কক্ষে প্রবেশ করলেন, এবং তৎক্ষণাৎ মন্দির কক্ষ এক স্বর্গীয় সুগন্ধে ও স্নিগ্ধতায় ভরে ওঠে। উপস্থিত শিষ্যরা নাকি দেখেছিলো, গোরক্ষনাথের স্থূল দেহ, একটা শুভ্র জ্যোতিমণ্ডলে পরিণত হয়ে গেছে।  এবং খানিক্ষন পরে, তার লোকত্তর সিদ্ধ দেহ উর্ধাকাশে মিলিয়ে যায়। এসব কি গল্পকথা, নাকি এর মধ্যে সত্যতা আছে ?
  
আমরা আদিগুরু শঙ্করাচার্য্যের কথা শুনেছি, তার গুরুদেব ছিলেন, মহাত্মা গোবিন্দপাদ।  তিনি নাকি আসলে মহর্ষি পতঞ্জলি। আর এই মহর্ষি পতঞ্জলি হাজার হাজার বছর  ধরে অপেক্ষা করছিলেন, নর্মদা নদির তীরে, একটা গুহার মধ্যে,  আচার্য্য শঙ্করকে দীক্ষা দেবার জন্য।

আমরা বাবাজির নাম শুনেছি।  যিনি কয়েক'শ  বছর অপেক্ষা করেছিলেন, শ্রী শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়কে দীক্ষা দেবার জন্য। বাবাজি নাকি শ্যামাচরণ লাহিড়ীর আগের জীবনের গুরুও  ছিলেন।

আমরা যোগাচার্য্য শ্রীমৎ স্বামী শিবানন্দ সরস্বতীর কথা শুনেছি।  তিনি বলেছিলেন, যোগীদের ইচ্ছামৃত্যু হয়।

ভারতবর্ষে হাজার হাজার মহাপুরুষ ছিলেন, এমনকি এখনো হয়তো আছেন, যারা ইচ্ছামৃত্যু বরন করতে পারেন, বা করে থাকেন ।

এখন কথা হচ্ছে এটা কি আদৌ সম্ভব। দেখুন এই ব্যাপারটা বুঝতে গেলে আমাদের প্রাণত্যাগের বা মৃত্যু প্রক্রিয়াটা ভালোভাবে বুঝতে হবে। আর এটাও আমাদের বুঝতে হবে, আমার অর্থাৎ আত্মার কিন্তু মৃত্যু নেই।  কেবল মাত্র স্থূল শরীরের মৃত্যু। আসলে মৃত্যু হয় আমাদের দুটো শরীরের, সেটা হচ্ছে, অন্নময় ও প্রাণময় শরীরের। এর মধ্যে একটা হচ্ছে স্থুল (অনন্ময়) আর একটা হচ্ছে সূক্ষ্ম (প্রাণময়) . বাকি যে শরীর  অর্থাৎ মনময়, বিজ্ঞানময়, ও আনন্দময় শরীরের কিন্তু এক্ষুনি মৃত্যু হচ্ছে না। সে যাই হোক, আমরা যাকে  মৃত্যু বলতে বুঝি, অর্থাৎ আমাদের দেহের মৃত্যু, সেটা কি ভাবে সংগঠিত হয় ?

মৃত্যুর সময় আমাদের কি হয় ? প্রথমে আমাদের খাদ্য গ্রহণ করবার ইচ্ছা চলে যায়। অর্থাৎ আমাদের অন্নময় শরীরের  ক্ষয় বৃদ্ধি হতে থাকে। আমরা জানি আমাদের শরীরে প্রতিদিন অসংখ্য কোষ  জন্মাচ্ছে, আবার প্রতিদিন অসংখ্য কোষ মারা যাচ্ছে। যতদিন কোষ জন্মের হার মৃত্যুর থেকে বেশি থাকে, ততদিন আমাদের শরীর  বৃদ্ধি পেতে থাকে। আবার ঠিক যখন উল্টোটা ঘটে অর্থাৎ যখন  আমাদের কোষের মৃত্যুর হার জন্মের থেকে বৃদ্ধি পেতে থাকে, তখন আমাদের শরীরের নাশ হতে থাকে । কিন্তু  এসব সত্ত্বেও, অর্থাৎ না খেয়ে, বা শুধু জল খেয়ে  মানুষ বেশ কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারে, কারন কিছু কোষ আছে, যারা সর্বাধিক ৭ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু এই কোষ গুলো বেঁচে থাকার জন্যও খাদ্যের প্রয়োজন। আর এই খাদ্য শুধু অন্ন নয়, এর মধ্যে আছে প্রধানত বায়ু, তারপরে অগ্নি।

আমাদের জীবন হচ্ছে শ্বাসের খেলা। শ্বাসের ক্রিয়া শুরুতে আমাদের জীবনের শুরু হয়, আবার শ্বাসের শেষে আমাদের জীবন শেষ হয়।  এই শ্বাসের মাধ্যমেই আমাদের শরীরের  সমস্ত প্রক্রিয়া চলে।  পঞ্চভূতের মধ্যে  মরুৎ অর্থাৎ বায়ু সবথেকে শক্তিশালী ও সংযোগকারী। উপনিষদে একেই  ব্রহ্ম বলে আখ্যা  দেওয়া হয়েছে।এবং প্রাণের সঙ্গে সঙ্গে আত্মাও আমাদের শরীর  ছেড়ে চলে যায়।  অর্থাৎ প্রাণের সঙ্গে আত্মার একটা সংযোগ আছে।  প্রাণ আমাদের শরীরের সমস্ত জায়গায়  পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। এই বায়ুকে বা মরুৎকে  পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রাণ-অপান-সমান-উদান-ব্যান। আমাদের শরীরে প্রাণের বা বায়ুর ক্রিয়াটাকে একটু বুঝে নেই। শ্বাসের সঙ্গে আমরা যে বায়ু গ্রহণ করি, ফুসফুস এই বায়ুকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করে দেয়।  আর তা হলো :

প্রাণ - অর্থাৎ উইন্ড অফ লাইফ (wind of  life ) : এর কাজ হচ্ছে, শ্বাসগ্রহণ ও শ্বাস ত্যাগ।  অর্থাৎ ফুসফুসকে পরিচালনা করা। আমরা খাবার সঙ্গে সঙ্গে যে খাবার পেটে চলে যায়, এটা এই প্রাণবায়ুর কাজ।
অপান - অর্থাৎ ইন্টেস্টিনাল ওইন্ড (intestinal wind) : এই বায়ু সাধারণত আমাদের নিম্নাঙ্গে প্রবাহিত হয়।  অর্থাৎ মলমূত্র-শুক্র এমনকি সন্তানকে নিচে নাবিয়ে আনতে  সাহায্য করে এই বায়ু।
সমান - সমান কথাটার ইংরেজি হতে পারে smooth  । অর্থাৎ যে বায়ু প্রাণ ও অপান বায়ুর ক্রিয়ার মধ্যে  একটা সমতা বজায় রাখে, তাকে বলে সমান বায়ু ।
উদান - গুট্টুরাল ওইন্ড guttural air  এই উদ্যান বায়ুর সাহায্যেই  আমরা কথা বলি। আবার এই উদ্যান বায়ুর সাহায্যে আমরা কুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করতে পারি।
ব্যান - ব্যান বায়ুর সাহায্যে আমরা আমাদের সর্ব শরীরে এমনকি মস্তিষ্কে রক্ত প্রেরণ করতে পারি। এই ব্যান বায়ুর সাহায্যে আমরা রোগমুক্ত হতে পারি।

আমাদের  শরীরের শ্বাসক্রিয়া শুরু হলেতবেই  আমাদের  কৰ্মইন্দ্রিয় (বাক,পানি,পাদ, পায়ু,উপস্থ ) জ্ঞান ইন্দ্রিয় (কর্ন, চর্ম, চক্ষু, জিহবা, ও নাসিকা)  ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। শ্বাস-প্রক্রিয়ার গুরুত্বের কথা চিন্তা করে ভগবান বোধহয়,  স্বাস প্রক্রিয়ার জন্য দুটো অঙ্গ বা দুটো ইন্দ্রিয় ব্যবহার করার ব্যবস্থা করেছেন । এই জন্য  শরীরের অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলো বিশ্রাম নিলেও, নিদ্রা গেলেও এই প্রাণশক্তির ক্রিয়া চলতে থাকে।  কখনই বিশ্রাম নিতে পারে না। দিন-রাত অনবড়ত  কাজ করতে থাকে। যতক্ষন এই প্রাণশক্তি প্রবাহমান থাকে ততক্ষনই আমাদের আয়ু থাকে। প্রাণ যতক্ষন কর্মক্ষম থাকে ততক্ষনই আমাদের জীবিত বলা হয়।  এই প্রাণশক্তির কাজ শেষ হয়ে গেলে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। এই প্রাণের শক্তিতেই দৃষ্টি-শক্তি, এই প্রাণের শক্তিতেই শ্রবণ শক্তি, এই প্রাণের শক্তিতেই ঘ্রান শক্তি, বাক শক্তি, জ্ঞানশক্তি, পাচন  শক্তি। প্রাণের ক্রিয়া শুরুতে জীবন শুরু হয় - আবার প্রাণের ক্রিয়া শেষে জীবনের শেষ হয়। ত্রিলোকে যা কিছু বর্তমান সবই প্রাণের অন্তর্গত।

অতএব এই প্রাণক্রিয়া আমাদের স্থূল শরীরকে বাঁচিয়ে রাখে। আমাদের মৃত্যুর সময়, আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়শক্তি সংকুচিত হতে থাকে। এবং অপানবায়ু প্রথমে আমাদের শরীর  ছেড়ে দেয়। ফলতঃ মৃত্যুকালীন সময় আমরা মল-মূত্র ত্যাগের উপরে নিয়ন্ত্রণ হারাই। তার পারে ধীরে ধীরে ব্যান, উদ্যান, সমান এবং সব শেষে প্রাণবায়ু আমাদের দেহ ছেড়ে দেয়। এই প্রাণবায়ুর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চেতনশক্তি, বা আত্মা আমাদের স্থূল শরীর ছেড়ে দিয়ে আমাদের সংস্কারকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে থাকে। অর্থাৎ তখন আমরা সাধারণ মানুষরা মনোময় দেহে অবস্থান করি। উন্নত মহাত্মারা মনময় দেহকে  ছেড়ে দেন, তারা বিজ্ঞানময় দেহে অবস্থান করেন। অর্থাৎ বাসনা-সংকল্প বিহীন অবস্থায় শুধু জ্ঞানময় জগতে  তাঁরা অবস্থান করেন।

এতো গেলো আমাদের পার্থিব শরীর  দেহত্যাগের কথা। কিন্তু আমাদের মূল যে প্রশ্ন পার্থিব দেহ ত্যাগের সময় নির্ধারণ কি আমরা নিজেরা করতে পারি? অর্থাৎ এই ত্যাগের প্রক্রিয়াকে আমরা কি পিছিয়ে দিতে পারি ? যদি পারি, তবে তা কি ভাবে সম্ভব হতে পারে ?

আমরা এতক্ষনে বুঝতে পেরেছি, জীবন হচ্ছে শ্বাসের ক্রিয়া। তো এই শ্বাস-প্রশ্বাস যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তবে আমাদের আয়ু আমরা নিজেরাই বর্ধিত করে নিতে  পারি। তবে একটা কথা মনে রাখবেন, প্রাকৃতিক নিয়মে আমাদের শরীরের ক্ষয় হবে। এই ক্ষয়কে নিবারণ করবার কথা ক্ষমতা কারুর নেই। তবে এই ক্ষয় বৃদ্ধির মাত্রা কমানো যেতে পারে। আমরা আজ সেই আলোচনায় যাবো না। আমাদের প্রশ্ন প্রাণবায়ুকে ধরে রাখা, বা প্রাণবায়ুকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনা । এই শ্বাস-প্রশ্বাস এর প্রক্রিয়া করে আমাদের শরীরের একটা মূল্যবান অঙ্গ যার নাম  ফুসফুস।  অতএব  আমাদের ফুসফুসকে সবসময় সক্রিয় রাখতে হবে।  সুস্থ  সবল রাখতে হবে। তার জন্য আমাদের এই ফুসফুসের ব্যায়াম  করতে হবে। আর সেটা হচ্ছে প্রাণায়াম। আর এই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে, আমাদের ফুসফুস যাতে কোনো রকমে সংক্রামিত না হয়।  অর্থাৎ অন্যের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। আর এই কাজটাই করে থাকেন, আমাদের সাধু-সন্তেরা। অর্থাৎ নেশা না করা। ধোঁয়া আমাদের ফুসফুসকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। নির্মল বাতাসের পরিবেশে নিজেকে রাখা।  এইজন্য, নির্জন পাহাড়ে থাকা ফুসফুসের জন্য ভালো।  এইবার মূল যে কাজ সেটা হচ্ছে  অনুলোম-বিলোম বা সহজ প্রাণায়াম দিয়ে শুরু করে, শেষে কুম্ভক  অভ্যাস করা।অর্থাৎ বাতাসকে একবার নিজের শরীরের মধ্যে আটকে  রাখা। আবার বাতাসকে একবার সম্পূর্ণ শরীরের বাইরে আটকে রাখা।   আমরা জানি ধ্যানের একটা প্রক্রিয়া হচ্ছে, শ্বাস-প্রশ্বাস গতিকে পর্যবেক্ষন করা, শেষে তাকে নিজের ইচ্ছে মতো নিয়ন্ত্রণ করা, এবং সব শেষে  শরীরের ভেতরে  বা বাইরে মরুৎকে  আটকে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় নিজেকে সামিল করা। এইভাবে আমরা শ্বাস প্রশ্বাস কে যদি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে  পারি তবে আমরা  আমাদের মৃত্যুকে পিছিয়ে দিতে পারি। আর একটা কথা বলি, ফুসফুসকে ভালো রাখবার জন্য, দুবেলা শঙ্খ বাজানো, ধূপের গন্ধ নেওয়া, বা সুগন্ধি ফুলের বাস নেওয়া, কাঁসর-ঘন্টার ধ্বনি শোনা - খুবই উপকারী।

এখন কথা হচ্ছে, এইসব কথা যদি সত্যি হয়, তবে তো মানুষ অমর  হয়ে যেতে পারে। না পারে না, কারন আমরা জন্মগ্রহণ করি আমাদের বাসনা পূরণের জন্য, সংকল্প সাধনের জন্য। আর স্থুল দেহ ভিন্ন আমাদের সঙ্কল্প বা বাসনা পূরণ সম্ভব সম্ভব নয়।  তো শরীর যখন আমাদের সংকল্প পূরণের অযোগ্য হয়ে যাবে। তখন আমরা অবশ্য়ই এই পার্থিব দেহ ছেড়ে অন্য দেহে চলে যেতে চাইবো। তাই আমরা কখনোই অমর হতে চাইবো না।

সব শেষে একটা কথা বলি, আমরা কি করে বুঝবো যে আমার জন্মের সময় নির্ধারিত আয়ু বাড়লো কি কমলো ? দেখুন আমি জন্মেছি, ১৯৫৪ সালের ৯-ই অক্টোবর শনিবার, সকল ছটায় । আর আমার মারা যাবার কথা ২০৩০ সালের ২০ নভেম্বর, বুধবার, দুপুরের একটু আগে।  না এটা আমার মনগড়া কথা নয়।  আমার কুষ্টিতে সেরকম লেখা আছে। তো আমার কথার সত্যতা প্রমান করবার জন্য আমাদের সবাইকে  অপেক্ষা করতে হবে ২০৩০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত।

এই প্রসঙ্গে তিব্বতিবাবার একটা গল্প বলি, তিব্বতিবাবা কলকাতার এক ভক্তের গৃহে এসেছেন।  সেখানে তিনি তার গুরুদেব পরমানন্দ ঠক্কর বাবার সাধন ঐশর্য্য এবং তার দীর্ঘ আয়ুষ্কালের কথা শোনাচ্ছিলেন। বলছেন, ঠক্কর বাবার বয়স কয়েকশত বৎসর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। একথা শুনে, এক শিক্ষিত ভদ্রলোক বলে বসলেন, বাবাজি আজকের দিনে এসব কথা কেউ বিশ্বাস করবে না, বরং বলবে, এসব "ঠাকুরমার ঝুলির গল্প"।একথা শুনে তিব্বতি বাবা বললেন, শুনে রাখ নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের নামই জীবন। এদুটোর ক্রিয়া বন্ধ  করার কৌশল যে জানে, সে-ই পারে জীবনের গতিকে স্তম্ভন করতে, সেই পারে শত শত বৎসর জীবিত থাকতে। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। আপন-ভোলা নিরাসক্ত মনে যদি সংকল্প জেগে ওঠে, শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া যায় নিরুদ্ধ হয়ে, আর জীবনের পরিধিও হয়ে যায় বিস্তৃততর। আমার গুরুদেবের শক্তির পরিমান তোরা শালা কি বুঝবি ? (ভারতের সাধক - খন্ড - ৬ পৃষ্ঠা -১৯০)
 
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।
মৃত্যুর অভিজ্ঞতা :
ছেলেটি ঘুমুলে তার কোনো হুঁশ থাকে না। ডাকাডাকি তো দূরের কথা তার শরীরে আঘাত করলেও, তার ঘুম ভাঙে না। এমনকি তাকে বিছানা থেকে নামিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে গেলেও তার ঘুম ভাঙে না। আসলে ঘুমুলে তার দেহ-বোধ লোপ পেয়ে যেত। যেখানে সে বসতো, সেখানেই সে ঘুমিয়ে পড়তো। এর ফলে, দুস্টু ছেলেরা তার পিছনে  লাগতো। শারীরিক নির্যাতন করতো।  আর এই দুস্টু ছেলেদের হাত থেকে বাঁচতে, একদিন এক অন্ধকারময় ভূগর্ভে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। স্থানটি ছিল আলো-বাতাস বর্জিত। উঁইপোকা, ইঁদুর আর নাম না জানা অসংখ্য পোকামাকড়ের আশ্রয়স্থল। কিন্তু এতে কিশোরের  কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না। বিষাক্ত পোকার কামড়ে তার সর্বাঙ্গে ক্ষতের সৃষ্টি হলো। শুভাকাঙ্খীগণ অনুরোধ-উপরোধ করলেও, বালক ভূগর্ভের আসন ছেড়ে বাইরে আসতে  চাইলো না।  এর পর জোর করে তাকে বাইরে আনা  হলো, দেখা গেলো, তার সমস্ত শরীর, পোকার কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে। কিন্তু বালকের  না আছে কোনো যন্ত্রণাবোধ, না আছে শরীরবোধ। আসলে সে ঘুমাবিষ্ট নয়, ধ্যানাবিষ্ট হয়ে যেত নিজের অজ্ঞাতসারেই।  উত্তর জীবনে এই ঘুম-কাতুরে বালকটি রুপান্তরিত হয়, মহাজ্ঞানী তাপসরূপে। যার নাম আমরা শুনেছি - মহর্ষি রমন। 

এই মহাজ্ঞানীর জীবনে মৃত্যু-অভিজ্ঞতা হয়েছিল।  মহর্ষি রমন বলছেন, একদিন ১৯১৮ সালের এক স্নিগ্ধ  সকালে কয়েকজনকে নিয়ে গুহার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন।  পথে তার সমস্ত শরীর  কোনো এক অজ্ঞাত কারনে শিথিল, অবসন্ন হয়ে পড়ে। তখন বহির্জগতের সমস্ত দৃশ্য অন্তর্হিত হলো, চোখের সামনে একটা সাদা পর্দা নেমে এসে দৃষ্টিকে অবরুদ্ধ করে দিলো। মহর্ষি বলছেন, আমি থমকে গেলাম। আছাড়  খাবো ভেবে, পথ চলা বন্ধ করে, দাঁড়িয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে আবার সব স্পষ্ট হলো। আমি আবার পথ চলা শুরু করলাম। কিন্তু শীঘ্র আবার আমার চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এলো। বেশ বুঝতে পারছি, ধীরে ধীরে বাহ্যজ্ঞান লোপ পাচ্ছে। আমি আবার পাথরে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম। এরপর তৃতীয়বার এলো, চৈতন্য অবলুপ্তির পালা। একটা সাদা পর্দা আমার চোখের সামনের সমস্ত দৃশ্য ঢেকে দিলো। রক্ত সঞ্চালন ও শ্বাসক্রিয়া কি রুদ্ধ হয়ে গেলো ? সঙ্গে ছিল, বাসুদেব শাস্ত্রী ।  আমার শরীর নাকি তখন কৃষ্ণাভ নীল। বাসুদেব, আমি মরে  গেছি ভেবে, আমাকে  দুই হাতে জড়িয়ে কান্না জুড়ে দিলো। আমার  কিন্তু তখনও  চেতন ধারা লোপ পায়  নি। একটা আছন্ন ভাব আমাকে জাগিয়ে রেখেছে। আমি অভ্যাস বশতঃ আসনের ভঙ্গিতেই বসে আছি। পাথরে হেলান দেবার প্রয়োজন বোধ হয় নি। রক্তের গতি যেন রুদ্ধ হয়ে গেছে, শ্বাস-প্রশ্বাস নিরুদ্ধ হয়ে গেছে। এই অবস্থায়,  মিনিট পনেরো কেটে যাবার পরে, সারা দেহে আকস্মিকভাবে কম্পন অনুভূত হতে লাগলো। আর সঙ্গে সঙ্গে যেন শুরু হলো, রক্তের সঞ্চালন, শ্বাস-প্রশ্বাস। সারা শরীর  থেকে প্রবলভাবে ঘাম বেরুতে লাগলো।শরীর আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। এযেন মৃত্যুর অনুভূতি।

শ্বাস রুদ্ধ হবার ঘটনা আমি সামনে থেকে  একবার দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছি। স্ত্রীর জিভ অসার হয়ে গেছে, স্বাদ-বোধ লোপ পেয়ে গেছে। আগেও কয়েকজন  ডাক্তারকে  দেখিয়েছি , কিন্তু কোনো সুরাহা হয় নি। স্ত্রীর ধারণা  হয়েছে, তার লিভারটা বোধহয় পচে গেছে। ডাক্তারবাবু বলছেন, কিছুই হয় নি, কিন্তু জিভে যে স্বাদবোধ নেই, এটাতো সত্য।   তো আমার দাদা-প্রতিম ডাক্তার দশরথ বিশ্বাসের কাছে গেছি, তার বাড়িতে। সেখানে কিছুক্ষন বসে কথা বলতে বলতে স্ত্রী হাঁসফাঁস করতে লাগলেন । কথা বলতে পারছেন  না। হাবভাবে বুঝলাম, তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমি কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে গেলাম। ডাক্তারবাবু, দৌড়ে ভিতরে চলে গেলেন। আমি কিছু না বুঝে ব্যাগের ভিতর থেকে জলের বোতল থেকে তার মাথায় জল ঢালতে লাগলাম। স্ত্রী আমার হাত থেকে বোতলটা নিয়ে, মুখের ভিতরে জল ঢেলে দিলেন। কিছুক্ষনের মধ্যে তিনি আবার শ্বাস নিতে শুরু করলেন।  ঘটনাটা বোধহয়, এক মিনিট বা দুই  মিনিটের। কিন্তু এর মধ্যে মনে হলো, স্ত্রী নতুন জীবন পেলেন, যমের  দুয়ার থেকে ফিরে এলেন । আসলে আমার স্ত্রী কথা বলতে বলতে মৌরি চিবোচ্ছেলেন। আর মৌরির দানা গলায় বেঁধে এই দুর্যোগ উপস্থিত হয়েছিল। সেই থেকে তিনি মৌরি খাওয়া  ছেড়ে দিলেন। আসলে কিছুদিন ধরে লক্ষ করছিলাম, আমার স্ত্রী মাঝে মধ্যে মৌরি চিবুতো। এতে করে নাকি তার ভালো লাগতো। একটা নেশার মতো হয়ে গেছিলো। মৌরিতে যে এমনতরো বিপদ আসতে  পারে, তা আমাদের কারুর ধারণার মধ্যে ছিল না। সেই মুহূর্ত থেকেই তিনি মৌরি খাওয়া ছেড়ে দিলেন, যা তাকে এক বিরল দমবন্ধের অনভিপ্রেত অসহনীয় অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করেছিল। আর আশ্চর্য্যের বিষয় হচ্ছে, জিভের অসারভাবও কেটে গেলো। স্ত্রী বলতে লাগলেন, দমবন্ধ হয়ে মরার কষ্ট কি, তা এবার টের পেলাম। জীবনে আর মৌরি খাবো না কোনোদিন।           

 


No comments:

Post a Comment