Monday 15 February 2021

প্রণব/উদ্গীথ/ওম/ওং/ওঁ/ওঁং/ঔং - (একত্রে)/ ছান্দোগ্য

 



প্রণব/উদ্গীথ/ওম/ওং/ওঁ/ওঁং/ঔং (একত্রে) / ছান্দোগ্য উপনিষদ  

প্রণব কথাটার অর্থ ঈশ্বরের জপ্ । আমাদের অজ্ঞাতসারেই আমরা জন্ম থেকেই  প্রণব মন্ত্র উচ্চারণ করি। প্রণব কথাটার আর একটা মানে প্রতিনিয়ত নতুন। কথিত আছে ব্রহ্মা সৃষ্টির প্রারম্ভে এই প্রণব মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন। আর এই প্রণব থেকেই সমস্ত সৃষ্টি। অতএব ব্রহ্মা যদি আমাদের পিতা হন তবে প্রণব আমাদের আদি মাতা। এই প্রণবের গর্ভেই আমাদের সবার জন্ম। আবার প্রণব কথাটার আর একটা মানে হচ্ছে যা উচ্চারণ করে স্তব করা হয় তাকেই বলে প্রণব। বেদের মূল এই প্রণব। অর্থাৎ সমস্ত শব্দের মূল এই প্রণব।  আমরা এমনকি সমস্ত জীব জগৎ,  জ্ঞাতসারে, অজ্ঞাতসারে, এই প্রনব দিয়েই  জীবনের প্রথম শব্দ উচ্চারণ করি। যা আসলে ঈশ্বরের জপ্। সমস্ত জীব জগৎ যে ভাষায় কথা বলে তাকে বলে বৈজিক ভাষা।  সমস্ত ভাষার বীজ এই বৈজিক ভাষা। বৈজিক থেকে বৈদিক, গ্রিক, হিব্রু, ল্যাটিন ইত্যাদি ভাষার জন্ম হয়। এই বৈজিক ভাষাতেই সমস্ত জীব কথা বলে বা মনের ভাব প্রকাশ করে। প্রণব বা ওং এই বৈজিক ভাষার উচ্চারিত  ধ্বনি ।     

সনাতন হিন্দুদের কাছে  প্রণব মন্ত্রের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ও বাধ্যতামূলক।  আমাদের সবার বীজ মন্ত্র  প্রণবপুত হওয়া জরুরী। নতুবা বীজ মন্ত্রের শক্তি অপ্রকাশিত থাকে। অবশ্য হিন্দু ব্রাহ্মণ পন্ডিতগণ এখানেও জাতপাতের ব্যাপারটা নিপুন ভাবে প্রয়োগ করেছেন। তান্ত্রিক সন্ধ্যা পদ্ধতির এক জায়গায় পড়ছিলাম স্ত্রী ও শূদ্রদের ওঁ বা ওম  উচ্চারন করার অধিকার নেই। তারা বলবে "ঔং"অর্থাৎ দীর্ঘ প্রণব। যজুর্বেদীয় তর্পন পদ্ধতিতেও  বলা আছে, শূদ্রগন "ওঁ" না বলে "নমঃ" বলবে।   
যাই হোক, "ওম ". কথাটাকে ভাঙলে দাঁড়ায় অ-উ-ম।  সনাতন হিন্দু মতে,  ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর  অর্থাৎ সৃষ্টি, স্থিতি, লয় এর কর্তা। আবার  সত্ত্বঃ, রজঃ, তমঃ এই তিন গুনের প্রতীক হচ্ছে "ওম"।  কিন্তু কেউ কেউ বলেন,  অ-আ-উ-ম্ এই চারটি বর্ণ নিয়ে প্রণব গঠিত। আবার কেউ কেউ বলেন, প্রণব পাঁচ অক্ষরের মিলন।  অর্থাৎ অ -আ -উ -ঊ -ম অর্থাৎ ক্ষিতি, অপ, তেজঃ মরুত, ব্যোম।
আবার  প্রণব লেখাও হয় -  চার রকম বানানে  -ওম , ওঁ, ওং, ওঁং।
এর কারন কী  ? ওম আসলে কত অক্ষরের মিলন তা আমরা একটু দেখে নেবো।
ওম-কে বলা হয় অক্ষর ব্রহ্ম।  এঁকে  একাক্ষর বলা যেতে পারে।  অর্থাৎ অনুস্বার, চন্দ্রবিন্দু  এগুলোকে বর্ণ থেকে বাদ  দিয়ে  এক অক্ষর বলা যেতে পারে। সত্যি কথা বলতে কি  স্বরই পূর্ণ বর্ণ। কেবল স্বরেই পূর্ণমাত্রা আছে। ব্যঞ্জন  পূর্ণ বর্ণ নহে।  স্বর, স্বয়ং উচ্চারিত হতে পারে। কিন্তু ব্যঞ্জন, অন্যকে আশ্রয় করে উচ্চারিত হয়। সুতরং ও এবং ম্ এই দুটিতে মিলিত হয়ে যে ওম বা ওং হয়েছে, এঁকে এক বর্ণ বা এক অক্ষর বলা যেতে পারে। অতএব ব্যঞ্জন ও একটি স্বর একত্র থাকলে, এই দুটিকে একটি বর্ণ বলা হয়। অর্থাৎ প্রণব এক-অক্ষর, আবার দুই-তিন-চার-পাঁচ অক্ষর বলে বর্ণনা করা হয়।

ওম আসলে দুটো অক্ষরে লেখা হয় অর্থাৎ ও এবং ম অথবা ও এবং"  ঁ" বা  "ং" তাই এঁকে দুই অক্ষরের মিলন বলা যেতে  পারে। অর্থাৎ নিষ্ক্রিয় বা নির্গুণ ব্রহ্ম এবং সক্রিয় বা সগুন ব্রহ্ম।

তবে সব থেকে প্রচলিত অর্থ যেটা  আমরা জানি তা হচ্ছে,  অ, উ, ম - এই তিনটি বর্ণ নিয়ে ওম বা ওঁ অর্থাৎ সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের কর্তা (ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর ) .
 .
কিন্তু কেউ কেউ বলেন,  অ-আ-উ-ম্ এই চারটি বর্ণ নিয়ে প্রণব গঠিত। তাঁরা বলেন,  অ-কার হচ্ছে পালন কর্তা ,  আ-কার হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা অর্থাৎ ব্রহ্ম, উ কারে লয়-কর্তা অর্থাৎ তমোগুণাত্মক ব্রহ্ম এবং ম বা ং (অনুস্বার) শব্দে পরব্রহ্ম অর্থাৎ গুণাতীত ব্রহ্ম। আর চন্দ্রবিন্দু হচ্ছে স্বরের অনুনাসিকত্ব  জ্ঞাপক।

আবার কেউ বলেন ওং পঞ্চবর্নাত্বক  অর্থাৎ অ-আ-উ-ঊ-ম  অর্থাৎ পঞ্চভূতের (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম )-এর  প্রতীক বলা যেতে পারে।
এইখানে একটা কথা আমি বলি। প্রণব অর্থাৎ ওম, বা ওং বা ওঁ বা ওঁং। একটা জিনিষ খেয়াল করুন, ও এর সঙ্গে ম বা ং বা ঁ যোগ করা আছে -। "ম" অর্থাৎ মহেশ্বর বা কারুর কারুর, কথায় পরব্রহ্ম বা গুনাতীত ব্রহ্ম . কিন্তু,এই অনুস্বার বা চন্দ্রবিন্দু এর অর্থ কি ? বীজ মন্ত্রের  অর্থ খুঁজতে গিয়ে দেখেছি ঁ (চন্দ্রবিন্দু ) হচ্ছে দুঃখ হরাত্মক বাচক। আর ং ( অনুস্বর ) হচ্ছে সুখপ্রদ ও দুঃখনাশন।      
যাই হোক,   ওম , ওঁ, ওং, ওঁং - এই চারটিই প্রণব বাচক।  
প্রথম "ওম" প্রনবটি তমোগুণের প্রতিপাদক, তাই জ্ঞানীরা ব্যবহার করেন না। 
দ্বিতীয় প্রণব অর্থাৎ ওঁ নৈসর্গিক ঘটনায়  শোনা যায়।  বহু শাস্ত্রে, এই প্রণবের ব্যবহার পাওয়া যায়। 
তৃতীয় প্রণব অর্থাৎ ওং কার ত্রিদেবাত্মক অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের প্রতীক।  অনেকেই এটির ব্যবহার করেছেন।  
চতুর্থ প্রণব অর্থাৎ   ওঁং  এর কথা প্রায় শোনা যায় না। তার কারন হচ্ছে - যাদের সগুন সাধনা সমাপ্ত না হয়েছে, তাদের পক্ষে এর ব্যবহার শক্তির অধিক কাজ বলে নির্দিষ্ট হয়। যাদের ভিতর থেকে জাতিভেদ জ্ঞান দূর হয় নাই, নির্গুণ সাধনার যোগ্য হন নাই,  তাদের পক্ষে এই চতুর্থ প্রণব ব্যবহার করা উচিত  নয়। 
 "ওঁং" বানানের প্রতিধ্বনি পাই শিব পূরণে। সেখানে ভগবান শিব, ব্রহ্মা ও বিষ্ণুকে বলছেন : আমার পাঁচটা মুখ। আর তা হচ্ছে সৃষ্টি, পালন, সংহার, তিরোভাব এবং অনুগ্রহ। সৃষ্টি ভূমিতে, স্থিতি জলে,সংহার অগ্নিতে, তিরোভাব বায়ুতে,অনুগ্রহ আকাশে স্থিত। পৃথিবী থেকে সৃষ্টি, জল থেকে বৃদ্ধি, অগ্নিতে সংহার, বায়ুতে স্থানান্তর আর আকাশ সকলকে অনুগ্রহিত করে। সর্বপ্রথম আমার মুখ থেকে ওঁংকার উদ্গারিত হয়। উত্তরদিকের মুখ থেকে অকার, পশ্চিম মুখ থেকে উকার, দক্ষিণ মুখ থেকে মকার, পূর্ব মুখ থেকে বিন্দু (ঁ) মধ্যের  মুখ থেকে নাদ (ং) উচ্চারিত হয়েছে।  এইভাবে পাঁচ অবয়ব দ্বারা "ওঁং"কার বিস্তারিত হয়েছে।  
বেশিরভাগ পন্ডিতদের মতে,  প্রণব আসলে ত্রিবর্ণাত্মক। আ বর্ণটি  প্রথমটির অর্থাৎ অ এর উচ্চারণ ভেদ মাত্র।

প্রণবকে ত্রিবর্ণাত্মক, অর্থাৎ সত্ত্ব, রজ, তম গুনের প্রতীক বলা যেতে পারে।  আবার পঞ্চবর্নাত্বক  অর্থাৎ অ-আ-উ-ঊ-ম  অর্থাৎ পঞ্চভূতের (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম )-এর  প্রতীক বলা যেতে পারে।

 আবার একাক্ষর বলা যেতে পারে।  অর্থাৎ অনুস্বার, চন্দ্রবিন্দু  এগুলোকে বর্ণ থেকে বাদ  দিয়ে  এক অক্ষর বলা যেতে পারে। সত্যি কথা বলতে কি  স্বরই পূর্ণ বর্ণ। কেবল স্বরেই পূর্ণমাত্রা আছে। ব্যঞ্জন  পূর্ণ বর্ণ নহে।  স্বর, স্বয়ং উচ্চারিত হতে পারে। কিন্তু ব্যঞ্জন, অন্যকে আশ্রয় করে উচ্চারিত হয়। সুতরং ও এবং ম্ এই দুটিতে মিলিত হয়ে যে ওম বা ওং হয়েছে, এঁকে এক বর্ণ বা এক অক্ষর বলা যেতে পারে। অতএব ব্যঞ্জন ও একটি স্বর একত্র থাকলে, এই দুটিকে একটি বর্ণ বলা হয়। 
 স্রষ্টা-সৃষ্টি-সৃষ্ট  এ তিনই এক। কিন্তু এ সব কথা যতক্ষন সাধকের  ব্রহ্মজ্ঞান না জন্মায় অর্থাৎ এক ব্রহ্মর জ্ঞান না জন্মায় ততক্ষন অনুধাবন করা যায় না। এইজন্য, যেমন সাধক, সে অনুযায়ী সে  বোঝে বা  তাকে সেইভাবে বোঝানো হয়। 
প্রণব অসীম শক্তির আধার। এই শক্তি অজ্ঞানীর কাছে সুপ্ত।  জ্ঞানীর কাছে উদ্ভাসিত। 
"ওম" বা প্রণবের মাহাত্য ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। অবিরত জপ্-ই এর উত্তর দিতে পারে।
এইবার প্রণব সম্পর্কে সুপ্ত সত্য   কথা বলবো, প্রণব আসলে একটা ধ্বনি।জীবনরূপ অগ্নি ও প্রাণরূপ বায়ুর মিথুনে বা সংঘর্ষে এই ব্রহ্ম-শব্দ উৎপত্তি হয়েছে। এটি   অর্থবহ শব্দ নয়। এই ধ্বনির  কোনো অর্থ হয় না। পন্ডিতরা যে যার মতো করে অর্থ বের করেছেন।এই ধ্বনি প্রতিনিয়ত উদ্গীথ হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সর্বত্র, ও সর্বদা। ধ্যানস্থ হয়ে কান পাতলে এই শব্দ শোনা যায়।  এবার, ধ্বনি বা শব্দ  সৃষ্টির রহস্যঃ একটু দেখে নেই।
আমরা জানি, ধ্বনি  চার প্রকার,  পরা, পশ্যন্তী, মধ্যমা ও বৈখরী।
শব্দের বা স্বরের উৎপত্তি হচ্ছে পরা - আমাদের শরীরের ক্ষেত্রে এটি মূলাধার। এই মূলাধারে আছে বায়ুশক্তি বা উর্জা শক্তি।সৃষ্টিতত্ত্বের এখানেই অবস্থান।  এইখানেই ধ্বনির উৎপত্তি। পরা  কথাটার অর্থ হচ্ছে উচ্চ। অর্থাৎ ধ্বনির সর্বোচ্চ পর্যায়, যা আমাদের গোচরীভূত নয়।
এর পরে আছে পশ্যন্তি : এটি  আমাদের নাভিমূল। যার জন্য কেউ কেউ বলে থাকেন, প্রণব নাভি থেকে উৎপন্ন শব্দ।আমাদের নাভিচক্রের বায়ু থেকে আসে। শোনা যায় যোগীরা এই ধ্বনি শুনতে পান।  একে বলে নাদব্রহ্ম।
ধ্বনি এর পরে, নাভি থেকে চলে আসে হৃদয়ে। এখানকার অবস্থানে ধ্বনিকে বলা হয়, মধ্যমা। হৃদয়ের বায়ুচক্রে  যখন ধ্বনি অবস্থান করে, তখন তাকে বলে মধ্যমা।  এটিও সূক্ষ্ম।  তাই হৃদয়ের ডাক সবাই শুনতে পায়  না।
এরপরে, কন্ঠে - যেখান থেকে ধ্বনির  উৎপত্তি বলে সাধারণের ধারণা। আসলে এই পর্যায়ে এসে ধ্বনি শব্দে পরিণত হয়ে যায়। এই ধ্বনি বা শব্দ আমরা শুনতে পাই।  একে বলে বৈখরী।

এবার  বিশ্বব্রহ্মান্ডকে যদি আমরা বিরাট পুরুষের দেহ বলে কল্পনা  করি, তবে দেখতে পাবো, সেই বিরাট পুরুষের মূল ঊর্যাশক্তি থেকে এই ধ্বনির উৎপত্তি। এটি সৃষ্টির সূচক মাত্র। এর কোনো অর্থ হয় না। কেবল গুন্ বর্তমান।
দ্রব্যের যেমন গুন্ বা শক্তি আছে, শব্দেরও তেমনি শক্তি আছে। ভালো সুর শুনলে আমাদের মন মোহিত হয়। আবার বাজির শব্দে বা বজ্রের শব্দে আমাদের মন চমকে ওঠে।

শব্দ দুই রকম : ধ্বনি ও বর্ণ। ধ্বনি অর্থবহ নয়। যেমন বিভিন্ন বাদ্যের বাজনা।কাঁসর ঘন্টা,বাঁশির সুর, বজ্রের ধ্বনি। মেঘের ডাক। ইত্যাদি। তেমনি প্রণব অর্থবহ নয়। প্রণব ধ্বনি, তাই অর্থবহ নয়। 
বর্ণ কিন্তু অর্থবহ। মানুষ এই বর্ণের সাহায্যেই কথা বলে।  তাই অর্থবহ। বর্ণ আবার দুই প্রকার ব্যঞ্জন  বর্ণ ও স্বরবর্ণ। স্বরবর্ণ নিজে থেকে উচ্চারিত হতে পারে। কিন্তু ব্যঞ্জন বর্ণ স্বরবর্ণের সাহায্যে উচ্চারিত হয়।
 আমাদের মুনি ঋষিরা ধ্বনি ও শব্দ, উভয়ের মাহাত্য দিয়েছেন। বেদে  ধ্বনির মাহাত্য।  এইজন্য বেদের সূক্ত বা শ্লোকের উচ্চারণের প্রতি বিশেষ গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে।  এই জন্য এঁকে শ্রূতি   বিদ্যা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এটি একমাত্র গুরুমুখে শুনেই শেখা বা আয়ত্ত্ব করা যায়।

অগ্নি ও বায়ুর মিশ্রনে বর্ণের সৃষ্টি।  বর্ন আর কিছুই নয় আলোর বিন্দুর সমষ্টি।  পরাবিদ্যাবিদ-গন  বলছেন, দেবতারা যখন কথা বলেন, তখন এক আলোর আভা দেখতে পাওয়া যায়। তাই ওম হচ্ছে আদি ধ্বনি, এটি অর্থবহ নয়।অগ্নিতত্ত্ব ও বায়ুতত্ত্বের মিশ্রনে এই প্রণবের উৎপত্তি।  যে যার মতো করে আমরা অর্থ দিয়েছি মাত্র।

ফলাফল :
এবারে আমরা ছান্দোগ্য উপনিষদের থেকে জেনে নেবো প্রণব জপ্ করলে কি হয় ?ছান্দোগ্য  উপনিষদের প্রথম  পাঁচটা অধ্যায়  আছে এই প্রণব সন্মন্ধে।

দেখুন, ঈশ্বর নিরাকার, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। আমাদের মতো সাধারণের পক্ষে তাঁর সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভবই  নয়। সেই জন্য আমাদের পক্ষে সকাম উপাসনা করা ভালো।  সকাম উপাসনা করলে আমাদের ধন, স্বাস্থ্য, সুনাম, ক্ষমতা ইত্যাদি, এমনকি স্বর্গলাভও  হতে পারে। কিন্তু শাশ্বত শান্তি বা আনন্দ এতে পাওয়া যাবে না। একমাত্র আত্মজ্ঞান লাভই শাশ্বত শান্তির পথ বা মুক্তির পথ। এরই প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে উদ্গীথ বা "ওম" আবৃত্তি বা জপ করতে বলা হয়েছে।

ছান্দোগ্য উপনিষদ বলছে :

ওম-ইত্যে-তদ্-অক্ষরম-উদগীথম-উপাসিত : অর্থাৎ  উদ্গীথ  শব্দ-বাচ্য "ওম" এই অক্ষরকে উপাসনা করবে। 

ওম-ইতি  উদগায়তি : ওম দিয়েই উদ্গীথ গান করা হয়। (উদ্গাতার গেয় অংশই  উদ্গীথ।)

বাক্ ও প্রাণ যখন মিলিত হয় তখন উদ্গীথ জন্ম নেয়।  এই উদ্গীথ - এর বর্ণাত্মক অক্ষরই ওম বা ওঁ। 

"ওম" সম্মতিসূচক শব্দ। ওম অর্থাৎ হ্যাঁ। ওম সমস্তকিছুর  উৎস। সূর্য্য  

আচার্য্য চানক্য বলছেন, বেদে "ওম" কে পরব্রহ্ম বলে স্বীকার করা হয়েছে। এই "ওম" শব্দের সঠিক প্রয়োগে, ও জ্ঞান অর্জনের দ্বারা, স্বর্গলোক এমনকি এই পার্থিব জগতের সমস্ত কিছুই লাভ করা যায়।
প্রণব সন্মন্ধে শব্দের বিরাম দেব। শেষ করার আগে শুধু একটা কথা বলবো : 
প্রণব সর্ব্ব শক্তির আধার, তা সে জাগতিক বলুন আর আধ্যাত্মিক বলুন।

ওম নমঃ শিবায়ঃ।

উদ্গীথ 
জীব দেহে অনাদিকাল থেকে ভালো-মন্দ উভয় বৃত্তি বর্তমান। আর এর লড়াইও চিরকালীন। জীবদেহের এই দুই বৃত্তির লড়াইকে বলাহয় দেবাসুরের যুদ্ধ। এই দেবাসুরের যুদ্ধে দেবতারা উদ্গীথ অস্ত্র দ্বারা অসুরদের পরাজিত করেছিলেন। তাই আমাদের ভেতরের অসুরকে যদি দমন করতে চাই , তবে আমাদের উদ্গীথ-এর  সাহায্য অপরিহার্য। আমরা সাধারণ মানুষেরা মনে করি, আমাদের নাক হচ্ছে, ঘ্রান-ইন্দ্রিয় মাত্র। কিন্তু দেবসুলভ মানুষেরা মনে করেন, এই নাসিকাতে অবস্থান করেন, আমাদের প্রাণ-পুরুষ বা প্রাণ দেবতা। তাই নাসিকাগ্র আমাদের সাধনার স্থান বটে। এখানেই আমরা আমাদের মনকে স্থাপন করে থাকি, সাধনার সময়। বাক-ইন্দ্রিয়কে আমরা সাধারণ মানুষেরা ব্যবহার করি সত্য-অসত্য ভাষণের  জন্য। আর দেবসুলভ মানুষেরা বাক-ইন্দ্রিয়কে ব্যবহার করেন, উদ্গীথ-এর উপাসনার জন্য। চক্ষুকে আমরা ব্যবহার করি, জাগতিক বস্তু দর্শনের জন্য, আর মহাত্মারা এই চক্ষুকে ব্যবহার করেন, ওঁ-কারের মহিমা দর্শনের জন্য। কর্ন-কে আমরা ব্যবহার করি, ভালো-মন্দ শব্দ শোনার জন্য।  কিন্তু মহাত্মারা এই কানকে ব্যবহার করে, ওঁ-করে মহিমা শোনার জন্য। আমরা মনকে ব্যবহার করি ভালো-মন্দ চিন্তা করবার জন্য। মহাত্মারা মনকে ব্যবহার করেন, উদ্গীথ-এর উপাসনা করবার জন্য। আমরা প্রাণকে কোনো গুরুত্ত্ব দেই না, তাই  প্রাণের আঘাতেই  আমরা মারা যাই, মহাত্মারা প্রানেই উপাসনা করেন। তাই তারা ইচ্ছামৃত্যু বরণ  করতে পারেন।  প্রাণ নিত্যসুদ্ধ, প্রাণ পরিবর্তনীয়। 
উদ্গীথ উচ্চারণ  করবার সময়, আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া বন্ধ রেখে করতে হয়। উদ্গীথ উচ্চারণের সময় আমাদের  প্রাণ ও অপানের মধ্যবর্তী ব্যান বায়ুকে ভিতরে ধরে রাখতে হয়।  আসলে ব্যান-বায়ু আমাদেরকে  শক্তিশালী করে। আমরা যখন কোনো অতিরিক্ত শক্তির কাজ করতে যাই, তখন আমাদের শ্বাস গ্রহণ-বর্জন বন্ধ রাখি, এতে করে আমাদের ভিতরের শক্তি বৃদ্ধি হয়। 
এখন কথা হচ্ছে, এগুলোর  সঙ্গে উদ্গীথ-এর কি সম্পর্ক ? আসলে "উৎ" অক্ষরটি প্রাণের প্রতীক। "গী" অক্ষরটি হলো বাক আর "থ" হচ্ছে অন্ন। "উৎ" অর্থাৎ উত্থিত হওয়া, যা প্রাণের প্রতীক। আসলে প্রাণ-ই পৃথিবীর সব কিছুকে উত্থান করায়। "গী" হচ্ছে বাক-এর প্রতীক, অর্থাৎ প্রকাশের প্রতীক । "থ" হচ্ছে অন্ন বা যিনি আমাদের ধারণ করেন, অর্থাৎ পৃথিবী। 
অর্থাৎ এই উদ্গীথ-এর মধ্যে আছে, প্রাণশক্তি,-বাকশক্তি  অর্থাৎ ধীশক্তি, ও অন্ন বা আমাদের ধারনকর্ত্রী। তাই উদ্গীথ বা এই ওঁ হচ্ছে  বিভিন্ন শক্তিকে জাগ্রত করবার একটা শক্তিশালী ধ্বনি মাত্র।
ওঁ - এর ব্যবহার বা ওঁ -এর উচ্চারণ আমাদেরকে আধ্যাত্মিক, জাগতিক, ও বৌদ্ধিক - এই তিন পৰ্য্যায়ের উন্নতি সাধনের এটি ক্রিয়াশীল পন্থা। এখন আমরা উদ্গীথ এর সাধারণ ধ্বনি ও দ্রুত-ক্রিয়াশীল শুনবো। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  ওম।

 উদ্গীথ বা প্রণব যে কোনো সময়, যে কোনো জায়গায়, যে কোনো অবস্থায় উচ্চারিত হতে পারে।  কিন্তু এই প্রক্রিয়া (শেষের পনেরো মিনিট যেটা করা  হয়েছে) একমাত্র ভোর বেলা করা যেতে পারে। অথবা খাবার  পাঁচ-ছয় ঘন্টা পরে করা যেতে পারে।   তবে প্রথমে মাত্র ৫ বার থেকে শুরু করুন, অথবা জোরে চালিয়ে, শুধু মনোযোগ দিয়ে  শুনুন, তাতেও আপনার মধ্যে একটা আলোড়ন শুরু হবে।   এবং ধীরে ধীরে সেটা ৫ থেকে ১৫ মিনিট পর্যন্ত করতে পারেন। এই প্রক্রিয়া ভীষণ শক্তিশালী ও কার্যকর।  এমনকি অল্প সময়েই এর কার্যকারিতা উপল্বদ্ধিতে আসে। এটি করলে মেরুদণ্ডে শিরশিরানি শুরু হবে। তখন পাশাপাশি ম্যাসেজ  করতে হবে।খেয়াল রাখবেন, উপর-নিচ নয়।  অথবা উদ্গীথ বন্ধ রাখতে হবে। নিজের শরীরে যতটুকু সহ্য হয়, ততটুকুই করুন। ধীরে ধীরে সময় বাড়ান। অবশ্যই শারীরিক ও মানসিক ব্রহ্মচর্য্য পালন করুন। কাছে কেউ একজন যেন থাকে, যিনি আপনার সুবিধে অসুবিধাগুলো নিয়ে সহযোগিতা করতে পারবেন। আমার কথায় এসব করতে যাবে না। কেননা আমি সাহায্য করবার মত অবস্থায় নেই।     
"ওম্" ও ছান্দোগ্য উপনিষদ
ওঁ আপ্যায়ন্তু মম অঙ্গানি বাক্ প্রাণ চক্ষু শ্রোত্রম অথঃ
বলম ইন্দ্রিয়ানি  চ সর্বানি।  সর্বং ব্রহ্ম উপনিষদম।  মা অহং 
ব্রহ্ম  নিরাকুর্যাং, মা মা ব্রহ্ম  নিরাকরোৎ ; 
অনিরাকরম অস্তু, অনিরাকরনং মে অস্তু।  তদ্ আত্মনি নিরতে 
য উপনিষদসু ধর্মাস্তে  ময়ি সন্তু, তে ময়ি সন্তু। ।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।

ওঁ - হে ব্রহ্ম
 আপ্যায়ন্তু - পুষ্টি লাভ করুক 
 মম অঙ্গানি -  আমার অঙ্গ সমূহ
 বাক্ প্রাণ চক্ষু শ্রোত্রম অথঃ বলম - বাকশক্তি, প্রাণবায়ু, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি এবং বলশক্তি
 ইন্দ্রিয়ানি  চ সর্বানি। - এবং সব ইন্দ্রিয়
 সর্বং ব্রহ্ম উপনিষদম। উপনিষদ বলছে সবই ব্রহ্ম,   
 মা অহং ব্রহ্ম  নিরাকুর্যাং, - আমি যেন না উদাসীন হই ব্রহ্ম কথা শুনতে 
মা মা ব্রহ্ম  নিরাকরোৎ ; -  ব্রহ্ম যেন আমাকে কখনো সরিয়ে না নেন। 
অনিরাকরম অস্তু, - আমি যেন তার কাছ থেকে সরে না আসি। 
অনিরাকরনং মে অস্তু। - তিনিও যেন তার কাছ থেকে আমাকে  সরিয়ে না দেন।  
তদ্ আত্মনি নিরতে য উপনিষদসু ধর্মাস্তে  ময়ি সন্তু, : উপনিষদে যে সব ধর্ম আছে তার অর্থাৎ  আত্মজ্ঞান লাভের সাধনায় রত আমি
তে ময়ি সন্তু। । - সেগুলো যেন আমার আয়ত্ত্বে আসে। 
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।  - আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক শান্তি হোক। 

অর্থাৎ - আমার সমস্ত অঙ্গ যেন পুষ্ট হয়। আমার প্রাণবায়ু, বাকশক্তি, দৃষ্টি শক্তি,শ্রবণশক্তি ও অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলো যেন শক্তিশালী হয়। সব উপনিষদ ব্রহ্ম  কথা বলে। আমি যেন কখনো ব্রহ্ম কথা শুনতে উদাসীন না হই। ব্রহ্মও যেন কখনো আমাকে সরিয়ে না দেন। আমি তার কাছ থেকে সরে  আসবো না।
তিনিও যেন আমাকে সরিয়ে না দেন। আমি যেন সরে  না আসি। উপনিষদের যে সব ধর্মকথা  আছে, সেই শিক্ষা লাভে আমি রত আছি। আমার যেন সেগুলো আয়ত্ত্বে আসে।
-আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক শান্তি হোক

ছান্দোগ্য : ছান্দোগ্য উপনিষদ  আসলে সাম-বেদের অংশ। সামবেদ আবার বিভিন্ন বেদের ছন্দোবদ্ধ গান। এই বইয়ের প্রথমে সাকার উপাসনা সম্পর্কে বলা হয়েছে। যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় তার সম্পর্কে ধারণা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বাক্য-মনের অতীত যে ব্রহ্ম তাকে আমাদের পক্ষে ধারণা করা সম্ভব নয় । ঈশ্বর নিরাকার, এগুলো আমাদের শোনা কথা। উপল্বদ্ধির বিষয় নয়। এছাড়া, নানারকম বাসনা আমাদেরকে তারা করে নিয়ে বেড়ায়। এই সমস্ত বাসনা পূরণ হলে আমরা খুশি হই। এইসব যারা অস্বীকার করেন, তারা আত্মপ্রবঞ্চনা করছেন। আমরা সকাম উপাসনার মাধ্যমে আমাদের অপূর্ন বাসনা পূরণের সুযোগ পাই। সেই জন্য উপনিষদ বলছে, শাস্ত্রবিহিত, সকাম উপাসনা করলে আমরা আমাদের মন,  শরীর ভালো রাখতে পারি।  ধন দৌলত লাভ করতে পারি, মান সন্মান প্রতিপত্তি ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারি।  এমনকি আমরা স্বর্গলাভও  করতে পারি।  কিন্তু এগুলো সব অনিত্য। কেউ যদি শাশ্বত শান্তি বা আনন্দ পেতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই মুক্তি লাভ করতে হবে। মুক্তি পেতে গেলে আত্মজ্ঞান লাভ করতে হবে। এই আত্মজ্ঞানই ব্রহ্মজ্ঞান।  স্থায়ী শান্তি বা আনন্দ পেতে গেলে আমাদের আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে হবে।

আত্মজ্ঞান লাভের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে উদ্গীথ অর্থাৎ ওম-কে আবৃত্তি করতে বলা হয়েছে। মনকে বসে আনার এটি একটি উপায়। ছান্দোগ্য উপনিষদের প্রথম পাঁচটি অধ্যায়ে এই উদ্গীথ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। আমরা সেই কথা শুনবো।

১. ওম ইতি এতৎ অক্ষরম উদ্গীথম উপাসীত ওম ইতি হি উদ্গায়তি তস্য উপ ব্যাখ্যানম। ।
    
ওম ইতি - এই ওম  
এতৎ অক্ষরম  - এই অক্ষরকে  
উদ্গীথম উপাসীত -উদ্গীথ রূপে উপাসনা করবে। 
ওম ইতি - এই ওম
হি উদ্গায়তি -কিভাবে গাইবে
তস্য উপ ব্যাখ্যানম। । - তার ব্যাখ্যা করা হচ্ছে

উদ্গীথ কথাটার আভিধানিক  অর্থ  সামবেদের ধ্বনি, সামগান বা প্রণব।  কেউ কেউ বলেন, যা থেকে সমস্ত উদ্গত হয়েছে, সেই কারণের কারণ হচ্ছেন  উদ্গীথ। সেই পরম ব্রহ্ম। যার তরঙ্গধ্বনিকে অক্ষরে প্রকাশ করা হয়েছে "ওম" এই শব্দ। তাই ওম-ই ব্রহ্ম। যখন কেউ ওম এই শব্দটি উচ্চারণ করেন, তখন তিনি আসলে ব্রহ্মের উপাসনা করছেন বুঝতে হবে। এই আবৃত্তিই উদ্গীথ। এই আবৃত্তি সাধারণতঃ উচ্চস্বরে করা হয়ে থাকে। ওম-এর উপাসনা দ্বারাই ধীরে ধীরে, আমাদের মনের মলিনতা দূর হয়।  আমাদের চিত্তশুদ্ধি হয়। আর একটা কথা উদ্গীত মানে উচ্চকন্ঠে গীত। তাই উদ্গীথ সবসময়েই উদাত্তস্বরে গীত হয়।

২. এষাং  ভূতানাং পৃথিবী রসঃ।  অপাম ঔষধয়ঃ রস, ঔষধীনাং পুরুষ রসঃ, পুরুষস্য বাগ্ রসো, বাচ ঋগ  রস, ঋ চ স্যাম রসঃ, সাম্ন উদ্গীথো রসঃ।  

এষাং  ভূতানাং পৃথিবী রসঃ। - এই  ভূত সকলের রস অর্থাৎ সার বা আশ্রয়স্থল হচ্ছে প্রথিবী।
অপাম ঔষধয়ঃ রস, - অপাম, অপ অর্থাৎ জলের সার উদ্ভিদ। 
ঔষধীনাং পুরুষ রসঃ, - ঔষধীনাং অর্থাৎ উদ্ভিতের সার হচ্ছে পুরুষ বা  মানুষ।
পুরুষস্য বাগ্ রসো, - পুরুষস্য অর্থাৎ পুরুষের বা মানুষের বাক বা বাকশক্তি।
বাচ ঋগ  রস, - - অর্থাৎ বাকের সার  ঋক্বেদ।
ঋ চ স্যাম রসঃ, - আবার ঋক্বেদের সার হচ্ছে সামবেদ।
সাম্ন উদ্গীথো রসঃ। সামবেদের সার হচ্ছে উদ্গীথ।

তাহলে আমরা বুঝলাম, পৃথিবী হলো চরাচর  সমস্ত ভূতের সার। আর জল হচ্ছে পৃথিবীর সার। উদ্ভিদ  হচ্ছে জলের সার। মানুষ উদ্ভিদের সার। মানুষের সার হচ্ছে বাক। বাকের সার হচ্ছে ঋক্বেদ। আবার ঋক্বেদের সার হচ্ছে সামবেদ।  সামবেদের  সার হচ্ছে উদ্গীথ বা প্রণব মন্ত্র অর্থাৎ "ওম"।

পৃথিবীতে আমরা দুই ধরনের পদার্থ দেখতে পাই। চেতন ও অচেতন। এদের আশ্রয় কি ? বা কাদের আশ্রয়ে এরা আছে ? এরা সবাই পৃথিবীকে আশ্রয় করে আছে।  পৃথিবী কার আশ্রয়ে আছে ? পৃথিবী জলের আশ্রয়ে আছে। জলের উপরেই পৃথিবী ভাসছে। এই জল থেকেই উদ্ভিদের জন্ম। তাহলে জল হচ্ছে উদ্ভিদের আশ্রয়। আবার মানুষ হচ্ছে উদ্ভিদের সার। কারন মানুষ উদ্ভিদজাত খাবার খেয়ে বেঁচে থাকে। আবার মানব দেহের শ্রেষ্ট অংশ হচ্ছে বাগ-ইন্দ্রিয়। তাই বাগ হচ্ছে মানবদেহের সার। এবার বাকের মধ্যে শ্রেষ্ট হচ্ছে ঋকবেদ। আর ঋক্বেদের সার হচ্ছে সামবেদ। সাম-বেদের  সার হচ্ছে ওঙ্কার।


৩. স এষ রসানাং রসতমঃ পরমঃ পরার্ধ্যো অষ্টমো যৎ উদ্গীথঃ  

স এষ রসানাং রসতমঃ  - সেই এই রসের মধ্যে শ্রেষ্ট রস অর্থাৎ সার। 
পরমঃ পরার্ধ্যো অষ্টমো - সর্বশ্রেষ্ঠ পরম স্থান অষ্টম।  অষ্টম (অর্থাৎ ১. পৃথিবী, ২. জল, ৩. উদ্ভিদ, ৪.মানুষ, ৫.বাক্, ৬. ঋক্বেদ, ৭. সামবেদ, ৮. উদ্গীথ ) .
যৎ উদ্গীথঃ -যে উদ্গীথ বা ওম।

সমস্ত অষ্ট রসের মধ্যে উদ্গীথ বা ওম হলো পরম রস। অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ রস। এই শ্রেষ্ঠ রস ব্রহ্মের এক ও অভিন্ন।

৪. কতমা কতমর্ক্  কতমৎ সাম  কতমঃ কতম উদ্গীথ ইতি বিমুষ্টং ভবতি

কতমা কতমর্ক্ - কোনটা  কোনটা ঋক  ?
কতমৎ সাম  কতমঃ - কোনটা কোনটা সাম ?
কতম উদ্গীথ ইতি বিমুষ্টং ভবতি। - কোনটা উদ্গীথ ? এই হলো প্রশ্ন।

কোনটা ঋক ? কোনটাই বা সাম, আর উদ্গীথই বা কি ?

আমরা জানি, ঋক কথাটার মানে হচ্ছে স্তূতি।  ভগবানের স্তূতি।  ঋকবেদের সমস্ত শ্লোককেই বলা হয় ঋক। এই ঋক বেদ থেকে কিছু স্তোত্র যেগুলো সুর করে গাওয়া হয়,  সেগুলো আলাদা করে সাম বেদের  মধ্যে ঢোকানো হয়েছে। এই সামবেদে  যত  গান আছে, তার মূল সুর হচ্ছে উদ্গীথ। উদ্গীথ হচ্ছে -  উচ্চস্বরে যা গাওয়া হয়।

৫. বাগেব ঋক্ প্রাণঃ সাম-ওম-ইতি-এতৎ-অক্ষরম-উদ্গীথঃ। 
তদ্বা এতৎ-মিথুনং যদ্-বাক চ প্রানশ্চ ঋক চ সাম চ। ।   

বাগেব ঋক্ - বাক এব ঋক অর্থাৎ বাক্যই ঋক  
প্রাণঃ সাম- প্রাণই  সাম অর্থাৎ প্রাণ শক্তি হলো সাম। কারন প্রাণশক্তির সাহায্যে (অর্থাৎ বাতাসের সাহায্যে ) সামগান করা হয়।  
ওম-ইতি-এতৎ-অক্ষরম-উদ্গীথঃ। - ওম এই শব্দটি উদ্গীথ।
তদ্বা - তৎ বৈ অর্থাৎ তা-ই   
এতৎ-মিথুনং - এই যুগল বস্তূ - মিঠুন কথাটার মানে হচ্ছে মিলনজনিত সংঘর্ষ।  এই বাতাস বা প্রাণের সাথে বাকের সংঘর্ষে ওম এর উৎপত্তি।
যদ্-বাক চ প্রানশ্চ  - যা বাক ও প্রাণের মিলন
ঋক চ সাম চ। । -  যা ঋক ও সামের মিলন।

আগের শ্লোকে প্রশ্ন ছিল ঋক কি, সাম  কি, এবং উদ্গীথ কি ? এর উত্তরে এখন বলছেন - বাক্যই হলো ঋক, প্রাণ হলো সাম, এবং উদ্গীথ হলো ওম। বাক ও প্রাণের মিলনে আবার ঋক ও সামের মিলনে এই ওম এবং ইনি ব্রহ্ম। অর্থাৎ স্থূল জগতের ক্রমবিকাশের সর্বোচ্চ হল ওম। সবকিছুর শেষ কথা হল ওম। সবকিছুর অন্তরাত্মা হল ওম। "ওম"-ই হলো পরম-আত্মা।

. তৎ এতৎ মিথুনম ওম ইতি এতস্মিন অক্ষরে সংসৃজ্যতে যদা বৈ মিথুনৌ 
সমাগচ্ছত আপয়তো বৈ তাবন্যোন্যস্য কামম্ ।।  

 তৎ এতৎ মিথুনম - সেই এই মিলন  অর্থাৎ বাক ও প্রাণের মিলন
ওম ইতি এতস্মিন অক্ষরে সংসৃজ্যতে - ওম্ এই অক্ষরের সৃষ্টি করে
 যদা বৈ - অর্থাৎ যখনই
 মিথুনৌ সমাগচ্ছত - পরস্পর মিলিত হয়
 আপয়তো বৈ তাবন্যোন্যস্য (তৌ+অন্যোন্যস্য) কামম্  -   তারা একে অন্যের কামনা পূর্ন করে।

অর্থাৎ বাক ও প্রাণের মিলনেই ওম্ এই শব্দ ব্রহ্মের সৃষ্টি হয়।  এবং পরস্পরের অর্থাৎ বাক ও  প্রাণ তাঁদের পরস্পরের কামনা পূর্ন করে। বাক ও প্রাণ মিলিত হয়ে পরস্পরের ওম সৃষ্টির যে আকাঙ্খা তা পূরণ করে।

.আপয়িতা হ বৈ কামানাং ভবতি য এতদেবং বিদ্বান অক্ষরম উদ্গীথম উপান্তে। 

আপয়িতা : অর্থাৎ প্রাপক অর্থাৎ জিনিলাভ করেন।
 হ বৈ কামানাং : যা কামনা করেন।
 ভবতি য : হন যিনি।
এতদেবং : এতৎ এবম - এঁকে এইভাবে
 বিদ্বান : জেনে
 অক্ষরম : ওম এই অক্ষরকে
 উদ্গীথম : উদ্গীথ রূপে অর্থাৎ ব্রহ্ম রূপে।  
উপান্তে : উপাসনা করেন।

ওম-ই সব কিছুর আশ্রয়। এইভাবে যিনি ওমকে ব্রহ্ম বা উদ্গীথরূপে উপাসনা করেন, তিনি যা পেতে চান, তিনি তাই পান। অর্থাৎ ওমকে আপনি যেভাবে উপাসনা করবেন, অর্থাৎ ওম-এর মধ্যে সব কিছু আছে, তাই আপনি ওমকে  যা ভেবে উপাসনা করবেন, আপনি তাই পাবেন।  আমি সব কিছুর আশ্রয়স্থল। আপনার ভাবনা ওমের উপাসনার মাধ্যমে প্রকাশিত হবে। আপনি তাই হয়ে যাবেন। আপনি যদি ওমকে ব্রাম্হ ভেবে উপাসনা করেন, তবে আপনি স্বয়ং ব্রহ্ম সেই জ্ঞান আপনার হবে।
 

No comments:

Post a Comment