Friday 18 September 2020

নিদ্রা-রহস্যঃ


                                                               নিদ্রা-রহস্যঃ ধ্যান ও ঘুম 

আধ্যাত্মিক জীবনে, বিশেষ করে যারা ধ্যানের  অনুশীলন করতে চান, তাদের সব সময় ঘুম সম্পর্কে সতর্ক  থাকতে হয়। ধ্যানে বসলেই আমাদের ঘুম পায়।  ধ্যানের  প্রধান শত্রূ  হচ্ছে ঘুম। তাই ঘুম সম্পর্কে আমাদের সবার একটা সাধারণ জ্ঞান থাকা আবশ্যক। 

 আমরা শুনেছি, সুনিদ্রা সুস্বাস্থের লক্ষণ। শুধু শরীরের নয় মানসিক স্বাস্থ্য এতে করে ভালো থাকে। কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও আমাদের জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় আমরা ঘুমিয়েই  কাটাই। ঘুম যদি আমাদের ঠিক-ঠিক মতো না হয়, তবে আমরা  নানান রোগের শিকার হই - যেমন মাথাধরা, রক্তচাপ, খিটখিটে মেজাজ, এমনকি আমাদের স্মৃতিশক্তি হ্রাস হতে পারে, যদি ঘুম আমাদের ঠিক ঠিক মতো না হয়। বিজ্ঞানীগন বলে থাকেন, সারাদিনের ক্লান্তি দূর করবার জন্য আমরা ঘুমাই। কিন্তু ঘুম কি শুধু শরীরের ক্লান্তি দূর করবার জন্য, নাকি আমাদের মানসিক অবসাদ দূর করবার জন্য আমরা ঘুমাই ? নাকি অন্য কোনো কারন আছে  ? কেন ঘুমাই আমরা ? 

বেশিরভাগ মানুষ বলে থাকেন, আমরা যতক্ষন জেগে থাকি, ততক্ষন আমাদের শরীরে অবক্ষয় চলতে থাকে। শারীরিক পরিশ্রম  আমদের দেহকোষকলায়, ক্ষয় ঘটায়। নিদ্রা আমাদের কাছে, সম্পূর্ণ বিশ্রাম। আর এই বিশ্রামের মধ্যে দিয়ে আমরা আমাদের ক্ষয় ক্ষতি পুষিয়ে নেই। এখন কথা হচ্ছে, শরীরের কোন অংশ বা আমাদের কোন শারীরবৃত্তীয় আমাদেরকে ঘুম পাড়ায় ?

একসময় বলা হতো, শরীরের অভ্যন্তরে, আমাদের বিপাকীয় কাজকর্ম্মের ফলে একধরনের রস  বা সামগ্রী উৎপাদিত হয়, এই রসই আমাদের ঘুমের কারন। কেউ কেউ মনে করতেন, খাবার পরে আমাদের পাকস্থলীতে জমে এক ধরনের উষ্ম বাষ্প। সেই উষ্ম বায়ু  যখন উর্দ্ধমুখী হয়, তখন আমাদের ঘুম পায়। এইজন্য খাবার পরে, আমাদের  ঝিমুনি আসে। এই উষ্ম বায়ু  আবার আমাদের খাদ্য সামগ্রী হজম করায়।

 কেউ কেউ আবার মনে করতেন, মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরনের ফলে আমাদের নিদ্রার আগমন ঘটে।এই  ধারণা  থেকে, মাথায় বালিশ দিয়ে ঘুমুনোর প্রচলন শুরু হয়েছিল মাথায় মোটা বালিশ দিয়ে ঘুমোলে, মাথা থেকে অতিরিক্ত রক্ত নেবে যাবে ।

 কেউ কেউ আবার উল্টোটা ভাবতেন, তার বলতেন, মস্তিষ্কে রক্তের অভাবেই  আমাদের নিদ্রা এসে থাকে। শরীর তার মস্তিষ্কের রক্ত টেনে নিয়ে অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে, তাই আমাদের ঘুম পায়।  অর্থাৎ বালিশ  মাথায় দিয়ে শুলে, রক্ত চলাচল ব্যাহত হবে, তাই শোবার  সময় বালিশের ব্যবহার না করে ভালো।

 নানা মুনির নানা মত. কেউ বলে থাকেন, আমরা দৈনন্দিন কাজকর্ম্ম থেকেআমাদের শরীর  উদ্দীপিত হয়। আর এই উদ্দীপনা আমাদের জেগে থাকতে বাধ্য করে। এই উদ্দীপনা যখন শেষ হয়, অর্থাৎ আমাদের কাজকর্ম্ম যখন শেষ হয়, তখন আমরা ঘুমের কোলে ঢোলে  পড়ি। 

যতক্ষন সূর্য্যের আলো, ততক্ষন আমাদের কাজ। যতক্ষন কাজ ততক্ষন আমাদের কোনো ঘুম নেই। কাজ ফুরোলো, তো আমরা ঘুমের কোলে আশ্রয় নেই - বিশ্রাম নেই। এই তত্ত্ব সমস্ত জীবের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমরা ছুটির দিনে, বর্ষার দিনে, অলস দিনে বেশি ঘুমোই। কিন্তু কথা হচ্ছে, তাহলে আমাদের কাজ করতে করতে আমাদের কেন ঘুম পায় ? কারু ক্ষেত্রে দেখা যায়, সারা দিনের পরিশ্রমের পরেও  চোখের পাতা এক করতে পারছেন না। এর কারন কি ? 

আজকাল বলা হচ্ছে, এইসব উদ্দীপনা টুদ্দীপনা কিছু নয়, ঘুম আমাদের শারীরবৃত্তের একটা ঘটনা। খাদ্যের বিপাকীয় কাজকর্ম্মের   জন্য, আমাদের শরীরে জমে অপ-দ্রব্য অর্থাৎ জলীয় পদার্থ যা আসলে বিষ    । এদের মধ্যে আছে, ল্যাট্রিক এসিড, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কোলেস্টোরল ইত্যাদি।  এটি আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এই ক্ষতিকর অপ-পদার্থ যাতে আমাদের শরীরে জমে না থাকে, তার জন্য সাহায্য করে ঘুম। যাদের ঘুম না হয়, তাদের এই ক্ষতিকর পদার্থগুলো ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, ঘুম পড়ানোর জন্য। এটাকেই বলে ঘুমের ঔষধ। যার জন্য বলা হয়ে থাকে ঘুমের ঔষধ বেশি খাওয়া উচিত নয়। 

ঘুম দুই প্রকার।  REM SLEEP এবং NON -REM SLEEP .রেম  স্লীপ -  ঘুমুচ্ছে কিন্তু চোখের পাতা নড়ছে। আসলে এই সময় ঘুমন্ত ব্যক্তি স্বপ্ন দেখছে। আর নন-রেম-স্লীপ হচ্ছে গভীর ঘুম। আসলে ঘুম কেন হয়, কিভাবে হয়, তা এখনো সঠিক ভাবে বোঝা সম্ভব নি । 

আর একটা কথা হচ্ছে, ঘুম মানুষের রোগযন্ত্রণার উপশম ঘটায়। রোগযন্ত্রনায় মানুষ যখন ছটফট করে,  তখন তাৎক্ষণিক  উপায় হিসেবে, ঘুমের ঔষধ বা ইনজেকশন দেওয়া হয়। বাচ্চা যখন কান্নাকাটি করে তখন  তাকে আমরা ঘুম পড়ানোর চেষ্টা করি। তাহলে কি ঘুম আমাদের সমস্ত জাগতিক যন্ত্রণার উপশম ঘটাতে পারে ? আবার দিনের বেলা ঘুমুলে, আমাদের শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে। আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি, জ্বর থেকে যখন সবে সেরে উঠেছি, তখন ডাক্তার বাবু আমাদের দিনের বেলায় ঘুমুতে নিষেধ করতেন।  দিনে ঘুমুলেই আমাদের আবার জ্বর আসতো। ঈশ্বরের লীলা যেমন বোঝা  দায় ,ঘুমের গতি-প্রকৃতি আমরা এখনো   উঠতে পারি নি।  অথচ ঘুম আমাদের নিত্য ও অপরিহার্য  সঙ্গী।  ঘুমের বিচিত্র গতি।  কে যে এর নিয়ন্ত্রক তা এখনো  সঠিক ভাবে নির্দিষ্ট করা সম্ভব হয় নি। তবে, মানুষ নিশ্চয়ই একদিন এই গভীর-তত্ত্ব আবিষ্কার করবে।  

এখান থেকেই, আমাদের আধ্যাত্মিক যাত্রা শুরু। গভীর ঘুমে আমরা বাহ্য চেতনাহীন হয়ে পড়ি। জগতের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক থাকে না। কিন্তু তন্দ্রা বা স্বপ্নাবস্থায় আমরা বাহ্যিক জগতের মতোই আর একটা জগতে ঘোরাফেরা করে থাকি। ঘুম যখন আমাদের গভীর হয়, অর্থাৎ গাঢ়  ঘুমে আমাদের এই স্বপ্ন-জগতের বিলুপ্তি পায়। এই অবস্থাকে সাধক বলে থাকেন, সুসুপ্তির অবস্থা। এই অবস্থায় আমাদের মনের কাজ সাময়িক ভাবে লোপ পায়। অর্থাৎ মন তখন নিষ্ক্রিয় হয়ে  যায়। কিন্তু শরীরের স্বাভাবিক যে কাজ কর্ম্ম অর্থাৎ শ্বাস-প্রশাস, রক্তচলাচল ইত্যাদি ঠিক ঠিক চলতে থাকে। এবং আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোও সজীব-সতর্ক থাকে। হঠাৎ কেউ ডাক দিলে বা পিঁপড়ে কামড়ালে, বা মশায় কামড়ালে আমরা উঠতে পারি। সুসুপ্তির অবস্থা থেকে আমরা যখন জেগে উঠি, তখন ক্ষনিকের জন্য, আমরা বিমূঢ় অবস্থায় থাকি, হঠাৎ বুঝতে পারি না, এটা কি সকাল না বিকেল। কেউ যেন  ডাকলো,কিন্তু কে ডাকলো, তা আমরা ধরতে পারি না। 

এই অবস্থার পরেই আর একটা অবস্থা আছে, যাকে  বলে তুরীয় অবস্থা। ধ্যান আসলে বিভিন্ন ঘুম-প্রায় অবস্থার মধ্যে দিয়ে বিচরণ করা। ঘুমের জগতে বিচরণ করা। আমরা যখন সঙ্গাহীন থাকি, তখন আমাদের মধ্যে স্বাভাবিক যে চেতনা, তা সে শারীরিক হোক বা মানসিক হোক, তা লোপ পায়। কিন্তু জীবনের ক্রিয়া বজায় থাকে। অর্থাৎ আমাদের ফুসফুসের ক্রিয়া চলছে। কিন্তু সাধক যখন তুরীয় অবস্থায় যায়, তার এই শারীরিক ক্রিয়া সাময়িক ভাবে অবরুদ্ধ থাকে। 

এক মহাত্মা আমাকে  বলেছিলেন, এ এক নিশ্চল অবস্থা, খাচ্ছি  কিন্তু খাচ্ছি না, দেখছি কিন্তু দেখছি না। অর্থাৎ সমস্ত ইন্দ্রিয়, অর্থাৎ চক্ষু কর্ন নাসিকা জিহ্বা ত্বক সবাই থেকেও নেই। মন-বুদ্ধি বিলোপ হয়ে গেছে। অন্যকোনো বিশ্ব-শক্তির নিয়ন্ত্রণে আমরা যেন আলোর সমুদ্রে ভাসছি। 

তো আমরা যেটা বলছিলাম, ঘুম আমাদের ধ্যানের প্রধান শত্রূ। আসলে ধ্যান ও ঘুম দুটো সমান্তরাল রাস্তা। আমরা ঘুমের পথে না হেটে ধ্যানের  পথে হাটবো। কিন্তু অচেতন ভাবেই আমারা  এই যাত্রাকালে  মাঝে মধ্যে ধ্যানের  পথ ছেড়ে ঘুমের পথে চলে  যাই। আরো গভীর ভাবে যখন আমরা বিষয়ের মধ্যে প্রবেশ করবো, তখন আমরা বুঝতে পারবো , ঘুম প্রত্যেক মানুষকে ঈশ্বরের সাথে বা বিশ্বশক্তির সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করিয়ে দেয়, আমাদের বেঁচে থাকবার শক্তি যোগায় । আমরা তা ধরতে পারি না। উদ্দেশ্যহীন ভাবে, অজ্ঞাতসারে  আমরা তাঁর সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছি।অন্যদিকে ধ্যান  আমাদের ঈশ্বরের সাথে বা বিশ্বশক্তির সাথে  যোগাযোগ করাচ্ছে, যেটা আমরা ধরতে পারি।  ঘুমের মধ্যে  আমরা ঈশ্বরের সাথে সচেতন ভাবে যোগাযোগ রাখছি। তাই ঘুম আমাদের শত্রূ  নয়। চেতন মানুষের জন্য ধ্যান আর অচেতন মানুষের জন্য ঘুম।  দুটোর উদ্দেশ্য এক। ঈশ্বর থেকে শক্তি আহরণ। আমাদের যখন স্বাভাবিক মৃত্যু আসন্ন হবে, তখন আমরা দেখতে পারবো, আমাদের ঘুম স্বাভাবিকের থেকে বেড়ে গেছে।  একটা স্বপ্নের জগতে, একটা সঙ্গাহীন অবস্থায় আমরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করছি, তখন জগতের সমস্ত কিছু, কেমন আবছা হয়ে আসছে, সূক্ষ্ম জগতে যারা বাস করছেন, অর্থাৎ আগেই যারা জড় শরীর  ছেড়েছেন, তাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ হচ্ছে। ঘুমের পথেই আমরা শরীর ছাড়ি আবার ঘুমের মধ্যেই আমরা শরীর ধারণ করি। আমরা জন্মের সময় তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকি, আবার মৃত্যুর ঠিক  পূর্ব মুহূর্তে  আমরা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে  যাই। ঘুম বা তন্দ্রাবস্থা আমাদের স্থুল থেকে সূক্ষ্মে, এক সূক্ষ্ম শরীর  থেকে আরেক সূক্ষ্ম শরীরে প্রবেশ করি।   তো ঘুম আমাদের শত্রূ নয়। ঘুমই আমাদের অনন্ত যাত্রার সঙ্গী।  

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।  

 


No comments:

Post a Comment