Friday 10 July 2020

ব্রহ্মের খোঁজে ভৃগু - তৈত্তিরীয় উপনিষদ / ঈশ bramha

                                                                    
 তৈত্তিরীয় উপনিষদ /ঈশ উপনিষদ  

তৈত্তিরীয় উপনিষদ-১ - ব্রহ্মের খোঁজে ভৃগু

প্রশ্নটা হচ্ছে আমি কে ? কোথা থেকে এসেছি ? কোথায়ই বা চলে যাবো ? আর কিভাবেই বা সেটা আমরা জানতে পারবো ? তৈত্তিরীয় উপনিষদে এইসব প্রশ্নের ব্যাখ্যা আছে, যা একটা গল্পের আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। 

ঋষি বরুনের পুত্র ঋষি ভৃগু। ঋষি ভৃগু শাস্ত্রগ্রন্থ অনেক পাঠ  করেছেন, কিন্তু ব্রহ্ম কি তা তিনি জানতে পারেন নি।উপনিষদে আত্মাকে বলা হয় ব্রহ্ম।   তো তাঁর মনে একটা ক্ষোভ জন্মালো।  তাঁর পিতা ঋষি বরুন।  যিনি ব্রহ্মজ্ঞানী বলে খ্যাতি আছে । তো যার পিতা ব্রহ্মজ্ঞানী সে ব্রহ্ম সন্মন্ধে কিছু জানে না, তা কি করে হতে পারে ? তো ভৃগু পিতার কাছে গিয়ে প্রণাম করে, শ্রদ্ধা সহকারে বললেন, "ব্রহ্ম কি তা আমি জানি না। আমাকে ব্রহ্ম বিদ্যা দান  করুন।" তো পিতা ঋষি বরুন, ভাবলেন, ব্রহ্ম কি তাতো মুখে বলে কাউকে বোঝানো যায় না। ব্রহ্মকে জানতে গেলে, ব্রহ্মকে পেতে গেলে মন-প্রাণ-শরীর দিয়ে তপস্যা করতে হয়। তপস্যার দ্বারা আমাদের শরীর মন নির্মল তেজ লাভ করে, আর ব্রহ্মজ্ঞান তখন আপনিই ভিতর থেকে জন্মাতে থাকে। একমাত্র তপস্যাই ব্রহ্মলাভের উপায়। তো ঋষি বরুন বললেন, হে পুত্র তুমিই ব্রহ্ম।  তোমার এই শরীর, মন, প্রাণ, এরাই ব্রহ্ম। তুমি ব্রহ্ম থেকেই এসেছো, আবার ব্রহ্মেই ফিরে যাবে। হে পুত্র তুমি যদি ব্রহ্মকে জানতে চাও তবে, তবে যা থেকে এই জীবজগৎ জন্মাচ্ছে, জন্মানোর পরে যাতে বেঁচেবর্তে থাকছে, এবং পরিণামে যাতে লয় হচ্ছে, তিনিই ব্রহ্ম। তার খোঁজ কারো। আর এই খোঁজের উপায় হচ্ছে তপস্যা।   তপস্যা দ্বারা এই ব্রহ্মকে জানো। 

তো ঋষি ভৃগু ভাবতে লাগলেন, আমরা এই শরীর -মন-প্রাণ সব ব্রহ্ম, আমি আবার ব্রহ্মে ফিরে যাবো ? ভৃগু তপস্যায় রত হলেন, মন-প্রাণ দিয়ে ধ্যান করতে লাগলেন। তপস্যা কথাটার অর্থ হচ্চে কঠোর সংযম ও নিয়মের অবলম্বনে যোগসাধন। মন ও ইন্দ্রিয়ের একাগ্রতাই তপস্যা। এই একাগ্রতার দ্বারাই সাধক, মন, ইন্দ্রিয় এবং সমগ্র সত্ত্বাকে একটা নির্দিষ্ট লক্ষের  দিকে চালিত করেন। এই যোগ সাধন  করতে করতে তার মনে হলো, অন্নই ব্রহ্ম। কেননা অন্ন থেকেই  সমুদয় জীবজগৎ জন্মাচ্ছে,  অন্ন খেয়েই বেঁচে থাকছে, আবার অন্নতেই সবাই লয় পাচ্ছে। অন্ন থেকে যেমন দেহের উৎপত্তি, তেমনি এই জগৎও অন্ন থেকেই এসেছে।  অন্নই এই জগৎকে ধারণ করে আছে, আবার অন্নেই এই জগতের লয় হয়। মৃত্যুর পর এই জীবদেহ অন্য প্রাণীর খাদ্যতে পরিণত হয়, সবশেষে  মাটিতে মিশে যায়, আবার সেখান থেকে উদ্ভিদ তার খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। আমি তো এসেছি পিত-মাতা থেকে যারা অন্ন দ্বারা পরিপুষ্ট হয়ে ছিলেন। অন্নের নির্যাস হচ্ছে শুক্র।  তো শূকর থেকে আমার এই শরীরের জন্ম হয়েছে। অতএব নিশ্চই অন্নই   ব্রহ্ম। 

ভৃগু পিতা বরুনের কাছে এলেন, বললেন, হে পিতা আমি বুঝেছি অন্নই ব্রহ্ম, কিন্তু অন্নের তো উৎপত্তি আছে, আবার লয় আছে।  তো যার জন্ম মৃত্যু আছে, তাতো বিনাশশীল। আমি তো শুনেছি, ব্রহ্ম অবিনাশী।  অতয়েব বিনাশশীল দ্রব্য কিভাবে ব্রহ্ম  হবে ? আপনি আমাকে অধিক জ্ঞান দান করুন। 

বরুন এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না।  বললেন যাও  তপস্যা করো। আসলে গুরুদেব শিষ্যকে একটা ধারণা দেন মাত্র, উপায় বলে দেন, কিন্তু সত্যকে নিজের অন্তরে খুঁজতে হবে। চিত্তের একাগ্রতায় এই জ্ঞান আপনা আপনি ফুটে উঠবে। এবং তার জন্য আমাদের নিরন্তর অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে হবে।  আর অনুসন্ধানের মাধ্যমে যা আমরা পাবো, তার আবার  সঠিক বিশ্লেষণ করতে হবে। তো ভৃগু বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখলেন, অন্ন থেকে জগৎ আসে বটে, কিন্তু  অন্নের জন্ম মৃত্যু আছে, অন্ন বিনাশশীল। তাই অবিনাশী ব্রহ্ম কখনো অন্ন হতে পারে না। 

ভৃগু আবার তপস্যা মগ্ন হলেন। আর তাঁর মনে হলো, এই অন্ন প্রাণের সংযোগে জন্মায়, প্রাণের  দ্বারা বেঁচে থাকে আবার প্রাণের বিয়োগে নাশপ্রাপ্ত হয়। সবকিছুর মধ্যে আছে প্রাণ।  অতএব প্রাণই ব্রহ্ম। প্রাণোব্রহ্ম।  কিন্তু প্রাণের সীমাবদ্ধতা আছে। তাই  ভৃগুর মনের সংশয় গেলো না।  তিনি আবার পিতার সমীপে উপস্থিত হলেন, পিতা বললেন, তপস্যা করো। 

ভৃগু আবার তপস্যা রত হলেন, এবং দেখলেন, জড়ের অন্তরালে প্রাণশক্তি, আবার প্রাণের অন্তরালে আছে বোধাত্মক শক্তি যা মনঃশক্তির খেলা। তখন ভৃগুর মনে হলো মনই ব্রহ্ম। মন থেকে এই জীবজগৎ জন্মাচ্ছে, মনেই বেঁচে থাকছে, আবার শেষে মনেই লয় পাচ্ছে। তপস্যার মাধ্যমে ভৃগু মধ্যে জ্ঞানের উচ্চতর স্তরে ধাপে ধাপে উন্নীত হচ্ছে। তার অন্তরে জ্ঞানের প্রকাশ হচ্ছে। কিন্তু ভৃগু যেন সন্তুষ্ট হতে পারছে না। ভাবছেন, মন অবশ্যই শক্তিশালী, কিন্তু মনেরও সীমাবদ্ধতা আছে। মনের সংকল্প বিকল্প আছে।  মন কখনো সুখী, কখনো দুঃখী। অতয়েব মন কখনোই পরমসত্য হতে পারে না। 

ভৃগু আবার তাপস্যামগ্ন হলেন, এবং জানতে পারলেন বুদ্ধিই ব্রহ্ম। জগতে যা কিছুর অস্তিত্ত্ব আছে, তা বুদ্ধি থেকেই জন্মায়। জন্মাবার পর বুদ্ধিই তাকে ধারণ করে রাখে। আবার মৃত্যুর পর তারা বুদ্ধিতেই লয় প্রাপ্ত হয়। কিন্তু ভৃগু ভাবতে  লাগলেন,বুদ্ধিও পরিবর্তনশীল। অভিজ্ঞতার সাহায্যে আমাদের বুদ্ধির পরিবর্তন হয়। সুতরাং পরিবর্তনশীল স্বভাবের কারনে, বুদ্ধি কখনো পরম সত্য হতে পারে না। এই তত্ত্ব জেনে ভৃগু আবার তার পিতার কাছে গেলেন। পিতা বললেন, ব্রহ্মকে জানার উপায় একমাত্র তপস্যা।  তুমি তপস্যার মাধ্যমেই কয়েক ধাপ এগিয়েছ। এই তপস্যাই তোমাকে ব্রহ্মের স্বরূপ জানতে সাহায্য করবে। তুমি তপস্যা করো। 

ভৃগু আবার তাপস্যারত  হলেন। আর এই তপস্যা তাকে একটা অনাবিল আনন্দ দিতে লাগলো।  তো ভৃগু মনে করলেন, এই আনন্দই ব্রহ্ম। ভৃগু ধাপে ধাপে তাপস্যাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আসলে তপস্যা আমাদের সুনিয়ন্ত্রিত চিন্তা। আমরা যখন চিন্তা করি, তখন বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে চলে যাই। কিন্তু একজন বিজ্ঞানী যখন চিন্ত্ৰা করেন , তখন তিনি নির্দিষ্ট বিষয়ের মধ্যে চিন্তাকে আবদ্ধ করে রাখেন, এবং প্রতি পদক্ষেপে চিন্তায় প্রাপ্ত তথ্যগুলোকে লিপিবদ্ধ করেন। এই তথ্যগুলোকে নিয়ে পরে বিচার বিশেষণ করেন। এই একই কাজ করতে হয় আমাদের তপস্যায়। তপস্যায় আমরা যা জানতে পারি, তাকে বিশ্লেষণ করতে  করতে পরবর্তী ধাপে যেতে হয় আমাদের। তো ভৃগু ব্রহ্মের সন্ধান করতে গিয়ে আনন্দের সন্ধান পেলেন। অর্থাৎ জগৎ তার কাছে  আনন্দময় মনে হচ্ছে । আর এই সময়, মহান তপস্বী  ভৃগু হয়ে উঠেছেন   আত্মপ্রত্যয়ী, দৃঢ় মানসিক ইচ্ছাশক্তির অধিকারী।

ভৃগু অনেকটা শান্ত হলেন। কিন্তু এখনো তার সংশয় গেলো না। আনন্দের স্পর্শ পাচ্ছেন বটে, কিন্তু কোই পূর্নতা তো মিললো না। যেন কোথায় একটা অভাব, অপূর্নতা থেকেই গেল। মনে হচ্ছে যেন কাছে এসে গেছি, কিন্তু কোই পরমশান্তি, সংশয়াতীত হতে তো পারছি না। ভৃগু আবার ফিরে গেলেন পিতার কাছে।  হে পিতঃ আমি পারি নাই, আমি এবারও  ব্রহ্মকে জানতে পারি নাই। আমাকে ব্রহ্ম-উপদেশ করুন। সিদ্ধ ঋষি বরুন আবার একই কথা, একই সংকেত দিলেন, এগিয়ে যাও। পথ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, আরো একটু এগিয়ে যাও। কঠিন তিনটি সিঁড়ি তুমি পার হয়েছো। আর ভয় কি এগিয়ে যাও , তপস্যা করো। তবে তুমি যে আনন্দের সন্ধান পেয়েছো, তা সেই চরম আনন্দের  ঝিলিক মাত্র। জ্ঞান তোমার বাড়ছে বৈ  কি কিন্তু এই আনন্দ সেই আনন্দের কনা মাত্র।  এগিয়ে যাও - তপস্যা করো। 

এর পরের দিন আমরা গল্পের পরবর্তী অংশ শুনবো।  আজ ব্রহ্মবাক্যের বিরাম দিলাম। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ হরি  ওম।
 
ব্রহ্মের খোঁজে ভৃগু (২)  - তৈত্তিরীয় উপনিষদ

মরার পরে বুঝতে পারবেন মরাটা এত সহজ নয়, এর জন্য অবশ্য়ই সাধনা করতে হবে। তবেই আমরা সত্যিকারের মারা যেতে পারি।  "আমি" সত্ত্বার লোপ সাধন করতে পারি। আমরা শুনছিলাম, ঋষি ভৃগুর ব্রহ্ম-জ্ঞান  লাভের গল্প। সমস্ত ধর্ম্ম শাস্ত্র পাঠ  করেও যা তিনি জানতে পারেন নি। তাই গুরুদেব পিতা  ঋষি বরুনের নির্দেশে তিনি তপস্যার পথ বেছে  নিয়েছিলেন। আর তপস্যা করতে করতে তার অন্তরে বিভিন্ন ভাবের উদয় হয়েছিল।  ঋষি বরুন বলেছিলেন, তুমিই ব্রহ্ম। তোমার এই শরীর মন প্রাণ সবই ব্রহ্ম। আর এই শরীর মন প্রাণ যা থেকে উৎপত্তি হয়েছে, সবই ব্রহ্ম।জগৎ  যাতে স্থিত হচ্ছে সেসব ব্রহ্ম, আবার পরিণামে যাতে লয় হচ্ছে, সবই ব্রহ্ম। আর এই জ্ঞান নিজের অন্তরে উপলব্ধি করতে হলে, তপস্যাই একমাত্র অবলম্বন। ঋষি বরুন, তাই পুত্র ভৃগুকে তপস্যার মাধ্যমে এই জ্ঞান অর্জন করতে বলেছিলেন। আর যোগ্য সাধক ভৃগু তপস্যার মাধ্যমে প্রথমে অন্ন অর্থাৎ খাদ্যকে ব্রহ্ম হিসেবে অনুমান করেছিলেন। প্রাণকে ব্রহ্ম হিসেবে ভেবেছিলেন। মনকে ব্রহ্ম হিসেবে ভেবেছিলেন, বুদ্ধিকে ব্রহ্ম  হিসেবে ভেবেছিলেন, আর এই কঠোর তপস্যা করতে করতে নিজের মধ্যে এক আনন্দের অনুভূতি পেয়েছিলেন, তাই ভেবেছিলেন আনন্দ যা আমাদের মধ্যে অনুভব হচ্ছে, সেটাই ব্রহ্ম।  কিন্তু পিতা বরুন, তাকে আরো তপস্যা করতে বললেন। আমরা এই পর্যন্ত শুনেছিলাম। এখন আমরা গল্পের পরবর্তী অংশ শুনবো।

ভৃগু আবার তপস্যা মগ্ন হলেন।  বড়ো  কঠোর এই তপস্যা। কিন্তু তপস্যা যত  কঠোর হবে, তপস্যার আনন্দ তত মধুর হবে, সাধকের মধ্যে তখন এক তেজস্বী ভাব জেগে উঠবে। ভৃগু এইভাবে কতকাল তপস্যা করেছিলেন, সেই সময়ের,  কোন লেখা জোকা নেই। তপস্যা করছেন তো করছেনই। তপস্যায় তার দেহ, প্রাণ, মন,  বাক্য, সবই একাকার হয়ে গেলো।  ভৃগুর বাহির-ভিতর সব এক হয়ে গেল। ভৃগু ভাবতরঙ্গের অতলে তলিয়ে গেলেন। এখনো বুঝি তপস্যার শেষ নেই। সহসা তপঃক্লিষ্ট ভৃগু যেন এক হিমবাহ ঝর্নার শীতল জলে স্নান করে উঠলেন। তার অন্তরে জ্বলে উঠলো তপস্যার আগুন। তপস্বী ভৃগু অন্তর্দৃষ্টিতে দেখতে পেলেন চেতনার আলো। তার বুদ্ধি তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হয়ে উঠলো। তপস্বী ভৃগু বুঝলেন, বিজ্ঞানই ব্রহ্ম।  "বিজ্ঞানং ব্রহ্ম" . বিজ্ঞান অর্থাৎ বিশেষরূপে জ্ঞান যার দ্বারা পাওয়া যায়  অর্থাৎ আমাদের বুদ্ধিসত্ত্বা আমাদের অস্মিতাতত্ত্ব। আমাদের এই জ্ঞান আছে,  তাই আমাদের সম্মুখে এই  জগৎ প্রতিভাত হচ্ছে।  অজ্ঞানীর কাছে, জগৎ প্রতিভাত হয় না। চেতনাহীনের কাছে, জগৎ অর্থবিহীন শব্দমাত্র। অতএব, এই  বিশেষ জ্ঞান যার দ্বারা প্রতিভাত হচ্ছে, সেই বিজ্ঞান-ই ব্রহ্ম। 

ভৃগু আবার পিতা  বরুনের কাছে উপস্থিত হলেন। ঋষি বরুন, আবার তাকে এগিয়ে যেতে বললেন। তপস্যা করতে বললেন, বললেন, তুমি লোহার  খনি থেকে তামার খনি, তামার খনি থেকে রুপার খনি, রুপার খনি থেকে সোনার খনিতে এসেছো।  কিন্তু এখানেই শেষ নয়।  তোমাকে হীরের খনিতে যেতে হবে। ভৃগুর চোখে তখন ব্রহ্মদীপ্তি। বরুন তাকে শেষবারের মতো তপস্যা করতে বললেন। তপস্বী ভৃগুর এখন তপস্যাই অভ্যাস হয়ে গেছে। তপস্যা এখন তার স্বভাবে পরিণত হয়ে গেছে। পিতার নির্দেশ শুনে আবার তিনি তপস্যা করতে ফিরে গেলেন। 

সম্বিদ যখন ফিরলো, তখন বুঝতে পারলেন, এই অন্ন ও অন্নাদ অর্থাৎ খাদ্য ও খাদক একই, ভোক্তা ও ভোগ্য একই। তার মনে হলো, এই দেহ-প্রাণ-মন-বুদ্ধি-জ্ঞান-আনন্দ সবই অভিন্ন। আমিই খাদ্য, আমিই খাদক, আমিই জগতরূপে দৃশ্য, আমিই অদৃশ্য। আমাতেই  আলো, আমাতেই  অন্ধকার।   আমিই পুরসুরী।  আমিই উত্তরপুরুষ। আমিই পূর্ববর্তী, আমিই পরবর্তী। আমিই পিতা , আমিই পুত্র। আমিই মাতা, আমিই কন্যা।  আমিই সব, আমিই একমাত্র। আমিই ব্রহ্ম।  সমস্ত জগৎ ব্রহ্ম। স্বামী বিবেকানন্দ, তখন অবশ্য নরেন, একসময় "আমি ব্রহ্ম" এই কথাটা শুনে তার তাৎপর্য না বুঝে উপহাস করতেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণ তাকে একবার স্পর্শ করতেই, নরেন সর্বভূতে ব্রহ্মকে দেখতে লাগলেন। বেশ কয়েকদিন তার এই আচ্ছন্ন অবস্থা চলেছি। স্বাভাবিক কাজকর্ম্ম করা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। খেতে বসে দেখছেন, খাদ্যবস্তু ব্রহ্ম।  তাহলে নিজেই নিজেকে খান কি করে ? রাস্তায় যেতে যেতে  ছ্যাকড়া গাড়িগুলোকে দেখে মনে হতো - সবই ব্রহ্ম।  চাপা পড়ে মারা যাবার জোগাড় আরকি !   

এইবার একটু অন্য কথা বলি।  আত্মোপলব্ধি অর্থাৎ আত্মাকে উপলব্ধি করতে গেলে, আমাদের এই স্থূল জগৎ থেকে সূক্ষ্ম জগতে আবার সূক্ষ্ম জগৎ থেকে সূক্ষ্মতর, সূক্ষ্মতম জগতে পৌঁছতে হবে। এই যাত্রা শুধু দীর্ঘ তাই নয়, এই পথ দুর্গম, তাই কষ্টকরও   বটে।  .কিন্তু নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি পেতে গেলে এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।  আমাদের অনেকের ধারণা মৃত্যু আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। আমরা মৃত্যুর পরে অনুভূতিহীন হয়ে শান্তিতে বিরাজ করবো।  অথবা "আমি" বলে মৃত্যুর পরে আর কিছু থাকবে না। কিন্তু বিষয়টা এমন নয়, হলে হয়তো ভালো হতো। সত্য যা তা হচ্ছে, আমাদের সহজে মৃত্যু নেই।  আর মরবার পরে অর্থাৎ স্থূল দেহ ছাড়বার  পরে (বিশেষ করে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য) আপনি নিজেও  বুঝতে পারবেন, মারা যাওয়া এত সহজ নয়। আমাদের চিন্তার জগৎ থেকে আমাদের সহজে নিস্তার নেই। মৃত্যুর পরে আমরা সেই চিন্তার জগতে বাস করে থাকি। সেখানে  চিন্তাই আমাদেরকে সুখ দুঃখের অনুভূতি যোগায়। আর এই  চিন্তার প্রতি আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকেনা।  স্থুল জগতে থাকবার সময় আমরা আমাদের চিন্তাকে ইচ্ছে করলে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। পরিবর্তন করতে পারি। তাই দেবতারাও এই মনুষ্য দেহের কামনা করে থাকেন। তাই এই চিন্তাধারার পরিবর্তনের  সেই শিক্ষাই আমাদের যোগদর্শন দিয়ে থাকে।   স্বপ্নজগতে যেমন আমরা নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় থাকি, আজ রাতে আমি কি স্বপ্ন দেখবো, তা আমি জানি না। তেমনি  মৃত্যুর পরেও আমরা এই স্থুল জগতের অনুরূপ একটা জগতে বাস করে থাকি। সেটি পুরোপুরি আমাদের চিন্তার জগৎ। তাই স্থূল জগতে থাকতে থাকতে আমাদের চিন্তার মধ্যে শুদ্ধতা আনতে  হবে। পবিত্রতা আনতে  হবে। স্বপ্ন যেমন আমাদের অবচেতন মনের চিন্তার ফসল, তেমনি মৃত্যুর পরে আমরা যেখানে থাকি, তা আমাদের স্থূল জগতের চিন্তাধারার ফসল। 

এখান  থেকে বেরিয়ে আসতে  গেলে, আমাদের চিন্তাকে বিশ্লেষণ করতে হবে, তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, তাকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে মহাত্মা তারাই, যারা যোগী, যারা চিন্তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পেরেছেন। তাই মনে রাখবেন, স্থুল  দেহের পরিবর্তন প্রকৃতি করে দেবে, স্থূল দেহের নাশও একদিন প্রকৃতি করে দেবে, তা আমরা চাই আর না চাই।  কিন্তু চিন্তা ধারার যে পরিবর্তন তা আমাদেরকেই করতে হবে, আর তা এই স্থুল দেহে থাকাকালীনই করতে হবে।   তবেই আমরা এই স্থূল দেহে থাকাকালীন বলুন আর স্থুল দেহের নাশের  পরে বলুন, আমরা একটা নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি ও আনন্দ পেতে পারবো। আর এই পথই হচ্ছে, যোগ - তা সে কর্ম্মযোগ হোক, জ্ঞানযোগ হোক, ভক্তিযোগ বা রাজযোগ হোক। যোগই একমাত্র পথ - যা আমাদের সব ধর্ম্ম শেখায়। এটাই ধর্ম্মপথ। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

তৈত্তিরীয় উপনিষদ - ৩
ব্রহ্মসূত্র : ব্রহ্মানন্দের খোঁজে। 
কথায় বলে যার যেমন ভাব তার তেমন লাভ।  আপনি যদি ধনসামগ্রী লাভের আকাঙ্খ্যা করেন, তবে আপনি তা পেতে পারেন।  আপনি যদি সন্তান চান তবে তা পেতেও পারেন।  আপনি যদি সন্মান লাভের জন্য চেষ্টা করেন, তবে তা আপনি পেতেও পারেন । আপনি যদি সৌভাগ্য লাভের আকাঙ্খ্যা করেন, তবে আপনি তা পেতেও পারেন । আর অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, মানুষ অনেক কিছুই পান, পেতেও  পারেন, কিন্তু সব কিছু কোনো মানুষই  পান না। কারুর হয়তো, অনেক ধন-সম্পদ আছে, কিন্তু সন্তানাদি নেই। তো সন্তান সুখ থেকে তিনি বঞ্চিত।  আবার হয়তো দেখা গেলো, কাউর ৫-৬টি সন্তান আছে, তার আবার ধন সম্পদ নেই।  অথবা ধন-সম্পদ স্ত্রী-পুত্র সবই আছে, কিন্তু তার মনে এক মুহূর্তের জন্য  শান্তি নেই, কারন তার সন্তানগণ লেখাপড়ায় অমনোযোগী । অথবা লেখাপড়ায় খুব ভালো, কিন্তু বিদেশবাসী।  অথবা সারাক্ষন অসৎকর্ম্মে  লিপ্ত হয়ে, মা-বাবার অশান্তির কারন হয়েছে। আসলে কোনো মানুষ জীবনে সব দিক থেকে সাফল্য অর্জন করতে পারেন না। এমনকি কোনো মানুষই সারাজীবন সুখের মধ্যে থাকতে পারেন না ।  কোনো না কোনো কারনে, তার জীবনে দুঃখ নেমে আসবেই। বিষয়ের অভাবে আমাদের যে দুঃখ তা  যেমন চিরস্থায়ী নয়, তেমনি বিষয়ের প্রাপ্তিতে মানুষের জীবনে যে সুখ অনুভব হয়, তাও  কখনো চিরস্থায়ী হতে পারে না। অর্থাৎ কোনো মানুষই  চিরদিন আনন্দে থাকতে পারে না, যা সে চায় । আসলে আমরা সমস্ত জাগতিক বস্তুর সন্ধান করি কারন আমরা  শুধু আনন্দে বেঁচে থাকতে চাই।  আর এই সব লাভ করবার জন্য আমরা প্রাণপাত করি। শুধু এই উদ্দেশ্যে যে  এইগুলো পেলে আমরা সবাই আনন্দ লাভ করে থাকি। কিন্তু বিষয়প্রাপ্তি জনিত সুখ ক্ষণস্থায়ী। এমনকি এই বিষয়ঃপ্রাপ্তিযোগ ঘটাতে আমাদের অনেক দুঃখ ভোগ করতে হয়। এখন কথা হচ্ছে তাহলে আমরা কি করবো, বিষয়ের প্রাপ্তিতেই তো আমাদের আনন্দ হয়, এটা আমরা সবাই উপলব্ধি করি, হোক না সে ক্ষণস্থায়ী। চির শান্তি মানে তো আমাদের মৃত্যু, যা আমরা কখনোই কামনা করি না। আর কিই বা উপায় আছে, যাতে আমরা চিরস্থায়ী শান্তি হতে পারে।     

উপনিষদ বলছে, বিষয়ের উপাসনা  না করে ব্রহ্মের উপাসনা করো।   যিনি ব্রহ্মের উপাসনা করেন, তিনি সমস্ত কিছুই পেয়ে যেতে পারেন। আর ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ  সারা জীবন ধরে আনন্দেই থাকেন। এখন কথা হচ্ছে, এই ব্রহ্ম কে - যাকে  পেলে আমরা সব কিছুই পেতে পারি। উপনিষদ বলছে, আমিই ব্রহ্ম। জগৎ ব্রহ্মময়।  যাকিছু দেখছি, সবই ব্রহ্ম।  যা কিছু দেখছি না তাও ব্রহ্ম।  যা কিছু কাছে, তাও ব্রহ্ম, যা কিছু দূরে তাও ব্রহ্ম। এখন কথা হচ্ছে, আমিই যদি ব্রহ্ম হই, তাহলে আলাদা করে ব্রহ্মকে পাবার কি আছে ? এই প্রসঙ্গে একটা ছোট্ট গল্প বলি। 

একজন ভাগ্যক্রমে একটা পরশ পাথর পেয়েছিলো। কিন্তু সে জানতো না, এই পাথরের সাহায্যে কি কাজ হতে পারে। এই পাথর দিয়ে সে নোরার   কাজ করতে লাগলো।  অর্থাৎ চাল-ডাল-মশলা   পেশার কাজে ব্যবহার করতে লাগলো। একদিন কোনোভাবে পরশ পাথরে লোহার ছোঁয়া লেগে গেলো। আর অমনি এক আশ্চর্য্যের সন্ধান পেয়ে গেলো। সমস্ত দুঃখ তার ঘুচে গেলো। 

আমরা যে মানব শরীরটা পেয়েছি, তা এই পরশ পাথর।  যার ব্যবহার আমরা জানি না। আমরা যদি জানতাম, এই শরীরটি ব্রহ্ম বৈ কিছু নয়, তবে আমাদের জীবন বদলে যেতে পারতো । আমরা নিজেদেরকে ব্রহ্ম বলে ভাবি না।  তবে আমরা নিজেদেরকে কি ভাবি ? আমরা নিজেদেরকে অনেক কিছুই ভাবি।
 প্রথমতঃ এই যে শরীর এটিই আসলে আমি। এই শরীর  যদি না থাকতো, তবে আমি বলে কিছু থাকতো না। যারা একটু এগিয়ে ভাবেন, তারা বলে থাকেন। এই শরীর,  খাদ্যকনা ও জল দ্বারা গঠিত সঙ্গে বায়ু ও উত্তাপ। অর্থাৎ জল বায়ু ও তাপ ভিন্ন আমাদের শরীর বেঁচে থাকতে পারে না। আরো একটু এগিয়ে যারা ভাবেন তারা বলে থাকেন, আমি আসলে একটা মন, যা আমার এই শরীরের মধ্যে  অবস্থান করছে। মনের মধ্যে আছে স্মৃতি - যা আসলে আমাকে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র করেছে। এই মন-শরীর না থাকলে আমি বলে কিছু থাকে না।
 দেখুন আমাদের শরীর একাধিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিয়ে গঠিত।  আমাদের হাত, পা, মাথা, বুক, পেট, চোখ, কান, নাক, ইত্যাদি যেমন আমাদের বিভিন্ন বাহির অঙ্গ তেমনি আমাদের এই বহিরঙ্গ শরীরের  ভিতরেও আছে, বহু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যার ক্রিয়া আমাদের বহিরঙ্গগুলোকে ক্রিয়াশীল করে রেখেছে। আবার আরো একটু গভীরে যদি ভাবি, তবে বুঝবো, আমাদের শরীরে আছে রস, রক্ত, পিত্ত, হাড়, মাস। আবার এই হাড়-মাস রক্ত-রসের  মধ্যে আছে, অসংখ্য কোষ। এই কোষের মধ্যেও  আছে, প্রকারভেদ। আছে তাদের বিভিন্ন কার্যক্রম। তো এই মিলিয়েই এই মানব শরীর। অদ্ভুত  ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের শরীরে যে অসংখ্য কোষ আছে, তাদের সবার আলাদা আলাদা  জীবন প্রণালী আছে। তাদেরও আলাদা সত্ত্বা আছে। এমনকি তাদের জীবনের একটা আয়ুও  আছে। জন্ম মৃত্যু আছে। কত সংখ্যক কোষ যে আমাদের এই শরীরকে ঘিরে জীবন অতিবাহিত করছে, তার পরিসংখ্যান আজও  আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব হয় নি। জানিনা এই কোষগুলোর মধ্যেও কোনো মন আছে কিনা, তারাও আমাদের মতো চিন্তা করতে পারে কি না। তবে এটা ঠিক, তারাও কিন্তু বেঁচে থাকবার জন্য লড়াই করছে, তাদের মধ্যেও মৃত্যুভয় কাজ করে থাকে । আশ্চর্য্যের ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের শরীর যখন মৃতদেহে পরিণত হয়, তখনও এই শরীরের মধ্যে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয়।  তাদেরও একটা জীবন-কাল আছে, তাদেরও জন্ম মৃত্যু আছে। ভাবলে অবাক হতে হয়।  তাই বলছি, আমার শরীর বলতে আমরা যা  বুঝি, তা একটা নির্দিষ্ট একক নয়, বহু জীবনের  বা বহু জীবের সমষ্টি  এই মানব শরীর। আর এইসব কোষ বাইরে বেরিয়ে গেলে তারা আর বেঁচে থাকতে পারে না। এদের জন্ম-মৃত্যু আমাদের শরীরকে ঘিরেই হয়ে থাকে।  আর এদের সবার কাজই আমাদের শরীরের জন্য  গুরুত্ত্বপূর্ন। আমাদের বেঁচে থাকতে গেলে, আমাদের হাত-পা-মাথা  কাজের উপযুক্ত  হওয়া চাই। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো কাজের উপযুক্ত হওয়া চাই, এমনকি শরীরের যে অঙ্গ মলমূত্র-ঘাম বের করে দেয়, সেগুলোও  কাজের উপযুক্ত হওয়া চাই।  নতুবা আমি আর বেঁচে থাকতে পারি না। অর্থাৎ আমার শরীরের কোষের মৃত্যু হলে,  আমি বলে আর কিছু থাকে না। আমার শরীর বলেও কিছু থাকে না। 

ঠিক তেমনি, একটু কল্পনা করুন, এই অসীম ব্রহ্মান্ডের মধ্যে লাট্টুর মতো লাট খাওয়া এই পৃথিবী। এই পৃথিবীর মধ্যে কিট্-সম একটা মনুষ্য আমি। অর্থাৎ এই বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডকে যদি একটা শরীর হিসেবে কল্পনা করা যায়, যার নাম ব্রহ্ম,   তবে আমি সেই শরীরের মধ্যে একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোষ বই কিছু নোই। কিন্তু  আমি সেই শরীরের অংশ তো বটেই, তা সে যত  ক্ষুদ্রই  হোক  না কেন। অর্থাৎ সেই ব্রহ্মের অঙ্গ আমরা সবাই, তা সে মানুষ বলুন, জীব-জন্তু বলুন, সমুদ্র-পর্বত যাই বলুন না কেন।  সবই সেই বিরাট পুরুষের বা  ব্রহ্মের অংশ বা অঙ্গ  বিশেষ। তাই উপনিষদ উচ্চস্বরে ঘোষণা করছে, আমিই ব্রহ্ম - তুমিও ব্রহ্ম - জগৎ ব্রহ্ম - ব্রহ্ম ছাড়া কিছু নেই। সবই ব্রহ্মময়। 

এই জগৎ ব্রহ্মের উপর আশ্রিত। তাই উপনিষদ আমাদের বলছেন, ব্রহ্মকে সমস্ত বস্তুর আশ্রয়রূপে, অধিষ্ঠান রূপে চিন্তা করো। যিনি এইভাবে ব্রহ্মের উপাসনা করেন, তিনি নিজেই সর্ববস্তুর আশ্রয় স্বরূপ হয়ে ওঠেন।  অর্থাৎ সাধক তখন ব্রহ্মই হয়ে যান। আপনি যদি ব্রহ্মকে মহান  করেন, তবে আপনি নিজেই মহান হয়ে ওঠেন। আমরা এই সব কথা স্বীকার করি বা না করি, কিন্তু এই ভাবনা একটা অপূর্ব অনুভূতি এনে দিতে পারে। আপনি যদি ব্রহ্মকে করুনা রূপে  কল্পনা করেন, তবে আপনি দয়ার সাগর হয়ে যেতে পারেন। যদি আমরা কোনো নির্দিষ্ট গুন্ বা দেবতার চিন্তায় মগ্ন হয় তবে ধীরে ধীরে তার মতোই হয়ে উঠি। এই যে হয়ে ওঠা এটি কেবল আধ্যাত্মিক বা অভৌতিক নয়, ভৌতিক বা শারীরিকও বটে। যিনি উদার, করুণাঘন, সতত ক্ষমাশীল, সরল আত্মভোলা শিবের আরাধনা করেন, অর্থাৎ আমি যদি  সারাক্ষন তারই অর্থাৎ তার গুনের কথা স্মরণ-মনন করি, তবে  সেই  চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো, তখন আমার মধ্যে ফুটে উঠবে। 

কেউ যদি মন বা বুদ্ধি রূপে ব্রহ্মের উপাসনা করেন, তবে তার মধ্যে বুদ্ধির শক্তি বৃদ্ধি পাবে, আর তিনি বুদ্ধিমান হয়ে উঠবেন।  জীবাত্মা দেহ-মন-বুদ্ধির দ্বারা নিজেকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। আর এই জন্যই আমরা  নিজেদেরকে পরমাত্মা থেকে  আলাদা মনে করি। কিন্তু আমরা যখন দেহ-মন-বুদ্ধিকে অতিক্রম করতে পারি, তখন পরমাত্মার সঙ্গে এক হয়ে যাই। আমাদের মধ্যে যেমন শরীর-মন-বুদ্ধি ইত্যাদির স্তর ভাগ আছে, তেমনি পরমাত্মাও দেহ-মন-বুদ্ধি রূপে রয়েছেন। আমাদের এই অনন্ত সত্ত্বাকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। আমরা এই ক্ষুদ্র দেহ-মন নিয়ে মত্ত। কিন্তু হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করি, আমার নিজের ভিতরে চৈতন্যের বিভিন্ন স্তর  রয়েছে, যা ছিল এতদিন পর্যন্ত আমার  কাছে অজানা। আর এই জ্ঞান  যখন হয়, তখন আমরা অনেক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের ধারনা  করতে পারি - যার এর আগে আমাদের কাছে কল্পনাতীত ছিল। আমাদের মন অহঙ্কারের  দ্বারা আচ্ছন্ন। যখন আমরা অহঙ্কারকে অতক্রমন করে উচ্চতর অবস্থা প্রাপ্ত হতে পারি, সেই অবস্থায় আমরা বিশ্বের সাথে এক হয়ে যাই। এই ভাবাবস্থায় আমাদের অভাব বলে কিছু থাকে না। শুধু নিরবিচ্ছিন্ন আনন্দ আমাদের আশ্রয় করে থাকে। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম।    



          

ঈশ উপনিষদ -১

ঈশ উপনিষদ আসলে শুক্ল-যজুর্বেদের একদম শেষ অধ্যায়।  শুক্ল-যজুর্বেদে মোট ৪০টি অধ্যায় আছে, এর মধ্যে ৪০নং অধ্যায়কে বলা হয় ঈশ উপনিষদ। শুক্ল যজুর্বেদের প্রথম ৩৯টি অধ্যায় আসলে কর্ম্ম-কাণ্ডের কথা বলা হয়েছে। একমাত্র এই ৪০তম অধ্যায়টিতে জ্ঞানকাণ্ডের কথা বলা হয়েছে। আসলে আমাদের অন্তঃকরণ যতক্ষন শুদ্ধ না হয়, ততক্ষন আমাদের জ্ঞানের কথা ভালো লাগে না।  শুনতেও চাই না। তাই আগে নানাবিধ কর্ম্মের দ্বারা, বিশেষত শুভ কর্ম্মের সম্পাদন করতে করতে আমাদের মন শুদ্ধ হয়।  তখন জ্ঞানের কথা আমাদের শুনে ভালোও লাগে, বুঝতেও সুবিধা  হয়। যতক্ষন আমাদের অন্তঃকরণ কর্ম্মের ঘাত-প্রতিঘাতে, অভিজ্ঞতার সম্মুখীন না হচ্ছে ততক্ষন আমরা ভালো কথা শুনে চাই না। তাই শুক্ল-যজুর্বেদে একদম শেষে একটি মাত্র অধ্যায়ে জ্ঞানের বাণী দেওয়া হয়েছে।  এটি উপদেশ নয়।  জ্ঞান হচ্ছে সত্যকে উপলব্ধি করা। মানুষ কর্ম্মের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করে থাকে, আর প্রতক্ষ্য  অভিজ্ঞতা মানুষকে সত্য উপলব্ধি করতে সাহায্য করে থাকে। যাই হোক, ঈশ কথাটা দিয়ে এই উপনিষদের শুরু, তা এঁকে ঈশ-উপনিষদ বলা হয়ে থাকে আর ঈশ কথাটির অর্থ হচ্ছে ঈশ্বর। 
  
 মঙ্গলাচরণ মন্ত্রের যথার্থ অর্থ 

ওঁম পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে। 
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।

সন্ধিবিচ্ছেদ করলে দাঁড়ায় : 
ওঁম পূর্ণম অদঃ পূর্ণম ইদম্ পূর্ণাৎ পূর্ণম উদচ্যতে  
পূর্নস্য পূর্ণম আদায় পূর্ণম এব অবশিষ্যতে। 
ওঁম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।

ঈশ অর্থাৎ ঈশ্বর। 
উপ অর্থাৎ নিকটে বা কাছে । 
নিষদ অর্থাৎ বসা বা উপবেশন করা । 
অর্থাৎ ঈশ্বরের নিকটে উপবেশন করা । 

ওঁম অর্থাৎ ব্রহ্ম 
পূর্ণম অর্থাৎ সর্ব্বব্যাপী 
অদঃ অর্থাৎ সে-ই বা ব্রহ্ম (কারণরূপী)
পূর্ণম অর্থাৎ অনন্ত 
ইদম্ অর্থাৎ এই ব্রহ্ম (কার্যরূপী) 
পূর্ণাৎ অর্থাৎ কারনব্রহ্ম থেকে 
পূর্ণম অর্থাৎ কার্যব্রহ্ম 
উদচ্যতে অর্থাৎ প্রকাশিত হয়েছেন   
পূর্নস্য অর্থাৎ কারন ব্রহ্ম থেকে 
পূর্ণম অর্থাৎ কার্যব্রহ্ম 
আদায় অর্থাৎ সরিয়ে দেওয়া হয় 
পূর্ণম অর্থাৎ অনন্ত-সর্ব্যব্যাপী ব্রহ্ম  
এব অর্থাৎ এই (ব্রহ্মই) 
অবশিষ্যতে অর্থাৎ অবশিষ্ট থাকে। 

ব্রহ্ম (নির্গুণ) অনন্ত। এই জগৎও (সগুন ব্রহ্ম) অনন্ত। এই জগৎরূপ ব্রহ্ম কারনব্রহ্মের উপরে আরোপিত সত্তা মাত্র। এই জগৎকে যদি সরিয়ে দেওয়া যায় তথাপি কারন ব্রহ্ম অনন্তই থাকেন।
 
ওঁম অর্থাৎ ব্রহ্ম
শান্তিঃ  আধিভৌতিক শান্তি 
শান্তিঃ আধিদৈবিক শান্তি
শান্তিঃ আধ্যাত্মিক শান্তি 
এই মঙ্গলাচরণ শ্লোকটি অন্য অনেক উপনিষদের প্রারম্ভে ব্যবহার করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, ব্রহ্ম অনন্ত। এই জগৎও অনন্ত।এই জগৎরূপ ব্রহ্ম, বা দৃশ্যমান জগৎ-এর কোনো স্বাধীন সত্তা নেই। এই জগৎরূপ ব্রহ্ম কারনব্রহ্মের উপরে আরোপিত সত্তা মাত্র। এই জগৎকে যদি সরিয়ে দেওয়া যায় তথাপি কারন ব্রহ্ম অনন্তই থাকেন। হে ব্রহ্ম আমাদের আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক শান্তি দান করুন।

এই মন্ত্রটিতে  সমস্ত উপনিষদের নির্যাস ঘোষিত হয়েছে। ব্রহ্ম সম্পর্কে শেষ কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে দুটো কথা আমাদের কানে লাগে, আর তা হচ্ছে পূর্নম আর ইদং-ইদঃ। পূর্নম কথাটার  অর্থ সমস্ত বা সমগ্র। ইদং অর্থাৎ ইহা আর ঈদঃ অর্থাৎ উহা। বাংলায় ইহা বলতে আমরা কাছের বস্তু বোঝাই আর উহা বলতে আমরা দূরের বস্তু বুঝি ।  মানুষের শৈশবে যখনই জ্ঞান পিপাসা জাগ্রত হয়, তখন শিশু জানতে চায়, এটা কি, ওটা কি ? এটা অর্থাৎ কাছের বস্তু, আর ওটা অর্থাৎ দূরের বস্তু। বড়ো হয়ে আমরা এই জগৎ সম্পর্কে জানতে চাই, আবার এই জগতের পিছনে কি আছে সে সম্পর্কেও আমাদের জানতে ইচ্ছে করে। এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর আছে এই শ্লোকের মধ্যে।  বলছেন, ইহাও ব্রহ্ম উহাও ব্রহ্ম।  যা কিছু দৃশ্যমান তা  যেমন ব্রহ্ম তেমনি যা কিছু আমরা দেখতে পাচ্ছি না তাও ব্রহ্ম।  যা কিছু ব্যক্ত তা যেমন ব্রহ্ম, যা কিছু অব্যক্ত তাও ব্রহ্ম। ব্যক্ত অব্যক্ত সমস্ত জগৎ ব্রহ্ম বৈ কিছু নয়। একটা সগুন ব্রহ্ম আর একটি নির্গুণ বা গুণাতীত ব্রহ্ম। সমগ্র জগৎ তা সে ব্যক্ত হোক বা অব্যক্ত হোক, কাছে হোক বা দূরে হোক, দৃশ্যমান হোক বা অদৃশ্য হোক সবই ব্রহ্ম। অর্থাৎ সমস্ত বেদ-বেদান্ত-পুরান-উপনিষদ যাঁর কথা নানানভাবে, নানান ভাষায় বলবার চেষ্টা করেছে, সে সারকথা ব্যক্ত হয়েছে এই মঙ্গলচারনে। এই একটা শ্লোকের মর্মার্থ যদি আমরা ধরতে পারি, যদি এই সত্যকে উপলব্ধি করতে পারি,  তবে মনে হয়, ব্রহ্ম বিষয়ক সমস্ত বাতবিতণ্ডার, সমস্ত আলোচনার সমাপ্তি হতে পারে।  যাই হোক, এবার আমরা মূল উপনিষদের মধ্যে প্রবেশ করবো। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।     

 শ্লোক - এক ঈশ-উপনিষদ
ওঁম ঈশাবাস্যমিদং সর্বং যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ। 
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য স্বিধনম্।।
 
ওঁম = ঈশ্বর 
ঈশা+বাস্যম+ ইদং = ঈশ্বর কর্তৃক আচ্ছাদিত এই
সর্বং = সব 
যৎ+কিঞ্চ = যা কিছু 
জগত্যাম্ = জগতে 
জগৎ = বিনাশশীল এই জগৎ 
তেন = সেই কারনে 
ত্যক্তেন = ত্যাগের দ্বারা
ভুঞ্জীথা = পালন করো 
মা গৃধঃ = লোভ করো না 
 কস্য = কাহারো 
স্বিৎ+ধনম্ = নিজের ধনে। 

 ঈশ্বর দ্বারা আচ্ছাদিত বিনাশশীল এই জগৎ। এগুলোকে অর্থাৎ এই দৃশ্যমান জগতের সবকিছুকে তুমি ত্যাগের প্রবৃত্তি নিয়ে লালন পালন করো, কিন্তু অন্যের অর্থাৎ ঈশ্বরের এই ধনে তুমি লোভ করো না। 

ব্রহ্মজ্ঞান লাভের প্রথম সোপান হচ্ছে ত্যাগ। প্রপঞ্চময় এই জগৎ নানান প্রলোভনে আমাদেরকে আকৃষ্ট করছে। সতত  পরিবর্তনশীল, বিনাশশীল এই পদার্থ সমূহ আমাদের আকাঙ্খা জাগিয়ে তুলছে।  এই আকাঙ্খ্যাকে প্রশমিত করে, আমাদের ব্রহ্মচিন্তায় পরিণত  করতে হবে। নাম-রূপের মধ্যেই আছে ব্রহ্ম।  সেই চিরন্তন  ব্রহ্মকে উপলব্ধি করতে হবে।

আমরা যা কিছু দেখছি, সবকিছুর মধ্যেই ঈশ্বর পরিব্যাপ্ত হয়ে আছেন। আমাদের এই  ঈশ্বরকে বস্তুর মধ্যে থেকে আলাদা করতে হবে। এর জন্য  আমাদের বিচ্ছিন্ন করবার প্রক্রিয়া আয়ত্ত্বে আনতে  হবে। অর্থাৎ আমাদের ঈশ্বরে মনোনিবেশ করতে হবে। একটা পাথরের মধ্যে থেকে শিল্পী যেমন বাইরের আচ্ছাদন সরিয়ে দিয়ে, তার মনের মতো মূর্তি বের করেন,  তেমনি সমস্ত বস্তুর মধ্যেই আছেন সেই চিরন্তন সত্য ঈশ্বর।  আমাদের কাজ হচ্ছে, পরিবর্তনশীল সত্তাকে সরিয়ে চিরন্তন সত্তাকে বের করে আনা। বাইরের আচ্ছাদনের প্রতি উদাসীন থাকতে হবে, তবেই আমরা বস্তুর মধ্যেই মূলভূত সত্তার সন্ধান পাবো।
 শ্লোক - দুই  ঈশ-উপনিষদ
কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি জিজীবিষেচ্ছতং সমাঃ। 
এবং ত্বয়ি নান্যথেতোঽস্তি ন কর্ম লিপ্যতে নরে।। 

কুর্বন্+এব+ইহ = এই করেই এখানে অর্থাৎ ইহ জগতে  
কর্মাণি = কর্ম্ম সমূহ অর্থাৎ শাস্ত্র বিহিত কর্ম্ম 
জিজীবিষেৎ+শতং = যদি বাঁচার ইচ্ছে হয়, শতশত 
সমাঃ = বছর 
এবম = এইভাবে 
ত্বয়ি = তোমাকে  
ন+অন্যথা+অস্তি = অন্য কোনো পথ নেই 
ন= না 
কর্ম = কাজ 
লিপ্যতে = লিপ্ত হওয়া 
নরে = হে মনুষ্য। 
শাস্ত্রবিহিত কর্ম্ম করে মানুষ শত বৎসর বাঁচার ইচ্ছে করতে পারেন। অর্থাৎ যদি শত  বাঁচতে চান, তবে শাস্ত্র বিহিত কর্ম্ম করতে হবে। অন্য কোনো উপায় নেই। 
আগের শ্লোকে আমরা শুনেছিলাম, ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে হলে ত্যাগের অনুশীলন করতে হবে। এই শ্লোকে বলছেন, যারা ত্যাগের পথে যেতে পারবেন না, তারাও যদি শাস্ত্র বিহিত কর্ম্মে নিজেকে লিপ্ত রাখেন, তাহলেও, ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে শাস্ত্রের নির্দেশে কাজ করতে গিয়ে, কিছু কঠোর নিয়ম পালন করে হবে, আর এতে করে তাদের মধ্যে চিত্ত শুদ্ধি হবে। বিবেক জ্ঞান বৃদ্ধি  পেতে থাকবে। বিষয়সুখের বাসনাও ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকবে। একটা জীবন নিশ্চয়ই আসবে যেদিন তাদের মধ্যেও আত্মজ্ঞান লাভের  ইচ্ছে জাগ্রত হবে। তখন তাকে এই ত্যাগের পথই অবলম্বন করতে হবে। আসলে সমস্ত মানুষের মধ্যে ব্রহ্মজিজ্ঞাসা জাগবে, এমন ভাবার কোনো কারন নেই।  আমরা জন্ম গ্রহণ করি,প্রারব্ধ  কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য, আবার নতুন কর্ম্মফল সঞ্চিত করে আমরা মৃত্যু বরণ  করি। কিন্তু মহাপুরুষগণও  জন্ম গ্রহণ করেন, প্রারব্ধ ভোগ করবার জন্য, জীবন ধারনের জন্য তাদেরও কর্ম্ম করতে হয় ঠিকই কিন্তু তারা কর্ম্মফলে অনাসক্ত থাকেন, তাই তাদের নতুন কর্ম্মফল সঞ্চিত হয় না। যতদিন আমাদের মধ্যে বিষয়াসক্ত ভাব থাকবে, ততদিন যদি আমরা শাস্ত্রোক্ত কর্ম্মে লিপ্ত থাকি, তবে ধীরে ধীরে আমাদের অনাসক্ত ভাব আসবে। আর মনের মধ্যে ব্রহ্মজিজ্ঞাসা জেগে উঠবে। 

শ্লোক - তিন - ঈশ-উপনিষদ

অসূর্যা নাম তে লোকা অন্ধেন তমসাবৃতাঃ। 
তাংন্তে প্রত্যাভি গচ্ছন্তি যে কে চাত্মহনো জনাঃ।। 

অসূর্যা অর্থাৎ সূর্য্যহীন 
নাম তে লোকা অর্থাৎ নাম যে লোক 
অন্ধেন অর্থাৎ আত্মজ্ঞানহীন অন্ধ  
তমসাবৃতাঃ অর্থাৎ অন্ধকারের দ্বারা  
তাংন্তে  = তান+তে = সেই সকল লোকে,  
প্রত্যাভি = দেহ ত্যাগের পর 
গচ্ছন্তি  অর্থাৎ  গমন  করে 
যে কে চ আত্মহনো অর্থাৎ যারা আত্মঘাতী  
জনাঃ অর্থাৎ মানুষ 

অসূর্য নামে যে লোক, তা অন্ধদের (জ্ঞান-অন্ধ) বাসস্থান   যা  অন্ধকারের দ্বারা আবৃত। আত্মজ্ঞান অর্জনে অক্ষম ও উদাসীন মানুষ মৃত্যুর পরে এই লোকে গমন করে থাকেন । এরা  আসলে আত্মঘাতী মানুষ।

ঋষি বলছেন, জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মজ্ঞান লাভ। যেসব মানুষ আত্মজ্ঞান   লাভের  জন্য  সচেষ্ট হন  না, তারা আসলে আত্মহনন করে থাকেন। এতে করে, আমাদের ইহ জীবনে স্থুলদেহ ধারনের যে উদ্দেশ্য তা লংঘিত হচ্ছে। এমনকি এরা মৃত্যুর পরে, সেই অজ্ঞানের অন্ধকার দেশে গমন করে থাকেন। আর জন্ম-মৃত্যুর চক্রে বার বার আবর্তিত হতে থাকেন। ঋষিগন আমাদের তাই সতর্ক করছেন, যাতে আমরা আত্মজ্ঞান লাভের  চেষ্টা করি, এবং আমাদের নিজেদের জীবনকে সার্থক করে তুলি। 

শ্লোক নং - ৪ - ঈশ উপনিষদ 

অনেজদেকং মনসো জবীয়ো, নৈনদ্দেবা আপ্নুবন্ পূর্বমর্ষৎ  
তদ্ধাবতোঽন্যানত্যেতি তিষ্ঠৎ, তস্মিন্নপো মাতরিশ্বা দধাতি।।  

অনেজৎ একম অর্থাৎ নিস্কম্প এক 
মনসো জবীয় অর্থাৎ মনের চেয়ে বেগবান 
অন্যান্ দেবা অর্থাৎ অন্য সমস্ত দেবতা বা ইন্দ্রিয়সমূহ 
আপ্নুবন্   অর্থাৎ  নাগাল,  
পূর্বমর্ষৎ -  পূর্বম+অর্ষৎ = সকলের আগে 
তদ্ধাবতোঽন্যানত্যেতি = এতদ্বৎ অন্যান অতি এতি অর্থাৎ এই তিনি অন্য সকলকে অতিক্রম করে যান। তিষ্ঠৎ  অর্থাৎ স্থির থেকে 
তস্মিন্নপো = তস্মিন অপঃ অর্থাৎ তিনি আছেন বলে জল  
মাতরিশ্বা অর্থাৎ বায়ু 
দধাতি অর্থাৎ বিশেষরূপে পালন করেন। 

ব্রহ্ম নিস্কম্প অর্থাৎ স্থির, কিন্তু মনের চেয়ে বেগবান। তিনি ইন্দ্রিয়গনেরও আগে রয়েছেন। তিনি স্থির থেকেও সকলকে অতিক্রম করেছেন। তিনি আছেন বলেই জল, বায়ু ইত্যাদি সবাইকে লালন পালন করছে। অর্থাৎ জল-বায়ুর মধ্যে তিনি আছেন বলে, জল বায়ুর মধ্যে পালনের ক্ষমতা রয়েছে। 

উপনিষদ বার বার ঘোষণা করছে, ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়। ব্রহ্ম অচঞ্চল, অপরিবর্তিত। তিনি স্থির হয়েও, মনের থেকেও দ্রুতগামী। এই জগতের সবকিছুকে পরিচালনা করেন তিনি। তিনিই ব্রহ্মান্ডের অধিকর্তা  মাতরিশ্বাকে অর্থাৎ অন্তরিক্ষবাসী কার্য্য-কারন শক্তিকে সক্রিয় করে থাকেন।

ব্রহ্ম স্থির আবার দ্রুতগামী। আসলে ব্রহ্মের স্থিতি সর্বত্র। তাই ব্রহ্মের আলাদা করে গতিশীলতার প্রয়োজন নেই। তাই মন যখন যেখানেই যাক না কেন, সেখানেই  ব্রহ্মের চিরস্থিতি, লক্ষ করা যায়।  তাই বলা হয়ে থাকে মনের থেকে ব্রহ্মের গতি দ্রুত। আসলে ব্রহ্মের কোনো গতিই  নেই। বায়ুর সঙ্গে যখন আত্মার সংযোগ ঘটে তখন বায়ু জীবনীশক্তি, প্রাণশক্তি  হতে পারে।  নতুবা বায়ুর কোনো শক্তি নেই। বায়ুকে বলা হচ্ছে মাতরিশ্মা।  মাতরি কথাটার অর্থ শূন্য, শ্বা কথাটার অর্থ চলমান, অর্থাৎ অন্তরীক্ষে যিনি চলমান।

শ্লোক নং - ৫ - ঈশ উপনিষদ 
তদেজতি তন্নৈজতি তদ্দূরে তদ্বন্তিকে।
তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বস্যাস্য বাহ্যতঃ।।

তৎ এজতি অর্থাৎ তিনি চলেন,
তৎ ন এজতি অর্থাৎ তিনি চলেন না
তৎ দূরে অৰ্থাৎ তিনি দূরে
তৎ উ অন্তিকে অর্থাৎ তিনি কাছেও
তৎ অন্ত অস্য সর্বস্য অর্থাৎ তিনি জগতের ভিতরে
তৎ উ সর্বস্য অস্য বাহ্যতঃ অর্থাৎ তিনি আবার সকলের ভিতরে আবার বাইরে।

ব্রহ্ম গতিশীল, আবার গতিহীন, তিনি দূরে আবার কাছে, তিনি জগতের ভিতরে আবার বাইরে, তিনি সবার ভিতরে আবার বাইরে।

তিনি সবার অন্তরে অন্তর্যামী রূপে বিদ্যমান, হৃদয়গুহায় তার অবস্থান। আবার বাইরে প্রাণরূপে বর্তমান। রূপ ও নামের পার্থক্য হেতু তিনি বহু হয়েছেন। তিনি স্বাধীন। ব্রহ্ম নাম-রূপহীন।
শ্লোক নং - ৬ - ঈশ উপনিষদ 

যস্তু  সর্বানি ভূতানি আত্মন্যেবানুপশ্যতি। 
সর্বভূতেষু চাত্মানং ততো ন বিজুগুপ্সতে।। 

যঃ তু অর্থাৎ যে ব্যক্তি 
ভূতানি অর্থাৎ ভুতসমূহ 
আত্মনি এব  অনুপশ্যতি অর্থাৎ নিজের মধ্যে দেখেন 
সর্বভূতেষু অর্থাৎ সর্ব ভূতের মধ্যে 
চ আত্মনাং অর্থাৎ এবং আত্মাকে 
ততো ন বিজুগুপ্সতে অর্থাৎ সেজন্য ঘৃণা করেন না। 

যিনি নিজের মধ্যে সকলকে দেখেন, এবং সবার মধ্যে নিজেকে দেখেন, তিনি কাউকে ঘৃণা করেন না। 

ঋষি এই শ্লোকে সমদৃষ্টির কথা বলেছেন। সবার মধ্যেই একই আত্মা বিরাজ  করছে। পার্থক্য শুধু নাম ও রূপে।  সেই খড়-বিচুলি-মাটি-রঙ দিয়ে সমস্ত দেবতার মূর্তি তৈরি হয়। তা সে শিব বলুন, কালী বলুন, গনেশ বলুন, কার্তিক বলুন বা দূর্গা বলুন,  রাধাকৃষ্ণ বা রামচন্দ্র-হনূমান। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত কখনো বাঘ, কখনো সাধু, সাজে।   মুখোশ পড়ে  শিব সাজছে, রাক্ষস  সাজছে,  মুলে কিন্তু  শ্রীকান্ত। রূপ পাল্টায়, নাম পাল্টায়, মূলবস্তু একই থাকে। এই একত্ত্বকে উপলব্ধি করাই সাধনা।    
ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, আধ্যাত্মিক পথের তিনটি সোপান। তপস্যা, স্বাধ্যায়, ও ঈশ্বর প্রণিধান। তপস্যা হচ্ছে সংযম পালন, স্বাধ্যায় হচ্ছে বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ ও তার মনন, এবং শেষে হচ্ছে ঈশ্বর সম্পর্কে সম্যক ধারণা পোষণ। 

শ্লোক নং - ৭ - ঈশ উপনিষদ 

যস্মিন সর্বানি ভূতানি আত্মা এব অভুৎ বিজানতঃ।
তত্র কো মোহঃ কঃ শোক একত্বম অনুপশ্যতঃ।। 
   
যস্মিন সর্বানি ভূতানি অর্থাৎ যিনি সর্বভূতের মধ্যে 
আত্মা এব অভুৎ অর্থাৎ আত্মাই  আছেন  
বিজানতঃ অর্থাৎ এইরূপ জ্ঞান করেন 
তত্র কো মোহঃ অর্থাৎ তার কিসের মোহ  ?
কঃ শোক অর্থাৎ কিসের শোক ?
একত্বম অনুপশ্যতঃ অর্থাৎ সবই একরূপে দেখেন।  

যিনি সর্বভূতের মধ্যে আত্মাই আছেন, এইরূপ জ্ঞান করেন, তাঁর কিসের মোহ কিসের শোক, তিনি সর্বত্র তিনি এককেই দেখেন।

পান্ডবদের বিরুদ্ধে আছেন, মহাবীর কর্ন। ভগবান  শ্রীকৃষ্ণ জানেন, কর্নই একমাত্র যিনি অর্জুনকে অর্থাৎ পান্ডবদের শ্রেষ্ঠ বীরকে পরাস্থ করবার ক্ষমতা রাখেন।  ভীষ্ম-দ্রোণ মহাবীর হলেও, তারা পান্ডবদের কাছে সন্মন্ধের বন্ধনে আবদ্ধ। তাই তাঁদের অস্ত্র পান্ডবদের দেহে আঘাত মৃদু বা অসমর্থ হয়ে যাবে।  কিন্তু কর্ণকে ঠেকাবে কে ? তাই শ্রীকৃষ্ণ কৌশল নিলেন, কর্নকে ডেকে তার জন্মের পরিচয় জানালেন। অর্জুন যে তারই ছোট ভাই, পান্ডবকুলের জ্যেষ্ঠ পুত্র হচ্ছে কর্ন। একথা শুনে কর্ন মুখে যাই বলুক না কেন, অন্তরে  পান্ডবদের প্রতি  স্নেহধারা বইতে লাগলো। অর্থাৎ নিজেকে পান্ডবদেরই একজন ভাবতে লাগলো। মানুষ যখন, সত্য জানতে পারে, সবার পিতা  একজন, সবাই একই পরমাত্মার অংশ, তখন তার মধ্যে থেকে ঘৃণা, দ্বেষ দূর হয়ে যায়। আবার যখন সে জানতে পারে, আত্মার মৃত্যু বলে কিছু হয় না, তখন তার মধ্যে থেকে মোহ শোক তাপ দূর হয়ে যায়। মৃত্যু তখন অনন্ত যাত্রার একটা বাঁক মাত্র মনে হয়।

শ্লোক নং - ৮ - ঈশ উপনিষদ
 
স পর্যাগাৎ শুক্ৰম  অকায়ম অব্রণম অস্নাবিরম শুদ্ধম অপাপবিদ্ধম। 
কবিঃ মনীষী পরিভূ স্বয়ম্ভূ  যাথাতথ্যতঃ  অর্থান ব্যদধাৎ শাশ্বতিভ্যঃ সমাভ্যঃ।।

 স পর্যাগাৎ অর্থাৎ তিনি সর্বব্যাপী 
 শুক্ৰম  অকায়ম অর্থাৎ  উজ্বল ও কায়াহীন   
 অব্রণম অস্নাবিরম অর্থাৎ অক্ষত ও মস্তকবিহীন 
শুদ্ধম অপাপবিদ্ধম অর্থাৎ পবিত্র ও সমস্ত দোষ রোহিত  
কবিঃ মনীষী অর্থাৎ প্রাজ্ঞ ও মনোজ্ঞ
পরিভূ স্বয়ম্ভূ  অর্থাৎ উত্তম ও স্বপ্রকাশিত 
যাথাতথ্যতঃ  অর্থান যথাযথ ভাবে কর্ম্মফলকে 
ব্যদধাৎ অর্থাৎ দান করেন 
শাশ্বতিভ্যঃ সমাভ্যঃ অর্থাৎ চিরন্তন কালব্যাপী। 

তিনি সর্বব্যাপী, উজ্বল, কায়াহীন, অক্ষত, মস্তকহীন, সমস্ত দশ রোহিত, পবিত্র।  তিনি প্রাজ্ঞ, মনোজ্ঞ ও উত্তম । তিনি স্বপ্রকাশিত। তিনি শ্বাশ্বত কাল ধরে কর্ম্মফল দান করে থাকেন।

উপনিষদে বিশ্বশক্তিকে যদিও ব্রহ্ম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।  তথাপি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে "তিনি" "তাঁর" অর্থাৎ যার নাম জানা নেই,  এমন ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। উপনিষদ অদ্বৈতবাদের ধারক-বাহক।  তাই যখনই দ্বৈত ভাব আমাদের মনে আসে, তখন সেটাকে বুঝতে হবে, আত্মার উপরে আরোপিত গুনের জন্য এটি হচ্ছে। আবার আত্মার প্রভাবেই সব কিছু ঘটছে। সূর্যকিরণ জগতের সব কিছুতেই প্রতিভাত হচ্ছে, এটা তার স্বভাব। তেমনি আত্মাও সবকিছুতেই বর্তমান এটা তার স্বভাব। এই উপলব্ধি অর্থাৎ আত্মাই সকলের মধ্যে আছে, যখন হবে, তখন আমাদের দ্বৈতভাব ঘুঁচে যাবে। এবং বুঝতে পারবো, ভাব বা কর্ম্ম অনুযায়ী রূপের প্রকাশ। 
    
শ্লোক নং - ৯ - ঈশ উপনিষদ 

অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যে অবিদ্যাম উপাসতে । 
ততো ভূয় ইব তে তমো য উ বিদ্যায়াং রতাঃ।।

অন্ধম অর্থাৎ অন্ধ বা জ্ঞানান্ধ 
তমঃ অর্থাৎ অন্ধকার বা অজ্ঞনতার অন্ধকার 
প্রবিশন্তি অর্থাৎ প্রবেশ করেন  
যে অবিদ্যাম উপাসতে অর্থাৎ যিনি অবিদ্যাকে উপাসনা করেন।  
ততো ভূয় ইব অর্থাৎ  আরো বেশী 
তে তমো অর্থাৎ অন্ধকারে গমন করেন 
য উ অর্থাৎ কিন্তু যিনি 
 বিদ্যায়াং রতাঃ অর্থাৎ দেবদেবীর উপাসনা করেন। 

যিনি যান্ত্রিক ভাবে যজ্ঞাদি কর্ম্ম (অবিদ্যা) করে থাকেন, তিনি অজ্ঞনতার অন্ধকারে প্রবেশ করেন। কিন্তু যিনি দেবদেবীর (বিদ্যার) উপাসনা করেন, তিনি আরো গভীর অন্ধকারে প্রবেশ করেন। 

যাঁরা যাগযজ্ঞ করেন, তাঁরা বিশেষ উদ্দেশ্যে, বাসনা পূরণের জন্য যজ্ঞাদি কর্ম্ম করে থাকেন। তো বাসনা পূরণের জন্য আপনি যা কিছু করুন না কেন, সেই বাসনা মানুষকে জন্মচক্রের বন্ধনের মধ্যে আবধ্য করে রাখে। ফলতঃ আত্মজ্ঞান লাভ তাদের পক্ষে কোনো দিনই সম্ভব হয় না। অজ্ঞানী কেবল আমার আমি করে থাকে। আর ভোগলিপ্সা তাদেরকে অজ্ঞান-অন্ধকারেই নিমজ্জিত করে থাকে। ভোগ লিপ্সা মানুষকে কখনো, চিরস্থায়ী শান্তি দিতে পারে না। ভোগলিপ্সা মানুষের কখনো পূরণও  হয় না।  বরং দিনে দিনে তা বাড়তেই থাকে। আবার এক ধরনের মানুষ আছেন, যারা দেবদেবীর অর্থাৎ ঈশ্বরের  বিশেষ একটা গুন্ বা একাধিক  গুনের অধিকারীর, উপাসনা করে থাকেন । এরা  বিদ্যার অধিকারী অর্থাৎ সাধারণ বৈষয়িক জ্ঞানের অধিকারী। এরা নিজেদেরকে  পণ্ডিত ভাবেন । বহু শাস্ত্রে পণ্ডিত এঁরা। এঁরা  ভাবে দেবতার উপাসনা করলে, একদিন তারাও সেই দেবসম বা স্বয়ং দেবতা বোনে যাবে, এবং সর্বসুখের অধিকারী হবে। যেমন দেবতারা স্বর্গসুখ ভোগ করে থাকে, তাঁরাও তেমনি স্বর্গবাসী হতে পারবে।  তো দেব-দেবীর উপাসক  স্বর্গবাসী হয় ঠিকই কিন্তু সুখ ভোগান্তে এরা আবার ভুর্লোকে নেবে আসে। ফলত এদের মুক্তিলাভে আরো দেরি হয়, অনন্তকালেও হয় না । তাই ঋষিগণ  বলছেন, তথাকথিত জ্ঞানী-দেব-দেবী উপাসক আরো গভীর অজ্ঞান অন্ধকারে প্রবেশ করেন। যে কিছু জানে না, তাকে সহজেই  শেখানো যায়। কিন্তু যে ভুল জানে, তাকে শেখাতে অনেক বেশি সময় লাগে।  কারন, আগে তার ভুল শিক্ষার অপসারণ দরকার। না হলে সে নতুন শিক্ষা নিতে পারে না। ক্ষুধার্থ, খাবার পেলে খেতে পারে, কিন্তু যার বদহজম হয়েছে, সে সুখাদ্য গ্রহণ করতে পারে না। 

ঈশ উপনিষদ - শ্লোক নং -১০

অন্যৎ এব আহুঃ বিদ্যয়া অন্যৎ আহুঃ অবিদ্যয়া ।
ইতি শুশ্রুম ধীরাণাং যে নঃ তৎ বিচচক্ষিরে।।

 অন্যৎ এব আহুঃ বিদ্যয়া অর্থাৎ  বলাহয়ে থাকে বিদ্যা ভিন্ন ফল প্রদান করে থাকে  
অন্যৎ আহুঃ অবিদ্যয়া অর্থাৎ অবিদ্যা অন্য ফল প্রদান করে থাকে 
ইতি শুশ্রুম অর্থাৎ এই শ্রুতি 
ধীরাণাং অর্থাৎ জ্ঞানীর নিকট থেকে 
যে নঃ অর্থাৎ যারা আমাদেরকে 
তৎ বিচচক্ষিরে অর্থাৎ তা ব্যাখ্যা করেছেন। 

জ্ঞানীব্যক্তিগন বলে থাকেন, বিদ্যা ও অবিদ্যা দুটো ভিন্ন ভিন্ন ফল প্রদান করে থাকে। বিচক্ষণ ব্যক্তি এই কথা সমর্থন করেন। এখানে বিদ্যা বলতে বিশেষ বিশেষ  গুনের অধিকারী দেবতাদের উপাসনার  বলা হয়েছে।  আর অবিদ্যা বলতে সকাম যজ্ঞকর্ম্ম বোঝানো হয়েছে। যজ্ঞকর্ম্মই বলুন আর দেবতাদের উপাসনা বলুন দুটোই আত্মজ্ঞান লাভের  অন্তরায়। সকাম যজ্ঞের দ্বারা  আমাদের কামনা-বাসনার পূরণ হতে পারে।  অর্থাৎ যজ্ঞের দ্বারা আমরা আমাদের বাঞ্চিত ফল পেতে পারি। অন্যদিকে বিশেষ বিশেষ গুনের অধিকারী দেবতাদের উপাসনা করলে, আমরা সেই দেবতাদের গুনের অধিকারী হতে পারি। এবং মৃত্যুর পরে আমরা দেবলোকে অর্থাৎ স্বর্গে যেতে পারি। কিন্তু এর দ্বারা আমাদের কি লাভ হবে ? বরং বলা যেতে পারে, সুখভোগের জন্য, আমরা যে সময় স্বর্গে বাস করবো, সেই সময়টাই নষ্ট হবে। কারন এই সময় আমরা আর কোনো জ্ঞানলাভের অধিকারী হতে পারবো না। কেননা দেবতাদের কোনো আত্মজ্ঞানের চেষ্টা থাকে না, আর স্বর্গে কোনো কর্ম্মফল থাকে না। পশুদের যেমন কোনো কর্ম্মফল সঞ্চিত হয় না তেমনি দেবলোকে দেবতাদের কোনো কর্ম্মফল সঞ্চিত হয় না। তাই সত্যদ্রষ্টা  ঋষিগণ বলছেন, চিত্তশুদ্ধি করে আত্মজ্ঞানের পথে জীবন থাকতে অগ্রসর হও। 

 ঈশ উপনিষদ - শ্লোক নং -১১
বিদ্যাং চ অবিদ্যাম চ যঃ তৎ বেদ  উভয়ং সহ ।
অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়া অমৃতম অশ্নূতে।।  
       
বিদ্যাং চ অবিদ্যাম চ যঃ  অর্থাৎ যিনি বিদ্যা ও অবিদ্যা 
তৎ বেদ  উভয়ং সহ অর্থাৎ উভয়কে একত্রে জানেন 
অবিদ্যয়া মৃত্যুং অর্থাৎ অবিদ্যার দ্বারা মৃত্যুকে 
 তীর্ত্বা অর্থাৎ অতিক্রমন করেন 
বিদ্যয়া অমৃতম অশ্নূতে অর্থাৎ বিদ্যার দ্বারা অমৃত লাভ করেন। 

যিনি অবিদ্যা অর্থাৎ যাগযজ্ঞ কর্ম্ম করেন, আবার বিদ্যা অর্থাৎ দেবতাদের উপাসনা করেন, তিনি যজ্ঞকর্মের দ্বারা অমরত্ব লাভ করেন, আবার দেবদেবীর উপাসনার দ্বারা অমৃতত্বের সন্ধান পান। 
আগে আমরা শুনেছি যাগযজ্ঞ করলে  বা দেবতাদের উপাসনা করলে আমাদের মুক্তি বিলম্বিত হয়।  আত্মজ্ঞান লাভ হয় না। এই ১১নং শ্লোকে বলছেন, যাদের পক্ষে ত্যাগের রাস্তায় যাওয়া সম্ভব নয়, যারা এখনো সে স্তরে উঠতে পারেন নি, তাদের জন্য, এই যাগযজ্ঞ বা দেবতাদের উপাসনা যদি নিষ্কাম ভাবে করা হয়, তবে লাভ হতে পারে।  অর্থাৎ এই বাহ্যিক ক্রিয়াকর্ম্ম বা দেবতাদের স্তুতি স্বরূপ উপাসনা মানুষের মনকে ক্রমমুক্তির পথে নিয়ে যেতে পারে। তবে এই উপাসনা বা যাগযজ্ঞা অবশ্যই  করতে হবে কামনাশূন্য হয়ে। অর্থাৎ স্বর্গলাভের কথা ভাবলে চলবে না বা জাগতিক বস্তু লাভের  কথা বিস্মৃত হয়ে এই সব করতে হবে।  তবে চিত্ত শুদ্ধি হবে।  এবং ক্রমোন্নতি হবে। 

ঈশ উপনিষদ - শ্লোক নং -১২
অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যেঽসম্ভূতিম উপাসতে। 
ততো ভূয় ইব তে তমো য উ  সম্ভূত্যাং রতাঃ।। 

অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি অর্থাৎ অন্ধ বা জ্ঞানান্ধ অন্ধকার লোকে প্রবেশ করেন 
যেঽসম্ভূতিম অর্থাৎ যে অসম্ভূতিম, যিনি অব্যক্তকে 
উপাসতে অর্থাৎ উপাসনা করেন।  
ততো ভূয় ইব তে তমো অর্থাৎ তার ফলে তারা যেন আরো বেশি অন্ধকারে 
য উ  সম্ভূত্যাং রতাঃ অর্থাৎ যাঁরা ব্যক্তকে নিয়ে রত থাকেন। 

যারা অব্যক্তকে উপাসনা করেন, তাঁরা অন্ধের মতো অন্ধকারে প্রবেশ করেন। আর যারা ব্যক্তকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তারা আরো বেশি অন্ধকারে প্রবেশ করেন। 

অব্যক্ত অর্থাৎ জগতের কারন।  আর ব্যক্ত অর্থাৎ এই দৃশ্যমান জগৎ। ঋষি বলছেন, যারা জগতের কারন সেই অব্যক্ত শক্তির উপাসনার উপাসনা করেন, তার জ্ঞানান্ধ। আর যারা দৃশ্যমান এই অনিত্য জগতের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখনে, তারা আরো বেশি জ্ঞানান্ধ। 
শূন্য থেকে কিছু সৃষ্টি হতে পারে না। কার্য্য অবশ্য়ই কারনের পরিণতি। কারন ভিন্ন কখনো কোনো কার্য্য হতে পারে না। বর্তমানে গাছ থাকলে, অবশ্য়ই ধরে নিতে হবে, অতীতে বীজ ছিল। মুরগি দেখলে আমরা অবশ্যই বুঝে নেবো, ডিমের অস্তিত্ত্ব। আমরা আজ আমাদের চারিপাশে যা দেখছি, তা একদিন অব্যক্ত অবস্থায় ছিল।  আজ ব্যক্ত হয়েছে। ভবিষ্যতে আবার অব্যক্ত অবস্থায় অবশ্য়ই ফিরে যাবে। এক থেকেই বহু হয়েছে, আবার বহু কালে-কালে একে পরিণত হবে। তাই ব্যক্ত বা অব্যক্ত উভয়ই একই সত্তার দুটি রূপ। এই প্রথম প্রকাশ হিরণ্যগর্ভ। প্রকাশের নিস্পত্তি প্রলয়। এই দুই বস্তুই আমাদের বাইরের বস্তু। বেদান্ত বলছে, যা কিছু  বাইরে, সবই অনাত্মা, তা সে ব্যক্ত হোক বা অব্যক্ত হোক । তো অনাত্মার উপাসনা আমাদের অবশ্য়ই জ্ঞানান্ধ করে রাখে । আর যে  শক্তি এই ব্যক্ত ও অব্যক্তর ক্রিয়া সঞ্চালিত  করছে, তা আমার ভিতরের  আত্মা। আমাদের এই আত্মাকে জানতে হবে।  অর্থাৎ নিজেকে জানতে হবে। এটাই সত্যিকারের অধ্যাত্মবিদ্যা।  অন্য সব অবিদ্যা, অজ্ঞান। g        

ঈশ উপনিষদ - শ্লোক নং -১৩

অন্যাৎ এব  আহুঃ সম্ভবাৎ অন্যাৎ আহু অসম্ভাৎ। 
ইতি শুশ্রুম ধিরাণাং যে নঃ তৎ বিচচক্ষিরে।। 

অন্যাৎ এব  অর্থাৎ অন্য কিছু হবে,
আহুঃ অর্থাৎ পন্ডিতগণ বলেন 
সম্ভবাৎ অর্থাৎ ব্যক্ত প্রকৃতি থেকে 
অন্যাৎ আহু অর্থাৎ পন্ডিতগণ বলেন, অন্য ফল 
অসম্ভাৎ অর্থাৎ অব্যক্ত প্রকৃতি থেকে  
ইতি শুশ্রুম অর্থাৎ এইরূপ শোনা যায়  
 ধিরাণাং অর্থাৎ জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাছ থেকে 
যে নঃ যারা আমাদেরকে 
তৎ বিচচক্ষিরে অর্থাৎ তৎ বা সেই প্রকৃতিকে ব্যাক্ষা করছেন।  

পন্ডিতগণ বলে থাকেন, ব্যক্ত ও অব্যক্ত প্রকৃতির উপাসনা আলাদা আলাদা ফল দেন করে থাকে। জ্ঞানীগণ এই মত সমর্থন করেন। 

ঋষিগণ  বলছেন,  আসলে আমরা যার উপাসনা করি, বা যার প্রতি ধ্যান দেই, ধীরে ধীরে আমরা তাই হয়ে যাই। তো যারা অব্যাক্তের উপাসনা করছেন, তার অব্যক্ত প্রকৃতির সঙ্গে এক হয়ে যান ।  আবার যারা ব্যাক্তের উপাসনা করেন, তারা ব্যক্ত জগৎপ্রকৃতির কিছু বিভূতি অর্জন করেন। অর্থাৎ উপাস্যের গুন্ উপাসকের মধ্যে প্রকট হয়।  এতে  করে আমাদের আত্মজ্ঞান লাভ হয় না।  অর্থাৎ যা আমি নোই, তা জেনে আমাদের কি হবে ? আমি কে, সেই জ্ঞান যতক্ষন আমাদের না হচ্ছে, ততক্ষন আমাদের মুক্তি নেই। তাই আত্মজ্ঞানের সাধনা করা মুক্তির সোপান।  উপনিষদকারগণের এমনই পরামর্শ। 

ঈশ উপনিষদ - শ্লোক নং -১৪
সম্ভূতিং চ বিনাশং চ যস্তদ্বেদ উভয়ং সহ। 
বিনাশেন মৃত্যুং তীর্ত্বা অসম্ভূত্যা অমৃতম  অশ্নূতে ।।

সম্ভূতিং চ অর্থাৎ অব্যক্ত প্রকৃতি বলুন 
বিনাশং চ অর্থাৎ ব্যক্ত বা বিনাশশীল  প্রকৃতি বলুন 
যস্তদ্বেদ উভয়ং সহ অর্থাৎ যিনি এই উভয়কে জানেন, 
বিনাশেন মৃত্যুং অর্থাৎ ব্যক্তের  উপাসনা দ্বারা মৃত্যুকে 
তীর্ত্বা অর্থাৎ অতিক্রম করেন 
অসম্ভূত্যা অমৃতম অর্থাৎ অব্যক্তের  উপাসনা দ্বারা অমৃত বা অমরত্ব 
 অশ্নূতে অর্থাৎ লাভ করেন। 

যিনি যিনি ব্যক্ত ও অব্যক্ত এই উভয়ের উপাসনা একসঙ্গে করেন, তিনি ব্যক্তের  উপাসনা দ্বারা মৃত্যুকে জয় করেন, আবার অব্যক্তের উপাসনা দ্বারা মৃত্যুকে জয় করেন। 
ব্যাক্ত  ও অব্যক্ত দুইই পরম সত্য। অর্থাৎ সত্য   অব্যক্ত হতে পারে আবার ব্যক্ত হতে পারে। আর এই দুইকে জানবার প্রক্রিয়ায় হচ্ছে উপাসনা। আর এই দুইকে যখন কেউ জানতে পারে, তখন সে বুঝতে পারে এই দুইয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তাই এই উভয়ের উপাসনা করলে আমরা যেমন জগতের সম্পর্কে জানতে পারবো, জীবনের সীমাবদ্ধতাকে জানতে পারবো, ঠিক তেমনি আমরা যখন স্থুল থেকে সূক্ষ্মে যাবো, অর্থাৎ দেহ ছেড়ে যখন দেহান্তরিত হবো, তখন যে সূক্ষ্ম জগতে প্রবেশ করবো, সেই সূক্ষ্ম জগৎ সম্পর্কেও আমাদের জ্ঞান লাভ হবে। আজ আমরা ব্যক্ত জগতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরাই অব্যক্ত হয়ে যাবো। এইভাবে উপাসনা করলে  আমাদের চিরন্তন জ্ঞান লাভ হতে পারে। তবে এইসব উপাসনা আমাদের মুক্তি দিতে পারে না। প্রকৃত মুক্তির স্বাদ হবে তখনই যখন আমরা এই দুইয়ের পারে একে মিলিত হতে পারবো। যখন আমাদের একের জ্ঞান হবে। 

ঈশ উপনিষদ - শ্লোক নং -১৫

হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্য অপিহিতং মুখম্। 
তত্ত্বং পূষন্ অপাবৃণু  সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে।। 

হিরণ্ময়েন পাত্রেণ অর্থাৎ সোনারমতো উজ্জ্বল পাত্রের দ্বারা 
 সত্যস্য অপিহিতং মুখম্ অর্থাৎ সত্যের মুখ আবৃত  
তত্ত্বং পূষন্ অপাবৃণু  অর্থাৎ যে জগতের ধারক তোমার দ্বারা সেইসব অনাবৃত হোক 
সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে অর্থ যাতে সত্যধর্ম্ম দৃষ্ট হয়। 

সত্যের মুখ সোনার মতো উজ্জ্বল পাত্রের দ্বারা আবৃত হয়ে আছে। জগতের ধারক হে সূর্যদেব তুমি সেই আবরণটি দয়াকরে সরিয়ে দাও। যাতে করে আমার মতো সত্যের অনুসন্ধানীগন সত্যকে দর্শন করতে পারে। 

জগতের ধারক বাহক এই সূর্যদেব। তিনিই জীবজগতের উৎস স্বরূপ। তাঁরই আলোতে জগৎ উদ্ভাসিত। তারই করুনায়, জীবজগৎ পুষ্টি লাভ করছে। সেই উজ্জ্বল সূর্যদেবের কঠোর ঔজ্বল্য আমাদের দৃষ্টি ধাঁধিয়ে দেয়।  উপনিষদ বলছে, এই সূর্য্যের ওপারে আছে সত্য-স্বরূপ  ব্রহ্ম। আমরা সেই সত্য-স্বরূপ ব্রহ্মকে খুঁজে চলেছি। কিন্তু সূর্য্যের প্রখর সোনালী বর্ণের অগ্নির তেজ আমাদেরকে সত্যের সন্ধানে যেতে বাধা দিচ্ছে। আমরা ব্রহ্ম থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।  তাই সূর্যদেবের কাছে আমাদের প্রার্থনা, তিনি তার এই তেজের আড়ালটি সরিয়ে দিন, আমরা ব্রহ্মের সাক্ষাৎ লাভ করে ধন্য হই। আসলে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সমস্ত বস্তুই সূর্যদেবের জন্য আমাদের কাছে প্রকট হচ্ছে। আবার এই সূর্যদেবের জন্যই , আমরা আসল বস্তু দর্শন থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। কেননা দর্শনীয় সমস্ত বস্তুর উপরেই, সূর্য্যের প্রভাব। তো সূর্যদেবই সমস্ত কিছু যেমন প্রকট করছে, তেমনি সূর্যদেবই সত্যকে ঢেকে রেখেছেন । তো যত  ক্ষণস্থায়ী বস্তু সব সূর্য্যের তেজে ঢাকা, আবার সত্য বস্তু সূর্য্যের তেজে ঢাকা। তাই আমাদের সূর্যদেবের কাছে প্রার্থনা, তার এই অসীম তেজ, যা আমাদেরকে সত্য-স্বরূপ  ব্রহ্ম থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, সেই তেজ কে সম্বরন করুন।  আমাদের সত্যের জ্ঞান হোক।
 
ঈশ উপনিষদ - শ্লোক নং -১৬
পূষন একর্ষে যম সূর্য প্রজাপত্য ব্যূহ রশ্মীন সমূহ তেজঃ। 
যত্তে রূপং কল্যাণতমং তত্তে পশ্যামি যোঽসাবসৌ পুরুষঃ সোঽহমস্মি ।। 

পূষন অর্থাৎ জগতের  পোষণকারী 
একর্ষে অর্থাৎ  যিনি একই ভ্রমন  করেন 
যম সূর্য প্রজাপত্য অর্থাৎ যম অর্থাৎ মৃত্যুর কারন, সূর্য অর্থাৎ পুষ্টিদানকারী, প্রজাপত্য অর্থাৎ জীবন দানকারী  
 ব্যূহ রশ্মীন সমূহ তেজঃ অর্থাৎ সমস্ত তেজ-রশ্মি সমূহ সম্বরন করো 
যত্তে রূপং কল্যাণতমং অর্থাৎ যাতে তোমার কল্যাণতম রূপ 
তত্তে পশ্যামি অর্থাৎ যাতে দেখতে পাই 
যোঽসাবসৌ = যঃ অসৌ অসৌ  অর্থাৎ যা আদিত্যমন্ডলের সেই  
পুরুষঃ অর্থাৎ  পুরুষ 
 সোঽহমস্মি  = সঃ অহম  অস্মি অর্থাৎ সেই তিনিই আমি। 

এখানে সূর্যদেবকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে, হে পূষন অর্থাৎ জগতের পোষণকারী, হে নিঃসঙ্গ ভ্রমনকারী, হে সর্ব সংহারের কারন, আবার সবকিছুর সৃষ্টির কারন, তুমি দয়াকরে, তোমার এই ওই তীব্র তেজ সংহত করো। আমি তোমার কল্যানতম  রূপটি দেখতে চাই, সেই পরম পুরুষকে দেখতে চাই । তোমার মধ্যে যে পুরুষ আছেন, সেই একই পুরুষ আমার মধ্য আছেন। 

বেদ, বেদান্ত, উপনিষ, সুর্য্যকে ব্রহ্মের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সূর্যই জগতের প্রকাশক, পালক, আবার সংহারকর্তা। তো এই তিন শক্তি যার মধ্যে আছে, তিনিই আবার পরমপুরুষ। এই পরমপুরুষ সমস্ত মহিমা যেমন সূর্য্যের অন্তরালে লুকিয়ে আছেন, তেমনি এই যে আমি ক্ষুদ্র পুরুষ আমার অন্তরালেও লুকিয়ে আছে, সেই একই পরমপুরুষ। পুরুষের তেজ স্বরূপ সূর্য, পুরুষকে ঢেকে রেখেছে। এই তেজ সম্বরন হলে তিনি প্রতিভাত হবেন। তেমনি আমার অজ্ঞান রূপ অন্ধকার তিরোহিত হলে আমি আমাতে মহিমান্বিত হবো।  তো সূর্যতেজ  ও আমার বাহ্যিক অন্ধকাররূপ  একই ।  তুমি আলোর সমাহার, আমাকে ঘিরে রেখেছে অন্ধকার। আমরা তোমার অর্থাৎ সূর্য্যের সুবর্ন সৌন্দর্যে অভিভূত। আবার বহির্জগৎ রূপ অন্ধকার আমাকে বিমোহিত করে  রেখেছে। দূরীভূত হোক সমস্ত অন্ধকার দূরীভূত হোক সমস্ত অসহ্য তেজ। আমি আমাতেই স্থিত হতে চাই।

ঈশ উপনিষদ - শ্লোক নং -১৭
বায়ুরনিলম অমৃতমথেদং ভষ্মাতং শরীরম্। 
ওঁ ক্রূতো স্মর কৃতং স্মর ক্রূতো স্মর কৃতং স্মর।।

বায়ুরনিলম = বায়ুঃ+অনিলম অর্থাৎ বায়ু অর্থাৎ প্রাণবায়ু অনিলে অর্থাৎ মহাবাযুতে 
 অমৃতমথেদং = অমৃতম অথ ইদং অর্থাৎ সেইজন্য এই (শরীর) অমৃত 
ভষ্মাতং শরীরম্ অর্থাৎ শরীর ভস্মে প্রিন্ট হোক।  
ওঁ অর্থাৎ ব্রহ্ম 
ক্রূতো স্মর অর্থাৎ হে মন স্মরণীয়কে স্মরণ করো
কৃতং স্মর অর্থাৎ কৃতকর্মকে স্মরণ করো,
ক্রূতো স্মর কৃতং স্মর অর্থাৎ স্মরণীয়কে স্মরণ করো, নিজের কৃতকর্ম্মকে স্মরণ করো। 

এখন প্রাণবায়ু নিঃসরণের সময় হয়েছে। অর্থাৎ আমার মৃত্যু আসন্ন। এইসময় আমার প্রার্থনা, আমার প্রাণবায়ু যেন বিশ্বপ্রাণে বিলীন হয়। আমার দেহ যেন পুড়ে ছাই  হয়ে যায়। হে আমার মন তুমি সারাজীবন যা কিছু করেছো, তার স্মরণ করো। 

আমাদের মৃত্যু যখন মাথার কাছে এসে দাঁড়ায়, তখন আমাদের মনে নানান রকম চিন্তা এসে ভিড় করে। আমরা সারা জীবন যা কিছু করেছি, সেইমতো চিন্তা আমাদের মনে উঠতে থাকে। কিন্তু এই সময় আমাদের উচিত ঈশ্বর চিন্তন, শুভ চিন্তন। এই অন্তিমক্ষণের চিন্তাই আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনকে প্রভাবিত করে। তাই এইসময় যাকিছু চিন্তা করি, আমার আত্মীয়স্বজন যা কিছু চিন্তা করেন, তার প্রভাব আমার পরবর্তী দেহ ধারনে অনুপ্রাণিত করবে।  তাই এই সময় শুভ চিন্তায় মগ্ন থাকতে হয়। 

ঈশ উপনিষদ - শ্লোক নং -১৮ 
অগ্নে নয় সুপথা রায়ে অস্মান্ বিশ্বানি দেব বয়ুনানি বিদ্বান।
যুযোধ্যস্মাৎ জুহুরাণম এনো ভূয়িষ্ঠাং তে নম-উক্তিং বিধেম।।

অগ্নে নয় সুপথা রায়ে অস্মান্ অৰ্থাৎ হে অগ্নি আমাদেরকে শুভ কর্ম্মফল লাভের উদ্দেশ্যে নিয়ে চলো 
বিশ্বানি দেব বয়ুনানি বিদ্বান অর্থাৎ বিদ্বানগণ জানেন, বিশ্বের সমস্ত কর্ম্ম ও চিত্তবৃত্তি 
যুযোধ্যস্মাৎ = যুযোধি+অস্মাৎ অর্থাৎ আমাদের কাছ থেকে দূর করুন   
জুহুরাণম এনো অর্থাৎ সব অশুভ কর্ম্মের ফল 
ভূয়িষ্ঠাং অর্থাৎ বার-বার 
তে  অর্থাৎ তোমাকে 
নম-উক্তিং বিধেম অর্থাৎ নমস্কার বচন উচ্চারণ করি। 

হে অগ্নিদেব শুভফল লাভের  জন্য, হিতকর পথে নিয়ে চলো। হে দেব, আমাদের সব কৃতকর্ম্ম, আমাদের সমস্ত চিন্তা তুমি জ্ঞাত আছো। আমাদের সব অশুভ ফল দূর করে দাও। হে অগ্নিদেব তোমাকে বার বার প্রণাম করি। 

আমাদের মৃত্যুর পরে, আমাদের স্থুলদেহ অগ্নিতে পুড়ে ছাই  হয়ে যাবে। থাকবে সূক্ষ্ম দেহ। এই সূক্ষ্মের দেহের যারা  কারন, সেগুলো সবই ভৌতিক। এই সূক্ষ্মদেহে আমরা কতদিন থাকবো, তা আমাদের কর্ম্মের উপরে নির্ভর করছে। কোথায় থাকবো, তাও আমাদের কর্ম্মের উপরে নির্ভর করছে। এই জ্ঞান আমাদের নেই।  কিন্তু হে অগ্নিদেব তোমার তো সব জানা আছে, তোমাকে আমরা পুনঃ পুনঃ প্রণাম করি, তুমি আমাদের শুভ পথে পরিচালিত করো। 

 ওঁম পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে। 
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  

ঈশ উপনিষদ সমাপ্ত।  

      
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ : 

ভূমিকা : শ্বেত কথাটার অর্থ হচ্ছে শুদ্ধ। অশ্বতর কথাটার অর্থ হচ্ছে ইন্দ্রিয়সকল। তো শ্বেতাশ্বতর কথাটার অর্থ হচ্ছে শুদ্ধ ইন্দ্রিয়ের অধিকারী। আমাদের মতো সাধারণের ইন্দ্রিয়সমূহ চঞ্চল। শ্বেতাশ্বতর নামে  এক ঋষি ছিলেন, যার ইন্দ্রিসমূহ অচঞ্চল তাই শুদ্ধ মনের অধিকারী ছিলেন। এই   শ্বেতাশ্বতর মুনি এই উপনিষদের দ্রষ্টা ছিলেন। তাই এই উপনিষদের নাম শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ। এই বিখ্যাত উপনিষদ কৃষ্ণ যজুর্বেদের অন্তর্গত। 

এই যে মহাবিশ্ব এর কারন কি, কে এর স্রষ্টা  ? আমরাই বা কে, আমরা কোথা থেকে আসি, আবার পরিণামে কোথায় চলে যাই ? কে আমাদের এই আসা যাওয়া করাচ্ছে  ? আমরা কেন সুখী বা অসুখী হই ? ইত্যাদি নানান প্রশ্নের জবাব আছে, এই উপনিষদে। সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, পরমাত্মার উপল্বদ্ধির জন্য আমাদের কি করতে হবে, সেই সম্পর্কে কার্যকরী উপদেশ আছে, এই উপনিষদে। আমরা আজ এই কথাগুলো শুনবো।

 প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ১ : একসময় কিছু ব্রহ্ম জিজ্ঞাসু এক জায়গায় মিলিত হয়েছেন। তো কথায় কথায়, তাদের মধ্যে জিজ্ঞাসা উঠলো, এই জগতের কারন কি ব্রহ্ম ? জগতের মধ্যে বিচরণকারী এই যা আমরা - কোথা থেকে এসেছি ? আমাদেরকে কে লালন পালন করছে ? মৃত্যুর পরে আমরা কোথায় চলে যাবো ? কোন আইনে আমরা সুখ দুঃখ ভোগ করে থাকি ?
ঋষি শ্বেতাশ্বতর বলছেন, গভীর ধ্যানে মগ্ন হতে হবে, তখন জানা যাবে জ্যোতির্ময় পরমাত্মার শক্তিই এই জগতের কারন। মায়া তার তিন গুনের সাহায্যে অর্থাৎ সত্ত্ব-রজঃ-তম গুনের সাহায্যে সেই পরমাত্মাকে এই বিশ্বের কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছেন। সেই এক এবং অদ্বিতীয় পরমাত্মা সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, এমনকি জীবাত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করছেন।
এখন কথা হচ্ছে গভীর ধ্যান মানে কি ? ধ্যান অর্থ গভীর অনুসন্ধানী মন। ভদ্রলোক চায়ের দোকানে চা পান করবার জন্য বেঞ্চে বসে আছে, উনুনে কেটলিতে জল ফুটছে। ভদ্রলোক মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। নিজের মধ্যে প্রশ্নের পর প্রশ্ন জেগে উঠছে। হঠাৎ তার মধ্যে স্বজ্ঞা জাগ্রত হলো, আবিষ্কার হলো বাষ্প চালিত রেলগাড়ী। মনের মধ্যে হঠাৎ একটা আলোর ঝলকানি। বহুদিনের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয় এই স্বজ্ঞা। ধ্যান হচ্ছে সেই প্রক্রিয়া যার সাহায্যে স্বজ্ঞা জাগ্রত হয়। আর সব বহুদিনের সঞ্চিত প্রশ্নের জবাব এক ঝলকেই মিলতে পারে। তাই ঋষি শ্বেতাশ্বতর বলছেন, গভীর ধ্যান করো।

প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ২ : এখন কথা হচ্ছে এই জগতের কারন কি ? কিভাবে কথা থেকে উৎপত্তি হলো এই জগতের ? কেউ বলে থাকেন, কালের নিয়মে এই জগৎ সৃষ্টি হয়েছে, আবার কালের প্রভাবে এই জগতের বিলোপ ঘটবে। কেউ বলে থাকেন বস্তুর স্বভাবের মধ্যেই আছে জগৎ সৃষ্টির কারন ও তার কার্য্য। কেউ বলেন, জগতের সৃষ্টি একটা আকস্মিক ঘটনা। এর কোনো কার্য কারন নেই। কেউ বলেন, পঞ্চভূতই এই জগৎ সৃষ্টির কারন, অর্থাৎ ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোম এগুলোর সমন্নয়ে গঠিত হয়েছে জগৎ। আবার কেউ বলছেন, এগুলোর কোন একটি বা এগুলো সমষ্টিগত ভাবেও জগৎ সৃষ্টির করেন হতে পারে না। কারন এগুলোকে অর্থাৎ পঞ্চভূতকে একত্রিত করতে পারে জীবাত্মা। কিন্তু জীবাত্মা আবার কর্ম্মফলের অধীন। অতএব জীবাত্মা স্বাধীন নয়, জীবাত্মা নিজের প্রভু নয়।

প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ৩ :ঋষিগণ ধ্যানমগ্ন হলেন। এবং দেখলেন, জ্যোতির্ময় পরমাত্মার শক্তিই এই জগতের কারন। মায়া তার তিনটি গুনের সাহায্যে তাকে আড়াল করে রেখেছে। এই পরমাত্মাই সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছেন।
প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ৪ : ব্রহ্ম যেন একটা বিশাল চক্র। এর পরিধি হলো মায়া। মায়া আবার তিনটি গুনের দ্বারা আবৃত। সত্ত্ব, রজঃ তম। এই ব্রহ্মচক্রের ষোলোটি কলা অর্থাৎ পাঁচটি মহাভূত, পাঁচটি কর্ম্ম-ইন্দ্রিয়, পাঁচটি জ্ঞান-ইন্দ্রিয়, এবং মন। ব্রহ্মচক্রের পঞ্চাশটি শলাকা (স্বরবর্ণ (৩৯) ও ব্যঞ্জনবর্ণ (১১), কুড়িটি খিল বা খোঁটা, ছয় শ্রেণীর বৈচিত্র ( ছটি অষ্টক যথা ত্বক, চর্ম্ম, মাংস, রুধির, মেদ, অস্থি, মজ্জা ও শুক্র) যার প্রতিটি আবার আট প্রকারের (অলৌকিক সিদ্ধি - অনিমা, লাঘিমা, প্রাপ্তি, প্রাকাম্যম, মহিমা, ঈশিত্বম, বশিত্বম, কামাবসায়িত) .। এগুলো সবই ব্রহ্মচক্রের বাঁধনের প্রতীক। এই চক্রের বিচরণ ভূমি হচ্ছে, পাপ, পুন্য ও জ্ঞান ক্ষেত্র।

প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং ৫ : এই বিশ্বজগৎ যেন একটা নদী। এই নদী সর্বদা বইছে, নানান পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে। এই নদীর পাঁচটি ধারা। পঞ্চভূত এই জ্ঞান ইন্দ্রিয়রূপ নদীকে স্রোতস্বীনি করে তুলেছে। কর্ম্ম-ইন্দ্রিয়গুলো নদীর তরঙ্গ আর মন হচ্ছে নদীর উৎস। শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ যেন নদীর যেন নদীর আবর্ত , পাঁচ রকমের দুঃখ (গর্ভাবস্থায়, ভূমিষ্ঠ অবস্থায়, ব্যাধি, বার্ধক্যঃ ও মৃত্যু) যেন নদীর ঢাল। নদীর পাঁচটি ভাব, পঞ্চাশ রকম রূপান্তর, অর্থাৎ মনের রূপের রূপান্তর-এর মধ্যে দিয়ে জগৎ নদী বয়ে চলেছে।

প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং ৬ : যতক্ষন জীবাত্মা নিজেকে পরমাত্মা থেকে পৃথক বলে মনে করে, ততক্ষন ব্রহ্ম চক্রের চারদিকে তাকে পরিভ্রমন করতে হয়। আর উত্থান পতন হতেই থাকে। ঈশ্বরের ইচ্ছেয় যখন জীবাত্মা পরমাত্মাকে অভিন্ন মনে করে, তখন তার মুক্তি। তাই যে ভাবেই হোক, এই অনুভূতি আমাদের আসতেই হবে, তা সে এক জন্মে হোক বা হাজার জন্মের পরে হোক। আর এটা তখনই হবে যখন ঈশ্বরের ইচ্ছে ও জীবের ইচ্ছে মিলে যাবে।

দ্বিতীয় অধ্যায় : 

ঋষি শ্বেতাশ্বতর দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলছেন, আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করতে গেলে, প্রথমে প্রার্থনা দিয়ে শুরু করতে হবে। তো কার কাছে প্রার্থনা করবো ? কিসের জন্য প্রার্থনা করবো ? পরমাত্মার কাছে।  কিন্তু পরমাত্মা সম্পর্কে আমরা কোনো ধারণা  করতে পারি না। তাই ঋষি বলছেন, সবিতার কাছে  প্রার্থনা করতে হবে। আর আমাদের মন-বুদ্ধিকে উপযুক্ত করে তুলবার জন্য প্রার্থনা  করতে হবে। ।  প্রথম কথা হচ্ছে, সূর্য আমাদের দৃষ্টিগোচর বস্তুর মধ্যে বিরাট-বিশাল। সূর্য্যের শক্তি সম্পর্কে আমাদের একটা ধারণাও  আছে। সূর্যই, এই পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির  কারন, প্রাণ রক্ষার কারন,  সূর্যই আমাদের লালন পালন করছে। আবার সূর্য্যশক্তি আমাদের বিনাশ  করতে পারে। সূর্যই আমাদের মূলসত্তায় ফিরে যাবার মাধ্যম হতে পারে।  তো সূর্য আমাদের দৃষ্টিগোচর জগৎ পদার্থের মধ্যে বিশ্বস্রষ্টার শক্তিশালী প্রতিনিধি।  এছাড়া জাগতিক বস্তুই আমাদের আকর্ষণের বিষয়। এই জগৎই আমাদের মনকে টেনে রেখেছে। তাই আমরা সূর্যকে কেন্দ্র করে পরমাত্মার কাছে প্রার্থনা করতে পারি। 
"হে জ্যোতিস্বরূপ সূর্য আমার মন-বুদ্ধিকে পরমাত্মা অভিমুখী করে তোলো। হে অগ্নির প্রকাশশক্তি আমার ইন্দ্রিয়গুলোকে প্রজ্বল করে তোলো। হে অগ্নের-জ্যোতি  আমার স্থূল দেহ যেন পরমাত্মার উপল্বদ্ধির যোগ্য হয়ে উঠতে পারে। আমি জগতের উৎস ব্রহ্মের উপলব্ধি করতে চাই। দয়া করে, তুমি আমার মন বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়গুলোকে ব্রহ্মের সাথে যুক্ত করো। " 

আমাদের পরিচিত সাবিত্রী বা গায়ত্রী মন্ত্রেও  এই একই প্রার্থনার কথা বলা আছে।  

ওঁং ভূর্ভুবঃ স্বঃ। তৎসবিতুর্বরেন্যং। ভর্গো দেবস্য ধীমহি। ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ ওঁং।
হে (ভূঃ-ভূবঃ-স্বঃ) ত্রিলোকেশ্বর ! সবিতাদেবের পরব্রহ্মাত্মক সেই বরণীয় তেজকে আমরা ধ্যান করি। সেই সবিতা আমাদের বুদ্ধি-বৃত্তিকে প্রেরিত করুন।




 

 




   






  

 













 

  

No comments:

Post a Comment