Wednesday 12 February 2020

সাধনা - পর্ব্ব - তিন - ধ্যানের উপকারিতা


সাধনা - পর্ব্ব - তিন - ধ্যানের উপকারিতা - স্থুলদেহ ত্যাগের পরেও চলতে থাকবে। 

আমরা সাধনার  কথা শুনছিলাম । এর আগে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব্বের আলোচনায়, যম (অর্থাৎ সর্বদা সত্যকে আশ্রয় করে থাকতে হবে, হিংসা করা চলবে না, পরের দ্রব্য না বলে গ্রহণ করা চলবে না, শরীরের মূল্যবান  বীর্যশক্তি রক্ষা করতে হবে, দান গ্রহণ করা চলবে না ) এবং নিয়ম  (অর্থাৎ দেহের ও মনের শুচিতা বজায়  রাখতে  হবে, বর্তমান অবস্থায় সন্তুষ্ট থাকতে হবে, তপস্যা করতে হবে, স্বাধ্যায়  অর্থাৎ ভালো  অভ্যাসের ধারাবাহিকতা রাখতে হবে, প্রতিদিন ঈশ্বরের উপাসনা করতে হবে। ) এর পরে আমরা শুনেছি, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান, সমাধি সম্পর্কে। এর পরে আমরা শুনবো, আসন, প্রাণায়াম সম্পর্কে। কিন্তু তার আগে, আমরা শুনে নেবো, আসন, প্রাণায়াম, ধ্যান করলে আমাদের কি উপকার হতে পারে। আসন প্রাণায়াম করলে আমরা শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে পারবো। এগুলো সম্পর্কে আমরা ধীরে ধীরে বিস্তারিত শুনবো।   কিন্তু আজ আমরা শুনবো ধ্যান করলে আমাদের কি লাভ হতে পারে। আমরা এর আগে শুনেছি, ধ্যানে বসলে নানান রকম চিন্তা আসে, সেই নানানরকম চিন্তা থেকে মনকে সরিয়ে আনাকে প্রত্যাহার বলে।  আর ইষ্টে মনকে নিবিষ্ট করাকে ধারণা বলে । এই ধারণাই ধীরে ধীরে ধ্যানে পরিণত হয়। আর ধ্যান পরিপক্ক হলে স্বাভাবিক ভাবেই যা হয়, তার নাম সমাধি। এগুলো আমরা শুনেছি। কিন্তু ধ্যানের উদ্দেশ্য কি ?
ধ্যান হলো, প্রকৃত আমির উৎসে যাবার বিরামহীন  প্রয়াস। আমি আসলে জীবাত্মা। আর এই জীবাত্মা সদা সর্বদাই পরম-আত্মার সান্নিধ্যে রয়েছে। এবং সেই পরম-আত্মার কাছ থেকে শক্তি সংগ্রহ করে নিজস্ব একটা অস্তিত্ত্ব তৈরি করেছে। এই সম্পর্কে আমরা সচেতন নোই। এই সচেতনতার বৃদ্ধির জন্য, আমাদের ধ্যানে প্রবৃত্ত হতে হয়। বস্তু জ্ঞান থেকে আমরা চৈতন্যের স্তরে নিজেকে উত্তরণ করতে চাই। আর এই যাত্রা পথের  শেষে আমাদের মন অনন্ত প্রশান্তিতে ভরপুর হয়ে যায়। অপরিসীম ও অহেতুক এক অনাবিল আনন্দ আমাদেরকে ঘিরে থাকে। এটাই ধ্যানের প্রাপ্তি।
এখন কথা হচ্ছে কিভাবে এটা হয় ? দেখুন, প্রাণহীন বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কের জন্য  আমাদের মধ্যে আনন্দ হয়। আবার প্রাণের বা প্রাণীর সঙ্গে  সম্পর্কেও  আমাদের একটা আনন্দ হয়। আর এই প্রাণ ও বস্তুর সমন্নয়ে  তৈরি যে জীবজগৎ তার সঙ্গে সম্পর্কেও আমাদের আনন্দ হয়। তো এই বস্তু ও জীবজগৎ প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। ফলতঃ আমাদের এই বস্তু-নির্ভর ও জীব-নির্ভর যে আনন্দ তা ক্ষণস্থায়ী।ফলতঃ  বস্তুর অভাবে বা বিনাশে আমাদের দুঃখ উৎপন্ন হয়, ঠিক তেমনি জীবের জীবন তো অনিশ্চিত। কাল তাকে সর্বদা পরিবর্তন করছে, একটা সময় নাশ করছে। তো আমাদের আনন্দ যদি এদের উপরে নির্ভরশীল হয়, তবে আমাদের আনন্দ কখনোই চিরন্তন হতে পারে না। আমরা বিভিন্ন সম্পর্কের মধ্যে আনন্দ খুঁজি বা আনন্দ পাই। আমরা ছেলে-মেয়েকে ভালোবেসে আনন্দ পাই।  আমরা মা-বাবার উপরে নির্ভর করে নিশ্চিন্ত থাকি। কিন্তু মা-বাবা চিরকাল থাকেন না। আবার ছেলেমেয়েরাও আমাদের ছেড়ে কর্ম্মের সন্ধানে বেরিয়ে যায়। আমরা তখন দুঃখ অনুভব করি। আমরা বাড়ি-গাড়ী পেয়ে আনন্দ পাই। কিন্তু এই বাড়ি গাড়ি আমাদের সর্বোচ্চ সুখ দিতে পারে না। আর এগুলো সবই ক্ষণস্থায়ী। তাই বার বার করে মনে হয়, হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য  কোনোখানে।   এই আনন্দ চিরন্তন নয়। তাই  এই চিরন্তন আনন্দের জন্যই মুনি-ঋষিরা  চিরন্তন বস্তু খুঁজে বের করেছেন।  আর তা হচ্ছে চেতনা।  চেতনশক্তি।  আমরা যখন চেতনশক্তির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারি, তখন আমরা নিরবিচ্ছিন্ন আনন্দ ভোগ করতে পারি। হ্যাঁ আমাদের দেহ, আমাদের জীবন বলতে আমরা যা বুঝি, তাতো চিরন্তন নয়।  তবে আমরা কেন এই চিরন্তন বস্তুর খোঁজ করি ? আসলে যিনি আমিকে বুঝতে  পেরেছেন, যিনি নিজের স্বরূপকে চিনতে পেরেছেন, তিনি জানেন, "আমি" কখনোই অস্থায়ী নয়। আমার এই দেহ অস্থায়ী। অর্থাৎ আমি এখন যেখানে বাস করছি, সেই দেহটি অস্থায়ী। আমরা, আমার-আমার বলে  যাকিছু ভাবছি, সেগুলো অস্থায়ী, কিন্তু আমিতো অস্থায়ী নয়, আমি চিরস্থায়ী ।   আমার এই দেহের নাশের  পরেও আমি থাকবো। কিন্তু সেই থাকা হবে, জন্ম জন্মান্তরের যে সংস্কার আমার মধ্যে তৈরি হচ্ছে, সেগুলোকে  নিয়েই তখন আমাদের চলতে হবে। অর্থাৎ আমি কর্ম্মক্ষম থাকাকালীন অবস্থায়, আমি যাকিছু সংগ্রহ করবো, আমার চাকরি থাকা কালীন অবস্থায় আমি যে ধন সঞ্চয় করতে পারবো, সেই সঞ্চয় দিয়েই  বৃদ্ধাবস্থার দিনগুলো আমাদের কাটাতে হবে। অর্থাৎ দেহ কর্ম্মের ক্ষমতা হারালে, বা দেহের  নাশের  পরে যে দিনগুলো আসবে, তখন আর আমাদের  সঞ্চয় করবার ক্ষমতা থাকবে না। কিন্তু ভোগ থাকবে। যেমন বৃদ্ধাবস্থায় আমাদের সংগ্রহ করবার ক্ষমতা থাকে না, কিন্তু ভোগ থাকে। ঠিক তেমনি আমাদের দেহ নাশের পরেও আমাদের ভোগ থাকবে, কিন্তু কর্ম্মক্ষমতা থাকবে না।  আসলে এই দেহ ভিন্ন আমরা কর্ম্ম করতে পারি না। তাই এই পৃথিবীকে বলা হয়, কর্ম্মক্ষেত্ৰ। আর এটি যেহেতু প্রতিনিয়ত মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে, তাই এর আর এক নাম মৃত্যুপুরী। আমাদের এটা বুঝতে হবে, আমাদের এই দেহ ধারনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, অনন্ত যাত্রার জন্য, রসদ সংগ্রহ করা । আমরা যতক্ষন এই দেহে থাকবো, ততক্ষন আমাদের উচিত হচ্ছে, আমাদের ভবিষ্যতের জন্য রসদ সংগ্রহ করা।

এখন কথা হচ্ছে, আমাদের এই স্থুল দেহ নাশের পরে, আমাদের ভোগ থাকবে, সেটা কি করে সম্ভব।  ভোগ তো দেহের। তো দেহ ভিন্ন আমাদের পক্ষে কিভাবে ভোগ করা সম্ভব হবে । সেক্ষেত্রে বলি, দেহ তো আমাদের একটা নয়, দেহ আমাদের অসংখ্য। এই অসংখ্য দেহকে  বুঝবার সুবিধের জন্য  তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে । স্থুল, সূক্ষ্ম, ও কারন। 
অনন্ময় দেহ স্থূল, অর্থাৎ হাড় -মাংসের শরীর । যে দেহ আমাদের চক্ষুগোচর।

প্রাণময় দেহ। অর্থাৎ আমরা জানি এই শরীরের মধ্যে সবর্ত্র ছড়িয়ে আছে প্রাণের শক্তি।  এই প্রাণ আর কিছু নয়, বায়ুর সূক্ষ্মতম সংস্করণ। তো স্থূল দেহের ভিতরেই আছে, এই প্রাণময় দেহ।  প্রাণময় দেহ সুক্ষ। দেখা যায় না কিন্তু বোঝা যায়। 
এর পরে আছে, মনোময় দেহ। আমাদের মনের একটা জগৎ আছে। আর এই জগৎটি আর কিছুই নয়, আমাদের চিন্তা ভাবনা দিয়ে গঠিত। অর্থাৎ আমাদের মনের চিন্তা -ভাবনা দিয়ে গঠিত হচ্ছে, আমাদের মনোময় শরীর। এটিও সূক্ষ্ম কিন্তু আমাদের বুদ্ধির অগোচর নয়।

এর পরে আছে বিজ্ঞানময় শরীর।  অর্থাৎ আমাদের যে জ্ঞান তার আধাঁর হচ্ছে বিজ্ঞানময় শরীর। 
আর যে শরীরে আনন্দ অনুভব হয়, সেটি হচ্ছে আনন্দময় শরীর। 

যাই হোক আমাদের আলোচ্য বিষয় ধ্যান, ও তার উপকার। তাই আমরা দেহ নিয়ে বেশি আলোচনা করবো না।  
আমাদের যখন মৃত্যু হয়, তখন আমাদের এই স্থুল  দেহের নাশ হয় মাত্র। সূক্ষ্ম ও কারন দেহ থাকে। এরমধ্যে বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ মৃত্যুর পরে মনময় দেহে  অবস্থান করে থাকেন। 

আর সত্যি কথা বলতে কি, ভোগ শরীরের নয়, ভোগ হয় জীবাত্মার। আর আমাদের মৃত্যুর পরে, জীবাত্মা আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয় শক্তি, আমাদের কর্ম্মফল , ইত্যাদি  সংস্কার আকারে  সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে থাকে। তাই আমাদের সংস্কার বা বৃত্তিগুলো  যদি শুদ্ধ হয়, তবে আমাদের তথাকথিত মৃত্যুর পরেও আমরা ভালো থাকতে পারি। একেই বলে স্বর্গবাস   আর আমাদের সংস্কারের মধ্যে যদি অশুভ বৃত্তির ভাগ বেশি থাকে, তবে আমাদের কষ্ট ভোগ করতে হয়।  একেই বলে নরক যন্ত্রনা।

ধ্যানের মাধ্যমে আমরা আমাদের বৃত্তিগুলোকে বা সংস্কারগুলোকে  ধরতে পারি। আর এই বৃত্তিগুলিকে আমরা যদি বিচার-বিশ্লেষণ দ্বারা সংশোধন করতে পারি, তবে আমরা যেমন এই স্থুল দেহে  থেকেও পরমশান্তি  ভোগ করতে পারি। তেমনি  আমরা যখন স্থূল দেহের নাশের পরে  সূক্ষ্ম দেহে অবস্থান করবো তখনও আমরা আনন্দে থাকতে  পারবো। ধ্যানের এটাই উদ্দেশ্য।

আমরা প্রকৃতির মধ্যে বাস করছি। প্রকৃতির গুন্ তিন রকম।  সত্ত্ব, রজঃ তম। এই গুনগুলোর ধর্ম্ম-ই হচ্ছে মানুষের মনকে সদা চঞ্চল করে রেখে, সুখ-দুঃখ আনন্দ-বিষাদ ভোগ করানো। কিন্তু আমরা যদি ধ্যানমগ্ন হতে পারি, তবে আমাদের মনের গতি হবে উর্দ্ধমুখী।  অর্থাৎ তখন আমাদের মন আত্মার সান্নিধ্য অনুভব করতে পারবে। আর এই আত্মার সান্নিধ্য মানে আনন্দময় সত্ত্বার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা।  আর এই আনন্দময় সত্ত্বার সঙ্গে যখন আমরা নিজেদেরকে  সম্পৃক্ত করতে পারবো, তখন প্রকৃতির যে প্রভাব আমাদের মধ্যে বিদ্যমান আছে,  সেই প্রভাব ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাবে । এবং আমাদের সমস্ত অস্তিত্ত্ব তখন শান্ত, সংযমী ও তেজস্বীতায় ভরপুর হয়ে হবে।  এই ধ্যানে যখন আমরা একটা নিরবিচ্ছিন্ন ধারা বজায় রাখতে পারবো, তখন আমাদের মন হবে স্থির, শান্ত।  আমাদের চিন্তাশক্তি তখন স্বচ্ছতা লাভ করবে।  আমাদের মন-প্রাণ তখন বিশ্বমনের স্পর্শে সতেজ  ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে। আমাদের মনন শক্তি তখন বৃদ্ধি  পাবে।  আমাদের ধীশক্তি বৃদ্ধি পাবে। বুদ্ধি ধারালো হবে, বোঝার ক্ষমতা বৃদ্ধি  পাবে।  এমনকি বাহ্যিক কর্ম্মেও আমাদের উদ্দম বৃদ্ধি পাবে। সবার সঙ্গে আমাদের  একটা মধুর সম্পর্ক স্থাপন হবে। আর নিজের মধ্যে যখন আনন্দ উৎসারিত হবে, তখন আমাদের চারিপাশে যারা থাকবেন, তারাও শান্তিতে আনন্দে থাকবে। আপনার ভিতর থেকে একটা শান্তির তরঙ্গ প্রবাহিত হবে। যা অন্যকে প্রভাবিত করবে । আপনার মধ্যে উদ্বেগ কমে যাবে , দুশ্চিন্তা কমে যাবে। আর খেয়াল করবেন, একটা অদৃশ্য শক্তি আপনাকে সঠিক পথে পরিচালনা করবেন । আপনি তখন অনিষ্টকর কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে বাধ্য থাকবেন। শুভশক্তি আপনাকে চুম্বকের মতো টানতে থাকবে, আর যাকিছু আপনি করবেন, তা শুভ ফল প্রদান করবে। আপনার রক্ত চাপ কমে হবে। ধ্যান  যখন ঠিক ঠিক ভাবে হবে, তখন আপনার অল্পসময়ে বেশী বিশ্রামের উপযোগিতা মিলবে। আসলে ধ্যানে একটা প্রাণবন্ত সূক্ষ্ম-তড়িৎপ্রবাহ আমাদের দেহে সঞ্চালিত হয়। যা মস্তিস্ক থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত এক ধরনের শিহরনের সঞ্চার করে। দেহ মনে একটা পুলক, একটা রোমাঞ্চ অনুভব হয়। সত্যি কথা বলতে কি, ধ্যানের উপকারিতার কথা ভাষা দিয়ে বলে শেষ করতে পারা  যায় না। আর এটা ভাষার দোষ  নয়, ভাষার উপরে আমাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের জন্যই, আমরা সব কথা ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না। আজ বাক্যের বিরাম দিলাম। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।












































No comments:

Post a Comment