Sunday 5 January 2020

একাকীত্ত্ব কাটিয়ে ওঠার উপায়


                                 

একাকীত্ত্ব কাটিয়ে ওঠার উপায়

আমরা সবাই একা।  কিন্তু এই একাকীত্ত্ব আমরা সহ্য করতেপারি না। এমনকি আধ্যাত্মিক জগতেও  সাধুসঙ্গের উপকারিতা অনস্বীকার্য। কিন্তু মনের মতো সাধুসঙ্গ না পাওয়া, মনের মতো গুরুদেব না পাওয়া, আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশের দ্বারকে কখনো রুদ্ধ করতে পারেনা। আমরা যদি আমাদের মনকে সর্বদা ভগবানের সুরে বেঁধে রাখতে পারি, তবে সাধুসঙ্গের প্রয়োজন নাও হতে পারে। অবাঞ্চিত সাধুসঙ্গের চাইতে নিঃসঙ্গ থাকা অনেক ভালো। আর সবসময় পছন্দমত সাধুসঙ্গ  পাওয়া যাবে তার কোনো মানে নেই। 

আপনি নিশ্চই লক্ষ করে থাকবেন, সাধুরা নিজেদের মধ্যে মারামারি-চুলোচুলি করছে। এরা একজন আর একজনকে হিংসেও করে। আমার এক বন্ধু ভারত সেবাশ্রমের আশ্রয়ে থেকে পড়াশুনা করতো। তো একসময় তার মনে হয়েছিল, সারাজীবন সে আশ্রমেই থাকবে, আর বড় একজন সাধু হবে। তো মহারাজকে  একথা বলতেই, মহারাজ বললেন, বট গাছের ছায়ায় আশ্রয় নেওয়া ভালো, বটগাছে ওঠার চেষ্টা কোরো না।  কীটপতঙ্গের কামড় সইতে  পারবে না। আর ভালো সাধু হবার চেয়ে, ভালো মানুষ হওয়া অনেক বেশি জরুরী।    আমার  নিজের একবার একটা সাধুসঙ্গের সাধ জেগেছিলো। তো আমি কিছুদিন বাইরে থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলাম। কিছুদিন পরেই লক্ষ করলাম, আমাকে কিছুসাধু অযাচিত উপদেশ দেওয়া শুরু করলো। আমি কার সাথে মিশবো, আর কার সাথে মিশবো না। কার সাথে কথা বলবো, কার সাথে কথা বলবো না। এমনকি কার কি ইতিহাস সেসব আমাকে শোনাতে লাগলো।  আমার মনে হয়েছে, এরা নিতান্তই সাধারণ মানুষ, হিংসা, দ্বেষ, ঘৃণা এদের ভিতর থেকে নষ্ট হয়ে যায়  নি।  বরং একটু বেশীই মাত্রাতেই আছে বলেই মনে হলো। কারন এদের অভাববোধ অত্যন্ত প্রবল। তো এইসব সাধু থেকে নিজেকে দূরে রাখাই ভালো।

শুধু সাধু কেন, নিজের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, এমনকি নিজের ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকেও নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখুন। আমার এক বন্ধু আছে, তার দুটি ছেলে, একটি মেয়ে। তাদের  সবার বিয়ে-থা হয়ে গেছে। মেয়ে দিল্লী  থাকে, বড় ছেলে পুনাতে, ছোটটি বেঙ্গালুরু থাকে। সবাই প্রতিষ্ঠিত।   তো বন্ধুটির স্ত্রীর একটা আকস্মিক দুর্ঘটনা ঘটলো। হাসপাতালে ভর্তি হলো।  ছেলেমেয়েদের কাছে খবর গেলো। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, তাদের চাকরিতে নাকি, এতটাই চাপ যে তারা কেউ আসতে  পারলো না। আর বললো, তারা এসেই বা কি করবে ? তারা তো কেউ ডাক্তার নয়। টাকা পাঠিয়ে দিলো।  কিন্তু বন্ধুর তো টাকার অভাব ছিল না। সে সেই টাকা ছুঁয়েও দেখলো না। এখন মাঝে মধ্যে ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনি এলে সে আমাকে বলে, আমার বাড়িতে গেস্ট এসেছে।  বাজার করতে যেতে হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে এদের ছেড়ে আমরা থাকবো কি করে ? আর এদের যদি ছেড়ে দেই তবে, একটা সৎসঙ্গ তো অন্তত দরকার।  সাধু সঙ্গ করার  সুযোগও যদি  না পাই, তাহলে কি করা যাবে ?

তবে শুনুন, আপনার পছন্দমত কোনো চরিত্র বেছে নিন। যাঁকে আপনি ঈশ্বরের প্রতিভূ হিসেবে ভেবে  নিন। হোক না সে সব কল্পনা।  এই চরিত্রের মধ্যে আপনি আপনার পছন্দমত গুনগুলোকে আরোপ করুন। এঁকে আপনি সর্বশক্তিমান ভাবতে থাকুন। এর একটা শুদ্ধ আকার নিজের মনের মধ্যে তৈরি করুন। আর এঁকে হৃদয়কেন্দ্রে স্থাপন করুন।  সেই রূপের বা শুদ্ধ আকারের ধ্যান করতে থাকুন, আর তারই সঙ্গ করুন সর্ব্বক্ষন। এই মানস প্রতিমার সঙ্গে কথা বলতে শিখুন। যখনই সাধু সঙ্গের কথা মনে হবে, যখনি ছেলে-মেয়েদের কথা মনে হবে, তখন এই মানস প্রতিমার চিন্তা করুন। এই মানস প্রতিমার একটা নাম রাখুন। আর তার নাম সদা-সর্বদা  জপ করতে থাকুন। মনে মনে ভাবুন, এই সর্ব্বশক্তিমান পুরুষ  আপনাকে সর্ব্বক্ষন আগলে রেখেছেন। তাকে এতটাই গভীর ভাবে ভালোবাসুন, যেন তার এক মুহূর্তের জন্যও অদেখা  আপনাকে অস্থির করে তোলে। মনের করুন, তিনি আপনার আত্মারও  আত্মা। আর এই অন্তরাত্মার সাথে সংযোগ সাধনের চেষ্টা করুন। আপনি যখন যেখানে যাবেন, আপনার হৃদয়গুহাতে তাঁকে বসিয়ে নিয়ে চলুন। মনে মনে ভাববেন, আপনার ইষ্ট  দেবতা,  একটা সর্বশক্তিমান পুরুষ আপনার সঙ্গে সঙ্গে আছেন। মনে করুন, আপনার চলার পথে, তিনি শুধু আপনার সঙ্গী নয়, তিনি আপনার রক্ষাকর্তা। সমস্ত হানিকর পরিস্থিতিতে তিনি আপনাকে রক্ষা করছেন। সবসময় তিনি আপনাকে লক্ষ করছেন , আপনিও তার ছায়াসম হয়ে পথ চলছেন। মনে করুন, আপনার অন্তরে সবসময় তিনি অভয়বাণী উচ্চারণ করছেন, আপনার মধ্যে একটা শান্তভাব, একটা শান্তির ভাব বিরাজ করছে। এঁকে একমুহূর্তের জন্যও আপনি যেন ভুলে না থাকেন। আর এটা করতে পারলে, আপনি উপলব্ধি করবেন, কেউ যেন আপনাকে অলক্ষে থেকে আপনাকে রক্ষা করছেন। আপনার সব কাজ সুষ্ঠূ ভাবে হয়ে যাচ্ছে।  যদি দেখেন, কোনো কাজ হচ্ছে না, তবে জানবেন, সেই কাজ না হবার পেছনেও ভগবানের একটা মঙ্গল-ভাবনা  আছে, যা ভবিষ্যতে আপনি বুঝতে পারবেন।
   
একলা থাকায় আমাদের মধ্যে একটা সহজাত-ভীতি কাজ করে। আমাদের সবসময় একটা সঙ্গী দরকার। আমরা সমাজবদ্ধ জীব, সমাজেই স্বাছন্দ বোধ করি। শুধু মানুষ নয়, পশু পাখিও সঙ্গীদের নিয়ে বাস করে সর্বদা। আমরা অন্যের সঙ্গে কথা বলতে চাই, অন্যের কথা শুনতে চাই। আমাদের সুখ-দুঃখের কথা অন্যের সঙ্গে বিনিময় করতে চাই। আমাদের এই যে প্রবণতা, এর কারন হচ্ছে, আমি আমার ক্ষুদ আমিকে, আমার অহংসত্ত্বাকে আঁকড়ে থাকতে চাই। আসলে আমিত্ত্ব হলো আমাদের নানা ভাব, আমাদের স্মৃতি, আমাদের উত্তেজনা অর্থাৎ সারা দেবার বা সারা পাবার একগুচ্ছ আকাঙ্ক্ষা। তাই এর একটা অবলম্বন চাই। এবং আমরা সবাই, আমাদের আমিত্ত্বকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য, একটা অবলম্বন  খুঁজি, সমর্থক খুঁজি। তাইতো আমাদে যে সমর্থন করেন, আমাকে যিনি প্রশ্রয় দেন, তার কাছে আমি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। কিন্তু আমরা যদি আমাদের অহংকে একটা পূর্ণরূপ দিতে পারি, তবে আমাদের আর কারুর প্রয়োজন হবে না। যারা তাদের ব্যক্তিসত্ত্বাকে পূর্ণরূপ দিতে পেরেছেন, তাদের আর কোনো বাহ্য অবলম্বনের প্রয়োজন পড়ে না।  তাই আমরা দেখি, সাধু-মহাত্মারা  নির্জন গুহাতে একাকী বাস করতে পারেন। এদের ব্যাক্তিত্ত্বের ভরকেন্দ্র এঁদের অন্তরেই অবস্থান করছে। একটা সমন্বয়ী শক্তি এঁদের মধ্যে সদা বিরাজমান। একলা থাকতে  আমরা ভয় পাই, আমরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করি। কিন্তু একলা থাকলেই শান্তিতে থাকা যায়। একলা থাকলে ভগবৎ অনুভূতি প্রবল হয়। ঈশ্বরের সঙ্গে সবাই মিলে  থাকা যায় না। ঈশ্বরের সাথে একা একাই  দেখা করতে হয়। আর অন্তর-দেবতাকে যিনি অনুভব করতে পেরেছেন, তার না আছে ভয়, না আছে নিঃসঙ্গতা। তার ভাবের বিনিময় তো ঈশ্বরের সাথেই সদা-সর্বদা চলছে। তাই ঈশ্বরের সাথে থাকতে গেলে একলা থাকুন। আর মনে মনে বলুন, উপনিষদের (গুরুগীতার) সেই বিখ্যাত উক্তি - ত্বমেব মাতা চ   পিতা ত্বমেব। ত্বমেব  বন্ধুশ্চ সখা ত্বমেব। ত্বমেব বিদ্যা দ্রবিনং ত্বমেব। ত্বমেব সর্ব্বং মম দেবদেব।

 শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।    .   



















  

No comments:

Post a Comment