Thursday 2 January 2020

দূর করে দিন সকল দুঃখ এক্ষুনি ।

এক্ষুনি দূর করে দিন সকল দুঃখ।

আমরা সবাই দুঃখে দুঃখে জ্বরজ্বরিত। বিপদ আর বিপদ। এর থেকে রেহাই পাবার কি উপায় নেই ? আপনি, আমি সবাই সর্ব্বক্ষন বিপদের সন্মুখীন। সীমাহীন দুঃখ আমাদের আমাদের ঘিরে রেখেছে। এর থেকে কি করে রেহাই পাবো ? উপায় আছে, শুধু ধৈর্য্য-ধরে এই কথাগুলো শুনুন।

দুঃখ মূলত আমাদের শারীরিক, ও মানসিক। শরীর অসুস্থ হলে আমাদের শারীরিক দুঃখ অনুভব হয়। আর একটা হচ্ছে  মানসিক দুঃখ, যা আমাদের মনের অস্থিরতা থেকে হয়ে থাকে। আর এর থেকে নিষ্কৃতি পাবার উপায় হচ্ছে প্রাণায়াম, ধ্যান, ধারণা।

 ডাক্তারবাবু বলছেন, ঔষধে কাজ করছে না। আপনারা এঁকে বাড়ি নিয়ে যান। ঔষধ হচ্ছে দ্রব্য বা দ্রব্যের মিশ্রণ। তো দ্রব্যের একটা গুন্ আছে। আর এই দ্রব্যগুন আমাদের শরীরে অবশ্যই ক্রিয়া করবে। তা আপনি জানেন আর না জানেন। বিষ যেমন আপনাকে রেহাই দেবে না। ঠিক তেমনি ঔষধ সেবনে আমরা ভালো থাকতে পারি।  তবে কেন ডাক্তারবাবু বলছেন, ঔষধে কাজ করছে না। তাহলে কি দ্রব্যগুন শেষ হয়ে গেলো ?
সাধারণভাবে আমাদের মনে হয়, বাহ্যিক বস্তু, অর্থাৎ  ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদির আক্রমনে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমরা মনে করি, আমাদের অসুস্থ হবার এটাই কারন। আসলে কিন্তু আমাদের শরীরের প্রাণশক্তি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লে, আমরা রোগাক্রান্ত হই। এই প্রাণশক্তি বহনকারী যে কোষ সেগুলো যখন ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তখন আমাদের মধ্যে প্রাণশক্তি বহনক্রিয়া ব্যাহত হয়। এই কোষ বাইরের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে, বাইরের বিরোধী শক্তির আক্রমনেও  হতে পারে। এখন কোষ যে কারণেই ক্ষতিগ্রস্থ হোক না কেন, এই কোষগুলোকে আমাদের সুস্থ  করে তুলতে হবে। ঔষধ, ম্যাসেজ, এমনকি তড়িৎশক্তি এই কোষগুলোকে উদ্দীপ্ত করতে পারে। আর তখন কোষগুলোর মাধ্যমে আবার প্রাণশক্তি প্রবাহিত হওয়া শুরু করে। প্রাণশক্তির ছোঁয়ায় কোষগুলো আবার উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। এবং আমাদের শরীরের মেরামতির কাজ শুরু করে দেয় । এখন কথা হচ্ছে,বস্তুচেতনা যতক্ষন মানুষের মনে উচ্চপর্য্যায়ে বিরাজিত থাকে, ততক্ষন আমাদের ঔষধে কাজ হতে পারে।বস্তু চেতনা যখন আমাদের কমতে থাকে, বা একেবারেই থাকে না, তখন আর ঔষধে আর কাজ করতে পারে না। এছাড়া, ঔষধ বাইরের থেকে প্রয়োগ করা হয়, তাই এর একটা সীমাবদ্ধতা আছে। আর ঔষধ বা বাহ্যিক ক্রিয়া, আমাদের রোগমুক্তি ঘটায়  না, রোগের উপশম করতে পারে মাত্র। তারা প্রাণশক্তিকে ক্ষতিগ্রস্থ বা রোগগ্রস্থ কোষে প্রাণশক্তি আসতে উদ্দীপ্ত বা প্রলুব্ধ করতে পারে মাত্র । কিন্তু আমাদের শরীরের কোন অঞ্চলের কোষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, সেটা যতক্ষন না ডাক্তারবাবু ধরতে পারছেন, ততক্ষন ঔষধে কাজ করতে পারে না। তখন  ডাক্তারবাবু অসহায় হয়ে যান। আর ঔষধ কাজ করে না।

 কিন্তু এই প্রাণশক্তিকে যদি আমরা আমাদের ভিতরের থেকে উজ্জীবিত করতে  পারি, তবে আমরা অভ্যন্তরীণ ভাবেও শরীরকে সুস্থ অবস্থায় রাখতে পারি। তাই প্রতিনিয়ত প্রাণের সাধনা করা মানুষেরা কখনো অসুস্থ হতে পারেন না। একমাত্ৰ ইচ্ছাশক্তি দ্বারা সে প্রাণশক্তিকে ইচ্ছেমতো কোষে প্রবাহিত করতে পারেন। এবং চিরকাল নীরোগ থাকেন। বস্তুচেতনা থেকে নিজেকে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। ঈশ্বরীয় চেতনায় নিজেকে উত্তরণ ঘটাতে  হবে, তবে আমরা ইচ্ছামৃত্য বরণ করতে পারবো। রোগ ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকতে পারবো। এগুলো শুধু কথার কথা নয়, পরীক্ষিত সত্য। আপনিও এই সত্যের অনুধাবন করতে পারবেন, যদি আমাদের মুনি-ঋষিদের দেওয়া প্রক্রিয়া অনুসরণ করেন।

আর এর জন্য যে নির্দিষ্ট কাজটি করতে হবে তা হচ্ছে মাত্র ৭টি প্রাণায়াম। যা আজকের দুনিয়ায়  পরীক্ষিত সত্য।  ভস্ত্রিকা, কপালভাতি, বাহ্য, অগ্নিসার, অনুলোম-বিলোম, ভ্রামরী, এবং উদ্গিত বা প্রণবের উচ্চারণ। এর মধ্যে কাপালভাতি ও অনুলোম-বিলোম  ১৫ মিনিট করে ৩০ মিনিট করুন, অন্যগুলো তিন তিন মিনিট করে মোট ১৫ মিনিট করুন। এর পরে ১৫ মিনিট ধ্যান-ধারণা করুন।  মোট একঘন্টা আপনি দিনের শুরুতে নিজের শরীরের জন্য দিন। আর এগুলো শিখবার জন্য, আপনি বাবা রামদেবের সিডি বা youtube -এ দেখে নিতে পারেন। তবে একটা কথা মনে রাখবেন, যা-ই করুন না কেন, আপনার মধ্যে বিশ্বশক্তির প্রবেশ ঘটছে, এটা সব সময় ভাবতে থাকুন। আর এক আশ্রয় পরিবর্তন অনুভব করুন।

এর পরে শুনবো, আমাদের মানসিক দুঃখ দূর করবার উপায়।

মানুষের সবথেকে দুঃখ হচ্ছে মৃত্যু শোক, এছাড়া আছে আর্থিক কষ্ট, অন্যের ব্যবহারে কষ্ট পাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি ।  যদিও মানুষের কষ্টের মূল কারন হচ্ছে প্রত্যাশা পূরণ না হওয়া।  অর্থাৎ আমি যা আশা করেছিলাম, তা না হওয়া। এর জন্য আমাদের ধারণার পরিবর্তনের দরকার।  সেই সন্মন্ধে দু চার কথা বলি।    
এখন যে দুঃখের মধ্যে দিয়ে আপনি যাচ্ছেন, বা যে বিপদের দিন-এর মধ্যে দিয়ে আপনি চলছেন, তার থেকেও অনেক বড় বিপদ আপনি একদিন কাটিয়ে উঠেছেন। নিজের অতীত জীবনের কথা একবার ভাবুনতো। ছোটবেলায় আপনার বাবা কিংবা মা মারা গিয়েছিলো। তখন আপনি অসহায় হয়ে গিয়েছিলেন। আপনার পাশে তখন প্রতিবেশীরা দাঁড়িয়ে ছিলো।  আপনার মামা কিংবা কাকারা আপনার পাশে দাঁড়িয়েছিল। অনেক যন্ত্রণার মধ্যে কেটেছিল সেই দিনগুলো। এখন আপনি বড়  হয়েছেন। কেটেগেছে সেই দিনগুলো। কোনো-না-কোনো ভাবে কেটে গেছে আপনার সেই দুঃখের দিনগুলো। আজকে যে বিপদের মধ্যে আপনি আছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বিপদও অবশ্য়ই কেটে যাবে। এই দুঃখও একদিন কেটে যাবে। আপনি শুধু আপনার কর্তব্যে স্থির থাকুন। আপনার পক্ষে যা সম্ভব, আপনার যে ক্ষুদ্র শক্তি আছে, সেই শক্তি দিয়ে আপনার পক্ষে যা সম্ভব তাই করুন। আপনি শুধু আপনার দুঃখের  দ্রষ্টা হয়ে যায়। ঘটনাকে আপনার বিচার বুদ্ধি দিয়ে, বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করুন। আর সেইমতো কাজে নেবে পড়ুন। আপনার এই দুঃখও একদিন শেষ হয়ে যাবে। 
 আপনি নিজের দুঃখ নিয়ে চিন্তা করছেন, কাতর হয়ে পড়েছেন ? একটু বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখুনতো আপনার চেয়ে অনেক বেশি দুঃখী মানুষ আপনার চারিদিকেই রয়েছে। আপনি কি জানেন, ভারতের ২৫-কোটি লোক দিনে দুবেলা খেতে পায় না। আপনি কি জানেন, ভারতের পচিশ  কোটি মানুষ শীতের বস্ত্র জোগাড় করতে পারে না। আপনি কি জানেন, কত কোটি মানুষ ভারতে আজ গৃহ ছাড়া ?
আপনি কি সেই মায়ের কথা জানেন, যিনি শীতের রাতে  উনুন  জ্বালিয়ে জলের হাড়ি চাপিয়ে বসে আছেন,  আর ক্ষুদার্থ সন্তানদের মিথ্যে আশ্বাস দিচ্ছেন, এইতো এক্ষুনি ভাত হয়ে যাবে। সন্তানেরা খিদে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, আবার খিদে নিয়ে জেগে ওঠে। আপনি তো এদের চেয়ে ভালো আছেন। আপনি এদের কথা একটু ভাবুন, আপনার দুঃখ থাকবে না। 
 গত কয়েক বছরে লক্ষ লক্ষ লোকের চাকরি গিয়েছে, আপনি কি তাদের থেকেও দুঃখে আছেন ? এদেশে কোটি কোটি লোক বেকার। ওই সমর্থ যুবকরা জানে না তাদের ভবিষ্যৎ কি ?  আপনি কি জানেন, পৃথিবীতে প্রায় ৫০ হাজার শিশু প্রতিদিন মারা যাচ্ছে, কেবল ঔষধ আর পথ্যের  অভাবে ? ভাবুনতো এই পঞ্চাশ হাজার শিশুর এক লক্ষ মা-বাবার অসহায়তার কথা। তাদের থেকে তো আপনি ভালো আছেন। 
 আমার  এক প্রতিবেশীর দুটি ছেলে ছিল। তার একটা ছেলে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। আর একটা ছেলে ছিনতাই করতে গিয়ে জনরোষে মারা গেছে। ছেলেদুটির পিতা অন্য এক মহিলার সঙ্গে ভেগে গেছে। ভাবুন তো সেই মায়ের কথা সন্তানহারা স্বামী ছাড়া মায়ের কথা ? সেই মা কিন্তু এখনো বেঁচে আছেন। এখন তিনি বাড়িতে বাড়িতে আয়ার  কাজ করেন। এখনো তার মুখে  হাসি মিলিয়ে যায়  নি। আর এক মায়ের কথা বলি, তার এক ছেলে এক মেয়ে, মেয়েটির বিয়ে হয়েছে আসামে। বাঙালি খেদাও আন্দোলনে, জামাই মারা গেছে।  ছেলেটিকে তার বন্ধুরাই নাকি পিটিয়ে মেরেছে। স্বামী মারা গেছে অনেক দিন।  ভদ্রমহিলা এখন চায়ের দোকান করেন। আপনি কি এদের থেকেও খারাপ
আছেন ?
 আমার বাড়ির পাশের এক সোনার কারিগর-কাম-দোকানদার মারা যায়।  ওর বয়স তখন কত হবে ৩০-৩২।  তার  একটা মেয়ে ছোটো।  ওর স্ত্রী নিতান্তই ঘরোয়া মহিলা। বাড়ির কাজ - রান্না বান্না ছাড়া কিছু জানে না। অকুল পাথারে পড়েছিল। শেষমেষ রুটি তরকারির দোকান খুলে বসলো। এখন ভালো আছে।

দৈনন্দিন জীবনে যে আঘাত  আপনি অন্য কারুর কাছ থেকে পাচ্ছেন, তার জন্য আপনি দুঃখ করছেন ? বাড়ির লোকের কাছ থেকে দুর্ব্যবহার পাচ্ছেন, অফিসের বসে কাছ থেকে দুর্ব্যবহার পাচ্ছেন, প্রতিবেশীর কাছ থেকে দুর্ব্যবহার পাচ্ছেন, - এদের দুর্ব্যবহারে আপনি দুঃখ পাচ্ছেন কেন ? সব মানুষ তো সমান নয়।  সব মানুষ তো ভালো নয়, সব মানুষ তো যুক্তিশীল নয়।  হতে পারে, এদের আপনার থেকে অনেক বেশি শিক্ষা, অনেক বেশি টাকা পয়সা। হতে পারে, এদের মধ্যে কেউকেউ আপনার থেকে বয়সে বড়। এমনকি পদমর্য্যাদায় আপনার থেকে অনেক বড়ো।  কিন্তু জানবেন, এরা সবাই সাধারণ মানুষ, এমনকি আপনার থেকে নিম্ন মানের মানুষ।  আর পাঁচ জনের মতো, এদের লোভ, ক্রোধ, কাম, মোহ  ঈর্ষা তারা করে নিয়ে বেড়াচ্ছে। আর এদের ব্যবহারে, আপনি দুঃখ পাচ্ছেন ? এদের ব্যবহারের মধ্যেই এদের নিচতা  প্রকাশ পাচ্ছে। চরিত্রগত ভাবে এরা  অতি সাধারণ। আর তাই এরা  আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করছে। বিবেকানন্দের কথা মনে করুন, বিদেশের রাস্তায় তাকে বাচ্চা ছেলেরা ঢিল ছুড়ে মারছে। বিবেকানন্দ বলছেন, এরা  অতি নিচ, এদের মুখে মধু, অন্তরে গরল, এরা  স্বার্থপর, মিথ্যাবাদী - এরাই সংসারে বেশী।  এদেরই প্রতাপ। এদেরকে উপেক্ষা করুন। মনে করুন না, এই পাগলদের কাছ থেকে আমি কিই বা আশা করতে পারি ? হোক না এরা প্রতাপশালী।  দুদিন পরেই দেখবে, এরা  সব কবরে শুয়ে আছে। যারা  ভাবতো, আমি ছাড়া সংসার অচল, যারা  ভাবতো, আমি ছাড়া দেশ চলবে না। এদের ঔদ্ধত্ত্ব এদেরকে শুইয়ে দিয়েছে। আপনি কি করে আশা করতে পারেন, যে এরা আপনার সঙ্গে ভালো, বা যুক্তিশীল আচরণ করবে ? আপনি কি এই অসুরদের কাছ থেকে  দেবসুলভ ব্যবহার আশা করেছিলেন ? তাহলে ভুল ভেবে ছিলেন। আজ সময় এসেছে, নিজেকে শুধরে নেবার। আপনি একটা জিনিস মনে রাখবে, এদের মনের মধ্যে ক্লান্তি, এদের মনে হতাশা, এদের মনের মধ্যে জ্বালা - যন্ত্রনা ভর্তি।  আর এদের ব্যবহার এই সব কিছুর বিকৃত প্রকাশ মাত্র। আপনি নিজে কি সব সময় ঠান্ডা মাথা রাখতে পারেন, তবে কেন আশা করছেন যে এরা  আপনার সাথে ঠান্ডা মাথায় কথা বলবে। এরা  আপনার থেকেও বেশি যন্ত্রনায় ভুগছে, এরা বিচারশীল নয়, এরাও বিচারের অপেক্ষায় আছে।

আপনি ভাবছেন, আপনি ভালো কাজ করছেন, আর সমাজ আপনাকে দুঃখ দিচ্ছে ? এই সমাজ কাকে না দুঃখ দিয়েছে ? যীশুখ্রিস্টকে ওরা  মেরে ফেলেছে। সক্রেটিসকে ওরা  বিষ খাইয়েছে। মহাত্মা গান্ধীকে ওরা গুলি করে মেরেছে, ওর ইন্দিরা গান্ধীকে, রাজীব গান্ধীকে মেরেছে। ওরা সুভাষচন্দ্রকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। ওরা  আম্বেদকরকে কষ্ট  দিয়েছে। ওরা ভারতবর্ষকে টুকরো করেছে, জাতিতে জাতিতে দাঙ্গা বাধিয়েছে। ওরা বিবেকানন্দকে  অব্রাহ্মণ বলে গালি দিয়েছে। ওরা ঠাকুর রামকৃষ্ণকে পাগল বলেছে। তাহলে বুঝতে পারছেন, ওরা চিরকালই ছিল, শুধু আজ নয়। ওরা এখনো আছে।  ওরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে গোয়ালার ছেলে বলে গালি দিয়েছে। তো আপনি কী করে এদের কাছ থেকে ভালো কথা আশা করেন ? উপেক্ষা করুন, এদেরকে। কালের নিয়মে এরা  হারিয়ে যাবে।  আপনি বেঁচে থাকবেন। যারা ভালো বেসেছিলো, তারা বেঁচে আছে, যারা ঘৃণা করেছিল, তারা কবরে চলে গেছে। সুতরাং কারুর সমালোচনায় দুঃখ পেয়ে লাভ নেই। ওরাতো সাধারণ মানুষ, ঘৃণা করা কোনো কৃতিত্ত্ব নয়।  গালাগালি দেওয়া কোনো কৃতিত্ত্ব নয়।  সমাজের ভয়ে সংকুচিত হওয়া কোনো লাভের  বিষয় নয়। আপনি যা কিছু অর্জন করেছেন, সে তো আপনার পরিশ্রমের ফল। আপনার নিজের চেষ্টায় আপনি পরীক্ষায় ভালো ফল করেছেন, কারুর দয়ায় নয়। আপনার চেষ্টায়, আপনার নিজের  যোগ্যতায় আপনি চাকরি পেয়েছেন।  আপনার আজকের ওই বসের বদান্যতায় নয়। তো তার কথায় আপনি চাকরি ছেড়ে দেবেন কেন ?

একটা কথা শুনুন প্রত্যেকের জীবনে দুঃখ আসে। এবং এটাই স্বাভাবিক। যদি মানুষের জীবনে দুঃখের ছোয়া না থাকতো, তবে সুখের আনন্দ কোথায় পেতেন।  যদি রৌদ্রের প্রখরতা না থাকতো তবে ছায়ার মাধুর্য্য কি করে পেতাম। কোনো মানুষের জীবনেই শুধু সাফল্যের ধারাবাহিকতা থাকতেই পারে না।  রবীন্দ্রনাথ, জানেন আপনি সারা জীবন  একের পর এক মৃত্যুশোক তাকে তারা করে নিয়ে বেরিয়েছে। আর তিনি ভগবানকে ধন্যবাদ দিয়ে গেছেন। দুঃখের মধ্যে ভগবানের সান্নিধ্য অনুভব করেছেন। ওয়েব এই রৌদ্র ছায়ার খেলা শুধু আপনার নয়।  পৃথিবীর সবার। দুঃখ প্রত্যেকের জীবনে আসবে, এখন আপনি সেই দুঃখ গ্রহণ করবেন কি না সেটা আপনার ব্যাপার। দুঃখের ফেরিওয়ালা রাস্তা দিয়ে হাক দিয়ে যাবে।   আপনি তাকে বাড়ির মধ্যে ডেকে আনবেন কি না সেটা আপনার ব্যাপার।

জীবনে কে না হেরেছে ? স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জন্ম থেকে কষ্ট  পেয়েছেন। শ্রীরাধিকার মতো প্রেমিকাকে ছেড়ে যেতে হয়েছে। হয়তো সেটা সামাজিক কারণেই।  কিন্তু যেতেতো হয়েছে।

জীবন একটা যুদ্ধ।  জীবন একটা খেলার প্রাঙ্গন। এখানে হার জিৎ আছে। কখনো হারবেন, কখনো জিতবেন।  এটাই খেলার নিয়ম। হেরে গেলে আর খেলবো না। তা হতে পারে না।  নেতাজি সুভাষ ইংরেজদের কাছে হেরে গিয়ে ছিলেন। তার "আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব" - সফল করতে পারেন নি।  তাতে কি তিনি জীবন যুদ্ধে হেরে গিয়েছিলেন ? হার কখনো কখনো জেতার চেয়েও  মহান। ইংরেজরা আমাদের মন থেকে দূরে চলে গিয়েছে।  কিন্তু নেতাজি আজও আমাদের মনো কোথায় উজ্জ্বল। মনে রাখবেন, মেরুদন্ড সোজা রেখে হেরে যাওয়াতেও আনন্দ। পোষ্য কুকুরের চেয়ে বনের নেকড়ে অনেক বেশি স্বাধীন। আপনি হেরে গেছেন বলে, আপনার চোখে জল ? এই জল আপনাকে মানায় না। আপনার সামনে মহান আদর্শ।  আপনি সেই আদর্শের জন্য লড়াই করেছেন। আজ হেরে গেছেন, কিন্তু কাল আপনার জিৎ কে ঠেকাতে পারবে ? আজ যাদের সাধু দেখছেন, তারা বহু লড়াই করে আজ সাধু হতে পেরেছেন। আজ যাদের সাফল্যের শিখরে দেখছেন, তারা সবাই একদিন নানান তাচ্ছিল্লের স্বীকার হয়েছিলেন। দোষগুণ নিয়েই মানুষ। আপনার কোনো দুর্বলতা থাকতেই  পারে। আপনার কাজ হচ্ছে,  আপনার কাজ হচ্ছে সেই দুর্বলতা কাটিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানো।  আপনার ভিতরে অসীম শক্তি আছে, আপনি সর্ব্বশক্তিমান ঈশ্বরের সন্তান। আপনার আবার কষ্ট  কিসের ? আপনার আবার দুঃখ কিসের ?

আমি দেখেছি, প্রেমে প্রত্যাক্ষ্যাত হয়ে, আত্মহত্যের পথ বেঁচে নিচ্ছে, আমি দেখেছি, পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট না করতে পেরে, আত্মহত্যার পথ বেছে  নিচ্ছে। আপনি একটা জিনিস শুনে রাখুনমরে  গিয়ে, কখনো বাঁচা যায় না। আপনাকে আবার এই দেহ ধারণ করতে হবে। হয়তো দেখবেন, এই আত্মহত্যার অপরাধে আপনাকে আবার কোনো নিকৃষ্ট যোনিতে জন্ম গ্রহণ করতে হবে। বেঁচে থাকলে আপনি একদিন অবশ্যই দুঃখ থেকে রেহাই পাবেন, বিপদ থেকে রেহাই পাবেন।  কিন্তু মরে  গেলে আপনি আর কখনো এই সুযোগ পাবেন না।

সুখ-দুঃখ সবসময় মিশ্র অবস্থায় থাকে। বাতাসের মধ্যে যেমন অক্সিজেন, কার্বনডাই-অক্সাইড মিশ্রিত  অবস্থায় থাকে।  আমরা অক্সিজেন রেখে কার্বনডাই-অক্সাইড বের  করে দেই। তেমনি আমরা যদি সুখ চাই, তবে সঙ্গে সঙ্গে দুঃখ আসবেই। আমাদের কাজ হচ্ছে সুখটাকে রেখে দুঃখটাকে বের করে দেওয়া।  কিন্তু সেই প্রক্রিয়া করবার কোনো অঙ্গ আমাদের শরীরের মধ্যে নেই, যার এই দুঃখ বের করে দেবার সাধ্য আছে । তাই হয় সুখ দুঃখ দুটোই গ্রহণ করতে হবে, নতুবা আমাদের নিরাসক্ত থাকতে হবে। তাই সমস্ত ধর্ম্মশাস্ত্র আমাদের নিরাসক্ত থাকতে উপদেশ দেয়।

সব শেষে বলি, দুঃখ থেকে রেহাই পাবার একটা মোক্ষম পথ হচ্ছে প্রার্থনা, প্রাণায়াম ও ধ্যান। সমস্ত দুঃখ চলে যাবে, শুধু মন খুলে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করুন,  বুক ভরে শ্বাস নিন, আর ধ্যানের  মাধ্যমে নিজেকে বিশ্লেষণ করুন। প্রতিটি  কাজে নিজের বুদ্ধি প্রয়োগ করুন।  বিবেকের নির্দেশে কাজ করুন। ভগবান নিজের সন্তানকে কষ্ট দিতে চান না - আমরাই আমাদের দুঃখের জন্য দায়ী। আমরাই আমাদের দুঃখের নিবৃত্তি করতে পারি।

ওম সর্ব্বেসাম স্বস্তির্ভবতু,  ওম সর্ব্বেসাম শান্তিরভবতু,  ওম সর্ব্বেসাম পূর্নম ভবতু,  ওম সর্ব্বেসাম মঙ্গলম্ ভবতু।

যদি প্রশ্ন আসে আমরা কি চাই ? তো কেউ বলবেন, আমি ভগবানকে চাই। কেউ বলবেন, আমি আনন্দ চাই। কেউ বলবেন, আমি ঝামেলা থেকে মুক্তি চাই। কেউ বলছেন, আমার পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো চাই।  কেউ বলছেন, আমি চাকরি চাই। কেউ বলছেন, আমি এই সমাজটাকে পাল্টাতে চাই। কেউ বলছেন, আমার মেয়েটার একটা ভাল পাত্র চাই। কেউ বলছেন, আমি সংসারের আনন্দও চাই, আবার ভগবৎ আনন্দও চাই। তো দেখুন, আমাদের একএক জনের এক রকম চাহিদা। কিন্তু এর মধ্যে একটা জিনিস লক্ষ করুন, সবাই যে যার নিজের জন্য চাইছে।  এর মধ্যে কেউ অন্যের জন্য  কিছু চাইছে না। আর এটাই স্বাভাবিক।  আসলে আমরা সবাই আমাকেই ভালোবাসি। আর আমাকে নিয়েই আমরা চিন্তিত। আমার এক পণ্ডিতমহাশয় একদিন বলেছিলেন, দেখো সবাই কেমন জিততে চায়, আর এই জেতার জন্য সে অন্যকে ঠকাতেও প্রস্তুত। আর যদি ব্যাপারটা ঠিক উল্টো হতো, অর্থাৎ আমরা যদি সবাই সবাইকে জেতাতে চাইতাম, তবে আমরা সবাই জিততে পারতাম। কিন্তু তা আমরা করি না। তাই আমরা সবাই ঠকেই চলেছি।

আসলে আমরা সবাই আমি-আমার গন্ডিতে সীমাবদ্ধ। আর আমাদের চিন্তাও এই আমার জগৎকে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে। কারুর পরিধিটা হয়তো একটু ছোট, কারুর পরিধিটা হয়তো একটু বড়ো। সেটাও আমাকে ঘিরেই আছে।  আমি এই সমাজব্যবস্থায় সন্তুষ্ট নোই, এই সমাজব্যবস্থা আপনাকে কষ্ট  দিচ্ছে।  তাই আপনি সমাজব্যবস্থাটাকে পাল্টাতে চাচ্ছি ।







































   

No comments:

Post a Comment