Thursday 21 November 2019

ভগবানকে পেতে গেলে, ধ্যান করুন, হৃদয়কেন্দ্রে।

ভগবানকে পেতে গেলে 


ভগবানকে পেতে গেলে একটা আধ্যাত্মিক জগৎ তৈরী করতে হবে, নিজের মধ্যে। আর সেই জগতেই ভগবানের আসন পাতবো। পরিবেশ অনেক সময়  ভগবানকে পেতে সাহায্য করে। সময় কাটাবো ভগবানের সঙ্গে।

আমার এক বন্ধু আছে, সে সারাদিন নাকি একাএকা একটা ঘরে  থাকে। বাড়িতে তার স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে আছে। তথাপি সে একা একটা ঘরেই  বেশিরভাগ সময় কাটায়। সেই ঘরেই সে ঠাকুরের আসন পেতেছে। একটা আলমারি আছে, তাতে বই ঠাসা। সারাদিন মুখ গুঁজে আছে বইয়ের মধ্যে।  অথবা ধ্যানে বসে আছে। তো আমি তাকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, তুমি সারাদিন একা একা থাকো কি করে ? সে আমার প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে গেলো।  কেন, একা  কেন ? আমার ঘরে বহু লোক আছে, তুমি তাদের দেখতে পাও না, আমি দেখতে পাই।  তারা আমার সঙ্গে কথা বলে। আমি অবাক হয়ে গেলাম।  পাগল হয়ে গেছে নাকি ? যতদূর  জানি এই ঘরে, কাউকে সে ঢুকতে দেয় না। আমি জিজ্ঞেস করি,  তারা কারা ? সে আলমারির দিকে আঙ্গুল তুলে, বললো - ওই দেখো, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, প্রণবানন্দ, বঙ্কিম , শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়ার, এরিষ্টটল।  এদিকে দেখো, শ্রীকৃষ্ণ, ব্যাসদেব, রামচন্দ্র,  চৈতন্য, হরিচাঁদ, ........আর এই পাশে দেখো, আমার মা-বাবা, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, এদিকে সরস্বতী, মালক্ষ্মী, মহাত্মা গুরুনাথ, সাঁইবাবা,  এক এক করে নাম বলে গেলো। আমি বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
আসলে কি জানো, ওঁরা  সবাই আমার সঙ্গে কথা বলে, আমি ওদের কথা বোঝার চেষ্টা করি। না বুঝতে পারলে, চুপচাপ বসে থাকি। ......তোমরা যাকে ধ্যান বলো। আসলে কি জানো, আমি সৎসঙ্গ করার চেষ্টা করছি। আর এর ফলেই আমাকে বাইরে বেরুতে হয় না। এঁরাও আমাকে বেরুতে দিতে চায় না। তো বলো তুমি কেমন আছো ?
ওর কথা শুনে, আমার মধ্যে একটা অনুভুতি প্রবল হয়ে উঠলো। আমি যে ভিড়ের মধ্যে আছি, সেখানে সবাই সমস্যায় আছে।  আর আর বন্ধুটি যাঁদের সঙ্গে আছে তাঁরা   সবাই সমস্যা কাটিয়ে উঠেছে। আমরা যাদের সঙ্গে আছি, তারা তো সবাই সুখ-দুঃখের দাস। এঁরা  সবাই সুখ দুঃখের অতীত। সত্যিকারের সৎ সঙ্গ  এটি।

ও আমাকে আর একটা সুন্দর কথা বললো, জলে ডুবে যাওয়া মানুষকে বাঁচিয়েছো কোনোদিন ? আমি বললাম, না সে সুযোগ কখনো হয়নি আমার। তো সে বললো - জলে ডুবে যাওয়া মানুষকে বাঁচাতে গেলে, দূর থেকে তাকে সাহায্য করতে হয়।  ডুবন্ত মানুষকে  তুমি ধরো, কিন্তু তোমাকে ধরতে দিও না। তুমি ওর কাছে যেতে পারো, কিন্তু ওকে তোমার কাছে আসতে  দিও না।   কারন কাছে গেলে ডুবে যাওয়া মানুষ বাঁচার জন্য,  তোমাকে সে আঁকড়ে ধরবে। আর এতে করে, তুমিও মরবে, সেও মরবে। তাই ডুবতে যাওয়া মানুষকে দূর থেকে সাহায্য করো। কিন্তু কখনও কাছে যেও না। সংসারের মানুষ নানান সমস্যায় জর্জরিত। এঁরা ঠাকুরের মন্দিরে যায়, সমস্যার সমাধানের জন্য, বাসনার  পূরণের জন্য। এঁরা  বিপদে ঠাকুরকে ডাকে, বিপদ কেটে গেলে, আবার যে-কে সেই। তাই এইসব সংসারী মানুষকে দূর থেকে সাহায্য করো। কখনো তাদের সঙ্গে জড়িয়ে যেয়ো না। তবে সেও মরবে, তোমাকেও মারবে।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।

ধ্যান করুন, হৃদয়কেন্দ্রে।

ভগবানকে পেতে গেলে একটা আধ্যাত্মিক জগৎ তৈরী করতে হবে, নিজের মধ্যে। আর সেই জগতেই ভগবানের আসন পাততে হয় । পরিবেশ অনেক সময়  ভগবানকে পেতে সাহায্য করে। সময় কাটাবো ভগবানের সঙ্গে। এই মানসিকতা নিয়ে আমাকে ধ্যানাবিষ্ট হয়ে থাকতে হবে। আর  আমি যদি ভগবানের ধ্যানে আবিষ্ট থাকতে পারি, তবে, পরিবেশ আমার অনুকূলে চলে আসতে বাধ্য থাকবে।

ধ্যান করুন, হৃদয়কেন্দ্রে। ভগবানের আসন পাতুন, হৃদয়কেন্দ্রে।  প্রাথমিক সাধকদের পক্ষে হৃদয়কেন্দ্রে ধ্যান সবথেকে নিরাপদ, ও প্রশস্ত। যদিও ধ্যান বলতে বোঝায়, জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন। ধ্যান শুরু হয় একাগ্রতা দিয়ে। এখন কিসের উপরে একাগ্র হবো ? ইষ্টদেবতার উপরে একাগ্র হবো।  আমার ইষ্টদেবতাকে কোথায় স্থাপন করবো। হৃদয়ে স্থাপন করবো। এখন কথা হচ্ছে, এই হৃদয় কোথায় ? আর আমার ইষ্টদেবতাই বা কে ? এই ইষ্টদেবতা আর কেউ নন পরম-পুরুষ, পরম-পিতা, পরম-আত্মা, পরম-ঈশ্বর।

হৃদয়কেন্দ্র কোথায় ? আসলে আমাদের ধৈর্য্য ভীষণ কম। এই হৃদয়টা তো আমার, অন্য কারুর নয়। তো যেটা আমার, সেটাকে খুঁজে বার করার দায়িত্ত্বও  তো আমাকেই নিতে হবে।  হৃদয়কেন্দ্র খুঁজে পেতে গেলে, আমাদের শরীর ও মনের যেমন পবিত্রতা চাই, ব্রহ্মচর্য্য চাই।  আর ব্রহ্মচর্য্য মানে শারীরিক ভাবে ব্রহ্মচর্য্য পালন শুধু নয়। ত্যাগ ও তিতিক্ষা অবশ্য়ই প্রয়োজন। ধৈর্য্য ধরে অনুসন্ধান করতে হবে,  তবেই আমরা আমাদের হৃদয়কেন্দ্রকে খুঁজে পাবো। অন্য কেউ আমার  হৃদয়কেন্দ্রকে খুঁজে দিতে পারবে  না।

প্রাথমিক ভাবে সাধককে এটা বুঝে  নিতে হবে যে, হৃদয় বলতে আমরা ফুসফুস দুটোর মাঝখানে যে রক্তমাংসের হৃদযন্ত্র  আছে, এটা সেই  আধ্যাত্মিক জগতের হৃদয়কেন্দ্র  নয় । এই অঞ্চলে যে আকাশ আছে,যেখানে ইথারীয় তরঙ্গ আছে,  সেই অঞ্চলকেই আমাদের  নির্দিষ্ট করতে হবে হৃদাকাশ হিসেবে । এর পরে,  সাধনার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আপনি আপনার হৃদয় খুঁজে পাবেন। কারুর মতে  অনাহত চক্রকে আমরা  এই ভাবনার কেন্দ্র হিসেবে ধরে নিতে পারি । কুণ্ডলিনী শক্তি জাগরণের সময় যেমন আমাদের প্রথমে চেতনকেন্দ্র বা চক্রগুলো সম্পর্কে একটা কাল্পনিক ধারণা করে নিতে হয়, তেমনি হৃদয়কে চিহ্নিত করতে হলে প্রথমে আমাদের হৃদযন্ত্রের সংলগ্ন এই আকাশ বা ইথার-তরঙ্গের প্রবাহিত স্থানকে চিহ্নিত করতে হবে। এই হৃদয়কেন্দ্রেই  ভক্তসাধক ঈশ্বরের সাকার রূপ দেখতে পান।

দেখুন, আমাদের প্রাণবায়ুর সঙ্গে চেতনার ওতপ্রোত সম্পর্ক আছে । তো এই প্রাণবায়ু আমাদের হৃদয়কেন্দ্রে ঘোরাফেরা করে। অতএব এই প্রাণবায়ুকে বিশ্লেষণ করলে, আমরা  চৈতন্যকে ধরতে পারবো । তবে, সেখানে চেতনার মাত্রা কম থাকায়, আমরা প্রথমে ধরতে পারি না।  দুধের সঙ্গে মাখন মিশে আছে। প্রথমে এটি আমাদের কাছে শোনা কথা, কিন্তু যখন আপনি দুধকে নাড়াচাড়া শুরু করবেন , ধীরে ধীরে আপনি বুঝতে পারবেন, মাখন উঠে আসছে। ঠিক প্রাণবায়ুর দিকে যত গভীর পর্যবেক্ষন ক্রিয়া করবেন, তখন আপনি চৈতন্যকে  ধরতে পারবেন। আমাদের উর্জ্বা শক্তি যেমন সমস্ত শরীরে ব্যাপৃত , তেমনি আমাদের চেতন শক্তিও সমস্ত শরীরে ব্যাপৃত। এবং ঠিক এই কারণেই, আমাদের সমস্ত শরীরেই স্পর্শ-চেতনার অনুভব করি। এমনকি এই চেতনাকে  আমরা আমাদের মনোময় দেহেও  অনুভব করি। আমরা জানি আমাদের মানসিক শরীর হচ্ছে সূক্ষ্ম উপাদানে তৈরী। আমাদের এই মন যখন চেতনার স্পর্শ পায়, কেবলমাত্র তখনই সে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। চেতনাবিহীন পদার্থ অর্থাৎ হাড়-মাংসের এই শরীর, এমনকি আমাদের মন  কেবলমাত্র চেতনার স্পর্শেই সজীব হয়ে উঠতে পারে ।

আমাদের ধ্যান এই হৃদয়-আকাশেই করতে হবে। আমাদের হৃদযন্ত্রের আশেপাশে যে আকাশ বা শূন্যস্থান রয়েছে, তা আমাদের স্থুল  শরীরে বা মনোময় শরীরে অনুপ্রবিষ্ট বিশাল আকাশের অংশ মাত্র। আর এটাই জীবাত্মার আসন। এখানেই তিনি সদা অবস্থান করছেন। আবার এটাও  বলা যেতে পারে, পরম-আত্মার প্রতিফলিত ক্ষেত্র এই হৃদাকাশ । এই আকাশ আমাদের হৃদয়স্থলে থাকলেও, বিশাল আকাশ থেকে একে পৃথক করা যায় না। ঠিক যেমন এর মধ্যে যে চৈতন্য শক্তি আছে, তাঁকেও পরম চৈতন্য থেকে আলাদা করা যায় না। এই অনন্ত চৈতন্য সর্বত্র সবার ভিতর অনুস্যুত হয়ে আছে। তা সে মাটি, জল, আগুন, আকাশ, বাতাস, এমনকি আমাদের চক্ষু, কর্ন, নাসিকা,জিব্বা, ত্বক, আবার মন, চিত্ত, বুদ্ধি, অহংকার - তিনি সবার ভেতরেই অণুমাত্র হয়ে অবস্থান করছেন। তিনিই আমাদের অন্তরস্থ নিয়ন্তা - অমর জীবাত্মা।

কিন্তু কথা হচ্ছে, অধ্যাত্ম সাধক সেটা উপলব্ধি করবেন  কি ভাবে ? সেই মোক্ষম উপায় হচ্ছে ধ্যান। ধ্যান একটা অনুসন্ধান ক্রিয়া।  যার মাধ্যমে আমাদের অনুভূত হবে, প্রতক্ষ্য চৈতন্য শক্তি।

বেদান্ত বলছে , আত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই। আমাদের মধ্যে যেমন হৃদয়- আকাশ আছে, ঠিক তেমনি  বিশ্ব-হৃদয়েও আকাশ আছে।  আর সেই একই আকাশ আমাদের মনময় শরীরে এমনকি বিশ্ব শরীরে অনুস্যূত হয়ে আছে। এই একই চৈতন্য শক্তি যেমন জীবাত্মায় আছেন, তেমনি আছেন পরমাত্মায়।  সব রূপের মধ্যেই তিনি বিদ্যমান। তিনি যেমন ব্যষ্টি রূপে আছেন, তেমনি সমষ্টি রূপে নিজেকে  প্রকাশিত করে সদা বিদ্যমান। ব্যষ্টি আত্মার বা জীবাত্মার আবাস এই হৃদয়-আকাশ। আবার পরম-চৈতন্যের আবাস এই জীবাত্মার মধ্যে। আসলে জীবাত্মা হচ্ছে  পরমাত্মার অংশ। তাই জীবাত্মা কখনোই পরম-আত্মা ভিন্ন থাকতে পারে না। সাগরের ঢেউ, সাগরের বুদ্বুদ কখনোই সাগর ছেড়ে থাকতে পারে না। সূর্য্যের রশ্মি কখনো সূর্যকে ছেড়ে থাকতে পারে না। তাই অনন্ত-আকাশ না থাকলে, আমাদের হৃদয়-আকাশেরও কোনো অস্তিত্ত্ব থাকতে পারে না। জীবাত্মা ও পরম-আত্মা অবিচ্ছেদ্দ। এই দুই চৈতন্য আলাদা  নয় এক। এটা আমাদের ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হবে।

তাই আমরা যখন হৃদয়কেন্দ্রে গভীর ভাবে মনোনিবেশ করবো, তখন এই হৃদয়-আকাশে যে পরম-চৈতন্য অবস্থান করছেন, সেটাও আমাদের দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস ও অনুভব করবার চেষ্টা করতে হবে।
অনন্ত কখনো সান্ত হতে পারে না। অনন্ত থেকে কোনো কিছুই বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। তাই সেই অনন্তই আমাদের হৃদয়-আকাশে বর্তমান।  এর কোনো অন্যথা হতে পারে না। জ্ঞানালোক যেমন আমার মধ্যে, তেমনি একই জ্ঞানালোক সমগ্র বিশ্বে ব্যাপ্ত হয়ে আছে। আমাদের এই শরীর তো ব্রহ্মের আবাস-স্থল। আমাদের শরীর হচ্ছে ব্রহ্মপুর। তাই আমি যেটুকু চেতনার উপলব্ধি করছি বা করতে পারছি, সেই চেতনশক্তিকে আমাদের বিশ্ব চেতন শক্তির সঙ্গে লিন করে দিতে হবে। এইসব কথা প্রথমে আমাদের কাছে কল্পনা বলে মনে হবে। এবং সাধনার প্রথম দিকে এই কল্পনার সাহায্যেই এগুতে হবে। কিন্তু সাধনা যত  গভীর হবে, তত আমরা উপলব্ধি করবো, এগুলো কোনোটাই কল্পনা নয়। সবই সত্য। গভীর নিষ্ঠা, ধৈর্য্য, ত্যাগ, ও আধ্যাত্মিক অনুশীলন আমাদের এই চরম সত্যের কাছে উপস্থিত করে দেবে।

সবশেষে বলি, ধ্যান মানে, সেই এক অখন্ড সত্ত্বাকে  অগ্রাধিকার দেওয়া। আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনের শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, নিজেকে নৈতিক ভাবে উন্নত করা, পবিত্র করা  - এগুলো আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনের উপাদান। আর এই উপাদানের সাহায্যেই আমরা সিঁড়ি করে নেবো। আর এই সিঁড়ি বেয়ে  পৌঁছে যাবো আমাদের লক্ষে। হৃদয়-আকাশে আমাদের সাথে মিলন হবে পরম-আত্মার সঙ্গে।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।    

No comments:

Post a Comment