Wednesday 6 November 2019

স্থুল মানব দেহ-ভাণ্ড ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ড HUMAN BODY & SPACE

স্থুল মানব দেহ-ভাণ্ড ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ড HUMAN BODY & SPACE

মানবদেহ এক বিস্ময়। কত যে কারিকুরি আছে এই দেহে, তার ইয়ত্ত্বা নেই। বিজ্ঞান এখনো দেহের সমস্ত অঙ্গের কার্যকারিতা সম্পর্কে অবহিত নয়। আবার আমাদের এই স্থুল দেহই চৈতন্যের আবাসস্থল। তাই আমাদের এই মনুষ্য জীবন ও মানুষের এই স্থূল দেহ আমাদের সাধনার মূল আশ্রয়। বহু জন্ম অতিক্রান্ত করে, লক্ষ লক্ষ যোনি ভ্রমণের পর আমরা এই মনুষ্যদেহ প্রাপ্ত হয়েছি। একমাত্র মনুষ্যদেহেই আমাদের কর্ম্মফল সঞ্চিত হয়। তাই আমরা সবাই আবার মনুষ্যদেহ প্রাপ্ত করতে চাই।
মনুষ্যদেহ ভিন্ন সাধন সম্ভব নয়। তাই মানব জীবন  আমাদের কাছে, অতি মূল্যবান। আমাদের এই দেহকে ভালো করে জানতে হবে। আমরা জানি আমাদের এই  দেহ কতকগুলো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সমাহার মাত্র । এই দেহকে শারীরবিদগন এক রকম ভাবেই  দেখেছেন।  অধ্যাত্ম পথের  পথিকরা এই দেহকে অন্য ভাবে দেখেছেন। তারা মনে করেন, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অনুরূপ একটি ব্রহ্মান্ড, হচ্ছে আমাদের এই দেহ । আমরা আজ সেই কথাই  শুনবো।

বাউল লালন ফকির বলছেন :
দেব-দেবতাগন / করে আরাধন / জন্ম নিতে মানবে।।
কত ভাগ্যের ফলে না জানি / মন রে পেয়েছো এই মানব তরণী।
বেয়ে যাও ত্বরায় সুধারায় / যেন ভারা  না ডোবে।।
এই মানুষে হবে মাধুর্য-ভজন / তাইতো মানুষরূপ গড়লে নিরঞ্জন।
এবার ঠকলে আর না দেখি কিনার / অধীন লালন তাই ভাবে।।

বেশিরভাগ ধর্ম্মপ্রান মানুষ অল্পবিস্তর যোগের ক্রিয়া করে থাকেন। অর্থাৎ তাঁদের সাধনকেন্দ্র এই দেহ। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, জৈন, মুসলমান, সবাই কিঁছু না কিছু শারীরিক ক্রিয়া অবশ্য়ই করে থাকেন। অর্থাৎ দেহের মাধ্যমেই আমাদের সাধন ভজন।  আমরা সবাই মনে করি, ঈশ্বর যেমন বাইরে আছেন  বৃহৎ আকারে, তেমনি আমাদের দেহে আছেন  সূক্ষ্ম আকারে। এই দেহের মধ্যেই আছেন পরমতত্ত্ব, বা পরমাত্মা। দেহের বাইরে যেমন আছে পঞ্চতত্ত্ব, সপ্তলোক, নদী, সাগর, দ্বীপ, পর্বত। তেমনি আমাদের শরীরকে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ বলে কল্পনা করা হয়েছে। তাইতো একটা প্রচলিত কথা আছে যে, যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাই আছে এই দেহ-ভান্ডে।

আমরা জানি আমাদের মেরুদণ্ডকে আশ্রয় করে, ছটি চক্র আছে। এর মধ্যে সবথেকে নিচে, যে মূলাধার চক্র আছে সেখানে কুণ্ডলিনী শক্তি, অর্থাৎ সৃষ্টিশক্তি সুষুপ্ত অবস্থায় আছেন। এই কুণ্ডলিনীকে প্রাণ-অপান বায়ুর সাহায্যে ক্রিয়া দ্বারা  জাগ্রত করে, সুষুম্নার ভিতর দিয়ে উর্দ্ধগতি করাতে পারলে, সেই বায়ু সূক্ষ্ম অবস্থায় সহস্রারে অর্থাৎ পরমশিবের সাথে মিলিত হন । মানুষ তখন, ত্রিগুণাতীত ব্রাহ্মীস্থিতি লাভ করতে পারেন ।

তাই দেহকে অবলম্বন করেই সাধনা। তা সে হিন্দু, বৌদ্ধ, তান্ত্রিক, যোগী, বৈষ্ণব, বাউল, সুফি, যাই বলুন না কেন, সবাই এই দেহকে অবলম্বন করেই সাধনা করছেন। আমরা সবাই  জানি, পঞ্চভূতের এই দেহ। এই পঞ্চভূত কি ভাবে আমাদের দেহে অবস্থান করছেন দেখুন।

ক্ষিতি অর্থাৎ কঠিন পদার্থ বা পৃথিবী : আমাদের শরীরে, অস্থি, চর্ম, নাড়ী, লোম ও মাংস এই পাঁচটি পৃথিবীর গুন্, বা বিকার অবস্থা।
অপ অর্থাৎ তরল পদার্থ বা জল : মল, মূত্র, শুক্র, শ্লেষ্মা ও শোনিত - এই পাঁচটি হচ্ছে জলের গুন্।
তেজ অর্থাৎ তাপ বা অগ্নি : ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা, মোহ, ক্ষান্তি (ক্ষমা বা তিতিক্ষা) - এই পাঁচটি হচ্ছে তেজের গুন্।
মরুৎ  অর্থাৎ বায়বীয় পদার্থ বা বাতাস  :  বিরোধ, আক্ষেপন, আকুঞ্চন, ধারণ ও তৃপ্তি - এই পাঁচটি হচ্ছে বায়ুর গুন্।
ব্যোম অর্থাৎ বিশাল বা আকাশ : রাগ, দ্বেষ, মোহ, ভয় ও লজ্বা - এই পাঁচটি হচ্ছে আকাশের গুন্।

পঞ্চভূতের মধ্যে বায়ু প্রধান।  তাই আমরা বায়ু সম্পর্কে এবার আমরা আরো একটু গভীরে যাবো। বায়ু দশ রকম বা বায়ুর দশটি গুন্ - প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান (এগুলো অর্থাৎ এই পাঁচটি  আমরা জানি ) এছাড়া আছে, নাগ, কূর্ম, কৃকর অর্থাৎ কয়ার পাখি, দেবদত্ত্ব( দেবতাদের কর্তৃক প্রদত্ত্ব ) ও ধনঞ্জয় (যিনি ধনকে জয় করেছেন)। এই মোট দশটি বায়ুর গুন্। প্রাণবায়ু আমাদের হৃদয়ে অবস্থিত। অপান আমাদের গুহ্যদেশে। নাভিদেশে আছে সমান, কন্ঠে উদানবায়ু, এবং সর্বশরীরে ছড়িয়ে আছে ব্যানবায়ু। এই পাঁচটি বায়ু প্রধান।  নাগ, কূর্ম, কৃকর, দেবদত্ত্ব ও ধনঞ্জয় - এগুলো আমাদের নাড়ীতে অবস্থান করে। অর্থাৎ আমাদের শরীরে যে ৭২০০০ নাড়ী  আছে, তার মধ্যে অবস্থান করে।  তবে প্রধানত পাঁচটি নাড়ী অর্থাৎ ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, বজ্রাক্ষ্যা ও চিত্রাণি এই পাঁচটি নাড়ীতে অবস্থান করে। কেউকেউ বলে থাকেন, ললাট, উরঃ, স্কন্ধ, হৃদয়, নাভি, ত্বক ও অস্থিতে এই পাঁচ নাগাদি বায়ু অবস্থান করে।

আমরা যে সাতটি তল ও  লোকের কথা জানি, সেগুলোর অবস্থান এই রকম :
লোক :ভূর্লোক  নাভিদেশে, ভুবর্লোক হৃদয়ে, স্বর্লোক আমাদের কন্ঠে, মহর্লোক আমাদের চক্ষুদ্বয়ে।  ভ্রূদ্বয়ে আমাদের জনলোক, ললাটে তপোলোকে, সহস্রারে সত্যলোক।
তল:তল সাতটি।  তাদের অবস্থান এই রকম : পাদের আধোভাগ হচ্ছে অতল, পাদের উর্ধভাগ হচ্ছে বিতল।জানুদ্বয়ে সুতল, সন্ধি-রন্ধ্রে হচ্ছে তল, গুদমধ্যে বা গুহ্যমধ্যে তলাতল, লিঙ্গমূলে রসাতল,পাদের অগ্রভাগ ও কটির সন্ধি-স্থলে পাতাল।
পর্বত :আমাদের মূলাধার চক্রে একটা ত্রিকোণ কল্পনা করা হয়েছে। এটি পর্বতের বিশেষ অবস্থান কেন্দ্র। ত্রিকোণের উর্দ্ধকোনে  মন্দর  পর্বত। ডানকোনে কৈলাশ পর্বত। বামকোনে হিমালয়। এছাড়া ত্রিকোণের উর্ধভাগে বিন্ধ্য ও বিষ্ণু পর্বত। এছাড়া আছে ত্রিকোণে মেরু পর্বত। এই মোট সাতটি পর্বতের অবস্থান কেন্দ্র।
দ্বীপ :আমাদের দেহের অস্থিতে অবস্থান করছে জম্বুদ্বীপ, মাংসে কুশদ্বীপ, শিরা সমূহে ক্ৰৌঞ্চদ্বীপ, রক্তে আছে শাকদ্বীপ।  আমাদের শরীরের উর্ধভাগে সমস্ত সন্ধিদেশে শাম্বলি দ্বীপ, লোমপূর্ন স্থানে প্লক্ষদ্বীপ এবং নাভিতে পুস্কর দ্বীপ।
সমুদ্র :লবন সমুদ্র আমাদের মূত্র। শুক্র হচ্ছে ক্ষীরোদসাগর। মজ্জা হচ্ছে দধিসাগর। চর্ম হচ্ছে ঘৃতসাগর। বসা অর্থাৎ আমাদের অবস্থিতি বা আধার হচ্ছে  জল সাগর। কটিরক্তে ইক্ষুসাগর। এবং শোনিতে সুরাসাগর অবস্থিত।
গ্রহ :নাদচক্রে সূর্য অবস্থিত। বিন্দুচক্রে চন্দ্র। মঙ্গল আছে আমাদের চক্ষুতে। হৃদয়ে আছে বুধ।  পেটে বা উদরে আছে বৃহস্পতি। শুক্রে আছে শুক্রগ্রহ। নাভিচক্রে শনি, মুখে আমাদের রাহু আর নাভিতে কেতু।

ঈশ্বরের প্রকাশ স্বরূপ এই ব্রহ্মান্ড। আর এই ব্রহ্মান্ডের ক্ষুদ্র সংস্করণ হচ্ছে আমাদের এই মানবদেহ। এর মূল্যশুধু  অসীম নয়, এটি একটি দুর্লভ বস্তূ। আমরা কেবল বাইরে আমার স্বামীকে খুঁজছি। স্বামীতো ঘরেই আছেন। অশরীরী আমাদের শরীরেই লুকিয়ে আছেন। এই দেহের মধ্যেই গঙ্গা-যমুনা। এখানেই মিলনক্ষেত্র গঙ্গাসাগর। এখানেই প্রয়াগ, হরিদ্বার, বারাণসী। এটাই তীর্থক্ষেত্র। এটাই পীঠস্থান। রত্নসার বলছে :
ভান্ডকে জানিলে জানি ব্রহ্মাণ্ডের তত্ত্ব।
ভান্ড বিচারিলে জানি আপন মাহাত্ম।

বহু ধর্মমতে আমাদের এই দেহের মধ্যেই ঈশ্বরের বাসস্থান কল্পনা করা হয়েছে। এটা  শুধু কল্পনা নয়, এটি বাস্তব সত্য। প্রথম দিকে এই কল্পনা নিয়ে এগুতে হয়। ক্রমে ক্রমে এই সত্য সাধকের উপল্বদ্ধিতে আসে। এমনকি কিছু কিছু সূক্ষ্মতত্ত্ব সামনে আসে, যখন মনে ঈশ্বর সম্পর্কে দৃঢ়তা আসে। এমনকি ঈশ্বরের সঙ্গে একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রতিনিয়ত ঈশ্বরের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। সমস্ত সাধনাই আত্মউপলব্ধির সাধনা। এবং একমাত্র দেহকে অবলম্বন করেই আমরা স্থূল থেকে সূক্ষ্মে অগ্রসর হয়ে, সবশেষে আত্মার স্বরুপত্বে পৌঁছানো যায়। স্থুল থেকে সূক্ষ্মে অগ্রসর হওয়া মানে, সৃষ্টিধারার বিপরীত গতিতে অগ্রসর হওয়া। জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন দুটো ভাবে হতে পারে, এক যদি পরমাত্মা স্বেচ্ছায় জীবাত্মার কাছে আসেন, আর জীবাত্মা যদি তার গতি পরমাত্মমুখী করেন। তো দেহের সাধন দ্বারা  মানুষের সহজাত স্বাভাবিক অবস্থা লাভ করা। এই অবস্থাতেই মানুষ ব্রহ্ম-স্বরূপত্ত্ব লাভ করে। তাই তন্ত্রমতে চক্রভেদ, বা পাতঞ্জল মতে অষ্টাঙ্গ যোগাভ্যাস, বেদান্তের পঞ্চকোষ-বিবেক  সাধন, বৌদ্ধদের কায়-বাদ, বৈষ্ণবদের ভক্তিসাধন, বাউলদের সহজিয়া সাধন, মূলত একই পথের প্রকারভেদ মাত্র। তাই লালন বলছেন, একবার আপনারে চিনলে, পরে যায় অচেনারে চেনা।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম। 



No comments:

Post a Comment