Thursday 1 August 2019

আত্মার খোঁজে

আত্মার খোঁজে 

ওম সহ নাববতু সহ নৌ ভুনক্তু। সহ বীর্যং করবাবহৈ। 
তেজস্বি নাবধিতম অস্তূ মা বিদ্বিষাবহৈ।। 
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।।
আত্মার খোঁজে (১)
মানুষের আসা যাওয়া আত্মা ভিন্ন সম্ভব নয়।  তাই আমরা আজ আত্মার সন্ধানে যাবো।
কঠোপনিষদ -এর যমরাজ ও নচিকেতার কাহিনী আমাদের সবার জানা। তো কাহিনীতে নচিকেতা নামে  এক কিশোর মৃত্যুরাজ্যে গিয়ে যমরাজকে তিনটি প্রশ্ন করেছিলো। তার মধ্যে শেষ প্রশ্নটি ছিল আত্মার অস্তিত্ত্ব-অনস্তিত্ত্ব সম্পর্কে। হাজার বছরের পুরাতন এই প্রশ্ন আমাদের সবার মনে আজও  জাগে । আমরা মারা গেলে এই দেহটি পুড়িয়ে বা কবর দিয়ে দেওয়া হবে। পঞ্চভূতের তৈরি এই রক্ত-মাংসের এই দেহ পঞ্চভূতে মিশে যাবে। তা হলে আমি বলে কিছু থাকে কি ? আমি বলে যদি কিছু না থাকে তবে শ্রাদ্ধশান্তি - কার্য্যের কি দরকার ? আর  পরজন্ম বা স্বর্গ-নরক বলে কিছু থাকে কি ?

আসলে আমরা কেউ মরতে চাই না। এবং সেই কারণেই আমরা বিশ্বাস করি, মৃত্যুর পরেও আমরা বেঁচে থাকবো। তাই মৃত্যুর পরেও আমার অস্তিত্ত্ব আছে, এটা প্রমান করবার জন্য, আমরা উঠে পরে লেগে আছি। কিন্তু সত্য কি ? সেটা আমাদের জানতে হবে।

মহাভারতের যুদ্ধের পরে, ব্যাসদেবের কাছে ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী তার মৃত পুত্রদের দেখতে চেয়েছিলো। ব্যাসদেব তাদের দেখিয়েছিলেন। এবং মৃত্যুকালীন চেহারায় তারা দেখা দিয়েছিলো। সত্যিই কি এটা সম্ভব ? সাহিত্যে অনেক কাল্পনিক গল্প থাকে, এটা সত্য। আর আমার কাছে এটাও সত্য যে মানুষ যা কিছু কল্পনা করে, বা চিন্তা-ভাবনা করে, তার সবকিছুর প্রতিচ্ছবি  এই জগতে বর্তমান। তাই এই ঘটনা আমার কাছে কল্পনা নয়, সত্য।

আবার একটা প্রশ্ন আমার মধ্যে জাগে, সেটা হচ্ছে মানুষ বা জীবজন্তু যদি মারাই যাবে, তবে আর জন্ম নেওয়া কেন ? আর এত দুঃখ-কষ্ট কেন ? ঈশ্বর যদি আনন্দময় হন , তবে আমাদেরকে চিরজীবী করে আনন্দের মধ্যেই তো রাখতে পারতেন। কেন তিনি তা করেন না।

মারা যাবার পরে আমরা কি চেতন থাকি ? অর্থাৎ মৃত্যু পরবর্তী জগৎ সম্পর্কে কি মৃত্যুর পরে আমরা সবাই জানতে পারবো ? জাগতিক সুখ ক্ষণস্থায়ী। জাগতিক সুখ খুবই স্বল্প-স্থায়ী।  এমনকি আমাদের যে জীবন-পরিসর, অর্থাৎ ৮০-১০০ বছর, তার মধ্যেও  স্বল্পক্ষনই মাত্র মানুষ সুখে থাকে।এর থেকে আরো বড় সত্য হচ্ছে, আমাদের সুখ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে আমরা আইঢাই করি।  যাকে সোজা বাংলায় বলে, সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়। তাই সুখ আমাদের সয় না।

মৃত্যু কেন নির্ধারিত সত্য।  এর অন্যথা হয় না কেন ? ইত্যাদি ইত্যাদি নানান প্রশ্ন আমাদের সবার মনে উঁকি দেয়। আমরা এই সব প্রশ্নের জবাব খুঁজবো।

প্রথমে বলি, মৃত্যুর পরে আমরা সবাই বা আমাদের সবার আত্মা মৃত্যু পরবর্তী জগৎ সম্পর্কে সচেতন থাকে এমন নয়। স্বল্প সংখ্যাক আত্মার এই উপলব্ধি থাকে। বাকিরা ঘোর তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় কাল অতিবাহিত করে। তাই যদি হয় তবে আমরা যারা এই দেহে অবস্থান করছি, তারা কি করে আমাদের মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারবো ?

নচিকেতার গল্পের একটা দিক খেয়াল করুন, নচিকেতা যমরাজের কাছে গেছে, অর্থাৎ এখন তার মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা। দ্বিতীয়তঃ দেখুন, তার জিজ্ঞাসায় সে অটল। হাজার বছর বাঁচার আয়ু, অঢেল ধনসম্পত্তির লোভ সে ত্যাগ করেছে। অর্থাৎ যারা উচ্চ শুদ্ধজ্ঞানে পৌঁছুতে পেরেছেন, যারা পরা-চৈতন্যের স্তরে উপনীত হয়েছেন, একমাত্র তারাই এই জ্ঞানের অধিকারী। তাই মৃত্যুর পর আমাদের কি হবে, বা আমরা মৃত্যুর পরে কি হবো অর্থাৎ আমরা সত্যি সত্যি থাকবো কি না, বা সত্যি সত্যি আমাদের আত্মা বলে কিছু আছে কি না, বা আমরা সত্যি আত্মা কি না, নাকি অন্য কোনো মিশ্র বস্তু, , নাকি কিছুই নয়, তা জানতে গেলে আমাদের পরাচৈতন্য-স্তরে পৌঁছতে হবে। নতুবা আমি যা বলবো, তা আপনার কাছে স্পষ্ট হবে না। এমনিতে যাকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, তাকে ভাষার মধ্যে আবদ্ধ করা মানে অসীমকে সীমাবদ্ধ করা। এইজন্য একাজে দরকার সৎগুরু। যিনি আপনাকে একমাত্র উপলব্ধি দিতে পারেন, বা বলা যেতে পারে, ব্যাসদেবের মতো দিব্যদৃষ্টি দিতে পারেন।

এখন আমরা যমরাজ কি বলেছিলেন, সেটা আমরা একটু দেখে নেই।

যমরাজ বলছেন,  পথ দুটি একটা প্রেয় আর একটা শ্রেয়। প্রেয় অর্থাৎ যে পথে গেলে আমরা প্রিয় বস্তুকে পেতে পারি। আর একটা পথ হচ্ছে শ্রেয় অর্থাৎ যে পথে গেলে আমরা শ্রেষ্ট বস্তুকে পেতে পারি। যদিও এদুটোই বন্ধনের  কারন। অর্থাৎ আপনি ভালো কাজ করলে অর্থাৎ ভালো পথে গেলে আপনার ভালো ফল হবে, আর আপনি খারাপ কাজ করলে খারাপ ফল হবে। ফল দুটোতেই হবে। আর ফল হলে তা ভোগ করবার জন্য আপনাকে আবার পুনরায় জন্ম গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ কর্তা জ্ঞান যতক্ষন আছে, ততক্ষন আমাদের কর্মফল ভোগ করতেই হবে।

বিদ্যা দুই রকম জাগতিক ও আধ্যাত্মিক। একটি জাগতিক বিষয়ের উপরে জ্ঞান আর অপরটি আত্ম বিষয়ে জ্ঞান। জাগতিক বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করে মানুষ বৈষয়িক  উন্নতি করতে পারে। আর আধ্যাত্মিক বিষয়ের জ্ঞানের দ্বারা মানুষ নিজের উন্নতি করতে পারে। এখন জাগতিক বিষয়ের জ্ঞান, বা তার প্রয়োগগত ফল, আপনার মৃত্যুর পরেও  এই ইহ জগতের কাজে লাগতে পারে, কিন্তু আপনার নয়। কিন্তু আধ্যাত্মিক জ্ঞান আপনার মৃত্যুর পরেও কাজে লাগতে পারে। এখন কথা হচ্ছে,  পরলোক বলে কিছু আছে কি না, সেই জ্ঞান আমাদের মতো যাদের  নেই, তাদের কাছে এই জ্ঞান অর্থহীন। আর সেই আমরাই এই পৃথিবীটাকে ভরাট  করে রাখি।  অর্থাৎ আমরা জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবদ্ধ হয়ে বার বার ফিরে ফিরে আসি। আর মৃত্যু যন্ত্রনা ভোগ করি।

আত্মা সম্পর্কে কথা বলার লোকের অভাব। তাই আমাদের আত্মা সম্পর্কে শোনার সুযোগ নেই। আবার যে সব ভাগ্যবান শোনার সুযোগ পান, তারা শুনেও এর তাৎপর্য বুঝতে পারেন না। একমাত্র ব্রহ্মজ্ঞানী এই আত্মা সম্পর্কে জানেন। যুক্তি তর্কের দ্বারা আত্মাকে জানা যায় না। যাদের সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি আছে, তারাই আত্মাকে আচার্য্যের কাছ থেকে জানার অধিকারী হন। প্রতক্ষ্য উপলব্ধি ছাড়া আত্মাকে জানা যায় না। আত্মাকে জানতে গেলে বিষয়তৃষ্ণাকে ত্যাগ করতে হবে। যজ্ঞ-ফলের আশা ত্যাগ করতে হবে। আত্মা রয়েছেন হৃদয়ের গভীরে,ইনি ইন্দ্রিয়-গোচর নন। কঠোর আধ্যাত্মিক অনুশীলনের দ্বারা আত্মাকে উপলব্ধি করা যায়।

যেমন ভাবে আমরা বাইরের বস্তুকে দেখি তেমনভাবে আত্মাকে দেখা যায় না। দেখতে গেলে দুটো জিনিস লাগে এক : দৃশ্য ও দুই : দ্রষ্টা। এক্ষেত্রে দ্রষ্টা ও দৃশ্যবস্তু আলাদা নয়। যতক্ষন আত্মা নিজেকে সাধকের নিজের স্বরূপ প্রকাশ না করেন,  ততক্ষন আত্মাকে কেউ দেখতে পান না। এযেন  আয়নাতে নিজেকে দেখা। পরিষ্কার আয়না না হলে, নিজেকে স্পষ্ট দেখা যায় না। ইন্দ্রিয়সুখ থেকে নিজেকে পুরুপুরি  গুটিয়ে নিতে পারলে আমাদের চিত্তশুদ্ধি হয়। তখন সেই স্বচ্ছ মনে আত্মা নিজেকে ধরা দেন। আমাদের মন কামনা বাসনায় পরিপূর্ন।  বিষয় থেকে মনকে নিয়ে গিয়ে যদি আত্মাতে সমাহিত করা যায়, তবে মন শান্ত হয়, একেই বলে চিত্তশুদ্ধি।  চিত্তশুদ্ধি হলে জ্ঞান আপনা আপনি ফুটে ওঠে।

আমরা মনের আলোচনার সময় শুনেছিলাম, মন আর কিছু নয় আমাদের বিভিন্ন স্নায়ুকেন্দ্রের ক্রিয়া। এক একটা স্নায়ু কেন্দ্রে এক এক রকম ক্রিয়া সংগঠিত হয়। নিচের তিনটি কেন্দ্রে অর্থাৎ মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মনিপুরে যে ক্রিয়া সম্পাদিত হয় তা আমাদের সাধারণ জীবনের ক্রিয়া। অনাহত চক্র  থেকে এই  আত্ম-উপলব্ধি শুরু হয়। অর্থাৎ অনাহত -বিশুদ্ধি,-আজ্ঞা, ও সহস্রার এই সব স্নায়ু কেন্দ্রে  যখন আমাদের মন নিবিষ্ট হয়, তখন আমরা আত্মার প্রতিফলন অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পাই, এটাই উপলব্ধি। এই আত্মাকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

আমার এক অকালপক্ক বন্ধু, ছোটবেলায় ভারত সেবাশ্রমের এক শিক্ষক  স্বামীজিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, স্বামীজী  ঈশ্বর কেমন ? তিনি বলেছিলেন, দেখো বাবা তোমরা আমার সন্তানের মতো,  এইসব প্রশ্নের কোনো জবাব হয় না।  তবু বলি, যে কোনোদিন ঝাল খায় নি তাকে ঝাল কেমন তা কি ভাষায় দিয়ে বোঝাতে পারা  যায় ?  যায় না, তবে কি করতে হয় ? তার জিভে লঙ্কা ঘষে দিতে হয়। তবে সে হাড়ে  হাড়ে   বুঝতে পারে ঝাল কেমন। ঈশ্বর কেমন তোমরা যখন ঈশ্বর দেখার উপযুক্ত হবে, তখন বুঝবে ঈশ্বর কেমন।

আত্মা উপল্বদ্ধির বস্তূ, এঁকে  ভাষা দিয়ে বোঝানো যায় না।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি  ওম।

আত্মার খোঁজে (২)

আমরা কিছু বয়স্ক মানুষ প্রতিদিন সন্ধ্যে বেলা মিলিত হই। সেখানে একদিন  মৃত্যুর পরে মানুষের কি হয়, সেই আলোচনা হচ্ছিল, আমাদের এক  মিত্র বললো : মৃত্যুর পরে, মানুষের আর কিছু থাকে না। হাওয়ায়  মিলিয়ে যায়। আমি এসব আত্মা-ফাত্মায়  বিশ্বাসও করি না। আর এসব জেনে কোনো লাভ নেই। মিত্র, ব্যাঙ্কে অফিসার ছিল। অবসরকালীন টাকা আছে, আছে পেনশন, একমাত্র ছেলে, ভালো চাকরি করে।   বৈষয়িক মানুষ, বাড়িতে পূজাঅর্চনা করে। তারকেশ্বরে প্রায়ই পুজো দিতে যায়। বাড়িতে শ্রীকৃষ্ণ-শিবঠাকুর-লক্ষ্মী ইত্যাদি ঠাকুরের পুজোও করে, ভক্তি সহকারে। বিশেষ করে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো বেশ ঘটা  ক'রে করে। এই কয়দিন আগে বাড়িতে বাবার মৃত্যুদিন উপলক্ষে গীতাপাঠের আয়োজন করেছিল। ওর বাবা নাকি প্রতিদিন গীতাপাঠ করতো।

কিছু মানুষের ভোগে আনন্দ, ব্যতিক্রমী কিছু মানুষ আছেন, যারা ত্যাগে আনন্দ পান । আমরা সাধারণ মানুষেরা মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে, মনোযোগ না দিয়ে খেয়েপরে সুখে কাটিয়ে দিতে চাই। তাইবাঞ্চিত  বস্তূ পাবার জন্য, আমরা দেবদেবতার পুজো করি। ঠাকুর কাছে মানত করি, । মৃত্যুর পরে  কি হবে সেই চিন্তা করে সময় নষ্ট করতে চাই না। মৃত্যুর পরে মৃত্যুই আমাদের ভার নেবে। তাই তার জন্য মাথা ঘামাই না। খাই-দাই সুখে থাকি, এই হলো আমাদের মনোবৃত্তি।

কিন্তু স্বল্প সংখ্যক মানুষ আছেন, যারা ভয়ে হোক বা সংসারের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে হোক,অথবা অন্তরের ডাকে হোক, তাদের  স্বাভাবিক জীবনের শান্তি ভঙ্গ করে, এই জানার স্পৃহা । মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগায়, মৃত্যুর পরে আমাদের কি পরিণতি হবে ?

বর্তমানে  আমরা যার উপরে নির্ভর করছি, তা সে বিষয়-সম্পত্তি বলুন, আর আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব বলুন, তা  একসময় আমাদের হাত থেকে চলে যাবে। মা-বাবা- চলে গেছেন, ভাই-বোন-বন্ধুবান্ধবও এক এক করে চলে যাওয়া শুরু করেছে। দিনে দিনে আমরা সবাই একা হতে চলেছি । এমনকি  এই সাধের শরীরও আর সাধ দিতে চাইছে না। কানে কম শোনা, চোখে কম দেখা, শুরু হয়েছে। যারা ছিল না, তারা আসা শুরু করেছে।  রোগ-শোক এখন  নিত্য সাথী। সুগার এসেছে, প্রেসার বেড়েছে। জীবনে আমোদ উপভোগ করবার ক্ষমতা লোপ পাচ্ছে। এবং শাশ্বত সত্য হচ্ছে, জাগতিক সব কিছুই আমাদের ছেড়ে যেতে হবে।  তা সে ধনী-দারিদ্র, সুখী-অসুখী, জ্ঞানী-অজ্ঞানী, যে অবস্থায়ই আপনি থাকুন না কেন।
এখন কথা হচ্ছে, মৃত্যুর পরে কি হবে সে কথা আমাদের জানলেই বা কি হবে, আর না জানলেই বা কি হবে ? আর যে জানে মৃত্যুর পরে কি তার কাছে সেই জ্ঞান থাকবে ? অর্থাৎ আমরা তো এই শরীর  দিয়েই জ্ঞান সংগ্রহ করি, আবার এই শরীরেই জ্ঞান সঞ্চিত হয়। তো আমরা যখন শরীর  বিহীন হয়ে যাবো, তখন কি করে এই জ্ঞান কাজ লাগবে ? যদি ধরেও নেই যে আত্মা বলে কিছু আছে, সেটা তো  ক্রিয়াহীন, তো তার জ্ঞানকর্ম কি ভাবে  কোন কাজে লাগবে ?

একটা বিদ্যালয়ে গেলে দেখবেন, দুটো জিনিস একসাথে আছে। একটা হচ্ছে বিদ্যাগৃহ আর একটা খোলা মাঠ।  বিদ্যাগৃহে যেমন ছাত্ররা শিক্ষা গ্রহণ করে, তেমনি মাঠে খেলাধুলা করে। এই জীবনটাও একটা বিদ্যালয়, সেখানে আমরা যেমন আনন্দ লাভের  জন্য  খেলাধুলা করি, তেমনি শিক্ষা গ্রহণ করি। এখন কেউ যদি শিক্ষা গ্রহণ না করে, শুধু খেলাধুলা করে, তো তার ভবিষ্যৎ নিশ্চয় উজ্জ্বল হয় না। এই জীবন থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। শিক্ষার উদ্দেশ্যেই আমরা এখানে আসি।

যমরাজ যখন, খেলনা দিয়ে নচিকেতাকে ভোলাতে চাইলো, নচিকেতা কিন্তু আত্মজ্ঞান লাভের ইচ্ছা ত্যাগ করলো না। অজ্ঞানী লোকেরা পরলোকে বিশ্বাস করে না, সে সম্পর্কে জানতেও চায় না। এই বিশ্বাস -অবিশ্বাসের পিছনে তাদের  কোনো অনুসন্ধান নেই, কেবল অন্ধবিশ্বাস এদেরকে আঁকড়ে ধরে আছে। এরা  বাসনা নিয়ে জন্মায়, বাসনা নিয়ে মরে। কেননা বাসনার তৃপ্তি এদের কখনো হয় না। বাসনা পূরণের জন্য দেহ ধারণ করে, তাই মৃত্যুর ফাঁদ এরা  এড়াতে  পারে না। এরা  মনে করে, মৃত্যু মানে শেষ, ধংশ। মৃত্যু চরম অবলুপ্তি নয়, শরীরের পরিবর্তন মাত্র। এই জগৎ একটা মৃত্যুপুরী।  এখানে কেন আমরা এসেছি, আমরা জানি না। মৃত্যুর পরে আমরা কোথায় যাবো তা  আমরা জানি না। কিন্তু এটা জানার অধিকার আমাদের সবার আছে। যদি তুমি বলতে পারো, জন্মের আগে তুমি কোথায় ছিলে, আর জন্মের পরে তুমি কোথায় যাবে, তবে তুমি সার্থক, তোমার জীবন সার্থক। শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, হে অর্জুন, তুমি আমি বহুবার জন্ম গ্রহণ করেছি, আমি তা জানি তুমি সেটা জান  না।

আমাদের এই জড় দেহ যেমন প্রতিদিন পরিবর্তন হচ্ছে, আমাদের চিন্তার ধারাও প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। আমরা আমাদের কল্পনার সাহায্যে একটা চিন্তা দেহ ধারণ করতে পারি।  স্বপ্নের মধ্যে এই চিন্তাদেহে আমরা বিচরণ করে থাকি। এই চিন্তাদেহ আমাদের মতো কথা বলে। এই চিন্তদেহও পরিবর্তনশীল। আমরা যেমন স্থুল দেহের পরিবর্তন  রোধ করতে পারিনা। শিশু থেকে কিশোর, কিশোর থেকে যুবক, যুবক থেকে প্রৌঢ়, প্রৌঢ় থেকে বৃদ্ধ বৃদ্ধ থেকে সূক্ষ্ম শরীর ধারণ করি ।ঠিক তেমনি আমরা আমাদের চিন্তা দেহের পরিবর্তন রোধ করতে পারি না।  মৃত্যুর পরে আমরা যে  সুক্ষ দেহ ধারণ করি , এটি কিন্তু নতুন দেহ নয়। আমরা স্থুল দেহে থাকালীন এই দেহেরও পালন পোষণ করেছি। সুস্বাস্থের জন্য আমরা যেমন খাদ্য, পানীয় গ্রহণ করি, শরীর চর্চ্চা করি। তেমনি আমাদের এই মানসিক দেহের্  সু-গঠনের জন্য বা উন্নত করবার জন্য আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করা অবশ্যিক। অর্থাৎ  আমাদের চিন্তা, আমাদের বুদ্ধি, এই সূক্ষ্ম দেহেই সংস্কার আকারে সূক্ষ্ম রূপে সঞ্চিত থাকে। স্থূল দেহের মৃত্যুর পরে  এই মানস  লোকে মানসদেহে আমরা আত্মজ্যোতিখন্ড সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে থাকি। কিন্তু এই সময়ে আমাদের যেহেতু স্থুল দেহ বলে কিছু থাকে না, আমাদের দৈহিক কর্ম বলে কিছু থাকে না। আর তাই যে জাগতিক জ্ঞান আমরা স্থূল দেহে থাকা কালীন  সংগ্রহ করেছিলাম, তা আর কোনো কাজে লাগে না। কিন্তু যদি কেউ পরাবিদ্যা বা আধ্যাত্মিক জগতের জ্ঞান সংগ্রহ করে থাকে তবে এখানে সেটা কাজে লাগে। এইখানেই সাধারণ মানুষ আর সন্যাসীর মধ্যে পার্থক্য। অর্থাৎ অজ্ঞানী  ও জ্ঞানীর মধ্যে পার্থক্য। এই মানস লোকেও এই পৃথিবীর মতোই অনুরূপ একজগৎ আছে। তাই মৃত্যুর পরে প্রথমে আমরা বুঝতে পারি না। কিন্তু দৈহিক কর্ম না থাকায় নিজেকে অসহায় লাগে। এইখানে জ্ঞানী ও অজ্ঞানীর পার্থক্য। তো আমার মিত্র যে প্রশ্ন  করছিলো, ওসব না জানলে, বা না মানলে কি হয় ? তার জবাব এখানেই নিহিত আছে।

 কিন্তু এই চিন্তা-দেহের পরেও আছে একটা শাশ্বত সত্য আছে । যাক বলে চেতন সত্ত্বা।  এটি জীবাত্মা বা  সূক্ষ্ম শরীর থেকে ভিন্ন। এর সন্ধান অতি দুঃসাধ্য।  তাই যমরাজ  বলছেন, মানুষের এই অন্তর্নিহিত এই সত্ত্বা সম্পর্কে বা চেতন সত্ত্বা সম্পর্কে অতি অল্পলোক সচেতন। আবার যারা সচেতন তার মধ্যে গুটিকয় মানুষ মাত্র একে  জানতে পারে। এই উপল্বদ্ধির জন্য, শিষ্যকে যেমন উপযুক্ত হতে হবে,  তেমনি উপযুক্ত গুরুর প্রয়োজন।
এই শাশ্বত আত্মা সম্পর্কে বক্তৃতা করা সহজ। কিন্তু উপলব্ধি করা সহজ নয়। বই পড়ে, বা আমাদের এই কথা শুনে আত্মউপলব্ধি সম্ভব নয়। বই পড়ে, জাগতিক জ্ঞান হতে পারে। আত্মজ্ঞান প্রাণে প্রাণে উপলব্ধি করতে হয়। আর সেই উপলব্ধি দীর্ঘ দিনের আকুলতা ব্যাকুলতা , ধ্যান ধারণা, সমাধি ইত্যাদির একটা ধারাবাহিক অভ্যাস থেকে হতে পারে।
আর এই আত্মতত্ত্ব জানলে, আমাদের মৃত্যুভয় থেকে চির মুক্তি পেতে পারি। তখন আর নিজেকে দেহ-মন-ইন্দ্রিয় বলে মনে হয় না। তখন এই জড়-নিয়ম থেকে নিজেকে মুক্ত ও স্বতন্ত্র অনুভব করতে পারা যায় । আর এই অনুভব আমাদের দিব্যগুরু দিতে পারেন। তার শিক্ষা, তার সাহায্য ব্যতীত ভ্রান্তপথে ভ্রমন অসম্ভব নয়।
আমাকে কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করেছেন, এই গুরু কোথায় পাবো ? তাদেরকে বলি, গুরু খুঁজতে যাবেন  না। গুরু আপনাকে খুঁজে নেবেন। তারা তাদের দিব্যদৃষ্টিতে আপনাকে দেখছেন, আপনার উপযুক্ত হবার অপেক্ষায় আছেন। একটা জিনিস জানবেন, সবাই তার জ্ঞান-সম্পত্তি উপযুক্ত উত্তরাধিকারীর কাছে রেখে যেতে চান। এর জন্য তারা উপযুক্ত শিষ্যের খোঁজে আছেন।
যোগীবর বরোদাচরণ মজুমদার-এর বাড়িতে গুরুদেব  চলে এসেছিলেন । সেই  সত্যদ্রষ্টা বরদাচরণ যিনি  নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে ক্রিয়াযোগে দীক্ষিত করেছিলেন।  শোনা যায়,  আচার্য্য শঙ্করকে দীক্ষা দেবার জন্য,মহর্ষি পতঞ্জলি গোবিন্দপাদ নাম নিয়ে নর্মদার তীরে অপেক্ষায় ছিলেন। মহাত্মা বাবাজি শ্যামাচরণ লাহিড়িকে দীক্ষা দেবার জন্য, পাহাড়ের গুহায় শ' শ' বছর  অপেক্ষায় ছিলেন। এমনি অনেক উদাহরণ আছে।  এবং এরা সবাই সদ্গুরু। যারা সত্যি সত্যি পথ যেখানে পারেন। তো আপনার জন্যও গুরুদেব অপেক্ষায় আছেন।  সময় হলে ঠিক তিনি এগিয়ে আসবেন। আপনার কাজ ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষা করা, আর অন্তরের নির্দেশে কাজ করে যাওয়া।

আত্মা সম্পর্কিত আলোচনা, আমরা আগেও শুনেছি, ভবিষ্যতেও শুনতে থাকবো।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি  ওম।

আত্মার খোঁজে  (৩)

আত্মা সম্পর্কে খোঁজ-খবর করছেন অনেকে। কিন্তু সেই সম্পর্কে যিনি শিক্ষা দিতে পারেন, সেই মানুষ কিন্তু বিরলতম। আমাদের মতো সাধারণ সাধক  যারা মনেপ্রাণে পবিত্রতা লাভ করতে পারেনি তাদের পক্ষে এই সব তত্ত্বকথার উপলব্ধি শুধু দুরূহ নয় অসম্ভব। আর একটা কথা হচ্ছে আত্মাকে জানতে গেলে আমাদের একটা ক্রমবিকাশের পথ ধরে এগুতে হয়। বহু গুহ্য সাধনার দ্বারা, এক এক করে স্তর উন্মোচিত হয়।  প্রাথমিক স্তরগুলোর উপলব্ধি যাদের হয় নি, অর্থাৎ আমাদের দেহ বা দেহের স্তরগুলো  সম্পর্কে যিনি সচেতন নন,  তার পক্ষে আত্মার উপলব্ধি অসম্ভব। যারা বক্তৃতা শুনতে চান শুনুন, কিন্তু এই বক্তৃতা শুনে আপনি আত্মাকে জেনে যাবেন, এটা একদমই সম্ভব নয়। তাদের কাছে এগুলো শোনা মানে সময় নষ্ট। আর এগুলো শুধু শোনা কথাই হয়ে থাকবে।  বহু জন্মের সাধনার ফলে, এই জ্ঞান পাওয়া সম্ভব হয় । তবে যদি ধৈর্য্য ধরে এই কথাগুলো শোনেন, তবে আপনার মধ্যে একটা স্পৃহা জগতে পারে এবং একটা প্রাথমিক পথের সন্ধান পেতে পারেন।  তার বেশি কিছু নয়। তাই যারা মনে প্রাণে এখনো পবিত্র হতে পারেন নি, তারা আগে সেই চেষ্টা করুন, তবেই আমাদের এই কথার অর্থ অনুভব করতে পারবেন।শুধু গ্রন্থ পাঠে, বা কারুর কাছে শুনে যে জ্ঞান লাভ হয় তা দিয়ে ব্রহ্মতত্ত্ব বা আত্মা সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধি হওয়া একদমই সম্ভব নয়। এজন্য আমরা আগেই বলেছি, যথার্থ গুরুই আপনাকে এই উপলব্ধি করাতে পারেন ,  গুরুই পারেন  আপনার দিব্য চক্ষু খুলে দিতে । আমরা মহাভারতে দেখেছি, শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে আগে দিব্য  চক্ষু দান করেছেন, তার পরে ভগবানের স্বরূপ দেখিয়েছেন বা উপলব্ধি করিয়েছেন । শুধু তাই নয়, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের  কাছে যখন এই সব কথা ব্যক্ত করবার জন্য শূদ্র সঞ্জয়কে দায়িত্ত্ব দিলেন, তখন তাকে ব্যাসদেব দিব্যচক্ষু দান করেছিলেন। আমরা ওই অন্ধ যুধিষ্ঠিরের মতো জ্ঞান-অন্ধ। আমাদের যতক্ষন জ্ঞানচক্ষু উন্মিলিত না হবে, ততক্ষন আমরা কিছুই অনুভব করতে পারবো না। সঞ্জয় কথার মানে হচ্ছে সংযমী। তো যিনি সংযমী তারই জ্ঞান চক্ষু উন্মিলিত হতে পারে। তো আমাদের সংযমী হতে হবে। দিব্যজ্ঞান লাভের জন্য আমাদের অন্তঃকরণ উন্মুক্ত করতে হবে। আপনি আগে যা সব খেছেন, তাতে আপনার পেট ভরে  আছে। শুধু ভরে আছে না বদ  হজম হবার সম্ভাবনাই  বেশি। তাই নিজের অন্তঃকরণকে উন্মুক্ত করুন। যা কিছু তথাকথিত জ্ঞান আপনি সঞ্চয় করছিলেন, সেগুলো খানিক্ষণের জন্য হলেও সরিয়ে রাখুন।
 নিজেকে পরিশুদ্ধ করুন।  আপনি কোথায় জন্মেছেন, বা কি হয়েছেন,সেটা বড়কথা নয়। আপনি কি হতে চান সেটা বড়ো  কথা।

এবার আসল কথায় আসি, যা অবিনাশী তাই আত্মা, এটি সুক্ষ থেকে সুক্ষতর। এটা এতটাই সূক্ষ্ম যে আমরা কল্পনাও করতে পারি না। শুধু সূক্ষ্ম তাই নয়, এটি বেশ কিছু আবরনে  ঢাকা। এইখানে একটা কথা, আত্মাকে তাহলে কি, আবরণ দিয়ে ঢেকে রাখা যায় ? বা আত্মাকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে কে ? দেখুন আত্মা আচ্ছাদিত নয়। আমরা আমাদের চোখের সামনে আচ্ছাদন দিয়ে রেখেছি। আমরা ভাবি সূর্যকে মেঘ ঢেকে রেখেছে। আসলে আমাদের চোখগুলো মেঘে ঢাকা। তাই আমরা সূর্যকে দেখতে পাই না। বিশাল সূর্য্য, তাকে ঢেকে রাখে কার সাধ্য ? আমাদের চোখে অজ্ঞানের রঙ্গিন চশমা।  তাই আমরা যা কিছু দেখি সবেতেই আমার চশমার কাঁচের রঙ দেখতে পাই। সত্য সত্যতেই অবস্থান করে। মানুষ যখন  ঈশ্বর-ভাবনায় ব্যাকুল হয় তখন তাকে বিষয়-ভাবনা আকর্ষণ করতে পারে না। এইজন্য বিষয়-বাসনার পূর্তি বা শেষ হওয়া দরকার। তবেই আপনার মুমুক্ষত্ত্ব জাগার সম্ভাবনা। নতুবা গাছেরও খাবো, আবার তলারও খাবো এটা সম্ভব নয়। আপনি সংসারে আছেন কি পাহাড়ে আছেন, আপনি মন্দিরে আছেন কি মসজিদে আছেন সেটা বড়  কথা নয়, বড় কথা আপনার চেতন কেন্দ্রে কি উদ্ভাসিত হচ্ছে। আপনার মন কোথায় আছে ? বাহ্যিক ধর্মাচরণ এমনকি সৎকাজ, দান - ধ্যান যাই করুন না কেন, তা আপনাকে আত্মউপলব্ধি এনে দিতে পারবে না।

তাই যমরাজ বলছেন, হে নচিকেতা ইন্দ্রিয়নুভূতির বহির্ভূত এই পরম সত্ত্বা আমাদের চেতনসত্ত্বার মধ্যে লুক্কায়িত। অর্থাৎ আমাদের আত্মার বা জীবাত্মার মধ্যেই লুকোনো আছে। আমাদের অন্তরের গুহায় এর অবস্থান।  চির পুরাতন এই সত্ত্বা, সৃষ্টির পূর্বেও ছিল এখনো আছে আবার প্রলয়ের পরেও থাকবে। আর একে জানতে গেলে তোমাকে যোগ অভ্যাস করতে হবে। মনন. নিদিধ্যসন অভ্যাস ক'রে আপনাকে  নির্বিকল্প সমাধিতে পৌঁছতে হবে। তবেই তার সামনে পৌঁছতে পারবেন  আর তাকে উপলব্ধি করতে পারবেন ।
এই প্রসঙ্গে কঠোপনিষদের দুটো শ্লোক খুবই গুরুত্ত্বপূর্ন।  প্রথমটি হচ্ছে : ১/২/১২ নং শ্লোক।  সেখানে যমরাজ বলছেন :
তং দূর-দর্শং - সহজে দেখা যায় না তাকে ।
গূঢ়ম্ অনুপ্রবিষ্ট্ং - অতি সূক্ষ্ম ভাবে অন্তরে প্রবিষ্ট হয়ে আছেন ।
গুহাহিতং গহ্বরেষ্ঠং পুরাণম  - গুহার ভিতরে  নিহিত অর্থাৎ আমাদের বুদ্ধিরূপ গুহাতে নিহিত সেই কালাতীত আত্মা, পুরাণম   ।
অধ্যাত্ম যোগাদি গমেন - অধ্যাত্ম যোগের অনুশীলন দ্বারা।
দেবং মত্বা ধীরো হর্ষ শোকৌ জহাতি - সেই স্ব-আত্মাকে মনন করে, ধীর ব্যক্তি অর্থাৎ প্রাজ্ঞ ব্যক্তি সুখ দুঃখের অতীতে চলে যান।

অর্থাৎ যমরাজ বলছেন, আমাদের সবার অন্তরে, বুদ্ধিরূপ গুহায় প্রবিষ্ট অতিশয় দুর্বিজ্ঞেয় স্ব-প্রকাশ পরমাত্মাকে যোগ সমাধি দ্বারা অবগত হতে পারেন, এবং এর ফলে সেই ধীর জ্ঞানী ব্যক্তি সুখ-দুঃখের এই জগৎ থেকে মুক্তি লাভ করতে পারেন।

এতো গেলো আত্মা কোথায় থাকেন, আত্মাকে জানলে কি হয় ? কিন্তু আত্মা কি বা কে ?
শ্লোক নং ২/৩/১৭ তে যমরাজ  বলছেন : 

অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষ-অন্তরাত্মা সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ। 
তং স্বাৎ-শরীরাৎ প্রবৃহেৎ মুঞ্জাৎ ইব ইষীকাম  ধৈর্যেণ। 
তং-বিদ্যাৎ-শুক্ৰম-অমৃতম তং   বিদ্যাৎ-শুক্ৰম-অমৃতম  ইতি।  (২/৩/১৭)

যমরাজ বলছেন, অঙ্গুষ্ঠ পরিমান পুরুষরূপী অন্তর-আত্মা আমাদের সবার হৃদয়ে সদা বিরাজমান। মুঞ্জা ঘাসের কোমল শীষকে যেমন অতি যত্ন সহকারে কোষমুক্ত করতে হয়, সেই ভাবে মুমুক্ষ ব্যক্তিকে, আত্মাকে বিবেক জ্ঞানের সাহায্যে দেহ-মনের থেকে আলাদা করতে হয়। সেই আত্মাকে শুদ্ধ, অমৃতস্বরূপ পরমাত্মার সাথে অভিন্ন বলে জানা যায়।

অঙ্গুষ্ঠ পরিমান, অঙ্গুষ্ঠ মানে বুড়ো আঙুলের কর। অর্থাৎ বুড়ো  আঙুলের করের রেখার সম পরিমান জায়গায় এর অবস্থান। এই জায়গাটা কোথায় না হৃদয়ে। বাস্তবিক এই জায়গাটার আর একটা নাম হচ্ছে অনাহত চক্র। এইখানেই প্রথম আমাদের আত্মানুভূতি হয়। পরবর্তী কালে অনাহত, বিশুদ্ধি, আজ্ঞা, সহস্রার, এবং একদম শেষ পর্যায়ে বিন্দুতে এই চমক ও ধ্বনি মানুষকে আনন্দ অনুভূতির এক চরম পর্যায়ে নিয়ে যায়।   আর এটা কেমন দেখা যায় ? আমাদের আঙুলের করের  রেখার মতো। অর্থাৎ  বিদ্যুতের রেখার মতো, একটি উজ্জ্বল আলো। বিদ্যুতের রেখা যেমন  ক্ষনিকের জন্য দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায়।এটিও ঠিক তেমনি।  কিন্তু একটা ধ্বনি চারিদিকে ছাড়িয়ে পড়ে । আর আমাদের শরীর  চমকে চমকে ওঠে।  আর সেই ধ্বনিটি হচ্ছে ওম। প্রথমদিকে এটি দেখা দিয়ে হারিয়ে যায়, নিরন্তর অভ্যাসে এটির স্থিতিকাল বাড়ে। কিন্তু স্থুল শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে যায়। ঠাকুর  রামকৃষ্ণদেব  বলছেন, এই অবস্থা হলে,  কিছু ব্যতিক্রমি মানুষ বাদে, সবাই একুশ দিনের মধ্যে দেহ ত্যাগ করেন ।

এবার বলছেন, মুঞ্জাঘাসের কোমল শীষকে পেতে গেলে,  যেমন অতি যত্ন সহকারে কোষমুক্ত করতে হয়, সেই ভাবে মুমুক্ষ ব্যক্তিকে  আত্মাকে বিবেক জ্ঞানের সাহায্যে দেহ মনের থেকে আলাদা করতে হয়। মুঞ্জা ঘাস হচ্ছে যা গুচ্ছ আকারে তৈরি হয়। এটি খুব শক্ত।  এই ঘাস পাকিয়ে নৌকোর দড়া বা বলা যেতে পারে খুব শক্ত দড়ি তৈরি করা হয়। এটি কুশ গাছও হতে পারে।  মুঞ্জা ঘাসের মধ্যে কোষবদ্ধ অতি কোমল শীষের সঙ্গে আত্মার তুলনা করা হয়েছে। ঘাস থেকে শীষকে পেতে গেলে যেমন অতি যত্ন সহকারে ঘাস থেকে আলাদা করতে হয়। ঠিক তেমনি আমাদের দেহকোষগুলোকে ধীরে ধীরে আলাদা করে আত্মাকে পাওয়া যায়।

যমরাজ বলছেন, মানুষের দেহ-অভ্যন্তরে, যে অসংখ্য নাড়ী ছড়িয়ে আছে, তার মধ্যে সুষুম্না-নাড়ীই প্রধান। এই নাড়ীর পথ  মেরুমজ্জার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়ে ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে উর্দ্ধগামী হয়ে রয়েছে। যোগীদের ধারণা অনুসারে এই সুষুম্না নাড়ী অবলম্বন করে মানুষ সর্ব্বোচ্চ লোকে পৌঁছাতে  পারে। এখানেই জীবাত্মার উৎক্রমন  ঘটে।  এটি পরম-আত্মার প্রতিফলিত জ্যোতি মাত্র। এবং এর কোনো পরিমান নেই। যে আঁধারে এটি প্ৰতিফলিত হচ্ছে আমরা সেই আঁধারের আকারকেই আত্মার আকার বলে মনে করতে পারি । অর্থাৎ বিভিন্ন চক্রের যে আকার সেই আকারে বা আয়তনে  আমরা আত্মাকে উপলব্ধি করি। এবং এই অনাহত চক্র থেকে যাত্রা শুরু।  এর পরে, বিশুদ্ধি, আজ্ঞা,সহস্রার  প্রতিটি কেন্দ্রেই এই প্রতিফলন আমরা অনুভব করি। এবং এক এক চক্রে আমাদের অনুভূতিও আলাদা আলাদা হয়। এর কারন হচ্ছে প্রতিটি চক্রের রঙ আলাদা আলাদা।আকার আলাদা। এবার আমরা আলোচনা শুনবো কোষগুলো সম্পর্কে যা আমাদের ছাড়াতে হবে।

আমাদের দেহ আসলে পঞ্চকোষের সমষ্টি।  এগুলো হচ্ছে, অন্নময় , প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময়, এবং আনন্দময়।

অন্নময় কোষ : অন্ন অর্থাৎ খাবার, অন্নময়-কোষ মানে খাবার দিয়ে  তৈরি যে কোষ রয়েছে আমাদের শরীরে।
প্রাণময় কোষ : অর্থাৎ উর্জা শরীর।  এই শরীর বায়ুর শক্তিতে তৈরী।

মনময়  কোষ : অর্থাৎ মানসিক শরীর, মনের চিন্তার জগৎ ।

এই তিন শরীরকে  ভৌতিক শরীর  বলে। অন্নময়  শরীর স্থূল।  প্রাণময় শরীর  সূক্ষ্ম  ও মনময়  শরীর অতি সূক্ষ্ম।  কিন্তু এই তিন শরীর-ই  ভৌতিক। এই তিন শরীরের উপরেই আমাদের কর্মের প্রভাব পড়বে। স্থূল শরীর  অর্থাৎ অন্নময় কোষ দ্বারা গঠিত শরীরের উপরে কর্মের ছাপ পড়বে।  তেমনি প্রাণময় ও মনময় শরীরের উপরেও কর্মের প্রভাব আছে। কর্ম-বন্ধন  এই তিন শরীরকে জুড়ে রেখেছে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, সিমেন্ট বা আঠার মতো কর্ম এই তিন শরীরকে জুড়ে রাখতে সাহায্য করে।  অর্থাৎ আমাদের কামনা বাসনা থেকে উদ্ভুত কর্ম এই শরীরগুলোকে সজীব রেখেছে।

এর পরে আছে :
বিজ্ঞানময় কোষ : এটি ভৌতিক নয় কিন্তু ভৌতিক শরীরের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। এটি আমাদের শুদ্ধ জ্ঞানের দ্বারা তৈরি।

আনন্দময় কোষ :  পুরোপুরি অভৌতিক। আমাদের মধ্যে যে আনন্দের অনুভূতি হয়, তা এই আনন্দময় কোষের স্পন্দন।

বিজ্ঞানময় শরীর যা আসলে অভৌতিক, এই আনন্দময় শরীরের অর্থাৎ অভৌতিক শরীর ও ভৌতিক শরীরের  সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। তার মানে বিজ্ঞানময় কোষ নিজে অভৌতিক, কিন্তু তিনি ভৌতিক ও অভৌতিক শরীরের মধ্যে সম্পর্ক জুড়ে রাখে। এইজন্য আমাদের স্থুল শরীর ত্যাগের পরেও আমাদের বিজ্ঞানময় শরীর অর্থাৎ আমাদের জ্ঞানের ভান্ডার পরলোকে আমাদের পথ দেখাতে পারে।

ভৌতিক শরীরের রূপ বা আকার আছে। অন্নময় শরীর অতি স্থূল, তাই আমরা দেখতে পাই। প্রাণময় ও মনময় সূক্ষ্ম কিন্তু আমাদের অনুভূতির বাইরে নয়। এদুটো আসলে আউড়া বা জ্যোতি। দেখতে না পেলেও আমরা এর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি।

যদি ভৌতিক শরীর নষ্ট হয়ে যায়, তবে এই বিজ্ঞানময় শরীর আনন্দময় শরীরের সঙ্গে মিশে যায় ,এবং তৎপর  আনন্দময় শরীর বিশ্বব্রমান্ডের সাথে বিলীন হয়ে যায় বা একাত্বিভূত হয়ে যায়।

ভৌতিক শরীর পঞ্চভূতের মিশ্রণ।  মৃত্যুর পরে, আমাদের ভৌতিক শরীর পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের কর্মবন্ধন, আমাদের আবার দেহধারণের জন্য উদগ্রীব হয়। ও আমরা আবার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করি। যখন আমরা কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারি তখন আমরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সাথে এক হয়ে যাই।  জন্মমৃত্যুর চক্রের থেকে মুক্ত হয়ে যাই। একে বলে, মুক্তি।  কেউ বলে সমাধি।

এই পঞ্চকোষের পারে বসে আছেন শুদ্ধ আত্মা। পঞ্চকোষের আভরণ উন্মুক্ত হলে আমরা আত্মাকে উপলব্ধি করতে পারি। যিনি এই পরমাত্মাকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন তিনি নিজেকে পরমাত্মার সঙ্গে নিজেকে অভিন্ন মনে করেন। তিনি চাওয়া-পাওয়ার উর্দ্ধে উঠে যান। তিনি তখন নিত্য-সুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত-আত্মা। আমাদের গল্পের নচিকেতা এইভাবে মৃত্যুকে অতিক্রম করে অমৃতত্ব লাভ করেছিলেন।আপনি আমি সবাই এই নচিকেতার পথ অনুসরণ করে অমৃতত্ব লাভ করতে পারি।

ওম সহ নাববতু সহ নৌ ভুনক্তু। সহ বীর্যং করবাবহৈ। 
তেজস্বি নাবধিতম অস্তূ মা বিদ্বিষাবহৈ।। 
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ  হরি  ওম।

অনন্ত যাত্রা : স্থুল দেহ নাশের পরে আমাদের কি গতি হয় ?  

বিবেকানন্দ বলছেন, "সত্য তাদের কাছেই প্রকাশিত হয়, যারা শুধু সত্যের জন্য ভয় ত্যাগ করে, লাভালাভের চিন্তা ত্যাগ করে, সত্যের মন্দিরে উপাসনা করেন। মানুষের বুদ্ধির সচেতন প্রচেষ্টার দ্বারাই এই ব্যাপারে আলোকপ্রাপ্ত হওয়া যায়।"

আমাদের বাড়িতে আমার স্ত্রীর হেফাজতে একটা কৌটার মধ্যে কতকগুলো দানা  আছে।  তো আমি একদিন স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কি ? তো আমার স্ত্রী বললেন এগুলো ফুলের বীজ।  তো আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোনটা কিসের বীজ  তুমি চেনো কি করে ? আর এগুলো লাগিয়ে দিচ্ছো না কেন ? তো তিনি বললেন, প্রত্যেকটি বীজ লাগাবার একটা সময় আছে।  সময়মতো না লাগালে এর থেকে গাছ হবে না। আর তা ছাড়া, এর মধ্যে কোনো কোনো বীজ অপুষ্ট যা থেকে কোনো গাছ হবে না। সেগুলো আমাকে বেছে বার করতে হবে। আর আমি এগুলো চিনি কি করে ? এটা আমার অভিজ্ঞতার ফল। যখন এগুলো সংগ্রহ করেছি, তখন এগুলো আমি ভালো করে দেখে রেখেছি, কোন গাছে  কেমন বীজ হয়। তাই কোন বীজে কি ফুল বা ফল হবে তা আমি বুঝতে পারি।  আর কবে হবে তাও আমি জানি।

আমাদের চিন্তা হচ্ছে কর্মের বীজ। আসলে সমস্ত জিনিস আমাদের মনের মধ্যে আছে। অতীতে যা ঘটেছে, এমনকী বর্তমানে যা ঘটছে সবই আমাদের অবচেতন মনে সংস্কার আকারে সঞ্চিত হয়ে  থাকছে। আমরা যদি আমাদের অবচেতন মনের সংস্কারকে ধরতে পারি তবে সব ঘটনার আগাম খবর বলে দেওয়া যায়। আমাদের অবচেতন মনের সংস্কারকে চেতন স্তরে নিয়ে আসতে গেলে একটা কম্পন তুলতে হয়।এই কম্পন হচ্ছে মাধ্যম। চেতন ও অবচেতন মনের সংযোগের মাধ্যম।  এই কম্পনের ফলে  অবচেতন মনের সংস্কার চেতন স্তরে উদ্ভাসিত হয়। তখন আমরা ভূত ভবিষ্যৎ জানতে পারি।  এমনকি আমরা অন্যের অবচেতন মনের সংস্কারকে এই কম্পনের মাধ্যমে আমাদের চেতন স্তরে টেনে আনতে  পারি।  তখন আমরা অন্যের ভূত ভবিষ্যৎও  জানতে পারি। আর এটি তারাই পারেন, যারা মানসিক উচ্চ শক্তি সম্পন্ন, অর্থাৎ মহাত্মারা, যাদের মনের শক্তি বিশেষ ভাবে বিকাশ লাভ করেছে ।

আমরা যখন দেহ ছেড়ে অনন্তের যাত্রায় বেরিয়ে পড়ি, তখন আমরা মানস দেহে অবস্থান করি। মানস দেহ অর্থাৎ আমাদের চিন্তা-ভাবনার যে মূর্তি তাকে বলে মানস দেহ। আমরা এখন জগতের তৃতীয় স্তরে আছি। অর্থাৎ স্থুল দেহে আছি। স্থুল দেহের বিনাশ হলে আমরা মানস দেহে অবস্থান করি।   অর্থাৎএই মানস দেহ আমাদের চতুর্থ স্তরের বাসিন্দা। আমরা জানি অসংখ বিন্দুর সমষ্টি দিয়ে তৈরি হয় একটা ছবি। এখন এই বিন্দুর-সমষ্টি যখন অসীমে ছাড়িয়ে পড়ে বা  কমতে থাকে তখন ছবি  অস্পষ্ট হয়ে যায়। তৃতীয় স্তরে আসতে  গেলে আমাদের আবার ঘনীভূত হতে হয়। আমাদের মৃত্যুর পরে আমরা আমাদের স্পন্দন বা কম্পন  নিজের সঙ্গে নিয়ে যাই। আর এই কম্পনের গতি অনুযায়ী আমরা নির্দিষ্ট স্তরে প্রবেশ করি। এগুলো স্বয়ংক্রিয়। তাই আমাদের চিন্তা ভাবনা জ্ঞান অনুযায়ী আমাদের মৃত্যু পরবর্তী স্থান নির্দিষ্ট  হয়।  এই সময় প্রথম দিকে  আমরা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় থাকি। যারা পৃথিবীতে থাকাকালীন, উকন্ঠা, না পাবার দুঃখ-যন্ত্রনা নিয়ে ছিলেন, অপূর্ন বাসনা রেখে যেতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের তন্দ্রাঘোর  কাটতেই, চঞ্চলতা অনুভব করেন। পৃথিবীর মায়া-মোহ-আসক্তি তাকে  অস্থির করে তোলে। আর যখন সে দেখে তার কোনো নির্দেশ শরীর, বা অন্য কেউ পালন করছে না তখন  সে অসহায়, অস্থির  ও শোকাচ্ছন্ন হয়ে যায় । আর যারা জ্ঞানত দেহ ত্যাগ করে, তারা মৃত্যুকালীন তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব কাটিয়ে চির নিদ্রায় শায়িত থাকে। এই অবস্থাটা আমাদের খানিকটা স্বপ্নের মতো। স্বপ্নে যেমন আমরা একটা জাগতিক পৃথিবীতে ঘুরে  বেড়াই। সুখ-দুঃখ ভোগ করি, এই অবস্থাতেও আমরা একই রকম অনুভব করি। বাসনা যাদের বেশি থাকে তারা ভোগ ভূমিতে নেবে আসে। আত্মীয়স্বজনদের পাশে পাশে ঘুরে বেড়ায়। আমরা যেমন আমাদের ঘুমের মধ্যে ঘুরে বেড়াই, এরা তখন তাদের আত্মীয়স্বজনদের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। তাদের সাহায্য করতে চায়। তারা তখন বুঝতেই পারে না, যে তারা মারা গেছে। এই বিশৃঙ্খল অবস্থায় তাদের বেশ কিছু সময় কেটে যায়। আর একদল আছেন, যারা মৃত্যুর পরে বুঝতে পারেন। তারা দেহাতীত হয়ে গেছেন। এরা  তখন শান্তিতে নিদ্রা যান। অর্থাৎ সুসুপ্তির স্তরে অবস্থান করেন। এই সময় তাদের কোনো জ্ঞান থাকে না। এমনকি সময়জ্ঞানও থাকে না। এইজন্য বলা হয়ে থাকে মানুষের বাসনা অনুযায়ী, জ্ঞান অনুযায়ী মানুষ মৃত্যুর পরে, স্বর্গ-নরকে অবস্থান করেন, ভালো বা মন্দ থাকেন । এই জন্য বিভিন্ন আত্মার জন্য বিভিন্ন স্তর নির্দিষ্ট হয়ে যায়। এবং এগুলো সবই আমাদের চিন্তা-ভাবনার ফল। তাই আমাদের চিন্তা -ভাবনা যেমন  সবার আলাদা আলাদা, আমাদের সবার চিন্তা-ভাবনার কম্পনও তেমনি আলাদা আলাদা। আর এই কম্পনের  মাত্রা অনুযায়ী আমাদের বসবাসের স্তর নির্দিষ্ট হয়ে যায়। এখানে ঈশ্বরেরও কিছু করার নেই। একটা কথা আমাদের বোঝা দরকার যে, আমাদের এই যে মনময় শরীর, এটি সুক্ষ কিন্তু অপার্থিব নয়। স্থূল শরীর  যেমন পার্থিব এই সূক্ষ্ম শরীরও পার্থিব। অর্থাৎ অন্নময়, প্রাণময় শরীর যেমন পার্থিব, মনময় শরীরও পার্থিব। এবং এই মনময় শরীর চিরস্থায়ী নয়।  এটিরও পরিবর্তন আছে, নাশ আছে। অন্ন না পেলে যেমন  অন্নময় শরীরের ধংশ হয়ে যায়,  বায়ু না পেলে যেমন প্রাণময় শরীর নাশ হয়ে যায়, আমাদের কামনা বাসনা সংকল্প শেষ হয়ে গেলে এই মনময় শরীরেরও  নাশ হয়ে যায়। এইজন্য স্বাভাবিক মৃত্যুতে দেখবেন, মানুষ প্রথমে খাওয়া ছেড়ে দেয়।অর্থাৎ খাবার থেকে যে শক্তি সে সংগ্রহ করছিলো, তা বন্ধ হয়ে যায়।  এর পরে হৃদযন্ত্র কাজ করা বন্ধ করে দেয়, অর্থাৎ বায়ু থেকে যে উর্জাশক্তি সে  সংগ্রহ করছিলো, সেটা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মনময় শরীর থেকে যায়। অর্থাৎ কামনা বাসনা আমাদের সহজে ছেড়ে যায় না। এইজন্য, ঋষি-মহাপুরুষরা আমাদের কামনো বাসনা পরিত্যাগ বা নিয়ন্ত্রণ  করতে বলেছেন। অর্থাৎ অন্নময় এবং প্রাণময় শরীর একসময় প্রাকৃতিক নিয়মে শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু মনময়  শরীর, তখনি নাশ হবে, যখন আমরা কামনা-বাসনা পরিত্যাগ করতে পারবো। আর এই তিনটে শরীর নাশ হয়ে গেলে বিজ্ঞানময় শরীর আনন্দময় শরীরের সঙ্গে মিশে যায়। এবং আনন্দময় শরীর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে বিলীন হয়ে যায়।

মনময় সূক্ষ্ম দেহকে সহজে নাশ করা যায় না। এটি তার কামনা বাসনা পূরণের জন্য আবার দেহ ধারনের জন্য উদগ্রীব হয়। কারন সে জানে দেহ ভিন্ন কামনা বাসনা পূরণের কোনো উপায় নেই।  এই জন্য বলা হয়ে থাকে, মানুষ তার কামনা বাসনা অনুযায়ী দেহ প্রাপ্ত হয়।  এবং এই চক্রের মধ্যেই আমরা অর্থাৎ  বেশির ভাগ প্রাণী ঘুরপাক খাচ্ছি।
মানুষ মৃত্যুর পরে অজ্ঞানের ঘুমে সে আচ্ছন্ন হয়ে পরে, এবং ধীরে ধীরে ঘন্টা চারেকের মধ্যেই  তার আচ্ছন্নতা কেটে যায়। তখন থেকে  বায়বীয় দেহ নিয়ে  সে জীবনের চতুর্থ স্তরে ধাতস্ত হবার চেষ্টা করে।  এই চতুর্থ স্তরের মধ্যেই স্বর্গ-নরক বলতে আমরা যা বুঝি, তা এইখানেই।  এই চতুর্থ জগতের সঙ্গে আমাদের বুঝবার জন্য আমাদের স্বপ্নাবস্থার সাথে তুলনা করতে পারি। আমাদের স্বপ্নের জগতে যেমন এই পৃথিবীর জগতের মতো একটা জগৎ উপলব্ধি করি, এখানেও  আমাদের দৃশ্যমান জগতের অনুরূপ একটা জগৎ বিদ্যমান। পার্থক্য হচ্ছে আমাদের স্বপ্ন ৬ বা ৮ ঘন্টার পরে ভেঙে যায়। আমরা বুঝতে পারি যে আমরা স্বপ্ন দেখছিলাম।  আর এই জগতের স্থিতিকাল দীর্ঘ। এবং এক একজনের ক্ষেত্রে এক এক রকম। তবে অনন্তকাল নয়। এখানেও আমরা ইহজগতে থাকা কালীন যেমন কাজ কর্ম করতাম।  এখানেও সেইরূপই করে থাকি। কেউ যদি ইহজগতে পুজো-অর্চনা করতে ভালো বাসতেন, তবে এখানেও তিনি সেটাই করেন। এখানে চিন্তামাত্র তার কাছে সবকিছু উপস্থিত হয়ে যায়। এমনকি তারা ইহজগতের সবাইকে যাদের তিনি স্মরণ করেন, তাদেরই সাথে মিলিত হতে পারেন। এগুলো তাদের কল্পনা প্রসূত। এমনকি এখানে তারা আহার-পানীয় গ্রহণ করেন। অর্থাৎ এটাকে বলা যেতে পারে চিন্তা বা কল্পনার রাজ্য। আসলে আমরা যখন স্বপ্ন দেখি, সেই মূহুর্তের জন্য স্বপ্নকে আমাদের সত্য বলে মনে হয়। আমরা জানি স্বপ্ন আমাদের চিন্তার আকার বা পরিণতি বিশেষ। স্বপ্নে আমরা যেমন স্পর্শসুখ পাই,  শ্রবণসুখ এবং দৃশ্যসুখ পাই বা বিপরীত ভাবে বলা যেতে পারে, স্বপ্নে আমরা যেমন দুঃখ বা  ভয় পাই,  আতঙ্কগ্রস্থ হই, তেমনি  এখানেও  আমরা মানসিক  দেহ নিয়ে আমরা সমস্ত সুখ-দুঃখ ভোগ করি। এই ভোগেচ্ছা একটা সময় সমাপ্ত হয়। তখন আবার আমরা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি।    
এই অবস্থায় এক একজনের ক্ষেত্রে এক একরকম সময়-কাল ধরে চলে। কেউ কেউ বলেন, ২৫/৩০ বছর থাকার পরে, তার আবার ধরণীতে দেহ ধারণের ইচ্ছা প্রবল হয়। কেউ বলেন, হাজার বছর। আসলে বাসনার প্রবলতা অনুসারে এই স্তরে স্থায়ীকাল নির্দিষ্ট হয়।  এই সময় আবার সে অজ্ঞান-আচ্ছন্ন হয়ে পরে। এবং এই অবস্থাতেই সে তার ইচ্ছে পূরণের জন্য বা বাসনা পূরণের জন্য উপযুক্ত শরীরের  ভ্রূণের  মধ্যে প্রবেশ করে। এটাকেই বলি আমরা গর্ভধারণ। পার্থিব শরীর  ভিন্ন আমাদের আমাদের ইচ্ছে পূরণের কোনো সুযোগ নেই।  তা সে ভালো ইচ্ছেই বলুন আর ভোগের ইচ্ছেই বলুন। শরীর যন্ত্র ছাড়া আমাদের কোনো আদর্শ বা লক্ষ্য পূরণের কোনো উপায় নেই। তাই অনন্ত কাল কেউ স্বর্গে অর্থাৎ আনন্দে থাকে না বা অনন্ত কাল কেউ নরকে বা নিরানন্দে  থাকে না। এখানেই ফিরে ফিরে আসে। ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যুর  বড় ছিল, ভীষ্ম কথাটা এসেছে ভ্রম থেকে, এই ভ্রম মানুষের সহজে যায় না।ভীষ্মেরও সহজে মৃত্যু ঘটে না। তীরের ঊপরে বিদ্ধ হয়ে, শ্বর-শয্যায়  তাকে বেঁচে থাকতে হয়। আমাদের ভোগেই সুখ, এই ভ্রম যতদিন না যাবে ততদিন আমাদের বার বার ফিরে আসতে  হবে।

এখান থেকে আদর্শবান পুরুষ, বা  প্রাজ্ঞপুরুষ যাকে স্থিতপ্রজ্ঞ বলে থাকি, তারা আর এই জগতে সাধারণত ফিরে আসেন না। তারা আরো উর্দ্ধে অর্থাৎ পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম  অর্থাৎ মহঃ, জনঃ তপঃ এবং সব শেষে সত্যম বা ব্রহ্মলোকে  যাত্রা করেন।  

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওম।                      



























No comments:

Post a Comment