Saturday 15 June 2019

প্রান-রহস্যঃ


প্রান-রহস্যঃ

ওঁ আপ্য়ায়ন্তু মম অঙ্গানি বাক প্রাণঃ চক্ষুঃ শ্রোত্রম অথোবলম ইন্দ্রিয়ানি চ সর্বানি। 

হে পরম-ঈশ্বর আমার সর্ব্ব অঙ্গ যেন পুষ্ট হয়। আমার প্রাণবায়ু, বাকশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি ও অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলো যেন শক্তিশালী হয়। 
ওঁ শান্তি শান্তি শান্তিঃ ।।
  
জীবন হচ্ছে  শ্বাসের খেলা। শ্বাসের শুরুতে প্রাণের শুরু, শ্বাসের  শেষে প্রাণের শেষ। চৈতন্য-হীন মানুষ বা জীব বেঁচে থাকতে পারে,  কিন্তু প্রাণহীন  জীব হয় না।   আমাদের সবাইকে বেঁচে থাকতে গেলে,  এই  প্রাণের সাধনা  করতে হয়।   আবার আত্মজ্ঞান লাভ করতে গেলেও প্রাণের সাধনা করতে হয়।  শারীরবিনা সাধন হয় না। আর আমাদের শরীরের প্রধান হচ্ছে  প্রাণ অর্থাৎ বায়ু। আমরা আজ এই প্রাণ বা বায়ু নিয়ে আলোচনা করবো। 
কোনো বাড়িতে ঢুকতে গেলে, কর্তার  সাথে দেখা করতে গেলে, যার সেই বাড়িতে যাতায়ত আছে, তেমন কারুর  সাহায্যে প্রবেশ করতে হয়।  আমাদের শরীরে এই বায়ু প্রতিনিয়ত যাতায়াত করছে, অর্থাৎ একবার ঢুকছে, একবার বেরোচ্ছে। আমাদেরও, ভগবানের তৈরি এই  দেহ-মন্দিরে ঢুকতে গেলে, এই প্রাণবায়ুর সাহায্য নিতে হবে। তাই আধ্যাত্মিক জগতে এই বায়ুর বা স্বাসপ্রস্বাস-এর  গুরুত্ত্ব অপরিসীম। বায়ু আমাদের আত্মা বা পরমাত্মার কাছে নিয়ে যাবার জন্য বাহক হিসেবে কাজ করতে পারে।
আজ আমরা  বায়ুর অর্থাৎ প্রাণের  গোড়ার কথায় যাবো। আমাদের সমস্ত সৃষ্টি প্রকৃতি প্রসূত। প্রকৃতি ত্রিগুণাত্বক - সত্ত্বঃ -রজঃ -তমঃ। এই ত্রিগুণের সাম্য়-অবস্থায় অব্যক্ত। আর বৈষম্য অবস্থায় হচ্ছে সৃষ্টি। সমস্ত সৃষ্টি তা চেতন বা অচেতন, যাই হোক না কেন, তা  এই প্রকৃতির সাহায্যেই  হয়েছে। সত্ত্বগুণ হচ্ছে আত্মশক্তির মুলস্পন্দন।  রজঃগুন হচ্ছে ক্রিয়া শক্তির মূল স্পন্দন। এই ক্রিয়া শক্তিই সৃষ্টিকে ভাঙে গড়ে। ক্রিয়াশক্তির এই যে কার্যরূপ তাকে বলে তমোগুণ।
শক্তির এই তমোগুণ থেকেই পঞ্চতত্ত্ব সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমে কারন-রুপী  মহাকাশ। এই আকাশ থেকে বায়ু, অর্থাৎ মহাপ্রাণশক্তি উৎপন্ন হয়েছে। মহাত্মারা বলেন, আমাদের এই দেহটি একটি ক্ষুদ্র ব্রহ্মান্ড। পঞ্চতত্ত্বের সমস্ত তত্ত্ব আমাদেরই এই দেহে বর্তমান।
এখন, আকাশ থেকে সৃষ্টি হয়েছে, বায়ু। আকাশের গুন হচ্ছে  শব্দ। বাতাসের,   নিজস্ব,গুন হচ্ছে স্পর্শ।   আর বায়ু আকাশের উত্তরাধিকারী হিসেবে যে গুন্ পেয়েছে তা হচ্ছে শব্দ । এই বায়ুই আমাদের স্পর্শ ইন্দ্রিয় অর্থাৎ ত্বকে অনুভব জাগায়। এই বায়ুই আমাদের দেহের প্রাণশক্তি, প্রাণবীজ ও প্রাণকোষ নির্মাতা। এই বায়ু আমাদের দেহের সমস্ত যন্ত্রগুলোকে, দেহের রস-রক্তকে দেহের সর্বাঙ্গে পরিচালিত করে।
আকাশভূতের ক্রিয়া আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না।  বায়ুকেও  আমরা চোখে দেখি না বটে, কিন্তু তার স্পর্শ অনুভব করি। আমরা যেমন আকাশ জুড়ে, বায়ু অগ্নি ও বরুনের খেলা প্রত্যক্ষ করি, অর্থাৎ ঝড়, বিদ্যুৎ ও মেঘ বা বৃষ্টির খেলা দেখতে পাই, তেমনি আমাদের দেহের মধ্যেও এই ত্রিদেবতার খেলা চলছে, এবং আমাদের দেহ যদিও পঞ্চভূতের তৈরি, তথাপি এই তিন ভূতের অধিক প্রাধান্য, আমাদের শরীরে। এর মধ্যে আবার বায়ু ভূতের প্রাধান্যই সর্বাধিক।
বক্ষ প্রদেশ বায়ুশক্তির প্রধান কর্ম্মকেন্দ্র।  যদিও সমস্ত দেহেই সমস্ত ভূতের কাজ চলতে থাকে, তথাপি প্রত্যেক তত্ত্বের একটি প্রধান কেন্দ্র আছে। বায়ুর প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে আমাদের বুক।  এখানে, ফুসফুসহৃদযন্ত্র, মঙ্গলগ্রন্থি এবং প্রাণকোষ নির্মাণকারী গ্রন্থি ইত্যাদি পাঁচটি গ্রন্থি ও অনেকগুলি উপগ্রন্থি আছে এখানে।  হৃদয়কেকে সাধকরা  অনাহত চক্রে কর্ম্মস্থল  বলে থাকেন । এই চক্রে অবিরত কাজ চলছে, একমুহূর্তের জন্য বিশ্রাম নেই। এই চক্রের বিশ্রাম মানে, আমাদের চিরবিশ্রাম বা মৃত্যু। বিজ্ঞান বলছে,  আমাদের বুকের পিছনের স্পাইনাল কর্ড লেভেল, বা সুষুম্না নাড়িতে অবস্থিত  অনাহত চক্র থেকে, অর্থাৎ আমাদের বুকের পিছনের সুষুম্না নাড়ি থেকে  বারোজোড়া স্নায়ু যার প্রত্যেক জোড়ায়  একটি  গ্রাহক, অন্যটি প্রেরক  স্নায়ু ( রিসেপ্টর আর একটি কন্ডাকটর ) আমাদের বুকের মধ্যে বিস্তার করে আছে।
বায়ুকে উপনিষদ পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন।  প্রাণ-ব্যান-অপান -সমান-উদান। এঁরা আমাদের দেহমন্দিরের রক্ষক। এইপাঁচজন দ্বাররক্ষক আমাদের হৃদযন্ত্রের পাঁচদিকে অবস্থান করছে।
ছান্দোগ্য উপনিষদ বলছে : আমাদের হৃদয়ের পুব দিকে প্রাণ, পশ্চিমে অপান ,দক্ষিণে ব্যান, উত্তরে সম বা সমান আর উর্দ্ধ দিকে উদান।
পূর্ব দিকে আছেন - প্রাণ। হৃদয়ের যে পূর্বদ্বার সেখানে তিনি অবস্থান করছেন। প্রাণকে বলা হচ্ছে আদিত্য বা সূর্য্য । ইনি আমাদের চক্ষুস্বরূপ। আদিত্য অর্থাৎ তেজ। এই প্রাণ বায়ুর কাজ হচ্ছে শ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ, হৃদযন্ত্র পরিচালন, খাদ্য বস্তুকে পেটের  মধ্যে পাঠানো। ধমনীর সাহায্যে আমাদের সর্ব্ব অঙ্গে রক্ত পরিচালনা - অর্থাৎ পাঠানো ও গ্রহণ করা। অর্থাৎ শিরা এবং স্নায়ুগুলোকে তাদের কাজে প্রবৃত্ত করা। 
দক্ষিণ দিকে আছেন - ব্যান।  হৃদয়ের দক্ষিণ দ্বারে ব্যানবায়ু অবস্থান করেন। ব্যান-কে  বলা হচ্ছে চন্দ্র। ইনি আমাদের কর্ন  স্বরূপ। মানুষ কানের সাহায্যে জ্ঞান লাভ করে। চন্দ্র আমাদের খাদ্যের উৎস - খাদ্য আমাদের শক্তি যোগায়। শরীরের রস-রক্তকে প্রয়োজনমতো সমস্ত শরীরে দ্রুত পরিবেশন করা, আমাদের শরীরের সংকোচন-সম্প্রসারণ, মস্তিষ্কে রক্ত পাঠানো, শরীর থেকে ঘাম বের করে দেওয়া  এই ব্যান বায়ুর কাজ। এই ব্যানবায়ু কুপিত হলে, আমাদের সমস্ত দেহে রোগের  প্রকপ হয়, এবং আমরা মারা যাই।  
পশ্চিমদ্বার, অর্থাৎ হৃদয়ের যে পশ্চিম দ্বার সেখানে অবস্থান করছেন  অপান। এটা আমাদের বাকশক্তি, আবার এই অপান-ই হচ্ছে অগ্নি। অপান বায়ুর প্রধান কাজ, প্রাণ বায়ুকে আকর্ষণ করে, প্রাণবায়ুর স্বাস প্রশ্বাস কাজকে সহায়তা করা। মল,মূত্র, শুক্র, প্রভৃতিকে নিচের দিকে চালিত করা। নারী দেহের সন্তান পোষণ, সন্তান ভূমিষ্ট করার ব্যবস্থা করা, রজঃ নিঃস্বরণ  ইত্যাদি ক্রিয়াও অপান বায়ুর অন্তর্গত।
এর পরে,হৃদয়ের উত্তর দ্বারে আছেন সমান বা সম।  আমরা যা কিছু খাই বা পান করি, সেই সকল বস্তুকে জীর্ন করে, রূপান্তরিত করে এই সমান বায়ু। অর্থাৎ সমান বায়ু আমাদের হজমশক্তি। জীর্ন খাদ্যের সার, ও অসার ভাগ অর্থাৎ প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়জনীয় অংশকে পৃথক করে অসার ভাগ বৃহৎ-অন্ত্রের ভিতর দিয়ে মলনারীতে প্রেরণ করে, এই সমান বায়ু। অপান  ও প্রাণ  বায়ুর কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করার দায়িত্ব এই সমান বায়ুর।
হৃদয়ের উর্দ্ধদিকের দিকে যে দ্বার সেখানে আছেন, উদান । পা থেকে উর্দ্ধগমনকারী বায়ু, এই ছিদ্রের মধ্য দিয়ে উপরের দিকে যায়। এই উদান বায়ুর সাহায্যেই মানুষ শব্দ করে, কথা বলে, গান ইত্যাদি করে। এই উদান বায়ুর সাহায্যেই আমাদের মন বুদ্ধি স্মৃতিশক্তি পরিপুষ্ট হয়। সাধকের কাছে, এই উদান বায়ুর খুব গুরুত্ত্ব , কারন  এই উদান বায়ুর সাহায্যেই কুন্ডলিনী শক্তিকে সাহস্রারের দিকে নিয়ে যায়। এর উদান বায়ুর সাহায্যেই  আমাদের মন অতীন্দ্রিয় জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
অতএব সচেতন ভাবে, আমাদের প্রাণকে রক্ষা করতে হবে, শক্তিশালী করতে হবে। আর এটা  করবার জন্য, আমাদের প্রতিনিয়ত খানিকটা সময়, প্রাণের অর্থাৎ স্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়াকে একাগ্রভাবে পর্যবেক্ষন করতে হবে। তার কাছে উপবেশন করতে হবে, তাতেই তিনি খুশি হবেন, এবং আমরাও ভালো থাকবো।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ - হরি  ওঁং









  

  


No comments:

Post a Comment