Wednesday 5 June 2019

কর্মরহস্য


কর্মরহস্য (১)

কেউ বলেন "যেমন কর্ম্ম তেমন ফল" । কেউ  বলেন, "ভাগ্যের লিখন খণ্ডাবে কে ?" কোনটা যে ঠিক কে বলে দেবে ? কর্ম ফল নাকি কপাল - কোনটা কার্যকরী বেশী ? আজ আমাদের আলোচ্য বিষয় কর্মরহস্য।

গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, কর্মে তোমার অধিকার, ফলে কখনোই নয়। এই কথার গূঢ় অর্থ কী ?

কর্ম্ম কাকে বলে ?

পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করে আমরা যা কিছু করি সবই কর্ম্ম। সৃষ্টি এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য, যা কিছু করা হয় তাকেই কর্ম বা ক্রিয়া বলে।

কর্ম্ম কয় প্রকার  ? 

প্রাথমিক ভাবে, কর্ম্ম দুই প্রকার, দৈহিক কর্ম্ম ও মানসিক কর্ম্ম।

দৈহিক কর্ম্ম  বা অবচেতন মনের কর্ম্ম  :
দেহকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য, আমরা যে কর্ম্ম করি, বা যে কর্ম্ম সম্পাদিত হয়, তাকে দৈহিক কর্ম্ম বলে। যেমন - চোখের পাতা ফেলা, স্বাস প্রশ্বাস, পাচন  ক্রিয়া, বাতাস থেকে উর্জ্বা শক্তি সংগ্রহ করা।  এগুলো আমাদের দৈহিক কর্ম্ম। এগুলো অবচেতন মনের নির্দেশে হয়।  এই কর্ম্মের ফল তাৎক্ষণিক। সঞ্চয়ের কোনো সুযোগ নেই।

মানসিক কর্ম্ম  বা সচেতন মনের কর্ম্ম :
ইন্দ্রিয়গনের সাহায্যে বিষয় সংযোগে যে কর্ম্ম করা হয়, তাকে মানসিক কর্ম্ম বলা হয়। মানসিক কর্ম্ম আবার দুই প্রকার। প্রতক্ষ্য ও অপ্রতক্ষ্য ।

আসলে আমরা কর্ম্ম বলতে যা বুঝি তা এই এই মানসিক কর্ম্মের বহিরঙ্গ মাত্র। অর্থাৎ যে কর্ম্মের দ্বারা আমরা এক্ষুনি বা অদূর ভবিষ্যতে ফল পেতে পারি। অর্থাৎ প্রতক্ষ্য কর্ম্ম

ইন্দ্রিয়গনের দ্বারা আমাদের কর্ম্ম করতে হয়। আর মন হচ্ছে ইন্দ্রিয়গনের রাজা। মন যখন কোনো কিছু চিন্তা করে, সেটা হচ্ছে অপ্রতক্ষ্য কর্ম্ম।  এই অপ্রতক্ষ্য কর্ম্ম যখন ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বাহ্যিক রূপ নেয় তখন তাকে প্রতক্ষ্য কর্ম্ম বলা হয়। সাধারণ ভাবে একেই আমরা কর্ম্ম বলে থাকি।

তাহলে আমরা বুঝলাম, মন হচ্ছে কর্ম্মের রাজা। এই মনের আবার দুটো প্রবৃত্তি আছে। একটাকে বলি কামনা, আর একটা হচ্ছে বাসনা। এই দুটো প্রবৃত্তি আমাদের কর্ম্মে উদ্বুদ্ধ করে।

কামনা :  ইন্দ্রিয়গনের সঙ্গে বিষয়-সংযোগের যে ইচ্ছে আমাদের মধ্যে জাগ্রত হয় তাকে বলে কামনা। শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ - প্রভৃতি উপভোগ করবার যে প্রবৃত্তি আমাদের মনে বর্তমান থাকে, তার দ্বারা ভোগ্য বিষয়ে আমাদের আসক্তি জন্মে। এই আসক্তিই কামনা-প্রসূত। মানুষের যাতে ন্যায্য অধিকার নেই,অথচ সেগুলো পাবার জন্য, আমরা সদাই চঞ্চল।  তাই কামনা প্রসূত কর্ম্ম আমাদের সুখ-দুঃখের কারন।

বাসনা : মনের আর একটা প্রবৃত্তির নাম বাসনা বা সংকল্প। আমি সংযম পালন করবো। চরিত্রের উন্নতি সাধন করবো। পরহিতার্থে কাজ করবো। জ্ঞান অর্জন করবো, ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ একটা হচ্ছে নিজের সুখ-দুঃখের জন্য কাজ যাকে  বলে কামনা আর একটা অন্যের হিত বা নিজের উন্নতি সাধনের কাজ, একে বলে সংকল্প বা বাসনা।

এই কামনা ও বাসনা দুটোরই উৎপত্তি স্থানই মন। এদুটোই মনের কাজ।  এটাকে সম্পাদন করা  বা না করা দুটোই কর্ম্ম। কর্ম্ম হিসেবে এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।  পার্থক্য হচ্ছে ফলে।

কর্ম্ম বলতে আমরা স্থুল দেহের কর্ম্ম বুঝে থাকি।  কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের আরো দুটো লিঙ্গদেহ বা সূক্ষ্ম দেহ আছে, একটা হচ্ছে কামদেহ আর একটা হচ্ছে মানসদেহ। এই দুটো দেহেরও  কর্ম্ম করবার শক্তি আছে। এবং এই দুটো দেহই সর্ব্বদা কর্ম্ম করছে। আর পৃথিবীই আমাদের কর্ম্মভূমি। আর এই পৃথিবীতে বসে আমরা যে  কর্ম্ম করবো, তার ফলও আমরা এই পৃথিবীতে বসেই ভোগ করবো। এই সব কর্ম্মের ফল আমরা পরলোকে গিয়ে ভোগ করবো না। যদি এই জীবনে আমাদের কর্ম্মফল ভোগ সম্পূর্ণ না হয় তবে আমাদের আবার পৃথিবীতে এসে ভোগ করতে হবে। আর একেই বলে প্রারব্ধ কর্ম্মফল ভোগ। ফলদানে প্রবৃত্ত এই সব কর্ম্মফলের গতি রোধ করা যায় না। আর পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করে যে সব কর্ম্ম আমরা করি, সেগুলো হচ্ছে ক্রিয়মান কর্ম্ম। ভবিষ্যৎ জন্মে আমাদের আজকের  ক্রিয়মান কর্মের ফল ভোগ করতে হবে। এছাড়া বহু জন্মের যে কর্ম্মফল আমাদের ভোগ করা হয় নি তাকে বলে সঞ্চিত কর্ম্ম। সেই সব সঞ্চিত কর্ম্মের ফলও  আমাদের ভোগ করতে হবে। ক্রিয়মান কর্ম্মের প্রতি আমাদের আমাদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি, কিন্তু প্রারব্ধ বা সঞ্চিত কর্ম্মফলের প্রতি আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই ক্রিয়মান কর্ম্মকে নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্য আমাদের কর্ম্ম বা কর্ম্মফল সম্পর্কে জ্ঞান সঞ্চয় করতে হবে, এবং সেই অনুযায়ী কর্ম্মে লিপ্ত হতে হবে, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনে, এই জীবনের কোনো কর্ম্ম  প্রারব্ধ বা সঞ্চিত হিসেবে টেনে নিয়ে যেতে হবে না। এখন কি করে সম্ভব ?

চিন্তাদ্বারা কর্ম্ম :  আমরা কৰ্ম্ম-ইন্দ্রিয় দ্বারা যে সব কাজ করি, তাদের সন্মন্ধে ভালো-মন্দ জ্ঞান আমাদের নেই। অনেক সময় আমরা না বুঝে, বা বিচার বিবেচনা না করে, খারাপ কাজ করে বসি। পরে সেটা নিয়ে আমাদের অনুতাপ হয়। আবার অনেক সময়, আমরা বুঝে শুনে, বিবেকের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে, খারাপ কাজে লিপ্ত হই। অনেক সময়, রাগের বশে, বা হিংসার বশে  অনুচিত কাজ করে বসি। আর একটা ব্যাপার হচ্ছে, চিন্তা দ্বারা যে কোনো কাজ করা যায়, তা আমরা মন করি না। আমরা মনে করি, শারীরিক উদ্দম ছাড়া কোনো কাজ করা যায় না। স্বামী বিবেকানন্দ একবার এক সাধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনারা সব উন্নত মহাত্মা, এই নির্জনে, পাহাড়ের কোলে বসে সাধনা কোরছেন।  এতে সাধারণ মানুষের কি কাজে লাগবে ? মহাত্মা বলেছিলেন, মনের দ্বারাও যে মানুষের উপকার করা যায়, এবং উপকার করতে চাইলে যে যে কোনো জায়গায় বসে সেটা করা যায়, তা কি তুমি জানো ? অর্থাৎ মানুষ তার শুভ চিন্তার দ্বারা কাজ করে থাকেন। আমরা মনে করি, চিন্তা মনের একটা অবস্থা-বিশেষ মাত্র। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে তা নয়। চিন্তা একটা বস্তূ।  বস্তূর সমস্ত ধর্ম্মই এতে বর্তমান। এই চিন্তা দ্বারা, যেমন নিজের উপকার করা যায়, তেমনি অপরের উপকারও করা যায়। জড়-বিজ্ঞান এখনো এর আবিষ্কার করতে পারে নি বলে এটা অসত্য হয়ে যায় না। চিন্তার কার্য্যকরী শক্তি সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। আমরা তপস্যার কথা শুনে থাকি, ঐকান্তিকভাবে চিন্তা করাই তপস্যা। আর এই তপস্যার ফলই আমাদের "বেদ"। তপঃ-প্রভাব-সম্পন্ন ঋষির কাছে কিছুই দুর্লভ নয়। তা সে জাগতিক বস্তূই হোক আর আধ্যাত্মিক জ্ঞানই হোক। গভীর চিন্তা দূরে থাকুক, সাধারণ চিন্তাও কখনো নিষ্ফল হয় না।

আমাদের এই ভূলোকের সঙ্গে যেমন আরো অনেক লোক   (  ভূঃ , ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ, তপঃ, সত্যম ) ওতপ্রোত ভাবে অবস্থান করছে, তেমনি আমাদের এই স্থুল দেহের সঙ্গে সূক্ষ্ম দেহ ওতপ্রোত ভাবে অবস্থান করছে। আমাদের এই স্থুল দেহের চতুর্দিকে, এক-দেড় ফুট পর্যন্ত একটা জ্যোতির্বিম্ব আচ্ছাদন করে রেখেছে আমাদেরকে। এরও আকৃতি আমাদের দেহের মতোই। তবে এটি আলোর রশ্মি মাত্র। আমাদের মনের ভাবের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই আলোর রঙের পরিবর্তন হয়।  আমাদের চিন্তা ধারার গভীরতার সঙ্গে সঙ্গে এই আলোর ঘনত্ত্ব বাড়ে-কমে। আমাদের মনে যখন যে প্রবৃত্তি জেগে ওঠে, সেই অনুযায়ী আমাদের এই আউড়া দেহ বা জ্যোতির্বিম্ব সূক্ষ্ম জগৎ থেকে সূক্ষ্ম পরমাণু আকর্ষণ করে থাকে। এবং তা থেকে শত শত - এমনকি হাজার হাজার আজ্ঞাবহ  চিন্তামূর্তি সৃষ্ট হয়। এই সব চিন্তামূর্তি গুলো সূক্ষ্ম উপকরণে নির্মিত। এই সকল মূর্তিতে কিঞ্চিৎ চৈতন্যেরও সঞ্চার হয়। মনের প্রবৃত্তির লক্ষ্য বস্তূ কাছে থাকলে, তারা সেই বস্তূর নিকটে গিয়ে তার সূক্ষ্ম দেহে সেই রকম প্রবৃত্তির উন্মেষ করতে চেষ্টা করে। আমাদের চিন্তা যত গভীর হবে, এই চিন্তামূর্তিগুলোর স্থায়িত্ত্ব ও কর্মক্ষমতা তত বেশি হবে এবং ফলপ্রদ হবে। সুতরাং আমি যদি কারুর সন্মন্ধে, ভালো চিন্তা করি, তবে তার ভালো হবে আর আমি যদি কারুর সন্মন্ধে খারাপ চিন্তা করি তবে তার খারাপ হবে।  আমার চিন্তার গভীরতা অনুযায়ী এই ফল গভীরতা ও স্থায়িত্ত্ব পাবে।  এই জন্য বলা হয়ে থাকে খারাপ কাজের চাইতে খারাপ চিন্তা ভয়ঙ্কর। আমাদের শারীরিক শক্তির একটা সীমা আছে, কিন্তু মানসিক শক্তি সীমাহীন। শরীর দ্বারা কৃত, পাপকর্মের মাত্রা শারীরিক শক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু মনের গতি  অপ্রতিরোধ্য, তাই চিন্তাশক্তিও অসীম। অতএব  মনের সাহায্যে যত পাপ করা যায়, তা  সীমাহীন। আবার মনের সাহায্যে যে ভালো কাজ করা যায় তা-ও সীমাহীন। এই জন্য সমস্ত ধর্মশাস্ত্রে মনের উপরে নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। আমাদের শুভ-ইচ্ছা যত  গভীর হবে, সূক্ষ্ম জগতে আজ্ঞাবহ সচেতন মূর্ত্তি তত মঙ্গল কর্মে লিপ্ত থাকবে। আর আমাদের অশুভ চিন্তা যত গভীর হবে, সূক্ষ্ম জগতের আজ্ঞাবহ মূর্তিগুলো তত অমঙ্গল কর্মে লিপ্ত থাকবে। বেদে  যে সব মন্ত্র আমরা পাই, তা আসলে দেবতাদের   স্তূতি ও প্রার্থনা। দেবতাদের অর্থাৎ এক বা একাধিক গুনের অধিকারী যারা, তাদের আমরা দেবতা বলি। দেবতাদের স্তূতি মানে গুনের   স্তূতি ও গুণীর কাছে প্রার্থনা। এই সব মন্ত্র আমাদের মনকে শুভ চিন্তায় নিমগ্ন রাখে, বার বার উচ্চারণ বা জপ্ আমাদেরকে মঙ্গলের পথে নিয়ে যায়। মন্ত্রের এখানে সার্থকতা।

ক্রিয়মান কর্ম্ম :  বর্তমানে আমরা যা করছি, সেটাই ক্রিয়মান কর্ম্ম। এই ক্রিয়ামান কর্ম্ম খুবই গুরুত্ত্বপূর্ন, কারণ, এই ক্রিয়মান কর্ম্মই আমাদের ভবিষ্যৎ গঠন করবে। আমি এই জীবনে যাকিছু করবো, তা আমার ভবিষ্যৎ জীবন গড়ে দেবে। ভবিষ্যৎ জীবনের শুভ-অশুভ ব্যাপার সংগঠিত করে দেবে, এই জীবনের কর্ম্ম। অর্থাৎ আজ আমি কর্তা, কাল কিন্তু আমি হয়ে যাবো ভোক্তা বা দাস। আমাদের পুরুষাকার বা স্বাধীন ইচ্ছে যদি কিছু থেকে থাকে, তবে তা এই জীবনে বিচারশীল হয়ে প্রয়োগ করতে হবে।  তবেই আমরা আগামী জীবনের সৌভাগ্য গঠন করতে পারবো।

আমরা কুকর্ম করি কেন ?  আমরা একটু স্থির হয়ে চিন্তা করলে  বুঝতে পারবো, আমাদের সমস্ত কর্মই আমাদের অবিচ্ছিন্ন চিন্তার ফল। তা সে ভালো বা মন্দ, পাপ বা পুন্য যে ধরনের কাজই হোক না কেন, এর মুলে আছে আমাদের কামনা। প্রবৃত্তির তাড়নায়, আমাদের মনে ক্ষনে ক্ষনে কুচিন্তা ফুটে উঠছে। অন্যদিকে আমাদের বিবেক-বুদ্ধি  এই কুচিন্তাকে কার্য্যে পরিণত করতে বাধা দিচ্ছে। কিন্তু যেসব কুচিন্তা বারবার স্ফূরণ ঘটাচ্ছে, তা আমাদের মনে চাপ ফেলছে। সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় আছে। এইসব দীর্ঘদিনের কুচিন্তা, একদিন উপযুক্ত সুযোগ পেয়ে, বিবেকের নির্দেশকে অগ্রাহ্য করে, আমাদেরকে কুকর্মে প্রবৃত্ত করবে। এইভাবে আমরা গর্হিত কাজ করে, পরে অনুতাপে দগ্ধ হই।

পুরুষাকার : একটা জিনিস মনে রাখবেন, বহু জন্মের কর্মফলে, আমাদের আজ এই মনুষ্য দেহ, আমাদের স্বভাব, মস্তিস্ক, চিন্তাশক্তি, বিবেক, এবং এই পারিপার্শ্বিক অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছি। আমাদের মধ্যে এই যে দৈন্যতা, এও  আমাদের পূর্ব পূর্ব জন্মের কর্মফল। আমাদের মধ্যে যে আধ্যাত্মিক ভাবের দৈন্যতা, আমাদের ইন্দ্রিয়াসক্তি, আমাদের নিষ্ঠূরতা, এগুলো সবই আমাদের পূর্ব পূর্ব জন্মের মজ্জাগত স্বভাব। এর মধ্যেও আছে আমাদের ক্ষীণ বিবেকশক্তি। আমরা যদি আমাদের ইচ্ছাশক্তিকে বিবেকের নির্দেশ অনুযায়ী চালিত করতে পারি, তবে ক্রমশঃ উন্নতির দিকে যেতে পারবো। ভাগ্য ইচ্ছার অধীন নয়, ভাগ্য কর্মের অধীন।   স্বাধীন ইচ্ছেই  পুরুষকার। তাই বিবেকের দ্বারা পরিচালিত স্বাধীন ইচ্ছা আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। স্বাধীন ইচ্ছেকে শক্তিশালী করতে হবে। ইচ্ছেকে বিবেক দ্বারা পরিশীলিত করতে হবে।  এই ভাব যখন আমাদের দৃঢ় হবে, তখন আমাদের জীবনের গতি  উর্দ্ধমুখী হবে। দেখুন জীবন একটা যাত্রা।  এই পথে চড়াই উৎরাই আছে, আপনাকে লক্ষ্য স্থির রেখে, দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলে আপনি সঠিক সময় লক্ষে পৌঁছতে পারবেন, তা না হলে পথে পথে ঘুরতে হবে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ সময়। ঈশ্বরের ইচ্ছেয় লক্ষে আপনাকে যেতেই হবে, যেখান থেকে ঈশ্বর আপনাকে কোলে তুলে নেবেন। কিন্তু আপনি যত  বিপথে যাবেন, তত আপনার বার বার জন্ম নিতে হবে, এবং আপনি জন্ম-মৃত্যুর চক্রে সুখ-দুঃখের আবর্তে ঘুরপাক খাবেন।

ভাগ্য :  আমরা আগেই শুনেছি, কর্ম্ম তিন রকম, সঞ্চিত, প্রারব্ধ, এবং ক্রিয়মান। এর মধ্যে ক্রিয়মান কর্ম্ম হচ্ছে - এখন করছি। সঞ্চিত কর্ম্ম হচ্ছে, আমরা যে কর্ম্ম করেছিলাম, আর প্রারব্ধ কর্ম্ম হচ্ছে - যে সব কর্ম্ম ফল দানে উম্মুখ বলে আমাকে জন্ম গ্রহণ করতে হয়েছে।  অর্থাৎ প্রারব্ধ কর্ম্মফল আমাকে ভোগ করতেই হবে। এই প্রারব্ধ কর্মফলের সমষ্টি হচ্ছে আমার ভাগ্য। তাই ভাগ্য আমাদের ঈশ্বরের নিদান। এই জীবনে আমাকে সেই সব সুখ-দুঃখ ভোগ করতেই হবে। সঞ্চিত কর্ম্মের যেগুলো এই জীবনে ভোগ করা সম্ভব নয়, সেগুলো থেকে যাবে ভবিষ্যৎ জন্মের জন্য। অর্থাৎ আমাদের এমন কিছু কর্ম্ম আছে যার ফল এই জীবনে ভোগ করা যাবে না। অর্থাৎ আমি এখন যেখানে জন্ম গ্রহণ করেছি,  সেখানে, আর আমার সঞ্চিত কর্ম্ম যাদের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত তার হয়তো সেখানে জন্ম গ্রহণ করেন নি। অন্য কোনো দেশে আছেন, বা আদৌ জন্ম গ্রহণ করেন নি, তবে তার কাছে আমার যা ঋণ তা পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। তাই সঞ্চিত কর্মের অবলুপ্তি এক জীবনে সম্ভব নয়। আমরাশুধু প্রারব্ধ কর্মের দাস,  এই জীবনে। আমাদের জন্ম, মৃত্যু, সুখ দুঃখ  এই প্রারব্ধ কর্মের ফল, জেক আমরা ভাগ্য বলি। এবং এটি এড়িয়ে যাবার কোনো উপায় নেই। প্রারব্ধ কর্ম্ম ক্ষয়ের  একমাত্র উপায়, ভোগ। এর কোনো অন্যথা নেই।
----------
কামনা অনুসারে আমাদের দেহলাভ :  কামনা মনের একটা ক্রিয়া।  আবার এই কামনা থেকেই আমাদের কামদেহ পুষ্টি লাভ করে। কামনার শুচিতার উপরে আমাদের পরের -জন্মের  কাম দেহের উৎকর্ষ নির্ভর করছে। এবং সেই অনুযায়ী আমাদের জন্মের স্থান, আমাদের মাতৃস্থান নির্দিষ্ট হয়। কামনা চরিতার্থ করবার জন্য আমাদের শরীর, এবং শরীর অনুযায়ী আমাদের কর্ম্ম। আবার কর্ম্ম অনুযায়ী ফল লাভ করে থাকি আমরা। কামনা দ্বারাই আমরা ঐহিক সম্পর্ক স্থাপন করি। আমাদের ভাব-বন্ধনের আকর্ষণ পরজন্মে তাদের সাথে সন্মন্ধে আবদ্ধ করে। এই ভাবেই তৈরি হয় আমাদের শত্রূ - মিত্র। আমরা কর্ম্মের দোষ গুন্ সন্মন্ধে ধারণা করতে পারি।  কিন্তু মনের মধ্যে যে কামনা উঠে তা আমাদের মনের মধ্যেই নিহিত থাকে, বাইরে প্রকাশ পায়  না। কিন্তু এর দ্বারা যে কর্ম্ম উৎপন্ন হয় - তার ফল আমরা ভোগ করি। চিন্তা ও কামনা যদি সুপথে প্রবাহিত হয়, তবে আমাদের যে শক্তি ও ক্ষমতা অর্জিত হবে, তা আমাদের সুখের কারন হতে পারে।          

আমরা অনেকে মনে করি, আমাদের মনের গভীরে যে চিন্তা স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে, সেতো মনের মধ্যেই আছে, তাতো কারুর কোনো ক্ষতি করে নি, তবে তার জন্য আবার ফল ভোগ করতে হবে কেন ? আমার মনে ভাব তো মনের মধ্যেই লয় প্রাপ্ত হয়ে গেছে - তবে তার আবার ফল কি ? লৌকিক জগতে সুপ্ত চিন্তার কোনো বিচার নেই। কিন্তু  আপনার সুপ্ত চিন্তাই আপনার ভবিষ্যৎ কর্ম্মের নির্ধারক হিসেবে কাজ করবে। আপনার চিন্তাই আপনাকে সুকর্ম-দূরকর্মে লিপ্ত করবে। এটাই কর্ম্ম পদ্ধতি।  তাই লৌকিক জগতে চিন্তার প্রতিফলন যতক্ষন না হচ্ছে ততক্ষন সেই চিন্তার বিষয় বিচার্য্য হয় না। কিন্তু সূক্ষ্ম জগতে, এই চিন্তার অপরিসীম গুরুত্ত্ব। কারন এগুলো হচ্ছে কর্ম্মের বীজ। তাই কুচিন্তা কুকর্মের বীজ। তাই আমাদের উচিত এই কুকর্মের বীজকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করা।আর আমরা আগেই শুনেছি, চিন্তাও সূক্ষ্ম বস্তূ দ্বারা নির্মিত, এবং তার অসীম শক্তি এবং এদের সামান্য চৈতন্যশক্তিও আছে। এবং এই চিন্তা শক্তি লক্ষ্য বস্তুর উপরে প্রভাব বিস্তার করে।  অতএব চিন্তা কিছু করছে না, তা নয়, এর প্রভাব সাধারণ কর্ম্মের থেকেও অনেক বেশী।  এমনকি, এই চিন্তা সময় সুযোগ পেলে আপনাকে অবশ্য়ই কর্ম্মে অনুপ্রাণিত করবে।

কর্ম্মের বিচিত্র গতি।  বিষয়টি অতিশয়  দুর্জ্ঞেয়। প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, যে যেমন কর্ম্ম করবে, সে তেমনি ফল ভোগ করবে। ব্যাপারটা কিছু এতটা সহজ নয়। কর্ম্মের আরো একটা দিক আছে। আর তা হলো, আমরা অনেক সময় দেখি, আমরা ভালো কাজ করতে গিয়েও অনেক দুর্নামের ভাগিদার হই। বা অন্যের দোষে আমাদের ক্ষতি হয়ে যায় । এর কারন কী ?

আমাদের ব্যক্তিগত কর্ম্ম ছাড়াও আমাদের চারিদিকে যে সব কর্ম্ম সম্পাদিত হচ্ছে তার প্রভাব থেকে আমি মুক্ত হতে পারবো না। আমি যে পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছি, সেই পারিবারিক কর্ম্মফল আমাকে প্রভাবিত করবে। আমি যে সমাজে জন্ম গ্রহণ করেছি, তার প্রভাব আমার উপরে পড়বে।  আমি যে দেশে জন্ম গ্রহণ করেছি - সেই দেশের শাসন কর্তার কর্ম্মের প্রভাব আমাদের উপরে পড়বে। আমি যে জাতিতে জন্ম গ্রহণ করেছি, তার প্রভাব আমাদের উপরে পড়বে। অর্থাৎ আমাদের পারিবারিক কর্ম্ম, সামাজিক কর্ম্ম, দেশজ কর্ম্ম, জাতিগত কর্ম্ম সবই আমার উপরে প্রভাব পড়বে। তাই বলা হয়েছে, একা ভালো থাকা যায় না। আমাদের সবাইকে নিয়েই ভালো থাকতে হবে। পরিবারের চিন্তা, সমাজের চিন্তা, জাতির চিন্তা, দেশের চিন্তা সবই আমার সুখভোগ বা দুঃখভোগের কারন হতে পারে। তাই সমাজে যখন মহাত্মারা আসেন, তারা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন না, শুধুমাত্র নিজের মুক্তির চেষ্টা করেন না। তারা আমাদের সবার বিচারের শুদ্ধতা আনবার জন্য সচেষ্ট হন। এই প্রসঙ্গে গীতার কথা আসে। যোগীশ্রেষ্ঠ শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যোগভ্রষ্ট ব্যাক্তিগন পবিত্র স্বভাব ও ধনী পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। এবং আমাদের সবাইকে বলছেন, আসক্তি-হীন  ভাবে কর্ম্ম করতে। অর্থাৎ শুদ্ধ কর্ম্মে যেমন আমাদের লিপ্ত থাকতে হবে, তেমনি আসক্তিহীন হয়ে কর্ম্ম করতে হবে। ব্যষ্টির কল্যাণ নয়, সমষ্টির কল্যাণের জন্য আমাদের কর্ম্ম করতে হবে।    

কর্ম্ম বন্ধন থেকে মুক্তি পাবার উপায় : শুধু মানুষ নয়, যে কোনো জীব-জন্তু কর্ম্ম না করে বাঁচতে পারবে না। আর কর্ম্ম থাকলে তার ফল থাকবে। তাহলে আমরা এই জন্ম-মৃত্যু চক্র থেকে রেহাই পাবো কি করে ? দেখুন দৈহিক কর্ম্ম থেকে আমাদের বেরোবার কোনো উপায় নেই। অর্থাৎ দেহকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য আমরা যে সব কর্ম্ম করে থাকি, তাকে বলে দৈহিক কর্ম্ম । যেমন, খাওয়া, শোয়া, নিঃস্বাস -প্রশ্বাস নেওয়া, হজম করা, বাহ্য ত্যাগ করা ইত্যাদি ইত্যাদি । আর এর জন্য কোনো পাপ বা পুন্য হয় না। সঞ্চিত কর্মের মধ্যে এর কোনো আশ্রয় নেই। সচেতন মন, যে চিন্তার অনুশীলন করে, তা  থেকেই কর্ম্মের উদ্ভব। আর এই কর্ম্ম-ই আমাদের পাপ-পুণ্যের ভাগিদার করে। পূর্ব্ব জীবনে আমরা যেমন ও যে পরিমান চিন্তার অনুশীলন আমরা করেছি, এবং সেই অনুযায়ী কর্ম্ম করেছি, মানসিক শক্তি লাভ করেছি , আজ তারই ফল আমরা এখন ভোগ করছি। 

গাঢ় চিন্তাই হচ্ছে  ধ্যান। যে অবস্থায় চিত্তবৃত্তি এক বিষয়ে নিবদ্ধ থাকে, জ্ঞানবৃত্তির সেই একতানতাকে বলে ধ্যান। প্রতিদিন এই ধ্যানের অভ্যাস করলে ক্রমশঃ একাগ্রতা শক্তি বৃদ্ধি পাবে। এবং আমরা বাহ্য বিষয় থেকে মনকে ইষ্ট বিষয়ে আবদ্ধ করতে পারবো। মনের উচ্চতর স্তরে, যে চিন্তার উদ্ভব হয়, তাতে কামনার লেশমাত্র থাকে না।  স্বার্থসিদ্ধির কোনো কল্পনা তখন থাকে না। তাই
কামনা-জাত  কোনো কর্ম্মও  থাকে না। আমরা জানি, মানুষ প্রয়াণকালে যেমন চিন্তা করে, বা যে ভাবে তন্ময় থাকে, পরবর্তী জন্মে সে সেই মত দেহ ধারণ করে। তাই ধ্যানের মধ্যে থাকতে পারলে, আমরা পার্থিব বিষয় থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারি, এবং জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকেও  মুক্ত থাকতে পারি। আমরা আজ যাদের সঙ্গে সন্মন্ধে আবদ্ধ হয়েছি, পূর্ব্বে বা পূর্ব্ব জন্মে নিশ্চই তাদের উদ্দেশ্য আমাদের চিন্তাস্রোত প্রবাহিত হয়েছিল, তাই আমরা তাদের সঙ্গেই, বা তাদের ঘরেই জন্ম গ্রহণ করেছি। তাই বন্ধন  মুক্তির একমাত্র পথ ধ্যান যা আমাকে বিষয় থেকে মুক্ত রাখবে। কর্ম্ম বন্ধন  থেকে মুক্তি দেবে, আর জন্ম মৃত্যুর চক্র থেকে রেহাই দেবে।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওম 

পুনশ্চ :

গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, কর্ম্ম তিন রকম :কর্ম্ম, অকর্ম্ম, ও বিকর্ম্ম। শাস্ত্র অনুযায়ী কর্ম্ম করাকেই আসল কর্ম্ম বলে। আর শাস্ত্রনিষিদ্ধ যে কাজ তাকে বলে বিকর্ম্ম। আর কর্ম্ম থেকে বিরত থাকা অর্থাৎ কর্ম্ম সন্যাস - এর নাম হচ্ছে অকর্ম্ম।
কর্ম্ম : আমাদের সমস্ত কর্ম্ম-ই শাস্ত্র অনুযায়ী হওয়া উচিত। এখন কোন শাস্ত্র অনুযায়ী আমাদের কর্ম্ম করা উচিত। যে শাস্ত্র আমাদের যজ্ঞে পশুবলি দিতে বলছে ? যে শাস্ত্র মানুষকে অস্পৃশ্য করে রেখেছে। যে শাস্ত্র মানুষকে ঘৃণা করে শেখায়। প্রাচীন ঋষিরা, এমনকি রাজ্-রাজারা যজ্ঞ করতেন, বিভিন্ন ধরনের যজ্ঞ করতেন। এবং প্রত্যেকটি যজ্ঞের এক একটা উদ্দেশ্য ছিল।  এবং এর সবই কামনা প্রসূত। মন মন ঘি ঢালা হতো। তাহলে কি আমাদের সেই যজ্ঞকর্ম করতে হবে ? না, যজ্ঞ হচ্ছে, ব্রহ্মাগ্নিতে অহংকে আহুতি দেওয়া। আমাদের অহংকে আহুতি দিতে হবে, মন মন ঘি ঢালা নয়, বা পশুবলি দেওয়া নয়। আর দিতে হবে কোথায়, না ব্রহ্মাগ্নিতে, অর্থাৎ বেল কাঠের বা ডুমুর কাঠের অগ্নিতে নয়, জ্ঞান দ্বারা প্রজ্বলিত যে ব্রহ্ম সেখানে আহুতি দিতে হবে।   শাস্ত্র বলতে বোঝায় - স্ব-অস্ত্র। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য যার সাহায্য নিতে হয়, তাই আমাদের শাস্ত্র।  এখন এই শাস্ত্র যারা রচনা করেছেন,  তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য যা বলে গেছেন, তাইই কি শাস্ত্র ? না মানব জাতির স্বার্থে যা রচিত হয়েছে, তাইই শাস্ত্র। তথাকথিত ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের রচনামাত্রই শাস্ত্র নয়। পশুবলি , বা হিংসায় প্রেরণা, বা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করা শাস্ত্রের উদ্দেশ্য নয়, শাস্ত্রের উদ্দেশ্য, সর্বেষাং মঙ্গলম ভব, সর্ব্বে সন্তু সুখিনঃ । সবার যাতে মঙ্গল হয়, অন্ততঃ বেশিরভাগের যাতে মঙ্গল হয়, সেই আপ্তবাক্যই শাস্ত্র। 
বিকর্ম্ম : শাস্ত্র অনুযায়ী কাজ না করাই বিকর্ম্ম। এখন শাস্ত্র বলছে, মিথ্যে কথা বলবে না। কিন্তু যদি মহৎ কাজের জন্য, বা কারুর প্রাণ রক্ষার জন্য, বা কোনো মায়ের সন্মান রক্ষার জন্য যদি মিথ্যে বলতে হয়, তবে সেটা কর্ম্ম হতে পারে। কাউকে আঘাত করবার জন্য অস্ত্র চালানো, আর ডাক্তারের অস্ত্র চালানো এক ব্যাপার নয়। ডাক্তারের অস্ত্র চালানো কর্ম্ম, কিন্তু ডাকাতের অস্ত্র চালানো বিকর্ম্ম। আসলে আমরা কি করছি সেটা বড়  কথা  নয়, কেন করছি সেটা বড়ো  কথা। তাই উদ্দেশ্য বিহীন হয়ে কর্ম্ম নয়, সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কর্ম্ম করতে হবে আমাদের।
অকর্ম্ম : কর্ম্ম সন্যাসকে  বলে অকর্ম্ম। কিন্তু তাই বলে, কোনো কাজ না করে, চুপ চুপ বসে থাকাকে, অকর্ম্ম বলে না। দেহ কর্ম্মহীন থাকতে পারে না। কর্ম্ম সন্যাস তাকেই বলে, যিনি কর্ম্মের দ্রষ্টা হতে পারেন, কর্তা  নয়। কর্ম্ম আমাদের জ্ঞানের আলো  এনে দিতে পারে। আর জ্ঞান মানে ঈশ্বর জ্ঞান। আর ঈশ্বর সম্পর্কে যখন আমাদের জ্ঞান হবে, তখন আমাদের ঈশ্বরভক্তি হবে। অতএব অকর্ম মানে আলসেমী নয়। অকর্ম মানে অকর্তা জ্ঞানে কর্ম করা।
এখন কর্ম্ম ফলের বন্ধন  কার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর কার ক্ষেত্রেই বা প্রযোজ্য নয়। আসলে কর্ম্ম কর্তাকেই বন্ধন  করে, কর্মচারীকে নয়। যার কর্তৃত্ব-অভিমান আছে, সেই কর্তা। তেমনি, ভোগে যার অভিলাষ আছে, তিনিই ভোক্তা। আসলে কর্ম্ম যেমন আমাদের চিন্তার ফল, ভোগও চিন্তার ফল। সেই জন্য, কি করছেন সেটা বড়  কথা নয়, কেন করছেন,  সেটা বড়  কথা। আপনার বিচার আপনার কর্ম্মকে প্রভাবিত করবে, এবং আপনাকে ফল ভোগ করাবে। সেই জন্য বলা হয়ে থাকে, যিনি কর্তৃত্বাভিমানহীন  তিনি নিরাশ্রয়, নিত্যতৃপ্ত। এনাদের  কর্ম্মে কোনো ফালাকাঙ্খা নেই, আমি করছি, সেই ভাবও  নেই। তাই ভোগ বা দুর্ভোগ এদের প্রভাবিত করতে পারে না।
এখন কথা হচ্ছে, জীব পুনঃ পুনঃ জন্মাচ্ছে, পুনঃ পুনঃ মরছে, জন্মালে কর্ম্ম করতে হচ্ছে, আবার কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য আবার জন্মাতে হচ্ছে। এই গোলক ধাঁধায় জীব অবিরত ঘুরছে।  এর থেকে অব্যহতি পাবার কি কোনো উপায় নেই ?
এইখানে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, "পরমাং গতিম" (৮/২১) . বা "মে পরমং ধাম" আমার পরমধাম, যা পেলে আর প্রত্যাবর্তন হয় না। এখন সেই পরম ধামে পৌঁছিবার উপায় কি ?  এইখানে ভগবান বলছেন, " ভক্ত্যা লভ্যস্ত্ব অনন্যয়া" - অর্থাৎ কেবল ঐকান্তিক ভক্তি দ্বারা তিনি প্রাপ্য।  এবং এই অনন্য ভক্তি দ্বারা জীবের গতাগতি শেষ হতে পারে।
দেখুন দুটো পথ, দুই ধরনের ভক্ত। একটা সরল-সোজা পথ। যে পথে গেলে আর ফিরে আসতে  হয় না। আর একটা পথ হচ্ছে, চক্রাকারে, যেটা ঘুরে ফিরে আবার একই জায়গায় মিলিত হয়। একদল বলছেন, ভগবান আমি মুক্তি চাই না।  আমি যেন তোমার দাসানুদাস হয়ে থাকতে পারি।  তোমার স্মরণাগতি  নিয়ে থাকতে পারি। এই চক্রটি বিশাল।  ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ, তপঃ ও সত্যম।  এই সত্যম বা ব্রহ্মলোক পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরতে হয়।
আর সরলরেখা ধরে  যারা যান, অর্থাৎ সেই বিরাট পুরুষের লীলালোকে, তারা আর ফিরে আসেন না। এই দুটো পথই সাধকদের জন্য।  অর্থাৎ এই জীবনে আপনি যে পর্যন্ত সাধনায় অগ্রসর হলেন, পরবর্তী জীবনে আপনি সেখান থেকে শুরু করবেন, এবং সাধনার উপুযুক্ত সময় ও পরিবেশ পাবেন।
আর একটা উপায় হচ্ছে, স্থান বা ক্ষণ মহত্ত্ব। পাণ্ডবেরা, স্বর্গারোহন করবার জন্য, উত্তরদিকে যাত্রা করেছিলেন । আমাদের অনেকের ধারণা হচ্ছে কাশীতে  মৃত্যু বরন আর মরজগতে ফিরে আসতে  হয় না। বা দেবস্থানে মৃত্যু  করলে জন্ম মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়।  আবার সময় ভেদ মানুষকে জন্ম মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেতে পারে।   ভীষ্মদেব, উত্তরায়ণে মৃত্যু কামনা করেছিলেন । কিন্তু কেন ?
আমরা জানি সূর্য্য পুব থেকে পশ্চিমে যায়। যে সব জীব মাত্র এক দিন বাঁচে, এই বিশ্বাস নিয়েই তারা মারা যায়।   সূর্য্যের আর একটা গতি আছে, সেটা হচ্ছে উত্তর-দক্ষিণ।  যারা এক বছর  বা তার বেশি বাঁচে, তারা এটা খেয়াল করলেই ধরতে  পারবে। সূর্য্য যখন, উত্তর দিকে যায়, অর্থাৎ পৌষসংক্রান্তি থেকে আষাঢ়মাসের সংক্রান্তির দিন পর্যন্ত সূর্য্যের গতি উত্তর দিকে থাকে। আবার আষাঢ়মাসের সংক্রান্তির দিন  থেকে পৌষমাসের সংক্রান্তি পর্যন্ত দক্ষিণ অভিমুখী থাকে। ভারতের উত্তর দিকে হিমালয়, যেখানে দেবতাদের বাস। এবং উত্তর দিক উচ্চ অবস্থান, আমাদের দক্ষিণে সমুদ্র, অর্থাৎ নিম্ন ভূমি। সাধক সব সময় উর্দ্ধগতি প্রাপ্ত হতে চান । তাই নিম্নগতির সঙ্গে দক্ষিণ, আর উর্দ্ধ গতির সঙ্গে উত্তর গমনের একটা ভাবনা আমাদের প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে।
আমরা দেহ-মন ও আত্মার সম্মিলিত সত্ত্বা। আমরা  যখন দেহভুমিতে থাকি, তখন আমরা পশুবৎ। যখন আমরা মনোভূমিতে থাকি তখন, আমরা মননশীল বা মানুষ । আর যখন আমরা আত্মভূমিতে থাকি, তখন আমরা দেবতা বা মহামানব । আত্মা যখন সাধনা আরম্ভ করলো, তখন সে উত্তরের দিকে চললো। ধ্রুব নক্ষত্র তখন আমাদের মাথার উপরে।  ধ্রুব অর্থাৎ অচল সত্য তখন আমাদের মাথার উপরে। উত্তরদিকে গেলে সনাতন সত্য শিবে আরোহন করি আমরা। এর বিপরীতে চললে, ধ্রুব নক্ষত্র নিচের দিকে নাবতে লাগলো। সূর্য্য দক্ষিণের দিকে যেতে লাগলো। আমরা ভোগাভিমুখী হতে লাগলাম। সুতরাং ঈশ্বর বিমুখ হয়ে গেলাম।
আবার বলা হয়ে থাকে, আমাদের মন চন্দ্র দ্বারা প্রভাবিত। শুক্লপক্ষে চাঁদের উদয়ে মন আত্মমুখী।  আর কৃষ্ণপক্ষে আমাদের মন দেহমুখী। রাতে চাঁদের রাজত্ব, মানসিক উন্নতির সময় ।  তাই সাধকরা রাতে জেগে থাকেন। আমরা  রাতে নিদ্রিত থাকি । বলা হয়ে থাকে রাতে যারা সাধনার জন্য  জেগে থাকেন, তারা দেবযানে যাতায়াত করেন, আর যারা নিদ্রা যান তার পিতৃযানে যাতায়াত করেন।  পিতৃযান মানুষকে চক্রাকারে ঘোরায়।  অর্থাৎ জ্জন্মমৃত্যুর চক্র তার পরিক্রমার পথ।  আর দেবযান দিব্যলোকে নিয়ে যায়।  যেখানে গেলে,  ফিরে আসতে না চাইলে, আর ফিরে আসতে  হয় না।
এই দুই পথের সন্ধান যার জানা আছে, তিনি মোহগ্রস্থ হন না। তবে বই পড়ে জানা, বা কারুর কাছ থেকে শুনে জানা, জানা নয়, বিবেকগুরুর কাছ থেকে জানাই জানা। তাই ভগবান অর্জুনকে বলছেন, যোগযুক্ত হও হে অর্জুন।  "যোগযুক্ত ভবার্জ্জুন " ।
এবার আমরা আলোচনার শেষ দিকে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, একমাত্র অনন্য ভক্তির দ্বারাই আমাকে অর্থাৎ পরম পুরুষকে  জানা যায়। এখন ভক্ত কে ?
 ভক্ত হচ্ছেন তিনি যিনি : ১. সর্বদা আমার নাম কীর্ত্তন করেন ; ২. যিনি সর্ব্বদা আমাকে পাবার জন্য চেষ্টা করেন। ৩. আমাকে পাবার জন্য সাধনমার্গে দৃঢ়ভাবে লেগে থাকেন ; ৪. যিনি সর্ব্বদা আমাকেই নমস্কার করেন। ৫. সব সময় আমাতে যুক্ত থেকে আমারই উপাসনা করেন। এর থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি, যিনি কর্ম্মে, চিন্তনে, মননে সর্ব্বদা শ্রীহরিতে যুক্ত থাকেন তিনিই ভক্ত।
শ্রী ভগবান বলছেন, প্রাপ্য বস্তু হচ্ছে ভগবান আর প্রাপ্তির উপায় হচ্ছে ভক্তি। ভাগবত তত্ত্ব জ্ঞাত যে ভক্ত তিনি সেই পরমধামে নিত্য বিরাজ করেন। তার আর এই মর জগতে ফিরে আসতে  হয় না ।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ ; হরি ওং। .....
 - 


No comments:

Post a Comment