Thursday 7 March 2019

ধ্যান ও সাধনা - মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্তের বই - "তত্ত্বজ্ঞান-দ্বিতীয় খণ্ড- সাধনা " অবলম্বনে

ধ্যান ও সাধনা  



 মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্তের বই - "তত্ত্বজ্ঞান-দ্বিতীয় খণ্ড- সাধনা " অবলম্বনে

সাধনা - কথাটা খুবই প্রচলিত। কিন্তু সাধনা বলতে আমরা কি বুঝি ? মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন অভ্যাসকে সাধনা বলে।  যেকোনো সফলতার  পিছনে থাকে সাধনা। যে কোনো সফলব্যক্তির পেছেনে থাকে সাধনা। এই সাধনা বা অভ্যাস দুই প্রকার।  এক -পার্থিব বা বাহ্যিক জগৎ সম্মন্ধীয় সাধনা। আর দুই - আধ্যাত্মিক বা সূক্ষ্মাজগৎ সংক্রান্ত সাধনা। পার্থিব বা বাহ্যিক জগৎ সম্মন্ধীয় সাধনা দ্বারা আমরা পার্থিব জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন  করতে পারি। আমাদের জাগতিক জগতের উন্নতি এই সাধনবলেই সম্পন্ন হয়েছে। অন্যদিকে,  আধ্যাত্মিক বা সূক্ষ্ম জগৎ সংক্রান্ত সাধনা থেকে আমরা সূক্ষ্ম জগৎ সম্পর্কে জানতে পারি। পরিণামে,  ব্রহ্মজ্ঞানের প্রাপ্তি হয়ে থাকে। মহাত্মা বলছেন : যে অভ্যাস প্রভাবে মানুষের দোষরাশি গুণরাশিতে পরিণত হয়, আত্মার সতেজ দশা সংসাধিত হয়  এবং পরিশেষে জীব বা জীব-আত্মা পূর্ণস্বরূপ সৎ-চিদানন্দ  অনন্ত মহার্ণবে সুনিমগ্ন হয় - সেটাই আধ্যাত্মিক সাধনা। আসলে  গুরুদেবের লেখা পান্ডিত্যে ভরা। সহজ পাচ্য নয়। তাই আমরা  আমাদের মতো করে সহজ ভাষায় বিষয়ে প্রবেশ করবো।

গুরুদেব বলছেন, সাধনা এমন একটি বিষয় যে তুমি চাও বা না  চাও, ইচ্ছা করো বা না করো, তোমাকে কোনো না কোনো সাধনা করতেই হবে। এই যে ইচ্ছার উর্দ্ধে যে সাধনা, আমাদের আপনা আপনি হয়, তাকে বলে ব্যতিরেকি সাধনা। আসলে সেই মঙ্গলময় অনন্ত পুরুষ, পূর্ণ পুরুষ, তাঁর ইচ্ছে পূরণের জন্য, তিনি এই সাধনা আমাদের দিয়ে করান। তিনি চান তার অংশ সমূহকে কালে কালে অনন্ত শক্তি প্রদান করতে। তাই ব্যতিরেকি সাধনা, মঙ্গলময়ের নিয়মে, আপনা আপনি হয়, প্রাকৃতিক ভাবেই হয়।  এর জন্য আমাদের কোনো প্রয়াস করতে হয় না। এক টুকরো বীজ কোথাও পড়ে থাকলে, বিনা চেষ্টাতেই, অঙ্কুর উদ্গম হবে। কালে কালে গাছে বা বৃক্ষে পরিণত হবে। জীবের , শৈশব  থেকে কৈশোর, কৈশোর   থেকে যৌবন, যৌবন থেকে প্রৌঢ়, প্রৌঢ়  থেকে বৃদ্ধ - এই উন্নতি বা ক্রমবিকাশ আপনা আপনি হয়।  এর জন্য আমাদের কিছু করতে হয় না।এমন কি মৃত্যুর জন্যেও আমাদের কিছু করতে হয় না।    আমাদের হজম করার জন্য কিছু করতে হয় না। চোখের পাতা আপনা আপনি পড়ে। এর জন্য আমাদের আলাদা করে কিছু করতে হয় না। গুরুদেব বলছেন, এগুলো যদি তুমি সচেতন ভাবে করো, তবে তোমার মঙ্গল হবে। এবং এই সচেতন ভাবে করাকেই সাধনা বা ধ্যান বলে। ধ্যান অর্থাৎ মনোযোগ, বা চেতন বা জাগ্রত অবস্থায় কিছু করা। অমনোযোগী হয়ে করা  আর মনোযোগ সহকারে করার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে । যে কোনো কাজ মনোযোগ সহকারে করলে সেটা উৎকৃষ্ট ফল দেবে, আর মনোযোগ না দিয়ে করলে সেটা যেমন তেমন হবে।

তুমি  বাল্য অবস্থায় বৃদ্ধ আবার বৃদ্ধ অবস্থায় বালক হতে পারো, যদি তুমি চেষ্টা করো, সাধনা করো, সচেতন থাকো। চেষ্টা করলে যে কোনো অবস্থায় তুমি আনন্দে থাকতে পারো। আর চেষ্টা না করলে তুমি সময়ের দাস, পরিস্থিতির দাস হয়ে যাবে।  এবং পরিস্থিতি তোমাকে সুখ দুঃখের অনুভূতি দেবে। আর তুমি যদি সচেতন থাকো, তবে পরিস্থিতি তোমার দাস হয়ে যাবে। আর তুমি সাম্যাবস্থায় অবস্থান করবে। সাধনা করা আর না করার মধ্যে এখানেই পার্থক্য।

গুরুদেব বলছেন - যত প্রাতঃস্মরণীয় পুরুষ সবাই সাধনা করেই পাশমুক্ত হয়েছেন। তা সে দেবাদিদেব মহাদেব বলুন,  কার্ত্তিক - গনেশ বলুন  আর কংশ -ধ্বংস কারী কৃষ্ণ বলুন আর ধনুকধারী রাম
বলুন , সবাই সাধন বলেই শক্তি অর্জন করেছেন। বুদ্ধদেব বলুন আর যীশু বলুন, মোহাম্মদ বলুন আর মহাবীর বলুন সবাই সাধন বলেই শক্তি অর্জন করেছেন। অতএব সাধনাই শক্তি, জ্ঞান, প্রেম , পরমানন্দ লাভের একমাত্র ও অদ্বিতীয় পথ।

সাধনার বিভাগ :

আমরা আগেই বলেছি সাধনা দুই প্রকার : আধ্যাত্মিক ও পার্থিব।  আবার আধ্যাত্মিক সাধনা দুই রকম। এক - অন্বয়ি সাধনা  ; দুই - ব্যতিরেকি  সাধনা।

অন্বয়ি সাধনা  :  মহাত্মা বলছেন - সাধনীয় বিষয়ের অংশতঃ সাধনা-সহকারে সমুদায়ের সাধনা করা যার বিষয়, তাকে অন্বয়ি সাধনা বলে। মনে করো ধর্মে বিশ্বাস করতে হবে।  তাহলে ধর্মের উপকারিতা অল্প অল্প জ্ঞাত হয়ে, ধীরে ধীরে ধর্মের প্রতি বিশ্বাস, বা আগ্রহ বাড়িয়ে ধর্মে লিপ্ত হওয়াকে অন্বয়ি সাধনা বলে।  অর্থাৎ ধীরে ধীরে কোনো বিষয়ের প্রতি নিবিষ্ট চিত্ত হওয়াকে অন্বয়ি সাধনা বলে।

ব্যতিরেকি সাধনা : ধর্মাচরণ না করার ফলে যে অপকারিতা হয় তা পদে পদে অনুভব করে, বা দেখে  ধর্মে বিশ্বাস অর্জনকে ব্যতিরেকি সাধনা বলে।

আধ্যাত্মিক সাধনাকে আবার শ্রেয়ঃ ও প্রেয়ো ভেদে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সাংসারিক কাজ সম্পূর্ণ ভাবে পরিত্যাগ করে সাধনাকে শ্রেয়ঃ সাধনা বলা হয়। শ্রেয়ঃ সাধক বলেন সংসারে থেকে সাধন হয় না। তাই এখনই সংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়ো। অন্যদিকে প্রেয়ো সাধক বলেন, সংসারে থেকেই  মাতা-পিতার সেবা করো, স্ত্রী-পুত্রের প্রতি কর্তব্য পালন করো, তাদের ভালোবাসলেই, ঈশ্বরের সেবা করা হবে । গুরুদেব বলছেন প্রথমে প্রেয় পথ পরে শ্রেয়ঃ পথ অবলম্বন করা কর্তব্য।

এ ছাড়া যোগ সাধনা, গুন্ সাধনা, মন্ত্র  সাধনা - অর্থাৎ যোগ সাধনা বা শারিরীক কসরত দ্বারা  শরীরকে সুস্থ রেখে ঈশ্বরে নিবিষ্টচিত্ত হওয়াকে যোগ সাধনা বলে। মংত্র সাধনা আসলে শব্দ বা ধনির সাহায্যে ঈশ্বর অনুভূতি বা সাক্ষাৎ লাভ। এর পর গুন্ সাধনা। ঈশ্বর  অনন্ত গুনের অধিকারী।  তাঁর সেই গুনের সাধনা অর্থাৎ অভ্যাস দ্বারা নিজেকে উন্নত করা, একেই গুন্ সাধনা বলে।

এর পর আছে , সশক্তিক সাধনা এবং নিঃশক্তিক সাধনা। অর্থাৎ ক্রমশঃ শক্তি সঞ্চয় করে নিজেকে পূর্ণব্রহ্মের অন্তর্গত হওয়াকে সশক্তিক সাধনা বলে। আর আমার কিছুই নাই , আমি সর্বশূন্য, সবই তুমি  এই ভাব অবলম্বন করে যে সাধনা তাকে নিঃশক্তিক সাধনা বলে।

এতক্ষন মহাত্মা গুরুনাথ সাধনার প্রকারভেদ বোঝাচ্ছিলেন।  এবার সাধকের কি কি করা উচিত সে সম্পর্কে বলছেন।

সত্য : গুরুদেব বলছেন, সাধককে সর্বদা সত্য পথে চলতে হবে।  সর্বদা  সত্যব্রত অবলম্বন করতে হবে। সত্য ভাষণ, সত্যপথে গমন এবং পরম অবলম্ব-বোধে সত্য গ্রহণ করতে হবে। মহাত্মা বলছেন, তোমার মধ্যে যখন অটলভাবে সত্য প্রতিষ্ঠা হবে, তখন তুমি যা বলবে তাই সত্য হবে। সাধক তখন রোগীকে রোগ মুক্ত করাতে পারবে। নির্ধনকে ধন লাভ করাতে পারবে। অভক্তকে ভক্তি লাভ করাতে পারবে। অর্থাৎসত্যেপ্রতিষ্ঠ  সাধক  মুখে যা বলবেন, বাস্তবে তাই হবে।

অহিংসা : অর্থাৎ হিংসা না করা। গুরুদেব বলছেন হিংসা দুই রকম - এক : প্রাণী বধ জনিত হিংসা ;
 দুই : প্রাণী পীড়ন জনিত হিংসা। অহিংস ব্যক্তি সদা আনন্দে থাকে। শুধু আনন্দে থাকে না, অহিংস ব্যক্তির আশেপাশে একটা অহিংস-পরিবেশ তৈরী হয়। ফলতঃ অহিংস ব্যক্তির আশেপাশে যারা থাকে এমনকি জীব জন্তুও অহিংস হয়ে যায়, এটা আপনা আপনি হয়ে পড়ে । হিংসা, হিংসাকে ডেকে  আনে।  আসলে তুমি যা দিচ্ছো - সেটা তরঙ্গ আকারে ছাড়িয়ে পড়ে।  ফলে অহিংস সাধককে ঘিরে  একটা অহিংসার  বাতাবরণ তৈরি হয়।
অহিংসার কথা বলতে গিয়ে গুরুদেব আমাদেরকে সতর্ক করেছেন : বলছেন আমরা অনেকে মনে করি : আমরা মাছ-মাংস খাই বটে, কিন্তু মাছ ধরি না, মারি না, রান্নাও করি না তবে আমরা কি ভাবে দোষী হবো ? গুরুদেব বলছেন : আহরণকারী - অনুমতিদায়ক - বধকারী -  ক্রয়-বিক্রয় কারী -সংস্কারকারী ও উপভোগকারী এই ছয়জনই খাদক। অতয়েব গুরুদেবের কথা অনুযায়ী এই সব বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, যদি কিনা আমরা সত্যিকারের সার্থক অহিংস-সাধক হতে চাই।

অস্তেয় : বা  চুরি না  করা, অর্থাৎ ধনস্বামীর অনিচ্ছায় বা অজ্ঞাতসারে তার ধন গ্রহণ করাকে চুরি করা বা স্তেয় বলে। শুধু চুরি করা না, চুরি করার কথা ভাবাও পাপ। গুরুদেব বলছেন : মানুষের মন থেকে যখন পরধন গ্রহণের ইচ্ছা সম্পূর্ণ ভাবে দূরীভূত হয়, তখন এক বিচিত্র ব্যাপার সংগঠিত হয়। যে ধনের জন্য মানুষ চৌর্য্য বৃত্তি অবলম্বন করে সেই  ধন-রত্ন রাশীকৃত রূপে সাধকের পদানত হয়।

ব্রহ্মচর্য্য :  ব্রহ্মচর্য কথাটির মানে বীর্যকে রক্ষা করা। বীর্য হচ্ছে রক্তের নির্যাস। দুধ থেকে যেমন ঘি মাখন হয় - তেমনি মানুষের রক্ত থেকে তৈরি হয় বীর্য। এই বীর্য ধী শক্তি বর্ধক।  প্রাণ সৃষ্টির পুরুষাকার, এই বীর্যের মধ্যে অবস্থান করে। এটি আমাদের লিঙ্গমূলে অবস্থান করে। এই শক্তি তমগুনে নিম্নগামী হয় হয়, অর্থাৎ প্রকৃতির দিকে ধাবিত হয়।  আবার রজ গুনে এই শক্তি ঊর্ধ্বগামী হয়। কুণ্ডলিনী জাগ্রত হওয়া মানে এই বীর্যের যে শক্তি অর্থাৎ ঊর্যাশক্তি সুষুম্না নারী বেয়ে উর্ধগামী হওয়া। অতএব  বীর্য রক্ষা করা মানে আপনার ঊর্যাশক্তি বৃদ্ধি পাওয়া। আপনার মন - শরীর এক অপূর্ব বলবতি-অনাবিল   আনন্দে চনমন করবে যদি আপনার ঊর্যাশক্তি বৃদ্ধি পায় । গুরুদেব বলছেন ব্রহ্মচর্য  পালন না করলে মানুষ কখনোই মহৎ কর্মে  সিদ্ধমনোরথ হতে পারে না।

অপরিগ্রহ : অপরিগ্রহ কথাটার মানে অন্যের কাছ থেকে কোনো দ্রব্য না নেওয়া। অর্থাৎ দান গ্রহণ না করা। আগে বলেছেন চুরি না করতে অর্থাৎ না বলে কিছু না নিতে, এবার বলছেন দান গ্রহণ না করতে। গুরুদেব বলছেন দান গ্রহণ করলে দাতার মধ্যে যে নিকৃষ্ট ভাব, গ্রহীতার মধ্যে সেটা চলে আসতে  পারে। এ ছাড়া  তুমি কারুর কাছ থেকে দান গ্রহণ করার ফলে  দাতার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়বে। তোমার মন বিশুদ্ধ থাকবে না। তুমি দাতার অনুগ্রহের পাত্র হয়ে যাবে। মহাত্মারা সদা সর্বদা মাথা উঁচু করে বাঁচেন। কিন্তু পরিগ্রহ করলে অর্থাৎ দান গ্রহণ করলে তোমার মন বিশুদ্ধ থাকতে পারে না। আর মন যখন তোমার শুদ্ধ পথে চলবে তখনি তুমি মুক্তিপথে অগ্রগামী হতে পারবে। গুরুদেব বলছেন অপরিগ্রহে প্রতিষ্ঠিত হলে পূর্ব জন্মের বিষয় জানা যায়।

শৌচ :  শৌচ অর্থাৎ শুচিত্ব। এটি দুই প্রকার।  একটা হচ্ছে বাহ্যিক শুচিত্ব - যা আমরা শরীর  পরিষ্কার, বেশভূষা পরিষ্কার ইত্যাদির মাধ্যমে রাখতে পারি।  আর একটা হচ্ছে আভ্যন্তরীণ শুচিত্ব যা আমাদের জ্ঞান ও তপস্যা দ্বারা করতে হবে। আসলে এটি অন্তঃকরণের শুদ্ধি। এই  অভ্যন্তরীণ শুচিত্বই প্রধান। এই অভ্যন্তরীণ শৌচ থেকেই মনের প্রফুল্ল্তা আসে, একাগ্রতা আসে,আমরা ইন্দ্রিয়কে জয়  করতে পারি অর্থাৎ জিতেন্দ্রিয় হতে পারি।  এবং সর্বপরি আমাদের আত্মদর্শনের ক্ষমতা জন্মে এই অভ্যন্তরীণ শুচিতা থেকেই। তাই আমাদের সর্বদা শৌচ বজায় রাখতে হবে তা সে শারীরিক হোক আর অন্তঃকরণের হোক। এটাই আমাদের আত্ম-দর্শনের পথ দেখাবে।

সন্তোষ :  বর্তমান বা উপস্থিত অবস্থাতে তৃপ্ত থাকা। এতেই পরম সুখ লাভ হবে। তোমার যা কিছু আছে তাতেই তুমি সুখী হও। ঈশ্বর যা কিছু দিয়েছেন তাতেই তুমি তৃপ্ত হও। আসলে ঈশ্বর প্রদত্ত সম্পদের পরিমাপ করতে পারিনা না বলে আমরা ভাবি কম পড়ে  গেল, আর এই কম পড়ার বেদনা আমাদেরকে  কস্তূরী  মৃগের মতো চঞ্চল করে তোলে। আমরা জাগতিক সুখের আশায় দাপাদাপি করি আর কষ্ট ভোগ করি। প্রকৃত জ্ঞান আমাদের সন্তোষ দিতে পারে।  তাই জ্ঞানী সর্বদা সন্তোষ লাভ করেন। আমরা যারা অজ্ঞান সর্বদা অতৃপ্তিতে ভুগি ও কষ্ট পাই।

তপস্যা : নিবিষ্ট চিত্তে, কঠোর ক্লেশ স্বীকার করে, নিজ নিজ কর্মে লিপ্ত থাকাকেই তপস্যা বলে। জঙ্গলে, পাহাড়ে, নদীর  পাড়ে একাকী বসে থাকাকেই তপস্যা বলে না। তপস্যা হচ্ছে, স্ব - স্ব -ধর্ম- কর্মে নিবিষ্ট চিত্ত  হওয়া, একাগ্র হওয়া, যা কিছু করছো তাতে সমস্ত শক্তি নিয়োগ করা। গুরুদেব বলছেন  এই তপস্যা বলেই মানুষ অলৌকিক শক্তি সম্পন্ন হতে পারে। দূরশ্রবণ -দূরদর্শন  ক্ষমতা এই তপস্যা বলেই হতে পারে।

স্বাধ্যায় : বার বার একই জিনিস করাকে স্বাধ্যায় বলে। যে কোনো জিনিস বার বার করলে সেই কর্মের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। পাথরের উপরে মাটির কলসি রাখলে  কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে না।  কিন্তু  একই পাথরের উপরে প্রতিদিন কলসি  রাখলে দেখবেন সেখানে কলসির  পশ্চাৎদেশের আকার নেবে। প্রতিনিয়ত পাথরের উপরে জল পড়লে পাথর পর্যন্ত ক্ষয়ে যাবে।  তাই বার বার বীজ মন্ত্রের জপ্ করুন জপের সুফল অনুভব করবেন। বার বার করে ধর্মশাস্ত্রের পাঠ করুন, দেখবেন আপনার উপল্বদ্ধির স্তরে নতুন নতুন অনুভূতি দেবে।  আপনি আগে যা বোঝেননি , তা বুঝতে পারবেন। গুরুদেব বলছেন বেদই স্বাধ্যায় শব্দ বাচ্য।  মন্ত্র-উচ্চারণ বারবার করলে অভিলষিত দেবাদি দর্শন লাভ হয়। সৎশাস্ত্র পাঠে বহু বিষয়ে জ্ঞান জন্মে।

ঈশ্বর উপাসনা :  ঈশ্বরের কাছে উপবেশনই উপাসনা। প্রতিদিন নিয়ম করে উপাসনা করুন।  গুরুদেব বলছেন এই উপাসনার প্রভাবেই সত্য, অহিংসা, অস্তেয়  প্রভৃতি সহজেই প্রতিষ্ঠিত হয়। নিয়মিত যে উপাসনা করে তার শক্তির সীমা নেই। গুরুদেব বলছেন এই উপাসনা বলেই ধ্যান, ধারণা, সমাধি প্রভৃতি সহজেই আয়ত্ব করতে পারেন। আপনারা সবাই জানেন সত্যধর্মে উপাসনাকে সবথেকে বেশি  গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

প্রত্যাহার : প্রত্যাহার কথাটা মানে হচ্ছে ত্যাগ বা সরিয়ে দেওয়া। ইন্দ্রিয়গণ যখন তাদের স্বাভাবিক ধৰ্ম অর্থাৎ কান দ্বারা শব্দ গ্রহণ,ত্বক দ্বারা স্পর্শ গ্রহণ, চোখ দ্বারা রূপ গ্রহণ, জিব্বা দ্বারা রস গ্রহণ, নাক দ্বারা ঘ্রান গ্রহণ, এই সকল গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে বিরত থেকে চিত্ত যখন  স্বরূপে অনুকরণ করে - তখন তাকে প্রত্যাহার বলে। ধ্যান করার যার অভ্যাস আছে তিনি বুঝতে পারবেন - প্রথম প্রথম ধ্যান করার সময়, নানান অবাঞ্চিত দৃশ্য, অবাঞ্চিত শব্দ ভেসে আসে। এই অবাঞ্চিত শব্দ-দৃশ্য উপেক্ষা করে চিত্তে মন স্থির করতে হয়। এই যে অবাঞ্চিত শব্দ-দৃশ্য-গন্ধ, এগুলোকে উপেক্ষা করাকেই বলে  প্রত্যাহার।

ধারণা :  মনকে বিষয়-বিশেষে বদ্ধ  রাখার নাম ধারণা।  প্রত্যাহারে আমাদের  ইন্দ্রিয়গণ বিষয় ত্যাগ করে চিত্তে লীন-প্রায় হয় , আর ধারণায় ইন্দ্রিয়ের চিত্তে লীনপ্রায় অবস্থায় মন সেই বিষয় বিশেষে নিযুক্ত থাকে। আমাদের  এই অবস্থায় আমাদের মন ও ইন্দ্রিয়গণ বিশেষ বিষয়ে অর্থাৎ ইস্টে নিযুক্ত বা আবদ্ধ হয়ে যায়। বাহ্যিক বিষয়বোধ প্রায়  লোপ পেয়ে যায় ।

ধ্যান : অনন্য  চিত্ত হয়ে লক্ষ্যে  বা ইস্টে স্থিতিই ধ্যান। অর্থাৎ যাকে  তুমি জানতে চাও তা সে সাকার-ই  হোক আর নিরাকার-ই হোক তার মধ্যে যখন চিত্ত  স্থির হয়, তখন তাকে ধ্যান বলে। এই সময়ে ইস্ট ভিন্ন অন্য কোনো কিছু চিত্তে প্রতিফলিত হয় না। কেবল ইস্ট চিন্তন থাকে, এবং এই ইস্ট চিন্তনকে ধ্যান বলে।

চিত্তকে কোনো পদার্থে বন্ধ রাখার নাম ধারণা।  আর সেই পদার্থে যদি জ্ঞানের তন্ময়তা হয় তবে তাকে ধ্যান বলে। অর্থাৎ ধারণা  থেকে ধ্যান আরো সূক্ষ্ম।

এই সূক্ষ্মতার তারতম্য অনুসারে ধ্যান ত্রিবিধ। স্থুল, জ্যোতির্ধ্যান, পর-ব্রহ্মের ধ্যান।  গুরুদেবের বা পিতামাতার,বা দেবদেবতার ধ্যানকে স্থুল  ধ্যান বলে। ধ্যানের সময় যখন শুধু জ্যোতি বর্তমান থাকে তখন জ্যোতির্ধ্যান বলে। আর কুণ্ডলিনী জাগ্রত হয়ে অর্থাৎ উর্জা শক্তি জাগ্রত হয়ে যখন সহস্রার বা বিন্দুতে মন স্থির হয়, তখন তাকে পর - ব্রহ্মের  ধ্যান বলে। ধ্যান দ্বারা বিভূতি জন্মে। বিভূতিকে উপেক্ষা করে ধ্যান প্রক্রিয়া চালিয়ে গেলে তত্বজ্ঞান জন্মে।

গুরুদেব বলছেন : ধ্যানের সাতটি পর্যায় : ঘোরতর অন্ধকার - তারপরে বিরল অন্ধকার - তারপরে মূর্তি দর্শন - তারপরে দেব-জ্যোতিঃ দর্শন - তার পরে বিভিন্ন দেবদেবতার সহিত কথাপোকথন - এর পরে ব্রহ্ম-তেজ মাত্র দর্শন  - একদম শেষে ব্রহ্ম দর্শন।

সমাধি : বিচ্ছেদ বিহীন ভাবে , অর্থাৎ নিরলস ভাবে ধ্যান প্রক্রিয়া চালিয়ে গেলে ধ্যান সমাধিতে পরিণত হয়। ধ্যানে বাহ্য জ্ঞানের আভাস থাকে। সমাধিতে বাহ্য জ্ঞান লোপ পায়। এই অবস্থা চলতে থাকলে তার শরীর  বোধ লোপ পায়, ক্ষুধা তৃষ্ণা বোধ থাকে না, কর্তব্য-অকর্তব্য বোধ থাকে না, বাহ্যিক হিতাহিত জ্ঞানশুন্য হয়ে যান । এই সময় তার শরীর  রক্ষার জন্য অন্যের সাহায্য দরকার পড়ে। এই সময় তাকে ঘিরে অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটে যা সাধক উপেক্ষা করে, কিন্তু ঘটে। তিনি তখন ব্ৰহ্মময়, জগৎ অসত্য হয়ে যায়। শরীর  রক্ষার কোনো তাগিত না থাকায় অচিরেই তিনি দেহ ত্যাগ করেন।
ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ। .......

সাধনা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে গুরুদেব আরো দুটো কথা বলেছেন তার মধ্যে একটি হলো আসন ও অপরটি হলো প্রাণায়াম।

আসন : যেরূপ বসলে কোনো কষ্ট বোধ হয় না, অথচ শরীর  স্থির থাকতে পারে, তাকেই আসন বলে। যেমন পদ্মাসন , বীরাসন, স্বস্তিকাসন, ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যি কথা বলতে কি, আসনের সঙ্গে ঈশ্বরের সাধনার কোনো যোগ নেই। কিন্তু দেহভিন্ন যে হেতু সাধনা চলে না তাই আসনাদি অভ্যাস করে শরীরকে সাধনার উপযোগী করে রাখা জরুরী বলে হঠযোগীরা মনে করেন।আসলে ধ্যান আর আসন একসাথে উচ্চারিত হয়। ধ্যান করতে গেলে প্রাথমিক ভাবে স্থির আসনে বসা জরুরি। শরীর  অসুস্থ থাকলে চিত্ত-মন অস্থির হবে, আপনি স্থির হয়ে বসতেই পারবেন না। আপনার ধ্যান সমাধি কিছুই হবে না। তাই হঠযোগীরা সাধনা আরম্ভের শুরুতে এই আসন অভ্যাস করার পক্ষপাতী।

প্রাণায়াম : প্রাণ অর্থাৎ জীবনীশক্তির আয়াম অর্থাৎ বিস্তার যা থেকে হয় তাকে প্রাণায়াম বলে। বায়ু পূরণ, বায়ু ধারণ ও বায়ু রেচন অর্থাৎ পূরক, কুম্ভক , ও রেচক  এগুলো নির্দিষ্ট সময় ধরে করাকে প্রাণায়াম বলে। এই প্রাণায়ামের সাহায্যে মানুষ দীর্ঘজীবী হতে পারে। একটি নির্দিষ্ট সময়ধরে প্রাণ বায়ুকে নিয়ন্ত্রিত করাকেই প্রাণায়াম বলে।  গুরুদেব বলছেন ১২, ২৪, অথবা ৩৬ সেকেন্ড ধরে বায়ু নিন বা পূরণ করুন, এর পর এর চতুর্গুণ সময় ৪৮,৯৬, এবং ১৪৪ সেকেন্ড সময় ধারণ করুন অর্থাৎ কুম্ভক করুন। তার পরে ২৪,৪৮,৭২ সেকেন্ড ধরে রেচক করুন। এতে আপনার জীবনী শক্তি বৃদ্ধি পাবে। আপনার চেতন শক্তি বৃদ্ধি পাবে। এটি একটি শক্তিশালী প্রক্রিয়া।  গুরুর আশ্রয়ে থেকে এই প্রক্রিয়ার অভ্যাস করতে হয়। কেননা এই প্রক্রিয়ায় মানুষের শরীরের স্বাভাবিক স্পন্দন বাধাপ্রাপ্ত হয়। কখন এই প্রক্রিয়া করতে হবে, কতক্ষন করতে হবে, অস্বাভাবিক অবস্থায় কি করতে হবে, কখন বিশ্রাম  নিতে হবে, এগুলো শরীর  বুঝে করতে হবে। সবার জন্য যেহেতু সময়ক্রম একই রকম হবে না, তাই নির্দেশক বা গুরুর সাহায্য ছাড়া করা উচিত নয়। এতে মানুষ পাগল হয়ে যেতে  পারে।  এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। তাই সাবধান থাকবেন।  নিতান্ত কৌতহলের বশে এই পথে পা দেবেন না।

গুরুদেব বলছেন এসব আসন-প্রাণায়াম করে কোনো লাভ নেই, বরং প্রকৃত গুরুর উপদেশ অনুসারে কাজ করলে আধ্যাতিক বিষয়ে উন্নতি লাভ সহজ হবে। তাই ঈশ্বর বিষয়ে অনুশীলন করো।  ধ্যান-ধারণায় প্রবৃত্ত হও।  ভক্তবৎসল দয়াময়ের দয়ায় জানতে পারবে তিনি জ্ঞান স্বরূপ।  এবং তিনিই একমাত্র জ্ঞান স্বরূপ। বাহ্য চেষ্টায় বহু বছরেও জ্ঞান লাভ হয় না, তার উপাসনা করো, তবে অতি অল্প সময়ে "ব্রহ্ম সত্যং জ্ঞানম্" এই উপলব্ধি  তোমার হবে। তিনি অনন্ত কিন্তু আনন্দ স্বরূপ।  তিনি প্রেমময়। গুরুদেব বলছেন তুমি উপাসনা ও ধ্যানে ব্যাপৃত থাকো - আর অনুভব করো - জগদীশ্বর সর্বশক্তিমান ; জগদীশ্বর সর্বব্যাপী ; জগদীশ্বর মঙ্গলময়। এই প্রত্যয়  সমস্ত সাধকের, সমস্ত সত্যধর্ম  অনুরাগীর মধ্যে  পরিস্ফুট হবে। অতএব গুরুদেব মহাত্মা গুরুনাথসেনগুপ্ত  বলছেন ধর্মার্থী  ও মোক্ষার্থী উভয়েরই প্রথম কর্তব্য উপাসনা ও ধ্যান।


ধ্যান 

এতক্ষন আমরা মহাত্মা গুরুনাথের বই "তত্ত্বজ্ঞান - সাধনা" বই থেকে সাধনা সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। এবার আমরা একটু  প্রাসঙ্গিক অন্য্ কথা আলোচনা করবো। সত্যধর্মের অনুষ্ঠানে গেলে প্রধানতঃ যা শুনতে পাওয়া যায়, বা দেখতে পাওয়া যায় তা হলো উপাসনা।  এই উপাসনায় গানই প্রধান অঙ্গ। কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন জাগে গুরুদেব কি শুধু উপাসনা করেই সাধনা সারতেন ? বা উপাসনা করেই জগদীশ্বরের সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন ? না কি অন্য্ কিছু করতেন ? গুরুদেবের জীবনীতে পড়েছি  তিনি কয়েকজন  বন্ধু মিলে নির্জন ঘরে ধ্যান করতেন। এবং এই ধ্যানেই মহাত্মাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন।  এবং তাদের কাছ থেকেই এই মহান ধর্মের বার্তা পেয়েছিলেন। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, উপাসনাই  ঈশ্বর সাধনার একমাত্র পথ নয়। গুরুদেব তার তত্ত্বজ্ঞান - উপাসনা বইয়ে একজায়গায় বলেছেন : নিষ্পাপ মহাত্মারা কোনো কারণে পাপস্পষ্ট হলে একমাত্র গুনকীর্তন দ্বারাই পাপমুক্ত হতে পারেন। অর্থাৎ গুণকীর্তনে এটি শক্তি। আর পাপাচারণ-শীলদিগের অর্থাৎ এখনো যারা পাপ আচরণ করে বেড়াচ্ছেন তাদের জন্য  গুনকীর্তন ও প্রার্থনা দুইই  করা দরকার। গুরুদেব বলছেন উপাসনা সাধারণ ভাষায় বা স্তোত্র দ্বারা অথবা সংগীত  সহযোগে করা যেতে পারে। অথবা এই মহান ব্যাপার ধ্যান করেও  সুসম্পন্ন করা যেতে পারে। যারা নিষ্পাপ স্থিরচিত্ত তাদের পক্ষে ধ্যানই প্রশস্ত। কিন্তু যারা পাপী ও চঞ্চল চিত্ত, তাদের পক্ষে গানই সর্ব্বপ্রধান উপাসনার উপায়। আমি মনে করি না যে সত্য ধর্মে যারা আছেন সবাই পাপী বা অস্থির চিত্ত। বরং আমি মনে করি আমরা সবাই নিষ্পাপ, ঈশ্বরের সন্তান।  সমস্ত সত্ সতীই পরম পিতা পরম-ঈশ্বরের অংশ।   এমন মানুষ নিশ্চই আছেন যারা ধ্যান করার যোগ্য। অর্থাৎ স্থির চিত্ত ও নিষ্পাপ।  তাদের কথা ভেবে আমরা এখন ধ্যান সম্পর্কে আলোচনা করবো। আর একটা কথা, চঞ্চল মনকে শান্ত করতে ধ্যানের থেকে উৎকৃষ্ট আর কিছু নেই। তাই ধ্যান করা  আমাদের সবার পক্ষেই ভালো এবং আমি মনে করি উৎকৃষ্ট ।


গুরুদেব বলছেন : ধ্যানের সাতটি পর্যায় : ঘোরতর অন্ধকার - তারপরে বিরল অন্ধকার - তারপরে মূর্তি দর্শন - তারপরে দেব-জ্যোতিঃ দর্শন - তার পরে বিভিন্ন দেবদেবতার সহিত কথাপোকথন - এর পরে ব্রহ্ম-তেজ মাত্র দর্শন  - একদম শেষে ব্রহ্ম দর্শন। গুরুদেব ধ্যান  সম্পর্কে এইযে ক্রোম-পর্যায় বলছেন এটি  সাধারণ ব্যাখ্যা মাত্র। আসলে এটা এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকম হয়। বিবেকানন্দ চোখ বুজলেই জ্যোতি দেখতেন। আপনি ধ্যানে বসলে  আপনার সুখ দুঃখের স্মৃতি, আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা,  অবাঞ্চিত অজানা দৃশ্য, মূর্তি ইত্যাদি আপনার চিন্তায় আসতে  পারে। এই দর্শন বা চিন্তা এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকম হয়। এগুলো নিয়ে আমরা পারে আলোচনা করবো।
ধ্যান সম্পর্কে আমাদের একটা ধারণা আছে যে, এ সব সাধু মহারাজদের কাজ। আমরা যারা সংসারী তাদের জন্য ধ্যান নয়। আমাদের জন্য পূজা, অর্চনাই যথেষ্ট। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। বরং আমাদেরই বেশি করে ধ্যান করা উচিত। কারন সংসার করতে গিয়ে আমাদের অনেক মানসিক চাপে থাকতে হয়। আমাদের রোগ শোকও বেশী।  আমরা অল্পতে ভেঙে পড়ি। প্রথমেই বলি, ধ্যান করলে মন শান্ত হয়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে  নিয়মিত ধ্যান করলে হার্টের ছোটোখাটো রোগ ভালো হয়। রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে। শরীরে একটা ভারসাম্য বজায় থাকে।প্রচুর উর্জাশক্তি আহরণের এটি একটি উৎকৃষ্ট উপায় হচ্ছে ধ্যান ।   ফলে আমরা আনন্দে থাকতে পারি।  একটা বৈরাগ্যের ভাব আসে যা আমাদেরকে শান্তি এনে দেয়। তবুও বলি ধ্যানের মূল উদ্দেশ্য কিন্তু এগুলো নয়।  ধ্যানের  মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে - সত্যকে জানা -সত্যে প্রতিষ্ঠিত হওয়া-সত্যকে আবিষ্কার করা। 

এতক্ষন আমরা ধ্যান করার কথা বলছিলাম, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি  ধ্যান করা যায় না, ধ্যান হয়।  ধারণা করা যায়।  ধ্যান করা যায় না। ধারণা, প্রত্যাহার, ও ধ্যান - ধ্যানের  এই তিনটি  ক্রম বা পর্যায়। মনে রাখবেন ধ্যানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্যকে জানা। কি সেই  সত্য, যাকে আমাদের জানতে হবে ? আসলে আমি কে ? দৃশ্যমান জগৎ কি ? জগতের সঙ্গে আমার  সম্পর্ক কি ? এই সত্যকে আবিস্কার করাই ধ্যানের উদ্দেশ্য। আসলে, আমি কে - নিজেকে আগে জানতে হবে।  তার পর যাকে জানতে চাই তাকে জানতে হবে। তারপর  এই জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় এর মধ্যে কি সম্পর্ক তা জানতে হবে। এই জানার প্রক্রিয়াই ধ্যান।  আমরা ধ্যানের  তাত্বিক কথায় আজ  যাবো না। আমরা ধ্যানের প্রক্রিয়ার মধ্যে সরাসরি প্রবেশ করবো।  কারন এই প্রশ্নের উত্তর যদি আমি আপনাকে দিয়ে দেই তবে আপনার মধ্যে জ্ঞান হবে, কিন্তু সত্যকে যখন উপলব্ধি করবেন তখন এই জ্ঞান দিয়ে আপনি তাকে মেলাতে চাইবেন, বা মেলাতে চেষ্টা করবেন । এবং উপালবদ্ধজাত অনুভূতি আপনার বুদ্ধি দিয়ে সেঁকে তুলতে চাইবেন। তাই সেটা যথাযথ হবে না।

আর একটা কথা বলি - ধ্যান করতে গিয়ে সাধককে নানান বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়। এক : শারীরিক বাঁধা - যেমন অসুস্থতা, আলস্য, আর সবথেকে বড়ো বাধা হচ্ছে ঘুম বা নিদ্রা।  আমি অনেককেই দেখেছি ধ্যানে বসে ঘুমুচ্ছে। ঘুমোলে কিন্তু ধ্যান হবে না।  তাই সচেতন থেকে, সজাগ থেকে আমরা ধ্যান করবো এটা মনে রাখতে হবে।  দুই : মানসিক বাঁধা অর্থাৎ অনিচ্ছা।  এ গুলোকে কাটিয়ে  উঠতে গেলে আপনাকে আসন, প্রাণায়াম অভ্যাস করতে হবে। প্রথমে ঘন্টা খানেক আসন-প্রাণায়াম করুন।  তারপরে ধ্যানে বসে যান। ধ্যান করার প্রথম শর্ত হলো শারীরিক অঙ্গ সঞ্চালন বন্ধ  করা। অর্থাৎ একভাবে দীর্ঘক্ষণ মেরুদণ্ড সোজা  করে  বসে থাকা। এর পর মনের চঞ্চলতাকে স্থির করা। এই মনের চঞ্চলতাকে স্থির করবার জন্য কোনো প্রয়াস না করে কেবল মনকে দেখতে থাকুন। অথবা কোনো বিষয়ের উপরে মনকে স্থির করুন। কিন্তু দেখবেন মন এক বিষয়ের উপরে স্থির থাকছে না। হঠাৎ খেয়াল করলেন, মন বিষয়ে নেই , তো তাকে আবার বিষয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসুন। এই যে আদিষ্ট বিষয় থেকে  বিষয়ান্তরে মন চলে যাচ্ছে, আর আপনি তাকে বিষয়ে নিয়ে আসছেন এই প্রক্রিয়ার নাম প্রত্যাহার। আর যে বিষয়কে আপনি আপনার লক্ষ করেছেন সেটি হচ্ছে ধারণা।

আপনারা যারা গুরুমন্ত্র জপ্ করেন তারা খেয়াল করবেন, আপনি হয়তো জপের মন্ত্র উচ্চারণ করে যাচ্ছেন, কিন্তু আপনার মন  জপের মধ্যে নেই, অর্থাৎ জপ্-কে  যে মনন করা, তা হচ্ছে না। আবার হয়তো মনকে জপের মধ্যে নিয়ে এলেন।  যতক্ষন আপনার মন স্থির না হচ্ছে ততক্ষন এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এটাই প্রত্যাহার।  জপ্মন্ত্র  হচ্ছে আপনার ধারণার বিষয়। মন বিষয় থেকে বেরিয়ে যাওয়া -এটি আপনার দুর্বল ইচ্ছাশক্তির পরিচয়। এইখানে গুরু সহায়ক  হয়। প্রকৃত গুরুর কাছ থেকে যদি আপনি মন্ত্র  পান, তা সে আপনার জানা মন্ত্রই হোক, গুরু আপনার অবচেতন মনে মন্ত্রের মালা গেঁথে  দেবে। আপনার শরীরে মশা  পড়লে যেমন হাত আপনা থেকে এগিয়ে যায়, আপনার অজ্ঞাতসারেই এটা হয় ।  তেমনি আপনার জপ্ বন্ধ  হয়ে গেলে বা মন থেকে জপের মালা সড়ে গেলে, গুরুর ইচ্ছেই আপনার ইচ্ছে হয়ে যাবে, মন্ত্র আর মন এক হয়ে যাবে।  এর জন্য কোনো প্রয়াস করতে হয় না। এইখানেই গুরুকরণের সার্থকতা। মন্ত্র  তো আমরা বই পড়ে শিখে নিতে পারি।  কিন্তু গুরুপ্রদত্ত মন্ত্র, গুরুকৃপায় সর্বক্ষণ স্পন্দিত হতে থাকে। কিন্তু তাই বলে এটা ভাববেন না যে, নিরলস জপের মধ্যে আছেন বলে আপনি সত্যকে জেনে গেছেন। সত্য এখনো অনেক দূর।

মন যখন বিষয়ান্তরে চলে যাচ্ছে - আপনি আবার মনকে ধরে বিষয়ে নিয়ে আসছেন - এই প্রক্রিয়া বেশি দিন চলতে দেবেন না। মন যাক, আপনি এবার মনের সাক্ষী হয়ে যান। মন কি করছে শুধু তাই দেখতে থাকুন। ওকে ফেরাবার  চেষ্টা করবেন না। আপনি শুধু দেখতে থাকুন। একটা সময় মন হাঁপিয়ে উঠবে ও স্থির হয়ে যাবে। এইখানে একটা ব্যাপার খেয়াল করুন, আমি কে ? প্রথম প্রথম দেহকে আমি মনে হবে। তারপরে মনকে আমি মনে হবে। এইবার আমি যখন মনের সাক্ষী বা দ্রষ্টা হয়ে যাবো তখন বুঝতে পারবো, আমি না দেহ না মন, দেহ মন বাদে অন্য কিছু। এই অবস্থায়ই চলতে থাকুক।  আপনি শুধু দ্রষ্টা হয়ে যান।

এই অবস্থায় আপনি অনেক দৃশ্য, অনেক মূর্তি, দেখতে থাকবেন, এমনকি শব্দ শুনতে থাকবেন। এগুলো বিপর্যয় জ্ঞান। আপনার অনেক স্মৃতি ভেসে আসতে  থাকবে। আপনি অনাসক্ত থাকুন।

মাঝে মাঝে নিজের মধ্যে সন্দেহ জাগবে, আমি কি ভুল পথে যাচ্ছি ? মাঝে মাঝে ইচ্ছে হবে, এই অভিজ্ঞতা  অন্যের সঙ্গে শেয়ার করতে।  কিন্তু না গুরু ছাড়া অন্য কাউকে কিছু বলতে যাবেন না। নিজের মধ্যে রাখুন। প্রতিনিয়ত নিয়ম করে, নির্দিষ্ট জায়গায়, নির্দিষ্ট আসনে, ধ্যান প্রক্রিয়ার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখুন।পারলে খাতায় আপনার অভিজ্ঞাতার কথা লিখে রাখুন।  কিছুদিন পরে আপনার সন্দেহ কেটে যাবে। কোনো কিছুতে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস দুটোই ছেড়ে দিন।  আগে থেকে আপনার সঞ্চিত  জ্ঞান, বিচার বুদ্ধি দিয়ে মাপতে যাবেন না। শুধু দ্রষ্টা হয়ে যান।

এক স্বামীজীর মুখে শুনেছিলাম : ধ্যান হচ্ছে একটা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। মানুষই এই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার আনন্দ গ্রহণ করতে পারে। অন্য কোনো জীব বা প্রাণী এই দুর্লভ আনন্দ পেতে পারে না। ধ্যান  হচ্ছে চূড়ান্ত ভাবে কিছুই না করা।  কোন কাজ নয় কোনো চিন্তা নয়, কোনো ভাবাবেগ নয়। কেবল তুমি আছো আর আছে পরম আনন্দ। কোথা থেকে এই পরম আনন্দ আসছে , যখন তুমি কিছুই করছো না ? এ কোনো জায়গা থেকে আসছে না। অথবা বলা যেতে পারে সব জায়গা থেকেই আসছে। এর কোনো কারন নেই।  আনন্দের মূল উপাদানই আনন্দ।

যখন তুমি কিছুই করছো না, মানসিক শারীরিক  অথবা অন্য কোনো ভাবে তুমি কিছুই করছো না, যখন তোমার সমস্ত কাজই  পরিত্যাগ করা হয়েছে, এবং তুমিই কেবল আছো, ঠিক এই অবস্থাকে বলে ধ্যান।  ধ্যান করা যায় না, ধ্যান অনুশীলনের দ্বারাও হয় না, কেবল অনুধাবন করতে হয়, উপলব্ধি করতে হয়, উপভোগ করতে হয়, অনুভব  করতে হয়।  যখনি তুমি সময় পাবে কিছুক্ষনের জন্য সমস্ত কাজ ছেড়ে দাও।  চিন্তা করাও  একটা কাজ, মনোনিবেশ করাও  একটা কাজ। অনুধাবন করাও  একটা কাজ।  যদি একটা মুহূর্তও তুমি কাজ না করে থাকতে পারো এবং নিজের কেন্দ্রে অবস্থান করো সমস্ত ছেড়ে দিয়ে তবেই হল ধ্যান। যদি এই কৌশল একবার আয়ত্ব করতে পারো - যতক্ষন ইচ্ছা তুমি এই অবস্থায় থাকতে পারবে।  অবশেষে তুমি এই অবস্থায় দিনে ২৪ ঘন্টা থাকতে পারবে। যখন তুমি নিজেকে অচঞ্চল বা শান্ত রাখার পদ্ধতিতে পরিপক্ক হয়ে উঠবে, তখনই কাজটা শুরু করতে পারবে, নিজেকে সম্পূর্ণ সচেতন রেখে, যে তুমি নিজে স্থির হয়ে গেছো।

ধ্যান কাজের বাঁধা নয়। ধ্যান এমন নয় যে জীবনের কঠিন কর্তব্য থেকে অব্যাহতি নেবার জন্য ধ্যান।  ধ্যান জীবনের এক নতুন অধ্যায়।  জীবনের এক নতুন ধারা। ঝড়ের কেন্দ্রে চলে যাও তুমি।  তোমার জীবন চলতে থাকবে।  আরো উপভোগ্য হয়ে উঠবে।  জীবন আরো আনন্দময় হয়ে উঠবে।  জীবনের এক নতুন দিক উন্মোচিত হবে।  অনেক দৃশ্যের পর্দা উঠে যাবে , জীবন হয়ে উঠবে আরো সৃষ্টিধর্মী। অথচ তুমি নীরব দর্শক হয়ে যাবে। যেন পাহাড় থেকে তুমি নিজেকে দেখছো। আকাশ থেকে তুমি নিজেকে দেখছো। তোমার পাশে কি সব ঘটছে, তুমি নিতান্তই সাক্ষী। তুমি জানলা মাত্র, তোমার ভেতর দিয়ে তোমাকেই তুমি দেখছো।  তুমি শ্রোতা মাত্র। এটাই ধ্যানের গোপন রহস্য। নিজের নিজের কাজ করে যাও, শুধু একটা কথা মনে রেখো নিজেকে কেন্দ্র থেকে সরিয়ে নিও না। কেন্দ্রে অচঞ্চল রেখে দাও নিজেকে।  এই জ্ঞান, সতর্কতা যেন মেঘাচ্ছন্ন না হয়, না বাধাপ্রাপ্ত হয়।

ধ্যান সম্পর্কে  কোনই এক স্বামীজীর মুখে  শোনা একটা কাহিনী বলি।

এক সাধু গভীর রাতে নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকে। এটা তার প্রতি রাতের নৈমিত্তিক ব্যাপার। কেননা রাতে নদী নির্জন থাকে, নীরব থাকে।  সাধু নদীর পাড়ে বালির উপরে বসে থাকে। কিছুই করে না। কেবল নিজেকে অনুধাবন করার জন্য নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকে।    রাত  শেষ হলে ফিরে আসে। একদিন, যখন সে ফিরে আসছিলো, একটা আমবাগানের পাশ দিয়ে, আমবাগানের প্রহরী যে বাগানের ফটকের পিছনে  দাঁড়িয়ে ছিলো, সে বেরিয়ে এলো। দারোয়ান আসলে কৌতূহলী  হয়ে গিয়েছিলো।  কারন প্রতিদিন গভীর রাতে এই সাধুটিকে আমবাগানের পাশ দিয়ে যেতে দেখে। আবার রাত  শেষ হলে ঠিক এই সময়ে ফিরে আসে। দারোয়ান ফটক থেকে বেরিয়ে এসে জিগ্যেস করলো - কিছু মনে করবেন না। বহুদিন থেকে দেখছি, গভীর রাতে আপনি এই বাগানের পাশ দিয়ে নদীর  দিকে যান, আবার ঠিক এই সময় ফিরে আসেন। আপনি কি করেন ? আপনি নদীতে কেন যান ? অনেকবার রাতে  আমি আপনাকে অনুসরণ করেছি, কিন্তু কিছুই দেখতে পাইনি। আপনি কেবল নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকেন ঘন্টার পর ঘন্টা। এবং সূর্য্য উঠলে স্নান করে আপনি ফিরে আসেন। সাধু বললো আমি জানি তুমি  আমাকে অনেকবার অনুসরণ করেছো।  কেনোনা রাতের গভীরতা এত নীরব যে তোমার পায়ের শব্দ আমি শুনতে পাই। আমি এও জানি তুমি ফাটকের পেছনে লুকিয়ে থাকো, যখন আমি ফটকের পাশ দিয়ে যাই। শুধু তুমি আমার সন্মন্ধে কৌতূহলী তা নয় আমিও তোমার সন্মন্ধে কৌতূহলী। তোমার কাজ কী ?

দাড়োয়ান বললো আমার কাজ ? আমি একজন সাধারণ দাড়োয়ান।  পাহারাদার।

সাধু বললো : আসল কথাটা শোনালে তুমি আজ  আমাকে। আমিও একজন পাহারাদার। দর্শক।

দারোয়ান বললো : ঠিক বুঝতে পারলাম না আপনি  যদি সত্যিই  দারোয়ান হন , তবে তো, রাতে আপনার  ডিউটি হওয়া উচিত, কিন্তু প্রতিদিন  রাতে আপনি  নদীর  পাড়ে বালির উপরে বসে আপনি  কি পাহারা দেন  ?
সাধু বললো : দেখো তোমার দেখাশোনা আর আমার দেখাশোনার  মধ্যে পার্থক্য আছে। তুমি আম বাগানের দেখাশোনা করো। তুমি বাইরের লোকের দিকে খেয়াল রাখছো। কেউ যাতে বাগানে প্রবেশ করতে না পারে।  আমি কেবলমাত্র এই দ্বাররক্ষীর দিকে খেয়াল রাখছি।  এই কথা বলে সাধু  নিজের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন। আমি আমাকেই দেখছি, কে এই আমি ? সারা জীবন ধরেই আমি আমাকেই দেখে চলেছি।

 দারোয়ান বললো : আশ্চর্য ব্যাপার তো। আজব ব্যাপার। আপনাকে  এই কাজের জন্য পয়সা দেয়
 কে ?

 সাধু বললো :  এটা একটা আনন্দ।  এটা এমন এক আনন্দ যা হাজার হাজার টাকা দিয়ে কেনা যায় না। কোনো ব্যাঙ্কে এত টাকা নেই যা দিয়ে এই আনন্দ কেনা যায়।

দারোয়ান বললো : আশ্চর্য ! আমি সারা জীবন ধরে দেখাশোনার কাজ করছি।  কিন্তু এমন সুন্দর অভিজ্ঞাতার সম্মুখীন হয়নি কখনো। আগামী কাল রাতে আমি আপনার  সাথে যাবো।  আমাকে একটু শিখিয়ে দেবেন । আসলে দেখাশোনার কাজটা আমি তো ভালোই পারি। আমাকে শুধু দেখিয়ে দেবেন  কাকে দেখতে হবে।

শুধু একটা মাত্র পদক্ষেপ, দৃষ্টিটা  ঘুরিয়ে দেওয়া।   চোখ খুললে আমরা বাইরেরটা দেখতে পাই।  চোখ বুজলে ভেতরটা। হয় আমরা বাইরের দিকে চোখ খুলে থাকতে পারি, আবার চোখের ভিতরের পর্দাটা খুলে দিতে পারি। সমস্ত চেতনাকে আমরা ভিতরে নিবদ্ধ করতে পারি। এর পরেই আসল জানার শুরু হবে।  তুমিই জ্ঞাতা, তুমিই জ্ঞান, তুমিই জ্ঞেয়। এসব হারাবার নয়।  চেষ্টা করেও হারাতে পারবে না। সমস্ত জ্ঞানই তোমার মধ্যে আছে।  তুমি শুধু একটু আলো  ফেলো।  দৃষ্টি নিবদ্ধ করো।  সমস্ত জ্ঞান তোমার কাছে উন্মোচিত হবে। তুমি তোমার নিজে বাড়ি দেখতে পারবে। পরমানন্দে উদ্বেল হয়ে উঠবে তোমার সমস্ত চেতনা।

ধ্যানের আসল উদ্দেশ্য, কি ভাবে যথার্থ দর্শক হওয়া যায়। ধ্যানের মূখ্য কাজই নিজেকে দেখার। দর্শকের আসনে নিজেকে বসিয়ে দেওয়ার। যথাযথ পর্যবেক্ষণের নামই ধ্যান। পর্যবেক্ষণের গুনই ধ্যান। সচেতন ভাবে পর্যবেক্ষণশীলতাই ধ্যান।  একটা কথা মনে রেখো - ধ্যানের  অর্থ অবগত হওয়া।  অবগত হওয়ার জন্য যা করতে হয় তাই ধ্যান। তুমি কি করছো সেটা বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা হচ্ছে তোমার কাজে তোমার গুন্ কতটা কাজে লাগছে। পদচারণাও ধ্যান হতে পারে যদি তুমি সচেতন ভাবে করো।  বসে থাকাও ধ্যান হতে পারে যদি নিজেকে সজাক  করে বসে থাকো।  বসে বসে হৃদ স্পন্দন অনুভব করাও  ধ্যান, যদি সতর্ক ভাবে করা হয়।

ধ্যানের  একটি বড় বাঁধা হলো তুষ্টি।  কেউ কেউ ধ্যানে জ্যোতিঃ  দর্শন  করে বা অনাহত ধ্বনি  শুনে ভাবেন অনেক উঁচুতে পৌঁছে গেছেন।  কিন্তু এগুলো প্রাথমিক স্তর  মাত্র। ধ্যানে ইস্ট মূর্তি দর্শন , অবিরাম জপ্ চলতে থাকা, এগুলোতে আটকে থাকলে অগ্রগতি রুদ্ধ  হয়ে যায়।

মনে রাখবেন ধ্যানের  উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্যকে উপলব্ধি করা, আনন্দ নয়। শান্তি নয়।  এগুলোকে অতিক্রম করে উপরে উঠে যান।

আপনারা যারা সৎ সংগ করেন বা শাস্ত্র পড়াশুনা করেন তাদের নিজস্ব সংস্কার বা জ্ঞান অনুযায়ী ঈশ্বর সন্মন্ধে একটা ধারণা গড়ে নেন। ধ্যানের সময় ইস্ট মূর্তির দিকে নজর থাকে বেশী। মন যত শান্ত হতে থাকে, ততই ইস্ট মূর্তির চেয়ে তার গুনের ভাব জোরালো হতে থাকে। প্রথম দিকে সাধক মানস নেত্রে ইস্ট মূর্তি দেখতে থাকেন, আস্তে আস্তে সেটা ভাবে পরিণত হয়।  এই ভাবের অনুভব গভীর হলে তিনি নিজের মধ্যে এক জ্যোতির্ময় সত্তার অনুভব করতে থাকেন। এখন মনের জানলা খুলে গেছে। আস্তে আস্তে এই জ্যোতি চৈতন্যময় হয়ে যায়। সাধক তখন অনুভব করেন, এই চৈতন্যময় জ্যোতিই সব।  সাধক নিজে এই চৈতন্যময় জ্যোতির মধ্যে এক ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। এই অবস্থাতেও সাধকের অহং বোধ থাকে। নিজেকে জ্যোতির অংশ মনে করে। সাধনা আরো গভীর হলে এই জ্যোতিও মিলিয়ে যায়। থাকে শুধু চৈতন্য। এই অবস্থায় অহং বোধ লোপ পায়।  আমি বলে কিছু থাকে না। জ্যোতি পরিণত হয়ে যায় জ্যোৎস্নায়। সমস্ত দ্বৈত বোধের লোপ পায়। সাধক এতদিন অহংবোধে সাধনায় লিপ্ত ছিলেন। অহং বোধের বিলুপ্তিতে সাধক সত্যে প্রতিষ্ঠিত হন। এই উপল্দ্ধিই অদ্বৈত উপলব্ধি। আধ্যাত্বিক সাধনার চরম উপলব্ধি। আমিত্ব লোপ পেয়ে গছে। উৎসে ফিরে গেছেন। আপনি বিলীন হয়ে গেছেন। ...... সবশেষ - না সব প্রাপ্তি ?  জানিনা বুঝি না। ..............  ওম শান্তি ওম শান্তি ওম শান্তিঃ।        
                



                          
          



  



  






         



 
             



1 comment:

  1. জয় গুরু কৃপা কর হে প্রভু

    ReplyDelete