Monday 26 November 2018

চার্বাক ও নারদের আখ্যান

                                                                                                             
                                                                                                                      
চার্বাক ও নারদের  আখ্যান

আজ আপনাদের একটা আজগুবি গল্পো শোনাবো। আপনারা সবাই ঋষি চার্বাকের নাম নিশ্চই শুনেছেন। শুধু তাই নয় তার বিখ্যাত উক্তি : ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ, যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ, আপনারা সবাই শুনেছেন। আজ সেই ঋষি চার্বাক ও ব্রহ্মাপুত্র নারদের সাক্ষাতের কাহিনী বলবো। যা আপনি কখনো শোনেননি .......
কলিকালে দেবতাদের  খাবারের খুব আকাল পড়েছে। জাগযজ্ঞ নেই বললেই চলে। এখন আর কেউ খাবার আগে দেবতাদের উদ্দেশে একমুঠো অন্ন তুলে দেয় না। শুলেই নরকের ঘন্টাধ্বনি শুনতে পান দেবরাজ ইন্দ্র। অসুরেরা পাতালে  নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।  মর্তের  লোকেরা অর্থাৎ মৃত্যুলোকেও মানুষেরা  নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। কেবল দেবরাজ ইন্দ্রের চোখে ঘুম নেই। উর্বশীর নাচ, রম্ভার নাচ আর ভালো লাগে না তার। সোমরস কেমন যেন বিস্বাদ  লাগে। কোথায় যেন এক বিপদের ঘন্টাধনি শুনতে পাচ্ছেন দেবরাজ ইন্দ্র।  মনে মনে ভাবছেন, এর আগে তো এমনতরো হয় নি। কতো গর্হিত কাজ করেছি, কিন্তু এমনতরো কখনো হয়নি।  ঋষি গৌতমের স্ত্রী অহল্যাকে একবার   সয্যাসঙ্গিনী করেছিলাম, ঋষি গৌতম আমাকে শাপ দিয়েছিলো।  আমার সমস্ত শরীর সহস্রযোনীর ক্ষতে পূর্ন হয়ে গিয়েছিলো । সেসবও  এককালে  ভালো হয়ে গেছে, অশ্বিনী কুমারদ্বয়ের  চিকিৎসায়। কিন্তু এখন কি হলো ?
দেবরাজ ইন্দ্রের এখন এক অদ্ভুত অসুখ, এক আশঙ্কা, এক ভীতি গ্রাস করেছে। এই অসময়ে,  তিনি সবজান্তা নারদকে, সর্বত্রগামী নারদকে শরণ  করলেন। মহামুনি নারদ এলে, তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, বলতো আমার কেন এমন লাগছে ? তুমি একটু মর্ত থেকে খবর নিয়ে এস তো। সেখানে সব ঠিক ঠাক আছে কি না। ব্রাহ্মণরা সব সুরক্ষিত আছে কি না।  ধর্ম পালন করছে কি না সব। জাগযজ্ঞ সব ঠিক ঠাক মতো হচ্ছে কি না।   আমার কেন এত উদ্বিগ্ন লাগছে ? তুমি একটু মর্তে গিয়ে দেখতো,  আমাদের এজেন্টরা অর্থাৎ ব্রাহ্মণরা, ঋষিরা, মুনিরা সব ঠিকঠিক মতো কাজ করছে কি না।
নারদ এলেন মর্তে। এসে এক অদ্ভুত ঋষির দর্শন পেলেন। তিনি হচ্ছেন ঋষি চার্বাক। বেশ জাঁকিয়ে আশ্রম খুলে বসেছেন। হাজার হাজার গরু তার আশ্রমে। প্রচন্ড পরিশ্রমী। বুদ্ধিমান। আত্মনির্ভর। ঈশ্বরের প্রতি তার বিন্দুমাত্র বিশ্বাসও  নেই, আবার অবিশ্বাসও নেই। ঈশ্বর নিয়ে তার না আছে চিন্তা না আছে অনুষ্ঠান। মিষ্টভাষী, অতিথি পরায়ন। সত্যভাষী। ভয়ভীতি বলে কিছু নেই। নীরবে কর্মই যার ধর্ম। নারদ খবর নিয়ে জানলেন, এঁকে  কেউ বলেন, বৃহস্পতি, কেউ বলে চার্বাক।
নারদ ভাবলেন, চার্বাক শব্দের অর্থ মিষ্টভাষী।  আর একটা অর্থ হচ্ছে চারু-বাক অর্থাৎ সত্যভাষী। যার কাছে ঈশ্বর পৌঁছয়নি, তারাই চার্বাক। যার কাছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা  অনস্তিত্ত্ব, বলে  কিছুই   নেই সে-ই চার্বাক। এঁরা অর্থাৎ চার্বাকপন্থীরা, পুরুষাকারে বিশ্বাসী। ঈশ্বর বলে কিছু আছে, তা তারা মানেন না, আবার অস্বীকারও করেন না । এরা  না আস্তিক, না নাস্তিক। এরা  ঈশ্বর সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন, নির্লিপ্ত ।
নারদ তো সর্বজ্ঞ, চোখ বুজে নারদ চার্বাকের সৃষ্টি কেমন করে হলো, সেটা  দেখতে লাগলেন। এবং দেখলেন,  বার্ধ্ক্যে প্রজাপতি ব্রহ্মা রিপুগ্রস্থ হয়ে দুঃখের দেবী শোচনাকে কামনা করেছিলেন। শোচনা ব্রহ্মাকে শুধু প্রত্যাখ্যানই  করেন নি, তিরস্কার করেছিলেন এই বলে যে, তুমি একটা বিকৃতমনা ব্যভিচারী। এই ভর্ৎসনা শুনে প্রজাপতি ব্রহ্মা দুঃখের দেবী, শোচনাকে  অভিশাপ দিয়েছিলো এই বলে যে "দূর হ স্বর্গ থেকে"। তো শোচনা শাপগ্রস্থ হয়ে পৃথিবীতে অর্থাৎ মৃত্যুপুরীতে চলে আসে। দুঃখ দিয়ে যার জীবন গড়া। দুঃখ যার জীবন সঙ্গী তাদের আমরা বলি শুদ্র। সেবাই যার ধর্ম্ম সেই শুদ্র ।  সব ধৰ্ম থেকে বিতাড়িত হয়ে যেখানে  আশ্রয় হয় সবার, সেটাই শুদ্রঘর। সেই  শূদ্র ঘরে জন্ম নেন শোচনা । তার স্বামীর নাম ছিল পুরুষাকার। এই শোচনার পুত্রের নাম চার্বাক, কেউ বলেন বৃহস্পতি, কেউ বলেন শূদ্র চার্বাক।
নারদ ধীর পায়ে, চার্বাকের আশ্রমে প্রবেশ করলো। গোলাভরা ধান, গোয়াল ভরা গাভী। অসংখ্য শিষ্য-সামন্ত, সন্তান-সন্ততি।  জমজমাট  সংসার। কিন্তু সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। কে এলো, কে গেল তার প্রতি তাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। চার্বাক তখন,গরুর খাবার দিচ্ছেন। নারদ গিয়ে চার্বাককে দর্শন দিলেন। চার্বাক নারদকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আপ্যায়ন  করলেন।  নারদ তো সব দেখে অবাক।  কি নেই, ঝলমলে আশ্রম। মাঠে সবজির বাগান, ফলের বাগান, আর সব আশ্রমীরা কর্মে ব্যস্ত। রূপবতী স্ত্রী এলো। কুণ্ঠাহীন সাবলীল গর্বিতা নারী। আপ্যায়ন করলো নারদকে । নারদতো খুব  খুশী।  কিন্তু একটা জিনিস তাকে অবাক করলো, আশ্রমের কোথাও কোনো  ঠাকুরের মূর্তি নেই।  পূজা অর্চনার কোনো ব্যবস্থা নেই। তো যাই হোক, নারদ দুপুরের খাবার খেলেন, বত্রিশ ব্যঞ্জনে তৃপ্তি নিয়ে খেলেন। খাবার পরে তাকে পান খেতে দেওয়া হলো। এইবার বিশ্রাম নিতে বললেন, কিন্তু নারদের খুম এলো না। যেখানে নারায়ণের মূর্তি  নেই, সেখানে তার ভালো লাগে না । যেখানে ধর্ম নেই।  সেখানে নারদের ভালো লাগে না। তো ভাবলেন, এঁকে  একটু ধর্মজ্ঞান দেওয়া দরকার। সবই ঠিক আছে, কেবল এদের ঈশ্বর বিশ্বাস নেই।  এটা  একটু জাগানো দরকার। তো আশীর্বাদের ভঙ্গিতে বললেন - ঈশ্বরের কৃপায় তোমার সব মঙ্গল হোক। এই কথা শুনে, চার্বাক আহত বাঘের মতো গর্জন করে উঠলো। আমি আপনার আশীর্বাদ চাই। আপনি আমার মঙ্গল কামনা করুন। আমি ঈশ্বরের কৃপা চাই না। এই জীবন আমার, এর রক্ষার দায়িত্ত্ব আমার, আমার মেধা, আমার পরিশ্রম আমাকে স্বছন্দ করেছে। এখানে ঈশ্বর নামক কল্পিত কারুর সহযোগিতা নেই। এই যা কিছু দেখছেন সবই আশ্রমীদের পরিশ্রমের ফল। এর মধ্যে কোনো ঈশ্বরের কৃপা নেই। আমার তথাকথিত ধর্ম আমাকে রক্ষা করে না। আমাকে রক্ষা করে, আমার কর্ম আমার জ্ঞান।এটাই আমার ধর্ম।  আমি ভিক্ষারী নোই। আবার ঈশ্বর কর্তৃক প্রতারিত একজন ব্যর্থ মানুষও নোই। যারা ঈশ্বর বিশ্বাস করে কর্মহীন হয়ে বসে থাকে। তারা নিজেকেই প্রতারণা করে। ঈশ্বরের কৃপাকে আমি উপেক্ষা করি। ঈশ্বরের দয়া আমার দরকার নেই। আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন। তাতেই হবে। যদি তা না করতে চান, বা না করতে পারেন,  তবে আশীর্বাদের বিষয় ছাড়ুন। যা  নিজে পারেন তাই  করুন, আর এক জনের দোহাই দেবেন না। এই ঈশ্বরটা কে আপনার ? তাকে দেখতে  পারেন ? কোথায় থাকেন ? কি কাজ  তাঁর  ?
দুপুরের ভোজনে তৃপ্ত নারদ, প্রমাদ গুনলো, তার শরীর  কাঁপতে লাগলো। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বললো : দেখো চার্বাক এই পৃথিবীটা তো তাঁরই  সৃষ্টি।  ঈশ্বরের সৃষ্টি। এই সমস্ত জীব জন্তু, গাছপালা সবই তার সৃষ্টি। এমনকী তোমাকেও তিনিই সৃষ্টি করেছেন। তিনি না থাকলে এই জীবন কি করে এলো , কোত্থেকে এলো ?
চার্বাক বললো : দেখুন কারুর কৃপাতেই এই পৃথিবী সৃষ্টি হয় নি। এই পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে চারটি জড় পদার্থের সমাহারে।  অর্থাৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এই চারটি জড় পদার্থের সমাহারে পৃথিবীর সৃষ্টি। এখানে তোমাদের ঈশ্বরের কোনো কেরামতি নেই। এই চারটি জিনিস বাদ  দিয়ে তোমাদের ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করতে পারে ? পারে না অতএব তোমার্  ওই আজগুবি ঈশ্বরের কথা রাখো। আর শোনো তোমরা বলো পাঁচ ভূত, আমি বলি চার ভূত কর্ম করে, আর এক ভূত খায়। তোমাদের ওই আকাশ ভূত খালি খায়। তোমরা আত্মা সম্পর্কে বলে থাকো " শস্ত্র দ্বারা ছেদন করা যায় না, অগ্নি একে  দহন  করতে পারে না, জল একে ভেজাতে পারে না, বায়ু একে শুকাতে পারে না। তো তোমার কাল্পনিক ঈশ্বর আকাশ ভূতেরও  উর্দ্ধে। শোনো তোমার শরীর, তোমাদের কথা অনুযায়ী এই শরীর পাঁচ ভূতের মিশ্রণ। আর তোমার আত্মা এই পাঁচ ভূতের ধরাছোঁয়ার বাইরে। যে ধরাছোঁয়ার বাইরে, অর্থাৎ যাকে  আমি ধরতে পারি না, সে আমাকে কি করে ধরবে ? আমার উপকারও করতে পারবে না, অপকারও করতে পারবে না। তো তোমার আজগুবি কল্পনা ছেড়ে, কাজে মন দাও।   
নারদ এবার ভীত হলো, শঙ্কিত হলো।  সত্য যদি প্রচার হয়ে যায় তবে আমাদের দেবতাদের কি হবে ? কিন্তু নারদ পিছু হটার পাত্র নয়।  সে বললো ঠিক আছে, মানলাম জড় পদার্থের সমাহারে এই পৃথিবী, কিন্তু এখানে প্রাণ কি করে এলো ? ঈশ্বরই তো প্রাণ সৃষ্টি করেছেন। জড় পদার্থতো জীবনের জন্ম দিতে পারে না। জড় জগতে প্রাণের জন্ম দিয়েছেন ঈশ্বর।
চার্বাক এবার  সতর্ক। এ ব্যাটা ঈশ্বরের চর।  আমাকে ঈশ্বরজ্ঞান দিতে এসেছে।  দেখুন, আপনার মুখে পান। ঠোঁট আপনার লাল। আপনি পান খেছেন, অর্থাৎ পান,, খয়ের,  চুন, সুপুরি খেছেন। এর কোনোটাই লাল নয়। কিন্তু আপনার ঠোঁট লাল। কোত্থেকে এলো এই লাল ? আসলে পদার্থের গুন্ অর্থাৎ দুটি পদার্থের গুন্ নতুন গুনের সৃষ্টি করে। পান সুপুরি চুন, খয়ের গালে ফেলে যখন চিবোনো হয় তখন এই লাল রঙের সৃষ্টি হয়। যা আপনার সারা গালে,  ওষ্ঠকে রাঙিয়ে ফেলেছে। তেমনি মাটি জল, বায়ু, অগ্নি যে জড় পৃথিবীর জন্ম দিয়েছে সেই জড় পদার্থের সমাহারে নতুন একটা গুন্ জন্ম নিয়েছে, আর তা হলো জীবন। জড় পদার্থের প্রকৃতিই হচ্ছে মানুষের অজৈব শরীর।  সুতরাং এই পৃথিবী বা জীবন সৃষ্টিতে ঈশ্বরের কোনো ভূমিকা নেই।
দেবর্ষি নারদে সারা গা দিয়ে ঘাম ঝরছে। মনে মনে ভাবছে। এই সব কথাতো ঈশ্বর সব শুনছেন। এখন নিশ্চয় কোনো অঘটন ঘটবে। আকাশ থেকে বজ্র নিক্ষিপ্ত হবে প্রবল আক্রোশে। এক্ষুনি প্রবল ঝড় ঝঞ্ঝা শুরু হবে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, কিছুই হলো না। ব্রহ্মাপুত্র নারদ বাকহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন অসহায় হয়ে।  পৃথিবীবাসী  এক প্রবল পরিশ্রমী, আত্মবিশ্বাসী, পুরুষ নির্বিবাদে কথাগুলো বলে গেল। হঠাৎ কোনো দৈবশক্তি তার মুখ চেপে ধরলো না। নারদের নিজেকে মনে হলো পরগাছা।
মানুষের বিশ্বাসের গভীরে, অজ্ঞানতার  অন্ধকারে, যে বীজ ব্রাহ্মণ ঋষিদের দ্বারা রোপন করা হয়েছিল, তা যেন ম্লান হয়ে গেল। স্বর্গ তো অন্তরীক্ষে। যেখানে দেবতারা থাকে, ঈশ্বর থাকে। সেখানে তো মাটি নেই। তাই সেখানে যা জন্মায় তার শিকড় গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। শুধু অন্ধ বিশ্বাসের ভিত্তিমূল কখনো দৃঢ় হতে পারে না। তাই ঈশ্বর উপরে উপরে থাকে, মানুষ যখন অসহায় হয় তখন ঈশ্বরকে ডাকে।  ভাবে ঈশ্বর তাকে উদ্ধার করবে।  কিন্তু কোনোদিন ঈশ্বর আসেও না।  আর মানুষের কষ্টের লাঘবও  হয় না। মানুষের উদ্ধারও হয় না।
মৃত সন্তানের প্রাণ ভিক্ষায় মাতা দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায়।  ভগবানের কাছে যায়।মন্দিরে মন্দিরে মাথা ঠুকে ঠুকে রক্ত বের করে ফেলে।  আর ভগবান চাতুরীর আশ্রয় নেয়। বলে, যে বাড়িতে কেউ মারা যায় নি তার বাড়ি থেকে সরষে নিয়ে এস। প্রকৃতি প্রভাবশালী। তাকে ভগবানও  এড়িয়ে যেতে  পারে না। কর্মহীন জীবন হয় না। জ্ঞাতসারে অজ্ঞাতসারে আমরা কর্মে লিপ্ত। স্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া আমাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অন্ন আমাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
নারদ বলছেন : আচ্ছা চার্বাক তোমার কথা মেনে নিলাম। জড় পদার্থের প্রকৃতিই পৃথিবীতে জীবন উৎপন্ন করেছে। কিন্তু চৈতন্য কোথা পেল এই জীবন। কে তাকে চেতনা দিল ?  চার্বাক তুমি  কিছু গুহ্য কথা শোনো। শরীরের বিনাশ আছে। তোমার ভিতরে যিনি শরীরী অর্থাৎ আত্মা তার মৃত্যু নেই। আত্মা কখনো জন্মায় না।  আত্মা কখনো মৃত্যু বরণ  করে না। আত্মা অনিশ্বর। আত্মা জন্ম-মৃত্যু রোহিত। চার্বাক তুমি সেই অমর আত্মাকে জানো। আত্মা কেবল এক শরীর ছেড়ে অন্য শরীরে প্রবেশ করে মাত্র। মানুষ যেমন তার পুরানো বস্ত্র পরিবর্তন করে ,তেমনি আত্মা মৃত শরীর ছেড়ে নতুন শরীরে প্রবেশ করে।
পরম-আত্মার অংশ এই জীবাত্মা । মানুষের শরীর তো জড় পদার্থ, এই শরীরের মধ্যে যতক্ষন পরম-আত্মার অংশ জীবাত্মা বর্তমান আছে, ততক্ষনই মানুষকে জীবিত বলা হয়। পরমাত্মা ভিন্ন সবই জড়প্রকৃতি।
চার্বাক এবার দৃঢ় ভাবে জবাব দিলো। তোমার  এইসব সৃষ্টিছাড়া কথা রাখো তো । তুমি যাকে আত্মা বলছো, আমি তাকে বলি চেতনা। শুনে রাখো চেতনা কখনো এক শরীর  ছেড়ে অন্য শরীরে প্রবেশ করে না। চেতনা সবত্র বর্তমান। শরীর প্রাণক্রিয়ার সাহায্যে এই চেতনা গ্রহণ করে। প্রাণের সাহায্যে গ্রহণ করে, আবার অপানের  সাহায্যে বের করে দেয়।  এই প্রক্রিয়া আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত, প্রতি মুহূর্তে চলছে। এই ক্রিয়ার মুহূর্তের বিরামে আমরা মৃত বলে গণ্য হই। তোমরা যাকে পঞ্চইন্দ্রিয় বলো, আমরা তাকে বলি, শরীরের দ্বার। অর্থাৎ আমাদের শরীরে পাঁচটি দরজা আছে। চোখ, কান, নাক, জিব্বা, ত্বক। এগুলো সাহায্যে আমরা প্রতিনিয়ত বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। এই পাঁচটি দরজা দিয়ে আমাদের মস্তিস্ক বাইরের খবর সংগ্রহ করে। এগুলো আমাদের গ্রন্থিচক্রে আলোড়ন তোলে। এই আলোড়নকে বলে মনের ক্রিয়া ।এই ইন্দ্রিয় দ্বারা সংগৃহিত খাবারগুলোই মস্তিষ্কে প্রতিফলিত হয়ে সৃষ্টি করে অনুভূতি। এই অনুভূতিই চেতনা।  এর সঙ্গে ঈশ্বরের কোনো সম্পর্ক নেই। আমার যদি এই পাঁচ ইন্দ্রিয়, কাজ বন্ধ কর দেয় বা  একমাত্র নাসিকা অর্থাৎ প্রানের আগমন নির্গমন বন্ধ হয়ে যায়, তবে কোনো ঈশ্বরই  আমাকে বাঁচাতে পারবে না। আমার কোনো চেতনা থাকে না।
আর শোনো, আমি চোখ দিয়ে কখনো ঈশ্বর দেখিনি।  কান দিয়ে কখনো ঈশ্বরের কথা শুনিনি। আমার ত্বক তাকে কখনো স্পর্শ করেনি। আমার স্বাদে অর্থাৎ জিব্বায় ঈশ্বর কখনো আসেনি। ইন্দ্রিয় বাহিত হয়ে ঈশ্বর কখনো আমার অনুভূতিতে আসেনি। তাই আমরা ঈশ্বরে বিশ্বাসও করিনা, অবিশ্বাসও করিনা। সে আছে কি নেই তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমরা কর্মে বিশ্বাস করি। কর্মই আমাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ফুসফুস আমাদের প্রাণের আগমন নির্গমন করাচ্ছে।  তাই আমরা বেঁচে আছি। কর্মই আমাদের অন্ন যোগাচ্ছে। বুদ্ধিযোগে কর্ম করাতেই  আমাদের বিশ্বাস। তোমার ওই কাল্পনিক ঈশ্বর আমাদের কাছে নেই। তুমি বরং সব ছেড়ে কর্মে মনযোগ দাও।
নারদ এবার পালাতে পারলে বাঁচে। আবার মনে মনে ভাবছে, আমরা তো পরগাছা। মানুষের পরিশ্রমের অন্নে আমরা প্রতিপালিত। মানুষের শ্রমে অর্জিত, মানুষের দেওয়া নৈবেদ্যর অন্নে আমরা বেঁচে আছি। এখন মানুষ যদি চার্বাকের মত সবাই ঈশ্বর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে আমাদের কি হবে ? এই চার্বাকদের মতো লোকেরা আমাদের অস্তিত্বকে বিলোপ করে দেবে।
এবার নারদ তার মোক্ষম দাওয়াই ছাড়লো।  দেখো চার্বাক, তুমি বলছো তোমার পঞ্চইন্দ্রিয় কখনো ঈশ্বরের খবর পায়নি  তাই তুমি তাকে বিশ্বাস করো না। কিন্তু  তুমি তোমার ঠাকুরদাকে দেখেছো ? চার্বাক বললো হ্যাঁ  দেখেছি। তোমার ঠাকুরদার বাবাকে দেখেছো ? না দেখিনি। আমার জন্মের আগে তিনি মারা গেছেন।  তুমি তোমার চোদ্দ পুরুষের নাম জান  নিশ্চয়।  কিন্তু তাদের তুমি  দেখোনি কোনোদিন।  কিন্তু তুমি নিশ্চই বিশ্বাস করো যে তারা ছিল।  এবং তোমার রক্তে তাদের ধারা বিদ্যমান। তাই যদি হয়, তবে শোনো, ঈশ্বরের প্রথম পুত্র মনু। এবং তারই বংশজাত আমরা সবাই। সুতরাং ঈশ্বরে বিশ্বাস না করে তোমার কোনো উপায় নেই। এই কথা বলে নারদ মনে মনে হাসতে  লাগলো।
চার্বাক এবার দিশেহারা। কি জবাব দেবেন তা বুঝতে পারছেন না। ......নারদ মুচকি হাসছেন।
চার্বাক  খানিকটা দম নিয়ে বললেন, তোমাদের ঈশ্বর দেখতে কেমন ? আমার মতো ? আমার বাপ্ ঠাকুরদা কিন্তু আমার মতো ছিল। তাহলে ঈশ্বর কিন্তু আমার মতো হওয়া উচিত। অবশ্য তোমাদের এজেন্ট, ওই বাওনদের ঘরেঘরে মানুষের অবয়বে বস্তু দিয়ে তৈরী নানান মূর্তি দেখছি। আমার পূর্ব পুরুষরা অতীত। কেননা তাঁরা আর দেহে নেই। আমি যদি ঈশ্বরের বংশধর হই, তবে আমার সেই প্রথম পুরুষ অবশ্যই অতীত। আর যিনি অতীত, তাকে দিয়ে কোনো কাজ হয় না। তাই তোমার ঈশ্বরকেও আমার কোনো কাজে লাগবে না।
নারদ বললো : না না তা কেন হবে ? ঈশ্বর নিরাকার। তবে তোমার মতো হতেও পারেন। তিনি অব্যয়, অক্ষয়, অবিনাশী।
চার্বাক বললো : ও তাহলে তোমাদের ঈশ্বর অবিনাশী।  দেখো অবিনাশী পরমাত্মা কখনো কোনো সৃষ্টির কারন হতে পারে না। কারন হওয়ার জন্য তাকে সক্রিয় হতেই হয়। আর যা সক্রিয় তা কখনো অক্ষয়, অব্যয় হতে পারে না। যা সক্রিয় তা স্বরূপে ও স্বভাবে নিত্য পরিবর্তনশীল। তাই তুমি যাকে অবিনাশী, অব্যয়, অক্ষয় বলছো, তেমন কোনো কিছু আর যাই হোক সৃষ্টির কারন হতে পারে না।

চার্বাকের এই অমার্জিত যুক্তিতে নারদ বিস্ময়ে বাক রোহিত  হয়ে গেলো।

চার্বাক এবার প্রশ্ন করলো, তোমাদের ঈশ্বর কি বস্তু থেকে আলাদা, না বস্তুসাপেক্ষ ?
নারদ জবাব দিলো : দেখো ঈশ্বর নিরাকার, বস্তুনিরপেক্ষ।
চার্বাক : যা বর্তমান তা আমি স্বীকার করি, কেননা তা আমার কাজে লাগে।  যা অতীত তা আমার কোনো কাজে লাগে না, তাই তা নিয়ে আমার কোনো চিন্তা নেই। ঈশ্বর ছিল কি না, সেটা বড়ো  কথা না।  তিনি আছেন কি না সেটাই বড়ো  কথা। যদি বলো আছে, তবে অবশ্যই  সেটা বস্তুসাপেক্ষ হবে আমার ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য হবে। বস্তুহীন, নিরাকার শুন্যতাকে আমার কোনো প্রয়োজন নেই।  আর তাকে আমি স্বীকারও  করি না অস্বীকারও করি না । এই ব্যাপারে আমরা নিস্পৃহ, নিরপেক্ষ।

নারদ এবার বিমর্ষ হয়ে স্বর্গের দিকে ফিরতে লাগলো। পরগাছাদের কোনো রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধ থাকে না। নিরাকার, অবলম্বনহীন নারদের যাত্রাপথে কোনো ছায়া পড়লো না।  জেগে রইলো, জীবজগৎ, পৃথিবী, আর মানুষের কোলাহল। চার্বাক আবার নিজের কাজে মন দিলো। গরুকে খাবার দিতে গেল।

সমাপ্ত                             

       
      







No comments:

Post a Comment