Tuesday, 27 May 2025


মরণ ঘুমের রহস্যঃ - নিদ্রা বা ঘুমের রহস্যঃ : ঘুমের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক কী ?  

মুক্তানন্দ বলছিলেন, ঘুমের রহস্য যদি তোমার কাছে পরিষ্কার হয়, তবে এই নিত্য-অনিত্য, সৎ-অসৎ, আত্মা-অনাত্মা এমনকি জন্ম-মৃত্যুর রহস্যঃ তোমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। এমনকি  ওঙ্কারের বা প্রণবের রহস্যঃ তোমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু জন্মের পর থেকেই, ঘুম তো আমাদের এমনি এমনি আসে, ঘুম ছাড়া আমরা কেউ বাঁচতে পারি না, এই ঘুমের মধ্যে আমরা প্রতিনিয়ত যাতায়াত করছি, কতবার যে ঘুম আসছে, আর চলে যাচ্ছে, এ যেন শ্বাস প্রশ্বাসের মতো, আসছে আবার চলে যাচ্ছে। এর মধ্যে কি এমন রহস্যঃ আছে, যাতে আমরা এমনকি জন্ম-মৃত্যুর রহস্যঃ বুঝতে পারবো ? 

মুক্তানন্দ বলছেন,  স্বাসের সঙ্গে যেমন তোমার জীবন জড়িয়ে আছে, অর্থাৎ তোমার এই  বেঁচে থাকা বা মৃত্যু বরণ করা জড়িয়ে আছে, তেমনি ঘুমের সঙ্গে তোমার আত্মা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ঘুমের মধ্যে তুমি যদি সজাগ থাকতে পারো, অর্থাৎ সচেতন থাকতে পারো, তাহলেই সব রহস্যের উন্মোচন হতে পারে। কিন্তু কথা হচ্ছে, ঘুমের মধ্যে আবার কেউ সজাগ   থাকতে পারে নাকি ? ঘুমে আমরা জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। কিন্তু কথা হচ্ছে যাই কোথায় ? মুক্তানন্দ বলছেন, এই ঘুমের মধ্যে আমরা সবাই একটা অন্য জগতে চলে চাই, এমনকি ঘুমের মধ্যে আমরা  সবাই আত্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে যাই। মুক্তানন্দ বলছেন, গাঢ়  ঘুমে আমরা প্রতিদিন একবার করে আত্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে যাই।  কিন্তু জেগে উঠে আমাদের সেই স্মৃতি থাকে না। তাই আত্মা সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান থাকে না। তো ঘুমের মধ্যে যদি তুমি সচেতন থাকতে পারতে, তবে তোমার মধ্যে এই আত্মার  জ্ঞান হতে পারতো। অর্থাৎ তুমি আত্মজ্ঞান লাভ করতে পারতে । 

আজ আমরা এই ঘুম সম্পর্কে, এবং ঘুমের মধ্যে সজাগ থাকার প্রক্রিয়া  সম্পর্কে শুনবো। 

প্রথমত ঘুম ব্যাপারটা কি ? ২. ঘুম কেন আসে ? ৩. ঘুমের মধ্যে আমরা কোথায় কি অবস্থায় থাকি।  ৪. ঘুম থেকে আবার আমরা আবার জেগে উঠি কেন ? 

ঘুম ব্যাপারটা কি ? 

বিজ্ঞান বলছে, আমাদের চোখের ভিতর থেকে একটা নার্ভ মস্তিষ্কে গিয়েছে, সেখানে হাইপো-থ্যালামাসে গিয়ে মিশেছে। মস্তিষ্কের এই হাইপো-থ্যালামাসে আছে ঘুমের চাবিকাঠি। একেই বলে আমাদের স্লিপ সেন্টার। এই হাইপো-থ্যালামাসে আছে সুপ্রাকায়াসমেটিক নিউক্লিয়াস যাকে   সংক্ষেপে বলা হয় SCN. তো আমাদের ঘুমের নিয়ন্ত্রক হচ্ছে এই SCN - দিনের বেলায় রেটিনা, আর রাতের বেলা পিনিয়াল গ্লান্ড থেকে নির্গত রস বা মেলাটনিন হরমোন আমাদের ঘুমকে ডেকে  আনে।  সবার ঘুমের মধ্যে পিটুইটারি গ্রন্থি একধরনের হরমোনের নিঃসরণ করে, যা আমাদের শরীরের ক্ষতিগ্রস্থ কলার মেরামতি করে। তো ঘুমের মধ্যে আমরা আমাদের ক্ষতিগ্রস্থ কোষগুলোর মেরামতি ক্রিয়া করে থাকি। 

আবার এই ঘুম আমাদের দুটি ধরন দেখা যায়,  যাকে  বিজ্ঞান বলছে, REM এবং NREM . REM বা  RAPID EYE MOVEMENT আর NREM অর্থাৎ NON RAPID EYE MOVEMENT. বলা হচ্ছে, ঘুমের মধ্যে নাকি আমাদের চক্ষু কখনো  স্থির থাকে, আবার কখনো চক্ষু নাড়াচাড়া করে।  

শরীর যখন ক্লান্ত  হয়ে যায়, বা আমাদের যখন ঘুমোতে যাবার ইচ্ছে হয় ষে একসময় আমাদের মস্তিষ্কের পিছন দিকে যে পনস আছে, তাকে নির্দেশ দিয়ে প্রথমে শরীরের কাজ কর্ম্মকে স্থগিত করে দেয়।  এবার ঘুম শুরুর প্রথম  অবস্থায় এই NREM বা স্থির চক্ষুর ঘুম শুরু হয়। অর্থাৎ আমরা চোখ বুজকে ঘুমুতে যাবার চেষ্টা করি। প্রথমে অর্থাৎ  ১ থেকে দেড় ঘন্টার এই অবস্থা থাকে, এর পরে REM ঘুম অর্থাৎ  চক্ষু নাড়াচাড়া শুরু করে, একে  অস্থির চক্ষুর ঘুম বলে।  কিছুক্ষন অর্থাৎ ১৫-২০ মিনিট নাকি চক্ষু দ্রুত নাড়াচাড়া করতে থাকে। তখন  এই অবস্থাকে বলে REM  ঘুম বলে।  এইভাবে  একবার REM ঘুম একবার NREM ঘুম চলতে থাকে।  চার পাঁচ ঘন্টা ধরে  এই চক্র  চলতে থাকে।  

এই যে NREM বা স্থির  চক্ষুর ঘুম এর শেষের দিকে আমাদের গভীর ঘুম হয়। অস্থির চক্ষুর ঘুমে বা REM ঘুমে  আমরা স্বপ্ন দেখে  থাকি। স্বপ্নাবস্থায় আমাদের হার্টবিট, পালসবিট বাড়ে, এই সময় মস্তিষ্কের মধ্যে ওয়েব বা তরঙ্গের মাত্রা বাড়ে। অন্যদিকে গাঢ়  ঘুমে, আমাদের হার্টবিট, পালসবিট কমে, শ্বাস প্রশ্বাসের হার কমে, এমনকি দেহের তাপমাত্রা কমে। 

এবার আমরা অধ্যাত্ম জগতের মহাত্মাদের কথা শুনবো।  তাঁরা ঘুম সম্পর্কে কি বলেন। এঁরা  বলছেন, ঘুম আর তোমার মৃত্যুর মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। আমাদের যে ঘুম তা কেবল মাত্র ৭/৮ ঘন্টা ব্যাপী হয়ে থাকে।  এর পরে আমরা আবার জেগে উঠি। আর যাকে  আমরা মৃত্যু বলি, সেও এক প্রকার ঘুম, যে ঘুম থেকে ফিরে আসতে আমাদের দশ/বিশ/ত্রিশ বা হাজার  বছর লেগে যায়। অর্থাৎ মৃত্যুতে আমরা দীর্ঘদিন ঘুমের মধ্যেই  কাটাই। কথায় বলে মরন ঘুম অর্থাৎ যে ঘুমে কেউ আর  জেগে ওঠে না। পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন, মৃত্যু কালীন অবস্থাতেও, জীবের কিছুক্ষনের জন্য ঘুম ঘুম ভাব আসে। অর্থাৎ একটা অজ্ঞান ভাব তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।  

আমাদের শাস্ত্র বলছেন, ঘুম তো নয়, এ এক বিশেষ অবস্থা মাত্র। জেগে থেকে আমরা যেমন স্থূল জগৎকে ভোগ করি, তেমনি ঘুমের সময় আমরা সূক্ষ্ম ও কারন জগতের বাসিন্দা  হয়ে যাই । ধ্যানে বসলে আমাদের ঘুম পায়।  আসলে ধ্যান আর ঘুমের মধ্যে পার্থক্য সামান্যই। গভীর ঘুমে আমরাদের জ্ঞান থাকে না, আর সমাধির ঘুমে আমরা অজ্ঞান থেকে বেরিয়ে যাই। মুক্তানন্দ বলছেন, মৃত্যু আসলে এক ধরনের সমাধি বিশেষ, যে সমাধি সহজে ভাঙে না। 

আমরা যখন মাণ্ডুক্য উপনিষদের  কথা শুনেছিলাম, সেখানে শুনেছি, জীবরূপী ব্রহ্মার চার অবস্থা -  জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি ও তুরীয়।  
















Sunday, 11 May 2025

সাংখ্য যোগদর্শন। দুঃখ যাবে কিসে ? Samkhya Yogadarshan

সাংখ্য যোগদর্শন। দুঃখ যাবে কিসে ?  Samkhya  Yogadarshan 

১) মানুষ যখন ত্রিতাপ জ্বালায় দগ্ধ হতে শুরু করে, অর্থাৎ মানুষ যখন, দুঃখত্রয়ের (আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক, আধিদৈবিক) সম্মুখীন হয়, তখন সে এই দুঃখত্রয় থেকে পরিত্রানের রাস্তা খোঁজে। মানুষের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, কেন এমন হয় ? আর কিভাবেই বা এই দুঃখ-দুর্দশা দূরীভূত হবে ? বলা যেতে পরে, কেন আমরা তো এই দুঃখ দূর করবার জন্য, নানান রকম ঔষধাদির ব্যবস্থা করেছি। ঘরবাড়ি বানিয়েছি। নদী-নালাকে বাঁধ দিয়েছি। নদীর  উপরে সেতু বানিয়েছি, পশুকুলকে খাঁচায় পুরেছি। জঙ্গল কেটে বস্তি গড়েছি, পাহাড় কেটে রাস্তা করেছি।  আমরা এখন নিরাপদ, আমরা এখন নিশ্চিন্ত।  কিন্তু সত্যিই কি আমরা নিশ্চিন্ত হতে পেরেছি ? এখনও মেঘের ডাকে আমরা শিউরে উঠি, মাথার উপরে বাজ পড়ে,  অজানা মৃত্যু  ভয় আমাদেরকে তাড়া করে  নিয়ে বেড়ায়। ডানলোপিলোর গদিতেও আমাদের ঘুম আসে না। আসলে যাকিছুই করা হোক না কেন, এযেন বালির বাঁধ, সবই সাময়িক। তাই যদি হয়, তবে কিভাবে আমরা এই ত্রিতাপ জ্বালা থেকে নিষ্কৃতি পাবো ? 

২)  এই দুঃখ দূর করবার উপায় হিসেবে, শাস্ত্র আমাদের অনেক উপদেশ দিয়ে থাকে। অনেক আচার-আচরণের নির্দেশ দিয়ে থাকে। কখনো কখনো এগুলো ফলপ্রসূ হয় বটে, তবে তাও সাময়িক। এই দুঃখ দূর করবার উপায় হচ্ছে অভেদ জ্ঞানদের উন্মোচন। জগৎ কখনও  ব্যক্ত, কখনো অব্যক্ত।  ব্যক্ত ও অব্যক্তের মধ্যে যে ভেদ রেখা আছে, তাকে দূর করবার জন্য দরকার প্রতক্ষ্য অভেদজ্ঞান। এই প্রতক্ষ্য অভেদজ্ঞানই পারে আমাদের সমস্ত দুঃখ-দুর্দশাকে  দূর করে দিতে। যতদিন আমাদের মধ্যে বৈষম্যজ্ঞান বর্তমান থাকবে, ততদিন, আমাদের দুঃখের নিবৃত্তি হবে না। 

৩) সাংখ্য দর্শন বলছে, সৃষ্টিতত্ত্বের গোড়ায় মূল কারন রূপে অবস্থান করছে পুরুষ ও প্রকৃতি। এই আদি পুরুষ ও আদি প্রকৃতি অব্যক্ত, সর্বব্যাপী, অনন্ত, কালাতীত। এখান  থেকেই এসেছে মহৎতত্ত্ব অর্থাৎ বুদ্ধি যা সৃষ্টির প্রথম প্রকাশ স্বরূপ। এই মহত্তত্ত্ব থেকে অহঙ্কার। এই অহঙ্কার  ত্রিবিধ সাত্ত্বিক, রাজসিক, এবং তামসিক। এই সাত্ত্বিক অহংকার থেকে এসেছে মানস।  এই মানস  থেকে কর্ম্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়। অন্যদিকে তামসিক অহঙ্কার  থেকে এসেছে পাঁচটি তন্মাত্র, পাঁচ তন্মাত্র  থেকে পাঁচ মহাভূত। তো কেউ একজন পুরুষ এই সৃষ্টির করেন স্বরূপ, এমন ধারণা সাংখ্য দর্শন অনুমোদন করে না। 

তো সমষ্টি  মন থেকে মানস, পাঁচটি  জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচটি কর্ম্মেন্দ্রিয় এবং পাঁচটি মহাভূত - এই ষোলোটা তত্ত্বের উৎপত্তি। মহাচৈতন্য থেকে মহৎ, অহঙ্কার ,এবং পাঁচটি তন্মাত্র এই ৭জন।  তো একটা বিকৃতি তত্ত্ব, আর একটা প্রকৃতিতত্ত্ব। এই হচ্ছে সৃষ্টির  মূল কারন। 

দুঃখ যাবে কিসে ? 

খোকন বাবু কিছুদিন যাবৎ দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। কিছুদিন আগে তার ৩৫-৩৬ বছরের যুবক ছেলে, ৫/৬ বছরের নাতিকে বৌমাকে রেখে  হঠাৎ  হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। তার নিজের স্ত্রীর নানান রকম রোগে,  বলতে গেলে শয্যাশায়ী। দু-দু বার কিসব কারনে অস্ত্রপচার  হয়েছে। সংসারের কোনো কাজ করতে পারেন  না। ডাক্তারবাবু বলছেন, আবার অপেরেশন করতে হবে।  কিন্তু হার্টের ডাক্তারের অনুমতি ছাড়া এই অপেরেশন করা  যাবে না। হার্টের ডাক্তার লিখিত অনুমতি দিতে রাজি নয়।  আবার অপেরেশন না করলে নাকি, তার স্ত্রী আর বেশিদিন  দিন ইহজগতে থাকবেন না। ডাক্তার বাবু গম্ভীর স্বরে নিদান হেঁকেছেন। খোকন  বাবু যিনি একটু বেশী কথা বলতে ভালো বাসেন,  তিনি এখন মুখ কালো করে থাকেন। 

জিজ্ঞেস করতেই  খোকনবাবু বললেন, জানেন, কাল রাতে স্ত্রীর মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে। এর আগে মলদ্বার দিয়েও রক্ত ঝরেছে। কি যে করি কিছুই বুঝতে পারছি না। কোনো ডাক্তারবাবু বলছেন, এই ট্যাবলেটটা খাওয়ালে এমনি ভাবে রক্ত ঝরবে। আবার কেউ বলছেন, এই ট্যাবলেট টা  না খাওয়ালে চলবে না। আমি বুঝে উঠতে পারছি  না,  কি করবো ? বলে ফ্যাল ফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। 

এমনিতে ওনার টাকা পয়সার টানাটানিও আছে।  বাড়ি  থেকে স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পাঁচশো / হাজার টাকা বেরিয়ে যায়।  এছাড়া ডাক্তার বাবুকে নাকি ৬০০ টাকা ফিস্ দিতে হয়।  অথচ কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছি না। 

আমরা খুব খারাপ লাগলো, ওনার এই অবস্থার কথা  শুনে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমি তো ডাক্তার নোই। আমি কিছু করতেও পারি না। 

বললাম, দেখুন, আমরা কে কয়দিন বাঁচবো, তা আমরা কেউ জানি না।  তবে এটা জানি, যে একদিন না একদিন আমরা অবশ্যই মারা যাবো।  আর  এছাড়া, আপনাদের দুজনের বয়স ৭০ এর কাছাকাছি। যে কয়দিন বাঁচবেন, আনন্দে বাঁচুন।  কিন্তু আনন্দে বাঁচবেন কি করে ? ধীরে ধীরে ডাক্তারের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করুন। এক্ষুনি  না হলেও, ধীরে ধীরে ঔষধের প্রতি আকর্ষণ ত্যাগ করুন। 

আপনি হয়তো জানেন না, মানুষের মধ্যে ঔষধ ততক্ষন সুফল বা ক্রিয়া করতে পারে, যতক্ষন রুগীর মধ্যে ঔষদের প্রতি বিশ্বাস থাকে।  যেদিন বিশ্বাস হারিয়ে যায়, সন্দেহ তৈরী হয়, এমনকি যেদিন বস্তুর প্রতি অনাসক্তি আসে, তখন আর এই ঔষধ তার শরীরে রাসায়নিক ক্রিয়া করতে অক্ষম হয়ে যায়।  প্রত্যেকের জীবনে একটা দিন আসে, যখন শরীরে ঔষদের ক্রিয়া বন্ধ  হয়ে যায়। তখন  ঘুমের ঔষধ খাওয়ালেও আর রুগীর ঘুম আসে না। আর ঠিক এই কারণেই, একদিন ডাক্তার বাবু বলে দেন, আপনি রুগীকে বাড়ি নিয়ে যান। ভালো মন্দ খেতে দিন। একটু সেবাযত্ন করুন।  এই রুগীর  চিকিৎসা এখন আমাদের হাতে নেই।  

আমি তাকে দুটো দাওয়াই দিয়েছিলাম। 

১. সকালে ঘুম থেকে বিছানা ছাড়ার আগে, এবং রাতে ঘুমুতে যাবার আগে,  ঈশ্বরের কাছে আপনার কষ্টের  কথা জানিয়ে, প্রতিকারের জন্য প্রার্থনা করুন। 

২. একটা কাঁচা সুপুরি জোগাড় করুন। স্ত্রীকে বলুন এটিকে লাল সুতো দিয়ে ভালো করে মুড়ে দিতে। একটা ডিমের আকৃতি বানিয়ে নিন। এর পরে প্রতিদিন তিনবেলা, অর্থাৎ সকালে, দুপুরে, এবং সন্ধ্যাতে ধুপ ধুনো প্রদীপ দিয়ে, আরতি  করুন।  এবার  এই সুপারির (গনেশ সুপারির) কাছে বসে, মনে মনে প্রার্থনা করুন। এই যে প্রক্রিয়া এসব আমার মনগড়া নয়, এটি একটি জ্যোতিষ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। 

এই কথা গুলো আমি প্রায় ছয়  মাস আগে বলেছিলাম। তিনি এগুলো করতেন কি না, সেই খোঁজও আমি কখনও  নেই নি। কেননা বারবার বললে, পাচ্ছে ভদ্রলোক বিরক্ত হন। হঠাৎ গতকাল ভদ্রলোক , বললেন আমার স্ত্রী কিছুদিন যাবৎ  ভালো আছেন, প্রেসারের ঔষধ ছাড়া আর কিছু খান না। শুনে  আমার খুব ভালো লাগলো। 

আসলে কি জানেন, আমরা সবাই শরীরে রোগকে টেনে আনি, রোগকে প্রশ্রয় দেই। আমাদের মন নানান রকম আশঙ্কায় ভুগছে। আর এই আশঙ্কা থেকে আমরা দুশ্চিন্তার শিকার হয়েছি। এই দুশ্চিন্তা আমাদের শরীরে নানান রকম হরমোনের জন্ম দিচ্ছে, বা হরমোনের নিঃসরণে বাধা সৃষ্টি করছে।  শরীরের সাম্যভাব  নষ্ট হচ্ছে। আমরা শারীরিক দিক থেকে রোগগ্রস্থ হয়ে পড়ছি। 

আমরা যখন অসহায় হয়ে পড়ি, আমরা যখন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ হয়ে যাই, তখন বিশ্বশক্তির কাছে ঐকান্তিক প্রার্থনা একটা অলৌকিক শক্তির জন্ম দেয়। আমরা একটা আশ্রয় খুঁজে পাই, যা আমাদের শরীরের মধ্যে সাম্যভাবের সৃষ্টি করে। আমরা একটা শান্তি অনুভব করি। মানসিক স্থিরতা, শারীরিক অসুস্থকে সরিয়ে তোলে। কাঁচা সুপারিতে সুতো জড়িয়ে সুপারি গনেশ বানানো, মানে হচ্ছে নিজের মধ্যে ভালো থাকবার একটা অদম্য উৎসাহ সৃষ্টি  করা।  এর কোনো বস্তুগত মূল্য নেই।  কিন্তু মনের দিক থেকে এর অসীম গুরুত্ত্ব। সুপারি গনেশ নিমিত্ত মাত্র , মনের মধ্যে বেঁচে থাকবার, শারীরিক দিক থেকে সুস্থ থাকবার, অদম্য ইচ্ছাশক্তি মানুষকে ভালো থাকবার রসদ যোগাতে  সক্ষম। 

যেখানেই থাকুন, যে অবস্থাতেই থাকুন, সেই বিশ্বশক্তির কাছে আকুল হয়ে প্রার্থনা করতে পারলে , অনেক সমস্যা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।  মন একটা নির্ভরতা খুঁজে পায়। আসলে আমরা কেউ আশ্রয়হীন হয়ে বাঁচতে পারি  না। মায়ের কোল  যেমন শিশুকে নিশ্চিন্ত রাখে, তেমনি আন্তরিক  প্রার্থনা মানুষকে নিশ্চিন্ত থাকতে অলৌকিক ভাবে শক্তি জোগাতে পারে। 

তাই অনুরোধ করবো, রাতে ঘুমুতে যাবার আগে, আর সকালবেলা বিছানা ছাড়ার আগে, এক মিনিট বিশ্বশক্তির কাছে প্রার্থনা করুন। করেই দেখুন না, কিছু ফল হয় কি না ?

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি  ওম।   

সবকিছু ছেড়ে দেবেন কখন ? অনাসক্তি আসবে কি করে ?

বাড়িতে একটা পুরানো, ফ্রিজ পড়েছিলো। ছেলে নতুন ফ্রিজ কিনে নিয়ে এসেছে।  গৃহকর্ত্তি ফ্রিজটিকে বেঁচে দিতে চাইলেন। গৃহকর্ত্তা কিছুতেই সেটি বেচতে দেবেন না। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া। অশান্তি।  মনে মনে ভাবছিলাম, এই আসক্তি, বস্তুর প্রতি এই যে আসক্তি, যা অশান্তির করেন, তার  নিষ্পত্তি হবে কবে ? 

জীবন মানেই কৰ্ম্মময় অবস্থা।  কর্ম্মহীন জীবন বলে কিছু হয় না। এই কর্ম্মই জীবনে সাফল্য এনে দেয়। আর এই কারণেই জীবনে সাফল্য পেতে গেলে, জীবনের উদ্দেশ্য ও উপায়গুলোর প্রতি অর্থাৎ আমাদের বিষয়কর্ম্মে  মনোযোগী হওয়া উচিত। অর্থাৎ জীবনের উদেশ্য পূরণের জন্য, আমাদের কিছু উপায়ের অবলম্বন করতে হয়। আর এই উপায়ের প্রতি যে যত  বেশি মনোযোগ দিতে পারে, তার জীবনে সাফল্য বেশি মাত্রায় দেখা যায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই মনোযোগ দিতে গিয়ে আমরা ওই বিষয়ের প্রতি অর্থাৎ উপায়ের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। তখন আমাদের কাছে বিষয়গুলো  এতো বেশী আকর্ষণীয় হয়, যে তাকে আমরা আর ঝেড়ে ফেলতে পারি না। মধুর ভান্ডে মধু  খেতে গিয়ে আমরা মধুর মধ্যেই নিজেকে   আটকে ফেলি ।  আর সেখানেই  আমাদের দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটে। অর্থৎ  আমরা মধুর মধ্যে যে মৃত্যু ওঁৎপেতে রয়েছে, তা আমরা বুঝতে পারি না। 

জীবনে যখন ব্যর্থতা  আসে, তখন আমরা ব্যর্থতার কারনগুলোর  দিকে যদি আমরা ধ্যান দেই , তাহলে আমরা দেখবো, এই ব্যর্থতার মধ্যে আছে, উপায়গুলোর প্রতি আমাদের অতিরিক্ত মনোযোগ। জীবনে সাফল্য পেতে গেলে, আমাদের উপায়গুলোর দিকে মনোযোগ দিতেই  হবে, উপায় যদি সঠিক হয়, তবেই  আমাদের সাফল্য অবশ্যই  আসবে।  কিন্তু  জীবনের উদ্দেশ্য আর উপায়কে আমরা গুলিয়ে ফেলি। এইজন্যই আমাদের হতাশা আসে। 

দেখুন, জীবনের সাফল্যের পিছনে, যেমন একটা কারন আছে, তেমনি অসাফল্যের পিছনেও একটা কারন থাকে। আমাদের জীবনে দুঃখের সবচেয়ে বড়ো  কারন হচ্ছে, আমরা যখন কোনো কাজ একবার শুরু করি, তাতেই আমরা সর্ব্বশক্তি নিয়োগ করি, হয়তো সেখান থেকে সাফল্য আসে, বা আসে না, কিন্তু সেই কাজকে আমরা কখনোই পরিত্যাগ করতে পারি না। বুদ্ধিমান মানুষ এও  জানে, বা উপলব্ধি করে, যে এই কাজ চালিয়ে যাওয়াটা পীড়াদায়ক, কিন্তু তথাপি  সে সেই কর্ম্ম ছাড়তে পারে না। একটা নেশার মতো হয়ে যায়। সে এটাও বুঝতে পারে , যে এখান  থেকে তার দুর্দশা আসছে, তথাপি সে এখান  থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। 

মধুমক্ষি-রূপ এই আমি সংসাররূপ মধুভান্ডে মধু খেতে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে এসে  সেই সংসাররূপ মধুভান্ডে  আমি নিজেকে এতটাই জড়িয়ে ফেলেছি, যে এখন হাজার এক দুর্দশার কারন এই সংসারের মধ্যে দেখেও, আমি আর সেই সংসার রূপ মধুভান্ড থেকে বেরুতে পারছি না।  মধুর মধ্যেই যেন আটকে দমবন্ধ হয়ে আসছে। 

আমরা যখন এসেছিলাম, তখন নিজের ইচ্ছেয় এসেছিলাম, না  ঈশ্বরের   ইচ্ছেয় এসেছিলাম তা আমরা জানি না। কিন্তু এখন আমি না আমার ইচ্ছেয় চলতে পারছি, না ভগবানের ইচ্ছেয় চলতে পারছি । আমরা  এখন অপরের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছি। এমনকি আমরা অপরের মনকে চালিত করবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার।  আমরা এইভাবেই  সুখের আস্বাদ পেতে চাইছি, কিন্তু ধীরে ধীরে এই চক্রে পড়ে, আমার প্রাণশক্তি শেষ হয়ে  যাচ্ছে । 

আমরা চাই প্রকৃতির কাছ থেকে সব কিছু পেতে, আমরা জল চাই, বাতাস চাই, আলো  চাই , আশ্রয় চাই, কিন্তু পরিণামে আমরা নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলি, প্রকৃতিই  আমাদের থেকে সব কিছু শুষে নিচ্ছে। আমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত শরীর ভেঙে পড়ছে। জরা ব্যাধি, আমাদেরকে আক্রমন করছে। আমরা ছেলে-মেয়ে-স্ত্রীর কাছ থেকে পেতে চাই, কিন্তু পরিণামে এরাই আমার কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিচ্ছে। আসলে আমরা এদের কাছে আবদ্ধ  হয়ে পড়েছি। যদি আমরা আবদ্ধ  না হতাম, তবে আমাদের জীবন হয়ে উঠতে পারতো আনন্দ-উজ্জ্বল। 

আমাদের সমস্ত দুঃখের কারন হচ্ছে, আমরা অন্যের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছি, আমরা জীবনে সাফল্যের জন্য যে উপায়গুলোকে খুজেছিলাম, অর্থাৎ ধন, দৌলত, গাড়ি, বাড়ি, স্ত্রী, পুত্র, এখন সেই  সফলতাই  আমাদের অসফলতার কারন হয়েছে। যাদের কাছে আমি সুখের জন্য গিয়েছিলাম, এখন সেখানে জড়িয়ে জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছে। শ্বাস ওষ্ঠাগত  হয়ে উঠেছে। 

এইজন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, কর্ম্ম করো, কিন্তু আসক্ত হয়ো না। তুমি নিয়ত কর্ম্ম করবে, কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, তোমাকে যেন কর্ম্ম আবদ্ধ করে না ফেলে। প্রতিটি  বিষয়কে গ্রহণ করবার শক্তি যেমন তোমাকে অৰ্জন করতে হবে, তেমনি সেই বিষয়কে বৰ্জন  করবার  শক্তি যেন আমরা হারিয়ে না ফেলি। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সংসার বেঁধেছিলাম সুখ পাবো বলে, এখন সেই সংসার যেন আমাকে না বেঁধে ফেলতে পারে, সেই দিকে নজর দিতে হবে। প্রত্যেকটি বিষয় থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেবার বিদ্যাও  শিখতে হবে। বস্তু তা সে যতই প্রিয় হোক, তাকে ত্যাগ করতে হবে।  আর এই ত্যাগ করতে যেন বেদনা না আসে, এই শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। 

জীবাণু তো সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভাইরাস না আছে কোথায় ? কিন্তু নিজের মধ্যে যদি প্রতিরোধ শক্তি থাকে তবে সেই  ভাইরাস তোমাকে আক্রমন করতে পারবে না। জীবনে সবচেয়ে দুঃখের কারন হচ্ছে, নিজেকে দাস করে ফেলা। নিজেকে দুর্ব্বল করে ফেলা। এই দুর্ব্বলতা জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু। দুর্ব্বলকে সবাই আঘাত করে, দুর্বলতাই  মৃত্যু ডেকে  আনে ।  জীবন থেকে সমস্ত দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে দাও। নিজের মধ্যে থেকে দাসত্বের বৃত্তি, দাসত্বের মনোভাবকে দূর করে দাও।  শক্তিকে আশ্রয় করো।  শক্তিই জীবন, শক্তিই সুখ, সত্যকে আশ্রয় করো, সত্যই জীবন। 

দুঃখে যাদের জীবন চলছে, তাদের দিকে একবার খেয়াল করলেই দেখতে পারবেন, তাদের এই দুঃখের কারন হচ্ছে, আসক্তি।  কর্ম্মের প্রতি আসক্তি, সাফল্যের প্রতি আসক্তি, আত্মীয় স্বজনের প্রতি আসক্তি, বন্ধু বান্ধবের  প্রতি আসক্তি, স্ত্রী-পুত্র পরিবারের প্রতি আসক্তি। 

প্রকৃত আনন্দ পেতে গেলে, আমাদের অনাসক্ত হতে হবে। একটা বয়সে, সংসারের কাজ ছেড়ে দিতে হবে, ঈশ্বরের কাজ করতে হবে। ধরা-ছাড়াতে যারা স্বচ্ছন্দ তাদের জীবন হয়, সহজ সরল। আমাদের সবার জীবনে একটা সময় আসে, যখন চাকরি থেকে অবসর নিতে হয়, তেমনি প্রত্যেকের জীবনে একটা সময় বেছে  নিতে হয়, যখন সে সংসার থেকে অবসর নেবে। তথাকথিত কর্ম্ম থেকে অবসর নেবে। একটা জিনিস জানবেন, অনাশক্তিই জীবনে আনন্দ এনে দিতে পারে। যার মধ্যে ইচ্ছেশক্তি অনাসক্ত এনে দিতে পারে, তার মধ্যে আনন্দের অভাব  হয় না। 

আর এই ক্ষমতা আমার, আপনার সবার মধ্যেই আছে।  জীব-জন্তু সাধারণত পেট ভরে গেলে, আর খাবারের সন্ধানে বেরোয় না।  মানুষই একমাত্র, যার পেটের  ক্ষিদে মিটে  গেলেও, তার মনের খিদে মেটে  না। আবার এই মানুষেরই ক্ষমতা আছে, ক্ষুধা-তৃষ্ণা সহ্য করবার। জীব জন্তু কখনও  ক্ষুধা তৃস্না সহ্য করতে পারে না, মানুষ পারে । 

এখন কথা হচ্ছে, তাহলে কি আমরা সবাই কাজ-কর্ম্ম ছেড়ে দিয়ে সংসার ছেড়ে সন্যাসী হয়ে যাবো ? কিছু লোক অবশ্য  আমাদের মধ্যে  আছেন, তাঁরা কোনো কিছুতেই আকৃষ্ট হন না। যাদেরকে আমরা তথাকথিত সন্ন্যাসী বলি।  এদের কঠিন হৃদয়, এরা এমনকি ভালোবাসতেও চায় না। এদের মন কঠিন।  কিন্তু পাথরের মতো মন নিয়ে আপনি হয়তো দুঃখে এড়িয়ে যেতে পারেন, কিন্তু জানবেন, তখন আনন্দও আপনার কাছ থেকে দূরে চলে যাবে। এই অবস্থা কাম্য নয়। এই জড়বৎ অবস্থায়, দুঃখবোধ না থাকতে পারে, কিন্তু সত্যিকারের আনন্দবোধ থেকেও তিনি  বঞ্চিত থাকে। বরং আমরা চাই, একটা প্রেমময় জীবন।  যেখানে সহানুভূতি থাকবে, ভালোবাসা থাকবে, কিন্তু ভালোবাসার বস্তুর প্রতি আসক্তি থাকবে না। এ এক অদ্ভুত রহস্য যা আমাদের শিখতে হবে। 

দেখুন, ভিখারি কখনো সুখী হতে পারে না। আবার ব্যবসায়ীও কখনো সন্তুষ্ট হতে পারে না। যারা জীবনকে ভিক্ষারিবৎ করেছেন, অথবা জীবনকে নিয়ে কেবল ব্যবসা করছেন, তারা ঘৃণার পাত্র, তারা জীবনে কখনো সুখী হতে পারেন না।  এই ভিক্ষারী লাখ-টাকা পেলেও, ভিক্ষাই করবে। মন্দিরে মসজিদে গীর্জায়, এই ভিক্ষারিদের দর্শন পাওয়া যায়। এদের মধ্যে কেউ মানুষের কাছে ভিক্ষা চাইছে, আবার কেউ ঈশ্বরের কাছে ভিক্ষে চাইছে। 

আবার যারা জীবন-ব্যবসায়ী তারা  প্রেম নিয়ে ব্যবসা করে, ধর্ম্ম নিয়ে ব্যবসা করে, ব্যবসায়িক বৃত্তিই তার জীবনকে টেনে নিয়ে চলেছে, একটা অজ্ঞান অন্ধকারের দিকে।  

এখন কথা হচ্ছে, আমরা এই বস্তু বা বিষয় বা সংসারের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ি কিভাবে ? আসলে আমরা যাকিছু দেই, তার একটা প্রতিদান আশা করি। আর এর ফল হয় উল্টো, আমরা ভালোবাসা দিয়ে দুঃখ পাই।  কিন্তু সত্য হচ্ছে,  এই দুঃখ বাইরে দিক থেকে  আসে না, আমার্  ভালোবাসার প্রত্যাশা, অপূর্ন হলেই, আমার ভিতর থেকে  থেকেই দুঃখ উঠে আসে। দুঃখের বাহক হচ্ছে বাসনা। বাসনাই দুঃখ বহন করে নিয়ে আসে। 

তাই মহাত্মাগণ  বলছেন, "কিছু কামনা করো না. প্রতিদানে কিছু চেয়ো না। যা তোমার দেবার আছে তা তুমি দাও। যা তোমার প্রয়োজন আছে তা তুমি নাও। সূর্য সমুদ্র থেকে জল শুষে  নিচ্ছে, আবার বৃষ্টি  রূপে ফিরিয়ে দিচ্ছে। একটা জিনিস জানবে, যা তুমি নিচ্ছ, তা তোমাকে ফিরিয়ে দিতে হবে, আবার যা তুমি দিচ্ছ, তা তোমার কাছে হাজার গুন্ বেশি হয়ে ফিরে আসবে। তাই তুমি যদি কাউকে ঘৃণা দাও, তবে, তোমার কাছে ঘৃনাই ফিরে ফিরে আসবে, আবার তুমি যদি ভালোবাসা দাও, তবে প্রেম হয়ে তা ফিরে আসবে। একটা জিনিস যেন, তুমি সংসারে এসেছো সঞ্চয় করতে নয়, ভিক্ষা চাইতে নয়।  তুমি যা কিছু এখান থেকে নেবে, তা এখানেই ফিরিয়ে দিতে হবে। যাবার সময় শূন্য হাতেই ফিরে যেতে হবে। আমাদের ত্যাগে সাহস আসে না, ভাবি যদি ভবিষ্যতে যদি কম পরে যায়। কিন্তু সত্য হচ্ছে, তুমি যখন এসেছিলে তখন তোমার কাছে কিছুই ছিল না, আবার যখন তুমি এখান থেকে চলে যাবে, তখন শূন্য হাতেই  যেতে হবে।  এখানকার জিনিস এখানেই পরে থাকবে।  তাহলে কার জন্য সঞ্চয় করছো ? হাসপাতালের ডাক্তারদের জন্য ? ভুলে যাও , যখন যাবার সময় হবে, তখন ডাক্তার কেন, ডাক্তারের বাপও তোমাকে  বাঁচাতে পারবে না। তবে কেন ডাক্তারের কথা ভাবছো ? সবই ভগবানের, তুমি কেবল আদান-প্রদানের মাধ্যম মাত্র। তোমার দ্বারা এই আদানপ্রদান ক্রিয়া করছেন, স্বয়ং ঈশ্বর। তুমি গতিশীল নদী মাত্র।  তোমার গন্তব্য সমুদ্র। তোমার ঘাটে  যদি কেউ স্নান করে, তাতে তোমার জল কমবে না। তোমার কাছ থেকে জল নিয়ে কেউ যদি পান করে, তবে তোমার জল কমবে না, তোমার কাছ থেকে জল নিয়ে কেউ যদি অন্ন উৎপাদন করে, তাতেও তোমার জল কমবে না। কারন এই জল উৎস থেকে  প্রতিনিয়ত ঝরছে, তুমি সেই জলের তোরে ভেসে চলেছো। তুমি জল, নও, তুমি নদী নয়, তুমি শুধুই প্রবাহ। সামনের দিকে বেয়ে চলাই  তোমার কাজ। অনাসক্ত হয়ে এগিয়ে চলো । নিজেকে অনুভব করবার চেষ্টা করো। তুমি যে শক্তি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছো, তাকে অনুভব করবার চেষ্টা করো। 

প্রতিদিন প্রভাতে অনাসক্ত থাকবার জন্য সংকল্প করো। কারুর ক্রীতদাস হয়ে থেকো না।  নিজেই নিজের প্রভু বোনে যায়। নিজের উপরে নিজেই কর্তৃত্ত্ব করো। আমরা বলি, সবাই আমাকে কষ্ট  দিচ্ছে। মিথ্যে - মিথ্যে- মিথ্যে   আমরা বলি জগৎ মন্দ -  মিথ্যে মিথ্যে মিথ্যে - কেউ ভালো না, বার কেউ খারাপ না। শিবরাম নির্জন  পাহাড়ের  কোলে দাঁড়িয়ে, একসময় হতাশ হচ্ছে চিৎকার করে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলো, প্রভু তুমি কি নেই ? কঠিন পাথরে আঘাত খেয়ে সে ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এসেছিলো নেই - নেই- নেই। প্রভু তুমি কি আছো - প্রতিধ্বনি জবাব দিয়েছিলো,  আছে আছে আছে। 

মেরুদন্ড সোজা করে দাড়াও, কারুর উপরে দোষারোপ করো না। নিজেকেও নয়।  কাউর মধ্যে দোষ  খুঁজতে যেও না। তুমি যখন দোষের কথা চিন্তা করবে, তখন শুধু দোষই  দেখবে। যখন আনন্দ খুঁজবে, তখন শুধুই আনন্দই দেখবে । সব ছেড়ে দাও, আবার কিছুই ছেড়ো না। ধরি মাছ, না ছুঁই পানি। সেই যে গোসাঁই কবি গেয়েছেন, আমার যেমন বেণী তেমনি রবে, চুল ভেজাবো না। শুধু বিষয়-আসক্ত থেকে নিজেকে অনাসক্ত করো। কিছুই ছাড়বে না, আবার কিছুই ধরবে না। কর্ম্ম থেকে নিষ্কৃতি নয়, আসক্তি থেকে নিষ্কৃতি পেতে হবে। আর এটা করতে হবে এক্ষুনি, এখন থেকেই। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম। 



  






সত্যধর্ম্ম : মন -গ্রন্থিচক্র - বীজমন্ত্র


সত্যধর্ম্ম : মন -গ্রন্থিচক্র - বীজমন্ত্র 
শশাঙ্ক  শেখর শান্তিধাম 




ওঁ সহ নাববতু।  সহ নৌ ভুনক্তু । সহ বীর্যং করবাবহৈ।
তেজস্বি নাবধীতমস্তু  মা  বিদ্বিষাবহৈ।।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।

হে  পরম আত্মা  পরম ঈশ্বর,  আমাদের উভয়কে  সমভাবে রক্ষা করুন।   সমভাবে  বিদ্যাফল  দান করুন।   আমরা যেন সমভাবে বিদ্যাফল লাভের জন্য সামর্থ অর্জন করতে পারি। আমাদের লব্ধ বিদ্যা সফল হোক।  আমরা যেন পরস্পর বিদ্বেষ না করি।  - হে পরম আত্মা-পরম ঈশ্বর আমাদের ত্রিবিধ শান্তি অর্থাৎ শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্বিক শান্তি হোক।

আমরা আগের দিন পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও পঞ্চভূত নিয়ে আলোচনা করছিলাম। এবং বুঝেছিলাম এই ইন্দ্রিয়গুলি সরাসরি সুখ-দুঃখের অনুভূতির কারন। এখন এই ইন্দ্রিয়গুলি কার নির্দেশে চলে ?

ইন্দ্রিয়গুলো মস্তিষ্কের নির্দেশে চলে। কিন্তু মস্তিস্ক মনের নির্দেশে চলে। তাই আমরা এই মন ও মস্তিস্ক নিয়ে আলোচনা করবো। আমরা মনের গভীরে ঢুকবো। কিন্তু তার আগে, আমাদের আধ্যাত্বিক হতে হবে। আর  আধ্যাত্বিক জীবনের প্রবেশ দ্বার হচ্ছে গুরুকরন। গুরুমন্ত্র গ্রহণ। গুরুমন্ত্র মানে বীজ মন্ত্র।  আগে এই বীজ মন্ত্র  সম্পর্কে কিছু কথা আলোচনা করবো, তার পরে মস্তিস্ক ও মন নিয়ে আলোচনা করবো।  

বীজ মন্ত্র আর কিছু নয়  ঈশ্বরের গুনকীর্তন, বা  ঈশ্বরের বর্ণনা মাত্র। অথবা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা। এটি খুব কম শব্দে উচ্চারিত হয়। বা একক শব্দে উচ্চারিত হয়। বার বার এই মন্ত্র  উচ্চারণের ফলে শরীরে একটা মৃদু কম্পন অনুভূত হয়। মন্ত্রে তন্ময় হলে চিত্ত ঈশ্বরে নিবদ্ধ হয়। জপ্ করলে  বা বারবার একই মন্ত্র বা বিষয় বারবার উচ্চারিত হলে মন সেই বিষয়ে স্থির হয়। বাহ্যিক সুখ-দুঃখ থেকে, শরীরকে সাম্য অবস্থায় রাখা যায়।

গুরুদেব  বলছেন : উপাসনা বা গুনকীর্তন যেমন সাধারণ ভাষায় করা যেতে  পারে, তেমনি বৈজিক ভাষায় করা যেতে পারে। সাধারণ ভাষা অর্থাৎ বাংলা, সংস্কৃত, ইত্যাদি।  আর সব থেকে আদি ভাষা হচ্ছে বৈজিক  ভাষা। ভাষা সৃষ্টির ক্রোম এই রকম - বৈজিক -বৈদিক-সংস্কৃত-প্রাকৃত-বাংলা ইত্যাদি।

গুরুদেব বলছেন বৈজিক ভাষাই  মূল ভাষা। বৈজিক থেকে বৈদিক। আর বৈদিক থেকে সংস্কৃত, গ্রিক, ল্যাটিন,আরবি, হিব্রু  প্রভৃতি উৎপন্ন হয়েছে। সংস্কৃত থেকে প্রাকৃত তারপর বাংলার উৎপত্তি হয়েছে। অতএব  ভাষার মূল বা বীজভূত ভাষা হচ্ছে "বৈজিক"। এই ভাষাতেই জীব, জন্তু, পশু, পাখি কথা বলে। অতএব যদি  বৈজিক ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান থাকে তবে তুমি সবার কথা বুঝতে পারবে, তা সে দেবতার কথাই হোক আর পশু পাখির কথাই  হোক, আর মানুষের কথাই  হোক। বৈজিক ভাষায় উৎকৃষ্ট জ্ঞান থাকলে নিখিল ব্রহ্মান্ডের ভাষা বোঝা যেতে পারে।

বৈজিক  ভাষা হচ্ছে ভাব প্রকাশের সব চেয়ে সংক্ষিপ্ত ভাষা এবং প্রথম ভাষা, সৃষ্টির আদি ভাষা ।  বীজ থেকে  বৈজিক, অর্থাৎ ভাষার মূলভূত বীজ। কেউ কেউ এটাকে বৈচিক ভাষায় বলে অর্থাৎ কথ্য ভাষায় বীজকে বলে বিচি।  এই বিচি থেকেই বৈচিক।  যাই হোক বৈজিক ভাষা  শুধু সংক্ষিপ্ত  শব্দ নয়, বৈজিক ভাষার উচ্চারনে একটা মহৎ গাম্ভীর্য ভাব উৎপন্ন হবে।   গুরুদেব মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্ত, একটা উদাহরণ দিয়ে এটা বুঝিয়েছেন। যেমন ধরো আমাদের বলতে হবে  :

"হে জগদীশ্বর ! তোমার করুনার অন্ত  নেই, তুমি আমাদেরকে  যাবতীয় বিপদ হতে রক্ষা  .করছো এবং তোমার তুল্য মহৎ কেউ নেই. অর্থাৎ তুমি সর্ব জগতের মধ্যে মহিষ্ঠ, তোমাকে প্রণাম করি। "

এই একই কথা সংস্কৃতে বললে অল্প সময়ের মধ্যে বলা যাবে এবং তা হবে :

"অনন্ত-করুনং ব্রহ্ম রক্ষকং ত্বাং নমাম্যহম্"

গুরুদেব বলছেন ভাষার শক্তি দেখ   ; একই কথা সংস্কৃতে উচ্চারণ করলে যে মহান গাম্ভীর্যতা প্রকাশ পায়  তা বাংলায় হয় না।  আবার একই ভাব বা কথা যদি বৈজিক ভাষায় উচ্চারণ করা হয় তা হয়ে যাবে  এই রকম।

"ওঁং ক্রীং নমঃ"

 তাহলে দেখছো বৈজিক ভাষা, বা  বীজ মন্ত্রের ভাষা কতটা সংক্ষিপ্ত ও গাম্ভীর্যপূর্ণ।

বৈজিক ভাষার আরো কিছু মন্ত্র অর্থ সহ বলছি :

হৌং  :  হ্ = শিব, ঔ=সদাশিব, ং=দুঃখহরণ ; সর্বদা মঙ্গলকারী শিব আমার দুঃখ হরণ  করুন।

দূঁ : দ্ = দুর্গা , ঊ = রক্ষা, ঁ = কর : হে জগৎ জননী দুর্গে ! আমাকে রক্ষা করো।

ক্রীঁ : ক্ = কালী , র্= ব্রহ্ম, ঈ = মহামায়া, ঁ = দুঃখ হরণ  : মহামায়া ব্রহ্মস্বরূপ জগৎ জননী কালী আমার দুঃখ হরণ  করুন।
গং :  গ = গনেশ , ং = দুঃখ হরণ।  গনেশ দুঃখ হরণ করুন।

ক্লীং : ক = কামদেব বা কৃষ্ণ  ল =  ইন্দ্র বা ঐশ্বর্য্যশালী , ঈ = তুষ্টি , ং = দুঃখ হরণ  : হে  ঐশ্বর্য্যশালী কামদেব বা কৃষ্ণ আমার তুষ্টি বিধান করুন, দুঃখ হরণ করুন।

এই রকম আরো বীজ মন্ত্র আছে : যেমন

হ্রীঁ - মহাদেবের শক্তি মহামায়া জগৎ জননী দুঃখ হরণ  করুন
শ্রীঁ - পরমেশ্বরী মহালক্ষ্মী আমাদের ধন ও পরম সন্তোষ প্রদান করুন এবং আমার দুঃখ হরণ  করুন।
ঐং - সরস্বতী দুঃখ হরণ  করুন।
হূঁ - মহাদেব যার ভৈরব, সেই পরমেশ্বরী আমার দুঃখ হরণ  করুন ।
স্ত্রীঁ - জগৎ জননী মহামায়া মোক্ষদা দুর্গোত্তারিণী তাঁরা আমার দুঃখ হরণ  করুন।

দ্রব্যের যেমন গুন্ বা শক্তি আছে, শব্দেরও তেমনি শক্তি আছে। ভালো সুর শুনলে আমাদের মন মোহিত হয়। আবার বাজির শব্দে বা বজ্রের শব্দে আমাদের মন চমকে ওঠে।
শব্দ দুই রকম : ধ্বনি ও বর্ণ। ধ্বনি অর্থবহ নয়। যেমন বিভিন্ন বাদ্যের বাজনা।বাঁশির সুর, বজ্রের ধ্বনি। মেঘের ডাক। ইত্যাদি।
বর্ণ কিন্তু অর্থবহ। মানুষ এই বর্ণের সাহায্যেই কথা বলে।  তাই অর্থবহ। বর্ণ দুই প্রকার ব্যঞ্জন  বর্ণ ও স্বরবর্ণ। আমাদের মুনি ঋষিরা ধ্বনি ও শব্দ, উভয়ের মাহাত্য দিয়েছেন। বেদে  ধ্বনির মাহাত্য।  এইজন্য বেদের সূক্ত বা শ্লোকের উচ্চারণের প্রতি বিশেষ গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে।  এই জন্য এঁকে শ্রূতি   বিদ্যা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এটি একমাত্র গুরুমুখে শুনেই শেখা বা আয়ত্ত্ব করা যায়।

ধ্বনির সাথে সাথে বর্ণগুলিকে অর্থাৎ অ, আ - ক, খ ইত্যাদি বর্নকে পর্যালোচনা করে, মুনি ঋষিরা  দেবতা-বিশেষের জন্য বিশেষ বীজ মন্ত্র নির্দ্ধারণ করে গেছেন।

তোমরা  শুনে থাকবে,  ওম নমঃ শিবায়ঃ - একটা বীজ মন্ত্র।  ওম নমঃ বাসুদেবায়, এ ছাড়া গায়ত্রী মন্ত্র, মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র এগুলো মানুষ জপ্ করে। এগুলোর উচ্চারণ যে যার মতো করে। ফলতঃ সঠিক উচ্চারণের ফল অপ্রকাশিত থাকে। আর একটা কথা খেয়াল রাখবে, বীজ মন্ত্র  সব সময় প্রণব পূত হবে। অর্থাৎ প্রণব ছাড়া  বীজমন্ত্র হয় না। 

বীজমন্ত্রের  সঠিক অর্থ যেমন জানা দরকার, তেমনি ভাবে এর সঠিক  উচ্চারণ করা আবশ্যক। যেহেতু উচ্চারণ কখনো  বই পড়ে শেখা যায় না, তাই গুরুর কাছ থেকে এটা  শিখে নিতে হয়। তাই দেখবে, গুরুদেব  বীজমন্ত্র সবসময়  কানের কাছে মুখ নিয়ে উচ্চারণ করেন । এর সঠিক উচ্চারণ গুরুই শিখিয়ে দেন। তাই বীজ মন্ত্র গুরুপ্রদত্ত। আর একটা কথা তোমরা  যারা গুরুমন্ত্র জপ্ করো  তারা খেয়াল করবে, তুমি  হয়তো জপের মন্ত্র উচ্চারণ করে যাচ্ছো, কিন্তু তোমার  মন  জপের মধ্যে নেই, অর্থাৎ জপ্-কে  যে মনন করা উচিত, তা হচ্ছে না। আবার হয়তো মনকে জপের মধ্যে নিয়ে এলে।  যতক্ষন তোমার  মন স্থির না হচ্ছে ততক্ষন এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এটাই প্রত্যাহার।  জপমন্ত্র   হচ্ছে তোমার  ধারণার বিষয়। মন বিষয় থেকে বেরিয়ে যাওয়া মানে  তোমার  দুর্বল ইচ্ছাশক্তির পরিচয়। এইখানে গুরু সহায়ক  হয়। প্রকৃত গুরুর কাছ থেকে যদি তুমি  মন্ত্র  পাও , তা সে তোমার  জানা মন্ত্রই হোক, গুরু তোমার  অবচেতন মনে মন্ত্রের মালা গেঁথে  দেবেন। তোমার  শরীরে মশা  পড়লে যেমন হাত আপনা থেকে এগিয়ে যায়, তোমার  অজ্ঞাতসারেই এটা হয় ।  তেমনি তোমার  জপ্ বন্ধ  হয়ে গেলে বা মন থেকে জপের মালা সড়ে গেলে, গুরুর ইচ্ছেতেই আবার জপ্ শুরু হয়ে যাবে।  মন্ত্র আর মন এক হয়ে যাবে।  এর জন্য কোনো প্রয়াস করতে হয় না। এইখানেই গুরুকরণের সার্থকতা। মন্ত্র  তো আমরা সবাই বই পড়ে শিখে নিতে পারি।  কিন্তু গুরুপ্রদত্ত মন্ত্র, গুরুকৃপায় সর্বক্ষণ স্পন্দিত হতে থাকে। আসলে গুরুদেবের আজ্ঞাচক্র সক্রিয়। আর সক্রিয় আজ্ঞাচক্র যখন কাউকে কোনো নির্দেশ দেয় তা সে মানতে বাধ্য। তাই সৎ গুরুর দেওয়া বীজমন্ত্র সব সময় শিষ্যের  মধ্যে স্পন্দিত হতে থাকে। কোনো প্রয়াশ ছাড়াই।  তাই গুরুমন্ত্র প্রকৃত  গুরুর কাছ থেকেই গ্রহণ করা উচিত। অন্যথা নিজের ইচ্ছা শক্তি জাগ্রত করতে হয়।  যা সবাই পারে না।

গুরুদেব  বলছেন : বৈজিক ভাষা উচ্চারনে ভাব বিনিময় যেরূপ সম্পূর্ণ হয়, অন্য কোনো ভাষায় তদ্রুপ হয় না। বৈজিক ভাষাই পূর্ণ ভাষা। বৈজিক ভাষা নিখিল ভাষার মাতা-পিতা। বৈজিক ভাষাই সার্বভৌম, ও সর্বজীবের ভাষা। একারনে, উন্নত মহাত্মারা এই অতি মহীয়সী ভাষায় যে সকল বীজ প্রদান করেন, তার উচ্চারণেই  অভিপ্রেত সিদ্ধি সম্পূর্ণ রূপে হয়ে থাকে। বীজ বিশেষের উচ্চারণে ভক্তি, একাগ্রতা বৃদ্ধিও হয়ে থাকে।

এখন এই বীজমন্ত্র উচ্চারণে আমাদের কি ভাবে উপকার হয়, সেই সম্পর্কে আলোচনা করবো।

গুরুদেব বলছেন :

মেরুদণ্ডের দুইদিকে ইড়া ও পিঙ্গলা নামে দুইটি নাড়ী আছে। এই ইড়ার দক্ষিণে ও পিঙ্গলার বামে অর্থাৎ ইড়া-পিঙ্গলার মাঝখানে সুষুম্না নাড়ী অবস্থান করছে। সুষুম্নার মধ্যে আবার বজ্রাখ্যা নাড়ী ও তার মধ্যে চিত্রিণী নাড়ী অবস্থান করছে। এর মধ্যে সাতটি স্থানে গ্রন্থি আছে।

 কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে  এসব জানলে কি আমরা  ভালো থাকতে পারবো ?

দেখো, ভালো যদি থাকতে চাও তো না জানাই ভালো। সহজ সরল মানুষ বড়ো ভালো থাকে।
কিন্তু আমরা  মোটেই সহজ সরল নই । সহজ সরল মানুষের মধ্যে কোনো প্রশ্ন জাগে না। তারা শুধু মেনে নেয়। তাই তারা ভালো থাকে। কোনো প্রশ্ন করে না। আমাদের  মধ্যে প্রশ্ন অনেক। আমরা  সমুদ্রের কিনারে দাঁড়িয়ে আছি । সমুদ্রের ঢেউ আমাদেরকে   অস্থির করেছে। 

মন ও মস্তিস্ক আমাদের দেহেরই অঙ্গ। মস্তিস্ক অসংখ্য স্নায়ুর বা গ্রন্থির  সমষ্টি। একটা খুলির  মধ্যে সুরক্ষিত প্রায় ১০০০০ মিলিয়ন অর্থাৎ ১০০০ কোটি নিউরোন নিয়ে গঠিত স্নায়ুতন্ত্রের স্ফীতকায় অংশটিকে বলে মস্তিস্ক। আমাদের মস্তিষ্কের ওজন প্রায় ১২০০ থেকে ১৪০০ গ্রাম।

আর মন হচ্ছে বিভিন্ন  গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত অন্তর্মুখী রসের সূক্ষ্যাংশ দ্বারা গঠিত।

আমরা আগেই জেনেছি, দেহ পঞ্চভূতের তৈরি। মন নিয়ে আলোচনার প্রারম্ভে আমাদের দেহতত্বটা একবার বুঝে নিতে হবে। কথায় বলে যা আছে ব্রম্ভান্ডে তাই আছে আমাদের দেহভান্ডে। দৃশ্যমান ব্রহ্মান্ড যেমন পঞ্চভূতের তৈরী, দেহও তেমনি পঞ্চভূতের তৈরি।

হঠযোগীরা বলছেন : "শরীরমাদ্যং খলু  ধর্মসাধনম্" . শরীরই সমস্ত সাধনার ভিত্তিভূমি। এই শরীর সুস্থ না থাকলে তোমার  দ্বারা কোনো সাধনাই  হবে না। তা সে সূক্ষ্ম জগতের সাধনা বলো  আর স্থুল জগতের সাধনাই  বলো । দেহটাই যন্ত্র।  আর দেহকে ধারণ করে আছেন আত্মা-রূপী যন্ত্রী। এই দেহই বলো, আর দেহে স্থিত মন, বুদ্ধি, অহংকার এগুলো আত্মার বিভূতি বা শক্তি। এই শক্তির খেলাই  চলছে নিরন্তর দেহ যন্ত্রের মধ্যে। দেহযন্ত্র ভালো বা শুদ্ধ থাকলে - এটা  হবে দেবভূমি।  আর দেহযন্ত্র যদি ত্রূটি যুক্ত হয় তবে তা  হবে অসুরভূমি। এখন তোমার দেহকে দেবভূমি বানাবে না অসুরভূমি বানাবে তা তোমার উপরে। দেখো তোমার যদি ঠিকমতো হজম না হয়, অর্থাৎ তোমার দেহের যকৃতের ক্রিয়া যদি ঠিক না থাকে তবে তোমার মেজাজ খিটখিটে হবে।  তোমার সেক্স-গ্লান্ড-(Sex gland)  বা পিতৃগ্রন্থি যদি ঠিক না থাকে তবে তুমি স্বার্থপর এবং কামুক হয়ে যাবে। তোমার থাইমাস (thymus ) বা মঙ্গলগ্রন্থি যদি ঠিক না থাকে তবে তুমি চোর-ডাকাত-বদমায়েশ হবে। শিবসতী গ্রন্থি  (Pituitary ) যদি ঠিক না থাকে তবে মানুষ ছোট মনের  মানুষ হয়। এরা কেবল পরের দোষ  দেখে বেড়ায়। এমনকি এরা ঘুষখোরও  হয়।

আসলে কোনো মানুষই খারাপ হয়ে জন্মায় না। সবার অন্তরে ভাগবত সত্ত্বা বিরাজ করছে। কিন্তু খাদ্যদোষে হোক আর প্রাকৃতিক কারণে হোক আমাদের শরীরে, রোগ বাসা বাঁধে। অর্থাৎ বিভিন্ন গ্রন্থির কাজ ঠিক ঠিক মতো হয় না। কোনো কোনো গ্রন্থি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। গ্রন্থির ক্রিয়া দোষযুক্ত হলে আমাদের মধ্যে কুচিন্তা ও কু-কাজ করবার প্রবৃত্তি জেগে ওঠে। তাই আমরা মানুষে মানুষে পার্থক্য দেখতে পাই। খেয়াল করবে, মাংসাশী প্রাণী প্রায়শঃ হিংস্র হয়। তৃণভোজী প্রাণী নিরীহ হয়। দেহ শুদ্ধ হলে মন শুদ্ধ হবে। মন যার শুদ্ধ সে সর্বদা আত্মাস্বরূপে অবস্থান করে।  আনন্দে থাকে। পরহিতে নিযুক্ত থাকে।

হঠযোগীরা বলছেন আমাদের শরীরের ইড়া-পিঙ্গলার উপরে আধিপত্য বিস্তার করতে পারলে চিরদিন যেমন ব্যাধিমুক্ত থাকা যায় তেমনি মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি। আত্মার আনন্দময় স্বরূপ, অনন্ত  স্বরূপ, আমরা আস্বাদন করতে পারি। এখন কথা হচ্ছে, এর সঙ্গে গুরুমন্ত্রের কি সম্পর্ক ?

মন্ত্র  হচ্ছে তরঙ্গ উৎপাদনের কারন। আমরা যখন শব্দ বলি বা ধ্বনির সৃষ্টি করি তা সে যে ভাবেই হোক, তা একটা বিশেষ তরঙ্গ সৃষ্টি করে। তরঙ্গই রূপ নেয়। যার জন্য বলা হয় সৃষ্টির আদি হচ্ছে প্রণব। প্রণব কথাটার মানে হচ্ছে নব নব রূপ পরিগ্রহ। আদি ধ্বনি ওঁম থেকেই সমস্ত সৃষ্টি। সাধনার একটু গভীরে করলে, আমরা বুঝতে পারবো : প্রণব আসলে অনাহত নাদ । প্রণবের কোনো অর্থ  নেই। সাধারনতঃ সমস্ত ধ্বনি সৃষ্টি হয় - হয় সংঘর্ষে নয়  আঘাতে। প্রণবের কোনো কারন নেই, কোনো আঘাতে বা সংঘর্ষে  এর সৃষ্টি হয় নাই। প্রণব সৃষ্টির আগে সমস্ত-ই ছিল এক। আঘাতে বা সংঘর্ষে দুই-এর প্রয়োজন। তাই প্রণবকে অনাহত নাদ বলা হয় । কাঁসর ঘন্টা, শঙ্খের  ধ্বনি ইত্যাদি প্রণব পুত।  তাই এই ধ্বনি শুভ, মঙ্গলময় ও সৃষ্টির আদি। এখন এই বিশেষ ধ্বনি যে তরঙ্গের সৃষ্টি করে তা আমাদের শরীরের বিভিন্ন চক্রে  আঘাত করে, এবং সেখানে স্পন্দন তোলে, তাকে চঞ্চল করে তোলে, এবং ক্রিয়াশীল করে তোলে। বিশেষ বিশেষ ধ্বনি আমাদের বিশেষ বিশেষ জায়গায় বা গ্রন্থিতে আলোড়ন তোলার  সক্রিয় ভূমিকা নেয়। আর ওই গ্রন্থি যখন ক্রিয়াশীল হয়ে যায়, তখনি আজব ব্যাপার সংগঠিত হয়। মানুষের চিন্তা ধারার পরিবর্তন হয়। বিচারাধারার পরিবর্তন হয়। কর্মধারার পরিবর্তন হয়। মানুষ পাশবিক প্রবৃত্তি ত্যাগ করে, দেবমানব হয়ে যায়। এইখানেই মন্ত্রের কারিকুরি। প্রতিনিয়ত যখন বীজমন্ত্র জপ্ করছো তখন তোমার  সমস্ত চক্র (১১৪) ক্রিয়াশীল হতে পারে। ১১৪টি চক্রের মধ্যে ১০৮টি চক্র ক্রিয়াশীল করা যায়। এই জন্য জপের মালায় ১০৮টি পুঁথি থাকে।  বাকি ছয়টি ক্রিয়াশীল হয় না। কিন্তু মাত্র ৭টি চক্র বা ১১টি স্পর্শকাতর জায়গায় আমরা যারা সাধারণ মানুষ, একটু চেষ্টা করলেই সেগুলিকে ক্রিয়াশীল করতে পারি। সেজন্য এই জায়গাগুলো সম্পর্কে আমাদের একটা ধারণা থাকা দরকার। প্রথমে এটি কল্পনা করে নিতে হয়। সাধনার সঙ্গে সঙ্গে এই সব জায়গায় মৃদু কম্পন অনুভূত হয়। তখন এর সঠিক অবস্থান জানা যায়। 

এই এগারোটি জায়গা হচ্ছে :

মূলাধার,(মেরুদণ্ডের শেষে গুহ্যদ্বারে) 
স্বাধিষ্ঠান, (লিঙ্গমূলে) 
মনিপুর,(নাভির ঠিক পিছনে ) 
অনাহত, (হৃদয়ের পিছনে ) 
বিশুদ্ধি, (কন্ঠার ঠিক পিছনে) 
আজ্ঞা, (মেরুদণ্ডে নয় - এটি ভ্রূযুগলের পিছনে নিম্ন মস্তিষ্কে) 
সহস্রার, (মস্তিষ্কের তালুতে) 
বিন্দু, (সহস্রারের ঠিক উপরে )
এ ছাড়া তিনটি স্পর্শকাতর জায়গা সম্পর্কে আমাদের ধারণা রাখা উচিত।  সেগুলো হল : 
ভ্রূযুগল মধ্যে,
নাসিকাগ্র ; 
এবং 
চিদাকাশ অর্থাৎ চোখ বুজলে যেখানে আমরা অন্ধকার দেখি । এগুলোর মধ্যে প্রথম ৭টির জন্য বিশেষ মন্ত্র  আছে। যেমন
মূলাধারের জন্য লং, ल्न्ग 
স্বাধিষ্ঠানের জন্য ৰং (ওয়াং), व्ङ्ग् 
মনিপুরের জন্য রং, र्ङ्ग् 
অনাহতের জন্য যং (ইয়ং), य्ङ्ग्  
বিশুদ্ধির জন্য হং, ह्ङ्ग्  
আজ্ঞাচক্রের জন্য ওঁং ॐ এবং 
সহস্রারের জন্য সোহং सोह्ङ्ग् । 

এই মন্ত্র  বা ধ্বনির  সাহায্যে এই চক্র বা গ্রন্থিগুলিকে ক্রিয়াশীল করা যায়।
গুরুদেব  বলছেন :
এই বীজগুলি বস্তুতঃ বাংলা অক্ষরে বা সংস্কৃত অক্ষরে লিখিত নহে। এগুলি বৈজিক ভাষার বর্ণমালা অনুসারে লিখিত। শুধু তাই নয়, এই ৭টি দলে বা গ্রন্থিতে যে আকার আছে অর্থাৎ যে আকৃতিতে ওই গ্রন্থি সকল আমাদের শরীরে অবস্থান করছে তা বৈজিক বর্নমালার আকার অনুসারেই হয়েছে। আর একটা গুহ্য কথা বলছেন গুরুদেব তা  হচ্ছে, নাড়ী সংযোগ উৎপন্ন  স্থল বা চক্র ৬৮ টির অধিক হলেও এর মধ্যে ৫০টি প্রধান।  আর তাই আমাদের বর্নমালার সংখ্যাও পঞ্চাশ। (অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ এ ঐ ও ঔ - ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ ড ঢ ণ ত থ দ ধ ন প ফ ব ভ ম য র ল শ ষ স হ ড় ঢ় য় ৎ ং ঃ ঁ ক্ষ )  এখানে অবশ্য গুরুদেব বলছেন  "ক্ষ" যুক্তাক্ষর হলেও একে মূল বর্ণের মধ্যে বর্ণনা করা হয়েছে। 

কিন্তু কথা হচ্ছে এগুলো  ক্রিয়াশীল করলে কি হয় ?

আমরা জানি সমগ্র ব্রহ্মান্ড সাতটি  লোক বা স্তরে  বিভক্ত। এগুলো হচ্ছে : ভূ-লোক, ভুব-লোক, স্বঃ-লোক, মহঃ-লোক, জনঃ-লোক, তপঃ-লোক, এবং সত্যম বা  সত্য-লোক। আবার আমাদের শরীরের মধ্যেও সপ্ত ধাতু আছে যেমন : শুক্র, শোনিত, মজ্জা, মেদ, মাংস, অস্তি , ত্বক। এই দেহের এক একটা স্থান এক একটা লোকের কর্ম-কেন্দ্র। এই কর্মকেন্দ্রের নামই চক্র বা গ্রন্থি। এই গ্রন্থিগুলো বা এক একটা গ্রন্থি এক এক তত্ত্বের কর্মকেন্ত্র। তত্ত্ব অর্থাৎ পঞ্চতত্ত্ব - ক্ষিতি, অপ, তেজ. মরুৎ , ব্যোম। দেহের প্রধান প্রধান গ্রন্থি গুলির অন্তর্মুখী রস  নিঃসরণের ক্ষমতা আছে। এই অন্তর্মুখী রসই রক্তের সঙ্গে মিশে দেহের গঠন ও পালনপোষন করে। এমনকি মানসিক জীবন  বা মন গঠন করে। যার দেহে যে গ্রন্থির আধিপত্য বেশি বা যার দেহে যে গ্রন্থি অধিক ক্রিয়াশীল, তাকে সেই গ্রন্থিপ্রধান মানুষ বলা হয়।

যদিও সমস্ত গ্রন্থিই আলাদা আলাদা ভাবে সারা শরীরে ক্রিয়াশীল। তথাপি এক এক গ্রন্থির এক একটি প্রধান কার্যকেন্দ্র  আছে। এগুলো এই রকম :

কণ্ঠদেশ থেকে ললাটের মধ্যবর্তী অংশ   আকাশ তত্ত্বের কাজ করে। অর্থাৎ ব্যোম গ্রন্থি বলা যেতে পারে। এখানেই  ইন্দ্রগ্রন্থি ( THYROID) উপেন্দ্রগ্রন্থি (Para-Thyroid ), তালুগ্রন্থি (Tonsil ),  লালা গ্রন্থি (Salivary Glands ) ইত্যাদির কর্মক্ষেত্র   । এখান থেকেই যে অন্তর্মুখী রস  নিঃসৃত হয় আমাদেরকে সুস্থ থাকতে  সাহায্য করে।  এই গ্রন্থিগুলি  সুস্থ-সবল থাকলে - আমাদের স্নেহ, প্রীতি, ভালোবাসা, উচ্চ চিন্তা বা গভীর চিন্তা করার ক্ষমতা থাকে। আর গ্রন্থিগুলি  অতি সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলে আমাদের বিষাদ, উচ্চ চিন্তার ক্ষমতা হ্রাস, হতদ্যম, আলস্য, কর্মবিমুখতা প্রভৃতি দেখা দেয়। ব্যোম তত্ত্বে সত্ত্বগুণের আধিপত্য। 

এখানে একটা কথা বলা প্রয়জন :: এই অন্তর্মুখী রস, অর্থাৎ প্রত্যেক চক্র বা গ্রন্থি  থেকে নিঃসৃত অন্তর্মুখী রসের সুক্ষ অংশ থেকে মন গঠিত হয়। এই কথাটা আর একবার একটু খেয়াল করো - গ্রন্থি বা  চক্র থেকে  নির্গত অন্তর্মুখী রস আমাদের মনের গঠন করে।

এর পরে আসছে বক্ষ প্রদেশ।  এটি বায়ুতত্বের প্রধান কর্মকেন্দ্র। এখানে দুটো ফুসফুস, হৃদযন্ত্র, মঙ্গলগ্রন্থি (thymus ) এবং প্রাণকোষ নির্মাণকারী গ্রন্থি এবং অনেকগুলো উপগ্রন্থি এই বায়ু গ্রন্থির অন্তর্গত। বায়ুই দেহের প্রধান রক্ষক ও পরিচালক।

এই বায়ু গ্রন্থি ও তার তার অন্তর্গত গ্রন্থিগুলি সুস্থ-সবল থাকলে একদিকে যেমন দেহ সুস্থ থাকে তেমনি এই গ্রন্থিই মানুষকে ধীর-স্থির, শুদ্ধ-শান্ত, শ্রদ্ধাশীল, ও মহাকর্মী করে । বায়ু ঠিকমতো কাজ না করলে মানুষ অস্থিরমতি, অকৃতজ্ঞ, কৃতঘ্ন হয়।

এর পরে আসছে মধ্যপ্রদেশ অর্থাৎ পেট। এটি অগ্নিগ্রন্থির  অন্তর্গত। এখানে কি আছে এক বার দেখে নেই। প্লীহা,(Spleen ) যকৃৎ(liver ) অগ্ন্যাশয় (Pancreas ) শুক্রগ্রন্থি (Adrenal Gland )  প্রভৃতি গ্রন্থি অগ্নিগ্রন্থির প্রধান কর্মক্ষেত্র। অগ্নিগ্রন্থিই শরীরে তাপ প্রদান করে। প্রাণকে সঞ্জীবিত রাখে। এই অগ্নিগ্রন্থি থেকে যে রস  নিঃসৃত হয় তা Nitric Acid , Hydrochloric Acid, Sulphuric Acid প্রভৃতি দাহিকাশক্তি সম্পন্ন উপাদানের সমাহার। এই অগ্নিরসই পাচকরস, পিত্তরস, অম্লরস। এই অগ্নিরস অন্নকে দগ্ধ করে, রসরক্তে পরিণত করে। দেহের মাংস মেদ অস্থি প্রভৃতি গঠনে সহায়তা করে।

এই অগ্নিপ্রধান লোকেরাই হয় মহাতেজস্বী, উদ্দমী। নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা থাকে এঁদের। আর এই গ্রন্থি যদি ঠিক ঠিক মতো কাজ না করে তবে তারা হয় কামুক, ঝগড়ুটে, দাম্ভিক, অহংকারী, উগ্র, অস্থির, অসহিষ্ণু।

এর পরে আসছে নিম্নাঙ্গ। অর্থাৎ মূত্রগ্রন্থি,(kidney ), প্রজাপতি গ্রন্থি বা পিতৃগ্রন্থি (Testis ) কন্দর্প-গ্রন্থি (Prostate gland ), মদনগ্রন্থি (cowpers Gland ), মাতৃ গ্রন্থি (Ovary ) রতি গ্রন্থি,(Bartholins gland)  মিথুন  গ্রন্থি (Skenes gland ) . এগুলো সবই  বরুন গ্রন্থির অন্তর্গত। এই বরুণগ্রন্থির নিঃসৃত অন্তর্মুখী রসে সন্তান বীজ বা শুক্রকীট উৎপন্ন হয় ও সৃষ্টিধারাকে অব্যাহত রাখে। এই শুক্র হতেই দেহের সমস্ত উপাদান অর্থাৎ স্নায়ু, তন্তু  কোষ, মাংস, মজ্জা, অস্থি সমস্তই গড়ে ওঠে। বরুণগ্রন্থি হতে নিঃসৃত রসকে বলা হয় সোমরস।

বরুন-গ্রন্থি  প্রধান লোকেরা খুব সহৃদয় হয়। এদের মিষ্টি ব্যবহার, মিষ্টি কথা মানুষকে আকর্ষণ করে। এরা বৈষয়িক প্রতিষ্ঠা পায়। বরুণগ্রন্থি  ঠিক ঠিক মতো কাজ না করলে মানুষ স্বার্থপর, পরশ্রীকাতর, ক্রোধী ও কামুক হয়।

পৃথ্বি গ্রন্থি অস্থি ও মাংস উপাদানের কারন ক্ষেত্র। পৃথ্বি গ্রন্থির শক্তি ও তার প্রকাশ সুপ্ত।

পৃথ্বি গ্রন্থিপ্রধান লোকেরা স্থুলদেহী হয়।  স্বভাব হয় উদার,ও সহিষ্ণু। এরা  সাধারণত ঝামেলা এড়িয়ে চলে। এই গ্রন্থির অসামাঞ্জস্যে মানুষ হয় ভোগী স্বার্থপর।

আধুনিক বিজ্ঞান  বলছে  : স্নায়ুতন্ত্র বা nurvas system আমাদের বাহির জগৎ ও অন্তর্জগতের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে।   এই স্নায়ুতন্ত্র গঠিত হয় স্নায়ু তন্তু অর্থাৎ সুতো বা fibre-এর   মতো একপ্রকার পদার্থ দিয়ে। তন্তু গুলো বিভিন্ন আকারের হয়। সরু, মাঝারি, পাতলা। কর্ম অনুসারে এরা  তিন ধরনের হয়।  প্রথম গ্রাহক বা receptor, দুই প্রেরক বা বাহক conductor (Neurone ) এবং তিন কারক বা effector . এই তিন রকম কাজের সাহায্যে স্নায়ুতন্ত্র আমাদের অন্তর্জগৎ ও বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।

আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি  অর্থাৎ চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিব্বা, ত্বক, এই  পাঁচটি ইন্দ্রিয় এবং দেহের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত গ্রাহক কোষগুলি বাইরের জগতের উদ্দীপনা বা ভৌত বা রাসায়নিক পরিবর্তন গ্রহণ করে। এইবার গৃহীত উদ্দীপনা সংবেদ স্নায়ু বা বাহক স্নায়ুর মাধ্যমে স্নায়ুকেন্ত্র অর্থাৎ মস্তিস্ক বা সুষুম্নাকাণ্ডে পাঠিয়ে দেয়।

এইবার মস্তিস্ক বা সুষুম্নাকাণ্ড অর্থাৎ স্নায়ু কেন্দ্র এই উদ্দীপনার বিশ্লেষণ করে এবং ক্রিয়া স্থান বা কারকে অর্থাৎ effective organ- এ বাহকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়। 

এইবার স্নায়ু কেন্দ্র থেকে গৃহীত আদেশ অনুসারে ক্রিয়াস্থান বা কারকে কার্য সম্পাদিত হয়।

অতএব আমাদের কাছে একটা জিনিস পরিষ্কার : মস্তিস্ক হচ্ছে স্নায়ু কেন্দ্র।  এবং এখানেই সুষুম্না অর্থাৎ স্নায়ুতন্ত্রের প্রধান কর্মক্ষেত্র , এবং  এখান থেকেই বাহক তন্তুর সাহায্যে  সমস্ত নির্দেশ পাঠাচ্ছে এবং সেই মত আমরা কাজ করছি বা আমাদের কার্য সম্পাদিত হচ্ছে।

আধুনিক বিজ্ঞান বলছে,  সুষুম্নাকাণ্ডের উভয়পার্শ্বে বিভিন্ন স্থান থেকে একাধিক স্নায়ু নির্গত হয়ে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। এগুলো সবই জোড়া জোড়া। সাধারনতঃ এর মধ্যে একটি গ্রাহক অন্যটি বাহক হিসেবে কাজ করে। এই রকম ৩১ জোড়া স্নায়ু সুষুম্না থেকে নির্গত হয়েছে। 
এই যে ৩১ জোড়া স্নায়ু এর মধ্যে আট জোড়া স্নায়ু  গ্রীবা (survical ) থেকে অর্থাৎ কন্ঠের পিছনে অবস্থিত সুষুম্না নারি  থেকে নির্গত হয়েছে।  যাকে মুনি ঋষিরা বলছেন বিশুদ্ধ চক্র। 
বারো জোড়া স্নায়ু  বক্ষ (Thoractic) থেকে অর্থাৎ বুকের পিছনের সুষুম্না নারি থেকে বের হয়েছে।  যাকে ঋষিরা বলছেন অনাহত চক্র। 
পাঁচ জোড়া স্নায়ু কটিদেশ (Lumber)  বা নাভির বিপরীতে সুষুম্না নারি থেকে নির্গত হয়েছে।
যাকে সাধকরা বলছেন মনিপুর চক্র। 
আরো পাঁচজোড়া স্নায়ু নির্গত হয়েছে শ্রোণীদেশ (Sacral ) বা লিঙ্গমূল থেকে। যাকে  সাধকরা বলছেন স্বাধিষ্ঠান চক্র। 
আর একজোড়া স্নায়ু নির্গত হয়েছে পুচ্ছদেশ (Coceygeal) যাকে  ঋষিরা বলেছেন মূলাধার। 

ভাবতে অবাক লাগে, হাজার হাজার বছরের পুরাতন ঋষিবিদ্যা কতটা বৈজ্ঞনিক সত্য ছিল।  আগে এগুলো নাকি কেউ পাশ্চাত্য প্রদেশে  জ্ঞাত ছিল  না।         

অহং গ্রন্থি বা অহং তত্ত্বের স্থান ললাট বা আমাদের কপাল।  এই অহং গ্রন্থি আমাদের সমস্ত গ্রন্থির অর্থাৎ পঞ্চগ্রন্থির (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম)  কর্তৃত্ব করে। আমাদের দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, চিন্তাশক্তি, বিচারশক্তি, স্মৃতিশক্তি, সমস্ত কিছুই অর্থাৎ পঞ্চইন্দ্রিয়শক্তির  (চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিব্বা, ত্বক) কর্ম পরিচালনা হয় এই অহং গ্রন্থি থেকে। এদের দোষ, ত্রূটি, দুর্বলতা সবই  যথাসাধ্য সংশোধন করে এই অহংগ্রন্থি।

এই অহংগ্রন্থি প্রধান লোকের ভিতর থেকেই বেরিয়ে আসে উচ্চ প্রতিভা, সাধু-মহাত্মা।  এই অহংগ্রন্থি ক্রিয়াশীল না থাকলে দেখা দেয় হৃদয়হীনতা, নিচটা, দুস্টু বুদ্ধি।

মহৎগ্রন্থি আমাদের ললাটের উপরে। অর্থাৎ অহংগ্রন্থির কিঞ্চিৎ উপরে অবস্থিত। এরই মধ্যে আছে সোমগ্রন্থি, দেবক্ষগ্রন্থি (Pineal Gland ), রুদ্র গ্রন্থি, সহস্রার গ্রন্থি  প্রভৃতি। এই মহৎ গ্রন্থির অন্তর্মুখী রসের নাম সোমধারা। এই সোমধারাই মাথা থেকে নেমে  দেহের সমস্ত গ্রন্থিকে, সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রকে সুস্থ-সবল ও প্রাণবন্ত রাখতে সাহায্য করে।

এই মহৎ গ্রন্থি প্রধান লোকই মহাপুরুষ, অবতার রূপে পূজিত হন। পৃথিবীতে এঁরাই নরোত্তম। ভগবৎ প্রাপ্তির অপার্থিব অনাবিল আনন্দ এঁরাই আস্বাদন করেন।

মহৎগ্রন্থির ঠিক উপরে আছে ব্রহ্মরন্ধ্র, যা আমাদের দেহাকাশ ও দিব্যাকাশকে  যুক্ত রেখেছে। এই ব্রহ্ম বা সহস্রার প্রদেশেই চেতনার অনন্ত পারাবার, এই প্রদেশই  গুণাতীত ভূমি। একেই কেউ বলে কৈলাস, কেউ বলে পরমশিব ও পরমাশক্তির অধিষ্ঠান ভূমি।

গ্রন্থিকথা এবার শেষ করবো। এই গ্রন্থিস্রাব বা গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালা আমাদের জীবন, আমাদের ব্যক্তিত্ব, আমাদের মন, আমাদের স্বভাব নিয়ন্ত্রন করছে । জানিনা সম্পূর্ণরূপে এর নিয়ন্ত্রণ করা যায় কি না। তবে এটা  ঠিক এই  ব্রহ্মান্ড বায়ু, অগ্নি, ও বরুন  দ্বারা লালিত হচ্ছেন, তেমনি এঁরা  কুপিত হলে, সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের দেহে অবস্থিত এই বায়ু অর্থাৎ প্রাণক্রিয়া, অগ্নি অর্থাৎ দেহের তাপ  রক্ষাকারী   ও জল অর্থাৎ রস রক্ত ইত্যাদির দ্বারা  এই  দেহের পালন হচ্ছে, দেহের পুষ্টি সাধন হচ্ছে। এই তিন দেবতার প্রকোপেই দেহ অসুস্থ হয়, আমাদের মৃত্যু ঘটে।

প্রসঙ্গত বলি : ভূত তো পাঁচটি। তবে তিনটি ভূতের কথা হচ্ছে  কেন  ? আসলে  অতিসূক্ষ্ম আকাশভূতের ক্রিয়া আমাদের ইন্দ্রিয় গোচর হয় না। আবার পৃথিবীতে বা মাটিতে জড়ত্বের ভাব বেশি। তাই শক্তির প্রকাশ নেই। অর্থাৎ শক্তির প্রকাশ আছে বায়ু, অগ্নি ও জলে। তাই   বায়ু  আকাশের মতো অতিসূক্ষ্ম না হলেও সূক্ষ্ম।  বায়ুকে আমরা চোখে দেখিনা বটে কিন্তু বায়ুর স্পর্শ আমরা অনুভব করতে পারি। তেজ বা অগ্নি বায়ুর মতো সূক্ষ্ম নয় আবার জল বা মাটির মতো স্থুলও নয়। আকাশের বিদ্যুৎ, আলো, জ্যোতি ইত্যাদি অগ্নির রূপ আমাদের চোখে পড়ে । সুতরাং অগ্নি স্থুল  ও সূক্ষ্মের মাঝামাঝি। জল আবার পৃথিবীর মতো বা মাটির মতো স্থুল  না হলেও অর্ধস্থুল।  আবার মাঝে মাঝে বরফের আকার নিয়ে স্থুলে পরিণত হয়।  অর্থাৎ শক্তির প্রকাশ আছে বায়ু, অগ্নি ও জলে। তাই আমাদের দেহে ত্রিশক্তির আধিপত্য। আকাশ ও মৃত্তিকা ম্রিয়মান হয়ে আছে আমাদের শরীরে। 

এসো,  আমরা এই তিন দেবতাকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য জপে প্রবৃত্ত হই। ধ্বনির সাধনায় লিপ্ত হই।  এই বায়ু, অগ্নি, জল - দেবতার সৃষ্টির কারন  সেই প্রণবের সাহায্য নেই। এবার আবার জপের কথায় আসি।

জপে যাবার আগে একবার মনটাকে  বুঝে নেই। আমরা অনেকেই জানি মন ত্রিস্তরীয় : চেতন - অবচেতন - অতিচেতন। হঠযোগীরা বলেন : দেহ শুদ্ধ হলেই মন শুদ্ধ হবে। এবং একমাত্র শুদ্ধ মনই আত্মউপলব্ধি করতে পারে। তো যার দ্বারা আত্মউপলব্ধি হবে তাকে একটু বুঝে নেই।

এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি :  এটি কোনো এক কবিগানের আসরে আমি শুনেছিলাম। ছেলে বলছে আমি কাঁঠাল খাবো। বাবা বাজার থেকে কাঁঠাল কিনে এনেছে। বাবা ছেলেকে কাঁঠালের পরিচয় দিচ্ছে। এই যে উপরের কাঁটা কাঁটা আস্তরণ দেখছিস  এঁকে বলে ছোবড়া। আস্তরণ ছাড়ালে কোয়া, কোয়ার ভিতরে আঁটি, আর এইযে কোয়ার বাইরে যে দেখছিস এটাকে বলা হয় ভুচরো।  আর ভেতরে মুগুরের মতো দেখছিস এটাকে বলে মোথা। তো ছেলে বলছে তবে  বাবা কাঁঠাল কোথায়  ?

তো মনকে খুঁজলে, দেহের মধ্যে কোথাও পাওয়া যাবে না। তবু আমাদের মনকে জানতে হবে।

যারা বিজ্ঞানের ছাত্র তারা জানে -  মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের কাজ কে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। একটা হচ্ছে সুষুম্না কান্ডীয় (Spinal Cord  Level ) , দ্বিতীয়টা হচ্ছে নিম্নতর মস্তিস্ক স্তর (Lower Brain Level) উচ্চতর মস্তিস্ক স্তর  (Upper Brain Level )

এই উচ্চতর মস্তিস্ক আমাদের মাথার সবচেয়ে বা আমাদের দেহের সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ন অংশ। আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার সংগ্রহশালা হিসাবে কাজ করে। অতীতের অভিজ্ঞতার অধিকাংশ স্মৃতিই এখানে সঞ্চিত থাকে। এছাড়া আমাদের শরীরের যে প্রতিক্রিয়া হয় অর্থাৎ যাকে  আমরা চেতন মনের কাজ বলি, তার খবর এখানে সঞ্চিত থাকে। এবং নিজের ইচ্ছায় সে খাবরাখবরকে কাজে লাগিয়ে দেহের চেষ্টীয় প্রতিক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ করে।

নিম্নতর মস্তিস্ক দ্বারা দেহের অধিকাংশ অবচেতন কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। রক্তচাপ,শ্বাসক্রিয়া, ক্রোধ, উত্তেজনা, যৌনক্রিয়াকলাপ, যন্ত্রনা, আত্মতুষ্টি, এগুলো সবই নিম্নতর মস্তিষ্কের কাজ।  অতএব আমরা যাকে অবচেতন মনের কাজ বলি তা এই নিম্নতর মস্তিস্ক করে থাকে।

দেহের ইন্দ্রিয়সকল দ্বারা গৃহীত সমস্ত সংবাদ বা উদ্দীপনা সুষুম্নাকাণ্ডে প্রেরণ করা হয়।  এবং সুষুম্নাকাণ্ড এই সংবাদের ভিত্তিতে সুষুম্না কাণ্ডের উদ্ভাবনী প্রতিক্রিয়ার উদ্ভব হয়। এটা স্বয়ংক্রিয় এবং সংজ্ঞাবহ সংকেত সুষুম্নাকাণ্ডে যাবার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায়। এটাই অতিচেতন মনের কাজ বলতে আমরা যা বুঝি তাই।

মন কোনো আলাদা বস্তূ  বা স্নায়ু নয়। বিভিন্ন স্নায়ুর ক্রিয়াকে আমরা মনের ক্রিয়া বলি। মন বলে কিছু নেই সবই স্নায়ুর খেলা।  আমাদের এই স্নায়ুর কেন্দ্রে যেতে হবে।  স্নায়ু যেখান থেকে  শুরু হয়েছে সেটা মস্তিস্ক। আর স্নায়ুর অবতরণ ক্ষেত্রে হচ্ছে সুষুম্না কাণ্ড। তাই সুষুম্না নাড়িকেই আমাদের আশ্রয় করতে হবে যদি আমরা আত্মউপলব্দ্ধি করতে চাই। এই স্নায়ুকেন্দ্রে প্রতিফলিত হবে আমাদের অধরা ঈশ্বর।আমাদের চেতন স্বরূপ।

যদি ভালো থাকতে চাও তবে সব ছেড়ে গুরুমন্ত্র জপ্ করতে থাকো।

আপনাদের বলি  যদি গুরুপ্রদত্ত মন্ত্র না পেয়ে থাকেন তবে পরম-পিতার  যে কোনো নামের আগে/পরে  ওঁং জুড়ে জপতে থাকুন । আপনি  মহাসুখী থাকবেন । ভালো থাকবেন। আর আপনার যা কিছু দরকার, সব জগদীশ্বরের কাছে চান। মানুষ তো ভিখারী।  ভিখারীর কাছে কিছু চাইতে যাবেন না। পরম পিতা পরম-ঈশ্বরের কাছে চান। ঈশ্বরের অসীম ক্ষমতা, অসীম সম্পদ। অনন্ত অনন্ত অনন্ত করুনাময় ঈশ্বর আপনার সহায়। আপনি তার কাছে বসুন। তার কাছেই প্রার্থনা করুন। আপনি সর্বসুখী হবেন।, কি পার্থিব, কি অপার্থিব সব সম্পদের অধিকারী একমাত্র ঈশ্বর। আপনি তাঁকেই ধরে থাকুন। 

ওম শান্তি ওম শান্তি ওম শান্তিঃ।         


                





















Tuesday, 17 October 2023

ষোলো কালা কাকে বলে ? প্রশ্ন উপনিষদ : শ্লোক নং ০৬/০৪


ষোলো কলা কাকে বলে ? প্রশ্ন উপনিষদ : প্রশ্ন উপ: শ্লোক নং ০৬/০৪

কথায় বলে, ষোলোকলা পূর্ন  হলো।  অর্থাৎ সব শেষ হয়ে গেলো নাকি সব পূর্ন  হলো ? এই কলা কথাটার অর্থ কি ?  কলা বলতে আমরা একধরনের বিশেষ ফলকে বুঝে থাকি। কলা বলতে আমরা শিল্পকর্ম বুঝি, কলা বলতে আমরা বিদ্যার এক বিশেষ ভাগকেও  বুঝি। 

আবার আমরা চাঁদের সুধাকে বা অমৃতকে  ষোলো ভাগের  একভাগকে বলে কলা।  চাঁদের ষোলো কলা হলো, ১. অমৃতা, ২. মানদা, ৩. পূষা, ৪. পুষ্টি, ৫.তুষ্টি, ৬.রতি, ৭.ধৃতি, ৮. শশিনী ৯. চন্দ্রিকা, ১০. কান্তি, ১১. জ্যোৎস্না, ১২. শ্রী ১৩. প্রীতি, ১৪.অঙ্গদা, ১৫. পূর্ণা, সবশেষে  ১৬. পূর্ণামৃতা। বলা হয়, এক-একদিন এক-একজন দেবতা কৃষ্ণপক্ষে চাঁদের অমৃত পান করেন,  আর এঁরা প্রতিদিন এক কলা করে পান করেন। আবার শুক্লপক্ষে এক-একদিন এক-এক কলা বৃদ্ধি পেয়ে ১৬ কলা পূর্ন  হয়। 

আমাদের জানি,  পৃথিবী  সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে। আবার  চন্দ্র ঘুরছে  পৃথিবীর চারিদিকে। সূর্যের নিজস্ব আলো আছে কিন্তু চন্দ্রের  কোনো নিজস্ব আলো নেই। সূর্যের আলো চন্দ্রের উপরে আলো প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে এসে পড়ে। একেই আমরা বলি জ্যোৎস্না।  চন্দ্রের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে এর দৃশ্যমান পার্শ্ব বিভিন্নভাবে সূর্যের আলোতে আলোকিত হয়। এই আলোকিত অংশের পরিমাণ একসময় শূন্য হতে বৃদ্ধি পেতে পেতে এক সময় চন্দ্রের সম্পূর্ণ পৃষ্ঠভাগ  আলোকিত হয়, তখন বলা হয় পূর্ণিমা। আবার এই  আলোকিত অংশের পরিমাণ কমতে কমতে একসময় চন্দ্র আমাদের চোখের দৃষ্টির বাইরে চলে যায়।  তখন তাকে  বলা হয় অমাবশ্যা। চন্দ্রের আলোকিত অংশের এই হ্রাসবৃদ্ধির এক একটি ভাগকে  বলা হয় কলা বা চন্দ্রকলা।  ষোলটি কলা পূর্ণ হলে তবেই চন্দ্রের পূর্ণিমা, আবার কলার নিস্পত্তি হলে  অমাবশ্যা হয়। 

আবার অতি অল্প সময়কে নির্দিষ্ট করবার জন্য এই কলা কথাটার প্রয়োগ হয়ে থাকে।  বলা হয়, ক্ষণ-কে ৩০ ভাগ করলে যে সময় তাকে বলে কলা।  আমাদের শাস্ত্রে বলা হচ্ছে, ১৮ নিমেষে এক কাষ্ঠা, ৩০ কাষ্ঠায় এক কলা, আবার ৩০ কলায় এক ক্ষণ।  তো কালের একটা অংশকে বলা হয় কলা। 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে বলা হয়, তিনি ষোলোকলা যুক্ত পূর্নপুরুষ। তার ষোলো কলার নাম হচ্ছে,                                                                                                    

"সঃ প্রাণম অসৃজত প্রাণাৎ শ্রদ্ধাম খং বায়ুঃ জ্যোতিঃ আপঃ পৃথিবী ইন্দ্রিয়ম মনঃ। অন্নম  অন্নাৎ বীর্যম তপো  মন্ত্রাঃ কর্ম লোকা  লোকেষু চ নাম চ।" (প্রঃ ০৬/০৪)

সেই পুরুষ (সগুন ব্রাহ্ম) প্রাণাত্মাকে সৃষ্টি  করলেন, প্রাণ থেকে সৃষ্টি হলো শ্রদ্ধা (জ্ঞান) . এরপর আকাশ (খং), বায়ু, তেজ, জল, পৃথিবী, ইন্দ্রিয় ও মন এবং অন্ন।  অন্ন থেকে ক্রমে বীর্য।  বীর্য বা বল থেকে তপস্যা মন্ত্র (ঋক সাম  যজুঃ অথর্ব) কর্ম, লোক (স্বর্গ, মর্ত, পাতাল) . এবার লোক সমূহে বিভিন্ন নাম ও পদ এলো (সৃষ্টি হলো) . 

প্রশ্ন ছিলো, কে আমাদের শরীর  ছেড়ে চলে গেলে আমাদের মনে হয়, আমিও দেহত্যাগ করলাম। আবার কার কারণেই বা আমি শরীরে ছিলাম ? উত্তর হচ্ছে এই কলা বা প্রাণাদি। 

এবারের শ্লোকে ঋষি পিপ্পলাদ ষোড়শকলা সম্পর্কে বলছেন। এগুলো হচ্ছে - ১. প্রাণ, ২. শ্রদ্ধা ৩. আকাশ, ৪. বায়ু, ৫. তেজ, ৬. জল, ৭, পৃথিবী, ৮. ইন্দ্রিয়, ৯. মন ১০. অন্ন, ১১. বীর্য, ১২. তপস্যা, ১৩. মন্ত্র  ১৪. কর্ম, ১৫. লোক, ১৬. নাম ।  

তো সেই পুরুষ চিন্তা করলেন, কে দেহথেকে উৎক্রমন করলে, আমি উত্ক্রান্ত হবো, আবার কে প্রতিষ্ঠিত হলে আমিও দেহে অবস্থিত থাকবো ? এর উত্তর  হচ্ছে প্রাণ ইত্যাদি।  এই যে প্রাণ ইত্যাদি এগুলো হচ্ছে ষোলোটি কলা। 
এইজন্য তিনি প্রথমে প্রাণকে সৃষ্টি  করলেন। প্রাণ থেকে শ্রদ্ধা অর্থাৎ জ্ঞান। যা থেকে আমাদের "আমি" এই বোধের উৎপত্তি হয়। বিশ্বশক্তির মধ্যে এই অহং-বোধ থেকে ইচ্ছে, আর ইচ্ছে থেকে এই সৃষ্টি। আমাদের মধ্যেও  এই জ্ঞান বা আস্তিক্য বুদ্ধি আছে।  আর এর ফলেই আমার মতো এই ক্ষুদ্র সত্ত্বার মধ্যে  অখন্ড সত্ত্বার স্পর্শ অনুভব করি। এই ক্ষুদ্র আমার মাঝেই সেই বিরাট পুরুষের অবস্থান। এই শ্রদ্ধা (জ্ঞান) আছে বলেই মানুষ জ্ঞান ও কর্ম্ম পথে নিজেকে পরিচালিত করে। সুতরাং নিস্কল (কলাহীন) পুরুষ ও তার শক্তিরূপ প্রাণ ও শ্রদ্ধা এই তিনটি হচ্ছে সৃষ্টির মূল। এবার এই অহংবোধ জ্ঞান (শ্রদ্ধা) বিধাতার মধ্যে বাসনার উদ্রেগ ক'রে পঞ্চভূতের (অপঞ্চীকৃত পঞ্চভূতের) সৃষ্টি করেন। যথাক্রমে সেগুলো হচ্ছে, আকাশ, বায়ু, জ্যোতিঃ, জল ও পৃথিবী। এই পঞ্চভূতকে আশ্রয় করে তৈরী হলো জীবদেহ। তো দেহ উৎপত্তির কারন এই ৭টি  অর্থাৎ প্রাণ, শ্রদ্ধা, ও পঞ্চ মহাভূত। প্রথম প্রাণীকে যদি আমরা আমিবা নামে  ডাকি তবে বলতে হয়, তার উৎপত্তি এই ৭ তত্ত্ব থেকে। এর পরে ইন্দ্রিয়, মন। আমিবার মধ্যেও এই ইন্দ্রিয়শক্তি লক্ষিত হয়, কিন্তু আমিবার মন বলে  হয়তো কিছু থাকে না। সে যাই হোক,  এখন এই প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য দরকার অন্ন। এই অন্নই বল প্রদান করে থাকে। এই অন্ন প্রাণশক্তিকে জাগিয়ে রাখে। আবার অন্ন দ্বারাই জীব বীর্যবান হয়ে ওঠে। এই বীর্য হচ্ছে প্রাণশক্তির উচ্ছাস। এই বীর্য একসময় দেহ ছাপিয়ে উপচে পড়ে এবং নতুন দেহের সৃষ্টি করে। কিন্তু প্রাণের এই যে উপচে পড়া, একে  বলা হয়, অশুদ্ধ প্রাণশক্তি। এই অশুদ্ধ প্রাণশক্তি যখন সংহত হয়, তখন  তাকে বলে তপস্যা বা তপঃশক্তি। এই তপঃশক্তি আবার মন্ত্রের জন্ম দেয়, যা জীবকে উদ্ধার কার্য্যে সাহায্য করে থাকে। মন্ত্র অর্থাৎ মনন করা। এই মননের ফলে জীব একসময় বুঝতে পারে, যে সে প্রকৃতির দ্বারা  অভিভূত হয়েছে।  আবার সে এই অভিভূত অবস্থা থেকে উদ্ধ্বার পাবার প্রচেষ্টা শুরু করে, একেই বলে কর্ম্ম।  সে তখন একটা কর্ম্মলোকের সৃষ্টি করে। এই কর্ম্মলোকই আমাদের ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য জগৎ। এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ নাম ও রূপের দ্বারা আচ্ছাদিত। এই নাম ও রূপের জন্যই জগতে ভিন্নতা পরিদর্শিত হচ্ছে। 

সেই বিরাট  পুরুষ যিনি সমগ্র সৃষ্টিকে ধারণ করে আছেন।  জগতের সমস্ত কিছুই অর্থাৎ প্রাণ থেকে শুরু করে নাম পর্যন্ত এগুলো সবই তাঁরই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। আর এই কারণেই তাঁকে  বলা হচ্ছে ষোড়শকলা যুক্ত পুরুষ। অতয়েব নির্গুণ, নিস্কল পুরুষ থেকেই এই ষোলোকলা এসেছে যা পুরুষ থেকে পৃথক নয়। এইভাবেই সেই পরমপুরুষ নিজেকে প্রকাশ করছেন। 
------------------------

Tuesday, 18 July 2023

শয়তানের সন্ধানে

 




সাধন জগতে শয়তানের সন্ধানে / শয়তানের হাত থেকে বাঁচবেন কি কে ? 
মূলসূত্র - যোগদর্শন সমাধিপাদ শ্লোক নং ৩০
DEVIL FORCE WITHIN ME

মানুষ ভাবে এক আর হয় আর-এক। মানুষ দুর্ভোগ চায় না, কিন্তু দুর্ভোগ এসে হাজির হয়, মানুষ মৃত্যু চায় না, কিন্তু মৃত্যুকে সে উপেক্ষা করতে পারে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুর্ভোগ, দুঃখ, কষ্ট, এমনকি মৃত্যু  এসে হাজির হয়।  মানুষ জরা-ব্যাধি চায় না, কিন্তু জরা-ব্যাধিকে সে দূরে রাখতে পারে না। মানুষ তো দূরে থাকুক,এমনকি ভগবান চাইছেন, দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন। ভগবান চাইছেন, ধর্ম্মের রক্ষা আর অধর্ম্মের নাশ। কিন্তু হচ্ছে উল্টো, দুর্যোধন রাজার আসনে, পাণ্ডবেরা জঙ্গলে জঙ্গলে। দুষ্টের উদ্ভবের জন্য ভগবানের দরকার নেই, অধর্ম্মের উদ্ভবের জন্য ভগবানের দরকার নেই। তাহলে কি ভগবান থেকেও শক্তিশালী কেউ আছেন, যিনি এই অধর্ম্মের উদ্গাতা, দুষ্টের পালন কর্তা।

যাদের একটু আধটু যোগ-সাধন করবার অভ্যাস আছে, তাদের এই অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে, নানান রকম বীভৎস ভয়ংকর মূর্তি সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে।  এরা  সব না চাইতেই আসছে, কিন্তু ভগবানের সৌম্য মূর্তি সহজে আসে না।  তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়, নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলে মনের মধ্যে শান্তি আসে, কিন্তু অশান্তি সবসময় মনের মধ্যে খচখচ করছে। 
ঋষি বিশ্বামিত্র শিবের সাধনা করছেন, আর সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে মেনকা-উর্ব্বশীর দল। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলছেন, "বেলতলায় ধ্যান করছি, পাপ-পুরুষ এসে কত রকম লোভ দেখাতে  লাগলো।" কে এই পাপপুরুষ ? যাকে না ডাকলেও এসে যান। 
আমাদের  সবার মধ্যে যেমন সুপ্রবৃত্তি আছে, তেমনি আছে কু-প্রবৃত্তি।  আর কে না জানে, এই সু-প্রবৃত্তির চাইতে কুপ্রবৃত্তি অধিক শক্তিশালী। রামচন্দ্রের মতো যুগাবতারের বৌ চুরি হয়ে যায়। আর তিনি সোনার হরিনের পিছে ছুটে  বেড়ান। কে তাঁকে সোনার হরিণের  ঋণের পিছনে চুটিয়ে নিয়ে বেড়ায়  ? 

আসলে একই মাতা-পিতার সন্তান এই দেবতা ও অসুর।  শুভ আর অশুভের উৎস একই জায়গায়। সমুদ্র মন্থনে যেমন বিষকুম্ভ উঠে আসে, তেমনি উঠে আসে অমৃত-কলস। আর মন্থন ক্রিয়ার প্রথমেই আসে এই বিষকুম্ভ। আর বিষকুম্ভের বিষকে হজম না করতে পারলে, অমৃত কুম্ভের অমৃতের স্বাদ পাওয়া যাবে না। দুঃখকে সহ্য করতে না পারলে, সুখের সন্ধান পাওয়া যাবে না। একই মানুষের মধ্যে আছে শুভ বুদ্ধি, আবার অশুভ বুদ্ধি। অশুভ বুদ্ধিকে পরাস্থ  করতে পারলেই , আমাদের শুভবুদ্ধি কার্যকর হবে। 

HRISHI AURABINDA SAYS : THE FORCES THAT STAND IN THE WAY OF SADHANA ARE THE FORCES OF THE LOWER MIND, VITAL AND PHYSICAL NATURE. BEHIND THEM ARE ADVERSE POWERS OF THE MENTAL, VITAL AND SUBTLE PHYSICAL WORLDS.

MOTHER SAYS : THERE ARE ALL THE DIFFICULTIES OF IGNORANCE OF THE DIFFERENT STATES OF THE BEING, TO WHICH ARE ADDEDED THE ENDLESS MALICE AND THE UNBONDED CUNNING OF THE HOSTILE FORCES IN THE WORLD.

হৃষি অরবিন্দ বলেছেন: যে শক্তিগুলি সাধনার পথে দাঁড়ায় সেগুলি হল নিম্ন মন, প্রাণশক্তি এবং শারীরিক বা  প্রকৃতির শক্তি ৷  আর এদের  পিছনে রয়েছে মানসিক, গুরুত্বপূর্ণ এবং সূক্ষ্ম শারীরিক জগতের প্রতিকূল শক্তি।

মা বলেছেন: সেখানে সত্তার বিভিন্ন অবস্থার অজ্ঞতার সমস্ত অসুবিধা রয়েছে, যার সাথে যুক্ত হয়েছে অন্তহীন পাপ এবং শত্রুপক্ষের অবাধ ধূর্ততা। 

ঋষি পতঞ্জলি এই শয়তানের কয়েকটি  রূপের কথা বলেছেন।  ১. শারীরিক ব্যাধি, ২. মনের অবসাদ, ৩. সংশয়। ৪. চিত্তের উদ্যমহীনতা , ৫. আলস্য, ৬. বিষয়তৃষ্ণা, ৭. ভ্রান্তজ্ঞান ৮. অলব্ধ ভূমিকত্ত্ব  ৯. চিত্তের অস্থিরতা। আজ আমরা এই শয়তানদেরকে চিহ্নিত করে, তার থেকে নিজেকে বাঁচানোর উপায় সম্পর্কে শুনবো। 

১. প্রথমত হচ্ছে শারীরিক ব্যাধি : শয়তানের প্রথম প্রভাব আমরা বুঝতে পারি, যখন আমাদের শরীর  অসুস্থ হয়। আমাদের শারীরিক অসুস্থতায়, আমরা সবা থেকে বেশি বিড়াম্বনার শিকার হয় । শরীরের এই কষ্ট  আমরা কেউ চাই  না. তবু আসে।  শরীর অসুস্থ হলে, আমরা কোনো কাজেই  মনোযোগ দিতে পারি  না। 
এই শারীরিক অসুস্থতা নামক শয়তানকে তাড়াবার জন্য নানান উপায় আছে। মনে রাখবেন, শরীর একটা যন্ত্র মাত্র, আর একে  আমরাই সৃষ্টি করেছি, কর্ম্ম নামক ফল উৎপাদনের জন্য। এই যন্ত্রের দ্বারাই আমরা জাগতিক সমস্ত কর্ম্ম সম্পাদন করে, ফলের জন্ম দিয়ে থাকি। আর এই কর্ম্মফল কাঁচা অবস্থায়  ভীষণ টক, কিন্তু পাকলে ভীষণ মিষ্টি। ঠিক যেন আম।  অর্থাৎ এই শরীর ও শরীরের কর্ম্ম আমাদের জাগতিক সুখ-দুঃখ প্রদান করে থাকে, আবার এই শারীরিক কর্ম্মই আমাদের ঈশ্বর-উপল্বদ্ধির জন্য শ্রেষ্ঠ যন্ত্র। তো আর সব যন্ত্রের থেকে এই যন্ত্র অধিক মূল্যবান।  অতয়েব একে  সুস্থ  রাখতেই  হবে।এই শরীরের মধ্যে দুটো অঙ্গ ভীষণ মূল্যবান, এক হচ্ছে মস্তিস্ক, র একটি হচ্ছে আমাদের স্নায়ুতন্ত্র। বিশুদ্ধ ও উপযুক্ত খাদ্য এবং আহারে, পানে  ও বিহারে  সংযম রক্ষা করতে পারলেই এই শরীররূপ যন্ত্র ঠিক থাকে। আপনারা যারা শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা পড়েছেন, তারা জানেন, সেখানে নানান সাধনপ্রণালীর বর্ননা আছে। সংক্ষেপে বলি, শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যারা বেশী  পানাহার করে, খুব বেশি ঘুমোয়, খুব বেশি আমোদ-প্রমোদে আসক্ত  থাকে, তাদের শরীর ব্যাধিগ্রস্থ হবে। আর ব্যাধিগ্রস্থ শরীরে কোনো কাজই সুষ্ঠ ভাবে হতে পারে না। তো আমাদের সংযম অভ্যাস করতে হবে। অর্থাৎ আমাদের মনে রাখতে হবে, শরীরের জন্য খাবার খেতে  হবে,  কিন্তু খাবারের ভান্ডার যেনা এই শরীর না নয়।  যোগাচার্য্যগণ বলে থাকেন, রাজযোগ-অভ্যাস আমাদের শরীর  ও মনের পক্ষে ভালো। আসলে শরীর ও মনের যে স্পন্দন তা সহজ ও সাবলীল হলে শরীর ও মন উভয়ই সুস্থ  থাকে। আর এই বিপরীত হলে, মনের মধ্যে যেমন উদ্বিগ্নতা বাড়ে, তেমনি শরীর ব্যাধিগ্রস্থ হয়ে পড়ে ।  তো ব্যাধি  নামক শয়তানকে আমাদের প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না, তাকে অবশ্যি তাড়াতে হবে। 
২. এর পরে হচ্ছে চিত্তের অবসাদ। অনেক সময় দেখবেন, ঘুমের ঘোর  যেন কাটছে না। আসলে মনের উদ্যমহীনতা আমাদের আলস্যকে ডেকে আনে। এই আলস্যকে বিদায়  গেলে, আমাদের বোঝার চেষ্টা  করতে হবে, এই আলস্য কোথেকে আসছে, কি এর কারন ? আর যখনই  তুমি এই কারনে দিকে খেয়াল করতে থাকবে, কারনে দিকে দৃষ্টি ফেরাবে, তখনি মনের এই জড়তা কেটে যাবে। এই যে জড়তা এটি আমাদের অনেক সময় অতিরিক্ত আহারের ফলে ঘটে থাকে, হজমের গোলমাল  থেকে হতে পরে, আবার আমাদের মনের শক্তি যখন বেশি খরচ হয়ে যায়, তখন মন অস্থির হয়ে ওঠে। মন তখন আমাদের অধীনে বা আয়ত্ত্বে থাকতে চায় না। তখন হয়, মন চঞ্চল হয়ে ওঠে অথবা মন ঘুমিয়ে পড়ে। এই মনকে জাগিয়ে তোলার জন্যও রাজযোগের অভ্যাস, এবং সৎসঙ্গ ভীষণ ভাবে কার্যকরী ভূমিকা  নিতে পারে।

৩. এর পরে হচ্ছে সন্দেহ।  যাকিছু করছেন, বা করতে চাইছেন, সে সম্পর্কে যেন কোনো সন্দেহ না থাকে।  আপনি হয়তো যোগক্রিয়া করতে চাইছেন, তো যোগ সম্পর্কে, বা যোগের কার্যকারিতা সম্পর্কে আপনার মনে যেন কোনো সন্দেহ না থাকে। যদি সন্দেহ থাকে, যা করতে চাইছেন, সে সম্পর্কে আপনার যদি অবিশ্বাস থাকে তবে তা দূর করবার জন্য, উপযুক্ত ব্যক্তি বা শাস্ত্র থেকে জেনে নিন। এর পরে নিঃসন্দেহে হয়ে সেই কাজে সর্ব্বশক্তি দিয়ে নেমে পড়ুন। 

৪. জীবনের একটা লক্ষ ঠিক করুন, জীবনের একটা আদর্শ ঠিক করুন। কাউকে বিশ্বাস করবার আগে, এমনকি ঈশ্বরকে  বিশ্বাস করবার আগে, নিজেকে বিশ্বাস করতে হবে।  নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। যার  আত্মবিশ্বাস নেই, সে কাউকেই বিশ্বাস করতে পরে না - এমনকি ঈশ্বরকেও সে বিশ্বাস করতে পারে  না। আর যার বিশ্বাস নেই, তার মধ্যে কর্ম্মের  দৃঢ়তা আসে না। ফলত  সে পদে পদে অসফল হয়। রামচন্দ্রের মনে সন্দেহ ছিলো, সে জানতো  সোনার হরিণ বলে কিছু হয় না। তাই সীতার দৃষ্টিতে সোনার হরিণ থাকলেও, রামচন্দ্র কখনো সোনার হরিণকে খুঁজে পাননি। 

৫. অন্ধবিশ্বাসকে প্রশ্রয় দেবেন না। ধরুন আপনি যোগক্রিয়া করে সাফল্য লাভ করতে চান।  সেক্ষেত্রে যোগক্রিয়া সম্পর্কে যোগাচার্য্যের কাছ থেকে জেনে নিয়ে, কিছুদিন তার অভ্যাস করতে হবে। দিন কয়েক অভ্যাস করলেই দেখবেন, আপনার মধ্যে কিছু না কিছু পরিবর্তন হচ্ছে, কিছু দর্শন হচ্ছে, আর এইযে জ্ঞান তা আপনার উপলব্ধিগত সত্য। এই দর্শন যদি না হয়, বা আপনার ভিতরে যদি যোগের ফলে কোনো পরিবর্তন না আসে, তবে আপনার মধ্যে সত্যিকারের বিশ্বাস জাগবে না। এই বিশ্বাস লাভের  জন্য তখন বিচারের দ্বারস্থ হন। নিজেকে  প্রশ্ন করতে থাকুন, কেন হচ্ছে না ? কোথাও আমার কাজের নিষ্ঠার অভাব হচ্ছে কি ? যোগবিজ্ঞান এমন একটা বিজ্ঞান, যা সাধকের মধ্যে বিশ্বাস আনতে একটা কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে। 

৬. মনের মধ্যে উদ্যমহীনতা, কার্যফলে বাধা সৃষ্টি করে। এটি ঠিক শারীরিক আলস্য নয়, এটি মনের আলস্য। একে  পরিহার করতে হবে। 

৭. কোন কাজ অর্ধেক করে ছেড়ে দেওয়া, কোনো কাজের কথা  নয়। অনেক সময় দেখা যায় আমরা যোগের পথে খানিকটা এগিয়ে আবার এসব করে কি হবে, ভেবে সেখান থেকে ফিরে আসি।  এটি সাধনার পথে অন্তরায়। 

৮. ভ্রমজ্ঞান -  বিবেক বিচারের সাহায্যে আমাদের জ্ঞানের মধ্যে ভ্রান্ত ও অভ্রান্তের মধ্যে পার্থক্য করতে শিখতে হবে। তা না হলে আমরা ভ্রমজ্ঞানের  প্রলোভনে পরে, সত্য কে মিথ্যা ভেবে, বা মিথ্যে কে সত্য ভেবে ভুল পথে চালিত হবো। এইজন্য যা কিছু জানবেন, তার সত্যতা সম্পর্কে যাচাই করে  নিতে হয়।  

৯. ঋষি পতঞ্জলির ভাষায় আরো একটা শয়তান আছে, তার  নাম হচ্ছে অলব্ধ ভূমিকত্ব। মন যখন আমাদের চঞ্চল থাকে, তখন মনকে একটি বিষয়ে একাগ্র করা যায় না। এই অবস্থায় আমাদের ধারণা প্রত্যাহার ও ঢংয়ের অভ্যাস করলে আমরা অবশ্যই  সুফল পেতে পারি। 

আসলে শয়তান বাইরে নয়, শয়তান আছে, আমাদের নিজেদের মধ্যে। , আর অশুভ শক্তি বলুন,  শুভ শক্তি বলুন, ভালো বলুন আর মন্দ বলুন, সবই  আমাদের নিজেদের তৈরী।  অশুভ চিন্তা আমাদের শয়তানের জন্ম দেয়। আর শুভ চিন্তা আমাদের মধ্যে দেবতার জন্ম দিয়ে থাকে। চিন্তা বা  ভাব মানুষের ভবিষ্যৎ তৈরী করে।  চিন্তা হচ্ছে একধরনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব। যাদের কাজ হচ্ছে আমাদের চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া। আপনি যেমন চিন্তা করবেন, ধীরে ধীরে সেটি আপনার সামনে রূপ পরিগ্রহ করবে। তো আমাদের চিন্তাই  শয়তান,  আবার চিন্তাই দেবতা। 
---------------------  



   

Monday, 17 July 2023

মাণ্ডুক্য উপনিষদ রহস্যঃ

 মাণ্ডুক্য উপনিষদ রহস্যঃ

শশাঙ্ক শেখর শান্তি ধাম 

মঙ্গলাচরণ :

ওঁ ভদ্রং কর্নেভিঃ শৃনুয়াম দেবা 
ভদ্রং পশ্যেম অক্ষভিঃ  যজত্রাঃ। 
স্থিরৈঃ অঙ্গৈঃ তুস্তুবাংসঃ তনুভিঃ 
ব্যশেম দেবহিতং যদাযুঃ । 
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।

হে দেবগন যাকিছু ভালো, তাই যেন আমরা কান দিয়ে শুনতে পাই, চোখ দিয়ে যা কিছু ভালো তাই যেন দেখতে পাই।  স্থির শরীর ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্বারা যেন তোমার স্তুতি করতে পারি। দেবগন যে আয়ু বিহিত করেছেন, যা যেন আমরা লাভ করতে পারি। 
আমাদের ত্রিবিধ শান্তি  প্রদান করুন । 

ভূমিকা :

আমরা মাণ্ডুক্য উপনিষদের মধ্যে প্রবেশ করতে চলেছি। এই সূক্ষ্ম পথের যাত্রা যেন আমাদের সুস্থ  শরীর ও মনের সাহায্যে করতে পারি। হে ঋষিগণ আমাদের ধীশক্তি বৃদ্ধি  করুন, আপনাদের শ্রীমুখ নিঃসৃত সমস্ত  শব্দের মর্মার্থ যেন আমরা ধরতে পারি, উপলব্ধি করতে পারি, এবং সেইমতো যেন জীবনকে পরিচালিত করতে পারি। 

মাণ্ডুক্য উপনিষদ অথর্ব বেদ  থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে ওঙ্কার, প্রণব, বা ওম-কে ব্রহ্মের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে, ব্রহ্মজ্ঞানের কথা বলা হয়েছে। আমাদের যে জাগ্রত-স্বপ্ন-সুসুপ্তির অবস্থা, একেই অ-উ-ম হিসেবে বর্ননা করা হয়েছে। প্রথমে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে এই বিরাট জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান, তার পরে দেহকে নিষ্ক্রিয় রেখে মনের জগৎ অর্থাৎ সূক্ষ্ম অবস্থার  জ্ঞান, এবং সব শেষে দেহ-মন-ইন্দ্রিয়কে নিষ্ক্রিয় রেখে ইন্দ্রিয়াতীত জ্ঞানের দিকে ধাবিত হতে হবে। দেখুন, আমরা যা কিছু চিন্তা করি, তাই একসময় আমাদেরকে কর্ম্মে উদ্দীপ্ত করে। আর এই কর্ম্মের মাধ্যমে আমাদের চিন্তা একসময় বাস্তবিক রূপ গ্রহণ করে। আবার আমরা ইন্দ্রিয়সকল দ্বারা যে বিষয়ের অনুভব করি, তা আমাদের মনের মধ্যে একটা ছাপ ফেলে। এই যে মনের চিন্তার  ছাপ তা আমাদের অনেক সময় স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্নজগতে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এই যে দুটো জগৎ অর্থাৎ স্বপ্ন জগৎ ও জাগতিক জগৎ এ ছাড়াও আরো জগৎ আছে, যা আমাদের বাহ্য  ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উপলব্ধ নয়। এই জগৎ ইন্দ্রিয়াতীত - কিন্তু এই জগতের বাসিন্দা আমরাই। আমরা যখন সুসুপ্তিতে অর্থাৎ গাঢ়  ঘুমে অবস্থান করি, তখন একটা জগতের মধ্যে প্রবেশ করি। স্বপ্ন জগতের কথা বা দৃশ্য আমরা স্বপ থেকে  জেগে উঠলেও  মনে রাখতে পারি, অর্থাৎ আমাদের স্মৃতিতে থাকে।  কিন্তু এই সুসুপ্তির জগতের কথা আমাদের স্মৃতিতে থাকে না।  তাই এই জগতের কথা অর্থাৎ গাঢ় ঘুমের মধ্যে আমরা কিছু দেখেছিলাম কি না, বা আমরা কিছু করেছিলাম কি না, তা আমাদের মনে পড়ে না কারন সেটি আমাদের স্মৃতি অর্থাৎ স্থূল ও সূক্ষ্ম শরীরের মস্তিষ্কে যে স্মৃতির ভান্ডার আছে, তাতে গচ্ছিত থাকে না। এটি থাকে আমাদের কারন শরীরে।  সাধন জগতের মহাত্মাগণ ইচ্ছে করলেই, এই জগতের মধ্যে বিচরণ করতে পারেন। তাঁরা কিভাবেই বা পারেন, সেই  সব কথা আমরা ধীরে ধীরে শুনবো। কিন্তু উচ্চতর বোধে যেতে গেলে , আমাদের শরীর-মনকে স্থির করতে হবে।  এইজন্যই আমরা আলোচনার শুরুতে দেবতাদের কাছে, প্রার্থনা করেছি। যা কিছু ভালো, তাই যেন আমরা শুনি, দেখি, বলি । অর্থাৎ আমাদের চিন্তার মধ্যে যেন শুদ্ধতা আসে, আমাদের বোধ শক্তি যেন আরো বেশি গভীর হয়, এই প্রার্থনা দিয়েই মাণ্ডুক্য উপনিষদ শুরু হয়েছে।  
------------ 

মাণ্ডুক্য উপনিষদ - আগম  প্রকরণ - শ্লোক ০১/০১-০২

"ওম ইতি এতৎ অক্ষরম ইদং সর্বং তস্য উপব্যাখ্যানং ভূতং ভবৎ ভবিষ্যৎ ইতি সর্বম ওঙ্কারঃ এব। যৎ চ অন্যৎ ত্রিকালাতীতং তৎ  অপি ওঙ্কারঃ এব।" (০১/০১)

"ওম" এই বিশেষ অক্ষরটি এই সমস্ত কিছু। সেই ওঙ্কার ব্রহ্মের নিকটবর্তী মহিমার নিদর্শক হওয়ায়, বলা হয় ভূত-ভবিষ্যৎ ও বর্তমান, এমনকি যা ত্রিকালের অতীত তাও এই ওঙ্কারই। 

মন্ডুক কথাটার অর্থ ব্যাঙ। আমরা জানি ভেকের ডাক বর্ষনের বার্তা বহন করে। আর এই বর্ষণ ক্ষেত্রকে উৎপাদনের উপযোগী করে তোলে। পৃথিবী উর্বরা হয়ে উদ্ভিদকুল, জীবকূলকে পুষ্টি প্রদানের জন্য অন্নাদির উৎপাদন করে থাকে। তো মুন্ডক উপনিষদে এমন একটা ধ্বনির ইঙ্গিত আছে, যা আমাদের এই শরীররূপ ক্ষেত্রকে উর্ব্বরা করে ব্রহ্ম সান্নিধ্যে এনে দিতে পারে।  
আবার এই মন্ডুক একজন ঋষির নাম  বিশেষ, যিনি এই বিশেষ ধ্বনিকে আমাদের সামনে এনে, এর উর্বরাশক্তি সম্পর্কে জ্ঞাত করাচ্ছেন, যা আমাদের ব্রহ্মানুভূতি এনে দিতে পারে । 

আর এই ধ্বনি হচ্ছে ওঙ্কার - যা সৃষ্টির ইঙ্গিত বহন করে। হিন্দু শাস্ত্রমতে এই ওঙ্কার  হচ্ছে  সৃষ্টির মূল। ঋষি বলছেন, এই ওঙ্কার কার্য্য ও কারনে প্রতীক। এই যে দৃশ্যমান জগৎ, এ ওঙ্কার ছাড়া কিছু নয়। এই যে কাল, অর্থাৎ অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ এমনকি এই কালের অতীত যদি কিছু থেকে থাকে তাও এই ওঙ্কার। অর্থাৎ এটি নিত্য সত্য।  এই  ওঙ্কারকে  বলা  হয় শব্দব্রহ্ম বা নাদব্রহ্ম। উপনিষদে আত্মা আর ব্রহ্ম  সমার্থক শব্দ। এই যে ওঙ্কাররূপ ধ্বনি এটি সমস্ত ধ্বনিজগতের মূল। সমস্ত ধ্বনিজগৎ এই ওঙ্কারের অন্তর্গত। আর এই ধ্বনি বিশ্বব্রহ্মান্ড ব্যাপী বিস্তার করে আছে। এই ওঙ্কারকে  বলা হয়, এর কখনো ক্ষয় নেই, তাই  এঁকে  বলা হয় অক্ষর। ওঙ্কার ধ্বনি সম্পর্কে বলা হয়, এটি আমাদের নাভিমূল থেকে অন্যমতে এটি আমাদের মূলাধার থেকে উৎসারিত হয়ে শরীরের নাভি, হৃদয়, কন্ঠ, ওষ্ঠ বাহিত হয়ে শেষে ঠোঁট বন্ধ  অবস্থায় অনুনাসিক স্বর হিসেবে নির্গত হয়। অর্থাৎ এই ধ্বনি যেমন সমস্ত শরীরকে আঘাত করে উজ্জীবিত করে, তেমনি এই দৃশ্যমান জগতকে প্রকাশিত করছে এই ওঙ্কার বা ওম।
-------------

"সর্বং হি  এতৎ ব্রহ্ম অয়ম আত্মা ব্রহ্ম সঃ অয়ম আত্মা  চতুষ্পাৎ। " (০১/০২)

এইসকল অর্থাৎ সমগ্র এই জগৎ ব্রহ্ম। এই যে আত্মা (জীবাত্মা) তাও  ব্রহ্ম। এই আত্মার চারটি পাদ বা অবস্থা। 

স্থূল জগৎ বলুন, সূক্ষ্ম জগৎ বলুন, এসব ব্রহ্মের বিশেষ স্থিতি  মাত্র। যা কিছু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, আবার যাকিছু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, অথচ আমাদের উপলবদ্ধিতে  আসে, আবার এমন সবকিছু যে আমাদের উপল্বদ্ধিতেও  আসে না, সবই সেই এক ব্রহ্ম। এই যে জীবাত্মা যিনি আমাদের এই শরীর মনের ধারক, তিনিও এই  ব্রহ্ম  বৈ কিছু নয়। তো যা কিছুর অস্তিত্ত্ব আছে, সবই ব্রহ্ম। ব্রহ্ম  ভিন্ন কোনোকিছুর অস্তিত্ত্ব নেই। 

এই যে জীব, বা এই যে জগৎ, এর মধ্যে কোনো পার্থক্য  নেই। এই দুইই  সেই এক ব্রহ্ম। এই যে বিরাট বিশ্ব আর এই যে ক্ষুদ্র জীব অর্থাৎ সমষ্টি ও ব্যষ্টি  এসবই এক ব্রহ্ম। আমাদের দেহের ভিতরে যে অগ্নি, আর সূর্য্যের  ভিতরে যে অগ্নি, এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এই যে অনন্ত  আকাশ আর আমাদের শরীরের মধ্যে যে আকাশ, এই  দুই আকাশের  মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমার আপনার শরীরের মধ্যে যে জল, বায়ু ইত্যাদি আছে, তার সঙ্গে এই বায়ুমন্ডলের বা সমুদ্রের জলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তো আমার আপনার মধ্যে যে ব্রহ্ম  আছেন, আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে ব্রহ্ম আছেন, তার মধ্যেও কোনো পার্থক্য নেই। এই সত্যকে উপলব্ধি করা সহজ না হলেও অসম্ভব  নয়। আর এই কারণেই উপনিষদের  ঋষিগণ  বারবার বলছেন,  তুমি জানো  আর না যেন, তুমিই ব্রহ্ম। তুমিই ব্রহ্ম।  তুহি তুহি। 

আমরা দেহাভিমানী জীব, তাই আমরা আমাদের দেহকে ঘিরে আমিত্বের বোধ করে থাকি। কিন্তু এই দেহতো আমি নোই, এই দেহে আমি বাস করছি মাত্র। এই দেহ আমার আবরণ মাত্র। এই আবরণ খুলে ফেললে, আমি আমাতেই স্থিত হবো।  অর্থাৎ যখন আমাদের দেহাভিমান চলে যাবে, তখন আমি আমার স্বরূপে স্থিত হবো।  আর আমার এই স্বরূপ হচ্ছে ব্রহ্ম, যা উপনিষদ বার বার করে উচ্চারণ করছেন, উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করছেন । 

এখন ঋষি মন্ডুক বলছেন, এই যে ব্রহ্ম  বা আত্মা ইনি  চতুষ্পাদ।  অর্থাৎ এনার চারটি পা, বাচারটি  অবস্থা বিশেষ। তো ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন কিন্তু এনার চারটি অবস্থা। 

মাণ্ডুক্য উপনিষদ - আগম  প্রকরণ - শ্লোক-২

প্রথম হচ্ছে, এই যে দৃশ্যমান জগৎ, যা আমরা জাগ্রত অবস্থায় প্রতক্ষ্য করে থাকি। একে  বলে জাগ্রত অবস্থা।  এই জাগ্রত অবস্থায় এই জগৎকে উপলব্ধি করি কিভাবে, আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে। অর্থাৎ চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহবা, ত্বক এই পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রীয়ের সাহায্যে এই জগৎ বিষয়  আমাদের উপলব্ধি হয়ে থাকে। যদি কোনো কারনে এই ইন্দ্রিসকল নিষ্ক্রিয়  হয়ে যায়, তবে এ জগৎ আমার চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে যাবে। 

দ্বিতীয় অবস্থা হচ্ছে আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি, অর্থাৎ আমাদের স্বপ্নাবস্থা। এই অবস্থায় আমাদের জ্ঞানীন্দ্রিয় সকল, এমনকি সমস্ত শরীর স্থির, নিষ্ক্রিয়  হয়ে থাকে।  তখন আমরা আর চর্ম্ম  চক্ষু দিয়ে দেখতে পারি না, কান  দিয়ে শুনতে পারি না, মুখ দিয়ে কথা বলতে পারি না, জিভ দিয়ে স্বাদ গ্রহণ করতে পারি না। কিন্তু আশ্চর্য্যের কথা হচ্ছে, তখনও আমরা এই স্থূল জগতের অনুরূপ আরো একটা জগতের মধ্যে বিচরণ করে থাকি ।  সেখানে অর্থাৎ এই স্বপ্নের জগতে  আমরা শুনি, দেখি, কথা বলি, এমনি খাবার খাই, ইত্যাদি ইত্যাদি।  এইসময় আমাদের বাহ্য  ইন্দ্রিয় নিষ্ক্রিয় থাকে, তথাপি এই সূক্ষ্ম জগতের স্বাদ নিতে আমাদের কোনো অসুবিধা হয় না। এই অবস্থা আমাদের এমনকি সুখ-দুঃখের অনুভূতি গ্রহণ করে থাকি। তো এই সময় যে অবস্থা আমাদের হয়, তাকে বলে তৈজস অবস্থা। অর্থাৎ আমাদের শরীরের তেজঃশক্তি মনের সাহায্যে সমস্ত ক্রিয়া সম্পাদন করে থাকে। এমনকি বিষয় অনুভূতি এনে দেয়। 

তৃতীয় অবস্থা হচ্ছে আমাদের গাঢ়  ঘুমের অবস্থা। একে উপনিষদের ঋষিগণ বলছেন, সুসুপ্তির অবস্থা।  এই অবস্থায় আমাদের ইন্দ্রিয় সকল তো বটেই, এমনকি আমাদের মন নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে। এই অবস্থায় আমাদের যে কি হয়, তা আমরা জানি না। কিন্তু এইখান থেকে যখন বেরিয়ে আসি, অর্থাৎ যখন আমাদের  গাঢ়  ঘুম ভেঙে যায়, তখন আমরা অনেক বেশি সতেজ ভাব  অনুভব করি। স্বপ্নাবস্থায় যা কিছু হয়, তার একটা রেশ আমরা জাগ্রত অবস্থায় অনুভব করি। এমনকি স্বপ্নে দেখা ভয়ের দৃশ্য আমাদের জাগ্রত অবস্থাতেও  মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে।  কিন্তু গাঢ়  ঘুমের পরে অর্থাৎ সুষুপ্তি থেকে জেগে উঠে আমরা কেবলমাত্র সতেজতা অনুভব করি। এমনকি দেখা যায়, ক্ষনিকের জন্য আমরা বাহ্যজ্ঞান রোহিত হয়ে বিমূঢ় অবস্থায় থাকি। যদিও  এই অবস্থা বেশিক্ষন থাকে না, মুহূর্তের মধ্যেই আমরা আবার বাহ্য  জগতের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেই, তথাপি মুহূর্তের জন্য, আমরা যেন একটা অন্য জগতে থাকি।  এই জগৎ সম্পর্কে  আমাদের কোনো স্মৃতি থাকে না। থাকে  কেবল একটা সতেজ  ভাব।

চতুর্থ অবস্থাকে উপনিষদের ঋষিগণ বলছেন, তুরীয় অবস্থা। অর্থাৎ ব্রহ্মের  চতুর্থ অবস্থা। বলা হয়, এই অবস্থায় মানুষ চৈতন্যের সঙ্গে অবস্থান করেন। তখন আমরা ব্রহ্মেের সঙ্গে বা আত্মার সঙ্গে আরো একটু গভীর ভাবে বলতে গেলে, বলতে  হয়, আমি তখন "আমার" সঙ্গে অবস্থান করি।  অর্থাৎ আমি স্বরূপে স্থিতি  লাভ করি। আর আমার এই স্বরূপ হচ্ছে স্বয়ং ব্রহ্ম।  আমি ব্রহ্ম বৈ  কিছু নয়।  

এখন কথা হচ্ছে, জীবকুলের এই যে চারটি অবস্থা এতে করে জীবের মধ্যে কোনো পরিবর্তন হয় না। আমরা ঘুম থেকে উঠে আবার এই জগতের একজন হয়ে যাই।  আবার সেই দেহাভিমানী হয়ে সংসারকাজে লেগে পড়ি।  আবার সেইসুখ-দুঃখের, মায়ার সংসারে নিজেকে আবদ্ধ  করে ফেলি। যেখানে যে কাজ ফেলে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সেখান থেকে আবার কাজ শুরু করি।   তো আমরা কখনো জেগে আছি, কখনো ঘুমিয়ে আছি, কখনো পাতলা ঘুমের মধ্যে আছি, কখনও গাঢ়  ঘুমের মধ্যে আছি, কিন্তু আমি সেই একই আছি। তো এতে করে আমার কোনো পরিবর্তন হয় না। আমি ঘুমের আগেও যা ছিলাম, ঘুমের পরেও সেই আমিই থাকি, হয়তো একটু সতেজ  থাকি, তার  বেশি কিছু নয়। একই আমি কখনও বাইরের ঘরে, কখনও  পড়ার ঘরে, কখনও   শোবার  ঘরে, কখনও  বা ঠাকুর ঘরে। 

এবার একটু ভাবুন,  আমার যেমন ব্যষ্টি  শরীর  আছে, ব্যষ্টি  মন আছে, ব্যষ্টি  ইন্দ্রিয় আছে, তেমনি  জগতের সমস্ত জীবের মনকে, শরীরকে, ইন্দ্রিয়কে একত্র করলে যে বিরাট শরীর হতে পারে, আবার সমস্ত বস্তুকে একত্র করে যেমন যে বিশাল ব্রহ্মান্ড হতে পারে, তা যাঁকে  আশ্রয় করে অবস্থান করছে তাকেই  বলা হচ্ছে ব্রহ্ম। এইজন্য ঋষি বলছেন, এই আত্মাই ব্রহ্ম। সমগ্র এই জগৎ ব্রহ্ম। ব্রহ্মের বাইরে কিছু নেই ।
---------------------

মাণ্ডুক্য উপনিষদ - শ্লোক ০১/০৩

"জাগরিত স্থানঃ বহিঃ প্রজ্ঞঃ সপ্তাঙ্গ একোনবিংশতি মুখঃ  স্থূলভূক বৈশ্বানরঃ প্রথম পাদ।" (০১/০৩)

জাগরিত অবস্থায় বহির্জগৎ সম্পর্কে জীবরুপি ব্রহ্ম  সচেতন থাকেন  ।  তখন সাতটি অঙ্গবিশিষ্ঠ উনিশটি মুখ বিশিষ্ঠ স্থূলভূখ বা স্থূল বিষয়ের ভোক্তা হচ্ছেন বৈশ্বানর।  এই তাঁর (আত্মার) প্রথম পাদ। 

পরমাত্মার ক্ষুদ্র সংস্করণ হচ্ছে জীবাত্মা। পরমাত্মা হচ্ছে সমষ্টি আর জীবাত্মা হচ্ছেন ব্যষ্টি। তেমনি সমস্ত ব্যষ্টি শরীর  মিলিয়ে এই বিশ্ব। 
এই যে স্থূল জগত এর  ভোক্তা হচ্ছে এই শরীর। এই শরীর  ভিন্ন স্থূল জগৎকে ভোগ করা যায় না। আবার এই শরীর হচ্ছে তিন প্রকার। স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারন। এই তিনটে মিলে একটা  শরীর। এই তিন  শরীর  কিন্তু আলাদা নয়, এই তিনটে শরীর একের সঙ্গে অন্যটি  ওতপ্রোতভাবে জড়িত।  এইব্যাপারটা আমরা একটু ভালোভাবে বুঝে নেই।

দৃশ্যমান এই যে মানব দেহ বা  কর্ম্ম দেহ, এটি খাদ্য বা অন্ন দ্বারা গঠিত। এবং খাদ্য দ্বারাই পুষ্টি লাভ করে থাকে। আমাদের একটা ধারণা  হচ্ছে, এই স্থূল দেহই সমস্ত গুনের আধার। ব্যপারটা কিন্তু এমন নয়। এই যে স্থূল দেহ তা ভৌতিক উপকরণে তৈরী। দেহের মৃত্যু কালে এই দেহের সমস্ত উপাদান আবার পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাবে। এই দেহের ভিতরে এবং কিছুটা বাইরে আরো একটা দেহ আছে, যা অতি সূক্ষ্ম পদার্থে নির্মিত। এই দেহকে বলা  হয় সূক্ষ্ম দেহ বা লিঙ্গ দেহ। এখানে স্থূল উপকরণ কিছু নেই, অতিসূক্ষ্ম পদার্থে নির্মিত। এই সূক্ষ্ম দেহের অভ্যন্তরে আরো একটা দেহ আছে, তাকে বলা হয় মনোময় দেহ বা মানস দেহ। এই মনোময় দেহই আসলে আমাদের মন-বুদ্ধির আধার। এই যে তিনটে দেহ অর্থাৎ স্থূল, সূক্ষ্ম ও সূক্ষ্মতর এই তিনটে দেহই পার্থিব দেহ। একেই বলে অন্নময়, প্রাণময়, ও মনময় দেহ। অন্নময়  দেহ স্থূল, প্রাণময় দেহ সূক্ষ্ম, আর মনোময় দেহ সূক্ষ্মতর। এই তিনটে দেহই পার্থিব। 
এ ছাড়া আমাদের আরো দুটো দেহ আছে, একটি বিজ্ঞানময় আরেকটি আনন্দময় দেহ। এই দুটো দেহ পার্থিব নয়। এই দেহ অভৌতিক অর্থাৎ পঞ্চভূতের তৈরী নয়।  একেই বলে কারন দেহ।  
দেখুন আত্মা সম্পর্কে যত কথাই বলি না কেন, এই সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান কেবলমাত্র পুঁথিগত। আমরা মেনে নিয়েছি, আত্মা (জীবাত্মা) বলে একটা কিছু আছে, কিন্তু সেটা যে কি বস্তু, তা আমরা বলতে পারবো  না।  বুঝবার সুবিধের জন্য একে  মহাত্মাগণ বলে থাকেন চৈতন্য। পরা-বিদ্যাবিদগণ বলে থাকেন,  এই আত্মার একটা দেহ আছে, যা অদৃশ্য উপকরণে তৈরী। দেহের আকৃতি অনুসারে এই আত্মার (জীবাত্মা) একটা আকৃতিও আছে। যদিও এই দেহ লিঙ্গহীন। যখন যেমন দেহে অবস্থান করে, তখন সেই লিঙ্গ ধারণ  করে। আমাদের চিন্তা, মনের ভাব, ইত্যাদি কার্য্যের উৎপত্তি স্থান হচ্ছে এই কারন দেহ। এই কারন দেহে যিনি বাস করেন, তিনিই আত্মা, যিনি অজর, অমর শ্বাশত। কিন্তু কালের গতিতে এই আত্মার (জীবাত্মার) ক্ষমতার  হ্রাস-বৃদ্ধি  আছে। আর এই ক্ষমতার হ্রাস বা বৃদ্ধির কারন হচ্ছে আমাদের জ্ঞান অভিজ্ঞতা।  এই জ্ঞান-অভিজ্ঞতাই আত্মাকে অধোগামী বা উর্দ্ধগামী করে থাকে। এতো কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, উপনিষদের এই শ্লোকে বলা হচ্ছে এই জীবাত্মাই আসলে ভোক্তা।  তিনি এই দেহাদির মাধ্যমে ভোগ সম্পাদন করে থাকেন।  

এই ভোগের প্রথম অবস্থা হচ্ছে, জাগ্রত অবস্থা । এই অবস্থায় আমরা ইন্দ্রিয় সকলের দ্বারা এই জগৎকে উপলব্ধি করে থাকি। এই ইন্দ্রিয়সকলের দ্বারাই আমরা বহির্জগৎ-এর সঙ্গে  সম্পর্কযুক্ত থাকি।  এই ভোগ হচ্ছে স্থূলের ভোগ। তাই একে  বলা হচ্ছে স্থূলভূক। আমাদের সবার, এমনকি সমস্ত জীবকুলের এই স্থূলভোগের অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে। আর এই ভোগ হয়ে থাকে আমাদের দেহ ও তৎসংলগ্ন ইন্দ্রিয়ের দ্বারা। উপনিষদের ঋষি বলছেন, এর সাতটি  অঙ্গ  অর্থাৎ সাতটি লোক - ভূঃ  ভুবঃ স্বঃ মহঃ  জনঃ  তপঃ সত্যম।  উনিশটি মুখ, এগুলো হচ্ছে পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচ কর্ম্মেন্দ্রিয়, পাঁচ প্রাণ , এবং মন, বুদ্ধি চিত্ত অহংকার। মোদ্দা কথা হচ্ছে, জাগ্রত অবস্থায় আমরা স্থূল জগতের ভোক্তা। একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, জাগ্রত অবস্থায় আমরা স্থূলরূপে ব্রহ্মকে দেখতে পাচ্ছি, অনুভব করতে পারছি। এই হচ্ছে ব্রহ্মার প্রথম পাদ বা প্রথম প্রকাশ। ওঙ্কারের প্রথম মাত্রা "অ".

আসলে জগৎ কিছু স্থূল থেকে  শুরু হয়নি, বরং বলা যায়, ব্রহ্মর প্রকাশ স্থূলে  এসে পরিণতি প্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞাতায় যেহেতু প্রথমেই স্থূলের অনুভূতি হয়ে থাকে, তাই উপনিষদের আলোচনা এখান থেকেই শুরু হয়েছে। বৈশ্বানর কথাটার অর্থ হচ্ছে বিশ্ব  এবং নর। আমাদের যেমন তিনটে  শরীর  (স্থূল, সূক্ষ্ম, কারন) তেমনি আমাদের তিন অবস্থা অর্থাৎ জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি। তো এই যে বৈশ্বানর ইনি অগ্নি বিশেষ। আমাদের শরীরে যে খাদ্য হজম প্রক্রিয়া তা এই বৈশ্বানর অগ্নির সাহায্যেই হয়ে থাকে। অর্থাৎ খাদ্য থেকে যে সূক্ষ্ম বস্তুকে আলাদা করা হয়, তা এই বৈশ্বানর রুপী ব্রহ্ম করে থাকেন।  তো স্থূল বস্তুকে বৈশ্বানর নামে সেই পরমেশ্বর ভোগ করছেন। 
------------------- 
এই প্রসঙ্গে দেহভান্ড সম্পর্কে একটা বিশেষ প্রবন্ধ পুনঃপ্রচার করা হলো।      

স্থুল মানব দেহ-ভাণ্ড ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ড HUMAN BODY & SPACE

মানবদেহ এক বিস্ময়। কত যে কারিকুরি আছে এই দেহে, তার ইয়ত্ত্বা নেই। বিজ্ঞান এখনো দেহের সমস্ত অঙ্গের কার্যকারিতা সম্পর্কে অবহিত নয়। আবার আমাদের এই স্থুল দেহই চৈতন্যের আবাসস্থল। তাই আমাদের এই মনুষ্য জীবন ও মানুষের এই স্থূল দেহ আমাদের সাধনার মূল আশ্রয়। বহু জন্ম অতিক্রান্ত করে, লক্ষ লক্ষ যোনি ভ্রমণের পর আমরা এই মনুষ্যদেহ প্রাপ্ত হয়েছি। একমাত্র মনুষ্যদেহেই আমাদের কর্ম্মফল সঞ্চিত হয়। তাই আমরা সবাই আবার মনুষ্যদেহ প্রাপ্ত করতে চাই।
মনুষ্যদেহ ভিন্ন সাধন সম্ভব নয়। তাই মানব জীবন  আমাদের কাছে, অতি মূল্যবান। আমাদের এই দেহকে ভালো করে জানতে হবে। আমরা জানি আমাদের এই  দেহ কতকগুলো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সমাহার মাত্র । এই দেহকে শারীরবিদগন এক রকম ভাবেই  দেখেছেন।  অধ্যাত্ম পথের  পথিকরা এই দেহকে অন্য ভাবে দেখেছেন। তারা মনে করেন, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অনুরূপ একটি ব্রহ্মান্ড, হচ্ছে আমাদের এই দেহ । আমরা আজ সেই কথাই  শুনবো।

বাউল লালন ফকির বলছেন :
দেব-দেবতাগন / করে আরাধন / জন্ম নিতে মানবে।।
কত ভাগ্যের ফলে না জানি / মন রে পেয়েছো এই মানব তরণী।
বেয়ে যাও ত্বরায় সুধারায় / যেন ভারা  না ডোবে।।
এই মানুষে হবে মাধুর্য-ভজন / তাইতো মানুষরূপ গড়লে নিরঞ্জন।
এবার ঠকলে আর না দেখি কিনার / অধীন লালন তাই ভাবে।।

বেশিরভাগ ধর্ম্মপ্রান মানুষ অল্পবিস্তর যোগের ক্রিয়া করে থাকেন। অর্থাৎ তাঁদের সাধনকেন্দ্র এই দেহ। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, জৈন, মুসলমান, সবাই কিঁছু না কিছু শারীরিক ক্রিয়া অবশ্যই  করে থাকেন। অর্থাৎ দেহের মাধ্যমেই আমাদের সাধন ভজন।  আমরা সবাই মনে করি, ঈশ্বর যেমন বাইরে আছেন  বৃহৎ আকারে, তেমনি আমাদের দেহে আছেন ক্ষুদ্র আকারে । এই দেহের মধ্যেই আছেন পরমতত্ত্ব, বা পরমাত্মা। দেহের বাইরে যেমন আছে পঞ্চতত্ত্ব, সপ্তলোক, নদী, সাগর, দ্বীপ, পর্বত। তেমনি আমাদের শরীরকে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ বলে কল্পনা করা হয়েছে। তাইতো একটা প্রচলিত কথা আছে যে, যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাই আছে এই দেহ-ভান্ডে।

আমরা জানি আমাদের মেরুদণ্ডকে আশ্রয় করে, ছটি চক্র আছে। এর মধ্যে সবথেকে নিচে, যে মূলাধার চক্র আছে সেখানে কুণ্ডলিনী শক্তি, অর্থাৎ সৃষ্টিশক্তি সুষুপ্ত অবস্থায় আছেন। এই কুণ্ডলিনীকে প্রাণ-অপান বায়ুর সাহায্যে ক্রিয়া দ্বারা  জাগ্রত করে, সুষুম্নার ভিতর দিয়ে উর্দ্ধগতি করাতে পারলে, সেই বায়ু সূক্ষ্ম অবস্থায় সহস্রারে অর্থাৎ পরমশিবের সাথে মিলিত হন । মানুষ তখন, ত্রিগুণাতীত ব্রাহ্মীস্থিতি লাভ করতে পারেন ।

তাই দেহকে অবলম্বন করেই সাধনা। তা সে হিন্দু, বৌদ্ধ, তান্ত্রিক, যোগী, বৈষ্ণব, বাউল, সুফি, যাই বলুন না কেন, সবাই এই দেহকে অবলম্বন করেই সাধনা করছেন। আমরা সবাই  জানি, পঞ্চভূতের এই দেহ। এই পঞ্চভূত কি ভাবে আমাদের দেহে অবস্থান করছেন দেখুন।

ক্ষিতি অর্থাৎ কঠিন পদার্থ বা পৃথিবী : আমাদের শরীরে, অস্থি, চর্ম, নাড়ী, লোম ও মাংস এই পাঁচটি পৃথিবীর গুন্, বা বিকার অবস্থা।
অপ অর্থাৎ তরল পদার্থ বা জল : মল, মূত্র, শুক্র, শ্লেষ্মা ও শোনিত - এই পাঁচটি হচ্ছে জলের গুন্।
তেজ অর্থাৎ তাপ বা অগ্নি : ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা, মোহ, ক্ষান্তি (ক্ষমা বা তিতিক্ষা) - এই পাঁচটি হচ্ছে তেজের গুন্।
মরুৎ  অর্থাৎ বায়বীয় পদার্থ বা বাতাস  :  বিরোধ, আক্ষেপন, আকুঞ্চন, ধারণ ও তৃপ্তি - এই পাঁচটি হচ্ছে বায়ুর গুন্।
ব্যোম অর্থাৎ বিশাল বা আকাশ : রাগ, দ্বেষ, মোহ, ভয় ও লজ্বা - এই পাঁচটি হচ্ছে আকাশের গুন্।

পঞ্চভূতের মধ্যে বায়ু প্রধান।  তাই আমরা বায়ু সম্পর্কে এবার আমরা আরো একটু গভীরে যাবো। বায়ু দশ রকম বা বায়ুর দশটি গুন্ - প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান (এগুলো অর্থাৎ এই পাঁচটি  আমরা জানি ) এছাড়া আছে, নাগ, কূর্ম, কৃকর অর্থাৎ কয়ার পাখি, দেবদত্ত্ব( দেবতাদের কর্তৃক প্রদত্ত্ব ) ও ধনঞ্জয় (যিনি ধনকে জয় করেছেন)। এই মোট দশটি বায়ুর গুন্। প্রাণবায়ু আমাদের হৃদয়ে অবস্থিত। অপান আমাদের গুহ্যদেশে। নাভিদেশে আছে সমান, কন্ঠে উদানবায়ু, এবং সর্বশরীরে ছড়িয়ে আছে ব্যানবায়ু। এই পাঁচটি বায়ু প্রধান।  নাগ, কূর্ম, কৃকর, দেবদত্ত্ব ও ধনঞ্জয় - এগুলো আমাদের সমস্ত  নাড়ীতে অবস্থান করে। অর্থাৎ আমাদের শরীরে যে ৭২০০০ নাড়ী  আছে, তার মধ্যে অবস্থান করে।  তবে প্রধানত পাঁচটি নাড়ী অর্থাৎ ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, বজ্রাক্ষ্যা ও চিত্রাণি এই পাঁচটি নাড়ীতে অবস্থান করে। কেউকেউ বলে থাকেন, ললাট, উরঃ, স্কন্ধ, হৃদয়, নাভি, ত্বক ও অস্থিতে এই পাঁচ নাগাদি বায়ু অবস্থান করে।

আমরা যে সাতটি তল ও  লোকের কথা জানি, সেগুলোর অবস্থান এই রকম :
লোক :ভূর্লোক  নাভিদেশে, ভুবর্লোক হৃদয়ে, স্বর্লোক আমাদের কন্ঠে, মহর্লোক আমাদের চক্ষুদ্বয়ে।  ভ্রূদ্বয়ে আমাদের জনলোক, ললাটে তপোলোকে, সহস্রারে সত্যলোক।
তল:তল সাতটি।  তাদের অবস্থান এই রকম : পাদের আধোভাগ হচ্ছে অতল, পাদের উর্ধভাগ হচ্ছে বিতল।জানুদ্বয়ে সুতল, সন্ধি-রন্ধ্রে হচ্ছে তল, গুদমধ্যে বা গুহ্যমধ্যে তলাতল, লিঙ্গমূলে রসাতল,পাদের অগ্রভাগ ও কটির সন্ধি-স্থলে পাতাল।
পর্বত :আমাদের মূলাধার চক্রে একটা ত্রিকোণ কল্পনা করা হয়েছে। এটি পর্বতের বিশেষ অবস্থান কেন্দ্র। ত্রিকোণের উর্দ্ধকোনে  মন্দর  পর্বত। ডানকোনে কৈলাশ পর্বত। বামকোনে হিমালয়। এছাড়া ত্রিকোণের উর্ধভাগে বিন্ধ্য ও বিষ্ণু পর্বত। এছাড়া আছে ত্রিকোণে মেরু পর্বত। এই মোট সাতটি পর্বতের অবস্থান কেন্দ্র।
দ্বীপ :আমাদের দেহের অস্থিতে অবস্থান করছে জম্বুদ্বীপ, মাংসে কুশদ্বীপ, শিরা সমূহে ক্ৰৌঞ্চদ্বীপ, রক্তে আছে শাকদ্বীপ।  আমাদের শরীরের উর্ধভাগে সমস্ত সন্ধিদেশে শাম্বলি দ্বীপ, লোমপূর্ন স্থানে প্লক্ষদ্বীপ এবং নাভিতে পুস্কর দ্বীপ।
সমুদ্র :লবন সমুদ্র আমাদের মূত্র। শুক্র হচ্ছে ক্ষীরোদসাগর। মজ্জা হচ্ছে দধিসাগর। চর্ম হচ্ছে ঘৃতসাগর। বসা অর্থাৎ আমাদের অবস্থিতি বা আধার হচ্ছে  জল সাগর। কটিরক্তে ইক্ষুসাগর। এবং শোনিতে সুরাসাগর অবস্থিত।
গ্রহ :নাদচক্রে সূর্য অবস্থিত। বিন্দুচক্রে চন্দ্র। মঙ্গল আছে আমাদের চক্ষুতে। হৃদয়ে আছে বুধ।  পেটে বা উদরে আছে বৃহস্পতি। শুক্রে আছে শুক্রগ্রহ। নাভিচক্রে শনি, মুখে আমাদের রাহু আর নাভিতে কেতু।

ঈশ্বরের প্রকাশ স্বরূপ এই ব্রহ্মান্ড। আর এই ব্রহ্মান্ডের ক্ষুদ্র সংস্করণ হচ্ছে আমাদের এই মানবদেহ। এর মূল্যশুধু  অসীম নয়, এটি একটি দুর্লভ বস্তূ। আমরা কেবল বাইরে আমার স্বামীকে খুঁজছি। স্বামীতো ঘরেই আছেন। অশরীরী আমাদের শরীরেই লুকিয়ে আছেন। এই দেহের মধ্যেই গঙ্গা-যমুনা। এখানেই মিলনক্ষেত্র গঙ্গাসাগর। এখানেই প্রয়াগ, হরিদ্বার, বারাণসী। এটাই তীর্থক্ষেত্র। এটাই পীঠস্থান। রত্নসার বলছে :
ভান্ডকে জানিলে জানি ব্রহ্মাণ্ডের তত্ত্ব।
ভান্ড বিচারিলে জানি আপন মাহাত্ম।

বহু ধর্মমতে আমাদের এই দেহের মধ্যেই ঈশ্বরের বাসস্থান কল্পনা করা হয়েছে। এটা  শুধু কল্পনা নয়, এটি বাস্তব সত্য। প্রথম দিকে এই কল্পনা নিয়ে এগুতে হয়। ক্রমে ক্রমে এই সত্য সাধকের উপল্বদ্ধিতে আসে। এমনকি কিছু কিছু সূক্ষ্মতত্ত্ব সামনে আসে, যখন মনে ঈশ্বর সম্পর্কে দৃঢ়তা আসে। এমনকি ঈশ্বরের সঙ্গে একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রতিনিয়ত ঈশ্বরের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। সমস্ত সাধনাই আত্মউপলব্ধির সাধনা। এবং একমাত্র দেহকে অবলম্বন করেই আমরা স্থূল থেকে সূক্ষ্মে অগ্রসর হয়ে, সবশেষে আত্মার স্বরুপত্বে পৌঁছানো যায়। স্থুল থেকে সূক্ষ্মে অগ্রসর হওয়া মানে, সৃষ্টিধারার বিপরীত গতিতে অগ্রসর হওয়া। জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন দুটো ভাবে হতে পারে, এক যদি পরমাত্মা স্বেচ্ছায় জীবাত্মার কাছে আসেন, আর জীবাত্মা যদি তার গতি পরমাত্মমুখী করেন। তো দেহের সাধন দ্বারা  মানুষের সহজাত স্বাভাবিক অবস্থা লাভ করা। এই অবস্থাতেই মানুষ ব্রহ্ম-স্বরূপত্ত্ব লাভ করে। তাই তন্ত্রমতে চক্রভেদ, বা পাতঞ্জল মতে অষ্টাঙ্গ যোগাভ্যাস, বেদান্তের পঞ্চকোষ-বিবেক  সাধন, বৌদ্ধদের কায়-বাদ, বৈষ্ণবদের ভক্তিসাধন, বাউলদের সহজিয়া সাধন, মূলত একই পথের প্রকারভেদ মাত্র। তাই লালন বলছেন, একবার আপনারে চিনলে, পরে যায় অচেনারে চেনা।
-----------------


মাণ্ডুক্য উপনিষদ শ্লোক : ০১/০৪-৫
 
"স্বপ্নস্থানঃ অন্তঃ প্রজ্ঞঃ সপ্তাঙ্গ একোনবিংশতি মুখঃ 
প্রবিবিক্ত ভূক তৈজসঃ দ্বিতীয়ঃ পাদঃ"। (০১/০৪) 

স্বপ্ন জগতে যখন   স্থান হয়, তখন অন্তরেন্দ্রীয়ের অর্থাৎ অন্তঃকরণ-এর জ্ঞান হয়।  তখন সাত অঙ্গবিশিষ্ঠ ও ঊনিশ মুখ তৈজস বিশিষ্ঠ পুরুষ সূক্ষ্ম জগতের ভোক্তা হয়ে থাকেন।  একেই  পরমাত্মার দ্বিতীয়পাদ বলে। 

জাগ্রত অবস্থায় আমরা যেমন বাহ্য ইন্দ্রিয়ের দ্বারা স্থূল জগৎবিষয়ের জ্ঞান হয়, তেমনি স্বপ্নাবস্থায় আমাদের অন্তর ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অর্থাৎ মনের দ্বারা আমাদের  সূক্ষ্ম জগতের জ্ঞান হয়। জাগ্রত অবস্থায় আমরা বহির্মুখী থাকি, কিন্তু স্বপ্নাবস্থায় আমরা অন্তর্মুখী হয়ে যাই। এই অবস্থাতেও আমাদের পূর্ব-উক্ত সাতটি অঙ্গ ও উনিশটি ইন্দ্রিয় অটুট থাকে। 
সাতটি লোক - ভূঃ  ভুবঃ স্বঃ মহঃ  জনঃ  তপঃ সত্যম। ভূর্লোক  নাভিদেশে, ভুবর্লোক হৃদয়ে, স্বর্লোক আমাদের কন্ঠে, মহর্লোক আমাদের চক্ষুদ্বয়ে।  ভ্রূদ্বয়ে আমাদের জনলোক, ললাটে তপোলোক, সহস্রারে সত্যলোক।উনিশটি মুখ, এগুলো হচ্ছে পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়, (চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক)  পাঁচ কর্ম্মেন্দ্রিয় (হাত, পা, বাক, পায়ু, উপস্থ )  পাঁচ প্রাণ ( প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান) এবং মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার। 

তো জাগ্রত অবস্থায় আমরা স্থূলভূক আর স্বপ্ন অবস্থায় আমরা প্রবিবিক্ত ভূক। প্রবিবিক্ত কথাটার অর্থ হচ্ছে সূক্ষ্ম। প্রবিবিক্ত কথাটার আরো একটা অর্থ আছে, "যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে"।  অর্থাৎ যাকিছু আমরা জাগ্রত অবস্থায় দেখি, শুনি, বলি, বা চিন্তা করি, তা আমাদের প্রথমে মনের উপরে ছাপ  ফেলে, এবং কখনো কখনো তা স্বপ্নাবস্থায় দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।  আসলে আমরা যাকিছু কামনা করি, সেই কামনা দ্বারাই আমরা উপভোগ্য বস্তুর নিকট উপস্থিত হই। এবং সেই মতো শারীরিক ভোগ হয় জাগতিক অবস্থায়, আর মানসিক ভোগ হয় স্বপ্নাবস্থায়। তো স্বপ্নাবস্থায় আমাদের মনের দ্বারা ভোগকর্ম্ম সম্পাদন হয়ে থাকে।  আমাদের মনের যে কামনা বাসনা, এবং আমাদের যে অতীত অভিজ্ঞতা তারই ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের স্বপ্নাবস্থায়। 
   
এই শ্লোকে উপনিষদের ঋষি পরমাত্মার দ্বিতীয় পাদের কথা বলছেন। এই স্বপ্নাবস্থাকেই  বলা হচ্ছে দ্বিতীয়পাদ। এখানেই সেই সাত অঙ্গ যুক্ত এবং উনিশটি মুখ সম্পন্ন অভিমানী জীবাত্মা সূক্ষ্ম বিষয়ের উপভোগ করেন। জাগ্রত অবস্থায় স্থূল শরীরে যেমন তিনি স্থূল জগতের জ্ঞান অৰ্জন করেন, তেমনি সূক্ষ্ম শরীরে স্বপ্নাবস্থায় সূক্ষ্ম বিষয়কে উপভোগ করেন। এই জগতেরই নিয়ন্তা বা জ্ঞাতা বা ভোক্তা  হচ্ছেন, একই পরম-আত্মা । এই স্বপ্নের জগৎকে উপনিষদ বলছেন, তৈজস অবস্থা অর্থাৎ পরম-জ্যোতির অবস্থা। তেজঃ থেকে তেজসঃ - তৈজসঃ । ওঙ্কারের এটি দ্বিতীয় মাত্রা "উ" . জাগ্রত অবস্থায় চৈতন্যের  খেলা চলে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে, আর স্বপ্নাবস্থায় চৈতন্যের খেলা চলে অন্তরেন্দ্রিয় মনের মাধ্যমে। 
--------------------

মাণ্ডুক্য উপনিষদ শ্লোক নং ০১/০৫

"যত্র সুপ্তো ন  কঞ্চন কামং কাময়তে ন কঞ্চন স্বপ্নং পশ্যতি তৎ সুষুপ্তম ।  সুষুপ্তস্থান একীভূতঃ প্রজ্ঞানঘন এব  আনন্দময়ো  হি আনন্দভুক চেতমুখঃ প্রাজ্ঞঃ তৃতীয়ঃ পাদঃ । "(০১/০৫) 

স্বপ্নহীন  গভীরঘুমের অবস্থায় যখন মনের মধ্যে  কামনা বাসনা সুপ্ত থাকে, মন নিষ্ক্রিয় হয়ে অবস্থান করে, সেই অবস্থাকে বলা হয় সুষুপ্তি। সুসুপ্তির অবস্থায় মনের সঙ্গে আত্মার মিলন হয়, তখন কেবল ঘনীভূত চৈতন্য।  আর কিছুই থাকে না। এই ঘনীভূত চৈতন্য-এর স্বরূপ হচ্ছে আনন্দ। এটি তুরীয় অবস্থার নিকটবর্তী -চেতমুখঃ । এই অবস্থাকে বলা হয় প্রাজ্ঞ, যা আত্মার তৃতীয় অবস্থা। আত্মা এখানে আনন্দভূক। 

জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি এই তিন অবস্থা সম্পর্কেই  আমাদের একটা অভিজ্ঞতা আছে। জাগ্রত ও স্বপ্ন অবস্থা অর্থাৎ এই যে স্থূল জগৎ (যা আমরা জাগ্রত অবস্থায় অনুভব করে থাকি) ও অনুরূপ একটা সূক্ষ্ম জগৎ (যা আমরা স্বপ্নাবস্থায় অনুভব করে থাকি),  তা আমরা ওই  অবস্থা থেকে ফিরে এসে রোমন্থন করতে পারি। কিন্তু সুসুপ্তির অবস্থায় কি ঘটে থাকে তা আমরা মনে  করতে পারি না।  আসলে সুসুপ্তির অবস্থায় থাকে কেবল চৈতন্য, যা বিষয় রহিত। এই যে চৈতন্যের কথা বলা হলো এটি কিন্তু আমাদের জাগ্রত অবস্থায় আছে, স্বপ্নাবস্থায়ও আছে, কিন্তু তা বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত।  কিন্তু সুসুপ্তির সময় চৈতন্য বিষয় রহিত হওয়ায়, তখন কোনো বিষয় বোধ থাকে না। চৈতন্য হচ্ছেন দ্রষ্টা, কিন্তু যেখানে দৃশ্য নেই, সেখানে কেবলই  চৈতন্যের প্রকাশ। 

মাণ্ডুক্য উপনিষদ - আগম  প্রকরণ - শ্লোক-০৫-০৬

এই অবস্থাটা বোঝা আমাদের পক্ষে একটু কষ্টকর। ধরুন অমাবশ্যার রাত, ঘরের মধ্যে গাঢ় অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তো ঘনীভূত অন্ধকারে সব যেন একাকার মনে হয়। ঘন অন্ধকারে ভিন্ন ভিন্ন  বস্তু বা পদার্থের মধ্যে পার্থক্য করতে পারি না। যখন আলোর মধ্যে এলাম, বা আলো জ্বালালাম, তখন আমি চেয়ার, টেবিল, বিছানা, আলমারীকে আলাদা ভাবে দেখতে পেলাম।  যতক্ষন ঘন অন্ধকার ছিল, ততক্ষন আমার কাছে ঘরের মধ্যে সব কিছুই যেন এক বলে মনে হচ্ছিলো। সব আছে, জগৎ আছে, চেয়ার টেবিল আছে, কিন্তু অন্ধকার এমনভাবে আমাকে চেপে বসেছে, যে আমি আর কাউকে আলাদা করতে পারছিলাম না। আমার মধ্যে জগতের বস্তুগত অনুভূতি তখন লোপ পেয়েছে। এইসময় আমাদের মধ্যে একটা ভয় কাজ করে। আর এই যে ভয় এটি  জ্ঞানের বা আলোর অভাবে হয়ে থাকে। ঠিক তেমনি  সুষুপ্তি হচ্ছে এমন একটা  অবস্থা যেখানে কেবলমাত্র চৈতন্য অবস্থান করছে, এখানে জগৎ লোপ পেয়ে গেছে। আসলে  জগতের জায়গায় জগৎ আছে, কিন্তু আমার অনুভূতিতে নেই।  এই সুষুপ্তি থেকে যখন আমরা  আবার জেগে উঠি, তখন একটা আনন্দানুভূতির রেশ থেকে যায়। অন্ধকারে যেমন অকারনেই আমাদের ভয় করে, তেমনি সুসুপ্তিতে আমাদের অকারনেই আনন্দ হয়। আবার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলে যেমন ধীরে ধীরে আমাদের ভয় কেটে যায়,  এবং স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসি, তেমনি সুষুপ্তি থেকে জেগে উঠে আমরা আবার নিজেকে জগতের সঙ্গে  মানিয়ে নেই।  পূর্বাবস্থায় ফিরে আসি। 

এই যে সুসুপ্তির অবস্থা এঁকে উপনিষদের ঋষি বলছেন, চেতমুখঃ।  অর্থাৎ চেতন ভান্ডারের মুখ।  অর্থাৎ এখান  থেকেই যেন চেতনা স্ফূরিত হচ্ছে, বা বেরিয়ে  আসছে এবং স্বপ্ন ও  জাগ্রত  অবস্থাযা এসে অনুভূতি  গ্রহণ করছে, অর্থাৎ ভোগ সম্পাদন করছে ।  তো চৈতন্য যখন সুসুপ্তির মধ্যে ছিল, তখন কোনো দ্বৈত ভাব ছিল না, কিন্তু একটা অনুভূতি ছিল, আর তা হচ্ছে আনন্দ। এইজন্য এই অবস্থায় আত্মাকে  বলা হচ্ছে আনন্দভূক। তো আত্মা  জাগ্রত অবস্থায় স্থূলভূক, স্বপ্নাবস্থায় প্রবিবিক্ত ভূক বা সূক্ষ্মভূক, আর সুসুপ্তির অবস্থায় আনন্দভূক। 

এখন কথা হচ্ছে, এই সুসুপ্তির অবস্থায় আমরা কেবল মাত্র আনন্দ ভক্ষণ করি।  তাহলে তো এখানে আমরা দীর্ঘকাল  থাকতে পারি।  এই গাঢ়  ঘুম থেকে কে আমাদের জাগিয়ে তোলে ? এই অবস্থা থেকে জাগিয়ে তোলে আমাদের অজ্ঞান বা অবিদ্যা। আরো একটা কথা হচ্ছে, এই যে আনন্দ এটি কিন্তু চিরস্থায়ী আনন্দ নয়, আনন্দের একটা স্ফুলিঙ্গ মাত্র । এইজন্য আমরা সুসুপ্তিতে আমরা বেশিক্ষন থাকতে পারি না। এই সুসুপ্তির অবস্থাতেও আমাদের  অজ্ঞান থাকে । যার জন্য আমরা ঘুম থেকে জেগে উঠে আবার এই অজ্ঞানরূপ মায়ার সংসারে বদ্ধ হয়ে যাই। কখনো সুখ, আবার কখনো দুঃখের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি। তো যার মধ্যে ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে, অর্থাৎ উচ্চকোটির যোগীপুরুষগন যখন ধ্যানের গভীরতার মধ্যে ডুবে থাকেন, তখন এই আনন্দকে তাঁরা দীর্ঘায়িত করে অবস্থান করেন। পরম-আত্মার এই তৃতীয় অবস্থাকে অর্থাৎ সুসুপ্তির অবস্থাকে বলা হচ্ছে ওঙ্কারের তৃতীয় পাদ "ম".

তো প্রথমে আমরা স্থূল শরীরে, জাগ্রত অবস্থায় বাহ্য জগতের উপলব্ধি করি। দ্বিতীয় অর্থাৎ স্বপ্নাবস্থায় আমরা সূক্ষ্ম  মানসিক শরীরে সূক্ষ্ম জগতের অনুভব করি।  এবং সুসুপ্তিতে আমরা কারন শরীরে আনন্দ জগতের বাসিন্দা হয়ে যাই। এই হচ্ছে আত্মার তিন-অবস্থা। 
------------------------- 

মাণ্ডুক্য উপনিষদ শ্লোক ০১/০৬

এষ সর্বেশ্বর এষ  সর্বজ্ঞ এষ অন্তর্যামী এষ যোনিঃ সর্বস্য প্রভব-অপ্যয়ৌ হি ভূতানাম। (০১/০৬) 

এষ অর্থাৎ আগে যে আমরা তিনপাদের কথা শুনেছি, এই তিন পাদে যিনি অবস্থান করেছেন, তিনি সর্বেশ্বর, বা  ঈশ্বরেরও ঈশ্বর তিনিই সর্বজ্ঞ, তিনিই অন্তর্যামী। তিনিই যোনী অর্থাৎ কারন বা উৎপত্তি স্থান আবার লয়ের স্থান।প্রভব-অপ্যয়ৌ অর্থাৎ জন্ম ও মৃত্যুর  কারণ । ভূতানাম অর্থাৎ সর্ব্ব ভূতের কারন স্বরূপ  বর্ধনশীল ও বিনাশকারী। 

তো প্রথমে আমরা জাগ্রত অবস্থায় বৈশ্বানর, পরে স্বপ্নাবস্থায় তৈজস, শেষে সুসুপ্তির অবস্থায় প্রাজ্ঞ নামে আত্মার উপস্থিতির কথা শুনেছিলাম। এই তিন অর্থাৎ বৈশ্বানর, তৈজস ও প্রাজ্ঞ এই তিন নামই এক পরমাত্মার  নাম। এখন কথা হচ্ছে, এই যে বৈশ্বানর ইনি আমাদের বহিরেন্দ্রীয়ের  দ্বারা স্থূল জগতের বিষয়কে  ভোগ করেন, স্বপ্নাবস্থায় তৈজস ইনি মন নামক অন্তরেন্দ্রীয়ের দ্বারা সূক্ষ্ম জগতের বিষয় ভোগ করেন, কিন্তু সুসুপ্তির অবস্থায় প্রজ্ঞা কার দ্বারা আনন্দকে ভোগ করেন ? উপনিষদ বলছেনা, এই আনন্দ কোনো কিছুর উপরে নির্ভরশীল নয়, তাই এই আনন্দ ভোগের জন্য বাহ্য  বা অন্তর ইন্দ্রিয়ের প্রয়োজন হয় না। 

মাণ্ডুক্য উপনিষদ - আগম  প্রকরণ - শ্লোক-০৬-০৭

আত্মাই যেহেতু সমস্ত জ্ঞানের উৎস তাই তিনি সর্বজ্ঞ । তিনি সকলের  অন্তরে স্থিত, হয়ে দ্রষ্টা স্বরূপ অবস্থান করছেন, তাই তিনি অন্তর্যামী। এই আত্মাই সর্বস্য যোনি অর্থাৎ সমস্ত কিছুর কারন বা উৎস। এই আত্মাই সমস্ত বস্তুর উৎপত্তি ও বিনাশের বা জন্ম মৃত্যুর কারন।  আবার জন্মের আগে, এবং জন্মের পরে যেহেতু এই আত্মাতেই সবকিছু বিলীন হচ্ছে তাই তিনি ভূতানাম। 

এখন কথা হচ্ছে, আমরা সবাই সেই আত্মা থেকে এসেছি, আবার আত্মাতেই ফিরে যাবো। এমনকি আমি নিজে স্বয়ং আত্মা এই ব্যাপারটা আমরা বুঝবো কি করে ? এই প্রসঙ্গে উপনিষদের ঋষিগণ বলছেন, প্রথমে তুমি  তোমার নিজের অস্তিত্ত্বে বিশ্বাসী হও। নিজের দিকে তাকালে বুঝতে পারবে, প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল এই দেহ মনের একটা সত্ত্বা তুমি। যা কখনোই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। শিশু অবস্থায়, যে তুমি ছিলে যুবক অবস্থাতেও সেই একই তুমি আবার বৃদ্ধাবস্থাতেও সেই একই তুমি। তুমিই শিশু, তুমিই যুবক, আবার তুমিই বৃদ্ধ। এই যে তিন অবস্থার তুমি ইনি কে ? একি কেবলই তোমার ব্যক্তি সত্ত্বা ? না অভিন্ন কোনো সত্ত্বা যা সমস্ত জগৎ ব্যাপী, আবার সমস্ত ব্যক্তি সত্ত্বার মধ্যে বিরাজকারী একজন অপরিবর্তনীয় নিত্যসত্ত্বা। যদি এই নিত্য সত্ত্বাকে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনীয় সত্ত্বা থেকে  আলাদা করতে পারো, তবে তুমি সেই পরম-সত্ত্বার সন্ধান পেতে পারো। আর তখন বুঝতে পারবে এই নিত্যসত্ত্বা দুটি নয়, একটি। আর এই একটি সত্ত্বাই সবার মধ্যে বিরাজ করছে। তখন তোমার মধ্যে থেকে ভেদবুদ্ধি চলে যাবে। তখন জীবাত্মা ও পরমাত্মা যে এক, সেই  উপলব্ধিতে  তুমি  উদ্বেল হয়ে সমস্ত সুখ-দুঃখের পারে, আনন্দ সাগরে ভাসতে পারবে। এই কথাগুলোই উপনিষদের ঋষিগণ আমাদের মনের মধ্যে মনন করবার জন্য, সত্যকে উপলব্ধি করাবার  জন্য  বারবার একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন।
--------------  

"ন অন্তঃ প্রজ্ঞং ন বহিঃ প্রজ্ঞং ন উভয়ঃ  প্রজ্ঞং ন প্রজ্ঞানঘনং ন প্রজ্ঞং ন অপ্রজ্ঞম। অদৃষ্টম অব্যবহার্যম অগ্রাহ্যম অলক্ষণম অচিন্তম অব্যাপদেশ্যম একাত্ম প্রত্যয়সারং  প্রপঞ্চ উপশমং  শান্তং শিবম অদ্বৈতং চতুর্থং মন্যন্তে স আত্মা স বিজ্ঞেয়ঃ।"  (০১/০৭) 

তুরীয় অবস্থায় যে পরমাত্মা তিনি অন্তরস্থ অর্থাৎ স্বপ্নাবস্থার ঘটনা সম্পর্কে সচেতন নয়, আবার বাইরের জগতের ঘটনা সম্পর্কেও সচেতন নন, অর্থাৎ  এই  দুই অবস্থার ঘটনা সম্পর্কেও সচেতন নন। আবার  সুসুপ্তির  অবস্থার  প্রজ্ঞা তিনি  নন আবার "ন  অপ্রজ্ঞং" অর্থাৎ অসচেতনও  নন।  

তিনি অদৃষ্ট, অর্থাৎ দৃষ্টির অগোচর, ব্যবহারের যোগ্য নন, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নন,  তিনি সকল জ্ঞানের অতীত বা অলক্ষনম অর্থাৎ তার কোনো লক্ষণ বা উপাধি নেই , তিনি চিন্তার অতীত, তিনি  বর্ণনার অতীত। এক আত্মাই সার।  এই  ভৌতিক  জগতের তখন অবসান হয়। এখানে শান্তি, শিবম অর্থাৎ সর্বমঙ্গলময়, অদ্বিতীয়  চৈতন্য থাকে এই চতুর্থ বা তুরীয় অবস্থায়। প্রাজ্ঞ ব্যক্তি এই তূরীয়কেই  আত্মা বলে জানেন। এই আত্মাই একমাত্র জ্ঞানের বিষয়। 
তাঁকেই, একমাত্র  তাঁকেই  জানতে হবে অর্থাৎ কেবল পরমাত্মাকে  উপলব্ধি করতে হবে। এই হচ্ছে সাধকের উদ্দেশ্য। পরমাত্মার সম্পর্কে  কোনো কথা না  বলাই শ্রেয়। জাগ্রত অবস্থায় যিনি বহিঃপ্রজ্ঞং , স্বপ্নাবাস্থায় যিনি  অন্তঃপ্রজ্ঞং,  সুষুপ্তির অবস্থায় যিনি  প্রজ্ঞানঘনং,  আবার পরমআত্মা এই তিন অবস্থার উর্দ্ধে তিনি "একাত্মপ্রত্যয়সারং" - আমাদের অহংবোধ। 
কিন্তু আমাদের এই যে অহংবোধ এতো আমাদের দেহ মনের সঙ্গে অভিন্ন। এই দেহ-মন চলে গেলে আমাদের এই অহং থাকে কোথায় ? নাকি আমাদের দেহ-মন চলে গেলে, আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না ? উপনিষদের ঋষিগণ বলছেন, তুমি ব্রহ্ম, আমি ব্রহ্ম, আমরা সবাই ব্রহ্ম। সবাই আমরা এই অহং-এর আশ্রয়ে আছি।  আমার এই অহংবোধ চলে গেলে, আর কিছু থাকে না। আমরা যখন সব কিছুকে ছেড়ে এই অহংকে আশ্রয় করতে পারি তখন, কেবল একটাই সত্ত্বা থাকে আর তা হচ্ছে অহং। মহৎ-অহং, সমষ্টি  অহং, নাম রূপ বর্জ্জিত কেবলই অহং। অহং যখন দেহ-নাম-রূপ-বস্তু কেন্দ্রিক ততক্ষন এই অহং-এর মধ্যে ভিন্নতা।  যখন এই দেহ-নাম-রূপ-বস্তু-বিষয় বর্জ্জিত হবে, তখন যে অহং থাকবে, তা বিশ্বব্যাপী একটাই সত্ত্বা। 

একেই উপনিষদের ঋষিগণ  "একাত্মপ্রত্যয়সারং" - একত্ববোধ। তখন কেবল শান্তম, শিবম, অদ্বৈতম, অর্থাৎ শান্তি, আনন্দ, এবং একত্মবোধ। একেই বলে পরমাত্মার চতুর্থ অবস্থা - তুরীয় অবস্থা - ত্রিমাত্রা যুক্ত ওঙ্কার। 

এই অবস্থায় প্রপঞ্চের উপশম হয় - প্রপঞ্চ - উপশমং - প্রপঞ্চ হচ্ছে মায়া। মায়া রূপ পঞ্চভূতের দ্বারা গঠিত এই যে জগৎ তাকে উপেক্ষা বা অস্বীকার করতে পারলেই আমরা এই অদ্বৈত সত্ত্বাকে উপলব্ধি করতে পারি। 

মাণ্ডুক্য উপনিষদ - আগম  প্রকরণ - শ্লোক - ০৭-০৯

ঋষি বলছেন, "সঃ বিজ্ঞেয়" - এঁনাকেই জানাতে হবে, ইনিই জানবার একমাত্র বিষয়।  ইনিই আত্মা, পরমাত্মা। এখন  কথা হচ্ছে, জানতে তো হবে, জানবে কে ? আত্মা যদি একমাত্র জ্ঞেয় বস্তু হন, তবে জ্ঞাতা কে হবে ? আসলে জানবার কিছু নেই, কেবল অজ্ঞানকে দূর করতে হবে। লোকে বলে অন্ধকার দূর করতে গেলে, আলো  জ্বালতে  হবে।  পন্ডিতরা বলেন, অজ্ঞানকে দূর করতে গেলে, জ্ঞানের আলো  জ্বালতে  হবে।  উপনিষদের ঋষিগণ বলছেন, আলো  নিভিয়ে দাও,  এই আলো তো কৃত্তিম, অন্ধকারই সত্য। অন্ধকারই অসীম। আলো সীমাবদ্ধ। আমরা যাকে  জ্ঞান বলি, তা তো বিষয় নির্ভর অজ্ঞান মাত্র। এই অজ্ঞানের আলোটাকে নিভিয়ে দিলেই সত্য উদ্ভাসিত  হবে। জ্ঞাতা, জ্ঞেয়, জ্ঞান এই তিনিই এক। ব্রহ্ম সেই একজনই যাঁকে  তোমরা খুঁজছো। ব্রহ্ম স্বয়ং তুমি যাঁকে তুমি খুঁজছো। বহির্মুখী দৃষ্টি অন্তর্মুখী হোক, আর নিজেকে জেনে সুখী ভব। 

তো আমরা চারটি অবস্থার কথা শুনলাম, প্রথম তিনটি হচ্ছে বিশ্ব, তৈজস, ও প্রাজ্ঞ, চতুর্থটি হচ্ছে নিরপেক্ষ, বা তুরীয়। প্রথম তিনটি অজ্ঞানের অবস্থা। চতুর্থ অবস্থা হচ্ছে চৈতন্য স্বরূপ। এই অবস্থায় আনুষঙ্গিক সমস্ত বিষয় দূরীভূত হয়ে যায়।  

সুষুপ্তি ও তুরীয় অবস্থার মধ্যে পার্থক্যটা আরো একবার বুঝবার চেষ্টা করি। জাগতিক অবস্থায়, আমাদের দেহ মন ইন্দ্রিয়সকল সক্রিয় থাকে, স্বপ্নাবস্থায় আমাদের দেহ  নিষ্ক্রিয় থাকে কিন্তু অন্তর-ইন্দ্রিয় মন সক্রিয় থাকে। সুসুপ্তির অবস্থায় দেহ-মন-ইন্দ্রিয় সবকিছু নিষ্ক্রিয় হয়ে অবস্থান করে। কিন্তু এই  সুসুপ্তির অবস্থায় আমরা অচেতন হয়ে পড়ি। অর্থাৎ অজ্ঞান থাকি, একটু ঘুরিয়ে বলা যায়,  আমাদের চৈতন্য বলে কিছু থাকে না। যার জন্য আমরা যখন আবার  ঘুম থেকে জেগে উঠি, তখন পূর্বাবস্থায় ফিরে যাই। অর্থাৎ বদ্ধ অবস্থায় ফিরে যাই। কিন্তু তুরীয় অবস্থায় আমাদের এই অজ্ঞানতা থাকে না। তাই বলে কি জ্ঞান হয়, না তাও নয়, তখন না জ্ঞান না অজ্ঞান, তখন নিরপেক্ষ দ্রষ্টা মাত্র। তখন একটা অদ্বিতীয় স্বতন্ত্র অবস্থা। তখন  তুমি সেই অপরিবর্তনীয় নিত্য-সত্য স্বরূপ। যার কথা আমরা আগে শুনেছিলাম।  তখন তুমিই সর্বজ্ঞ পুরুষ। তখন একটাই বোধ  তা হচ্ছে আমিই অভিন্ন আত্মা যা সকলের মধ্যে বিরাজ করছে। তুরীয় অবস্থায় কেবলই জ্ঞান, না জ্ঞাতা  না জ্ঞেয়।  এই অবস্থা কার্য কারনে অধীন নয়। আর সমস্ত অবস্থাই কার্য কারনে অধীন। 

এখন কথা হচ্ছে এই তুরীয় অবস্থাই  যদি আমাদের লক্ষ্য হয়, তবে সেখানে যাওয়া  কিভাবে সম্ভব ? এই পথে যেতে বাধা কি ? এসব কথা আমরা ধীরে ধীরে শুনবো, উপনিষদের ঋষিগণের কাছ থেকে। 

------------------- 
মাণ্ডুক্য উপনিষদ - আগম  প্রকরণ - শ্লোক - ০৮-১১
        
সঃ অয়ম  আত্মা অধ্যাক্ষরম ওঙ্কার অধিমাত্রম পাদা মাত্রা মাত্রাশ্চ পাদাঃ  অকার উকারো  মকার  ইতি। (০১/০৮)

এই অধি-অক্ষর ওঙ্কারই আত্মা। মাত্রাগুলো তাঁর  পাদ (জাগ্রত-স্থান - বৈশ্বানর, স্বপ্ন-স্থান তৈজস, সুষুপ্ত-স্থান  প্রাজ্ঞ)। অর্থাৎ আত্মার পাদসমূহ ওঙ্কারের মাত্রা। অকার উকার মকার  এরাই প্রণবের মাত্রা।

তিন মাত্রাযুক্ত ওঙ্কার পরমেশ্বর বাচক। ওঙ্কার যেমন তিন মাত্রার উচ্চারনে পরে নিজেকে পূর্ণ করেন, বা যথার্থ ভাবে ধ্বনিত হন । তেমনি পরমাত্মা তিন অবস্থার পারে এসে প্রকৃত অবস্থায় অবস্থান করেন। অর্থাৎ তুরীয় অবস্থা আত্মার প্রকৃত অবস্থা।   


"জাগরিত স্থানো বৈশ্বানর অকারঃ প্রথমা মাত্রা আপ্তেঃ আদিমত্বাৎ বা অপ্নোতি হ বৈ সর্বান কামান আদিঃ চ ভবতি যঃ এবং বেদ । " (০১/০৯) 

জাগ্রত অবস্থায় বৈশ্বানর রুপি "অ" প্রথম মাত্রা কারন এটাই প্রথম।  বৈশ্বানর ও অ-বর্ণ দুটোই সর্বব্যাপী। যার এই নিশ্চিতজ্ঞান হয়েছে, তিনি সমস্ত কাম্য বস্তু পেয়েছেন, এবং তিনি সমস্ত কাম্যবস্তু লাভ করে সর্ব মান্যতা লাভ করেন। 

"অ" বর্ণটি জাগ্রত অবস্থায় বৈশ্বানর। সব শব্দের  মধ্যে যেমন আছে অকার, সব বর্ণের প্রথমে আছে যেমন অকার, তেমনি বিশ্বের মধ্যেই প্রথম ব্যাপক সেই ঈশ্বরের অবস্থান। এইজন্য ঋষিগণ প্রথমে বিশ্বকেই (স্থূল জগৎ) জ্ঞাত হতে বলছেন। আর এই বিশ্বকে সম্যকরূপে জ্ঞাত হতে পারলে, তিনি জাগতিক সমস্ত কামনা বাসনা পূরণে সক্ষম হন।  আর এই পুরুষই জগৎ সংসারে শ্রেষ্ঠ হয়ে থাকেন। সবার কাছে তিনি মান্যতা পান। দেখুন নাম ও নামি একই, তেমনি প্রতীক ও যাঁর  প্রতীক, এই দুইই এক ও অভিন্ন। তো বৈশ্বনারের প্রতীক যেহেতু অকার,  তাই এই অকার ও বৈশ্বানর  এক এবং অভিন্ন। এই জ্ঞান যার হয়েছে, তিনিই আপ্তকাম পুরুষ। ইনি  সকলের মধ্যে প্রধান ও সর্বমান্য হয়ে থাকেন।    
----------

"স্বপ্নস্থানঃ তৈজস উকারো দ্বিতীয়া মাত্রা উৎকর্ষাৎ উভয়ত্বাৎ উৎকর্ষতি হ বৈ জ্ঞান সন্ততিম সমানঃ  চ ভবতি ন  অস্য ব্রহ্মবিৎ কূলে ভবতি য এবং বেদ। " (০১/১০) 

স্বপ্নস্থান তৈজস হচ্ছে ওঙ্কারের দ্বিতীয় মাত্রা উ-কার। যিনি এইরূপ জানেন, তিনি অবশ্যই জ্ঞানের পরম্পরাকে উন্নত করেন , এবং সাম্য ভাব যুক্ত হন। এনার  বংশে অব্রহ্মবিৎ জন্মান না। 

উকার হচ্ছে তৈজসের প্রতীক। এই উকার ওঙ্কারের মধ্যবর্তী অক্ষর। আমাদের বিজ্ঞানময় শরীর  যেমন  অপার্থিব, কিন্তু পার্থিব ও অপার্থিব শরীরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, তেমনি উকার,  অকার (বিশ্ব) ও মকার (প্রজ্ঞা) এই উভয়ের মধ্যবর্তী হয়ে, দুয়ের সঙ্গেই যোগাযোগ রক্ষা করছেন। যার মধ্যে এই জ্ঞান হয়েছে, বুঝতে হবে তাঁর বোধশক্তি, বিচারশক্তি তীক্ষ্ণ। তিনি জাগ্রত  ও সুসুপ্তির পার্থক্য ধরতে পেরেছেন। তাঁর অনুভূতিতে ব্রহ্ম ধরা পড়েছে। উপনিষদ বলছেন, এই ব্রহ্মবিদের কূলে কখনো অব্রহ্মবিদ জন্ম গ্রহণ করেন না। আসলে এই কথার মাধ্যমে ব্রহ্মজ্ঞানের প্রসংসা করা হয়েছে। এককালে এমনকি এখনো হয়তো বিদ্যা কেবলমাত্র বংশগত হয়ে থাকে।  কবিরাজের পুত্র কবিরাজ হন, পালের পুত্র পাল হন, গায়কের বংশে গানের কদর, তেমনি বিদ্বানের পুত্র বিদ্বান হয়ে থাকেন।  ঋষিকুল যেহেতু  বিদ্যাদানে বংশ পরম্পরাতে অধিক গুরুত্ত্ব দিতেন, তাই উপনিষদে এই ধারার সম্মতিসূচক বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।   

"সুষুপ্তস্থানঃ প্রাজ্ঞো মকারঃ তৃতীয়া মাত্রা মিতেঃ অপিতের্বা মিনোতি  হ বা ইদং সর্বম  অপ্রীতিঃ চ ভবতি য এবং বেদ ।" (০১/১১) 

সুষুপ্তির অবস্থায় প্রাজ্ঞ হচ্ছে ওঙ্কারের তৃতীয় মাত্রা ম-কার। বৈশ্বানর ও তৈজসের কাল শেষ হলে ম-কার বা প্রাজ্ঞ অবস্থায়  আত্মার কারন শরীরের  মিলন  হয়।  এইরূপ যিনি জানেন, তিনি অবশ্যই সম্পূর্ণ কারন জগৎকে জানেন, এবং সবকিছু নিজের মধ্যে লীন করে নেন। 

সুষুপ্তি বা প্রাজ্ঞ অবস্থাকে, প্রতীক ওঙ্কারের ম-এর দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। তো বিশ্বজগৎ বা স্থূল জগৎ সূক্ষ্মের সঙ্গে বিলীন হয়, সূক্ষ্ম আবার কারনে সঙ্গে বিলীন হয়। এই কারন স্থির শান্ত। এখানে এসে দ্বৈত জ্ঞানের সমাপ্তি ঘটে থাকে।  অ  এবং উ  উভয় এখানে এসে ম-এর সঙ্গে বিলীন হয়।  মানুষ তৈজস অবস্থায় স্বপ্নের জগতে বিচরণ করে, জাগ্রত অবস্থায় স্থূল জগতের বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে, কিন্তু প্রাজ্ঞ বা সুসুপ্তির অবস্থায় মানুষ মৃতবৎ হয়ে যায়।  তখন তার মধ্যে কোনো জ্ঞান থাকে না। এইসময় মানুষ কিছুই জানতে পারে না। কারন এইসময় মানুষের দেহ-ইন্দ্রিয়-মন সব নিষ্ক্রিয়  হয়ে থাকে।  তো ম-কার প্রাজ্ঞ অবস্থার প্রতীক। এই অবস্থায় না থাকে দৃশ্যের  অনুভূতি, না থাকে শব্দের অনুভূতি। সব তখন একাকার হয়ে অনুনাসিক হয়ে যায়। 
----------------- 

মাণ্ডুক্য উপনিষদ শ্লোক ০১/১২ অন্তিম শ্লোক।  

অমাত্ৰঃ চতুর্থ অব্যবহার্য্যঃ প্রপঞ্চ উপশমঃ শিবঃ অদ্বৈত এবম ওঙ্কার আত্মৈব সংবিশতি আত্মনা আত্মনং য এবং বেদ।  (০১/১২) 

আত্মার চতুর্থ অবস্থা অমাত্ৰ, (মাত্রাহীন, অর্থাৎ অসীম)।  ইনি  অব্যবহার্য্য অর্থাৎ ব্যবহারযোগ্য নয়। সেখানে প্রপঞ্চের উপশম হয়, অর্থাৎ জগৎ হারিয়ে যায়। শিবঃ অদ্বৈত অর্থাৎ অদ্বিতীয় শিবস্বরূপের   অবস্থা । এইরূপ ওঙ্কারই অদ্বৈত আত্মা ছাড়া কিছু নয়, যিনি এইভাবে জানেন, তিনি স্বয়ং পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যান, অর্থাৎ আর ফিরে আসেন না। 

মাণ্ডুক্য উপনিষদের এই শেষের পাঁচটি  শ্লোক ব্যাখ্যা শুধু দুরূহ নয়, অসম্ভব। এই জ্ঞান কেবলমাত্র উপল্বদ্ধির বিষয়। আসলে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে সবকিছুর বিচার করি। যা আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে কোনোদিন আসে নি, তার সম্পর্কে ধারণা করা  সম্ভব নয়। যিনি কোনোদিন রসোগোল্লার  খান নি, তাকে রসোগোল্লার রচনা পড়ে, রসোগোল্লার আস্বাদন করানো যাবে না। এর জন্য আমাদের সেই ময়রার কাছে যেতে হবে, যিনি শুধু রসোগোল্লা খেয়েছেন তাই নয়, তিনি এটি হাতে ধরে আপনাকে খাওয়াতেও পারেন। যার কোনোদিন পেটব্যথা হয়নি, তাকে কখনোই ভাষা দিয়ে পেটব্যথা বোঝানো সম্ভব নয়। "চীন চীন করে ব্যাথা করছে," এই  কথার  দ্বারা আসলে কিছুঁই  বোঝানো যায় না। তথাপি এর দ্বারা হয়তো কিছু বুঝি। ভাবের বিনিময় করি। এর বেশি কিছু নয়। 
আমরা জপ-ধ্যান করি।  বলা হয়, একলক্ষ বার  এই মহামন্ত্র  জপ করুন। এইবার এই একলক্ষ বার জপের পরে, কিন্তু সবার মধ্যে একই অনুভূতি হয় না। এই যে অনুভূতি এটি একাগ্রতার উপরে নির্ভর করে, সংস্কারের উপরে নির্ভর করে, এমনকি ঐকান্তিকতার উপরেও নির্ভর করে। আর এই যে একাগ্রতা, ঐকান্তিকতা, এসব বাইরে থেকে পরিমাপ করবার যন্ত্র এখনো আবিস্কার হয় নি।  তো যা ইন্দ্রিয়াতীত, যা বাক্য মনের অতীত, যা সীমাহীন, তাকে বাক্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায় না। 
 
আমরা এর আগেই শুনেছি, আত্মা  চতুষ্পাদ অর্থাৎ জাগ্রত অবস্থায় বৈশ্বানর, স্বপ্নাবস্থায় তৈজস ও সুসুপ্তির অবস্থায় প্রাজ্ঞ, এবং তুরীয় অবস্থায় শুদ্ধ চৈতন্য।  তেমনি ওঙ্কারের প্রথম যে তিনটি মাত্রা অর্থাৎ অ - উ - ম  এই তিনটি  হচ্ছে আত্মার প্রথম তিন পাদ। তুরীয় অবস্থাকে এই মাত্রার বাইরে রাখা হয়েছে, অর্থাৎ এই তুরীয় অবস্থা অমাত্ৰ। 

তো বিশ্ব  হলো প্রথম অবস্থা,  আবার বর্নমালার প্রথম অক্ষর, বলা হয়, এই প্রথম অক্ষরটি প্রতিটি বর্ণের মধ্যেই রয়েছে। "অ" হচ্ছে স্থূল জগতের প্রতীক। তাই অকার বা বিশ্ব সর্বব্যাপী। 
উ-আর হচ্ছে ওঙ্কারের মধ্যম মাত্রা। উ-কার হচ্ছে অ এবং ম এর মধ্যবর্তী অক্ষর। অর্থাৎ তৈজস বা স্বপ্নাবস্থা হচ্ছে প্রাজ্ঞ ও বৈশ্বানরের মধ্যবর্তী। আবার ম-কার বা আত্মার তৃতীয় অবস্থা হচ্ছে প্রাজ্ঞ যা আত্মার চূড়ান্ত নিষ্ক্রিয়  অবস্থা।
তো প্রথমে আমরা দেহ-মন-ইন্দ্রিয় দ্বারা সবকিছু উপলব্ধি করছিলাম। এর পরে স্বপ্নাবস্থায় এসে, দেহকে নিষ্ক্রিয় রেখে মন নামক অন্তর-ইন্দ্রিয়ের দ্বারা আমরা  সূক্ষ্ম জগতের সবকিছু  উপলব্ধি করতে  লাগলাম।  এর পরে কারন অবস্থায় চলে গেলাম।  এখানে সব কিছু স্থির হয়ে গেলো। এই ব্যাপারটা যেমন ব্যষ্টির ক্ষেত্রে সত্য, তেমনি সমষ্টির ক্ষেত্রেও সত্য। তো প্রথমে স্থূল সমস্ত-দেহ, তারপরে সমষ্টি-সূক্ষ্ম মন, তার পরে সমষ্টি-কারন শরীর  . এই তিন অবস্থার মধ্যে আমি আত্মা আছি। 

উপনিষদের ঋষিগন  বলছেন, যিনি এই জ্ঞানের অধিকারী হয়েছেন, তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয়। কারন কি ? কারন হচ্ছে, এই  অবস্থায় অদ্বৈতের অনুভূতি হয়। আর অদ্বৈতের অনুভূতি হলে, মানুষের মধ্যে থেকে ভেদ বুদ্ধি চলে যায়। যখন সব কিছুই আমি, যখন নিজেকে সমষ্টির মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিতে পারি, যখন স্থূল থেকে সূক্ষ্মে, সূক্ষ্ম থেকে কারনে নিজেকে নিয়ে যেতে পারি, তখন আমরা তুরীয় অবস্থার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাই। আপনি যত সুক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর অবস্থার মধ্যে যেতে পারবেন, বা বৃহৎ থেকে বৃহত্তর অবস্থার মধ্যে নিজেকে নিয়ে যেতে পারবেন , তত আপনার মধ্যে ভিন্নতা-বোধ দূর হতে থাকবে। আকাশের উপরে দিকে যত  উঠবেন, পৃথিবীর মানুষদের আর আপনি আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারবেন না। মানুষের অন্তরে যখন প্রবেশ করতে পারবেন, তখন আপনি সবার অন্তরস্থ হয়ে যাবেন। 

প্রণব বা ওঙ্কার হচ্ছে, পরমাত্মার স্বাভাবিক নাম। ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, "শব্দ জ্ঞানানুপাতী বস্তুশূন্যো বিকল্প"  - শব্দই জ্ঞানের অনুধাবনকরী। শব্দ থেকে জ্ঞানের উৎপন্ন হয়। কিন্তু বস্তুর অস্তিত্ত্ব যদি না থাকে, তাহলে বুঝতে হবে এই জ্ঞান ভ্রম ছাড়া কিছু নয়।  এখন পরম পুরুষ চৈতন্য স্বরূপ। তো চৈতন্য হলো পরমপুরুষেের স্বরূপ। জাগ্রত ও স্বপ্নের অভাবে যে অবস্থার জ্ঞান হয়, তাকে আশ্রয় করে যে বৃত্তি, তা হলো সুসুপ্তির নিদ্রা। এই সুসুপ্তির অবস্থায় যা থাকে তা হচ্ছে অজ্ঞান। এর পর অজ্ঞানও  যখন দূরীভূত হয়ে যায়, তখন আসে তুরীয় অবস্থা। এই তুরীয় অবস্থায় কেবল চৈতন্য বর্তমান থাকে। এখন প্রশ্ন হলো তাকে কিভাবে জানা যায় ? 

ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, "তস্য বাচক প্রণবঃ" - ঈশ্বর প্রণবের বাচ্য। এই বাচ্য কথাটার অর্থ হলো জ্ঞেয় বস্তু। তো প্রণব হচ্ছে জ্ঞেয়  ঈশ্বর। আবার প্রণবই জ্ঞেয়  বস্তুর অবগতি মাধ্যম। কঠোপনিষদে বলা হচ্ছে, এই ওঙ্কার উপাসনায় পুরুষ ব্রহ্মলোকে মহিয়ান হন।  (কঠোপনিষদ - ১/২/১৭) . তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হচ্ছে, "ওমিতি ব্রহ্ম" . আমরা যখন মাণ্ডুক্য উপনিষদ শুরু করেছিলাম, তখনও শুনেছি, "ওম ইতি এতৎ অক্ষরম ইদম"। 

তো আমরা বুঝি আর  না বুঝি, ওঙ্কার সাধনাই আমাদেরকে ব্রহ্ম উপলব্ধি এনে দিতে পারে - একথা আমাদের  মুনিঋষিগন বারবার ঘোষণা করেছেন।  এখন এই প্রণবের উপাসনা হবে কি ভাবে ? এর আভাস  আছে ঋষি পতঞ্জলির যোগদর্শনে। 

প্রণবের জপ হলো, প্রণবের অভিধেয় বাচ্য  ঈশ্বরের ভাবনা করা। "তজ্জপ তদর্থ ভাবনম।" (সমাধি - ২৮)  কোনো প্রাণীর গুনগত, রূপগত, আকারগত লক্ষণ দেখা যায়, তার চিত্তে আরোপিত ভাবনার উপরে। তো ঈশ্বর যিনি শুদ্ধ সত্ত্ব, যিনি দিব্য , পবিত্র, অমূর্ত মুক্ত পুরুষ, তাঁর  চিন্তন-মাধ্যম হচ্ছে ওঙ্কার। সাধক  যখন তার সার্বিক সত্তার চিন্তনে  ঈশ্বর-পুরুষের সত্তা আরোপিত করে, তখন সেই পরম-পুরুষের মধ্যে শুদ্ধত্ব, পবিত্রত্ব, দিব্যত্ব ইত্যাদি সত্তা সেই সাধকের মধ্যে আরোপিত হয়। আর এটি তখনই  সম্ভব যদি কিনা ওঙ্কার মন্ত্র জপের সময় মন্ত্রের লক্ষিত ঈশ্বরের মধ্যে নিস্কম্প দীপশিখার  মতো স্থির ভাবে চিন্তা করতে পারেন। 
-----------------
মাণ্ডুক্য উপনিষদের রহস্যঃ কথা এখানেই শেষ হলো।