ষোলো কলা কাকে বলে ? প্রশ্ন উপনিষদ : প্রশ্ন উপ: শ্লোক নং ০৬/০৪
ETERNAL PEACE SEEKER - SSPF
SASANKA SEKHAR PEACE FOUNDATION
Tuesday, 17 October 2023
ষোলো কালা কাকে বলে ? প্রশ্ন উপনিষদ : শ্লোক নং ০৬/০৪
ষোলো কলা কাকে বলে ? প্রশ্ন উপনিষদ : প্রশ্ন উপ: শ্লোক নং ০৬/০৪
Tuesday, 18 July 2023
শয়তানের সন্ধানে
Monday, 17 July 2023
মাণ্ডুক্য উপনিষদ রহস্যঃ
মাণ্ডুক্য উপনিষদ রহস্যঃ
শশাঙ্ক শেখর শান্তি ধাম
মঙ্গলাচরণ :
মনুষ্যদেহ ভিন্ন সাধন সম্ভব নয়। তাই মানব জীবন আমাদের কাছে, অতি মূল্যবান। আমাদের এই দেহকে ভালো করে জানতে হবে। আমরা জানি আমাদের এই দেহ কতকগুলো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সমাহার মাত্র । এই দেহকে শারীরবিদগন এক রকম ভাবেই দেখেছেন। অধ্যাত্ম পথের পথিকরা এই দেহকে অন্য ভাবে দেখেছেন। তারা মনে করেন, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অনুরূপ একটি ব্রহ্মান্ড, হচ্ছে আমাদের এই দেহ । আমরা আজ সেই কথাই শুনবো।
বাউল লালন ফকির বলছেন :
দেব-দেবতাগন / করে আরাধন / জন্ম নিতে মানবে।।
কত ভাগ্যের ফলে না জানি / মন রে পেয়েছো এই মানব তরণী।
বেয়ে যাও ত্বরায় সুধারায় / যেন ভারা না ডোবে।।
এই মানুষে হবে মাধুর্য-ভজন / তাইতো মানুষরূপ গড়লে নিরঞ্জন।
এবার ঠকলে আর না দেখি কিনার / অধীন লালন তাই ভাবে।।
বেশিরভাগ ধর্ম্মপ্রান মানুষ অল্পবিস্তর যোগের ক্রিয়া করে থাকেন। অর্থাৎ তাঁদের সাধনকেন্দ্র এই দেহ। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, জৈন, মুসলমান, সবাই কিঁছু না কিছু শারীরিক ক্রিয়া অবশ্যই করে থাকেন। অর্থাৎ দেহের মাধ্যমেই আমাদের সাধন ভজন। আমরা সবাই মনে করি, ঈশ্বর যেমন বাইরে আছেন বৃহৎ আকারে, তেমনি আমাদের দেহে আছেন ক্ষুদ্র আকারে । এই দেহের মধ্যেই আছেন পরমতত্ত্ব, বা পরমাত্মা। দেহের বাইরে যেমন আছে পঞ্চতত্ত্ব, সপ্তলোক, নদী, সাগর, দ্বীপ, পর্বত। তেমনি আমাদের শরীরকে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ বলে কল্পনা করা হয়েছে। তাইতো একটা প্রচলিত কথা আছে যে, যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাই আছে এই দেহ-ভান্ডে।
আমরা জানি আমাদের মেরুদণ্ডকে আশ্রয় করে, ছটি চক্র আছে। এর মধ্যে সবথেকে নিচে, যে মূলাধার চক্র আছে সেখানে কুণ্ডলিনী শক্তি, অর্থাৎ সৃষ্টিশক্তি সুষুপ্ত অবস্থায় আছেন। এই কুণ্ডলিনীকে প্রাণ-অপান বায়ুর সাহায্যে ক্রিয়া দ্বারা জাগ্রত করে, সুষুম্নার ভিতর দিয়ে উর্দ্ধগতি করাতে পারলে, সেই বায়ু সূক্ষ্ম অবস্থায় সহস্রারে অর্থাৎ পরমশিবের সাথে মিলিত হন । মানুষ তখন, ত্রিগুণাতীত ব্রাহ্মীস্থিতি লাভ করতে পারেন ।
তাই দেহকে অবলম্বন করেই সাধনা। তা সে হিন্দু, বৌদ্ধ, তান্ত্রিক, যোগী, বৈষ্ণব, বাউল, সুফি, যাই বলুন না কেন, সবাই এই দেহকে অবলম্বন করেই সাধনা করছেন। আমরা সবাই জানি, পঞ্চভূতের এই দেহ। এই পঞ্চভূত কি ভাবে আমাদের দেহে অবস্থান করছেন দেখুন।
ক্ষিতি অর্থাৎ কঠিন পদার্থ বা পৃথিবী : আমাদের শরীরে, অস্থি, চর্ম, নাড়ী, লোম ও মাংস এই পাঁচটি পৃথিবীর গুন্, বা বিকার অবস্থা।
অপ অর্থাৎ তরল পদার্থ বা জল : মল, মূত্র, শুক্র, শ্লেষ্মা ও শোনিত - এই পাঁচটি হচ্ছে জলের গুন্।
তেজ অর্থাৎ তাপ বা অগ্নি : ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা, মোহ, ক্ষান্তি (ক্ষমা বা তিতিক্ষা) - এই পাঁচটি হচ্ছে তেজের গুন্।
মরুৎ অর্থাৎ বায়বীয় পদার্থ বা বাতাস : বিরোধ, আক্ষেপন, আকুঞ্চন, ধারণ ও তৃপ্তি - এই পাঁচটি হচ্ছে বায়ুর গুন্।
ব্যোম অর্থাৎ বিশাল বা আকাশ : রাগ, দ্বেষ, মোহ, ভয় ও লজ্বা - এই পাঁচটি হচ্ছে আকাশের গুন্।
পঞ্চভূতের মধ্যে বায়ু প্রধান। তাই আমরা বায়ু সম্পর্কে এবার আমরা আরো একটু গভীরে যাবো। বায়ু দশ রকম বা বায়ুর দশটি গুন্ - প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান (এগুলো অর্থাৎ এই পাঁচটি আমরা জানি ) এছাড়া আছে, নাগ, কূর্ম, কৃকর অর্থাৎ কয়ার পাখি, দেবদত্ত্ব( দেবতাদের কর্তৃক প্রদত্ত্ব ) ও ধনঞ্জয় (যিনি ধনকে জয় করেছেন)। এই মোট দশটি বায়ুর গুন্। প্রাণবায়ু আমাদের হৃদয়ে অবস্থিত। অপান আমাদের গুহ্যদেশে। নাভিদেশে আছে সমান, কন্ঠে উদানবায়ু, এবং সর্বশরীরে ছড়িয়ে আছে ব্যানবায়ু। এই পাঁচটি বায়ু প্রধান। নাগ, কূর্ম, কৃকর, দেবদত্ত্ব ও ধনঞ্জয় - এগুলো আমাদের সমস্ত নাড়ীতে অবস্থান করে। অর্থাৎ আমাদের শরীরে যে ৭২০০০ নাড়ী আছে, তার মধ্যে অবস্থান করে। তবে প্রধানত পাঁচটি নাড়ী অর্থাৎ ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, বজ্রাক্ষ্যা ও চিত্রাণি এই পাঁচটি নাড়ীতে অবস্থান করে। কেউকেউ বলে থাকেন, ললাট, উরঃ, স্কন্ধ, হৃদয়, নাভি, ত্বক ও অস্থিতে এই পাঁচ নাগাদি বায়ু অবস্থান করে।
আমরা যে সাতটি তল ও লোকের কথা জানি, সেগুলোর অবস্থান এই রকম :
লোক :ভূর্লোক নাভিদেশে, ভুবর্লোক হৃদয়ে, স্বর্লোক আমাদের কন্ঠে, মহর্লোক আমাদের চক্ষুদ্বয়ে। ভ্রূদ্বয়ে আমাদের জনলোক, ললাটে তপোলোকে, সহস্রারে সত্যলোক।
তল:তল সাতটি। তাদের অবস্থান এই রকম : পাদের আধোভাগ হচ্ছে অতল, পাদের উর্ধভাগ হচ্ছে বিতল।জানুদ্বয়ে সুতল, সন্ধি-রন্ধ্রে হচ্ছে তল, গুদমধ্যে বা গুহ্যমধ্যে তলাতল, লিঙ্গমূলে রসাতল,পাদের অগ্রভাগ ও কটির সন্ধি-স্থলে পাতাল।
পর্বত :আমাদের মূলাধার চক্রে একটা ত্রিকোণ কল্পনা করা হয়েছে। এটি পর্বতের বিশেষ অবস্থান কেন্দ্র। ত্রিকোণের উর্দ্ধকোনে মন্দর পর্বত। ডানকোনে কৈলাশ পর্বত। বামকোনে হিমালয়। এছাড়া ত্রিকোণের উর্ধভাগে বিন্ধ্য ও বিষ্ণু পর্বত। এছাড়া আছে ত্রিকোণে মেরু পর্বত। এই মোট সাতটি পর্বতের অবস্থান কেন্দ্র।
দ্বীপ :আমাদের দেহের অস্থিতে অবস্থান করছে জম্বুদ্বীপ, মাংসে কুশদ্বীপ, শিরা সমূহে ক্ৰৌঞ্চদ্বীপ, রক্তে আছে শাকদ্বীপ। আমাদের শরীরের উর্ধভাগে সমস্ত সন্ধিদেশে শাম্বলি দ্বীপ, লোমপূর্ন স্থানে প্লক্ষদ্বীপ এবং নাভিতে পুস্কর দ্বীপ।
সমুদ্র :লবন সমুদ্র আমাদের মূত্র। শুক্র হচ্ছে ক্ষীরোদসাগর। মজ্জা হচ্ছে দধিসাগর। চর্ম হচ্ছে ঘৃতসাগর। বসা অর্থাৎ আমাদের অবস্থিতি বা আধার হচ্ছে জল সাগর। কটিরক্তে ইক্ষুসাগর। এবং শোনিতে সুরাসাগর অবস্থিত।
গ্রহ :নাদচক্রে সূর্য অবস্থিত। বিন্দুচক্রে চন্দ্র। মঙ্গল আছে আমাদের চক্ষুতে। হৃদয়ে আছে বুধ। পেটে বা উদরে আছে বৃহস্পতি। শুক্রে আছে শুক্রগ্রহ। নাভিচক্রে শনি, মুখে আমাদের রাহু আর নাভিতে কেতু।
ঈশ্বরের প্রকাশ স্বরূপ এই ব্রহ্মান্ড। আর এই ব্রহ্মান্ডের ক্ষুদ্র সংস্করণ হচ্ছে আমাদের এই মানবদেহ। এর মূল্যশুধু অসীম নয়, এটি একটি দুর্লভ বস্তূ। আমরা কেবল বাইরে আমার স্বামীকে খুঁজছি। স্বামীতো ঘরেই আছেন। অশরীরী আমাদের শরীরেই লুকিয়ে আছেন। এই দেহের মধ্যেই গঙ্গা-যমুনা। এখানেই মিলনক্ষেত্র গঙ্গাসাগর। এখানেই প্রয়াগ, হরিদ্বার, বারাণসী। এটাই তীর্থক্ষেত্র। এটাই পীঠস্থান। রত্নসার বলছে :
ভান্ডকে জানিলে জানি ব্রহ্মাণ্ডের তত্ত্ব।
ভান্ড বিচারিলে জানি আপন মাহাত্ম।
বহু ধর্মমতে আমাদের এই দেহের মধ্যেই ঈশ্বরের বাসস্থান কল্পনা করা হয়েছে। এটা শুধু কল্পনা নয়, এটি বাস্তব সত্য। প্রথম দিকে এই কল্পনা নিয়ে এগুতে হয়। ক্রমে ক্রমে এই সত্য সাধকের উপল্বদ্ধিতে আসে। এমনকি কিছু কিছু সূক্ষ্মতত্ত্ব সামনে আসে, যখন মনে ঈশ্বর সম্পর্কে দৃঢ়তা আসে। এমনকি ঈশ্বরের সঙ্গে একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রতিনিয়ত ঈশ্বরের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। সমস্ত সাধনাই আত্মউপলব্ধির সাধনা। এবং একমাত্র দেহকে অবলম্বন করেই আমরা স্থূল থেকে সূক্ষ্মে অগ্রসর হয়ে, সবশেষে আত্মার স্বরুপত্বে পৌঁছানো যায়। স্থুল থেকে সূক্ষ্মে অগ্রসর হওয়া মানে, সৃষ্টিধারার বিপরীত গতিতে অগ্রসর হওয়া। জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন দুটো ভাবে হতে পারে, এক যদি পরমাত্মা স্বেচ্ছায় জীবাত্মার কাছে আসেন, আর জীবাত্মা যদি তার গতি পরমাত্মমুখী করেন। তো দেহের সাধন দ্বারা মানুষের সহজাত স্বাভাবিক অবস্থা লাভ করা। এই অবস্থাতেই মানুষ ব্রহ্ম-স্বরূপত্ত্ব লাভ করে। তাই তন্ত্রমতে চক্রভেদ, বা পাতঞ্জল মতে অষ্টাঙ্গ যোগাভ্যাস, বেদান্তের পঞ্চকোষ-বিবেক সাধন, বৌদ্ধদের কায়-বাদ, বৈষ্ণবদের ভক্তিসাধন, বাউলদের সহজিয়া সাধন, মূলত একই পথের প্রকারভেদ মাত্র। তাই লালন বলছেন, একবার আপনারে চিনলে, পরে যায় অচেনারে চেনা।
Sunday, 9 July 2023
অন্ধকারে তাঁকে খুজবেন কি করে ? প্রশ্ন না জাগলে উত্তর পাবেন কি করে ?
ঈশ্বরকে কোথায় খুজবেন ? অন্ধকারের ধ্যান
মুক্তানন্দ গিরি মহারাজ বলছেন, পরব্রহ্মকে যদি পেতে চান, তবে অন্ধকারে খুঁজুন, আলোতে নয়। কিন্তু অন্ধকারে তাঁকে খুজবেন কি করে ?
আবার ঋষিগণ প্রার্থনা করছেন, অসতো মা সৎ গময় - তমসো মা জ্যোতির্গময়। - আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, এই জ্যোতি তো সসীম, সীমাবদ্ধ, - অসীমের খোঁজে অনন্তের খোঁজে জ্যোতিঃ কিভাবে আমাদের সাহায্য করতে পারে।
আসলে আমরা সব কিছুই আলোতে খুঁজতে চাই, কারন অন্ধকারকে আমরা ভয় পাই। অন্ধকারে আমরা কিছুই দেখতে পাই না। তাই আমাদের প্রার্থিত বস্তু, হোক না সে ঈশ্বর, যা অসীম, সীমাহীন, শ্বাশ্বত তাঁকেও আমরা সবাই আলোতেই খুঁজি। কিন্তু সত্য হচ্ছে, অসীম কখনো আলোতে পাবেন না। আলো কখনো শাশ্বত নয়। আলো একদিন না একদিন নিভে যাবে, অন্ধকার বেঁচে থাকবে। তাই সত্যকে খুঁজতে গেলে, আমাদের অন্ধকারকেই খুঁজতে হবে। আলো কখনোই সীমানা ছাড়িয়ে যেতে পারে না। আপনি হয়তো ভাবছেন, এমন কথা তো কখনো শুনিনি। অন্ধকারে আবার কাউকে খোঁজা যায় নাকি ? তবে শুনুন, যদি অন্ধকারকে আপনি খুঁজে না পান, তবে আপনি কোনো দিন সেই অসীমের খোঁজ পাবেন না। আর ঠিক এই কারণেই, যুগ যুগ ধরে, মানুষ যাঁকে খুঁজছে, তিনি অধরা থেকে যাচ্ছেন। আর সত্যিকারের যোগীগণ এই রাতের অন্ধকারে বসে ধ্যানস্থ হন। তো আসুন আজ আমরা অন্ধকারের খোঁজ করি।
কিন্তু কথা হচ্ছে, অন্ধকারের মধ্যে প্রবেশ করবেন কি করে ? অন্ধকারের মধ্যে প্রবেশ করা খুবই কঠিন। আলোর মধ্যে প্রবেশ করা সহজ। আলোর একটা উৎস আছে, তাকে লক্ষ করে এগিয়ে চলা যায়। কিন্তু অন্ধকারের কোনো উৎস আছে বলে আমাদের জানা নেই। তাই অন্ধকারে আমরা হারিয়ে যাই। আমাদের বাইরে আলো ফোয়ারা, অন্তরে, অন্দর-মহলে অন্ধকার জমাটবাঁধা । তাই আমরা বাইরে স্বচ্ছন্দ, কিন্তু ভিতরে যেতে ভয় পাই।
আজ আমরা অন্ধকারে পথ চলার প্রক্রিয়া সম্পর্কে শুনবো। আমাদের হারানো বস্তু যা অন্ধকারে লুকিয়ে আছে, তাঁকে আমরা খুঁজবো। আমরা অন্ধকারের মধ্যে প্রবেশ করবো।
প্রক্রিয়া - ১
আমরা জানি অন্ধকার সবত্র বিরাজ করছে। আলো বিশেষ অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আলোর সীমানা আছে, আলোর একটা উৎস আছে, আপনি সেই উৎসকে সামনে রেখে পথ চলতে পারেন। কিন্তু অন্ধকারের কোনো উৎস নেই, অন্ধকার সবত্র ছড়িয়ে আছে, অন্ধকার সীমাহীন । আপনি জানেন আর নাই জানেন, আপনার আমার সবার চারিদিকে কেবলই অন্ধকার। আর আলোর কারনে আপনি এই অন্ধকারকে দেখতে পারছেন না। বা অনুভব করতে পারছেন না। এই অন্ধকারের সিঁড়ি দিয়েই শূন্য পৌঁছনো যায়। আলোর সিঁড়ি দিয়ে কখনো অসীমে পৌঁছানো যায় না। কারন এক সময় আলো শেষ হয়ে যাবে, আর অন্ধকার শুরু হবে। অন্ধকার কখনো শেষ হবে না, তাই অন্ধকার আমাদেরকে মহাশূন্যে নিয়ে যেতে পারে। অসীমের কাছে নিয়ে যেতে পারে অন্ধকার।আলো পারে না। তো অন্ধকারে যিনি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না, তিনি অসীমের কাছে যেতে পারেন না।
অন্ধকার যেহেতু সর্বত্র বিরাজ করছে, আপনি এই অন্ধকারকে উদ্দেশ্যে করে তাকিয়ে থাকুন। আপনি শুধু দেখতে থাকুন . আপনি এই অন্ধকারকে অনুভবে আনবার চেষ্টা করুন। না চোখ বন্ধ করবেন না, চোখ খুলে আলোর পিছনের অন্ধকারকে দেখতে থাকুন। একটা সময় দেখবেন, আপনার চোখের আলো নিভে গেছে, চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। আপনি সত্যি সত্যি চোখে অন্ধকার দেখছেন। চোখ খোলা রাখুন। প্রথম দিকে এটি অন্ধকার রাত্রিতে, অন্ধকার ঘরে অভ্যাস করুন। চোখ বন্ধ করবেন না, কারন বাহ্য চক্ষু বন্ধ করলে, আপনি মনের চক্ষু দিয়ে দেখা শুরু করবেন। তাই চোখের পাতা বন্ধ করবেন না। চোখের পাতা খুলে রাখুন। এই যে চোখে আপনি অন্ধকার দেখছেন, এ কিছু সত্যিকারের অন্ধকার নয়, এই অন্ধকার কৃত্তিম, অন্ধকারের নেগেটিভ মাত্র।
এবার আপনি চোখ বন্ধ করুন, এবারেও আপনি অন্ধকার দেখবেন - কিন্তু এই অন্ধকার আসলে আলোর অভাবে হয়ে থাকে। এই অন্ধকার আসলে সত্যিকারের অন্ধকারের একটা নেগেটিভ মাত্র । আপনি যখন জানালার দিকে তাকাবেন, তখন আপনার চোখে জানালার একটা নেগেটিভ আপনার চোখের উপরে ভাসবে। আসলে আমাদের যা কিছু অভিজ্ঞতা তা এই আলোর কারনে ঘটে থাকে। তো যখন আমরা চোখ বন্ধ করি, তখন আলোর একটা নেগেটিভ আমরা অনুভব করি, যাকে আমরা বলি অন্ধকার।
এবার আবার চোখ বন্ধ করুন, এখন আপনার চোখের সামনে একটা অন্ধকার ভেসে উঠবে, এই অন্ধকার একটু আলাদা ধরনের। এবার এই অন্ধকারের সিঁড়ি দিয়ে নিজেকে বাইয়ে দিতে শুরু করুন। মনের মধ্যে কোনো ভাবনা চিন্তা রাখবেন না। কেবল অন্ধকারের সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে যান। একটা সময় আসবে, যখন সত্যিকারের অন্ধকার আপনার চোখের মধ্যে প্রবেশ করবে। এই অবস্থায়, আপনি নতুন একধরনের অনুভূতি পেতে থাকবেন। যখন সত্যিকারের অন্ধকার আপনার ভিতরে প্রবেশ করবে, তখন আপনি অন্ধকার দ্বারা পরিপূর্ন হয়ে যাবেন। যদিও যোগাচায্যগণ এই অন্ধকারের কথা বলেন নি। সত্যিকারের অন্ধকার আছে, এই যোগাচার্য্যের মধ্যে। তিনি একমাত্র এই অন্ধকারের মধ্যে বিচরণ করতে পারেন। আমরাও যখন যোগের মধ্যে প্রবেশ করবো, তখন এই অন্ধকারের আস্বাদন পেতে থাকবো।
আমরা অন্ধকারকে ভয় পাই, আমরা সবকিছু আলোর মধ্যে খুঁজে থাকি। আমরা আলোর মধ্যে সুরক্ষা খুঁজে পাই। যখন আমি চোখ বন্ধ করি, তখন অন্ধকারের একটা নেগেটিভ আমার মধ্যে ভেসে ওঠে। আমরা সত্যিকারের অন্ধকারের খোঁজ পাই না। আমরা অন্ধকার থেকে অনেক দূরে অবস্থা করি। এই অন্ধকারের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। অন্ধকারকে আমরা এতটাই ভয় পাই, যে যদি কখনো অন্ধকার আমাদের ঢেকে ফেলে, তখন আমরা দিশেহারা হয়ে যাই। আসলে আমরা সবাই অন্ধকারের পিছনে যে আলো আছে, তার মধ্যেই আমরা স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। আলো সব কিছুকে ব্যক্ত করে, আর অন্ধকার সবকিছুকে সুরক্ষিত রাখে। ব্যক্ত বস্তুর প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে, অব্যক্তের কোনো পরিবর্তন নেই। তাই অন্ধকারেই ঈশ্বর নিজেকে অপরিবর্তিত রেখেছেন। আমরা আলোতে ঈশ্বরকে খুঁজছি, আর ঈশ্বর বসে আছেন, অন্ধকারের মধ্যে।
তাই অন্ধকারে আমাদের পক্ষে প্রবেশ করা খুবই কঠিন। কিন্তু যদি আপনি এটা করতে পারেন, তবে একটা মিরাকেল ঘটে যেতে পারে আপনার সঙ্গে। আপনি তখন অন্য মানুষ হয়ে যাবেন। যখন অন্ধকার আপনার মধ্যে প্রবেশ করবে, আপনিও অন্ধকারের মধ্যে প্রবেশ করবেন। এই প্রক্রিয়া সবসময় পারস্পরিক সমন্ধবাচক। মহাজাগতিক রশ্মির মধ্যে তখনই আপনি প্রবেশ করবেন, যখন মহাজাগতিক রশ্মি আপনার মধ্যে প্রবেশ করবে। আপনি একে জোর করতে পারবেন না, আপনি এর মধ্যে জোর করে প্রবেশ করতেও পারবেন না। আপনার কাজ হচ্ছে শুধু নিজের মধ্যে একটা রাস্তা তৈরী করে রাখা, যাতে মহাজাগতিক রশ্মি আপনার মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। আপনি এই মহাজাগতিক রশ্মির মধ্যে জোর করে প্রবেশ করতে পারবেন না, কেবল মাত্র মহাজাগতিক রশ্মি যখন প্রবেশ পথ পাবে, তখন মহাজাগতিক রশ্মি আপনার মধ্যে প্রবেশ করবে, তখন আপনি সেই রশ্মিময় হয়ে উঠবেন। তেমনি আপনি যখন অন্ধকারময় হয়ে উঠবেন, তখন অসীমের মধ্যে নিজেকে উপলব্ধি করবেন আর আপনি তখন নির্বিকার যাবেন ।
দেখুন শহরের অলিতে গলিতে এখন আর অন্ধকার খুঁজে পাবেন না। এমনকি শহর থেকে এখন আর মুক্ত আকাশকেও আপনি দেখতেও পারবেন না। এই অন্ধকারকে খুঁজে পেতে গেলে আপনাকে চলে যেতে হবে, শহর থেকে দূরে কোনো গ্রামের প্রান্তরে, যেখানে আজও বিজলি বাতির সজ্জ্বা নেই। সেখানে এক/দুই সপ্তাহ থাকুন। অমাবস্যার আকাশে নিজেকে বিলিয়ে দিন। তখন আপনার অবচেতন মন থেকে অনেক কিছু উঠে আসবে, যা এতদিন লুকিয়ে ছিল। এতদিন যা মনের মধ্যে লুকিয়ে ছিলে তা বেরিয়ে আসবে। অমাবস্যার রাতে গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে যান। প্রত্যেক অমাবস্যার রাতে অন্ধকারের ধ্যানের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিন। এছাড়া প্রতিদিন গভীর রাতে অন্তত একঘন্টা ধ্যান করুন। এইভাবে অন্ধকারের সঙ্গে প্রতিদিন অন্তত একঘন্টা কাটান। তখন আপনি বুঝতে পড়বেন, কিছু একটা আপনার মধ্যে ঠুকছে, বা আপনি কোনো কিছুর মধ্যে প্রবেশ করছেন। এইভাবে তিন মাস প্রতিদিন গভীর রাতে একঘন্টার ধ্যান আপনার ব্যক্তিত্বকে পাল্টে দেবে - আপনি সব কিছু থেকে স্বতন্ত্র হয়ে যাবেন। আপনি নিজেকে একটা বিছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা বলে মনে করবেন। এমনকি নিজেকে যেন বিশাল গভীর সমুদ্রের মতো মনে হবে। অন্ধকারের সঙ্গে সমুদ্রের একটা সম্পর্ক আছে। গভীর অন্ধকারের নির্জন রাতে যদি কখনো সমুদ্রের সৈকতে একাকী এক ঘন্টা কাটান তবে একটা আলাদা অনুভূতি হবে। আপনার ভিতরে একটা পরিবর্তন হবে। তখন নিজেকে আর কাছের বলে মনে হবে না, মনে হবে আপনি যেন দূরে কোথাও হারিয়ে গেছেন।
প্রক্রিয়া : ২
বিছানায় শুয়ে পড়ুন। মনে মনে ভাবতে থাকুন, আপনি যেন অন্ধকার রূপ মায়ের কোলে শুয়ে আছেন। অন্ধকারকে নিজের মা ভাবুন। মনে মনে ভাবতে থাকুন এই অন্ধকার ছাড়া আপনার কাছে আর কিছু নেই। আপনি আর অন্ধকার। এই অন্ধকার হচ্ছেন মা, এই অন্ধকার হচ্ছে মায়ের গর্ভ। এই অন্ধকারই কেবল মাত্র সত্য। এইসব ভাবতে ভাবতে একসময় আপনি অনুভব করবেন যেন, আপনি অন্ধকারের গর্ভে একটা শিশু। অন্ধকার আপনাকে চারিদিক থেকে ঘিরে রেখেছে, ঢেকে রেখেছে, রক্ষা করছে ।
প্রক্রিয়া ৩ : আপনি চলছেন, ফিরছেন, খাচ্ছেন, এমনকি ঘুমিয়ে আছেন, সব সময় আপনার মধ্যে অন্ধকার বিরাজ করছে। অন্ধকারেই আপনি বাস করছেন, অন্ধকারেই আপনি প্রবেশ করছেন। অন্ধকার না থাকলে, আলোর কোনো দরকার হতো না। অন্ধকার আলোকে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পড়িয়েছে। চারিদিকে যেহেতু অন্ধকার তাই আপনি আলো নিয়ে চলতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। আলো আপনাকে কর্ম্মে উদ্যোগী করে তোলে। কিন্তু অন্ধকার আপনাকে বিশ্রামের মধ্যে নিয়ে যায়। আর এই কারণেই অধিকাংশ জীব অন্ধকারে গুমিয়ে পড়ে। অন্ধকার আপনাকে শান্তি এনে দেয়। আপনার হাতে আলো থাকলে, বা আপনি আলোর মধ্যে প্রবেশ করলে, অন্যেরা আপনাকে দেখতে পায়। . কিন্তু আপনি যদি অন্ধকারের মধ্যে প্রবেশ করেন, আপনি যদি অন্ধকারকে সঙ্গে নিয়ে চলেন, তবে আপনাকে কেউ দেখতে পাবে না। আপনি সুরক্ষিত থাকবেন। এমনকি আপনাকে সবাই এড়িয়ে চলবে। কেননা অন্ধকারকে কেউ সহ্য করতে পারে না। অন্ধকার তাদের কাছে অসহ্য।
আর যারা অন্ধকারের মধ্যে থাকেন, তারা অন্তর্নিহিত হয়ে থাকেন। কেননা, আমাদের বাইরেই যত আলো , আমাদের ভিতরটা অন্ধাকরময়। একটু মনের করবার চেষ্টা করুন, যে আপনি আপনার অন্তরে একটা ঘনীভূত অন্ধকারের মেঘ নিয়ে বিচরণ করছেন। তাহলে দেখবেন, আপনি সব সময় বিশ্রামের আনন্দ উপভোগ করতে থাকবেন। চেষ্টা করে দেখুন, তখন সব কিছু ধীর হতে হতে একসময় থেমে যাবে। আপনি আর দৌড়াতে চাইবেন না, আপনার গতি ধীর হয়ে যাবে, যেমন একজন গর্ভবতী মা করে থাকেন। এমনকি একসময় আপনার গতি থেমে যাবে। আপনি স্থির হয়ে যাবে। আত্মস্থ হয়ে যাবেন। আপনার তখন মনে হবে, আপনি একটা কিছু ভারীবস্তু বহন করছেন।
ঠিক এর উল্টোটা হবে, যখন আপনার হাতে আলোর প্রদীপ থাকবে। আলো আপনার গতি বাড়িয়ে দেবে। লোকে ভাববে, আপনি একটা অলস। কিন্তু আপনি তখন শান্তিতে বিরাজ করবেন।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
নিজেকে কেন্দ্রে নিয়ে যাও।
আমি যখন জন্মে ছিলাম, তখন সবাই হেসেছিলো, আর আমি কাঁদতে শুরু করেছিলাম। আমার কান্না সহজে থামে নি। এমনি করে আঠেরো বছর পর্যন্ত আমি কেঁদেছি। তারপর একদিন এক অদ্ভুত মানুষের সন্ধান পেলাম। আমাদের স্কুলের খেলার মাঠের পাশে বটগাছ তলায় বসে আছেন, এক অর্দ্ধ উলঙ্গ পাগলপ্রায় মানুষ, দেখছি তিনি কেবল হাসছেন, কোনো কারণ ছাড়াই। আর তাঁর সেই হাসির দৌলতে তাঁর ছোট্ট ভুড়িটাও দুলছে। তো আমি তাঁকে জিগেস করলাম, ব্যাপার কি, আপনি হাসছেন কেন ? সেখানে অন্য কোনো লোক ছিলো না, সেখানে কেউ কোনো হাস্যকৌতুক করছিলো না। কিন্তু তিনি হাসছেন। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, আপনি হাসছেন কেন ? তো তিনি বললেন, আমি সুখীরাম, আমিও তোমার মতো একদিন বিমর্ষ থাকতাম। সারাদিন আমার মুখ কালো থাকতো। তারপর একদিন নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, আরে দুঃখীরাম তুমি এতো দুঃখী কেন ? দুঃখীরাম বললো, এটা আমার পছন্দ। এই দুঃখী দুঃখী ভাবই আমার জীবন। আমি কাঁদতে ভালো ভাসি, তাই আমি কাঁদি। তো মনে মনে আমি ভাবলাম, দুঃখীরাম কাঁদতে ভালোবাসে, তাই সে কাঁদে, দুঃখীরাম যদি হাসতে ভালোবাসতো, তবে নিশ্চই সে হাসতো। আর তার নাম হতো সুখীরাম বা হাসিচরণ। এর পর থেকে প্রতিদিন সকাল বেলা ঘুম ভেঙে গেলেই, বিছানা ছাড়ার আগে, আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি, হ্যাঁ রে দুখিরাম, তুমি কি চাও ? দুঃখ না আনন্দ ? আজ তুমি কোনটা পছন্দ করবে ? এবং আমি দেখতাম, আমার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতো, একটাই কথা আর তা হচ্ছে আমি আনন্দ পেতে চাই। আনন্দই আমার পছন্দ। সেই থেকে আমি প্রতিদিন, প্রতিক্ষনে হাসি, আর হাসতে আমার ভালো লাগে। আমি অকারনেই হাসি। তাই আমাকে এখন লোকে হাসির বলে। সারাক্ষন হাসি, তাই লোকে আমাকে পাগল বলে। কিন্তু তাতে আমার কিছুই এসে-যায় না। আমি সদা আনন্দে থাকি। আনন্দে থাকতে আমি ভালোবাসি।
সুখীরাম বললেন, তুমিও চেষ্টা করে দেখো, সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানা ছাড়ার আগে, নিজেকে জিজ্ঞেস করো, ওহে, আবার একটা নতুন দিন এলো, তুমি কি সুখী হতে চাও, না দুঃখী হতে চাও ? তখন মন স্বভাবতই বলে উঠবে , আমি সুখী হতে চাই, কেননা এটাই স্বাভাবিক, এটাই মনের ধর্ম্ম। মন সর্বদা সুখী থাকতে চায় । আমার তোমার প্রকৃতির মধ্যে আছে আনন্দসত্ত্বা, আর এই কারণেই আমি তুমি নিজেকে আনন্দে রাখতে চাই। সবাই আনন্দকে পছন্দ করে, কেউ দুঃখকে পছন্দ করে না।
এক শিষ্য একবার এক গুরুদেবকে প্রশ্ন করেছিলেন, মানুষ কি চায় ? মানুষ কি চায়, তাকি সে জানে ?
গুরুদেব বললেন, নিশ্চয় জানে, কেউ ধন চায়, কেউ যশ চায়, কেউ রূপ চায়, কেউবা ভোগ বিলাসে মগ্ন থাকতে চায়। আর এর জন্যই সে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে, উন্মত্তের মতো পরিশ্রম করে। আসলে, মানুষ মোহ-বিকারে আচ্ছন্ন। মানুষ উন্মত্তের মতো কিছু একটা খোঁজ করছে, যাঁকে সে জানে। আর জানে বলেই তা প্রাপ্ত হবার জন্য, সে চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু কথা হচ্ছে, কিসের তাড়নায়, কোন মহা রত্নের অন্বেষনে জীব জন্ম থেকে জন্মান্তরে ঘুরে মরছে ? কিসের তাড়নায় মানুষ এই সংসারে উন্মাদের মতো পরিশ্রম করে, বা কেউ দুর্গম অরণ্যে, বরফের পাহাড়ে, দিনের পর দিন ঘুরে ঘুরে দিনাতিপাত করছে ? কখনো জনকোলাহলে, কখনো নিঃসঙ্গ একাকী হয়ে সমস্ত কষ্টকে অগ্রাহ্য করে, উদাস প্রাণে, ভারাক্রান্ত মনে দীর্ঘ দুর্গম পথ পারি দিচ্ছে ? আসলে সে যে কি চাইছে তা সে জানে না, কিন্তু এটা জানে সেখানে শান্তি আছে। আর এই শান্তির খোঁজেই সে চিরকাল অশান্তির মধ্যে কালাতিপাত করছে। এক দেহ থেকে আরেক দেহে পরিভ্রমন করে বেড়াচ্ছে। আসলে এই যে চাওয়া-পাওয়া এসব ভ্রাম্ত মাত্র। আমরা জানিনা কি সেই বস্তু যা পেলে আমাদের চিরশান্তি, পরম শান্তির উপলব্ধি হতে পারবো । আসলে মানুষ চায় সেই পুরুষবার্থ, আর যে উপায়ে এই পুরুষার্থের সিদ্ধি হয়, তাকে বলে সাধনা।
তুমি যখন তোমার প্রিয়জনকে দেখো, তখন তোমার মন আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে। এই যে আনন্দ, এটি কিন্তু তোমার বন্ধুর কাছ থেকে আসছে না, এটি তোমার নিজের মধ্যে থেকেই উৎসারিত হচ্ছে। তুমি যখন প্রভাতসূর্য্য উদিত হতে দেখো, তখন মন আনন্দে ভরপুর হয়ে ওঠে। হঠাৎ যেন মনে হয়, কিছু একটা তোমার ভিতর থেকে জেগে উঠছে। বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন রকম অনুভূতি আমাদের মধ্যে প্রকাশ পায় .এই যে অনুভূতি, এটি বাইরে থেকে আসে না, আসে ভিতর থেকে, এই যে পরিবেশ, বা সূর্য্যের উদয়, বা বন্ধুর আগমন, এটি নিমিত্ত মাত্র। অনুভূতিটা কিন্তু আসে আমাদের ভিতর থেকে। তাই যখনই এই আনন্দের অনুভূতি হবে, তবে নিজের ভিতরে প্রবেশ করবার চেষ্টা করো । খেয়াল করবার চেষ্টা করো, কোথা থেকে এই আনন্দের ফোয়ারা বেরুচ্ছে। নিজের কেন্দ্র বিন্দুতে নিজেকে স্থাপন করবার চেষ্টা করো। যখনই তুমি এই কেন্দ্রবিদুৎ নিজেকে স্থাপন করবার চেষ্টা করবে, তখন দেখবে, এই আনন্দের ঝর্নার গতি বেড়ে গেছে। তখন নিজেকে কিছুই করতে হবে না, কেবল এই আনন্দের ঝর্ণায় নিজেকে স্নাত করতে হবে । নিজেকে ভাসিয়ে দাও এই আনন্দধারায়। যতদিন বন্ধুর দিকে তাকাবে, যতদিন প্রভাতসূর্য্যের দিকে ধ্যান দেবে, ততদিন এই আনন্দের উৎসকে তুমি খুঁজে পাবেন না। কিন্তু যখন নিজের কেন্দ্রে নিজেকে স্থাপন করবে, তখন বুঝতে পারবে, এই আনন্দ তোমার মধ্যেই ছিল। প্রভাত সূর্য বা বন্ধুর আগমন যেন এই উৎসকেই খুঁচিয়ে দিলো। বন্ধুর আসা একটা ঘটনা মাত্র। এই ঘটনা তোমাকে কেন্দ্র বিন্দুতে যেতে সাহায্য করেছে। এটা শুধু আনন্দের ক্ষেত্রে নয়, এটি ঘটতে পারে তোমার রাগ, দুঃখ, ঘৃণা সব কিছুর ক্ষেত্রে। অপছন্দের ব্যক্তিকে দেখে তোমার রাগ হতে পারে। কাউকে দেখে তোমার দুঃখ হতে পারে, কাউকে দেখে ঘৃণা হতে পারে। কিন্তু এই যে দেখা, এটি নিমিত্ত মাত্র, এই রাগ, দুঃখ, ঘৃণা তোমার ভিতর থেকে জেগে উঠেছে। বাইরে থেকে আসে নি। যা এতদিন তোমার মধ্যে সুপ্ত ছিল, তাই প্রকাশিত হয়েছে। যা ছিল বীজ আকারে, তা জল-বাতাস-আলোর সাহায্যে অংকুরিত হয়ে, একদিন মাখরুহ রূপে দেখা দিয়েছে। যা কিছু ঘটছে, তার কারন তুমি স্বয়ং। যা কিছু তোমার ভিতরে ঘটছে, তা তোমার ভিতরেই ছিল, পরিবেশ পরিস্থিতিতে তার প্রকাশ ঘটেছে মাত্র। যা ছিল গোপন, তা এখন প্রকাশ পেয়েছে।
যখনই এসব ঘটছে, তখন নিজের কেন্দ্রবিন্দুতে মনকে স্থাপন করবার চেষ্টা করো । আর যখনই তুমি নিজের কেন্দ্রবিন্দুতে মনকে স্থাপন করবে, তখন দেখবে, এই অনুভূতিগুলো ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। ভালো মন্দ যাই হোক না কেন, যখনই দুঃখ-আনন্দ-ঘৃণা ইত্যাদির উদ্রেগ হবে, তখনই নিজেকে নিজের কেন্দ্রে স্থাপন করো। নিজের আপনার রাগকে দেখতে থাকো, নিজের দুঃখকে দেখতে থাকো, নিজের মধ্যে ঘৃনাকে দেখতে থাকো। বাইরেরদিকে নয়, অর্থাৎ যাকে দেখে তোমার রাগ হচ্ছে, বা যাকে দেখে তোমার আনন্দ হচ্ছে, মনটা তার দিকে নয়, মনটাকে সেখান থেকে ঘুরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করিয়ে দাও। রাগ হলে, রাগকে হতে দাও,, বাধা দিয়ো না, আনন্দ হচ্ছে, আনন্দ হতে দাও,, বাধা দিয়ো না, ঘৃণা হলে, ঘৃনাকে হতে দাও, বাধা দিতে যেয়ো না। সমুদ্রের জলে আঘাত আসে, তখন জল উচ্ছসিত হয়। উদ্বেল হয়ে ওঠে। তুমি শান্ত থাকো। অন্যরা যাকিছু করছে করুক তুমি ভিতর থেকে কেবল সাক্ষী হয়ে দেখতে থাকো। কেবল দ্রষ্টা হয়ে যায়। তুমি কেবল আশ্রয়দাতা হয়ে যাও, তুমি কেবল মায়ের গর্ভের মতো একে সুরক্ষা দাও। তখন দেখবে, একটা আমূল পরিবর্তন হতে চলেছে। যারা অশান্ত হয়ে এসেছিলো, তারা সবাই ধীর স্থির হয়ে, তোমার পাশেই চুপচাপ বসে গেছে। টু শব্দটি করছে না। রাগ যেন স্তিমিত হয়ে তোমার সাথী হয়ে গেছে, আনন্দের মৃদু ধারা তোমার সাথী হয়ে গেছে, ঘৃণার অগ্নি নিভে গেছে। তুমি যেন শীতল জল, অগ্নির স্ফুলিঙ্গ তোমাকে জ্বালাতে পারবে না। যদি তোমার উপলব্ধি নঞৰ্থক হয়, ভালো না লাগে, তাহলেও নিজেকে শান্ত রাখো, আবার উপলব্ধি যদি সদর্থক হয়, তাহলেও নিজেকে শান্ত রাখো । তখন তোমার এই স্থিরতাকে কেউ ভেঙে ফেলতে পারবে না। রাগ চলে যাবে, ঘৃণা চলে যাবে, এমনকি আনন্দও চলে যাবে, কিন্তু তুমি থাকবে স্থির প্রশান্তিতে। তুমি কেবল দ্রষ্টা হয়ে যাও । সবাই থাকুক, তুমি কেবল এঁদেরকে দেখতে থাকো । নিজেকে এদের সঙ্গে বিতর্কে জড়াবে না, এদেরকে তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করবে না। তখন সিনেমার দৃশ্যের মতো একেকটা আসবে, আবার চলে যাবে, সাদা পর্দা রূপ তোমার মন স্থির হয়ে আছে। মনের মধ্যে কোনো চাপ পড়বে না । মনের মধ্যে কোনো অস্থিরতা দেখা যাবে না। আসলে মানুষের কাম্য, এটাই মানুষ চায়, এটাই মানুষের স্ব -স্থিতি।
------------------------
প্রশ্ন না জাগলে উত্তর পাবেন কি করে ? লোকায়ত ধর্ম্ম এই প্রশ্নের কথাই বলে থাকে।
আমরা কেউ আমাদের পরিচয় কাউকে দিতে পারি না। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার। আমি আমার পরিচয় জানি না। আমরা যে পরিচয় দিয়ে থাকি, আমরা নিজেরা জানি, এই পরিচয় সত্য নয়, এই পরিচয় আমাদের উপরে আরোপ করা হয়েছে। তথাপি, এই ভুয়া পরিচয় নিয়ে আমি সারাটা জীবন বেঁচে আছি। আমরা কেবল বিশ্বাস করি, এই আমার নাম, এই আমাদের ধাম, ইনি আমার পিতা, ইনি আমার মাতা, স্কুল কলেজ আমাকে একটা কাগজে লিখে দিয়েছে, তুমি এম.এ. পাশ, তুমি ডাক্তার, তুমি ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি ইত্যাদি। এই কাগজটা হারিয়ে গেলে, আমিও যেন হারিয়ে যাই। কিন্তু তথাপি আমার মধ্যে কখনো প্রশ্ন জাগে না, আমি কে, আমি কোথা থেকে এসেছি, কোথায়ই বা আবার চলে যাবো ? আমরা কেবল মিথ্যে বিশ্বাসের, মিথ্যে পরিচয়ের উপর ভর করে জীবন অতিবাহিত করে চলেছি। একদিন এই মিথ্যে পরিচয়ের মৃত্যু ঘটে। আর আমি পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাই।
আমার এই ভন্ড পরিচয়ের সম্পর্কে কেউ যদি কোনো প্রশ্ন তোলে, তাহলে আমরা আমাদের কানে আঙ্গুল দেই, চোখে কাপড় বেঁধে নেই। কারন আমি জানি, এই পরিচয় এতটাই ঠুনকো, কাঁচা, ননীর পুতুল, যে একে মান্যতা না দিলে, এর কানাকড়িও দাম নেই। শরীর আমাকে মানুষ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে, পিতা-মাতা আমার একটা নাম রেখেছে, স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি আমাকে শিক্ষিত বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। সমাজ, পরিবার আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাই এদের দেওয়া একটা পরিচয় বহন করে আমি সারা জীবন গর্বিত হয়েছি। কিন্তু আমি মনে মনে জানি, আমার মনের মধ্যে সন্দেহ আছে, এই যে পরিচয় তা মিথ্যে, মিথ্যে, মিথ্যে ।
ভন্ড আস্তিকরা ঈশ্বরেরও একটা পরিচয় দিয়েছে। আর এই পরিচয় দাঁড়িয়ে আছে, মিথ্যে বিশ্বাসের উপরে ভিত্তি করে। ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যদি কেউ কিছু বলে, যদি সন্দেহ প্রকাশ করে, তবে আমরা ঘাবড়ে যাই। মনের মধ্যে একটা সন্দেহ দানা বাঁধে। সন্দেহ তো আমার ভিতরে ছিলোই, কিন্তু খুঁচিয়ে তুলে দিলে আমরা তাতে বিরক্ত বোধ করি, এমনকি আমরা তখন অসহায় হয়ে যাই। ঈশ্বর সম্পর্কে একটা সন্দেহ আমার ভিতরেই আছেই , কিন্তু এটাকে কেউ খুঁচিয়ে তুলুক সেটা আমরা চাই না। কেননা এতে করে আমরা অসহায় হয়ে যাই। সন্দেহ আমার ভিতরেই আছে, কিন্তু কেউ এটাকে জাগিয়ে তুলুক, সেটা আমরা চাই না। যে সন্দেহকে আমরা অন্যমনস্কতা দিয়ে ঢেকে রেখেছিলাম, যে সন্দেহকে আমি মনের মধ্যে চাপা দিয়ে রেখেছিলাম, তাকে কেউ জাগিয়ে তুলুক, সেটা আমরা চাই না। আমাদের ঈশ্বর, এমনকি এই যে আমি, আমার পরিচয়, এর অস্তিত্ত্ব এতটাই ঠুনকো, যে এবিষয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলুলে ঘাবড়ে যাই, রেগে যাই। কেউ প্রশ্ন করুক, তা আমরা চাই না। কারন এতে করে আমি অসহায় হয়ে যাই।
এই আস্তিকতা, বা বিশ্বাস একটা মিথ্যের ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। মিথ্যে আস্তিক হবার চেয়ে নাস্তিক হওয়া অনেক ভালো। আমি জানিনা, এই কথাটা যত সত্যের উপর নির্ভর করে আছে, আমি জানি, এই বিশ্বাস ততটাই মিথ্যের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। মেনে নেওয়া, সহজ কিন্তু প্রশ্ন তোলা কঠিন। প্রশ্ন মানুষকে বিব্রত করে। কিন্তু আমার তো সেই বোধ নেই, আমার তো সেই অনুভব নেই, লোকে বলে, মা-বাবা বলে, পাড়াপ্রতিবেশীরা বলে, রাষ্ট্র বলে, ধর্ম্মগুরুরা বলে, শিক্ষকরা বলে, হাজার বছর ধরে লোকেরা বলে আসছে, তাই আমি সব মেনে নিয়েছি। এমকি ঈশ্বরকেও আমি মেনে নিয়েছি, স্বীকার করেছি । নাতো আমার কোনো অনুভূতি আছে, না তো আমার কোনো জ্ঞান আছে, না আমি তাঁকে জানি, না তাঁকে জানবার চেষ্টা করেছি।
একটা শিশু যখন জন্মায়, তখন সে সন্দেহ নিয়ে জন্মায়। একটা শিশু যখন জন্মায়, তখন সে জ্ঞানপিপাসা নিয়ে জন্মায়। কিন্তু যখন এই শিশু আমাদেরকে প্রশ্ন করে, তখন আমরা অস্থির হয়ে যাই। আমরা হয়তো বলি, তুমি যখন বড়ো হবে, তখন তুমি সব জানতে পারবে। কিন্তু শিশুর প্রশ্ন শেষ হয় না, সে প্রশ্ন করতেই থাকে। আর বুদ্ধিমান ব্যক্তি তাকে কখনো উপেক্ষা করে, কখনও অপেক্ষা করতে বলে। কারন কোনো প্রশ্নের উত্তর এই বুদ্ধিমানের কাছে নেই। বুদ্ধিমানের কাছে আছে, মিথ্যে শ্রদ্ধা। যা দিয়ে সে আস্তিক্যকে পুষে রেখেছে।
কিন্তু শিশুর কাছে, নাস্তিকের কাছে আছে প্রশ্ন, আছে কৌতূহল, আছে প্রচেষ্টা, আছে সন্দেহ। আর এই যে সন্দেহরুপী সম্পদ এটি সেই পরমাত্মারই দান। সন্দেহ আসলে সেই বীজ যার মধ্যে শাঁস রূপে আছে শ্রদ্ধা। এই সন্দেহটা একটা খোলস, একটা আবরণ, মাটির অন্ধকারের মধ্যে এই আবরণটা যদি ভাগ্যক্রমে গোলে যায়, তবে এই সন্দেহরুপী বীজ একটা অংকুরের জন্ম দিতে পারে। এই অঙ্কুর থেকেই একদিন শ্রদ্ধারূপী বৃক্ষের বিকাশ হতে পারে।
ধর্ম্ম জগতে সন্দেহকে শত্রু বলে মনে করা হয়। শাস্ত্র বাক্যে সন্দেহ করা চলবে না, গুরুবাক্যে সন্দেহ করা চলবে না, আচার্য্যের বাক্যে সন্দেহ করা চলবে না। কেবল বিশ্বাস করো, শ্রদ্ধা করো। কিন্তু যার মধ্যে সন্দেহ আসেনি, যার মধ্যে প্রশ্ন জাগেনি, তার মধ্যে যে শ্রদ্ধা তা তো নিষ্প্রাণ। এই পাথরের শিবলিঙ্গ, বা শালগ্রাম শিলা, বা পাথরের মূর্তি তো নিষ্প্রাণ। এর মধ্যে প্রাণের ছোঁয়া আসবে কি করে, যদি শ্রদ্ধা না থাকে। আর এই শ্রদ্ধা যদি অন্ধ হয়, তবে তার থেকে বিশ্বাসের বৃক্ষ জন্মাবে কি করে ?
দেখো, শিব তো সাজা যায়, শ্রীকৃষ্ণ সাজা যায়, কিন্তু ভিতরে যদি সন্দেহ থাকে, তবে এই মুখোশ তোমাকে কোনো দিন শিব বা শ্রীকৃষ্ণের ধারে কাছে নিয়ে যেতে পারবে না। তোতাপাখির মতো মন্ত্র জপ করে, বা শাস্ত্রাদি মুখস্ত করে মুখে মুখে আওড়ালে সত্যিকারের শ্রদ্ধা জাগ্রত হয় না। এই শ্রদ্ধা পঙ্গু - নিষ্প্রাণ। এই শ্রদ্ধার মধ্যে প্রাণবায়ুর ঘোরাফেরা নেই। তাই এই মেকি শ্রদ্ধা হৃদয়ের মধ্যে স্পন্দন আনতে পারে না।
আসলে সন্দেহের সিঁড়ি দিয়ে, প্রশ্নের সেতু দিয়ে শ্রদ্ধাকে উপলব্ধি করতে হয়। যে সন্দেহকে আঁকড়ে ধরে, যে প্রশ্নকে আঁকড়ে ধরে, সেই একদিন সন্দেহর সিঁড়ি পেরিয়ে, শ্রদ্ধাকে অনুভব করে। সন্দেহের উপরে যদি সন্দেহ হতে শুরু করে, তখন সত্যিকারের শ্রদ্ধার জন্ম হয়। আর এই শ্রদ্ধা হয়, নিরেট, যাকে কখনোই টলানো যায় না।যখন সন্দেহের উপরে সন্দেহ এসে ইমারত গড়ে, তখন চাপা পরে যায়, তখন সন্দেহের মৃত্যু ঘটে। সন্দেহ তখন বাধ্য হয়ে আত্মহত্যা করে, আর তিরোহিত হয়ে যায়। সন্দেহ যখন মিটে যায়, তখন আসল শ্রদ্ধার জন্ম হয়।
আমাদের দেশে যে ধর্ম্ম তা পণ্ডিত-পুরোহিতের দ্বারা প্রচলন হয়েছে, যা আসলে একটা মিথ্যা আস্তিকতার ব্যবসা ছাড়া আর কিছু নয়। এই সময় যদি চার্বাক বেঁচে থাকতেন, তবে এই তথাকথিত ধর্ম্মের মূল উৎপাটিত হয়ে যেত। তখন আর যাগযজ্ঞ মন্দির মসজিদ গির্জা গুরুদ্বার থাকতো না। তাহলে ধর্ম্মের নামে আজ যে ব্যবসা চলছে, তাকে আর বাঁচিয়ে রাখা যেত না।
আমরা হিন্দুরা বলি বটে যে আমরা ধর্ম্মের ব্যাপারে খুব উদার। আসলে এটা এক ধরনের ধরনের ভণ্ডামি ছাড়া কিছু নয় । আসলে আমরা একটা অহঙ্কারের সিংহাসনে বসে, গর্বভরে বলতে ভালোবাসি যে আমরা উদার, আমরা ধর্ম্মের ব্যাপারে সহিষ্ণু। আমরা সুযোগ পেলেই ঈশ্বরের নামকরে, তরোয়ালে শান দিতে থাকি। আমরা মুখে বলি, "ঈশ্বর-আল্লা তেরে নাম" - আর জয় শ্রীরাম বলে, বা আল্লাহ আকবর বলে লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়ি।
এককালে একটা সম্প্রদায় ছিল, যাদের বলা হতো চার্বাক। তাঁদের কাছে এই পৃথিবীটাই ছিল সব। এই পৃথিবীর বাইরে স্বর্গ বা মর্ত বলে কিছু আছে, তা তারা বিশ্বাস করতো না। এই পৃথিবীর জীবনকেই তারা আনন্দ-উৎসবপূর্ন, পরিপূর্ন জীবন বানাতে চেয়েছিলো। তাদের কাছে পরমাত্মা বলে কিছু ছিল না। এদের কাছে মৃত্যুর পরে, পরকাল বলে কিছু ছিল না। তারা সত্যকে আশ্রয় করে, প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধনে জীবনকে দেখেছিলো। তাদের মুখে ছিল মধুর বচন। এদের দর্শনকে বলা হলো "লোকায়ত" ধর্ম্ম। লোকায়ত কথাটার অর্থ হচ্ছে পছন্দমত। সাধারণ মানুষের বুদ্ধিগম্য এই ধর্ম্ম সবাই পছন্দের ছিল।
আর এতে করে ভন্ড পণ্ডিত-পুরোহিত, প্রমাদ গনেছিলো। মৃত্যুর পরে কিছু নেই, এই কথা যদি সবাই মেনে নিতে থাকে, তবে আর ব্যবসা কি করে চলবে ? এই সব ভন্ড পুরোহিতের দল, মানুষকে বলে, এই জীবনে কেবল দিয়ে যাও। আর পরের জীবনে কেবল পেতে থাকো। এখানে এক পয়সা দিলে পরপারে একশো পয়সা পাবে। এইসব পণ্ডিত-পুরোহিত আসলে ধর্ম্মের নামে সাধারণ মানুষকে শোষণ করছে। আর কাকে দেবে ? না কেবল ব্রাহ্মণদেরকে দিতে হবে। পন্ডিতদের দিতে থাকো। রাজাদের দিতে থাকো। দেবতাদের নাম করে ব্রাহ্মণদেরকে দিতে থাকো। রাজকোষ ভরবার জন্য, রাজাদের দিতে থাকো। এরা কেউ জন্মালে হাত পেতে থাকবে, মৃত্যুকালে হাত পেতে থাকবে, বিয়ের অনুষ্ঠানে হাত পেতে থাকবে। বাৎসরিক উৎসবে, জন্মদিনে হাত পেতে থাকবে। এরা সুখের সময় হাত পাতবে, দুঃখের সময় নিদান হেকে হাত পাতবে। এরাই ঈশ্বরের নাম করে, গোহত্যা করে, অশ্ব বলি দেয়, এমনকি এরা নরমেধ যজ্ঞ করে থাকে। এতে কি হবে, না এতে করে পুন্য হবে, সব পাপ ধুয়ে মুছে যাবে।পরলোকে স্বর্গ প্রাপ্তি হবে, অপ্সরাদের নিয়ে আনন্দ-স্ফূর্তি করতে পারবে।
এরা একটা অদ্ভুত কথা বলে, সবই নাকি কর্ম্মফল। তুমি যদি একে অস্বীকার করো, তুমি যদি এই জন্মের কর্ম্মের খতিয়ান দেখাও, তবে বলবে, এ তোমার কপাল, পূর্ব জন্মের কর্ম্মফল । আজ তোমার যে দারিদ্রতা, তা বড়োলোকের শোষণের জন্য নয়, এ তোমার কর্ম্ম ফল। আগের জন্মে নিশ্চই তুমি কোনো পাপ করেছিলে, তাই তুমি গরিবের ঘরে জন্ম নিয়েছো। আসলে এইসব পণ্ডিত পুরোহিতের দল বড়োলোক রাজা-জমিদারদের রক্ষাকর্তা। আর এরাই গরিবের শোষণকর্ত্তা। রাজা-মহারাজারা এদেরকেই নিয়োগ করে থাকে, গরিবদের ধর্ম্মের আফিং খাওয়ানোর জন্য। তা না হলে গবীর একদিন হয়তো বিদ্রোহ করবে। এরা যে রাজার ধন কেড়ে নিতে আসবে। এরা আর সৈন্যদলে নাম লেখাবে না। এরা আর রাজার হয়ে যুদ্ধ করবে না। এরা আর রাজার হয়ে অন্যের সম্পদ লুট করতে চাইবে না। অদ্ভুত এই কর্ম্ম ফল, বলা হয় সৈন্য হয়ে সৈন্যদের তুমি মারবে, সেখানে কোনো পাপ নেই, কিন্তু শূদ্র হয়ে ব্রাহ্মণদের মারলেই তোমার পাপ লেগে যাবে। পরের জন্মের লালিপপ তোমার মুখের সামনে দোলাবে, বলবে, এই জন্মের দুঃখ-কষ্ট সহ্য করো, ব্রাহ্মণকে দান করো, তাহলে তোমার পরের জন্ম সুখের হবে। এই ধোঁকা খেতে খেতে তোমার কত জন্ম যে চলে যাবে তার কথা কে বলতে পরে ? পন্ডিতরা বলে থাকে, কেউ তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে না, তোমার কর্ম্মে তুমি দুঃখ ভোগ করছো। তুমি নিজের পাপ কর্ম্মের ফল ভোগ করছো। শক্তিশালী ব্যক্তি, পণ্ডিত ব্যক্তি, রাজা মহারাজারা সকলেই তাদের পূর্ব জীবনের ফল ভোগ করছে। চালাকিটা দেখো - তুমি চাষ করবে, ভোগ করবে জমিদার, তুমি পরিশ্রম করবে ভোগ করবে মালিক। তুমি মুরগি পুষবে, আর ডিম্ খাবে দারোগা। তুমি কাপড় বুনবে, গায়ে চড়াবে বড়োলোকের গিন্নি। মুখে বলবে, কর্ম্মফল - কিন্তু এজন্মের কর্ম্মফল নিয়ে নেবে, রাজা-জমিদার, পণ্ডিত -পুরোহিত। এ এক আজব ধর্ম্মের দুনিয়া। তুমি গরিব, এই কারণেই তোমাকে দান করতে হবে, তুমি শ্রম দান করবে, তুমি ধন দান করবে। আর ভোগ করবে বড়লোকেরা, তুমি অনাহারে শুকিয়ে মরবে, আশ্রয়ের অভাবে গাছের তলায় শুযে থাকবে। অদ্ভুত এই ধর্ম্মপথ।
লোকায়ত ধর্ম্ম কখনো পরজন্মে বিশ্বাস করেনি। তাঁরা না পূর্ব জন্ম না পর জন্ম -এর বিশ্বাস করে। পন্ডিতরা বললেন, এত ভয়ানক কথা। এই বিশ্বাস না থাকলে, দুঃখের শান্তনা কিভাবে পাওয়া যাবে ? তাহলে তো সুখ-দুঃখ, ধন সম্পদ, শান্তি অশান্তি এসব এখানেই থেকে যাবে, তাহলে কোন অজুহাতে গরিব মানুষকে শোষণ করা যাবে ? তাহলে কিভাবেই বা এই ভুয়া শান্তির পথ দেখানো যাবে ? আসলে এটি একটা ষড়যন্ত্র যা পণ্ডিত পুরোহিত ও রাজা মহারাজাদের মধ্যে একটা গাঁটছড়া। এই ষড়যন্ত্র একদিন লোকায়ত ধর্ম্মকে ভারতবর্ষ থেকে নির্মূল করে দিলো। কিন্তু ইউরোপের দেশবাসীগণ এই লোকায়ত ধর্ম্মকেই গ্রহণ করে, আজ বিশ্ব শাসন করছে। ভারতবর্ষ থেকে সমস্ত বৈভব চলে গেলে ইউরোপীয় বাসিন্দাদের কাছে।
যেদিন পরলোকের দ্বার বন্ধ হবে, সেইদিন প্রকৃতির দ্বার উন্মোচন হবে। যেদিন ভৌতবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে, সেদিন পরলোকের দ্বার বন্ধ হবে। আমরা কোনো বিখ্যাত ভৌতবাদীর জন্ম দিতে পারিনি, আমরা দার্শনিকের জন্ম দিয়েছি। এই লোকায়ত ধর্ম্ম যদি প্রসারলাভ করতে পারতো , তবে ভাতের অভাব থাকতো না। আমরা দীন-হীন হয়ে ধুঁকে ধুঁকে পরলোকের জন্য অপেক্ষা করতাম না।
একটা জিনিস জানবেন, গরিব কখনও দাতা হতে পরে না, গরিব কখনও ধার্ম্মিক হতে পারে না। একমাত্র সমৃদ্ধ সমাজ ধার্ম্মিক হতে পারে। সাধনা তখনই সাফল্য পাবে যখন জগৎ দিয়ে শুরু হবে আর বুদ্ধ দিয়ে পূর্ন হবে। এই রহস্যের সন্ধানই পরমাত্মার সন্ধান। জীবন রহস্যের বোধদয় হলেই পরমাত্মা আমাদের বোধে আসতে পারে। আসলে এই জগৎ ব্রহ্মময়। তো যে জগৎকে উপেক্ষা করে শূন্যবাদের মধ্যে জীবন রহস্য খুঁজে মরছে, সে তো প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। তুমি এই দেহ, আবার তুমিই আত্মা। একটা উপেক্ষা করে আরেকটাকে পেলে তা হবে অঙ্গহীন মূর্তি। যেখানে পূর্নতা নেই, সেখানে ব্রহ্ম নেই। ধর ও মুন্ডু উভয় যখন একত্রিত হবে তখন একটা পূর্ন মানুষ হবে। জগৎ ও আত্মা, যখন একসুরে কথা বলবে তখন তা হবে ব্রহ্মবাক্যঃ। পরমাত্মা জগতের প্রতিটি কনার মধ্যে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। এই জগৎ ভিন্ন কোথাও পরমাত্মা নেই। তাই জগতের মধ্যে প্রবেশ করতে হবে, জগৎকে জানতে হবে, জগতের ঐশ্বর্যকে আয়ত্বে আনতে হবে, তবেই আমরা পরমাত্মার উপলব্ধি করতে পারবো। নতুবা শূন্য হাতে এক জন্ম থেকে আর জন্মে ঘুরে ঘুরে বারবার মৃত্যুর যন্ত্রনা ভোগ করতে থাকবো।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম। অধ্যাত্ম পথে জিজ্ঞাসাকে জাগিয়ে রাখুন