Monday 22 November 2021

শব্দই ব্রহ্ম :

 


২৯.১০.২১ 

শব্দই ব্রহ্ম : অঽম ব্রহ্মস্মীন - আমি কিভাবে ব্রহ্ম থেকে এলাম ? 

 উপনিষদের ঋষিগণ বলছেন, "শব্দই ব্রহ্ম"।  শব্দ আমাদের কর্নেন্দ্রিয় দ্বারা গোচারীয়ভূত হয়। শব্দকে আমরা অনুভব করতে পারি। কিন্তু এই শব্দই ব্রহ্ম এই অনুভূতি আমাদের নেই। কেননা ব্রহ্ম আমাদের অনুভূতিতে আসে না। তাহলে কি যে শব্দ আমাদের অনুভূতিতে আসে, সেই শব্দ ছাড়াও  আলাদা কোনো শব্দ আছে, যাকে ঋষিগণ "ব্রহ্ম" বলছেন ? 
দেখুন শব্দ দুই প্রকার অনাহত, আর আহত। আঘাতের সাহায্যে যে শব্দের উৎপত্তি হয়, তাকে বলে আহত শব্দ, যা আমাদের  সাধারণ ভাবে শ্রুতিগোচর হয়। আর কোনো আঘাত ছাড়াই যে শব্দ প্রতিনিয়ত ধ্বনিত হচ্ছে তাকে বলা হয় অনাহত শব্দ।  এই অনাহত শব্দকে ঋষিগণ বলছেন "নাদ"। এখন এই নাদ বা অনাহত শব্দকে কেন ব্রহ্ম বলছেন, সেটা আমরা একটু বুঝবার চেষ্টা করি। 

আমরা জানি আকাশের গুন্ হচ্ছে শব্দ। এই আকাশ বিশ্বচরাচর ব্যাপ্ত হয়ে আছে।  এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে আকাশ নেই। আকাশ নিত্য ও অনাদি। 

এখন শব্দ বলতে আমরা কি বুঝি ? যা শুনলে, বা যা উচ্চারিত হলে, আমাদের মধ্যে কোনো বস্তুর উপলব্ধি হয়, বা জ্ঞানের উদয় হয় তাকে আমরা শব্দ বলে থাকি। অর্থাৎ শব্দ আমাদের কাছে অর্থবোধক। শব্দ থেকেই আমাদের মধ্যে  বস্তুর বা ভাবের অর্থ বোধগম্য হয়।

এখন কথা হচ্ছে অর্থ বলতে আমরা কি বুঝি ? যা অর্থিত বা যাচিত তাই আমাদের কাছে অর্থ। অর্থাৎ শব্দের কাছে আমরা যা যাচ্ঞা করি, তাকেই শব্দের অর্থ বলা হয়ে থাকে। আর এই অর্থকে কে প্রকাশ করে, না অর্থকে প্রকাশ করে শব্দ। অতয়েব শব্দের সাথে অর্থের একটা সম্মন্ধ আছে। অর্থাৎ শব্দ হচ্ছে প্রকাশক, আর অর্থ হচ্ছে প্রকাশ্য। 

শব্দ আবার দুই প্রকার ধ্বনাত্মক ও বর্ণাত্মক। অর্থাৎ একটা হচ্ছে ধ্বনি, আর একটি হচ্ছে বর্ণ। আমাদের কন্ঠ-জিহবা-নাক-মুখ থেকে যে শব্দ বের হয়, তাকে বলা হয় বর্ণ। আর বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের থেকে শব্দের উদ্ভৱ হয়, তাকে বলা হয় ধ্বনি। এই দুই ধরনের শব্দই শ্রুতিগোচর। অর্থাৎ আমরা কান দিয়ে শুনতে পাই। শব্দের একটা শক্তি আছে, অর্থাৎ শব্দ যখন আমাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে, তখন কোনো না কোনো স্বরূপের প্রকাশ করে, অথবা কোনো না কোনো মানস ক্রিয়া বা জ্ঞান উৎপাদন করে থাকে।আবার  দেখুন, আমরা যখন হাসি, কান্নাকাটি করি, উদ্বেগ প্রকাশ করি, বা ভয় পাই, তখন আমরা বিভিন্ন ধরনের শব্দের সৃষ্টি করে থাকি, এর কোনো নির্দিষ্ট অর্থ নেই, কিন্তু এইসব শব্দ মাত্রেই একটা মানসিক বিকার বা অবস্থার প্রকাশ করে থাকে। অর্থাৎ এইসব শব্দের মধ্যে কোনো ছবি সংলগ্ন নেই কিন্তু একটা মানসিক অনুভূতির প্রকাশ হয়ে থাকে।  তেমনি, আমরা যখন বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি শুনি, তখনও আমাদের মনের মধ্যে একটা বিকার বা উৎফুল্ল ভাবের জন্ম হয়। 

বর্ণ বলতে আমরা সেই শব্দকে বুঝি তা মানুষের কন্ঠ থেকে বুদ্ধিসহযোগে নির্গত হয়। অর্থাৎ এর একটা অর্থ আছে। তা হতে পারে কোনো বস্তুর প্রতিচ্ছবি বা মনের ভাবের প্রতিচ্ছবি। তো ধ্বনি বা বর্ণ উভয়ই আহত শব্দ।  অর্থাৎ কোনো না কোনো আঘাতের ফলে এর জন্ম হয়েছে।

 কিন্তু আহত শব্দের অতীত এক প্রকার শব্দ আছে, যাকে  বলা হয় অনাহত  ধ্বনি। একে মহাত্মাগণ বলে থাকেন অশরীরি বাণী। এই অশরীরি বাণী আমাদের হৃদয় আকাশে উদ্ভূত হয়। আমাদের হৃদয় থেকে অনেক কথা বা বাণী আমরা শুনতে পাই। এই অশরীরি বাণী আমরা কানে শুনি না, কিন্তু উপলব্ধি করি।আবার আমাদের শরীর যখন বিভিন্ন তপঃ সাধনার দ্বারা শুদ্ধ হয়, মন যখন সংযত হয়, তখন আমাদের বুদ্ধির উৎকর্ষতা দেখা দেয়। আবার সাধক যখন ধ্যান সাধনা দ্বারা নিজেকে উচ্চস্তরে নিয়ে যেতে পারেন, তখন আমাদের মধ্যে সত্ত্বগুণের উৎকর্ষতার ফলে ও বুদ্ধি নির্মল হলে, সাধকের বহু ভাগ্যফলে, সাধকের দক্ষিণ দিকের কানে, এক অস্ফুট নাদধ্বনি প্রকাশিত হয়। যা তার একান্ত নিজস্ব সম্পত্তি। শব্দ বা ধ্বনি অর্থাৎ আহত ধ্বনি আমরা সবাই যারা নির্দিষ্ট পরিসরে অবস্থান করছি, তারা সবাই শুনতে পাই। কিন্তু অনাহত ধ্বনি কেবল সাধক শুনতে পান। এইজন্য বলা হয়ে থাকে নাদধ্বনি কেবল সাধকের শ্রুতিগোচর হয়। 
  
এখন এই অনাহত ধ্বনির মধ্যে কি রহস্য আছে, যার জন্য স্বয়ং  "ব্রহ্ম"কে এই শব্দের মধ্যে অনুভব করা যায় ?

এখন পদ বা শব্দবোধ্য অর্থের নাম হচ্ছে পদার্থ। আবার বলি কথাটা, পদ+অর্থ = পদার্থ। বাক্যের অর্থের দ্বারা যাকে  প্রতিপন্ন করা হয়, তাকে বলা হয় পদার্থ। যেকোনো পদার্থকে আমরা শব্দের দ্বারা  বুঝি ও তাকে চিহ্নিত করি। বিষয়ের উর্দ্ধে অর্থাৎ বাক্যের অতীত যা তাকে বলা হয়ে অজ্ঞেয়। আর যা বাক্যের বিষয়ভূত অর্থাৎ যাকে  আমরা বাক্য দ্বারা প্রকাশ করতে পারি, তাকে বলা হয় জ্ঞেয়। অর্থাৎ যে বস্তু আমাদের জ্ঞানের-শক্তি মাধ্যমে  বাক্যের আকারে প্রকাশিত হয়,  আমরা তাকে জ্ঞেয়বস্তু বলে থাকি। জ্ঞেয়বস্তু আমাদের জ্ঞানের অধীন। অর্থাৎ যা কিছু আমরা চিন্তা করতে পারি, এবং বাক্যের দ্বারা প্রকাশ করতে পারি, তাকেই আমরা পদার্থ বলে থাকি।  জগতে এমন কোনো পদার্থ নেই, যার কোনো নাম নেই। নাম আর নামি তাই আমাদের কাছে একই। আমাদের স্বপ্ন, আমাদের কল্পনা, আমাদের চিন্তা, আমাদের অভাববোধ সবই আমরা বাক্যের দ্বারা প্রকাশ করতে পারি।  তাই এগুলো সবই পদার্থ। আঘাতের দ্বারা যে শব্দের উৎপত্তি হয়, তাকে বাচক বলা হয়ে থাকে। এই বাচক শব্দই  সংকেত বাহক। শব্দ  ও অর্থ দুই-এর প্রকারে  প্রকৃতির পরিনাম বা পরিণতি নির্মাণরূপ আবহের সাথে প্রতিনিয়ত গতিশীল হয়ে চলেছে। সুতরাং শব্দই পরিনাম বাচক। এই আকাশতত্ত্ব বা শব্দতত্ত্ব বিভক্ত হয়ে, মরুৎ বা বায়ু, তেজ, বা অগ্নি, অপ বা জল ক্ষিতি বা পৃথিবী - এই ভিন্ন ভিন্ন পদার্থরূপে অবস্থান করছে। প্রকৃতি যেমন শব্দময়, তেমনি শব্দও প্রকৃতিতে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। 

উপনিষদ বলছেন, শব্দ স্ব-প্রকাশ। শব্দ নিজেই নিজের প্রকাশক। আবার শব্দ অর্থের প্রকাশক । বলা হয়ে থাকে, প্রণব  শব্দ বিশ্ব প্রকাশক। বলা হয়ে থাকে শব্দশক্তির (প্রণব) মাধ্যমেই জগৎ প্রতিভাত হয়েছে। শব্দজ্যোতি যদি না থাকতো, তবে  ত্রিভুবন অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকতো। এখন আমাদের ধারণা  হচ্ছে, আলো বা আলোক রশ্মিই জগৎকে প্রকাশ করেছে। সূর্য্যের উদয়ে  সর্ব্ববস্তুর প্রকাশ হয়। আসলে শব্দ-ব্রহ্মই সূর্য্যের প্রকাশক। সূর্য জগতের অংশমাত্র।   শব্দ-জ্যোতির কারনে জগতের উদ্ভব হয়েছে। মহাত্মাগণ বলছেন,  শব্দই আমাদেরকে রাজা-প্রজা, মাতা-পিতা, ভাই-বোন ইত্যাদির বোধশক্তির জন্ম দিয়ে থাকে। আবার এই শব্দের মধ্যেই আছে সমস্ত জ্ঞানভাণ্ডার। আমাদের ইতিহাস বলুন, পুরাণ বলুন, বেদ বলুন, উপনিষদ বলুন সবই কেবল শব্দ ভান্ডার মাত্র। শব্দ না থাকলে, আমরা ধর্ম্ম-অধর্ম্ম, ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, কিছুই জানতে পারতাম না। শব্দই সমস্ত কিছুকে প্রকাশ করে থাকে। শব্দই আমাদের চেতনা বা জ্ঞানজ্যোতিঃ  দান করছে।  বলা হয়ে থাকে স্বয়ং ব্রহ্মের প্রকাশক হচ্ছে শব্দ।  অর্থাৎ শব্দই পরাব্রহ্ম। শব্দ থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, তেমনি শব্দেই তার স্থিতি, আবার শব্দেই বিলীন হয়ে যায়। শব্দই বিশ্বকে বন্ধনের দ্বারা আবৃত করে রেখেছে। শব্দ চক্রেই সমস্ত কিছু আবৃত হচ্ছে। 

পদার্থের বিভাজন পরিণতি হচ্ছে পরমাণু, আবার পরমাণুর একত্রীকরণ পরিণতি হচ্ছে পদার্থ। অতয়েব, পদার্থের যদি শব্দগুন্  থাকে তবে পরমাণুতেও  শব্দ গুন্ আছে। আবার পরমাণুর যে  কার্য্যশক্তি বা পরমাণুর যে কারণশক্তি তার মধ্যেও শব্দ আছে। বিন্দু বা পরমাণু হচ্ছে বস্তুর শেষ বিভাজ্য বস্তু।  অর্থাৎ যার আর বিভাজন করা যায় না। কাকে আমরা  বিন্দু বলি, যার অস্তিত্ত্ব আছে, কিন্তু তার আর ভাগ হতে পারে না। অর্থাৎ ভাগের অতীত এই পরমাণু। অন্য দিক থেকে বলা যায়, শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ এই যে শক্তিগুন এর শেষ বিভাজ্য বস্তু হচ্ছে বিন্দু। 
 
এখন ব্রহ্ম কাকে বলে, যার বিভাজন নেই, যার ক্ষয় নেই, অর্থাৎ পদার্থের শেষ সীমায় যিনি অবস্থান করছেন তাকেই বলা হয়ে থাকে ব্রহ্ম।  অর্থাৎ সমস্ত সৃষ্টির কারন-রূপে  যিনি অবস্থান করছেন। যার সীমা নেই, যার ক্ষয় নেই, যাকে বিভাগ করা যায় না, তাকেই বলা হয় ব্রহ্ম। আবার এই পদার্থই কিন্তু এক এবং শব্দময়। সুতরাং বলা যেতে পারে, শব্দ, পরমাণু, বিন্দু, বা ক্ষণ সমস্তই এক ব্রহ্ম-পদবাচ্য। 

এখন কথা হচ্ছে, এই তিন  আলাদা ভাবে প্রত্যক্ষভূত নয়। কিন্তু সমষ্টিভূত অবস্থায় প্রতক্ষ্য-গোচর হয়, এবং আমাদের বুদ্ধির গোচর  হয় ।  যখন দুই বস্তুর সংঘাতে শব্দ শ্রুত হয়, তখন তা ব্রহ্ম অনুসৃত। অব্যক্ত অবস্থায় চেতনার মধ্যে ছিল, আবার অচেতনের মধ্যেও ছিল। এই  দুয়ের সংযোগে অব্যক্ত শব্দ ব্যক্ত হলো। এই ব্যক্ত শব্দই প্রণব মন্ত্র বা ওঙ্কার। 

বলা হয়ে থাকে, পরমেশ্বর জগৎরূপ ধারণ করবার সময় বিন্দু, নাদ ও বীজ এই ত্রিধা-বিভক্ত অবস্থায় ছিল। বিন্দু হচ্ছে শিব, বীজ হচ্ছে শক্তি, আর এই শিব ও শক্তির মিলনে হচ্ছে নাদ। অর্থাৎ নাদ শিব-শক্তি-আত্মক। আমরা জানি চাঁদ ও সূর্য যে-যে আধারে প্রতিবিম্বিত হয়, সেই আধারে তখন স্পন্দন ওঠে, আধার তখন চঞ্চল হয়ে ওঠে, আবার এই  শব্দ বা নাদতত্ত্ব হচ্ছে এই আধারের নির্মাতা। সমস্ত আধারে, তা সে পৃথিবী বলুন বা চন্দ্র-সূর্য বলুন, গ্রহ-নক্ষত্র বলুন, সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত আধার এই শব্দব্রহ্ম থেকে সৃষ্ট। বিশ্ব ব্রহ্মান্ডেরও  হয়তো সীমা  থাকতে পারে, কিন্তু শব্দের কোনো সীমা  নেই। শব্দ অনন্ত। বিশ্ব-জগৎ শব্দব্রহ্মের পরিনাম।  আদি অনাদিকাল থেকেই এই শব্দব্রহ্ম (প্রণব বা ওঙ্কার)   জগৎ-আকারে বিবর্তিত হয়ে চলেছেন। তাই উপনিষদের ঋষিগণ বলছেন, "শব্দই ব্রহ্ম"। বাক্যের মাধ্যমে অর্থাৎ শব্দের মাধ্যমে (ওঙ্কার) আমরা সেই পরমপুরুষের উপলব্ধি করতে পারি। এগুলো কোনো কল্পকথা নয়, এগুলো ভারতীয় মুনিঋষিদের অনুভূতিলব্ধ জ্ঞান। আজও এই সত্য অনড়। 

8.11.2021 অঽম ব্রহ্মস্মীন - আমি কিভাবে ব্রহ্ম থেকে এলাম ?

বৈদিক সাহিত্যে বলা হয়ে থাকে আমরা সবাই নাকি ব্রহ্মের অংশ।  আবার শব্দই নাকি ব্রহ্ম। তো তাহলে বলতে হয়, আমি শব্দ থেকে এসেছি। আমাদের অনেকের জপ ধ্যান করবার অভ্যাস আছে। এখানে আমাদের বলা হয়, একটা ধ্বনি বা শব্দের বারবার উচ্চারণ বা জপ করতে। আমরা জানি শব্দ চার প্রকার। পরা, পশ্যন্তি,  মধ্যমা, বৈখরী। এই পরাবাক একেই বলে শব্দব্রহ্ম। এই পরা বাকের স্ফূরণ তিন প্রকার, প্রথমে পশ্যন্তি রূপে, তারপর মধ্যমা রূপে, এবং সবশেষে বৈখরীরূপে। যোগীদের দৃষ্টিতে বিশ্বব্রহ্মান্ড তিন ভাগে বিভক্ত একটি শব্দ, একটি অর্থ, আর-একটি হচ্ছে জ্ঞান। অর্থ হচ্ছে পদার্থ, শব্দ ও অর্থের মধ্যে সম্মন্ধ হচ্ছে বাচ্য ও বাচক। জ্ঞান ও অর্থের মধ্যে সম্মন্ধ হচ্ছে বিষয় ও বিষয়ী। বৈখরী অবস্থায় শব্দ ও অর্থ পরষ্পর  ভিন্ন। শব্দ হচ্ছে বাচ্য, অর্থ হচ্ছে বস্তু বা বাচক । এই দুইয়ের ভেদ আছে। মধ্যমা অবস্থায় শব্দ ও অৰ্থের ভেদাভেদ সম্মন্ধ।  পশ্যন্তি অবস্থায় শব্দ ও অর্থের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। 

আমরা জানি, মন্ত্রদাতা গুরু শিষ্যকে গোপনে অর্থাৎ কানে কানে, মন্ত্রবিজ প্রদান করে থাকেন। তিনি আসলে দেন বিশুদ্ধ চৈতন্য কিন্তু একটা মোড়কে ঢাকা। আমরা যেমন কাউকে উপহার দিতে গেলে, সুন্দর একটা প্যাকেটে ঢেকে উপহার সামগ্রী প্রদান করে থাকি, তেমনি গুরুদেব চৈতন্যশক্তিকে শব্দের মোড়কে ঢেকে শিষ্যকে গোপনে প্রদান করে থাকেন। অর্থাৎ স্থুল বস্তু শব্দের আবরনে ঢেকে চৈতন্যশক্তির প্রবাহ শিষ্যের স্থূল শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেন। সাধক এই শব্দকে অবলম্বন করে, চৈতন্যের জগতে প্রবেশ করে। শিষ্যকে বলা হয়, নিরন্তর এই শব্দের ধ্যান করতে, বা উচ্চারণ করতে। আসলে বারবার এই শব্দকে আঘাত আঘাত করতে করতে, একসময় শব্দ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।  আর  চৈতন্যেরশক্তি  শব্দের আবরণ ভেঙে উন্মুক্ত হয়ে ওঠে শিষ্যের হৃদয়ে। এই চৈতন্য শক্তি জ্যোতিঃস্বরূপ। তাই জপের সাহায্যেই একসময় শিষ্যের চিত্ত জ্যোতির্ময় হয়ে ওঠে। একেই মহাত্মাগণ বলছেন চিত্ত শুদ্ধি। নিরবিচ্ছিন্ন জপ-এর আঘাতে গুরু প্রদত্ত মন্ত্রের বাহ্য আবরণ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায়। আর এক অশ্রুতপূর্ব নাদের ধ্বনি শ্রুতিগোচর হয়। মন হয়ে যায় অন্তর্মুখী। জ্যোতির প্রভাবে ভৌতিক জগতের অনুভব লুপ্তপ্রায় হয়ে যায়। এই হচ্ছে  পশ্যন্তি অবস্থায় শব্দের খেলা। এই অবস্থাকে আপনি আত্ম-সাক্ষাৎকারের পূর্বাবস্থা বলতে পারেন। 
এইবার আমরা শব্দের আরো গভীরে প্রবেশ করবো। এই শব্দব্রহ্মের গর্ভে বিশ্ব অব্যক্ত অবস্থায় ছিলো, আবার এই শব্দের গর্ভে জগৎ প্রবেশ করবে। এই শব্দব্রহ্ম হচ্ছে ঈশ্বরের শক্তি-স্বরূপিণী। এরই আর এক নাম চিৎশক্তি। হিন্দু শাস্ত্রে বলছে, শিব-শক্তি। যিনি শিবরূপে শান্ত অক্ষয়-অব্যয়-নিস্পন্দ।  আবার শক্তিরূপে ইনিই ক্রিয়াশীল। এই শিব ও শক্তি সহযোগে আত্মা নিজেকে পূর্ন অহং রূপে গ্রহণ করে থাকেন। এই পূর্ন অহংভাবই পরমাত্মার পরম-স্বরূপ। এখানে কোনো আবরণ নেই।  এখানে জীব বা জগৎ বলে কিছুই নেই। আবার এই পূর্ন  অহং-এর সংকোচ-বশতঃ আবরনের সৃষ্টি হয়ে থাকে। এই আবরণ নিজের স্ব-রূপের আবরণ এবং এই আবরনের উর্দ্ধে উন্মুক্ত স্বরূপ সর্বদা বিরাজ  করছেন । এই আবরনের ফলে দুটো জিনিস সংগঠিত হয়। প্রথমত স্বরূপের বিস্মৃতি ; দ্বিতীয়ত এই আবরণকেই স্বরূপ বলে ধরে নেওয়া, বা গ্রহণ করা। উপনিষদ বলছে, লয় ও বিক্ষেপ। লয় তমোগুণের ক্রিয়া, আর বিক্ষেপ রজোগুণের ক্রিয়া। 

আত্মস্বরূপ যখন আবরনে ঢাকা পড়ে তখন একদিকে  মহাশূন্যের আবির্ভাব হয়, অন্যদিকে মায়ার উদয় হয় । একেই জীবাত্মা বা চিত্ত বলা হয়ে থাকে। শুদ্ধ দ্রষ্টা-স্বরূপ চিদাত্মক এই মায়িক প্রমাতাই জীবাত্মা। এই জীবাত্মা তখন মহাশূন্যে ভাসতে থাকে। মহাশূন্য তখন দৃশ্য, আর জীবাত্মা তখন দ্রষ্টা। এখন দ্রষ্টা অর্থাৎ জীবাত্মা তখন মহাশূন্যকে আর আপন বলে মনে করে না। শুরু হলো দ্বৈতভাবের। জীবাত্মা তখন গতিশীল জগতের অসংখ্য দৃশ্য দেখতে পায়। শুরু হলো অবিদ্যার বিক্ষেপশক্তির খেলা। জীবাত্মা  পরম-পুরুষ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিলো। এরপর সংবিত বা উন্মনা ভাবের মধ্যে যখন প্রাণের আবির্ভাব হয়, তখন দৃশ্য সকলের মধ্যে কোনো একটিকে সে আপন করে গ্রহণ করে। তখন দৃশ্য ও দ্রষ্টার মধ্যে একাত্ত্ববোধ তৈরী হয়। একেই বলে অভেদতত্ত্ব। এখন তার দেহ তৈরী হয়।  এই দেহ স্থুল দেহ নয়।  এটি আত্মার প্রাক্তন কর্ম্মজনিত সংস্কারের উত্থান। আত্মা তখন এই দেহটি-সহ স্থুল  জগতে আসবার জন্য পথের অনুসন্ধান করে। এরপর কর্ম্ম-শক্তির প্রভাবে যোগ্য পিতা-মাতার সন্ধান পেলে, সে  মাতৃগর্ভে প্রবেশ করে। মাতৃগর্ভে সে মাতৃকাশক্তির দ্বারা স্থুল দেহের রচনা করে। ধীরে ধীরে মায়ের কাছ থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে, সে নিজেকে পুষ্টিবর্ধন করে। একসময় দেহের পরিপুষ্টির ফলে মায়ের গর্ভ থেকেই  কালের রাজ্যে প্রবেশ করে। ভূমিষ্ট হয়। একেই বলে প্রসব।

অর্থাৎ আমরা বা এই জগৎ একসময় শব্দব্রহ্মের গর্ভে অব্যক্ত অবস্থায় ছিল, ধীরে ধীরে শিব-শক্তির ক্রিয়ার  ফলে বা  রজঃ ও তমঃ গুনের  ক্রিয়ার ফলে জগৎ ব্যক্ত অবস্থায় প্রকাশিত হল । এ যেন একটা খেলা, এখেলা চলছে নিরন্তর।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

------------------------------------  

12.11.2021

শব্দই ব্রহ্ম, নাদব্রহ্ম । (পরিবর্ধিত অংশ)
মান্ডূক্য উপনিষদ-আগম  শুরুতে বলা হয়েছে - ওম  ইতি এতৎ অক্ষরম  ইদং সর্বং। ওম এই অক্ষরটিই এই সমস্ত। ব্রহ্মই অক্ষর কারন এতে কোনো ক্ষর বা ক্ষয় নেই। এই ওম্-কেই বলা হয়  নাদব্রহ্ম বা শব্দব্রহ্ম। 
শব্দব্রহ্মকে  বাক্যের দ্বারা বোঝানো সাহজসাধ্য নয়।   বলা যেতে পারে, অসম্ভব। কেননা বাক্যের মধ্যেই শব্দ, বর্ণ  ওতপ্রোত ভাবে মিশে আছে।  এঁকে আলাদা করা যায় না। আবার জগতের ভাষা ভিন্ন ভিন্ন। তাই ভাষার মধ্যে আমাদের তাঁকে খুঁজতে হবে, কিন্তু এঁকে ভাষা থেকে  আলাদা করা যাবে না।

বলা হয়ে থাকে, যিনি যে ভাষা জানেন, তিনি সেই ভাষাতেই চিন্তা করেন। অর্থাৎ আমি যদি বাঙালি হই, তবে আমি বাংলাতেই চিন্তা করি।  আমি যদি মারাঠি বা গুজরাটি, ওড়িয়া, তেলেগু বা পাঞ্জাবি হই তবে আমার চিন্তাও সেইভাষাতেই সংগঠিত হবে। অর্থাৎ একজন বাঙালি কখনো ইংরেজিতে চিন্তা করতে পারে না। তো একজন বাঙালিকে যদি ইংরেজিতে কথা বলতে হয়, তবে তাকে বাংলা  চিন্তাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে প্রকাশ করতে হবে। 
 
আসলে চিন্তা কোনো ভাষাতে হয় না,চিন্তা হচ্ছে পদার্থ, যা আমাদের মনে চিত্র আকারে প্রকাশিত হয়। এবং পরবর্তীতে  চিন্তা ভাষাতে  রূপান্তরিত হয়। আর যে ভাষা সে জানে, সেই ভাষাতেই এই রূপান্তরন ঘটতে পারে। দেখুন, ভাষা সৃষ্টির আগেই চিন্তার অস্তিত্ত্ব ছিলো। ভাষা মানুষের সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আবিষ্কার হয়েছে। চিন্তার প্রকাশ ভাষাতে ঘটে থাকে। আজও ভাষা আমাদের সমগ্র চিন্তাকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশের যোগ্য হয়ে উঠতে পারে নি। ভাষার ক্রমোন্নতি বা রূপান্তর এখনো ঘটছে। 

আমাদের মনে যে ধারণা বা যে ভাবনার উদয় হচ্ছে শব্দ তার প্রতীক। আর প্রত্যেকটি শব্দ যা আমরা উচ্চারণ করি তার একটা অর্থ আছে। শব্দ হচ্ছে বাচ্য আর অর্থ হচ্ছে বাচক। একই শব্দ বিভিন্ন রকম অর্থের প্রকাশক হতে পারে।  যেমন "গো"   অর্থে আমরা গরু বুঝতে পারি, আবার গো অর্থে পৃথিবীতে বুঝতে পারি। গো-অর্থে গমন করা, অর্থাৎ যথেচ্ছ বিচরণকারীকে বোঝায়। সেই গো অর্থে সংস্কৃতে  পৃথিবী, চক্ষু, ইন্দ্রিয়, সূর্য, চন্দ্র, দিক, জল, কিরণ, ইত্যাদি বিভিন্ন অর্থে এর বিরল প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়। তো একই শব্দ যেমন বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হয়। তেমনি একই বস্তুকে আমরা বিভিন্ন নামে  ডেকে থাকি।  যেমন জল, পানি, (হিন্দি) ওয়াটার (ইংরেজি) ভাসের (জার্মান), ল্যাটিন ভাষায় বলা হয়, একোয়া। কিন্তু এই সমস্তই সেই একই বস্তুর অর্থাৎ জলের ভিন্ন ভিন্ন নাম মাত্র। আমাদের মনে যে ধর্ণা বা ভাবনার জন্ম হয়, তার সঙ্গে ধ্বনির কোনো সম্পর্ক নেই। খ্রিস্টগন বলে থাকেন, "আদিতে ছিলো শব্দ, আর এই শব্দটি ছিলো, ঈশ্বরের সঙ্গে, আর শব্দটিই ছিলো ঈশ্বর". ( In the beginning was the WORD, and the WORD was with the GOD and the WORD was GOD" - John-I.

এখন কথা হচ্ছে, এই শব্দ থেকে কিভাবে এই হাড়-মাস-রক্তের  শরীর হতে পারে, এটা আমাদের কল্পনার বাইরে। এই ব্যাপারটা বুঝতে গেলে, আমাদের জ্ঞানের  অনেক দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হবে। এই একই ধারণা বা সিদ্ধান্ত ছিল, আমাদের সনাতন ধর্ম্মের বিভিন্ন শাস্ত্রে। আবার এই খ্রিস্ট ধর্ম্মের বহু পূর্বে, অর্থাৎ তখন খ্রিস্ট, ইসলাম, বৌদ্ধ ধর্ম্মের জন্ম হয় নি, তখনও  লোগসের ধারণা ছিলো। লোগস কথাটার অর্থ হচ্ছে শব্দ। এই শব্দ থেকেই আলোর সৃষ্টি হলো। এমন কথা শুধু ভারতের মুনি ঋষিগণ নয়, বাইবেলেও এই কথার প্রতিধ্বনি আমরা দেখতে পাই। সেখানে বলা হচ্ছে, প্রভু বললেন,  আলো  হোক, অমনি আলোর প্রকাশ হলো । অর্থাৎ শব্দ ব্রহ্ম এবং সেই শব্দব্রহ্ম থেকে আলোর সৃষ্টি হলো।  
এখন কথা হচ্ছে, আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আমাদের মনের মধ্যে যখন কোনো ভাবনার উদয় হয়, তখন সেই ভাবনাকে রূপদান করবার জন্য, আমরা উপাদান সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়ে থাকি ।  ধরুন আপনার মনের মধ্যে, বা মাথার মধ্যে    একটি বাড়ি তৈরীর ভাবনা এলো, তখন আপনি নিশ্চই এই বাড়ি তৈরির উপাদান সংগ্রহ করতে উদ্যোগী হবেন। এবং ভবিষ্যতে কোনো না কোনো একদিন, এই বাড়ির ভাবনা বাস্তবে ফুটে উঠবে। ঠিক তেমনি সমষ্টি মনে যখন কোনো ভাবনার উদয় হয়, তখন বিশ্বশক্তি একে রূপ দেবার জন্য, উপাদানকে আকর্ষণ করে থাকে। একটা কথা জানবেন, সৃষ্টির প্রথম থেকে যা কিছু এই অখিল মনে ছিল, অখিল মনে আদর্শ রূপে ছিল, সেই আদর্শেরই রূপ পরবর্তীতে প্রকাশ পেয়ে থাকে।  তো যে আদর্শ অখিল মনে চিরকাল বর্তমান থাকে, সেই আদর্শকে রূপ দান করবার সময় হলে,  সমস্ত উপাদান  একত্রিত হতে শুরু করে, এবং একসময় সেই আদর্শের প্রকাশ পায়।
 আবার একটা জিনিস জানবেন, সেই সমষ্টি মনে বা অখিল মনে এই আদর্শের কখনো বিলোপ ঘটে না। জগতের সমস্ত জীব জন্তু যদি মারা যায়, বা সমস্ত জীবজগতের যদি নাশ হয়ে যায়, তথাপি অখিল মনে এই আদর্শ বজায় থাকতে পারে। আর এই আদর্শের সঙ্গে যতক্ষন না বাস্তব রূপটি নিখুঁত  হয়, ততক্ষন এই সৃষ্টিতে ধংসলীলা ঘটতে থাকবে। অর্থাৎ শিল্পী যতক্ষন না তার মন মতো শিল্প সৃষ্টি করতে পারছেন, ততক্ষন তিনি এই ভাঙা-গড়ার কাজ থেকে বিরত হবেন না। আর ঠিক এই কারণেই আমরা চোখের সামনে সৃষ্টি-ধংশ হতে দেখছি।  আসলে ঈশ্বর তার মনের মতো আদর্শকে রূপায়িত করবার প্রয়াসের কোনো বিরতি রাখতে চান না। 

সমস্ত জীব-জগৎ, এমনকি এই পৃথিবী, চন্দ্র সূর্য, নক্ষত্র সবার ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য। বিশ্বশক্তি তার মনে অন্দরে যে রূপের ছবি এঁকেছেন, সেই রূপকে সে চাক্ষুস করতে চান। ধরুন, এই পৃথিবী একসময়, কালের প্রবাহে, বা হঠাৎ করে গ্রহ-নক্ষত্রের আঘাতে ধংশপ্রাপ্ত হলো, তথাপি, ঈশ্বরের মনের মধ্যে এই পৃথিবী মৌলিক অবস্থায় নীহারিকা পূঞ্জের  মতো বস্তুপিণ্ডে পরিণত হবে।  কিন্তু যে আদর্শ পৃথিবীকে নিয়ে অখিল মনে আছে, তা থেকে বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের কোথাও না কোথাও একই উপাদানে আরো একটি পৃথিবী বা আরো উন্নত পৃথিবীর জন্ম হবে। এবং এই ধারা চলতে থাকবে। সেখানেও হয়তো এইরকম বা আরো উন্নত জীব তৈরী হবে। 

পরা-বিদ্যাবিদগন বলছেন, এই পৃথিবীর আগে চন্দ্রে মানুষের অস্তিত্ত্ব ছিল।  তখন চন্দ্র ছিল, গ্রহ। ধীরে ধীরে কালের প্রবাহে, চন্দ্রের বিলুপ্তি ঘটতে চলেছে। চন্দ্র আজ গ্রহ থেকে উপগ্রহে রূপান্তরিত হয়েছে।   একসময় এই চন্দ্রের অস্তিত্ত্ব মহাবিশ্বের  মহাশূন্যে ছড়িয়ে পরবে।  তখন চন্দ্রকে আর চাক্ষুস করতে পারা  যাবে না। আবার এই পৃথিবীও একসময় চন্দ্রের অবস্থা প্রাপ্ত হবে। আবার এই পৃথিবীর ধংসের পরে বুধে জীবনের ক্রিয়া শুরু হবে। সেখানে এখন জীবনী শক্তির সৃষ্টির খেলা চলছে। জীব সৃষ্টির উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির কাজ চলছে। পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন, এই মুহূর্তে শুক্রগ্রহ পৃথিবীর মানুষের থেকেও উন্নত ধরনের জীব বর্তমান। এই সব কথার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আজ গবেষণার বিষয়। ভবিষ্যৎ বলবে এইসব কথার মধ্যে কোনো সত্যতা আছে কি না। 

ঋকবেদে পড়ছিলাম, 
সূর্য-চন্দ্র-মসৌধাতা যথা-পূর্বম কল্পয়ৎ 
দিবং চ পৃথিবীং চ অন্তরিক্ষম অথো স্বাঃ।

কল্পের আরম্ভে বিধাতার মনে সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্রাদি পূর্বকল্পে যেমন ছিল, তেমনই সৃষ্টি করলেন। বিধাতা প্রথম কল্পের ন্যায়ই পূর্ববৎ সূর্য, চন্দ্র, দিব্যলোক, পৃথিবীলোক, অন্তরীক্ষ ও লোকান্তর সৃষ্টি করেছেন।
তো একটা কথা আমরা মনে হয়, যা কিছু সৃষ্টি সবই সমষ্টি মনের খেলা। আর তার শুরুটা হয়েছে শব্দের মাধ্যমে। 

এখন কথা হচ্ছে, শব্দ থেকে কিভাবে এই জগৎ এমনকি জীব শরীর সৃষ্টি হলো। এই রক্ত-মাংসের দেহ কি শব্দ দিয়ে তৈরী করা সম্ভব ? জীব-জগতের সমস্ত দেহ হচ্ছে কতকগুলো কোষের সমষ্টি।  কোষের মধ্যে আছে নিউক্লিয়াস।  নিউক্লিয়াসের মধ্যে আসে নিউক্লিয়াস এসিড। 

বিজ্ঞান বলছে, আজ থেকে ৪৫০ কোটি বছর  আগে,  গ্যাসীয় পুঞ্জ ও ধূলি-বালিকণা ঘনীভূত হয়ে পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল। ১৬০ কোটি বছর আগে, মৌল পদার্থগুলোর মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে, জল, মিথেন, এমোনিয়া, কার্বন-ডাইঅক্সাইড, হাইড্রোজেন সায়ানাইড ইত্যাদি অণুগুলো তৈরি হয়। এর পরে, তাপের বিকিরণের ফলে পৃথিবী ঠান্ডা হতে থাকে ও কিছু গ্যাস তরলে ও কিছু গ্যাস কঠিন পদার্থে রূপান্তরিত হয়। পৃথিবীর এই যে কঠিন রূপ তা হয়তো ৩০০ কোটি বছরের পুরানো। 

--------------------

নমস্তভ্যং বিরূপাক্ষ নমস্তে দিব্য চক্ষুষে। 

আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমাদের প্রাচীন মুনিঋষিগন সবাই কি দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন ছিলেন ? যোগগুরুগন বলে থাকেন, তোমার সাধনফল, তা সে অনুভূতি হোক, প্রতক্ষ্য দর্শন হোক, সেগুলোকে শাস্ত্রবাক্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখবে। যদি দেখো, সেখানে কোনো অমিল আছে, তাহলে জানবে, তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে।  তখন নিজেকে সংশোধন করবার জন্য প্রয়াস করবে। অর্থাৎ জানবে শাস্ত্রবাক্যই ধ্রুবসত্য। শাস্ত্র নির্দেশিত পথই সত্যের পথ। কালের চক্রে পড়ে, নিজেকে ভুল পথে যেতে দিও না।  বলা হচ্ছে শিব দিব্যচক্ষু বিশিষ্ট। ইন্দ্রিয়াতীত তৃতীয়নেত্র বিশিষ্ট শিব, যার দৃষ্টি বিরূপের দিকে।  তাই শিব বিরূপাক্ষ। যে শিবলিঙ্গের আমরা পুজো করি,  এই শিবলিঙ্গ উর্দ্ধরেতা।  আর উর্দ্ধরেতা হলে বিন্দুর অধোগতি হয় না। তাই সৃষ্টি হয় না, হয় সংহার। তাই শিবকে বলা হয় সংহারকর্তা। আবার এই বিন্দুর গতি যখন অধোমুখী, তখন সৃষ্টি। অধোগতি কাম-জনিত, আর উর্দ্ধগতি প্রেমজনিত। স্থিতাবস্থায় না আছে কাম না আছে প্রেম। বিন্দুর অধোগতিতে রূপের প্রকাশ আর বিন্দুর উর্দ্ধগতিতে রূপ অন্তর্হিত হয়ে যায় । 

শক্তিবীনা বিন্দুর না আছে অধোগতি, না আছে উর্দ্ধগতি। শক্তির সংযোগে বিন্দু কম্পিত হয়।  শক্তিকে ধরতে চায় বিন্দু । শক্তির সঙ্গে এক হতে চায় বিন্দু ।  তাই ধাবিত হয়। বিন্দু যতক্ষন বাহ্য পদার্থের সঙ্গে মিশ্র অবস্থায় থাকে, ততক্ষন সে অশুদ্ধ। শুদ্ধ বিন্দু কল্পান্তরে জীবের বা বাইরের পরমাণু সংযোগে নেমে আসে। বা বলা যেতে পারে, পরমাণুসকল শুদ্ধবিন্দুকে টেনে নামিয়ে আনে। যতক্ষন বাইরের পরমাণুর সঙ্গে বিন্দু মিশ্রিত না হয়, ততক্ষন সে কেন্দ্রীভূত একক সত্ত্বা  বা অখন্ড থাকে। শক্তির সংযোগ হলে বিন্দুতে কম্পন ওঠে ও উর্দ্ধদিকে উঠতে থাকে। সাধকের এই সময় থেকে শিবভাবের প্রারম্ভিক অবস্থার তৈরী হয়। জমাট বাঁধে, তাই আর ভাঙে না, কিন্তু গলে যেতে পারে। আমরা জানি জমাট বস্তু আঘাতের শক্তিতে  ভেঙে  টুকরো টুকরো হয়ে যায়, কিন্তু অগ্নির স্পর্শে এলে সেই একই বস্তু গলে যায়, তরল হয়ে যায়। তখন আর তাকে কেটে ভাগ করা যায় না।  জলকে কাটা যায় না।  তখন সে শক্তির সাথে সমান স্বচ্ছ হয়ে যায়, একসময় আরো দাহিকার শক্তির প্রাবল্যে ব্যাপক আকার ধারণ করে, বাস্পে পরিণত হয়ে যায়। এইসময় সাধক নিজের পৃথক সত্ত্বাকে ধরে রাখে, কিন্তু শক্তি থেকে তাকে বিভাজ্য করা যায় না। 

বিন্দুর সাথে প্রকৃতির সম্মন্ধ হলে, বিন্দুকে জড়-পরমাণু ঘিরে ফেলে।  তাকে স্থুল করে নিচের দিকে টেনে নামায়। এর কারন হচ্ছে, বিন্দুতে আছে জড়-সংস্কার। আর প্রকৃতিতে আছে জড়ের আধিক্য। বিন্দুর সুপ্ত  জড়-সংস্কার আছে বলেই বাইরের জড়াংশ এসে তাকে বেষ্টিত করে জড়ের দেশে নিয়ে যায়। বিন্দু যখন জড়-সংস্কার রোহিত হয়, তখন কোনো প্রকৃতি সংযোগ ঘটিয়েও তাকে নিচে নামাতে পারে না। তখন জড়-সংস্কারবিহীন বিন্দু অধোগতি হয় না, বরং উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হয়। তাই সাধকের উচিত বিন্দুকে জমাট বাঁধানোর চেষ্টা করা। বিন্দু একবার কঠিন হয়ে গেলে, জমাট  বেঁধে গেলে, তা আর জড়-প্রকৃতির দ্বারা আকৃষ্ট হয় না।  এইজন্য বলা হয়ে থাকে, সাধকের প্রথম দিকে অবশ্যই প্রকৃতির সঙ্গ ত্যাগ করা উচিত। চিৎশক্তি যদি বিন্দুতে সঞ্চারিত হয়, তাহলে বিন্দুকে জমাট করে দেবে, কম্পনের সাহায্যে। হাতের মধ্যে কাদামাটি নিয়ে হাত ঘোরালে,যেমন, কাদা ধীরে ধীরে শক্ত-স্তূপে পরিণত হয়, তেমনি বিন্দু যখন চিৎশক্তির সংস্পর্শে আসে, তখন তার মধ্যে একটা কম্পন সৃষ্টি হয়, আর বিন্দু জমাট বাঁধতে শুরু করে। আর তখন বিন্দু উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হবে। 

প্রক্রিয়া ১ : স্থির হয়ে বসুন, শরীরকে অচঞ্চল করুন।  এইবার যেকোনো একটা শব্দ শুনতে থাকুন। এই প্রক্রিয়া গভীর রাতে অধিক ফলপ্রসূ হয়। কেননা এইসময় প্রকৃতির মধ্যে  বাহ্যিক আহত শব্দের পরিমান কমতে থাকে। মন দিয়ে শুধু এই শব্দকে শুনতে থাকুন। একাগ্রতা যত  বাড়বে, তত দেখবেন, শব্দ যেন সূক্ষ্ম হয়ে আসছে। এইসময় মন ও শব্দকে একত্রে রাখতে চেষ্টা করুন।  মন যেন এক মুহূর্তের জন্যও শব্দকে ছেড়ে না যায়। মনের একাগ্রতা কম থাকলে, মাঝে মধ্যে এই শব্দকে মন হারিয়ে ফেলবে। তখন আবার মনকে ধরে এনে শব্দের পিছনে বসিয়ে দিন।  শব্দকে ধরে এগুতে থাকুন। মনকে যদি শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন, তখন দেখবেন, শব্দ ধীরে ধীরে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম হচ্ছে, কখনো কখনো অধিক শক্তিশালী হচ্ছে, আর তখন মন আবার শব্দ থেকে নিবৃত্ত হবার চেষ্টা করবে। কিন্তু মনকে ধরে রাখুন, শব্দের সঙ্গে। 

এই যে শব্দকে আপনি শুনছেন, বা অনুসরণ করছেন, তা আসলে বৈখরী বা আহত শব্দ। এই শব্দ আপনি আপনার কর্ন  ইন্দ্রিয় দিয়ে শুনছেন। একটা সময় দেখবে, কানের সামর্থের বাইরে চলে গেছে, এই শব্দ। তখন যে শব্দ আপনি শুনে পাবেন, তাকে বলা হয় অনাহত শব্দ বা ওঙ্কার। একটা সময় এই শব্দ আর মন দ্বারা বা কান দ্বারা শ্রুতিগম্য থাকবে না। তখন যে অবস্থা থাকবে তা হচ্ছে চৈতন্য।  এইসময়  শব্দ চৈতন্যময় হয়ে উঠবে। এই অবস্থা হচ্ছে শব্দের পশ্যন্তি অবস্থা। এর পরে চৈতন্যের অবস্থিতি ক্ষীণ হয়ে আসবে।  চৈতন্য নেই বললেও বলা চলে।  একেই বলে শব্দের পরা অবস্থা। 

প্রক্রিয়া ২ : মূলাধারে আকাশের মধ্যে মনকে নিবিষ্ট করুন। আকাশ যার একমাত্র গুন্ হচ্ছে শব্দ। এখানে অবস্থান করছে পরাশব্দ। নাভিতে এসে এই শব্দ হলো পশ্যন্তি।  হৃদয়ে এসে হলো অনাহত মধ্যমা, কন্ঠে এসে হলো বৈখরী। এখানে এসেই বায়ু সাথে সংঘর্ষে নাদ বক্র আকার ধারণ করে। এবং শ্রুতিগোচর শব্দ বা ভাষারূপে পরিণত হয়। বাসনা থেকে বায়ুর গতি বক্র হয়। এখানেই বিষয়ের প্রথম স্তর। এই স্তরে শব্দ আঘাত পেয়ে বিষয়ে পরিণত হয়। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর দ্বারা যে শব্দ শুনি বা দেখি, সে সব এই স্থূল স্তরের অন্তর্ভাব সম্পন্ন। 

অবয়ব কিভাবে দৃশ্যমান হয় দেখুন। আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। আপনার চারিদিক থেকে চারটি আলো ফেলা হলো। তো আপনার চারটি ছবি দেওয়ালে বা মাটিতে দেখতে পারবেন। এইবার আপনি ভাবুন, আপনার চারিদিক থেকে অসংখ্য আলোর রশ্মি ফেলা হলো, তখন আপনার অসংখ্য ছায়া তৈরি হলো। এখন এই ছায়াকে যদি কোনো উপায়ে স্থুল করা যায়, তবে কিন্তু আপনার অসংখ্য মূর্তি তৈরী হতে পারে। আমাদের ধারনা  হচ্ছে, অন্তত বিজ্ঞান বলছে, বা আমরা প্রতক্ষ্য করছি, আলো  আসে সূর্য থেকে। কিন্তু উপনিষদ বলছে, আলো  আসে পরমাত্মা থেকে। এখন পরমাত্মা কোথায়  আছেন ? উপনিষদ বলছে, পরমাত্মা আছে, আমাদের সবার হৃদয়ে। জীবের  অন্তরাত্মাই পরমাত্মা। অতয়েব যতগুলো রশ্মি জীবাত্মা থেকে বের হবে, ততগুলো অবয়ব বা দেহ দেখা যাবে। এখন এই রশ্মিগুলোকে যদি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়, তখন আর অবয়ব বা দেহ বলে কিছু থাকবে না। 

নিচ থেকে কোনো কিছুকে উপরে তুলতে গেলে, তাকে সূক্ষ্ম  করতে হয়। অর্থাৎ মূল সারবস্তু বাদে, সমস্তকিছুকে পরিত্যাগ করতে হয়। আর এই সার বস্তু সংগ্রহের জন্য, নিজেকে তাপিত করতে হয়। বায়ুকে উর্দ্ধগতি সম্পন্ন করতে গেলে, বায়ুকে তাপ দিতে হয়। মূলাধারে যে ব্রহ্মরন্ধ্র আছে, একমাত্র যেখান থেকে ব্রহ্মচক্রের মার্গ, সেখানে প্রবেশ করতে গেলে, আমাদের স্থুল বায়ু, যার সঙ্গে আছে প্রাণ, আছে  চৈতন্য, তাকে  সূক্ষ্ম-সারবস্তুতে রূপান্তরিত করতে হবে। বায়ুকে সরল গতি সম্পন্ন করতে হবে। ...................................  

দেহের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বিন্দুর আবির্ভাব হয়, আবার এই বয়সের সঙ্গে সঙ্গেই  বিন্দু অপ্রকট হয়। শক্তিবিহীন সার বস্তু গতিহীন। আমরা শুনেছি, সূর্য্যের যেমন রশ্মি আছে, তেমনি পরমাত্মার রশ্মি আছে। আসলে পরমাত্মা অর্থাৎ শব্দ-ব্রহ্ম  থেকে সূর্য তেজ সংগ্রহ করছে। আবার পরমাত্মাই জীবের অন্তরে জীবাত্মা রূপে বাস করছেন। 
অতয়েব যত  রশ্মি এই জীবাত্মা থেকে বার হবে, ততগুলো দেহ বা অবয়ব দেখা যাবে। আসলে সাকার-সিদ্ধি না হলে কায়ব্যূহ তৈরী হতে পারে না। আর প্রত্যেকটি রশ্মি তখনই সাকার হবে, যখন রশ্মির কেন্দ্রবিন্দু সাকার। রশ্মির কেন্দ্র নিরাকার হলে ব্যূহও নিরাকার অর্থাৎ পরিণতিও নিরাকার  হবে। সত্ত্বকে যখন শক্তি বিক্ষুব্ধ করে, তখন তা থেকে বিন্দু বের হয়ে কারণ-বারিতে পতিত হয়। কারন-বারি এই বিন্দুর স্পর্শে জড়-উপাদান থেকে উপাদান সংগ্রহ করে একত্রিত করে এবং দেহ নির্মাণ হয়।  আর সেই দেহে বিন্দুর একাংশ  অনুপ্রবিষ্ট হয়। যদিও দেহে বিন্দুর-অংশ প্রবিষ্ট হয়েছে, তথাপি বিন্দু থাকে নির্লিপ্ত। বিন্দুর এই নির্লিপ্ত অবস্থাই পরমাত্মার অবস্থা।  আর অপর অংশ অভিমানী জীবাত্মা। এই যে দেহ নির্মাণ হলো, একেই বলে লিঙ্গদেহ। এই লিঙ্গ দেহ দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়ে থাকে, চিরকাল নয় ।  যতদিন মুক্তি না হয়, অর্থাৎ চিৎবিন্দু যতক্ষন না এঁকে পুনরায়  আকৃষ্ট করে, ততদিন এই লিঙ্গদেহের স্থায়িত্ত্ব থাকে। একসময় এই লিঙ্গদেহ স্থুলতা প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ স্থুলের ছাঁচ নিয়ে যখন অধোগতি সম্পন্ন হয়, তখন স্থুল  আকার বিশিষ্ট হয়। কিন্তু নিম্নস্তরে অধঃপতিত হয়েও, স্বাভাবিক ভাবে পঞ্চভূতের দ্বারা আবৃত  হতে পারে না। স্থুল পিতা-মাতার মিলনে তেজের বিকাশ ঘটে। এই তেজ লিঙ্গ-কোষের বিকাশ সাধন করে থাকে। এই সময় যেমন যেমন ভাবনা থাকে, লিঙ্কদেহ  তদ্রুপ আকার ধারণ করে থাকে। আর ঠিক এইসময় বাহির থেকে তদ্রুপ ভাবাপন্ন লিঙ্গদেহ আকৃষ্ট হয় ও তাতে প্রবেশ করে।  এর পরে আরো অধোগতি, কালের রাজ্যে প্রবেশ, মৃত্যুপুরীতে প্রবেশ স্থূলতা প্রাপ্তি। তো এর থেকে আমার বুঝতে পারলাম, (১) চিদবীর্য হচ্ছে শুদ্ধসত্ত্ব বিন্দু স্বরূপ। (২) এইবার এই চিদবীর্যের সঙ্গে কারন-বারি সংযোগে লিঙ্গদেহ। (৩) এবার কারন-বারি, লিঙ্গদেহ ও পঞ্চভূত থেকে স্থূল দেহের উৎপত্তি। যা থেকে বা যে বিরাট সত্ত্ব থেকে শুদ্ধ সত্ত্ববিন্দু ক্ষরন হয়েছে, তিনি বিরাটপুরুষ ঈশ্বর। এই ঈশ্বর আমাদের  সবার মধ্যে অন্তর্যামীরূপে অবস্থান করছেন। আবার ইনি সাক্ষী-স্বরূপ অবস্থান করছেন।  (৪) আর এইসবের সঙ্গে সন্মন্ধাতীত চতুর্থ নির্গুণ ব্রহ্ম বা তূর্য্যাতীত। 

এই লিঙ্গদেহই পঞ্চভূতকে একত্রিত রাখে, এই লিঙ্গদেহ আলাদা হয়ে গেলে, পঞ্চভূতের বাঁধন ছিঁড়ে যায়। স্থুল দেহের বিনাশ সাধন হয়, যাকে  আমরা মৃত্যু বলে  থাকি । কিন্তু লিঙ্গদেহ তখনও থেকে যায়। এই লিঙ্গদেহ আবার পরবর্তীতে একই প্রক্রিয়ায় স্থুল দেহের নির্মাণ করে থাকে। একেই বলে পুনর্জন্ম। 

কিন্তু লিঙ্গদেহ থেকে সত্ত্ববিন্দু বের করে নিলে লিঙ্গদেহের বিনাশ সাধন হয়। তখন সত্ত্ববিন্দু সেই বিরাটসত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। লিঙ্গদেহের নাসের ফলে তন্মাত্র ইত্যাদি পরমাণু আকারে ছাড়িয়ে পড়ে । .............................  তাহলে আমরা শব্দ-ব্রহ্ম থেকে স্থুল দেহের নির্মাণ প্রক্রিয়ার একটা আভাস পেলাম। আবার কি করে সেখানে ফিরে যাওয়া যায়, সেই প্রক্রিয়ার কথাও ধীরে ধীরে শুনবো। আমরা যত  বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করবো, তত আমাদের আসা-যাওয়ার পথ আমাদের কাছে পরিষ্কার হবে। অর্থাৎ আমাদের সংযমশক্তি আমাদেরকে বিষয়ের গভীরে নিয়ে যাবে, আমরা নিশ্চই মার্গের সন্ধান পাবো।  ....................  

শব্দহীন শব্দকে শুনুন। (soundless sound)

আমার এক বন্ধু তার একটা ম্যাজিক-শো-তে আমাকে যেতে আমন্ত্রণ করেছিল। তো তার ইন্দ্রজাল দর্শন আমাকে অভিভূত করেছিল।  তো তাকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, এটা কিভাবে করলে ? একথা শুনে সে আমাকে ইন্দ্রজালের একটা বই উপহার দিয়েছিলো, গণপতি সরকারের লেখা। তো বইটা পড়ে, আমার মনে হয়েছিল, এগুলোতো আমিও করতে পারি। শুধু আমি কেন, যেকেউ এটি করতে পারে। শুধু প্রক্রিয়া সম্পর্কে জ্ঞান আর অভ্যাস আমাদেরকে ম্যাজিক শেখাতে পারে। আমরাও পারি। ঠিক তেমনি ধ্যানের  জন্য, ঈশ্বরের অনুভূতি লাভের  জন্যও, আমাদের প্রাচীন মুনি ঋষিগণ কিছু প্রক্রিয়ার কথা দীর্ঘদিনের অভ্যাস ও অনুসন্ধানের ফলে জেনেছিলেন। আমরা যদি তাঁদের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে, প্রক্রিয়াগুলোকে সঠিকভাবে অভ্যাসের মধ্যে আনতে  পারি, তবে আমরাও মুনিঋষিদের যে অনুভূতি তা আমাদের মধ্যেও অনুভব হতে পারে।    

আমাদের পাঁচ ইন্দ্রিয় দ্বারাই আমরা ধ্যানের  অভ্যাস করতে পারি।তবে, কান আমাদের এমন একটা ইন্দ্রিয় যার ক্রিয়া সহজে বন্ধ হয় না। এমনকি শ্রবণ ইন্দ্রিয় আমাদের এমন একটা ইন্দ্রিয় যা আমাদের ঘুমন্ত অবস্থাতেও সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে। তো আজ আমরা কানের সাহায্যে কিভাবে ধ্যানের অভ্যাস করবো, সেই কথা শুনবো।  

শুধু শুনুন।  কিছুই করতে হবে না , শুধু বসে বসে মনোযোগ দিয়ে শুনুন।  আপনি সমুদ্রের গর্জন শুনুন।  আপনি নদীর কুল-কুল ধ্বনি শুনুন। আপনি পাখির গান শুনুন। আপনি ফ্যানের আওয়াজ শুনুন। আপনি ঘড়ির টিক টিক আওয়াজ শুনুন। আপনি বাতাসের শো-শো শব্দ শুনুন। শুধু শুনেই আপনি নিজের মধ্যে একটা শান্তির ভাব অনুভব করতে পারবেন। মুখ দিয়ে কথা বলা, বা চোখ দিয়ে দেখার চাইতে, কান দিয়ে শোনা অনেক সহজ। কান হচ্ছে একটা দরজা, যা খোলাই থাকে -  তাকে খোলাই থাকতে দিন, আর সজাগ থাকুন। 

নাদব্রহ্ম ধ্যান :

নাদব্রহ্ম এটি একটি বহু প্রাচীন তিব্বতীয় প্রক্রিয়া যা ভোরের দিকে অভ্যাস করতে হয়। খালি পেটে  এই  প্রক্রিয়ার অভ্যাস আপনি দিনের যে কোনো সময়, সমষ্টিগত ভাবেও করতে পারেন। এই প্রক্রিয়ার তিনটে ভাগ, (৩০-১৫-১৫)  মোট সময় এক ঘন্টা। 

প্রথম পর্যায় : চোখ বন্ধ করে বিশ্রামের ভঙ্গিতে বসুন। ঠোঁট-দুটো বন্ধ করুন। এইবার "ম্" বা ওঙ্কারের অনুনাসিক ধ্বনি  (ভ্রামরী) অর্থাৎ ভ্রমরের মতো করে আওয়াজ) এই ধ্বনি উচ্চস্বরে উচ্চারণ করতে থাকুন। এমন ভাবে উচ্চারণ করুন, যাতে আপনি ও আপনার পাশের সবাই এই ধ্বনি শুনতে পান। এই ধ্বনির দিকে মনকে নিবিষ্ট করুন। নিজের শরীরের মধ্যে একটা কম্পন আনতে চেষ্টা করুন। মনে করুন, যেন এই ধ্বনি আপনার নাভি প্রদেশ থেকে উৎসারিত হচ্ছে। পেটের  মধ্যে একটা কম্পন হচ্ছে, গলার মধ্যে একটা কম্পন হচ্ছে। মনে করুন, আপনি যেন একটা খালি  কলসি। আর কলসির ভিতর থেকে একটা ধ্বনি বেরিয়ে আসছে, আপনার কান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কানের ভিতরে ধ্বনি প্রবেশ করছে না, কানের ভিতর দিয়ে ধ্বনি বেরিয়ে বাইরে বিস্তার লাভ করছে। এই প্রক্রিয়া করতে করতে একটা সময় মনে হবে, এই ওম (অনুনাসিক  ধ্বনি ) আপনি উচ্চারণ করছেন না, কেবল মাত্র উচ্চারিত হচ্ছে।  আপনি শুধু শ্রোতা হয়ে গেছেন। এই সময় আপনার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিন। এই অবস্থায় ত্রিশ মিনিট থাকুন, বা এই প্রক্রিয়া ত্রিশ মিনিট ধরে করুন।  

দ্বিতীয় পর্যায় :  এই প্রক্রিয়ার সময়কে আধা-আধি ভাগ করে নিন। অর্থাৎ ৭.৫ মিনিট - ৭.৫ মিনিট।  প্রথম সাড়ে-সাত মিনিট : বা  হাতের পাতাকে ডান  হাতের পাতার উপরে স্থাপন করে, নাভিমূলে স্থাপন করুন।  এবার হাতদুটোকে সামনের দিকে প্রসারিত করতে থাকুন। ঠিক  যেন নাভিমূল থেকে উৎসারিত ওঙ্কার আপনি কর্ণকুহর পথে বিশ্বজগৎকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। অর্থাৎ হাতদুটো দিয়ে দুটো গোল চক্রাকারে ঘুরিয়ে আবার নাভিমূলে স্থাপন করুন। অর্থাৎ এই অবস্থায় আপনি দুটো অদৃশ্য  গোল চক্র পরিক্রমা করছেন। এই কাজ করবার সময় ধীরে ধীরে করুন। এতটাই আস্তে হাতের বিস্তার করুন, যেন মনে হবে, হাতের কোনো মুভমেন্টই  হচ্ছে না। মনে মনে ভাবুন, আপনি বহির বিশ্বজগতে  অসীম অনাহত ধ্বনির শক্তি ছড়িয়ে দিচ্ছেন। 

এর পরে ধাপে হাত দুটোকে বিপরীত দিকে ঘোরাতে থাকুন।  অর্থাৎ এবার বহির্বিশ্বের সমস্ত ব্রহ্মশক্তি আপনার কানের ভিতর দিয়ে  নাভিপ্রদেশে প্রবেশ করছে। তো প্রথম পর্য্যায়ে হাতদুটো কে  এমন ভাবে  ঘোরাবেন যেন আপনি বাইরে ওঙ্কারের ধ্বনি ছড়িয়ে দিচ্ছেন, আবার বিপরীতক্রমে অর্থাৎ হাত দুটোকে উল্টোমুখী করে ঘোরান, যাতে মনে হয়, সমস্ত বিশ্বশক্তি আপনার ভিতরে প্রবেশ করছে। 

তৃতীয় পৰ্য্যায় : এবার স্থির হয়ে পাষাণবৎ অবস্থান করুন। নির্জনতাকে উপভোগ করুন।  এই অবস্থায় ১৫ মিনিট থাকুন। এইসময় খেয়াল করুন, প্রথম ৩০সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট আপনার স্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে।  এই ক্ষণকে ধরবার চেষ্টা করুন। -------------------
---------------------  
ওঙ্কার ধ্যান : 
শব্দের অর্থ যেমন আমাদের প্রভাবিত করে, তেমনি শব্দের ধ্বনি-তরঙ্গ আমাদেরকে প্রভাবিত করে।  আর তা শুধু মানসিক দিকে থেকে নয়, শারীরিক দিক থেকেও। বজ্রের শব্দে আমার শরীর কেঁপে ওঠে, কোকিলের মধুর ডাক আমাদের শরীরে এমনকি মনে হিল্লোল  তোলে। মেঝেতে  কাঁচ ঘসার আওয়াজ আমাদের শরীরে বিরক্তির  উদ্রেগ করে। আবার ওঙ্কারের গুরুগম্ভীর  ধ্বনি আমাদের শরীরের মধ্যে একটা পবিত্র স্নিগ্দ্ধ ভাবের আলোড়ন তোলে। আর যদি কোনো ভাগ্যবানের অস্ফূট অনাহত ইন্দ্রিয়াতীত ব্রহ্মধ্বনি শুনবার সৌভাগ্য হয়, তবে তিনি বুঝবেন, তিনি যেন পবিত্র থেকে পবিত্র আলোর তরঙ্গে অবগাহন করছেন। একটা শুদ্ধ মনের অধিকারী হচ্ছেন। 

স্বয়ং শিব বলছেন, আপনি যখন কোনো শব্দ সুর করে বারবার উচ্চারণ করছেন, যেমন ওম যখন আপনি বিশেষ সুরের সঙ্গে  আবৃত্তি করছেন, তখন আপনার ভিতরে সেই  শব্দময় ভাবের উদয় হচ্ছে। ধীরে ধীরে এই ওম উচ্চারণ করুন। সমস্ত শব্দের মূলীভূত কারণশব্দ হচ্ছে এই ওম।  অ, উ, ম - এই তিনটে অক্ষর বা ধ্বনি সংযুক্ত হয়ে ওম সংগঠিত হয়েছে। আর  সমস্ত ধ্বনি তৈরী হয়েছে এই  ওম থেকে। এই তিন ধরনের ধ্বনি (অক্ষর) দিয়েই সমস্ত ধ্বনির উৎপত্তি। বিজ্ঞান যেমন বলছে, ইলেক্ট্রন, নিউট্রন, ও প্রোটন সমস্ত পদার্থের মূল, তেমনি জগতের মূল হচ্ছে এই ওঙ্কার । 

এই ওঙ্কারের উপযোগিতা উপলব্ধি করতে গেলে, প্রথমে ওঙ্কারকে উচ্চস্বরে গাইতে হয়, যাতে পাশাপাশি সবাই এই ধ্বনি শুনতে পায়, আবার আপনিও শুনতে পান। আসলে আমরা যা কিছু মুখ দিয়ে উচ্চারণ করি, তা সবই অন্যকে শোনানোর জন্য। এটাই আমাদের অভ্যাস।অন্যরা বলে আমরা শুনি, আবার আমরা বলি, অন্যরা শোনে।   নিজেকে শোনানোর জন্য, সাধারণত কোনো শব্দের ব্যবহার করি না।আমরা যখন নিজের সাথে কথা বলি, তখন আমরা শব্দের উচ্চারণ সাধারণত করি না।  কিন্তু আমরা যখন মন্ত্র বা ঈশ্বরের স্তুতি উচ্চারণ করি, তা আমারা নিজের জন্যই উচ্চারণ করে থাকি। আসলে আমরা অন্যের সাথে কথা বলি।  আমরা কখনো নিজের সাথে কথা বলি না। কিন্তু এই মহামন্ত্র আমাদের নিজেদের সাথে কথা বলতে শেখায়। আর সমস্ত মন্ত্রের সর্বোচ্চ স্থান আছে এই ওম-এর মধ্যে। ওম একমাত্র ধ্বনি যা আমাদের নাভিমূল থেকে সরাসরি উঠে আসছে।  

এই ওঙ্কারের  যখন উচ্চারণ করবেন, তখন নিজেকে ওঙ্কারের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চেষ্টা করুন। নিজেকে ওম, এই ধ্বনি দিয়ে পূরণ করে তুলুন।  নিজেকে ওম-ময় করে তুলুন। ধীরে ধীরে ওম এই পবিত্র ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়ে যান। নিজের মধ্যে একটা রূপান্তর আনুন।  আর এটি খুই সহজ কাজ। ওম দিয়ে নিজের মনের মধ্যে আলোড়ন তুলতে পারেন, এমনকি আপনার শরীরের মধ্যেও একটা কম্পন তুলতে পারেন। আপনার সমস্ত তন্ত্রে, এই ধ্বনিকে ছড়িয়ে দিন। তখন আপনি ওম এর প্রতিধ্বনি শুনতে পারবেন। কেননা ধ্বনির স্বভাব হচ্ছে, আঘাত খেয়ে আবার উৎসে ফিরে আসা। তো আপনি যখন ওঙ্কারের ধ্বনি বারবার উচ্চস্বরে করতে থাকবেন, তখন তা আপনারই শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে, স্নায়ুতন্ত্রে আঘাতের সৃষ্টি করবে। আর স্নায়ু, কলা ইত্যাদিতে আঘাত খেয়ে সেই  ধ্বনি আবার আপনার কাছে ফিরে ফিরে আসবে। সমস্ত শরীরের মধ্যে একটা কম্পনের অনুভব হবে। কারন এইসময় আপনার স্নায়ু তন্ত্র  শব্দের আঘাতে স্পন্দিত হচ্ছে।  এবং একই ধ্বনি বারবার অনুরণিত হচ্ছে। ফলত প্রতিধ্বনি যা আপনি শুনতে পাবেন, তা কিন্তু আপনার শরীরের ভিতর থেকেই  আসছে, এটা অনুভব করতে পারবেন।  

দেখুন শব্দ আর ধ্বনি যেমন আলাদা, তেমনি ধ্বনি ও সুর আলাদা। শব্দ অর্থবহ।  ধ্বনি অর্থবহ নয়। কিন্তু ভাবের বাহক। আবার দেখুন সুরকরে কোনো গান বা কবিতা উচ্চারিত হয়, তখন তা আরো বেশি অনুভূতি প্রবন হয়ে ওঠে। তো ধ্বনি থেকে সুর আরো বেশি অনুভূতি প্রবন। বেহালার সুরে কথা বা শব্দ থাকতে পারে, আবার নাও থাকতে পারে, কিন্তু সুর আপনাকে আরো বেশি করে টানবে। তাই ওঙ্কারকে বিশেষ সুরের সঙ্গে উচ্চারণ করতে বলা হচ্ছে। 

আবার ধ্বনি আপনার ভিতরে তৈরী হয়ে মুখগহ্বর থেকে নিঃসৃত হচ্ছে, আবার সেই ধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবেশ করে আপনার শরীরের সমস্ত কলা-তন্ত্রে স্পন্দন তুলছে। সেইজন্য মহাত্মাগণ বলছেন, নিজেকে শব্দময় করে তুলুন। তাহলে আপনি শব্দ ও নিজের মধ্যে একটা সাম্য অবস্থার জন্ম দিতে পারবেন। শরীরে একটা একতানতা অনুভব করবেন। একটা মধুর সুরধ্বনি আপনার মধ্যে গুঞ্জন তুলবে। তো ওঙ্কার আপনি যতবার সুর করে উচ্চারণ করতে থাকবেন, তত মধুর অনুভূতি আপনাকে ঘিরে ফেলবে। দেখুন কতকগুলো শব্দ বা ধ্বনি আছে, যা শ্রুতিকটু, কিছু শব্দ বা ধ্বনি আছে যা আমাদের বিরক্তির, বা ভয়ের উদ্রেগ করে থাকে ।  কিন্তু ওম এমন একটা মধুর ধ্বনি যা আমাদের শরীর ও মনে পবিত্রতার ভাব জাগিয়ে তোলে। দেহ মন শুদ্ধ বাতাবরণে ঢেকে যায়। তাই নিরন্তর ওম-এর উচ্চারণ আমাদের শরীরের মধ্যে একটা হারমোনি বা একতানতার সৃষ্টি করে। একটা হার্মলেস বা নির্দোষ শান্তির বাতাবরণ দিয়ে আমাদেরকে ঢেকে রাখে। 

যখন আপনি আপনার শরীরের মধ্যে এই একতানতার উপলব্ধি করতে থাকবেন, তখন ওঙ্কারের উচ্চারণ উচ্ছস্বরে না করে, মুখ বন্ধ করে মনে মনে করতে থাকুন। ঠোঁট বন্ধ করুন, চোখ বন্ধই থাকবে। মনে মনে এই উচ্চারণ অবশ্য়ই করতে থাকবেন, যাতে করে এই ধ্বনির রেশ আপনার সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে যায়। মনে করুন আপনার শরীর একটা বিশেষ বাদ্যযন্ত্র। যেখানে আপনার শিরা-উপশিরা হচ্ছে মনবীণার তার। সেখানে এই উচ্চকোটির ধ্বনির  আলোড়ন তুলছে। আর আপনার শরীরের মধ্যে একটা স্পন্দন উঠছে। এইসময় আপনি একটা নতুন জীবনের সন্ধান পাবেন। জীবনের উদ্দেশ্যকে খুঁজে পাবেন।  এইজন্য বলা হয়ে থাকে পবিত্র ধ্বনির মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে  দিন, আর একটা ভালোলাগা অনুভব করতে থাকুন। কিন্তু কথা হচ্ছে, কেন এইসময় আমাদের এতো ভালো লাগে ? আসলে আমরা এই সময় সুরের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। এখন সুর আপনার ভিতর থেকেই উৎসারিত হচ্ছে, আবার আপনার মধ্যে ধীরে ধীরে স্নায়ুতন্ত্রের সাহায্যে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। আনন্দের রেশটুকু আপনি উপভোগ করছেন।  এইসময় আপনি আপনার "আমি" কে হারিয়ে ফেলবেন।  আপনি তখন একটা চেতন সত্ত্বাতে পরিণত হয়ে যাবেন। আপনি যেন প্রাণহীন, শুধু চেতন সত্ত্বা।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম।        
    



             

      





















  

No comments:

Post a Comment