Wednesday 27 October 2021

দুঃশ্চিন্তাহীন নতুন জীবন (১,২,৩,৪)


 বাস্তব জীবনের গল্প যা জীবন বদলে দিতে পারে। 

ধর্ম্ম বলতে আমাদের  একটা ধারণা  আছে  যে ধর্ম্ম পালন বোধহয়, আমাদের বাস্তব জীবনের সুখ-দুঃখ থেকে বিশ্রাম  নেওয়া। ধর্ম্ম কথাটার সঙ্গে আরো একটা কথা জড়িয়ে আছে, তা হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা।ইংরেজি ভাষায়  একটা  RELIGION  আর একটা SPIRITUALITY

জীবনে এমন কোনো মানুষ দেখলাম না, যার কোনো নাম নেই। এমনকি নামের নাকি একটা অর্থও আছে। নামগুলো নিতান্ত একটা ধ্বনি নয়, তার  একটা অর্থ আছে।  আর এই অর্থের সঙ্গে মানুষটির কোনো মিল নেই। যার মধ্যে বিনয় বলে কিছু নেই, উগ্রতা যার স্বভাবের মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে, তার নাম নাকি বিনয়। এ-এক অদ্ভুত হাস্যসকর ব্যাপার।   আজকাল শুধু তো আবার জীব জন্তুদেরও একটা করে নাম দেওয়া হয়। আর এই মানুষই বোধহয়, সমস্ত বস্তুর, সমস্ত জীব-জন্তুর  একটা করে নাম দিয়েছে। তেমনি মানুষের একটা বিশেষ জীবন ধারার  নাম দেওয়া হয়েছে। ধর্ম্ম বলতে আমরা কিছু নীতিবাক্যের কথা বুঝে থাকি, যা আমাদের জীবনকে একটা নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত করতে পারে। কিছু বিধিনিষেধ যা আমাদেরকে সতর্ক করতে পারে।   অন্যদিকে আধ্যাত্মিকতা  বলতে আমরা বুঝি এক ভাবধারা বা একটা  মানসিক অবস্থা যা আমাদেরকে জীবন ধারনের  জন্য নয়, জীবন থেকে উত্তীর্ন হতে সাহায্য করতে পারে। জীবনের উর্দ্ধে উঠতে সাহায্য করতে পারে। সমাজ জীবনে ধর্ম্ম আমাদের বিশেষ  সংস্কৃতিবান  করতে পারে। তাই সমাজের জীবনীশক্তি এই ধর্ম্মের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আধ্যাত্মিকতা সমাজ-সংস্কৃতির সঞ্জীবনী শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। ধর্ম্ম হারিয়ে গেলে, আমাদের সংস্কৃতি হারিয়ে যাবে। কিন্তু আধ্যাত্মিকতা হারিয়ে গেলে, আমরা পশুবৎ জীবনে প্রবেশ করবো। সমাজের উন্নতির জন্য ধর্ম্ম ঔষধের  কাজ করতে পারে।  কিন্তু আহ্যাত্মিকতা পশু থেকে মানুষকে মহৎ মহামানবে উন্নীত করতে পারে। 

19th October, 2021 

দুঃশ্চিন্তাহীন নতুন জীবন (১) 

আমার এক বন্ধুর বাবার খুব শরীর  খারাপ।  খবর পেয়ে তাকে দেখতে গেলাম।  শুনলাম, ওর দাদার চাকরি চলে গিয়েছে। সেই খবর পাওয়া মাত্রই ওর বাবা শয্যা নিয়েছেন। ডাক্তার এলেন, বললেন, কোনো কিছু বুঝতে পারছি না। কিছু ভিটামিন আর নার্ভের ঔষধ দিচ্ছি, দেখেন কি হয়।  কিছুদিনের মধ্যেই ওর দাদা আবার একটা চাকুরী  পেয়ে গেলো। ওর বাবাও সুস্থ  হয়ে উঠলো। 

ভালো থাকার জন্য, আমরা কতকিছুই  না করি। বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবন অনেক  সহজ হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বরং আধুনিক জীবন আমাদের অনেক বেশি উচ্চাকাঙ্খী করছে। বিজ্ঞান জীবনের একটা দিক দেখে। পৃথিবী থেকে চন্দ্র-সূর্যের একটা ভৌগলিক দিক অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক  দর্শন করতে পারি ।  পৃথিবীকে উপর থেকে ছবি নিলে, পৃথিবীর একপৃষ্ঠ ছবিতে আসতে  পারে। বাকি অর্ধেকটা অদৃশ্য থেকে যায়। একটা নদী দেখলে, আমরা তার উৎস-পরিণতি, পাড়ের ঘরবাড়ি, মানুষজন দেখতে পারি। আমরা ভাবি গতির গতি সমুদ্রমূখী, আর উৎস পার্বতমুখী।  নদীর আরো একটা দিক আছে, যা আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। আর তা হলো, নদী সূর্যমুখী, নদীর সমস্ত জলকণা, এমনকি সমুদ্রের সমস্ত জল বাষ্প আকারে বাতাসের সাহায্যে সূর্য্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সেই জল আবার বৃষ্টি আকারে নদীতে পাহাড়ে জঙ্গলে, এমনকি সমুদ্রে পতিত হচ্ছে। ঠিক তেমনি আমাদের জীবন নদীর প্রবাহে অনেক অদেখা শক্তি কাজ করছে, যা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে  না। মাতৃ গর্ভ থেকে জীবাত্মা  শরীর ধারণ করে, মৃত্যুর সমুদ্রে পতিত হচ্ছে। মৃত্যুই আমাদের কাছে শেষ কথা। কিন্তু কেউকেউ অর্থাৎ আমাদের প্রাচীন মুনিঋষিগন প্রতক্ষ্য করেছিলেন, জীবন মৃত্যুর উপরেও আরো একটা জীবন প্রবাহ আছে, যাকে তারা বলছেন, জীবাত্মার অনন্ত যাত্রা। জীবাত্মা ফিরে ফিরে আসে। .দেহাতীত হয়ে আত্মা সূর্যলোকেই অবস্থান করে, আবার পৃথিবীর টানে, মর্তলোকের  টানে আবার সে ফিরে ফিরে আসে। এইসব কথা বিশ্বাস করতে চান করুন, যারা বিশ্বাস করতে চান না, তারা অহেতুক যুক্তির তর্কের দ্বারা খণ্ডন  করতে গিয়ে সময় নষ্ট করবেন না। বরং নিজে যাতে ভালো থাকতে পারেন, সেই চেষ্টা করুন। 

জীবনে সমস্যা নেই এমন কোনো মানুষ নেই। আর এই সমস্যা যে আমাদের স্বকৃত কর্ম্মের জন্য, একথা অস্বীকার করি কি করে?  কিন্তু কথা হচ্ছে, যার কর্ম্ম তাকেই ফল ভোগ করতে দাও, এই কথা বলে আমরা যেন দুর্ভাগার কাছ থেকে দূরে না সরে থাকি। বিপন্ন মানুষকে সাহায্য করা, আমাদের কর্তব্য হওয়া উচিত। দুর্দশাগ্রস্থ ব্যক্তিকে সাহায্যের হাত বাড়াতে না পারলে, আমাদের মনুষ্য নামক  শ্রেষ্ঠ জন্মের সার্থকতা কোথায় ?  আসুন, আমরা সবাইমিলে জীবনের সমস্যাগুলোর সঙ্গে লড়াই করি। 

অতিরিক্ত পরিশ্রম করে কেউ মারা যায় না। বরং অখাদ্য, কুখাদ্য খেয়ে, অথবা পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে, জীবনীশক্তি নষ্ট হয়। মানসিক উদ্বেগ মানুষকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দেয়। চিতাগ্নি  দেহকে দাহন করে, আর চিন্তা রূপ অগ্নি জীবনকে তিলে তিলে ভষ্মে পরিণত করে দেয়। তো জায়গাটা আমাদের বুঝতে হবে, আর এই গহীন-অরণ্য থেকে আমাদের বের হতে হবে। 

---------------- 

 দুঃশ্চিন্তাহীন নতুন জীবন (২) 

ক্রোধাৎ ভবতি সন্মোহঃ সন্মোহাৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ 
স্মৃতিভ্ৰংশাদ বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রনশ্যতি।  গীতা- ২/৬৩

ক্রোধ থেকে মোহ, মোহ থেকে স্মৃতিবিভ্রম। আর স্মৃতিভ্রষ্ট হলে বুদ্ধিনাশ ঘটে, আর বুদ্ধিনাশের ফলে বিনাশপ্রাপ্তি হয়। 

আমার বাবা ভীষণ রাগী  ছিলেন। আমরা তাঁর ভয়ে সব সময় তটস্থ থাকতাম। বাবা বাড়িতে থাকলে, আমরা আর সবাই যে বাড়িতে আছি, তা কেউ বুঝতেই পারতো না। বাবা রাগের বশে আমার ছোট ভাইকে একদিন নর্দমার মধ্যে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। মাকেও কারনে অকারনে ধমক দিতেন। এমনকি মাঝে মধ্যে তার গায়ে হাত তুলতেন।  আমরা এমনকি প্রতিবেশীদের কেউ প্রতিবাদ করতে পারতেন না। বাবার রাগ এমনই ভীষণ ছিল, হিজড়া যারা কাউকেই কখনো তোয়াক্কা করতো না, তারাও বাবা বাড়ি থাকলে, আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করতে চাইতো না। বাবাকে সবাই সমীহ করে চলতো। এমনকি বাবাকে কেউ উপেক্ষা করবার সাহস দেখাতো না। বাবার যারা সমবয়সী, তারাও বাবার এই রাগকে প্রশমিত করবার সাহস পেত  না। তখন বুঝতাম না, এখন বুঝি, বাবা এই রাগের কারণেই পেপটিক আলসারের রোগে ভুগতেন। আর এই কারণেই  অসহ্য পেটের  ব্যথায় কষ্ট  পেতেন। 

আমাদের প্রত্যেকের জীবনে একটা চাপা উত্তেজনা আছে, আছে যন্ত্রনা, আছে দুঃখকষ্ট। এইযে জীবনের কষ্ট তা  সহ্য করবার ক্ষমতা ভগবান সবাইকে  সমান ভাবে দেন নি। এই দুঃখ-কষ্ট আর আমাদের অহংভাব, আমাদের বঞ্চিত বস্তু না পাওয়া, আমাদেরকে ক্রোধান্বিত  করে তোলে। আর এই রাগের প্রকাশ আমাদের জীবনকে আরো দুর্বিষহ করে তোলে। 
সারাদিন বাইরে বাইরে পরিশ্রম করে, সারাদিন বাইরে লোকের কাছে অপমানিত হতে হতে, মানুষের মধ্যে একসময় রাগের জন্ম হয়।  আর এই রাগের বহিঃপ্রকাশ প্রকাশ হয় অদ্ভুতভাবে , দুর্বল আপনজনের ঘাড়ে  গিয়ে পড়ে, নতুবা সে নিজেই নিজের ক্ষতি করে বসে। নিজের মাথার চুল ছিড়তে থাকে।  একসময় রাগের বসে এমন কাজ করে বসে যার জন্য তাকে অনুতপ্ত হতে হয়। রাগের বসে একবার বাবা আমার দাদাকে খড়ম দিয়ে মাথায় আঘাত করেছিলেন । দাদার মাথা কেটে গলগল করে রক্ত ঝড়তে থাকে।  দাদা অজ্ঞান হয়ে যায়। আমরা হাসপাতাল থেকে ডাক্তার ডাকতে ছুটি। (হ্যাঁ তখনকার দিনে,  হাসপাতালের ডাক্তারবাবুকে বাড়িতে ডাকলে, তিনি বাড়িতে এসে রুগী দেখে যেতেন।) ডাক্তারবাবু এসে, দাদার মাথায় ৫/৬টি শেলাই করে দেন। বাবা তখন বুম  মেরে বসে ছিলেন ।  হয়তো অনুশোচনা করছিলেন। কিন্তু রাগের বশে যা তিনি করে ফেলেছেন, তারজন্য যা ক্ষতি হবার তাতো হয়ে গিয়েছিলো। তাই দাদা বাবাকে ভয় করতেন, হয়তো শ্রদ্ধাও করতো কিন্তু ভালোবাসত কিনা আমার সন্দেহ আছে। 

রাগ আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। রাগের সময় আমাদের মস্তিকের রক্তবাহী শিরা ছিঁড়ে  যেতে পারে। এমনকি রাগের চোটে, আমাদের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। - এমনকি এরফলে আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। রাগ  পুষে রাখলেও আমাদের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। পুষেরাখা রাগ, ভবিষ্যতে আমাদেরকে   এমন কাজে আকস্মিকভাবে  নিয়োগ করে ফেলতে পারে, যা আমরা স্বাভাবিক অবস্থায়  চিন্তাও করতে পারে না। 

এখন কথা হচ্ছে, রাগ কি আমাদের বাহ্যিক ঘটনার সংস্পর্শে ঘটে থাকে ? নাকি এর জন্য আমাদের শারীরিক গঠন দায়ী ? কিছু লোককে আমরা রাগী  লোক বলেই চিহ্নিত করে থাকি। আর এদেরকে আমরা সাধারণত এড়িয়ে  যেতে চাই। আমরা জানি গ্রন্থির অন্তর্মুখী রসের সূক্ষ্যাংশ দ্বারা আমাদের মন গঠিত হয়। আর মানসিক গঠনের উপরে মানসিক জীবন পুষ্টিলাভ করে থাকে। এই গ্রন্থিচক্রে রসের নিঃসরণের প্রকার ও পরিমান ভেদের কারনে মানুষে মানুষে প্রভেদ দেখা যায়। ব্যোমগ্রন্থি, বায়ুগ্রন্থি, অগ্নিগ্রন্থি, বরুনগ্রন্থি, পৃত্থিগ্রন্থি, অহংগ্রন্থি, মহৎগ্রন্থি এইযে সাতটি  গ্রন্থি, আমাদের শরীরে আছে, তারমধ্যে সবকটি গ্রন্থি সবার শরীরে সমান ভাবে কার্যকরী থাকে না। বিশেষ গ্রন্থির আধিক্য হেতু, মানুষে মানুষে স্বভাবের তারতম্য দেখা যায়।  যাদের অগ্নিগ্রন্থির প্রাবল্য থাকে, তাদের মধ্যে ধৈর্য্যের অভাব দেখা যায়।  এদের মধ্যেই অস্বাভাবিক ক্রোধের বহির্প্রকাশ দেখা যায়।  দেখবেন  একই ঘটনা,  বিভিন্ন মানুষের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে আলোড়ন তোলে। তাই কেউ রেগে যায়, আবার কেউ দুঃখ পায়, কেউ আবার আনন্দ পায়। আপনি হয়তো ভাবছেন, একই ঘটনায় কেউ আনন্দ পায়, আবার কেউ দুঃখ পায়,  এমনটা আবার হতে পারে নাকি ? হ্যাঁ পারে।  আমার এক বন্ধুর ছেলে, বাজারে গেলেই, বাবাকে মুরগির দোকানে টেনে নিয়ে যেতো।  আর সেখানে মুরগি কাটা দেখে, সে আনন্দে লাফাতো। আবার এমন অনেক বাচ্চাকে দেখেছি, এসব দেখলে, সে চোখবুজে থাকতো। কিংবা সেখান থেকে দ্রুত সরে পড়তো। আমার ছেলে, ছোটবেলায়,   জ্যান্ত মাছ কাটা দেখতেই  পারতো না।  মাকে সে কিছুতেই জ্যান্ত মাছ কাটতে দিতো না। কান্নাকাটি জুড়ে দিতো। এগুলো সবই আমাদের শরীরের গ্রন্থির খেলা। 

আমাদের নেতিবাচক চিন্তার বা আবেগের ফলে, আমাদের শরীরে একটা রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়, আর এর ফলে ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থের নিঃসরণ হতে থাকে।  আবেগের ফলে মানুষের যখন কান্না পায়  তখন তার চোখদুটো জলে ভোরে আসে।  এমনকি নাক দিয়ে জল ঝড়তে শুরু করে।
আমরা প্রায় কেউই জানিনা, এই আবেগকে কিভাবে সংযত করবো। আমরা রেগে গেলে, আমাদের চোখ লাল হয়ে যায়, ভ্রু কুঁচকে যায়, এমনকি গলার স্বর উচ্চস্তরে বাধা হয়ে যায়, আমরা চিৎকার করতে থাকি।  এইসময় আমাদের রক্তচাপ বেড়ে যায়। হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। রাগ প্রশমনের সঙ্গে সঙ্গে এগুলো আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এইযে আমাদের ক্রোধের ফলে শারীরিক পরিবর্তন তা আমাদের স্বাভাবিক শরীরের ভারসাম্যকে নষ্ট করে দেয় ।  এমনকি আমার শরীর, হাত-পা কাঁপতে থাকে।রাগ দেখিয়ে, বিপক্ষকে হয়তো দমিয়ে রাখা যায়, বা ভয় দেখানো যায়। আর এতেকরে আমার উদ্দেশ্য হয়তো কখনো কখনো সফল হয়, কিন্ত আখেরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়, ক্রোধান্বিত ব্যক্তির। এমনকি এর ফলে তার জীবনের আয়ু কমে যায়। তো আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, আমরা যেন ক্রোধের স্বীকার না হই।  
--

দুশ্চিন্তাহীন  নতুন জীবন (৩) SASANKA SEKHAR LIFE STYLE 

চিন্তা তা সে সে সুচিন্তা হোক, বা দুশ্চিন্তা যা-ই হোক, এই দুই ধরনের চিন্তাই আমাদের স্বভাবের সঙ্গে মিশে আছে। আমাদের জন্মের পর থেকেই আমরা বাঁচার জন্য লড়াই শুরু করে দেই । জন্মের পর থেকেই আমাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণার  উদ্রেগ হয়। এই যে ক্ষুধা তৃষ্ণা এর জন্য আমাদের কোনো প্রয়াস করতে হয় না। এমনি এমনি হয়। অর্থাৎ শরীরকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য, শরীরকে বর্দ্ধিত করবার জন্য, ভগবান প্রদত্ত একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এটি। এর পরেই যে জিনিষটি মনের  মধ্যে স্বাভাবিক ভাবে আসে, তা হচ্ছে, ভয়। এই ভয়ের ভাব জাগিয়ে তুলবার জন্যও আমাদের আলাদা করে কিছু করতে হয় না। কিন্তু কিসের  এই ভয় ? কিসের জন্য এই ভয় ? মৃত্যু ভয়।  ক্ষুধা তৃষ্ণা যেমন শরীরকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য স্বাভাবিক চাহিদা। তেমনি ভয় আমাদেরকে মৃত্যু থেকে রেহাই পাবার  রক্ষা কবচ। এই ভয় মানুষকে সতর্ক করে মৃত্যুর থেকে দূরে থাকবার জন্য। মায়ের কোল  থেকে পরে যাবার ভয়, বিছানা থেকে পরে যাবার ভয়। এই ভয় যদি মানুষের স্বভাবের মধ্যে ভগবান না দিতেন, তবে মানুষ এমন সব কাজ করে ফেলতো, যাতে তার জীবন বিপন্ন হয়ে উঠতো। তো ভয় আমাদের জন্মগত মানসিক বৃত্তি। ক্ষুধা-তৃষ্ণা যেমন আমাদের শরীরের স্বাভাবিক চাহিদা, শরীরের বৃত্তি , ভয় তেমনি আমাদের মানসিক বৃত্তি । বেঁচে থাকবার সতর্কিকরন বৃত্তি। ভয় থেকেই আমরা সতর্ক হয়ে যাই। মহাত্মাগণ বলছেন, পূর্ব-পূর্ব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই আমাদের দুটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া আয়ত্ত্ব করে থাকি। বার বার আমরা না খেতে পাওয়ার  যন্ত্রনা ভোগ করছি, বারবার আমরা মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছি। সেই অভিজ্ঞতা আমাদের সূক্ষ্ম কারন শরীরে স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেছে। 

এই ভয় থেকেই, বা বেঁচে থাকবার তাগিদ থেকেই  আসে আমাদের চিন্তা। যা আসলে আমাদের মানসিক বৃত্তি। বেঁচে থাকবার জন্য অনুকূল ও প্রতিকূল অবস্থাকে বিচার করে থাকে আমাদের এই  চিন্তা-সম্পদ । তো আমরা যখন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে যখন পরে যাই, তখন যে চিন্তা আমাদের মধ্যে আসে, তাকে বলে দুশ্চিন্তা। তো ক্ষুধা তৃষ্ণা ভয় সমস্ত জীব বা প্রাণীর মধ্যেই ভগবান দিয়ে দিয়েছেন। প্রাণী মাত্রই এই তিনের অধিকারী। 

ভয়ের উল্টোটা হচ্ছে, সাহস। তো আপনি যখন নিজেকে দুর্বল ভাববেন, অর্থাৎ পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করবার জন্য নিজেকে অসহায় ভাববেন, তখন ভয় আপনাকে আঁকড়ে ধরবে। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে আমাদের হীনমন্যতা কাটিয়ে উঠতে হবে। অর্থাৎ মানসিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে। এই মানসিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে, দুটো জিনিস জ্ঞান-অভিজ্ঞতা,  ও ঈশ্বর নির্ভরতা। জ্ঞান আমরা দুই ভাবে সংগ্রহ করতে পারি, এক হচ্ছে অন্যের জীবনে এই পরিস্থিতিতে তারা কি করেছিলেন, সেই কথা জানা। অর্থাৎ মহাত্মাদের জীবনীগ্রন্থ পাঠ  করা। আর একটি, এই অবস্থাতে আপনি নিজে আগে কি করে বেঁচেছিলেন। দ্বিতীয়তঃ অন্য কারুর প্রতি নির্ভর করা। তা সে মা-বাবা হতে পারে, অর্থাৎ অধিক শক্তিশালীর শরণ নেওয়া। এই অধিক শক্তিশালী হচ্ছেন, স্বয়ং ঈশ্বর বা বিশ্বশক্তি যাঁকে  আমরা কেউ দেখতে পাই না, কিন্তু তিনি আমাদের দেখতে পান। আর আপনি যদি মন-প্রাণ দিয়ে ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পন করতে পারেন, তবে জানবেন, ঈশ্বর আপনাকে পথ দেখিয়ে দেবেন।  আপনার কাজ সেই পথে নিজেকে পরিচালনা করা। ঈশ্বর আপনার মনে সাহস এনে দেবেন। আর  আপনার মনে যদি সাহস থাকে, তবে যেকোনো সমস্যায় আপনি শান্ত চিত্তে স্থির সিদ্ধান্তে আসতে  পারবেন। সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ভীতু মানুষ বাঁশের সাঁকো পার হতে গিয়ে সাঁকো নাড়িয়ে, নিজের বিপদ ডেকে আনে।  আর সাহসী মানুষ নির্ভিক চিত্তে জীবননদী পেরিয়ে যায়, উদ্বেগবিহীন ভাবে। তো আপনাকে সাহসী হতে হবে, ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে, আর মহাত্মাদের পথ অবলম্বন করতে হবে। 
-----------------       

আর এক্ষেত্রে আমাদের প্রথম দরকার হয়ে পরে,  

যাই হোক, আমরা শুনছিলাম, এই ক্রোধ আমাদের অগ্নিগ্রন্থির ক্রিয়া। তাই আমরা স্বামী শিবানন্দ সরস্বতীর কাছ থেকে  অগ্নিগ্রন্থির কথা একটু শুনে নেবো । 
ইংরেজ পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন বলছেন,   পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ-খাওয়ানোই হচ্ছে বুদ্ধিমত্তা।   

অগ্নিগ্রন্থি :  প্লীহা,(SPLEEN)  যকৃৎ (LIVER), অগ্ন্যাশয় (PANCREAS) , সূর্য্যগ্রন্থি, SUNGLAND শুক্রগ্রন্থি (SPARM GLAND)  
----------------------

 মনকে শান্ত করবার সাতটি উপায়।  
১. আমাদের মন যখন বিষয়গত কারনে উদ্বিগ্ন বা চঞ্চল হচ্ছে, তখন  এই অস্থির মনকে শান্ত করবার জন্য, সেই অস্থিরতার কারন যে বিষয়চিন্তা সেখান থেকে তাকে সরিয়ে অন্য বিষয়ে নিবদ্ধ করা।  এতে করে মন শান্ত হয়ে উঠবে।  
২)  মনকে শান্ত করবার জন্য আমাদের মৃত্যু চিন্তা করা উচিত।  মৃত্যু চিন্তা করলেই দেখবেন, মন এক লহমায় শান্ত হয়ে গেছে। মনকে শান্ত করবার এটি সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। 
৩) মহাত্মা গন বলছেন,  নাসিকাগ্রে,  তালুতে প্রভৃতি ইন্দ্রিয়স্থানে মনকে ধারণা বা একাগ্র করলে, অলৌকিক দিব্য  গন্ধাদির সাক্ষাৎ লাভ হয়, এতেকরে আমাদের শাস্ত্রে বিশ্বাস বা আগ্রহ জন্মে এবং চিত্ত স্থির হয়।
৪) হৃদয়মধ্যে প্রকাশশীল চিত্তসত্ব বিষয়ে ধারণা  করলে, শোকরহিত জ্যোতির্ময়ী প্রবৃত্তি উৎপন্ন হয়, তাতেও চিত্তের স্থৈর্য সম্পাদন হয়।
৫) যাঁদের মধ্যে আসক্তি নেই, তেমন মহাপুরুষের চিত্তে সমাধি করলে চিত্ত স্থির হয়। 
৬) স্বপ্নে দেখা, দেবতামূর্তি অথবা সাত্ত্বিকী সুষুপ্তি-বৃত্তিকে অবলম্বন দ্বারাও, যোগীর চিত্ত স্থির হয়। 
৭) সুখদায়ক কোনো স্মৃতি মনের মধ্যে জাগিয়ে তুললে, মন আনন্দে  ভরপুর হয়ে ওঠে ও চিত্ত স্থির হয়।


দুশ্চিন্তাহীন  নতুন জীবন (৪) SASANKA SEKHAR LIFE STYLE 

আমরা সবাই ব্যস্ত। কারন আমরা সবাই সামাজিক জীব। আমাদের অনেক কর্তব্য আছে। আমাকে আমার বাবা-মাকে সন্তুষ্ট করতে হবে, আমাদের ছেলেমেয়েদের সন্তুষ্ট করতে হবে। অফিসের বসকে সন্তুষ্ট করতে হবে। পাড়ার পরিবেশীদের সন্তুষ্ট করতে হবে। আর এই কর্তব্য করতে গিয়ে, আমরা নিজের সন্তুষ্টির কথা ভুলে বসে আছি। আমরা অন্যকে সন্তুষ্ট করার মধ্যে ভালো থাকতে চাইছি। আর কর্তব্য করতে করতে নিজের কষ্ট ডেকে আনছি।স্বামী  বিবেকানন্দ বলছেন, "কর্তব্য আমাদের রোগবিশেষ হয়ে পরে এবং তা আমাদের সবসময় সামনের দিকে টেনে নিয়ে যায়। কর্তব্য আমাদেরকে ধরে রাখে এবং আমাদের সারা জীবনটাই দুঃখপূর্ণ করে তোলে। এটি মনুষ্যজীবনের ধ্বংসের কারন। ....... কর্তব্য মানুষের অন্তরাত্মাকে দগ্ধ করে দেয় । কর্তব্য বেচারাকে ভগবানকে ডাকবার অবসারটুকুও দেয়  না। স্নানাহারের সময় পর্য্যন্ত দে না।  কর্তব্য যেন সর্বদা তাদের মাথার ওপর ঝুলছে। কর্তব্যের টানে, সারাদিন বাড়ির বাইরে কাজ করে, বিড়ি ফিরে এসে আবার কর্তব্য করতে বসে, রাতে ঘুমুতে যাবার আগে, আবার কালকের কর্তব্যের কথা চিন্তা করে। এই কর্তব্যের হাতথেকে যেন মুক্তি নেই। তো এতো ক্রীতদাসের জীবন। আর কর্তব্য করতে করতে একসময় ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে, মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে। মৃত্যুর সময় যমদূত যখন শিয়রে এসে দাঁড়ায়, তখনও এরা  কর্তব্যের কথা চিন্তা করে। আমি কর্তব্যের জন্য, না আমার জন্য কর্তব্য এই কথাটা এরা  ভুলে যায়।  এরা  কর্তব্যের ক্রীতদাসে পরিণত হয়ে যায়।
তাহলে কি আমাদের কর্তব্য সম্পর্কে যে ধারণা তাতে কোনো ভুল আছে ? 

কর্তব্য কোথায় কিভাবে পালন করতে হবে, সে বিষয়ে আমাদের আরো গভীরভাবে ভাবতে হবে। নিজ সমস্যা সমাধানের উপায় না খুঁজে আমরা অপরকে  সাহায্য করতে এগিয়ে যাই। আর এটি আমরা করে থাকি ভালোবাসার তাগিদে নয়, আত্মতুষ্টির স্বার্থে। আমরা আত্মগরিমার তুষ্টির জন্য অন্যদের ব্যাপারে নাক গলাই । আর এতেকরে, আমরা অন্যের পছন্দের পাত্র না হয়ে অপছন্দের পাত্র হয়ে উঠি।  শেষ জীবনে এসে দেখি, ছেলে-মেয়ে, এমনকি নিজের স্ত্রী আমাকে সহ্য করতে পারছে না। কেননা, আমি অযাচিত ভাবে তাদের উপকার না করে স্থির থাকতে পারি না। আমরা অন্ধকে রাস্তা পার করে দিতে চাই।  কিন্তু একথা জিজ্ঞেস করি না, সে রাস্তা পার হতে চায় কি না। আমরা বোকাকে বুদ্ধিমান করতে চাই, কিন্তু সে বুদ্ধিমান হতে চায় কিনা তা আমরা ভুলেও জিজ্ঞেস করি না। লোন  করা টাকায় আমরা কম্বল বিতরণ করতে চাই। কিন্তু আমরা জানিনা, তার কিসের দরকার, খাবার না কম্বল।  ফলত আমাদের লোনের টাকায় কেনা কম্বল তার কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। 
-------------------
ভালো থাকতে গেলে গুরুকে খুঁজুন। 

"গুরুদেব" কথা শুনলেই, আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনের কথা মনে পড়ে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, জীবনকে মসৃন করতে গেলে, জীবনে কিছু শিখতে গেলে, জীবন-সমস্যার সমাধানের জন্য, একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির সাহায্য অবশ্য়ই প্রয়োজন। আমাদের অবশ্য়ই একজন বা একাধিক গুরুর প্রয়োজন। একজন শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিকে আপনি অভিভাক হিসেবে নির্বাচন করুন। যদি মা -বাবা বেঁচে থাকেন, তবে তাদেরকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ত্ব দিন। তার কথায়  অবশ্য়ই গুরুত্ত্ব দিন। তার প্রতি বিশ্বাস রাখুন। অথবা  যার সাথে কথা বললে আপনার ভালো লাগে, যিনি আপনার বাড়িতে এলে আপনার ভালো লাগে, যার বাড়িতে গেলে আপনার ভালো লাগে, হতে পারে সে আপনার অনেকদিনের বন্ধু, হতে পারে সে আপনার অফিসের বস,  হতে পারে সে আপনার পাড়ার কোনো বয়স্ক ব্যক্তি। যাকে  আপনি মনের কথা মনখুলে বলতে পারেন, যার কাছে আপনি শান্তনা পান, স্বস্তি পান, যার কাছে আপনি প্রশ্রয় পান, এমন একব্যক্তিকে নির্বাচন করুন, যাকে  আপনার বুদ্ধিমান বলে হয়।দেখুন, গুরুভিন্ন আমাদের চুরিবিদ্যাও রপ্ত হতে পারে না। জীবনভর বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য, এইসব অভিজ্ঞ ব্যক্তির কথার অনেক গুরুত্ত্ব। এর মধ্যে কোনো রহস্যের সন্ধান করতে যাবেন না। বিজ্ঞান সম্পর্কে এমনকি সহজপাঠ পড়তে গেলেও একজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের প্রয়োজন, তেমনি জীবনবিদ্যা অর্জন করবার জন্য একজন অভিজ্ঞ মানুষের খুব প্রয়োজন। একটা জিনিস জানবেন, সামনের দিন কেমন হবে, তা আপনি জানেন না , কিন্তু যিনি এই বয়স পেরিয়ে গেছেন, তিনি জানেন, কোনো বয়সে কি সমস্যা আসতে  পারে।  আর তার সমাধান কিভাবে করতে হবে। একটি নয় বছরের কন্যা জানেনা, একদিন তার ঋতুস্রাব শুরু হবে। তো আকস্মিকভাবে এই অবস্থার মধ্যে পড়লে, সে ঘাবড়ে যাবে। এমনকি কান্নাকাটি শুরু করে দিতে পারে।  কিন্তু যখন সে মা-মাসির কাছে, বা দিদির কাছে, বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত হয়, তখন সে এটিকে জীবনের স্বাভাবিক অবস্থা বলে ভাবতে শুরু করে।  এবং এই অবস্থায় আমাদের কি করা উচিত সে সম্পর্কে সতর্ক হয়ে যায়। 

অর্জুনের মধ্যে যুদ্ধ সম্পর্কে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। আর মন মোহগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল। সখা শ্রীকৃষ্ণের কাছে সে নিজেকে সমর্পন করে বলেছিলো, আমাকে পথ দেখাও। আচার্য্য শঙ্কর তার বিবেক চূড়ামণি গ্রন্থে - শিষ্য বলছেন, হে গুরুদেব, আমি জন্ম-মরন তরঙ্গ-সংকুল সমুদ্রে পড়েছি, এই কষ্ট  থেকে আমাকে রক্ষা করুন। 

হিন্দুদের মধ্যে দ্বিজ হবার একটা প্রথা আছে। কুলগুরুর একটা প্রচলন আছে। যদিও আজকাল আর সেইসব কুলগুরুর সাক্ষাৎ আর পাওয়া যায় না। নির্ভরতায় একটা স্বস্তির ভাব জাগে মনে। সমর্পণের মধ্যে  একটা শান্তি আছে। স্বাভাবিকভাবে জীব অজ্ঞান হয়ে জন্মায়। তো জীবনপথে চলতে গেলে, তার জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন করতে হয়। চোখে তো জগতের দৃশ্য দেখতে পায়। তাকে ভাষা শিখতে হয়, মনের ভাব প্রকাশ করবার জন্য , তাকে জানতে হয়, কোন জিনিসের কি নাম ।  কোন  জিনিসের কি উপকার বা অপকার।  কোনটা খেলে ভালো হবে, কোনটি খেলে খারাপ হবে। কিসে হাত দিলে হাত পুড়তে পারে, কিসে হাত দিলে হাতে ঠান্ডা লাগবে। কোন জিনিসের কেমন স্বাদ।  ইত্যাদি ইত্যাদি জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা কারুর না কারুর সাহায্য ভিন্ন আমরা বাঁচতে পারি না। আসলে কোনো মানুষই একা বাঁচতে পারে না। আমরা সবাই সবার সাহায্য নিয়ে বেঁচে থাকি। তো বাহ্যিক স্বাভাবিক  জীবনে যেমন আমাদের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন, তেমন সমস্যা সংকুল জীবনে আমাদের মানসিক শরীরকে সাহায্য করবার জন্য প্রয়োজন একজন প্রকৃত জ্ঞানী , যিনি আমার প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন, যিনি আমাকে বিপদের দিনে সঠিক পথের  সন্ধান দিতে পারেন, এমন একজন মানুষের খুব প্রয়োজন। 

জীবনের দুটো দিক, একটা হচ্ছে জীবন সমস্যা সংকুল, জীবনবোধ মানেই অভাব বোধ,  জীবন মানেই মৃত্যু থেকে বাঁচার লড়াই। আবার অন্যটি হচ্ছে, জীবন মানে আনন্দ। সমস্যা সমাধানে আনন্দ, অভাব মেটানোতে আনন্দ, আবার মৃত্যুকে হারিয়ে বেঁচে থাকবার আনন্দ। সমস্যার জন্য, আমাদের আগবাড়িয়ে কিছুই করতে হয় না। জন্মের পর থেকেই শরীরের খাদ্যের অভাব বোধ হয়, জীবন শুরুতেই স্বাসের অভাববোধ হয়। আর এই অভাবকে মেটাতে গেলে আমাদের ক্রিয়াশীল হতে হয়। তাই এই পৃথিবীকে বলা হয়, কর্ম্ম-জগৎ। এই জগতে কর্ম্মহীন হয়ে কেউ থাকতে পারে না। আর কর্ম্মের গুড় রহস্যঃ আমরা জানি না।  কি করলে কি হবে, তা আমরা জানি না। তবুও কর্ম্মহীন হয়ে থাকতে পারি না। আর ভুল কর্ম্মের জন্য, জন্য আমাদের শাস্তি পেতে হয়। 

 ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলছেন, বিকারহীন, মরনহীন, সদ্বস্তুকে জানতে গেলে আমাদের অন্তরাত্মাকে জাগাতে হবে। আর এই অন্তরাত্মাকে জাগাতে গেলে, আমাদের শুধু শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ করা বা এই সম্পর্কে আলোচনা করাই  যথেষ্ট নয়।  এর জন্য দরকার আমাদের অনুভূতিশক্তিকে শক্তিশালী করা। আমাদের অন্তরে যে আলোকরাশি প্রজ্বলিত আছে, সেই অন্তর্লোকের প্রতক্ষ্য অনুভূতি চাই। এখন কথা হচ্ছে, এই দেহের মধ্যে সেই আত্মজ্যোতি বিরাজ করছে, তবে তা আমাদের কেন উপলব্ধ হচ্ছে না, আর কিভাবেই বা এই আত্মজ্যোতিকে আমরা প্রতক্ষ্য করতে পারবো।  আর এই আত্মজ্যোতি প্রতক্ষ্য করলেই বা আমাদের কি এমন পরিবর্তন হবে, যাতে করে আমরা আনন্দে থাকতে পারবো ? কেননা আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে আনন্দে থাকা। 

দেখুন যা দেহ থেকে জন্মেছে, তাই দেহ।  আর যা আত্মা থেকে জন্মেছে তাই আত্মা। আবার গুলিয়ে গেলো।  দেহ থেকে যা জন্মেছে, সেটি দেহ তা না হয় বোঝা গেলো।  কিন্তু আমরা তো জানি আত্মা অজর, অমর, জন্মহীন, মৃত্যুহীন। তবে আত্মা থেকে আবার আত্মার জন্ম হয় নাকি ? দেখুন জল সবই সমুদ্রের, কিন্তু জল যখন বাটিতে বা ঘটিতে নিয়ে নেওয়া হলো, তখন আর তা সমুদ্র থাকলো না। অর্থাৎ একটা আবরনের দ্বারা জলকে আলাদা করে ফেলা গেলো।  এখন এই জল আবার একদিন সমুদ্রে মিশে যাবে, তা সে সুয্যরশ্মির মাধ্যমে হোক, বা নদীর মাধ্যমে হোক, একদিন আবার সেই জল সমুদ্রে মিশে যাবে। কিন্তু এই ঘটনা যে কবে ঘটবে তা আমরা কেউ  জানি না। 
আধ্যাত্মিকতা মানেই হচ্ছে, এই সময়কে ত্বরান্বিত করা। ডিম্ থেকে বাচ্চা হয়, কিন্তু সব ডিম্ থেকে কি বাচ্চা হয় ? হয় না, কারন পরিবেশ, প্রযত্ন ইত্যাদির অভাব। বীজ থেকে গাছ হয়, কিন্তু সব বীজ থেকে কি গাছ হয় ?  হয় না। এর জন্য দরকার উপযুক্ত পরিবেশ, ও যত্ন নেওয়া। কিন্তু সব বীজ বা ডিমের মধ্যে সম্ভাবনা  আছে। আর এই বীজ বা ডিম্ নিজে থেকে নিজের যত্ন নিতে পারে না। এর জন্য এক-জনের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। সেই ব্যক্তিটি হচ্ছেন, আমাদের মাতা-পিতা, শিক্ষক, আচার্য্য, গুরুদেব। যারা অজ্ঞান-জীবকে আলোর জগতে নিয়ে আসতে  পারেন, জ্ঞানের আলো  দেখাতে পারেন । 

সত্যদ্রষ্টা আচার্য যখন আধ্যাত্মিক দীক্ষা দেন, তখন জীবাত্মা আর পরমাত্মার সমন্নয় সাধন করে থাকেন। এই ব্যাপারটি এক চীনা সাধু তাও খুব সুন্দর ভাবে দেখিছিলেন। তিনি দুটো বীণার  তারকে একই শুরে বাঁধলেন। একটি বীনা পাশে রেখে, হাতে রাখা বীণাটিতে টুং করে আওয়াজ করলেন, অমনি পাশে রাখা বীণাটি টুং করে বেজে উঠলো। হাতে রাখা বীণাতে যখন তিনি যে সুর তুলছেন, পাশে রাখা বীণাতে সেই একই সুরের ধ্বনি উঠতে লাগলো। কারন দুটো বীণা একই সুরে  বাঁধা। যখন একটি বীণার তারের লয় পাল্টে দেওয়া হলো, তখন অপরটি বেসুরো আওয়াজ করতে লাগলো। আওয়াজ হলো, কিন্তু সুরের তাল বা প্রভাব কেটে গেলো। ঠিক তেমনি আমরা নিজে নিজে পড়তে পারি, নিজে নিজে ভাবতে পারি, নিজে নিজে কথা বলতে পারি, কিন্তু সেই ভাবনা, সেই অধ্যায়ন, সেই কথা কখনোই ঈশ্বরের সুরের সঙ্গে মিল খাবে না। ব্যক্তির আত্মা বা জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার তত্ত্বটি আমরা যদি না মেলাতে পারি, তবে জীবনের যে অসীম আনন্দ তা পেতে পারি না।  সবই তখন বেসুরো লাগে। অসহ্য লাগে। জীবন হয়ে ওঠে বিষময়।  কিন্তু যখন পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মেলবন্ধন হয়ে যায়, তখন জীবন এক অনাবিল আনন্দে ভরপুর হয়ে ওঠে।

আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশের প্রথম দিকে এগুলোকে আমরা বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে চাই, কিন্তু আমার যে বিচার বা বুদ্ধি তা দিয়ে এই গুরু-শিষ্য সম্পর্ক মেলাতে পারি না। আর সন্দেহের দানা বাঁধে। গুরুর নিদেশ অনুযায়ী কাজ করতে হবে, তবেই গুরুর মাহাত্ম বোঝা যাবে। গুরুর নির্দেশ লাভ যথেষ্ট নয়, সাধকের উচিত সর্বক্ষণ নিজের সঙ্গে লড়াই করে যাওয়া। হৃদয়ের ব্যাকুলতা যত  বাড়বে, তত আমরা গুরুমহাত্ম বুঝতে পারবো। 

যিনি দুঃখের মধ্যে আছেন, তার সাথে কথা বলে আপনি কখনোই আনন্দ পেতে পারেন না। কিন্তু যিনি আনন্দে আছে, তার সাথে মেলামেশা করলে, আপনার মধ্যেও আনন্দের স্ফূরণ ঘটতে পারে। যথার্থ  গুরুদেব তিরস্কার করেন কৃত্তিম, কিন্তু তার হৃদয়ের ভালোবাসা অকৃত্তিম। উত্তম আচার্য্য তার শিষ্যের মধ্যে একটা তৃষ্ণা জাগিয়ে তোলেন, এমনকি আধ্যাত্মিক স্পন্দনসমূহ সঞ্চালিত করে শিষ্যের হৃদয়ে সঞ্চার করে দেন। কিন্তু এই কাজ তিনি তখনই করতে পারেন, বা করে থাকেন, যখন উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান পান। তাই বলা হয়ে থাকে, গুরুদেব শিষ্যকে খুঁজে বের করে আনেন। বীজকে প্রস্ফুটিত করেন। তাকে লালন-পালন করেন। একসময় তার সমস্ত আধ্যাত্মিক শক্তি দিয়ে তাকে আগলে রাখেন। 

স্বামী ব্রহ্মানন্দ  বলছেন,  দেখো যথার্থ গুরু যিনি ব্রহ্মানুভূতি লাভ করেছেন, তার সাক্ষাৎ পাওয়া আমাদের ভাগ্যের ব্যাপার। আর যদি এমন কাউকে ভাগ্যক্রমে পেয়েও যাও, তবু সবসময় বা তোমার প্রয়োজনের সময় তাকে নাও পেতে পারো। কিন্তু তোমার অন্তরে একজন আচার্য্য আছেন, তিনি হচ্ছেন তোমার শুদ্ধ মন। আর এই শুদ্ধমনের মধ্যেই বিরাজ করছেন, বিবেকরূপী গুরু । তাই আমাদের উচিত, ধ্যান, প্রার্থনা, উপাসনা জপ-তপ, যোগক্রিয়া ইত্যাদি দ্বারা আগে শরীর  ও মনকে শুদ্ধ করা। যখন তোমার মন শুদ্ধ হবে, তখন দেখবে, তোমার এই শুদ্ধমনই তোমাকে নির্দেশ পাঠাবে। অন্তর থেকেই তোমাকে সঠিক পথে চালিয়ে নিয়ে যাবে। এমনকি তোমাদের দৈনন্দিন কাজেও এই অন্তর্গুরু তোমাকে সঠিক পথ দেখাবে, তোমাকে সাহায্য করবে।  তোমার সমস্ত সমস্যার সমাধানের উপায়কে বলে দেবে।    
















 

   

            

       

  














 

No comments:

Post a Comment