Friday 28 May 2021

"আত্মাকে /আমিকে ধরবেন কি করে ? (পুনঃপ্রকাশ)/গুরুর সন্ধানে


আত্মাকে /আমিকে  ধরবেন কি করে ? (পুনঃপ্রকাশ)

পর্ব -১
আমরা এর মধ্যে জেনে গেছি, আমি এই দেহ নোই।  আমি এই মন নোই।  আমি বুদ্ধি নোই। তাহলে আমি কে ? আমি নাকি আত্মা।  এই আত্মা ব্যাপারটা কি ? আত্মা বা আমি হচ্ছে চেতন শক্তি যা স্থানান্তরিত হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, জীর্ন দেহ পরিত্যাগ করে, নতুন দেহে আশ্রয় গ্রহণ করে।তবে সত্য হচ্ছে, এই নতুন দেহে আশ্রয় গ্রহণ করে ততক্ষন, যতক্ষন না তার বাসনা বা সংকল্প পূরণ হয়।

 কিন্তু বাসনাহীন সঙ্কল্পহীন  আত্মার গতিপথ অন্যরকম। অর্থাৎ চেতন শক্তি প্রথমে আমাদের স্থূল শরীরে থাকে।  তার পরে আমাদের স্থূল দেহের মৃত্যুর পরে মানসদেহে অবস্থান করে। তার পরে মানস দেহের অবলুপ্তিতে চেতনশক্তি আমাদের বিজ্ঞানময় দেহে অবস্থান করে। আমাদের তিনটি ভৌতিক বা পার্থিব   দেহে।   অন্নময়, প্রাণময়, ও মনময়, অর্থাৎ স্থুল, সুক্ষ, ও অতিসুক্ষ  এই তিনটি দেহের যখন অবলুপ্তি হয় তখন এই চেতন শক্তি বিজ্ঞানময় দেহে বা অভৌতিক দেহে  ক্ষনিকের জন্য অবস্থান করে। তার পর বিজ্ঞানময় দেহ চেতনশক্তি সহ  আনন্দময় দেহে অবস্থান করে, এবং সবশেষে আনন্দময় দেহ চেতনশক্তিকে নিয়ে তার উৎস অর্থাৎ বিশ্বশক্তি বা  বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু এগুলো হচ্ছে তাত্ত্বিক কথা। সত্যি সত্যি আমাদের আমিকে কি আমরা ধরতে পারি ? যদি ধরতে পারি কিভাবে ধরবো ? সেই গোপন গূঢ়রহস্যঃ আজ আমরা শুনবো। ১০টি প্রক্রিয়া, সাধনত ১০ সপ্তাহের পরিক্রমা। তবে আপনার অবস্থান অনুযায়ী এই পরিক্রমার সময় নির্ধারণ হবে।   

আমরা এও জেনে গেছি, যে আমাদের স্নায়ুকেন্দ্রে যখন ঢেউ ওঠে তাকে বলে আমাদের মনের চিন্তা- বা আমাদের কামনা-বাসনা। অর্থাৎ আমাদের মানসিক বৃত্তি। আমাদের চেতনা অর্থাৎ সত্যিকারের আমি যখন এই মানসিক বৃত্তির সঙ্গে মিশে থাকে, তখন আমরা তাকে ধরতে পারি না। তো আমাদের কাজ হচ্ছে আমাদের চেতনাকে এই বৃত্তি থেকে আলাদা করা। এটা কি ভাবে করবো ? এই প্রক্রিয়াকে বলতে পারেন, অমিকে বা আত্মাকে  ধরবার খেলা। এই প্রক্রিয়াকে আমরা দশভাগে ভাগ করেছি। 

প্রক্রিয়া : ১
চুপচাপ মেরুদন্ড সোজা রেখে বসুন। মনের গভীরে ঢোকার চেষ্টা করুন। মনে কি কোনো চিন্তা উঠছে ? যদি ওঠে তবে তাকে পর্যবেক্ষন করুন। যতক্ষন না মনের চিন্তা দূরীভূত হচ্ছে, ততক্ষন এই অবস্থায় বসে থাকুন। মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন, যতক্ষন না মন চিন্তাশূন্য হচ্ছে ততক্ষন আমি মনকে ছাড়ছি না। 

প্রক্রিয়া : ২ 
এই ভাবে অবস্থানের ফলে, মন চিন্তা ছেড়ে, জ্ঞানের মধ্যে প্রবেশ করবে। এবং আপনি একটা আলোর বিন্দু দেখতে পাবেন। এই আলো আসলে জ্ঞানের আলো। এই আলো  আপনাকে পথ দেখাবে। এই আলোয় আপনি প্রথমে আপনার স্থূল দেহকে দেখতে পাবেন। অর্থাৎ প্রথম প্রথম মনে হবে, এই দেহই আমি। এর পরে,  শুধু আপনি আপনার মুখটা দেখতে পাবেন। অর্থাৎ মনে হবে, আপনার মাথাটাই আপনি। এর পরে আরো অপেক্ষা করুন, মাথার আকৃতি একটি কালো চক্রে পরিণত হবে  যার ভিতরে একটা আলোর বিন্দু দেখতে পাবেন। তখন মনে হবে, এই আলোর বিন্দু  বা মাথার একটা নির্দিষ্ট অংশই  আমি। এবার আপনি এই আলোর বিন্দুটাকে খেয়াল করুন, এটি মাথার কোথায় অবস্থান করছে ? 

প্রক্রিয়া : ৩
এই সময় আপনার মধ্যে আবার চিন্তা উঠতে থাকবে। না একে  এড়িয়ে যাবেন না। চিন্তাগুলোকেই লক্ষ্য কোরতে  থাকেন।  এবার খুজুন কে চিন্তাগুলোকে দেখছে ? এবং মনের মধ্যে প্রশ্ন তুলতে থাকুন, আমি কে ? আমি কে ? প্রশ্ন করুন, আর মনকে গভীর ভাবে লক্ষ করুন। এখন চিন্তা সরে যাবে। আর ভিতরে অর্থাৎ চেতন কেন্দ্র উদ্ভাসিত হবে। এই সময় আপনি একটা অখণ্ডতা নিস্তব্ধতা অনুভব করবেন। এই নিস্তব্ধতার অনুভবই আমি বোধ।  বা অহং বোধ।

প্রক্রিয়া : ৪ 
 এবার এটাকে ভালো করে লক্ষ করতে থাকুন। একটা জ্যোতি আপনি এখন দেখতে পাচ্ছেন।আপনার মনে একটা আনন্দ-অনুভব হচ্ছে। এই সময়, আপনার প্রশ্ন অর্থাৎ আমি কে, এটাকে দৃঢ় রেখে অপেক্ষা করুন। 

প্রথম ৪ সপ্তাহ এই প্রক্রিয়া প্রতিদিন নিয়ম করে নির্দিষ্ট সময়ে নির্জনে অভ্যাস করতে থাকুন। আর পরবর্তী প্রক্রিয়াতে যাবার আগে, আমাদের কথাগুলো শুনুন। 

একটা কথা বলি, এই   কাজগুলো আপনাকেই করতে হবে। অর্থাৎ এই কাজ আপনাকে স্বয়ং করতে হবে।  আপনার হয়ে অন্য কেউ করে দিতে পারবে না।   গুরুদেব বলছেন, সাধককে এবার একলা যাত্রা করতে হবে। তবে, আমি যতটা  সহজে কথাগুলো বলে গেলাম, এটাকে কার্যকরী করা এতটা সহজ নয়।  এটি প্রথমত সময় সাপেক্ষ, দ্বিতীয়ত একমাত্র গুরুর সান্নিধ্যে, গুরুর নির্দেশে এসব করতে হয়। গুরুদেব সবসময় আঁধার ভেদে, অর্থাৎ আপনার ব্যাকুলতা ও শারীরিক মানসিক প্রস্তুতির পরীক্ষা করে, সাধনপথের নির্দেশ দিয়ে থাকেন।    আমার কথায় একাজ করতে যাবেন  না।  এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। 

তথাপি আত্মাকে যে ধরা যায়, নিজেকে যে আত্মস্থ করা যায়, আর গুরু সান্নিধ্যে এটি অবশ্য়ই সম্ভব  হতে পারে সেই বিশ্বাস জাগ্রত করবার জন্য, এই আলোচনা। এটি শুনলে আপনার মধ্যে একটা ধারণা এমনকি আপনার মধ্যে আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশের  প্রেরণা জন্মাতে পারে। 

আত্মাকে /আমিকে  ধরবেন কি করে ? (পুনঃপ্রকাশ)
পর্ব -২ 
আগের দিন আমরা শুনেছিলাম,  এবার একলা যাত্রা করতে হবে। কিন্তু এই পথে কি একলা যাওয়া যায় ? যাকে চিনি না, জানিনা, তাকে ধরতে গেলে, তাকে পেলেও আমি সনাক্ত করতে পারবো না। গুরুদেবকে এ কথা বলতেই তিনি যা বলেছিলেন, আমরা আজ সেই কথা শুনবো।

একটা কথা একটু গভীরে বুঝবার চেষ্টা করুন যে, আমরা যখন যার মধ্যে অবস্থান করি, তখন আমরা তাই হয়ে যাই। আমরা যখন দেহের মধ্যে প্রবেশ করি তখন আমরা দেহী হয়ে যাই।  আমরা যখন জ্ঞানের মধ্যে প্রবেশ করি তখন আমরা জ্ঞানী হয়ে যাই। আমরা যখন পাপের মধ্যে প্রবেশ করি তখন আমরা পাপী হয়ে যাই।  আসলে আমি ও আমার এই কথাটা ভালো করে বুঝতে হবে। আমি মানুষ, আমি জ্ঞানী, আমি গায়ক, আমি সাধক, আমি লেখক, এগুলো হচ্ছে আমাদের অহং জ্ঞান। আবার আমার দেহ, আমার ছেলে, আমার মেয়ে ইত্যাদি হচ্ছে  সম্মন্ধ-জাত জ্ঞান বা মমতা । অর্থাৎ যার সাথে আমার সম্মন্ধ হয়েছে। এগুলো সবই সাময়িক। কেননা আমি চিরকাল মানুষ, বা গায়ক, বা সাধক, বা লেখক থাকবো না, অর্থাৎ এগুলো সবই কালের অধীন। আবার আমার যাদের সাথে সন্মন্ধ হয়েছে, এগুলোও একসময় থাকবে না। কিন্তু আমি থাকবো। তো আমি এখন কিসের মধ্যে প্রবেশ করেছি সেটা একটু ধ্যান দিয়ে দেখি।

প্রক্রিয়া : ৬ 
ধ্যান যখন গভীর হবে, আমি বোধকে আলাদা করে নিয়ে মনের উপরে নিবিষ্ট করলে, এই কালের বা সাময়িক  সম্পর্ক গুলোকে আমরা বিচ্ছিন্ন করতে পারবো। আমি কে - এই প্রশ্নটাকে আমাদের মধ্যে দৃঢ় রাখতে হবে। অর্থাৎ আমাদের মূল উদ্দেশ্য আমিকে জানা বা ধরা। এই উদ্দেশ্যকে বা ভাবনাকে আমাদের মনের মধ্যে বারবার উৎসারিত করতে হবে।  এই ভাব যেন ক্ষনিকের জন্যও ত্যাগ না করি।
 
এই ছয়টি প্রক্রিয়া মোট চার সপ্তাহ ধরে চলবে। 

আমরা জানি আমাদের পাঁচটা শরীর। বা পাঁচকোষের এই শরীর ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আমি বোধকে ধরবার যে প্রক্রিয়া সেটা আমরা আগেই  আলোচনা করেছি । সেই প্রক্রিয়ার দ্বারা আমরা মনের স্তরে প্রবেশ করেছিলাম। অর্থাৎ অন্নময় - প্রাণময় কোষ পেরিয়ে মনময়  কোষে প্রবেশ করেছিলাম। এবং গভীর ধ্যানে লিপ্ত থেকে মনকে চিন্তা মুক্ত করেছিলাম। এই অবস্থায় মন কিন্তু বিলীন হয়ে যায় না। এই সময় মনের বৃত্তিগুলো সংস্কার রূপে সুপ্তভাবে থাকে। এই অবস্থায় মনের সংস্কারগুলো মাঝে মধ্যেই জেগে ওঠে। এই অবস্থায় ধ্যানের  গভীরতা যত  বাড়াতে পারবো, তখন আমিকে আরো ভালো করে ধরতে পারবো। এবং এই আমি-বোধে স্থির হয়ে থাকার  শক্তি ও সময় অর্থাৎ স্থিতিকাল  বৃদ্ধি পাবে। এই অবস্থায় আমরা, আমাদের  দৈনন্দিন কাজের সময়ও , এই আমি বোধকে অন্যান্য মানসিক বৃত্তি থেকে আলাদা করতে পারবো। এই রকম হলে, আপনি জানবেন, আপনার সাধন জীবনের  উন্নতি হয়েছে। মনে রাখবেন, ধ্যান একটা নিরবিচ্ছিন্ন অবস্থা। এমন নয় যে যতক্ষন আমরা  ধ্যানাসনে আছি, শুধু সেই সময়টুকু আমাদের উচ্চ অবস্থা থাকবে, আর তার পরেই আমরা আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবো। ব্যাপারটা এমন নয়। আমার আমি-বোধকে মানসিক বৃত্তি থেকে আলাদা করে আমার দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপ চালিয়ে যাবো। এটাই প্রকৃত ধ্যানের প্রাপ্তি।

প্রক্রিয়া : ৭
এই ভাবে আমার আমি-বোধকে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে ধরে রাখতে পারলে, এবং নিয়মিত ধ্যান সাধনা চালিয়ে গেলে আমরা মনময় কোষ ত্যাগ করে বিজ্ঞানময় কোষে উত্তীর্ন হতে পারবো। অর্থাৎ জ্ঞানময় জগতে বিবরন করবো। তখন নিত্য-অনিত্য জ্ঞান জন্মাবে। পার্থিব ও অপার্থিব জগৎ সম্পর্কে একটা ধারণা স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকবে।  এই অবস্থা একটু ভালো করে খেয়াল করুন। এই অবস্থায় আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস-এর গতি কমে যাবে। সাধারণত আমরা যখন শ্বাস নেই সেটা আমাদের নাক থেকে বুকে, বুক থেকে পেটে চলে যায়। কিন্তু আমাদের আমিবোধ যখন মনময় কোষ ছেড়ে বিজ্ঞানময় কোষে ওঠে, তখন আমাদের শ্বাস নাকের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। এবং আরো পরে একসময়  কেবলমাত্র নাসিকাগ্রে অবস্থান করে। 

ধ্যানের বাধা :
এই অবস্থায় আমাদের অস্বস্তি বোধ হওয়া স্বাভাবিক।  কিন্তু গুরুর নির্দেশ নিয়ে, এই সময় ধ্যানে অবস্থানের সময় বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।  এবং তাতে এই অসুবিধা বা অস্বস্তি কেটে যাবে। এই সময় আরো কতগুলো অস্বাভাবিকতা আপনার মধ্যে দেখা দিতে পারে। যেমন শরীরে একটা কম্পন - যার উৎস হচ্ছে মেরুদন্ড। মেরুদণ্ডের মধ্যে একটা শিরশিরানি ভাব।  এমনকি এও মনে হতে পারে, যে একটা ছুঁচ আপনার মেরুদণ্ডের  ভেতর দিয়ে কেউ যেন উপরের দিকে  ঠেলে দিচ্ছে। এই শারীরিক অস্বস্তির সময় ধ্যানে নিরত থাকুন। আপাতত ধ্যান বন্ধ রাখুন। অথবা  কাউকে বলুন, মেরুদণ্ডে ম্যাসেজ করে দিতে। ম্যাসেজ করার সময় খেয়াল করবেন, হাত দিয়ে আলতো  করে পাশাপাশি ম্যাসেজ করতে।  ভুলেও উপর নিচ করবেন না। যদি এতেও  অস্বস্তি না যায়, তবে কয়েকদিন ধ্যান বন্ধ রাখুন। দেখবেন আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছেন। কিন্তু স্বাভাবিক হয়ে গেলেই আবার ধ্যানের অভ্যাস শুরু করুন। দরকার হয় এই অস্বস্তি অল্পবিস্তর সহ্য করুন।

এই সময় থেকে আপনার নানান-রকম দর্শন হতে পারে। জ্যোতি দর্শন হতে পারে। নানানরকম দেবদেবী যা আপনার চেনা বা অচেনা  মূর্তি, বিভিন্ন জায়গা, বিভিন্ন দৃশ্য, তা সে ভালোমন্দ সবই হতে পারে। সুন্দর, কুৎসিত, এমনকি ভয়ঙ্কর হতে পারে। এগুলো একটা সময় চলে যাবে, আর আপনার মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটবে। এগুলো দেখায় আপনার মধ্যে আনন্দ বা ভয় বা উদ্বেগ  দেখা দিতে পারে। 

প্রক্রিয়া - ৮ 
আপনি নিস্পৃহ থাকুন। আর আপনি আপনার মধ্যে চিন্তা ওঠান যে এগুলো কে দেখছে ? অর্থাৎ আপনার সেই মূল ও প্রাথমিক প্রশ্ন আমি কে ? এই প্রশ্নকে আঁকড়ে ধরুন।  আমি কে ?
এই অবস্থায় অনেকের চিন্তা শক্তি হারিয়ে যায়। ক্ষনিকের জন্য চেতন শক্তিও  হারিয়ে যায়। যদিও এটা কয়েক  মুহূর্তের জন্য হয়ে থাকে।  তথাপি এই অবস্থা থেকে ফিরে এলে মনে হয়,  আমি কি সমাধিতে ছিলাম। আসলে এটি সমাধি নয়, বলা যেতে পারে আপনার মূর্ছা হয়েছিল।বা আপনি খানিকটা সুসুপ্তির অবস্থায় চলে গিয়েছিলেন।  মন তখন কয়েক মুহূর্তের জন্য  লয় হয়ে গিয়ে ছিলো।

আমাদের একটা কথা সব সময় মনে রাখতে হবে, আমি আমাকে খুঁজছি। তাই আমি কে, অর্থাৎ আমি একটা চেতন সত্ত্বা।  অর্থাৎ যে সব কিছু উপলব্ধি করছে তা একটা চেতন সত্ত্বা এই কথাটা আমাদের সব সময় স্মরণে রাখতে হবে। এই অবস্থায় আমাদের অনেকের  ঘুম পায়। আর ঘুম পেলে জানবেন, আপনার যাত্রা পথে এটি একটি বড়ো বাঁধা। আপনাকে সজাগ থাকতে হবে। চেতন থাকতে হবে। এই বিজ্ঞানময় কোষে যখন  আপনি  অবস্থান করেন, তখন আরেকটা অদ্ভুত উপলব্ধি হয়, আর তা হচ্ছে আমি যেন শরীর নোই। শরীরের মধ্যেও আমি নেই। এই সময় আমাদের চেতন সত্ত্বাটি শরীরের চারিদিকে ঘুরে বেড়ায়। শরীরের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। তখন যেন মনে হয়, আমি মারা  গেছি। শরীরের সঙ্গে মনের যোগসূত্রটি কেটে গেছে। শরীর স্থির হয়ে বসে আছে, আর আমি শরীরের বাইরে।এমনটি হলে, প্রথম প্রথম আমাদের ভীষণ ভয়ের উদ্রেগ হয়। কিন্তু ভয়ের কিছু নেই। এইসময় দেহের সম্পর্কে কোনো চিন্তা ওঠালে অর্থাৎ কোনো স্মৃতি বার বার ওঠালে, এই অবস্থা কেটে যায়। সাধক তখন সাধারণ অবস্থায় স্থিতিশীল হয়।

প্রক্রিয়া - ৯
বিজ্ঞানময় কোষে যাতায়াত ও স্থিতি  যখন আমাদের সহজ মনে হয়, অর্থাৎ বার বার যাতায়াত করতে করতে এই ব্যাপারটা যখন  সহজ মনে হয়,  তখন এই বিজ্ঞানময় কোষকে অতিক্রম করবার চেষ্টা করতে হয়। শান্ত মনে চেতনাকে আমিবোধে নিবিষ্ট করতে হয়। এইখানে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় এক হয়ে যায়। তখন আমাদের মধ্যে আমি আমাকে জানছি এইরকমটা  মনে হয়। দ্রষ্টা ও দৃশ্য এক হয়ে যায়। এই অবস্থায় আমরা চেতন সত্ত্বার উপরে আমি বোধ বা আমিত্ব আরোপ করে ধ্যানের প্রক্রিয়া চালাতে থাকুন।
 প্রক্রিয়াটা এই রকম। প্রথমে বিষয় সম্পর্কে যে চৈতন্য বা বিষয়ের সঙ্গে যে চৈতন্য মিশে আছে, অর্থাৎ বুদ্ধির সঙ্গে বিষয় মিশে যে চৈতন্য আমি বোধের সৃষ্টি করেছে, তাকে আলাদা করতে হয়। অর্থাৎ প্রথমে ভাবুন, আমি আমাকে জানছি, এর পরে কেবলমাত্র আমাকে জানছি, তারও  পরে শুধু জানছি এই ভাবে "আমি"কে আলাদা করুন। আমি আমার মধ্যে আছি,  তারপরে আমার মধ্যে আছি, তারপরে শুধুই  আছি। এইভাবে আমিকে আলাদা করুন। অর্থাৎ জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বলে কিছু থাকবে না, দ্রষ্টা-দৃশ্য বলে কিছু থাকবে না। জ্ঞাতা-জ্ঞেয়  মিশে যাবে, দ্রষ্টা দৃশ্য মিশে যাবে। বিজ্ঞানময় কোষে নিজেকে উত্তীর্ন হতে পারলে এই আছি বোধ স্থির হতে থাকবে। আপনি এক অপূর্ব শান্তি, অহেতুক আনন্দ আপনার মধ্যে স্ফূরিত হতে থাকবে। আমি ও আনন্দ তখন এক হয়ে যাবে। অর্থাৎ আমি যে আনন্দময় সত্ত্বা সেটা আমাদের উপল্বদ্ধিতে স্থায়িত্ত্ব লাভ করবে। যাকে আমরা এতদিন,শরীর-মন-বুদ্ধি-চিত্ত্ব-অহংকার বলে অনুভব করতাম, সেই আমি এখন একমাত্র আনন্দময় সত্ত্বা বলে অনুভব হবে। আমাদের মনে হবে আমরা আনন্দের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছি। আর এটাকেই বলে আনন্দময় শরীরে প্রবেশ।

প্রক্রিয়া : ১০ 
এই আনন্দময় শরীরকেও আমাদের ছাড়তে হবে। তা না হলে আমরা শরীর বিহীন হতে পারবো না। অর্থাৎ এক-এক করে পাঁচটা শরীরকে ছেড়ে যাবো।  এইজন্য ধ্যানের এই অবস্থায়, আমাদের খেয়াল করতে হবে, এই আনন্দ আসছে কোথা থেকে ? এই আনন্দের উৎস খুঁজতে হবে। এই সময় আমাদের চেতনা শরীর  শূন্য হয়ে পড়ে।  অহংহীন  হয়ে পড়ে। আর আমাদের মনে হয় মহাশূন্য আমাদের গ্রাস করে নিচ্ছে। আমি যেন মহাশূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছি। মহাশুন্য আর আমার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকছে না। মহাশূন্য আর আমি একই সত্ত্বা। এবার মনে হয়, আমি আর আমিতে  থাকছি না। আমার যেন নিজস্ব সত্ত্বা বলে কিছু নেই।  এই সময় এক গভীর অন্ধকার, এক মহাশুন্য, আমাকে অপ্রকাশ করে ফেলছে। আমি যেন বিশ্বসত্ত্বার সঙ্গে মিলিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বসত্ত্বা আর আমি এক হয়ে গেছি। আমার অহং  বলে আর কিছু থাকছে না। এক অব্যক্ত সাম্যাবস্থা। সমস্ত গুনের বন্ধন, সমস্ত সত্ত্বার বন্ধন, সমস্ত শরীরের বন্ধন   আমার কেটে গেছে। আমি বিশ্বগ্রাসে পতিত। সমস্ত রহস্যভেদ হয়ে গেছে।  এই সময়, অস্তিত্ত্বের দাবি অস্বীকার হয়ে গছে। আমি বলে কিছু নেই। আমি মহাশূন্যের, মহাশূন্যই আমি। এটাই আমার প্রকৃত সত্ত্বা। শিবোহম  শিবোহম, তুহি তুহি। 

সবশেষে বলি, এই প্রক্রিয়া গুরুসান্নিধ্যে অভ্যাস করতে হয়। আমাদের এই লেখা পড়ে এইসব করতে যাবেন না। দুর্বল মনের মানুষ তো অবশ্য়ই এইসব কথা শুনেও শুনবেন না। কেননা এটি একটি অতীন্দ্রিয় জগতে প্রবেশ ও অবস্থানের প্রক্রিয়া । এখানে সবই শিবময়। যা ধংসের ও মঙ্গলের প্রতীক। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওম।

সিদ্ধগুরু ছাড়া কি যোগসাধন হবে না ?

যোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্রহ্মানন্দ লাভ।  আর এই ব্রহ্ম-অনুভূতি বা ব্রহ্মানন্দ লাভ সিদ্ধযোগীর সান্নিধ্যেই একমাত্র লভ্য। আর সেইজন্যই আমরা যখনই যোগের সন্মন্ধে বিস্তারিত কথা শুনি, তখন যোগবিদ্যার সঙ্গে একটা কথা বারবার উচ্চারিত হয়, যে সৎ-গুরু বিহীন এই যোগের অভ্যাস করবেন না। তো কথা হচ্ছে, সেই যোগগুরু আমরা কোথায় পাবো ? এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। এই সমস্যার কারন হতে পারে, ভৌগলিক, অর্থাৎ এদের বাস নির্জনে। কোটিতে হয়তো এক-আধজন সংসারে থাকতে পারেনা। এর কারন আরো একটা হতে পারে, তা হচ্ছে  আমাদের কাছে তথ্যের অভাব, অর্থাৎ কোথায় সেই গুরুদেবের অবস্থান তা আমরা জানি না । সিদ্ধগুরুর যেমন অভাব তেমনি সবথেকে বড় অভাব  হচ্ছে, উপযুক্ত ছাত্রের, বা জিজ্ঞাসুর  । অর্থাৎ আমাদের মধ্যে আকুলতার অভাব। 

আবার এই যোগগুরুর মধ্যে দুটো ভাগ আছে, একদল নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে চান। তারা মনে করেন, আমি এখনো গুরু হবার যোগ্য নোই। আমি নিজে এখনো গন্তব্যে বা লক্ষে পৌঁছতে পারিনি। অনন্ত এই যাত্রাপথ। একের পর এক সত্য উদ্ঘাটিত হতে থাকে এই যাত্রায়। তো এইসময় অন্যকে সাহায্য করার নামে  সময় অতিবাহিত করা  মানে নিজের যাত্রাপথের বিঘ্ন সৃষ্টি করা। 

আরেক দল আছেন, তারা অন্যকে সাহায্য করার মধ্যে একটা আত্মশ্লাঘা অনুভব করেন। নিজে উপরের ক্লাসের ছাত্র হয়ে নিচের ক্লাসের ছাত্রদের পড়ানো একটা আত্মতৃপ্তি দান  করে থাকে। এঁরা যেকোনো ছাত্রকেই গ্রহণ করে থাকেন ।

কিন্তু সত্যিকারের সিদ্ধগুরু, উপযুক্ত ছাত্রের বা অধিকারীর  খোঁজ করে থাকেন, অর্জিত জ্ঞানসুধাকে সংরক্ষণের জন্য। তাঁর বহু সাধনায় অর্জিত জ্ঞান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই বিদ্যা রেখে যেতে  চান। আর এই কারণেই আমাদের কাছে যোগগুরুর অভাব আবার এই কারণেই এই গুহ্যবিদ্যা দিন দিন লোপ পেতে চলেছে। ঠাকুর রামকৃষ্ণকে গুরু খুঁজে বেড়াতে হয়নি। বারোদা চরণ মজুমদারকে গুরু খুঁজে বের করতে হয়নি। এঁরা ঘরে বসেই গুরুর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। আবার এমন অনেক সিদ্ধিসাধক আছেন, যারা গুরুর খোঁজে হন্যে হয়ে ঘর ছেড়েছেন। যোগ্য আধার পেলে গুরুদেবগনও  তাকে শিক্ষা/দীক্ষা দেবার জন্য উদগ্রীব হন। শুদ্ধ আধার  বিবেকানন্দকে দীক্ষা দেবার জন্য পওহারীবাবা আগ্রহী ছিলেন।  

তো, যিনি ঈশ্বর উপলব্ধি করেছেন, কেবলমাত্র সেই সিদ্ধপুরুষের কাছেই যোগশিক্ষা করা কর্তব্য। অধ্যায়ন বা শাস্ত্রপাঠ মানুষকে একটা পথের সন্ধান দিতে পারে মাত্র। কিন্তু ব্যবহারিক বিদ্যা গুরুর কাছ থেকেই পেতে হয়। সিদ্ধ পুরুষের জীবনই যোগ। তাই তার সান্নিধ্যে না থাকলে, যোগশিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। অন্যদিকে সিদ্ধগুরুর নির্দেশ অনুযায়ী সূক্ষাতিসূক্ষ অন্বেষনে অগ্রসর হবার মতো প্রবল ইচ্ছেশক্তি না থাকলে, ধৈর্য্য না থাকলে, এই পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। সিদ্ধপুরুষের সান্নিধ্যে এলে, এবং তার কৃপা হলে, আমাদের সমস্ত দুর্বলতা কেটে যায় সত্য, কিন্তু প্রথম দিকে এদের কাছে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব বলে মনে হয়। প্রথম দিকে এরা ভাবি শিষ্যকে নিজের সেবার কাজে নিযুক্ত করেন, বা আশ্রমের বিভিন্ন জাগতিক কাজে নিযুক্ত করেন। যা আমাদের মতো অহংকারী মানুষের পক্ষে অবাঞ্চিত কাজ, যা যোগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে ভাবতেই পারি না। আসলে এইসময় আমাদের  সহ্য ক্ষমতার পরীক্ষা করা হয়। লক্ষে আমরা কতটা দৃঢ়, সেই পরীক্ষা দিতে হয়, আমাদের। খেয়ালের বশে, বা নিতান্ত কৌতূহলের বশে, এমনকি শুধুমাত্র অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে এই পথে আসা শুধু নিরর্থক নয়, বিপদজনকও বটে। 

আর একটা কথা বলি, আপনি গুরুর সাক্ষাৎ পেলেন, তার কাছে আপনার যোগশিক্ষার ইচ্ছে নিবেদন করলেন, আর তক্ষুনি  গুরুদেব আপনাকে আপনার ইচ্ছে পূরণ করে দিলেন, এমনটা হবার নয়।  এই বিদ্যা রাতারাতি আয়ত্ত্ব করবার বিষয় নয়। আর সিদ্ধগুরু পাত্রাপাত্র বিচার না করে, আপনাকে মুক্তিমন্ত্র  দান  করবেন না। আর এই বিষয় কোনো জাগতিক বস্তুর বিনিময়ে সংগ্রহ করা যায় না। সাঁতার শেখাবার আগে, দেখবেন সাঁতার শিক্ষক আপনার শারীরিক শক্তি, আপনার শ্বাসের শক্তির বৃদ্ধি করবার জন্য, বিভিন্ন ব্যায়াম ও প্রাণায়ামের শিক্ষা দেন। এর পর যখন জলে নামান হয়, তখন তিনি নিজে জলে নেমে, আপনাকে সাহায্য করেন, কিন্তু জলে নেমে  আপনি নিষ্ক্রিয় থাকলে, সাঁতার শিক্ষক আপনাকে প্রয়োজনে শুধু মুখে নয়, হাতের চাপড় দিয়েও আপনাকে উপযুক্ত করবার চেষ্টা করবেন।

 ঠিক তেমনি,  সিদ্ধগুরুর দায়িত্ত্ব আপনাকে মুক্তির পথের  সন্ধান দেওয়া। জীবন-মৃত্যুর চক্র থেকে বিচ্ছিন্ন করা।  যোগ কোনো শারীরিক কসরৎ নয়।  যোগ কোনো শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়াও নয়। এমনকি যোগ কোনো মানসিক ব্যায়ামও  নয়। যোগ একটা প্রক্রিয়া যা ঈশ্বর অনুভূতি এনে দিতে পারে।    যোগ এমন একটা প্রক্রিয়া যা আমাদের স্থুল শরীরে থাকা কালীন অবস্থাতেই ব্রহ্মানুভূতি অনুভব করাতে পারে ।  

বেদান্তদর্শনে, বা যোগদর্শনে বহুবিধ যোগের প্রণালী উল্লেখ করেছেন।  কঠোপনিষদে যমরাজ বলছেন, যোগাভ্যাস করে যারা অবিলম্বে সিদ্ধিলাভ করতে অসমর্থ, বা অপারগ, তাঁদেরও নিরাশ হবার কারন নেই।  তাঁরাও কালক্রমে, সৎ-কর্ম্মের অনুষ্ঠান ক'রে  মুক্ত হয়ে যাবেন। 

রাজযোগ আলোচনা প্রসঙ্গে যমরাজ বলছেন, (২/৩/১৬) মানুষের দেহের অভ্যন্তরে অসংখ্য নাড়ী ছড়িয়ে আছে।এর মধ্যে সুষুম্না নাড়ী প্রধান। এই নাড়ী শরীরের  মেরুমজ্জার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়ে, ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে, উর্দ্ধগামী হয়ে রয়েছে। যোগীগণ মনে করেন, এই সুষুম্না নাড়ী অবলম্বন  করেই মানবাত্মা সর্বোচ্চ লোকে পৌঁছতে পারেন  । স্থুলদেহ ত্যাগ কালে অর্থাৎ স্থুলদেহের মৃত্যুকালীন সময়ে, উদান বায়ুর সাহায্যে এই উৎক্রমন ঘটে থাকে। এই উৎক্রমন যদি, সুষুম্না নাড়ী অবলম্বন করে, উর্দ্ধগামী হয়, তবে মানবাত্মার অমৃতত্ব লাভ হয়। কিন্তু অন্যপথে অর্থাৎ ধমনীর পথ ধরে  মানবাত্মা নিষ্ক্রান্ত হলে, জীবের পুনর্জন্ম অবশ্যম্ভাবী।  ব্রহ্মরন্ধ্র হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সর্বোচ্চ স্থান। একেই বলা হয় ব্রহ্মলোক। এই ব্রহ্মলোক মানবাত্মার উন্নতির পরাকাষ্ঠা হিসেবে চিহ্নিত হয়। এখানেই মানবাত্মা নিত্যলোকের দর্শন পায়।  অর্থাৎ যেলোকে অমরাত্মা স্থিত হন। আর এর অন্যথা হলে, মানবাত্মা পুনঃ পুনঃ জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্ত  হতে থাকে। আর দুঃখ-কষ্ট -ক্লেশের ভাগিদার হতে থাকে। এইজন্য, যোগীগণ সুষুম্না কাণ্ডের জাগরণ ঘটিয়ে, বায়ুকে উর্দ্ধগামী করেন। সিদ্ধযোগী ভ্রূযুগলের মধ্যবর্তী স্থানে অর্থাৎ আজ্ঞাচক্রে বায়ুকে স্থির করেন। শরীর থেকে মনকে ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করে, এই আজ্ঞাচক্রে একাগ্র করেন। এই অবস্থায় মানব কেবল চৈতন্যময় হয়ে অবস্থান করেন। দেহত্যাগকালে, যোগীর আত্মা সুষুম্না নাড়ী অব্লম্বন করে, ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে, উর্দ্ধমুখী হয়ে অনন্তে যাত্রা  করেন। এই যে আত্মার উৎক্রমন ক্রিয়া, এই ক্রিয়ায় সাধারণ মানুষ অসহায় হয়ে থাকে।  কিন্তু সিদ্ধ যোগী, যিনি নিয়মিত রাজযোগ অভ্যাস করেন, তিনি এই উৎক্রমন ক্রিয়ায় নিজেকে নিযুক্ত করতে পারেন। এই উৎক্রমন ক্রিয়ার জ্ঞান, ও কৌশল আয়ত্ত্ব করে যোগীর সাধনা।

 যাদের পক্ষে  সৎগুরু বা সিদ্ধযোগীর সন্ধান করা সম্ভব নয়, তাদেরকে দুটো  কথা বলি। প্রথমতঃ যা কিছু করবেন, তা সে শারীরিক হোক, বা মানসিক হোক, গভীর মনোযোগের সাথে করুন। আপনি জল পান করছেন,  ছবি  আঁকছেন, কি অফিসের কাজ করছেন, বা রাস্তায় হাঁটছেন - বা আকাশের মেঘ দেখছেন, যা কিছুই করুন না কেন, সদা সচেতন থাকুন। যে কাজ করছেন, সেই কাজে আপনি গভীর মনোযোগ দিন। অহেতুক তাড়াহুড়া করবেন না। যে কাজ করবেন, তা আপনার সাধ্য অনুযায়ী সর্ব শক্তি  নিয়োগ করে, করুন। প্রত্যেকটি কাজ আপনার ক্ষমতা অনুযায়ী উৎকৃষ্টতর করবার চেষ্টা করুন।

 দ্বিতীয়তঃ, প্রতিনিয়ত নিজের  শ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে খেয়াল করুন। জানবেন, শ্বাসের সঙ্গেই বিশ্বের  প্রাণশক্তি, শ্বাসের সঙ্গেই  বিশ্বের  চেতনাশক্তি, এই শরীরে প্রতিনিয়ত যাতায়াত করছে। মুহূর্তের জন্য, এই যাতায়াতের পথে বিঘ্ন হ'লে, আপনার প্রাণপাত হবে। আর আপনি যদি শ্বাসক্রিয়ার  দিকে সদা সতর্ক থাকতে পারেন, তবে জানবেন, আপনার আপনার লক্ষ পূরণের জন্য, স্বয়ং ঈশ্বর আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন। তা সে গুরুর সন্ধান হোক, জীবনে প্রতিপত্তিলাভ হোক,  অথবা জীবনে সুখের সন্ধান হোক। সবই দেখবেন, আপনার সামনে এসে হাজির হচ্ছে। এর জন্য আলাদা করে কোনো প্রয়াস করতে হবে না। একটা জিনিষ জানবেন, আপনার সঙ্গে একটা বিশ্বশক্তি সবসময় আপনার দিকে খেয়াল রেখেছে।  আপনাকে রক্ষা করছে।  এমনকি আপনাকে সতর্ক করছে। আপনি সেই  দৈববাণী  কি শুনতে পাচ্ছেন ? যদি শুনতে পান, তবে তার নির্দেশকে উপেক্ষা না করে, তার নির্দেশ অনুযায়ী জীবনের কর্ম্ম নির্ধারণ করুন। দেখবেন সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। তা সে আধ্যাত্মিক হোক বা জাগতিক হোক। তার নির্দেশেই সবকিছু চলছে, আপনি-আমি  নিমিত্ত মাত্র।  আপনি-আমি তো ছাড়, সমস্ত জগতের সমস্ত কিছু সংগঠিত হচ্ছে তাঁর নির্দেশে । তাঁর নির্দেশেই অগ্নি তাপ বিকিরণ করছে, সূর্য কিরণ দান করছে, চাঁদ জ্যোৎস্না দান করছে, বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। মেঘ বৃষ্টি দেন করছে।  তাই  তাঁর নির্দেশ মেনে চলুন, দেখবেন, সমস্ত সমস্যার সমাধান তিনিই করে দেবেন। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।

শান্তিতে মরতে পারলে বাঁচি। (১)  মূলসূত্র : কঠোপনিষদ 

আমাদের বাড়িতে এক বুড়িমা আসতেন। বছর দুই আগেও আসতেন, এখন আর দেখি না। বড্ড অসহায়, কিন্তু স্বনির্ভর  ছিলেন। তার বয়স ৭০ /৮০ না তার বেশী তা বলতে পারবো না। কিন্তু নিজেই চাল-ডাল  ভিক্ষে করে, নিজের হাতে রান্না করে জীবন নির্বাহ করতেন। মুখে সব সময় একটা হাসি লেগে থাকতো। গৃহস্থের কাছে কিছু পেলে কৃতজ্ঞতা জানাতেন, কিন্তু কিছু না পেলেও, কখনো গোমড়ামুখো হতে দেখিনি।  তো এই বুড়িমা একটা কথা বলতেন, এখন শান্তিতে মরতে পারলে বাঁচি। আমাদের মতো সাধারনের কাছে, এটি একটি স্ববিরোধী কথা, মরলে আবার কেউ বাঁচে নাকি ?  

আসলে বাঁচা বা মরা দুটি আপেক্ষিক শব্দ মাত্র। একটির সঙ্গে আরেকটির পরিপূরক। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু যেন ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।   যারা মনে করে আমি জন্মেছি, তাদের অবশ্য়ই মনে রাখা উচিত যে সে একদিন মরবেই । কিন্তু যে জন্মেনি কোনোদিন সে আবার মরবে কি করে ? যার জন্ম নেই, তার মৃত্যুও নেই। এই বাঁচা বা মরা  কথাটার অর্থ রূপান্তর মাত্র। না কেউ  জন্মে না কেউ মারা যায়। 

নচিকেতার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছিলো, মানুষের মৃত্যুর পরে কি আর তার কোনো অস্তিত্ত্ব থাকে ?
কঠোপনিষদে নচিকেতা যমরাজকে তার এই সংশয়ের কথা জানিয়েছিল। নচিকেতা বলছে, হে যমরাজ, প্রতিনিয়ত জীবের মৃত্যু হচ্ছে। কেউ বলেন, মৃত্যুর পরে স্থুল দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। এরপর তার আর কোনো অস্তিত্ত্ব থাকে না,   আবার কেউ বলেন,  মৃত্যুর পরে মানুষ নাকি আত্মারূপে বা সূক্ষ্মদেহে   যমলোকে প্রবেশ করে। আর সেখানে সে কৃতকর্ম্মের  ফল ভোগ করে।  আর এই যম লোকের রাজা আপনি। তো মানুষ স্থুলদেহ ত্যাগ করার পরে যমলোকের বাসিন্দা হয়।  এইরকম একটা কথা  আমরা শুনে থাকি।  সত্যিই কি মৃত্যুর পরে জীবের কোনো অস্তিত্ত্ব থাকে  ? আত্মা বলে কিছু আছে কি ? 

আমরা ভাবি, মৃত্যুর পরে কি হবে, সেই কথা আমরা নিশ্চই মৃত্যুর পরে জানতে পারবো। কিন্তু সত্য হচ্ছে, মৃত্যুর পরে কি হয়, তা দেহ বিচ্ছিন্ন স্বয়ং আত্মাও জানতে  পারে না। কেবলমাত্র অতি অল্প সংখ্যক মানবাত্মা  এই সম্পর্কে জ্ঞাত থাকেন । আর এই জ্ঞান সে দেহে থাকাকালীন অবস্থাতেই অর্জন করেছিলেন । যমরাজ বলছেন, মৃত্যুর পরে কি হয়, তা দেবতারাও জানার জন্য আগ্রহী। অর্থাৎ দেবতারাও এই বিদ্যা আয়ত্ত্ব করতে পারে নি। আর এই বিষয়ে নানা মুনির নানা মত।  এর কারন হচ্ছে, যিনি যে অবস্থায় আছেন, তিনি সেইমতো দর্শন করে থাকেন । তাই এই সম্পর্কে সঠিক তত্ত্ব একমাত্র যমরাজই দিতে পারেন, যিনি এই রাজ্যের রাজা ।
এখন কথা হচ্ছে, এই যমরাজ কে ? বলা হয়ে থাকে ইনি মৃত্যুর রাজা। আর এর সাগরেদ হচ্ছে, রোগ, ব্যাধি, বার্ধক্য ইত্যাদি। আর এনার একজন যোগ্য ম্যানেজার আছেন, তার নাম চিত্রগুপ্ত। এই চিত্রগুপ্তের খাতায় যুগযুগ  ধরে জীবের জন্ম মৃত্যুর দিনক্ষণ লেখা আছে।  আর এনার এমন ক্ষমতা যে সারা পৃথিবীর সমস্ত জীব, জন্তু তা সে আকাশচারী  হোক, জলচরী হোক, বা স্থলচারী হোক, এমনকি মাটির নিচে, পাতালে,   বসবাসকারী কীটপতঙ্গ হোক বা সমুদ্রের নিচের কোনো পাতাসবাসী হোক,  সবাই এই যমরাজের   নজরের মধ্যে। যমরাজের হাত থেকে ছিঁটকে  গিয়ে, হাজার হাজার বছর কেউ বেঁচে আছেন বা স্থূল দেহে অবস্থান করছেন, এমন দৃষ্টান্ত নেই। অদ্ভুত তার শাসন ব্যবস্থা। অদ্ভুত তার শাসন প্রণালী। আর এই শাসন চলছে, জীব সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই। এখন কথা হচ্ছে, এই যমরাজ কে ? আসলে রূপক এই যমরাজের পরিচয় হচ্ছে, সূর্যপুত্র।  যমির  পুত্র যম। যমরাজকে বলা হয়ে থাকে ধর্ম্মরাজ। আর মহাভারতের যুধিষ্ঠির হচ্ছেন, সাক্ষাৎ যমরাজের অবতার। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, যমরাজ হচ্ছে সেই ব্যক্তি যিনি প্রথম মৃত্যুকে দর্শন করেছিলেন। অর্থাৎ যম রাজ্যে  প্রবেশকারী প্রথমব্যাক্তি।    

আমাদের দৃষ্টিতে, কঠোপনিষদের যমরাজ আসলে একজন শিক্ষক, আচার্য্য, গুরুদেব। এনার একটা বাড়ি আছে।  সেখানে তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করেন।  তার সমাজের ভয়ও আছে। এমনকি তিনি পাপের  ভয়ও  করেন। তা না হলে, নচিকেতা যখন তার বাসস্থলে পৌঁছান, তখন দেখা যায়, যমরাজ বাড়িতে নেই। তো তিনদিন পরে, যমরাজ বাড়িতে ফিরে, দুয়ারে ব্রাহ্মণ যুবককে দেখে ঘাবড়ে গেলেন কেন ? তিনদিন তিনরাত নচিকেতা না খেয়ে তার দুয়ারে হত্যে  দিয়ে পড়ে আছেন  দেখে, তিনি সূর্যপুত্র  বৈবস্বত অর্থাৎ তার ভাইকে  ডেকে তাড়াতাড়ি জল আনতে  বললেন, নচিকেতার পা ধুয়ে দেবার জন্য।   

দেখুন মৃত্যুর পরে কি হয়, সেই তত্ত্ব  যারা যেমন জানেন  বা ভাবেন, তাদের  কাছে, মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা ঠিক তেমন ভাবেই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। যমরাজ বলছেন, অজ্ঞানীগণ মরোত্তীর্ণ অবস্থা উপলব্ধি করতে পারেন না।  তা সে ইহলোকে হোক বা পরলোকে।  কারন মৃত্যুর পরে, এরা সঙ্গহীন ও সঙ্গাহীন অবস্থায় ইতস্তত ঘোরাফেরা করে। ফলত এদের পরলোক সন্মন্ধে কোনো জ্ঞান থাকে না। কিন্তু এদের মধ্যে থাকে সুপ্ত বাসনা-কামনা। আর এই কামনা বাসনার তাড়নায়, এরা পরবর্তী দেহ ধারনের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। আর এই কারণেই এরা পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহন করে থাকে। তাই এদের কাছে, তাদের পূর্ব জীবন, অর্থাৎ যেখান থেকে এসেছে, সেই সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই থাকে না।  এমনকি কেন এসেছে, অর্থাৎ আমাদের কেন এই দেহ ধারণ করতে হয়, তার সত্যিকারের উদ্দেশ্য কি তা তার জানা নেই। এঁরা বিষয়সুখে মগ্ন থাকতে চায়।  বিষয়ের পিছনে ছুটে  বেড়ায়।  বিষয়কে কেন্দ্র করে ঘূর্ণিপাকের  বায়ুর মতো বিষয়কে কেন্দ্র করে জন্মের পর জন্ম ধরে ঘুরতে থাকে। আর আশ্চর্য্যের ব্যাপার হচ্ছে,এরা  বিষয়কে কেন্দ্র করে ঘোরে  বটে কিন্তু বিষয়কে প্রাপ্তির যে নেশা তা তাদের কোনোদিন শেষ হয় না। নেশারুরা যেমন বারবার নেশার দ্রব্য সংগ্রহ করবার জন্য ছুটে  বেড়ায়। এরাও বাসনার তৃপ্তির জন্য, জন্ম থেকে জন্মান্তর ধরে ঘুরে বেড়ায়। তবু বাসনার তৃপ্তি হয় না।  তাই যমরাজ বলছেন, এরা বারবার অধিগত হয়, অর্থাৎ বারবার  জন্ম ও মৃত্যু বরণ  করে। 

দেখুন জগৎ দুটো, একটা পার্থিব আর একটা অপার্থিব। আমরা যখন যে জগতে অবস্থান করি, তখন সেই জগৎকে সত্য বলে মনে করি। ধরুন আপনি জেগে আছেন, তো আপনি এই পার্থিব জগতের সমস্ত কিছু সত্য বলে আপনার কাছে প্রতিভাত হচ্ছে। এই আকাশ, এই বাতাস, এই সূর্য, এই পৃথিবী, এই পৃথিবীর মানুষজন, আপনার আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব, এমনকি আপনি নিজে একটা পার্থিব শরীর সবই আপনার কাছে সত্য বলে মনে হচ্ছে। আর এগুলো আপনি প্রতক্ষ্য করছেন।  আপনি ফুলের গন্ধ পাচ্ছেন, আপনি মধুর সংগীত উপভোগ করছেন, আপনার সুন্দর স্ত্রী-ছেলে-মেয়েকে আপনি নিজের চোখের সামনে দেখছেন, আপনি রসগোল্লার স্বাদ নিচ্ছেন, মায়ের কোলের স্পর্শসুখ বা মায়ের স্নেহ, বাবার আদর  অনুভব করছেন - এগুলো সবই তাৎক্ষণিক ভাবে সত্য বলে আপনার মনে হচ্ছে। 

আবার দেখুন আপনি যখন ঘুমিয়ে আছেন, তখনও আপনি আছেন, শরীর ক্রিয়াশীল না থাকলেও আপনি এই শরীরেই আছেন। এবং আপনি সেই স্বপ্ন জগতের সমস্ত কিছু অবিকল পার্থিব জগতের মতোই উপভোগ করছেন।  তখনও আপনি ইন্দ্রিয়শক্তি কাজ করছে। অর্থাৎ আপনি শুনছেন, দেখছেন, খাবারের স্বাদ উপভোগ করছেন, এমনকি স্ত্রী-সান্নিধ্য অনুভব করছেন।  স্বপ্নের জগতে সবই আছে, আপনিও সেখানে আছেন, অবিকল এই পার্থিব জগতের মতোই। এই স্বপ্নাবস্থাতে আপনার কাছে এই জগৎ অনুভবের অযোগ্য নয়, এমনকি অবিশ্বাস্য নয়, একবিন্দু অসত্য আপনার মধ্যে তখন জগতে পারে না। কিন্তু এইসব অসত্য বলে মনে হয় তখনই যখন আপনি ঘুম বা স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠেন। এই জেগে ওঠাও যেমন সত্য, স্বপ্নে বিচরণ সত্য, আবার এই পার্থিব জগৎ সত্য। আপনি হয়তো বলবেন, না স্বপ্ন কখনো সত্য হতে পারে না। কিন্তু এই কথা কখন আপনি বুঝতে পারেন, যখন আপনি জেগে ওঠেন। যতক্ষন আপনার মধ্যে জাগ্রত অবস্থা না হচ্ছে, ততক্ষন আপনার কাছে স্বপ্ন অবশ্য়ই সত্য বলে প্রতিভাত হচ্ছিলো। 

আবার ধরুন, আপনি গাঢ় ঘুমে আছন্ন। সেখানে এই পার্থিব, অপার্থিব দুটো জগৎই অদৃশ্য হয়ে গেছে। তাবলে কি এই দুটো জগতের অস্তিত্ত্ব নেই ? তা কিন্তু নয়, দুটো জগৎই আছে, কিন্তু আপনি দেখতে পাচ্ছেন না। অর্থাৎ আপনি কোন অবস্থাতে আছেন, তার উপরে নির্ভর করছে, জগতের স্থিতি। আপনি জেগে আছেন, তাই পার্থিব জগৎ আপনার কাছে দৃশ্যমান, আপনি স্বপ্নাবস্থায় আছেন তাই স্বপ্নের জগৎ আপনার কাছে দৃশ্যমান, আর আপনি যখন গাঢ়  ঘুমে আচ্ছন্ন আছেন, তখন এই দুটো জগৎই আপনার কাছ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। 

আমাদের ইহকাল ও পরকাল, ঠিক তেমনি। কাল কথাটার অর্থ হচ্ছে, সময়। ইহকাল অর্থাৎ বর্তমান সময়।  আর পরকাল হচ্ছে, বর্তমানের আগের সময় বা পরের সময়।  পরকাল বলতে আর একটা জিনিস বোঝায়, জন্মের আগে ও মৃত্যুর পরে যে কালে বা সময়ে আমরা অবস্থান করি, তাকে বলা হয় পরকাল। ঠিক তেমনি প্রত্যেক মানুষের দুটো অবস্থা একটা হচ্ছে চেতন অবস্থা আর একটি হচ্ছে অচেতন অবস্থা।  অচেতন অবস্থায় মানুষ প্রকৃত সত্যকে ধরতে পারে না। তখন সে নানান রকম অসত্য বা মরীচিকাকে সত্য বলে মনে করে। অন্ধকার রাতে যেমন মানুষ দড়িকে সাপ বা সাপকে দড়ি বলে মনে করে। ওই মুহূর্তে সে যা ভ্রমাত্মক দৃষ্টিতে দেখছে, তাকে সে সত্য বলেই  মনে করছে, এবং সেইমতো সে আচরণ করছে। এতে তার কোনো দোষ  নেই। কিন্তু টর্সের আলোতে যেমন তার ভুল ভেঙে যায়, তেমনি জ্ঞানের আলোক যখন মানুষের অন্তরে প্রবেশ করে তখন তার ভুল ভেঙে যায়। 

এই সব জ্ঞানের কথা আমরা ধীরে ধীরে শুনবো। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।                 

শান্তিতে মরতে পারলে বাঁচি। (২)











h

No comments:

Post a Comment