Saturday 3 April 2021

পতঞ্জলি যোগসাধনা - সাধন পাদ/


 পতঞ্জলি যোগসাধনা - সাধন পাদ 

ঈশ্বরের দুই রূপ - প্রকৃতি ও পুরুষ। একজন নিষ্ক্রিয় অপরজন সক্রিয়। একজন জড়ানো, একজন ছড়ানো। একপ্যাঁচে বন্ধন  উল্টো প্যাঁচে মুক্তি। একদিকে চঞ্চল আর একদিকে শীতল। এই দুইকে স্বরূপে জানাই সাধনা। কথায় বলে, সে বড়ো  কঠিন ঠাঁই গুরু শিষ্যে দেখা নাই। সাধন পথের  কথা অবোধ্য, দুর্বোধ্য। যার সাধন নেই, তাকে সাধন কথা বোঝানো বিড়ম্বনা। যেখানে ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধি লোপ পেয়ে গেছে,  সেখানে প্রবেশের অধিকার নেই আমাদের। স্বয়ং প্রকাশ, নিজেকে নিজের মধ্যে প্রকাশ করা, এই চূড়ান্ত উপল্বদ্ধির জন্য সাধনা।  

যোগের ভিত্তি দুটো পিলারের উপরে - প্রকৃতি ও পুরুষ। এই দুই তত্ত্বের চরম উপলব্ধি যোগের সাহায্যে হতে পারে। পুরুষকে স্বরূপে চিনতে হবে।  কারন, পুরুষের কোনো পরিনাম নেই, কোনো রূপান্তর নেই। তাই পুরুষ বোধের কোনো বদল হয় না, বিলোপ হয় না। পুরুষ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, প্রকৃতির দিকে, যেখানে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটে চলেছে। চিত্তে বা মনে যত  বৃত্তি, সব এই  পুরুষের জ্ঞানের বিষয়। চিত্ত বা মন চৈতন্যের আলোতে আলোকিত। চৈতন্যের আলোকে আড়াল করে, চিত্তের কোথাও কিছু ঘটে এমনটা সম্ভব নয়। তাই ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, 

সদা জ্ঞাতা চিত্তবৃত্তয়ঃ তৎপ্রভোঃ পুরুষস্য অপরিনামিত্বাৎ। (৪/১৮ কৈবল্যপাদ)

চিত্তের প্রভু পুরুষের অপরিণামত্ব হেতু চিত্তবৃত্তিগুলো সর্বদাই জ্ঞাত। 

পুরুষ নিজে জ্ঞানশক্তি সম্পন্ন।  তাঁর কোনো বিকার নেই। চিত্ত তার বৃত্তির মাধ্যমে প্রকাশমান ও অপ্রকাশ্য। কিন্তু পুরুষের কোনো প্রকাশ বা অপ্রকাশ নেই। চিত্ত, বিষয় সংযোগে  সক্রিয় হয়, শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ  ইত্যাদির মাধ্যমে। এটাই চিত্তের বিষয় জ্ঞান। বিষয়ের দ্বারা রঞ্জিত হয়ে, চিত্ত বিকারপ্রাপ্ত হয়, পরিনাম প্রাপ্ত হচ্ছে।  কিন্তু পুরুষ কখনো পরিণামপ্রাপ্ত হন না। 

আমরা সবাই প্রকৃতির কোলে অবস্থান করছি। প্রকৃতি চিরচঞ্চল, অস্থির রূপ। অথচ আমাদের চর্ম্মচক্ষে এই চঞ্চলতা ধরা পড়ে  না। পৃথিবী ঘুরছে, পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে  আমরাও ঘুরছি। কিন্তু আমাদের অনুভবে তা ধরা পড়ে না। আমাদের মনে হয়, পৃথিবী স্থির। প্রকৃতি স্থির। জীবন একটা নদী। আমরা জানি, নদীর  উপাদান জল। আর জল সদা প্রবাহমান।  তেমনি  জীবনের উপাদান চিরবহমান। জীবন নদী কখনো থামতে জানে না। অথচ নিরন্তর বহমানতা আমাদের উপল্বদ্ধিতে আসে না। জীবন নদীতে ভাসতে ভাসতে একসময় বৃদ্ধ বয়সে এসে মনে হয়, কত কিছু ছেড়ে এসেছি, কতকিছু হারিয়ে গেছে। কোথায় সেই শৈশবের দিনগুলো, কৈশোরের দিনগুলো, যৌবনের দিনগুলো ? এই ক্রোম-পরিণামের জন্য আমাদের রকমফের হয়েই চলেছে। 

পরিনাম বিচিত্র, পদার্থ এক। একই মাটি দিয়ে তৈরী হচ্ছে, কত বিচিত্র পুতুল, হাড়ি কড়াই, সরা, কলসি। মাটির রূপ একটাই , মাটির লক্ষণ একটাই, মাটির গুন্ অপরিবর্তিত। মাটি যখন বিশেষ রূপের মধ্যে আবদ্ধ  হলো, তখন তার ধর্ম্ম হলো, তখন তার লক্ষণ হলো। কলসি যখন তৈরী হয়নি, তখন সে অনাগত, যখন কলসি তৈরী হলো তখন সে আগত বা বর্তমান।  আবার কিছুদিন পরে কলসি ভেঙে গেলো, তখন সে অতীত। একটু যদি গভীর ভাবে চিন্তা করি, তখন আমরা বুঝতে পারবো, জগতের সমস্ত বস্তুরই এই তিনটি পরিনাম। পরিনাম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমানের পরিবর্তন হয়। যে মুহূর্তে কলসিটি তৈরী হলো, তখন সে বর্তমান নতুন।  কিন্তু পরমুহূর্তেই সে পুরাতন হলো, কিন্তু বর্তমান থাকলো, নতুন কলসি হলো অতীত। কলসির অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে, সময়ের নয়।মাটি থেকে কলসির রূপ ফুটে ওঠার ক্ষণ থেকে আবার মাটিতে মিলিয়ে যাবার ক্ষণ পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়া। সারা সৃষ্টি ধরে চলছে, এই পরিণামের ত্রিধারার (অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ) প্রবাহ। এযেন ক্ষনের মালা  গাঁথা। সময়ের মালা গাঁথা। আমি আমার বুদ্ধি আমার কল্পনার সুতোয় মালা গেথে চলেছি। ভাবছি, ক্ষণ চলে গেলো, আসলে ক্ষণ দাঁড়িয়ে। আমরা ক্ষনের পরে ক্ষনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।  আমাদের ক্ষনের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। তবে আমরা বস্তুর পরিনাম বুঝতে পারবো। কালকে সংকুচিত করতে করতে আমরা ক্ষনের কাছে পৌঁছে যেতে পারি। বস্তু ভাঙতে ভাঙতে যেমন আমরা পরমাণু পাই, তেমনি কাল ভাঙতে ভাঙতে আমরা  ক্ষণ পেতে পারি। পরমাণু জড়ো করতে করতে যেমন আমরা বস্তু পেতে পারি, তেমনি ক্ষণগুলোকে পরপর দাঁড় করিয়ে আমরা কালের কল্পনা করে থাকি। বস্তুকে বুঝতে যেমন আমাদের পরমাণুর কাছে যেতে হবে, তেমনি কাল বুঝতে গেলে আমাদের ক্ষনের কাছে যেতে হবে। অর্থাৎ স্থূল থেকে সূক্ষ্মে। সূক্ষ্ম  থেকে তন্মাত্রে, তন্মাত্র থেকে অহংকারে, অহংকার থেকে মহত্তত্ত্বে , সেখান থেকে প্রকৃতির   অলিঙ্গে - যেখানে  লিঙ্গ নেই। সৃষ্টির মূল। যেখানে আর কোনো মূল নেই। সর্ব কারনে কারন।  কারনে অবসান। এহলো প্রকৃতির অলিঙ্গে  দাঁড়িয়ে সৃষ্টিজোড়া প্রকৃতিকে খোঁজা।   

অন্যদিকে পুরুষের সন্ধান করতে গেলে, সবকিছু থেকে বিযুক্ত হতে হবে, তবেই পুরুষ শক্তির সন্ধান করা যাবে । পুরুষ কার্য্য-কারন  শৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে  না। পুরুষ সৃষ্টির উপাদান-কারন নয়। পুরুষ নিমিত্ত মাত্র। পুরুষের নিমিত্তই সৃষ্টির উপাদান জোগাচ্ছেন প্রকৃতি। পুরুষ আছেন, তাই প্রকৃতির উৎসাহ। প্রকৃতি পুরুষের জন্যই বিশাল আয়োজনে ব্যস্ত। স্ত্রী মৌমাছির টানে যেমন পুরুষ  মধু সংগ্রহ করে নিয়ে আসে, বাসা বাঁধে, তেমনি পুরুষের টানে প্রকৃতি সৃষ্টির উপাদান সংগ্রহ করে থাকে। বিপুল সেই আয়োজন। দেখবেন পুরুষ, ভোগ করবেন পুরুষ, ভালো-মন্দ বুঝবেন তিনি, তৃপ্ত বা অতৃপ্ত হবেন তিনি, সুখী বা অসুখী হবেন তিনি সেই আশায় প্রকৃতির বিশাল আয়োজন। কারন চেতনা তো তারই সম্পদ। কিন্তু হায়, পুরুষ উদাসীন, নির্লিপ্ত। পুরুষই, ভোক্তা, ভর্তা, দৃষ্টা , মালিক।  পুরুষ-মালিককে খুশি করবার জন্য, দাসী-প্রকৃতির ব্যস্ততা। পৃকৃতি গাইছে, নাচ্ছে, পুরুষ দেখছে, শুনছে। কখনো তৃপ্ত, কখনো বিরক্ত। বিরক্ত পুরুষ একসময় উঠে পরে, আসন ছেড়ে চলে যায়। যখন উঠে যায়, তখন নাচ-গান থেমে  যায়। কার জন্য নাচ-গান, যদি দ্রষ্টা-শ্রোতা-সমঝদার না থাকে ?  এই সমজদার পুরুষই পরমাত্মা। বোঝার, দেখার, শোনার, ভোগ করবার, ক্ষমতার যোগ যিনি করতে পারেন,  তিনিই পরমাত্মা। প্রকৃতির দ্বারা নির্মিত এই দেহে সেই পুরুষেরই বাস। এই পুরুষের সন্ধানই যোগ। শুরু হয়, প্রাকৃতিক দেহকে অবলম্বন করে, শেষ হয়, পুরুষ-চেতনায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে। জাতি-দেশ-কাল-সময় থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে চেতন-মৌন হয়ে যাওয়া। 

ম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।

পাতঞ্জল দর্শন - সাধন পাদ -২

ঋষি পতঞ্জলি তার পাতঞ্জল যোগদর্শনে বলছেন, (শ্লোক-১) তপঃ-স্বাধ্যায়-ঈশ্বর-প্রণিধানানি ক্রিয়াযোগঃ। তপস্যা, স্বাধ্যায়ঃ ও ঈশ্বর-প্রণিধান, একেই বলে ক্রিয়াযোগ। এখন  কথা হচ্ছে, তপস্যা, স্বাধ্যায়, ঈশ্বর-প্রণিধান বলতে আমরা কি বুঝি ? 

তপস্যা : আমাদের বিচিত্র বাসনা।  আর এই বাসনা পূরণ করবার জন্য আমরা কর্ম্মের ক্লেশ সহ্য করি। বিষয়ের ভোগের নিমিত্ত  চিত্তকে অশুদ্ধ করে ফেলি। এইযে চিত্তমল, ও কর্ম্মক্লেশ এগুলো আমাদের সাময়িক সুখ দুঃখের কারন। তপস্যা যোগীর চিত্তে বাধাহীন ভাবে প্রসন্নতা আনতে  পারে।

স্বাধ্যায় : হলো, বিভিন্ন পবিত্র ধর্ম্মগ্রন্থ যা মোক্ষের সন্ধান দিতে পারে, এমন গ্রন্থ পাঠ ও পাঠ্য বিষয়ে মনের গভীরে চিন্তন করা। যথার্থ পন্ডিতদের বাণী শ্রবণ, মনন করা। 

ঈশ্বর-প্রণিধান : অর্থাৎ ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পন করা। নিজের সমস্ত কর্ম্মফল ঈশ্বরে কাছে নিবেদন করা। 

এগুলো সবই ক্রিয়াযোগের অঙ্গ। এখন কথা হচ্ছে ক্রিয়াযোগ করলে কি হয় ? ঋষি বলছেন, (শ্লোক-২) সমাধি-ভাবনার্থঃ-ক্লেশ-তনুকরণ-অর্থশ্চ। অর্থাৎ সমাধি-ভাবনার জন্য,  এবং আমাদের ক্লেশ গুলোকে ক্ষীণ করবার জন্য, ক্রিয়াযোগের অনুষ্ঠান করা কর্তব্য।  সমাধি হচ্ছে একটা উচ্চ ভাবনার স্তর একটা উচ্চ  চেতন  স্তরে নিজেকে উন্নীত করা। আর এটি করতে গেলে, নিজের মধ্যে যত ক্লেশ/কষ্ট আছে,  চিত্তে যত মল জমা আছে, তাকে পরিষ্কার করতে হবে। এখন কথা হচ্ছে এই ক্লেশগুলো কী ? 

ঋষি বলছেন, (শ্লোক-৩) অবিদ্যা-অস্মিতা-রাগ-দ্বেষ-অভিনিবেশাঃ পঞ্চক্লেশাঃ। অর্থাৎ অবিদ্যা-অস্মিতা-রাগ-দ্বেষ-অভিনিবেশ - এই পাঁচপ্রকার ক্লেশ। অবিদ্যা অর্থাৎ মিথ্যাজ্ঞান, বা বিপরীত ভাবনা, মিথ্যা সংস্কার। অস্মিতা হচ্ছে আমিজ্ঞান - মিথ্যা আমিজ্ঞান -অহংকার। রাগ হচ্ছে আসক্তির অপূর্ণতার পরিণতি। দ্বেষ হচ্ছে অন্যের প্রতি ঈর্ষান্বিত হওয়া,  আর অভিনিবেশ হচ্ছে মৃত্যুভয়। এই পাঁচ ধরনের প্রভাব আমাদের চিত্তকে মলিন করে রাখে। এমনকি নিজের সত্ত্বার বিস্মৃতি ঘটায়। এবং এই কারণেই আমরা আমাদেরকে ভুলে আছি।

ঋষি বলছেন, (শ্লোক-৪) অবিদ্যা ক্ষেত্রম-উত্তরেষাং প্রসুপ্ত-তনু-বিছিন্নম-উদারাণাম্। অবিদ্যার উদরেই   জন্ম নেয়, অস্মিতা-রাগ-দ্বেষ-অভিনিবেশ ইত্যাদি ক্লেশ।  এই অবিদ্যা আবার প্রসুপ্ত, তনু, বিচ্ছিন্ন ও উদার এই চার ভেদে অবস্থিত। এখন কথা হচ্ছে প্রসুপ্তি কি ? আমাদের চিত্তে শক্তির আশ্রয়মাত্র একটা বীজ ভাবের উদয় হয়। এই বীজ হচ্ছে প্রবোধ। প্রবোধ অর্থাৎ সন্তুষ্টি। এই প্রবোধের সাহায্যে ক্লেশবিজ দগ্ধ হতে থাকে। যার জন্য সচেতন পুরুষের মধ্যে  বিষয় বাসনা জাগতে পারে না। তাই যোগী পুরুষের মধ্যে যদিবা ক্লেশ থাকে তা ক্ষীণমাত্র। আর পুড়ে যাওয়া বীজের মধ্যে থেকে যেমন অংকুর-উদ্গমনের সম্ভাবনা ক্ষীণ, তেমনি যোগী পুরুষের মধ্যে ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সংযোগ সত্ত্বেও কোনো ক্লেশের জাগরণ ঘটতে পারে না। 

তনু কথাটার অর্থ আমরা জানি  অঙ্গ বা দেহ। তনু কথাটার আর একটি অর্থ হচ্ছে সূক্ষ্ম। বিপরীত ভাবনায় অভিভূত যে ক্লেশ তনু অর্থাৎ ক্ষীণ অবস্থা প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ যে ভাবনায় ক্লেশ উৎপন্ন হচ্ছে, তার বিপরীত ভাবনায়, ক্লেশের নিস্পত্তি হতে পারে। আর বারবার একই ভাবনা উদয় হতে থাকলে, তখন ক্লেশ বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। চিত্ত যখন কোনো কিছু দ্বারা আসক্ত হয়, তখন সেই রঙে  রঞ্জিত হয়ে থাকে। ভবিষ্যতে যদি বিষয়ান্তর ঘটে, তবে পূর্ববর্তী বিষয় রঙ ত্যাগ করে নতুন রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নেয়। তখন লদ্ধ বৃত্তির উদর হিসেবে কাজ করে থাকে। 

আসলে যে ভাবনা আমাদের মনে কষ্ট বা ক্লেশ উৎপন্ন করে, বিপরীত ভাবনায় সেই ক্লেশের নাশ হতে পারে। অর্থাৎ নিবৃত্তি মার্গ অবলম্বন করতে পারলে, আমরা চিত্তেরপরিবৃত্তি  বৃত্তিগুলোকে পরিবর্তন করতে পারবো। তাই বলা হচ্ছে অবিদ্যা, বা অজ্ঞান আমাদের ক্লেশের কারন। অবিদ্যাই  সমস্ত ক্লেশের গর্ভ বা  সৃষ্টিভূমি।

এখন কথা হচ্ছে  অবিদ্যা ব্যাপারটা কি ? কোনটি অবিদ্যা, আর কোনটিই বা সঠিক বিদ্যা ? ঋষি পতঞ্জলি বলছেন (শ্লোক - ৫) অনিত্য-অশুচি-দুঃখ-অনাত্মাসূ নিত্য-সূচি-সুখ-আত্মখ্যাতিঃ-বিদ্যা। অনিত্য, অশুচি, দুঃখজনক, অনাত্ম অর্থাৎ যা আমি নোই, নিজেকে তাই মনে করা, হচ্ছে অবিদ্যা।  আর, যে জ্ঞান  নিত্য-সুখজনক, আত্মজ্ঞান জনক, তা হলো বিদ্যা। যে জ্ঞান এক বস্তুতে অন্য বস্তুর ধারনা করায় তাকেই অবিদ্যা বলা হয়ে থাকে। অবিদ্যা কিন্তু বিদ্যার অভাব নয়, বরং বলা যেতে পারে বিদ্যার বিপরীত বা ভ্রমজ্ঞানহচ্ছে অবিদ্যা । আর এই বিদ্যা ও অবিদ্যা চিত্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত। চিত্তবৃত্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত। অবিদ্যাজনিত চিত্ত বৃত্তির বিপরীত হচ্ছে বিবেক নামে খ্যাত। বিদ্যা ও অবিদ্যা উভয়ই  অনন্ত কিন্তু নাশ্য। অর্থাৎ অবিদ্যার যেমন নাশ হতে পারে, বিদ্যার উদয় হলে, তেমনি বিদ্যার নাশ হতে পারে অবিদ্যার উদয়ে। অর্থাৎ বিবেক যখন জাগ্রত হয়, তখন আমাদের ভ্রম দূর হয়ে যায়, আবার বিবেক যখন নিষ্ক্রিয় থাকে তখন আমাদের অবিদ্যার উদয় হয়। 

ঋষি এবার অস্মিতা অর্থাৎ অহং সম্পর্কে বলছেন। বলছেন (শ্লোক-৬) দৃকশক্তির ও দর্শনশক্তির একতানতাই অস্মিতা। "দৃকদর্শনশক্তোঃ একাত্মতা ইব অস্মিতা" । অর্থাৎ পুরুষের দৃকশক্তি, আর বুদ্ধির দর্শনশক্তি - এই দুইয়ের একতানতাই অস্মিতা বা আমাদের অহংবৃত্তি। এখন কথা হচ্ছে এই পুরুষের দৃকশক্তি আর বুদ্ধির দর্শনশক্তি বলতে কি বোঝায়। দৃকশক্তি অর্থাৎ যার দ্বারা আমাদের জ্ঞানলাভ হয়, অর্থাৎ চৈতন্য। আর বুদ্ধির দর্শনশক্তি অর্থাৎ বুদ্ধির বিচার করবার শক্তি। উভয়ই  চৈতন্যের কাজ - কিন্তু আমাদের জ্ঞানচক্ষু ও চর্ম্ম  চক্ষু যেমন আলাদা তেমনি পুরুষের দৃকশক্তি ও বুদ্ধির দর্শনশক্তি আলাদা। বুদ্ধির দর্শনশক্তি মোহদ্বারা আবৃত হওয়া সম্ভব কিন্তু পুরুষের দৃকশক্তি মোহমুক্ত। 

ঋষি বলছেন, "সুখানুশয়ী রাগঃ" (শ্লোক - ৭) অর্থাৎ সুখের আশায় যে কর্ম্ম করা হয়, তাকে বলা হয় রাগ বা আসক্তি। এখানে রাগ মানে ক্রোধ নয়, এখানে রাগ কথাটার দ্বারা বোঝানো হচ্ছে পীড়া, আসক্তি, কাম। সুখ-সাধনের  যে স্পৃহা, বা তৃষ্ণা ও লোভ তা হলো রাগ বা আসক্তির কারন । 

আবার "দুঃখানুশয়ী দ্বেষ" (শ্লোক-৮) অর্থাৎ দুঃখজনক কৃতকর্ম্মের অনুস্মরণ হলো দ্বেষ। আমরা জন্ম- জন্মান্তরে বহু দুঃখ ভোগ করেছি। এই দুঃখের স্মৃতি আমাদের সংস্কারের মধ্যে রয়ে গেছে। এই যে দুঃখের স্মৃতি এর স্মরণে আমাদের মধ্যে ক্রোধ বা দ্বেষ বাসা বাঁধে। ধরুন আমরা আগের জন্মে মৃত্যু যন্ত্রনা ভোগ করেছি। আর এই মরণযন্ত্রণার স্মৃতি আমাদের মধ্যে সংস্কারের মধ্যে গেঁথে আছে। তাই মৃত্যুর-স্মরন মাত্রেই আমাদের ভয়, দ্বেষ, রাগ উৎপন্ন হয়। 

"স্বরসবাহি বিদূষঽপি তথা রূঢ়ঃ অভিনিবেশঃ" (শ্লোক - ৯) স্বরসবাহী অর্থাৎ নিজের অধিকারে থাকা রস অর্থাৎ সংস্কার,    বিদূষঽপি অর্থাৎ বিদ্বানদেরকেও আবার অবিদ্বানদেরকেও,  তথা রূঢ়ঃ অভিনিবেশঃ অর্থাৎ, মৃত্যুভয় আঁকড়ে থাকে। দেখুন, বিদ্বান বলুন, অবিদ্বান বলুন, মানুষ বলুন, জীবজন্তু বলুন, কীট বলুন, বা কীটাণু বলুন - যাবৎ জীবকুল, মৃত্যুর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে, তাই প্রত্যেক জীবকেই মৃত্যুভয়ে আতঙ্কগ্রস্থ হতে দেখা যায়, মৃত্যু থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য বিভিন্ন রকম উপায় অবলম্বন  করতে দেখা যায়। আর এটা নিশ্চিত, যে তার এই মৃত্যুজনিত অভিজ্ঞতা সে এই জীবনে সঞ্চয় করেনি। তাহলে কোথা থেকে তার মধ্যে এই মৃত্যুভয় জনিত আতঙ্ক তৈরী হলো ? তাই ঋষি বলছেন, এগুলো আমাদের সংস্কার যা আমরা জীবন থেকে জীবনে বহন করে নিয়ে চলেছি। 

ঋষি এরপর বলছেন, "তে প্রতিপ্রসবহেয়াঃ সূক্ষ্মঃ" । তে অর্থাৎ এই পঞ্চক্লেশ ক্ষীণ হলে প্রতিপ্রসব হেতু তা সূক্ষ্ম হয়। প্রতিপ্রসব অর্থাৎ পুনরায় জন্ম। তো আমাদের মধ্যে সংস্কার রূপে যা কিছু আছে, আমাদের চিত্তে যদি তার বিপরীত  প্রভাব ফেলতে পারি, নতুন সংস্কারের জন্ম দিতে পারি, তাহলে আমাদের এই পুরোনো সংস্কারকে নাশ করতে পারি।

আসলে ঋষি বলতে চাইছেন, ক্রিয়ার মাধ্যমে জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার যোগ হতে পারে।  নিষ্কাম ক্রিয়াতে চিত্তশুদ্ধি হয়। আর শুদ্ধ চিত্তে মায়ার আধিপত্য স্থির হয়, শান্ত হয়, তাকে ক্রমোন্নতির পথে নিয়ে যায়। যোগ সাধন আমাদের বিচার শক্তিকে জাগ্রত করে, বৈরাগ্যের ভাবনা জাগ্রত হয়, অহং-এর  বিলোপ সাধন করে, রাগ-দ্বেষ এমনকি মৃত্যুভয় নাশ হয়। আর এই সব অবিদ্যার অন্তর্ধানে আমাদের চিত্ত নিজ কারন-স্বরূপে বিলীন হয়ে যায়। 

এর পরের দিন আমরা শুনবো, ঋষি পতঞ্জলি বলছেন ধ্যানের দ্বারা চিত্তের ক্লেশবীজ নাশের কথা। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।

----------------------- 

পাতঞ্জল যোগদর্শন - সাধনপাদ - ৩ 

মানুষ ছুটছে, একদল ভোগের জন্য, আর একজন মুক্তির জন্য। প্রকৃতি নিজের জন্য কিছু করে না। আকাশ-বাতাস-চন্দ্র-সূর্য কেউই নিজের জন্য কিছু করছে না। প্রকৃতি সবসময় পুরুষের সন্তুষ্টির জন্য ব্যস্ত। পুরুষ কখনো ভোগরূপে আবার কখনো মুক্তি রূপে আস্বাদন করছে । সমাধি সাধকের মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে পায়ে প্রজ্ঞা। সমাধি  আলাদাভাবে চিনিয়ে  দেবে এই দুই তত্ত্বের মধ্যে পার্থক্য। প্রকৃতির পরিনাম সম্পর্কে জ্ঞান হয় বিবেকের সাহায্যে। যোগদর্শন দুটো জ্ঞানের উপরে প্রতিষ্ঠিত একটা হচ্ছে বিবেকজ্ঞান আর একটি হচ্ছে বিবেকজ-জ্ঞান। বিবেকজ্ঞানে প্রকৃতি উন্মোচিত হয়। আর বিবেকজ-জ্ঞানে স্বরূপ দর্শন হয়। বিবেকজ জ্ঞানে প্রকৃতির স্বরূপ উপলব্ধি হয়। বিবেকের একদিকে পুরুষ আর একদিকে প্রকৃতি। বিবেকজ্ঞানের ফলে এই দুইয়ের বিচ্ছিন্নতা ঘটে থাকে। যোগসাধক এই জ্ঞানের সন্ধানে, সমস্ত কিছু থেকে নিবৃত্ত হয়ে থাকেন। আর সমাধি নিবৃত্তির পরিনাম।    

"ধ্যানহেয়া তদবৃত্তয়ঃ"   - শ্লোক - ১১

ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, আমাদের চিত্তে যে ক্লেশ বীজ রূপে অবস্থান করছে, ধ্যানের  দ্বারা সেই বীজগুলোকে বিনাশ করতে হবে। আমরা আগেই শুনেছি  অবিদ্যা-অস্মিতা-রাগ-দ্বেষ-অভিনিবেশ - এই পাঁচপ্রকার ক্লেশ। অবিদ্যা অর্থাৎ মিথ্যাজ্ঞান, বা বিপরীত ভাবনা, মিথ্যা সংস্কার। অস্মিতা হচ্ছে আমি-জ্ঞান - বা  মিথ্যা আমিজ্ঞান অর্থাৎ অহংকার। রাগ হচ্ছে আসক্তির অপূর্ণতার পরিণতি। দ্বেষ হচ্ছে অন্যের প্রতি ঈর্ষান্বিত হওয়া,  আর অভিনিবেশ হচ্ছে মৃত্যুভয়। এই পাঁচ ধরনের প্রভাব আমাদের চিত্তকে মলিন করে রাখে। এমনকি নিজের সত্ত্বার বিস্মৃতি ঘটায়। এবং এই কারণেই আমরা আমাদেরকে ভুলে আছি। এখান থেকে বেরুতে গেলে আমাদের ধ্যানে প্রবিষ্ট হতে হবে। এখন কথা হচ্ছে ধ্যান কি ? ধ্যান হচ্ছে আত্মার সঙ্গে মনের  একতানতা। আমাদের মনের মধ্যে যে সংকল্প-বিকল্প আছে, তার প্রতি একাগ্র হওয়া। মনকে স্থির করা। বিবেকের সাহায্যে ক্লেশবৃত্তিগুলোকে ত্যাগ করতে হবে। যোগের মধ্যে বিচার-জ্ঞানের  সাহায্যে ক্লেশ-বৃত্তিগুলোকে ত্যাগ করতে হবে। আমরা জানি ক্রিয়াযোগ হচ্ছে, তপস্যা, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বর প্রণিধান। ক্রিয়াযোগ অভ্যাসে ক্লেশগুলো ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকে। একসময় ক্লেশবীজ জ্বলে-পুড়ে ভস্মে পরিণত হয়। ক্লেশ গুলো যখন ভষ্মে পরিণত হয়, তখন বোঝা যায় ধ্যানের প্রারম্ভ হলো। মন তখন অবিচল হয়ে যায়, শান্ত হয়ে যায় । আর আমাদের বৃত্তিগুলোও তখন ধংশ হয়। মনে রাখতে হবে, স্থূল ক্লেশগুলো আমাদের শত্রূ, কিন্তু সূক্ষ্ম ক্লেশগুলো আমাদের মহাশত্রূ। যখন এই ক্লেশ গুলো পুড়ে ছাই  হয়ে যাবে, তখন সাধকের  যোগজ সমাধি হবে।    

ক্লেশমূলঃ কর্মাশয়ো দৃষ্টাদৃষ্ট জন্ম বেদনীয়ঃ - শ্লোক-১২ 

কর্মাশয় হচ্ছে ক্লেশের  মূল। আর এই কর্ম্ম সংস্কারই জন্ম-জন্মান্তরে ফল প্রদান করে থাকে। 

ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, কর্ম্মাশয় হচ্ছে ক্লেশগুলোর  মূল। কর্মাশয় বা কর্ম্মসংস্কার  আমাদের কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ ইত্যাদি থেকে উৎপন্ন হয়ে থাকে। আর এই কর্ম্মসংস্কার আমাদের জন্ম-জন্মান্তর ধরে ফল প্রদান করে থাকে। আমরা যা কিছু করি, দেখি, শুনি, এমনকি যে সম্পর্ক গড়ে তুলি,  এগুলো সবই আমাদের চিত্তে ছাপ ফেলে। আর এই ছাপগুলোকেই বলা হয়, সংস্কার। এই সংস্কার দুই প্রকার, নির্বীজ ও সবীজ। অর্থাৎ একটা থেকে ফল উৎপাদন হতে পারে, আর অন্যটি থেকে নতুন-ফল উৎপাদন হয় না। আবার সংস্কারকে   অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে, দুই রকম যেমন - কোনো সংস্কার ভালো ফল প্রদান করে থাকে, আবার কোনো সংস্কার  খারাপ ফল প্রদান করে থাকে। কিন্তু খারাপ-ভালো যে  ফলই প্রদান করুক না কেন, এই ফল ভোগ করবার জন্য, আমাদের পুনঃপুনঃ জন্ম গ্রহণ করতে হবে বা সংস্কার অনুযায়ী দেহও  ধারণ করতে হবে। অর্থাৎ যে দেহ যেমন ভোগের অনুকূল, সেইমতো দেহ ধারণ করতে হবে। । এই কথাই ঋষি পরবর্তী শ্লোকে বলছেন। বলছেন -   

সতি মুলে তৎ বিপাকো জাতি-আয়ু-ভোগাঃ (শ্লোক ১৩) 

সতি অর্থাৎ ক্লেশ গুলো থাকলে পর; মুলে অর্থাৎ কর্ম্মের মুলে ; তদ্বিপাকো অর্থাৎ সেগুলো (কর্ম্মফল) কর্মাশয়ে রান্না হতে থাকে, বিপাক হতে থাকে । জাতি-আয়ু-ভোগাঃ, -  জাতি অর্থাৎ মনুষ্য জাতি ইত্যাদির আয়ুষ্কাল ও ভোগ প্রাপ্ত হয়ে থাকে। 

কর্মের মুলে যে ক্লেশ থাকে, সেগুলোই আমাদের আয়ু, জাতি, ও ভোগরূপে তার পরিনাম প্রকটিত হয়। আসলে ক্লেশজনিত সংস্কারের জন্য কর্ম্মের উৎপত্তি আবার কর্ম্মের জন্য আমাদের জন্ম-মৃত্যুর খেলা। এই কর্ম্মফল ভোগ নিমিত্ত পুরুষের নির্দিষ্ট শরীরে জন্ম ও আয়ু নির্ধারিত হয়ে থাকে। আসলে এই কর্ম্মের খেলা বোঝা খুব শক্ত। কেননা কর্ম্মফল ভোগের জন্য শরীর-ধারন। আবার শরীর-রক্ষার জন্য কর্ম্ম।  আবার কর্ম্মফল ভোগের জন্য জন্ম। এই যে কর্ম্মচক্র - এর মধ্যে আবদ্ধ জীবকুল। প্রারব্ধ কর্ম্মফল ভোগের জন্য জন্মগ্রহণ, আবার এই জীবনে যে কর্ম্ম সম্পাদন করা হলো, তা  আমাদের  সঞ্চিত কর্ম্ম হিসেবে থেকে গেলো। তাহলে এর শেষ কোথায় ? এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কর্মসংস্কার  আমাদের অনাদিকাল থেকে চলে আসছে। আবার সংস্কার আমাদের অগুনতি, বহু। আবার বলা হয়ে থাকে আধার অনুযায়ী, কর্মফলের ভোগ হয়ে থাকে। আবার এক জীবনের কর্ম পরবর্তীতে কি এক জীবনেই ভোগ সম্ভব ? কেননা আমরা এক জীবনেই  অনেকের সাথে কর্ম-সন্মন্ধে জড়িত হয়ে থাকি।  তো এক জন্মে সবার সাথে সেই কর্ম্মফল ভোগ সম্ভব নাও হতে পারে। তাহলে একজীবনের কর্ম্ম আমাদের কি অনেক-অনেক জন্মের কারন হয়ে উঠতে পারে ?  যাইহোক, আমাদের আলোচ্য বিষয় পতঞ্জলির যোগসূত্র।  এখানে যা কিছু ঋষি পতঞ্জলি বলেছেন, সেই সব কথার মধ্যে আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো।  

 শ্লোক - ১৪ - তে হ্লাদ-পরিতাপ-ফলাঃ পুন্যাপুন্যহেতু ত্বাৎ। 

সেই জাতি-আয়ু-ও ভোগরূপ কর্ম্ম বিপাকগুলো পুন্য হেতুতে সুখফল ও অপূণ্য  হেতু দুষ্ফল প্রদান করে থাকে। 

ঋষি বলছেন, পুণ্যকর্মে সুখকর ফল, আবার অপূণ্য কর্ম্ম আমাদের আমাদের পরিতাপের বিষয় হয়ে থাকে। এখন কথা হচ্ছে, পুন্য কর্ম কাকে বলে, আর অপূণ্য কর্মই বা কি ? গৌড়পাদজি তার পতঞ্জলি-দর্শনের ভাষ্যে বলছেন, যম-নিয়ম-দয়া-দান এগুলো হচ্ছে পুণ্যকর্ম।  আর এর বিপরীত হচ্ছে অপূণ্য কর্ম। আবার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, সত্ত্বগুণের দ্বারা করা কর্ম্ম হচ্ছে দৈবসম্পদ লাভের  উপায়। অর্থাৎ পুণ্যকর্ম আমাদের সত্ত্বগুণের দ্বারা সম্পাদিত হতে পারে।  আবার রজঃ ও তমঃ-গুণের দ্বারা করা কর্ম হচ্ছে, আসুরি কর্ম। অর্থাৎ এতে পরিতাপ বা দুঃখের উৎপত্তি হয়ে থাকে। 

পরিনাম-তাপ-সংস্কার দুঃখগুন্-বৃত্তি বিরোধাৎ চ দুঃখমেব সর্বং বিবেকিনঃ। (শ্লোক - ১৫)

ঋষি বলছেন, পরিনাম, তাপ ও  সংস্কার এই তিন রকম দুঃখ বর্তমান থাকবার জন্য, এবং তিনটি গুনের বৃত্তির মধ্যে পরস্পর বিরোধের কারনে বিবেকীদের কাছে সবই দুঃখজনক। 

এবার ঋষি বলছেন, যারা বিবেকবান, তারা তিনটি গুন-জাত কর্মকেই দুঃখের কারন হিসেবে নির্নয় করেছেন। এখন কথা হচ্ছে, যা সাধারনের কাছে সুখকর-কর্ম্ম বা পুন্য-কর্ম্ম  তা বিবেকীদের কাছে, কিভাবে দুঃখজনক বা অপূণ্য কর্ম্ম  হতে পারে ? দেখুন সংসার থেকে সরে পড়তে গেলে, বা সংসার থেকে নিষ্কৃতি পেতে গেলে, সংসারের যাবতীয় সুখ-দুঃখ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে হবে। সুখ ও দুঃখ পরস্পর বিরোধী কিন্তু  দুটোই  ভোগ। তো সমস্ত ভোগ তা সে দুঃখ-ভোগ হোক আর সুখ-ভোগ হোক,  ভোগ থেকে নিজেকে আলাদা না করতে পারলে, সংসার নিগড় থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। আর এই ভোগের মুলে আছে আমাদের সংস্কারের শৃঙ্খল। আবার  এই সংস্কার হচ্ছে আমাদের অবিদ্যার ফল।  অবিদ্যার কারণেই সংস্কারের জন্ম হচ্ছে। তাই বিবেকীগণ সমস্ত কর্ম্মের মধ্যেই দোষ দর্শন করে থাকেন। আর অষ্টমার্গের পথে নিজেকে পরিচালিত করে থাকেন। নিজের মধ্যে আত্মজিজ্ঞাসা, জাগিয়ে তোলেন।  ঈশ্বর জিজ্ঞাসা জাগিয়ে তোলেন। আর একটা কথা হচ্ছে, সংসারে দুঃখের ভোগ কমাতে গেলে, দুঃখকেই ভোগ করতে হবে।  তবেই দুঃখের নিস্পত্তি। সংসারে সুখ-দুঃখের আদান-প্রদান চলতেই থাকে। হয় সুখ না হয় দুঃখ। এই জায়গা থেকে বেরুতে গেলে নিবৃত্তি মার্গ অবলম্বন  ভিন্ন অন্য পথ নাই। তাই বিবেকীগণ, ত্রিতাপ-জ্বালা থেকে মুক্তির জন্য, ত্রিতাপ-জ্বালাতেই নিজেকে পুড়িয়ে ছাই  করে থাকেন। আর এর থেকেই আসে মুক্তির আকাঙ্খ্যা। ধর্ম্ম-অধর্ম্ম সব পরিত্যাগ করতে হবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, হে অর্জুন তুমি এতদিন ধর্ম্ম-অধর্ম্ম বলতে যা কিছু বুঝেছো, সমস্ত কিছু পরিত্যাগ করে, আমরা স্মরণ নাও। বিবেকবান পুরুষ সেই কাজটিই করে থাকেন। 

হেয়ং দুখম-অনাগতম - (শ্লোক ১৬)  

অনাগত অর্থাৎ যে দুঃখ এখনো আসেনি, অর্থাৎ যে ক্লেশ, বীজরূপে চিত্তভূমিতে দেখা দিয়েছে, তাকেও পরিত্যাগ করতে হবে। 

ঋষি বলছেন, বর্তমানের সুখ-দুঃখে যেমন নির্বিকার থাকতে হবে, পরিত্যাগ করতে হবে, তেমনি যে সুখ-দুঃখ ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করা আছে, তাকেও আমাদের পরিত্যাগ করতে হবে। হেয় অর্থাৎ হীনভাবে ত্যাগ করতে হবে। অর্থাৎ ভবিষ্যতের যে সুখের আশায় আমি অপেক্ষমান হয়ে আছি, সেই জায়গায় থেকে নিজেকে বের করে নিয়ে আসতে  হবে। তাই সমস্ত সুখ-দুঃখ তা সে অতীতের  স্মৃতি হোক, বর্তমানের ভোগ হোক, বা ভবিষ্যতের ভোগ হোক, সবই মনেপ্রাণে আমাদের ত্যাগ করতে হবে।  তবেই, আমাদের মধ্যে মুক্তির আকাঙ্খ্যা জাগতে পারে।  আর নিজের মধ্যে যখন এই আকাংখ্যা পরিপুষ্ট লাভ করবে, তখন আমরা অষ্টমার্গের পথে নিজেকে নিয়োজিত করতে সক্ষম হবো। 

 দৃষ্ট দৃশ্যয়োঃ সংযোগো হেয়হেতু (শ্লোক ১৭) 

দ্রষ্টা ও দৃশ্য এই দুইয়ের সংযোগ, হেয় অর্থাৎ ত্যাজ্যের  হেতু। 

দ্রষ্টা হচ্ছে আমাদের বুদ্ধিতে প্রতিবিম্বিত স্বচ্ছ পুরুষ।  আর দৃশ্য হচ্ছে বুদ্ধি। এই দ্রষ্টা ও দৃশ্যের মিলনে বা সংযোগে যে ফল উৎপাদন হয়, তা দুঃখজনক। তাই ঋষি পতঞ্জলি দ্রষ্টা-দৃশ্য অর্থাৎ প্রতিবিম্বিত পুরুষ, যা পুরুষের ছবি  মাত্র, আসল পৌরুষ নয়, এবং যাতে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে অর্থাৎ আমাদের বুদ্ধি, এর  যে সংযোগ একে ঋষি  পতঞ্জলি পরিত্যাগ করতে বলছেন। অর্থাৎ বুদ্ধি ও বুদ্ধিতে প্রতিবিম্বিত পুরুষ এই দুইকে পরিত্যাগ করতে হবে।  কারন, এগুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে আয়না, যাতে প্রতিবিম্বিত হয়, আর আয়নার ভিতরে ছায়া, যা আসল পুরুষ নয়, এই দুইকেই পরিত্যাগ করে, সত্যের পথে সাধককে পরিচালিত করতে চাইছেন ঋষি পতঞ্জলি । অর্থাৎ যথার্থ পুরুষকেই অবলম্বন করতে বলছেন। 

ওম  শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।

------------------------------------------- 

প্রকাশ-ক্রিয়া-স্থিতিশীলং ভূতে-ইন্দ্রিয়াত্মকং ভোগ-অপবর্গ-অর্থং দৃশ্যম। (শ্লোক-১৮) 

প্রকাশ, ক্রিয়া ও স্থিতি নিজ নিজ স্বভাবের কারনে ভূত ও ইন্দ্রিয়ের পরিনাম প্রাপ্ত হয়। আর এই পারিনামত্ব আসলে পুরুষের ভোগ ও অপবর্গের প্রয়োজন সাধন করে।

 

বিশেষ-অবিশেষ-লিঙ্গমাত্র-অলিঙ্গানি গুনপর্বাণি (শ্লোক-১৯)

বিশেষ-অবিশেষ-লিঙ্গমাত্র-অলিঙ্গানি  এগুলো হচ্ছে গুনের অবস্থা ভেদ, গুনের বিভিন্ন পর্ব।  বিশেষ মানে পঞ্চভূতবর্গ ও ইন্দ্রিয়গুলো ; অবিশেষ অর্থাৎ তন্মাত্রা ও অস্মিতা বা অহং ; লিঙ্গমাত্র মহত্তত্ত্ব আর অলিঙ্গ বলতে বোঝায় প্রকৃতি। 

এখানে পুরুষ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, তিনি কোনো তত্ত্ব নন, তাই ত্রিগুণাত্ত্বক নন, তার কোনো পরিনাম নেই। 

দ্রষ্টা দৃশিমাত্রঃ শুদ্ধঽপি প্রত্যয়ানুপশ্যঃ। (শ্লোক-২০)

দ্রষ্টা দৃশি মাত্র। দ্রষ্টা অর্থাৎ পুরুষ।  দৃশি কথাটা অর্থ চৈতন্য, যার দ্বারা দেখার কাজ সম্পন্ন হয়ে থাকে। দ্রষ্টা শুদ্ধ। দ্রষ্টা প্রত্যয়ানুপশ্যঃ।  প্রত্যয় অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তি, যা সাক্ষীভাবে দর্শন করে মাত্র। অর্থাৎ দ্রষ্টাই চৈতন্য, দ্রষ্টা শুদ্ধ, সমস্ত ধর্মাধর্ম্ম রোহিত, বুদ্ধির সম্যক  অনুভবী। 

তদর্থ এব দৃশ্যস্য আত্মা। (শ্লোক ২১) .

তদর্থ ;  তদ + অর্থ  তার অর্থ তার এখানে পুরুষের আর অর্থ হচ্ছে বিষয়। দৃশ্যস্য অর্থাৎ বুদ্ধিরূপ দৃশ্যের, আত্মা আর নিজ স্বরূপ। অর্থাৎ পুরুষের বিষয় হলো দৃশ্যের স্বরূপ। 

কৃতার্থং প্রতি  নষ্টম অপি অনষ্টম তদন্য-সাধারণত্বাৎ।  (শ্লোক - ২২)

কৃতার্থ পুরুষের কাছে নষ্ট হলেও তা অন্য সাধারনের কাছে অনেস্ট অর্থাৎ নষ্ট নয়।

স্ব-স্বামিশক্তোঃ স্বরূপ উপলব্ধি হেতুঃ সংযোগঃ। (শ্লোক-২৩)

সংযোগ হলো স্বশক্তির ও স্বামীশক্তির স্বরূপ উপল্বদ্ধির  হেতু। 

 তস্য হেতুরবিদ্যা (শ্লোক -২৪)

সেই সংযোগের হেতু হলো অবিদ্যা। 

তদ অভাবাৎ  সংযোগ-অভাবো হানং তদ্দৃশ্যেঃ কৈবল্যম্। (শ্লোক ২৫)

অবিদ্যার অভাব থেকে সংযোগ অভাব, তা হলো হান, আর তা হচ্ছে দ্রষ্টার কৈবল্য। 

বিবেক খ্যাতি-অবিপ্লবা হানোপায়ঃ। (শ্লোক-২৬)

ছেদবিহীন বিবেকখ্যাতি হানের উপায়।  হানের অর্থাৎ অবিদ্যা নাসের উপায়।

তস্য সপ্তধা প্রান্তভূমিঃ প্রজ্ঞা (শ্লোক-২৭)

তস্য অর্থাৎ যাঁর বিবেকখ্যাতি জন্মেছে এমন যোগীর সাত প্রকার প্রজ্ঞা জাগে।

 
পতঞ্জলি যোগসাধনা : কৈবল্যপাদ 

বাবা অনেক কিছু জানেন, যা আমি জানিনা।  আমার মা সব কিছু জানেন, কিন্তু আমি জানিনা। আমার মাস্টার মহাশয় শুধু অনেক কিছু জানেন, তিনি অনেক কিছু করতে পারেন, আমি পারি না।  মাস্টার মহাশয় অংক  করতে পারেন, আমি পারি না। গুরুদেব অনেক কিছু জানেন, আমি জানিনা। কেন এমন হয় ? আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগে,  আমি যে বস্তু সম্পর্কে অজ্ঞ থাকি, সেই জ্ঞানের অগোচর বস্তুর গতি কি হয় ? বস্তুর জ্ঞান কি চিত্তের অধীন ? বস্তু কি কোনো নির্দিষ্ট চিত্তের অধীন হয়।  জ্ঞান কি কোনো বিশেষ বিশেষ চিত্তের অধীন ? আমরা এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো।

আপনি হয়তো বলবেন, বাবা-মা আমার থেকে বয়সে অনেক বড়ো।  তারা জীবনে অনেক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে, আজ অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। মাস্টার মহাশয় অনেক বই পড়াশুনা করেছেন, অনেক অঙ্ক শিখেছে, করেছেন, তাই তিনি অনেক কিছু জানেন। গুরুদেব, তার গুরুদেবের কাছ থেকে অনেক কিছু জেনেছেন, শিখেছেন, তাই তিনি অনেক কিছু জানেন। কিন্তু সত্যিই কি তাই ? বয়স তো অনেকের হয়েছে, সবাই কি আমার মা-বাবার মতো ? সব শিক্ষক বা সব ছাত্র কি সমান ? আমার গুরুদেবের মতো গুরুদেব কি আর একজন আছেন ? না নেই, এঁরা সবাই সতন্ত্র, ের সাবি সবার থেকে আলাদা আলাদা। ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, :  

শ্লোক : ১৭ - তদ-উপরাগ-আপেক্ষিতাৎ চিত্তস্য জ্ঞাত-অজ্ঞাতম। 

বিষয় দ্বারা রাঙিয়ে দেওয়ার অপেক্ষায় থাকা বস্তু, চিত্তের জ্ঞাত বা অজ্ঞাত হয়। 

বস্তু যে চিত্তের অধীন হয়, তাহলে চিত্তের অন্যমনস্কতায় বা বৃত্তি শূন্যতায়, বস্তুর স্বরূপ-সম্মন্ধ  বিষয়মুখী না হওয়ায়, বিষয়ীভূত হতে পারে না। ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, বিষয় দ্বারা চিত্ত যখন রঞ্জিত হয়, তখন সেই বস্তুর জ্ঞান জন্মে আমাদের চিত্তে। বিষয় আমাদের আকৃষ্ট করবার জন্য শৃঙ্গার করছে।

 চিত্ত হচ্ছে লৌহ। আর বস্তু হচ্ছে চুম্বক। চিত্তকে বস্তু সবসময় আকৃষ্ট করছে। চিত্তকে বিষয়বস্তু আকৃষ্ট করে তার রঙে  রাঙিয়ে নিচ্ছে। চিত্ত, যখন যে বিষয়ে  উপরঞ্জিত তখন, সে সেই বিষয়ে জ্ঞাত। আর যার আকর্ষণ সে অনুভব করেনি, সেই বিষয়-বস্তু তার কাছে অজ্ঞাত। এই যে বস্তুর জ্ঞান ও অজ্ঞান স্বরূপতঃ চিত্ত সেই পরিনাম প্রাপ্ত হয়। 

আসলে চিত্ত ও বস্তু দুটো আলাদা। কিন্তু দুটোই বস্তু। এখন আমাদের জ্ঞান ইন্দ্রিয়গুলোর সাহায্যে শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ দ্বারা  আমাদের ভিতরে প্রবেশ করছে এবং চিত্তকে আকর্ষণ করছে। আর চিত্ত তখন পরিনাম প্রাপ্ত হয়। পরিনাম প্রাপ্ত চিত্ত বৃত্তিতে বাহ্য  বিষয়ের উৎপন্নে ভোগকার্য্য চলে।  অন্তর্মুখীতায় পরিণামপ্রাপ্ত চিত্ত অন্তর্মুখী হয়।  এই ভাবে চিত্ত পরিনাম প্রাপ্ত হয়ে থাকে। 

এখন কথা হচ্ছে এই অন্তর্মুখীনতা ব্যাপারটা কি। ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, যম-নিয়ম ইত্যাদি অভ্যাসের দ্বারা এবং বৈরাগ্যের দ্বারা চিত্ত তাদের রঙে নিজেকে রাঙিয়ে পুরুষ ও চিত্তের নিজের সঙ্গে পৃথকতার পরিচয় করিয়ে দেওয়াই অন্তর্মুখীনতা। শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ এগুলো আমাদের কাছে কখনো জ্ঞাত কখনো অজ্ঞাত। কিন্তু পুরুষগত চিত্ত সবসময় জ্ঞাত। অপবর্গ লাভ অর্থাৎ জীবাত্মার সঙ্গে পরম-আত্মার যতক্ষন মিলন না হচ্ছে, ততক্ষন চিত্ত পুরুষকে জড়িয়ে রেখে ভ্রান্ত ধর্ণা করিয়ে নিজেও বিষয় উপভোগে পুরুষকে জড়িয়ে ফেলছে। এতে করে চিত্ত যেন পুরুষের বিষয় হয়ে যায়।      

  

        


    

 






   

    .












     

                                                                                   



      

No comments:

Post a Comment