Sunday 6 December 2020

স্থুলদেহ ত্যাগের সময় আমাদের কর্তব্য : প্রার্থনা


 স্থুলদেহ ত্যাগের  সময় আমাদের কর্তব্য : প্রার্থনা  

স্থুল দেহ ত্যাগের একটা  অবধারিত নির্দিষ্ট সময় আছে। সেই সময় উপস্থিত হলে, সকলকেই  চলে যেতে হয়। এখন কথা হচ্ছে, তাহলে কি আমাদের চিকিৎসার কোনো প্রয়োজন নেই ? আছে, চিকিৎসা আমাদের শারীরিক কষ্টের বা ব্যথার উপশম ঘটাতে পারে। কিন্তু মৃত্যুকে ঠেকানো যায় না। দৈব অনুকূল  হলে, চেষ্টার পথ সুগম হবে, অর্থাৎ চিকিৎসার সুযোগ পাবে, চেষ্টা ফলবতীও  হবে।  কিন্তু দৈব প্রতিকূল হলে, সব চেষ্টা বৃথা,  এটা আমরা সবাই বুঝি। আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে মৃত্যুকালে আমাদের কি করা উচিত ? তা সে মৃত্যুপথযাত্রী হোক, বা তার আত্মীয়-স্বজন হোক। 

প্রথমে দেখে নেই মৃত্যু কিভাবে আমাদেরকে  গ্রাস করে। মৃত্যুকালে আমাদের বাকশক্তি মনে লয় প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ তখন আমাদের কথা বলার শক্তি থাকে না। কিন্তু জ্ঞান থাকে, চিন্তা করবার শক্তিও থাকে। এসময়টা আমাদের মুমুর্ষ অবস্থা। এইসময় ছেলে-মেয়ে-আত্মীয়-স্বজনদের আমরা চিনতে পারি, কিন্তু মনের ভাব কথায় প্রকাশ করতে পারি না। এর পরে মন আমাদের প্রাণে লীন হয়।  তখন আমাদের চিন্তাশক্তি হারিয়ে যায়, কিন্তু জ্ঞান থাকে। এর পরে প্রাণশক্তি তেজ শক্তিতে বিলীন হয়। পরে, তেজশক্তি পরাদেবতাতে অর্থাৎ সুক্ষদেহে  লীন হয়।  তখন আমাদের বোধশক্তি লোপ পায়। আর ঠিক তক্ষুনি আমাদের মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।  এবার সুক্ষ দেহ নিয়ে আত্মা অনন্তে যাত্রা করে। "বাঙ্মনসি দর্শনাচ্ছব্দাচ্চ " । জীবাত্মার যা কিছু নিজস্ব অর্থাৎ তার স্বভাব, স্মৃতি, কৃষ্টি, মন সবই তখন সে নিয়ে যায়।  "অথ যদাস্য বাঙ্মেসি সম্পদ্যতে, মনঃ প্রাণে, প্রাণস্তেজসি, তেজঃ পরস্ম্যাং  দেবতায়াম অথ ন জানাতি।" আর সঙ্গে যায় কর্ম্ম। মৃত্যু স্বাভাবিক হোক বা আকস্মিক হোক, মৃত্যুকালে মানুষ পরাবিদ্যার অর্থাৎ উচ্চ জ্ঞানের অধিকারী হয়।   অর্থাৎ সুক্ষজ্ঞান জন্মে। তাই অতীত জীবনের সমস্ত ঘটনা ছবির মতো তার মনে উদ্ভাসিত হতে ওঠে। ছোট বা বড়ো, আনন্দ বা দুঃখ কোনো ঘটনাই বাদ  যায় না। তার প্রেম-ভালোবাসা, হিংসা-দ্বেষ জয়-পরাজয়, কামনা-বাসনা, ব্যর্থতা-সাফল্য সমস্ত কিছুই তার চিত্তপটে উদিত হয়। জীবাত্মা তখন অতীত ও ভবিষ্যৎ জীবনের সম্মুখীন হয়। অতীতের থেকে ভবিষ্যতের বার্তা শুনতে পায়। এইসময় তার স্বরূপ সম্পর্কে উপলব্ধি হয়। স্বল্পক্ষণের জন্য, এই স্বরূপের উপল্বদ্ধির শেষে ইহজগতের সমস্ত বন্ধন  ছিন্ন হয়। ইহজীবনে যাকিছু তার প্রধান চিন্তা ছিল, সেই অনুযায়ী সে তার নিজস্ব জগতে প্রবেশ করে। জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে যে চিন্তা তার মধ্যে জাগ্রত ছিল, সেটি সংস্কাররূপে স্মৃতিপটে উজ্জ্বল চিত্র এঁকে রাখে। প্রশ্ন উপনিষদ বলছে, মৃত্যুকালে জীবের চিত্ত যে বিষয়ে আসক্ত থাকে, জীব সেইমতো চিত্তের সঙ্গে মুখ্যপ্রাণকে প্রাপ্ত হয়। মুখ্য প্রাণ আবার তেজো যুক্ত হয়ে জীবকে জীবাত্মার সাথে অভীষ্ট লোকে নিয়ে যায়। 

মৃত্যু-প্রক্রিয়া আমাদের মতো সাধারণের  স্মৃতিতে থাকে না।  কিন্তু যারা সজ্ঞানে দেহত্যাগ করেন, তাদের মধ্যে এই স্মৃতি জেগে থাকে। 

যাইহোক, যিনি অনন্ত পথের  যাত্রী, তার কিছু শেষ কর্তব্য আছে। আবার যারা তার আত্মীয় স্বজন, অর্থাৎ কোনো ব্যক্তির মরন কালে যারা উপস্থিত আছেন, তাদের কিছু কর্তব্য আছে। 

সাধারণত আমরা দেখে থাকি, মৃত্যুপথযাত্রী যতক্ষন জ্ঞান না হারান, যতক্ষন ইন্দ্রিয়সকল বিকল না হয়, ততক্ষন সাংসারিক বিষয়ে উপদেশ দিয়ে সময় অতিবাহিত করেন। মৃত্যু আসন্ন এই কথা ভেবে, তিনি চোখের জল ফেলেন।  এমনকি বাকশক্তি চলে গেলেও, তার চোখের জলের ধারা অব্যাহত থাকে। আত্মীস্বজন যখন বুঝতে পারেন, তাদের পরম প্রিয়জন স্নেহ-ভালোবাসার বন্ধন  ছিন্ন করে, অজানা দেশে, অজানা পথে পারি দিচ্ছেন, তখন তাদের মন ভারাক্রান্ত হয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দেন। তাদের এই কান্নাকাটি সচেতন মুমূর্ষব্যক্তির হৃদয়ে দারুন চঞ্চলতার সৃষ্টি করে থাকে। এতেকরে, উৎক্রমন উদ্যত আত্মার ভীষণ কষ্ট  ও অকল্যাণ হয়। তাই এই সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকা উচিত। 

যদিও সারাজীবন বিষয়সুখে আবদ্ধ থেকে, সমস্ত ভালো-মন্দ, সমস্ত তত্ত্বকথা শুনেও, ভবিষ্যৎ মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও, আমরা যদি জীবনকে সুপথে চালিত না করতে পেরে থাকি, তবে মরণকালে আমাদের মনের মধ্যে তত্ত্বকথা উদয় হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আর তখন আমাদের কর্ম্ম-সমষ্টি  মিলিত হয়ে  নিয়তি তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে আমাদেরকে নিয়ে যায়। এইজন্য গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, যে জীব মৃত্যুকালে যে ভাব বা যে দেবতাকে স্মরণ করতে করতে দেহ ত্যাগ করে, তিনি সেই ভাব বা সেই দেবতাকে প্রাপ্ত হন।  সুতরাং আজীবন আমরা যে আচরণ করেছি, যে কর্ম্ম করেছি, মুমূর্ষকালে আমাদের সেই ভাবের উদয় হবে, সেটাই স্বাভাবিক। আর এই ভাব তখন নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে, আমাদেরকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। এর কোনো অন্যথা হবে না। 

মুমূর্ষু ব্যক্তির কর্তব্য :

জীবনের এই শুভসময়ে অর্থাৎ আত্মা যখন নিজ ধামে যাবার জন্য উদ্যোগী হয়েছেন, তখন  আমাদের উচিত সংসারের সমস্ত কামনা বাসনা বিসর্জন দিয়ে, মনকে শান্ত করা। মনকে নিজ কৃত ও কর্তব্য বিষয় সম্পর্কে স্মরণে নিযুক্ত  করুন। এইসময় সাংসারিক কোনো বিষয়ে প্রার্থনা করবেন না। আপনার হয়তো মনে হতে পারে, এই আমার স্নেহের ধন - ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী-আত্মীস্বজন, রইলো, এদের জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি।এই যে  বিষয়াশয় রইলো, তার সুরক্ষার জন্য প্রার্থনা করি। হয়তো ভাবছেন, সারা জীবনে যে দুঃখ কষ্ট ভোগ করেছি, মৃত্যুর পরে, যেন আর ভোগ কোরতে  না হয়। জীবনের এই চরম মুহূর্তে এই ধরনের প্রার্থনার কোনো মূল্য নেই। যদিও আমরা মনে করি, এই ধরনের প্রার্থনা আমাদের জীব থাকতেও করা উচিত নয়। আসলে আমাদের যাতে মঙ্গল হয়, তাই প্রার্থনা করতে হয়।  আর কিসে আমাদের মঙ্গল হবে, তাতো আমরা জানি না, তাই ভগবানকে বলতে হয়, হে ভগবান তুমি যা ভালো বোঝো তাই করো, যাতে মঙ্গল হয়, তাই করো। বরং জীবনশেষে যে অগ্নির কাছে, এই দেহ সমর্পিত হবে, সেই অগ্নির কাছে, অগ্নিতে দগ্ধ  হবার আগে, প্রার্থনা করুন, হে অগ্নি, তুমি আমাকে সুপথে নিয়ে চলো। হে অগ্নি  তুমি আমার সমস্ত কর্ম্ম, আমার সমস্ত ভাব জ্ঞাত আছো।  আমাকৃত সেই পাপ, তুমি দগ্ধ করে দাও। আমাকে সুপথে চালিত করো। আমি তোমাকে কোটি কোটি প্রণাম জানাই। এতে করে, মৃত্যু আমাদের অমৃত ফল প্রদান করতে পারে। 

মুমূর্ষু ব্যক্তির জন্য আত্মীস্বজনের কর্তব্য : 

আত্মীয়স্বজন যারা মৃত্যুকালে সামনে উপস্থিত আছেন, তাদের উচিত, কান্নাকাটি না করে, অমৃতপথের যাত্রীর মুখের দিকে দৃষ্টিপাত ক'রে, তার আত্মার কল্যাণ কামনা করা। ধৈর্য্যধরে, সম্মিলিত ভাবে ঐকান্তিক চিত্তে ধ্যানাবিষ্ট হয়ে, ভগবানের নিকট মুমূর্ষু ব্যক্তির জন্য প্রার্থনা করা উচিত। আপনি হয়তো বলবেন, এই পরমশুভ কর্ম্ম এই সময় করা বড্ড কঠিন। অনেকে মনে করেন, এসব না করে, যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত। দেখুন, চিকিৎসার একটা সময়রেখা রেখা আছে, ঔষধের  একটা সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু একটা সময় অবশ্য়ই আসবে, যখন এইসব উদ্যোগ মূল্যহীন হয়ে যাবে। নিয়তি প্রত্যেকের প্রাণবায়ুকে একদিন না একদিন দেহ থেকে ছিন্ন করে দেবে। এই চিরসত্যকে স্বীকার করে, আমাদের উচিত, চিকিৎসার পাশাপাশি প্রার্থনাকে গুরুত্ত্ব দেওয়া। দেখুন, মৃতব্যাক্তির আত্মার অকল্যাণ হোক, এটা আমাদের অভিপ্রেত নয়। আবার প্রার্থনা মৃত শরীরে প্রাণ সঞ্চার করতে সাহায্য করতে পারে, এই অলৌকিক সত্যকেও  মাথায় রাখতে হবে। তো প্রার্থনা আমাদের দ্বিবিধ কাজ করতে পারে।  এক অসুস্থ দেহে প্রাণের গতি বেড়ে যেতে পারে, আবার যদি দেহ থেকে প্রাণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তবে উদ্গমনশীল আত্মা শান্তিতে পরলোকের পথে গমন করতে পারবে। তো আত্মার শান্তির জন্য যেমন প্রার্থনার গুরুত্ত্ব  তেমনি মুমূর্ষু ব্যক্তির দেহে প্রাণের  সঞ্চার করতে প্রার্থনা গুরুত্ত্বপূর্ন। তাই প্রার্থনার উপকারিতা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।

 এই প্রার্থনা পরলোকবাসীদের আমন্ত্রণ জানাতে সাহায্য করে থাকে। আমরা জানি, মৃত ব্যক্তির আত্মাকে নতুন জগতে আমন্ত্রণ করবার জন্য, প্ৰলোকবাসী আত্মাগণ  সাহায্য করে থাকেন। নতুন জগৎ সম্পর্কে তাকে জ্ঞাত করান।  এতে করে নতুন আগত আত্মা নতুন জগতে স্বল্পসময়ের মধ্যে ধাতস্থ হতে পারেন। তো আপনারা যখন ঐকান্তিকভাবে প্রার্থনায় নিযুক্ত হবেন , তখন মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন, বা পিতৃ-মাতৃ পুরুষ  যাঁরা  আগেই দেহ ছেড়ে চলে গেছেন, তাঁরা সত্ত্বর, এই সদ্য দেহচ্ছিন্ন আত্মাকে সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে আসবেন। এটি একমাত্র প্রার্থনার সাহায্যেই হতে পারে। অন্য কোনো পথ নেই।

প্রার্থনা মন্ত্র। উচ্চস্বরে  এই প্রার্থনা মন্ত্র পাঠ  করুন। 
প্রভু পরমেশ করুন কল্যাণ অমঙ্গলরাশি করিয়া দূর, 
চিরদিন তরে করুন বিধান, আনন্দ নির্ম্মল অতি প্রচুর। 
পরম নির্ব্বাণ শান্তি সুখময় ব্রহ্মে বাস যেন বিহিত হয়, 
তৃপ্তি চিরন্তনী পরাপ্রীতি যেন চিরদিন ধরি তোমায় রয়। 
বিভু-কৃপাবারি বরষে তোমার পাপ তাপ যত  অনল-সম, 
চিরকাল তরে হোক প্রশমিত, ইহাই মঙ্গল প্রার্থনা।
 - শ্রী ক্ষিতিনাথ ঘোষ প্রণীত  
ঈশো দিশতু কল্যানং সর্ব্ব অশুভ নিবর্তকম।
নির্মল আনন্দ সন্দোহং শাশ্বতং তে প্রযচ্ছতু। ।

হে ঈশ্বর, সমস্ত অশুভকে দূর করে,  কল্যাণ  করুন। শাশ্বত নির্মল আনন্দ যথেষ্ট পরিমানে প্রদান করুন।

শান্তি নির্বাণ-পরমা ব্রহ্ম সংস্থা সদা অস্তু তে।
ভূয়াৎ চিরন্তনী তৃপ্তিঃ প্রীতির ঐকান্তিকী পরা। ।

পরম-নির্বাণ শান্তি স্বরূপ ব্রহ্মে স্থিতি যেন বিধেয় হয়।  তৃপ্তি ও প্রীতি যেন চিরস্থায়ী হয় ও ঐকান্তিক হয় ।

সৎ কৃপাবারি বর্ষৈস্তে ত্রিতাপানল সঞ্চয়াঃ।
চিরায় প্রশমং যান্তু-মাঙ্গল্যম ঈদম অর্থয়ে। ।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি  ওঁং

ত্রিতাপ জ্বালা নিবারণের জন্য তোমার সৎ কৃপাবারি সদাই বর্ষাতে  থাকুক। অমঙ্গল প্রশমিত হোক চিরতরে। এই আমাদের প্রার্থনা। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 



 





 

















    

No comments:

Post a Comment