Monday 2 November 2020

ধ্যান ও তার ফল - শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ


 ধ্যান ও তার ফল  - শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ 

 একসময় কিছু ব্রহ্ম জিজ্ঞাসু এক জায়গায় মিলিত হয়েছেন। তো কথায় কথায়, তাদের মধ্যে জিজ্ঞাসা উঠলো, এই জগতের কারন কি ব্রহ্ম ? জগতের মধ্যে বিচরণকারী এই যে আমরা - আমরা কোথা থেকে এসেছি ? আমাদেরকে কে লালন পালন করছে ? মৃত্যুর পরে আমরা কোথায় চলে যাবো ? কোন আইনে আমরা সুখ দুঃখ ভোগ করে থাকি ?

ঋষি শ্বেতাশ্বতর বলছেন, এসব বুঝতে গেলে, গভীর ধ্যানে মগ্ন হতে হবে, তখন জানা যাবে জ্যোতির্ময় পরমাত্মার শক্তিই এই জগতের কারন। মায়া তার তিন গুনের সাহায্যে অর্থাৎ সত্ত্ব-রজঃ-তম গুনের সাহায্যে সেই পরমাত্মাকে এই বিশ্বের কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছেন। সেই এক এবং অদ্বিতীয় পরমাত্মা সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, এমনকি জীবাত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করছেন।
এখন কথা হচ্ছে গভীর ধ্যান মানে কি ? ধ্যান অর্থ গভীর অনুসন্ধানী মন। ভদ্রলোক চায়ের দোকানে চা পান করবার জন্য বেঞ্চে বসে আছে, উনুনে কেটলিতে জল ফুটছে। ভদ্রলোক মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। নিজের মধ্যে প্রশ্নের পর প্রশ্ন জেগে উঠছে। হঠাৎ তার মধ্যে স্বজ্ঞা জাগ্রত হলো, আবিষ্কার হলো বাষ্প চালিত রেলগাড়ী। মনের মধ্যে হঠাৎ একটা আলোর ঝলকানি। বহুদিনের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয় এই স্বজ্ঞা। ধ্যান হচ্ছে সেই প্রক্রিয়া যার সাহায্যে স্বজ্ঞা জাগ্রত হয়। আর সব বহুদিনের সঞ্চিত প্রশ্নের জবাব এক ঝলকেই মিলতে পারে। তাই ঋষি শ্বেতাশ্বতর বলছেন, গভীর ধ্যান করো।

এখন কথা হচ্ছে এই জগতের কারন কি ? কিভাবে কথা থেকে উৎপত্তি হলো এই জগতের ? কেউ বলে থাকেন, কালের নিয়মে এই জগৎ সৃষ্টি হয়েছে, আবার কালের প্রভাবে এই জগতের বিলোপ ঘটবে। কেউ বলে থাকেন বস্তুর স্বভাবের মধ্যেই আছে জগৎ সৃষ্টির কারন ও তার কার্য্য। কেউ বলেন, জগতের সৃষ্টি একটা আকস্মিক ঘটনা। এর কোনো কার্য কারন নেই। কেউ বলেন, পঞ্চভূতই এই জগৎ সৃষ্টির কারন, অর্থাৎ ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোম এগুলোর সমন্নয়ে গঠিত হয়েছে জগৎ। আবার কেউ বলছেন, এগুলোর কোন একটি বা এগুলো সমষ্টিগত ভাবেও জগৎ সৃষ্টির করেন হতে পারে না। কারন এগুলোকে অর্থাৎ পঞ্চভূতকে একত্রিত করতে পারে জীবাত্মা। কিন্তু জীবাত্মা আবার কর্ম্মফলের অধীন। অতএব জীবাত্মা স্বাধীন নয়, জীবাত্মা নিজের প্রভু নয়।

ঋষিগণ ধ্যানমগ্ন হলেন। এবং দেখলেন, জ্যোতির্ময় পরমাত্মার শক্তিই এই জগতের কারন। মায়া তার তিনটি গুনের সাহায্যে তাকে আড়াল করে রেখেছে। এই পরমাত্মাই সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছেন।

ঋষি শ্বেতাশ্বতর  বলছেন, ধ্যানে প্রবেশ করতে গেলে, চুপ-চাপ একাসনে বসে থাকলেই ধ্যান হয় না। আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করতে গেলে, প্রথমে প্রার্থনা দিয়ে শুরু করতে হবে। তো কার কাছে প্রার্থনা করবো ? কিসের জন্য প্রার্থনা করবো ? ঋষি বলছেন,  পরমাত্মার কাছে প্রার্থনা করতে হবে ।  কিন্তু পরমাত্মা সম্পর্কে আমরা কোনো ধারণা  করতে পারি না। তাই ঋষি বলছেন, সূর্য বা সবিতার কাছে  প্রার্থনা করতে হবে। আর আমাদের মন-বুদ্ধিকে উপযুক্ত করে তুলবার জন্য প্রার্থনা  করতে হবে। ।  প্রথম কথা হচ্ছে, সূর্য আমাদের দৃষ্টিগোচর বস্তুর মধ্যে বিরাট-বিশাল। সূর্য্যের শক্তি সম্পর্কে আমাদের একটা ধারণাও  আছে। সূর্যই, এই পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির  কারন, প্রাণ রক্ষার কারন, এমনকি সূর্যই আমাদের লালন পালন করছে। তো সূর্য আমাদের দৃষ্টিগোচর জগৎ পদার্থের মধ্যে বিশ্বস্রষ্টার শক্তিশালী প্রতিনিধি।  এছাড়া জাগতিক বস্তুই আমাদের আকর্ষণের বিষয়। এই জগৎই আমাদের মনকে টেনে রেখেছে। তাই আমরা সূর্যকে কেন্দ্র করে পরমাত্মার কাছে প্রার্থনা করতে পারি। 
"হে জ্যোতিস্বরূপ সূর্য আমার মন-বুদ্ধিকে পরমাত্মা অভিমুখী করে তোলো। হে অগ্নির প্রকাশশক্তি আমার ইন্দ্রিয়গুলোকে প্রজ্বল করে তোলো। হে অগ্নের-জ্যোতি  আমার স্থূল দেহ যেন পরমাত্মার উপল্বদ্ধির যোগ্য হয়ে উঠতে পারে। আমি জগতের উৎস ব্রহ্মের উপলব্ধি করতে চাই। দয়া করে, তুমি আমার মন বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়গুলোকে ব্রহ্মের সাথে যুক্ত করো। " 

আমাদের পরিচিত সাবিত্রী বা গায়ত্রী মন্ত্রেও  এই একই প্রার্থনার কথা বলা আছে।  
ওঁং ভূর্ভুবঃ স্বঃ। তৎসবিতুর্বরেন্যং।
ভর্গো দেবস্য ধীমহি। ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ ওঁং।
হে (ভূঃ-ভূবঃ-স্বঃ) ত্রিলোকেশ্বর ! সবিতাদেবের পরব্রহ্মাত্মক সেই বরণীয় তেজকে আমরা ধ্যান করি। সেই সবিতা আমাদের বুদ্ধি-বৃত্তিকে প্রেরিত করুন।

ঋষি বলছেন, সমাধি লাভ করতে হলে, যোগীকে মাথা-ঘাড়-বুক শরীরের এই তিনটি অংশকে সমান্তরাল রেখে বসতে হবে। এর পর মনের সাহায্যে ইন্দ্রিয়গুলোকে ধরে এনে প্রণব বা ওম নৌকায় বা ভেলায় বসাতে হবে। এখন কথা হচ্ছে ধ্যান, আমরা যতদূর জানি মনের ব্যাপার। তো দেহ কি অবস্থায় থাকলো, তাতে কি এসে যায় ? ঠিকই বলেছেন, ধ্যান দেহের কাজ নয়, ধ্যান মনের ক্রিয়া। আসলে ঋষিগণ অভিজ্ঞতায় বুঝেছেন, মাথা-ঘাড় ও বুক সরলরেখায় রাখলে মন একাগ্র হয়। আর এই মনের একাগ্রতা ধ্যানের জন্য খুব প্রয়োজন। আমাদের গীতাতেও একই নির্দেশ আছে। সমং কায়-শিরো-গ্রীবং ধারয়ন্নচলং স্থিরঃ (৬/১৩) অর্থাৎ মাথা ঘাড় বুক ঋজু ও সমুন্নত থাকলে শরীর অচঞ্চল হয়। যদিও যোগে অভ্যস্থ ব্যক্তির জন্য, এর কোনো প্রয়োজন নেই, তারা সর্বদা যোগনিষ্ঠ।
যাই হোক, এই অবস্থায়, সংপ্রেক্ষ্য নাসিকাগ্রং স্বম। নাসিকাগ্রে মনকে স্থির করতে হবে। অর্থাৎ প্রাণবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ক্লান্তি বোধ না হাওয়া পর্যন্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন না, আবার যতক্ষন সম্ভব শ্বাসকে বাইরে রাখবার অভ্যাস করতে হবে। দৃষ্টি থাকবে নাকের অগ্রভাগে।

এখানে গীতার আর একটা কথা স্মরণে রাখতে হবে, যে যোগীকে মিতাহারী হতে হবে। অর্থাৎখাবার বেশিও গ্রহণ করা চলবে না, আবার উপোষ থাকলে চলবে না। নিদ্রার ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত ঘুম বা একেবারে না ঘুমোনো চলবে না। অর্থাৎ আপনাকে সংযত থাকতে হবে, মধ্যাবস্থা অবলম্বন করতে হবে। । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, মনকে বসে আনা আর বাতাসকে নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ, কিন্তু এই অসাধ্য কাজটি করতে পারে আমাদের সংযম, অভ্যাস । তাই যোগীকে অবশ্যই সংযমী হতে হবে। নিরন্তর অভ্যাস চালিয়ে যেতে হবে। মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্য, রেচক-পূরক-কুম্ভক-এর সাহায্য নিতে হবে। শ্বাস ত্যাগ প্রলয়ের প্রতীক, শ্বাস গ্রহণ সৃষ্টির প্রতীক ও কুম্ভক স্থিতির প্রতীক।

এবার কোথায় বসে আমরা ধ্যান করবো ? ঋষি শ্বেতাশ্বতর বলছেন, সমান স্থান, শুদ্ধ স্থান, যেখানে নুড়ি-পাথর-আগুন-বালি থাকবে না, কোলাহল মুক্ত হবে, জলাশয়ের কাছে হবে না। স্থানটি হবে মনোরম নয়ন-সুখকর। বাতাস যেখানে শান্ত অর্থাৎ গুহা বা ওই জাতীয় কিছু হলে ভালো হয়।

এখন কথা হচ্ছে, আপনি তো ধ্যানে বসলেন, কিন্তু আপনার কোনো উন্নতি হচ্ছে কি না, সেটা আপনি কিভাবে বুঝবেন ? ঋষি শ্বেতাশ্বতর বলছেন, ব্রহ্মজ্ঞান উপল্বদ্ধির আগে, যোগী তুষার, ধোয়া, সূর্য, বাতাস, আগুন, জোনাকি, স্ফাটিক, চাঁদ ইত্যাদি দেখতে পান। এগুলো সবই ব্রহ্মজ্ঞানের পূর্বাভাস। এই লক্ষণগুলো শারীরিক নয়, মানসিক। সাধক মনের গভীরে এগুলো প্রতক্ষ্য করে থাকেন। এইসব দর্শন থেকেই বোঝা যায়, ব্রহ্ম ক্রমশ তার অন্তরে উন্মোচিত হতে চলেছে।

আমরা যখন কোনো বস্তুর বা মানুষের প্রতি গভীর ভাবে আকৃষ্ট হই, বা মনোযোগ দেই, তখন সেই বস্তুর বা মানুষের গুণগুলো আমাদের কাছে স্পষ্ট হতে থাকে। আমরা জানি, জগতের সমস্ত কিছু পঞ্চভূতের সমষ্টি। পঞ্চভূতের পাঁচটি গুন্ আছে, অর্থাৎ শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ। এই গুনগুলোর সঙ্গে তখন যোগীর যোগাযোগ ঘটবে। এমনকি নিজের মধ্যে যে সূক্ষ্ম গুন্ আছে, তার সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হতে থাকে। আর এই জ্ঞান তখন যোগীর দেহের মধ্যে স্পষ্ট হতে থাকে। এতে করে যোগীর দেহের মধ্যেও রূপান্তর ঘটতে থাকে। দেহ তখন শুদ্ধ হতে থাকে। ইচ্ছাশক্তি বৃদ্ধি হতে থাকে। আর যোগীর ইচ্ছাশক্তি যখন ক্রিয়াশক্তিতে পরিণত হয়, তখন তার মৃত্যুও তারই ইচ্ছামতো হয়ে থাকে।

ঋষি শ্বেতাশ্বতর বলছেন, শরীর তখন হালকা হয়ে যায়, গড়ন হয় ছিপছিপে। মনে আসে অনাসক্তি। গায়ের রঙ হয় উজ্জ্বল, কন্ঠস্বর হয় মধুর। দেহে একটা সুগন্ধ পাওয়া যায়, এমনকি মলমূত্রের পরিমান যায় কমে। এগুলো যোগের প্রাপ্তি। কিন্তু স্বামী লোকেশ্বরানন্দ বলছেন, এই লক্ষণগুলো সবসময় দেখা যাবে, তার কোনো মানে নেই।

কিন্তু এই যে পরিবর্তন, এগুলো কি ভাবে হতে পারে ? ঋষি বলছেন, ধুলোমাখা একতাল সোনা যেমন ধুলে তার স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য ফিরে আসে, তেমনি কেউ যদি নিজেকে আত্মা বলে উপলব্ধি করতে পারে, অর্থাৎ আত্মার উপরে যে ধুলো-ময়লা স্বরূপ অহং-এর আভরণ আছে, তা মুছে ফেলতে পারে, আবার নিজের আত্মাকে সকলের আত্মা বলে উপলব্ধি করতে পারে, তখন এই রূপান্তর সম্ভব হতে পারে। যোগী তখন নিজেকে ব্রহ্মজ্যোতি স্বরূপ স্পষ্ট অনুভব করেন।

পরমাত্মা পরমেশ্বর সর্বত্র বিরাজ করছেন। তিনি জ্যোতিরূপে প্রথম প্রকাশিত হন। তিনিই মাতৃগর্ভে ভ্রূণ রূপে আসেন, ভবিষ্যতে শিশু হয়ে জন্মান। তিনি সমস্ত দেহের সমষ্টি। তিনি সমস্ত সত্তায় বিরাজ করছেন। সেই জ্যোতির্ময় পরমাত্মা আছেন অগ্নিতে, আছেন জলে, আছেন ঔষধি রূপে, জলচর রূপে, স্থলচর রূপে, উভচর রূপে। এই সত্য আমাদের কাছে শোনা কথা, কিন্তু ধ্যানযোগীর কাছে তখন এগুলো প্রতক্ষ্য সত্য হয়ে দেখা দেয়।
সেই পরমাত্মাকে আমরা নমস্কার করি।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।

ধ্যানের মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা।
গবান বুদ্ধ আত্মা সম্পর্কে নীরব, কিন্তু মানুষের দুঃখ সম্পর্কে সরব। তো ভগবান বুদ্ধের এক শিষ্য তাকে প্রশ্ন করেছিলেন। বলছেন আমরা তো আপনার সমস্ত উপদেশ শুনি, সেই অনুযায়ী কার্য্য করে থাকি। কিন্তু আমাদের দুঃখ গেলো কি ? আমরা জরা ব্যাধি মৃত্যু থেকে তো রেহাই পাইনি।

আচার্য্যদেব বললেন, মানুষের জীবনে দুঃখের তীর আসে দুই দিক থেকে। একটা বাইরে থেকে আর একটা আসে ভিতর থেকে। বাইরের তীর থেকে রক্ষা পাবার জন্য, মানুষ অনেক প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পরে। কিন্তু ভিতরের তীর মানুষকে বিদ্ধ করলে, তার কোনো প্রতিষেধক পাওয়া যায় না। মহাপুরুষগন এই ভিতরের তীর থেকে মানুষকে রক্ষা করে থাকেন। দেখো আমরা কেউ প্রকৃতির নিয়ন্ত্রক নোই। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা আসবে। জীবের জন্ম-মৃত্যু আমরা প্রতিরোধ করতে পারি না। তবে কি জান, প্রত্যেকটি ঘটনার একটা প্রতিক্রিয়া আছে। এই প্রতিক্রিয়াই আমাদের সুখ-দুঃখের কারন । সন্তানের জন্ম হলে, মানুষ আনন্দ পায়। আবার মৃত্যু হলে সে শোকাচ্ছন্ন হয়। এই সুখ-দুঃখের কারন হচ্ছে সম্পর্ক। আবার নির্ভরতা মানুষকে যেমন স্বস্তি দিতে পারে, তেমনি বিচ্ছেদ মানুষকে অসহায় করে তুলতে পারে। তুমি কেমন থাকবে সেটা নির্ভর করবে তোমার অবস্থানের উপরে। তুমি যদি নিজেকে দাহ্য পদার্থ অর্থাৎ পেট্রল বা কেরোসিন করে রাখো, তবে সামান্য জ্বলন্ত দেশলাইকাঠি তোমারকে জ্বালিয়ে পুড়িযে শেষ করে দেবে। আর তুমি যদি নিজেকে জলের পাত্র করতে পারো, তবে দেশলাই কাঠি তোমাতেই নিঃশেষিত হয়ে যাবে। অর্থাৎ তোমার অবস্থান, তোমার উপরে ঘটনার প্রতিক্রিয়া বা প্রভাব তোমাকে সুখ দুঃখের অনুভূতি এনে দেবে। তাই প্রতিক্রিয়ার কৌশল আয়ত্ত্ব বা প্রতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করবার শিক্ষাই মহাপুরুষগন দিয়ে থাকেন। প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করবার শিক্ষা নয়, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবার শিক্ষা । আর এটি করবার কৌশলই হচ্ছে ধ্যান।
মহাত্মাগণ বলে গেছেন, সত্যকে জানতে গেলে ধ্যান করো। শান্তিতে থাকতে গেলে ধ্যান করো। ধ্যান করলে শারীরিক ছোটোখাটো ব্যামো ভালো হয়। ধ্যান করলে মনের অসুখ ভালো হয়। কিন্তু কিভাবেই বা ধ্যান আমাদের শরীরে বা মনে কাজ করে সেসম্পর্কে আমরা বিশেষ কিছু জানি না। আজ আমরা সেই সম্পর্কে শুনবো।
ধ্যানের এই বৈজ্ঞানিক ক্রিয়া বুঝতে গেলে আমাদের ধ্যানের প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটা ধারণা থাকতে হবে। দেখুন যোগের যেমন হাজার এক প্রক্রিয়া আছে, তেমনি ধ্যানের গতিপথ ও চলার ছন্দ প্রত্যেকটি মানুষের ক্ষেত্রেই আলাদা আলাদা। তাই এই ব্যাপারে একটা একক সিদ্ধান্তে আসা খুব মুশকিল। ধ্যান আসলে মনের সাহায্যেই প্রাথমিক ভাবে শুরু করতে হয়। আবার মন যেহেতু শরীরের একটা সূক্ষ্ম পদার্থ বা আমাদের স্নায়ুর ক্রিয়া মাত্র তাই আমাদের স্থূল শরীরেও একটা ধ্যানের প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে।

আমরা আমাদের তিনটি অবস্থার সঙ্গে বেশ পরিচিত। সেগুলো হচ্ছে জাগ্রত, স্বপ্ন, ও সুষুপ্তি। মন এই তিন অবস্থায় তিন রকম কাজ করে থাকে।

আবার জাগ্রত অবস্থায় আমাদের মন একই রকম থাকে না। কখনো স্থির,কখনো চঞ্চল, কখনো ম্রিয়মান কখনো উৎফুল্ল। মন আপন খেয়ালে কাজ করে। ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যখন আমরা বিষয়ের সংস্পর্শে আসি, তখন মন কর্ম্ম চঞ্চল থাকে। এই-সময় আমাদের বিবেক বিবেচনা কাজ করে না। যেমন একজন শিশু, বা নির্বোধ ব্যক্তি করে থাকে।
আবার এমন অনেক সময় আসে, যখন মন আমাদের কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। মনের এই অবস্থাকে বলা হয়ে থাকে হতবুদ্ধি অবস্থা মুঢ় অবস্থা। এটি আমাদের সাময়িক ভাবে হতে পারে, আবার শারীরিকভাবে দুর্বল মুহূর্তে হতে পারে, বা এটা মানসিক দুর্বলতার লক্ষণ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
আসলে আমাদের মতো সাধারনের মানুষের মনে সব সময় দুটি ভিন্ন চিন্তার উদয় হয়, ভালো কি মন্দ, উচিত কি অনুচিত, ধরবো কি ছাড়বো অর্থাৎ, দুটি বিপরীত সংস্কারের উদয় হয়। আবার আমরা যখন কোনো বিশেষ একটি বিষয়ে একাগ্র হই তখন আমাদের মন শান্ত প্রকৃতির হয়ে যায়। এই শান্ত অবস্থা বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে থাকে। বৈজ্ঞানিক, শিল্পী, কবি, দার্শনিকগন মনের এই অবস্থার সাক্ষী।
এই একাগ্র অবস্থা বিষয়কেন্দ্রিক না হয়ে যদি শূন্য বা বিন্দুর মতো বিষয়-রোহিত হয় তখন মন আরো স্থির হতে পারে। যোগের দৃষ্টিতে মনের আরো একটি অবস্থা আছে, যাকে বলা হয়, নিরুদ্ধ অবস্থা। এই অবস্থায়, মনের মধ্যে কোনো বিষয় যেমন থাকে না, তেমনি কোনো চিন্তাও থাকে না। এই চিন্তাহীন মনের অবস্থা একে বলে নিরুদ্ধ অবস্থা। এইসময় মন চেতনাতে স্থিত থাকে।

আমরা ধ্যানে যেটা করি, সেটা হচ্ছে মনের এই শেষ অবস্থা। কিন্তু এই শেষ অবস্থায় অর্থাৎ মনকে নিরুদ্ধ অবস্থায় আনতে গেলে, প্রথমে মনকে একাগ্র করতে হয়। অর্থাৎ প্রথমে যেকোনো একটি বিষয়ে আমাদের মনকে একাগ্র করে থাকি।

এখন কথা হচ্ছে, মনকে যখন আপনি একাগ্র করতে যাবেন, বা একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে নিবদ্ধ করতে যাবেন, তখন আপনার মধ্যে নানান রকম প্রশ্ন উঠতে থাকবে। অর্থাৎ এটা করে কি হবে। অহেতুক সময় নষ্ট করছো। তার চেয়ে চলো একটু বেরিয়ে আসি। বা এসব করে কিছু হবে না , তার চেয়ে কিছু অর্থকরী কাজ করো। বেঁচে থাকতে গেলে, বসে থেকে ধ্যান করলে কিছু হবেনা । এতে দুঃখ বাড়বে বৈ কমবে না। সংসারে থাকতে গেলে, তোমাকে এইভাবে সময় নষ্ট করা ঠিক নয়। ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ মনের মধ্যে নানান রকম প্রশ্ন উঠতে থাকবে। এই যে প্রশ্ন - এগুলো বিশ্লেষণ করলে বুঝতে পারবেন, এগুলো আসলে আপনার পূর্বার্জিত সংস্কার। ধ্যানময় জীবন শুরুর আগে যে কর্ম্মময় জীবন আপনি অতিবাহিত করেছেন, সেই অভিজ্ঞতা আপনার স্মৃতিতে জমা হয়ে আছে। কিন্তু ধ্যান-জনিত কোনো সংস্কার বা অভিজ্ঞতা আপনার মধ্যে আগে থেকে সঞ্চিত নেই। তাই এই সব পুরোনো সংস্কার আপনার এই ধ্যানের কাজে বাধা স্বরূপ হয়ে দাঁড়াবে।

এইসময় সাধক যেটা করে থাকেন,সেটা হচ্ছে ইচ্ছেশক্তির সাহায্যে পুরোনো সংস্কারকে দূরে সরিয়ে রেখে নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়া। এইসময় সাধক নিজেকে চিনতে পারেন। অর্থাৎ তার পূর্ব পূর্ব সংস্কারকে তিনি এইসময় সাক্ষাৎ করে থাকেন। এখন ইচ্ছেশক্তির প্রাবল্য যত বাড়বে, তত আপনি পুরোনো সংস্কারকে পিছনে ফেলে দিয়ে এগিয়ে যেতে পারবেন। আর এটি তখনই সম্ভব হয়, যখন আপনার মধ্যে সত্যকে জানবার জন্য আকুলতা-ব্যাকুলতা একটা ঝড়ের আকার নেবে।

যখন আপনার ইচ্ছে শক্তি মনের উপরে প্রভুত্ত্ব বিস্তার করতে পারবে, তত সাধক ধ্যানের পথে অগ্রসর হতে পারবে। আসলে এই সংস্কারগুলো আমাদের মনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। এখন থেকে মন কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারে না। কিন্তু ইচ্ছেশক্তির ধারালো অস্ত্র দিয়ে, এই বাঁধনগুলোকে কেটে স্বচ্ছ মনকে সত্যের সন্ধানী করে তুলতে হবে। এটাই ধ্যানের কাজ।

এখন কথা হচ্ছে, মন এখান থেকে বেরুবে কি করে ? দেখুন আমাদের মন কাজ করে আমাদের পুরোনো সংস্কার ও আবেগের দ্বারা তাড়িত হয়ে। এর জন্যই আমরা লক্ষ করেছি, অধিকাংশ মানুষই একটা যান্ত্রিক স্বভাবের দাস। এমনকি সে তার জীবনের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে থাকে তার পুরোনো সংস্কারের দ্বারা।

আমরা আমাদের মনের চিন্তাকে না পারি নিয়ন্ত্রণ করতে, না পারি চিন্তাকে রোধ করতে। ফলে হয় কি, আমরা সবসময় কোনো না কোনো চিন্তার মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে থাকি। একাগ্রতা বা এক বিষয়ে মনকে নিবদ্ধ করতে পারলে, আমরা মনের চিন্তাকে একমুখী করে তুলতে পারি। তখন চিন্তার যে এলোমেলো স্রোত সেটা একমুখী হয়ে যেতে পারে। এইজন্য সাধককে প্রথমে ধারণা বা ইষ্টচিন্তা করতে বলা হয়।

চিন্তা হচ্ছে স্নায়ুর ক্রিয়া মাত্র, যাকে আমরা মনের কাজ বলে থাকি। আর সংস্কার হচ্ছে, আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা যা আমাদের স্মৃতিতে ধরা আছে। অর্থাৎ আমাদের কারন শরীরে যে স্মৃতিভান্ডার জন্ম-জন্মান্তর থেকে সংরক্ষিত আছে, তাকেই বলে সংস্কার। এই কারন শরীরের অনুভূতি আমাদের নেই। আসলে আমাদের সব অনুভূতিই দুর্বল প্রকৃতির। আমাদের চোখ বেঁধে দিলে, আমরা আমাদের নিজেদের স্থূল শরীরের সঠিক অবস্থান সম্পর্কে বিস্মৃত হই। তো কারন শরীরের কথা তো দূর অস্ত।

যাইহোক, ধারণা বা ইষ্টচিন্তা আমাদের মনকে শান্ত করতে পারে। যেকোনো জিনিষকে আপনি ভালো করে একাগ্র চিত্তে লক্ষ্য করুন, দেখবেন আপনার মন শান্ত হতে থাকবে। এমনকি আপনার যে সব গুন্ বা দোষ আছে, সেগুলোর দিকেও যদি আপনি খেয়াল করতে থাকেন, তবে দেখবেন, আপনার সেই গুন্ বা দোষ স্থির হয়ে যাবে। প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে যাবে। আর তখন আপনার এই দোষ বা গুনের প্রতি নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বাড়তে থাকবে। তাই ধ্যান হচ্ছে, মনকে শান্ত করবার একটি অনন্য উপায়। মনকে নিয়ন্ত্রণ করবার উপায়ও বটে।

আমাদের সঞ্চিত সংস্কারের সঙ্গে প্রথম দিকে ইচ্ছেশক্তি প্রভাব ফেলতে পারে না। কিন্তু নিরন্তর ধ্যানের অভ্যাসের ফলে, আমাদের ইচ্ছেশক্তির ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। পুরোনো সংস্কারের বিলোপ না হলেও, নতুন-নতুন অভিজ্ঞতা বা সংস্কারের জন্ম হবার ফলে, পুরোনো সংস্কার বা বৃত্তি ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যায়। অর্থাৎ পুরোনো সংস্কারের শক্তিক্ষয় হতে থাকে।

আমাদের প্রতিটি কাজের উৎস হচ্ছে মন। আর মনের গতিবিধি নির্দিষ্ট হয় তার পুরোনো সংস্কার থেকে। মনের কাজ হচ্ছে চিন্তা। আর চিন্তা পুষ্টিলাভ করে আমাদের কামনা-সংকল্প থেকে। শরীর অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গুলো থেকে কামনার উদ্রেগ হয়, তবে সেই সংস্কার শরীর ও ইন্দ্রিয়কে ঘিরেই প্রকাশিত হবার চেষ্টা করে থাকে। সুতরাং আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমাদের কি ধরনের চিন্তার উদ্ভব হচ্ছে, সেগুলোর দিকে খেয়াল রাখা দরকার। মনকে পবিত্র চিন্তা দিয়ে ভরিয়ে দিতে হবে। মনের মধ্যে পবিত্র চিন্তার সঙ্গে আমাদের শারীরিক পবিত্রতার সম্পর্ক আছে। তার আমাদের শরীরকেও পবিত্র রাখতে হবে। আর এতে করে, আমাদের জীবনের চিন্তাধারা বদলে যাবে। আর আমাদের চিন্তাধারার বদল হলে, আমাদের জীবনধারা বদলে যাবে।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।


-------------------




No comments:

Post a Comment