Saturday 25 May 2019

"হিন্দু" শব্দের অর্থ কী ?

"হিন্দু" শব্দের অর্থ কী ?

আমার এক অহিন্দু বন্ধু আমাকে বলেছিলো, মুসলমানরা নাকি "হিন্দু" শব্দের অর্থে কাফের অর্থাৎ বিধর্মী, বর্বর, দুরাচারী  বোঝে।  ইংরেজরা নাকি একই ভাবে  HEATHEN বা BLACK NATIVE বোঝে যার অর্থ হলো  প্রধান বিশ্ব-ধর্মগুলোর ( যেমন : ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমান ) বাইরে যাদের অবস্থান, বিধর্মী, পৌত্তলিক, ম্লেচ্ছ, বর্ব্বর, দুরাচারী  । আবার ইংরেজরা এদের BLACK NATIVE  বা কালো আদিবাসী বলে অভিহিত করে। 

আমার ধারণা ছিল সিন্ধু কথাটা থেকে হিন্দু কথাটা এসেছে। সিন্ধু একটা নদীর নাম, তো সেই নদীর তীরে যারা বসবাস করতেন, তাদেরকে হিন্দু বলা হয়। সিন্ধু তো একটা নদীর  নাম, তাহলে সিন্ধু থেকে যদি হিন্দু শব্দ এসে থাকে, তবে হিন্দু এদের ধর্ম নয়। তার কারন, সিন্ধু নদের তীরে, যারা বসবাস করতেন, তাদের সবার ধর্ম একই নাও হতে পারে। আবার জায়গার নামে সেখানকার বসবাসকারী দের ডাকা যেতে পারে, যেমন, বাংলাদেশি, ভারতবাসী, ইংল্যান্ডবাসী, ইত্যাদি। .... কিন্তু তাদের সবার তথাকথিত ধর্ম আলাদা হতে পারে। 

আমাদের সেই বন্ধুটি আরো বলেছিলো, প্রত্যেক  ধর্মের একজন প্রচারক আছেন , হিন্দু ধর্মের কোনো নির্দিষ্ট  প্রচারক নেই। তাহলে এর প্রতিষ্ঠাতা কে ? এই ধর্মের কোনো ধর্মগুরু নেই। এদের কোনো নির্দিষ্ট উপাসকও নেই। কেউ সূর্যের ভক্ত - অর্থাৎ সৌর, কেউ শিবের ভক্ত - শৈব, কেউ বিষ্ণুর ভক্ত - বৈষ্ণৱ, আবার কেউ গনপতির ভক্ত - গানপত্য,  কেউ বুদ্ধের ভক্ত তাই বৌদ্ধ। একটি নদীর নাম থেকে একটি ধর্মের নাম এবং যার অর্থ কদর্য-ব্যাঞ্জক। এটা কি করে সম্ভব ? 

বন্ধুটিকে বললাম - দেখো, তোমাদের দেওয়া, অর্থাৎ পরপ্রদত্ত কদর্য-ব্যঞ্জক শব্দ আমরা ব্যবহার করছি না। একদেশের বুলি, এক দেশের গালি। যে যেমন শিখেছে আর কি ! বাংলায় একটা কথা আছে "হরিবোল" - শুনেছে ? কথাটার মানে ঈশ্বরকে ডাকো। ইংরেজিতে একই শব্দ HORRIBLE কথাটার মানে ভয়ংকর বা বীভৎস। বাংলায় একটা কথা বাল - এটি মানুষের  নির্দিষ্ট জায়গার পশমকে বোঝায়।
যা আমরা গালি অর্থে ব্যবহার করি। কিন্তু একই শব্দ হিন্দিতে গালি মনে করি না।

হিন্দুস্থান কথাটার অভিধানগত অর্থ হচ্ছে, গৌরবান্বিত রাজ্য। আর হিন্দু কথাটার মানে, গৌরবানিত্ব জাতি বা মানুষ। মার্কিন মুলুকে, ভারতের অধিবাসী মানেই হিন্দুস্থানী বা হিন্দু। তা সে মুসলমান, খ্রিস্টান  হলেও। বাংলা ভাষার অভিধানে আছে, "শোনা যায়, ভারত থেকে যে সব মুসলমান আরব দেশে হজ করতে যান, তাদেরকেও ওই দেশের লোকেরা, হিন্দু বলে থাকে"। 

আসলে হিন্দু কোনো ধর্ম নয়।  এর কোনো প্রতিষ্ঠাতা নেই। হিন্দু কোনো জাতি নয়। হিন্দু বলতে কোনো সাম্প্রদায়কেও বোঝায় না। হিন্দু শব্দের  অর্থ উদার বিশ্বজনীতা, হিন্দু শব্দ সংস্কৃতি বাচক।  এই শব্দ অপৌরুষেয়। প্রাচীন ব্রহ্মাবর্তবর্ষ, তারই একটা অংশ আজকে যেটা ভারতবর্ষ বা হিন্দুস্থান নামে পরিচিত। এখানে যারাই বাস  করেন, তা সে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, এমনকি মুসলমান এরা সবাই হিন্দু নামের যোগ্য। আজকে যাদের আপনি, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ দেখছেন,  এরা একটা মতের  আশ্রয় নিয়েছে মাত্র। এদের পূর্বপুরুষ হিন্দু নামপদবাচ্য। বৌদ্ধদেবের  বৌদ্ধঘরে ঘরে জন্ম হয়  নি।হজরফ মোহাম্মদ মুসলমান ঘরে জন্ম গ্রহণকরেন নি। এমনকি যীশুখ্রিস্ট খ্রিস্টান ঘরে জন্ম গ্রহণ করেন নি। এরা  সবাই হিন্দু নামের যোগ্য। 

হীনতা বর্জনকারী মানব নিচয়। 
হিন্দু নাম আপনার দেয় পরিচয়। 

যিনি হীনতা ত্যাগ করতে পারেন, বা পেরেছেন, তিনিই হিন্দু। হিন্দু কথাটা অপৌরুষেয়। হীন+দুষ-ডু-যে - নিপাতনে সিদ্ধ এই ধ্বনি। দুষ্টের যিনি দন্ডদাতা, সৎ-ধর্মের যিনি পালক, তিনিই হিন্দু। 

এই জগৎ আসলে ব্রহ্মে  প্রতিষ্ঠিত। সব কিছুর মধ্যেই এক পরম চৈতন্য সত্ত্বা আছে। তিনি নিজেই নিজের মধ্যে ক্রিয়ারত। ধৈর্য্য, ক্ষমা, ইন্দ্রিয় সংযম, বুদ্ধি, বিদ্যা, সত্য, ইত্যাদি মানসিক সদ্গুণই আসলে ধর্ম। যে ধর্মের অনুষ্ঠানে, কুকার্য্য ও কলুষতা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, এবং সংসারে যেটি স্থিতির  কারন, তাই হিন্দু ধর্ম। আমাদের যজুর্বেদের উপদেশ হলো,মিত্রের চোখে সকলকে দেখবে।
নিজের কল্যাণকে বড়ো  করে দেখো না। ব্যষ্টির  কল্যানে, সমষ্টির কল্যাণ। 

যশ্চ মাং দ্বেষ্টি লোকে অস্মিন সোহপি ভদ্রানী পশ্যতু - যে আমাকে হিংসে করে, সেও মঙ্গল দর্শন করুক। সর্বেষাং মঙ্গলাং ভূয়াৎ, সর্ব্বে সন্তু নিরাময়াঃ, সর্ব্বে ভদ্রানী পশ্যন্তু, মা কশ্চিৎ দুঃখভাগ ভবেৎ। - সবার মঙ্গল হোক। সবাই নীরোগ থাকুক, সবাই ভালো  থাকুক, কেউ যেন দুঃখ না পায়। এই বিশ্ব মৈত্রীয়ের ভাব হিন্দু ধর্মে ভাবনা। 

দেখুন, মাত্র দুই হাজার বছর আগে, যিশুখ্রিস্ট এসেছিলেন। ২৬০০ বছর  আগে ইসলামের প্রবর্তন হয়েছে। বেদের সৃষ্টি পাঁচ হাজার বছর আগে ।  তার আগেও তো মানুষ ছিল।  তাদের ধর্ম কি ছিল ? সেই ধর্মের নামই  সনাতন ধর্ম। এবং সেই সনাতন ধর্মের ধারক বাহক হচ্ছে হিন্দুরা। 

যীশু খ্রিস্ট যা বলেছিলেন, সেটা পরবর্তী কালে সংকলিত করে, করা হয়েছে বাইবেল। মোহাম্মদ যা বলেছিলেন, তাই সংকলিত করে বানানো হয়ে কোরান। বুদ্ধ যা বলেছিলেন, তাই পরবর্তী কালে সংকলিত করে করা হয়েছে বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক । মহাবীর যা বলেছিলে, সেটাই জৈনদের ধর্মগ্রন্থ আগম । নানক সাহেব যা বলেছিলেন, শিখদের ধর্ম্মগ্রন্থ। বিভিন্ন ঋষিরা যা বলেছিলেন, সেটা বেদ। শ্রীকৃষ্ণ যা বলেছিলেন, সেটা গীতা। 

সব প্রবর্তিত ধর্মের লোক বলতে পারে, তাদের ধর্মগ্রন্থের নাম, এবং বক্তা বা লেখক বা প্রবর্তক। কিন্তু আপনাকে যদি প্রশ্নে করা হয়, পদার্থবিদ্যার লেখক কে ? আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, রাসায়নবিদ্যার লেখক কে,  আপনি  বলতে পারবেন ? না তার কারন বিষয়টা বহু পুরানো, তার কোনো নির্দিষ্ট লেখক হয় না।  আর তার লেখক বহু। ধর্ম তেমনি বিশ্ব সৃষ্টির সময় থেকেই আছে, আর এর লেখক বা বক্তা বহু। তাই সনাতন ধর্মের যারা ধারক ও  বাহক তাদের কোনো নির্দিষ্ট লেখক নেই, নির্দিষ্ট কোনো বক্তা নেই। এটি প্রাচীন, ও শাশ্বত।  এটি শুধু উপদেশের ধর্ম নয়, এটি উপল্বদ্ধির ধর্ম। যারা বস্তুর উপাসনা না কোরে, চৈতন্যের উপাসনা করেন, প্রাত্যহিক জীবনে যারা হীনতা, হিংসা বর্জন করতে পেরেছেন, যারা বিশ্ব-ভ্রাতৃত্যবোধে বিশ্বাস করেন, তারাই সনাতন, তারাই হিন্দু। হিন্দু কথাটার কে কি মানে বা অর্থ করলো তাতে কিছু আসে যায় না। হিন্দুত্ব একটা ধারা, যা মনুষ্য সৃষ্টির কাল থেকেই প্রবাহিত। তাই অন্য ধর্মে অবতার পুরুষরা আসেন না, কারন তারা যুগোপযুগি কথা বলেন ।  তারা দুই, আড়াই  বছর বা পাঁচ হাজার বছর মাত্র আগে এসেছিলেন। এই হিন্দু ধর্ম, মনুষ্য সৃষ্টির কাল থেকেই প্রবাহিত ধর্মের ধারা । এটি চিরকালীন।  কে কি বললো তাতে কিছুই আসে যায় না।   

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ      


















    
















    

2 comments:

  1. খুব ভালো লাগল এটা জেনে আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ

    ReplyDelete
  2. খুব সুন্দর 👌

    ReplyDelete